ট্যাগ আর্কাইভঃ নারায়ণগঞ্জ

দোলায় চড়ে দেবী মর্ত্যলোকে … শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি

images-2

সারাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জেও খুব জোরেশোরে চলছে আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পঞ্জিকা অনুযায়ী মূল পূজার শুভসূচনা শুরু হবে ২১ অক্টোবর ২০২০ বুধবার মহা পঞ্চমীতে। পরদিন ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে দেবীর বোধন। ২৬ অক্টোবর মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।

এবার মহালয়া ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, ৩১ ভাদ্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। মহালয়ার পার্বণ শ্রাদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। মহালয়া হয়ে থাকে অমাবস্যা তিথিতে। তখন থাকে ঘোর অন্ধকার। মহাতেজের আলোয় সেই অমাবস্যা দূর হয়ে প্রতিষ্ঠা পায় শুভশক্তি। সেই থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষের সূচনা। তাই দুর্গাপূজার দিন গণনা এ মহালয়া থেকেই শুরু হয়। এর পরবর্তী তিথিগুলো নিম্নরূপ:

পঞ্চমী:
মহাপঞ্চমী মানে বোধনের আগের দিন। অর্থাৎ দুর্গা পুজোর শুরু আর সেই সঙ্গে এক বছরের অপেক্ষার অবসান। এদিন মা দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচনই এই দিনের প্রধান কাজ হিসাবে গন্য হয়। মানে বোধনের আগে কল্পারম্ভ। এসময় ঢাকের শব্দে পূজামণ্ডপ-সহ আশেপাশে শোরগোল শুরু হয়, মা এসে পড়েছেন মর্ত্যে। আর এবার কিন্তু দুর্গাপুজা আশ্বিন নয়, কার্তিক মাসে। অর্থাৎ এবছর ২১ অক্টোবর ২০২০, ৪ঠা কার্তিক বুধবার।

মহাষষ্ঠী:
মহাষষ্ঠী পালিত হবে আগামী ২২ অক্টোবর, ৫ কার্তিক, বৃহস্পতিবার। এদিন দুর্গাদেবীর ষষ্ঠ্যাদিকল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজা। অর্থাৎ দুর্গা প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মহাসপ্তমী:
দুর্গাপূজা ২০২০ এর মহাসপ্তমী পালিত হবে আগামী ২৩ অক্টোবর, ৬ কার্তিক, শুক্রবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমী বিহত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে।

মহাঅষ্টমী:
মহাঅষ্টমী পালিত হবে আগামী ২৪ অক্টোবর, ৭ কার্তিক, শনিবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহাষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ ও মহাষ্টমী বিহিত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে। এদিন দুর্গাপূজার অন্যতম পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিপূজা তিথি শুরু হবে ভারতীয় সময় সকাল ১১টা ২৪ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে এবং তিথি শেষ হবে সকাল ১১টা ৪৬ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে।

মহানবমী:
দুর্গাপূজার মহানবমী তিথি পালিত হবে আগামী ২৫ অক্টোবর, ৮ কার্তিক, রবিবার। এদিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা প্রশস্তা অনুষ্ঠিত হবে।

বিজয়া দশমী:
এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী পালিত হবে আগামী ২৬ অক্টোবর, ৯ কার্তিক, সোমবার। এদিন দশমী পূজা সমাপনান্তে মা দুর্গার প্রতিমা নিরঞ্জন করা হবে। এদিন সন্ধ্যা লগ্নে প্রতিটি পূজামণ্ডপে উৎসবমুখর পরিবেশে দেবীকে সিঁদুর দানের সাথে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলবে বিবাহিত হিন্দু নারীদের সিঁদুর খেলা। এই সিঁদুর দেবীর কপালে এঁটে পানপাতায় দেবীর মুখমণ্ডল মুছে দিয়ে দেবীকে এবারের মতো বিদায় জানানো হয়। এসময় উপস্থিত সকল হিন্দু বিবাহিত নারীরা মনের অনন্দে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠে। সাথে চলতে থাকে ঢাক-ঢোলের বাজনা। তখন ঢাকের শব্দে কেঁপে ওঠে প্রতিটি পূজামণ্ডপ। এরপরই শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি নেওয়া।

এই শারদীয় দুর্গোৎসবটি হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। যা হয়ে থাকে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে। কিন্তু এবার মহালয়ার তিথি ছিলো ১৭ সেপ্টেম্বর। ৩১ ভাদ্র ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, বুধবার। কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ছিলো ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে এবার আশ্বিনে দেবীর পূজা না হয়ে, হচ্ছে কার্তিক মাসে।

আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয়া দুর্গাপূজা। এটি বাঙালি হিন্দু সমাজের অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষকের দুর্গাপূজাকে বলা হয় বাসন্তীপূজা। বাসন্তীপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পূজাটি অনেকের চোখে পড়ে না। অনেক স্থানে বাসন্তীপূজা হয়ও না।

যাইহোক, এবার ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠীতে দেবীর দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ দুর্গোৎসব। চলবে একনাগাড়ে পাঁচদিন। মহাষষ্ঠীর পরদিনই ২৩ অক্টোবর মহাসপ্তমী। এর পরদিন ২৪ অক্টোবর মহাষ্টমী। এদিন বাংলাদেশের অনেক পূজামণ্ডপে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ২৫ অক্টোবর মহানবমীর পরদিন ২৬ অক্টোবর দিনগত রাতে বিজয়াদশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই বর্ণিল উৎসব।

পঞ্জিকা মতে জানা যায়, এবার দেবী দুর্গা দোলায় চড়ে মর্ত্যলোকে আগমন। গমন গজে (হাতি) চড়ে। অর্থাৎ ধীরগতিতে, শান্ত হাতিতে চড়ে দেবী দুর্গা এবার পাড়ি দেবেন স্বর্গে। দুর্গাদেবীর আগমন ও গমনের মধ্যেও একটি বিশেষ ফল রয়েছে। তাহলে জেনে নেওয়া ভালো যে, দুর্গাদেবী এবার দোলায় আগমন আর গজে চড়ে গমন করার মধ্যদিয়ে কীরূপ প্রভাববিস্তার করতে পারে?

