ট্যাগ আর্কাইভঃ কিশোর গল্প

পুরস্কার


সুবর্ণা ও সজিব ওরা দু’ভাইবোন। সুবর্ণা বড় নবম শ্রেণিতে পড়ে। সজিব ছোট ষষ্ট শ্রেণিতে পড়ে। কয়েকদিন যাবত দু’জনেই পড়ালেখা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। কারণ সামনে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে হবে ওদেরকে। প্রতিযোগিতায় দু’জনেরই নাম দেয়া হয়েছে। সুবর্ণা প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা দিবে আর সজিব কবিতা আবৃতি করবে। সজিব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতাটি আবৃতি করবে। তাই সজিব বাড়িতে প্রতিদিন ‘লিচু চোর’ কবিতাটি চর্চা করছে। সুবর্ণার জানা নেই ওর ভাগ্যে কোন বিষয় পড়ে। তাই ও অনেক গুলো বিষয় নিয়ে নিয়মিত চর্চা করছে।

১২ জুন প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হবে। তাই ওরা দু’জনেই সেদিনটির জন্য অধির অপেক্ষা করছে কবে সেই শুভ দিনটি ওদের মাঝে আসবে। যতই দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল, ততই তাদের মন উসখুস করতে লাগল। দেখতে দেখতে সেই দিনটি প্রায় নিকটবর্তী হয়ে গেল। আর মাত্র দু’দিন বাকি।

সুবর্ণা তার বাবাকে বলছে, বাবা তুমি কিন্তু আমাদের সাথে অনুষ্ঠানে যাবে।
তার বাবা বললেন, অবশ্যই যাব।
সজিব তার মাকে বলছে, মা তুমিও কিন্তু আমাদের সাথে যাবে।
তার মা বললেন, যাব আমরা দু’জনেই তোদের সাথে যাব। যা এখন গিয়ে কবিতাটি বার বার পড়। পুরস্কার কিন্তু অবশ্যই আনতে হবে।
– মা তুমি দোয়া করিও অবশ্যই পুরস্কার আনব।

সকাল বেলা পাখির কিচিরমিচির ডাকে সুবর্ণা ও সজিবের ঘুম ভাঙ্গল। জলমলে রোদ এসে আঙ্গিনায় পড়ল। দু’ভাইবোন গোসল করে কাপড় পড়ে রেডি হল। দশটা বাজার পূর্বেই তাদেরকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হবে।

মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে স্বুর্ণা ও সজিব যথাসময়ে অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হল। সেখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে উপস্থিত হচ্ছে। এ মুহূর্তে অনুষ্ঠানস্থল মানুষে জমজমাট হয়ে গেল।

উক্ত অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতার অনেকগুলো বিভাগ করা হয়েছে। ষষ্ট শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ক’ বিভাগ। নবম-দশম শ্রেণি ‘খ’ বিভাগ। কলেজ ও মাদ্রাসার আলিম ও ফাজিল শ্রেণির জন্য ‘গ’ বিভাগ। সেই অনুসারে সজিব ‘ক’ বিভাগে এবং সুবর্ণা ‘খ’ বিভাগে পড়েছে।

দশটা বাজার সাথে সাথে অনুষ্ঠানটি কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ‘ক’ বিভাগের কুরআন তেলাওয়াত। তারপর ‘খ’ বিভাগের কুরআন তেলাওয়াত। এভাবে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা চলছে। সুবর্ণা ও সজিব অপেক্ষা করছে কখন তাদের পালা আসবে। দু’জনেরই মন ছটফট করছে।
অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃতি, রচনা লিখা, উপস্থিত বক্তৃতা, সুন্দর হাতের লেখা, হামদ-নাত, কোরআন তেলাওয়াত কৌতুক, নৃত্য- ইত্যাদি পর্ব করা হয়েছে।
এবার ‘ক’ বিভাগের কবিতা আবৃতির পালা। প্রথমে ভাষ্যকার আশিক নামের একজন ছেলেকে ডাকছেন। সে মঞ্চে গিয়ে একটি কবিতা আবৃতি করল। এভাবে কয়েকজনের নাম ডাকা হল।

সজিব ভাবতে লাগলো, আমিতো এ বিভাগেই আছি। আমি কি পারব সুন্দর করে আবৃতি করতে। পারব কি পুরস্কার ছিনিয়ে আনতে। এমন সময় ভাষ্যকার সজিবের নাম ঘোষণা করল। সজিব চমকে উঠল। তারপর দ্রুত সজিব মঞ্চে চলে গেল। সালাম দিয়ে ওর পছন্দের ‘লিচু চোর’ আবৃতি করতে লাগল।

বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সেকি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।

পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোতা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
……………………

এভাবে সজিব কবিতাটি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সুন্দর করে আবৃতি করল।
কবিতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত লোকজন করতালি দিল। তারপর আরও কয়েকজন কবিতা আবৃতি করল।
এবার ‘খ’ বিভাগের উপস্থিত বক্তৃতার পালা। প্রথমে সুবর্ণার নাম ঘোষণা করা হল। সুবর্ণা মঞ্চে চলে আসল।

