সারাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জেও খুব জোরেশোরে চলছে আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পঞ্জিকা অনুযায়ী মূল পূজার শুভসূচনা শুরু হবে ২১ অক্টোবর ২০২০ বুধবার মহা পঞ্চমীতে। পরদিন ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে দেবীর বোধন। ২৬ অক্টোবর মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।
এবার মহালয়া ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, ৩১ ভাদ্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। মহালয়ার পার্বণ শ্রাদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। মহালয়া হয়ে থাকে অমাবস্যা তিথিতে। তখন থাকে ঘোর অন্ধকার। মহাতেজের আলোয় সেই অমাবস্যা দূর হয়ে প্রতিষ্ঠা পায় শুভশক্তি। সেই থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষের সূচনা। তাই দুর্গাপূজার দিন গণনা এ মহালয়া থেকেই শুরু হয়। এর পরবর্তী তিথিগুলো নিম্নরূপ:
পঞ্চমী:
মহাপঞ্চমী মানে বোধনের আগের দিন। অর্থাৎ দুর্গা পুজোর শুরু আর সেই সঙ্গে এক বছরের অপেক্ষার অবসান। এদিন মা দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচনই এই দিনের প্রধান কাজ হিসাবে গন্য হয়। মানে বোধনের আগে কল্পারম্ভ। এসময় ঢাকের শব্দে পূজামণ্ডপ-সহ আশেপাশে শোরগোল শুরু হয়, মা এসে পড়েছেন মর্ত্যে। আর এবার কিন্তু দুর্গাপুজা আশ্বিন নয়, কার্তিক মাসে। অর্থাৎ এবছর ২১ অক্টোবর ২০২০, ৪ঠা কার্তিক বুধবার।
মহাষষ্ঠী:
মহাষষ্ঠী পালিত হবে আগামী ২২ অক্টোবর, ৫ কার্তিক, বৃহস্পতিবার। এদিন দুর্গাদেবীর ষষ্ঠ্যাদিকল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজা। অর্থাৎ দুর্গা প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মহাসপ্তমী:
দুর্গাপূজা ২০২০ এর মহাসপ্তমী পালিত হবে আগামী ২৩ অক্টোবর, ৬ কার্তিক, শুক্রবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমী বিহত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে।
মহাঅষ্টমী:
মহাঅষ্টমী পালিত হবে আগামী ২৪ অক্টোবর, ৭ কার্তিক, শনিবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহাষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ ও মহাষ্টমী বিহিত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে। এদিন দুর্গাপূজার অন্যতম পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিপূজা তিথি শুরু হবে ভারতীয় সময় সকাল ১১টা ২৪ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে এবং তিথি শেষ হবে সকাল ১১টা ৪৬ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে।
মহানবমী:
দুর্গাপূজার মহানবমী তিথি পালিত হবে আগামী ২৫ অক্টোবর, ৮ কার্তিক, রবিবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে।
বিজয়া দশমী:
এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী পালিত হবে আগামী ২৬ অক্টোবর, ৯ কার্তিক, সোমবার। এদিন দশমী পূজা সমাপনান্তে মা দুর্গার প্রতিমা নিরঞ্জন করা হবে। এদিন সন্ধ্যা লগ্নে প্রতিটি পূজামণ্ডপে উৎসবমুখর পরিবেশে দেবীকে সিঁদুর দানের সাথে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলবে বিবাহিত হিন্দু নারীদের সিঁদুর খেলা। এই সিঁদুর দেবীর কপালে এঁটে পানপাতায় দেবীর মুখমণ্ডল মুছে দিয়ে দেবীকে এবারের মতো বিদায় জানানো হয়। এসময় উপস্থিত সকল হিন্দু বিবাহিত নারীরা মনের অনন্দে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠে। সাথে চলতে থাকে ঢাক-ঢোলের বাজনা। তখন ঢাকের শব্দে কেঁপে ওঠে প্রতিটি পূজামণ্ডপ। এরপরই শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি নেওয়া।
এই শারদীয় দুর্গোৎসবটি হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। যা হয়ে থাকে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে। কিন্তু এবার মহালয়ার তিথি ছিলো ১৭ সেপ্টেম্বর। ৩১ ভাদ্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, বুধবার। কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ছিলো ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে এবার আশ্বিনে দেবীর পূজা না হয়ে, হচ্ছে কার্তিক মাসে।
আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয়া দুর্গাপূজা। এটি বাঙালি হিন্দু সমাজের অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষকের দুর্গাপূজাকে বলা হয় বাসন্তীপূজা। বাসন্তীপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পূজাটি অনেকের চোখে পড়ে না। অনেক স্থানে বাসন্তীপূজা হয়ও না।
যাইহোক, এবার ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠীতে দেবীর দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ দুর্গোৎসব। চলবে একনাগাড়ে পাঁচদিন। মহাষষ্ঠীর পরদিনই ২৩ অক্টোবর মহাসপ্তমী। এর পরদিন ২৪ অক্টোবর মহাষ্টমী। এদিন বাংলাদেশের অনেক পূজামণ্ডপে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ২৫ অক্টোবর মহানবমীর পরদিন ২৬ অক্টোবর দিনগত রাতে বিজয়াদশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই বর্ণিল উৎসব।
পঞ্জিকা মতে জানা যায়, এবার দেবী দুর্গা দোলায় চড়ে মর্ত্যলোকে আগমন। গমন গজে (হাতি) চড়ে। অর্থাৎ ধীরগতিতে, শান্ত হাতিতে চড়ে দেবী দুর্গা এবার পাড়ি দেবেন স্বর্গে। দুর্গাদেবীর আগমন ও গমনের মধ্যেও একটি বিশেষ ফল রয়েছে। তাহলে জেনে নেওয়া ভালো যে, দুর্গাদেবী এবার দোলায় আগমন আর গজে চড়ে গমন করার মধ্যদিয়ে কীরূপ প্রভাববিস্তার করতে পারে?
দুর্গাদেবীর আগমন…
শাস্ত্র তথা পঞ্জিকা মতে; এবারের দুর্গাপুজোয় মা আসছেন দোলায় চড়ে। যার ফলে প্রবল মড়ক প্রাক পূজার সময় পর্যন্ত চলবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে পুজোর আগে পর্যন্ত প্রবল মহামারীর পরিস্থিতি থেকে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল।
দুর্গাদেবীর গমন…
শাস্ত্র তথা পঞ্জিকা মতে; এবার দুর্গাদেবীর গমন গজে। অর্থাৎ ধীরগতিতে। গজে চড়ে মায়ের গমন শুভ। অর্থ্যাৎ এর ফলে বিশ্বে শুভ কোনও বার্তা নেমে আসবে। গজের গমনে সাধারণত শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা হয়। তাই এবার তারই প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বে।
কুমারী পূজা…
দুর্গা পূজার কথা আসলেই আগে আসে কুমারী পূজার কথা। এই কুমারী পূজা হচ্ছে দুর্গা পূজারই একটা অংশ। এই কুমারী পূজাটি হয়ে থাকে নারায়ণগঞ্জের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে এবং বাংলাদেশে যতগুলো রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম আছে সেসব মিশনে। নারায়ণগঞ্জের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমটি শহরের চাষাঢ়াস্থ মিশনপাড়াতে অবস্থিত। জানা যায় এবার করোনা ভাইরাসের আলামতের কারণে রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী মাতা ছাড়াই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিলো। যা শোনা যায় বুড়ো-বুড়ীদের কাছ থেকে। তবে আগের মতন বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন তেমন নেই। যা আছে শুধু সারাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতেই। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, এবারও হবে।
সকাল ১০টা হতে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা শেষে শুরু হয় পূজার্থী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ। পূজা পরিচালনা করেন নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের প্রধান মহারাজ।
জানা যায়, স্বামী বিবেকানন্দ শারদীয় দুর্গোৎসবে এই কুমারী পূজার প্রচলন করেন। নারী মানে মায়ের প্রতীক। তাই কুমারী পূজা মানে স্বয়ং মাকে পূজা করা। পৃথিবীতে দেবী দুর্গাই সর্বশক্তিমান। তাকে লক্ষ্য করেই কুমারী পূজা করা হয়। একজন কুমারীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করাই হলো দুর্গাদেবীকে পূজা করা।