দুর্গাদেবীর আগমন…
শাস্ত্র তথা পঞ্জিকা মতে; এবারের দুর্গাপুজোয় মা আসছেন দোলায় চড়ে। যার ফলে প্রবল মড়ক প্রাক পূজার সময় পর্যন্ত চলবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে পুজোর আগে পর্যন্ত প্রবল মহামারীর পরিস্থিতি থেকে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল।

দুর্গাদেবীর গমন…
শাস্ত্র তথা পঞ্জিকা মতে; এবার দুর্গাদেবীর গমন গজে। অর্থাৎ ধীরগতিতে। গজে চড়ে মায়ের গমন শুভ। অর্থ্যাৎ এর ফলে বিশ্বে শুভ কোনও বার্তা নেমে আসবে। গজের গমনে সাধারণত শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা হয়। তাই এবার তারই প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বে।

কুমারী পূজা…
দুর্গা পূজার কথা আসলেই আগে আসে কুমারী পূজার কথা। এই কুমারী পূজা হচ্ছে দুর্গা পূজারই একটা অংশ। এই কুমারী পূজাটি হয়ে থাকে নারায়ণগঞ্জের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে এবং বাংলাদেশে যতগুলো রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম আছে সেসব মিশনে। নারায়ণগঞ্জের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমটি শহরের চাষাঢ়াস্থ মিশনপাড়াতে অবস্থিত। জানা যায় এবার করোনা ভাইরাসের আলামতের কারণে রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী মাতা ছাড়াই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে।

কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিলো। যা শোনা যায় বুড়ো-বুড়ীদের কাছ থেকে। তবে আগের মতন বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন তেমন নেই। যা আছে শুধু সারাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতেই। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, এবারও হবে।

সকাল ১০টা হতে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা শেষে শুরু হয় পূজার্থী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ। পূজা পরিচালনা করেন নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের প্রধান মহারাজ।

জানা যায়, স্বামী বিবেকানন্দ শারদীয় দুর্গোৎসবে এই কুমারী পূজার প্রচলন করেন। নারী মানে মায়ের প্রতীক। তাই কুমারী পূজা মানে স্বয়ং মাকে পূজা করা। পৃথিবীতে দেবী দুর্গাই সর্বশক্তিমান। তাকে লক্ষ্য করেই কুমারী পূজা করা হয়। একজন কুমারীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করাই হলো দুর্গাদেবীকে পূজা করা।

দুর্গা পূজার গ্রন্থের তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে জানা যায়, এক থেকে ১৬ বছর বয়সী কুমারীকে পূজা করা যায়। তবে শাস্ত্রে ১০ বছরের কুমারী মেয়েকেই কুমারী পূজায় বশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বয়স অনুসারে কুমারীর নামকরণও করা হয়েছে। বিভিন্ন বয়সের কুমারী মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা নামও রয়েছে শাস্ত্রে।

যেমন–
এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা
দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী
তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি
চার বছরের কন্যা — কালিকা
পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা
ছয় বছরের কন্যা — উমা
সাত বছরের কন্যা — মালিনী
আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা
নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা
দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা
এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী
বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী
তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী
চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনায়িকা
পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা
ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা

কুমারী পূজায় যে ধ্যান করতে হয়, “মা তুমি ত্রৈলোক্যসুন্দরী, কিন্তু আজ তুমি কালিকাস্বরূপে আমার সম্মুখে উপস্থিত। তুমি জ্ঞানরূপিণী, হাস্যময়ী, মঙ্গলদায়িনী।”
আর কুমারী পূজার যে প্রণাম মন্ত্র রয়েছে তার অর্থ-
“মা, তুমি প্রসন্ন হলে আমাকে সৌভাগ্য দান করতে পারো। তুমি সকল প্রকারের সিদ্ধি আমাকে দান কর। তুমি স্বর্ণ, রৌপ্য, প্রবাল কত রকমের অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হয়েছ। তুমিই সরস্বতী। আমি তোমাকে প্রণাম করি।”

এবার নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলায় ১৯৬টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে গতবছর নারায়ণগঞ্জ জেলায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিলো ২০৬টি। মহামারী করোনা ভাইরাস প্রভাব বিস্তারের কারণে গতবারের চেয়ে এবার ৯টি কম। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন এলাকায় দুর্গাপূজা হবে ৭টি মণ্ডপে।

শারদীয় দূর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিমা তৈরির কাজ পায় শেষপর্যায়ে। ইতোমধ্যে চারুকারুর শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির কাজও শেষ করে ফেলেছে। রংতুলির কাজ যা বাকি আছে, তা শেষ সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে বলে আশা করছে, প্রতিটি পূজা মণ্ডপের কর্তারা। মণ্ডপ প্রাঙ্গণে তোরণ নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। তবে এবার মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে নারায়ণগঞ্জ শহরের রাস্তায়-রাস্তায় বিশাল-বিশাল তোরণ নির্মাণ হচ্ছে না। সাধারণভাবে যা হচ্ছে, তা কেবল পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণেই।

দুর্গাদেবীকে প্রণাম করার মন্ত্র:
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।।

অনুবাদ: যে দেবী সর্বপ্রাণীতে শক্তিরূপে অধিষ্ঠিতা, তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।

বলে রাখা ভালো যে, এবারের প্রতিটি পূজামণ্ডপে দর্শনার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা থাকবে বাধ্যতামূলক। আর পূজা উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ স্থানীয় প্রশাসনও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে জানা যায়। যাতে করে কোনও ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা না ঘটে এবং পূজা উদযাপন করতে কোনও ধরনের সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারেও স্থানীয় প্রশাসন রাখবে সজাগ দৃষ্টি। প্রতিটি পূজামণ্ডপে থাকবে পুলিশ বাহিনীর সদস্য।

শব্দনীড় ব্লগের সবাইকে শারদীয় দুর্গোৎসদের শুভেচ্ছা।
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।

বটগাছের মমতায় সমাধিস্থানে নির্মিত একটি মঠ

সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্-এর পুকুরপাড়ে পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত মঠ।

একটি বটগাছ পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত একটি মঠকে। মঠটি ঘিরে কথিত আছে অনেক জানা অজানা কথা। সেসব কথা নাহয় লেখার শেষাংশে প্রকাশ করবো। শুরুতে সুশীতল ছায়াসুনিবিড় দেববৃক্ষ বটগাছের জন্ম কথা নিয়ে কিছু লিখতে চাই।

বটগাছ একটি বৃহদাকার বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরে বট গাছ সাধারণত দুই প্রকারই বেশি দেখা যায়, কাঁঠালিবট ও জিরাবট৷ কাঁঠালি বটের পাতা ঠিক কাঁঠাল পাতার মতো। আর জিরাবটের পাতা পানপাতার মতো দেখা যায়। তাই দুই রকমের বটগাছের দুইটি নাম হয়েছে জিরাবট, আর কাঁঠালি বটগাছ। এই দুই প্রকারের বটগাছ আমাদের দেশের শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে অনেক দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পুরানো বাড়ির দেয়ালের কার্নিশে, প্রাচীর ঘেরা দেয়ালের ফাটলে।

