ট্যাগ আর্কাইভঃ জীবনের গল্প

জীবনের গল্প-১৬

জীবনের গল্প-১৫-এর শেষাংশ: সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখাচ্ছিল।

সেসময় কালাম সত্যিই ব্যস্ত ছিলো, টেনশনও ছিলো। কালামের ব্যস্ততা আমাদের জন্যই। কারণ আমরা ওঁদের বাড়িতে উঠেছি অনেকক্ষণ হলো, অথচ এখনো আমাদের ভাত খাওয়া হচ্ছে না, তাই ওঁর যত ব্যস্ততা। তাই ও বাজার থেকে বাড়ি এসে ওঁর মা ভাবীর সাথেও কথা কাটা-কাটি করে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলছে। আমরা ওর সাথে বাড়ি গেলাম। ওকে নিয়েই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ কালামদের ঘরে বসেই দেরি করলাম। এরপর কালামকে সাথে নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম, নিকটস্থ কোনও বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। তখন একেবারে সন্ধ্যা হয়ে চারদিক ঘুট-ঘুটে অন্ধকার। ঘর থেকে বের হয়েই কালামকে জিজ্ঞেস বললাম, ‘সামনা-সামনি কোনও হাট-বাজার আছে কিনা?’ কালাম বললো, ‘আছে ওস্তাদ! কেন, বাজারে যাবেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমাদের বাজারে নিয়ে চলো।’ যেই কথা, সেই কাজ। নৌকা চড়ে তিনজন চলে গেলাম, একটা গ্রামের পরই গ্রাম্য বাজারে। বাজার থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আসার সময় আমার প্রয়োজন মতো সিগারেটও নিয়ে নিলাম।

ওদের বাড়ি এসে সোজা পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। তখন ঠাকুরবাড়ির নারায়ণ সরকারও ঘাটে বসা ছিলো। আমাদের দেখে কালামকে বললো, ‘তোর ওস্তাদকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যা। বাড়িটা দেখা।’ এরপর কালাম আমার হাত ধরে টানা-টানি শুরু করলো, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যাওয়া জন্য। কালামের টানা-টানিতে আর থাকতে পারলাম না, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যেতেই হলো। ঠাকুরবাড়ির ভেতরে অনেক বড় উঠান। উঠানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই, আমাদের বসার জন্য একটা ছোটো ছেলে দুইটা পিড়ি একটা হাতল ভাঙা চেয়ার সামনে এনে দিলো। কালাম আমাকে হাতল ভাঙা চেয়ারে বসতে বলে, ওরা দুইজন বসলো, পিড়িতে। আমি চেয়ারেই বসলাম। একটু পরই বড় এক কাঁসার বাটিতে করে কিছু পাকনা পেয়ারা আমাদের সামনে এনে দিলো। আমরা তিনজনই পেয়ারা খাচ্ছিলাম।

ঘাট থেকে বাড়ির মুরুব্বি আমাদের সামনে এসে আরেকটা পিড়িতে বসলো। আমাকে খেটে-খুটে অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলো, আমি উনার কথার জবাব দিলাম। তারপর উনি আগামীকাল কালাম-সহ আমাদের তিনজকে ঠাকুরবাড়িতে দুপুরে খাবারের নেমন্তন্ন করলো। আমি না করে বললাম, ‘আগামীকাল সকালেই আমরা এখান থেকে বালি গাঁও চলে যাবো। বালিগাঁ থেকে সন্ধ্যার আগেই আবার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হবো।’ কালাম আমার কথা শুনে বালি গাঁও যেতে বারণ করে বললো, বালি গাঁও যাওয়ার দরকার নেই, ‘ওস্তাদ। আগামীকাল আমাদের বাড়িতে থাকবেন।’ কালামের কথা শুনে কানাইও কেমন যেন আমতা-আমতা করতে লাগলো, কিন্তু কিছু বলছিল না। বুঝলাম, কানাইও বালি গাঁও না গিয়ে এখানেই থাকতে চাচ্ছে। তারপর আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, থাকি-না-যাই তা সকালে দেখা যাবে, এখন চলো পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।’ পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসে কালামদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনজন একইসাথে ঘুমালাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কানাইকে বলছি, ‘তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে।’ কানাই আমতা-আমতা করতে লাগলো। ওর ভাব দেখে বুঝতে পারলাম, ও আজকে এখানে বেড়াতে চাচ্ছে। কালামের মা আমার সামনে এসে বললো, ‘আজকের দিনটা এখানে থেকে যাও। কালকে আর জোর করবো না।’ কালামের ভাই ভাবীও বলতে লাগলো। কানাইও বললো ‘আজকে এখানে থাকি। কালকে চলে যাবো। বন্ধ তো হাতে আরও একদিন থাকবেই। আজকে থাকলে আর সমস্যা হবে না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে, থাকলাম। আমার কথা শুনে কালামের মা ভাই ভাবী সবাই খুশি হলো। আমি আর কানাই মুখ ধুতে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। আমাদের সাথে-সাথে কালামও ঘাটে আসলো। আমরা একটা আমগাছের ঢালা ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। কালাম ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে নারায়ন সরকারকে বললো, ‘ওস্তাদ আজকে এখানে থাকবে।’ ওমনি ঠাকুরবাড়ি থেকে দুইটা মেয়ে হাসতে হাসতে কয়েকটা থালাবাসন হাতে নিয়ে পুকুর ঘাটে আসলো। আমি আর কানাই বসে বসে দাঁত মাজতে ছিলাম।

মেয়ে দুইটা দেখে বুঝা যাচ্ছিল না যে, কোনটা বড় আর কোনটা ছোট। দু’জনকে একই বয়সের মনে হলো। আসলে ওরা ছোট-বড় দুই বোন। কিছুক্ষণ পর কালাম ঘাটে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ মুখ ধুয়েছেন?’ বললাম, না, এখনও ধোয়া হয়নি।, মেয়ে দুইটা তখনও পুকুর ঘটে থালাবাসন ধুইতে ছিলো। কালাম ওদের বললো, ‘তোরা ওস্তাদকে সাইট দেয়, মুখ ধোবে।’ আমি কালামকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘ওদের কাজ ওরা করুক। আমরা পরেই ধুই।’ কালাম আমাকে বললো, ‘ওস্তাদ, ওরা দুই বোন। এইযে, ওর নাম জোসনা, ওর নাম আর্চনা। জোসনা বড়, আর অর্চনা ছোট।’ নাম জানা হলো। দেখাও হলো। কিন্তু এখনো কথা হয়নি।

মেয়ে দুইটা ওদের কাজ সেরে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে গেলো। আমারা ঘাটে নেমে হাতমুখ ধুয়ে অস্তেধীরে কলামদের বাড়ি গেলাম। নাস্তা করলাম। এমন সময় কালাম এসে ওর মাকে বললো, ‘মা ওস্তাদ দুপুরে ঠাকুরবাড়ি খাবে। আমারও ওস্তাদের সাথে যেতে হবে।’ আমি থমকে গেলাম! জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুরবাড়িতে খাবো কেন?’ কালাম, হাসতে-হাসতে বললো, ‘ওস্তাদ নারায়ন সরকার খুব অনুরোধ করছে। তাই আমি বললাম।’ কালামের কথা শেষ হতে-না-হতেই কালামের মা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা, আজ খুব ভোরবেলা নারায়ন সরকার আমাদের বাড়ি এসে আপনাকেও অনুরোধ করেছে, যাতে দুপুরবেলা তোমরা ঠাকুরবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করো। অমত করো না বাবা। বুড়ো মানুষ বলেছে যখন, আজকে দুপুরবেলা ঠাকুরবাড়িতেই খেও।’ কালামের মায়ের কথা শুনে আমি চুপ করে ঘর থেকে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানছি আর চিন্তাও করছি! খালি হাতে নেমন্তন্ন খেতে যাবো না!

কালামকে ডাকলাম। কালাম সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ কিছু বলবেন?’ বললাম, নৌকা রেডি আছে? কালাম বললো, ‘হ্যাঁ ওস্তাদ, নৌকা ঘটলায় বাঁধা আছে। কোথাও যাবেন?’ বললাম, বাজারে যেতে হবে। কালাম বললো, ‘ঠিক আছে যাবো। আগে নাস্তা খেয়ে নিন, তারপর।’ তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে কানাই সহ নৌকা চড়ে সুবছনী বাজারে গেলাম। বাজারে গিয়ে তিনজনে চা-বিস্কুট খেলাম। তারপর মিষ্টি দোকান থেকে দুই কেজি মিষ্টি কিনলাম। সাথে পান সূপারিও কিনলাম। কালাম রাগ হয়ে বললো, ‘এতকিছুর দরকার কী ওস্তাদ?’ বললাম, ‘দরকার আছে কালাম। নেমন্তন্ন খালি হাতে মানায় না। তাছাড়া তোমাদেরও তো মানসম্মান আছে। আমিতো তোমাদের অতিথি।’ কালাম আর কিছু বললো না, চুপ করে থাকলো।

সুবচনী বাজার থেকে কালামদের বাড়ি যেতে যেতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। কানাই মিষ্টির প্যাকেট-সহ পান সুপারি নিয়ে কালামের মায়ের হাতে দিলো। মিষ্টি দেখেই কালামের মা বুঝতে পেরেছে, মিষ্টি কেন অনা হলো! কালাম তাড়াহুড়ো করতে লাগলো, স্নান করার জন্য। গামছা সাবান নিয়ে কালাম-সহ ঠাকুরবাড়ির ঘাটে গেলাম, স্নান করার জন্য। স্নান করতে যাওয়ার সময়ই কালাম আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ আমি একরকম রাগ-রাগ ভাব নিয়েই বললাম, ‘আরে তোমাদের মাথা কি সত্যি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? আমি কি বিয়ে করতে এসেছি? নাকি মেয়ে দেখতে এসেছি!’ কালাম মুখটা কালো করে ফেললো। তা দেখে আমি নিজেই লজ্জায় পরে গেলাম! তারপর কালামের মনটা ভোলো করার জন্য কালামকে বললাম, ‘আচ্ছা, তোমার কাছে কোনটা ভালো লাগে?’ কালাম বললো, ‘ওস্তাদ, মেয় দুইটাই তো দেখার মতো।এখন কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি?’ কালাম আবার কানাইকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কানাই ভাই, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ কানাই বললো, আমার কাছে দুইটাই ভালো লাগে।’ আমি কালামকে বললাম, ‘আমার কাছে ছোটটা ভালো লাগে।’ আমার কথা শুনে কানাই আর কালাম দুইজনেই হাসলো।

পুকুর ঘাটে গেলাম। স্নান করে কালামদের বাড়ি গেলাম। জামা-প্যান্ট পরে রেডি হলাম, ঠাকুরবাড়ি যাবার জন্য। মিষ্টি পান সুপারি কালাম হাতে নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে। আমরা ওর পেছনে-পেছনে হাঁটছি। ঠাকুরবাড়ি গেলাম। কালাম মিস্টির প্যাকেট নিয়ে বড় ঘরের ভেতরে গেলো। মিষ্টি পান সুপারি দেখা আমাদের সমাদর আরও দুইগুণ বৃদ্ধি পেলো। আমরা উঠানে দাঁড়াতেই ঐ হাতল ভাঙা একটা ছেয়ার আর একটা পিড়ি এনে দিলো। কালাম ঘরে গিয়ে মিস্টির প্যাকেট আর পান-সুপারির পোটলা কারোর হাতে দিয়ে আমাদের সামনে উঠানে আসলো। বসার জন্য আরেকটা পিড়িও সাথে নিয়ে আসলো। তিনজনে বসে কথা বলতে বলতেই বড় ঘরে ডাক পড়লো। বড় ঘরে গিয়ে খাটের পর বসলাম। আমাদের সামনে তিনটা প্লেটে সাজানো কিছু মিষ্টি চলে আসলো। কালাম খেলো কানাইও খেলো। কিন্তু আমি খাইনি। কারণ মিষ্টি খেলে আর ভাত খেতে পারবো না, তাই।

কিছুক্ষন পরই ভাত খেতে দিলো। আমরা তিনজন একসাথে বসে ভাত খেলাম। ভাত খেতে বসে কালামের মনের ভাব দেখে বুঝলাম, কালাম মনে হয় মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢোকার পর আমার পছন্দের ব্যাপারটা ওদের কারো কাছে বলেছিল। এইজন্যেই মনে হয়,আমাদের খাওয়া-দাওয়ার সামনে ছোট মেয়েটা বেশি আসেনি। আমাদের খাওয়া-দাওয়া পরিবেশন করেছিল অবিবাহিত থাকা দুই বোনের মধ্যে বড় মেয়েই। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঠাকুরবাড়ি থেকে বের হয়ে সামনে থাকা পুকুর ঘাটে গেলাম। পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ বসে গল্প করছে। সাথে কালামের বড় ভাই সালামও আছে। তাঁদের কথাবার্তার ভাবে বুঝলাম, তাঁরা আমাদের নিয়েই আলাপ আলোচনা করছিলো।

সিঁড়ি ঘাটলার উপরে গিয়ে সালাম ভাইয়ের সাথে বসলাম। সালাম ভাই জিজ্ঞেস করলো, কী দিয়ে খাওয়া হলো?’ জবাবে যা যা খেলাম আর যেসব আয়োজন করেছিলো, সবই বললাম। পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসার পরই ঠাকুরবাড়ি থেকে ছোট একটা ছেলে অনেকগুলো পান সুপারি নিয়ে আসলো। সবাই পান খেলো, আমি কানাই আর কালাম পান খেলাম না। কিছুক্ষণ পর সালাম ভাই-সহ আমরা কালামদের বাড়ি চলে গেলাম। কালামের মা জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন খেলে বাবা?’ বললাম, ‘ভালোই খেয়েছি খালা।’ বললো, ‘গরিব হলেও আত্মা আছে লোকটার! তো মেয়ের হতে কিছু দিয়ে এসেছ নাকি?’ আমি আর কিছু বললাম না, কানাই বললো, ‘আমরা কি মেয়ে দেখতে গেছি নাকি, খালা? আমরা নেমন্তন্ন খেতে গেছি।’ কালামের মা আর কিছু বলেনি, ঘরে গিয়ে বসতে বললো। আমি আর কানাই শোবার ঘরে গিয়ে বসতেই কালামের মা একটা পানের ঢালা হতে নিয়ে আমাদের সামনে এসে বসলো। আমাদের পান খেতে বললে, আমরা না করলাম। কালামের আমাদের বিশ্রাম করতে বলে ঘর থেকে চলে গেলো। তখন শেষ বিকালের শেষ সময়। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। তাই বিশ্রাম আর করলাম না, কালামকে সাথে নিয়ে নৌকা চড়ে ঐ গ্রাম্য বাজারেই গেলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যার পর কালামদের বাড়িতে আসলাম।

কালামদের বাড়িতে এসে জামা-প্যান্ট চেঞ্জ করে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। সেদিন পুরো নয়াবাড়ি গ্রাম জানা-জানি হয়ে গিয়েছিল, নারায়ণ সরকারে মেয়েকে দেখতে এসেছে। তাই সেদিন পুকুর ঘাটে অন্যদিনের চেয়ে বেশি মানুষ লক্ষ্য করলাম। অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। অনেককেই সিগারেট দিলাম। কালামও পুকুর ঘাটে বসে বসে উপস্থিত থাকা সকলকে আমার কাজের গল্প শোনালো। অনেকক্ষণ পুকুর ঘাটে আড্ডা দিয়ে কালামদের বাড়ি এসে গেখি কালামে ভাবী আমাদের জন্য খাবার রেডি করে বসে আছে। আমি খাব-না-খাব না বলার পরও সবার সাথে খেতেই হলো। নামমাত্র দুমুঠো খেয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে সিগারেট টেনে ঘরে আসলাম। শোবার ঘরে বসে ঘুমিয়ে থাকার ভাব করছিলাম। এমন সময় কালামের মা আমাদের সামনে এসে বসলো। হাতে পানের ঢালা। আমাদের পান খেতে বললে, আমার না করলাম।

কালাম মা উনার নিজের জন্যই একটা পান বানিয়ে মুখে দিয়ে নিজে নিজেই বললো, ‘ঠাকুরবাড়ির অনেক কাহিনী আছে বাবা।’ শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে বললাম, কেমন কাহিনী, খালা? বললো, “নরায়ন সরকার যেই বাড়িতে থাকে, এটা কিন্তু তার নিজের বাড়ি না। এই বাড়িটা সত্যগুরু নামে এক ঠাকুরের বাড়ি। আর নারায়ণ সরকার হলো, সত্যগুরুর শিষ্য। নারায়ণ সরকারের বাড়ি ছিলো পদ্মার পড়। একসময় নারায়ণ সরকারের বসতভিটা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে, নারায়ণ সরকার এই সত্যগুরুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সত্যগুরু ঠাকুর জীবিত থাকতে ওই বাড়িতে কোনও চোর চুরি করতে পারেনি। চুরি করতে আসলেই সারারাত আটকা পড়ে থাকতে, যেতে পারতো না। সকালবেলা সত্যগুরু ঘুম থেকে ওঠে চোরকে শাসিয়ে ছাড়ত।’

‘আর পুকুরের ছিল এক অলৌকিক কাণ্ড! কারোর বিয়েসাদী হলে পুকুরপাড়ে এসে থালা-বাসনের কথা বললেই হতো। পরদিন ভোরবেলায় পুকুর ঘাটে থালাবাসন ওঠে থাকত। বিয়ে বা অন্যকোন ধর্মীয় কাজ ছিল মুখ্য বিষয়, এ ছাড়া অন্য কাজের জন্য নয়। কাজ শেষে থালা- বাসনগুলো ভালো করে ধুইয়ে আবার পানিতে ছড়ে দিতো। একদিন ঘটলো এক অন্যরকম ঘটনা। বিয়ের কাজ শেষে পুকুরের থালা-বাসন থেকে একটা কাঁসার থালা কেউ-না-কেউ রেখে দিয়ে, বাদবাকি থালাবাসন যখন পুকুরে দিচ্ছিল; তখন থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবছিলো না। তিনদিন যাবত থালা- বাসনগুলো ওইভাবেই পুকুরে ভাসমান অবস্থায় ছিল। তিনদিন পর থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবেছে ঠিক, কিন্তু কেউ আর কখনো কিছু চেয়ে পায়নি।’ এসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল সত্যগুরু জীবিত থাকতে।’

‘একসময় সত্যগুরু মারা যায়। সত্যগুরু মারা যাবার পর সত্যগুরুর ফ্যামিলি বেশ কয়েকবছর এই বাড়িতে ছিলো।হিন্দু-মুসলিম রায়টের পর একসময় সত্যগুরুর ফ্যামিলি নারায়ণ সরকারকে এই বাড়ির দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ভারতে চলে যায়। সেই থেকেই নারায়ণ সরকার এই বাড়ি নিজের বাড়ির মতো করে থাকছে।” কালামের মা আমাদের ঠাকুরবাড়ির গল্প শুনিয়ে শুয়ে থাকতে বললে, আমরা আগের রাতের মতো তিনজন একসাথে শুয়ে থাকি। পরদিন সকালবেলা

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়েটা কালামের বড় ভাবীর সাথে বসে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখেই চলে যাওয়া প্রস্তুতি নিতেই, কালামের বড় ভাবী ধমক দিয়ে বসতে বললো। মেয়েটিও চুপচাপ বসে থাকলো। কানাই আমার আগেই ঘুম থেকে উঠে আম পাতা মুড়িয়ে কালামদের উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিল। আমাকে দেখেই কানাই মেয়েটির দিকে আমাকে ইশারা দিয়ে দেখালো। আমিও কানাইকে হাতে ইশারা দিয়ে কাছে ডাকলাম। কানাই আমার সামনে আসলে, আমি মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্য কানাইকে বললাম। কানাই মেয়েটিকে কিছু না বলে আমাকেই মেয়েটির সাথে কথা বলতে বললো। আমি কানাই উপর রাগ না করে মেয়েটির সামনে গিয়ে ভাবীকে বললাম, ‘ভাবী, আমাদের জন্য কোনকিছুর আয়োজন করবেন না। কিছুক্ষণ পর তো চলেই যাচ্ছি।’ কালামের বড় ভাবী বললো, ‘সকালের নাস্তা রেডি করছি ভাই। নাস্তা না খেয়ে তো আর যেতে পারবেন না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে ভাবী, নাস্তা খেয়েই রওনা দিবো। তো আপনার সামনে মেয়েটি কে?’ ভাবী বললো, ‘ও-তো ঠাকুরবাড়ির সরকারের ছোট মেয়ে।’ আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নাম কি?’ মেয়েটি ওর নাম না বলে আমতা-আমতা করতে লাগলো। ভাবী ধমক দিয়ে বললো, ‘তোর নাম জিজ্ঞেস করছে, তুই তোর নাম বলছিস না কেন? নাম বলতে কি টাকা-পয়সার দরকার হয়?’ ভাবীর ধমক শুনে মিয়েটি নিজের নাম বললো। কয় ভাই-বোন বললো। লেখাপড়া কতটুকু বললো। কোন স্কুলে পড়ছে তা-ও বললো। কানাই আমার সামনেই দাঁড়িয়ে শুনছিলো। তারপর বললাম, তুমি এখন বাড়ি যাও, আবার দেখা হবে, কথাও হবে।

মেয়েটি মাথা নিচু করে বাড়িতে চলে গেলো। আমারা হাতমুখ ধুয়ে নামমাত্র কিছু খেয়ে কালামদের বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। নৌকায় উঠার আগে ঠাকুরবাড়ি গেলাম। ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে বাড়িতে থাকা সবার কাছে বলেকয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। কালাম নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজার নিয়ে এলো। ঢাকার লঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটেই ছিলো। একসময় লঞ্চ আসলে কানাই আর আমি লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে রওনা রওনা হলো। মাঝপথে ফতুল্লা লঞ্চঘাট নেমে নিজের বাসায় চলে গেলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৫

জীবনের গল্প-১৪-এর শেষাংশ: দুইদিন পর থেকে কাজ জয়েন্ট করবো বলে, অফিস থেকে বের হলাম। নিচে এসে সব তাঁতিদের সাথে দেখা করে মিল থেকে বের হওয়ার সময় মিস্ত্রি আমার হাতে ২০০/= টাকা দিয়ে বললো, এটা আজকের কাজের মজুরি। ২০০/= টাকা থেকে কানাইকে ১০০/= টাকা দিয়ে মিল থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় গিয়ে বড় দাদাকে সবকিছু জানালাম। বড়দাদা খুশি হলেন। মাও খুশি হলেন। পরদিন সকালে ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কানাইকে নিয়ে কাজ করলাম। কাজ সেরে বড় দাদাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, আমি ফরিদপুর যাওয়ার পর যেই লোক কাজ করেছিলো; আগামীকাল থেকে ফতুল্লার ঐ লোকই এখানে কাজ করবে। জানানোর পর ম্যানেজার সাহেব রাগ করিনি। রাগ না করার কারণও ছিলো, কারণ হলো, ফাইন টেক্সটাই মিলের কাজ হলো চুক্তিতে। ভীম প্রতি ৭০ টাকা। এতে প্রতিমাসে আমি ২০০০/= টাকার বেশি রোজগার করতে পারতাম না। আর এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানে বেতনভুক্ত। কাজ হোক আর না হোক, মাস শেষে আমার মূল বেতন হতে আসবেই। ম্যানেজার সাহেব আমার বেতন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, বেতন কত? বললাম, ‘বেশি না স্যার, মাত্র ৬০০০/=টাকা। তা শুনে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি হলেন।

এরপর ফতুল্লা গেলাম, কথা বলে রাখা ওই লোককে খুঁজতে। তাঁকে খুঁজে বের করে আগামীকাল সকাল থেকেই ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করার জন্য বললাম। তিনি তাতে রাজি হলেন, খুশিও হলেন। আমরা দুইজন বাসায় রওনা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পথেই কানাইর সাথেও ওঁর বেতন নিয়ে ফয়সালা করে ফেললাম। কানাইকে প্রতিমাসে ১৫০০/=টাকা দিতে হবে। ও অবশ্য ২০০০/=টাকা চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওঁর সারাদিনের টুকটাক খরচ আমার উপর নিয়ে ওঁকে ১৫০০/= টাকায়ই রাজি করলাম। কানাইরও এটা ছিলো প্রথম বেতনভুক্ত চাকরি। তাই আর ও বেশি মন খারাপ করেনি বরং খুশিই হয়েছিলো। এর পরদিন থেকেই ওয়েল টেক্সে কাজ করা শুরু করি। দুইদিন পরই মিলের দুইজন অপরিচিত শ্রমিক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো মিলের বাইরে। মিলের বাইরে গিয়ে এক চায়ের দোকানে আমাকে বসতে দিলেন, তাঁরাও বসলেন। তাঁদের একজনের নাম, মোহাম্মদ হাসেম মিয়া। আরেকজনের নাম, নূরমোহাম্মদ।

আমি মনে মনে ভাবছি, তাঁরা কি আমার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করবে নাকি! কিন্তু না, তাঁরা আমাকে বললো, ‘আপনি এখানে এসে সব শ্রমিকদের বাঁচালেন। এতে আমরা খুবই খুশি! তবে দাদা একটা কথা ছিলো–যদি কারোর কাছে না বলেন, তাহলে আপনাকে খুলে বলতে পারি!’ তাঁদের কতা শুনে আমি বললাম, ‘বলুন, কী বলতে চান?’ আমার কথায় তাঁরা হাসলে! বললে, ‘আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি, আশা করি আমাদের সাথে থাকবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা এমন কী কাজ যে, আপনারা আমার সহযোগিতা চাচ্ছে?’ বললেন, ‘আমরা অলরেডি মিলে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করে ফেলেছি! তার কাগজপত্র দুইএক দিনের মধ্যে হতে আসলেই, আমরা মিল গেইটে সাইনবোর্ড টাঙাবো। এখন খরচ বাবদ আপনাকে সবার সমতুল্য পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে।’ তাঁদের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে খুবই খুশি হলাম! তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাঁদা কত?’ বললো, ‘বেশি না দাদা, মাত্র ৭০০/=টাকা।’ আমি বললাম, ‘আমিতো কেবলমাত্র মিলে জয়েন করলাম দাদা। ৭০০/=টাকা নিতে হবে আমার বেতন হলে।’ আমার কথায় তাঁরা দুইজন খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা, তা আপনি বেতন হলেই দিবেন; কিন্তু এব্যাপারে কারোর সাথে কিছু বলবেন না। যদি বলেন, তাহলে হয়তো এক কান, দুই কান হতে হতে মালিকের কানে চলে যেতে পারে। তাতে আমাদের সকলের সমস্যা হতে পারে!’ এই বলেই চা দোকান থেকে উঠে মিলে গিয়ে কাজ করলাম।

মিলের কাজ সেরে সারাদিন পর বাসায় গেলাম। মিলের ইউনিয়নের ব্যাপারে বড় দাদার সাথে আলাপ করলাম। আমার কথা শুনে আমার বড়দাদা খুশি হলেন! এর কয়েকদিন পরই মিলের গেইটে বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা, ওয়েল টেক্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন তা দেখে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মাথা নষ্ট হলেও, মিলের শ্রমিকদের হইহুল্লোড় আনন্দ-ফুর্তি শুরু হয়ে হলো। মিল মালিক নিরুপায় হয়ে একসময় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনেও নিলো। মিলের সব শ্রমিকদের চাকরিও পাকাপোক্ত হলো। একসময় পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের ঘন্টা বেজে উঠলে, ফাইন টেক্সটাইল মিল থেকে ঐ কালাম একদিন আমার সাথে দেখা করতে ওয়েল টেক্সে আসে। কালাম এসে এই ঈদে ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যেতে অনুরোধ করলো। আমি ঈদের ছুটিতে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কালামকে কথাও দিলাম। কালাম খুব খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলো।

এর দুইদিন পরই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। এর আগেই কানাইকে বলে রেখেছিলাম, ঈদের দিন সকলেই সেজেগুজে ওঁদের বাসা থেকে আমার বাসায় চলে আসতে। কানাই আমার কথার বরখেলাপ করলো না, ঈদের দিন সকালে ঠিক সময়ে কানাই আমার চলে আসলো। আমি মায়ের কাছে বলে-কয়ে কানাইকে সাথে নিয়ে সুবচনীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মিনিবাসে চড়ে গেলাম ফতুল্লা। নামলাম ফতুল্লা লঞ্চঘাটের সামনেই। লঞ্চঘাটের টোল দিলাম জনপ্রতি আট আনা করে দুইজনের ১টাকা। বালিগাঁওর লঞ্চ ফতুল্লা ঘাটেই যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলো। তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠে দুইজন উপরেই দাঁড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো। ফতুল্লা থেকে সুবচনী যেতে কয়েকটি ঘটে যাত্রী ওঠানামা করে। ফতুল্লার পর বক্তবলী। এরপর কাঠপট্টি, বেতকা, তালতলা, সুবচনী। সবশেষে বালিগাঁও। কালাম এর আগের বার যাওয়ার সময়টা ঠিক রেখে সময়মতো লঞ্চঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। লাঞ্চ সুবচনী ঘাটে ভিড়ানোর পর আমারা লঞ্চ থেকেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা লঞ্চ থেকেই কালামকে হাতে ইশারা দিয়ে সুবচনী ঘাটে নামলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই আমি কানাইর হাতে ৩০০/= টাকা দিয়ে বাজারের ভেতরে পাঠালাম, পান-সুপারি-সহ কিছু মিষ্টি ও কিছু ফলফলাদির জন্য। আমি আর কালাম একটা চা দোকানে ঢুকলাম, চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। কানাই আমার কথামতো সবকিছু ঠিকঠাক মতো কেনাকাটা করে চায়ের দোকানে আসলো। চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে কালামদের নিজেদের নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকার মাঝি সেজেছে কালাম নিজেই। নৌকা চলছে হেলেদুলে।

বর্ষাকালে সুবচনীর খালটা ঠিক নদীর মতো দেখা যায়। সেসময় খালে খুব স্রোত থাকে। সুবচনীর খানটা যখন পাড় হচ্ছিলাম, আমার তখন ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার মনের ভয়টা টের পেয়েছে আমার বন্ধু কানাই। কানাই আমাকে শক্ত করে ধরে বসল। তবু আমার ভেতর থেকে ভয় যাচ্ছিল না। খাল পাড় হয়ে নৌকা যখন ফসলি জমির ওপর দিয়ে ছুটলো, তখনই আমার মন থেকে কিছুটা ভয় দূর হলো। নৌকা চলছে, আর আমি নৌকা থেকে আশে-পাশে থাকা গ্রামের ঘরবাড়িগুলো দেখছিলাম, মন ভরে। নৌকা থেকে পানির নিচের দিকে চেয়ে দেখি, বর্ষার স্বচ্ছ পরিস্কার পানির ওপর থেকে জমির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে কতরকমের উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে হেলে-দুলে নাচছে। নৌকা চলছে, কথাও চলছে কালামের সাথে। আমি নৌকার কার্নিশে বসে পানির সাথে জলকেলি খেলা খেলছি। কখনও আবার ভেসে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা টেনে তুলছি। এভাবে নৌকা চলতে-চলতে একসময় আমরা কালামদের বাড়ির সামনে চলে আসলাম।

বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ার আগেই কালাম বলছে, ‘এসে গেছি ওস্তাদ! কালামের কথা শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখি, এ কী কাণ্ড! এখানে এত মানুষ কেন? আমি কালামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালাম, বাড়ির ঘাটে এত মানুষ কেন?’ কালাম বলল, ‘ওস্তাদ, আপনারা নারায়ণগঞ্জের মানুষ। আবার হলেন আমার ওস্তাদ! তাই এতো মানুষ! এর আগে আমাদের বাড়ি এসেই তো সবার মন জোগাড় করে ফেলেছেন। আপনারা আসবেন, তা আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি এসেই গ্রামের সবাইর কাছে বলেছিলাম। আবার আজ নৌকা নিয়ে বাড়ি থেকে সুবচনী যাওয়ার সময়ও বাড়ির সবার কাছে বলে গিয়েছিলাম। তাই পাশের বাড়ির পোলাপানও ঘাটে অপেক্ষায় আছে। নামেন নামেন ওস্তাদ!’ ১০/১২ জন ছেলে-বুড়ে দেখে নিজের কাছে কেমন যেন শরম-শরম লাগছিল আমার। তবু নির্লজ্জের মতোই কানাই আর আমি নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ওঠলাম। নৌকা থেকে নামার সময় মিষ্টি আর ফলগুলো কালাম হাতে নিয়ে নিল। সেদিন কালামদের ঘরটা আগে থেকেই পরি-পাটি করে রাখা হয়েছিল। ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে সামনে দিল দুই গ্লাস সরবত। সাথে আমাদের নেওয়া কিছু মিষ্টিও দিলো। কানাই আর আমি খেলাম। কালামের মা বড় ভাবীর সাথে কথা বললাম। কালামদের ঘর থেকে বের হলাম। সামনেই ঠাকুরবাড়ির বিশাল পুকুর। আমার উদ্দেশ্য হলো ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবো।

কালামদের নয়াবাড়ি গ্রামটি দেখতে ঠিক সেন্টমার্টিনের একটা দ্বীপের মতো। আয়তনে বেশি একটা বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে কম নয়। পুরো গ্রামটির মাঝখানেই ঠাকুরবাড়ির এই বিশাল পুকুরটি। প্রতিদিন সকাল-বিকাল পুরো গ্রামের লোক এই পুকুর ঘাটলায় বসে আড্ড দেয়। খেলা-ধুলাও চলে। কেউ লুডু। কেউ ষোলগুটি। কেউ তাসখেলা।আমরা পুকুর ঘাটে আসার সময় কালামের বড়ভাই সালামও আমাদের সাথে ছিল। তখন ঘাটলায় চলছিল গ্রামের ছেলে-বুড়োদের আড্ডা। বর্ষাকাল, গ্রামের মানুষের কাজকর্ম নেই, তাই সময় কাটানোর আড্ডা। আমাদের দেখেই সবাই তাকিয়ে আছে। দুই-একজন লোক আবার হাতের তাস রেখে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি ঘাটলায় যাদের দেখতে মুরুব্বির মতো, তাদের নমস্কার জানালাম। যাঁরা এর আগের বার আমাদের দেখেনি, তাঁদের মধ্যে একজন লোক কালামের বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কারা? বাড়ি কোথায়? কী করে?’ আরও অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলো। কালামের বড়ভাই, মুরুব্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এরা একজন আমার ছোট ভাই কালামের ওস্তাদ, আরেকজন বন্ধু। কালাম যেই মিলে কাজ করে, সেই মিলের ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঈদের বন্ধ পেয়ে আমাদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে।’ কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে মুরুব্বি দুইজন হ্যাণ্ডশেক করলো। সিঁড়ি ঘাটলায় বসতে বললো। আমরা দুইজন বসলাম।

আমি ঘাটে বসেই সত্যগুরুর বাড়িটির দিকেই বেশি ফলো করছিলাম। কারণ, বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল, তাই। আগের দিনের তৈরি বাড়ি, সাথে তিন চারটা ঘর। আবার বাড়ির ভেতরে একটা বড় ঠাকুরঘ। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলা! বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি ভরা। আমরা ঘাটে বসা থাকতেই ওই বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে আসলো। ওদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, ওরা দুই বোন। ধারণা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য কানাইকে বললাম, ‘কানাই, মেয়ে দুইটি কে? তুই সালাম ভাইয়ের কাছ থেকে একটু জেনে নে।’ কালাম তখন ঘাটলায় ছিলো না। কালাম গেছে আবার সুবচনী বাজারে। আমাদের সাথে বসা আছে কালামের বড়ভাই সালামা মিয়া। আমার কথায় কানাই সালাম ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে। কিছুক্ষণ পর কানাই আমার কাছে এলো।

আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে কানাই, সালাম ভাই কী বললো?’ আমার কথার উত্তরে কানাই বললো, ‘সালাম দাদা বললো, ‘তোকে এই গ্রামেই বিয়ে করাবে, বুজলি।’ আমি বললাম, ‘বলে কী? তো মেয়ে কোথায়? মেয়ে দেখাতে বল! যদি আমার পছন্দ হয় তবে বিয়ে করতেও পারি! আমার মায়ের খুবই কষ্ট হচ্ছে রে কানাই। বিয়েটা তাড়াতাড়িই করতে হবে।’ কানাই আমার কথার জবাবে বললো, ‘মেয়ে তো কয়েকবারই এখানে বসে বসে দেখেছিস। এবার বল, পছন্দ হয়েছে কিনা?’ আমি কানাইর কথায় অবাক হয়নি! কেন হয় নি? সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখা যাচ্ছিল!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৬ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৪

জীবনের গল্প-১৩-এর শেষাংশ: দুইদিন পর থেকে কাজ জয়েন্ট করবো বলে, অফিস থেকে বের হলাম। নিচে এসে সব তাঁতিদের সাথে দেখা করে মিল থেকে বের হওয়ার সময় মিস্ত্রি আমার হাতে ২০০/= টাকা দিয়ে বললো, এটা আজকের কাজের মজুরি। ২০০/= টাকা থেকে কানাইকে ১০০/= টাকা দিয়ে মিল থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় গিয়ে বড় দাদাকে সবকিছু জানালাম। বড়দাদা খুশি হলেন। মাও খুশি হলেন। পরদিন সকালে ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কানাইকে নিয়ে কাজ করলাম। কাজ সেরে বড় দাদাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, আমি ফরিদপুর যাওয়ার পর যেই লোক কাজ করেছিলো; আগামীকাল থেকে ফতুল্লার ঐ লোকই এখানে কাজ করবে। জানানোর পর ম্যানেজার সাহেব রাগ করিনি। রাগ না করার কারণও ছিলো, কারণ হলো, ফাইন টেক্সটাইল মিলের কাজ হলো চুক্তিতে। ভীম প্রতি ৭০ টাকা। এতে প্রতিমাসে আমি ২০০০/= টাকার বেশি রোজগার করতে পারতাম না। আর এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানে বেতনভুক্ত। কাজ হোক আর না হোক, মাস শেষে আমার মূল বেতন হতে আসবেই। ম্যানেজার সাহেব আমার বেতন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, বেতন কত? বললাম, ‘বেশি না স্যার, মাত্র ৬০০০/= টাকা। তা শুনে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি হলেন।

এরপর ফতুল্লা গেলাম, কথা বলে রাখা ওই লোককে খুঁজতে। তাঁকে খুঁজে বের করে আগামীকাল সকাল থেকেই ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করার জন্য বললাম। তিনি তাতে রাজি হলেন, খুশিও হলেন। আমরা দুইজন বাসায় রওনা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পথেই কানাইর সাথেও ওঁর বেতন নিয়ে ফয়সালা করে ফেললাম। কানাইকে প্রতিমাসে ১৫০০/= টাকা দিতে হবে। ও অবশ্য ২০০০/= টাকা চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওঁর সারাদিনের টুকটাক খরচ আমার উপর নিয়ে ওঁকে ১৫০০/= টাকায়ই রাজি করলাম। কনাইরও এটা ছিলো প্রথম বেতনভুক্ত চাকরি। তাই আর ও বেশি মন খারাপ করেনি বরং খুশিই হয়েছিলো। এর পরদিন থেকেই ওয়েল টেক্সে কাজ করা শুরু করি। দুইদিন পরই মিলের দুইজন অপরিচিত শ্রমিক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো মিলের বাইরে। মিলের বাইরে গিয়ে এক চায়ের দোকানে আমাকে বসতে দিলেন, তাঁরাও বসলেন। তাঁদের একজনের নাম, মোহাম্মদ হাসেম মিয়া। আরেকজনের নাম, নূরমোহাম্মদ।

আমি মনে মনে ভাবছি, তাঁরা কি আমার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করবে নাকি! কিন্তু না, তাঁরা আমাকে বললো, ‘আপনি এখানে এসে সব শ্রমিকদের বাঁচালেন। এতে আমরা খুবই খুশি! তবে দাদা একটা কথা ছিলো–যদি কারোর কাছে না বলেন, তাহলে আপনাকে খুলে বলতে পারি!’ তাঁদের কতা শুনে আমি বললাম, ‘বলুন, কী বলতে চান?’ আমার কথায় তাঁরা হাসলে! বললে, ‘আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি, আশা করি আমাদের সাথে থাকবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা এমন কী কাজ যে, আপনারা আমার সহযোগিতা চাচ্ছে?’ বললেন, ‘আমরা অলরেডি মিলে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করে ফেলেছি! তার কাগজপত্র দুইএক দিনের মধ্যে হতে আসলেই, আমরা মিল গেইটে সাইনবোর্ড টাঙাবো। এখন খরচ বাবদ আপনাকে সবার সমতুল্য পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে।’ তাঁদের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে খুবই খুশি হলাম! তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাঁদা কত?’ বললো, ‘বেশি না দাদা, মাত্র ৭০০/=টাকা।’ আমি বললাম, ‘আমিতো কেবমাত্র মিলে জয়েন করলাম দাদা। ৭০০/= টাকা নিতে হবে আমার বেতন হলে।’ আমার কথায় তাঁরা দুইজন খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা, তা আপনি বেতন হলেই দিবেন; কিন্তু এব্যাপারে কারোর সাথে কিছু বলবেন না। যদি বলেন, তাহলে হয়তো এক কান, দুই কান হতে হতে মালিকের কানে চলে যেতে পারে। তাতে আমাদের সকলের সমস্যা হতে পারে!’ এই বলেই চা দোকান থেকে উঠে মিলে গিয়ে কাজ করলাম।

মিলের কাজ সেরে সারাদিন পর বাসায় গেলাম। মিলের ইউনিয়নের ব্যাপারে বড় দাদার সাথে আলাপ করলাম। আমার কথা শুনে আমার বড়দাদা খুশি হলেন! এর কয়েকদিন পরই মিলের গেইটে বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা, ওয়েল টেক্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন তা দেখে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মাথা নষ্ট হলেও, মিলের শ্রমিকদের হইহুল্লোড় আনন্দ-ফুর্তি শুরু হয়ে হলো। মিল মালিক নিরুপায় হয়ে একসময় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনেও নিলো। মিলের সব শ্রমিকদের চাকরিও পাকাপোক্ত হলো। একসময় পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের ঘন্টা বেজে উঠলে, ফাইন টেক্সটাইল মিল থেকে ঐ কালাম একদিন আমার সাথে দেখা করতে ওয়েল টেক্সে আসে। কালাম এসে এই ঈদে ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যেতে অনুরোধ করলো। আমি ঈদের ছুটিতে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কালামকে কথাও দিলাম। কালাম খুব খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলো।

এর দুইদিন পরই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। এর আগেই কানাইকে বলে রেখেছিলাম, ঈদের দিন সকলেই সেজেগুজে ওঁদের বাসা থেকে আমার বাসায় চলে আসতে। কানাই আমার কথার বরখেলাপ করলো না, ঈদের দিন সকালে ঠিক সময়ে কানাই আমার চলে আসলো। আমি মায়ের কাছে বলে-কয়ে কানাইকে সাথে নিয়ে সুবচনীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মিনিবাসে চড়ে গেলাম ফতুল্লা। নামলাম ফতুল্লা লঞ্চঘাটের সামনেই। লঞ্চঘাটের টোল দিলাম জনপ্রতি আট আনা করে দুইজনের ১টাকা। বালিগাঁওর লঞ্চ ফতুল্লা ঘাটেই যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলো। তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠে দুইজন উপরেই দাঁড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো। ফতুল্লা থেকে সুবচনী যেতে কয়েকটি ঘটে যাত্রী ওঠানামা করে। ফতুল্লার পর বক্তবলী। এরপর কাঠপট্টি, বেতকা, তালতলা, সুবচনী। সবশেষে বালিগাঁও। কালাম এর আগের বার যাওয়ার সময়টা ঠিক রেখে সময়মতো লঞ্চঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। লাঞ্চ সুবচনী ঘাটে ভিড়ানোর পর আমারা লঞ্চ থেকেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা লঞ্চ থেকেই কালামকে হাতে ইশারা দিয়ে সুবচনী ঘাটে নামলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই আমি কানাইর হাতে ৩০০/= টাকা দিয়ে বাজারের ভেতরে পাঠালাম, পান-সুপারি-সহ কিছু মিষ্টি ও কিছু ফলফলাদির জন্য। আমি আর কালাম একটা চা দোকানে ঢুকলাম, চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। কানাই আমার কথামতো সবকিছু ঠিকঠাক মতো কেনাকাটা করে চায়ের দোকানে আসলো। চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে কালামদের নিজেদের নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকার মাঝি সেজেছে কালাম নিজেই। নৌকা চলছে হেলেদুলে।

বর্ষাকালে সুবচনীর খালটা ঠিক নদীর মতো দেখা যায়। সেসময় খালে খুব স্রোত থাকে। সুবচনীর খানটা যখন পাড় হচ্ছিলাম, আমার তখন ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার মনের ভয়টা টের পেয়েছে আমার বন্ধু কানাই। কানাই আমাকে শক্ত করে ধরে বসল। তবু আমার ভেতর থেকে ভয় যাচ্ছিল না। খাল পাড় হয়ে নৌকা যখন ফসলি জমির ওপর দিয়ে ছুটলো, তখনই আমার মন থেকে কিছুটা ভয় দূর হলো। নৌকা চলছে, আর আমি নৌকা থেকে আশে-পাশে থাকা গ্রামের ঘরবাড়িগুলো দেখছিলাম, মন ভরে। নৌকা থেকে পানির নিচের দিকে চেয়ে দেখি, বর্ষার স্বচ্ছ পরিস্কার পানির ওপর থেকে জমির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে কতরকমের উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে হেলে-দুলে নাচছে। নৌকা চলছে, কথাও চলছে কালামের সাথে। আমি নৌকার কার্নিশে বসে পানির সাথে জলকেলি খেলা খেলছি। কখনও আবার ভেসে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা টেনে তুলছি। এভাবে নৌকা চলতে-চলতে একসময় আমরা কালামদের বাড়ির সামনে চলে আসলাম।

বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ার আগেই কালাম বলছে, ‘এসে গেছি ওস্তাদ! কালামের কথা শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখি, এ কী কাণ্ড! এখানে এত মানুষ কেন? আমি কালামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালাম, বাড়ির ঘাটে এত মানুষ কেন?’ কালাম বলল, ‘ওস্তাদ, আপনারা নারায়ণগঞ্জের মানুষ। আবার হলেন আমার ওস্তাদ! তাই এতো মানুষ! এর আগে আমাদের বাড়ি এসেই তো সবার মন জোগাড় করে ফেলেছেন। আপনারা আসবেন, তা আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি এসেই গ্রামের সবাইর কাছে বলেছিলাম। আবার আজ নৌকা নিয়ে বাড়ি থেকে সুবচনী যাওয়ার সময়ও বাড়ির সবার কাছে বলে গিয়েছিলাম। তাই পাশের বাড়ির পোলাপানও ঘাটে অপেক্ষায় আছে। নামেন নামেন ওস্তাদ!’ ১০/১২ জন ছেলে-বুড়ে দেখে নিজের কাছে কেমন যেন শরম-শরম লাগছিল আমার। তবু নির্লজ্জের মতোই কানাই আর আমি নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ওঠলাম। নৌকা থেকে নামার সময় মিষ্টি আর ফলগুলো কালাম হাতে নিয়ে নিল। সেদিন কালামদের ঘরটা আগে থেকেই পরি-পাটি করে রাখা হয়েছিল। ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে সামনে দিল দুই গ্লাস সরবত। সাথে আমাদের নেওয়া কিছু মিষ্টিও দিলো। কানাই আর আমি খেলাম। কালামের মা বড় ভাবীর সাথে কথা বললাম। কালামদের ঘর থেকে বের হলাম। সামনেই ঠাকুরবাড়ির বিশাল পুকুর। আমার উদ্দেশ্য হলো ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবো।

কালামদের নয়াবাড়ি গ্রামটি দেখতে ঠিক সেন্টমার্টিনের একটা দ্বীপের মতো। আয়তনে বেশি একটা বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে কম নয়। পুরো গ্রামটির মাঝখানেই ঠাকুরবাড়ির এই বিশাল পুকুরটি। প্রতিদিন সকাল-বিকাল পুরো গ্রামের লোক এই পুকুর ঘাটলায় বসে আড্ড দেয়। খেলা-ধুলাও চলে। কেউ লুডু। কেউ ষোলগুটি। কেউ তাসখেলা।আমরা পুকুর ঘাটে আসার সময় কালামের বড়ভাই সালামও আমাদের সাথে ছিল। তখন ঘাটলায় চলছিল গ্রামের ছেলে-বুড়োদের আড্ডা। বর্ষাকাল, গ্রামের মানুষের কাজকর্ম নেই, তাই সময় কাটানোর আড্ডা। আমাদের দেখেই সবাই তাকিয়ে আছে। দুই-একজন লোক আবার হাতের তাস রেখে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি ঘাটলায় যাদের দেখতে মুরুব্বির মতো, তাদের নমস্কার জানালাম। যাঁরা এর আগের বার আমাদের দেখেনি, তাঁদের মধ্যে একজন লোক কালামের বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কারা? বাড়ি কোথায়? কী করে?’ আরও অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলো। কালামের বড়ভাই, মুরুব্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এরা একজন আমার ছোট ভাই কালামের ওস্তাদ, আরেকজন বন্ধু। কালাম যেই মিলে কাজ করে, সেই মিলের ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঈদের বন্ধ পেয়ে আমাদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে।’ কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে মুরুব্বি দুইজন হ্যাণ্ডশেক করলো। সিঁড়ি ঘাটলায় বসতে বললো। আমরা দুইজন বসলাম।

আমি ঘাটে বসেই সত্যগুরুর বাড়িটির দিকেই বেশি ফলো করছিলাম। কারণ, বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল, তাই। আগের দিনের তৈরি বাড়ি, সাথে তিন চারটা ঘর। আবার বাড়ির ভেতরে একটা বড় ঠাকুরঘ। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলা! বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি ভরা। আমরা ঘাটে বসা থাকতেই ওই বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে আসলো। ওদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, ওরা দুই বোন। ধারণা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য কানাইকে বললাম, ‘কানাই, মেয়ে দুইটি কে? তুই সালাম ভাইয়ের কাছ থেকে একটু জেনে নে।’ কালাম তখন ঘাটলায় ছিলো না। কালাম গেছে আবার সুবচনী বাজারে। আমাদের সাথে বসা আছে কালামের বড়ভাই সালামা মিয়া। আমার কথায় কানাই সালাম ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে। কিছুক্ষণ পর কানাই আমার কাছে এলো।

আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে কানাই, সালাম ভাই কী বললো?’ আমার কথার উত্তরে কানাই বললো, ‘সালাম দাদা বললো, ‘তোকে এই গ্রামেই বিয়ে করাবে, বুজলি।’ আমি বললাম, ‘বলে কী? তো মেয়ে কোথায়? মেয়ে দেখাতে বল! যদি আমার পছন্দ হয় তবে বিয়ে করতেও পারি! আমার মায়ের খুবই কষ্ট হচ্ছে রে কানাই। বিয়েটা তাড়াতাড়িই করতে হবে।’ কানাই আমার কথার জবাবে বললো, ‘মেয়ে তো কয়েকবারই এখানে বসে বসে দেখেছিস। এবার বল, পছন্দ হয়েছে কিনা?’ আমি কানাইর কথায় অবাক হয়নি! কেন হয় নি? সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখা যাচ্ছিল!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৫ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৩

জীবনের গল্প-১২-এর শেষাংশ: খেলাম শরবত। এরপর কালামের মা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে আসার জন্য বললো। কলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য আমাদের নিয়ে গেলো, একটা পুকুরের সিঁড়ি ঘাটে। পুকুরের সিঁড়ি ঘাটটা হলো এক হিন্দু বাড়ির। পুকুর ঘাট থেকে হাত-পা ধুয়ে কালামদের বাড়িতে আসলাম। ভাত খেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম।

কালামদের ঘরে খাওয়া-দাওয়া করে মনে করেছিলাম, সেদিনই নারায়ণগঞ্জ ফিরে যাবো। কিন্তু বিশ্রাম করতে গিয়ে তা আর হলো না, ফেরা। ঘুম থেকে জেগে ওঠতেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমার সাথে কানাইরও একই অবস্থা। কানাইও আর সজাগ পায়নি। কানাইকে ডেকে ওঠালাম। বললাম, ‘তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নেয়, এখনই বের হবো।’ আমার কথা শুনে কালামের মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই রাত করে নারায়ণগঞ্জ যেতে বারণ করলে, আমরা দুইজন এক রাতের জন্য থেকে যাই কালামদের বাড়িতেই। এরপর কালাম আমাদের সাথে করে ঠাকুরবাড়ির পুকুর ঘাটে নিয়ে আসলো।

এই ঠাকুরবাড়িই বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়ে আছে, যা আগে কালাম আমার কাছে অনেক বলেছিল। কিন্তু মেয়ে দেখার মন-মানসিকতা নিয়ে কালামদের ওখানে আমরা যাইনি। আমরা গিয়েছি বেড়াতে। যখন কালামদের বাড়ি থেকে সন্ধ্যাবেলা এই ঠাকুরবাড়ির পুকুর ঘাটে আসি, তখন দেখলাম ঠাকুরবাড়ি থেকে কয়েকজন মহিলা আমাদের দেখে কেমন যেন হাঁকাহাঁকি করে চুপেচাপে দেখছিল। তখন ছিলো ভরা বর্ষা মৌসুম। নয়াবাড়ি গ্রমের চারদিকে পানি আর পানি। হাট-বাজারে যেতে হলে নৌকা ছাড়া আর কারোর উপায় ছিল না। আর রাতবিরেতে গ্রামের মানুষ অন্তত বর্ষাকালে অনেকেই বেশি একটা ঘোরা-ফেরাও করতো না। রাতের খাবারের আগপর্যন্ত এই ঠাকুরবাড়ি সিঁড়ি ঘাটেই বসে আড্ডা দিতো, সময় কাটাতো।

কালামের সাথে আমরা যখন পুকুর ঘাটে গেলাম, তখনও পুরো সিঁড়ি ঘাটলা ছিলো লোকে গিজগিজ। কালামের সাথে আমাদের দুইজনকে দেখে সিঁড়ি ঘাটলা থেকে কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়ে কানাই আর আমাকে বসতে দিলে, আমরা দুইজন বসলাম। ঠাকুরবাড়ি থেকেও একজন মুরুব্বি এসে আমাদের সাথেই বসলেন। কালামকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর ওস্তাদের বাড়ি কোথায়, ঘর কোথায়, জাত সম্প্রদায় কী, মা-বাবা আছে নাকি নেই, ভাই-বোন ক’জন, কী কাজ করে ইত্যাদি।’ আমি কিছুই বললাম না, যা বলার কানাই আর কালামই বলেছিলো। এরপর ঠাকুরবাড়ির ওই মুরুব্বি আমাদের দুইজনকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যেতে বললে, আমি আর গেলাম না, কালামের সাথে কানাইকে পাঠালাম। কানাই কালামের সাথে গিয়ে তাঁদের ঘরে গিয়ে বসলে, আমাকে ডেকে আনতে একটা ছোট শিশকে সিঁড়ি ঘাটলায় পাঠালো। কিন্তু তখনও আমি ওই ঠাকুরবাড়িতে আর পেলাম না, সিঁড়ি ঘাটলায় বসে আরও মানুষের সাথে কথা বলতে থাকি। আমার সাথে কালামের বড় ভাইও বসা ছিলো। কালামের বড়ভাইও বলেছিল, ‘যাও ঘুরে দেখে আসো।’ তারপরও আমি ঠাকুরবাড়ি গেলাম না, পুকুরঘাটেই ছিলাম।

কিছুক্ষণ পর কানাই আর কালাম বড় এক বাটি ভরে গাছের পাকা পেয়ারা সিঁড়ি ঘাটলায় নিয়ে আসলো। আমাকে দুটো দিয়ে বাদবাকিগুলো ঘাটলায় থাকা দুইএক জনকে দিলো। সবাই পেয়ারা খাচ্ছিল। আমি কানাইকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই বাড়িতে এতক্ষণ কি করলি?’ কানাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘তোর ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল।’ বললাম, ‘বলে কী পাগলটায়! আমার ব্যাপারে জেনে তাঁদের কী হবে?’ কানাই বললো, ‘তোর জন্য কালাম যেই মেয়ের কথা মিলে থাকতে বাবার বলেছিল, ওই মেয়েটাকে আজ দেখলাম! খুবই সুন্দর!’ আমি আর কোনও কথা বললাম না, সোজা পুকুর ঘাটে এসে কালামকে বললাম, ‘কালাম বাড়ি চলো, ঘামাবো।’ আমার কথায় কালাম আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে আমাদের নিয়ে ওঁদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। বাড়িতে আসার সাথে সাথেই রাতের খাবার রেডি হয়ে আছে কালামদের ঘরে। কোনরকম হাতমুখ ধুয়ে কালাম-সহ বসে রাতের খাবার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হালকা কিছু খাবার খেয়ে কালামের মা-বাবা, ভাই-বোন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির বাইরে আসলাম। এমন সময় কানাই বললো, ‘ঠাকুরবাড়ির সবাইর থেকে বলেকয়ে আসি।’ আমি কানাইকে আর ওই বাড়িতে যেতে দিলাম না, সোজা কালামদের নৌকায় উঠে বসলাম। কালাম-সহ কালামের বড় ভাইও আমাদের সাথে নৌকায় উঠলো। উদ্দেশ্য আমাদের ঢাকার লঞ্চে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কালাম আমাদের নিয়ে নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজারে আসলো। আমরা নৌকা থেকে নেমে কালাম-সহ ওঁর বড়ভাইকে সাথে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। লঞ্চ আসতে আরও দেরি হবে বলে অনেকেই বলছিল। সেই সময়টুকু কালামের বড়ভাইয়ের সাথেই কথাবার্তা বলে পাড় করতে চাচ্ছিলাম।

এমন সময় কালামের বড়ভাই বলছিল, “মেয়েটা ভালো। কিন্তু গরিব। ওঁদের নিজস্ব জায়গা-জমি নেই। বাড়িটাও সত্যগুরু নামে একজন ঠাকুরের। তবে সত্যগুরুর আরও অনেক বছর আগে মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পরিবারের সবাই একসময় এই বাড়ি তাঁদের দান হিসেবে দিয়ে যায়। তারপর থেকে তাঁরা আজ অনেক বছর যাবত গ্রামের আরও দশজন মুসলমানের সাথে মিলেমিশে এই বাড়িতে বসবাস করছে। বাড়ির মুরুব্বির নাম নারায়ণ সরকার। উনার চার মেয়ে দুই ছেলে। মেয়েগুলো বড়, ছেলে দুটো মেয়েদের ছোট। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরও অনেক আগে। ছেলের বাড়ি নোয়াখালী জমিদারহাট। এখন অবিবাহিত আছে তিন মেয়ে। করলাম আরও অনেক আগেই তোমার কথা বলেছিল। কিন্তু তুমি তো ওই বাড়িতে গেলেই না। কেন গেলে না, তা আমার মাথায় ঢুকছে না। মেয়ে যখন দেখতে এসেছ, তখন মেয়েদের বাড়িতে গেলে না কেন?”