পাঁচজন বিচারক বসেছেন। বিচারকগণ কয়েকটি কাগজে উপস্থিত বক্তৃতার বিষয়গুলো লিখলেন। সুবর্ণাকে বলা হলো একটি কাগজের টুকরা হাতে নেয়ার জন্যে। সুবর্ণা একটি কাগজ হাতে নিল। কাগজ খুলে দেখে তার বিষয় হলো ‘বাংলাদেশের নারী নির্যাতন’। সময় দেওয়া হল ৫ মিনিট। অতএব ৫ মিনিটের মধ্যে বিষয়ের সাথে মিল রেখে তার বক্তব্য শেষ করতে হবে।

সুবর্ণা তার বক্তৃতা শুরু করলো- উপস্থিত আজকের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, উপস্থিত বিজ্ঞ বিচারকমন্ডলী, উপস্থিত শ্রোতা ভাই ও বোনেরা আসসালামু আলাইকুম। ভাগ্যের লিখন যায় না খ-ন। তাই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে ঘুরতে আমার বিষয় নির্বাচন হলো ‘বাংলাদেশের নারী নির্যাতন’। আমি একজন নারী। নারী হয়ে নারী নির্যাতনের করুন চিত্রগুলো এখন আপনার সামনে তুলে ধরছি।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা আজ আমরা প্রবেশ করেছি একবিংশ শতাব্দিতে। নতুন শতাব্দীতে কেমন আছে বাংলাদেশের নারীরা? এই প্রশ্নের উত্তর সুখকর নয়। কারণ এককথায় বলতে পারি বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা ভাল নেই। বর্তমান সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। বাড়ছে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ ও নারী পাচারের মতো ঘটনা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের চেয়ে ঢের বেশি নারী নির্যাতন হচ্ছে পথে, ঘাটে, গৃহে, কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নারীর করুণ চিত্র। বর্তমানে দেশের সরকার প্রধান ও বিরোধী দলের নেতা দুজনই নারী। কিন্তু এই নারীরা কি পেরেছে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা চিরতরে বন্ধ করতে? পেরেছে কি ধর্ষণের সেঞ্চুরীর হাত থেকে নারীদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি এসিড নিক্ষেপের হাত থেকে আঁখির মতো অসহায় মেয়েদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী থেকে শিক্ষাঙ্গনকে কলঙ্কমুক্ত করতে?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা একটু লক্ষ্য করুন বর্তমানে নারীরা পুরুষ কর্তৃক যত প্রকার নির্যাতিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে যৌতুকের শিকার। বর্তমানে এ যৌতুক একটি প্রথা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যা নারী সমাজের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুকের ফলে কত নারীর সোনার সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। কত নারী যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারও কোন পরিসংখ্যান নেই। যুগ যুগ ধরে এ যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। আজ যৌতুক নামক এ কু-প্রথাটি ক্রমান্বয়ে সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের নারীরা উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে কিন্তু যৌতুকসহ বিভিন্ন অশুভ সামাজিক প্রথা সামাজিকভাবে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত হবার পথে এখন প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা এবার আসুন এসিড নিক্ষেপের কথা বলি। সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করেই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। কারণে অকারণে নারীর প্রতি এই মরণ এসিড নিক্ষেপ হচ্ছে। এসিড নিক্ষেপের ফলে ঝলছে যায় আক্রান্ত নারীর শরীর। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মানুষ এতোটা পাষাণ হয় কিভাবে? এর উত্তর আমার জানা নেই।

তাছাড়া কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে অনেক নারী বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। বাজারের পণ্যের মতো নারীকে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় নেই?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা বাংলাদেশের নারী নির্যাতনে আরো অনেক কারণ আছে সময় স্বল্পতার কারণে আর বলতে পারলাম না। পরিশেষে নারী সমাজের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে আমাদের অধিকারের জন্য আরো সচেতন হতে হবে। বুঝে নিতে হবে আমাদের হিসাব নিকাশ। পুরুষ শাসিত এই সমাজে আমাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হতে হবে। মুখ বুঝে সহ্য না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তাহলে নারী জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হবে। ধন্যবাদ সকলকে।

বক্তৃতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত লোকজন করতালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানালো। তারপর ভাষ্যকার পর্যায় ক্রমে আরো কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর নাম ঘোষণা করল। কারো ভাগ্যে পড়েছে ‘মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য’, কারো বা ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ ইত্যাদি। তারপর পর্যাক্রমে অন্যান্য পর্বগুলো শেষ হলো।
প্রধান বিচারকের নিকট ফলাফল এসে উপস্থিত হল। প্রধান অতিথি বক্তৃতা করলেন। তিনি সকল ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অনেক মজার মজার ঘটনা শেয়ার করলেন। তাদেরকে ভবিষ্যতে ভালভাবে গড়ে উঠার জন্য উৎসাহ দিলেন।

তারপর প্রধান বিচারক সাহেব ভাষন দেন। তিনি একজন নামকরা লোক। লোকেরা সবাই তাকে ভালোবাসেন।
মধ্যহ্নভোজের পর পুরস্কার বিতরণ শুরু হল। সুবর্ণা ও সজিব অপলক দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রতি পর্বে তিনজনকে পুরস্কার দেয়া হবে। বিচারক সাহেব প্রথমে কোরআন তেলাওয়াতের পুরস্কার ঘোষণা করলেন। তাদেরকে একটি করে সার্টিফিকেট ও বই উপহার দেওয়া হল। এভাবে পর্যাক্রমে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