এর কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে বিভাগীয় শহরগুলোতে এখনো অনেক পুরানো স্থাপনা আছে। খোদ ঢাকা শহরেও অনেক পুরানো স্থাপনা দেখা যায়। ঢাকা শহরের নিকটবর্তী শহর নারায়ণগঞ্জেও অনেক পুরানো স্থাপনা চোখে পড়ে। আগে সিমেন্টের খুবই দাম ছিল। দাম ছিল এই কারণে যে, তখনকার সময়ে আমাদের দেশে কোথাও কোনও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছিল না। কোনও জমিদার বংশের কারোর সিমেন্টের দরকার হলে, বিদেশের কথা স্মরণ করতে হতো। তাই সিমেন্ট ছিল বিদেশি এক দুর্লভ পণ্য। যেই পণ্য তখনকার দিনে যেকেউ কিনতে সক্ষম হতো না বা পারতো না। আগের দিনে যার কাছে এক হাজার টাকা থাকতো তাকে বলতো হাজার টাকার মালিক। আর যিনি থাকতো কয়েক হাজার টাকার মালিক, তাকে লোকে বলতো হাজারী।

পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত মঠ। মঠটাকে একটি বটগাছে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এখন আর এই মঠ থেকে একটি ইটাও খসে পড়বে না, কেউ আর ভেঙেচুড়ে তচনচও করতে পারবে না।

এসব হাজারীদের হাজার হাজার টাকা থাকতেও, তাঁরা বিদেশ থেকে সিমেন্ট এনে তাদের বসতবাড়ি, দালান-কোঠা রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করতে পারেনি। তৈরি করতে হয়েছে মোটা মোটা এঙ্গেলের সাহায্যে। আর সিমেন্টের পরিবর্তে সুরকির (ইটের ফাঁকি) সাথে চুনা মিশিয়ে পেঁকমাটির মতন করে ছোট ছোট ইটের সাথে লেপে তাদের স্থাপনাগুলো তৈরি করেছে। কেউ কেউ চুনের খরচের টাকা বাঁচাতে সুরকির পরিবর্তে আঠালো মাটি সাথে ইট গেঁথে বড়সড় দালানকোঠা তৈরি করছে। ওইসব দালান-কোঠা মাটি আর ইটের সুরকি দিয়ে তৈরি বলেই, এসব দালান-কোঠার দালানে, বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে শেওলা পড়তে দেখা যায়।

দালান-কোঠা বা বাউন্ডারির (প্রাচীর) শেওলায় জন্মায় এক ধরণের উদ্ভিদ। একসময় দেয়ালে জমে থাকা শেওলা থেকে জঙ্গলে পরিণত হয়। এসব জঙ্গলের সাথে জন্মে থাকে কাঁঠালি বটগাছ, জিরা বটগাছ। বটগাছের কোনও বীজ রোপণ করা যায় না। আর বটের বীজ রোপণ করলে বীজ থেকে গাছ জন্মায়ও না। তাহলে পুরানো দেয়াল, আর পুরানো দালান-কোঠা, পুরানো প্রাচীরে বটগাছ জন্মালো কীভাবে?

বটগাছের শিকড়ে ঘেরা পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত মঠ।

যেভাবে বটগাছ জন্মায়:
বসন্ত ও শরৎকালে বটগাছে নতুন পাতা গজানোর সময় হয়। একসময় বটগাছের ঢালার মঞ্জরিতে ফুলের কলি বের হতে থাকে। ফুল ফোটে। মঞ্জরির গর্ভে ফুলগুলো লুকানো থাকে। ফুলগুলো খুবই ছোট এবং ফলের মতোই গোলাকার৷ ফলগুলো হুবহু আঙুর ফলের মতো। দেখতে লাল রঙের। এই ফলগুলো পাখিরা মহানন্দে ফল খেয়ে ওদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে। একসময় পাখিরা মলত্যাগ করে এই বীজ ছড়িয়ে দেয়। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, পুরানো দালানের ফাটল ও অন্য কোন গাছের কোটরে জমা থাকে। সেই বীজ থেকে আস্তে আস্তে গাছ জন্মাতে থাকে। একারণে উপগাছা বা পরগাছা হিসেবেও বটগাছের বেশ খ্যাতিও আছে। এই বটগাছ এমনই একটা গাছ, তার ফল হইতে বীজ সংগ্রহ করে বপন করলে গাছ জন্মায় না। আবার কোন দালানের কার্নিশ হইতে তৈরি গাছ উঠিয়ে এনে রোপণ করলে হয়। উপযুক্ত পরিবেশে একটি গাছ পাঁচ(৫) থেকে ছয়(৬) শত বছর বেঁচে থাকতে পারে৷ বট বাংলা অঞ্চলের আদিমতম বৃক্ষ। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বটগাছকে দেববৃক্ষও বলে।

বটগাছের এসব ঝুরি বা লত বা শিকড়গুলো একদিন বটগাছে পরিণত হবে।

বটের বর্ণনা:
বটের পাতা একান্ত, ডিম্বাকৃতি, মসৃণ ও উজ্জল সবুজ৷ কচি পাতা তামাটে। স্থান-কাল পাত্রভেদে পাতার আয়তনের বিভিন্নতা একাধারে বটের বৈশিষ্ট্য তথা প্রজাতি শনাক্তকরণের পক্ষে জটিলতার কারণও। পরিণত গাছের পাতা আকারে কিছুটা ছোট হয়ে আসে। বটের কুঁড়ি পাংশুটে হলুদ এবং এর দুটি স্বল্পায়ু উপপত্র পাতা গজানোর পরই ঝরে পড়ে। খুব অল্প বয়স থেকেই বট গাছের ঝুরি বা লত নামতে শুরু করে। তবে কাঁঠালি বটের ঝুরি বা লত বেশি নামে। এসব ঝুরি বা লত মাটির সংস্পর্শ পেলেই বাড়তে থাকে। ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে গিয়ে নিজেরাই একেকটা কাণ্ডে পরিণত হয়। এভাবেই বট গাছ ধীরে ধীরে চারপাশে বাড়তে থাকে এবং একসময় মহীরুহে পরিণত হয়। তখন সর্বপ্রথম জন্মানো গাছটিকে আর চেনা যায় না। সবই ঝুরি বা লত গাছের মতনই দেখা যায়।

একসময় এই সমাধি স্থানের মঠটির সামনে গড়ে উঠেছিল তুলার গোডাউন। সেই তুলার গোডাউন একসময় আগুন ধরে যায়। সেই আগুনে মঠের উপর বটগাছের একটা ঢালা পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া সেই ঢালা থেকে এখন নতুন নতুন পাতা বের হচ্ছে।

বট গাছকে ঘিরে বাংলা অঞ্চলে রয়েছে শত সহস্র বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য। (আর এই ঐতিহ্য বহনকারী একটি বট গাছ রয়েছে আমাদের বাংলাদেশেও। জানা যায়, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে। এ বট গাছের যে বিশাল ব্যাপ্তি তা ডিজিটাল যুগের উন্নত ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা সম্ভব নয়। এই গাছটা আঠার(১৮) বিঘা জমির উপর বিস্তৃত। বনবিভাগের উদ্যোগে এর চারপাশ বাঁশ-মূলি দিয়ে ঘেরা হয়েছে গাছটি সুরক্ষিত রাখার জন্য। এই বটগাছটার জন্ম কথা জানে এমন লোক বর্তমানকালে কালিগঞ্জ উপজেলায় নেই। যাকেই জিজ্ঞাসা করা হয়, সে-ই বলে আমার দাদাও বলতে পারেনা, আর আমি বলবো কীভাবে?