আমি কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে হেসে বললাম, ‘দাদা, আমিতো আপনাদের এখানে কোনও মেয়ে দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। আমি এসেছি কালামকে দেওয়া কথা রক্ষা করতে। অন্যকিছু মনে করে আমি আসিনি, দাদা। অবশ্য কালাম-সহ ফাইন টেক্সটাইল মিলের আপনাদেরই গ্রামের আবুল মুন্সি, আপনার চাচা জব্বার কাকাও এই বাড়ির কথা অনেকবার বলেছিল। কিন্তু আমি তাঁদের কিছুই বলিনি। কারোর সাথে কথাও দেইনি। তাছাড়া এখনো আমার বিয়ের বয়স হয়নি দাদা। এই বয়সে বিয়ে করবো, এ চিন্তা আমি কখনোই করি না। যদি কপালে থাকে তাহলে কেউ আবার বাধাও দিতে পারবে না, যেকোনো একভাবে-না-একভাবে হবেই হবে।’ কালামের বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে একসময় বালিগাও থেকে সুবচনী লঞ্চঘাটে লঞ্চ এসে ভিরলো। কানাই আর আমি লঞ্চে উঠে এক জায়গায় দাড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো।

ফতুল্লা লঞ্চঘাটে নেমে নারায়ণগঞ্জ গেলাম। এরপর কানাই গেলো ওঁদের বাসায়, আমি আমার বড়দা’র বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। এর একদিন পরই ঈদের ছুটি শেষ হয়ে মিল চালু হলো। সব শ্রমিকরা যাঁর যাঁর বাড়ি থেকে এসে মিলে হাজির হলো। তখন ফাইন টেক্সটাইল মিলের বেশিরভাগ তাঁতিই ছিল সুবচনী এলাকার। আমরা যে ঈদের বন্ধে কালামদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তা পুরো নয়াবাড়ি গ্রাম-সহ ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিকের বাড়ি পার্শ্ববর্তী কড়পাড়া গ্রাম পর্যন্ত জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। মিল চালু হবার পর সে বলে, ‘আমাদের বাড়ি গেলে না কেন? ও বলে আমাদের বাড়ি গেলে না কেন?’ বললাম, ‘আরে দাদারা, আমাদের কি আর কারোর বাড়ি চেনা আছে? তাছাড়া সারা গ্রামই তো আমাদের কাছে সাগরের মতো মনে হলো। এই অবস্থা দেখে কারোর বাড়িতে আর যেতে মন চায়নি দাদা। আবার সুদিনে একবার যখন যাবো, তখন সবার বাড়ি খুঁজে খুঁজে বের করে ঘুরে আসবো।’ অনেকেই আবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি-না? মেয়েদের বাড়িতে গিয়েছিলাম কি-না ইত্যাদি।’ এরকম আলাপ আলোচনার মধ্যে এসব কথা আমার বড়দ’র কানে পৌঁছে গেলো। বড়দা বাসায় গিয়ে বৌদির কাছে বললো। এরপর বৌদি আমার মায়ের কাছে বললো।

বিক্রমপুর বেড়াতে যাওয়ার কথা, মেয়ে দেখার কথা বৌদির কাছে মা শুনে আমাকে আর কিছুই বলেনি। জিজ্ঞাসাও করেনি যে, কোথায় গেয়েছিলি! জিজ্ঞেস করেছিল আমার বৌদি। বিক্রমপুর থেকে আসার দুইদিন পর বৌদি আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ঠাকুরপো মেয়ে কেমন দেখলে?’ আমিতো একেবারে হক্কার-মা-টক্কা হয়ে গেলাম! বৌদিকে বললাম, ‘তোমার কাছে কে বলেছে যে, আমি মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম?’ বৌদি বললো, ‘চুপেচাপে কি আর বেশিদিন চলা যায়, ঠাকুরপো? চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। তো মেয়ে কেমন? পছন্দ হলে বলো, আমরা একদিন গিয়ে দেখে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে আসি!’ বললাম, ‘দূর বৌদি, সব মিথ্যে কথা। যেই বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেই বাড়ির সাথে একটা ঠাকুরবাড়ি আছে। সেই বাড়িতে তিনটা মেয়ে আছে। কিন্তু আমিতো আর মেয়ে দেখতে যাইনি। তিনটা থাকুক আর দশটা থাকুক। তাতে আমার কী? আমার কথা বিশ্বাস না হলে কালই কানাইকে বাসায় নিয়ে আসবো, তুমি কানাইকে জিজ্ঞাসা করবে।’ এই বলেই সেদিনের মতো বৌদিকে বুঝিয়ে দিলাম।

পরদিন কানাইকে নিয়ে বাসায় আসলাম। আমার বড় বৌদি কানাইকে জিজ্ঞাসা করলে, কানাই বললো, ‘নিতাই তো ওই বাড়িতেই যায়নি। আমি গিয়েছিলাম বলে আমার সাথে ও অনেক রাগারাগি করেছিল। তোমরা যা শুনেছ, তা ভুয়া খবর।’ কানাইর কথা শুনে বৌদি ও মা বিশ্বাস করলো। এরপর এব্যাপারে আর কোনদিন কোনও কথা হয়নি। নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ গোয়ালপাড়া থেকে আসা-যাওয়া করে ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতেছিলাম।

একদিন হঠাৎ করে ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিল থেকে এক লোক এসে আমাকে খুঁজতে লাগলো। খুঁজে বের করে বললো, ‘মিলন টেক্সটাইল মিল এখন “ওয়েল টেক্স” নামে পরিচিত। মিলটি একজন পাকিস্তানি মালিক কিনে নিয়ে সেখানে নতুন কোরিয়ান মেশিন বসিয়েছে। বর্তমান ওয়েল টেক্সের মালিকের নাম নিয়াজ সাহেব। উনি খুবই ভালো লোক। এখন মিলের ম্যানেজার রমিজ উদ্দিন সাহেব তোমাকে অতিশীঘ্র দেখে করতে বলেছে।’ লোকটার কথা শুনে বললাম, আজ আর যেতে পারবো না। আপনি ম্যানেজার সাহেবকে বলবেন, নিতাই আগামীকাল বিকালবেলা এসে দেখা করবে।’ আমার কথা শুনে লোকটা চলে গেলো। কিন্তু আমি ভাবতেছিলাম! নতুন মিল। কোরিয়ান মেশিন। এখানেই বা কাকে দিয়ে যাই। এসব নিয়েই ভাবছিলাম!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৪ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১২

জীবনের গল্প-১১-এর শেষাংশ: যদি কারোর মন চায়, তাহলে ব্লগ সাইট লিঙ্কে ক্লিক করে সেদিনের সেই লেখাটা পড়তে পারবেন। আশা করি ভালো লাগবে। আর আমার জীবনের গল্প-১২ পর্ব নিয়ে পরবর্তীতে হাজির হচ্ছি শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় মানুষগুলোর মাঝে।

বিয়ের পরদিন মেয়েটি বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকে আমার আর কিছুই ভালো লাগছিল না। সেদিন আর মিলেও গেলাম না। কানাইকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম বড় দাদার বাসায়। সেখান থেকে বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যার পর। পরদিন সকালে কানাইকে সাথে নিয়ে দুইজনে মিলে গেলাম। আমি আর কানাই কাজ করছিলাম। এমন সময় মিলের দারোয়ান আমার সামনে এসে বললো, ‘তোর লোক এসেছে।’ দারোয়ানের কথায় হঠাৎ চমকে গেলাম! চমকে গিয়ে মিলের বাইরে গিয়ে দেখি ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিলের সাত্তার মিস্ত্রি। উনার সাথে মিলন টেক্সটাইল মিলে অনেকদিন কাজ করেছিলাম। এই সাত্তার মিস্ত্রিকে আমি ওস্তাদ বলেই ডাকতাম। মিলন টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবার পর উনি চেলে গেলেন বাড়িতে। উনার বাড়ি কুমিল্লা। এরপর থেকে উনার সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ। অনেকদিন পর উনার সাথে এ-ই দেখা।

সাত্তার ওস্তাদের সামনে গিয়ে হাত জোড়ে নমস্কার জানালাম। উনি আমার নমস্কার গ্রহণ করে বললো, ‘তোমার বড়দাদা নিমাই বাবু কোথায়?’ বললাম, ‘দাদা তো মিলের ভেতরে কাজ করছে।’ উনি সাত্তার মিস্ত্রি আমার বড় দাদাকে ডেকে আনতে বললো। আমি কানাইকে মিলের ভেতরে পাঠালাম, বড় দাদাকে ডেকে আনতে। এই ফাঁকে সাত্তার ওস্তাদের সাথে অনেক কথা হলো। কীভাবে আমাদের ঠিকানা সংগ্রহ করলো। কীভাবে এখানে আসলো। এখন কোথায় কী করছে ইত্যাদি বিষয়ে। সাত্তার ওস্তাদ বললো ‘তিনি ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী নামে এক জায়গায় একটা মিলে কাজ করছে। মিলের নাম, আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিল। মিলটি দুই বছরের জন্য মিলন সাহেবের ভাড়া নেওয়া। এখানে এসেছেন আমাকে সেই মিলে নিয়ে যেতে।’ এরমধ্যেই আমার বড় দাদা মিল থেকে বেরুলো। সাত্তার ওস্তাদকে দেখে কোলাকুলি করলো।

তারপর সাত্তার ওস্তাদ-সহ আমরা মিলের সাথে থাকা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। চা-বিস্কুটের ওর্ডার দিলাম, চা-বিস্কুট আসলো। চা-বিস্কুট খেতে খেতে সাত্তার ওস্তাদ আমার বড় দাদাকে বললো, ‘নিমাই দা, আমি এখন মিলন সাহেবের ভাড়া নেওয়া এক মিলে চাকরি করি। মিলটা ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী। সেখানে ভালো ড্রয়ার ম্যান নেই। ড্রয়ার ম্যানের অভাবে মিলে ঠিকমতো উৎপাদন হচ্ছে না। তাই মিলন সাহেব নিতাইকে ওই মিলে নিতে পাঠিয়েছে। এখন আপনার সম্মতি পেলেই আমি নিতাইকে সাথে নিয়ে ফরিদপুর রওনা হবো।’ আমার বড়দাদা সাত্তার ওস্তাদের সব কথা শুনে বললো, ‘ও-তো এখানে পার্মানেন্ট চাকরি করছে। আবার বর্তমানে মা’কে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছে। তাছাড়া ও এখান থেকে হঠাৎ চলে গেলে, মিল বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবণা আছে। যদি ও ওখানে যাতে চায়, তাহলে এই মিলের জন্য ওঁর মতো একজন ড্রয়ার ম্যান এখানে দিয়ে যেতে হবে। তা না হলে, ওঁর বেতনের টাকা মিল মালিক আটকে দিবে। আর ওযদি ওখানে যায়, তাহলে ওঁর ভাড়া নেওয়া বাসাও ছেড়ে যেতে হবে। তারজন্য ওঁকে অগ্রীম বাবদ অন্তত ২০০০/= টাকা দিতে হবে। যাতে ও এদিকের দেনা-পাওনা সবকিছু মিটিয়ে যেতে পারে।’

বড়দা’র কথায় সাত্তার ওস্তাদ বললো, ‘ঠিক আছে দাদা, আমি আজই এ-বিষয়ে মিলন সাহের সাথে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করে আগামীকাল আবার আপনার কাছে আসছি।’ এই বলেই সাত্তার ওস্তাদ সেদিনের মতো আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা চলে গেলো। এরপর আমার বড়দাদা আমাকে বললো, ‘তুই মিলের কাজ সেরে এই মিলের জন্য আজই একজন ড্রয়ার ম্যান খুঁজে বের কর। যাতে এই মিলের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।’ বড়দা’র কথামতো আমি মিলের কাজ সেরে কানাইকে নিয়ে চলে গেলাম, ফতুল্লা আগের মিলন টেক্সটাইল মিল এলাকায়। সেখানে গিয়ে পরিচিত একজন ড্রাইভার ম্যানের সাথে কথা বলি। উনি কিল্লারপুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে আমার কাজের জায়গায় যেতে রাজি হলো। পরদিন সাত্তার ওস্তাদ আমার জন্য মিলন সাহেব থেকে ২০০০/= টাকা অগ্রীম বাবদ নিয়ে ফাইন টেক্সটাইল মিলে আসলো।

মিলে এসে আমার বড়দা’র হাতে ২০০০/=টাকা দিয়ে বললো, ‘নিমাই দাদা আমি নিতাইকে নিয়ে আগামীকালই ফরিদপুর রওনা দিতে চাই।’ আমার বড়দা বললো, আগামীকাল যেতে পারবে না। দুইদিন পর যেতে পারবে। এই সময়ে মধ্যে মিলে একজন ড্রয়ার ম্যান দিতে হবে এবং ওঁর বাসা ভাড়া পরিশোধ করে বাসা ছেড়ে আমার বাসায় সবকিছু পৌঁছাতে হবে। তাহলেই আমি এই ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিক ও ম্যানেজারের কটুকথা থেকে রেহাই পাবো।’ আমার বড় দাদার কথায় সাত্তার ওস্তাদ রাজি হয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গোলো। তারপর বড়দা সাত্তার ওস্তাদ থেকে পাওয়া ২০০০/= টাকা আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘এই মিলের জন্য একজন ড্রয়ার ম্যান আগামীকালই নিয়ে আসতে। আর বাসা ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে বাসার মালা-মাল গোয়ালপাড়া বাসায় নিয়ে যেতে।’ দাদার কথামতো আমি তা-ই করলাম। এই দিনই শ্যামসুন্দর সাহার বাসার ভাড়া পরিশোধ করে রাতা-রাতিই বাসার মালা-মাল দাদার বাসায় নিয়ে গেলাম। মাকেও ফরিদপুর যাওয়ার ব্যাপারে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম।

পরদিন সকালবেলায় ফতুল্লা গেলাম। ফতুল্লা থেকে ওই ড্রয়ার ম্যানকে সাথে নিয়ে কিল্লারপুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে আসলাম। আমার কাজটা ওই লোককে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলাম। তারপর আমার পনেরো দিনের মতো কাজের পাওনা টাকা বড়দা’র কাছে দিয়ে দিতে ফাইন টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার সাহেবকে অনুরোধ করলাম। তারপর ম্যানেজার সাহেব ও মিলের সবার কাছে বলেকয়ে মিল থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় গেলাম। পরদিন অগ্রীম পাওয়া ২০০০/= টাকা থেকে ১০০০/= মায়ের হাতে দিয়ে কাঁথা-বালিশের গাট্টি-সহ কানাইকে নিয়ে সাত্তার ওস্তাদের কথামতো ঢাকা ফুলবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডেই সাত্তার ওস্তাদ আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে বলে বলেছিল। আমরা ফুলবাড়িয়া পৌঁছার আগেই সাত্তার ওস্তাদ আমাদের জন্য টিকিট সংগ্রহ করে আমাদের জন্য অপেক্ষা দাঁড়িয়ে করছিল। আমরা ফুলবাড়িয়া পৌঁছার সাথে সাথে সাত্তার ওস্তাদ আমাদের সামনে এসে নাজি হলো। তারপর ফুলবাড়িয়া থেকে কিছু হাল্কা-পাতলা খেয়ে বাসে উঠে নিজেদের সিটে গিয়ে বসলাম।

বাস থেকে ফফরিদপুর রাজবাড়ীর পৌঁছালাম সন্ধ্যার একটু আগে। বাস থেকে নেমে রিকশা চড়ে গেলাম, গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে। এই মিলটি ফরিদপুর শহরের এক বড় ব্যবসায়ীর। শখ করে নিজের বাবার নামে মিলের নামকরণ করে। মিলের মেশিনগুলো ছিলো ইন্ডিয়ান। সেদিন মিলের শ্রমিকদের ম্যাচে রাতের খাবার সেরে শুয়ে থাকলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মিলের পাশে থাকা একটা চায়ের দোকান থেকে চা-পানি খেয়ে মিলের ভেতরে গেলাম। মিলের সবাই আমাদের দুইজনকে দেখে কেমন যেন হাঁকা-হাঁকি করতে ছিল। মিলের শ্রমিকদের ধারণা ছিল, আমরা হয়তো দুইদিনও এই মিলে কাজ করতে পারবো না। এরকম ধারণা নিয়েই শ্রমিকরা হাঁকা-হাঁকি করেছিল। যখন আমরা দুইজনে আমাদের কাজ রেডি করে কাজ করা শুরু করলাম, তখন মিলের সবাই আমাদের দুইজনের চারপাশে এসে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজের নমুনা দেখছিল।

আমি যেই কাজটা করতাম, সেই কাজে আমি খুবই দ্রতগামী ছিলাম। একসময় পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্যে যতগুলো প্রাইভেট টেক্সটাইল মিল ছিলো, সেসব মিলে যত ড্রয়ার ম্যান ছিলো, সবার থেকে আমিই ছিলাম সেরা ড্রয়ার ম্যান। তাই ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলেও আমার দ্রুত কাজ করা দেখে মিলের সবাই অবাক হয়ে গেলো। প্রথম কাজটা করেই প্রশংসার ফুলঝুরি কুড়িয়ে ফেললাম। সাত্তার ওস্তাদও খুশি হয়ে গেলো। এরপর ওই মিলে আমিই হয়ে গেলাম সবার পছন্দের মানুষ। মিলের বাইরেও ছিল আমার প্রশংসা। তাছাড়া ঢাকার লোক বলে একটা কথা তো ছিলোই। যেখানেই যেতাম, সম্মান পেতাম। মিলের ভেতরেও থাকতাম স্পেশালভাবে। সেই মিলের পাশের বাড়িঘরের অনেক ছেলেকেও কাজ শিখাইয়েছিলাম। ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে প্রায় ছয়মাসের মতো ঠিকমতো কাজ করেছিলাম। এরপর একসময় মিলন সাহের ওই মিলে সূতা দেওয়া বন্ধ করে দিলে, সাত্তার ওস্তাদ-সহ আমি আর কানাই নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।

ক’দিন ঘুরে-ফিরে আবার কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ নিয়ে নিই। ফাইন টেক্সটাইল মিলেও আমি সবার প্রিয় মানুষ ছিলাম। মিলের অধিকাংশ শ্রমিক ছিলো বিক্রমপুর মালিকের পাড়াপ্রতিবেশি ও নিকটাত্মীয় স্বজন। তখনকার সময়ে এদেশে এতো গার্মেন্টস ছিলো না। ছিলো শুধু প্রাইভেট টেক্সটাইল মিল। তাই তখন কাজের যেমন চাহিদা ছিলো, কাজের লোকের সম্মানও ছিলো। সেই সম্মানের সুবাদে অনেক শ্রমিকদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ পেতাম। অনেকের বাড়িতে যেতাম। আবার অনেকের বাড়িতে যেতাম না। তো ফাইন টেক্সটাইল মিলেরই আমার এক সাগরেদের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর তালতলা সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামে। ওঁর নাম ছিল কালাম মিয়া। কালাম ছাড়াও আরও অনেক লোকই ছিলো সুবচনী এলাকার। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল কালাম মিয়া। কালাম আমাকে ওস্তাদ ওস্তাদ বলের ডাকতো। ঈদ আসলে ঈদের বন্ধে ওঁদের বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করতো। এক ঈদকে সামনে রেখে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কথা দিলাম। চার-পাঁচ দিন পরই ঈদ-উল-ফিতর। একসময় মিলের সবাই ঈদের বন্ধ পেয়ে যাঁর যাঁর বাড়ি গেলো। কালামও বাড়ি যাবার আগে বারবার আমার হাতে ধরে ওঁদের বাড়িতে যাওয়া জন্য অনুরোধ করলো। তখন কালামকে বলেছিলাম, ‘ঈদের দিন যেকোনো সময় আমি আর কানাই তোমাদের বাড়িতে হাজির হয়ে যাবো। এব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।’

আমার কথা বিশ্বাস করে কালাম মিল থেকে ঈদের আগের দিন বাড়ি গেলো। বাড়ি গিয়ে ওঁর মা-বাবার কাছে বললো, ‘ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ওস্তাদ আসবে।’ ওই কথা এক কান দুই কান তিন কান হয়ে পুরো নয়াবাড়ি গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। ওঁদের বাড়ি যেতে হলে ফতুল্লা লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে সুবচনী বাজারে নামতে হয়। তারপর সুবচনী থেকে নৌকায় চড়ে নয়াবাড়ি গ্রামে যেতে হয়। তাই কালাম ঈদের দিন সকালবেলা সুবচনী বাজারে এসে পরিচিত সব নৌকার মাঝিদের বলে রেখেছিল, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ওস্তাদ আসবে। ওস্তাদের কাছ থেকে যেন নৌকা ভাড়া রাখা না হয়।’ ঈদের দিন আমি মায়ের কাছে বেড়াতে যাবো বলে কানাইকে সাথে নিয়ে সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে ফতুল্লা লঞ্চঘাটে আসি। তখন ফতুল্লা থেকে সুবচনীর ভাড়া ছিলো মাত্র ১৭ টাকা। লঞ্চঘাটে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ঢাকা থেকে লঞ্চ ছেড়ে এসে ফতুল্লা লঞ্চঘাটে ভিড়লো। আমরা লঞ্চে উঠলাম। সুবচনী যেতে যেতে দুপুর পার হয়ে গেলো। লঞ্চঘাটে লঞ্চ ভিড়লো। আমরাও লঞ্চ থেকে নামলাম। সামনেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে আছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছো?’ কালাম বললো, ‘আমি ওস্তাদ অনেকক্ষণ যাবত এখানে আনাগোনা করছিলাম, আপনাদের অপেক্ষায়।’ তারপর কালামকে নিয়ে এক চায়ের দোকানে গেলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে বাজারের ভেতরে গেলাম। কালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে মিষ্টির দোকান কোথায়? কালাম আমাদের মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেলো। দুই সের মিষ্টি নিলাম। কালামের মা-বাবার জন্য পান-সুপারি কিনলাম। বেশি করে সিগারেট কিনে নিলাম। তারপর ওঁদের নিজেদের নৌকা চড়ে ওঁদের বাড়ির ঘাটে নামলাম। আমরা কালামদের বাড়িতে যাবার আরও অনেক আগে থেকেই আমাদের দেরি দেখে ওঁর মা-বাবা, বড় ভাই-সহ বাড়ির সবাই পায়চারি করতে ছিল। আমরা ওঁদের বাড়ির ঘাটে যাবার সাথে সাথে পুরো নয়াবাড়ির ছোট-বড় অনেক মানুষ ঘাটে জড়ো হয়ে গেলো। এতো মানুষ দেখে আমি যেন লজ্জায় পড়ে গেলাম! মাথা নিচু করে কালামের সাথে ওঁদের ঘরে গিয়ে বসলাম।

ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে ওঁর মা-বাবা, বড় ভাই ও বোনের সাথে পরিচয় হলো। তারপর চিনির সাথে লেবুর শরবত সামনে এসে গেলো। আসলো আমাদের টাকা দিয়ে কেনা মিষ্টিও। খেলাম শরবত। খেলাম মিষ্টি। এরপর কালামের মা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে আসার জন্য বললো। কলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য আমাদের নিয়ে গেলো, একটা পুকুরের সিঁড়ি ঘাটে। পুকুরের সিঁড়ি ঘাটটা হলো এক হিন্দু ঠাকুর বাড়ির। পুকুর ঘাট থেকে হাত-পা ধুয়ে কালামদের বাড়িতে আসলাম। ভাত খেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১১

জীবনের গল্প-১০-এর শেষাংশ: তখনকার সময়ে টেক্সটাইল মিলে আমার এই কাজের প্রচুর চাহিদা ছিলো। একটা টেক্সটাইল মিলে মনোমত ১০০জন তাঁতি থাকলেও একজন মনের মতো ড্রয়ার ম্যান থাকতো না। ড্রয়ার ম্যান বা রেসিং ম্যানের কাজটা ছিলো খুবই খেয়ালি ও ধৈর্যশালী কাজ। এই কাজটা করতে হয় নির্ভুলভাবে!

ফতুল্লা কাঠেরপুল “মিলন টেক্সটাইল” মিলে আমরা দুই ভাই কাজ করে যা পাচ্ছিলাম, তা দিয়ে খুব সুন্দরভাবেই আমাদের সংসারটা চলছিল। হঠাৎ একসময় মিলের মালিক ‘মিলন সাহেব’ আর্থিক সংকটে পড়ে মিল বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, আমরা পড়ে গেলাম বিপাকে! তখন আমার বড়দাদা হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল “ফাইন টেক্সটাইল” নামে নতুন এক মিলে কাজ নিয়ে নেয়। মিল মালিকের নাম ‘ফারুক সাহেব’। ফারুক সাহেবের বাড়িও ছিল বিক্রমপুর। কাপড়ের ব্যবসা ছিল ঢাকা ইসলামপুর। ফাইন টেক্সটাইল মিলটা সবেমাত্র নতুন। তাই মিলে তাঁতি-সহ আরও অন্য সেকশনেও লোকের অভাব ছিল। তাই আমার বড়দাদা আমাকে ফাইন টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ করতে বললে, আমি বড়দা’র কথামতো ফাইন টেক্সটাইল মিলে প্রথমে তাঁতের কাজই করতে থাকি।

ফাইন টেক্সটাইল মিলের ড্রয়ার ম্যান ছিল নরসিংদীর একজন। তিনি একবার ছুটি নিয়ে বাড়িতে গেলে উনার আর মিলের খবর থাকতো না। তখন মিলের তাঁতি-সহ মিল মালিকেরও বারোটা বেজে যেতো। এই ঝামেলার কারণে মিল মালিক ওই লোককে বাদ দিয়ে অন্য একজন লোককে নিয়োগ দিতে বলে। মালিকের কথামতো মিল ম্যানেজার মিলের সকল শ্রমিকদের বিষয়টি জানালে, আমার বড়দাদা ম্যানেজার সাহেবকে বললো ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে দিতে। বড়দা’র অনুরোধে ম্যানেজার “রাজু আহমেদ” ইন্টারভিউ হিসেবে দুই-তিন দিনের জন্য ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে করতে বললে, আমি পড়ে যাই বিপাকে। কারণ, সেসময় আমার সাথে কাজ করার হেলপার ছিল না। আর হেলপার ছাড়া ড্রয়ার ম্যানের কাজটাও করা যায় না। মিলন টেক্সটাইল মিলে যেই হেলপার ছিল, সেই হেলপারকে আমি নিজেই মিলন টেক্সটাইল মিল সংলগ্ন আরেকটা মিলে আরেকজন ড্রয়ার ম্যানের সাথে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলাম।

উপায়ন্তর না দেখে আমি নিকটস্থ নগর খাঁনপুর গিয়ে আগের পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে একজন লোকের দরকার বলে জানাই। তখন নগর খাঁনপুর মহল্লার পরিচিত এক বেকার ছেলের সন্ধান পাই। ওই ছেলেকে বলে-কয়ে সাথে নিয়ে ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে থাকি। যেই ছেলেটাকে আমার সাথে কাজ করার জন্য এনেছি, সেই ছেলেটা টেক্সটাইল মিলের কাজ আর কখনো করেনি। আমার সাথেই প্রথম টেক্সটাইল মিলে কাজে আসা। ছেলেটার নাম, “কানাই লাল সাহা।” নতুন হেলপার কানাইকে নিয়েই ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ শুরু করি। প্রথম দিনের প্রথম কাজেই মিলের তাঁতিদের অনেক প্রশংসা আর বাহাবাহা কুড়ালাম। তিন-চার দিন পর ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিক মিলে আসার পর আমার ব্যাপারে তাঁতিদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে, মিলের সকল তাঁতিরা এই কাজে আমাকেই রাখতে বললো। তাঁতিদের কথা শুনে মালিক ফারুক সাহেব আমাকে সবসময়ের জন্য ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে বললে–আমি কানাইকে নিয়ে রেগুলার ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে থাকি।

কানাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে করতে একসময় কানাই হয়ে গেলো আমার প্রিয় বন্ধু। অবশ্য কানাই আমার বয়সের দিক দিয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট ছিলো। কিন্তু হাতে-পায়ে ছিলো আমারমতো উঁচা-লম্ব। দুইজন একসাথে চলাফেরা করলে কে বড় আর কে ছোট, অনেকেই বুঝতে পারতো না। যেখানেই যেতাম কানাইকে সাথে নিয়েই যেতাম। যখন যা-কিছু খেতাম, কানাইকে নিয়ে খেতাম। এভাবে দুই-তিন মাস কাজ করার পর আমার আর নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়ালপাড়া থেকে আসা-যাওয়া করে কাজ করতে ভালো লাগছিল না। বিষয়টি আমার মাকে জানালাম। মা আবার বড়দা’কে জানালো। বড়দাদা মা-কে বললো, ‘ওঁর যদি এখান থেকে আসা-যাওয়া করতে সমস্যা হয়, তাহলে ওঁকে বলবেন মিলের সাথে নগর খাঁনপুর আগের মহল্লায় একটা বাসা নিতে। আমি এখেই থাকবো।’ বড়দা’র কথা মা আবার আমাকে বললো। আমি তখন কানাইকে বললাম, ‘আমার জন্য একটা বাসা ঠিক করতে।’ কানাই নগর খাঁনপুর পুকুরপাড়ে ওঁদের বাসার সাথেই শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে আমার জন্য একটা বাসা দেখে। এরপর আমি কানাইকে সাথে নিয়ে শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে গিয়ে বাসা দেখি। বাসা ভাড়া প্রতিমাসে ১৫০ টাকা। বাসাটা ছোটো ছিলো বলেই বাসা ভাড়া ১৫০/= টাকা। আমার পরিবারের সদস্য বলতে ছিলাম আমি, মা, আর বোন মরা ভাগ্নী। বাসাটা ছোট হলেও, আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিলো মনে করে বাড়িওয়ালাকে কথা দিলাম, এই বাসা আমিই নিবো।

তখন কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইলে কাজ করে প্রতিমাসে বেতন পেতাম ২০০০/=টাকার মতো। বাজারে চাউলের মূল্য ছিল প্রতি সের ৫-৬ টাকা। তাতে হিসাব করে দেখলাম, যেই টাকা বেতন পাবো, তাতে মাকে নিয়ে সুন্দরভাবে চলতে পারবো। সময়টা ছিলো বোধহয় ১৯৮৪ সালের। একসময় বাসা ভাড়া ঠিকও করে ফেললাম। বাসা ভাড়া ঠিক করে যেদিন বাসায় ঢুকবো, সেদিন ছিল শুক্রবার, ঠিক দুপুরবেলা। সেদিন দাদার বাসা থেকে কিছু দরকারি মালা-মাল নিয়ে ভ্যানগাড়ি করে নগর খাঁনপুর মহল্লায় আসলাম। মালা-মালের মধ্যে তেমন কোন দামী কোনও আসবাবপত্র ছিলো না। তারপরেও মোটামুটি যা ছিলো, গরিব সমাজে চলনসই ছিলো। আমি আর কানাই, দুইজনে মিলে মালা-মালগুলো ভ্যানে করে বাসার সামনে আনলাম। বাসার সামনেই ছিলো পুকুর। পুকুর পাড়েই ছিলো শ্যামসুন্দর সাহার বাড়ি। বাড়ির সামনে যখন ভ্যানগাড়ি রাখলাম, তখন অমার চোখ পড়ল শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতেই থাকা একটা মানুষের উপর। মানুষটা ছিলো এক মেয়ে মানুষ।

মেয়েটা খুবই সুন্দর ও রূপসী ছিলো। গায়ের রং ছিলো ফর্সা। মায়াবী চেহারা। যেন হাতে গড়া এক মাটির মূর্তি দেবী দুর্গা। হাটু পর্যন্ত তাঁর মাথার চুল। অপরূপ এক রূপবতী। আমি চেয়ে চেয়ে মেয়েটাকেই শুধু দেখতেছিলাম। মেয়েটার নজরও ছিলো আমাদের দিকেই। মেয়েটা খানিক পরপর শুধু আমাদের দিকেই আনা-গোনা করতে লাগলো। মেয়েটির এমন আনা-গোনা দেখে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। তখন আর ভ্যানগাড়ি থেকে এই সামান্য মালামাল নামাতে ভাল লাগছিল না। লজ্জা লাগার কারণও ছিলো। কারণটা ছিলো, যেই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম, সেই বাড়িতে আরো দুই-তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া ছিলো। তাঁরা সবাই ছিলো ছোটখাট ব্যবসায়ী। তাঁদের ঘরে জিনিসের অভাব ছিলো না। তাঁদের সাথে তো আমার মত গরিব মানুষের খাপ খাবে না বলেই, আমার কাছে কেমন যেন লজ্জা- লজ্জা লাগছিল। ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম,কী যে করি! কানাই’র কথায় কেন এই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম! অবশ্য এর আগেও আমরা সপরিবারে এই নগর খাঁনপুরেই ভাড়া ছিলাম। সেই আগের চেনাজানা বলেই কানাই’র কথায় আবার এই এলাকায় শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে আসলাম বাসা ভাড়া নিয়ে। কিন্তু এখন তো এই বাড়িতে আমার মতন অধমেকে মানাবে না। এসব নিয়ে একা একাই ভাবছিলাম।

এমন সময়ই কানাই বলছে, ‘কি রে! মালগুলি ধর! তাড়াতাড়ি করে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাই। খানিক পর তো আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আবার বাজারে যেতে হবে না? নতুন বাসা, কতকিছুর দরকার হবে! সবই তো তোর আস্তে আস্তে কিনতে হবে।’ কানাই’র কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে দুইজনের দ্রুত টুকিটাকি মালা-মাল ভ্যানগাড়ি থেকে নামানো শুরু করলাম। একটু পরে ওই মেয়েটা আমাদের সামনে আসলো। সামনে এসেই বললো, ‘আপনারা দুইজনে না পাড়লে আমিও কিছু-কিছু নিয়ে যাই? মামা (শ্যামসুন্দর সাহা) আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের সাথে ভ্যানগাড়ি থেকে ধরা-ধরি করে নামাতে।আমি চুপ করে ছিলাম, কোন কথা’ই বলিনি। কানাই বললো, ‘না না থাক, তোমার লাগবে না, যা আছে সেটা আমরা দুইজনেই পারবো, তুমি যাও।’ তারপরেও মেয়েটা হাড়ি-পাতিলের বোস্তাটা হাতে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আমার ভাড়া করা বাসায় নিয়ে রাখলো। বাকি মালগুলো কানাই আর আমি দুইজনে নিলাম। সাথে সাহায্যকারি রিকশওয়ালাও ছিলো।

