
জীবনের গল্প-২৮ এর শেষাংশ: বুঝেশুঝেই দিবে। আমি বড়দি’র কথা শুনে মুচকি হেসে দিদির বাড়ির ভেতরে গেলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘দিদি আমরা বাংলাদেশি লোকেরা এরকমই। খরচের কাছে আমরা কখনোই হার মানি না।’
দিদির সাথে গেলাম বাড়ির ভেতরে। সাথে দিদির বাড়ির আশেপাশে থাকা আরও কয়েকজন ছিলো। এর পরমুহূর্তেই মধ্যেই দিদির বাড়ির আশেপাশের বাড়িতে খবর পৌঁছে গেলো। রবিন্দ্র নগর কলোনি এরিয়াতে থাকা প্রত্যেক বাড়ির মহিলা-পুরুষ দিদির বাড়ি আসতে লাগলো। সবাই বলতে লাগলো, ‘এতো বছর পর বুঝি দিদির কথা মনে পড়লো?’ কেউ আবার তাদের বাংলাদেশে থাকা বাড়ি-ঘরের কথাও জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ওখানে বসবাসকারী বেশিরভাগ বাঙালি হিন্দুদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাশহরে ছিলো। কারোর বাড়ি ফরিদপুর, কারোর বাড়ি মুন্সিগঞ্জ, কারোর বাড়ি গোপালগঞ্জ। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে কারোর আত্মীয়স্বজনের বাড়ি নেই। তাই কেউ নারায়ণগঞ্জের কথা জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি আমার জন্মভূমি নোয়াখালীর কথাও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। আমি তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম, ‘এখানে থাকা কারোর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সাইডে আছে কি-না?’ তখন আমার কথা শুনে সবাই বলছে, ‘না গো না। নারায়ণগঞ্জ নাম শুনেছি, কিন্তু কখনো সেখানে যাইনি। আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজনও নারায়ণগঞ্জ থাকে না।’
আমার বড়দি বললেন, ‘আমার যখন বিয়ে হয়েছিল, তারও আগে থেকেই আমার বাবা, বড়দা নারায়ণগঞ্জ থাকতেন।’ বড়দির কথার শুনে আমি বললাম, ‘দিদি বাবা যেখানে চাকরি করতেন বা থাকতেন, সেই মিলের নামটা কি আপনার মনে আছে?’ আমার বড়দি বললেন, ‘নামটাতো পেটে আছে, কিন্তু মুখে নেই!’ আমি বললাম, সেই মিলের নামটা ছিল, আদর্শ কটন মিলস্। আমার কথা শুনে আমার বড়দি আবারও কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। ঐ আদর্শ মিলে মায়ের সাথে আমিও একবার গিয়েছিলাম। বড়দাও সেখানেই চাকরি করতেন, তাইনা রে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি, দাদাও সেই মিলেই চাকরি করতেন।’
তখন আমার কথা শুনে বড়দি, জামাইবাবু, ভাগিনা-ভাগ্নি-সহ সবাই শতভাগ নিশ্চিত হতে পেরেছিল যে, এটা আমার ভাই, আর এটা আমার শালা, আর এটা আমাদের মামা। কিন্তু এর আগে আমি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম বড়দি, আর জামাইবাবু দুইজনের মনের ভেতরে কেমন যেন একরকম সন্দেহের ভাব! সন্দেহের কারণ হলো, “ও-কি সত্যিই সেই কোলের শিশু নিতাই? নাকি অন্য কেউ?” যখন ঠিকঠাক সব বলতে পেরেছিলাম, তখনই তাদের মনের ভেতরকার সন্দেহটা দূর হয়েছিলো।
এর মধ্যে বড়দির কাছে মা-বাবা স্বর্গীয় হবার কথা বললাম। জামাইবাবু, দিদি দুইজনেই হায়-আফসোস করলেন। দিদি মা-বাবার কথা বলে কাঁদলেন। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কি বিয়ে করেছিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি। একটা গরিবের মেয়েকে বিয়ে করেছি। দুইজন বাচ্চাকাচ্চাও আছে। একজন মেয়ে, আরেকজন ছেলে।’ তারপর আমার বড়দি আমাকে দেখতে আসা সবাইকে একটা করে মিষ্টি দিলো। সবাই তখন হাসাহাসি করে বলতে লাগলো, ‘দিদি, ‘আপনার ভাই কি বাংলাদেশ থেকে মিষ্টি গুলো এনেছে নাকি?’ আমি বললাম, ‘আমি যখন বাংলাদেশি, মনে করেন মিষ্টিও বাংলাদেশি। বলতে পারি আপনাদের এখানে এমন সুস্বাদু মিষ্টি পাওয়া যাবে না, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত। এগুলো উন্নতমানের এবং খুবই দামি মিষ্টি।’ আমার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। আবার কেউ কেউ বলতে লাগলো, ‘জয় বাংলার লোক বড় চালু।’ আমার বড়দি বললো, চালু না হলে কি আর বাংলাদেশ থেকে একা একা এখানে আসতে পেরেছে? যাক না ক’দিন, তারপর সবাই বুঝবে আমার ভাই কত চালু!’