এবার ‘ক’ বিভাগের কবিতা আবৃতির পুষ্কার ঘোষণার পালা। সজিবের মনটা উতাল পাতাল হয়ে যাচ্ছে কি জানি তার রেজাল্ট হয়। মনটা ছটফট করতে লাগল।
বিচারক সাহেব তৃতীয় পুরস্কার ঘোষণা করলেন কিন্তু সজিব নয় অন্য একজনের নাম। সজিবের হার্টবিট আরো বেড়ে গেল। তারপর দ্বিতীয় পুরস্কার এখানেও তার নাম নেই। এবার বিচারক সাহেব বললেন, প্রথম পুরস্কার পেয়েছে সজিব আহমেদ।

সজিব তার নাম মাইকে শুনতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সুবর্ণাকে জড়িয়ে ধরল। মা আনন্দের সাথে বলছেন, কি হল সজিব তাড়াতাড়ি যা। পুরস্কার নিয়ে আস।

সজিব মঞ্চে চলে আসল। প্রধান অতিথি খুব খুশি হয়ে পুরস্কার ও সার্টিফিকেটটি তার হাতে তুলে দিলেন।

এবার ‘গ’ বিভাগেরর উপস্থিত বক্তৃতার পুরস্কার ঘোষণা করা হচ্ছে। বিচারক সাহেব পর পর তৃতীয় ও দ্বিতীয় পুরস্কার ঘোষণা করলেন। সুবর্ণার নাম না আসায় চিন্তিত হয়ে গেল।
বাবা বললেন, চিন্তা করিসনা মা তুই ফাস্ট হবি।

ইতিমধ্যে বিচারক সাহেব বলতে লাগলেন, খুব আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আজকের প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা বিভাগে এবং সকল বিভাগে যিনি সবোর্চ্চ নাম্বার পেয়েছেন তিনি হচ্ছেন…বলে বিচারক একটু থামলেন।
সুবর্ণার হার্টবিট আরো বেড়ে গেল। কি জানি কি হয়।
– … তিনি হচ্ছেন সুবর্ণা আহমেদ। যিনি সকল প্রতিযোগিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন। আপনারা করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান।
সুবর্ণার নাম ভাষ্যকারের মুখে শুনতে পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে লাফিয়ে উঠলো সে। সজিব ও তার পিতা-মাতাও আনন্দে আত্মহারা।
সজিব বললো, কি আপু মঞ্চে যাও।
সুবর্ণা মঞ্চে গিয়ে তার পুরস্কার গ্রহণ করলো। মুহু মুহু করতালিতে মুখরিত মঞ্চ। চারপাশ থেকে ফুল ছিটানো হচ্ছে। এবার ভাষ্যকার সুবর্ণাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলেন।

সুবর্ণা তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, সত্যি আমি ভাবতে পারিনি যে এত বড় পুরস্কার পাব। এ পুরস্কার আমার একার নয়। আপনাদের সকলের। আমি পুরস্কার পেয়ে ভীষণ খুশি। আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে ভবিষ্যতে আরো ভাল করতে পারি। ধন্যবাদ সকলকে।
তারপর অন্যান্য সকল পুরস্কার বিতরণ করল। সবার শেষে মুনাজাতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসল। রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে লাগল। সজিব সুবর্ণা ওদের মা-বাবা সবাই আনন্দের সহিত বাড়ি ফিরল।