জানা যায় এই গাছ হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বটগাছ। উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশাল আয়তনের এই ছায়াবৃক্ষটি মানুষের অনেক উপকারে আসে। প্রাচীনকাল থেকেই বটবৃক্ষের ছায়ায় হাট-বাজার বসে, মেলা হয়, লোকগানের আসর বসে। জনসভারও আয়োজন হতো। কারণ হিসেবে বলা যায়, বাংলার গ্রামাঞ্চলে বড় বড় সুশীতল হলরুম ছিল না। আর তাই বড় বড় অনুষ্ঠান ও জনসভাগুলো ছায়াসুনিবিড় বটতলায় অনুষ্ঠিত হতো। এখনো গ্রামাঞ্চলে সেই দৃশ্য অনেকসময় চোখে পড়ে। বটগাছকে ভারত ও বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরা শিবের (মহাদেব) ছায়াবৃক্ষ হিসেবে মান্য করে থাকে।

মঠের ভেতরে খালি জায়গা আছে। খালি জায়গায় আগে অনেক মানুষ ঘৃতপ্রদীপ জ্বালাতো। দিতো ধূপের ধোঁয়া।

যার কারণে এই বটগাছ ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা কাটেও না,বটগাছের লাকড়ি পোড়ায়ও না। এখনো হিন্দু ঘনবসতি এলাকায় এই বটগাছের নিকটে মন্দির স্থাপন করে পূজা অর্চনা দিতে দেখা যায়। আর বটগাছের নিচে শিবের (মহাদেব) হাতের একটা অস্ত্র(ত্রিশুল) গাড়া থাকতে দেখা যায়। যার কারণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে ধর্মীয় কারণে বটগাছ কাটা নিষিদ্ধ।

সমাধি স্থানে নির্মিত মঠে বটগাছ:
উল্লেখ করা যায়, এমন আরেকটি বটগাছ আছে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায়। এই বটগাছটির অবস্থান চিত্তরঞ্জন কটন মিলের পুকুর পাড়ে। বটগাছটি একটি সমাধি স্থানকে অতি আদরে ঘিরে রেখেছে। সমাধি স্থানটি হলো একটি মঠ, (মন্দিরের মত) সমাধি স্থান।

আগেকার সময় কোন সরকারি বা পৌরসভার অধীনে হিন্দুদের জন্য খুব কম সংখ্যক শ্মশানঘাট ছিল। যা চোখে না পড়ার মতো। কাজেই কোন হিন্দু লোক মৃত্যুবরণ করলে তাঁর শবদাহ বা (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া) করা হতো তার নিজস্ব জায়গাতে। যার জায়গার অভাব ছিলো, তার মরদেহ দাহ (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া) করা হতো, কোনও এক জলাশয়ের ধারে, না-হয় নদীর পাড়ে। (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অর্থ হলো: অন্ত:অর্থ=শেষ, ইষ্টি:অর্থ=যজ্ঞ, ক্রিয়া: অর্থ=কার্যসম্পাদন। সুতরাং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শব্দের অর্থ শেষ যজ্ঞ সম্পাদন। এই শেষযজ্ঞ বলতে বোঝায় অগ্নিতে মৃতদেহ অহুতি দেওয়া)৷

১৯৪০ সালের দিকে পাগলা সাধু নামে একজন সাধু ছিলো। তাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায়। বর্তমান চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ পুকুরপাড় সংলগ্ন। এই পাগলা সাধুর মরদেহ বসত বাড়ির পাশে চিত্তরঞ্জন পুকুরপাড় দাহ করা হয়। এরপর তাঁর পুত্র মধু ঘোষ সেখানে একটি মঠ নির্মাণ করে রাখে। একসময় তারা সপরিবারে হিন্দু মুসলিল রায়টের সময় ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারত চলে যায়। রায়টের পর তাদের ঘরবাড়ি সবই বেদখল হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু পাগলা সাধুর সমাধির মট খানা সেভাবেই থেকে যায়। আর সেই মঠ হতে একটি বটগাছ জন্মে বড় হতে থাকে।

বর্তমানে মঠ থেকে গজে ওঠা বটগাছটি মঠটাকে এমন ভাবে জরিয়ে রেখেছে, এখন আর মঠ(মন্দির) দেখা যায় না। শুধু বট গাছের শিখর আর শিখর। দূর থেকে কেউ বুঝবেও না যে, এখানে একটি মঠ(মন্দির) আছে। আগে এখানে অনেকেই সকাল-সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাত। দিতো সকাল-সন্ধ্যা ধূপের ধোঁয়া। বর্তমানে এখানে আর কেউ সকাল-সন্ধ্যা ধূপের ধোঁয়া আর মোমবাতি জ্বালায় না। হয় না কোনও বাৎসরিক মেলা বা কোন হরিনাম সংকীর্তন। অনেকের মুখে শুনা যায় যে, আগে এই মঠ বা মন্দিরে মনোবাসনা পূর্ণের আশায় এখানে অনেকেই মানত/নিয়ত বাঁধত। শোনা যায় নিয়ত বা মনের আশা পূর্ণও হয়েছে অনেকের। সমাধিস্থান মঠ থেকে গজে ওঠা বটগাছটি দেখে বুঝা যায় যে, পাগলা সাধুর সব জায়গা বেদখল হলেও এই মঠ বেদখল হতে দিবো না।

এই পবিত্র সমাধি স্থানের মঠটির বটগাছের শিকড়ের ভেতরে আছে বিশালাকার দু’টি সাপ। এই সাপ দু’টি সময় সময় অনেকেরই চোখে পড়ে। কিন্তু কাউকে ক্ষতি করে না। ধরে নেওয়া যায়, এরা পাগলা সাধুর পবিত্র সমাধি স্থানের মঠটির পাহারাদার। তাই দিনের বেলায়ও সমাধিস্থান মঠের সামনে গেলে কেমন যেন শরীরে কাঁপন ধরে। যাই হোক মঠের সামনে গেলে সবচেয়ে অবাক লাগে মঠটিকে আদর করে আঁকড়ে ধরে রাখা বটগাছটি দেখলে। যেন মায়ের আঁচল দিয়ে মঠটিকে ঢেকে রেখেছে। এখন আর কেউ মঠের একটা ইটাও খুলে নিতে পারবে না। প্রতিটি ইটের ভেতরে ভেতরে বটের শিকড় পেছানো আছে।

অনেকে বলে, “এই বটগাছটির জন্যই পাগলা সাধুর সমাধি স্থানের মঠটি রক্ষা পেলো। বটগাছটি না থাকলে তাদের ফেলে যাওয়া জায়গা সম্পত্তির সাথে এই সমাধি স্থানের মঠটিরও অস্তিত্ব হারাতে হতো।” যে যা-ই বলার বলুক! দুঃখের বিষয় হলো, এমন একটি পবিত্র স্থানের দিকে স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। যদি নিকটবর্তী এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকলে এই পবিত্র সমাধি স্থানটির দিকে একটু খেয়াল রাখতো, তাহলে এখানেও অন্যান্য মন্দিরের মতন বাৎসরিক মেলা, হরিনাম সংকীর্তন, একনাম অনুষ্ঠিত হতো। পাগলা সাধুর সমাধি স্থানটিও থাকতো সবার মুখে মুখে, আর জায়গাটিও থাকতো আলোতে ঝলমল। কিন্তু না, কেউ আর এরকম উদ্যোগ নিচ্ছে না। অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে আছে পাগলা সাধুর পবিত্র সমাধি স্থানের মঠটি।

জয়তু পাগলা সাধু, জয়তু বটগাছ।

ঐতিহ্যবাহী বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারটি রয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে


মোগল আমলে নির্মিত বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজার।

প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস বিশ্বজুড়ে। প্রাচীনকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে সুপরিচিত। নারায়ণগঞ্জে মোগল আমলের স্থাপত্য এখনো অনেক জায়গায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারমধ্যে একটি হলো বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা বিবি মরয়ম মাজার। এই সমাধিসৌধটি স্থানীয় মানুষের কাছে বিবি মরিয়ম মাজার নামেই সুপরিচিত। বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারটি নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল সংলগ্ন অবস্থিত। নারায়ণগঞ্জ টু ডেমরা-চিটাগাং রোড আসা-যাওয়ার মাঝপথেই বিবি মরিয়ম মাজারটির অবস্থান।

বিবি মরিয়ম মাজারের ভেতরের সামনে থেকে তোলা।

কিল্লার পুল হলো আমাদের নারায়ণগঞ্জের একটা ঐতিহ্যবাহী পুল। যা হাজীগঞ্জ কেল্লার নামে নামকরণের ফলে পুলটির নাম হয় কিল্লার পুল। এই হাজীগঞ্জ কেল্লা নিয়ে এর আগেও একদিন শব্দনীড় ব্লগে আলোচনা করেছিলাম। আজকে বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজার নিয়ে কিছু লিখতে চাই। সেই সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজারটির সাথে।

এই বিবি মরিয়ম মাজারের সাথে মিশে আছে আমার আত্মা, মন-প্রাণ সবই। একসময় ভালোলাগা, না লাগার বেশিরভাগ সময়টা কাটাতাম এই পবত্র মাজারটির আশেপাশে। সমায়টা ছিল ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে। যখন কিল্লার পুল ‘ফাইন টেক্সটাইল’ মিলে কাজ করতাম তখন। বিবি মরিয়ম মাজারের সুবিশাল প্রাচীরের পাশেই ছিল ‘ফাইন টেক্সটাল’ মিল। বর্তমানে ফাইন টেক্সটাইল মিল মুন্সিগঞ্জ চান্দের বাজার সংলগ্ন আউটশাহী এলাকায়। সেখানেও কিছুদিন কাজ করেছিলাম। যাক সেসব কথা, আসা যাক বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজার প্রসঙ্গে।

বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারের প্রধান গেইট। এই গেইটের বাইরে ছিল ফাইন টেক্সটাইল মিলস্।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বিবি মরিয়মের সমাধি মুঘল আমলে নির্মিত একটি সমাধিসৌধ। এটি তৎকালীন মুঘল সম্রাট নিয়োজিত সুবেদার শায়েস্তা খাঁন কতৃক নির্মিত বলে ধারণা করে থাকেন ঐতিহাসিকরা । ঐতিহাসিকরা এ-ও ধারণা করেন যে, এই সমাধিসৌধটি ও এর লাগোয়া মসজিদের নির্মাণ কাল ১৬৬৪-৮৮ খৃষ্টাব্দে। সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’কে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে মনে করেন।

বিবি মরিয়ম মাজারের ভেতরে থাকা মসজিদ।

সমাধিসৌধটি সুউচ্চ প্রাচির দিয়ে ঘেরা একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের মাঝখানে ভুমি থেকে অনেক উচুতে নির্মিত। বর্গাকার ইমারতটিতে একটি গম্বুজও রয়েছে। এছাড়াও ভবনের চারদিকে খিলান ছাদ বিশিষ্ট বারান্দা আর অনেকগুলো জানালা রয়েছে সমাধিসৌধটিতে। সমাধিসৌধটির কেন্দ্রস্থলে চতুস্কোন কক্ষে রয়েছে তিন ধাপ বিশিষ্ট সমাধি। সমাধিটি শ্বেত পাথরে নির্মিত ও লতা পাতার নকশা অঙ্কিত। এছাড়া ও কবর ফলক ও সমাধি লাগোয়া বারান্দায় বেশ কয়েকটি সাধারণ কবরও রয়েছে, যা সমাধিসৌধটির সামনে গেলেই সবার চোখে পড়ে ।

মাজারের সামনে সারিবদ্ধভাবে থাকা কয়েকটি কবর।

এছাড়াও রয়েছে সমাধিসৌধটির পশ্চিম পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, যার নির্মাণকাল সমাধিসৌধটির সমসাময়িক অর্থাৎ ১৬৬৪-৮৮ খৃষ্টাব্দে। এটিও শায়েস্তা খাঁন নির্মাণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তার কারণেই হয়তো সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’ এর নামেই একে ‘বিবি মরিয়ম’ এর মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে। সূত্র: উইকিপিডিয়া থেকে।

স্বাধীনতা পরবর্তি সময় থেকে এখানে গড়ে ওঠেছে ‘বিবি মরিয়ম’ সমাধির নামে একটি স্কুল, যার নাম রাখা হয় ‘বিবি মরিয়ম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’। চতুর্দিকের প্রাচীর ঘেঁসে স্থায়ীভাবে গড়ে ওঠেছে বহু দোকানপাট। সন্ধ্যা হলেই সমাধিসৌধটি হয়ে পড়ে একটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো। সমাধিসৌধটি ছাড়া এর আশেপাশে কোনো লাইট বা কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। সমাধিসৌধ সংলগ্ন মসজিদে লাইট থাকলেও পুড়ো সমাধিসৌধটি জায়গা থাকে অন্ধকার। বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধটির চারদিকে স্থায়ীভাবে দোকান-পাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান, জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী পবিত্র মাজারটি রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়েলে।

বর্তমানে এটি নিয়ন্ত্রন দেখভাল করছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা বিভাগ। কিন্তু বহু প্রাচীনতম এই সমাধিসৌধটির কোনো সংস্কার হচ্ছে না বহুবছর ধারে। যার কারণে সমাধিসৌধটির প্রাচীরের পুরানো ইটগুলিও ধসে পড়ছে। সেইসাথে সমাধিসৌধ বা মাজারটিও। ধারণা করা যায়, যখন এই সমাধিসৌধটি তৈরি করে তখন কোনো সিমেন্টের আবিষ্কার হয় নাই, বা তখন কোনো সিমেন্ট-ই ছিলনা। সেইজন্যই পুড়ো সমাধিসৌধটি চুনা আর সুরখি দিয়ে নির্মিত হয়। তাই অনেক পুরানো স্থাপনা হওয়াতে সমাধিসৌধটির প্রাচীর সহ এর মূল স্থাপনাও শেওলায় ঢাকা পড়ে যায়। একযুগ বা দুই যুগ পরে রাষ্ট্রের সুনজরে শুধু সমাধিসৌধটি কিছুটা সংস্কার হলেও, এর পাশে থাকা স্থাপনাগুলো সংস্কারবিহীন পড়ে থাকে যুগযুগ ধরে। আর মোঘল আমলের নির্মিত ঐতিহ্যবাহী বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজারটি পড়ে থাকে আড়ালে আবডালে।

ছবি গত দুইবছর আগে নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা।

নারায়ণগঞ্জ টু চিটাগাং রোডে মারাত্মক দুর্ঘটনা


আটক করা জরুরী রপ্তানি কাজে নিয়োজিত ঘাতক কাভার্ডভ্যান।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ টু চিটাগাং রোড হলো এক ব্যস্ততম রোড। নারায়ণগঞ্জ থেকে চিটাগাং রোডের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। আছে অনেকগুলো মোড়। এসব মোড়গুলোর মধ্যে একমাত্র সিদ্ধিরগঞ্জ পুলের মোড়েই ট্রাফিকপুলিশ দেখা যায়। অন্যসব মোড়গুলোতে কোনও ট্রাফিকপুলিশ নেই। আছে একমিনিট পুলিশ নামের কিছু গঞ্জিকা সেবনকারী আর কিছু হিরোইঞ্চি। সড়কের দুইপাশে রয়েছে বর্তমান সময়ে গড়ে ওঠা ছোটবড় নীট গার্মেন্টস, ডাইং সহ নানারকম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো এই ব্যস্ততম সড়ক ঘেঁষা। প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে সকাল থেকে শুরু হয় কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের আনাগোনা। চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য রাস্তার এপার থেকে ওপারে আসাযাওয়া।

রিকশাচালক বাবুল মিয়ার ৫০০০০টাকার নতুন রিকশা।

এরকম পরিস্থিতি দেখে ব্যস্ততম সড়কে চলাচলকারী ছোটবড় যাত্রীবাহী যানবাহন সহ মালবাহী ট্রাক, কন্টিনারগুলো খুবই সতর্কতা অবলম্বন করে গাড়ি চালানোরই কথা। কিন্তু ড্রাইভাররা তেমন একটা সতর্কতা অবলম্ব করে গাড়ি চালায় না। চালায় নিজেদের ইচ্ছেমত। কার আগে কে যাবে এমন অবস্থা।

ঘটনাস্থলে নিহত রিকশাচালক বাবুল মিয়া।

এভাবেই আচমকা ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৪ নভেম্বর ২০১৮ইং সকাল ১১টায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন নারায়ণগঞ্জ টু চিটাগাং রোডের মাঝপথে, পাঠানটুলি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ঘটে গেল এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা সূত্রপাত একটি কাভার্ডভ্যানের সাথে একটি অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ। রিকশায় যাত্রী ছিল দুইজন। কভার্ডভ্যানের ধাক্কায় চলন্ত অটোরিকশাটি সাথে সাথেই ধুমড়ে মুচড়ে হয়ে যায় একাকার। দু’জন যাত্রী সহ রিকশাচালক ছিটকে পড়ে রাস্তার উপর।

আহত হওয়া রিকশার যাত্রী দুইজনের মধ্যে একজন।

তখন রাস্তায় পড়ে থাকা তিনজনের উপর দিয়েই কভার্ডভ্যান দ্রুতগতিতে চালিয়ে যায়। সাথে সাথেই রিকশাচাল বাবুল মিয়া ঘটনাস্থলেই মারা যায়। যাত্রী দু’জন রকি ও সবুজ মারাত্মক আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার উপরে পড়ে আছে রিকশাচালক সহ দুইজন। এরপর উপস্থিত জনতা ও এলাকাবাসীর সহায়তায় তাদের নিকটস্থ নারায়ণগঞ্জ ৩০০শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর জানা যায় যে, হাসপাতালে নেওয়া আহত দুইজনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশংকাজনক দেখে নারায়ণগঞ্জ ৩০০শয্যা হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হবার কিছুক্ষণ পরই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালো দুইজন। যিনি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে, তাঁর অবস্থাও আশংকাজনক।

নিরাপদ সড়ক চাই শ্লোগানে মানুষের রক্তে রক্তাক্ত সড়ক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের নাড়িভুঁড়ি।

জানা যায় রিকশাচালক বাবুল মিয়া তল্লা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি এলাকার বাসিন্দা। আর রকি ও সবুজ পাঠানটুলি আইলপাড়া এলাকার বাসিন্দা। এরা নিকটস্থ ইব্রাহীম নিট গার্মেন্টসের শ্রমিক ছিল। অবশেষে রাস্তার দুইপাশে থাকা জনতার বুদ্ধিমত্তার কারণে কাভার্ডভ্যান্টি ধরা পড়ে। কিন্তু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় কাভার্টভ্যানটির ড্রাইভার হেলপার। পর মুহূর্তেই শুরু হয় এক হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এর কিছুক্ষণ পরই সিদ্ধিরগঞ্জ থানা থেকে পুলিশবাহিনী এসে জনতার ভিড় সামাল দিয়ে রাস্তার যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ ঘটনাস্থলে থেকে জনতার আটক করা কাভার্ডভ্যানটি নিয়ে যায় থানায়। এরপর বিস্তারিত আর কিছু জানা যায়নি। জানা যাবে কেইস-মামলা আর এটা সেটা। কিন্তু সড়ক নিরাপদ আর মানুষের জানের নিরাপত্তার জন্য কোনও কিছুই করা হবে না। মোড়গূলোও থেকে যাবে ট্রাফিক শূন্য। ড্রাইভারাও তাদের গাড়ি চালাবে বেপরোয়াভাবে। এমনভাবে প্রতিনিয়তই ঘটবে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। আমরা শুধু দেখেই যাবো।

ছবি ঘটনাস্থল থেকে নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা।

ফুটেছে নাইট কুইন সৌরভ ছুটেছে


হযরত জলিল শাহ-এর মাজারে ফোটা দুর্লভ নাইট কুইন। দেখতে ঠিক পদ্মফুলের মতো।

নারায়নগঞ্জ গোদনাইল হাজারীবাগের হজরত জলিল শাহ মাজারে ফুটেছে দুর্লভ নাইট-কুইন ফুল। দেখতে অনেকটা পদ্ম ফুলের মতো। নাইট কুইন ফুলের রঙ ধবধবে সাদা ৷ মৃদু একটা সৌরভ আছে এই ফুলের। ফুল ফুটে থাকে রাতের শুরু থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত। মধ্য রাত পার হলেই ফুল মিলিয়ে যেতে শুরু করে। আর সেই রাতের অন্ধকারে হয় নাইট-কুইন ফুলের জীবনাবসান। তাই হয়তো এই ফুলের নাম হয়েছে রাতের রাণী নাইট-কুইন (night-queen)। যাকে বলা হয় দুর্লভ একটি ফুল। এর প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, এটা যতটা দুর্লভ ফুল ভাবা হয়, আসলে ততখানি নয়। কিছুটা বিরল ক্যাকটাস জাতীয়।


লম্বা লম্বা পাতায় লতার মতো গাছে দেখা যাচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক নাইট কুইন ফুল।

জানা যায় নাইট কুইন ফুলটির আদি নিবাস আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল এবং মেক্সিকোতে। নাইট-কুইনের বৈজ্ঞানিক নাম ( peniocereus greggii )। যার দেখা মেলে গাছ লাগানোর আনেক দিন পর। প্রচলিত ধারণায় এটাকে সৌভাগ্যের প্রতীকও মনে করে থাকে অনেকে। তবে দুর্লভ ফুল হিসাবে নয়, ফুলের চির স্নিগ্ধ শুভ্র-প্রবিত্র রূপকে সবাই বেশি পছন্দ করে। আর নাইট কুইন ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে কেউই দ্বিমত পোষণ করে না। নাইট-কুইন ফুল নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বহু কাহিনী ছড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনীর অবতারণা ঘটেছিল দু’হাজার বছর আগে বেথেলহ্যাম নগরীতে।

m.youtube.com/watch?v=oaGwCSfrk_Q
গতবছর ইউটিউবে আমার আপলোড করা একটা ভিডিও।

তখন নগরীর প্রত্যেক বাড়িতে নাইট-কুইন ফুলগাছ ছিল। এক রাতে ঘটল আশ্চর্যজনক ঘটনা! প্রত্যেক বাড়ি নাইট-কুইন গাছে ফুলে-ফুলে ছেয়ে গেল। এই ঘটনায় কৌতূহলী নগরবাসী এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। তাঁরা বুঝে উঠতে পারল না প্রকৃতি কেন এক অজানা উৎসবে মেতে উঠেছে। পরে অবশ্য সবাই আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছিল নগরবাসী। সেই রাতে বেথেলহ্যামের ঘোড়ার আস্তাবলে জন্ম হয়েছিল এক মহাপুরুষের। যিনি ছিলেন যিশু খ্রীষ্ট। বেথেলহ্যামের সব নাইট-কুইন সে রাতে মেতে উঠেছিল যিশুখ্রীষ্টের জন্মোৎসবে। এ জন্য আজও অনেকের কাছে এ ফুলটি বেথেলহ্যাম ফ্লাওয়ার নামেও পরিচিত ৷


মাজারে দায়িত্বে থাকা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মহিউদ্দিন সাহেব ও সৌন্দর্যের প্রতীক দুর্লভ নাইট কুইন ফুল।

আর আজ থেকে প্রায় বিশবছর যাবৎ এই দুর্লভ নাইট-কুইন ফুলটা নিয়মিত ফুটছে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল হাজারীবাগ হযরত জলিল শাহ’র মাজার শরিফে। সন্ধ্যার পর-পর প্রবিত্র এই মাজারে প্রবেশ করলেই এই ফুলের স্নিগ্ধ সৌরভে মন-প্রাণ বিচলিত হয়ে উঠে। আমার জানামতে এই দুর্লভ নাইট-কুইন ফুলটি নারায়নগঞ্জের আর কোথাও নেই। গাছের পাতা থেকে ফুলের কলি, তারপর ফুল। আবার পাতা থেকে গাছের জন্ম। পাতা মাটিতে পরলেই কিছুদিন পর আস্তে আস্তে পাতা থেকে শিকড় গজায়। এরপর হয় গাছের জন্ম। গাছগুলো লম্বা লম্বা পাতায় লতা আকৃতির হয়ে থাকে।


এবার শুরুতেই অনেক নাইট কুইন ফুল ফুটেছে। যা গতবছরের চেয়েও অনেক বেশি।

এই মাজার শরিফ থেকে অনেকেই নাইট-কুইন ফুল গাছের পাতা নিয়ে রোপণ করেছিল ফুল জন্মানোর আশায়, কিন্তু হয় নাই। এই মাজার শরীফের ওরশ মোবারক প্রতি বছর তিনবার হয়ে থাকে, যথাক্রমে পহেলা ফাল্গুন, আটাশে ভাদ্র, একুশে কার্তিক। ওরশ উপলক্ষ্যে এই মাজারে বহু লোকের সমাগম ঘটে। এই মাজারের ওরশ মোবারক উপলক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি লোকের সমাগম ঘটে একুশে কার্তিক। কারণ শুধু একটাই, তা হলো এই দুর্লভ নাইট কুইন ফুলের জন্য। আগত লোকজনের দৃষ্টি থাকে এই নাইট কুইন ফুলের দিকে। প্লাস্টিকের বড় ড্রাম আকারের টবে সারিবদ্ধভাবে রাখা ফুল সহ গাছগুলো খুব সুন্দর দেখা যায়।

অযত্নে অবহেলায় মোগল স্থাপত্য ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ কেল্লা


আড়ালে পড়ে থাকা নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লা।

প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জে রয়েছে মোগল আমলের অনেক স্থাপনা। তার মধ্যে একটি হলো হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লা দুর্গটি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নারায়ণগঞ্জ থেকে চিটাগাং রোড যেতে মাঝপথে নবীগঞ্জ গুদারাঘাটের একটু সামনেই, হাজীগঞ্জ ফায়ার ব্রিগেডের পরই হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লাটির অবস্থান। নারায়ণগঞ্জ সিটির হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরেই এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি অযত্নে অবহেলায় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

কোনো একসময় এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও সবার কাছে পরিচিত ছিল। নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোড ভায়া ডেমড়া আসা যাওয়ার মাঝেই এই কেল্লাটি সবার চোখে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে এই কেল্লাটির চারপাশে গড়ে উঠেছিল টিনশেড পাটের গোডাউন। সেসময় নারায়ণগঞ্জ পাট ও বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন সেই নাম-কাম না থাকলেও, কেল্লাটির চারপাশে গোডাউনগুলো এখনো দিব্বি রয়ে গেছে। পাটের নামগন্ধ নেই, অথচ গোডাউনগুলো চলছে ভাড়ায়। টিনশেড গোডাউন গুলোর জন্য মোগল আমালের প্রাচীনতম এই স্থাপনাটি অনেকেরই চোখে পড়ে না। কাজেই ইতিহাস ঐতিহ্যের সৌন্দর্য হারাতে বসেছে মোগল স্থাপত্য এই কেল্লাটি।

জানা যায়, কোনও একসময় ঢাকা শহর কে রক্ষা করতে এই কেল্লাটি নির্মাণ করেছিলেন। সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল। তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ বা কেল্লা। সম্ভবত মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এই দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। জলদুর্গের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত দুর্গটি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুরাতন বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। কেল্লাটি চতুর্ভূজাকৃতির। কেল্লাটিতে চার পাঁচটি প্রবেশদ্বার আছে। প্রবেশদ্বারগুলো দেখে মনে হয়, রাজা, বাদশাহ বা সম্রাটরা নৌযান থেকে নেমেই; খুব অল্পসময়ের মধ্যেই কেল্লায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হতো।

কেল্লাটি সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের ভেতরের সাইটে প্রায় তিন হাত চওড়া সরু রাস্তার মতো আছে। মনে এই রাস্তা দিয়ে সৈন্যদল হাঁটতো আর কেল্লার বাইরে নজর রাখতো। প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি বা বল্লম ছোড়ার উপযোগী ফোকর। আরও আছে চারকোণে গোলাকার বুরুজ। চারকোণের প্রতিটি বুরুজের অভ্যন্তর ভাগে দুর্গ প্রাচীরের শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত সিঁড়ি। এই বুরুজে কর্তব্যরত প্রহরী পাহারা দিতো। আছে কামান বসানোর উপযোগী সুউচ্চ বেদীর অবস্থান, এটি হলো দুর্গটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।


ঐতিহ্যবাহী মোগল স্থাপত্য হাজীগঞ্জ কেল্লার সুউচ্চ সিঁড়ির প্রধান ফটক।

কেল্লাটির ভেতরে বিশাল জায়গা। দেখে মনে হয় এ যেন একটা ফুটবল খেলার মাঠ। হয়তো এই মাঠেই সৈন্যদল ট্রেনিং অথবা শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ করতো। মাঠের এক কোণে একটা সুরঙ্গ পথ ছিল। জানা যায় এই সুরঙ্গ পথ নাকি শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত বন্দর কেল্লার সাথে সংযোগ ছিল। বিপদের আশংকা টের পেলে সৈন্যদল এই সসুরঙ্গপথ দিয়ে অন্য কেল্লায় পলায়ন করত। তবে বর্তমানে সুরঙ্গটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ আছে। এই কেল্লাটি দক্ষিণ পাশে একটি খাল রয়েছে। এই খাল দিয়ে সেসময়ের রাজপ্রতিনিধিরা তাদের রাজকীয় নৌযান নিয়ে কেল্লায় আসতো। তাই এই খালটির নামকরণ করা হয়েছে কেল্লা খাল।

নারায়ণগঞ্জ টু ডেমড়া সড়কের মাঝপথেই এই খাল। মানুষ আর যানবাহন চলাচলের জন্য এই খালের উপরে প্রাচীন আমলেই একটা ব্রিজ তৈর করা হয়েছিল। হাজীগঞ্জ কেল্লার নামানুসারে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় কিল্লার পুল। ব্রিজটির পাশেই রয়েছে বিবি মরিয়মের সমাধিস্থান। যা বিবি মরিয়মের মাজার নামে সবার কাছে পরিচিত। জানা যায় সমাধিতে শায়িত বিবি মরিয়মকে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে ঐতিহাসিকরা ধারনা করে থাকেন।


কেল্লার ভেতরের পরিতপ্ত যুদ্ধের ময়দান। স্থানীয় ছেলেপেলেদের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ। রাখাল ছেলের গরুছাগল ছড়ানোর জায়গা।

হাজীগঞ্জ কেল্লাটির উত্তর পাশে এম সার্কাস নামক স্থানে রয়েছে একটি শাহী মসজিদ। মসজিদটি এম সার্কাস শাহী মসজিদ নামে সুপরিচিত। জানা যায়, আগেকার সময়ে কেল্লায় আসা রাজপ্রতিনিধিরা এই শাহী মসজিদেই নামাজ আদায় করতো। তাই এই মসজিদটি স্থানীয় মানুষের কাছে শাহী মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।

বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ কেল্লাটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হতে বসেছে। হাজীগঞ্জ গুদারাঘাট বা নবীগঞ্জ গুদারাঘাট হতে কেল্লায় প্রবেশ করার সিঁড়িটিও খসে খসে পড়ছে। প্রাচীরে শেওলা জমে একাকার। কেল্লার ভেতরে দিনের বেলা থাকে ছেলেপেলেদের খেলাধুলা আর গোরু ছাগলের ভিড়। রাতেবেলা কেল্লাটি সহ এর চারপাশ থাকে চোর বদমাশ আর নেশাখোরদের দখলে। সন্ধ্যার পর কেল্লাটির আশেপাশে সৃষ্টি হয় এক ভূতুরে পরিস্থিতি। এমনিতেই কেল্লাটির চারপাশে রয়েছে আগেকার সময়ে গড়া টিনের চালের বিশাল বিশাল পাটের গোডাউন। কালের বিবর্তনে এখন আর আগের মতন পাটের জয়জয়কার সময় নেই বলে, এসব গোডাউন এখন ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্নরকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি এসব টিনের গোডাউনের আড়ালে আবডালেই থেকে যাচ্ছে।

এ অবস্থা চলতে থাকলে, হয়তো কোনও একদিন সত্যি সত্যিই নারায়ণগঞ্জের এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি ঝোপ জঙ্গলে ঢেকে যাবে। তাই এখন থেকেই স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ মোগল আমলের স্থাপনা কেল্লাটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া। তা না হলে হয়তো একদিন কেল্লাটি আর কারোর চোখেই পড়বে না। এমনটা যাতে না হয়, সেই আশাই করছি।