ট্যাগ আর্কাইভঃ পরবাস

এমন মমতার সত্তা দেখিনি আর পূর্বে


স্বার্থহীন ভালোবাসা

দৃশ্যপট:-(০৯)

আজ ৫ বছর পর দূর পরবাস সৌদি আরব থেকে বাড়ি ফিরার পালা।
বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই ফিরছি মায়ের কোলে। আমার আসাটা শুধু আমার বন্ধু হাসান জানে।
হাসানকে অনেক আগেই বলে রেখেছি ও যেন গাড়ি নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করে আমার জন্য।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে একটি বিমানের টিকেট আর ৭ ঘন্টার ব্যবধানে আমি নিজ মাতৃভূমিতে পা রাখতে পারলাম।
সবকিছু ঠিকঠাক মতই হলো।
হাসানের সাথে আলিঙ্গন করে গাড়িতে উঠে নিজ গ্রামের দিকে রওয়ানা হলাম।
চোখ জুড়ানো সবুজ মাঠ-ঘাট দেখে মনের ভিতর এক শীতল শান্তি অনুভব করছি।
পরবাসে যখন ছিলাম,তখন ভাবতাম কবে দেশে যাবো? কবে ধারদেনা পরিশোধ করে নিজের নামে জায়গা কিনবো।
সেই জায়গাতে বাড়ি উঠবে। বাড়ির নাম হবে হোসাইন ভিলা।

৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ নিজের জায়গাতে নিজের নামে ভিলা দাঁড় করালাম।
কতই না কষ্ট প্রবাসে,ফজরের আযানের আওয়াজে একজন পরবাসীর ঘুম ভাঙ্গে।

ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাসতা না করেই কর্মস্হলে যেত হয়! দীর্ঘ ৮ ঘন্টার ডিউটি শেষে বাসায় এসে আবার খাবার রান্না করে খেতে হয়! খাওয়া দাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে একটু বিশ্রাম না নিয়েই আবার বাহিরে গিয়ে কাজের সন্ধান করি এই ভেবে যে,এ মাসে দেশে রেমিটেন্সের পরিমানটা একটু বেশি যায়।

বাবার ঔষুধের টাকা,বোনের পড়ালেখার খরচ,ছোট ভাইয়ের একটা মোবাইলের আবদার ইত্যাদি সবার খরচের টাকা যেন এ মাসে দিতে পারি।
পিছনের এসব স্মৃতিচারণ করতে করতে আমার নিজ গ্রামে চলে আসলাম।

গাড়ির ভিতর থেকেই আমি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি,আমার মমতাময়ী মা বাড়ির সামনের গেইটে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো কারো অপেক্ষায়!
আমি হাসানকে বললাম, গাড়িটা একেবারে আমার মায়ের সামনে নিয়েই দাঁড় করাবি,মা যেন আমাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।

হাসানের গাড়ি যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছে আমার ভিতরে হার্টবির্ট ততই বাড়ছে।
এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি।
গাড়িটা থামনোর পর আমার আম্মুর নজর হলো গাড়ির ভিতরে কে???
আমি নামতে দেখেই আমার মায়ের চোখের পানি আর কে ধরে রাখে?
দূর থেকেই দুই হাত বাড়িয়ে মা বলতেছে আমায়।
আমার বাবা চলে এসেছে,আমার বাবা চলে এসেছে।
ইমোশনালের আঘাত এতটাই যে, আমার মত কঠিন মানুষটার চোখের জল অটোমেটিক ঝরতে থাকলো!
মায়ের কপালে চুমু দিলাম,মা ও আমার কপালে চুমু দিয়ে বলতে লাগলো,আমার বাঁকা চাঁদ।

৪/৫ মিনিটের ভিতর ঐ স্হানে ২০/২৫ জনের উপস্হিতি,তাদের মাঝে কেউ কাঁদছে কেউ হাসছে।
মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাতে বিভোর দুজন।
এ কান্না হলো খুশির কান্না।

অথচ এর চাইতে বেশি কেঁদেছিলাম যখন নিজ দেশ ও মায়ের বুক ছেড়ে পাড়ি জমাই যোজন-যোজন দূর পরবাসে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ ৫ মিনিটের কান্না! বিমানবন্দরে অবস্হানকৃত আশে পাশের সবাই মা ছেলের বিচ্ছেদের কান্না দেখছে।
পাশে দাঁড়ানো এক মধ্য বয়সী নারীর চোখে ও পানি আমাদের বিচ্ছেদ দেখে।

মাঁকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতেই ঘরে উঠলাম।
এদিকে মা চলে গেল রান্নাঘরে,আমার সাথে করে নিয়ে আসা আমার লাগেজ গুলো খুলতে শুরু করলাম।

ধীরে ধীরে সবাই উপস্হিত,
ছোট ভাই বলতেছে
ভাইয়া আমার মোবাইল আনছো??

বড় বোন,
ভাই আমার বোরকা আর তোর দুলাভাইয়ের ল্যাপটপ এনেছিস?

আদরের ছোট ভাগনি,
মামা আমার কানের দুল কই???

হাজারো চাওয়া,হাজারো আবদার ব্যাগ খোলার আগেই।
একটি বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,এতো ব্যস্ত আর বেদিক হলে হয়?
সবাই কিছু না কিছু পাবে।
নিরাশ কেউ হবেনা।

ঐদিকে আম্মু খাবারের জন্য ডাকতেছে!
আমি গিয়ে খাবারের টেবিলে বসলাম,অল্প সময়ের ভিতর মা অনেক কিছুই রান্না করলো।
আমি ভাত মুখে তুলি আর আম্মু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এক নজরে!
আমার পেটের দিকে তাকায়। আবার আমার চোখের দিকে দেখে,আর ঝরঝর ঝুম বৃষ্টি ধারায় চোখ দিয়ে পানি ঝরায় আমার মা।

আর বলে কতদিন যেন না খেয়ে কাটিয়েছিলি আমার বাঁকাচাঁদ?
কত রাত যেন নির্ঘুম পার করেছিলি?

অথচ আমি ফোন দিলে ঠিকি বলেছিস,হ্যাঁ দুপুরের খাবার খেয়েছি!
যখন বলতি তখন আমার মন ছটফট করতো!

আমি জানি তুই তখন মিথ্যা বলতি।
না খেয়েই বলতি হ্যাঁ মা আমি খেয়েছি।

অাজ সকাল থেকেই তোর মায়ের মনটা ছোটফট করেছে,কারন খুজে পাইনি কেন এমন হচ্ছে আজ? অকারনে কখনই আমার ধড়ফড় করেনি কখনো!
এখন বুঝলাম।

অবশেষে আমি মাকে প্রশ্ন করলাম।
মা সবাই তো জিজ্ঞেস করলো কার জন্য কি এনেছি?তুমি তো কিছুই চাইলেনা মা?
মা আবারো কান্না করে বলতে লাগলো।
আমার ছেলে আমার বুকে চলে এসেছে!
আমার জন্য পৃথিবীর বুকে এর চাইতে বড় আর কি চাওয়া হতে পারে?

সবাই সবার আবদারকৃত জিনিস নিয়ে চলে গেলো। দিনশেষে আমার পাশে শুধু রয়ে গেল আমার মমতাময়ী মা!

পৃথিবীতে ১০০% খাঁটি স্বার্থহীন ভালবাসা মা ছাড়া আর কেউ করেনা।

স্বার্থছাড়া কেউ কাউকে ভালবাসেনা।
কিন্তুু মায়ের ভালবাসা স্বার্থহীন।
খাদহীন খাঁটি।
প্রবাসীদেরকে কখনো গালি দিবেন না। তাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করবেন না।তারাই হলো দেশের অর্থনীতির চাকা।
তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকায় দেশের উন্নতি হচ্ছে।
এ বহতা ব্লগের সকল সদস্যদের মধ্য হতে কারো না কারো ভাই,বাবা,চাচা,মামা পরবাসে জীবন পার করছে,নিজে কাঁঠফাটা রোদে পুড়ে নিজ পরিবারকে শীতল ছায়া প্রদান করছে।

একটি দৃশ্যপট

অনেক পুরাতন লিখা। আজ থেকে দেড় বছর আগে লিখেছিলাম। গল্পটিতে বেশ কিছু টাইপো ছিলো সংশোধন করে নিয়েছি।

এ গল্পের প্রধান চরিত্র একজন নারী, একজন মা!

মোঃ শাহাদাত হোসাইন।