রচনাকাল- জানুয়ারি ১৯৯৯ খ্রি:।

মা


আমার নানার চার মেয়ে ও দু’ছেলের মধ্যে আমার মা ছিলেন সবার বড়। নানা আমার মাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের বাড়ি থেকে নানার বাড়ি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের নাম চরবাড্ডা মির্জাচর। সবুজ গাছপালা বেষ্টিত গ্রামটি খুবই চৎমকার। মাঝে মাঝে আমার মাকে দেখার জন্য নানা আমাদের বাড়িতে আসতেন। আসার সময় নানা মায়ের জন্য কাঁঠাল, আম, কলা, আনারস, বেদানা, আঙুর আরো কত কি যে নিয়ে আসতেন তার কোন হিসেব নেই। নানা যখন চলে যেতেন, তখন মা প্রায়ই কাঁদতেন আর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতেন। তখন প্রিয় বাবা চলে যাওয়ায় নিজের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করতেন।
নানাকে দেখার সুভাগ্য আমার হয়নি। আমি দুনিয়াতে আসার পূর্বেই আমার নানা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। নানার মৃত্যুতে আমার মা একদম পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুর শোক আজও আমার মা ভুলতে পারেননি। এখনও নানার কথা মনে হলে কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলায়। নানার কথা চিন্তা করে আমিও মাঝে মাঝে কাঁদি। আমি দুনিয়াতে এসে নানার স্নেহ, ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হলাম। মনভরে নানাকে ডাকতে পারলাম না। তবে নানীর কাছ থেকেই নানার সমস্ত আদর ভালোবাসা পেয়েছি।
আমার বাবা একজন সাধারণ শ্রমিক। আমার জন্মের পরই আমাদের সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। তখন মা মাঝে মাঝে নীরবে বসে কী যেন চিন্তা করতেন। আর দুচোখের জল ফেলতেন।
আমরা তিন ভাই, এক বোন। এর মধ্যে আমি বড় সন্তান। বাড়ির সমস্ত কাজ আমার মায়ের একা করত হতো। কারণ মায়ের কোন জা ছিল না। বাবা সারাদিন কাজ করার পর রাতে বাড়িতে ফিরতেন। তখন আমার মা বাবার পাশে বসে তাল পাতার পাখায় বাতাস করে ভাত খাওয়াতেন। আর তখন সংসারের সুখ দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতেন। কিভাবে আমাদেরকে বড় করবেন তা নিয়ে ভাবতেন। রাতে খাওয়ার পর মা আমাকে সুন্দর সুন্দর গল্প বলে ঘুম পড়াতেন। আমি অসুস্থ্য হলে মায়ের চিন্তার শেষ থাকত না। আমার রোগ মুক্তির জন্য সারাক্ষণ খোদার কাছে প্রার্থনা করতেন। সারা রাত আমার পাশে বসে আমার সেবা যত্ন করতেন। আমার প্রতি একটুও বিরক্ত দেখাতেন না।
আমি যখন একদম ছোট, তখন এক কান্ড ঘটেছিল। আমার মা বাহিরে চুলোয় রুটি খোলা দিচ্ছেন। তখন বাবা ও আমরা চার ভাই-বোন পিঁড়ি নিয়ে চুলোর পাশে বসলাম। মা একে একে সবাইকে ভাগ করে তিনটি করে রুটি দিলেন। আমি তখন রুটি নিয়ে একটু দূরে বসেছিলাম। আমি একটি রুটি খেয়ে অন্য একটি রুটি খেতে যাব এমন সময় একটি কুকুর এসে আমার বাকী রুটিটা নিয়ে দিল দৌঁড়। আমি তখন রুটি আনার জন্যে দৌঁড়ে গিয়ে কুকুরের গলায় জড়িয়ে ধরলাম। ভাগ্যিস কুকুর তখন আমাকে কামড় দেয়নি। কুকুর তৎক্ষনাত রুটি ফেলে চলে গেল। আর তখন আমি কুকুরের কাছ থেকে রুটিটি উদ্ধার করে মায়ের ভয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমি ভাবছি মা বুঝি আমাকে মারবে। কিন্ত না আমার মা লক্ষী আমাকে মারেনি বরং আদর করে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে বললেন, ‘তুই আমার লক্ষী ছেলে কাঁদিস না। এটা তোর দোষ না। আর এ রুটি খাসনে। মুরগীকে দিয়ে দে। আমি এক্ষুনি আবার রুটি বানিয়ে দিচ্ছি।’
মা আমাকে তখন আবার রুটি বানিয়ে দিলেন।
সারাদিন কাজ করার পর সন্ধ্যা হলে মা আমাকে পড়াতেন। আমি মায়ের সাথে বসে অ, আ, ক, খ পড়তাম আর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমি যখন ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম তখন থেকেই মায়ের কাজে একটু একটু সাহায্য করতাম।
ঈদ এলে আমাদের এলাকায় পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। বিশেষ করে ঈদ-উল ফিরত এর সময় চাঁদ উঠার একদিন পূর্বে প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা বানানো হতো। বাড়ির আশের সবার মতো আমার মাও পিঠা বানাতেন। মা গায়িল, সায়িট দিয়ে গুড়ি কুড়তেন। তারপর পানি সিদ্ধ করে মাধা তৈরি করতেন। পরে পিঠা বানাতেন। আমি তখন আমার মাকে পিঠা বানানোর কাজে সাহায্য করতাম। আমি লতি বানিয়ে দিতাম। মা তখন নিপুণ হাতে সুন্দর করে পিঁড়ির উপর হাত ঘুরিয়ে সেয়ুই বানাতেন। মায়ের সব কাজই আমার খুব ভাল লাগে। মা ঈদের দিন সকালে গুড় দিয়ে সেয়ুই পাক করতেন। ভাই-বোন সবাই মিলে সেয়ুই খেতাম। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে টাকা দিতেন। মা আদর করে আমাকে জামা কাপড় পড়িয়ে দিতেন। সুন্দর করে আমার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতেন।
আমি পরিবারের বড় ছেলে তাই বাবা-মার অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। লেখাপড়া করে একদিন অনেক নামি-দামী ব্যক্তি হব। সেই স্বপ্নে বিভোর আমার পিতা-মাতা। মাঝে মাঝে দেখতাম আমার মা পাক ঘরে বসে কাঁদতেন আর কি যেন এক শূন্যতা ‍অনুভব করতেন। আমি তখন মাকে বলতাম, ‘মা তুমি কাঁদছ কেন?’
মা আমাকে দেখে সাথে সাথে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে মুখে হাসির রেখা টেনে বলতেন, ‘কই কাঁদিনাতো।’
আমার জন্মের পর থেকেই আমার মায়ের দুঃখ বেড়েছ। প্রায়ই মা আমাকে দুঃখের কাহিনী শুনাতেন। মাঝে মাঝে মা আমাকে নিয়ে নানার পুরানো ইতিহাস বলতেন। এত কষ্টের পরও আমার লক্ষী মা আমার বাবা ও ভাই-বোনদের প্রতি একটুও বিরক্তবোধ করতেন না। শত কাজের মাঝেও পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিকমত আদায় করতেন।
মমতাময়ী মা তাঁর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বড় করছেন। তাইতো আমার মাকে দেখলে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ভুলে যাই। জগতের শ্রেষ্ঠ মায়েদের মধ্যে আমার মা একজন। আমার মায়ের মত এমন মা কয়জন আছে এ পৃথিবীতে? মাগো, তুমিই আমার প্রাণ লক্ষী মা তুমি।
রচনাকাল-জুন-১৯৯৯খ্রিস্টাব্দ।
[জলছবি বাতায়ন নববর্ষ সংকলন ১৪২১ বাংলা এ প্রকাশিত]