এরপর আমি সাথে নেওয়া ব্যাগটা খুললাম। ব্যাগ খুলে দিদির জন্য কানাইর দেওয়া শাড়িটা বের করে দিদির হাতে দিলাম। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা আবার কেন নিয়ে এসেছিস। এটা কী ভারতের? না কি বাংলাদেশি? এমনিতেই কতো কষ্ট করে বাংলাদেশ থেকে এসেছিস। এতো বছর পর যে তোকে দেখতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি।’ আমি বললাম, ‘দিদি এই শাড়িটা কোলকাতায় থাকা আমার বন্ধু দিয়েছে। ওর নাম কানাই। ওর সাথেই কোলকাতা এসেছিলাম। শাড়িটা আপনার পছন্দ হয়নি?’ দিদি বললেন, ‘হ্যাঁ পছন্দ তো হয়েছে রে, তো আমি এই স্লিকের শাড়ি কখনোই পড়ি না। এটা বরং তোর বড় ভাগ্নিই পড়বে।’ বললাম, ‘তা আপনার খুশি!’ এভাবে কথা বলতে বলতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে লাগলো। বড় ভাগিনা খবর পেয়ে ওর গ্যারেজ বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে আমাকে প্রণাম করলো। ওর ছোট দুই ভাই তখনো নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিলো।
আমার তিন ভাগিনা আর এক ভাগ্নি। দুই ভাগিনা মোটেও লেখাপড়া জানে না। তার মানে হলো, ওরা কোনো সময় স্কুলেই যায়নি। আমার বড়দির বিয়ের ১৫দিন পর এই ভারতে আসা। তখন তারা থাকতো বীরপাড়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে, ফালাকাটা নামক স্থানে। আমার জামাইবাবু ছিলেন একজন নেশার রাজা। তাকে নেশার সম্রাটও বলা চলে। কেননা, নেশার জগতের এমন কোনও নেশা বাদ নেই, যা আমার শ্রদ্ধেয় জামাইবাবু গ্রহণ করেননি। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখনো দেখেছি জামাইবাবুর সাথে অনেকরকম মাদকের নেশা জড়িয়ে আছে। কাচ্চি মদ, বিড়ি, পান, নশ্বি (যেটা নাক দিয়ে টানে- হুবহু আমাদের দেশের শাহাজাদা গুল-এর মতন দেখতে), চা, মাঝেমাঝে সিদ্ধিও (গাঁজা) টানে। এর কারণেই আগে আমার বড়দির সংসারটা ছিল একেবারে এলোমেলো। মোট কথা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল।
ছোট ভাগিনা দুজন যখন একটু বড় হলো, তখন স্কুলের চিন্তা না করে বড়দি নিজের সংসারের চিন্তা করে ওদের গাড়ির গ্যারেজে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর আস্তে আস্তে আমার বড়দি’র সংসারের অবস্থা একটু পরিবর্তন হলো লাগলো। একসময় ছেলে দুটোর রোজগারের টাকা দিয়ে বাড়ি করেছে। বাড়িতে রড-সিমেন্টের দালান তৈরি করেছে। বাড়িতে বাসা ভাড়াও দিয়েছে। জামাইবাবু নেশার জগতের সম্রাট হলেও, নিজের তামাকের ব্যবসা তখনো ছিলো। সেখানকার প্রায় লোকেরা তামাক, বিড়ি, পান-সিগারেট, মদ-গাজার নেশা বেশিরভাগ মানুষেই কম-বেশি করে থাকে।
