আমার ছেলেবেলা একটি অভাবী পরিবারে কেটেছে। পরিবারে অভাব থাকলেও ঈদের দিনে আনন্দের কোন কমতি ছিল না আমার মাঝে। আর সেই ছেলেবেলাটা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর থানাধীন ধরাভাঙ্গা গ্রামে কাটিয়েছি। এখানেই আমার জন্ম; তাই ছেলেবেলার ঈদ কেটেছে মা-মাটি ও প্রকৃতির সাথে, খেলার সাথীদের সাথে আনন্দ ফূর্তি করে। রোজা শুরু হতেই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে যেত ঈদের আর কত দিন বাকি আছে। প্রতিদিন আঙ্গুলের কর গুণে গুণে হিসাব করতাম কত দিন পর ঈদ হবে। প্রথম ও শেষ রোজা রাখতাম। মা বলতেন, শিশুরা ফেরেশতার মত নিষ্পাপ। এই দুটো রোজা রাখলে সব রোজা রাখা হয়ে যাবে।
শহরের চেয়ে গ্রামের ঈদ অনেক আনন্দের। কারণ গ্রাম হচ্ছে মানুষের শিকড়। মানুষ নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে ঈদকে ঘিরে। বছরের ক্লান্তি ভুলে প্রিয় মানুষের সাথে কিছু সময় অবসর কাটাবার জন্য মানুষের কি নিরন্তর চেষ্টা; তা উপলব্ধি করতাম গ্রামের পাশে মেঘনা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই শহর থেকে নৌকা ও লঞ্চের মাধ্যমে গ্রামের আসতেন সকল শ্রেণীর মানুষেরা। পাড়ার ছেলেরা মিলে সবাই মেঘনার পাড়ে দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখতাম; কিভাবে হাজার হাজার মানুষ নৌকা, লঞ্চ বোঝাই করে গ্রামমুখী হচ্ছে। আমাদের ঘাটে যখন লঞ্চ থামতো তখন দেখতাম আমাদের চেনা জানা কেউ আছে কিনা। থাকলে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে সালাম দিতাম। কৌশল জিজ্ঞাসা করতাম।
ঈদ এলে আমাদের এলাকায় পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যেত। বিশেষ করে ঈদ-উল ফিরত এর সময় চাঁদ উঠার একদিন পূর্বে প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা বানানো হতো। বাড়ির আশে পাশের সবার মতো আমার মাও পিঠা বানাতেন। মা গায়িল, সায়িট দিয়ে গুড়ি কুড়তেন। তারপর পানি সিদ্ধ করে মাধা তৈরি করে পিঠা বানাতেন। আমি তখন আমার মাকে পিঠা বানানোর কাজে সাহায্য করতাম। আমি লতি বানিয়ে দিতাম। মা তখন নিপুণ হাতে সুন্দর করে পিঁড়ির উপর হাত ঘুরিয়ে সেয়ুই বানাতেন। আমার দাদিও তখন আমার মাকে সাহায্য করতেন।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে বিরাট বড় একটি বিল। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার জন্য সেই বিলের পাড়ে সবাই ভিড় করতাম। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আকাশে চাঁদ উঠবে, সেই চাঁদের জন্য অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করতাম, কখন সেই চাঁদ বয়ে আনবে আনন্দের বার্তা। আকাশে শাওয়ালের একফালি চাঁদ কখন উঁকি দেবে সেই যে আকুলতা, চাঁদ আজ উঠবে, না কাল উঠবে সেই যে আনন্দময় অনিশ্চয়তা; সেটা এক অপার আনন্দেরই উপলক্ষ। কে কার আগে চাঁদ দেখবে এই নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। যে আগে চাঁদ দেখতে পেত সে লাফিয়ে উঠে বলতো, ‘ঐ চাঁদ উঠেছে… ঐ চাঁদ উঠেছে…।’ তারপর শুরু হতো আনন্দ মিছিল। ‘এক দুই সাড়ে তিন রাত পোহালেই ঈদের দিন’ স্লোগানে মুখরিত হতো আমাদের মিছিল। পাড়ার সকল ছেলে-মেয়েরা এক সাথে মিছিল করতাম গ্রামের রাস্তা দিয়ে। চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওতে বাজতো আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ…’। পাড়ায়-মহল্লায় মসজিদের মাইকে ভেসে আসতো ঈদ মোবারক ধ্বনি ও নামাজের সময়সূচী।
ঈদের আগের রাতেতো উত্তেজনায় ঠিকমত ঘুমাতে পারতাম না। সারা রাত হৈ চৈ করতাম। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করতাম। আমাদের গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। সেই নদীতে পাড়ার ছেলে-মেয়ে, আবাল বৃদ্ধ, নারী পুরুষ সবাই সকাল বেলা দল বেধে গোসল করতে যেতাম। পিপঁড়ার সারির মতো দল বেঁধে এক সাথে মেঘনায় যাওয়া ও ফিরে আসা, সে যে কি আনন্দ তা ভাষায় বুঝানো যাবে না। তারপর নতুন কাপড় পড়তাম। অভাবের সংসার ছিল তারপরও আব্বার যতটুকু সাধ্য ছিল ততটুকু দিয়ে আমাদের জন্য নতুন কাপড় আনতেন। আমরা তিন ভাই এক বোন ছিলাম। মা ঈদের দিন সকালে গুড় দিয়ে সেয়ুই পাক করতেন। ভাই-বোন সবাই মিলে মায়ের হাতের সেয়ুই খেয়ে রোজা ভাঙ্গতাম। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বাবা আমাদের সবাইকে ৫ টাকা করে দিতেন। মা আদর করে আমাকে জামা কাপড় পড়িয়ে দিতেন। সুন্দর করে আমার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতেন। তারপর পরিবারের সবার সাথে জায়নামাজ হাতে নিয়ে পাঞ্জাবী পায়জামা পরে ঈদগাহে যেতাম।
ঈদগাহ এর বাইরে বসতো সাময়িক ঈদের মেলা। নানান হাবিজাবি নিয়ে গ্রামের ছেলেরা পসরা সাজাতো। সেখানে গিয়ে ২ টাকা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনতাম। বাকি ৩ টাকা দিয়ে ছোট ভাইবোন ও বন্ধুদের নিয়ে কিছু কিনে খেতাম। আমার সহপাঠীদের মধ্যে আল আমীন, আজিজুল, ইসমাঈল, অলিউল্লাহ্, আজহারুল এরা সব সময় আমার পাশে থাকত। ইমাম সাহেব যখন নামাজ শুরু করেন তখন আমরা সবাই দল বেঁধে নামাজে দাঁড়াতাম। নামাজ শেষে বন্ধু-বান্ধব ও পাড়ার মুরুব্বীদের সাথে কোলাকুলি করতাম। পরে আব্বার সাথে ঈদগাহের পাশে কবরস্থানে যেতাম। সেখানে আমাদের পরিবারের যেসব সদস্য শুয়ে আছে তাদের জন্য আল্লাহর নিকট হাত তুলে দোয়া করতাম। তারপর বাসায় এসে এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে ফিরনী সেমাই খেতাম। ঈদের দিন বিকালে সহপাঠীদের সাথে মাঠে খেলতে যেতাম। রাতেও উঠানে বসে বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতাম। এভাবে কেটে যেত ঈদের দিন।
ছেলেবেলার কুরবানির ঈদটা ছিল একটু বিব্রতকর! আব্বা কুরবানি দিতে পারতেন না। মুরগী জবাই করা হতো। পাশের বাড়ির লোকজন আমাদেরকে মাংস দিতেন। লজ্জায় অন্য বাড়িতে যেতাম না। ঈদগাহ থেকে এসেই ইমাম সাহেব গরু জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হতেন। আমাদের সমবয়ী ছেলে-মেয়েরা গরু জবেহ দেখার জন্য ইমাম সাহেবের পিছে পিছে ঘুরতাম। কিছুক্ষণ পর পর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হৈ চৈ শুরু হয়ে যেত। গরুকে যখন মাটিতে শুয়ানো হয় তখন আমরা সবাই গরুর কাছাকাছি চলে যেতাম। যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ছুরি চালানো হয়; তখন লাফিয়ে দৌঁড়ে চলে যেতাম। এভাবে গ্রামের সকল গরু জবেহ করা দেখতাম। তারপর বাড়িতে এসে সেমাই খেতাম। বিকেল বেলা চুলার নিকট বসে থাকতাম কখন মাংস রান্না হবে আর কখন খাব। এভাবে কুরবানির ঈদটা কেটে যেত।
আমাদের সেই সময়ে ঈদ ছিল অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ উপলক্ষে, আত্মীয়স্বজনদের হতো মিলন মেলা, তার যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তখনকার ঈদের স্মৃতিচারণ করলে মনে হয়, আবার যদি সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম! আবার যদি সেই আনন্দের ছোঁয়া পেতাম! কী যে সেই আন্তরিকতা, মমতা, অকৃত্রিম ভালোবাসা, আনন্দঘন পরিবেশ, সামাজিক বন্ধন, সর্ম্পকের দৃঢ়তা, এখন কি আর তা আছে? ছেলেবেলার সেই ঈদের আনন্দ আর এখন পাই না। এখন আর মানুষের মধ্যে সেই আন্তরিকতা, মায়া, মমতা, ভালোবাসা নেই।
আমির ইশতিয়াক এর সকল পোস্ট
ধর্ষণের কারণ ও প্রতিকার
ধর্ষণ সর্ম্পকে আলোচনা করার আগে আমাদেরকে জানা প্রয়োজন ধর্ষণ কাকে বলে?
যখন কোন ব্যক্তি কাউকে জোর পূর্বক বা তার সম্মতি ব্যতিত যৌন আচরণ বা যৌন মিলন করে তখন তাকে ধর্ষণ বলে।
এবার বাংলাদেশের ধর্ষণের হালচিত্র নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ধর্ষণ বর্তমানে আমাদের সমাজে এক চরমতম সংকট ও মারাত্মক আতংক। যারা নিয়মিত পত্রিকা পড়ে তাদের কাছে ধর্ষণ শব্দটা বেশী পরিচিত। এমনকি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও ধর্ষণ শব্দটির সাথে পরিচিত। বর্তমানে পত্রিকা হাতে নিলে প্রথমে নজরে পড়ে ধর্ষণের লোমহর্ষক কাহিনী। পত্রিকার পাতায় এমন কোন দিন বাদ নেই যে ধর্ষণের খবর আসে না। পত্রিকার খবর ছাড়াও দেশের আনাচে কানাচে কত নারী যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার কোন হিসেব নেই। দেশের কোথাও না কোথাও ২ বছরের কন্যা শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্ষণের নেশায় কিছু মানুষরূপী নরপশুরা এসব নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে যা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। বর্তমানে এসব মানুষরূপী নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশু কন্যা, বৃদ্ধা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীকে ধর্ষণের ফলে তাদের যৌনাঙ্গের গ্রন্থি ছিঁড়ে যায়। তখন রক্তাক্ত অবস্থায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। এমতাবস্থায় অনেক শিশুর প্রাণহানী ঘটে। এর মধ্যে যারা ধর্ষিতা হয়ে বেঁচে থাকে তাদের জীবন হয়ে যায় অন্ধকার। তাদের বিয়ে নিয়ে দেখা দেয় পরিবার ও সমাজে চরম অনিশ্চয়তা। কিন্তু ধর্ষকের বিয়ে অনায়াসেই হয়ে যাচ্ছে। তাদের পোহাতে হয় না কোন লাঞ্ছনা। অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে লজ্জা ঢাকতে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে কতইনা অবলা নারী ধর্ষিত হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে ধর্ষণের কথা কারো কাছে প্রকাশ করে না। যতই দিন অতিবাহিত হচ্ছে ততই ধর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আগে ধর্ষণ হতো গোপনে আর এখন ধর্ষণ হয় প্রকাশ্যে খোলা মাঠে, চলন্ত বাসের মধ্যে। যেখানে একজন নারীকে হাত পা বেঁধে দল বেধে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হচ্ছে। যাকে গণধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ কারীরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্ষণের পর খুন করা হয় ধর্ষিতাকে। মা-বাবার সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এসব করেও ধর্ষকরা শান্তি পাচ্ছে না। তারা এখন ধর্ষণের দৃশ্যকে ভিডিও করে ব্লু-ফিল্ম বানিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে। ইদানিং ইন্টানেটেও ধর্ষণের ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে। যা জাহেলিয়াতের যুগকে হার মানাচ্ছে।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। এ দেশের ৯০% মানুষ মুসলমান। অথচ এ দেশেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণের সেঞ্চুরী হয়। তারপরও ধর্ষক বুক ফুলিয়ে রাস্তা ঘাটে হাঁটে। অথচ এ দেশের সরকার পারেনি তার বিচার করতে। এ যদি হয় দেশের অবস্থা তাহলে কিভাবে আমাদের মা বোনরা রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করবে? এ দেশের একজন নাগরিক হয়ে লজ্জায় রাস্তায় বের হতে ইচ্ছে করে না। যে দেশের সরকার ও প্রধান বিরোধী দলসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের অবস্থান সে দেশের নারী সরকার পারেনি ধর্ষণকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে। তাহলে কিভাবে এ দেশের অসহায় নারীরা ধর্ষণের হাত থেকে রেহায় পাবে?
এতক্ষণ ধর্ষণের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরলাম।
এবার আসা যাক নারী ধর্ষিত হাওয়ার কারণ কি? ধর্ষণের একাধিক কারণ আছে। এর মধ্যে তথ্যানুসন্ধান করে দেখা গেছে ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবার মূল কারণগুলো হলো, নগ্নতা, অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা, বেহায়াপনা, অবাধ যৌনাচার, রাস্তার পাশে দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, ফুটপাতে অশ্লীল ছবি সম্বলিত যৌন উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল পত্রপত্রিকা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, ব্লু-ফিল্ম, বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়ক কর্তৃক নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে সমাজে রাস্তা ঘাটে বাস্তবে ধর্ষণ করার উৎসাহ যোগান, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উম্মুক্ত করে দেয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, টুয়েনটি প্লাস চ্যানেলে নীল ছবি প্রদর্শন ইত্যাদি কারণে আজ যুবসমাজের মধ্যে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে অভিভাকদের উদাসীনতা।
পরিশেষে বলতে চাই, ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগ করে ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আর সমাজ থেকে নগ্নতা, বেহায়াপনা দূর করতে হবে। ব্লুু-ফিল্ম দেখানো নিষিদ্ধ করতে হবে। অশ্লীল পত্রপত্রিকা ও বইয়ের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ছেলে-মেয়েদেরকে যথাসময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। উপরোক্ত লক্ষণগুলো দূর করতে পারলে আশা করা যায় কিছুটা হলেও সমাজ থেকে ধর্ষণ প্রবণতা কমবে। তা না হলে কস্মিনকালেও ধর্ষণ প্রবণতা রোধ করা যাবে না।
(আমার লেখা কপি পেস্ট করে নিজের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা পত্রিকায় প্রকাশ করা নিষেধ।)
সোনালি দিন
সেদিন গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়ি
এখনও গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি
সবুজে ঢাকা গ্রামখানি ছবির মতো লাগে
গ্রামে গেলেই মায়ের কথা মনে হয় আগে
মায়ের রান্না ভুলতে কি আর পারি
মায়ের কথা মনে হলে ঝরে নয়ন-বারি
পাড়ার ছেলেমেয়ের সাথে খেলেছি কতো খেলা
সেই সোনালি দিনগুলো কি যায় সহজে ভোলা
অনাথ শিশু
কনকনে এই শীতের মাঝে
হাড় কাঁপানো সকাল-সাঁঝে,
পাই না কারো একটু আদর
কে দেবে গো একটি চাদর?