আমার মা গোয়ালপাড়া থেকে আসলো বিকালবেলা। মা আসার আগেই দুইজনে জিনিসপত্রগূলো ঘরের ভিতরে সব গোছ-গাছ করে রেখেছিলাম। মালপত্রগুলি গোছানোর সময়ও মেয়েটা বারবার একটু পরপর আমাদের সাহায্য করার জন্য আমার ঘরের সামনে যাওয়া-আসা করছিল। কিন্তু আমরা কিছু বলছি না দেখে, আমার ঘরের ভেতরে আসছে না, বাইরে থেকেই আনা-গোনা করছিল। একটু পরে মা বললেন, ‘যা রান্না করার জন্য কিছু বাজার-সদাই করে নিয়ে আয়।’ মাকে বললাম, ‘বাজারের ব্যাগটা দিন, আর কী কী আনবো বলেন।’ কী কী লাগবে মা বললেন, আর ওমনি ব্যাগ নিয়ে কানাই আর আমি দুইজনে বাজারের চলে গেলাম। মজিদ খাঁনপুর বাজার থেকে কিছু বাজার-সদাই করে বাসায় ফিরলাম। মা রাতের খাবার তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রাতের খাবারে কানাইকে আমাদের সাথে খেতে বললাম। কানাই ঠিক সময়মত আমার বাসায় এসে হাজির হলো। মা দুইজনকে ভাত খেতে দিলেন। আমরা দুইজন ভাত খাচ্ছিলাম। এমন সময় আবার মেয়েটা এসে মাকে বললো, ‘মাসিমা কী রান্না করলেন এত তাড়াতাড়ি?’ ‘ইরি চাউলের ভাত, মুশরের ডাইল রান্না করেছি।’ মা জবাব দিলেন। মেয়েটা বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁসার বাটি করে কিছু তরকারি এনে দিলেন, আমার মায়ের হাতে। মা প্রথমে রাখতে চায়নি। মেয়েটা তখন রাখার জন্য অনুরোধ করলো। তখন মা ওর অনুরোধে তরকারির বাটি রাখলো। সেই তরকারি আমাদের দুইজনকে ভাগ করে দিলো। আমরা দুইজন খেলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে হাত-মুখ ধুয়ে বাহিরে গেলাম। বাড়ির সাথেই চা’র দোকান, মুদি দোকান ছিলো। দোকান থেকে দুইজনে চা-সিগারেট টেনে আমি বাসায় আসলাম। কানাই ওঁদের বাসায় চলে গেলো।

এরপর মেয়েটার বিষয়-আশয় জানলাম। মেয়েটা কে? ওঁদের বাড়ি কোথায়? ওঁরা কয় ভাই, কয় বোন। মেয়েটি ছিলো এক দুখিনী মায়ের দুখিনী। মেয়েটার নাম মণিকা, (ছদ্মেমনাম) ৷ মেয়েটার বাবা জীবিত ছিলো না! মেয়েটা এই বাড়িওয়ালার বাসায় থেকে কাজ করে। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর। ওঁরা একভাই একবোন। মা জীবিত আছে। ওঁর মা-ও অন্য একজনের বাসায় কাজ করে। একসময় মেয়েটি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছিলাম না। তারপরও আমি বাসায় গেলে মেয়েটা সবসময় আমার পেছনে পেছনেই থাকতো। আমি ভীষণ ভয় পেতাম! কারণ, যদি কিছুর থেকে কিছু রটে যায়? তাই সবসময় ভয়ে ভয়ে মেয়েটাকে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আমার মা মেয়েটাকে খুভ ভালোবাসতো, পছন্দও করতো।

আমারও পছন্দ হতো, ভালো লাগতো। তারপরও আমি বান্দা পাত্তা দিতাম না। এড়িয়েই যেতাম। একসময় মেয়েটি নিজেই কানাই’র কাছে আমার প্রতি ওঁর ভালোবাসার কথা বললো। কিন্তু না, আমি সবসময়ই দূরে দূরেই থাকতাম। কারণ, আমি মনে করতাম, সেসময় আমার বিয়ের বয়স হয়নি। তারপর ছিলো সংসারের অস্বচ্ছলতা। একসময় মেয়েটার বিয়ে ঠিক হলো। মেয়েটি রাজি ছিলো না। শেষমেশ মেয়েটিকে আমি নিজের বলেকয়ে বিয়েতে মত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। আমার অনুরোধে মেয়েটি বিয়েতে রাজি হয়। বিয়ের দিন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পর, মেয়েটিকে বরের হাতে আমি নিজেই উঠিয়ে দেই। এই নিয়ে গত কয়েক বছর আগে অনলাইনে থাকা এক ব্লগ সাইটে “এক বিকেলের ভালো লাগা সারাজীবনের স্মৃতি” শিরোনামে একটা ব্লগ লিখেছিলাম। তা লেখার মাঝে লিংক দিয়ে দিলাম। যদি কারোর মন চায়, তাহলে ওই ব্লগ সাইট লিঙ্কে ক্লিক করে সেদিনের সেই লেখাটা পড়তে পারবেন। আশা করি ভালো লাগবে। আর আমার জীবনের গল্প-১২ পর্ব নিয়ে পরবর্তীতে হাজির হচ্ছি, শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় মানুষের মাঝে।
চলবে…

জীবনের গল্প-১২ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১০

জীবনের গল্প-৯-এর শেষাংশ: এভাবে চলতে চলতে একসময় নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব অনেক হয়ে গিয়েছিল। একসময় চানাচুর বিক্রি বাদ দিলাম। নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সীদের সাথে রিকশা চালানো শিখলাম। রিকশা চালানো শিখে নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

সংসারে অভাব দূর করার জন্য প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত রিকশা নিয়ে শহরের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকতাম। রিকশা চালিয়ে যা পেতাম, মায়ের কাছে এনে দিতাম। মা সংসারে খরচ করতো। তখন হঠাৎ করে এদেশে এক ধরণের নতুন রোগ দেখা দিলো। রোগের নাম ‘ঝিনঝিনা’ রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ হঠাৎ করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যেতো। ওই রোগের একমাত্র ঔষধ ছিলো, রুগীর শরীরে পানি ঢালা। তখন আমরা নগর খাঁনপুরেই থাকতাম। সেসময় ‘ঝিনঝিনা’ রোগের ভয়ে প্রতিদিন ঠিকমতো রিকশা চালানো হতো না। ভয়ে ভয়েই বেশি থাকতাম। মহল্লায় থাকা আরও বন্ধু-বান্ধদের সাথেই সারাদিন ঘুরাফেরা করতাম। মহল্লার কেউ ‘ঝিনঝিনা’ আক্রান্ত হলে তাঁকে সবাই ধরাধরি করে পুকুরপাড় সিঁড়ি ঘাটলায় বসিয়ে রুগীর শরীরে পানি ঢালতাম। রুগী যতক্ষণ না পর্যন্ত সুস্থ না হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত রুগীর গায়ে-মাথায় পানি ঢালতেই থাকতাম। এভাবে আমরা ‘ঝিনঝিনা’ রুগীকে সুস্থ করে তুলতাম।

আমরা কয়েকজন বন্ধু ছিলাম নগর খাঁনপুর মহল্লার সেচ্ছাসেবী হিসেবে। তখন ওই রোগের ভয়ে মহল্লার হিন্দুরা দলবেঁধে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হরির নাম সংকীর্তন করতে করতে পুরো মহল্লার আনাচে-কানাচে চক্কর দিতো। মহল্লার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও সকাল-বিকাল আল্লাহু আল্লাহু জিকির করতে করতে মহল্লার আনাচে-কানাচে ঘুরতো। প্রায় দিনেক ১৫ দিন পর একসময় ওই রোগ আস্তে আস্তে নিস্ক্রিয় হলো। যাঁর যাঁর সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমিও আবার নিয়মিত প্রতিদিন রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

আমি যেই মালিকের রিকশা চালাতাম, উনার নাম ছিলো, লেচু মহাজন। সবাই উনাকে লেচ্চা মহাজন নামেই চিনতো। নতুন রিকশা চালানো শেখা থেকেই আমি লেচ্চা মহাজনের রিকশাই চালাতাম। একসময় আমার সাথের অনেক রিকশাওয়ালারা রিকশা চালানো বাদ দিলেও, আমি আর বাদ দিতে পারছিলাম না, অন্যকোনো ভালো একটা কর্ম না জানার কারণে। তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ নতুন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। দেশের চারদিকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনী গাড়ি নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে শুরু করলো। কারোর মাথায় লম্বা চুল দেখলে চুলের মুঠি ধরে কেচি দিয়ে ধানকাটার মতো কেটে দিতো। মায়ের জাতি নারীদের পেট দেখা গেলে পেটে আলকাতরা লাগিয়ে দিতো।

ওই বিপদে আমি নিজেও একবার পড়েছিলাম। রিকশায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ২ নং রেল-গেইট সংলগ্ন ডায়মন্ড সিনেমাহলের সামনে গেলাম। হঠাৎ করে সেনাবাহিনীর আমার রিকশার সামনেই গাড়ি থামালো। তখন আমার মাথার চুল অনেক লম্বা ছিলো। আমাকে দেখামাত্রই দুইজন সেনাবাহিনী আমার চুলের মুঠি ধরে ঘেচাং ঘেচাং করে কেটে দিলো। এমনভাবে ঘেচাং ঘেচাং করলো, তখন মাথা ন্যাড়া করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সেদিনের রোজগার মাটি দিয়ে গ্যারেজে রিকশা জমা দিয়ে গেলাম সেলুনে। সেলুনের নাপিত আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। বললাম, ‘ভাই হাসাহাসি বাদ দিয়ে মাথাটা ন্যাড়া করে দিন।’ নাপিত আমার মাথা ন্যাড়া করছে, আর বিস্তারিত জানতে চাচ্ছে। বললাম, নাপিতের কাছে বিস্তারিত ঘটনা। মাথা ন্যাড়া করে বাসায় আসলাম। মহল্লার সবাই আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। সাথে বন্ধুরা জানতে চাইলো, ‘ঘটনা কী?’ সব বৃত্তান্ত খুলে বললাম। বাসায় আসার পরও ওই হাসা-হাসির পালায় পড়লাম। বৌদি হাসে, বড়দিদি হাসে। বড় দাদাও হাসতে লাগলো। এরপর আর ভয় করতাম না, নির্ভয়ে বুকেরপাটা টান করে রিকশা নিয়ে শহরে ঘুরতাম। অবশ্য এর কয়েকদিন পর সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর আনা-গোনাও কমে গেলো। যে যাঁর মতো শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে কাজ করতে লাগলো।

এর কিছুদিন পর হঠাৎ করে ফেনী থেকে আমার অবিবাহিত বড় বোনের বিয়ের সম্বন্ধ আসলো। ছেলে পক্ষের কোনও দাবি-দাওয়া নেই, কোনরকম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দিতে পারলেই হলো। ছেলেটা আমার মায়ের গুরুদেবের পরিচিত ছিল বলে আমার মা মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু হিন্দু বিয়ে বলে একটা কথা তো ছিলোই। একেবারে গাছ-পা খালি-পা করে করে তো, বিয়ে দেওয়া যায় না। তাই আমার মা নগর খাঁনপুর মহল্লার হিন্দু মুসলমান সকলের হাতে-পায়ে ধরে মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইতে শুরু করলো। আমাদের বাড়িওয়ালা আমার বোনের বিয়ের সাহায্যের জন্য আমাদের হয়ে নগর খাঁনপুররের বিশিষ্টজনদের কাছে গেলো এবং বিয়ে যাতে সুন্দরভাবে হয়, সেজন্য তাদের পরামর্শ চাইলো। তখন নগর খাঁনপুর মহল্লায় থাকা বিশিষ্টজনরা সম্মিলিতভাবে গরিবের মেয়ের বিয়ের জন্য সকলকে সাহায্য করার অনুরোধ করে একটা সাদা কাগজে দরখাস্তের মতো লিখে দিলো। সেই কাগজ সাথে নিয়ে আমি আর আমার মা বোনের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য নারায়ণগঞ্জ শহরের অলিগলিতে, মার্কেটে মার্কেটে গিয়ে ধনী-গরিব সকলের কাছে সাহায্য চাইতে লাগলাম। কেউ দিতো, কেউ আবার দিতো না। তবুও দ্বারেদ্বারে যাওয়া বন্ধ করলাম না, যেতেই লাগলাম। সাহায্য উঠাতে লাগলাম।

এভাবে বেশকিছু টাকা সংগ্রহ করলাম। আর নগর খাঁনপুর থেকেও কেউ লেপ, কেউ তোশক, কেউ ঘটি-বাটি, কেউ নগদ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে লাগলো। যে যা দিতো সব আমাদের বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছেই জমা থাকতো। একসময় বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হলো। বিয়ের ১০/১২ দিন বাকি থাকতে আমি বোনের বিয়ের জন্য সাহায্য উঠাতে চলে গেলাম, নোয়াখালী নিজের গ্রামে। গ্রামে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের কাছে বোনের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইলে, গ্রামের সব হিন্দু বাড়ির লোকজন একত্রিত হয়ে কেউ ২০ টাকা, কেউ ২৫ টাকা এমন করে ২০০টাকার মত মিলিয়ে আমার হাতে তুলে দিলো। তারপর গেলাম, আমার মাসিমা’র বাড়িতে। মাসিমা’র বাড়ি ছিলো নোয়াখালী সোনাপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে রাজুরগা গ্রামে। আমার বোনের বিয়ের কথা শুনে আমার মাসিমা আর মাসতুতো ভাই-বোন মিলে আমাকে ২০০টাকার মতো হাতে দিলো। আমি সেই টাকা নিয়ে তিনদিন পর নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি। তারপর কোনোএক সুন্দর লগ্নে কোনও ঝায়-ঝামেলা ছাড়াই সবার সাহায্য সহযোগিতায় বোনের বিহাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরদিনই জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে ফেনী ফুলগাজী নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আমাদের সংসার কিছুটা স্বচ্ছলভাবে চলতে থাকে। বড়দাদা কাজ করতো কিল্লার পুল এলাকায় এক টেক্সটাইল মিলে। আর আমি প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে শুরু করে রাতদুপুর পর্যন্ত রিকশা নিয়েই পড়ে থাকতাম নারায়ণগঞ্জ শহরের পাড়া-মহল্লার আনাচে-কানাচে।

একসময় আমার বড়দাদা কিল্লার পুল সংলগ্ন টেক্সটাইল মিলের কাজ ছেড়ে হাজীগঞ্জ আইইটি স্কুল নামক স্থানে এক নতুন টেক্সটাইল মিলে কাজ নেয়। সেসময় আমি রিকশাই চালাতাম। আমার বড়দাদা আমার পরিশ্রম দেখে আমাকে প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বড় দাদার সাথে কাজ শেখার জন্য বললো। কাজ শিখে রিকশা চালানো ছেড়ে দিতে বললো। বড় দাদার কথামতো আমি তা-ই করতে থাকি। সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রিকশা চালাতাম, আর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বড়দা’র সাথে টেক্সটাইল মিলের তাঁতের কাজ শিখতাম। একসময় তাঁতের কাজ পুরোপুরি শিখেও ফেললাম। তখন রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়ে বড়দাদা যেই মিলে কাজ করতো, সেই মিলেই কাজ করতে লাগলাম। আমি তখন ২০ বছরের এক যুবক। হাতে-পেয়েও ছিলাম উঁচা-লম্বা। শরীরের দিক দিয়েও ছিলাম আরও দশজনের চেয়ে স্বাস্থ্যবান এক জবরদস্ত যুবক।

সেসময় বাংলাদেশে নতুন একধরনের পলিয়েস্টার সূতার আগমণ ঘটলো। পলিয়াস্টার সূতার কাপড়ের খুবই চাহিদা ছিলো। রেডিওতে প্রতিদিন পলিয়েস্টার সূতার গুণাগুণ প্রচার করা হতো। সেসময় এই বঙ্গদেশের জেলা-শহরগুলোর আনাচে-কানাচে কচুগাছের মতো টেক্সটাইল মিল গড়ে উঠতে শুরু করলো। কোরিয়া, জাপান থেকেও কাপড় তৈরির অত্যাধুনিক মেশিনপত্র আসতে লাগলো। কাপড়ের কারিকর (তাঁতি)-সহ টেক্সটাইল মিলের বিভিন্ন কাজের লোকের চাহিদা বেড়ে গেলো। ঠিক সে-সময়ই আমি হলাম একজন সুদক্ষ তাঁতি। তাঁতের কাজ যেখান থেকে শেখা, সেখানেই অনেকদিন মনোযোগ সহকারে তাঁতের কাজ করলাম। একসময় আমার আর তাঁতের কাজ ভালো লাগছিল না। কারণ তাঁতের কাজ করতে হয়, দিনে-রাতে। এক সপ্তাহ দিনে, এক সপ্তাহ রাতে। রাতজাগা কাজটা আমার ভালো লাগছিল না। শিখলাম উইভিং ডিপার্টমেন্টের (তাঁত বিভাগ) অন্য এক কাজ। সেই কাজটা শুধু দিনেই করতে হয়। তাই খুব মন দিয়ে ওই কাজটা শিখেছিলাম। কাজটার নাম রেসিং ম্যান। কেউ ড্রয়ার ম্যানও বলে। আবার কেউ বলে, ব-গাঁথা বা বয়া-গাঁথা বা হানা-ব ভরা বা শানা-ব ভরা। কাজটা শিখেছিলাম ঠিক, কিন্তু এই কাজটা কোনও মিলে পার্মানেন্ট করতে পারছিলাম না। ওই কাজ শিখেও কাজ জোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাঁতের কাজেই করতে লাগলাম।

একসময় বড়দাদা নগর খাঁনপুর থেকে বাসাও ছড়ে দিলো। নতুন করে বাসা ভাড়া নিলো নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা এলাকায় গোয়ালপাড়া। বড়দাদা বাসা ছাড়ার সাথে সাথে নতুন করে ফতুল্লা কাঠের পুল এলাকায় থাকা একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ নিয়ে নিলো। আমাকেও সাথে নিলো। ওই মিলে মাত্র ৭টা পাওয়ার লোম (তাঁত) ছিলো। মিলের নাম ছিলো, মিলন টেক্সটাইল মিলস্। মালিকের নাম ছিলো, মিলন সাহেব। মালিকের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর। দোকান-সহ ব্যবসা ছিলো ঢাকা ইসলামপুর। ওই মিলে আমরা দুই ভাই একজোড়া তাঁত পার্মানেন্ট নিয়ে নিলাম। আর বাদবাকি তাঁত আরও কয়েকজন কারিকর (তাঁতি) চালাতো। আমার বড় দাদা করতো দিনে, আমার কপালে পড়লো, সেই রাতেই ডিউটি। তবুও বাধ্য হয়ে করতাম। কিন্তু রাতের কাজ আমার ভালো লাগতো না। তাই শখ করে যেই কাজটা আরও আগে শিখেছিলাম, সেই কাজটা আমাকে দেওয়ার জন্য একদিন মালিক মিলন সাহেবকে বললাম। কিন্তু সেই কাজটা তখন মিল এলাকার আবুল নামের একজন লোকে করতো। সেই লোক আবার আরও দুই-একটা মিলে চুক্তিতে কাজ করতো।

একসময় আমার বড়দাদা ওই আবুল নামের লোকটার সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করলো। তখন ওই লোক নিজের ইচ্ছায় মিলন টেক্সটাইল মিলের ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে বুঝিয়ে দিলো। আমি স্থানীয় একটা ছেলেকে(হেলপার) নিয়ে ওই শখের রেসিং-এর কাজটা করতে থাকি। মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতে করতে একসময় নারায়ণগঞ্জ শহরে আনাচে-কানাচে থাকা ছোট-বড় প্রাইভেট টেক্সটাইল মিলে আমার নাম ছড়িয়ে পড়লো। যেখানে যেই মিলেই নতুন পাওয়ার লোম (তাঁত) আসতো আমাকে সেই মিলে কাজ করার জন্য মালিক পক্ষ থেকে অফার দিতো। কিন্তু কোনও মিলে পার্মানেন্ট কাজ বা চাকরি করার কথা দিতাম না। তবে মিলন টেক্সটাইল মিলের কাজের ফাঁকে ফাঁকে হেলপার নিয়ে অন্য মিলে গিয়ে চুক্তিতে কাজ করে দিতাম। তখনকার সময়ে টেক্সটাইল মিলে আমার এই কাজের প্রচুর চাহিদা ছিলো। একটা টেক্সটাইল মিলে মনোমত ১০০জন তাঁতি থাকলেও একজন মনের মতো ড্রয়ার ম্যান থাকতো না। ড্রয়ার ম্যান বা রেসিং ম্যানের কাজটা ছিলো খুবই খেয়ালি ও ধৈর্যশালী কাজ। এই কাজটা করতে হতো নির্ভুলভাবে!
চলবে…

জীবনের গল্প-১১ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৯

জীবনের গল্প-৮-এর শেষাংশ: বাসায় গিয়ে দেখি মায়ের পরনে সাদা কাপড়। বড় দাদার পরনে সাদা মার্কিন কাপড়। হাতে বগলে কুশান। গলায় সাদা কাপড়ে চিকন দড়ির মতো মালার সাথে একটা লোহার চাবি ঝুলানো। সেদিনই সেই বেশ আমারও ধরতে হয়েছিল।

বোনের মৃত্যুর পর, আর বাবার মৃত্যুর পর আমার মা একরকম আধ-পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি। বোন মরা ভাগ্নীটা আমাদের সংসারে থেকে আস্তে আস্তে হাঁটি-হাঁটি পা-পা, করতে লাগলো। আমিও লেখাপড়া বাদ দিয়ে বড় দাদার সাথে সংসারের বোজা ভাগাভাগি করে মাথায় নিয়ে নিয়মিত কাজ করতে ছিলাম। এরমধ্যে কতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হয়, আসে-যায়! ওইসব ধর্মীয় উৎসবে মিলের ভেতরে থাকা সমবয়সীরা কতো নতুন নতুন জামা-কাপড় পরে, আনন্দ-উল্লাস করে! কিন্তু আমাকে সবসময়ই থাকতে হয় কাজের ধান্দায়। ঘরে এসে বসে থাকি একমুঠ ভাতে আশায়। এভাবে চলতে চলতে একসময় আদর্শ কটন মিল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা আসলো, মিলের পুরাতন মেশিনপত্র বিক্রি করে মিল আধুনিকায়ন করা হবে। এই ঘোষণার ফলে মিলের সব শ্রমিকরা ছাটাই হয়ে গেলো। শ্রমিকরা চাকরি ছেড়ে যাঁর-যাঁরমতো হিসাব বুঝে নিতে লাগলো। আমার বড় দাদার অবস্থাও আরও দশজনের মতো হলো। কিন্তু তখনো মিল কর্তৃপক্ষ মিলের ভেতর থেকে ফ্যামিলি কোয়ার্টার ছাড়ার কোনও ঘোষণা দিচ্ছিল না। তাই মিল থেকে বড় দাদার হিসাব বুঝে পেলেও, আমরা মিলের ভেতরেই থাকতে ছিলাম।

তখন মিলের ভেতরে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে বাসাভাড়া ছিল না ঠিক, কিন্তু বড় দাদা চাকরি ছিল না বলে সংসারের অভাব আরও বেড়ে গিয়েছিল। বড় দাদা সার্ভিসের যে ক’টা টাকা এককালীন পেয়েছিল, তা সুদের টাকা আর দোকান বাকি দিতে গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সংসারের বড় বোঝাটা তখন আমার মাথার উপরেই ঠেসে বসেছিল। আমি তখনো আদর্শ কটন মিলে ডেইলি কাজে ছিলাম। সেসময় ১২ টাকা থেকে দৈনিক মজুরি ১৫ টাকা হয়েছিল। একদিন ঠিক দুপুরের আগে একটা বাঁশের মাচার উপর দাঁড়িয়ে একজন মিস্ত্রিকে টিন উঠিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ বাঁশের মাচা ভেঙে আমার ডান হাতের তালুর একপাশে নতুন টিনের কোণা ঢুকে হাত কেটে যায়। সাথের লোকজন ধরাধরি করে মিলের ভেতরে থাকা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার প্রথমেই আমার হাতে ৭টা সেলাই করলো। তারপর ব্যথা কমানোর জন্য ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে লোক মারফত বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমার এই অবস্থা দেখে আমার মা জ্ঞানহারা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শুনেছিলাম, আমার জ্ঞান ফেরার পর বৌদির কাছে, বড় বোনের কাছে। সেই হাত এক্সিডেন্টে আমি অন্তত একমাস কাজ করতে পারিনি। তবে এক্সিডেন্ট হওয়ার চার-পাঁচ দিন পর মিলে গিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছিলাম। এর বিনিময়ে মিলের সরদার দয়া করে আমাকে প্রতিদিন অর্ধেক হাজিরা হিসাব করে সপ্তাহের দিন দিয়ে দিতো। ওই নামমাত্র টাকা পেয়ে সাথে সাথে বড় দাদার হাতে দিয়ে দিতাম। বড় দাদা তা দিয়ে নগদ-বাকিতে মিলিয়ে সংসার চালাতেন, আর সারাদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন।

বড় দাদা ঘুরতে ঘুরতে একসময় একটা কাজও পেয়ে গেলেন। কাজ পেয়েছেন আদর্শ কটন মিল ঘেষা মাউরা মিল নামে একটা ছোট কাপড়ের মিলে। সেই মিলে দিনরাত কাজ করে যেই টাকা পেতো, সেই টাকা দিয়েই কোনরকমভাবে সংসার চলতে লাগলো। আমিও আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলাম। একসময় আমি যখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠি, তখন আমার বড় দাদা ওই এক্সিডেন্টের ভয়ে আমাকে আর আদর্শ কটন মিলের ডেইলি কাজে যেতে দিতেন না। দাদার ইচ্ছা আমাকে তাঁর সাথে রেখে কাপড় বুনানোর (তাঁতে) কাজ শেখাবেন। তাই সুস্থ হয়ে দাদার কথামতো প্রতিদিন বড় দাদার সাথে নিকটস্থ মাউরা মিলে যেতাম। দাদার সাথে কাজ শিখতাম।

একদিন হঠাৎ করে বড় দাদার এক বন্ধুর ছেলে মুন্সিগঞ্জ রিকাবি বাজার সংলগ্ন কমালাঘাট থেকে আদর্শ কটন মিলে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসে। লোকটার নাম সুনিল। ওই লোক (সুনিল) বড় দাদার সাথে দেখা করে আমাদের সংসারের ভালো-মন্দের খবর নেয়। আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বড় দাদা সব বৃত্তান্ত খুলে বলে। তারপর সুনিল কাকা আমাকে কমলাঘাট একটা বড় বাণিয়া দোকানে চাকরি দিতে পারবে বলে বড় দাদাকে কথা দেয়। সুনিল কাকার কথায় আমার বড় দাদা খুশি হয়ে আমাকে সুনিল কাকার সাথে কমলাঘাট যেতে বলে। আমার ইচ্ছা না থাকা স্বত্বেও বড় দাদার কথায় সুনিল কাকার সাথে আমাকে বানিয়া দোকানে চাকরি করতে কমলাঘাট যেতে হয়।

গেলাম মুন্সিগঞ্জ কমলাঘাট। লাগলাম বাণিয়া দোকানে কর্মচারীর কাজে। খাওয়া-দাওয়া দুপুরে রাতে বাণিয়া দোকানের মালিকের বাসায়। সকালের খাবার দোকানের সাথে থাকা এক মিষ্টির দোকানে। প্রতিদিন নাস্তা বাবদ ১ টাকা। তখনকার সময় কমলাঘাটে থাকা মিষ্টির দোকানগুলোতে একটা পরোটার দাম ছিল চারআনা। পরোটার সাথে ডাল-ভাজিও চারআনা। আমি প্রতিদিন নগদ ১টাকা হাতে পেয়ে দুটো পরোটা আটআনা, আর ডাল অথবা ভাজি নিতাম চারআনার। মোট বারো আনা নাস্তা, আর বাকি থাকা চারআনা দিয়ে আধা প্যাকেট কমলাঘাটের নামকরা হোসেন বিড়ি কিনে নিতাম। রাতে দোকানের দোতালায় ঘুমাতাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা খেয়ে দোকানে থাকতাম। দুপুরের একটু আগে মালিকের বাড়ি থেকে মাথায় করে খাবারের ভাত নিয়ে আসতাম। আবার রাতে দোকান বন্ধ করে মালিক-সহ আমরা আরও দুইজন কর্মচারী মালিকের বাড়িতে যেতাম। রাতের খাবার একসাথে খেয়ে আবার দোকানে এসে ঘুমিয়ে পড়তাম।

কমলাঘাট ওই বাণিয়া দোকানে যে-ক’দিন ছিলাম, খাওয়া-দাওয়ার দিক দিয়ে ভালোভাবেই ছিলাম। কিন্তু মাকিল কিছুর থেকে কিছু হলেই গালমন্দ করতে, বকা-ঝকা করতো। এতে আমার মনটা সবসময় খারাপ হয়ে থাকতো। একদিন সুনিল কাকার সবকিছু খুলে বললাম। আমার কথা শুনে সুনিল কাকা তেলে-বেগুনে জেলে উঠলো। ওইদিনই সুনিল কাকা আমার জন্য আরেক মালিকের সাথে আলাপ করলে। তখন মালিক আমাকে তাঁর দোকানে নিয়ে যেতে বললো। পরদিন সুনিল কাকা আমাকে ওই দোকানে নিয়ে গেলেন। এই দোকানের কাজ হলো, তেলের টিনে মুখ ঝালাই করার কাজ। এখানে আরও ৮জন কর্মচারী আছে। ওঁরা কেউ লেখাপড়া জানতো না। মালিকও লেখাপড়া জানতেন না। মালিকের নাম জগদীশ বাবু। উনার এক ভাইও এই কাজে মালিকের সাথেই থাকতো। থাকা, খাওয়া-দাওয়ার জন্য বড় এক গোডাউনে মতো দোকানঘর ছিল। আমার সম্বন্ধে সুনিল কাকা থেকে আগেই শুনেছিল, আমি একটু-আধটু লেখা-পড়া জানি। তাই কাজের মালিক আমাকে এখানে রাখতে চায় এবং এ-দিনই তাঁর এখানে চলে আসতে বলে। মালিকের কথা শুনে সুনিল কাকা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি এখানে থাকবো কি-না?’ আমি সুনিল কাকার কথায় রাজি হলাম। সাথে সাথে সুনিল কাকা আমাকে নিয়ে আগের বাণিয়া দোকানে যায়। বাণিয়া দোকানে গিয়ে দোকান মালিককে জানিয়ে দেয়, ‘নিতাইকে আমি অন্য জায়গায় কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি। নিতাই আজ থেকে আর আপনার দোকানে কাজ করবে না।’ এরপর আমাকে তেলের মুখ ঝালাইয়ের মালিকের দোকানে এনে দিয়ে যায়। ওই তেলে মুখ ঝালাইয়ের দোকানে আমি প্রায় মাসেক ছয়মাস কাজ করে একবার জগদীশ দাদাকে বলে-কয়ে ছুটি নিয়ে আমাদের বাসায় আসি।

আদর্শ কটন মিলে আসার পর দেখি আমার সমবয়সীরা আদর্শ কটন মিলে নতুন কন্ট্রাক্টারের আন্ডারে কাজ করছে। তা দেখে আমি আর কমলাঘাট ঝালাই কাজে গেলাম না। আমি সমবয়সীদের সাথে আদর্শ কটন মিলে দৈনিক ১৫ টাকা মজুরিতে কাজ করতে থাকি। তখন আদর্শ কটন মিলের পুরাতন মেশিনপত্র বিক্রির পর নতুন মেশিনপত্র আসতে শুরু করলো। মিলের ডিপার্টমেন্টগুলো নতুন করে মেরামত করার জন্য নতুন করে কাজ শুরু হলো। যেই কন্ট্রাক্টর সাহেব এই কাজ পেয়েছিল, উনার নাম ছিল মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন। আমরা কাজের সাইটে সব লেবাররা তাঁকে বিল্লাল ভাই বলেই ডাকতাম। উনি আমার কাজের খুব প্রশংসা করতেন এবং সব লেবারদের চেয়ে আমাকেই বেশি আদর করতেন। আমি ছিলাম ঢালাই মাল বানানোর জন্য এক্সপার্ট। তাই যেদিন ঢালাই কাজ হতো, সেদিন কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাকে হাত খরচ বাবদ ৫-১০ টাকা খুশি হয়ে দিয়ে দিতো। আমিও খুশিতে নিয়মিত প্রতিদিন কাজ করতে লাগলাম।

একসময় আদর্শ কটন মিল কর্তৃপক্ষ মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টার থেকে সবাইকে বাসা ছেড়ে দিতে বললে, আমরা পড়ে যাই বিপাকে। তখন আমার বড় দাদা শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় নগর খাঁনপুর এলাকায় বাসা ভাড়া ঠিক করে। এরপর আমরা সপরিবারে আদর্শ কটন মিল থেকে নগর খাঁনপুর ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠি। আমি নগর খাঁনপুর থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে আদর্শ কটন মিল ওই বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করতে থাকি। আমার কাজ করার এমন ইচ্ছা দেখে সম্মানিত বিল্লাল কন্ট্রাক্টর সাহেব প্রতিদিন মিলের কাজ শেষে আমাকে চার-পাঁচ টাকা করে গাড়িভাড়া বাবদ দিয়ে দিতো। রোজের মজুরি তো থাকতই। সপ্তাহে কাজ করে যা পেতাম, তা বাসায় এসে মায়ের কাছে, নাহয় বড় দাদার কাছে দিয়ে দিতাম। তারপরও আমাদের সংসার চলছিল না। কারণ আদর্শ কটন মিল থেকে আসার পর বড় দাদার কাজ ছিলো না। তখন আমার মা নগর খাঁনপুর মহল্লায় থাকা এক বাড়িতে রান্না-বান্না করার কাজ নিলো। এর ক’দিন পরই বড় দাদাও নগর খাঁনপুরের সাথেই কিল্লার পুল সংলগ্ন একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ জোগাড় করে সেই মিলে কাজ করতে লাগলো। আর আমি কাজ করতে থাকি আদর্শ কটন মিলে বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের কাজ।

প্রতিদিন নগর খাঁনপুর থেকে আদর্শ কটন মিলে সকাল-সন্ধ্যা আসা-যাওয়ার মাঝে নগর খাঁনপুর মহল্লার কয়েকজন সমবয়সীদের সাথে পরিচয় হলো। ওঁরা কেউ রিকশা চালক, কেউ ঝালমুড়ি বিক্রেতা, কেউ ভ্যানগাড়ি চালক, কেউ কমলাপুর রেলস্টেশনের চানাচুর বিক্রেতা। একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি আদর্শ কটন মিল থেকে নগর খাঁনপুর বাসায় আসছিলাম। আসার পথে রুহিদাস নামে একজন সমবয়সী চানাচুরওয়ালা আমাকে ডাক দিলো, ‘এই শোন!’ আমি ওঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ভাই? বলেন, কি বলতে চান!’ আমাকে বললো, ‘তুই কোথায় কাজ করিছ?’ বললাম, ‘নদীর ওপার আদর্শ কটন মিলে।’ আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কাজ?’ বললাম, রাজমিস্ত্রীর যোগালি কাজ।’ আমার কথা শুনে চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস হাসতে লাগলো। ওঁর হাসি দেখে আমার মাথাটা চেন করে গরম হয়ে গেলো। আমি তখন রাগের মাথায় ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হাসলেন কেন, ভাই?’ আমার রাগ দেখে ও তখন থতমত হয়ে বললো, ‘আরে না, এমনি হাসলাম! যোগালি কাজ করে কি আর পেটের ভাত জুটবে? এর চেয়ে বরং তুই আমার সাথে চানাচুর বিক্রি কর, ভালো ইনকাম হবে।’ তখন আমার মাথা কিছুটা ঠাণ্ডা হলো! আমি বললাম, ‘চানাচুর বিক্রি করতে কত টাকা চালান লাগে, ভাই?’ চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস বললো, ‘তোর কাছে টাকা না থাকলে, আমি নিজেই তোকে চালান-সহ সবকিছু ঠিকঠাক করে দিবো।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা, বাসায় গিয়ে আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করে নিই।’ এই বলেই চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এসে মাকে সবকিছু বললাম! মা বললো, ‘তুই যেটা করতে পারবি, সেটাই করবি।’

মায়ের কথা শুনে আবার বাসা থেকে বের হয়ে চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাসের খোঁজ নিয়ে ওঁদের বাসায় গেলাম। মায়ের সম্মতির কথা জানালাম। রুহিদাস আমার কথা শুনে বললো, ‘তোর কাছে অল্পকিছু টাকা আছে?’ আমি সত্য কথা বললাম, ‘না!’ আমার কথা শুনে রুহিদাস বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আগামীকাল তোকে চানাচুর বিক্রি করার সবকিছু ঠিক করে দিবো। তুই সকালে আমার সাথে দেখা করবি।’ পরদিন সকালে রুহিদাস আমাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গেলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে একটা টুকরি, ছোট একটা দাঁড়িপাল্লা, ছোট ছোট কয়েকটা বাটখারা, চানাচুর বানানের জন্য একটা পট, বড় সাইজের দুই প্যাকেট চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ছটাকখানি ভিট লবণ, সরিষার তেল, পেঁয়াজ কাটার জন্য ছোট একটা ছুড়ি কিনলো। মোট খরচ হলো, ১০০ টাকার মতো। এরপর দুইজনে আবার বাসায় আসলাম। বাসায় এসে রুহিদাস সবকিছু টুকরিতে সাজালো। এরপর আমাকে রুহিদাস বললো, ‘তুই বাসা থেকে খেয়ে আয়। আসার সময় একটা গামছা নিয়ে আসবি। তারপর আমরা আস্তেধীরে চানাচুর নিয়ে বের হবো।’ আমি বাসায় গেলাম। ভাতা খেলাম। ভাত খেয়ে একটা গামছা কাঁধে ফেলে রুহিদাসের বাসায় আসলাম। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে দুইজনে একসাথে চানাচুর সাজানো টুকরি মাথায় নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন গেলাম। রুহিদাস রেলস্টেশনে বসে চানাচুর সাজানো টুকরির দুইপাশে ছিদ্র করে গামছা বেঁধে দিয়ে বললো, ‘ট্রেন আসলে তুই এক বগিতে উঠবি। আমি অন্য বগিতে উঠবো। প্রত্যেক স্টেশনে নামবি। ট্রেনের এক বগি থেকে অন্য বগিতে উঠবি। এভাবে ট্রেন যখন কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দুইজন একসাথ হবো।’

একসময় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে ট্রেন আসলো। যাত্রী ওঠা-নামা করার সময় রেলস্টেশনেই ১০/১২টাকা বিক্রি হয়ে গেলো। ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে সামনে লাগানো হলো। আমরা দুইজনে ট্রেনের দুই বগিতে ওঠালাম। রুহিদাস যেভাবে আমাকে বলেছিল, ঠিক সেভাবেই চানাচুর চানাচুর বলে চিল্লাতে চিল্লাতে ট্রেনের বগিতে বগিতে চানাচুর বিক্রি করতে করতে একসময় কমালাপুর গিয়ে পৌঁছলাম। রুহিদাস আর আমি একসাথ হলাম। রাত তখন ৮টার মতো বাজতে লাগলো। কিন্তু তখনও সব চানাচুর শেষ হয়নি। আমদানি করলাম ৬০ টাকার মতো। রুহিদাস বললো, ‘চিন্তা করবি না! ট্রেন আবার নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সময় সব চানাচুর শেষ হয়ে যাবে।’ এর কিছুক্ষণ পরই আবার ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার ট্রেন ছাড়ার সময় হলো। আমরা দুইজন দুই বগিতে উঠে গেলাম। ট্রেন ছাড়লো। আবার চানাচুর বিক্রি করা শুরু করলাম।

সেদিন চানাচুর বিক্রি হয়েছিল ১২০ টাকার মতো। আমি রুহিদাসকে ১০০ টাকা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রুহিদাস তখন ওঁর ১০০টাকা ফেরত নেয়নি। রুহিদাস বললো, ‘এই টাকা দিয়ে আগে নিজের চালান করে নে। তারপর আমার টাকা পরিশোধ করবি।’ এরপর থেকে প্রতিদিন নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ টু কমলাপুর– কমলাপুর টু নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে আমি চানাচুরওয়ালা সেজে ট্রেনের এই বগি থেকে ওই বগিতে চানাচুর বিক্রি করতে লাগলাম। অনেক সময় সারারাত পর্যন্ত কমলাপুর রেলস্টেশনে ঘুরে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করতাম। এর মাঝেই একদিন আদর্শ কটন মিলে গিয়ে বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে চার-পাঁচ দিনের পাওনা টাকা নিয়ে আসলাম। রুহিদাসের দেওয়া চালান বাবদ ১০০টাকা ফেরত দিলাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব অনেক হয়ে গিয়েছিল। একসময় চানাচুর বিক্রি বাদ দিলাম। নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সীদের সাথে রিকশা চালানো শিখলাম। রিকশা চালানো শিখে নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-১০ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৮

জীবনের গল্প-৭- এর শেষাংশ; আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।

রাস্তার কাজ ছেড়ে মনে অনন্দ নিয়ে ১২ থেকে ২৫ টাকা হাজিরায় গিয়ে লাগলাম, লবণের মিলে। কিন্তু লবণের মিলের কাজ যে ছিল এতো কষ্টের, তা আর আমরা তিনজনের একজনও কাজে লাগার আগে বুঝতে পারিনি। আমাদের দুইজনের আগে থেকে কাজ শুরু করা লোকমানও আমাদের কাছে কিছু খুলে বলেনি। যদি লোকমান আমাদের বলতো, ‘যেই কাজে আছিস সেই কাজেই থাক; লবণের মিলে কাজ করার আশা করিছ না’ তাহলেই আমরা বুঝে নিতাম যে, লবণের মিলে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আমরা আর লবণের মিলে গিয়ে কাজে যোগদান করতাম না।

কিন্তু লোকমান তা না বলে, ও আমাদের প্রতিদিনই কাজে যোগদান করার জন্য তোষামোদ করেছিল। কেন তোষামোদ করেছিল, তা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম, লোকমানও আমাদের কাছে তা খুলে বলেছিল। আমাদের দুইজনকে ছেড়ে লোকমানের একা-একা লবণের মিলে ভালো লাগছিল না, তাই। যাইহোক, এরজন্য লোকমানের সাথে আমাদের কোনদিন মনমালিন্য হয়নি। আমরা তিনজনই মিলেমিশে একসাথে জাকিরিয়া সল্ট মিলে মনোযোগ সহকারে কাজ করতে ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না, অতিরিক্ত খাটুনির কারণে আর শরীরে ঘা হয়ে যাওয়ার কারণে। এই কাজ করতে গেলে মিলে ঢোকার আগেই সমস্ত শরীরের পান খাবার ‘খয়ের’ মাখিয়ে কাজ করতে হয়। নাহলে শরীরে থাকা একটা ঘামাচি থেকে বড় আকারে ঘা হয়ে যাবে-ই-যাবে। তবু্ও একদিন কাজ করে, আর দুইদিন বসে থেকে অতি কষ্টে কাজ করে যাচ্ছিলাম।

আমাদের শরীরের এ-অবস্থা দেখে সবাই তখন বললো, কাজ করতে করতে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। একসময় হয়েছিলও তা-ই।। কাজের সাথে নিজেদের শরীরও মানিয়ে গিয়েছিল। আমরা যে কাজটা করতাম, সেই কাজের নাম ছিল ‘দৌড়’। লবণের মিলের কাজের এমন আরও নাম আছে। যেমন–খালাসি কাজ, বোজা কাজ, খামালি খাজ, কাচানি বা বেলচা কাজ, দৌড় কাজ, মিস্ত্রি, ফোরম্যান ও রপ্তানি বা ডেলিভারি কাজ। যিনি কাজ চলাকালীন সময়ে দেখবাল করতো, তাঁকে বলা হতো মাঝি বা সরদার। আমরা তিনজনই ছিলাম দৌড়ে। যিনি আমাদের কাজে লাগতে সহায়তা করেছিল, তিনি ইসমাইল মিয়া খামালি কাজ করতেন। উনার নাম ইসমাইল হলেও, মিলের সবাই তাঁকে ইসলাম ভাই বলেই ডাকতো। আমরাও ইসলাম ভাই বলে ডাকতাম।

ইসলাম ভাই’র আরো তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন৷ তখন ইসলাম ভাই বলতেন, ‘আজ থেকে আমরা সাত বন্ধু’। আমরা এক সাথে খেতাম, এক সাথে ঘুমাতাম। মোট কথা সাত মাথা মিলিয়ে হলাম এক মাথা৷ মিলে কাজ করতে হতো আট ঘন্টা৷ ছুটি হতো বিকাল ৫ টায়৷ ছুটি’র পর গা-গোসল করে আর দেরি করতাম না, চলে যেতাম মহেশখালী বাজারে৷ তখন প্রতি কাপ চা’র দাম ছিল চারআনা (২৫) পয়সা৷ সাতজন মিলে চা খেতাম পৌনে দুই টাকা, আর চারআনা দিয়ে চট্রগ্রামের আবুল বিড়ি কিনে নিতাম৷ একেক দিন একেকজন প্রতিদিন বিকাল বেলার চায়ের বিল দিতে হতো। তারপর যেতাম আদিনাথ পাহড়ের উপরে থাকা আদনাথ মন্দিরে। আদিনাথ মন্দিরটি ছিল মহেশখালী বজার হতে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর দিকে। মাঝপথেই জাকিরিয়া সল্ট মিল। সেখানে যাওয়াটা সবার চাইতে আমার একাই যাওয়া হতো বেশি! কারণ, আদিনাথ মন্দিরে নিয়মিত আসা-যাওয়া ফলে মন্দিরের পুরোহিতের সাথে আমার একরকম সখ্য গড়ে উঠেছিল। তখন এমন হয়েছিল যে, আদিনাথ মন্দিরে যদি এক বিকাল যাওয়া না হতো, পরদিন সকালবেলা ঠাকুর মশাই নিজে এসেই আমার তালাশ নিতো। বিকালবেলা মন্দিরে যেতে বলতো। আমিও যেতাম। মন্দিরের পরিবেশটা আমার খুবই পছন্দ হতো তাই। সেসময় আদিনাথ মন্দিরে বসে মন্দিরের ঠাকুর কর্তার সাথে বসে আমার অনেক সময় কেটেছিল।

অনেক সময় সন্ধ্যার পর ঠাকুর কর্তা নিজে অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো। এদিকে একটু দেরি হয়ে গেলেই ইসলাম ভাই-সহ মিলের সবার আমার জন্য অস্থির হয়ে যেতো। কারণ লবণের মিলের ভেতরেও আমি ছিলাম সবার পছন্দের একজন মানুষ। মিলের মাঝি, মিস্ত্রি, ম্যানেজার-সহ শ্রমিকদের কাছে আমি ছিলাম খুবই আদরের এবং পছন্দের। এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল শুধু একটুখানি লেখাপড়া জানতাম বলে। কিন্তু তাদের এই আচরণ দেখে আমার খুবই লজ্জা হতো। আমি তাদের সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু না পারতাম না৷ সবাই আমাকে স্নেহ ভালোবাসার চোখেই দেখে রাখতো। কারোর বাড়িতে চিঠি পাঠাতে হলে, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর খাতা-কলম নিয়ে আমাকে বসতে হতো। অনেক সময় কার আগে কারটা লিখবো, এই নিয়েও বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হতো। পরে অবশ্যই সবই ঠিক হয়ে যেতো। এভাবেই মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে কেটে গেলো প্রায় চার মাসের মতো। একসময় লবণের মিল-সহ মহেশখালী বাজারে থাকা বেশকিছু দোকানদার ও এলাকার কিছু স্থানীয় লোকদের সাথে আমার খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। যদিও মিল কর্তৃপক্ষের নিষেধ ছিল, এলাকার কারোর সাথে সখ্যতা বা বন্ধুত্ব না করার, তবুও আমরা কয়েকজন ছিলাম এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। এলাকার কিছু মানুষের সাথে ছিল সুগভীর ভালোবাসা। তাছাড়া ঢাকার লোক বলে একটা কথা আর সুনাম তো ছিলোই। সেই সুবাদে মিলেও ইজ্জত পেতাম, মিলের বাইরেও ইজ্জত পেতাম। চলতাম, ফিরতাম, ঘুরতাম, খেতাম, কাজও করতাম সমানতালে।

একসময় ঈদু-উল-ফিতরের আগমণ ঘটলো। রোজা আরম্ভ হলো। হঠাৎ করে বাজারে লবনের দাম কমে গেল৷ ছয়-আনা থেকে চার আনায় নেমে আসলো। মিলের কাজও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। এরমধ্যেই আমার সাথে আসা দুইজনের বাড়ি হতে তাদের ফিরিয়ে নিতে লোক এসে হাজির হলো৷ আমি তাদের দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মায়ের কথা। তাদের কাছ থেকে উত্তর মিলল, ‘তোমার মা আসার সময় আমাদের কিছু বলেনি।’ পরদিন সকালবেলা আমার সাথে আসা দুইজন জাকিরিয়া সল্ট মিল হতে বিদায় নিয়ে মহেশখালী ত্যাগ করলো। ওঁরা চলে যাবার পর আমি হয়ে গেলাম একা৷ তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। তাঁরা বলতেন, ‘তুই নিতাই আমাদের আপন ভাইয়ের মতো, আমরা খেলে তুই না খেয়ে থাকবি না।’ তাদের এই শান্ত্বনায় কিছুতেই আমার মন ভরছিল না৷ শুধু অামার মায়ের কথাই মনে পড়ছিল। সেদিন মিলেও তেমন কাজ ছিল না, আমিও আর কাজের ধান্দায় থাকলাম না। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লাম মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখতে। চিঠি লিখে দুপুরের আগেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে পোস্ট অফিস থেকে একটা এনভেলপ কিনে ঠিকানা লিখে ডাক বাক্সে ফেলে চলে আসলাম মিলে।

মিলে এসে শুনতে পেলাম, মিল কর্তৃপক্ষ লবণের দাম ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মিল বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে কাউকে মিল ত্যাগ করার জন্য চাপ দিবে না। যে থাকার থাকবে, যে যাবার সে অন্যত্র যেতে পারবে। বন্ধ মিলে কেউ থাকলে খাওয়া খরচ মিল কর্তৃপক্ষ থেকে বহন করা হবে। পড়ে গেলাম বিপাকে! সাহস দিচ্ছিলেন, ইসলাম ভাই ও সাথের আরও তিনজন। তাঁরা যেকোনো সাইটে কাজের জোগাড় না করে আর মিল থেকে কোথাও যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছে। আমি থেকে গেলাম তাঁদের সাথেই। এরমধ্যেই মিলের ফোরম্যান সাহেব মিলে যাঁরা-যাঁরা থাকবে তাঁদের নিয়ে নিজ খচরে ঈদ উপলক্ষে মিলের ভেতরেই একটা যাত্রানুষ্ঠান করার কথা জানালেন। এতো আমরা সবাই খুশি হলাম ঠিক, কিন্তু কাজ ছড়া নিজেদের হাত খরচ চালাবো কী করে, তা-ই নিয়েও পড়ে গেলাম দুঃশ্চিন্তায়! তখন মিল বন্ধ হলেও মিল কর্তৃপক্ষ শুধু দুইবেলা খাওয়াতো। দুপুরে আর রাতে। সকালের খাবার ছিল যাঁর-যাঁর কাঁধে। তখন আমরা পাঁচজন সকালের খাবার ও নিজেদের হাত খরচ চালানোর জন্য একটা বুদ্ধি করলাম। বুদ্ধি হলো, মিলের সাথেই একটা খাল ছিল। সাগরের জোয়ার-ভাটার সময় সেই খালের পানিও বাড়ত-কমতো। জোয়ারের পানির সাথে প্রচুর মাছ খালে চলে আসতো, আবার ভাটার সময় পানির সাথে মাছগুলো সাগরেই নেমে যেতো। খালটা ছিল খুবই চিকন। কিন্তু গভীর ছিল।

একদিন আমারা পাঁচজন সেই খালের কিছু অংশ দুইদিকে বাঁধ দিয়ে রাখলাম। জোয়ারের সময় পানি এসে খাল ভরে টবু-টুবু হলো। একসময় ভাটা লাগলো। বাঁধের ভেতরে পানি জমা হয়ে থাকলো। আমরা চারজন দুই ভাগে ভাগ হয়ে খালের পানি সেঁচতে লাগলাম। পানি সেঁচে দেখি, মাছ-আর-মাছ! অনেক মাছ! সেই মাছ টুকরি ভরে মহেশখালী বাজারে নিতেই পথিমধ্যেই সব মাছ বিক্রি হয়ে গেল। প্রথম দিনই মাছ বিক্রি হলো ৫০ টাকার মতো। আহা্! এতো টাকা খাবে কে শুনি! এরপর থেকে আমাদের দেখাদেখি মিলের আরও কয়েকজন ঠিক আমাদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে শুরু করে দিলো। সাথে মিল এলাকার স্থানীয় মানুষেও। সেসময় আমরা বন্ধ মিলের ভেতরে যাঁরা ছিলাম, তাঁরা সবাই দিনের বেলা থাকতাম খালের মাছ ধরার ধান্দায়, আর সন্ধ্যার পর থাকতাম নিজেদের যাত্রাপালার রিয়েসাল নিয়ে ব্যস্ত।

যাত্রার নাম, ‘চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে’। একসময় আমাদের রিয়েসাল শেষ হলো। ডাইরেক্টর ছিল স্বয়ং মিলের ফোরম্যান সাহেব নিজেই। ঈদের বাকি আছে দুইদিন। ফোরম্যান সাহেব যাত্রা করার জন্য মেকাপম্যান-সহ বাজনা দল ও প্রয়োজনীয় যা লাগে তা আনতে গেলেন চট্টগ্রাম। ঈদের আগের দিন থেকে এলাকায় মিলে যাত্রানুষ্ঠান নিয়ে পড়ে গেলো শোরগোল। ঈদের আগের দিন থেকেই যাত্রানুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরি করা-সহ অনেক বড় জায়গা জুড়ে উপরে তেরপাল দিয়ে ছাউনি দেওয়া হলো। সেই যাত্রাপালায় আমি একাই নিলাম দুই চরিত্র। আমাদের সাথে কোনও মেয়ে অভিনেত্রী ছিলো না। মেকাপম্যান ছিলো খুবই দক্ষ। “চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে” যাত্রাপালায় আমাদের থেকেই এক ছেলেকে নায়িকা বেছে নেওয়া হয়েছিল। ছেলেটাকে এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল, তা দেখে এলাকার সবাই ছেলেটিকে মেয়েই ভেবে নিয়েছিল। আমার চরিত্র ছিলো, চাঁদ কুমারীর সখী। আমাকেও এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল যে, আমাকে আর কেউ চিনতেই পারছিল না। আমার একা দুই চরিত্রের মধ্যে আরেকটি চরিত্র ছিল দাদা নাতি। ঈদের দিন সেই যাত্রানুষ্ঠান শেষ হতে রাত ভোর হয়ে গিয়েছিল। পরদিন এলাকার পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘নায়িকা কোথা থেকে আনা হয়েছিল।’ আমার বলতাম, ‘চট্টগ্রাম থেকে বায়না করে নায়িকা আনা হয়েছে।’ এটাই এলাকাবাসী বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সত্য কথা কেউ বলিনি যে, নায়িকা তো আমাদের মধ্যেই একজন ছিল। বলিনি এলাকার দুশ্চরিত্র কিছু মানুষের ভয়ে। সেই মনের ভয় ক’দিন পরে এমনিতেই কেটে গিয়েছিল। এলাকার কেউ তখন আর এসব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতো না। কিন্তু দেখা দিলো খালে মাছ ধরা নিয়ে নতুন বিপদ!

একসময় মাছ ধরা নিয়ে এলাকাবাসীর সাথে মিলের শ্রমিকদের মারপিট লেগে যাওয়া মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়ে গেলো। তখন আমরা কেউ আর বাজারে যেতে পারতাম না। যদিও বাজারে যেতেম, তাহলে থাকতাম এলাকার কিছু লোকের ভয়ে ভয়ে, গা ঢেক। আবার এলাকাবাসীর সাথে গণ্ডগোল সৃষ্টি হবার পর মিল কর্তৃপক্ষও একরকম ঘাবড়ে যায়। তখন মিল কর্তৃপক্ষ সবাইকে হুশিয়ার করে দেয় এভাবে– “যদি কেউ মিলের বাইরে এলাকার লোকের হামলার শিকার হয়, তাহলে মিল কর্তৃপক্ষ তার দায় নিবে না।” তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে, এখানে আর থাকা যাবে না। এই ভেবে একদিন আমরা পাঁচজন মিল থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যাওয়া হবে কালুরঘাট। ইসলাম ভাই-সহ আরও তিনজন এর আগে কালুরঘাটই থাকতো। কাজ করতো চট্রগ্রাম পোর্টে জাহাজ থেকে মাল নামানোর কাজ। তাই মহেশখালী থেকে আবার সেখানেই কাজ করার জন্য যাওয়া হচ্ছে।

আমরা মহেশখালী থেকে চট্রগ্রাম কালুরঘাট গিয়ে ইসলাম ভাইয়ের পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা করলাম। আগের বাসা নেই। নতুন করে একটা বাসা ভাড়া করা হলো। রান্নাবান্না করার জন্য সবকিছু সংগ্রহ করা হলো। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আলরেডি কাজ করা শুরু করে দিলো। আমি জাহাজ থেকে চাল, গম, ভুট্টা-সহ আরও অন্যান্য মালামাল মাথায় করে নামাতে পারবো না দেখে, তাঁরা আমাকে বাসায় রান্না করার দায়িত্ব দিয়ে কাজে চলে যেতো। এর চার-পাঁচ দিন পর একদিন বিকালবেলা আমার বড়দাদা মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তখন মিল ম্যানেজার আমার বড় দাদাকে আনুমানিকভাবে কালুরঘাটের ঠিকানা-সহ ইসলাম, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের নাম লিখে দেয়। আমার বড়দাদা সেই ঠিকানা মতো গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করে এবং ইসমাইল, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিনই দিবাগত রাতে বড়দাদা আমাকে টিকেট-সহ ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। বড়দাদা চলে যায় আমার ছোট কাকার বাড়ি পার্বত্যচট্টগ্রামের রামগড় গুইমারা বাজার।

আমি পরদিন ভোরবেলা কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে নারায়ণগঞ্জের ট্রেনে চড়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, তারপর পায়ে হেঁটে চলে যাই আদর্শ কটন মিলে। মিলে পৌঁছার সাথে সাথে শুরু হয় ঘরে থাকা মা-বাবা, বড় এক দিদি ও বৌদির কান্না-কাটি। বাবা তখন প্রায়ই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। এর দুইদিন পরই আবার শুরু করলাম আদর্শ কটন মিলে ১২ টাকা রোজে ডেইলি কাজ। এর দুইমাস পর-ই বাবা পর-পারে পাড়ি দেয় স্বর্গের ঠিকানায়। আমি তখন আদর্শ কটন মিলে ছিলাম না। আমি ছিলাম, কুমিল্লা দাউদকান্দি থানাধীন গৌরীপুর সংলগ্ন মলয় বাজার সন্নিকটে চিনামুড়া গ্রামে সেজো দিদির বাড়ি। বাবার মুখখানা আর শেষ দেখা আমি দেখতে পারিনি। মেজো দিদির বাড়ি থেকে আসলাম এর পরদিন। বাসায় গিয়ে দেখি মায়ের পরনে সাদা কাপড়। বড় দাদার পরনে সাদা মার্কিন কাপড়। হাতে বগলে কুশান। গলায় সাদা কাপড়ে চিকন দড়ির মতো মালার সাথে একটা লোহার চাবি ঝুলানো। সেদিনই সেই বেশ আমারও ধরতে হয়েছিল।

চলবে…

জীবনের গল্প-৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৭

জীবনের গল্প-৬-এর শেষাংশ: সেখানেই ওঁরা কাজ করবে।’ এই বলেই কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের এই নির্মাণাধীন ভবনে রেখে উনার বাসায় চলে যায়। আমারা রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁরমতো ঘুমিয়ে পড়ি। রাত পোহালেই যেতে হবে মহেশখালী।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমারা তিনজন একসাথে ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। আমরা তিনজন চলে যাবো বলে ম্যানেজার সাহেব স্বইচ্ছায় আমাদের নিয়ে চলে আসলো টিলার নিচে চায়ের দোকানে। চারজন একসাথে বসে চা-বিস্কুট খেলাম। চা-বিস্কুটের দাম ম্যানেজার সাহেব নিজেই দিয়ে দিলেন, আমাদের কাউকে আর দিতে দিলেন না। তিনি আগেও পকেট খরচ করার জন্য নিজের পকেট থেকে সময় সময় আমাদের এক টাকা দুই টাকা করেও দিতেন। কিছুক্ষণ পর হয়তো কন্ট্রাক্টর সাহেব এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। তাই আমাদের জন্য ম্যানেজার সাহেব খুবই আফসোস করলেন। বিশেষ করে আমরা তিনজন ঢাকাইয়া হওয়াতে ম্যানেজার সাহেব আমাদের খুবই পছন্দ করতেন, আদরও করতেন। কাজের ফাঁকে খোঁজখবর রাখতেন। আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়েও আলাপ করতেন। আমাদের কাজ করার সাহস দিতেন। আমরাও ম্যানেজার সাহেবকে সম্মান করতাম। উনার কথা ছাড়া এক পা-ও নড়তাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হয়তো আমরা আর এখানে থাকছি না। তাই ম্যানেজার সাহেবের মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। মহেশখালী গিয়ে সেখানে ভালোভাবে কাজ করার জন্যও ভালো উপদেশও দিলেন। ভালোভাবে চলার জন্য বললেন। মহেশখালী এলাকার স্থানীয় লোকজনের স্বভাবচরিত্র কেমন এবং তাঁদের সাথে কীভাবে চলাফেরা করবো, সে বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনাও দিলেন।

চায়ের দোকানে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে বলতেই কন্ট্রাক্টর সাহেব বেবিট্যাক্সি চড়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন। আমাদের তাড়াতাড়ি করে টিলায় গিয়ে বেডিংপত্র নিয়ে আসতে বললেন। আমরা টিলার উপরে গিয়ে বেডিংপত্র গোছগাছ করে বেঁধে সবার সাথে দেখা করে টিলার উপর থেকে নিচে নেমে আসলাম। ম্যানেজারের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা হলাম। বেবিট্যাক্সি চড়ে আসলাম কক্সবাজার যাওয়ার নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ডে। তখনকার সময়ে চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজারের বাস ভাড়া ছিল জনপ্রতি ১০ টাকা। বাসে ওঠার আগে কন্ট্রাক্টর সাহেব এক হোটেলে নিয়ে আমাদের নাস্তা খাওয়ালেন।

এরপরই কন্ট্রাক্টর সাহেব-সহ চারজন বাসে উঠে বাসলাম। তখন চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে কয় ঘণ্টা সময় যে লেগেছিল, তা বলতে পারবো না। তবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে প্রায় বিকাল হয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নেমে আবার এক হোটেলে গিয়ে চারজনে ভাত খেয়ে মহেশখালী যাওয়ার ট্রলার ঘাটে আসলাম। তখন কক্সবাজার থেকে মহেশখালী যেতে ট্রলারে জনপ্রতি ২ টাকা করে ভাড়া ছিল। ট্রলারে চড়ে মহেশখালী যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ট্রলার থেকে নেমে আবার এক চায়ের দোকানে চা পান করতে করতে কন্ট্রাক্টর সাহেব লোক মারফত উনার ম্যানেজারকে খবর পাঠালেন। ম্যানেজার সাহেব আসলেন। দুইজনে আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে গেলেন।

থাকার জায়গায়টা হলো, মহেশখালী বাজার থেকে নতুন বাজার যাওয়া রাস্তার পাশে থাকা সরকারি খাদ্য গোডাউন। সেই গোডাউনে তখন সরকারি কোনও খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না। অনেক বড় পাকা দালানের গোডাউন। সেই গোডাউনেই হলো আমাদের তিনজনের থাকার জায়গা। সাথে নেওয়া বেডিংপত্র গোডাউনের এক কোণে রেখে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে বাজারে আসলাম। তিনি আমাদের হাঁড়িপাতিল-সহ ১০-১২ দিনের চাল, ডাল, তেল, লবণ যা লাগে প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে দিলেন। তিনজনকে নগদ ১০০ টাকা করে হাত খরচ দিলেন। সেখানকার কাজের সাইটে থাকা ম্যানেজারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং কবে থেকে কাজ শুরু হবে তা ম্যানেজার সাথে বুঝ পরামর্শ করতে বললেন। আর আমাদের যখন যা দরকার হয়, তা ম্যানেজারকে দিতে বললেন। এরপর তিনি মহেশখালী থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলেন। আমরা থেকে গেলাম মহেশখালী।

কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর, আমরা তিনজন মহেশখালী বাজার থেকে মাছ-সহ কিছু কাঁচা তরিতরকারি কিনলাম। সাথে রান্না করার জন্য এক গাট্টি লাড়কিও কিনলাম। গোডাউনে এসে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রান্না করার চুলা তৈরি করলাম। একজন মাছ কাটছে। একজন ভাত রান্না করতে চাল ধুয়ে নিচ্ছে। আমি চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। এক তরকারি-সহ ভাত রান্না হয়ে গেল। তিনজনে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁর বিছানা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার আলুসিদ্ধ ভাত রান্না করে খেয়ে-দেয়ে কাজের ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। ম্যানেজার সাহেব উনার সাথে আমাদের কাজের সাইটে নিয়ে গেলেন। আমাদের যেই কাজের জন্য মহেশখালী নেওয়া হলো, সেই কাজটা হলো মহেশখালী থেকে সোজা পশ্চিমে নতুন বাজার পর্যন্ত মোট ১৩ মাইল সিসি ঢালাই রাস্তা তৈরির কাজ।

ম্যানেজারের সাথে কাজের সাইটে গিয়ে দেখা গেল, সেখানকার স্থানীয় লেবাররা সেদিন তখনো কেউ সাইটে আসেনি। ম্যানেজার সাহেব কাজের সাইটে কোথায় কী কী মাল আছে তা দেখিয়ে দিলেন। সেদিন সেখানে ম্যানেজার-সহ আমরা সেখানকার স্থানীয় লেবারদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু কারোর কোনও খবর হচ্ছিল না দেখে ম্যানেজার সাহেব সেদিনের জন্য কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে আমাদের নিয়ে সোজা মহেশখালী বাজারে চলে আসে। সেদিনের জন্য আমরা পুরোপুরি ফ্রি হয়ে গেলাম। আমাদের কাছ থেকে ম্যানেজার বিদায় হবার পর, আমরা মহেশখালী পুরো বাজারটা ঘুরে-ফিরে দেখে চা-বিস্কুট খেয়ে দুপুরের আগে আমাদের গোডাউনে চলে আসি। নিজেরা রান্নাবান্না করে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার তিনজনে মহেশখালী বাজারের দক্ষিণ পাশে সাগর পাড়ে ঘুরা-ঘুরি করে করে সন্ধ্যাবেলা চলে আসলাম নিজেদের থাকার জায়গা গোডাউনে।

পরদিন সকাল হতে-না-হতেই সেখানকার স্থানীয় লেবাররা গোডাউনে এসে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে ওঠালো। তাড়াতাড়ি ভাত রান্না না করেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে নাস্তা করে তাঁদের সাথে কাজে যোগদান করি। সেদিন কাজ করে স্থানীয় লেবারদের সাথে পরিচিত হলাম। পরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি আর থামছিল না। সারাদিন গোডাউনে আর বাজারে ঘুরা-ঘুরি করে সময় শেষ করলাম। এভাবে সেখানে প্রতিদিন হাঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির কারণে সেই কাজ আর আমরা বেশিদিন করতে পারিনি। প্রতিদিন সারাদিনের মধ্যে একবেলাও ঠিকমতো কাজ চলছিল না। ম্যানেজার সাহেবও আমাদের ঠিকমতো বাজার সাদাই করার খরচ দিচ্ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবেরও খবর ছিল না। তখনকার সময়ে এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ফোনও ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবের ডাক ঠিকানাও আমাদের জানা ছিল না। তাই নিজেদের পকেট খরচের কথা চিন্তা করে গোডাউনে থেকেই কাজ না থাকলে অন্য কাজ খুঁজতে থাকি।

একসময় বাজারে আসা-যাওয়ার মাঝেই এক লোকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। লোকটির নাম মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া । তিনি মহেশখালী বাজারের উত্তরে জাকিরিয়া সল্ট নামে এক লবণের মিলে কাজ করতো। তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের সব বিষয়-আশয় জানলেন, শুনলেন। আমাদের কোনপ্রকার চিন্তা না করার পরামর্শ দিলেন এবং জাকিরিয়া সল্টে তাঁদের সাথে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। তিনি জাকিরিয়া সল্টে গিয়ে উনার আরও তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আমাদের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। এরপর দুইদিন যেতে-না-যেতেই তিনি ইসমাইল মিয়া আমাদের কাজ রেডি করেছেন বলে জানালেন। কিন্তু আমরা গোডাউন খালি রেখে তিনজন একসাথে যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ এরমধ্যেই যদি কন্ট্রাক্টর সাহেব চট্টগ্রাম থেকে এখানে এসে আমাদের খুঁজে না পায়, তাহলে হয়তো আমাদের গার্ডিয়ানের ভয়ে মহেশখালী বাজারে থাকা থানায় জিডিও করতে পারে। সেজন্য আমরা তিনজন একসাথে এখান থেকে সরাসরি লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে রাজি হয়েছিলাম না।

তখন ইসমাইল মিয়া আমাদের বুদ্ধি দিলেন সপ্তাহে একজন করে রাস্তার কজা ছেড়ে লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে। আমরা তা-ই রাজি হয়ে আগে আমাদের সাথে থাকা লোকমান নামে লোকটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজ করার জন্য সুপারিশ করি। প্রতিদিন কাজের মজুরি ২৫ টাকা। আহা্! শুধু টাকা আর টাকা! এতো টাকা খরচ করেও শেষ করা যাবে বলে আমারা তিনজনই মনে মনে হিসাব কষতে ছিলাম। পরদিন সকালে লোকমান নামে বন্ধুটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে পাঠালাম। লোকমান লবণের মিলে কাজে লেগে গেলেন। আমরা দুইজন রাস্তার কাজেই থেকে গেলাম কন্ট্রাক্টর সাহেবের আগমণের আশায়। কিন্তু না, বেশকিছু দিন গত হয়ে গেলেও যখন আর কন্ট্রাক্টর সাহেব আসছিলেন না, তখন একদিন জাকিরিয়া সল্ট মিলের ইসমাইল মিয়ার শরণাপন্ন হলাম। ওই রাস্তার কাজ থেকে সরিয়ে আনতে আমাদের পক্ষ হয়ে ওই কাজের ম্যানেজারের সাথে আলাপ করার জন্য অনুরোধ করালাম।

তখন ইসমাইল মিয়া তাঁর আরও দুইতিন জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিয়ে একদিন বিকালবেলা ম্যানেজারের সাথে আলোচনা করে আমাদের দুইজনকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজে লাগিয়ে দেয়। আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।
চলবে…

জীবনের গল্প-৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৬

জীবনের গল্প-৫-এর শেষাংশ: মেজো দিদি মারা যাবার চার-পাঁচ মাস পর জামাইবাবু আরেক বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করে। দিদির রেখে যাওয়া এক বছরের মেয়েটি শেষতক আমাদেরই লালন-পালন করতে হয়। মেজো দিদির মৃত্যুর পর বাবার অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে।

মেজো দিদি মারা যাওয়ার পর বাবার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, তখন আর বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে গিয়ে ঔষধ খরচের টাকাও আনা সম্ভব হচ্ছিল না। চিত্তরঞ্জন মিল কর্তৃপক্ষও বাবার অনুপস্থিতে স্বাক্ষর বিহীন টাকা আমাদের কারোর কাছে দিতো না। মাস শেষে বাবার বেতনের টাকা তোলার জন্যও বাবাকে আদর্শ কটন মিল থেকে রিজার্ভ নৌকা করে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের নদী ঘাটে নৌকা বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। তারপরও মাসের বেতন হাতে পেতে মাস শেষে বাবাকে নিয়ে দুই-তিন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে যেতে হতো। এভাবে চলতে চলতে আমাদের সংসারের অবস্থাও দিন-দিন খারাপ হতে থাকে। সেইসাথে আমার লেখাপড়াও মাটির সাথে মিশে যেতে থাকে। মোটকথা তখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে সপ্তাহের প্রত্যেকদিন ১০ টাকা মজুরিতে নিয়মিত কাজ করতে লাগলাম।

একসময় বাবাকে আর কোনও অবস্থাতেই নৌকায় করেও চিত্তরঞ্জন কটন মিলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখন উপায়ন্তর না দেখে বাবা চিত্তরঞ্জন কটন মিলের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার জন্য অবসরপত্র জমা দেয়। সেই অবসরপত্র মিল কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহীত হয় একমাস পর। তারও দুইমাস পর বাবার চাকরির সার্ভিসের বিভিন্ন ভাতা-সহ টোটাল হিসাব হাতে পেয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে আমাদের ৮ সদস্যের সংসার যে কীভাবে চলেছিল, তা আর আমার এই লেখায় তুলে ধরতে পারলাম না, শর্টকাট করে বলে ফেলি।

বাবা চাকরি ছাড়ার দরখাস্ত দেওয়ার পর সংসারের করুণ অবস্থা দেখে আমি আদর্শ কটন মিলের ডেইলি কাজও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ প্রতিদিন কাজ থাকতো না! দুইদিন কাজ হতো, তো দুইদিন থাকতো না। এভাবে তো সে-অবস্থায় অন্তত আমার হচ্ছে না। কারণ হলো, অভাবগ্রস্থ সংসার তো ছিলোই, তারপরও ছিল আমার বাড়তি পকেট খরচ। যেমন– কাজের খাতিরে সহ-লেবারদের সাথে থেকে চা-বিড়ি-পান-সহ আরও নানারকম খরচ আমার এমনিতেই বেড়ে গিয়েছিল। যা দৈনন্দিন জীবনে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ওই লেবারদের সাথে কাজ করতেই গিয়েই, স্কুলে থাকতেই বিড়ি টানার বদভ্যাসটা হয়েগিয়েছিল। কাজ না থাকলে স্কুলে যাবার সময় নারায়ণগঞ্জের কাইয়ুম দু’চারটা পকেটে করে সাথে নিয়ে যেতাম। সময় সুযোগ বুঝে স্কুলের বাইরে গিয়ে ফুছুর-ফাছুর টনে আবার ক্লাসে আসতাম। যখন স্কুলে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়ে ওঁদের সাথে নিয়মিত কাজ করতে লাগলাম, পান-বিড়ি-সিগারেটও নিয়মিত টানতে লাগলাম। তখন চা-বিড়ি ছাড়া আমার মোটেও চলচ্ছিল না। তাই একদিন কাজ করে দুইদিন বসে থাকাটাও আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্যতামূলক আদর্শ কটন মিলের ডেইলি কাজ ছড়ে দিয়ে নতুন করে এক মসজিদ নির্মাণের কাজে লাগে গেলাম। মসজিদ তৈরি হচ্ছিল আদর্শ কটন মিলের ভেতরেই।

মসজিদের নির্মাণ কাজে সপ্তাহের প্রতিদিনই কাজ চলবে। সপ্তাহে শুধু একদিন সপ্তাহিক ছুটি থাকবে। আমার সাথে মিলের ভেতরে থাকা সমবয়সী আরও দুইজন লেবার ছিল। আমরা তিনজনে দৈনিক ১০ টাকা মজুরিতে নিয়মিত মসজিদ নির্মাণের কাজ করতে থাকি। সেই মসজিদ নির্মাণের কন্ট্রাক্টর ছিলেন চট্টগ্রামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আমাদের কাজ দেখে সেই কন্ট্রাক্টরের পছন্দ হয়ে যায় এবং তিনি আমাদের চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে ইচ্ছাপোষণ করে। তখন আদর্শ কটন মিলের মসজিদ নির্মাণের কাজের সাথে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় উনার আরও কাজ চলছিল।

আমি ছিলাম ঢালাই মাল বানোর মধ্য সেরা একজন। কন্ট্রাক্টর সাহেব বিশেষ করে আমার কাজ দেখেই পছন্দ করেছিল। তিনি প্রতিদিনই বিকালবেলা কাজ শেষে তাঁর সাথে চট্রগ্রাম যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতো। চট্টগ্রাম গেলে আমরা আরও ২টাকা রোজ বেশি পাবো বলেও কন্ট্রাক্টর সাহেব বলতো। এই ২ টাকার লোভে আমার সাথের দুইজন রাজি হয়ে গেল। কিন্তু আমি রাজি হচ্ছিলাম না, মা যদি যেতে না দেয়, তাই। তাছাড়া বাসায় অসুস্থ বাবা শয্যাশায়ী। সংসারের ভার বড়দাদা একা কোনমতেই সইতে পারবে না, সেই চিন্তাও আমার মাথায় ছিল। কিন্তু প্রতিদিন সাথের দুই জনের খোঁচানিতে আর ঠিক থাকতে পারলাম না, ওঁদের সাথে যাবো বলে কথা দিলাম। কিন্তু আমি আমার মা’কে না জানিয়ে কোনও অবস্থাতেই চট্টগ্রাম যাবো না, তাও বলেছিলাম।

ওঁদের সাথে কথা দিয়ে একদিন মাকে জানালাম চট্রগ্রাম যাবার কথা। মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বাবা বড়দাদা তো না-না-না-এর মধ্যেই থেকে গেল। কিন্তু কন্ট্রাক্টর সাহেব, আর সাথের দুইজনের তাগাদায় একসময় আমিও তাঁদের কথা দিলাম, মা রাজি থাকুক আর না থাকুক; চট্রগ্রাম যাবোই। তবে চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে কন্ট্রাক্টর সাহেবকে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে অগ্রীম দিতে হবে এবং যাওয়ার ভাড়া ও কাজে যোগদান করার আগ পর্যন্ত আমাদের খাওয়া খরচও দিতে হবে। কন্ট্রাক্টর সাহেব তা রাজি হয়ে গেলো। আমরাও খুশিতে হলাম আটখানা। মনে মনে ১২ টাকা খরচের হিসাব কষতে লাগলাম। ১২ টাকা থেকে প্রতিদিন ৫ টাকা খরচ করে বাকি ৭ টাকা বাসায় পাঠাতে পারলেই, মা-ও হবে খুশিতে আটখানা।

মনে মনে এই হিসাব মাথায় রেখে বাসায় আসলাম। মাকে অনেক লোভ দেখালাম, যাবার আগে ১০০ টাকা দিয়ে যাবো বলে কথা দিলাম। আর প্রতিমাসে মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাবো, সেটাও বললাম। আমার কথায় মা-ও লোভে পড়ে রাজি হয়ে গেল। আসার একদিন আগে অগ্রীম বাবদ পাওয়া ১০০ টাকা মায়ের হাতে দিলাম। ১০০ টাকা হাতে পেয়ে মা অনেক খুশি হলেন। মা বাবা ও বড় দাদাকে না জানিয়ে তা মনেই রেখে দিলেন। আসার সময় মা আমাকে ২০ টাকা খরচ করার জন্য সাথে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিলেন। আমরা তিনজন আদর্শ কটন মিল থেকে কন্ট্রাক্টরের সাথে চট্রগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। ওঁরা সাথে করে ওঁদের বেডিংপত্র নিয়ে নিলো। আমিও দুটো কাঁথা, একটা বালিশ, দুটো লুঙ্গি-সহ আমার পড়ার বইগুলো গাট্টির ভেতরে ঢুকিয়ে বেঁধে নিলাম। উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম গিয়ে কাজের অবসরে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার। আমার সাথে যে দুইজন লেবার চট্টগ্রাম যাচ্ছে, তাঁদের একজনের নাম ইসরাফিল, অন্যজনের নাম মোহাম্মদ লোকমান হোসেন। আদর্শ কটন মিলের আসার পর থেকে এই দুইজনই আমার খোঁজখবর বেশি রাখাতো। সবসময় কাজও করতাম ওঁদের সাথে। চট্রগ্রামও যাওয়া হচ্ছে ওঁদের ইচ্ছার কারণেই।

একসময় যাঁর যাঁর মা-বাবার কাছে বলেকয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেব-সহ আমারা চট্রগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। তখন ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্রগ্রামের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ২০ টাকা। একসময় ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে কন্ট্রাক্টর-সহ আমরা তিনজন চট্রগ্রাম পৌছলাম। সকালে ট্রেন থেকে নামার পর কন্ট্রাক্টর সাহেব প্রথমে আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। তিনজনকে নাস্তা খাওয়ালেন। একটু বিশ্রাম করতে দোতালা বাসার বারান্দায় শুতে দিলেন। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকালবেলা কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের সাথে করে আজডিপুর নামক স্থানে এক টিলার উপরে নিয়ে গেলেন।

সেই টিলার উপরে এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর বাসভবন নির্মাণের কাজ চলছিল, নির্মাণ কাজের কন্ট্রাক্ট ছিল এই কন্ট্রাক্টর সাহেবেরই। সেখা গিয়ে কাজের দেখবাল করার দায়িত্বে থাকা কন্ট্রাক্টরের ম্যানেজারকে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেব তাঁর বাসায় ফিরে গেলেন। সেদিন সেই টিলার উপরই আরও লেবারদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করে নির্মাণাধীন ভবনে সবার সাথে আমারাও ঘুমিয়ে পড়ি। রাত শেষে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে লেবারদের রান্না করা ডাল-ভাত খেয়ে আমাদের কী কাজ করতে হবে তা জানতে গেলাম, ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজার সাহেব আরও চার-পাঁচজন লেবারদের সাথে টিলার নিচ থেকে উপরে বালু ওঠানোর কথা বললেন।

টিলাটা ছিল পাহাড়ের মতো উঁচু। অনেক উঁচু টিলা হলেও সেখানকার পার্মানেন্ট লেবারদের কাছে যেন কোনও ব্যাপারই মনে হচ্ছিল না। তাঁরা দস্তুরমত বালুর টুকরি মাথায় নিয়ে দৌড়ে টিলার উপরে ওঠানামা করতে লাগলো। কিন্তু সেই কাজ আমাদের তিনজনের পক্ষে তা দুই ঘণ্টাও করা সম্ভব হচ্ছিল না। একসময় আমারা অস্থির হয়ে টিলার নিচেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমাদের এ অবস্থা দেখে সেখানকার স্থায়ী লেবাররা কেউ হাসাহাসি করতে লাগলো।কেউ দৌড়ে গিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে খবর দিলো। ম্যানেজার দৌড়ে টিলার নিচে আসলো। ম্যানেজার সাহেব টিলার নিচে নিচে আসলো। বালুর স্তুপের সামনে এসে ম্যানেজার সাহেব দেখে আমরা তিনজন পাহাড়ের লালমাটির উপর চিৎপটাং হয়ে মরার মতো পড়ে আছি। ম্যানেজার সাহেব আমাদের টেনে ওঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কাজ আমরা পারবো কি-না?’ আমরা হাতজোড় করে মাথা নেড়ে না-ই করলাম। আমাদের হাতজোড়ে ম্যানেজার সাহেবের দয়া হলো।

ম্যানেজার সাহেবে আমাদের সাথে করে নিকটস্থ রাস্তার পাশে এক দোকানে নিয়ে গেলো। যাঁর যাঁরমতো চা-বিস্কুট খেতে বললো। আমরা ক্লান্ত শরীরে বেশ কয়েকটা পাউরুটি-সহ পান-বিড়ি হজম করলাম। আমাদের সাথে ম্যানেজার সাহেবও চা পান করলেন। এরপর টিলার উপরে নিয়ে হালকা-পাতলা অন্য কাজ আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। আমরা তিনজন বুঝিয়ে দেওয়া সেই কাজ মনোযোগ সহকারে করতে লাগলাম। এক সপ্তাহ পর কন্ট্রাক্টর সাহেব কাজের সাইটে আসলেন। সবার কাজের মজুরি বুঝিয়ে দিলেন। আমাদেরও সেই কথামতো দৈনিক ১২ টাকা হারে বুঝিয়ে দিলেন। তা নিয়ে সেখানকার স্থায়ী লেবারদের সাথে কন্ট্রাক্টর সাহেবের একটু মন কষাকষিও হয়েছিল।

সেখানকার লেবারদের কথা হলো, ‘ওঁরা কোনও কাজই পারে না, অথচ ওঁদের মজুরি ১২ টাকা। আর আমাদের মজুরি ১০ টকা হবে কেন?’ ওখানকার লেবারদের কথা শেষে কন্ট্রাক্টর আমাদের কাজের বর্ণনা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওঁরা যা পারে, তা তোমরা আরও দুইবছরেও শিখতে পারবে না। আর আমি ওঁদের ঢাকা থেকে এখানকার কাজের জন্য আনিনি। ওঁদের এনেছি মহেশখালীতে রাস্তা নির্মাণ কাজের জন্য। ওঁরা শুধু আজ রাত পর্যন্তই এখানে থাকবে। গতকাল সকালেই আমি ওঁদের সাথে করে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা দিবো। সেখানেই ওঁরা কাজ করবে।’ এই বলেই কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের এই নির্মাণাধীন ভবনে রেখে উনার বাসায় চলে যায়। আমারা রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁরমতো ঘুমিয়ে পড়ি। রাত পোহালেই যেতে হবে মহেশখালী।

চলবে…

জীবনের গল্প-৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১’এখানে।

জীবনের গল্প-৫

জীবনের গল্প-৪-এর শেষাংশ: ওইদিন সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ! বড়দাদা আর মা বাবাকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে প্রথমে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে আনে। তারপর বাসায় আসলো রাত দশটার সময়। বাবার অবস্থা তখন বেশি ভালো ছিল না। ওইদিন বাসার সবাই মিলে সারারাত বাবার পাশে বসে রাত পার করেছিলাম।

বাবার হাতের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হতে লাগলো।একদিন পর-পর আমি নাহয় আমার মা বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের অফিসের সামনে ফকির মিসকিনের মতো বসে থাকতাম, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাহায্যে বাবার ঔষধ কেনার টাকার জন্য। দুই-তিন দিন ঘুরা-ঘুরির পর একদিন তাঁদের দয়া হতো, নাহয় আরও দুই-তিন গিয়ে অফিসের সামনে ভিক্ষুকদের মতো বসে থাকতে হতো। মাস শেষে মূলবেতন পাওয়া যেতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দয়ার উপর নির্ভর করে। তাও মিলের সব শ্রমিকদের বেতনের পরই পাওয়া যেতো। একারণে আমাদের সংসারে তখন নতুন করে দেখা দিলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সংসার চলতো একমাত্র বড় দাদার বেতনে। তখন বড়দাদা যেই টাকা বেতন পেতো, সেই টাকায় আমাদের ৯ সদস্যের সংসার ১৫ দিনও চলার মতো ছিল না। দোকান বাকি জমতে জমতে একসময় গলা সমান গয়ে গেলো। সাথে শেষ হয়ে যাবার উপক্রম হলো আমার লেখাপড়া। বাবা অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমার স্কুলে যাওয়াও আগের চেয়ে কমে গেলো। সপ্তাহে দুইদিন স্কুলে গেলে বাকি চারদিন স্কুলে থাকতাম অনুপস্থিত। বাসায়ও বই নিয়ে কখনো পড়তে বসতাম, সময়তে পড়তাম না। পড়তে বসতে মনও চাচ্ছিল না, বাবার অসুস্থতার কারণে।

স্কুলে না গিয়ে সারাদিন থাকতে হতো বাবার সাথে, আর মিলের ডেলি কাজ পাবার আশায়। একদিন কাজ পেতাম, দুইদিন বসা থাকতাম। এভাবে কেটে গেলো কয়েকমাস। এভাবে আমার কিছুতেই মন ভালো লাগছে না। তখন সংসারের অভাব আর বাবার হাতের ব্যথার ডাক-চিৎকারে আমার ঘরেই থাকতে মন চাচ্ছিল না। একদিন একটা চুক্তি কাজ পেলাম। কাজটা হলো মাটি কাটার কাজ। আমরা ছিলাম ছয়-সাত জন। দুইদিন মাটি কাটার কাজ করে ৩৫টাকা হাতে পেলাম। সেই টাকা পেয়ে সাথের একজনের সাথে আলাপ করলাম, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে কাঁচা বাদাম এনে বাসায় ভেজে বিকাল বিকাল মিলের গেইটে বসে বিক্রি করলে কেমন হয়!’ লোকটা বললো, “ভালোই তো হবে। বাদামে লাভ আছে! করতে পারলে ভালো হবে।” এর পরদিন আমি ৩৫ টাকা সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নারায়ণগঞ্জ গেলাম কাঁচা বাদাম আনতে। ২০ টাকা দিয়ে ৪ সের কাঁচা বাদাম কিনলাম। ছোট দাঁড়িপাল্লা-সহ প্রয়োজনীয় বাটখারাও কিনে আনলাম। মাকে বললাম, বাদামগুলো ভেজে দিতে। আমার মা তো আগেই মূড়ি ভাজার ওস্তাদ ছিলেন। তাই কীভাবে বাদাম ভাজতে হবে, তা আর মাকে কিছুই বলতে হয়নি। মা বালুর সাহায্যে খুব সুন্দরভাবে বাদাম গুলো ভাজলেন। আমি পরদিন বিকালবেলা একটা মুড়ির টিনে করে বাদাম নিয়ে মিলের গেইটে গিয়ে বসলাম, বিক্রি করার জন্য।

সেসময় আদর্শ কটন মিলের গেইটের সামনে আর কেউ বাদাম বিক্রি করতো না। গেইটের সামনে আমিই ছিলাম একমাত্র বাদামওয়ালা। মায়ের হাতে ভাজা বাদাম গুলো ১০ টাকা সের দামে, আধা ছটাক, এক ছটাক, আধা পোয়া, একপোয়া করে মুহূর্তে সব বাদাম শেষ করে ফেললাম। লাভ হলো ১০-১২ টাকার মতো। পরদিন সকালে আবার কাঁচা বাদাম আনতে চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জ। এদিন কাঁচা বাদাম আনলাম ৫ সের। সেগুলো ভাজে আগের দিনের মতো বিকালবেলা আবার মিল গেইটের সামনে গিয়ে বসলাম। এদিনও সব বাদাম বিক্রি করলাম। এভাবে প্রতিদিন সকালবেলা আমি নারায়ণগঞ্জ পায়ে হেঁটে যেতাম, আবার বাদাম মাথায় করে পায়ে হেঁটে বাসায় আসতাম। আমার এরকম কষ্ট দেখে একদিন আমার বড়দাদা আমাকে ৫০ টাকা হাতে দিলেন, বেশি করে বাদাম আনার জন্য। যাতে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ যেতে না হয়। তা-ই করলাম। বড় দাদার দেওয়া ৫০টাকা আর আমার কাছে থাকা কিছু টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে একসাথে ২০ সের (আধা মণ) কাঁচা বাদাম কিনে আনলাম। এতো অন্তত ৫/৬ দিন নারায়ণগঞ্জ যাওয়া-আসার ভেজাল শেষ করলাম।

প্রতিদিন ৪-৫ সের বাদাম মিল গেইটে নগদে বাকিতে মিলিয়ে বিক্রি করতাম। বিক্রি করে যা পেতাম, সব মায়ের কাছে এনে দিতাম। লাভের টাকা থেকে মা কিছু সংসারেও খরচ করতো। টুকটাক বাবার ঔষধে খরচ আনতো। মায়ের পান-সুপারি আনতো। আমি মাঝে-মধ্যে স্কুলে যাওয়া সময় আমাকেও চার আনা, আট আনা দিতো। এভাবেই চলতে থাকলো আমাদের দুর্ভিক্ষের সংসার। তখন আমাদের দুর্ভিক্ষপীড়িত সংসারের দায়িত্ব যেন বড় দাদার সাথে আমার উপরেও বর্তাল। আমি তখন মাঝে-মধ্যে স্কুলে যেতাম। বাবাকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলেও যাতাম। আবার প্রতিদিন বিকালবেলা শ্রমিকদের ছুটি হবার আগেই মিল গেইটে বাদামের টিন নিয়ে বসে থাকতাম। বাদাম বিক্রি শেষে আবার সময়তে সন্ধ্যার পর ওই ডেলি লেবারদের সাথেও কাজ করতাম। তবু্ও আমরা দুই ভাই আমাদের ৯ সদস্যের সংসারে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কোনো-কোনো দিন রাতে কিম্বা সকালে দুপুরে না খেয়ে থাকতাম।

এরমধ্যেই কুমিল্লা গৌরীপুর থেকে আমার এক বোনের বড় সেজো দিদির বিবাহের প্রস্তাব আসে। ছেলে ভালো। দাবি-দাওয়া নেই। নগদ টাকা, সোনা-দানা কিছুই দিতে হবে না। এমনকি আমাদের এখানে বিবাহ অনুষ্ঠানও করতে হবে না। বিবাহের দিন বড় দিদিকে ছেলে পক্ষ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে তাঁদের নিজ খরচে। এ-বাবদ আমাদের এক টাকাও খরচ করতে হবে না। আমাদের পাশে থাকা গৌরাঙ্গ কাকা-সহ মিল কোয়ার্টারের আরও অনেকেই বিয়েতে মত দিয়ে বলেছে, যদি আমার মা মেয়ে দিয়ে দিতে রাজি হয়; তাহলে আমরা সম্মিলিতভাবে মিলের সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের কাছ থেকে সাহায্য উঠিয়ে বিবাহের কাজ শেষ করবো। সবার কথা শুনে আমার মা ও বড় দাদা আরও দশজনকে সাথে নিয়ে কুমিল্লা ছেলেদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে আসলো।

এরপর মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেক্রেটারি-সহ ইউনিয়নের আরও সদস্যবৃন্দ বসে মিলের সকল শ্রমিকদের কাছে ১০ টাকা করে চাদা ধার্য্য করে এবং মিলের নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যানেজার সাহেব থেকেও কিছু দাবী করে। এতো সেসময় আমার সেজো দিদির বিয়ে জন্য মিল থেকে প্রায় ১০০০/= টাকার মতো সংগ্রহ হয়ে যায়। তারপরও একেবারে কিছু না দিয়ে তো দিদিকে পরের হাতে তুলে দেওয়া শোভা পায় না। হিন্দুদের বিয়েতে এক রত্তি স্বর্ণ হলেও লাগে, দিতে হয়। আমার বড় বৌদি বললেন, “প্রয়োজনে আমার হাতের চুড়ি, কানের দুল জোরা দিয়ে দিবো, তবুও যেন মায়ার ঠাকুরজির বিয়ে হয়।’

আমার বৌদি ছিলো আমাদের মায়ের মতো। আমার বড়দাদা বিয়ে করেছিল নোয়াখালী জমিদার হাট সংলগ্ন এক গ্রামে। বিয়ে করেছিল, দেশ স্বাধীন হবার পর দাদা ভারত থেকে দেশে ফেরার পর। আমার বড় দাদা বিয়ে করেছে এক গরিবের মেয়ে। মেয়ে পছন্দ করেছিল, নারায়ণগঞ্জ থেকে যেই ভগ্নিপতি আমাদের বাড়ি গিয়েছিল, সেই ভগ্নিপতির পছন্দের মেয়ে বলে কোনও দাবি-দাওয়া ছাড়াই বিয়ে হয়েছিল। তারপরও বিয়ের সময় বৌদির বাপের বাড়ি থেকে বৌদিকে হাতের, কানের, গলার তিনপদ সোনার জিনিস দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সোনার জিনিসগুলো থেকে আমাদের অভাবি সংসারের জন্য আগেই গলার হার বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। বাকি হাতের চুড়ি, আর কানের দুল এই বোনের বিয়েতে দিতে হচ্ছে, বৌদিকে। তারপরও বৌদি এ-ব্যাপারে কোনদিন টু-শব্দও করেছিল না। বরং কোনও অভিযোগ অনুযোগ ছাড়াই তিনি খেয়ে-না-খেয়ে আমাদের অভাবি সংসারে হাসি-খুশিতেই থাকতো।

এখন বোনের বিয়েতে বৌদি হাতের চুড়ি, আর কানে দুল দিয়ে দিলেও হিন্দু বিয়েতে নানারকম নিয়ম পালন করতে হলে আরও অনেক টাকার দরকার। উপায়ান্তর না দেখে বাবা বড় দাদাকে বললো, “নোয়াখালী গিয়ে বাড়ির নিজের অংশটুকু স্থানীয় বাদশা মিয়ার কাছে বিক্রি করে যা পাছ, তা এনে আমার মেয়ের বিয়ের কাজ শেষ কর।” আমাদের বাড়িটার ছিল তিন ভাগ। বাবার একভাগ। আমার দুই কাকার দুইভাগ। আমার দুই কাকা আরও আগেই তাঁদের নিজ-নিজ অংশ এই বাদশা মিয়া নামে কন্ট্রাক্টরের কাছেই বিক্রি করে দিয়েছিল। বাড়ির তিন অংশ থেকে বাকি থেকে যায় আমাদের অংশটুকু। সেই অংশটুকু বাবার সম্মতিতে বড়দা বোনের বিয়ের জন্য বিক্রি করতে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু বাবার স্বাক্ষর ছাড়া কোনও মতেই দাদার কাছে বাড়ি বিক্রির টাকা বাদশা কন্ট্রাক্টর বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছিল না। তখন বড়দাদা বুদ্ধি করে বলে-কয়ে বাড়ি বিক্রির টাকা-সহ বাদশা কন্ট্রাক্টরকে সাথে করে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসে, বাড়ি বিক্রির দলিলে বাবার একটা স্বাক্ষরের জন্য। বাদশা কন্ট্রাক্টর নারায়ণগঞ্জ আমাদের বাসায় এসে দলিলে আমার অসুস্থ বাবার স্বাক্ষর নিয়ে বাবার হাতেই তখনকার সময় ৪০০০/= হাজার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। সেই টাকা সেজো দিদির বিয়েতে খরচ করে বেঁচে যাওয়া যৎসামান্য কিছু টাকা দোকান বাকি-সহ আরও কিছু ধার-দেনা পরিশোধ করা হয়।

সেজো দিদির বিয়ের দিনতারিখ যখন ঠিক হয়, তখন কথা ছিল ছেলের পক্ষের খরচে সেজো দিদিকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই কথামতো ছেলে পক্ষ থেকে মেয়ের সাথে আরও দশজন যাওয়ার ভাড়া বাবদ ১০০ টাকা লোক মারফত বিয়ের একদিন আগেই আমার বড় দাদার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের দিন বড় দাদা-সহ মিলের আরও ৫/৬ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি সাথে করে সেজো দিদিকে ছেলের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমি আদরের ছোট ভাই, তাই সেজো দিদির সাথে আমিও ছিলাম। তখন চিটাগং রোড সংলগ্ন কাঁচপুরে ব্রিজ ছিল না। মেঘনা ব্রিজ ছিল না। দাউদকান্দি ব্রিজ ছিল না। ডেমরা ফেরিঘাট থেকে বাসে গৌরীপুর পর্যন্ত জন প্রতি ভাড়া ছিল মাত্র ৫ টাকা। বাস থেকে গৌরীপুর নেমে শুধু আমিই সেজো দিদির সাথে রিকশায় চড়ে ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর সবাই পায়ে হেঁটে ছেলের বাড়িতে পৌঁছেছিল। সাজো দিদির বিয়ের দিনই একই আসরে একই পুরোহিত দিয়ে ছেলের ছোট এক বোনের বিয়ে হয়। ছেলের ছোট বোনের বিয়ের কার্যসম্পাদন হয় আগে, আমার সেজো দিদির বিয়ে কাজ আরম্ভ হয় পরে।তবে খুব সুন্দরভাবে ঢাকঢোল বাজিয়ে আমার সেজো দিদির বিবাহের কার্যসম্পাদন সমাপ্ত হয়। বিয়ের পরদিন সবাই নারায়ণগঞ্জ চলে আসে। শুধু আমিই থেকে গেলাম সেজো দিদির সাথে। সেজো দিদির বাড়িতে সাতদিন থেকে জামাইবাবু-সহ আট দিনের দিন নারায়ণগঞ্জ চলে আসি।

সেজো দিদির বাড়ি থেকে ৮ দিন পর এসে দেখি, আদর্শ কটন মিলের গেইটের সামনে একজনকে বাদাম বিক্রি করতে। যিনি মিল গেইটে বাদাম বিক্রি করছে, তিনি শ্রমিক কলোনিরই একজনের মেয়ের জামাই ছিলেন। তাঁকে বাদাম বিক্রি করতে দেখে নিজের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপের কারণ হলো, এর আগে শুধু আমিই বাদাম বিক্রি করতাম। এখন মিল গেইটের দুইজন বাদামওয়ালা থাকলে এগের তুলনায় অর্ধেক বাদামও বিক্রি করতে পারবো না, তাই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আগের তুলনায় এখন অর্ধেক বাদাম বিক্রি হলে, তার চেয়ে বাদাম বিক্রি না করে অন্য কাজ করা ভালো হবে বলে মনে মনে ভাবতে লাগলাম। তাই বাসায় যে ক’সের বাদাম ছিল, সেগুলো শেষ করে বাদাম বিক্রি বাদ দিয়ে ১০ টাকা মজুরিতে ডেলি হাজিরায় লেবারের কাজে লেগে গেলাম। কিন্তু তখনও লেখাপড়া শেষ করিনি, ফাইল পরীক্ষার আশায়। একসময় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। টেনেটুনে পাসও করাম। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তিও হলাম।

অনেক কষ্ট করে পুরাতন বই কিনলাম। সপ্তাহে দুই-তিন মিলের কাজ বাদ দিয়ে স্কুলেও যেতাম। এরমধ্যেই লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলে থাকা আমার মেজো বোন জোৎস্না দিদি এক মেয়ে রেখে মৃত্যুবরণ করে। মেজো দিদি মারা যাবার চার-পাঁচ মাস পর জামাইবাবু আরেক বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করে। দিদির রেখে যাওয়া এক বছরের মেয়েটি শেষতক আমাদেরই লালন-পালন করতে হয়। মেজো দিদির মৃত্যুর পর বাবার অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে।
চলবে…

জীবনের গল্প-৬ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৪

জীবনের গল্প-৩ এর শেষাংশ: বারবার মনে পড়ছে বই কেনার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখার কথা। টাকার জন্য আমার তখন শোকে ধরে গেল। বই কেনা হলো না, অথচ টাকা খরচ করে ফেললাম! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই টাকা যে করেই হোক জোগাড় করবোই। গেলাম বন্ধুদের সাথে টেলিভিশন দেখতে। বাসায় ফিরে সেদিন আর পড়তে বসিনি। দুইটা আটা রুটি খেয়ে শুয়ে রইলাম।

রাত ভোর হওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে প্রতি দিনের মতো ঘরে বসে স্কুলের পড়া শেষ করি। তারপর, কিছু খেয়ে বই নিয়ে স্কুলের চলে যাই। বই কিনতে গিয়ে সিনেমা দেখে বাসায় আসার পরও আমার কাছে অবশিষ্ট ৭ টাকার মতন থেকে যায়। সেই টাকা আর খরচ করি না, সাথে করেই স্কুলে যাই। আবার সাথে করে নিয়ে আসি। মায়ের কাছেও দেই না, বড় দিদিদের কাছেও না। উদ্দেশ্য ২০টাকা মেলাতে পারলে মায়ের কাছে দিয়ে দিবো, বাবাকে দিয়ে দিতে।

এদিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেট যে-ক’জন ছিল, ওঁদের সাথে পুরান ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই-সহ বাদ থাকা বইগুলো কারোর কাছে পাবো কিনা আলাপও করি। উদ্দেশ্য যদি কারোর কাছে বাদ থাকা বইগুলো পাওয়া যায়, তাহলে আর বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হবে না, অল্প টাকায় হয়ে যাবো। এভাবে নিজেও বাদ থাকা বইগুলো সংগ্রহ করার জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি, কিন্তু পাইনি। যেই বইগুলো আমার কাছে ছিল না, সেই বইয়ের পড়া ক্লাসের ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের বই থেকে কিছু কিছু করে রাফখাতায় লিখে রাখতাম। বাসায় এসে সেগুলো পড়তাম। এভাবেই চলতে থাকলো আমার স্কুলের ক্লাস। একসময় প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও ঘনিয়ে আসতে লাগলো। পড়ে গেলাম দুশ্চিন্তায়! আমি শিওর ছিলাম পরীক্ষা দিলে আমি পাস করতে পারবো না, একশো পার্সেন্ট ফেল। তারপরও নিজের চেষ্টা নিজেই চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

এরমধ্যেই একদিন স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাসায় আসার পথেই আদর্শ কটন মিলের ডেলি লেবারদের সাথে দেখা। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজকে সন্ধ্যার পর কোনও কাজ আছে কিনা?’ একজন বললো, “আছে, কয়েক হাজার ইট নৌকা থেকে নামাতে হবে। টাকা নগদ নগদ। মানুষ কম দেখে এখনো মিলের সরদারের কাছে কেউ গিয়ে আলাপ করিনি। যে-কয়জন আছি তাতে নৌকা থেকে এতগুলো ইট নামানো সম্ভব হবে না। তুই যদি কাজ করতে চাস, তাহলে বাসায় গিয়ে খেয়ে-দেয়ে তাড়াতাড়ি করে মিলের গেইটে চলে আয়, আমরা সবাই মিলের সরদারের খোঁজে গেইটের সামনেই আছি।

ওঁদের কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে কোনরকম দু’চারটা খেয়ে, বন্ধুদের সাথে খেলা-ধুলার চিন্তা বাদ দিয়ে সোজা মিল গেইটে গিয়ে হাজির হলাম। ওঁরা ছিল ছয়জন। আমি-সহ হলাম সাতজন। নৌকা ভর্তি ইট। মিলের সরদারের সাথে কথা হলো, সব ইট নৌকা থেকে নামিয়ে মিলের ভেতরে জায়গামতো খামাল দিয়ে রাখতে হবে। আমরা রাজি হলাম, তা-ই করে দিবো। টাকা দিতে হবে ১৫০ টাকা। সরদার এতে রাজি হলো না। সরদার ১২০ টাকা দিতে রাজি। আমরা তা-ই রাজি হয়ে নৌকা থেকে ইট নামানোর জন্য যাঁর যাঁর মতো প্রস্তুতি নিয়ে নৌকার উপরে চলে গেলাম।

সাথের লেবারদের চেয়ে আমি বয়সে সবার ছোট ছিলাম বলে, ওঁরা আমাকে সবসময় হালকা-পাতলা কাজ দিয়ে রাখতো। ওইদিনও আমার কাজ ছিল অন্য লেবারদের মাথায় ইট সাজিয়ে দেওয়া। ওঁরা সবাই আদর্শ কটন মিলের শ্রমিক কলোনিতে থাকা শ্রমিকদেরই ছেলে-পেলে। মিলের ভেতরেই থাকতো। কিন্তু লেখাপড়া করতো না। সারাদিন ঘুরে-ফিরে সময় কাটাতো। নানারকম কাজ করে নিজেদের পকেট খরচ জোগাড় করতো। আদর্শ কটন মিলের ভেতরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পর থেকে এমনিতেই ওঁরা আমাকে কাছে ডাকতো। ওঁরা সবাই বিড়ি-সিগারেট টানতো। চা-পানও খেতো। কিন্তু আমি তখনো এসবের ধারেকাছেও ছিলাম না।

ওঁরা আরও অনেক আগে থেকে আমাকে মাঝেমধ্যে বলতো, “আরে বেডা, লেখাপড়া কইরা কী অইবো? আমাগো লগে থাইক্কা কাম কর! নিজের পকটে টেকা থাকলে হগলতে জিগাইবো, ডাকবো।” কিন্তু আমি আগে ওঁদের কথায় কান দিতাম না, নিজের লেখাপড়া নিয়েই টেনশনে থাকতাম। কিন্তু সংসারের অভাব অনটনের জন্য পেরে উঠতে পারছিলাম না। অনেক পরে হলেও শেষমেশ ওঁদের কথাই আমার কান দিতেই হলো। তাই ওইদিন গৌরাঙ্গ কাকার হাতে মার খাওয়ার পর থেকে ২০ টাকা মেলানোর জন্যই আমি ওঁদের পিছনে ঘুরঘুর করি। টুকটাক কাজও করি। ওইদিনের কাজটা হলো অন্যসব দিনের চেয়ে বড় কাজ এবং বেশি খাটুনির কাজ! পুরো একটা বড় নৌকা থেকে অনেকগুলো ইট নামাতে হচ্ছে।

একসময় নৌকা ভর্তি ইটগুলো আমরা খালি করে ফেললাম। রাত তখন আনুমানিক ১০ টার মতো হবে। আমি সেদিন টাকা পেলাম ২০ টাকা, ওঁরা নিয়ে নিলো ১০০টাকা। আমি ২০ টাকা হাতে পেয়ে মনের আনন্দে বাসায় গিয়ে মায়ের হাতে ২০টাকা দিলাম। মা ২০ টাকা হাতে পেয়ে হা করে আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, “এতো টাকা এত রাতে কোথায় পেলি? চুরি করেছিস নাকি?” আমি হেসে বললাম, ‘না মা, চুরি করিনি। নৌকা থেকে মিলের ইট নামিয়েছি।’ বাবা তখন বাসায় ছিল। আমার কথা শুনে বাবা আমার সামনে এসে বললো, “তাহলে তো তোর আর লেখাপড়া হবে না। তোর মন এখন টাকার দিকে চলে গেছে।” বাবার কথার উপর মা আবার বলে উঠলো, “টাকার দিকে মন যাবে না তো কোথায় যাবে? ওঁর বই নেই, খাতা নেই, কলম নেই, স্কুলের নামমাত্র বেতন দিতে পারি না। সামনে ওঁর পরীক্ষা। তাহলে ছেলে কী করবে? ও ঠিকই করেছে। এখন থেকে ওঁর নিজের খরচ নিজেই জোগার করে নিতে পারবে। ওঁর পেছনে আর কারোর দুই টাকা খরচ করতে হবে না।” এরপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “যা গামছাটা নিয়ে তাড়াতাড়ি গাঙ থেকে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাও।” বাবার কথার উত্তর আমার আর দিতে হয়নি। যা বলার মা-ই বলে দিয়েছে। বাবা চুপ করে ঘরে গিয়ে শুইয়ে রইল। আমি গামছা কাঁধে নিয়ে সোজা শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটে স্নান করতে চলে গেলাম।

এদিকে মা তাড়াতাড়ি গৌরাঙ্গ কাকার বাসা থেকে একবাটি ভাত চেয়ে এনে আমার জন্য রেডি করে রেখেছিল। তারপর মা আমাকে দুটো রুটি-সহ চেয়ে আনা ভাতগুলো সামনে দিলো। আমার মা সেদিন বুঝতে পেরেছিল যে ছেলে আমার কঠিন খাটুনির কাজ করে এসেছে। এখন ঘরে থাকা এই দুটো রুটিতে আমার ছেলের পেটের এক কোণাও ভরবে না। তাই আমি স্নান করার জন্য ঘরের বাইর হতেই, মা গৌরাঙ্গ কাকার বাসা থেকে ভাত এনে রেখে দিয়েছিল। ভাত খেতে বসে মাকে আস্তে আস্তে বললাম, ‘মা, আজ দেখছি রুটি আবার ভাত? রুটিও করেছ, ভাতও রান্না করেছ?’ মা বললো, ‘আরে না, রুটিই বানিয়ে ছিলাম। তোর জন্য দুটো রুটি রেখেছিলাম। এই কিছুক্ষণ আগে তোর গৌরাঙ্গ কাকার ঘর থেকে একবাটি ভাত হাওলাৎ এনেছি, তুই খা।” আমি আবার আস্তে আস্তে মাকে বললাম, ‘মা, বই কিনতে গিয়ে যেই টাকা হারিয়েছি, তা আজ অনেক কষ্ট করে আপনার কাছে এনে দিলাম। এই ২০টাকা বাবাকে দিয়ে দিবেন।’ মা বললো, “তোর বই নেই। আগে বই কিনে আনবি।” আমি বললাম, ‘মা, আর দু-এক দিন কাজ করতে পারলে বই কেনার টাকা আমার এমনিতেই হয়ে যাবে। আপনি এই টাকা বাবাকে দিয়ে দিবেন।’ আমার কথা শুনে মা বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে, আগে তুই ভাত খেয়ে নে।” রুটি আর ভাত খেয়ে নিজের শোবার জায়গায় গিয়ে চুপচাপ শুইয়ে রইলাম।

পরদিন সকালে যথারীতি ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে যখন ঘরে বই নিয়ে পড়তে বসলাম। আমার এক বোনের বড় মায়াদি সকালের খাবার নিয়ে আমার সামনে রাখলো। খাবার রেখে রাতে মায়ের কাছে দেওয়া ২০টাকা আমার পড়ার টেবিলের উপর রেখে বললো, “বাবা বলেছে এই টাকা দিয়ে বই কিনে আনতে। নাহলে বাবা রাগ করবে।” আমি আর দিদিকে কিছুই বললাম না, দিদির রাখা ২০টাকা বইয়ের ভেতরে রেখে দিলাম। স্কুলের সময় হলে স্কুলে চলে গেলাম। সাথের ক্লাসমেটদের সাথে নতুন বই কেনার ব্যাপারে আলাপ করলাম। ওঁরা বললো, “নতুন বই কিনতে হলে নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে না। ২নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের বাজারেই পাওয়া যাবে।” নিশ্চিত হলাম। স্কুল ছুটির পর একজন ক্লাসমেটকে অনুরোধ করে বললাম, ‘আমার সাথে একটু ২নং ঢাকেশ্বরী বাজারে যেতে হবে।’ ও রাজি হয়ে বললো, “চল যাই।” ওমনি দেরি আর না করে গুদারা নৌকা করে নদী পার হলাম। দুইজনের গুদারা ভাড়া পাঁচ পয়সা করে দশ পয়সা আমি দিবো মনে করে ভাড়া আদায়কারীর সামনে গিয়ে এক টাকার একটা নেট দিতে গেলে ভাড়া আদায়কারী আর রাখলো না।বললো, “যাও!” কিছুই বোঝার চেষ্টা না করে দশ পয়সা বেঁচে গিয়েছে, সেই আনন্দ মনে নিয়ে দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে ২নং ঢাকেশ্বরী বাজারে চলে গেলাম, বইয়ের দোকানে।

আমার সাথে টাকা ছিল ২৬ টাকার মতন। চারটা নতুন বইয়ের দাম হয়ে গেল ২৭ টাকার মতো। কিন্তু আমার কাছে আছে এক টাকা কম! সাথে যাওয়া স্কুলের বন্ধুটি বললো, “তোর কাছে কত আছে?” বললাম, ‘এক টাকা কম আছে।’ ওমনি লাইব্রেরির মালিক বললো, “দাও দাও, এক টাকা আর দিতে হবে না, বই নিয়ে যাও।” ২৭ টাকা দোকানদারকে দিয়ে বইগুলো নিয়ে নিলাম। সাথের স্কুল বন্ধুটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই তোর কাছে যাবার গুদারা ভাড়া আছে?’ ও বললো, “আমাদের গুদারা ভাড়া প্রতিদিন দিতে হয় না। আমরা মাসে একবার দেই। তাও সেটা দেওয়া হয় মিল থেকে। দেখলি না, আসার সময় যে গুদারা ভাড়া নেয়নি!’ ওঁর কথা শুনে চিন্তামুক্ত হয়ে দুইজনে আবার নদী পার হলাম। ওঁকে অনেকখানি পথ পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। আমি নতুন বই সাথে করে বাসায় পেলাম। বাসায় গিয়ে আগেই নতুন বইগুলো মাকে বড় দিদি ও বৌদিকে দেখালাম। তাঁরা বই দেখে খুশি হলো। মা জিজ্ঞেস করলো, “বইয়ের দাম কত?” আমি বললাম, ‘বেশি না, ২৭ টাকা।’ মা বললো, “দিলাম ২০ টাকা, বইয়ের দাম ২৭ টাকা। বাদবাকি টাকা কোথায় পেলি?” বললাম ‘আমার কাছে সেদিনের ৭/৮ টাকা ছিল। ওই টাকা মিলিয়ে সব বই একবারেই কিনে আনলাম। আমার আর বইয়ের চিন্তা করতে হবে না।’ আমার কথা শুনে বাসার সবাই খুশি হয়ে গেলো। আমি নতুন বই নতুন করে পড়ার ইচ্ছায় তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে যা ছিলো তা খেয়ে বই পড়তে বসে পড়লাম। সেদিন সন্ধ্যার পরও বাসা থেকে আর বের হইনি। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ার টেবিলেই ছিলাম। কারণ ক’দিন পরই পরীক্ষা।

তাই একটু মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া-সহ স্কুলে যাওয়া-আসাও ঠিকমতো করছি। যাঁদের সাথে মাঝেমধ্যে কাজ করি, ওঁদের সাথে আমার আগেরেই কথা; বিকালবেলা যদি কোনও কাজ থাকে, তাহলে যেন দয়া করে আমাকে কাজ দেয়। তাই সময় সময় ওঁরা বিকালবেলা কোনও কাজ পেলে, লোকের শর্ট থাকলেই আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যেতো। আমি ওঁদের সাথে কাজ করতাম। যা কয়টা টাকা পেতাম মায়ের কাছে এনে দিতাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় পরীক্ষার দিনতারিখ নির্ধারণ হলো। এক এক করে সব পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট বের হলো। স্কুলের নোটিশ বোর্ডের সবার নিচে আমার নাম দেখলাম। মানে টেনেটুনে পাস করলাম। তাতে আমি একটুও মন খারাপ করিনি, বরং খুশি হয়েছি। এর ক’দিন পরই আমার বাবা দুপুরবেলা উনার কর্মক্ষেত্রে অ্যাক্সিডেন্টে করলো। বাবা কাজ করতো শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলের আউট অফ সাইড ক্যালেন্ডারে। বাবার বাম হাতের চারটে আঙুল থেঁতলে গিয়েছিল।

দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই একদিকে তাড়াতাড়ি করে বাবাকে মিলের গাড়ি দিয়ে নিয়ে যায়, নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল। আরেকদিকে লোক মারফত খবর পাঠায় আদর্শ কটন মিলের ভেতরে আমাদের বাসায়। আমি ছিলাম স্কুলে। বড় দাদা ছিল আদর্শ কটন মিলে নিজের কাছে। খবর পেয়ে আমার মা বড় দুই বোন বৌদি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গিয়ে বড় দাদাকে খবর দিলো। বড় দাদা গেইটপাস নিয়ে তাড়াতাড়ি মিল থেকে বের হয়ে মাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হয়। আমি স্কুল থেকে আসার পথেই লোকমুখে বাবার অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে দৌড়ে বাসায় এসে দেখি, আমার বড় দিদি দুইজন বৌদি, ভাতিজি-ভাতিজা, বাসার সামনে বসে বসে কাঁদছে। আমাকে দেখে তাঁদের কান্না আরও বেড়ে গেলো। তাঁদের সাথে আমিও হাউমাউ করে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম। ওইদিন সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ! বড়দাদা আর মা বাবাকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে প্রথমে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে আনে। তারপর বাসায় আসলো রাত দশটার সময়। বাবার অবস্থা তখন বেশি ভালো ছিল না। ওইদিন বাসার সবাই মিলে সারারাত বাবার পাশে বসে রাত পার করেছিলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-৫ এখানে।

জীবনেরগল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৩

জীবনের গল্প-২ এর শেষাংশ: কিন্তুক আমাদের সংসারে লেগে থাকা দুর্ভিক্ষ তখনও দূর হয়নি। বারোমাসি দুর্ভিক্ষ আমাদের সংসারের লেগেই থাকলো। সেসময় স্কুলে যাওয়ার মতো পোশাকও আমার ছিল না। বাবা ও বড়দাদা মিল থেকে পাওয়া রিজেক্ট কাপড় দিয়ে বড়দি’র হাতে বানানো জামা- হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম। পায়ের স্যান্ডেলও ছিল না।

তারপরও একদিনের জন্যও স্কুল মিস করতাম না, স্কুলে আমি নিয়মিতই ক্লাস করতেছিলাম। ১নং ঢাকেশ্বরী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিত ক্লাস করছি ঠিক, কিন্তু আমার পড়ার সব বই ছিল না। সেসময় নতুন একসেট বই কেনার মতো সাধ্যও আমার বা আমাদের ছিল না। তখন আদর্শ কটন মিলের ভেতরে থাকা যেসব ছেলে-মেয়েরা ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে, সেসব ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে ওঁদের পুরাতন ছেঁড়া-ফাঁড়া কয়েকটা বই নামমাত্র মূল্যে সংগ্রহ করলাম। আর কিছু বই বাদ থেকে গেলো। মা বললেন বাদবাকি বইগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই কিনে দিবে। মায়ের কথা মেনে নিয়েই ছেঁড়া ফাঁড়া জামা প্যান্ট পরে হাইস্কুলে যেতাম, আসতাম, ক্লাস করতাম। তবে নতুন হাইস্কুলে যেতাম একা। আসতামও একা। কারণ, আদর্শ কটন মিলের ভেতরের কেউ এই হাইস্কুলে তখনও ভর্তি হয়েছিল না। তাই একাই যেতাম, একাই আসতাম। সময়টা তখন ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি নাহয় মার্চমাস হবে।

সেসময় দেশে দেখা দেওয়া দুর্ভিক্ষ কিছুটা দূর হতে শুরু করেছিল। অভাব অনটন আর দুর্ভিক্ষ শুধু লেগে থাকলো আমাদের ৯ সদস্যের সংসারে। কিন্তু খাই বা না খাই, আমার স্কুল ছিল নিয়মিত। স্কুলে যেতাম আসতাম ঠিকই, কিন্তু নিজের কাছে ভালো লাগতো না। সংসারের অভাব অনটনের জন্য আমার মনটা সবসময়ই খারাপ থাকতো। নতুন হাইস্কুলে ক্লাস শুরু করার প্রায় দুইমাস গত হয়ে গেলেও আমার বাদবাকি বইগুলো আর কেনা হচ্ছিল না। বাবা বড়দা বেতন পাবার পর দেখতাম দোকান বাকি দিয়েই সব শেষ হয়ে যেতো। ঘরে থাকতো না চাল, ডাল, আটা, তেল লবণ, লাড়কি খড়ি। তাই আমি স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে আবার লাড়কির চাহিদা মেটানোর জন্য গরুর গোবর কুড়াতাম। সে কুড়ানো গোবর মিলের বাউন্ডারি ওয়ালে চাপ্টির মতো করে লেপ্টে দিতাম। দেখতে দেখা যেতো হুবহু আটার রুটির মতো।এগুলোকে বলা হতো, গোবরের ঘুঁটে। এই গোবরের ঘুঁটে দিয়ে আমাদের সংসারের লাড়কির চাহিদা মিটত। আমার এই কষ্টের বিনিময়ে বাবা বেতন পেলে আমাকে নামমাত্র কয়টা টাকা দিতেন। সেই টাকা আমি খরচ করে খেতাম না। সেই টাকা দিয়ে পড়ার খাতা-কলম কিনে রাখতাম। খাতা-কলম কিনে দুইএক টাকার মতো থাকলে, তা দিয়ে স্কুলে যাঁরা আমাকে প্রতিদিন টিফিনের সময় ডেকে যেতো; বেঁচে যাওয়া সেই টাকা খরচ করে আমি তাঁদের পুরি-শিঙাড়া খাওয়াতাম। ওঁরা খুব খুশি হতো।

সেসময় সংসারের অভাবের কারণে স্কুল বন্ধের দিনে বাসায় বসে থাকতাম না। মিল গেইটে গিয়ে বসে থাকতাম, কাজের আশায়। মিলের কিছু মালামাল নৌকা করে মিলের নিজস্ব ঘাটে আসতো। তখন মালামাল নামানোর জন্য লেবার প্রয়োজন হতো। সেসব লেবারদের সাথে আমিও একজন লেবার হয়ে নৌকা থেকে মালামাল নামাতাম। বড় লেবাররা যদি পেতো ১৫ টাকা, আমাকে দিতো ৫ টাকা। তখনকার সময়ে ৫ টাকার খুবই দাম ছিল। এই ৫ টাকা এনে মায়ের হাতে দিতাম, মায়ের পান সুপারি কেনার জন্য। মা খুবই খুশি হয়ে আমাকে ঝাপটে ধরে কাঁদত। আমার মা সেই টাকা দিয়ে পান সুপারি কিনে খেতেন না। মা সেই টাকা আমার স্কুলের খাতা কলম কেনার জন্য আবার আমাকে দিয়ে দিতেন। সেই টাকা থেকে কিছু খরচ করে কিছু রেখে দিতাম, বাদ থাকা কয়টা বই কেনার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টা করেও একসাথে ২০-২৫ টাকা আর জমাতে পারিনি। তাই বাদবাকি বইগুলো আর সংগ্রহ করতে পারিনি। বইগুলো আমার বাদই থেকে গেলো।

একদিন স্কুলে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস চলছিল। তখন আমার কাছে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই ছিলো না। স্কুলের টিফিন টাইমে আমি এক ক্লাসমেট থেকে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বইটা চেয়ে নিয়ে বসে বসে পড়া মুখস্থ করছিলাম। টিফিনের পরেই ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস। আমি ক্লাসরুমে বসে পড়তে পড়তেই টিফিন টাইম শেষ হয়ে গেল। সব ছাত্রছাত্রী ক্লাসে ঢুকলো। স্যার আসলো। স্যার একেকজনকে প্রশ্ন করছে। যাঁকে প্রশ্ন করছে, সে দাঁড়িয়ে মুখস্থ পড়া বলছে। এবার স্যার আমাকে আঙুল উঁচিয়ে দাঁড়াতে বললো। আমি দাঁড়ালাম। প্রশ্ন করলেন, আমি আর উত্তর দিতে পারিনি। স্যারের হাতে ঠাসঠাস করে বেতের বাড়ি খেলাম কয়েকটা।

সেদিন বাসায় এসে মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে বললাম, ‘মা আমি আর স্কুলে পড়বো না’। মা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?” আমি বললাম, ‘আমার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই নেই! আজ স্যারের হাতে মার খেয়েছি, দেখেন’! মা দেখলো আমার পিঠে ফুলা লম্বা দাগ লাল হয়ে আছে। মা তেলে-জলে মিশিয়ে আমার পিঠে ঢলে দিলেন। রাতে বাবা বাসায় আসলেন। মা বাবাকে সব বৃত্তান্ত খুলে বললো। বাবা জিজ্ঞেস করলো, “বইয়ের দাম কত?” মা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “বইয়ের দাম কত?” আমি বললাম, ‘২০ টাকার মতো হবে’। বাবার কাছে মাত্র ১৫ টাকা ছিল। সেই ১৫ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বললো, “এই টাকা দিয়ে ও যেন বই কিনে নেয়”। মা আমার হাতে বাবার দেওয়া ১৫টাকা দিয়ে বললো, “কালই নারায়ণগঞ্জ থেকে বই কিনে আনবি”। আমি বললাম, ‘বইয়ের দাম তো ২০টাকার মতো’। তারপর মায়ের কাছে থাকা আরও ৫টাকা মিলিয়ে আমাকে ২০টাকা দিলেন বই কেনার জন্য। আমার কাছে জমানো ছিল ৫ টাকার মতো। মোট টাকা হয়ে গেলো ২৫ টাকা। আমি মহাখুশি!

রাত পোহালেই শুক্রবার। শুক্রবারে যে নারায়ণগঞ্জে সব দোকান বন্ধ থাকে তা আর আমার খেয়ালে ছিল না। আমি দুপুরে নামমাত্র দু’চারটা খেয়ে স্কুলের জামা-প্যান্ট পরে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে নারায়ণগঞ্জ চলে গেলাম বই কেনার জন্য। প্রথমে কালীর বাজার ঘুরে দেখলাম, এতএত বইয়ের দোকানের মধ্যে একটা দোকানও খোলা নেই। গেলাম ডিআইটি মার্কেট। সেখানেও বইয়ের দোকান খোলা পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম টান বাজার। টান বাজার ঘুরে দেখলাম, বইয়ের দোকান খোলা নেই। কোনও জায়গায় বইয়ের দোকান খোলা না পেয়ে হাঁটতে লাগলাম। উদ্দেশ্য বাসায় ফিরে যাবো।

আসার সময় সামনেই দেখি আশা সিনেমাহল। হলের সামনে লোকে লোকারণ্য। হৈচৈ পাড়া-পাড়ি। আশা সিনেমাহলের সামনেই বড় বিলবোর্ডে আর্ট করা বড় বড় ছবি! আশা সিনেমাহলে চলছে তখনকার সময়ে অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ” দি রেইন” ছায়াছবি। অভিনয়ে ওয়াসিম অলিভিয়া। তা দেখে আমার মনের ভেতরে শয়তান ঢুকে গেলো। আমি আস্তে আস্তে হলে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুকিঙে টিকেট নেই। যা আছে ব্লাকে তো আছে। সেকেন্ড ক্লাস ১০ টাকা। ফাস্ট ক্লাস ১৫ টাকা। এক ব্লেকার আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেকেন্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস বলে চিল্লাচিল্লি করছে। আমাকে নিতে বলছে, “নে নে, টিকেট শেষ! টিকেট শেষ! আমি আর মনটাকে সামলালে পারিনি। শয়তানের কাছে হার মেনে বইয়ের চিন্তা না করে ১০টাকা দিয়ে একটা সেকেন্ড ক্লাসের টিকেট নিয়ে ফেললাম। ব্লেকার আমার হাতে টিকেট দিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি দৌড় দে বেটা শো আরম্ভ হয়ে গেছে”।

তখনকার সময়ের অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ” দি রেইন” ছায়াছবির একটা গান শুনুন!

https://m.youtube.com/watch?v=RxycGP6r2X0

আমি তখন টিকেট হাতে নিয়ে দাঁড়াচ্ছি হলের দিকে। কিন্তু কোনদিকে যে সেকেন্ড ক্লাস, তা আর আমার জানা ছিল না। আমি সোজা ফাস্ট ক্লাসের গেইটে গিয়ে গেইট কিপারকে টিকেট দেখাচ্ছিলাম। গেইট কিপার আমাকে একটা দমক দিয়ে সেকেন্ড ক্লাসে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলো। আমি সেকেন্ড ক্লাসের গেইটে গিয়ে টিকেট দেখানোর পর গেইট কিপার আমার টিকেট দেখে হলের ভেতরে ঢুকতে দিলো। চেকম্যান টিকেট দেখে সিট দেখিয়ে দিলো। আমি আমার সিটে গিয়ে বসলাম। ছায়াছবির ” দি রেইন” দেখালাম সন্ধ্যা ৬ থেকে রাত ৯ পর্যন্ত। শো শেষ হলো। বই কেনার টাকা দিয়ে জীবনের দ্বিতীয়বার সিনেমা দেখে আশা সিনেমাহল থেকে রাত ৯টায় বের হলাম। (জীবনের দ্বিতীয়বার মানে, এর আগেও খুব ছোট থাকতে মায়ের কোলে বসে চৌমুহনী বাজারে থাকা ‘রূপ ভারতি’ সিনেমাহলে “মানুষের মন” ছায়াছবি দেখেছিলাম।) আশা সিনেমাহল থেকে বের হয়ে সামনে থাকা মিষ্টির দোকান থেকে এক টাকার পরোটা ভাজি খেলাম। রাত তখন প্রায় সাড়ে ৯টার মতো। ভাবলাম এতো রাতে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরা যাবে না। রিকশা নাহয় বাসে চড়েই যেতে হবে। এই ভেবে হাঁটতে হাঁটতে কালী বাজার আসলাম। তখন কালী বাজার থেকে রিকসায় চিত্তরঞ্জন কটন মিল গুদারা ঘাটের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ২ টাকা। দুইজন একসাথে ৪ টাকা।

রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালা আরেকজন জোগাড় করার জন্য চিত্তরঞ্জন চিত্তরঞ্জন একজন একজন বলে চিল্লাচ্ছিল। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের একজন প্যাসেঞ্জার আর পাচ্ছিল না, আমি রিকশায় উঠে বসেই রইলাম। প্রায় আধাঘন্টা হয়ে গেল, রিকশাওয়ালা একজন প্যাসেঞ্জার আর পাচ্ছিল না, আমিও তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারছি না। শেষমেশ আমি নিজের আরেকজনের ভাড়া বেশি দিয়ে একাই রিকশা নিয়ে চিত্তরঞ্জন গুদারাঘাট চলে আসলাম। কিন্তু এতো রাতে গুদারা ঘাটের খেয়া নৌকা ছিল না। নদীর এপার-ওপার মিলিয়ে দু’একটা নৌকা আছে মাঝিদের নিজস্ব নৌকা। চিত্তরঞ্জন গুদারা ঘাটে একটা ছইয়ানৌকা যাত্রীর আশায় বাধা আছে। কিন্তু নদী পার হবার মতো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না বলে, মাঝি বেটাও একজন নিয়ে নদী পাড়ি দিবে না। তখন গুদারা ভাড়া ছিল পাঁচ পয়সা। আর মাঝিদের নিজস্ব খেয়ানৌকায় জনপ্রতি ভাড়া ছিলো চারআনা। তখন গুদার ঘাটেই রাত হয়ে গেলো প্রায় ১১টা।

উপায়ন্তর না দেখে মাঝি বেটার হাতে-পায়ে ধরে দুই টাকা দিয়ে নদী পাড় হয়ে বাসায় গেলাম। বাসার সামনে যেতেই শুনি মায়ের কান্নাকাটি, আর বাবার ও বড় দাদার চিল্লাচিল্লি। মাথা নিচু করে চোরের মতো বাসায় ঢুকতেই, আমার বড় দাদা আমাকে খপ করে ধরে ফেললো। মুহূর্তেই আশে-পাশের বাসার মানুষ জড়ো হয়ে গেলো। বাবা বড় দাদাকে বলতে লাগলো, “ওঁকে মারবি না, শুধু জিজ্ঞেস কর; ও কোথায় গিয়েছিল”। তারপরও বড় দাদা দুই গালে দুটো চড় মেরে জিজ্ঞেস করলো, “বল কোথায় গছিয়েছিলি?” মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম, ‘বই কিনতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম’। বড় দাদা আবার জিজ্ঞেস করলো, ”বই কোথায়?” বললাম, ‘আজ তো শুক্রবার ছিল, তাই সব বইয়ের দোকান বন্ধ’। “তাহলে টাকা কোথায়? বের কর!” বললো বড় দাদা। ভয়ে ভয়ে মিথ্যে বললাম, ‘টাকা হারিয়ে ফেলেছি।’ এই কথা বলার সাথে সাথে আমার বাবার এক বন্ধ গৌরাঙ্গ কাকা দৌড়ে এসে আমাকে চড়থাপ্পড় মারা শুরু করে দিল। আমি মা গো মা গো বলে চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু না, সেদিন সেসময় আমার মা আর বড় দিদিরাও যেন নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিল। কেউ আমাকে ঐ কাকার হাত থেকে রক্ষা করেনি। আমিও আর সত্য কথা বলিনি, মিথ্যের মাঝেই রয়ে গেলাম। বাসার সামনে একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। বাবার বন্ধু গৌরাঙ্গ কাকা আমাকে সেই কাঁঠাল গাছের সাথে দুইহাত পিছনে দিয়ে বেঁধে রেখেছিল, সত্য ঘটনা উদঘাটনের জন্য। কিন্তু আমি বান্দা সেদিন আর সত্য কথা বলিনি। আমার একটা কথাই ছিল, টাকা প্যান্টের পকেট থেকে হারিয়ে গেছে। তারপরও আমাকে কাঁঠাল গাছের সাথে রাত দুইটা পর্যন্ত বেঁধে রেখেছিল। রাত যখন দুইটা ছুঁই ছুঁই করছিল, মা তখন কেঁদে কেঁদে বাবা দাদাকে বলেকয়ে গৌরাঙ্গ কাকার অনুমতি নিয়ে আমাকে ছেড়ে দিল।

ছাড়া পেয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম, আমার বাবার টাকা হারিয়েছি তাতে কাকার কী? গৌরাঙ্গ কাকা আমাকে মারল কেন? মা বললেন, “আরে চুপ কর, এই কাকাই তো একসময় তোর প্রাণ বাঁচতে সাহায্য করেছিল। যখন তোর গায়ে গুটিবসন্ত উঠেছিল। তোকে নিয়ে বাড়ি থেকে এখানে আসার পর এই গৌরাঙ্গ ঠাকুরপো তাঁদের ঘরে আমাদের থাকতে দিয়েছিল। আজ নাহয় তোকে দুটো চড়থাপ্পড়ই মেরেছে, তাতে কী হয়েছে? চল ভাত খাবি”। আমি মায়ের কথা না শুনে রাগে কাঁদতে কাঁদতে সোজা মিলে অভ্যন্তরে থাকা খেলার মাঠের দিকে চলে গেলাম। এর ঘণ্টাখানেক পর মা-বাবা দুইজন বাসা থেকে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে মাঠে এসে দেখে আমি মাঠের এককোণে বসে আসি। তখন মায়ের সাথে বাবাকে দেখে আমি আর রাগ করে বসে থাকতে পারিনি। মা বাবার সাথে বাসায় গিয়ে না খেয়েই শুয়ে রইলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার আগের নিয়মেই পড়তে বসলাম। স্কুলের সময় স্নান করে বই নিয়ে স্কুলে চলে গেলাম।

স্কুলে গিয়ে ক্লাসে বসে বসে গতরাতের কথা ভাবতে লাগলাম! ভাবলাম, সত্যি আমি গতকাল দুইটা অন্যায় করেছি। একটা হলো, বই কেনার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখেছি। আরেকটা হলো, গৌরাঙ্গ কাকার উপর অযথা রাগ করেছি। সত্যি অন্যায় করেছি। ভেবেছিলাম অভাবগ্রস্ত সংসারের কথাও। একসময় ক্লাস আরম্ভ হলো। স্কুল ছুটি হলো। বাসায় এসে বইয়ের জায়গায় বই রেখে পরনের জামা-প্যান্ট খুলে ভাত খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে মাঠে গেলাম। সব সমবয়সী বন্ধুরা আমাকে দেখে গতকালের ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। কেউ আবার জিজ্ঞেসও করলো, “সত্যি করে বলতো গতকাল তুই কোথায় গিয়েছিলি?” কারোর কথার জবাবই দিচ্ছিলাম না, শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কেউ বললো চল, হাতমুখ ধুয়ে লক্ষ্মণখোলা ক্লাবে গিয়ে টেলিভিশন দেখে আসি। কিন্তু আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। বারবার মনে পড়ছে বই কেনার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখার কথা। টাকার জন্য আমার তখন শোকে ধরে গেল। বই কেনা হলো না, অথচ টাকা খরচ করে ফেললাম! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই টাকা যে করেই হোক জোগাড় করবোই। গেলাম বন্ধুদের সাথে টেলিভিশন দেখতে। বাসায় ফিরে সেদিন আর পড়তে বসিনি। দুইটা আটা রুটি খেয়ে শুয়ে রইলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-৪ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২

জীবনের গল্প-১-এর শেষাংশ: থাকতাম মিলের শ্রমিক ফ্যামিলি কোয়ার্টারে। সময়টা তখন হতে পারে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর নাহয় ডিসেম্বর মাস।

গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পর প্রায় মাসখানেক পর্যন্ত আমার কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না এবং মিলের ভেতরে থাকা শ্রমিক কোয়ার্টারের কোনও সমবয়সী ছেলে আমার সাথে কথাও বলতো না। আমিও মিলের ভেতরে থাকা ওঁদের সাথে বেশি মিশতাম না। কারণ আমার নোয়াখালীর ভাষা ওঁরা কেউ বুঝতো না। আমি কিছু বলতে গেলেই আরও চার-পাঁচজন হিহিহি করে হাসতো। ওঁরা আমাকে দেখলেই নোয়াখাইল্লা নোয়াখাইল্লা বলে হাসাহাসি করতে। আবার আমার চেহেরাটা বেশি সুশ্রী ছিল না বলে, ওঁরা আমাকে দেখে ভেংচি দিতো।

আসলে ওঁদের কোনও দোষ ছিল না। দোষ ছিল আমার কুশ্রীত চেহারার। আমার মুখমণ্ডল আরও দশজনের চেয়ে অন্যরকম ছিল। মানে কুশ্রী। চেহারা কুশ্রী হওয়ার কারণ হলো, আমার বয়স যখন চার বছর; তখন নাকি আমি গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় তিনমাস পর্যন্ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে রোগমুক্ত হয়েছিলাম। শুনেছিলাম মা-বাবা ও বড়দাদা আর বোনদের মুখে। এই তিন মাসে গুটিবসন্ত রোগে আমাকে নাকি কঠিনভাবে আক্রান্ত করে ফেলেছিল। সেসময় আমাকে নাকি বাঁচিয়ে রাখার কোনও উপায়ই ছিল না। তবুও মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় নাকি বেঁচে গিয়েছিলাম।

আমার শরীরে নাকি বসন্ত রোগের সাত জাতের মধ্যে সাত জাতই দেখা দেয়েছিল। আগেকার মানুষে বলতো, একজন মানুষের যদি একসাথে সৈয়দ, দাউদ, বরণ রোগ দেখা দিতো, তখন নাকি ওই মানুষটার মরণই হতো। তাই কথায় আছে, “সৈয়দ, দাউদ, বরণ, এই তিন জাত উঠলে হয় মরণ।” আমার শরীরে উঠেছিল সাত জাত। এগুলো হলো, “সৈয়দ, দাউদ, বরণ, ছালাকাটা, মসুরিকাটা লুন্তি ও বসন্ত।” এই রোগ ছিল ছোঁয়াচে রোগ। একবার এক গ্রামে বা মহল্লায় দেখা দিলে, তাহলে পুরো গ্রামের ঘরে ঘরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তো এবং শতশত মানুষ মারা যেতো। কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছিলাম, আমার মা-বাবার আপ্রাণ চেষ্টার কারণে এবং মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায়। বলে বলে রাখা ভালো যে, আমার এই রোগের কারণে অন্যকোনো পরিবারের মানুষ তখন এই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়নি। এই রোগের রুগী শুধু আমি একাই ছিলাম।

আমার শরীরে যখন এই রোগ দেখা দেয়, তখন আমি গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। সাতদিন পর্যন্ত আমার মা গ্রাম্য কবিরাজ থেকে ঝাড়ফুঁক, ঔষধ ও পানি পড়া খাওয়ানোর পরও যখন আমি ভালো হচ্ছিলাম না, তখনই আমার মা নিকটস্থ পোস্ট অফিস থেকে বাবাকে টেলিগ্রাফ করে পাঠায়। বাবা তখন মায়ের পাঠানো টেলিগ্রাফ পেয়ে সাথে সাথে ধারদেনা করে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে এসে মা-সহ আমাকে অতি কষ্টে আমার সুচিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যায়। মা আমাকে নিয়ে উঠলো, আদর্শ কটন মিলের শ্রমিকদের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকা পরিচিত একজনের বাসায়। আমাকে নিয়ে যাঁর বাসায় গিয়ে উঠল, ওই লোক ছিল আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বাবার সাগরেদ। আমার এই ছোঁয়াচে রোগ হওয়ার পরও ওই লোক তাঁদের একটা রুম আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। যাতে আমার কোনো সমস্যা না হয়। ওই বাসায় থাকা খাওয়ার কোনও সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল শুধু আমার চিকিৎসার সমস্যা। তখন আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, আমাকে দেখে সবাই বলেছিল, আমাকে আর বাঁচানো যাবে না। নিশ্চিত মৃত্যু। আমার মা-বাবাও আমার আশা একরকম ছেড়ে দিয়ে নিকটস্থ ১নং ঢাকেশ্বরী কনট মিলের শ্রমিক কলোনিতে থাকা একজন কবিরাজের শরণাপন্ন হলেন। তিনি শুধু এই রোগেরই চিকিৎসা করতেন। গ্রামের বাড়ি থেকে আমাকে নারায়ণগঞ্জ আনাও হয়েছিল এই কবিরাজকে দেখানোর জন্য।

তখনকার সময়ে এদেশে এই রোগের কবিরাজি চিকিৎসা ছাড়া অন্যকোনো সুচিকিৎসা ছিল না। আমাকে যে কবিরাজ চিকিৎসা করেছিল, তিনি ছিলেন একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তিনি মাশীতলা দেবী’র সাধন করতেন এবং যেখানেই এই রোগ দেখা দিতো, সেখানেই দৌড়ে যেতেন। বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। উনার চিকিৎসায় এই রোগ থেকে সেরে ওঠলে নামমাত্রও কিছু নিতেন না। আমার এই রোগ হওয়ার আগে থেকেই ওই সাধকের পরিবারের সাথে আমার মা-বাবার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই এই চিকিৎসক আমার সু-চিকিৎসার জন্য এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের বাসায় বসেই মা শীতলা দেবী’র পূজা করতেন এবং আমাকে চিকিৎসা করতেন। উনি প্রচুর মদপান করতেন। শীতলা দেবী’র পূজা সেরে উনি মদ পানের সাথে আমার শরীরও নাকি চেটে খেতেন। শুনেছি মায়ের মুখে।

সেসময় এই গুটিবসন্তের কারণে আমার সমস্ত শরীরই পচন ধরে গিয়েছিল। শরীরের পুরো অংশই ছিল মাংসবিহীন। চৌকির উপর কলাপাতা বিছিয়ে তিলের তেল কলাপাতায় মেখে সেখানে আমাকে শোয়াইয়ে রাখতো। এমনিতেই এই রোগ হলে একরকম চুলকানির মতো রোগ। এই রোগ হলে সমস্ত শরীরই চুলকায়। শরীর চুলকানির কারণে আমি নাকি সবসময়ই আমার দুইহাত দিয়ে মুখমণ্ডল-সহ সারা শরীর সারাক্ষণ খামচাতাম। এজন্য আমার হাত পা চৌকির চার পায়ার সাথে বেঁধে রাখা হতো। যাতে আমি হাত পা দিয়ে শরীর না খামচাতে পারি। তবুও মাঝে মাঝে হাত দিয়ে খামচানোর ফলে, আমার মুখমণ্ডলের মাংস (ত্বক) হাতের নখের খোঁচায় এদিক-সেদিক হয়ে গিয়েছিল। সাথে দু’চোখের মনিতেও গুটিবসন্ত উঠেছিল। তিনমাস মৃত্যুশয্যা থেকে সেরে উঠার পর অন্তত বছরখানেক আমি অন্ধ মানুষের মতো দু-হাত নেড়ে-চেড়ে চলতাম। ওই কবিরাজের সাজেশন মতো পুকুরে জন্মানো বড় আকারের শামুকের জল প্রতিদিন তিনবেলা কয়েক ফোঁটা করে দেওয়ার পর আমার চোখ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুখমণ্ডল থেকে সরে যাওয়া মাংস(ত্বক) আর সমান হয়নি। আমার চেহারা এখনো কুশ্রী।

এই কুশ্রী চেহারা আর নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার কারণে আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে থাকা সমবয়সী ছেলেরা আমাকে দেখে একরকম ঘৃণাই করতো। হাসতো, ভেংচি দিতো। এতে আমার খুব রাগ হতো। অনেক সময় বেশি রাগ হয়ে যেতো। তখন মিল অভ্যন্তরে অনেক ছেলেকে ধামধুম মেরে নিজেদের বাসায় এসে বসে থাকতাম। আর বাড়ি থেকে সাথে আনা পুরানো বইগুলো নিজে নিজেই পড়তাম। এভাবে আস্তে আস্তে নিজে নিজেই নারায়ণগঞ্জের কিছু আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করে ফেললাম। বাসার বাইরে যেতাম। মিলের ভেতরে স্থায়ীভাবে থাকা সমবয়সী ছেলেরাও আস্তে আস্তে আমাকে কাছে ডাকতে শুরু করলো। ওঁদের সাথে খেলতে বলতো। আমিও ওঁদের সাথে মিশতাম, খেলতাম। যখন যা-ই করতাম, বাসায় এসে নিয়মিত পুরানো বইগুলো একা একা নেড়ে-চেড়ে পড়তাম। স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে বলতাম। মা শুনতেন, কিন্তু আমার কথায় সায় দিতেন না। কারণ আদর্শ কটন মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে সব ফ্যামিলিদের মধ্যে আমরাই ছিলাম একেবারে নিকৃষ্ট ফ্যামিলি। মানে অভাবগ্রস্ত ফ্যামিলি।

তখন আমাদের সংসার ছিল মা-বাবা, দাদা-বৌদি, দুকজন ভাতিজা, একজন ভাতিজী, অবিবাহিত দুই বোন ও আমি-সহ মোট নয়জন সদস্যের বিরাট এক সংসার। ইনকাম করার মতো ছিল আমার বাবা আর বড়দাদা। তাও ছিল নামমাত্র বেতন। মাসের প্রত্যেক দিনই তিনবেলার মধ্যে শুধু দুপুরবেলাই আমাদের কপালে ভাত জুটতো। আর দিনের দুইবেলার মধ্যে কোনো-কোনো সময় শুধু একবেলা খেতে পারতাম। আর একবেলা থাকত হতো আকাশ পানে চেয়ে। তখন মিল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রত্যেক শ্রমিক ও স্টাফের রেশন কার্ড দেওয়া ছিল। আমাদেরও ছিল। বাবারও ছিল। বড় দাদারও ছিল। রেশন কার্ডে শুধু চাল, গম, চিনি পেতাম। আমাদের সংসার মাসের অর্ধেক সময় রেশন কার্ডের উপর নির্ভর থাকতো। কোনো-কোনো সময় নগদ টাকা না থাকার কারণে রেশন তুলতে পারতাম না। তখন সামান্য লাভে রেশন বিক্রি করে দিতে হতো। ওই রেশন বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে অন্য কারোর রেশন থেকে গম কিনে নিতাম। সেই গম থেকে আটা করে সকাল-বিকাল আটার রুটি খেতাম। সময়টা তখন ১৯৭৩ সালের শেষদিকে। এরই মধ্যে দেশে দেখা দিতে শুরু করলো দুর্ভিক্ষ। এমন অবস্থার মধ্যে আমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করানো যেন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ালো। তবুও আমার পড়ার আগ্রহ দেখে সংসারের অভাব অনটনের মধ্যেও ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে আমার বড়দাদা নিকটস্থ দক্ষিণ লক্ষ্মণ খোলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেয়।

তখন দেশের চারদিকে দুর্ভিক্ষ! জায়গায় জায়গায় মানুষ না খেয়ে মরছে, এমন খবর সবসময়ই সবার মুখে মুখে থাকতো। সেসময় আমাদের মতো কষ্ট এদেশে আর কেউ হয়তো করেনি। দুইবেলা আটার জাউ ছিল আমাদের সংসারের নিয়মিত খাবারের তালিকায়। আর দুপুরবেলা চালের সাথে বেশি করে আলু কুচি দিয়ে ভাত রান্না করা হতো। মানে চালের উপর চাপ কমানো। চাল কম, আলু বেশি। সেসময় অভাব অনটন যে কী তা আমি এতো বুঝতাম না। আমি স্কুলে যাওয়ার সময় তামার দুই পয়সার জন্য মায়ের কাছে চেয়ে কাঁদতাম। কোনও দিন পেতাম। কোনও দিন আবার পেতাম না, কাঁদতে কাঁদতে বই বগলে নিয়ে স্কুলে চলে যেতাম। স্কুলে গিয়ে দেখতাম আরও দশজন সমবয়সী মনের আনন্দে আইসক্রিম খেতো, বুট ভাজা খেতো, এটা খেতো, সেটা খেতো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম, আর চোখের জল ফেলতাম। তবুও পারতপক্ষে কোনও দিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করিনি। আমি আমার ক্লাসে সবসময়ই নিয়মিত ছিলাম। ঘরে খাবার না থাকলেও, আমি বান্দা স্কুলে যেতাম।

সেই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের হাইস্কুলে ভর্তি হলাম ঠিক, কিন্তু সংসারের অভাব অনটন আমাকে দুর্বল করে তোলে। স্কুল থেকে বাসায় আসার পর যখন দেখতাম ভাতের হাঁড়িতে ভাত নেই, তখন কাউকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা আদর্শ কটন মিলের খেলার মাঠের এককোণে নিরিবিলি বসে থাকতাম অথবা সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খালি পেটে খেলায় মেতে থাকতাম। অনেকসময় সন্ধ্যাবেলা বন্ধুদের সাথে লক্ষ্মণখোলা জনতা ক্লাবে টেলিভিশন দেখতে চলে যেতাম। তখন আদর্শ কটন মিলে টেলিভিশন ছিল না। তখনকার সময়ে টেলিভিশনের খুবই দাম ছিল, মান ছিল, সম্মান ছিল। এখনকার মতো ঘরে ঘরে, মহল্লার আনাচে-কানাচে, হাটবাজারে টেলিভিশন ছিল না। টেলিভিশন ছিল সাতরাজার ধন, মানিক রতন। যা ছিল স্বপ্নের ব্যাপার-স্যাপার।

অনেকসময় টেলিভিশন দেখতে গিয়ে লক্ষ্মণখোলার স্থানীয় ছেলেদের হাতে মাইর-গুতা খেয়ে বাসায় ফিরতাম। বাসায় এসে দেখতাম রাতের খাবার তখনও জোগাড় হয়নি। না খেয়ে ওমনি বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে থাকতাম। অনেক রাতে বড় দিদিরা ভাত খেতে ডাকতো। কোনও দিন ওঠে খেতাম। কোনও দিন আর উঠতাম না। না খেয়েই ঘুমিয়ে থাকতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে জল দেওয়া পান্তাভাত খেয়ে আবার পড়তে বসতাম। স্কুলে যাবার সময় হলে শীতলক্ষ্যা নদীতে স্নান করে তাড়াতাড়ি স্কুলে চলে যেতাম। স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে কোনও দিন দেখতাম ভাতের হাঁড়িতে ভাত আছে, কোনও দিন দেখতাম ভাত নেই। এভাবেই সেসময়কার দিনগুলো আমাদের অতিবাহিত হতে লাগলো। দেশের দুর্ভিক্ষও তখন আস্তে আস্তে হাত নেড়ে দূরে যেতে লাগলো। কিন্তুক আমাদের সংসারে লেগে থাকা দুর্ভিক্ষ তখনও দূর হয়নি। বারোমাসি দুর্ভিক্ষ আমাদের সংসারের লেগেই থাকলো। সেসময় স্কুলে যাওয়ার মতো পোশাকও আমার ছিল না। বাবা ও বড়দাদা মিল থেকে পাওয়া রিজেক্ট কাপড় দিয়ে বড়দি’র হাতে বানানো জামা- হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম। পায়ের স্যান্ডেলও ছিল না।

চলবে…

জীবনের গল্প-৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।