সেমুলী

আমি তখন ছোট। বয়স ছয় কি সাত হবে। মাঝে মাঝে স্কুলে যেতাম এবং দিনে একটা করে বই ছিঁড়তাম। আমি ছিলাম নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার জন্মের পর থেকেই বাবার সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। অথচ আমার জন্মের পূর্বে আমাদের সংসারে ছিল গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ও বালতি ভরা দুধ। দাদা যখন সংসার ছেড়ে দিলেন, তখন থেকেই আমাদের সংসারে অবনতি ঘটতে থাকে। এখন বাবা একদম নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আসের মত জমিজমা নেই। সব বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন বাবা পরের জমিতে কাজ করে। এই রোজগার দিয়ে কোন মতে সংসার চালায়। আমরা পর পর চারটি ভাই ও একটি বোন জন্ম নিলাম। আমি হলাম বড় সন্তান। আমি পশু-পাখিকে খুব ভালোবাসতাম। মাঝে মাঝে টুনটুনি, বাবুই, বক ও চড়ুই পাখির বাসা ভেঙ্গে ছানা চুরি করে নিয়ে আসতাম। এসব পাখি ছানা বাড়িতে এনে খুব যত্ন করে লালন পালন করতাম। আমার এই পাখি প্রেম স্বভাব দেখে মা আমাকে একটি ছাগল কিনে দেন। ছাগলটি ছিল কুচ কুচে কালো। ছাগলটি পেয়ে আমি খুব খুশি হলাম। মনে মনে মাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। সেই থেকে আনন্দের সহিত ছাগলটি লালন পালন করতে লাগলাম। সারা দিন টো-টো করে এই ছাগলটির পিছনে লেসে থাকতাম। কয়েক মাসের মধ্যেই ছাগলটি বেশ বড় হয়ে গেল।
এক মাস, দুই মাস, তিন মাস এভাবে কেটে গেল ছয়টি মাস। ছাগলটি কিছুদিনের মধ্যে সুন্দর ফুটফুটে একটি বাচ্চা জন্ম দিল। যেদিন বাচ্চাটি জন্ম নিল সেদিন ছিল সোমবার। তাই আমি বুদ্ধি করে সোমবারের সাথে মিল রেখে ছাগল ছানাটির নাম রাখলাম ‘সেমুলী’। আমার এই বুদ্ধি দেখে মা-বাবা খুব খুশি হলেন।
সেমুলী যখন জন্ম নিল তখন হাঁটতে পারছিলনা। আমি তাকে ধরে হাঁটালাম। সেমুলী আমার দিকে লক লক করে তাকিয়েছিল। আমি তাকে আলতো করে ধরে দুধ খাওয়ালাম। সেমুলী যখন হাঁটা শিখল তখন থেকেই সে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে। কখনো বা পাক ঘরে চলে যায়। মায়েরর আঁচল গিয়ে কামড়ে ধরে। আবার কখনো বা ঘরের পিড়ায় উঠে উঠে লাফায়। একবার আমার কাছে আগে আবার তার মায়ের কাছে যায়। মনে হয় যেন আমি তার বাবা। আমি ডাকি, ‘সেমুলী কাছে এসো।’ অমনি সে লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে বসে। আমি ওকে আদর করি। ও তখন শান্ত হয়ে যায়। তখন আমি ওর শরীরে সুর সুরি দিই। সেমুলী সারাক্ষণ আমার পাশে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য আমাকে না দেখলে ভ্যা ভ্যা করে চিৎকার করে। তখন আমি ছুটে এসে ওর মসৃণ গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করি। আমার ভালোবাসার আদর পেয়ে সে আনন্দে চোখ বুঝে থাকে কিছুক্ষণ।
সেমুলী রাতে আমার পাশে থাকে। সারাক্ষণ আমায় জ্বালাতন করতো। আমি মাঝে মাঝে রাসে ওকে কানমলা দেই। কানমলা খেয়ে সে আরো বেশি করে আমার গা ঘেষে বসে। তবে সে একদিক দিয়ে ভাল ছিল। কখনো সে রাতে বিছানায় প্রস্রাব করে না। আমি তাকে রুটি, ভাত, ঘাস সবই খাওয়াতাম। আদরে আদরে সেমুলী এতদিনে খুব বাদর হয়ে সেছে। বাড়ির আশে পাশের যা কিছু পায় তা খেয়ে সাবাড় করে। এজন্য মাঝে মাঝে পাক ঘরে গিয়ে তরিতরকারি খেয়ে ফেলে। কখনো লবণের কোটা ফেলে দেয়। ওর এসব কা-কারখানা দেখে মা কখনো রেগে ওকে এক থাপ্পর মারে। তখন সেমুলী থাপ্পর খেয়ে দৌঁড়ে আমার কাছে এসে মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করে। তখন আমি খুব ব্যথা পাই। আমি তাকে মায়ের নিকট যেতে নিষেধ করি। কিন্তু কে শুনে কার কথা!
আমি মাকে বলি, ‘তুমি আর সেমুলীকে মের না।’
মা রেগে গিয়ে বলেন, কি করব বল, এত দুষ্টু কি ছাগল ছানা হয়!
দিন যায় সপ্তাহ আসে। এভাবে কেটে যায় মাসের পর মাস। সেমুলী আস্তে আস্তে তাজা হতে লাগল। তার সমস্ত শরীর কালো কুচকুচে লোমে ছেয়ে গেল। নাদুস-নুদুস শরীর। আমার ভালোবাসা ও আদর পেয়ে সে যেন অল্প কয়েকদিনেই মোটা হয়ে গেল। এখন সেমুলী আমার এতই ভক্ত হয়ে গেল যে, আমি যা বলি সে তাই করে। আমার মনে হয় সে আমার ডাক শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে আমার কুলে এসে যখন বসে তখন আমি ওকে চুমো দেই। তার শরীরের চুল চিরুনী করে আঁচড়ে দিই।
আমি যখন সেমুলী’র মাকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাই তখন সে পেছনে পেছনে লাফিয়ে যায়। দু’একটি ঘাসে কামড় দিয়ে আবার দ্রুত আমার কাছে চলে আসে। এভাবে চলছে প্রতিদিন। আমিও সেমুলীকে খুব বেশী ভালোবাসি। ওকে ছাড়া যেন আমার এখন আর কোন কিছু ভালো লাগে না। কোথাও বেড়াতে গেলে এক দিনের বেশি থাকতে পারি না। এভাবে কেটে গেল একটি বছর। এখন সেমুলী অনেক বড় হয়ে গেছে।
একদিন আমার বাবা মায়ের সাথে আলাপ করছে। বাবা বললো, আমাদের সেমুলী তো এখন অনেক বড় ও মোটা তাজা হয়ে সেছে। ওকে এখন বিক্রি করে দিই। তাছাড়া আমার হাতে এখন কোন টাকা পয়সা নেই যে সংসার চালাব।
মাতো রীতিমত অবাক। একি বলছেন আপনি! রাজুতো ওকে বিক্রি করতে দেবে না। সেতো কেঁদে সারা বাড়ি মাতিয়ে তুলবে।
কাঁদলে কি হবে? আজ হোক কাল হোক একদিন তো ওকে বিক্রি করতেই হবে।
মায়ের মুখে সেমুলীর বিক্রির কথা শুনে আমিতো হতবাক। মনে হয় যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি মাকে বললাম, মা তুমি বাবাকে বলো সেমুলীকে যেন বিক্রি না করে।
মাও সেমুলীকে খুব ভালোবাসে। মায়ের মুখে কষ্টের ছাপ লক্ষ করলাম। মা বললেন, তোর বাবাতো আমার কথা শুনবে না। যা মুখে একবার বের করবে তা আর ফেরানো যাবে না।
– আমি এত কষ্ট করে সেমুলীকে লালন পালন করছি। তাছাড়া তার প্রতি আমার অন্য এক ধরনের ভালোবাসাও জন্মালো। সেই আদরের সেমুলীকেকে বাবা বিক্রি করে দিবে তা আমার ভাবতে অবাক লাগে। এ হতে পারে না। আমি কিছুতেই সেমুলীকে বিক্রি করতে দিব না।
আজ শনিবার। বাবা সেমুলীকে বিক্রি করার জন্য হাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। বাবা যেন আজ পাষান হয়ে গেলেন। আমি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলাচ্ছি। বাবা সেদিকে কোন দৃষ্টিই দিচ্ছেন না। আমি একবার মায়ের নিকট যাই আবার সেমুলীর নিকট যাই। সেমুলী’র দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তার চোখের কোণায় পানি জমে আছে। আমাকে দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকাল। মনে হয়যেন সে বলছে, রাজু তোমাকে ছাড়া আমি পরের বাড়িতে কেমন করে থাকব। তোমার বাবা এত পাষান কেন?’ কিন্তু কে শুনে এই বোবা সেমুলীর ভাষা।
বাবা যখন সামনের দিকে সেমুলীকে নিয়ে যাচ্ছেন তখন সেমুলী ঘাড় ফিরিয়ে ভ্যা-ভ্যা করে ডাকছে। তার এই ডাক আমি সহ্য করতে না পেরে বাবার পিছনে ছুটলাম। বাবা আমাকে বাজারে যেতে বারণ করা সত্ত্বেও বাবার পিছে পিছে সারাটা পথ কেঁদে কেঁদে বাজারে পৌঁছলাম। এরি মধ্যে বাবার একটুও মন পরিবর্তন হলো না। তবে একটি কথা বলে বার বার সান্ত¡না দিল, রাজু আর কাদিস না। তোকে অন্য একটি বাচ্চা কিনে দিব।