কাঁপছি আমি থরথরিয়ে
প্রাণ বুঝি যায়― যায় বেরিয়ে,
এমন সময় সূর্য মামা
দেয় পরিয়ে গরম জামা।
আমি এবং আমার বাবা
আমার বাবা ৮/১০টা বাবা থেকে আলাদা। একেবারেই আলাদা। বাবার মতো জনদরদী এমন মানুষ খুজে পাওয়া কষ্ট হবে। জন্মের পর থেকেই যাকে আপন বলে জানতাম তা হলো মায়ের পরে বাবা। বাবার আদর ভালোবাসায় আজ আমি আজকের অবস্থানে আসতে পারছি। আমি আমার বাবার প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তান হিসেবে আমি অন্যান্য ভাই-বোনদের থেকে আলাদা আদর পেতাম। জন্মের এক বছরের মাথায় আমি আমার বাবাকে যখন অাধো অাধো বুলিতে আব্বা…আব্বা…বলে ডাকতাম তখন থেকে আমি আমার বাবার প্রিয় ছেলে হয়ে গেলাম। বাবা কোথাও গেলে আমি কেঁদে কেঁদে হয়রান হতাম। বাবাকে একনজর দেখার জন্য আমি এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতাম। আর মা তখন আমার খুঁজে পেরেশান হয়ে যেতেন। বাবা বাজারে গেলে তার পিছে পিছে যেতাম। আব্বু… বাজা…ম…জা, আনবেন আধো আধো ভাষায় বলতাম। বাবা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং সত্যি সত্যি বাজার থেকে মজা নিয়ে আসতেন। তারপর ধীরে ধীরে যতই বড় হতে লাগলাম ততই আমি বাবার কাছাকাছি চলে আসলাম।
আমার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে কোন রকম সংসার চালাতেন। আমার বয়স যখন পাঁচ বৎসর তখনই আমার কিছুটা বোধ শক্তি হয়েছে যে, দরিদ্র বাবার কাজে আমাকে সহযোগিতা করা উচিত। বাবা যেখানে যেতেন সেখানেই আমাকে নিয়ে যেতেন। আমিও যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। মাঝে মাঝে বাবার সাথে কাজে যেতাম। বাবা হাল চাষ করতেন আমি গরুর পিছে পিছে ছুটতাম। বাবা মই দিতেন। আমি মইয়ে উঠতাম। বাবা ক্ষেত নিড়াতেন আমিও বাবার সাথে ক্ষেত নিড়ানোর জন্য বায়না ধরতাম। তখন বাবা আমাকে ছোট একটা নিড়ি কাচি কিনে দিলেন। আমি মাঝে মাঝে বাবার সাথে ক্ষেত নিড়াতাম। আগাছার পরিবর্তে মাঝে মাঝে ভাল গাছও তুলে ফেলতাম। এ নিয়ে বাবা আমাকে মাঝে মাঝে বকা দিতেন। তখন আমি কেঁদে ফেলতাম। অমনি বাবা আমাকে আদর করে শিখিয়ে দিতেন। এভাবে দিনে দিনে বড় হতে লাগলাম। আর বাবার সাথে থেকে থেকে কৃষি কাজ শিখে ফেললাম।
আমি একদিন বায়না ধরলাম আমাকে একটি ছাগল কিনে দেয়ার জন্য। বাবা আমার আবদার রক্ষা করলেন। তবে টাকার অভাবে ছাগল কিনে দিতে পারেন নি। ভাগী এনে দিলেন। এতেই আমি খুশি। মাঝে মাঝে বাবা আমাকে স্কুলে যাওয়ার কথা বলতেন। স্কুলের কথা বললেই আমি ছাগল নিয়ে চড়ে চলে যেতাম। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিরাট বড় এক চড়। যেখানে আমার বয়সের অসংখ্য ছেলে-মেয়ে গরু-ছাগল নিয়ে ঘাস খাওয়াতে যেত। আমিও সেখানে চলে যেতাম। ছাগল আলগা ছেড়ে দিয়ে ডাংগুলি, গোল্লাছুট, কানামাছি, বউছি, হাডুডু ইত্যাদি খেলা খেলতাম। এই দেখে আমার মা খুব চিন্তিত ছিলেন। অর্থের অভাবে বাবা ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। আর সামনে এগুতে পারেননি। তারপর সংসার জীবন শুরু করে অভাবের সংসারের গ্লানি টেনে যাচ্ছেন। এখন আমিও যদি বাবার মতো কৃষক হয় তাহলে কিভাবে এই দেশ জাতি উন্নতি করবে। সবসময় মা আমার লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। একদিন আমার পড়াশুনা নিয়ে বাবার সাথে মায়ের ঝগড়া হয়।
মা বলেন, আপনি নিজেও লেখাপড়া করেননি। ছেলেকেও লেখাপড়ার শিখানোর মতো আগ্রহ দেখাননি।
বাবা বলেন, আমিতো তাকে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার কথা বলি না গেলে কি করব।
তারপর একদিন বাবা আমাকে নিয়ে রাতের বেলা পড়াতে বসলেন। আমি পড়া পারছিলাম না। এইজন্য আমাকে অনেক শাষন করলেন। সেইদিন থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি লেখাপড়া করব। মানুষের মত মানুষ হব। আমাদের সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনব। তারপর থেকে আমি নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করলাম। বাবার কাজেও মাঝে মাঝে সহযোগিতা করতে লাগলাম। প্রতিদিন রাতে মায়ের সাথে বসে পড়তাম। বাবা মাঝে মাঝে আমার পড়া নিতেন। বছরের শুরুতে বাবা আমাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দিলেন। মনযোগ দিয়ে পড়া শুনা করার সুবাধে আমি প্রথম স্থান অধিকার করে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়। তারপর ধারাবাহিকভাবে সেই ক্রমিক নং ক্লাশ টেন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলাম। আমার ছোট তিন ভাই ও এক বোন ছিল। তারাও আমার সাথে লেখাপড়ায় যোগ দিল।
বাবা একদিন ভাবলেন এভাবে দিনমজুরী করে সংসার চালিয়ে ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করানো সম্ভব না। তাই তিনি জমিজমা বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে। আমি তখন ক্লাশ থ্রীতে পড়াশুনা করি। আমি বাবাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে গেলাম। সকাল আটটায় বাবার ফ্লাইট। সাতটা সময় বাবা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। বিদায় বেলা বাবা আমার গলায় জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, দোয়া কর বাবা, আমাদের আর অভাব থাকবে না। ভাল করে লেখাপড়া করিও ছোট ভাই-বোনদেরকে আদর করিও। তারপর বাবা চলেন গেলেন এয়ারপোর্টের ভিতরে। আমার মন তখন বাবার জন্য কাঁদছিল। বাবা যখন বিমানে উঠে আমি তখন তাকিয়ে দেখছিলাম। বাবা হাত নাড়িয়ে শেষ বিদায় জানিয়ে বিমানের ভেতর চলে গেলেন। এর কিছুক্ষণ পর বিমান আকাশের দিকে উড়তে লাগল। যতক্ষণ খালি চোখে বিমান দেখা গিয়েছিল ততক্ষণ আমি বিমানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
সেই সময় বাংলাদেশে কোন মোবাইল ছিলনা যে ইচ্ছে করলেই বাবার সাথে যখন তখন কথা বলতে পারবো। তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। বাবার বিদেশ যাওয়ার আঠার দিন পর আমাদের কাছে একটি চিঠি আসে। বাবা ঠিক মত গিয়েছে কিনা সেই খবরটি জানার জন্য একটি চিঠির অপেক্ষায় আমরা পুরো পরিবার আঠার দিন অপেক্ষায় ছিলাম।
বিদেশ যাওয়ার ১ সাপ্তাহ পর থেকেই প্রতিদিন আমি পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতাম আমাদের কোন চিঠি আসছে কিনা। পোস্ট অফিসে প্রতিদিন দুপুর ১২:০০ টায় আমাদের আশ পাশের যত এলাকা আছে সব এলাকার মানুষ ভিড় করত। কারণ তখন প্রতিদিন এই সময়ে পিয়ন সকল চিঠির প্রাপকের নাম ধরে ডাকত। প্রাপক সেখানে উপস্থিত থাকলে চিঠি দিয়ে দিত। উপস্থিত না থাকলে পরদিন আবার নতুন চিঠির সাথে পুরানো প্রাপকের নাম ধরে ডাকত। এভাবে পর পর তিনদিন ডাকার পরও প্রাপককে না পেলে পিয়ন ঠিকানামত বাড়িতে আসত। আর বাড়িতে আসলে পিয়নকে বকশিস দিতে হতো। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে প্রাবাসী আছে তাদের বাড়িতে পিয়ন আসলে আশে পাশের বাড়ির সব লোক এসে ভিড় করত। ১৮তম দিনে আমি পোস্ট অফিসে গিয়ে বাবার সেই চিঠিটি হাতে নিলাম। একটি চিঠি একটি খবর। সেই খবরটি জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলাম। দ্রুত বাড়িতে আসলাম। চিঠি খুলে দেখি দুটো চিঠি লেখা। একটি মায়ের কাছে ও একটি আমার কাছে। মায়ের চিঠিটি মাকে পড়ে শুনালাম। বাবা ঠিকমত পৌঁছেছে এ খবর জানতে পেরে মা নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করলেন। বাবা আমার কাছে যে চিঠিটি পাঠিয়েছিল সেটি ছিল-
স্নেহের আমির
সর্ব প্রথমে আমার হাজার হাজার সালাম ও দোয়া নিও। আশা করি আল্লাহর রহমতে তোমার শরীর ভাল। আমি তোমাদের দোয়ার বরকতে এক প্রকার ভাল আছি।
পরসংবাদ এই যে, বাবা আমির আমি ১০ মে বিকাল ৫টায় ঠিকমত ওমান এসে পৌঁছেছি। চাকরী এখনও পাইনি। দোয়া করিও যাতে সুস্থ্য শরীর নিয়ে কাজ করতে পারি। সেদিন অনেক কষ্ট হয়েছে তোমাদেরকে ছেড়ে আসতে। কিন্তু কি করব বাবা অভাবের তাড়নায় তোমাদের সুখের জন্য হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তোমাদের চোখের আড়ালে চলে আসলাম। আমার জন্য কোন চিন্তা করিও না। আব্বার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করিও। আমাদের আর অভাব থাকবে না। ঠিকমত লেখাপড়া করিও। জীবনে বড় হতে হলে লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই। ছোট ভাইবোনদেরকে আদর করিও। মায়ের কথামত চলিও। তোমার মাকে আমার সালাম দিও। দাদা-দাদীকে আমার সালাম দিও। তোমার ভাইবোনদেরকে আমার স্নেহ দিও। আমার চিঠির উত্তর দিও। এই বলে এখানেই শেষ করলাম। খোদা হাফেজ।
ইতি তোমার বাবা
ওমান
বাবা দীর্ঘ আঠার বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রবাস জীবন কাটিয়ে এখন তিনি বাড়িতে। আমি এখন বড় হয়েছি। লেখাপড়া শেষ করেছি। বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি। বাবাকে হজ্জ্ব করিয়ে এনেছি। বাবাকে বলছি বাবা আপনি আর কোন কাজ করবেন না। এখন আপনি নাতী-নাতনীদের নিয়ে বাকি জীবন সুখে শান্তিতে কাটাবেন।
ভয়
আমি তখন ক্লাশ সেভেন এ পড়ি। তখন ছিল বর্ষাকাল। আমাদের গ্রামের পাশেই ছিল হাই স্কুল। সেই স্কুলে এক সাথে লেখাপড়া করতাম আমি ও শিহাব। আমরা এক সাথে সব সময় থাকতাম। শিহাবের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশী দূরে নয়। ওদের বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। আমাদের গ্রামে এসে তারা বাড়ি করেছে। বর্ষাকাল এলেই আমি ও শিহাব এক সাথে ঘুরাঘুরি করতাম। খেলাধূলা করতাম। মাছ ধরতাম। অনেক মজা করতাম। আমাদের গ্রামের পাশেই ছিল এক বিল। বিলের উত্তর পাশে আমাদের গ্রাম ও দক্ষিণ পাশে ঝিকাতলা গ্রাম। সেই বিলে আমি ও শিহাব মাঝে মাঝে রাতের বেলায় মাছ ধরতে বের হতাম। আরো অনেকেই তখন বর্ষাকালে মাছ ধরত। টেটা দিয়ে আমরা মাছ ধরতাম।
একদিন বিকাল বেলা আমি শিহাবদের বাড়িতে গেলাম। তাকে বলে আসলাম আজ রাতে মাছ ধরতে যাব। তুই রেডি থাকিস।
শিহাব বললো, ঠিক আছে দোস্ত।
তখন রাত দশটা বাজে। শিহাব আসল আমাদের বাড়িতে। আমি টেটা, টর্চ লাইট ও ডুলা নিয়ে মাছ ধরার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। দু’জনে মাছ ধরার জন্য বিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বিলের পাশে এসে আমি টস লাইট ও ডুলা হাতে নিলাম আর শিহাব টেটা নিয়ে মাছ ধরছে। অনেকক্ষণ হলো কোন মাছ পাচ্ছি না। প্রতিদিনই মাছ ধরতে এসেই শুরুতে আমরা মাছ পেয়ে যায় কিন্তু আজ দীর্ঘ দুঘন্টা যাবত কোন মাছ পাচ্ছি না। আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন জানি মনে হচ্ছে। আরো অনেকেই এখানে মাছ ধরছে। তারা মাছ পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমরা পাচ্ছি না।
তখন আমি বললাম, শিহাব চল্। আজ মনে হয় কোন মাছ পাব না। এদিকে রাত বারটা বেজে গেছে। আর থাকা যাবে না।
শিহাব বললো, আরেকটু দেখি দোস্ত। কোনদিনতো খালি হাতে বাড়ি ফিরিনি। আজ খালি হাতে যাব।
– ঠিক আছে আরো আধঘন্টা দেখি।
তারপর আমরা আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একেবারে বিলের শেষ প্রান্তে চলে আসলাম। শেষ মূহূর্তে আমরা একটি বোয়াল মাছ পেয়ে গেলাম। প্রায় দেড় কেজি হবে। তারপর আমি শিহাবকে বললাম, চল দোস্ত মাছতো একটা হলোই। এবার চলি।
শিহাবও বললো, ঠিক আছে দোস্ত চল।
এই বলেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমারা গ্রামের ত্রিরাস্তার মাথায় আসলাম। এখান থেকে উত্তর দিকে শিহাবদের বাড়ি যার দূরত্ব ৫ মিনিটের রাস্তা হবে। শিহাবদের বাড়িতে যাওয়ার পথে একটু দূরেই একটি মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের পাশেই একটি বিরাট বড় বটগাছ আছে। এর পাশেই ছিল হিন্দুদের চিতা। হিন্দুধর্মের অনুসারীদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে এখানে পোড়ানো হয়। সন্ধ্যার পর এ রাস্তায় গ্রামের লোকজন চলাফেরা কম করে। আর দক্ষিণ দিকে আমাদের বাড়ি। এখান থেকে আমাদের বাড়িও ৫ মিনিটের রাস্তা হবে। আর পূর্ব দিকে একটি রাস্তা বাজারের দিকে চলে গেছে। আমরা দু’বন্ধু মাছ ধরে ত্রিরাস্তায় এসে হাজির হলাম। তখন রাত ১টা বাজে। এবার দুজন দুই রাস্তা দিয়ে চলে আসব।
এমন সময় শিহাব বললো, সুজন তুই মাছটা নিয়ে যা।
আমি বললাম, না তুই অনেক কষ্ট করেছিস? তুই নিয়ে যা।
– না আমি নেব না। তুই নিয়ে যা। আমি অন্য দিন নেব।
শিহাব আমাকে মাছটি দেয়ার জন্য জোরাজোরি করছে। আমি তখন জোর করেই তাকে মাছটি দিয়ে বললাম, ঠিক আছে তুই নে। আমি সকাল বেলায় তোদের বাড়িতে গিয়ে মাছের তরকারী খেয়ে আসব। এই বলে দু’জন বিদায় নিয়ে দুদিকে রওয়ানা হলাম।
শিহাব কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সে শুনতে পেল পিছন থেকে আমার কণ্ঠে কে যেন ওকে ডাকছে, এই শিহাব দাঁড়া। আমাকে মাছটা দিয়ে যা।
তখন শিহাব পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। কাউকে না দেখে শিহাব ভয় পেয়ে গেল। ভাবল, সুজন তো এখানে নেই। সে চলে গেছে কিন্তু তার কণ্ঠে ডাকছে। শিহাব আবার সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।
আবার পিছন থেকে ডাকছে, এই শোন তুই মাথাটা নিয়ে যা আমাকে মাছটা দিয়ে যা।
শিহাব আবার পিছনে তাকাল দেখল কেউ নেই। তখন ভয়ে তার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। এমতাবস্থায় শিহাব বলল, না তুই পুরো মাছটাই নিয়ে যা। এই বলে সামনের দিকে পা বাড়াল কিন্তু তখনও কাউকে দেখতে পেল না। তখন তার ভয় আরো বেড়ে গেল। এবার সে আর পিছনে তাকাল না। বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌঁড় দিল। আর পিছন থেকে বলছে শিহাব দাঁড়া। শিহাব দাঁ…ড়া…
অনেক দূর পর্যন্ত শিহাব ঐ ডাকটি শুনছে। আস্তে আস্তে সেই শব্দটা মিলিয়ে গেল। আর শিহাব বাড়িতে চলে আসল। ভয়ে তার সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেল। ভাবছে সে, এ কি দেখলাম, কার কথা শুনলাম। এম হল কেন? এখন যদি কাউকে ডেকে বলি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তারচে বরং ঘুমিয়ে পড়ি।
মাছটা ঘরের এক কোনায় রেখে শিহাব তার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারারাত আজে বাজে চিন্তা করল। বিছানার এপাশ ও পাশ করল। কিন্তু ঘুম আসল না।
সকাল বেলা নয়টা বাজে এখনও শিহাব ঘুম থেকে উঠছে না। এ বিষয়টা লক্ষ্য করল শিহাবের মা। স্কুলের সময় হয়ে গেছে এখনও ঘুম থেকে উঠছে না। শিহাবের মা তার রুমে গিয়ে দেখে সে শুয়ে আছে এবং কাৎরাচ্ছে। নাকে মুখে ফেনা উঠে আছে। কোন কথা বলতে পারছে না। এ দৃশ্য দেখে তো মা ভয় পেয়ে গেল। চিৎকার চেচামেচি করতে লাগল। বাড়ির লোকজন ছুটে চলে আসল।
এদিকে আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে শিহাবদের বাড়িতে গেলাম তাকে ডাক দেয়ার জন্য। গিয়ে দেখি তার এই অবস্থা। তখন সে আমাকে দেখে হাউ মাউ করে কিছু বলার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট ভাষায় সে তখন রাতে ঘটনাটা আমাকে খুলে বলল।
আমি তখন তার আব্বাকে বললাম, চাচা শিহাব ভয় পেয়েছে। হুজুর ডেকে পড়াপানি খাওয়ান। আর আজ তার স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি চলে গেলাম। এই বলে আমি তখন তাদের বাড়ি থেকে চলে আসলাম।
আমি আবার বিকাল বেলা শিহাবদের বাড়িতে গেলাম। তখন গিয়ে দেখি শিহাব আগের মতো বোবা হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারছে না।
শিহাবের বাবা আমাকে বললো, তুমি যতক্ষণ ছিলে ততক্ষণ ও স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছে। তুমি যাওয়ার পরই সে আগের মতো অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।
এরপর থেকেই আমি যতবারই শিহাবদের বাড়িতে গেছি সে আমাকে দেখে বড় বড় চোখ করে তাকাত। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন কবিরাজ দেখানো হল। কিন্তু কোন উন্নতি হয় নি।
প্রায় রাতেই চিৎকার দিয়ে সজাগ হয়ে শিহাব বলতে থাকে। ঐ যে কে যেন আমাকে ডাকছে। শিহাবের চিৎকার শুনে তার বাবা মা দৌঁড়ে আসত কিন্তু কাউকে খুঁজে পেত না।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঐ মন্দিরের কাছে দৌঁড়ে যেত শিহাব। তখন বাড়ির সবাই মিলে তাকে ধরে আনত।
এভাবে চলল অনেকদিন।
একদিন আমি গেলাম শিহাবদের বাড়িতে তখন শিহাব আমাকে অস্পষ্ট ভাষায় বললো, দেখ সুজন আমাকে ঐ ভিটা থেকে কে যেন ডাকছে। ওরা আমাকে নিয়ে যাবে। তুই সাবধানে থাকিস!
শিহাবের মুখে এ কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আর ভাবলাম, মাছটা যদি আমি নিতাম তাহলে হয়তো এ ঘটনাটা আমার সাথে হতো। তাই সেদিনের পর থেকে শিহাবদের বাড়িতে বেশি যাইনি এবং রাতের বেলা বাড়ি থেকে বের হয়নি।
শিহাবের বাবা এবার ভাবল, এভাবে ছেলেকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখব। ভাল কবিরাজ ডেকে আনতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। একদিন তিনি এক কবিরাজকে ঢেকে আনলেন।
কবিরাজ তাকে দেখে বললো, আপনার ছেলেকে জিনে ধরেছে। তার উপর দুষ্টু জিন ভর করেছে। তাকে সরাতে হবে।
শিহাবের বাবা বললো, আমরা এগুলো বুঝিনা। যেভাবে পাড়–ন আপনি আমার ছেলেকে বাঁচান।
– আচ্ছা ঠিক আছে চিন্তা করবেন না।
কবিরাজ কিছু মন্ত্র পড়ে শিহাবের উপর ভর করে জিন হাজির করল।
কবিরাজ এবার জিনকে বললো, কে তুমি? এই বাচ্চা ছেলেটার উপর ভর করে আছ?
জিন অদৃশ্য থেকে বলছে, আমি করিমন জিন।
– কি চাও তুমি?
– আমরা জমজ দুই বোন। নসিমন ও করিমন। সবসময় ঐ শ্বশানের কাছে আমরা খেলাধূলা করি। ঐদিন রাতে সে আমাদের উপর লাথি মারে। তাই ওকে আমরা ধরেছি।
– তোমরাতো অদৃশ্য হয়ে থাক। তোমাদেরকেতো কেউ দেখে না। তাই ও না দেখে তোমাদেরকে লাথি মেরেছে। তোমরা চলে যাও।
– না আমরা যাব না। ওকে ছাড়ব না। ওরে ভাল লাগছে। ওরে নিয়েই যাব।
করিবাজ অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কোনক্রমেই জিনদেরকে তার কাছ থেকে সরাতে পারেনি। তাই ব্যর্থ হয়ে কবিরাজ চলে গেল।
দিন যত যায় শিহাবের অবস্থা ততই অবনতি হয়। পরে আবার ঐ কবিরাজকে ডেকে আনল। কবিরাজ আবার জিন হাজির করল।
জিন বললো, তোর রুগীকে মেরে ফেলব।
কবিরাজ বললো, না মারবি না। তোর যা লাগে তাই দিব। কি চাস তুই? তবুও তুই ওকে ছেড়ে যা।
– ঠিক আছে একটা খাসি ও এক মন চাউল দিবি।
– ঠিক আছে তাই দিব। কোথায় দিব?
– ঐ শ্বশানঘাটে।
– ঠিক আছে।
পরের দিন শিহাবের বাবা তার নামে একটা খাসি ও এক মন চাউল দিল। এর পর থেকে সাতদিন শিহাব খুব ভাল ছিল। সবার সাথে খেলাধূলা করছে। কথাবার্তা বলছে। কোন সমস্যাবোধ করেনি।
সাতদিন পর হঠাৎ সন্ধ্যার সময় শিহাবের আব্বা আসল আমাদের বাড়িতে। আমাকে ওনি বললেন, সুজন শিহাবতো আবার আগের মতো হয়ে গেছে। শুধু তোমাকে খুঁজে।
আমি তখন তাদের বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি ঐ করিবাজ শিহাবকে নিয়ে উঠানে বসে আছে। বাড়ির সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে।
আমাকে দেখে তখন শিহাব বললো, সুজন আমিতো যাইতেছি গা তুই ভালমতো থাকিস।
আমি বললাম, কি বলিস এগুলো। তুই ঘুমা। আমি চলি। আবার কাল আসব।
– না যাবি না। আমাকে আর পাবিনা। আমি সত্যিই চলে যাব।
কিন্তু তখন আমি শিহাবের কোন কথাই শুনিনি। আমি বাড়িতে চলে আসলাম। আসার দুইঘন্টা পরই শুনতে পেলাম শিহাব মারা গেছে।
শিহাবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাত ছুটে চলে যাই তাদের বাড়িতে। তার মৃত্যুতে আমি খুবই ব্যথা পাই। তারপর তার জানাযায় অংশগ্রহণ করি। তাকে মাটি দেওয়া হয়। রাতে আর আমার ঘুম আসে না। শুধু তার কথা মনে পড়ে। এমন একটি অদ্ভুদ ঘটনার মধ্যে সে মারা গেল। তাও আবার আমার সাথেই ঘটনাটি ঘটে।
শিহাবের মৃত্যুর এক মাস পর একদিন আমার এক কাকা বলল, চল ঘুরে আসি। ঘুরতে ঘুরতে আমরা শিহাবের কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এর পাশেই ছিল বাঁশ ঝাড়। তখন ছিল রাত প্রায় দশটা। হঠাৎ করে ঐ বাঁশ ঝাড় থেকে একটি আওয়াজ আসল। সুজন কৈ যাস?
আমি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। একটু খেয়াল করে দেখলাম এ যেন শিহাবের কণ্ঠ! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। আবার আমাকে ঐ বাঁশ ঝাড় থেকে বলছে, সুজন কৈ যাস? এ দিকে আয়।
আমি ও কাকা আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম। কিন্তু কাউকে না পাওয়ায় আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর পিছনে না থাকিয়ে তাড়াতাড়ি আমরা সেখান থেকে চলে আসলাম।
শীতের রাতে একদিন বাজার থেকে বাড়ি ফিরছি। বাড়িতে আসার পূর্বে একটি খালি পতিত জমি আছে। সেখানে আসার সাথে সাথে আমি সামনের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম শিহাবের মতো অবিকল এক ব্যক্তি হেঁটে আসছে। পরনে সাদা ধূতি। আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম। এ কি করে সম্ভব! শিহাবতো মারা গেছে। সে এখানে আসল কি করে! আমি আরেকটু সামনে গিয়ে তাকে ষ্পষ্ট দেখে শিহাব বলে ডাক দিলাম। ডাক দেয়ার সাথে সাথে সে ওধাও হয়ে গেল। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভয়ে দ্রুত সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। এবার পিছন দিক থেকে ডাকছে, সুজন কৈ যাস! চলে আয় আমার কাছে।
আমি ঘাড় ফিরে পিছনে তাকালাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। ভয়ে আমার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। প্রচ- শীতের মধ্যে আমি ঘেমে গেলাম। আবার সামনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। আমি দ্রুত হাঁটছি কিন্তু রাস্তা শেষ হচ্ছে না। আবার পিছন থেকে শিহাব আমাকে ডাকছে। এবার আর আমি পেছন ফিরে তাকালাম না। একবার দুবার তিনবার ডাকার পরও আমি পিছনে তাকালাম না। আমি চোখ বন্ধ করে দৌঁড়াচ্ছি। তখন শিহাব আমার সামনে চলে আসল। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি শিহাব সাদা ধূতি পড়ে আমার সামনে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে রইল। এ দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
রচনাকাল: ২১/১০/২০১৪খ্রি:
রহস্যময় পুকুর ও বটগাছ
জুনায়েদদের বাড়ির পাশেই ছিল পুরানো একটি পুকুর। পুকুর পাড়েই ছিল বিশাল একটি বড় বট গাছ। বট গাছটির ডালপালা এতই বিশাল ছিল যে সবগুলো ডালপালাই পুকুরে গিয়ে পড়েছে। বট গাছের ডালপালার কারণে সূর্যের আলো কমই পড়ত পুকুরে। সারাদিনই অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব থাকতো এই পুকুরে । এখন এই জায়গাটা এতই ভূতুরে হয়েছে যে দিনের বেলাও এখান দিয়ে মানুষজন যেতে ভয় পায়। আর সন্ধ্যার পরতো এখান দিয়ে লোকজন একেবারেই যায় না। প্রায় প্রতিদিনই এখানে এসে কোন না কোন লোক ভয়ের শিকার হয়। এই পুকুরে এক সময় মাছ চাষ করতো কিন্তু এখন আর কেউ মাছ চাষ করে না। ইতোমধ্যে এই পুকুরকে নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে। কোন ঘটনারই কোন সমাধান এই এলাকার মানুষ দিতে পারেনি। সবার কাছে এই পুকুর ও বটগাছটি রহস্যময় হয়ে রয়ে গেল।
আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। জুনায়েদের বয়স তখন দশ বছর। তখন বট গাছটা এত বড় ছিল না। তার ডালপালাগুলো আরো ছোট ছিল। কিন্তু বটগাছের শিকরগুলো পুকুরেই গিয়ে পড়েছে। এই পুকুরটা ছিল জুনায়েদদের বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে। অনেকেই দিনের বেলা তখন এই পুকুরে মাছ ধরত। সেই মোতাবেক জুনায়েদ কোন এক বিকাল বেলা তার চাচাতো ভাই মিলনের সাথে এই পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে গেল। দুজনে অনেক্ষণ মাছ ধরল। এক সময় সন্ধ্যা হয়ে গেল।
জুনায়েদ বললো, চল মিলন এবার চলে যাই।
মিলন বললো, তুই যা আমি একটু পরে আসতেছি।
– ঠিক আছে বলেই জুনায়েদ চলে আসল।
বাসায় এসে যথারীতি পড়তে লাগল।
এদিকে এশার আযান হয়ে গেল। এখনও মিলন বাসায় ফিরেনি। মিলনের মা খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। সেতো এতক্ষণ বাহিরে থাকে না। সেই বিকাল বেলা মাছ ধরতে পুকুরে গেল জুনায়েদের সাথে। মিলনের মা জুনায়েদের সাথে দেখা করে বললো, জুনায়েদ তোমার সাথেতো মিলন মাছ ধরতে গেল। সেতো এখনও আসে নাই। সে কোথায় তুমি জান?
জুনায়েদ আশ্চার্য হয়ে বললো, কি বলেন কাকী! জুনায়েদ এখনও ফিরে নাই। আমি আর সেতো এক সাথেই মাছ ধরছি। সেতো বলল, একটু পরে চলে আসবে তাই আমি চলে আসলাম। চলেনতো দেখি তাকে দেখে আসি। বাড়ির সবাই কুপি হাতে নিয়ে ঐ পুকুর পাড়ে চলে আসল মিলনকে খুজার জন্য। জুনায়েদের দেখানো মতে মিলন যে জায়গায় বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিল সেই জায়গায় কুপি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই কুপিটি নিবে যায়। তাই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার কুপি ধরিয়ে ঐ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু এবারও কুপিটি নিভে যাচ্ছে। এভাবে আট থেকে দশ বার চেষ্টা করেও ঐ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। সবাই মিলন মিলন বলে ডাকছে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। পরিশেষে আশে পাশে সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে মিলনকে কোথাও না পেয়ে নিরাশ হয়ে সবাই বাড়িতে ফিরে আসল। মসজিদের মাইক দিয়ে মাইকিং করে দেয়া হল মিলন নামের দশ/এগার বছরের একটি ছেলে হারানো গিয়েছে। কেউ পেয়ে থাকলে তাকে বাড়ীতে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হল।
সারারাত গেল। সকাল হলো। বাড়িতে কান্নার রুল পড়ে গেল। মিলনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দল বেধে সবাই ঐ পুকুর পাড়ে গেল। এবার পুকুরের ঐ বটগাছের গোড়ায় গিয়ে সবাই আতকে উঠল। একি দেখছে তারা! বটগাছের শিকড়ের নিচে মিলনের মাথা পড়ে আছে। বটগাছের শিকড়টা ছিল পানির মধ্যে। সেই মোতাবেক তার মাথাটা পানির মধ্যেই ডুবানো ছিল। আর তার পুরো দেহ কোথায় খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা বেয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তে লাল হয়ে গেল পুকুরের পানি। তারপর গ্রামের কয়েকজন মিলে মিলনের মাথাটা পানি থেকে উঠাল। মাথা উঠিয়ে দেখল চোখগুলো উপড়ানো। নাকে মুখে ভয়ংকর কামড়ের দাগ। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবার মধ্যে ভয় এসে গেল। এবার সবাই ভাবতে লাগল তার দেহ কোথায় থাকতে পারে। যেহেতু এখানেই তার মাথা পাওয়া গেছে। দেহও এখানেই পাওয়া যাবে। পুকুরে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু সবার মাঝে কেমন একটা ভয় কাজ করছে তাই কেউ পুকুরে নামতে রাজি হয়নি। পরে জাল ফেলে খুঁজার সিদ্ধান্ত হলো।
বিভিন্ন পাড় থেকে একের পর এক জাল ফেলতে লাগলো পুকুরে। প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টার পরে এক সময় কিছু হাড্ডি উঠে আসে জালে। কিন্তু মিলনের দেহ কোথাও খুঁেজ পাওয়া গেল না। মিলনের দেহের কোন হদিস না পেয়ে পরিশেষে সবাই বুঝে নিল এটা হয়তো মাছে খেয়ে নিয়েছে। তাই হাড্ডি পাওয়া গিয়েছে। কারণ এই পুকুরে এক সময় মাগুর মাছ চাষ করা হতো। সেই মাছগুলোর মধ্যে হয়তো কিছু পুরানো ভয়ংকর মাছ এখনও আছে সেই মাছগুলো হয়তো খেয়ে ফেলছে। অনেক চেষ্টা করেও মিলনের দেহ খুঁজে না পেয়ে সেই হাড্ডি ও মাথা কাফন করে কবর দেয়া হল।
মিলনের মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। রাত তখন প্রায় ১২টা বাজে। মিলনের মা ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করল।
হঠাৎ মিলনের মায়ের ঘুম ভাঙ্গল। এতো রাতে কে আসবে। তাই মনে ভয় এসে গেল। স্বামীকে ডাকবে কিনা ভাবছে। এমন সময় আবার নক করল। এবার মিলনের মা বললো, কে?
বাহির থেকে আওয়াজ এল মা, আমি মিলন। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আমি ভাত খাব।
এ কথা শুনে মিলনের মা আতকে উঠল। মিলন! তুই কোথা থেকে এলি বাবা?
মিলনের মায়ের কথা শুনে তার স্বামী ঘুম থেকে উঠে গেল। কি হয়েছে? তুমি কার সাথে কথা বলছ?
– মিলনের সাথে।
– মিলনের সাথে! সে আবার কোথা থেকে আসবে। সেতো মরে গেছে।
– সত্যি বলছি আমার ছেলে আমাকে ডাক দিয়েছে দরজা খোলার জন্য। ছেলের খুব ক্ষিধে ভাত খাবে।
– তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি? মরা মানুষ আবার ডাক দিতে পারে নাকি?
– না আমি পাগল হয়নি। আমি স্পষ্ট শুনলাম মিলন আমাকে ডাক দিল। তুমি দরজা খুল। দেখ মিলন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
– তুমি ভুল শুনছ।
– আমি ভুল শুনিনি। আমি দরজা খুলে দেখব।
– তুমি এত রাতে দরজা খুলবে না।
– আমি দরজা খুলবই।
দু’জনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল তর্কাতর্কি। মিলনের মা তার স্বামীকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে মিলন তাকে ডাক দিয়েছে। তাই জোরাজোরির এক পর্যায়ে স্বামীর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মিলনের মা দরজা খুলল। দরজা খুলেই দেখতে পেল কাপনের কাপড় পড়া অবস্থায় শূন্যে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভয়ংকর লোক। চোখগুলো থেকে রক্ত ঝরছে। এ দৃশ্য দেখে মিলনের মা ভয়ে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। তার স্বামী পিছনে পিছনে আসল কিন্তু এসসব কিছুই দেখল না। তারপর বাড়ির আশে পাশের লোকজন চলে আসে। মিলনের মাকে পানি দিল। ঝারফুক করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
সকাল বেলা জ্ঞান ফিরল ঠিকই কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় আর তাকে পাওয়া যায়নি। অর্থ্যাৎ সে পাগল হয়ে গেছে। সে এখন মিলন মিলন বলে চিৎকার করছে। দীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত পাগল অবস্থায় আজও মিলনকে খুঁজে বেড়ায় সেই পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে। কখনো রাতের অন্ধকারে একা একা ছুটে চলে যায় পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে। আজও সেই মিলনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি গ্রামবাসী। তার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে রহস্যময় এই পুকুর পাড়ে।
গত দু’বছর পূর্বেও ঘটে গেল এই পুকুরের পাড়ে বটগাছে এক ঘটনা। কোথা থেকে এক মহিলা এখানে এসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সকাল বেলা লোকজন এসে দেখে ঐ মহিলা জিহ্বা বের করে রশিতে ঝুলে আছে। কেউ ভয়ে এ মহিলার লাশ ছুতে যায়নি। এমনকি কারো সাহস হচ্ছে না তার লাশ নামাতে। গ্রামবাসী এলাকার মেম্বার ও চেয়ারম্যানকে খবর দেয়। তারা এসে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে এ লাশ নিয়ে যায়। সেই থেকে এখানে আরো আতঙ্ক বেড়ে যায়।
এক সময় গ্রামবাসীরা সবাই মিলে এই পুকুর ভরাট ও বটগাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু যেদিন রাতে এ সিদ্ধান্ত নেই সেদিন রাতেই সবাইকে একই স্বপ্ন দেখাল যে, কেউ যদি এই পুকুর ও বটগাছ ধ্বংস করতে চায় তাহলে তার বংশ ধ্বংশ করে হয়ে যাবে। তাই আর কেউ সাহস করে বটগাছ কাটতে যায় না। পুকুর মাটি দিয়ে ভরাট করতে যায় না।
কিছুদিন পূর্বে জুনায়েদ চাকুরী পায় পার্শ্ববর্তী এক শোয়েটার ফেক্টরীতে। প্রথম সপ্তাহ দিনের বেলা ডিউটি পড়ে। প্রতিদিন সকাল ৬ টায় যেত ফিরত দুপুর দুটো। প্রতি সপ্তাহে ডিউটি পরিবর্তন হওয়ায় আজ তার ডিউটি হলো দুপুর দুটো থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত। যথারীতি প্রতিদিনের মতো আজও ডিউটিতে আসল। ছুটি হলো রাত ১০:০০ টায়। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বের হতে সময় লাগল আরো আধা ঘন্টা। অর্থ্যাৎ রাত সাড়ে দশটার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বেশি রাত্র হওয়ায় রাস্তায় কোন রিক্সা নেই। আশে পাশে কোন লোকজনও নেই। তাদের বাড়ি থেকে শোয়েটার ফেক্টরীটা প্রায় দুই কিলোমিটা দূরে। পুরো রাস্তায় হেঁটে আসতে হয়। তাদের গ্রাম থেকে একমাত্র সেই এখানে চাকুরী করে। তাই তার কোন সঙ্গী নেই। একা একা এত রাতে বাড়ি ফিরতে তার কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। কিছুটা ভয় কাজ করছে তার মনে। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জুনায়েদ হাঁটতে হাঁটতে সেই পুকুর পাড়ের বটগাছের কাছাকাছি চলে আসল। তখন বাজে প্রায় রাত সাড়ে এগারটা। শোয়েটার ফেক্টরী থেকে জুনায়েদদের বাড়িতে যাওয়ার এই একমাত্র একটি রাস্তা। এর কোন বিকল্প রাস্তা নেই। এই বটগাছ ও পুকুর কসিং করেই তাদের বাড়িতে আসতে হয়। এছাড়া কোন উপায় নেই। বটগাছের কাছাকাছি আসতেই তার পূর্বের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আর অমনি তার মধ্যে ভয় কাজ করছে। সে যতই সামনে আসছে ততই ভয় পাচ্ছে। বটগাছের কাছাকাছি এসেই দেখতে পেল চারজন লোক বসে একটি লাশ কামড়িয়ে খাচ্ছে। আর একজন চোখ বড় বড় করে বলছে, এই ছেলে এদিকে আসবি না। তোকেও খেয়ে ফেলব।
এ দৃশ্য দেখে জুনায়েদ চিৎকার দিয়ে দৌঁড় দিল। এক দৌঁড়ে বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ে গেল। বাড়ির আশে পাশের লোকজন তার চিৎকার শুনে চলে আসল। সবার কাছে জুনায়েদ ঘটনাটি বর্ণনা করল। সবাই বিশ্বাস করলেও কেউ সাহস করে সত্যতা যাচাই করার জন্য যায়নি।
পরদিন সকাল বেলা প্রতিবেশীরা জুনায়েদের সেই ঘটনা দেখার জন্য দলবেঁধে সেই বটগাছের নিচে গেল কিন্তু এ ধরনের কোন আলামতই দেখতে পেল না। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। কিন্তু এর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি কেউ।
রচনাকাল: ২৩/০১/২০১৫খ্রি:
জিনের আছর
রাত বারটা।
চারদিকে নীরব নিস্তদ্ধতা। কোথাও কেউ নেই। এ মুহূর্তে গ্রামের কেউ এখন জেগে নেই। এমন সময় রুমা একা ঘর থেকে বের হলো প্রস্রাব করার জন্য। স্বামী শিহান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আছে। চারপাশ থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শুনা যাচ্ছে। রুমা যখন বাথরুমে গিয়ে বসল ঠিক তখনই উপর থেকে একটা খচখচ আওয়াজ হলো। রুমা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
– কে, কে ওখানে।
কোন শব্দ নেই। আবার রুমা প্রস্রাব করতে বসল। আবার খচখচ আওয়াজ আসলো। তখন আবার বললো, কে, কে ওখানে।
এবারও কোন শব্দ নেই। রুমা এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। প্রস্রাব শেষে দাঁড়িয়ে গেল। এবার সামনের দিকে পা বাড়াল। সামনের দিকে তাকিয়েই দেখে সাদা ধূতি পড়া এক বয়স্ক লোক। দাঁতগুলো ইয়া বড় বড়। আঙ্গুলের নখগুলো বেশ বড়। লোকটা শুন্যে ভাসছে। পা দুটো মাটি থেকে উপরে। ভয়ংকর চেহারার এই লোকটি রুমার দিকে এগিয়ে আসছে। রুমা যত সামনে যাচ্ছে ভয়ংকর লোকটা ততই সামনে আসছে। লোকটা একসময় রুমার কাছাকাছি এসে একটা অট্টহাসি দিল। তারপর রুমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, তুকে আমি এখন খেয়ে ফেলব।
এই কথা শুনে এবং ভয়ংকর লোকটাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল রুমা। তার চিৎকার শুনে শিহান ঘুম থেকে সজাগ হয়ে গেলো। চোখ মেলে শিহান দেখে রুমা বিছানায় নেই। দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে দেখে বাথরুমের কাছে রুমা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। ইতোমধ্যে বাড়ির অন্যান্য লোকজনও সজাগ হয়ে গেল। কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসল। রুমার শ্বাশুরি বিলকিস বেগম ছুটে আসলেন। শিহান লাইট নিয়ে রুমার কাছে গিয়ে দ্রুত তাকে কুলে নিল। রুমার মুখ থেকে লালা পড়ছে আর গোংগাচ্ছে। কিন্তু কথা বলছে না। তারপর সবাই ধরাধরি করে রুমাকে ঘরে নিয়ে আসল।
পাশের বাড়ি থেকে রুমার চাচা শ্বশুর ছুটে আসলেন। শিহান বললেন, চাচা দেখেন রুমার কি হয়েছে। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল।
চাচা দোয়া কলাম পড়ে রুমাকে ঝারফুঁক দিলেন। শ্বাশুরি মাথায় পানি দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। কিন্তু কোন কথা বলছে না।
চৌয়ালা গ্রামের রমিজ উদ্দিনের মেয়ে রুমা। খুবই শান্ত ছিল। এসএসসি পাশ করার পর পাশের গ্রামের মোতালিব মাস্টারের ছেলের সাথে তার বিয়ে দেন কয়েক মাস আগে। এমন লক্ষ্মী বউ পেয়ে মোতালিব মাস্টার ও বিলকিস বেগম খুব খুশী হয়েছেন। পাড়া প্রতিবেশীরা তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ। মোতালিব মাস্টারের গ্রামটি ছিল ঘন গাছগাছলায় ভরপুর। বাড়ির দু’পাশে দুটো চৌচালা টিনশীট ঘর। পশ্চিম পার্শ্বে বিশাল বড় বাঁশঝাড়। এর পাশেই একটি ঘর। বাঁশ ঝাড়ের ভেতর রমিজ উদ্দিনের মা বাবার কবর। দক্ষিণ পাশে কলার বাগান। এর পাশে আরেকটি ঘর। উত্তর পাশে বাথরুম। এর পাশেই কাঠবাগান। পশ্চিম পাশে তার বড় ভাইয়ের বাড়ি। দক্ষিণ ভিটার ঘরে শিহান তার বউকে নিয়ে থাকে।
পরদিন সন্ধ্যায় শিহান রুমার ঘরে গেল। শিহান রুমার শরীরে স্পর্শ করতেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল। কেমন জানি হয়ে গেলো রুমা। স্বামীকে বলছে, এই ব্যাটা তোর কত বড় সাহস আমার গায়ে হাত দিচ্ছিস। তুকে এক থাপ্পর মেরে বত্রিশ দাঁত ফেলে দিব। যা আমার ঘর থেকে চলে যা। আমি এখন আমার স্বামীর সাথে রাত কাটাব।
একথা শুনে শিহান আশ্চার্য হয়ে বললো, এসব কি বলছ তুমি, কে তোমার স্বামী?
রুমা অট্টহাসি হেসে বললো, তুকে বলব কেন?
– আমি তোমার স্বামী শিহান।
– কে শিহান? তাকে আমি চিনি না। হি হি হি।
তারপর শিহান বুঝতে পারল তার স্ত্রীকে জিনে ধরেছে। এভাবে কয়েকদিন চলল। দিন দিন রুমার অস্বাভাবিক আচরণে পাড়া প্রতিবেশী অতিষ্ট হয়ে গেলো। শ্বশুর শ্বাশুরিকে তুই তোকারি করে কথা বলে। স্বামীকে তার সাথে থাকতে দেয় না। প্রতিবেশীদেরকে গাল মন্দ করে। এমনকি অনেকের গায়ে থাপ্পরও মারে। খাওয়া দাওয়ায় তেমন মনযোগ নেই। গোসল ঠিক মতো করে না। দিন দিন যেন তার শরীরে শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল কে জানে। নতুন বউ এমন আচরণ করে তা কি করে তার শ্বশুর শ্বাশুরি সৈহ্য করবে? তার আবোল তাবুল কথায় বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। নিশ্চয় কোন অশরীরী কিছু ভর করেছে নাহলে এমন করবে কেন? যে বউ কোনদিন বাড়ীর কারো সাথে কোন কটু কথা বলেনি সে কিনা এখন বকাঝকা করে। মারধর করে। তুই তোকারি করে কথা বলে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টাপাল্টা জবাব দেয়। প্রতিবেশীরা কানাকানি করছে নিশ্চয় কোন জিনে ধরেছে। তা না হলে এমন করবে কেন?
রুমার চাচা শ্বশুর বেশ কয়েকদিন ঝারফুঁক করল কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে না। দিন দিন রুমার অত্যাচার বেড়েই চলছে। তার অত্যাচার সৈহ্য করতে না পেরে শিহান তাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।
রুমার বাবা রমিজ উদ্দিন পাশের গ্রামের এক মাওলানাকে ডেকে আনলেন। তিনি জিন-ভূত তাড়াতে পারেন। তার অনেক নাম ডাক। ইতোপূর্বে অনেকেরই জিন-ভূত তাড়িয়ে অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। মাওলানা সাহেব রমিজ উদ্দিনের বাড়িতে এসেই বললেন, আগে রুগীকে দেখান। দেখি কি হয়েছে। মাওলানা সাহেব রুমাকে দেখার জন্য ঘরে গেলেন। রুমা মাওলানা সাহেবকে দেখে বললেন, এই তুই আসছিস কেন? তোকে কে বলছে আসতে?
মাওলানা সাহেব বললেন, আমি তোর যম। তুই তাড়াতাড়ি এই রুগীকে ছেড়ে চলে যা। তা না হলে তুকে আজ মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলব।
রুমা হেসে উঠল, পারবি না।
আচ্ছা দেখা যাক। বলেই মাওলানা সাহেব বাইরে আসলেন। তিনি বুঝতে পারছেন রুমাকে কোন জিনে ধরেছে। এটা বড্ড দুষ্টু জিন। যাকে একবার ধরে তাকে একেবারে শেষ করে ছাড়ে।
মাওলানার আগমনে রুমার আচরণ আরো অস্বাভাবিক হয়ে গেলো। ঘরের ভেতর ছুটাছুটি করতে লাগল। আর জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, ঐ হুজুর বেটাকে বল, এ বাড়ি থেকে চলে যেতে। তা না হলে সবাইকে মেরে ফেলব।
রমিজ উদ্দিন ভয় পেয়ে গেল। মাওলানা আশ্বাস দিলেন ভয়ের কিছু কারণ নেই। যতবড় দুষ্টু জিনই তাকে ভর করুক না কেন সে আজ তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে নতুবা এখানেই তার দাফন হবে। তবে রুগীকে ঘর থেকে বের হতে দিবেন না। তাকে ঘরের মধ্যে দরজা দিয়ে আটকিয়ে রাখুন।
মাওলানার কথামত রুমাকে ঘরের মধ্যে বন্ধি করা হলো।
মাওলানা সাহেব উঠানে একটা গোল দাগ দিলেন। এর মধ্যে কোন দর্শনার্থীকে ঢুকতে দিবেন না। তারপর রুমাকে এই দাগের ভেতর বসানো হলো। দুজন দুপাশ থেকে তাকে ধরে আছে। পাড়ার সমস্ত মানুষ রুমার জিন তাড়ানো দৃশ্য দেখার জন্য হাজির হয়ে গেল। সবাই দাগের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেল।
রুমা চিৎকার চেচামেচি করছে, আমাকে ছেঁড়ে দে। তা না হলে তোদের সবার ক্ষতি হবে।
মাওলানা সাহেব একটি ছুড়া পড়ে রুমার বুকের উপর ফু দিলেন। তারপর রুমার হাত ধরতে যাবেন এমন সময় রুমা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল, খবরদার আমার হাত ধরবি না।
কিন্তু মাওনা সাহেব বড়ই সেয়ানা। এইসব দুষ্টু জিনকে তিনি ভয় পান না। তাই তার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রুমার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল চাপ দিয়ে ধরলেন। বল তুই কে?
– ছেড়ে দে আমাকে।
– না তোকে ছাড়বনা। বল তুই কে?
– বলব না।
– বলতে তোকে হবেই। তা না হলে আজ তোকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলব।
– না না আমাকে মারবি না। আমি বলছি।
– তাড়াতাড়ি বল।
– বলছি। আমি সেন্টু।
– মাওলানা বুঝতে পারছে সে মিথ্যে বলছে, তাই আবার বললো, না তুই মিথ্যে বলছিস। সত্যি করে বল তুই কে?
– সত্যি বলছি।
– না তুই মিথ্যে বলছিস। এই কথা বলেই রুমার আঙ্গুল জোরে চাপ দিয়ে ধরলেন।
– আমাকে মারবি না। বলছি। আমি হরমুজ।
– এবার বল তুই কোথায় থাকিস?
– উত্তর পাশে কাঠ বাগানে।
– এখানে কেন এলি?
– আমি বাগান থেকে এখান দিয়েই প্রতিদিন রাত বারটার সময় খাবারের সন্ধ্যানে দক্ষিণের দিকে যাই। যথারীতি আজও যাচ্ছিলাম। এই রাস্তায় তাদের বাথরুম। এমন সময় দেখি সে বাথরুমে ঢুকছে।
– কিন্তু তোর সমস্যা কি ছিলো? কেন এই নববধুকে তুই ভর করলি?
– তাকে দেখে আমার পছন্দ হয়ে গেল। তাই ওর উপর ভর করলাম।
– তোর সাথে আর কে কে আছে?
– আমার আরো পাঁচ বন্ধু আছে। তারা সবাই এখানেই থাকে।
– তাহলেতো তোদের সবাইকে বোতলে ভরে মারতে হবে।
– এটা করবি না। আমরা এখান থেকে চলে যাব।
– তোরা কথায় কথায় মিথ্যে বলিস। তোদের কথার কাজে কোন মিল নেই। আজ তোকে সহ তোর পাঁচ বন্ধুকে পুড়িয়ে মারব।
এবার সত্যি বলছি আর কোনদিন এই বাড়ির ত্রিসীমানায় পা দিব না। আজকের মতো আমাকে মাফ করে দে।
– বলেই রুমা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।
– কাঁদলে কোন লাভ হবে না। বল কখন যাবি।
– এখনই চলে যাব।
– তোর পাঁচ বন্ধুকে বল চলে যেতে।
– এখনই বলছি। তবে আমার আঙ্গুল ছেড়ে দে। তা না হলে কিভাবে যাব?
– আমার সাথে চালাকি করছ? বলেই মাওলানা সাহেব আরো জোরে আঙ্গুল চেপে ধরলেন।
রুমা চেচামেচি করছে। তোর পায়ে ধরি। আমাকে ছেড়ে দে। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
– ঠিক আছে তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু তুই যে চলে যাবি আমরা কিভাবে বুঝব? কি চিহ্ন রেখে যাবি।
– ঐ যে কড়ই গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে দিয়ে যাব।
– ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম। বলেই রুমার হাত ছেড়ে দিল মাওলানা সাহেব। আর অমনি রুমা ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এদিক দিয়ে ঐ পাশ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে পড়ে গেল। আর শো শো একটা আওয়াজ হলো।
রুমার মাথায় পানি দেয়া হল। এবার রুমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো। শুয়া থেকে উঠে বসল। চারদিকে তাকিয়ে এত লোক দেখে বললো, আমি এখানে কেন? এত লোক কেন এখানে?
কেউ তার উত্তর না দিয়ে তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর মাওলানা সাহেব তাকে পড়া পানি ও বেশ কয়েকটি তাবিজ দিয়ে গেলেন। এগুলো যেন সব সময় তার সাথে রাখেন সেকথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
তারপর থেকে রুমা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে লাগল। এক সময় সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে গেলো। চলে আসলো স্বামীর বাড়িতে।
রচনাকাল: ১০ মার্চ ২০১৫ খ্রি:
বিদায় ২০১৭ সাল, স্বাগতম ২০১৮ সাল
অন্যান্য দিনের মতো আজকের দিনটিও বিদায় নিয়েছে কিন্তু ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী এ দিনটির বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। কেননা আজকের দিনটি বিদায় নেয়ার সঙ্গে আমরা নতুন একটি বছরে পা রাখব। বিদায় নিবে ২০১৭ সাল। আগমন ঘটবে ২০১৮ সালের। নতুন বছরকে বরণ করতে ব্যস্ত বিশ্ববাসী। পুরাতনকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করা একটি সহজাত নিয়ম। তবুও আমরা প্রত্যাশা করি ২০১৭ সালের সব জরাজীর্ণ ও ব্যর্থতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন বছর সবার জন্য বয়ে নিয়ে আসুক সুখকর ও শান্তির বার্তা। সাফল্যে ভরে উঠুক সবার জীবন।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা আমার শুভেচ্ছা নিবেন। গত ০১-০৭-২০১৩ থেকে শব্দনীড়ের সাথে আছি। চলার পথে সহলেখক হিসেবে আপনাদের সাথে আমার লেখা শেয়ার করছি। আপনাদের লেখায় মন্তব্য করেছি। মন্তব্য করতে গিয়ে কারো কারো লেখায় কড়া সমালোচনাও করেছি। এতে করে যদি কারো মনে আঘাত লেগে থাকে তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর দোয়া করবেন যেন আগামী বছর আপনাদেরকে আরো ভালো ভালো লেখা উপহার দিতে পারি।
সবাইকে ২০১৮ সালের ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। শুভ নববর্ষ।
ভালোবাসা
আশিক গ্রামে লজিং থেকে লেখাপড়া করে। সে এ বছর এস.এস.সি পরীক্ষার্থী। ছাত্র হিসেবে খুব ভাল। আর মাত্র দু’মাস বাকী ওর ফাইনাল পরীক্ষার। লেখা পড়া নিয়ে এখন খুবই ব্যস্ত। বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করার সময়ও এখন আর তার নেই।
আশিকের লজিং মালিক মুক্তার সাহেবের বড় মেয়ে প্রিয়ার সাথে তার ভালোবাসা বিনিময় হয়।
আশিক প্রিয়ার ছোট একভাই ও বোনকে পড়াতো। প্রিয়াকে তার পড়াতে হতো না। সে ক্লাস নাইনে পড়ে। প্রিয়া প্রতিদিন আশিকের কাছে আসত। তার কাছে এসে বসে থাকত। মাঝে মাঝে তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কি যেন দেখত।
আশিক তাদের বাড়িতে আসার পর থেকে সে আশিকের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ল। কতবার বলার চেষ্টা করেছে আশিকের কাছে তার মনের কথা কিন্তু বলতে পারে না। কোথা হতে যেন লজ্জা, ভয় এসে তাকে বাঁধা দেয়।
আশিক তার বাঁকা চাহনীতে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। পড়ালেখা থেকে একটু একটু করে মন উঠে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ভাবে। একদিন প্রিয়া আশিকের হাত ধরে বলেই ফেলল, স্যার আই লাভ ইউ।
একি বলছ, প্রিয়া? এ হয় না।
কেন হয় না স্যার?
তোমার আমার মাঝখানে অনেক তফাৎ। আশা করি বুঝতে পেরেছ।
না, আমি এ তফাৎ মানি না। আপনার আমার মাঝে কোন তফাৎ নেই। আমি কিচ্ছু বুঝি না। আমি শুধু আপনাকে চাই। আপনাকে ভালোবাসি এটাই সত্যি। আপনার কি আছে, কি নেই এ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই।
এ সমস্ত অবেগের কথা প্রিয়ার মুখ থেকে শুনার পর আশিক আর ওর প্রিয়াকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। হয়ে গেল প্রেম। শুরু হলো নতুন প্রেমের যাত্রা। ওরা জানে না এ প্রেমের শেষ পরিণতি কি হবে। এখন আপনি থেকে তুমিতে চলে গেল। দু’জন দু’জনকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসে। প্রেমের সাগরে তারা এখন হাবুডুবু খেলছে।
একদিন আশিক প্রিয়াকে বললো, আচ্ছা প্রিয়া আমাদের এ ভালোবাসা কী তোমার মা-বাবা মেনে নিবেন?
কেন মেনে নিবে না?
আমিতো গরীব।
ও কথা বলছো কেন? তুমি গরীব বলে কী মানুষ নও?
হ্যাঁ আমি মানুষ। কিন্তু…।
কোন কিন্তু নেই। যা হবার পরে হবে। এ সব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন আমরা যেভাবে আছি সেভাবেই চলুক।
গ্রামের সবাই যদি জেনে যায়?
জানুক, তাতে কি আসে যায়। আমরাতো কোন অন্যায় কাজ করছিনা।
তোমার আমার দৃষ্টিতে এটা অন্যায় নাও হতে পারে কিন্তু ওদের কাছেতো এটা অন্যায়।
এখন এসব কথা বাদ দাও।
প্রিয়া ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুই চিন্তা করে না। কি হবে এ প্রেমের পরিনাম ভুলেও সে তা ভাবে না। প্রতিদিন এভাবে চলছে তাদের ভালোবাসা। এখনও কেউ জানে না এ গোপন ভালোবাসার কথা। কিন্ত সত্য কতদিন চাপা দিয়ে রাখা যাবে। নিশ্চয় একদিন প্রকাশ হবে। তখন কি হবে তাদের? তারাতো সে খবর রাখে না। এ সমাজ কি মেনে নিবে তাদের এ ভালোবাসা?
এখন আশিকের মনে শুধু প্রিয়া আর প্রিয়া। সারাক্ষণ তাকে নিয়ে ভাবে। মাঝে মাঝে তাদের মাঝে দু’একটি চিঠি আদান প্রদান করা হয়। এখন প্রিয়াকে ছাড়া সে অন্য কিছু ভাবতে পারে না।
মার্চ মাসের ৪ তারিখ আশিকের এস.এস.সি পরীক্ষা শুরু হলো। প্রতিদিন আশিকের সাথে প্রিয়া কেন্দ্রে আসে।
পরীক্ষা শেষ হলো। পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে। রেজাল্ট দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশিকের কোন কাজ নেই। এ অবসর সময় কি করে কাটাবে, তাই নিয়ে সে ভাবছে।
আশিকের এখন ইচ্ছে করছে এ অবসর সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু প্রিয়াকে ছাড়া তার যে কিছুই ভাল লাগেনা। একা বেড়িয়ে যে, সে আনন্দ পাবে না। তবুও তাকে একাই বেড়াতে হবে। কারণ প্রিয়াকে তার বাবা-মা ওর সঙ্গে যেতে দিবেনা।
আশিক ঢাকায় ফুফুর বাসায় চলে আসল। ঢাকা এসে চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, যাদুঘর, শিশু পার্ক ও রমনা পার্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর প্রিয়াকে মিস করছে।
রমনা পার্কে এসে প্রেমিক প্রেমিকাদের প্রেমালোচনা দেখে তার প্রিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। আর মনে মনে বলতে লাগলো, আহ্! এ মুহূর্তে যদি প্রিয়া আমার পাশে থাকতো তাহলে কত মজাই না হতো!
ঢাকায় অনেকদিন থাকার পর আশিক তার গ্রামের বাড়িতে ফিরল। বাড়িতে আসার পূর্বে সে তার ফুফা-ফুফুকে বলে আসছে যে, রেজাল্ট বের হলে তাঁদের এখানে চলে আসবে এবং ঢাকায় যেকোন একটি কলেজে ভর্তি হবে।
অনেক রাত। নির্জন কক্ষে আশিক বসে আছে। আশিক ভাবছে, অনেকদিন যাবত প্রিয়ার সাথে দেখা নেই। ওর কাছে একটি চিঠি দেওয়া উচিত। তা না হলে সে অভিমান করবে। আশিক জটপট করে চিঠির প্যাড নিয়ে বসে গেল। চিঠি লিখছে-
ওগো আমার প্রাণের প্রিয়া,
এখন অনেক রাত। আকাশে অসংখ্য তারা ঝিকিমিকি করছে। বাহিরে ঝিঁঝিঁ পোকা মিট মিট করে আলো দিচ্ছে। ঘড়ির কাটা টিক্ টিক্ করে বেজেই চলছে। সবাই এ মুহূর্তে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। কেউ হয়তো বা এ মুহূর্তে সুখের স্বপ্ন দেখছে। জানিনা তুমি এখন কি করছ। আমি এখন নির্জন কক্ষে একা বসে শুধু তোমার কথাই ভাবছি।
প্রিয়া তুমি আমার বুকভরা ভালোবাসা নিও। আর সাথে নিও লাল গোলাপের শুভেচ্ছা। কেমন আছ? আশা করি ভাল আছ। ভাল থাকাই আমার কামনা। প্রিয়া, আমি তোমাকে একান্ত আপন করে পেতে চাই। আমি তোমার জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাব। তুমি সুন্দর, সত্যি তোমার সুন্দর্যের প্রশংসা না করে পারছি না। তোমার চেয়ে তোমার সুন্দর মনটাকে আমি বেশি ভালোবাসি। চিঠির মাঝে তোমার প্রতি রইল আমার সোহাগভরা কিস। সাদরে বরণ করে নিও। আর দেড়ীতে চিঠি দেওয়ার জন্যে রাগ করো না, প্লিজ লক্ষ্মি। আর হে, আমি কিন্তু, অল্প দিনের মধ্যেই তোমার কুলে ফিরে আসব। ভাল থেকো। তোমার মঙ্গল জীবন কামনা করে আজকের মতো এখানেই বিদায় নিলাম।
খোদা হাফেজ।
ইতি
শুধু তোমার আশিক
আশিক যথাসময়ে চিঠি পোষ্ট করে দিল। প্রিয়া চিঠিটা হাতে পেল। ও চিঠিরটা পড়ে আনন্দে নেচে উঠল। একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার চিঠিটা পড়লো। তবুও ওর চিঠি পড়ার স্বাদ মিটলো না।
১৭ জুন রেজাল্ট দিবে আশিক আগে থেকেই জানে। বিকেলে আশিক পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হলো। অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী দূর থেকে বিদ্যালয়ে আসছে। আশিক রেজাল্টের জন্য অপেক্ষায় আছে।
হেডমাস্টার স্যার রেজাল্ট নিয়ে হাজির হলেন। ততক্ষণে আশিকের বুকটা ধুক্ ধুক্ করে কাপঁছে। কারণ ওর রেজাল্ট কি জানি কি হয়।
নোটিশ বোর্ড রেজাল্ট চার্ট লাগিয়ে দেওয়া হলো। অসংখ্যা ছাত্র-ছাত্রী ভীড় জমালো। আশিক দেখতে পেল, সে দুটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে পেয়েছে। আশিক রেজাল্ট দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।
মিষ্টি নিয়ে আশিক ওর লজিং বাড়িতে আসল। বাড়ির সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিল। তারপর সে নির্জনে গিয়ে প্রিয়াকে একটি মিষ্টি খাইয়ে দিল।
দিনে দিনে অনেক দিন হয়ে গেল আশিক প্রিয়ার প্রেম। এখনও প্রকাশ পায়নি। কিন্তু সত্য যে গোপন থাকে না এ কথাটি চিরন্তন সত্য। এখন আশিক প্রিয়ার প্রেম কাহিনীও গোপন নেই। ক্রমে ক্রমে বাড়ীর সবাই জেনে গেল।
প্রিয়ার মা তার বাবাকে বলছেন, তুমি কি কিছু লক্ষ্য করেছ?
কী লক্ষ্য করব?
মাষ্টারের সাথে প্রিয়ার…। প্রিয়ার বাবা তার মায়ের কথাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বুঝতে পেরেছি আর বলতে হবে না।
আগে থেকেই সাবধান করা উচিত। তা না হলে প্রিয়া আমাদের মান সম্মান ডুবিয়ে খাবে।
কথা ঠিকই বলেছ। তুমি কি ওদেরকে কিছু বলছ?
না।
তাহলে আমিই বলব।
আশিক ও প্রিয়া দু’জনে বাংলা ঘরে বসে প্রেমালোচনা করছে। হাত ধরাধরি করে বসে আছে। দু’জনের কোন খেয়াল নেই যে, মানুষ যদি ওদের দু’জনকে এভাবে এক সাথে বসে থাকতে দেখে তখন কি হবে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। হঠাৎ প্রিয়ার বাবা মুক্তার সাহেব ওদেরকে এ অবস্থায় দেখে ফেলে। এ দৃশ্য দেখার সাথে সাথে রাগে অগ্নির্শ্মা হয়ে গেলেন মুক্তার সাহেব। তারপর বললেন, এই প্রিয়া গেলি এখান থেকে, শুয়োরের বাচ্চা শুয়োর। আর যদি কোন দিন তোকে এই ঘরে দেখি তাহলে পিঠের চামড়া তুলে ফেলব।
তারপর আশিকের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে মুক্তার সাহেব বললেন, তুমি এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে চলে যাও। তোমাকে বিশ্বাস করে এ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম। আর তুমি কিনা শেষ পর্যন্ত আমার সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে দিলে।
আশিকের অপরাধ, প্রিয়া ওর ঘরে আসে কেন? সে প্রিয়ার সাথে কথা বলে কেন? প্রিয়াকে সে ভালোবাসে কেন? সব কেনর উত্তরতো একটাই, প্রিয়াকে ওর ভালোলাগে। ওকে সে ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোলাগা, ভালোবাসা তাঁরা ভালো চোখে দেখেনি। তাঁদের চোখে ভালোবাসা অপরাধ কিন্তু তাঁরা একথাটি উপলব্ধি করতে পারে না যে, ভালোবাসা আছে বলেই এ পৃথিবী বেঁচে আছে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ভালোবাসে বলেই প্রিয়াকে জন্ম দিতে পেরেছে।
মুক্তার সাহেব আশিককে বললেন, তুমি কী জান আজ কত বড় অন্যায় করেছ? আমাদের বংশের কোন মেয়ে কোন ছেলের সাথে প্রেম করুক তা আমরা চাইনা। তাছাড়া তোমার মত ফকিরের ছেলের সাথে আমার মেয়ে কিছুতে মিশতে পারে না। ছি: ছি: আমি ভাবতে পারিনা।
আশিক এবার মুখ খুললো, কাকা ভালোবাসা কী অপরাধ?
হ্যাঁ ভালোবাসা অপরাধ। তুমি জান কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো?
হ্যাঁ আমি জানি। আমি আমার ও প্রিয়ার ভালোবাসা হত্যাকরাী একজন পিতার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।
কী বললে, এত বড় স্পর্ধা তোমার! আর কোন কথা নয়। এখন আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও। তোমার মতো রাস্তার ছেলের সাথে আমার মেয়ে মেলামেশা করতে পারে না।
প্রিয়া এতক্ষণে মুখ খুললো, বাবা ওতো কোন অপরাধ করেনি। তোমার চোখে অপধার করেছি আমি। শাস্তি যদি দিতে চাও, আমাকে দাও। ওকে তুমি বিদায় করে দিও না। ওকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসা অন্যায় নয় বাবা। আমি ওকে ছাড়া বাঁচবোনা।
কী বললি, ওকে তুই ভালোবাসিস! আমার মুখের সামনে দাঁিড়য়ে কথা বলার সাহস হলো কি করে?
ভালোবাসা আমাকে সাহস দিয়েছে।
অভাব যখন ঘরে আসবে তখন তোর এসব ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে।
প্রিয়া আর কিছুই বলছে না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আশিক এবার নম্র সুরে বললো, আমি আপনাকে পিতা মনে করে আপনাদের বাড়িতে থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু গরীব বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। আমি আপনার মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। এই ছিল আমার অপরাধ। ঠিক আছে আর আমাকে বলতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি আমাকে মাফ করে দিবেন। হয়তো কোন একদিন আবার আসব।
একথা বলেই আশিক কাপড়-ছোপড় গুছাতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে প্রিয়ার চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছে না। প্রিয়া আশিকে ঝাপটে ধরে বললো, আশিক তুমি যেওনা। যেতে হলে সাথে আমাকে নিয়ে যাও।
না প্রিয়া না, এ হয়না। সময় হলে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। এখন আমি একাই যাব।
এদৃশ্য দেখে বাড়ির আশে পাশের লোকজন এসে এখানে ভিড় করলো। মুক্তার সাহেব প্রিয়াকে জোর করে ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন।
প্রিয়া খাটের উপর উপুর হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছে আর চোখ দিয়ে শ্রাবণের ধারা বইছে।
ভালোবাসার অপরাধে আজ আমি তাঁদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এখন কি করব। আমিতো প্রিয়াকে ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারবো না। আমি চলে গেলে আমাদের ভালোবাসার বাঁধন শেষ হয়ে যাবে। না, না, এ হতে পারেনা। আমি তো তাঁদের বাড়িতে জোর করেও থাকতে পারবো না। তাহলে কী আমাকে যেতেই হবে? অন্য কোন কি পথ নেই? কি করে আমি প্রিয়াকে পাব? এসব ভাবছে আর কাপড়-ছোপড় গুছাচ্ছে আশিক।
আশিক চলে যাচ্ছে। ওর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। একবার প্রিয়ার রুমের দিকে তাকায় আবার সামনের দিকে তাকায়। প্রিয়া আবার ছুটে এসে পিছন দিক দিয়ে ডাকছে। আশিক যেওনা। আমাকে নিয়ে যাও। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।
কিন্তু আশিক আর সেই কথা শুনছে না। একবারও পিছনের দিকে তাকালোনা। সামনের দিকে যাচ্ছেতো যাচ্ছে। বাড়ির আশেপাশের সবাই তার গমনাপথের দিকে তাকিয়ে রইল। আশিককে আর এখন দুর থেকে দেখা যাচ্ছে না। মিশে গেলো প্রকৃতির সাথে। প্রিয়া এ বেদনা সহ্য করতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল।
রচনাকাল- ০১-০২-২০০০খ্রি:
সম্পর্ক
– কিরে সাইফ কি করছিস? চল ঘুরে আসি। হঠাৎ বিকেল বেলা কাইফ সাইফের রুমে এসে হাজির।
– তুই এ সময়! কি মনে করে?
– কিছু মনে করে না। হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল তাই চলে আসলাম। এ ছাড়া অনেকদিন যাবত ভাবছি তোর সাথে একটা কথা শেয়ার করব?
– কি কথা?
– চল এখানে নয় অন্য কোথাও গিয়ে বলব।
– কোথায় যাবি?
– নদীর পাড়ে।
– ঠিক আছে চল।
সাইফ ও কাইফ দুই বন্ধু। সেই ছোট বেলা থেকেই দুই বন্ধু এক সাথে থাকে। একই গ্রামে তাদের বাড়ি। ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত একই সাথে পড়াশুনা করেছে। বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করে। কলেজে উঠার পর তারা পৃথক হয়ে গেছে। কাইফ একটু বেশী মেধাবী ছিল তাই সে নরসিংদী সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছে। সাইফ কম মেধাবী হওয়ায় তাকে সলিমগঞ্জ কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে। কাইফ নরসিংদী সরকারি কলেজ হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। দুজন দুই কলেজে ভর্তি হওয়ায় তাদের মধ্যে এখন আর বেশী দেখা হয় না। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কাইফ বাড়ীতে আসছে। বাড়ীতে এসেই বন্ধু সাইফের কথা মনে পড়ায় ছুটে আসল তাদের বাড়ীতে। এরই মাঝে কলেজ জীবনে কাইফের জীবনে ঘটে গেল এক কাহিনী। যা সাইফ জানে না। জীবনের সব ঘটনাই কাইফ সাইফের সাথে শেয়ার করেছে কিন্তু এই ঘটনাটি গোপন করেছে। কিন্তু আজ আর তা গোপন করতে পারল না। তাইতো কাইফ সাইফকে ডেকে নদীর পাড়ে নিয়ে আসছে।
সাইফ ও কাইফ চরমধুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছে। এ গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে মেঘনা নদী। গ্রাম থেকে ২০০ গজ সামনেই নদীর পাড়। প্রায় বিকেল বেলাই সাইফ ও কাইফ নদীর পাড়ে বসে গল্প করত।
পড়ন্ত বিকেল। এখনও সন্ধ্যা হওয়ার বেশ খানিকটা বাকী। বিকেল বেলা নদীর পাড়ে বসে সূর্য ডুবার দৃশ্য দেখতে বড়ই চমৎকার লাগে। গ্রামের অসংখ্য লোক এখানে এসে বসে বিকেল বেলার গোধূলীলগ্ন উপভোগ করে। সাইফ ও কাইফ নদীর পাড় ঘেষে হাঁটছে। একটু দূরে গিয়ে তারা দুজনেই বসে পড়ল।
সাইফ বলল, কি যেন বলবি বল।
সাইফ বলল, জীবনের সব কথাই তোর সাথে শেয়ার করেছি কিন্তু একটি কথা গোপন করলাম তা আজ আর না বলে পারছি না।
– কি এমন কথা আমাকে বলিছনি।
– সেটাইতো এখন বলব।
– ঠিক আছে বল আমি শুনছি।
– কিছুদিন আগে আমার এক বড় ভাই আমাকে একটি টিউশনি ঠিক করে দিল। একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রী। তারা দুই ভাই বোন। বোনটি ক্লাশ নাইনে পড়ে আর ভাইটি ক্লাশ ফাইভে পড়ে।
– ভাল কথা। টিউশনি পেয়েছিস এটা গোপন করার কি আছে? আর আজই বা হঠাৎ করে বলছিস কেন?
– আমাকে শেষ করতে দে না। পুরো কথা না শুনেই মন্তব্য করছিস কেন?
– ঠিক আছে বল তারপর কি হয়েছে?
– প্রথম দিন গেলাম তাদেরকে পড়াতে। আমি পড়ার রুমে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর ছাত্র-ছাত্রী দুজনই আসল। আমিতো ছাত্রীকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এত সুন্দর মেয়ে আমি আর কোন দিন দেখিনি। গোলাগাল চেহারা। চোখ দুটো হরিণের মতো। ঠোঁট দুটো কমলার কোয়ার মতো। গায়ের রঙ ফর্সা। এ যেন ঠিক পরীর মতো।
– গেছস টিউশনি করতে আর বর্ণনা দিচ্ছিস মেয়ের রূপের!
– আরে বোকা পুরো বর্ণনা না দিলে বুঝবি কি করে যে, মেয়েটি কেমন সুন্দর। তুইতো গাদা গ্রামে থাকিস। এত সুন্দর মেয়ে জীবনে দেখসনি। তাই বুঝবি কি?
– হয়েছে এবার বল পরে কি হলো।
– তাকে দেখেতো আর চোখ নামাতে পারছি না। কতক্ষণ যে এভাবে চেয়ে রইলাম তা বলতে পারছি না। যখন ছাত্রী আমাকে বলল, কি হল স্যার শুধু চেয়েই থাকবেন, পড়াবেন না। তখন আমার সেন্স ফিরল। আমি খুবই লজ্জা পেলাম। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। তখন জানিস সে কি বলল?
– কি বলল?
– তখন সে আমাকে বলল, স্যার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এই বয়সে এমন সুন্দরী মেয়ে দেখলে এমন হওয়া অস্বাভাবিকের কিছু নয়।
– তারপর তুই কি করলি?
– আমি আর তখন কি করব। এমনিতেই লজ্জায় মুখে কোন কথা বের হচ্ছে না। আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু সে আমাকে থামিয়ে দিল। তারপর কোন রকমে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। পরে তার সিলেবাস সর্ম্পকে কিছু ধারনা দিয়ে ঐদিনের মতো বিদায় নিলাম।
– তা তোর ছাত্রীর নাম কি ছিল?
– কারিনা।
– কি বললি, কারিনা! বলিউড নায়িকা কারিনা কাপুর নাকি?
– এইসব কি বলিস, কারিনা কাপুর হবে কেন?
– নাম শুনেতো তাই মনে হল।
– নামে নামে নামতো থাকতেই পারে কি বলিস?
– তা ঠিক। তা তোর ছাত্রী কারিনা কি বলিউড নায়িকা কারিনা কাপুরের মতো সুন্দরী ছিল?
– কি বলিস কারিনা কাপুর কোন সুন্দরী মেয়ে হলো নাকি? ওরাতো অভিনয় করার সময় মেকাপ করে অভিনয় করে তাই তোদের চোখে সুন্দরী মনে হয়। তাদেরকে বাস্তবে দেখলে বিশ্রী মনে হবে। আমার ছাত্রী কারিনা কাপুরের চেয়ে দ্বিগুন সুন্দরী। যা না দেখলে বুঝতে পারবি না।
– তাহলেতো একদিন দেখতে হয় সুন্দরী কারিনাকে।
– অবশ্যই দেখবি।
– তা কাইফ খান ঢালিউড নায়িকা কারিনার প্রেমে পড়েছিস কি?
– আরে সেটা বলার জন্যইতো তুকে এখানে আনলাম।
– তাহলে বলছিস না কেন?
– বলতে দিলি কৈ? তুইতো আমাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছিস?
– ঠিক আছে এবার বল।
– সেদিনের পর থেকে আমার হৃদয়ে স্থান পেলো কারিনা। শয়নে স্বপনে সারাক্ষণ তাকে নিয়ে ভাবতাম। মনে মনে তাকে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন দেখতাম। প্রতিদিনই তাকে যখন পড়াতে যেতাম তখন পড়ার প্রতি আমার কোন মনযোগ ছিলনা। দীর্ঘ সময় ধরে তার দিকে চেয়ে থাকতাম। তাকে নিয়ে ভাবতাম। আস্তে আস্তে আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেলাম। তার হাতের একটু স্পর্শ পেলে শিহরিত হয়ে উঠতাম। আমার এই দুর্বলতা সে লক্ষ্য করল। একদিন কারিনা পড়া শেষে আমাকে বলল, স্যার আপনি যাবেন না। একটু বসেন। আপনার সাথে কথা আছে।
তার কথায় আমি খুব আনন্দিত হলাম। আর ভাবছি আজ হয়তো আমাকে ভালোবাসার কথা বলবে। আবার উল্টোটাও ভাবছি।
কিছুক্ষণ পর কারিনা আমার জন্য কিছু ফল ও বিস্কুট নিয়ে আসলো। আমি সেগুলো খেলাম। তারপর সে বলল, স্যার আমি কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করে দেখলাম আপনি আমার প্রতি বেশী দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এভাবে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে গেলেতো আমাকে পড়াতে পারবেন না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন।
আমি বললাম, কি করব বল। আমি যে আর পারছি না। যেদিন থেকে আমি তোমাকে দেখছি সেদিন থেকেই আমার হৃদয়ের মনি কোঠায় তোমাকে স্থান দিয়ে রেখেছি।
– তা হতে পারে না স্যার। আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি শিক্ষক আর আমি ছাত্রী।
– তাতে কি হয়েছে? ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কি প্রেম হয় না?
– হয়। কিন্তু সমাজের চোখে সেটা খুবই খারাপ। মানুষ আমাদের নিয়ে সমালোচনা করবে।
– করুক তাতে কি আসে যায়।
– বুঝতে পারছি স্যার আপনার মধ্যে আবেগ কাজ করছে। একটু বিবেক দিয়ে চিন্তা করে দেখুন।
– তা ঠিক বলেছো কারিনা। মানুষ যখন কারো প্রেমে অন্ধ হয়ে যায় তখন বিবেক লোপ পেয়ে আবেগ কাজ করে।
– বিবেককে বাদ দিয়ে আবেগকে প্রশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে প্রশ্চাতে হবে স্যার।
– কিন্তু কিছু করার নেই কারিনা। আমি আনেক দিন যাবত তোমাকে আমার হৃদয়ের কথাগুলো বলবো বলে ভাবছি, কিন্তু সাহস করে বলতে পারছিলাম না। আজ যেহেতু তুমি শুরু করেছো তাই আজই আমি তোমাকে আমার হৃদয়ের কথাগুলো বলতে চাই।
– আচ্ছা আপনি কি বলতে চান বলুন।
আমি তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না। হঠাৎ কারিনার দুহাত চেপে ধরে বললাম, কারিনা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– এসব কি করছেন স্যার। ছাড়–ন আমাকে। এ হয় না। এখনও আমার প্রেমে পড়ার বয়স হয়নি।
– প্রেমে পড়ার জন্য কি নির্দিষ্ট বয়স লাগে? আমিতো মনে করি প্রেমে পড়ার জন্য কোন বয়স লাগে না। যে বয়সে একটা মেয়ে আরেকটা ছেলেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে সেটাই প্রেমে পড়ার বয়স। তুমি কি আমাকে নিয়ে ভাবনাই। সত্যি করে বলতো?
– ভাবছি।
– তাহলে কেন শুধু শুধু আমার কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে চাচ্ছ?
– তাছাড়া…
– তাছাড়া কি?
– আমার বাবা মা জানলে আপনাকে এ বাড়ীতে আসতে দিবে না। আর আমার কি হবে জানি না।
– সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
– কথায় আছে স্যার, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।
– আমি তোমার এত কথা শুনতে চাই না। তুমি বল আমাকে ভালোবাসো কিনা।
– যদি ভালো না বাসি তাহলে কি করবেন?
– তুমি দেখতে চাও আমি কি করতে পারি?
– জীবন দিবেন?
– তুমি কি তাই চাও?
– আমি চাই না আমার জন্য আপনি জীবন দেন? কিন্তু এ পৃথিবীতে ক’জন আছে একজন আরেক জনের জন্য জীবন দেয়।
– অনেক উদাহরণ আছে।
– তাছাড়া আমার মাঝে কি এমন পেলেন যে, প্রথম দেখাতেই আমাকে ভালোবেসে ফেললেন। যার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত?
– যা অন্যের কাছ থেকে পাইনি, তা তোমার কাছ থেকে পেয়েছি।
– আচ্ছা স্যার এসব কথা বাদ দেন। যা সম্ভব নয় তা নিয়ে কল্পনা করবেন না। আমি যাচ্ছি বলেই কারিনা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।
– এই শোন একটা সমাধান দিয়ে যাও।
– স্যার আমাকে একটু ভাবতে দিন।
– ঠিক আছে তোমাকে আমি তিন দিনের সময় দিলাম।
এই বলেই কাইফ থামল। সাইফ বলল, তিনদিন পর কি হলো?
– পর পর দুদিন আমি আর কারিনাকে পড়াতে যাইনি। তাকে ভাবার সময় দিলাম। তৃতীয় দিন আমি গেলাম। দেখলাম তার মনটা খুবই ভালো। খুব সেজে গুজে আমার সামনে এসেছে। পড়া শেষে তার ভাই যখন চলে গেল তখন আমি বললাম, ভেবেছো কিছু?
কারিনা মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ ভেবেছি।
– তাহলে বলো।
– কি বলব?
– তোমার মনের কথা।
– শুনতে চান আমার মনের কথা?
– হ্যাঁ শুনতে চাই। আজ প্রায় এক মাস যাবত তোমার মনের কথা শুনার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছি। বল আমার যে আর তর সইছে না।
– আমার যে লজ্জা করছে।
– লজ্জা কিসের?
– এখন বলব না।
– কখন বলবে?
– রাতে।
– রাতে! রাতে কিভাবে বলবে?
– কেন? মোবাইলে।
– তোমার মোবাইল আছে?
– হ্যাঁ।
– তাতো আগে বলনি।
– দরকার মনে করিনি, তাই বলিনি।
– তাহলে মোবাইল নম্বর দাও।
পরে কারিনা আমাকে তার মোবাইল নম্বর দিয়ে সর্তক করে দিল আপনি আমাকে ফোন দিবেন না। আমি আপনাকে রাত বারটার পর ফোন দিব। আপনি অপেক্ষায় থাকবেন।
আমি অপেক্ষায় রইলাম কখন রাত ১২টা বাজবে। একবার ইচ্ছে করছিল আমি ফোন দেই আবার ভাবছি না ও যেহেতু ফোন দিবে অপেক্ষায় থাকি। মনটা ছটফট করছে কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কখন আমার মনের ময়না আমাকে বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। অপেক্ষার প্রহর শেষ। রাত এখন বারোটা বাজে।
কারিনা ফোন দিল। আমি রিসিভ করলাম।
– হ্যালো
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি কণ্ঠ। স্যার আমি কারিনা।
– কেমন আছ?
– ভালো না।
– কি হয়েছে? মন খারাপ?
– না।
– জ্বর?
– না।
– মাথা ব্যথা?
– না। তবে অন্য কিছু হয়েছে।
– আহা বলনা কি হয়েছে?
– প্রেম রোগ। যে রুগের ঔষুধ আপনার কাছে আছে। আপনি সেই ঔষুধ দিলে আমি ভালো হয়ে যাব।
কাইফ বলল, খুব রসিকতো মেয়েটি।
সাইফ বলল, তার এই কথা শুনে আমি তখন হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না।
– তারপর তুই কি বললি?
– আমি বললাম, ঠিক আছে। আমার কাছে চলে আস ঔষধ দিয়ে দিব।
কারিনা বলল, না কাছে আসতে হবে না। মোবাইলে দিলেই চলবে।
– আগে বল তোমার মনের কথা তারপর দেখি কি করা যায়?
– ঠিক আছে বলছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।
– আপনাকে নয় বল ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
– আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তারপর সেদিন সারারাত তার সাথে কথা বললাম। ভোর পাঁচটায় ঘুমাতে গেলাম। এর পর থেকে প্রতিদিন তাকে কল দেই। প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত কথা হয়। যতই দিন যাচ্ছে ততই আমাদের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীর হচ্ছে।
কাইফের প্রেমের গল্পটা অনেকদিন পর বন্ধু সাইফকে বলতে পেরে তার মনটা হালকা হলো। এবার বলল, দোস্ত উঠ, সন্ধ্যা হয়ে গেল। আজ আর নয়।
সাইফ বলল, খুব মজা পেলাম। অরেকদিন বাকী গল্প শুনব। এই বলেই দুজন নদীর তীর ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী চলে আসল।
রচনাকাল: ০৭/০৮/২০১৫খ্রি:
নতুন জীবন
কলেজে ভর্তি হবার পূর্বে কলেজকে নিয়ে রবিন কতনা রঙিন স্বপ্ন দেখেছে। যেখানে আছে স্বাধীনতা। নেই কোন শাসন। ইচ্ছে হলে ক্লাশ করবে, ইচ্ছে না হলে ক্লাশ করবে না। কোন শিক্ষক কিছু বলবে না। এই হল কলেজের নিয়ম। আর পড়ার জন্য স্যারের পিটুনি খেতে হবে না। সেই সঙ্গে পারিবারিক দিক দিয়েও সে এখন স্বাধীন। কারণ সে এখন বড় হয়েছে। ভাল মন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। স্কুল পাশ করে কলেজে এসেছে। কাজেই ছেলেকে আর পূর্বের মত তার পিতা-মাতা শাসন করতে পারবে না। বন্দী পাখী খাচা থেকে মুক্তি পেলে যেমন মহানন্দে আকাশে বিচরণ করে, ঠিক তেমননি রবিন কলেজে ভর্তি হবার পর অনাবিল আনন্দে স্বাধীনতা ভোগ করছে। এ যেন এক নতুন জীবন।
সবে মাত্র রবিন কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হলো। রবিন খুব মিশুক ছেলে। তাই তার স্কুল জীবনে অনেক বন্ধু জুটে গেল। কিন্তু আজ তার সেই সব বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে যাদের সাথে দীর্ঘ ১০ বছর এক সাথে লেখাপড়া করেছে। যাদের সাথে মিশে আছে শৈশবের স্মৃতি। রবিন গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করত। বন্ধুদের মধ্যে সে ছিল মেধাবী। তাই সে নরসিংদী সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেল। কিন্তু অন্য বন্ধুরা ভর্তি পরীক্ষায় টিকেনি। এই জন্য কলেজে এসে রবিন একা হয়ে গেল। তার চারপাশে এখন অসংখ্য নতুন বন্ধু। এত বন্ধুর পরও তার সেই শৈশবের সেই বন্ধুদের কথা আজ বার বার মনে পড়ছে।
মিশুক রবিন অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই কলেজে এসে বন্ধু হিসেবে পেয়ে গেল হৃদয়, দেলোয়ার, তাদের ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে খাদিজা ও মনিরাকে। হৃদয় খুব বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছেলে। দেলোয়ার খুব রসিক মানুষ। অতি সহজেই মেয়েদের সাথে আড্ডা জমাতে পারে। কিছুদিনের মধ্যে ক্লাশের সবাই যেন রবিনের আপন হয়ে গেল। রবিন লক্ষ্য করে দেখল কলেজে পড়ার চেয়ে প্রেম বিষয়ে আলোচনা হয় বেশী। কিন্তু রবিনের প্রেম নিয়ে মুঠেও আলোচনা করতে ইচ্ছে করে না। সে শুধু লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ।
ছাত্র হিসেবে বেশ ভাল রবিন। এস.এস.সিতে দুটো লেটারসহ প্রথম বিভাগ পেয়েছিল রবিন। কলেজ যতই স্বাধীন হউক না কেন কিন্তু নিজেকে স্বাধীন ভাবে না রবিন। সে নিয়মিত ক্লাশ করে। বছরের প্রথম থেকেই প্রাইভেট পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। হৃদয়, দেলোয়ার, খাদিজা ও মনিরাকে প্রাইভেট সঙ্গী করে নিল। সিদ্ধান্ত হল শফিক স্যারের নিকট ইংরেজি পড়বে। পাঁচজন এক সাথে যাতায়াত, পাশাপাশি বসা, একে অপরের বাসায় আসা যাওয়া করে। এভাবেই প্রতিটি দিন চলছে তাদের। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের সর্ম্পক আরো গভীর হচ্ছে।
প্রাইভেট পড়তে গিয়ে রবিন সুন্দরী রমণী খাদিজার সঙ্গ পেয়ে সে তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। যে রবিন প্রেমালোচনা পছন্দ করতোনা, সে রবিন যেন অন্য রবিন হয়ে গেল। এদিকে খাদিজাও রবিনের প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। তার সঙ্গ, কথাবার্তা সবই যেন তার কাছে ভাল লাগে। রবিন যতই চাচ্ছে বিষয়টাকে হালকা করতে ততই যেন সে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তার এ পরিবর্তন হৃদয় ও দেলোয়ার লক্ষ্য করল। রবিন খাদিজাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবে। ক্লাশেও এক সাথে পাশাপাশি বসে। কেউ কারো প্রতি কোন বিরক্তবোধ করে না। কিন্তু তাদের ভালোলাগা ভালোবাসার কথা কেউ কাউকে বলতে পারছে না। প্রেমের আগুনে নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরছে। এযেন আগুন আর মোম এক সাথে থাকলে যেমন অবস্থা হয়, তাদের অবস্থাও ঠিক তেমনই।
বসন্তের হাওয়া লাগলে কোকিল যেমন নেচে উঠে কুহু… কুহু… করে ডাকে, ঠিক খাদিজাও আজ যেন ভালোবাসার বসন্তে নেচে উঠল। তার মনটা আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে ফ্রেশ। কারণ সে আজ রবিনকে তার মনে জমানো কথাগুলো বলবে। গতরাতে সে খুব চিন্তা করেছে। তাই তার তেমন ঘুম হয়নি। চোখ দুটো যেন লাল হয়ে আছে।
রবিন আজ কলেজ চত্বরে পা রাখতেই খাদিজার সাথে দেখা হল। খাদিজা সাজগোজ করে কলেজে এসেছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ তাকে খুব সুন্দর লাগছে। খাদিজা রবিনের চেহারার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
রবিন তার এমন চাহনী দেখে বললো, কি ব্যাপার এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?
খাদিজা মাথা নিচু করে বললো, হ্যাঁ।
বল।
এখানে নয়।
তাহলে কোথায়?
আঙ্গুল দিয়ে সামনের রুমটা খাদিজা দেখিয়ে বললো, ঐ রুমটায় চল।
ঠিক আছে চল।
বেঞ্চের উপর দু’জন পাশাপাশি বসল।
রবিন এতক্ষণ খাদিজার দিকে ভাল করে লক্ষ্য করেনি। এবার তার চোখে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করল, তোমার চোখ লাল কেন? ঘুমাওনি?
খাদিজা মাথা নেড়ে বললো, না।
কেন?
তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি তাই।
আমাকে নিয়ে! আমি আবার কি করলাম?
তুমি আমার মন চুরি করেছ।
এসব কি বলছ? আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বল।
কেন? তুমি কি কচি খোকা যে, কিছুই বুঝনা।
হ্যাঁ আমি কচি খোকা।
সব কথা কি বুঝিয়ে বলা যায়। কিছু কথা আছে এমনতিইে বুঝে নিতে হয়। তুমি কেন নিজেকে লুকাচ্ছ? তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে তুমি আমাকে নিয়ে ভাবনি? আমাকে ভালোবাসনি?
এতক্ষণ রবিন নীরব থেকে খাদিজার আবেগের কথাগুলো শুনল। এবার রবিন তার সমস্ত আবেগ উজাড় করে বললো, হ্যাঁ খাদিজা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসি।
প্রেমের সূচনা হল। রবিন এখন আর আগের রবিন নেই। সে একজনের প্রেমিক। অন্য দশটি প্রেমিক যুগলের মতো সেও ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে পুকুর পাড়ে, খেজুর তলায়, বেঞ্চের উপর বসে আড্ডা দেয়। তার এখন পাঠ্যপুস্তকের দিকে খেয়াল নেই। তার চিন্তা চেতনায় এখন শুধু খাদিজা থাকে। ভাবে কিভাবে সে আরো ভালোবেসে তাকে জীবন সঙ্গীনি বানাবে। মাঝে মাঝে চলে যায় আরশীনগর পার্কে। কখনো চলে যায় মিতালী, সুরভী ও সঙ্গীতা সিনেমা হলে। এভাবেই তাদের মাঝ থেকে চলে যাচ্ছে সোনালী দিনগুলো। দেখতে দেখতে চলে গেল একটি বছর। বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে দু’জনই উত্তীর্ণ হল। রেজাল্ট তেমন ভাল হয়নি। কোন মতে পাশ করেছে।
আজ কয়েকদিন যাবত কলেজে খাদিজাকে দেখা যাচ্ছে না। কি হল সে কলেজে আসছে না কেন? কোন অসুখ হয়নিতো? অসুখ হলে নিশ্চয় খবর দিত। এসব ভাবছে রবিন কলেজের মাঠে বসে। হৃদয় এসে রবিনের হাতে এক টুকরা ভাঁজ করা কাগজ দিল। উপরের লেখা দেখে এটা যে খাদিজার হাতের লেখা তা আর বুঝার বাকী রইলনা রবিনের। রবিন ভাঁজ করা কাগজখানা খুলে পড়তে লাগল।
রবিন,
প্রথমে তুমি আমাকে ক্ষমা কর। কারণ আমি আজ স্বার্থপরের মতো তোমাকে ভুলে গেলাম। আমি যদি আগে জানতাম যে আমার মামাত ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক আছে তাহলে তোমার সাথে আমি সর্ম্পক করতামনা। তাই আজ জানার পর মা-বাবাকে কষ্ট দিতে পারলাম না। রবিন তুমি আমাকে ভুল বুঝনা। আশা করি তুমি আমার চেয়ে সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। কারণ তোমার মতো ছেলে হয় না।
ইতি খাদিজা।
চিঠিটা পড়ে যেন রবিনের মাথায় আগুন ধরে গেল। এ কেমন ছলনা করল খাদিজা। রবিন ফিস ফিস করে বললো, তুমি আমাকে বলছো সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে। আমি কি তোমার মত স্বার্থপর যে, অন্য মেয়েকে বিয়ে করবো?
এখন রবিন যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যে রবিন সারাক্ষণ হাসিখুশি খাকত, সেই রবিনের মুখে হাসি নেই। কলেজে ঠিকমত যায় না। নাওয়া খাওয়াও ঠিক মত করে না। ঠিকমত সেভ হয় না। যেন অর্ধ পাগলের মতো সে। এখন সে খাদিজাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। সে খোদার কাছে প্রার্থনা করে, হে খোদা আমার মত অন্য কোন পুরুষকে এমন ছলনাময়ী নারীর ফাঁদে ফেলিও না। মেয়েরা যে সত্যিই ছলনাময়ী একথা ধ্রুব সত্য হয়ে গেল তার কাছে। যা এতদিন সে বিশ্বাস করত না।
বাবা আলতাব হোসেন ছেলের এ পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তিনি আস্তে আস্তে ছেলের সব খবর নিলেন। একদিন রাতে তাকে ডেকে এ সর্ম্পকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে খুব বকাঝকা করলেন। বাবার বকা খেয়ে রবিন আবার আগের মত হয়ে গেল। এখন সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কলেজে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। এখন আর কোন মেয়েদের সাথে কথা বলে না। এ যেন আবার এক নতুন জীবনের সূচনা করল।
রচনাকাল: ১৭ ডিসেম্বর ২০০০।
না বলা কথা
নোমানের বুকের ভেতরে নিদারুণ কষ্ট অনুভূত করতে লাগলো। এইতো কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সে এমন হয়ে গেল। অথচ এখন থেকে ছয় সাত ঘন্টা পূর্বেতো সে এমন ছিল না। তখন তার মন ছিল ফুর ফুরে, উৎফুল্ল। কিন্তু কেন? কি হয়েছে ওর? কিসের জন্য জন্য এত কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে শুয়ে আছে। হ্যাঁ সে ক্ষণিকের জন্য একটি চাঁদ হাতের কাছে পেয়েছিল, কিন্তু তা আবার হারিয়ে গেল। তাইতো তার বুকে এত কষ্ট চাপা দিয়ে আছে। বয়ে গেল তার জীবনে এক কাল বৈশাখী ঝড়। সে ঝড়ে তার হৃদয়টাকে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেল।
ক্ষণিকের জন্য ময়নাকে কাছে পেয়েছিল নোমান। কিন্তু পরক্ষণেই তার কাছ থেকে নীড়হারা পাখির মতো চলে আসতে হলো। যে নোমান সারাক্ষণ হাসত, বন্ধুদের সাথে গল্প করত; সেই নোমানের কাছ থেকে আজ হাসি সম্পূর্ণ রূপে বিলীন হয়ে গেল। সে তার বুকের মনিকোঠায় রাখতে পরে নি সেই মহামূল্যবান রত্নটি। কেন সে আজ সেই রত্নটি ধরে রাখতে পারে নি?
নিঃসঙ্গ নোমান বিষন্ন মনে একাকি নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। রাত অনেক হলো ঘুম নেই দু’চোখের পাতায়। মা এসে পাশে বসল। মায়ের আদর মাখা কোমল হাতটি নোমানের কপাল স্পর্শ করল। স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো, বাবা নোমান এভাবে বিষন্ন মনে শুয়ে আছিস! ঘুমাসনি? অসুখ-টুসুখ করেনিতো?
নোমান বিছানা থেকে উঠে মাকে জাপটে ধরে ঠোঁটের কোনে এক ঝলক হাসির রেখা টেনে বললো, না মা কিছু হয়নি। এতদূর জার্নি করে আসছিতো তাই খুব ক্লান্ত লাগছে। তাইতো ঘুম আসছে না।
মা চলে যাওয়ার পর আবার বিছানায় গা এলিয়ে ভাবছে নোমান। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠছে ময়নার সাথে কাটানো সেই সুখের মুহূর্তগুলো। আর কি করেই বা ভুলে যাবে সেই সোনালী স্মৃতিগুলো। তা কি ভুলা সম্ভব?
অনেকদিন যাবত নোমান ভাবছে আমিরের সাথে ওদের বাড়ি সিলেট যাবে। আমির তার কলেজ জীবনের প্রথম বন্ধু। কিন্ত যাবে যাবে বলে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবারের বসন্তে সিলেট যাবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। বসন্তের আগমনে চারদিক মৌ মৌ করছে। আকাশে মেঘের কানাকড়ি নেই। পরিষ্কার নীলাকাশ। গাছে গাছে শিমুল, পলাশ ফুটেছে। ফুটেছে আরো নানা জাত ও রঙের বাসন্তী ফুল। কোকিলের কুহুতানে চারদিক মুখরিত হচ্ছে। এমন সুন্দর পরিবেশে বেড়াতে কারনা ভালো লাগে। তাইতো আর বিলম্ব না করে তড়িগড়ি করে সিলেটের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেল দুই ভ্রমণ বিলাসী সৈনিক। নোমান কোন দিন সিলেটে যায়নি। আজ তার প্রথম ভ্রমণ। গাড়ীর জানালা দিয়ে তাকিয়ে প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্য দেখছে নোমান। যতই সে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছে ততই তার কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে গাড়ী সিলেট শহরে পা রেখেছে তার খেয়াল নেই নোমানের। সূর্য যখন বিদায় নেবার আয়োজন সমাপ্ত করল, ঠিক তখনই দু’জন বাসায় গিয়ে পৌঁছল। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল এক তরুণী। এ আর কেউ নয় আমিরের বোন ময়না। নবম শ্রেণীতে পড়ে। গায়ের রঙ ফর্সা। হালকা পাতলা গড়ন। গোলগাল চেহারা। বেশ সুন্দরী। মায়াবী চোখে তাকিয়ে আমিরকে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া ওনি কে?
আমির জবাব দিল, আমার বন্ধু নোমান।
ওহ্ ভাইয়া তাহলে আমার কাছে ওনার কথাই বলেছিলে?
মাথা নাড়িয়ে আমির জবাব দিল, হ্যাঁ।
ময়না বললো, আসুন নোমান ভাই। ভিতরে আসুন। বসুন।
দু’জনেই ঘরে প্রবেশ করল। চা বিস্কুট আপ্যায়ন করা হলো। ময়না মাঝে মাঝে আড়চোখে নোমানের দিকে তাকায়, আবার ফিরিয়ে নেয়। যখন চার চোখের মিলন হয়ে যায়, তখন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। নোমানও নিজের অজান্তে ওর দিকে তাকায়। হৃদয়ের গভীর অনুভূতি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে ওকে। এক পলক দেখে ক্ষণিকের সুখ অনুভূত করে। মাঝে মাঝে দু’চারটি কথা হয়। মিষ্টি মিষ্টি হাসি উপহার দেয়।
এভাবেই কেটে গেল রাত। সকাল হলো। কখন যে মনের অজান্তে দু’জন দু’জনাকে ভালোবেসে ফেলেছে তা বলা যাবে না। কিন্তু মনের ভালোবাসা মনেই রইল। কেউ কাউকে মুখ ফুঁটে বলার সাহস পায়নি। আর পারবেই বা কি করে। মাত্র পরিচয় হল। এত অল্প সময়ে কী প্রেম ভালোবাসা হয়? প্রেম এতো সোজা নয়, যে একদিনের পরিচয়েই হয়ে যাবে। প্রেমের জন্য করতে হয় সাধনা। যে প্রেমের জন্য লায়লী-মজুন, শিরি-ফরহাদ, রাধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুলেখা সাধনা করেছিলেন।
ময়না মনে মনে ভাবে, নোমান দেখতে মন্দ নয়, স্মার্ট চেহারা। সাহসী যুবক। ভাইয়ার বন্ধু। ওকে যে আমি নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেললাম। কাল ওকে দেখার পর থেকে ময়নার চলাচল অনেক পরির্বতন হয়ে গেছে। সারা অঙ্গে তার প্রেমের শিখা দংশন করছে, তা কেউ বুঝতে পারে নি। ময়নার এখন আর একা একা থাকতে ভালো লাগে না। এ বায়না ও বায়নায় নোমানের কাছে এসে বসে। একেবারে গা ঘেষে। নোমানও ওকে বাঁধা দেয় না। ওর স্পর্শ যেন ওকে অনাবিল সুখ দেয়। এই সুখের জন্য হয়তো বিধাতা ওকে জীবনের ষোলটি রঙিন বসন্ত পার করে এখানে নিয়ে এসেছে। ক্ষণিকের ভালোলাগার মোহে পড়ে আজ তারা স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছে। দু’জন দু’জনাকে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখছে।
ময়না এক সময় বললো, নোমান ভাইয়া, চলেন না চা বাগান থেকে ঘুরে আসি। চা বাগান দেখলে আপনার খুব ভালো লাগবে।
নোমান মুচকি হেসে বললো, অবশ্যই যাব। চা বাগান দেখার জন্যইতো তোমাদের এখানে আসা হলো।
নোমানের সম্মতি পেয়ে ময়না আজ খুশীতে বাহ্ বাহ্। এমন খুশী হয়তো সে কোনদিন হয়নি। মনের মত একজন বন্ধু পেয়ে ময়না আজ ধন্য। বিকেলে সূর্যের ত্যাজ যখন আস্তে আস্তে বিলীন হতে শুরু করল, ঠিক তখন নোমান, আমির ও ময়না রওয়ানা হয়ে গেল প্রকৃতির ছোঁয়ায় ধন্য সিলেটের চা বাগান দেখতে। সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন সিলেটের সবুজ চা বাগান গুলো উচুঁ নিচু পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থিত। প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে এক সময় ওরা হাজির হয়ে গেল সবুজ চা বাগানে। বিকেলের লাল মিষ্টি রোদ এসে সবুজ চা পাতার উপর পড়ে চিক্ চিক্ করছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। চা বাগানের এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে ওদের চোখ জুড়ালো। খুব হালকা লাগছে নিজেদেরকে। বিশেষ করে ময়না ও নোমানের মনটা আনন্দে নেচে উঠল। নোমান ভাবতেই পারে না সিলেটে এসে এভাবে ময়নার সাথে ঘুরে বেড়াবে। একটা ফুর ফুরে হাওয়া বয়ে গেল ওদের শরীর দিয়ে। একদম শান্ত পরিবেশ। কোথাও কোলাহল নেই। এ যেন অন্য এক জগত। সেখানে আছে শুধু ভালোবাসার অনুভূতি।
এখানে আর একটি আকর্ষণ হলো উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য ভ্রমণ বিলাসী তিনজনই পা অগ্রসর করলো। প্রকৃতির নীরবতা ভেঙ্গে অদৃশ্য শিল্পীর নিপূন হাতে সাজানো অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের শান্ত পরিবেশে মনে হয় ওরাই আজ প্রথম ভ্রমণবিলাসী। আমির সামনে নোমান মাঝে আর ময়না পিছনে। সারিবদ্ধভাবে পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে ওরা। এমন সময় ময়না পিছন দিক দিয়ে ডেকে বললো, নোমান ভাইয়া আমিতো পরে যাচ্ছি, আহ্হা একটু ধরেন না। এ বলে দু’হাত সামনের দিকে অগ্রসর করে দিল। অমনি নোমান ময়নার হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরল।
একি! মুহূর্তে ময়নার শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে গেল। গ্রীষ্মের রোদ যেমন লোহাকে গরম করে দেয় ঠিক তেমনি নোমানের স্পর্শে ময়নার শরীর গরম হয়ে গেল। নতুন এক অনাবিল সুখ অনুভব করল ময়না। নোমান কোন দিন কোন মেয়ের শরীর স্পর্শ করেনি। আজ প্রথম তার অভিজ্ঞতা। ময়নাকে ধরার সাথে সাথে ওর দেহের শিরা-উপশিরায় নতুন সুখানুভূতি জন্মালো। নোমান আস্তে আস্তে ময়নাকে টেনে পাহাড়ের চূড়ায় উঠাল।
ময়না আজ হালকা নীল রঙের থ্রিপিছ পরে আসছে। সেম্পু করা চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠার আনন্দে প্রকৃতির রূপ দেখে তারুণ্যের অন্তরালে লুকায়িত কিশোরী ময়নার মনটা পুতুলের মত নেচে উঠল। এই পাহাড় বুঝি তাদের আগমনের জন্যই এতদিন তীর্থের কাকের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হয় তাদেরকে পেয়ে আজ পাহাড় ধন্য। সবুজ ঘাসে আবৃত উচুঁ-নিচু পথ ধরে ওরা হাঁটছে। কিছুক্ষণের জন্য ওরা হারিয়ে গেল প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাগরে।
নোমানের সাথে ছিল ক্যামেরা। বন্ধি করলো তাদের স্মরণীয় স্মৃতিগুলো। ময়নার সাথে নোমান চা বাগানে ও পাহাড়ের চূড়ায় অনেকগুলো ছবি তুলল। নানা ভঙ্গিমায় ওরা তিনজনই ক্যামেরায় বন্ধি করল অসংখ্য ছবি। এরি মাঝ দিয়ে কখন যে সূর্যি মামা পশ্চিমাকাশে অস্ত গেল তার খেয়াল নেই। আর থাকা যাবে না। তাইতো বাড়িতে ফিরতে হবে। মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো ওরা।
পরদিন সকাল বেলা ভালো খাবারের আয়োজন করা হলো। ডাইনিং টেবিলে ময়না ও নোমান পাশাপাশি বসলো। দু’জন দু’জনার পা স্পর্শ করছে। ময়না তরকারী বেড়ে নোমানের প্লেটে দিচ্ছে। নোমান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ময়নার দিকে। ময়না এক সময় বলেই ফেলল, কি ভাইয়া, অমন করে তাকিয়ে কি দেখছেন?
নোমান ধ্যান ভেঙ্গে বললো, কেন তোমাকে?
তখন ময়নার দু’ঠোটের মাঝখান থেকে একটি শব্দ উচ্চারণ করলো, দুষ্টু!
এভাবে কেটে গেল কয়েকদিন। নোমান শাহ্জালাল (র) এর মাজার, জাফলং ও বিভিন্ন জায়গায় ময়নাকে নিয়ে ঘুরল। আর দু‘জনেই মনে মনে ভালোবাসার জাল বুনল কিন্তু কেউ কাউকে মুখ ফুটে বলল না। না বলা কথাগুলো দু’জনেই বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখছে। বিদায়ের ক্ষণটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। নোমান চলে যাবে মায়ার জাল ছিন্ন করে নিজ গন্তব্যস্থলে। রেখে যাবে অসংখ্য স্মৃতি আর ক্ষণিকের ভালোবাসা। এই স্মৃতি হৃদয়ে আঠার মত লেগে থাকবে। বিলীন হবে না কোনদিন। হৃদয়ের মনি কোঠায় থাকবে অনন্তকাল।
ময়নার মুখ মুহূর্তে কালো হয়ে গেল। যেমনি করে আকাশে মেঘ জমলে প্রকৃতি কালো হয়ে যায়। কোথা হতে যেন একগুচ্ছ কালি এসে পড়ল তার চোখে-মুখে। বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠল। শুরু হল দু’টি হৃদয়ের মাঝে কালবৈশাখী ঝড়। ঘন্টায় ষাট কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে ওদের অবাধ্য হৃদয়ে। এই ঝড় আজ তাদের দু’টি হৃদয়কে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিবে। পাঠিয়ে দিবে দু’জনকে দুই মেরুর দুই প্রান্তে।
নোমান আজ ময়নাকে ছেড়ে চলে যাবে এ কথা ভাবতেই ওর মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠল। হাহাকার করে উঠল হৃদয়টা। তার হৃদয় ব্যাংকে জমা না বলা কথাগুলো ময়নাকে বলতে পারেনি। তেমনিভাবে ময়নার হৃদয় ব্যাংকে জমা না বলা কথাগুলোও নোমানকে বলতে পারে নি। দু’জনের হৃদয়ে হাকারের সুর বেজে উঠল।
কাপড়-ছোপড় পড়ে নোমান যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত; ঠিক তখনি ময়না এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ওর বিদায়ের ক্ষণ মুহূর্তে ময়নার হৃদয়টা ছিঁড়ে ফানা ফানা হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বলছে, নোমান ভাই আপনি আর কতটা দিন থেকে যান। আমার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা না বলা কথাগুলো বলে মনটাকে হালকা করি। তা না হলে যে আমি শান্তি পাব না। কিন্তু কে শুনে তার হৃদয়ের আকুতি। শুন্যে মিশে হাওয়া হয়ে যায় তার এ সমস্ত কথাগুলো। ময়নার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে কিন্তু মুখ ফোঁটে বের হচ্ছে না। শুধু চাতক পাখির মত নোমানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বোবা কান্নায় হৃদয়টা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আবার সে খোদার কাছে প্রার্থনা করে, হে রাহমানুর রাহিম! আমি যদি তাকে ভালোবাসার কথা না বলতেই পারলাম তাহলে কেন এই ক্ষণিকের ভালোবাসা দেয়ার জন্য তাকে আমার কাছে পাঠালে? কেন সে ভালোবাসা এখন আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে?
ময়না আবার তার দৃষ্টি নোমানের দিকে নিক্ষেপ করে বলল, নোমান ভাইয়া আপনি যদি চলেই যাবেন তাহলে কেন আমাকে ক্ষণিকের ভালোবাসা দেয়ার জন্য আসলেন?
এ প্রশ্নের জবাব দেয়া বড়ই কঠিন। নোমানের কাছে এ প্রশ্নের জবাব নেই। মুখের ভাষা কে যেন কেড়ে নিল। এরি মাঝ দিয়ে ময়নার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা বেদনাশ্রু টপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তে চোখ দু’টোকে ওর দৃষ্টি থেকে নামিয়ে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুছে ফেলল।
যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবুও চলে যায়Ñ কবির সেই মূল্যবান পংক্তিকে ধারণ করে নোমান সামনের দিকে পা বাড়ালো। এক পা দু’পা করে সামনে এগুচ্ছে আর ঘাড় ফিরিয়ে ময়নাকে দেখছে। ময়না অপলক দৃষ্টিতে তার গমনাপথের দিকে চেয়ে রইল। এই চাওয়ার যেন শেষ নেই। কে জানে এভাবে কতক্ষণ নোমানের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। নোমান হাঁটতে হাঁটতে গাড়ীতে এসে উঠল। সে বিষন্ন মনে বাড়ী ফিরল।
ময়না বিছানায় শুয়ে মুখ গুজে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। নোমান যাবার বেলা রেখে গেল ময়নার জন্য একগুচ্ছ স্মৃতি।
নোমান বিছানায় শুয়ে ফেলে আসা ঐসব স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লো তা টেরও পেল না।
রচনাকাল- জুন ২০০০খ্রি:
মুক্তি
সোহেল সাবিনাকে অনেক ভালোবেসেছিল। তারপরও সোহেল সাবিনাকে তার জীবন থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়া কি আর করার ছিল তার। সে সোহেলের জীবনটাকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলেছে। ওকে নিয়ে সারাক্ষণ আতংকে থাকত সোহেল। কখন জানি কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। সোহেল যতই চাচ্ছিল সাবিনার জীবন থেকে মুক্তি পেতে সাবিনা ততই তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। তাইতো সোহেল নিরূপায় হয়ে আজ সাবিনাকে চিরজীবনের জন্য মুক্তি দিল। সে আর আসবে না কোন দিন সোহেলের জীবনে।
সোহেল ও সাবিনার প্রেম ছিল খাঁটি। কিন্তু এই খাঁটি প্রেমে যে কলঙ্কের দাগ লাগবে তা সোহেল চিন্তাও করতে পারেনি। অথচ তাদের দু’জনের ভালোবাসা দেখে সমাজের অনেকেই তাদের দিকে থুথু ফেলেছে। তারপরও একটি দিনের জন্য সাবিনাকে ভুলে থাকেনি সোহেল। সাবিনাকে সোহেল প্রচণ্ড ভালোবাসত। কিন্ত সে ভালোবাসার মূল্য সাবিনা দেয় নি।
সোহেল এতটা নিষ্ঠুর, এতটা জঘন্য, এতটা পাষাণ হত না। যদি না তার অনুপস্থিতে সাবিনা অন্য একটি ছেলের সাথে অনৈতিক সর্ম্পকে জড়িয়ে না যেত। অথচ সাবিনার সাথে সোহেলের যখন পরিচয় হয়, তখন থেকেই সোহেল সাবিনার প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। তাকে ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকে ভালো লাগত না। আজ তার চোখ খুলে গেল। আজ তার প্রতি কোন মায়া হচ্ছে না। তার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মাচ্ছে।
এইতো বছর খানেক আগের কথা। টিএসটিতে যখন সাবিনার সাথে সোহেলের পরিচয় হয় তখন মনে হয়েছিল যুগ যুগ ধরে দুজন দুজনকে চিনে। কেন জানি সোহেলের মনে হতো সাবিনাই তার জীবনের স্বপ্নের রাজকন্যা যার জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। সাবিনাকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারত না। একদিন শুধু তার সাথে দেখা হয়নি তখন সেদিনতো দুচোখ বেয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে গেল। সাবিনার প্রতি সোহেলের আবেগ দিন দিন বেড়েই যেতে লাগল। সাবিনার কিছু আচরণ সোহেলকে আরো বেশি ভালোবাসতে বাধ্য করল। সাবিনার এই সব আচরণ কি ভালোবাসার বহি:প্রকাশ? যদি তাই হয় তাহলে কেন না বলা কথাগুলো বলছে না। অবশেষে সোহেল সিদ্ধান্ত নিল সে তার মনের সব কথা সাবিনাকে বলবে। তার স্বপ্নের রাজকন্যাকে আপন করে নিবে।
সোহেল সাবিনাকে তার ভালোবাসার অনুভূতি জানালো। সে ভালোবাসায় সাড়া দিল। সেই থেকে তাদের মধ্যে প্রেম শুরু হলো। সাবিনার মধ্যে সামান্য প্রেমের অনুভূতি কাজ করছে দেখে সোহেলের কাছে মনে হয়েছে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। প্রতিদিন দেখা করা, মোবাইলে কথা বলা, ফেসবুকে চ্যাট করা সবই হতো তাদের মধ্যে।
পরিচয়, ভালোলাগা, প্রেম, সর্বশেষে বিয়ে। বিয়ের পরই সাবিনার আসল চেহারা উম্মুক্ত হলো। সে যে একাধিক ছেলের সাথে সর্ম্পক ছিল তা সোহেলের জানা ছিল না। যদি জানত তাহলে হয়তো এই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়াতো না। বিয়ের সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই সাবিনার পরিবর্তন লক্ষ করল সোহেল। সবকিছুতেই খিটখিটে মেজাজ দেখাত। অল্পতেই তুই ভাষা ব্যবহার করত। সোহেলের বাপ মাকে নিয়ে গালাগালি করত। সাবিনার সামান্য অবহেলায় সোহেলের হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত। সারা রাত বিছানায় এ পাশ করত। ঘুম আসতো না।
সোহেল ভাবছিল সারাজীবন এক সাথে কাটিয়ে দিবে। তাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে সন্তান আসবে। কিন্তু সন্তান নেয়ার ব্যাপারে সাবিনা অনিহা প্রকাশ করত। তখন থেকেই সাবিনার প্রতি সোহেলের সন্দেহ বেড়ে গেল। কেন সে এমন করছে?
চারতলা বিল্ডিং এর উপর একটি চিলেকোটা, দুটো রুম, বাথরুম, রান্নাঘর, একটি বারান্দা, পুরো একটি ছাঁদ। এখানেই সোহেল সাবিনাকে নিয়ে বাস করে। সোহেল একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরি করে। হঠাৎ আজ সোহেল অসুস্থতা অনুভব করায় ছুটি নিয়ে বেলা বারোটার দিকে বাসায় ফিরে। দরজায় নক করতেই সোহেল যা দেখল তাতে কারো মাথায় ঠিক থাকার কথা না। দরজা খুলতেই একটি ছেলে সাবিনার রুম থেকে বের হয়ে গেল। ছেলেটিকে হাতেনাতে ধরতে পারেনি সোহেল। সোহেলের রাগ চরমে উঠে গেল। এই মুহুর্তে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। হাতের কাছে যা পেল তা দিয়েই সাবিনাকে মারতে লাগল সোহেল।
– প্লিজ আমাকে মের না। আমার কথা শুন।
– আমি তোমার কোন কথাই শুনব না। এই তোমার ভালোবাসা? এইজন্যই এতদিন তোমাকে আমি ভালোবেসেছি? তুমি আমার ভালোবাসাকে নোংরা করে ফেলছ। তোমাকে আমি শেষ করে ফেলব।
– প্লিজ তুমি বস।
– আমি তোমার কোন কথায় শুনতে চাই না। আজ থেকে তোমার সাথে আমার কোন সর্ম্পক নেই। তুমি এ মুহূর্তে আমার বাসা থেকে চলে যাও।
– ঠিক আছে আমি চলে যাব। কিন্তু আমার কথা শুনবেতো।
– যা দেখছি তা কি মিথ্যা?
– সব সত্যি। কিন্তু কেন সে আসল? কে সে? তার সাথে আমার কত দিনের পরিচয়? তা কি জানবে না?
– না আর কিছু জানার দরকার নেই। তুমি যাবে কিনা সেটা বল?
– যদি না যাই।
– তাহলে তোমাকে খুন করব।
– কি বলছ তুমি! খুন! তুমি আমাকে খুন করবে?
– হ্যাঁ। খুন করব।
– ঠিক আছে চললাম। তোমার সাথে আমার কোন সর্ম্পক নেই।
– হ্যাঁ আমি তোমাকে আজই ডিভোর্স দিব।
সাবিনা চলে গেল কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে। সোহেল শুনল না তার মনের কথা। কিছুদিন পর সোহেল সাবিনাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিল। সাবিনাকে তার জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে দিল চির জীবনের জন্য।
রচনাকাল: ০৮/১০/২০১৫ খ্রি:
ফেসবুক প্রেম
মীম এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ। এখন পড়ার কোন চাপ নেই। যথেষ্ট সময় এখন তার হাতে। মীম তার ছোট নাম। পুরো নাম তানিয়া সুলতানা মীম। মেয়ে এখন অনেক বড় হয়েছে। তাই বাবা তাকে একটি এনড্রুয়েড মোবাইল সেট কিনে দেয়।
ফেসবুক জগৎ সর্ম্পকে কোন ধারনা নেই মীমের। বান্ধবী লুবনার সহযোগিতায় মোবাইল দিয়ে একটি ফেসবুক আইডি খুলছে সবে মাত্র দুই দিন হয়। দুই দিনে বেশ ভালোই বন্ধুর রিকুয়েস্ট এসেছে। মেয়েদের আইডিতো তাই রিকুয়েস্ট একটু বেশি আসে। ফেসবুক দুনিয়ায় মীম একে বারেই নতুন। কি করবে কিভাবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবে, কিভাবে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট গ্রহণ করবে, কিভাবে স্ট্যাটাস দিবে, কিভাবে ছবি আপলোড করবে, কিভাবে চ্যাটিং করবে এর কিছুই জানে না। তাই বন্ধবী লুবনার বাসায় প্রতিদিন বিকাল বেলায় এসে ফেসবুকের খুনিনাটি বিষয় জেনে যায়।
ইতোমধ্যে মীম বুঝে গেছে কিভাবে রিকুয়েস্ট পাঠাতে হয় এবং কিভাবে রিকুয়েস্ট গ্রহণ করতে হয়। মীম সব রিকুয়েস্ট গ্রহণ করে না। ওর বান্ধরীরা বলেছে না জেনে না বুঝে কারো রিকুয়েস্ট গ্রহণ করবি না। কারণ ফেসবুকে অনেক ভুয়া আইডি থাকে। এসব আইডি থেকে মেয়েদের প্রোফাইলে ট্রেগ করে অনেক খারাপ ছবি আপলোড করে দেয়। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। মীম কিছু সংবাদ পত্রের পেইজে লাইক দিয়েছে। ফেসবুক খুললেই তাজা খবর এখন তার সামনে চলে আসে। ফেসবুকে থাকাবস্থায় এসব খবর পড়ে সময় কাটিয়ে দেয়।
ইতোমধ্যে মীমের ফেসবুক সর্ম্পকে ধারনা হয়েছে। মোবাইলে একটি নাম্বারে একজনের সাথে যোগাযোগ করা যায় আর ফেসবুকে এক সাথে অনেক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করা যায়। পরিচিত অপরিচিত সবার সাথে চ্যাটিং করা যায়। ছবি শেয়ার করা যায়। মনের ভাবনা শেয়ার করা যায়। বন্ধুরা লাইক দিয়ে, মন্তব্য করে তাদের অনুভূতি জানান দেয়। তাইতো ফেসবুককে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বলা হয়। এসব সুবিধা দেখে মীম দিন দিন ফেসবুকের প্রতি আসক্ত হয়ে গেলো। দিন যত যাচ্ছে তার বন্ধুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। পরিচিত অপরিচিত অনেকের সাথে ইতোমধ্যে তার সর্ম্পক হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সমবয়সী ছেলেরা তার সাথে বেশী ভাব জমাতে থাকে। এখন ফেসবুক খুললেই চ্যাটিং করার জন্য অনেকের প্রস্তাব আসে। যাকে ভাল লাগে তার সাথে তার চ্যাটিং হয়। যাকে ভালো না লাগে তাকে এড়িয়ে যায়। কিন্তু এখনও তার মনের মতো কাউকে ফেসবুকে পায়নি।
দুই ভাই বোনের মধ্যে মীম বড়। তার ছোট একটি ভাই আছে। মীম খুব সুন্দরী মেয়ে। উচ্চতা পাঁচ ফুট ৩ ইঞ্চি। গায়ের রং ফর্সা। ছাত্রী হিসেবে খুবই মেধাবী। স্কুলে পড়াশুনা করা অবস্থায় অনেক ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সব প্রস্তাবই সম্মানের সহিত ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ তখন তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভালভাবে লেখা পড়া করে এস.এস.সিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া। তাই পড়াশুনার প্রতি ছিল তার প্রবল আকর্ষণ। তাইতো ছেলেদের সাথে বেশী মিশত না। সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু পরীক্ষা দেয়ার পর এখন আর সেই অবস্থায় নেই। এখন সে অবসর সময় কাটাচ্ছে। মনে মনে একজন ভাল সঙ্গী খুজছে। সহপাঠীদের মধ্যে অনেককেই তার মনে ধরেছে। কিন্তু এখনতো আর ক্লাস নেই। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। স্কুল পড়াকালীন সময় তার কোন মোবাইল ছিল না বিধায় কোন সহপাঠীর নম্বরও নেই। তাই তাদের কারো সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। এখন সারাক্ষণ শুধু ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে মীম। হঠাৎ একদিন একটি ছেলের একটি স্ট্যাটাস দেখে চমৎকে উঠল মীম।
মনের মতো প্রেমিকা চাই
আমার নাম মুন্না। পুরো নাম সাকিবুল হাসান মুন্না। বয়স ২৫ বছর। অনার্স পাস করেছি সবে মাত্র। এখনও বিয়ে করি নাই। মনের মতো কাউকে পেলে জীবন সঙ্গী করে বিয়ে করতে চাই। আগ্রহী সুন্দরী মেয়েরা আমার ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠালে তার সাথে যোগাযোগ করব।
এই স্ট্যাটাস দেখেতো মীম আশ্চর্য হয়ে গেল। এভাবে কি কেউ সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব করে! আসলে কি ছেলেটা প্রেম করতে চায় নাকি এমনিতেই মজা করছে, তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেল মীম। আর কিছু না ভেবেই তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দিল মীম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মীমের রিকুয়েস্ট গ্রহণ করে সে ম্যাসেজ দিল। হাই মীম।
এবার মীম ভাবছে এখন কি তার সাথে কথা বলবে নাকি ফেসবুক বন্ধ করে দিবে। সাহস হচ্ছে না একজন অপরিচিত ছেলের সাথে কথা বলতে। তাই তার ম্যাসেজে সাড়া না দিয়ে আজকের মতো ফেসবুক বন্ধ করে দিল।
পরদিন আবার যখন ফেসবুক ওপেন করল তখন দেখল ছেলেটি অনলাইনে আছে। কিন্তু আজও সাহস হচ্ছে না। তাকে কি বলবে। দাঁতে নখ কাটছে আর চিন্তা করছে এখন কি করা যায়। এমন সময় ছেলেটি ম্যাসেজ দিল। আপনি কি মীম বলছেন?