তবে আমার গুনধর জামাইবাবু ছিলো সবার উপরে। মানে অষ্টধাতু যাকে বলে! সেখানকার প্রায় মানুষের নেশার অভ্যাস থাকার কারণে সেখানে তামাকের ব্যবসাটা হলো রমরমা ব্যবসা। আমার জামাইবাবু তামাকের ব্যবসাটা ছিলো আদি ব্যবসা। উনি নেশা-পানি যা-ই করুক-না-কেন, তামাকের ব্যবসা ছিলো উনার নিয়মিত। আগে এমন নিয়মিত ছিলো না। একদিন মদ পান করে বেহুঁশ হলে তিনদিন আর তামাকের গাট্টি নিয়ে বাজারে যেতো না। আগে যদি ব্যবসায় এমন নিয়মিত থাকতো, তাহলে আমার ভাগিনা-ভাগ্নিদের লেখাপড়া হতো। হয়নি শুধু আমার গুণধর জামাইবাবু কারণেই। জামাইবাবু ওমন উড়াউড়ির ভাবের জন্যই বড়দি ছেলে দুটোকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি। আজীবনের জন্য বকলমই বানিয়ে রেখেছে।
তবে আমার ভাগিনা দুটো লেখাপড়া না করলেও মনেরমত কাজ শিখেছে। কাজ হলো গাড়ির মেকারের কাজ। এমন কাজই ভাগিনা দুটো শিখেছে যে, একটা চলন্ত গাড়ির শব্দ শুনে বলে দিতে পারে গাড়িটার সমস্যার কথা। বড় ভাগিনা অনেক আগেই ওস্তাদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে, নিজেই আলাদাভাবে মিস্ত্রির কাজ করছে। মেজো ভাগিনা তখনো পরের গ্যারেজে কাজ করছিলো। বেতন হলো সপ্তাহে মাত্র ৩০০ টাকা। বেতন ছাড়াও সাথে কিছু এদিক-সেদিক ছিলো। বেতন ছাড়া এদিক-সেদিক যা পেতো, তা আর গ্যারেজ মালিক নিতো না। এদিক-সেদিকের উপার্জনের টাকা দিয়েই সারা সপ্তাহের পকেট খরচ হয়ে যেতো।
ভাগিনা দুটো লেখাপড়া জানে না, কিন্তু ভারতের সবকটি প্রদেশের ভাষা ওদের আয়ত্তে। ইংরেজিতেও কথা বলতে পারে। সবার ছোট ভাগিনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে অস্থির হয়ে গেছে। লেখাপড়া করার কষ্ট সইতে না পেরে শেষ অবধি লেখাপড়া ছেড়েই দিয়েছে। তবে বেকার নয়। রাস্তার পাশে ওদের একটা দোকান আছে। সেই দোকানটায় বসে পান-বিড়ি-সিগারেটের ব্যবসা করে। ভাগ্নির কপালেও বেশি লেখাপড়া লাগতে পারেনি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্তই শেষ! অথচ এই ভারতের বাড়িতে প্রায় সকল মানুষেই কমবেশি শিক্ষিত। এমনও দেখেছি, মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেও সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করে তুলেছে। আর সেখানে আমার ভাগিনা-ভাগ্নি একেবারেই বকলম!
যাইহোক, সেদিন বড়দি’র কাছে উনার দুঃখ-সুখের কথা শুনতে শুনতে একসময় বড় ভাগিনা আমার সামনে এসে বললো, ‘মামা আমার সাথে চলো।’ ভাগিনার কথা শুনে দিদি বললো, ‘ওকে কোথায় নিয়ে যাবি? ও এসেছে অনেকক্ষণ হয়। এখনো খাওয়া-দাওয়া কিছুই করেনি। বাজারে গেলে আগে তোর মামাকে কিছু খাইয়ে দিবি।’ ভাগিনা বললো, ‘ঠিক আছে মা। এ নিয়ে তোমার মাথাব্যথার দরকার নেই। চলো মামা চলো।’ আমি ভাগিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবে শুনি? এখান থেকে কতটুকু দূরে?’ ভাগিনা বললো, ‘এইতো মামা এখানেই। তুমি বাস থেকে যেখানে নেমেছ, সেখানেই। আমাদের বীরপাড়া বাজারে। চলো মামা, মজা হবে খুব। আজ বাজারের পাশেই একটা অনুষ্ঠান আছে। তোমাকে নিয়ে সেখানেই যাবো।’
মজার কথা শুনে ভাগিনার সাথে রওনা দিলাম। রাস্তায় দিয়ে হাঁটা অবস্থায় ভাগিনা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মামা তুমি সিগারেট টানো না-কি?’ বললাম, ‘হ্যাঁ মামা অভ্যাস আছে।’ ভাগিনা আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘মামা তুমি কী সিগারেট টানো?’ বললাম, কমদামী একটা হলেই হয়ে যায়।’ আমার বড় ভাগিনা রাস্তার পাশে দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আমার পকেটে ভরে দিল। এরপর মামা-ভাগিনা হাঁটা ধরলাম বীরপাড়া বাজারের দিকে।
হেঁটেই যাচ্ছি দুজনে। কারণ, দিদির বাড়ি থেকে বীরপাড়া বাজার অল্পকিছু দূরে। যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। তখন সন্ধ্যা হয়েছিলো প্রায়। সেখানে সন্ধ্যার পরে বেশিক্ষণ দোকানপাট খোলা থাকে না। কারণ, সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই খেটে খাওয়া। সরকারি অফিস-আদালত তেমন নেই। আছে শুধু একটা পোস্ট অফিস, একটা পুলিশ ফাঁড়ি, আর দু-একটা বেসরকারি ব্যাংক ও বীমার অফিস। পুরো এলাকার দুই দিকেই পাহাড়। ভুটান সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকা হলেও পাকা রাস্তা। প্যাঁক-কাদা কাউকে ডিঙাতে হয় না। গাড়িঘোড়ার বেশি একটা চাপ নেই। রাস্তার পাশে লাইট পোস্ট আছে। আমাদের শহরের মতন প্রতিদিন বিকালবেলা সেখানে বাজার মেলে না। বাজার বলতে বলা যায়, স্থায়ীভাবে থাকা মার্কেট আর কিছু দোকানের টুকটাক বেঁচা-কেনা।
ভাগিনার সাথে গেলাম বীরপাড়া বাজারে। ভাগিনা বাবাজি আমাকে নিয়ে প্রথমেই ঢুকলো একটা মিষ্টির দোকানে। আমি বাস থেকে নেমে যেই দোকান থেকে মিষ্টি কিনেছিলাম, সেই দোকানেই। কিন্তু আমি সেখানে নতুন, তাই ফলো করতে পারিনি। দোকানদার আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। দোকানদারের মৃদু হাসি দেখে আমার ভাগিনা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হাসলেন কেন?’ দোকানদার বললো, ‘উনি কি তোমার মামা?’ ভাগিনা বললো, ‘হ্যাঁ, আপনি জানলেন কী করে?’ দোকানদার বললো, ‘আ-রে উনিতো কয়েক ঘন্টা আগে আমার দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আমি একটা রিকশা ডেকে তোমাদের বাড়িতে পাঠিয়েছি। চিন্তায় ছিলাম, রিকশাওয়ালা ঠিকমত তোমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে কিনা। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই রিকশাওয়ালা এসে আমার কাছে বলেছে। এখন ওনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো, তাই হাসলাম। বসো বসো। কী খাবে তোমরা?’ দোকানদারের কথা শুনে আমার ভাগিনাও হেসে বললো, ‘ওহ্ আচ্ছা, তাই নাকি কাকা! আমিতো ভাবছিলাম আবার অন্যকিছু। জাগগে, আমাদের এক প্লেট করে রসমালাই আর দুটো করে নিমকি দিন।’
মিষ্টির দোকানের কর্মচারী আমাদের নিমকি আর রসমালাই দিলো। আমিও খেলাম, আমার ভাগিনাও খেলো। খুবই সুস্বাদু রসমালাই। যেই রসমালাইয়ের জুড়ি নেই। দোকানদারকে খাবারের দাম বুঝিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বের হলাম। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে গেছে। ভাগিনার সাথে পুরো বীরপাড়া বাজারটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খুবই সুন্দর এক বাজার। দু-একটা টিনের চালের ঘর। আর দু’একটা ইটের দালান ঘর। বাদবাকি সব ঘরই টালির চালের ঘর। সেখানে টালির চালের ঘরই বেশি। কারণ হলো, টিনের চালের ঘরে নাকি গরম লাগে। ঘর ঠাণ্ডা থাকার জন্যই, সেখানকার মানুষে টালির চালই বেশি পছন্দ করে।
বাজারের পাশেই চা বাগানীদের কোয়ার্টার। দেখতে দেখা যায় আমাদের দেশের সরকারি সুইপার কলোনির মতন। ওদের শরীরের রঙ কালো হলেও ওদের ঘরদোর খুবই পরিস্কার। প্রতিদিন ওদের কলোনির সামনেই ওরা ওদের নিজেদের তৈরিকৃত মদ কেনাবেচা করে থাকে। ওদের নিজেদের বানানো মদের নাম হাড়িয়া। দেখতে হুবহু আমাদের দেশের মাঠা’র মতো।
ভাগিনার সাথে ঘুরেফিরে দেখে চলে এলাম বীরপাড়া বাজারে। ভাগিনা বাবাজি একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো। দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলাম। দোকানটা মাচাংঘর। কিন্তু খুব সুন্দর! ভাগিনা দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিলো। দোকানদার হলো একজন নেপালি মেয়ে। দোকানে আবার মদও বিক্রি করে। মদের মধ্যে ভুটানি আর নেপালি মদই বেশি। সাথে আছে ওদের নিজেদের তৈরি মদ। ওখানে নেপালীরা যে মদ তৈরি করে, সেই মদ’কে ওখানকার ভাষায় বলে কাচ্চি মদ। আমরা বাংলাদেশে এগুলোকে বাংলা মদ বলে থাকি। চা পান করে দোকান থেকে বের হলাম। তবে দোকানটা চিনে রাখলাম আবার আসবো বলে।
তখন বৈশাখ মাস। এই বৈশাখ মাসের শুরুতে সেখানে নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় আর রাস্তাঘাটে। পুরো ভারতের মানুষই সংস্কৃতি প্রিয়। যাত্রা, নাটক, থিয়েটার, সিনেমা এসব ওদের কাছে খুবই আনন্দের। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও নিজের মহল্লায় নানারকম গান-বাজনার আয়োজন করে। ভাগিনা বাবাজি বাজারের পাশে আমাকে নিয়ে গেলো। দূর থেকেই রবীন্দ্র সংগীতের আওয়াজ আমার কানে আসছিলো। ভাবলাম ভাগিনা বাবাজি মনে হয় এখানকার কথাই বলেছিল। আমার ধারণায় ঠিক তা-ই হয়েছিল।
সেখানে প্রতি বছরই বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। তারই ধারাবাহিতায় বাজারের সব দোকানদাররা কবিগুরু স্মরণে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেই অনুষ্ঠানেই ভাগিনা বাবাজি আমাকে নিয়ে গেল। বসার সিট নেই। ভাগিনা সহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ রবীন্দ্র সংগীত শুনলাম। এরপর বাসায় চলে এলাম। রাত তখন আনুমানিক ৮ টার মতন বাজে। দিদির বাড়িতে তখনো কেউ ঘুমায়নি। সবাই ঘরে বসে টেলিভিশনে কবিগুরু রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান দেখতে ছিল।
চলবে…
জীবনের গল্প-৩০ শেষ পর্ব এখানে।
জীবনের গল্প-১ এখানে।