কিন্তু আমি কি তা আর মানি। আমি যে নাছোড় বান্দা। চোখের পানি মুছে বললাম, আমি অন্য ছাগল চাইনা। আমি শুধু সেমুলীকে চাই। ওকে আমি বেঁচতে দিব না।
এদিকে সেমুলী কিছু দূর গিয়ে আর যাচ্ছে না। বার বার বাড়ির দিকে ফিরে আসতে চাচ্ছে। এক পর্যায়ে বাবা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে করতে বাজারে নিয়ে আসল। বাজারে শত শত ছাগল বিক্রেতারা তাদের ছাগল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাও একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে সেমুলীকে নিয়ে দাঁড়ালেন।
অনেক্ষণ বসে থাকার পর এক ক্রেতা আসল। সে সেমুলীকে ১০০০ টাকা দিয়ে কিনে ফেলল। তখন আমার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেল। এ বুঝি সেমুলীকে জীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। ক্রেতা আমার কান্না দেখে আশ্চার্য হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেসা করলেন, ছেলেটি কে হয় আপনার?’
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ও আমার ছেলে।
– কাঁদছে কেন?
বাবা আমার কান্নার কারণ ক্রেতা লোকটিকে বিস্তারিত ঘটনা বললেন। ক্রেতা এ ঘটনা শুনে খুব মর্মাহত হলেন। তার মনটা নরম হয়ে গেল। তিনি বাবাকে বললেন, আমি ছাগলটি অবশ্য ভাগি দিতাম। এখন যেহেতু আপনার ছেলে ছাগলটির জন্য কাঁদছে সেহেতু আমার মনে হয় আপনিই ছাগলটি ভাগি নিয়ে গেলে ভাল হবে।
একথা শুনে আমি ও বাবা খুব খুশি হলাম। আমি তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। সেমুলী মনে হয় একথা শুনছে তাই সে আনন্দে লেজ দোলাচ্ছে। আমি তার শরীরে হাত বুলালাম। লোকটিকে বাবা আমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলেন। পরে আমি সেমুলীর রশি ধরে খুশিতে বাবার আসে বাড়িতে চলে আসলাম।
মা সেমুলীকে দেখে আশ্চার্য হয়ে গেলেন। পরে মাকে আমি বিস্তারিত বললাম। মা একথা শুনে খুব খুশি হলেন।
সেদিনের পর থেকে আমি আবার আগের মতো সেমুলীকে লালন পালন করতে লাগলাম। এভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন সেমুলী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে আগের মতো আর ঘাস খায় না। আর দুষ্টুমি করে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চোখ দিয়ে জল পড়ে। পশু ডাক্তার দিয়ে সেমুলীকে চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে না। দিন দিন সেমুলী শুকিয়ে যাচ্ছে। যিনি সেমুলীকে কিনলেন ওনাকে খবর দেয়া হল। তিনি আসলেন। সেমুলীকে দেখে আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, রাজু এর জন্য মন খারাপ কর না। আল্লাহর নিকট দোয়া কর যাতে তিনি তোমার সেমুলীকে ভাল করে দেন।
লোকটি চলে গেলেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই সেমুলীর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন সেমুলীকে আদর করে বলি, তুমি একদিন ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু সেমুলী যেন আমাকে বলছে, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না।
বেশি ভালোবাসার জিনিস বেশি দিন থাকে না। সেমুলীকে আমি বেশি ভালবেসেছিলাম তাই খোদা সেমুলীকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন। সেমুলীর মৃত্যুর পর আমি তার উপর পরে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না দেখে আশে পাশের সবাই আমাকে বুঝালো, কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হয়নি।

রচনাকাল-১৫ মার্চ ২০০০ খ্রিঃ।

দুষ্টু মিন্টু


আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। তখন আমাদের ক্লাসে ছিল এক দুষ্টু ছেলে। তার নাম মনির হোসেন মিন্টু। সে সব সময় স্যারদের ক্লাসে পড়া জিজ্ঞাসা করলে উল্টাপাল্টা জবাব দিত। অবশ্য তার জবাবে যুক্তি থাকে। একদিন ক্লাসে বিজ্ঞান স্যার আমাদেরকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সর্ম্পকে বোঝাচ্ছিলেন। তিনি অনেকবার বুঝানোর পর স্যার একে একে সবাইকে বললেন, আম পাকলে আকাশের দিকে না উঠে মাটিতে পড়ে কেন?
আমরা সবাই যে যার মতো বুদ্ধি খাটিয়ে উত্তর দিলাম। যখন স্যার মিন্টুকে প্রশ্ন করলেন মিন্টু তখন জবাব দিল, স্যার আকাশেতো খাওয়ার কেউ নেই, তাই আম আকাশের দিকে না উঠে মাটিতে পড়ে যায়।
তার উত্তর শুনে আমরা সবাই তখন খিল খিল করে হাসতে লাগলাম।
স্যার আর কোন কথা না বলে ক্লাস থেকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর বাংলা স্যার ক্লাসে আসলেন। তিনি আমাদের সবাইকে কাল কত প্রকার ও কি কি বলতে বললেন। আমরা সবাই কালের প্রকারভেদ গুলি বলি। কিন্তু মিন্টুকে বলতেই মিন্টু চট করে উত্তর দিল স্যার ওদের উত্তর হয়নি।
স্যার বললেন, কেন হয়নি?
– কারণ স্যার কাল হচ্ছে ১২ প্রকার। আর তারা উত্তর দিচ্ছে মাত্র ৩ প্রকার। তারা ৯ প্রকার কম বলেছে।
স্যার মিন্টুর কথায় আশ্চার্য হয়ে বললেন, বলতো দেখি তোমার প্রকারভেদগুলো।
– ঠিক আছে স্যার বলছি।
১. অতীত কাল
২. বর্তমান কাল
৩. ভবিষ্যৎ কাল
৪. গতকাল
৫. সকাল
৬. বিকাল
৭. আগামীকাল
৮. ইহকাল
৯. পরকাল
১০. একাল
১১. সেকাল
১২. যৌবনকাল
মিন্টুর এ প্রকারভেদগুলো শুনে স্যারসহ আমরা সবাই খিলখিল করে হাসলাম।
পড়া শেষে আমাদের সাবাইকে উদ্দেশ্য করে স্যার বললেন, তোমরা সবাই মনযোগ দিয়ে শোন, কখনো পরের উপকার করতে ভুলবে না। যে উপকার করে না সে মানুষ না।
মিন্টু তখন জবাব দিল, স্যার আপনার ক্ষেত্রেও কি সেটা প্রযোজ্য?
স্যার বললেন, অবশ্যই। তবে একথা বললে কেন তুমি?
– স্যার, সেদিন পরীক্ষার হলে কি বিপদে পড়েছিলাম। কিন্তু উত্তর বলে দিয়ে আপনি একটুও উপকার করেননি।
– চুপ বেয়াদব, কিসের সাথে কি মিলাচ্ছ।
মিন্টু তখন লজ্জা পেল। চুপ করে মাথা নিচু করে রইল।
পরিশেষে স্যার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখ তোমরা জীবনে কু-অভ্যাস, কু-কথা, কু-নেশা কু-পরামর্শ হতে বিরত থাকবে। কারণ এগুলো মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
আমরা সবাই বললাম, ঠিক আছে স্যার। কিন্তু দুষ্টু মিন্টু বলে উঠল, স্যার আমার পক্ষে এক কু-ত্যাগ করা সম্ভব নয়।
স্যার রাগান্বিত স্বরে বললেন, তুমি সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি কর, কেন কু-ত্যাগ করা সম্ভব নয়?
– স্যার আমার বাড়ি কুমিল্লা। কু-ত্যাগ করলে বাড়ির ঠিকানাটাই যে ভুলে যাব!
এ কথা শুনে আরেকজন ছাত্র বলে উঠল, স্যার আমার বাড়ি কুষ্টিয়া!
স্যার দুই ছাত্রের কথা শুনে বোকা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর স্যার বললেন, ঠিক আছে তোমরা সবাই কু-অভ্যাস নিয়েই থাক আমি চললাম। বলেই স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলেন।
স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়ার পর নরসিংদীর ছেলে ছোটন বললো, কিরে মিন্টু তুই স্যারদের সাথে এভাবে উল্টাপাল্টা কথা বলছ কেন?
মিন্টু বললো, কেন কি হয়েছে তোর?
– আমার কিছু হয়নি। আমার জানতে ইচ্ছে করছে তোর বাড়ি কোথায়?
– কেন? শুনলি না আমার বাড়ি কুমিল্লা।
– কিন্তু তোর গ্রাম কোথায়?
– শুনবি নাকি আমার গ্রামের নাম?
– হ্যাঁ শুনব।
– আয় দেখিয়ে দিই।
– এখান থেকেই দেখাবি?
– হ এখান থেকেই দেখাব।
– আচ্ছা দেখাতো দেখি তোদের গ্রাম।
এ কথা বলার সাথে সাথে মিন্টু ছোটনকে সজোরে ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে ছোটন মাটিতে পড়ে গেল। তখন তার একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল।
ছোটন তখন কাঁদতে কাঁদতে হেডস্যারের কাছে গিয়ে মিন্টুর নামে নালিশ করল।
হেডস্যার ছোটনের অভিযোগ শোনার পর মিন্টুকে স্যারের রুমে ঢেকে আনলেন।
মিন্টু আসামীর মতো হেডস্যারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হেডস্যার জিজ্ঞেস করলেন, মিন্টু তুমি ওকে ধাক্কা দিয়েছ কেন?
মিন্টু বললো, স্যার ও আমাদের গ্রাম দেখতে চেয়েছিল, তাই।
– তাই বলে কি ধাক্কা মারতে হবে?
স্যার আমাদের গ্রামের নাম ধাক্কামারা। সে আমাদের গ্রাম দেখতে চেয়েছে তাই ধাক্কা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি!
মিন্টুর এই খামখেয়ালিপনা কথা শুনে হেডস্যার খুবই রাগান্বিত হলেন। অন্য একজন ছাত্রকে বললেন একটা বেত আনতে। একজন ছাত্র একটি বেত এনে দেয়। হেডস্যার বেত হাতে নিয়ে মিন্টুকে সামনে আসতে বললেন। মিন্টু সামনে আসতেই কয়েকটি বেত মারল আর বললেন, আর কখনো দুষ্টামী করবে?
মিন্টু কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, না স্যার। এখন থেকে আমি ভাল হয়ে যাব। আর কখনো এমন দুষ্টুমী করবো না। আমাকে মাফ করে দেন স্যার।
হেডস্যার তখন মিন্টুকে মাফ করে দিলেন এবং ছোটনের সাথে মিলিয়ে দিলেন।
সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে মিন্টু আর দুষ্টুমী করে না। এখন থেকে খুব ভাল মানুষ হয়ে গেছে। নিয়মিত ক্লাসে আসে। প্রতিদিনের পড়া মুখস্থ করে আসে। ইতিমধ্যে সকল ছাত্রদের মধ্যে সে একজন প্রিয় ছাত্র হয়ে গেল এবং ছোটন তার প্রিয় বন্ধু হয়ে গেল।

রচনাকাল-১ জুলাই ২০১৩ খ্রি: