ট্যাগ আর্কাইভঃ ধূমপান ক্ষতিকর

ধূমপানের কারণে আমার মৃত্যু হলে সরকার দায়ী থাকবে

বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো সিগারেট কোম্পানি আছে। যা Tobacco company নামে পরিচিত। সেসব কোম্পানিগুলোর তৈরি অনেক রকমের সিগারেট বাজারে আছে এবং প্রত্যেকটি সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ বা ‘ধূমপানের কারণে মৃত্যু হয়’ বা ‘পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি, ধূমপান এক বদ নেশা। যা আমি নিজেও জানি। আবার বুঝিও ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ-ও বুঝি ধূমপান আবার নেশার জগতে শিরোমণি। কারণ, ধূমপানের মাধ্যমেই নেশার জগতে মানুষের পা রাখা শুরু হয়। তাই ধূমপানকে অনেকেই নেশার জগতের নাটের গুরুও বলে। এর একটা কারণও আছে। কারণ হলো প্রাথমিক শিক্ষা যাকে বলে। যে কোনো মানুষ নেশার জগতে পা রাখার আগেই ধূমপান থেকেই নেশা করার শিক্ষাটা শুরু হয়।

তাই দেখা যায়, বিশ্বে যতপ্রকার নেশা জাতীয় দ্রব্য আছে, তার মধ্যে সিগারেট হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় নেশা জাত দ্রব্য। আর যেসব নেশাখোর আছে, প্রত্যেকেই ধূমপান থেকে শুরু করেছিল নেশার জগতে পা রাখা। নেশাখোররা প্রথমে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা অথবা যে-কোনো তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে শিখে ছিল গাঁজা সেবন করা। এরপর গাঁজার মহাগুরু হয়ে ধরেছিল হিরোইন, মদ, আফিম, ফেন্সিডিল, ইয়াবা-সহ নানাধরণের নেশা। শুরু হয়ে গেল নেশাখোরের সাথে মাদক জাত দ্রব্যের সাথে সখ্য ও বন্ধুত্ব গড়া। এরপর থেকে শুরু হয় নেশার জগতে পা রাখা। আর নেশাগ্রস্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরা।

আমিও একজন নেশাখোর। তবে সিগারেট খোর। সিগারেট ছাড়া অন্য কোন নেশা জাতীয় দ্রব্যের সাথে এখনো আমার পরিচয় ঘটেনি। বন্ধুত্ব গড়েছি শুধুমাত্র সিগারেটের সাথেই। এই মরণ নেশা তামাকজাত দ্রব্য সিগারেটের সাথে আমার পরিচয় ঘটে ছোটবেলা থেকে। যখন আমি হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হতে শুরু করেছি, তখন থেকে। দেখেছি মানুষকে ধূমপান করতে। কাউকে দেখেছি হুঁকা বা হুক্কার কল্কিতে তামাক ভরে টানতে। কাউকে টানতে দেখেছি বিড়ি। কারোর হাতে দেখেছি চুরুট। কাউকে দেখেছি সিগারেট টানতে। দেখতে দেখতে একসময় নিজেও একজন মস্ত বড়ো ধূমপায়ী হয়ে উঠলাম। আমি ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠি আমার ঠাকুমার ব্যবহার করা হুঁকা বা হুক্কা টেনে।

তবে আমি চুরিচামারি করে হুক্কা টেনে ধূমপান করা শিখিনি। হুক্কা টানতে বাধ্য হয়েছি একজন গ্রাম্য কবিরাজের পরামর্শে। গ্রাম্য কবিরাজও হুক্কা টেনে ধূমপান করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে। কবিরাজের এরকম বাধ্যবাধকতা ছিল আমার পেটের পীড়া নিয়ে। সেসময় আমি সারাদিন যা খেতাম, কিছুক্ষণ পর সবই বমি হয়ে বের হয়ে যেতো। এই অবস্থা দেখে আমার মা পাশের গ্রামে থাকা এক কবিরাজের শরণাপন্ন হলেন। মা গ্রাম্য কবিরাজের কাছে আমার সমস্যা সব খুলে বললেন। কবিরাজ তাঁর কেরামতি চিকিৎসা শুরু করলেন। ঔষধ দিলেন।

নিয়মিত ঔষধ সেবন করেও যখন পেটের বদহজম দূর হচ্ছিল না। তখন গ্রাম্য কবিরাজ পড়ে গেলেন দুশ্চিন্তায়! কবিরাজের সাথে আমার মা-বাবা-সহ সংসারের সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। উপায়ান্তর না দেখে কবিরাজ হুক্কা টেনে ধূমপান করার পরামর্শ দিলেন। হুক্কা টেনে ধূমপান করতে হবে যখন যা কিছু যা-কিছু খাওয়া-দাওয়া তখন। কবিরাজের পরামর্শ হলো, খাওয়ার পরপরই হুক্কা টেনে ধূমপান করতে হবে। গ্রাম্য কবিরাজের পরামর্শে ঠাকুমার হুক্কা থেকে ধূমপান করা শুরু। কিন্তু আমার মা জননী কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। আমি ছিলাম ঠাকুমার প্রিয় আদরের নাতি। তাই আমার ঠাকুমার জোরাজুরিতে মা আর রাজি না হয়ে পারলেন না। মা-ও রাজি হয়ে গেলেন।

এরপর থেকে শুধু খাওয়া দাওয়াই নয়, খাওয়া-দাওয়ার আগে-পরেও আমার হুক্কা টানা চলতোই। সেই থেকেই আজ আমি নামকরা একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি। প্রতিদিন অন্তত ছোট প্যাকেটের ৫ থেকে ৬ প্যাকেট সিগারেট না হলে আর আমার চলে না। ভোরের ঘুমভাঙা থেকে শুরু করে রাতদুপুর পর্যন্ত খানিক পরপর চলতেই থাকে আমার সিগারেট টানা। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন গ্রাম ছেড়ে স্বপরিবারে শহরে আসি। শহরে এসে প্রায় দুইবছর লেখাপড়া বন্ধ রাখি। ১৯৭৪ সালে আবার স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলে যাবার সময় আমার সাথে ‘কাইয়ুম বিড়ি’ থাকতো। সেই বিড়ি স্কুলের বাথরুমের উপরে থাকা ভেন্টিলেটর নামের ছোট একটা খোপে লুকিয়ে রাখতাম। টিফিনের সময় কিছু খেয়ে স্কুলের পেছনে গিয়ে গোপনে একটা বিড়ি টানতাম। সেই টানা আজ পর্যন্ত চলছেই। বর্তমানে আমার বয়স ৫৬ বছর গত হতে চলছে। বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে ধূমপানও।

দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে অনেক ধূমপান বিরোধী ব্যক্তি আমাকে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে বলে। বলে আমার ভালোর জন্যই। কিন্তু আমি কিছুতেই ধুমপান থেকে বিরত থাকতে পারি না। মুখে বলি হ্যাঁ, এই ছেড়ে দিচ্ছি! কিছুক্ষণ পর হ্যাঁ ভুলে গিয়ে বা হ্যাঁ’কে তুচ্ছ করে আবার টানতে থাকি স্বাদের ধূমপান নামের সিগারেট। বুঝতে পেরেছি আমি এখন ধূমপানে বা সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছি। তবে ৬ থেকে ৭ বছর বয়স থেকে ধূমপান শুরু করে অদ্য পর্যন্ত আমি একটু কাশিও দেই না। সিগারেটের কারণে বা ধূমপানের কারণে আমার তেমন কোনও শারিরীক সমস্যাও দেখা দেয়নি। আমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ সবল এক ব্যক্তি। তারপরও সময় সময় এই ধূমপানের কারণে অনেক মানুষের অনেকরকম কথা শুনতে হয়। শুনতে হয় ঘরের গিন্নির বকুনি। শুনতে হয় ডাক্তারের সাজেশনও। কিন্তু এতকিছুর পরও আমি আমার এই বদ নেশা ধূমপান ছাড়তে পারছি না এবং ধূমপান না ছাড়ার পক্ষেই থাকি।

তা কেন থাকি? থাকি ধুমপানের মধ্যে একটা ‘আভিজাত্য’ আছে বলে। পৃথিবীর অনেক ক্ষমতাবান অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছবিতে তাদের হাতে কিংবা ঠোঁটে চুরুট বা সিগারেট দেখি। আমি মনে করি এটা শুধু আমাকে দেখানোর জন্য অভিনয় করা নয়, এটা তাদের অভিনয়ের বাইরেও যেন একটা আভিজাত্য। একটা সময় ছিল  গ্রাম শহরের মানুষের বৈঠকখানায় হুঁকা বা হুক্কা ছিল। সেসময় হুক্কা শুধু বিচার সালিশেই বৈঠকখানায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল অনেকের বাড়িতেও। এটা ছিল তখনকার সময়ের একরকম আভিজাত্যের প্রতীক। রাজা জমিদারদের বৈঠকখানায়ও লম্বা নল বা পাইপের সাহায্যে তাঁরা হুঁকা বা হুক্কা টানতো। কথিত আছে, ‘এক চুলুম তামাকের বিনিময়ে নিজের এক কাঠা জমিও তামাক সমাদরকারীকে লিখে দিয়েছিলেন’। সেই পাইপওয়ালা হুক্কা তো এখন নেই বললেই চলে। যদিও থাকে তো ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিজে। যেখানে সিনেমা নাটক তৈরি হয়। তবে আগেকার দিনের ধনী ব্যক্তিদের বাড়ির পুরনো কোঠায় সেই যুগের দুই একটা হুঁকা বা হুক্কা এখনো থাকতে পারে বলে মনে হয়।

এছাড়াও হুক্কা শহর ছেড়ে গ্রামের পুরনো গৃহস্থদের ঘরেও থাকতে পারে। তা থাকুক আর না থাকুক, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। মাথা ঘামাচ্ছি এই যুগের সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা রয়েছে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ বা পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায় এই নিয়ে। আচ্ছা, তাই যদি হয় তাহলে রাষ্ট্র কেন এইসব সিগারেট কোম্পানিদের ব্যবসা করতে লাইসেন্স দিলো? যেহেতু এটা বিষের সমতুল্য সেহেতু এটাকে কেন বৈধ ব্যবসা হিসেবে সরকার অনুমোদন দিলো? তাহলে ধূমপানের কারণে মৃত্যু হয় এই কথাটা কতটুকু সত্য প্রমাণিত হচ্ছে? মদ পানে মাতাল হয়, গঞ্জিকা সেবনে পাগল হয়, ইয়াবা সেবনে নেশা হয়। আবার অনেকের জীবনও ধ্বংস হয়ে যায়, মারাও যায়। তাই সেসব মাদক জাত দ্রব্য সরকার নিষিদ্ধ করেছে এবং সেসব জীবন হরণকারী মাদক জাত দ্রব্যের ব্যবসাও নিষিদ্ধ করেছে।

সিগারেট যদি সেসব মাদক জাত দ্রব্যের সমতুল্য হয়, তাহলে সিগারেট বিড়ি তৈরি ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ-সহ এসব দ্রব্যাদি নিষিদ্ধ করছে না কেন? শুধু প্যাকেটের গায়ে লিখে দিলেই কী এর মরণ থাবা থেকে জাতি রেহাই পাবে? পাবে না। ধূমপানের কারণে যদি মানুষের মৃত্যুই হয়, তাহলে অন্যান্য মাদক জাত দ্রব্যাদির মতো সিগারেট কোম্পানিগুলোও বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করি। তা কী এদেশের সরকার কখনো করবে? মনে হয় না। এতেই বোঝা যায় ধূমপানের কারণে মানুষের মৃত্যু হয় না। তাই আমিও ধূমপান করা ছেড়ে দিচ্ছি না। দেখি শেষতক আমার কী হয়! কিছুই হবে না বলে বিশ্বাসও করি।

কারণ,আমি দেখে আসছি ধূমপানের কারণে মৃত্যু হয় না। পরোক্ষভাবে কারোর ক্ষতি হয় না। যদি এমনই হতো, তাহলে গ্রাম শহরের প্রতিটি পাড়া মহল্লার দোকানে দোকানে সিগারেট বিড়ি বিক্রি হতো না। সরকারও এসব মাদক জাত দ্রব্যাদি সিগারেট বিড়ি ওপেন বিক্রি হতে দিতো না। যদিও বিক্রি হতো তা মদ গাঁজা আফিম, হিরোইন, ইয়াবার মতো গোপনে গোপনে। কিন্তু না, এই সিগারেট বিড়ির নেশাখোররা রাস্তাঘাটে, লঞ্চ-স্টিমারে, ট্রেনে লোকালয় থেকেই কিনে মনের আনন্দে টানছে। খোলা আকাশের চিনে দিব্বি টেনেই যাচ্ছে। আর সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সহ ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীরা মৃত্যু মৃত্যু বলে চিল্লাচিল্লি করে বলছে, ‘ধূমপান থেকে বিরত থাকুন! ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর!’ আরেক দিকে সিগারেট বিড়ি কোম্পানিগুলোও প্যাকেটের গায়ে লিখে দিচ্ছে, ‘ধূমপানে মৃত্যু ঘটায়, ধূমপানের কারণে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়, পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতি হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে মনে হয় ধূমপানের কারণে মানুষের কোনও ক্ষতিই হয় না। যদি হতো, তাহলে আমারও হতো। আর যদি কোনও সময় এই ধূমপানের কারণে আমার কোনও ক্ষতি হয় বা মৃত্যু হয়, তাহলে আমি সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সহ সরকারকেই দায়ী করবো। সরকার কেন এই Tobacco company গুলো বন্ধ না করে লোক দেখানে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লিখে দিচ্ছে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?’ তাই ধূমপানের কারণে আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে সরকার।