দুর্গা পূজার গ্রন্থের তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে জানা যায়, এক থেকে ১৬ বছর বয়সী কুমারীকে পূজা করা যায়। তবে শাস্ত্রে ১০ বছরের কুমারী মেয়েকেই কুমারী পূজায় বশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বয়স অনুসারে কুমারীর নামকরণও করা হয়েছে। বিভিন্ন বয়সের কুমারী মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা নামও রয়েছে শাস্ত্রে।
যেমন–
এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা
দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী
তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি
চার বছরের কন্যা — কালিকা
পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা
ছয় বছরের কন্যা — উমা
সাত বছরের কন্যা — মালিনী
আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা
নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা
দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা
এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী
বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী
তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী
চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনায়িকা
পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা
ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা
কুমারী পূজায় যে ধ্যান করতে হয়, “মা তুমি ত্রৈলোক্যসুন্দরী, কিন্তু আজ তুমি কালিকাস্বরূপে আমার সম্মুখে উপস্থিত। তুমি জ্ঞানরূপিণী, হাস্যময়ী, মঙ্গলদায়িনী।”
আর কুমারী পূজার যে প্রণাম মন্ত্র রয়েছে তার অর্থ-
“মা, তুমি প্রসন্ন হলে আমাকে সৌভাগ্য দান করতে পারো। তুমি সকল প্রকারের সিদ্ধি আমাকে দান কর। তুমি স্বর্ণ, রৌপ্য, প্রবাল কত রকমের অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হয়েছ। তুমিই সরস্বতী। আমি তোমাকে প্রণাম করি।”
এবার নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলায় ১৯৬টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে গতবছর নারায়ণগঞ্জ জেলায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিলো ২০৬টি। মহামারী করোনা ভাইরাস প্রভাব বিস্তারের কারণে গতবারের চেয়ে এবার ৯টি কম। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন এলাকায় দুর্গাপূজা হবে ৭টি মণ্ডপে।
শারদীয় দূর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিমা তৈরির কাজ পায় শেষপর্যায়ে। ইতোমধ্যে চারুকারুর শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির কাজও শেষ করে ফেলেছে। রংতুলির কাজ যা বাকি আছে, তা শেষ সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে বলে আশা করছে, প্রতিটি পূজা মণ্ডপের কর্তারা। মণ্ডপ প্রাঙ্গণে তোরণ নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। তবে এবার মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে নারায়ণগঞ্জ শহরের রাস্তায়-রাস্তায় বিশাল-বিশাল তোরণ নির্মাণ হচ্ছে না। সাধারণভাবে যা হচ্ছে, তা কেবল পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণেই।
দুর্গাদেবীকে প্রণাম করার মন্ত্র:
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।
অনুবাদ: যে দেবী সর্বপ্রাণীতে শক্তিরূপে অধিষ্ঠিতা, তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
বলে রাখা ভালো যে, এবারের প্রতিটি পূজামণ্ডপে দর্শনার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা থাকবে বাধ্যতামূলক। আর পূজা উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ স্থানীয় প্রশাসনও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে জানা যায়। যাতে করে কোনও ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা না ঘটে এবং পূজা উদযাপন করতে কোনও ধরনের সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারেও স্থানীয় প্রশাসন রাখবে সজাগ দৃষ্টি। প্রতিটি পূজামণ্ডপে থাকবে পুলিশ বাহিনীর সদস্য।
শব্দনীড় ব্লগের সবাইকে শারদীয় দুর্গোৎসদের শুভেচ্ছা।
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।