এবার মীম আরো চিন্তায় পড়ে গেল এখন কি করবে। যদি তার সাথে কথাই না বলি তাহলে কেন তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম। এই চিন্তা থেকে তার উত্তর দেয়ার জন্য মনস্থির করল।
এবার মীম বুকে সাহস নিয়ে বলছে, জি আমি মীম বলছি।
মীমের সাড়া পেয়ে মুন্না খুব খুশী হলো। এবার মুন্না বলল, আপনি কি আমার স্ট্যাটাস পেয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাইছেন?
জি।
তাহলে কি আপনি রাজি?
একথা বলাতে মীম লজ্জায় লাল হয়ে বলল, এখন বলব না। পরে বলব।
আপনার বাসা কোথায়?
নরসিংদীতে।
নরসিংদীর কোথায়?
ব্রাহ্মন্দীতে।
পড়াশুনা কি করেন?
এবার এস.এসসি দিয়েছি।
পরিবারে কে কে আছে?
আমি আর আমার এক ভাই, বাবা-মা।
আপনার আব্বু কি করেন?
চাকুরী করেন।
মা কি করেন?
গৃহিনী।
এভাবে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে মুন্না আর উত্তর দিচ্ছে মীম। কিন্তু মীম কোন প্রশ্ন করছে না মুন্নাকে। তাইতো মুন্না বললো, আমার সর্ম্পকে আপনার জানার ইচ্ছে নাই?
আছে। এখন না পরে কথা বলব। এখন আসি। এই কথা বলেই মীম সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল।
এখন থেকে মীম প্রতিদিন ফেসবুকে মুন্নার সাথে চ্যাটিং করে। একদিন মুন্না মীমকে যাচাই করার জন্য তার মোবাইল নাম্বার চেয়ে নেয়। তারপর সেই নাম্বারে কল করে অনেকক্ষণ কথা বলে। তারপর থেকে মুন্নার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে মীম। এর মাঝে মীম বুঝে গেছে সে মুন্নাকে ভালবেসে ফেলেছে। মুন্নাকে কথাটা বলা দরকার কিন্তু কিভাবে বলবে যদি সে মুন্নার মনের মতো না হয়। যদি তার ভালোবাসার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তার থেকে না বলায় ভালো, বন্ধু আছি তাই থাকি। ভালোবাসার কথা শুনে যদি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এই ভেবে মীম আর মনের কথাটা বলে উঠতে পারে না। আবার ভাবে তা কেন হবে সেতো মনের মতো প্রেমিকা খুঁজছে। আর আমাকে যদি মনেই না ধরে তাহলে আমার সাথে কথা বলত না।
এদিকে মুন্না দিন রাত মীমকে নিয়ে ভাবছে। কিভাবে তাকে ভালোবাসার কথা বলা যায়। সেও ভাবছে কিভাবে বলবে। ইতোমধ্যে তাকে না দেখেই ভাল লেগে গেছে। তার মনের মতো প্রেমিকা পেয়েছে কিন্তু এখনও বলা হয়নি তাকে সেই প্রেমের কথা। সে সত্যিই আমাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে, নাকি আমার সাথে প্রতারণা করবে। এই নিয়েই ভাবছে। আবার ভাবছে তা কেন হবে সেতো আমার প্রস্তাব দেখেই আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই মীম মুন্নাকে ফোন দিল।
হ্যালো।
আপনি কেমন আছেন?
ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
ভাল আছি।
মুন্না আপনাকে একটা কথা বলার আছে।
হ্যা বলেন।
আচ্ছা আপনার কি কাউকে ভাল লাগে?
হুম লাগেতো।
কাকে?
এই যে আপনাকে!
প্লিজ মুন্না ভাই মজা করবেন না।
মজা করলাম কৈ?
এই যে বলছেন আমাকে আপনার ভাল লাগে!
তাতো সত্যিই বলছি।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ সত্যি।
কেন ভাললাগে আমাকে? ভালো লাগার মত কি দেখছেন আমার মাঝে?
তা বলতে পারব না। তবে ভাল লাগে আপনাকে। আর ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা হয়। আমি আপনাকে ভালোবাসি।
কি বললেন! আপনি আমাকে ভালোবাসেন? এটা কি মনের কথা?
কেন এতদিনের বন্ধুত্বের সর্ম্পকের মধ্যে কি আমাকে বুঝতে পারেন নাই?
পেরেছি। আমি সত্যি একজন ভাগ্যবতী মেয়ে যে আপনার মতো সুন্দর মনের একজন ছেলে পেয়েছি। কিন্তু আপনিতো আমাকে দেখেন নাই। না দেখে কি এভাবে ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়া ঠিক?
তাতে কি হয়েছে? আপনিতোও আমাকে দেখেন নাই। আর সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন, ভালোবাসার জন্য সুন্দর একটা মন লাগে। দেখার প্রয়োজন হয় না।
দেখা হলে ভাল হতো না। যেমন ধরুন আপনি আমাকে কল্পনা করেছেন এক রকম আর আমি হলাম অন্যরকম। তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে? তখনতো আমাকে নাও ভালোবাসতে পারেন?
এমনটা হবে না। কারণ আপনি যেমনই হউন না কেন আমি আপনাকে না দেখেই ভালোবেসেছি। আমি একজন মনের মতো সঙ্গী চেয়েছি। আপনি আমার অন্তরে ঢুকে গেছেন। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে মেয়ে এত সুন্দর করে কথা বলে আমার মতো ছেলেকে পাগল করতে পারে সে অবশ্যই সুন্দর হবে। তাছাড়া ফেসবুকেতো আপনার ছবি দেখলাম।
সেটাতো আমার নাও হতে পারে।
আমার বিশ্বাস এটা আপনারই ছবি।
আপনার ধারনা ভুল হতে পারে। আমি যদি কালো মেয়ে হই?
তাতে কি হয়েছে। কথায় আছে- জাতের মেয়ে কালোও ভাল।
তাই বলছেন?
তারপরও বলছি সরাসরি দেখে নিলে ভাল হয়।
আপনার দেখার ইচ্ছে থাকলে দেখা করব। কিন্তু তার আগেই আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা। আপনি রাজি কিনা বলুন।
এবার মীম লজ্জায় পড়ে গেল। বেশীরভাগ মেয়েরাই ভালোবাসার কথা সরাসরি মুখে বলতে পারে না। আকার ইঙ্গিতে বুঝাতে চায়।
আপনি বুঝতে পারেন নাই?
কিভাবে বুঝব? আপনি যদি খুলে না বলেন।
সব কথা কি খুলে বলতে হয়। কিছু কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।
মুন্না মীমের কথায় বুঝতে পেরেছে সে রাজি। কিন্তু তারপরও তার মুখ থেকে কথা শুনার জন্য বলল, আমি বুঝতে চাই না। সরাসরি বলুন।
এবার লজ্জা মাখা কণ্ঠে ক্ষীণ স্বরে মীম বলল, রাজি।
তাহলে আর আপনি নয়। এখন থেকে তুমি হবে।
ঠিক আছে মুন্না আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি শুধু আমার। কথা দাও আর কাউকে তুমি ভালবাসতে পারবে না।
কথা দিচ্ছি আমি তুমি ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসব না। বিয়ে যদি করতে হয় তোমাকেই করব।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ সত্যি।
তাহলে আজ রাখি।
ঠিক আছে।
ওকে বাই বাই বলে ফোনটা কেটে দিল মীম।
আজ মুন্না ও মীমের মনটা ফুরফুরে। কেউ কাউকে না দেখে শুধু ফেসবুকের পরিচয়ে ভালোবাসা হয়ে গেল। এখন শুধু দু‘জনার মধ্যে ভাবনা কখন দেখা করবে। ইতোমধ্যে দু’জন দু’জনার ছবি দেখেছে। প্রতিদিন কথা হয়। ফেসবুকে চ্যাটিং হয়। এত কিছুর পরও তাদের মন ভরে না। কি যেন অপূর্নতা রয়ে গেছে। দু’জনের দেখা হওয়া দরকার। তাহলেই তাদের প্রেমের পূর্ণতা ফিরে আসবে। তাইতো দু’জন সিদ্ধান্ত নিল দেখা করবে। কখন কিভাবে দেখা করবে সেই নিয়ে আলোচনা চলছে। মুন্না থাকে ঢাকায় আর মীম নরসিংদীতে। মীম মুন্নাকে বলল, নরসিংদীতে আসতে। মুন্না রাজি হলো। দিন তারিখ ঠিক হলো ২৬ মার্চ বিজয় দিবসে একে অপরের সাথে দেখা করবে।
আজ ২৬ শে মার্চ। সেই কাক্সিক্ষত দিন। এই দিনে দেখা করবে মীম ও মুন্না একে অপরের সাথে। নতুন করে আবার ভালোবাসা বিনিময় করবে এই দিনে। কিভাবে দেখা করবে, কোন পোশাক পড়ে যাবে এই নিয়ে দু’জনেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আজ মীম নীল রঙের একটা শাড়ী পড়েছে। কপালে লাল টিপ দিয়েছে। ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে। হাইহিল জুতা পড়েছে। কাঁধে একটি ব্যানিটি ব্যাগ নিলো। মুন্নার জন্য একটি লাল গোলাপ নিলো। তারপর দুপুর ১২:০০ টায় নরসিংদী সরকারি কলেজে আসলো। কলেজের পুকুর পাড়ে বসে আছে মীম। কখন আসবে মুন্না এই অপেক্ষায়।
এদিকে মুন্না সকাল থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে একটি কালো ব্লেজার পড়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। সেও একটি লাল গোলাপ ও একটি রজনী গন্ধা ফুল নিয়ে আসল। মুন্না কলেজ গেইটে এসেই মীমকে ফোন দিল।
হ্যালো মীম।
হ্যালো মুন্না তুমি কোথায়?
আমি কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে আছি।
ঠিক আছে তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।
মীম দূর থেকে দেখতে পেল। একটি ছেলে ফুল হাতে কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। ফেসবুকের ছবি অনুযায়ী বুঝা যাচ্ছে এই সেই মুন্না। কিন্তু তারপরও তাকে যাচাই করার জন্য আরেকটু কাছে এসে তাকে আবার ফোন দেয়। মুন্না ফোনটি রিসিভ করে কানে দিতেই মীম লাইনটা কেটে দিল এবং বুঝতে পারল এই হচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষ মুন্না। তারপর তার কাছে এসে বলল, তুমি নিশ্চয় মুন্না।
হ্যাঁ আর তুমি মীম।
হ্যাঁ।
পরিচয় পেয়ে দ‘ুজন আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলে। বিশেষ করে মুন্না মীমকে দেখে চোখ আর নিচে নামাতে পারছে না। একি দেখছে সে। এটা কি সত্যিই মীম। এত সুন্দর মীম। তা সে কল্পনাও করে নাই। আর মুন্নাও দেখতে হ্যান্ডসাম স্মার্ট, শিক্ষিত টগবগে যুবক। যা সে কল্পনা করে নাই তার চেয়ে বেশী।
এবার মীম বলল, কি ব্যাপার এভাবে কি দেখছ।
তোমাকে! জীবনের প্রথম দেখছি। তাই চোখ নামাতে পারছি না।
ঠিক আছে। প্রাণ ভরে দেখ। এখানে নয়। চল কোথাও বসি।
দু’জনে হাটঁতে হাঁটতে পুকুর পাড় একটি বেঞ্চে গিয়ে বসল। তারপর একে অপরকে ফুল দিয়ে নতুন করে ভালোবাসা বিনিময় করল। তাদের মধ্যে অনেক কথা হল। ভবিষ্যত পরিকল্পনা হলো। কিভাবে তাদের ভালোবাসাকে সফল করা যায় তা নিয়ে কথা হলো। এখন থেকে কিভাবে সাক্ষাত হবে তা নিয়ে কথা হলো। কথা বলতে বলতে বিকাল হয়ে গেল। দু’জনে স্টেশনে গিয়ে হোটেল থেকে খেয়ে নিল। বিকাল ৪:০০টায় মুন্না বিদায় নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।
দিন যত যাচ্ছে মুন্না ও মীমের প্রেম তত গাঢ় হচ্ছে। ইতোমধ্যে মীমের পরিবার ও বন্ধু বান্ধব সবাই এই ব্যাপারটা জেনে গেছে। একদিন এই ছেলের ব্যাপারে মীমকে অনেক শাসন করেছে তার বাবা। তাকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করেছে। তুমি সবে মাত্র এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছ। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তোমাকে ডাক্তার বানাবো। তোমাকে এইচ.এস.সিতে অনেক ভাল রেজাল্ট করতে হবে। এই সব বাজে চিন্তা বাদ দাও। কিন্তু কে শুনে কার কথা। মীম বাবার এই উপদেশকে খারাপ চোখেই দেখছে। প্রতিটা দিন কাটে এখন মুন্নার সাথে ফোন করে। ফেসবুক চ্যাটিং করে। বিশেষ করে বাবা মা যখন ঘুমিয়ে যায় তখন সারা রাত কথা বলে। এভাবে তিন মাস পার করে দিল। ইতোমধ্যে মীমের পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। দারুণ খুশী মীম ও মীমের মা বাবা। কিন্তু মীমের বাবা খুবই চিন্তিত তার ভবিষ্যত নিয়ে। মেয়ে যেভাবে প্রেমে জড়িয়ে গেছে তাকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে অনেক চেষ্টা করেছে। আদরের মেয়ের উপর হাত পর্যন্ত তুলেছে কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি।
একদিন মীমের মা বাবা পরামর্শ করলো তার মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়া হবে। তাই করা হলো। এই নিয়ে বাবা মায়ের সাথে মীমের তুমুল ঝগড়া হয়। দুদিন না খেয়ে থাকে। মেয়েকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই বুঝ মানছে না অবুঝ মীম।
এই দিকে মুন্না মীমের মোবাইল বন্ধ থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। সে কি ভুলে গেল কিনা তা জানার জন্য মীমের বান্ধবী লুবনাকে ফেসবুকে ম্যাসেজ দেয়। লুবনা মীমের পরিবারের কথা জানায়। অপরদিকে মীমও ইতোমধ্যে তার বাবাকে জানিয়ে দিল, তোমরা যদি আমার মোবাইল না দাও তাহলে আমি আত্মহত্যা করব।
এ কথা শুনে মীমের বাবা মা আশ্চার্য হয়ে গেল। বাবা বলল, একি বলছিস তুই! এসব অলক্ষণে কথা মুখে আনতে নেই। তুই মুন্নাকে ভুলে যা। তার ফেসবুক আইডি ও মোবাইল নাম্বার ডিলেট করে দে। আমি মোবাইল দিয়ে দিব।
আমি মুন্নাকে ভুলতে পারব না। আর মোবাইল ছাড়াও থাকতে পারব না। মোবাইল দিবে কিনা বল। না দিলে আমি বিষ খাব।
মেয়ের যে জিদ কখন জানি কি করে বসে। তাই ভয়ে বাবা তার মোবাইল ফেরত দিল।
মোবাইল পেয়ে মীম খুশী। আজ রাতেই মুন্নাকে কল দিল।
হ্যালো মুন্না।
মীম তুমি! কোথায় ছিলে দুইদিন। মোবাইল বন্ধ কেন?
বাবা মা তোমার আমার প্রেমটাকে ভালো চোখে দেখছে না। তাই তারা মোবাইল বন্ধ করে দেয়। আজ ভয় দেখিয়ে মোবাইল নিলাম।
আমিতো ভাবছি তুমি আমাকে ভুলে গেছ?
তা কখনো সম্ভব নয়। জীবন গেলেও তোমাকে ভুলতে পারব না। আমি এখানে থাকলে তারা তোমার সাথে কথা বলতে দিবে না।
তাহলে কি করব?
আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। পালিয়ে বিয়ে করব আমরা।
এসব কি বল!
হ্যাঁ তা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই।
আমার কোন চাকরী নেই। মাস্টার্স পড়াও শেষ হয়নি। এই মূহূর্তে বিয়ে করি কি করে?
টাকার চিন্তা তোমার করতে হবে না। তুমি শিক্ষিত ছেলে চাকরীর অভাব হবে না। আমি যত পারি টাকা নিয়ে আসব।
কিন্তু বাবা মাকে না জানিয়ে এভাবে বিয়ে করা কি ঠিক হবে?
ঠিক বেঠিক আমি জানতে চাই না। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে কিনা সেটা বল।
রাগ করছো কেন? মাথা ঠান্ডা কর।
তুমি বিয়ে করলেই আমার মাথা ঠান্ডা হবে অন্যথায় নয়। যে কোন সময় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
মুন্না এবার চিন্তায় পড়ে গেল। কি করবে বুঝতে পারছে না। এমন ভালোবাসার মানুষকে হারাতেও চায় না। আবার বাবা মাকেও কষ্ট দিতে চায় না। উভয় সংকটে মুন্না।
কি ব্যাপার কথা বলছ না কেন?
কি বলব?
কাল আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। রাজি।
আচ্ছা তোমাকে পরে জানাচ্ছি।
না এখনই বলতে হবে। পরে যে কথা বলতে পারবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। তোমাকে এখনই সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।
আর কিছু ভাবতে পারছে না মুন্না। আর কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেলল, ঠিক আছে। তবে কখন কিভাবে যাবে?
আমি আগামী কাল দুপুর ১২টার দিকে কলেজ গেইটে থাকব। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যাবে।
ঠিক আছে।
তারপর আরো দশ মিনিট দুজনের মধ্যে কথা হয়। কিভাবে পালিয়ে যাবে। কোথায় যাবে। কোন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবে ইত্যাদি নানা কথাবার্তা।
এপ্রিলের ১৪ তারিখ। বাংলা পহেলা বৈশাখ। আজ তারা পালিয়ে বিয়ে করবে। কথা অনুযায়ী যথাসময়ে দ’ুজন কলেজে মিলিত হয় এবং এখান থেকে দু’জন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। মেয়েকে বাসায় ফিরতে না দেখে চিন্তায় পড়ে গেল মীমের বাবা মা। বিকেল গড়িয়ে রাত হলো। মীমের মোবাইলও বন্ধ পাচ্ছে। আত্মীয় স্বজনের বাসায় খোঁজ নিয়েও দেখলো কোথাও যায়নি। চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল মুন্না মীম পালিয়ে বিয়ে করেছে। ইতোমধ্যে এই খবরটি পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেলে। ফেসবুকেও মুন্না-মীমের বিয়ের খবরটি ছড়িয়ে পড়ছে। শিরোনাম দেয়া হচ্ছে ‘ফেসবুকে পরিচয় অতপর পালিয়ে বিয়ে!’
রচনাকালঃ ০৬/০২/২০১৫খ্রি: