প্রতিদিন রাস্তাঘাটে চলাফেরার মাঝে অনেক জায়গায় থামতে হয়, অনেক চা’র দোকানে বসতে হয়। চায়ের দোকানে বসলেই চোখ যায় দোকানে চালু থাকা রঙিন টেলিভিশনের দিকে। চালু থাকা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা মেলেনা রাষ্ট্রীয় ‘বিটিভি’ চ্যানেল। চলতে থাকে আর বসে থাকা কাস্টমাররা মনের আনন্দে ডিশ এন্টেনার ভারতীয় চ্যানেলগুলো। ওইসব দৃশ্য চোখে পড়লেই মনের টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে ছোটবেলায় সাদাকালো টেলিভিশনে দেখা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কথা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন (বিটিভি) যে আমরা সমবয়সীরা কতো আনন্দে উপভোগ করতাম, তা আর লিখে শেষ করতে পারবো না। তবে একটু-আধটু লিখে শেয়ার করা যায়।
সময়টা তখন ১৯৭৪ সাল। আমি চার কেলাসের (ক্লাস ফোর)-এর ছাত্র। তখন আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকতাম। সেসময় ঘরে ঘরে এতো টেলিভিশন ছিলো না। যা ছিলো, তা কেবল সেসময়কার কিছুকিছু পয়সাওয়ালাদের বাড়িতেই কাঠের বাক্সের মতো একটা সাদাকালো টেলিভিশন থাকতো।
তখন রঙিন টেলিভিশন ছিলোই না। লক্ষ্মণ খোলা পুরো গ্রামে হয়তো দু’একজনের বাড়িতে টেলিভিশন নামের বাক্সটা ছিলো। আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে থাকা কোনও ফ্যামিলি বাসায় তো দূরের কথা, মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের ক্লাবেও একটা টেলিভিশন ছিলো না। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার ওপার দু’পারে দু’টি টেলিভিশন ছিলো। একটা টেলিভিশন ছিলো লক্ষ্মণ খোলা জনতা ক্লাবে, আরেকটা ছিলো নদীর পশ্চিম পারে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের শ্রমিকদের ক্লাবে। এই দুইটাও ছিলো সাদাকালো ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশন।
সেসময়কার টেলিভিশনের ছোট্ট বাক্সটা বর্তমানে অনেক বড়সড় হয়ে গেছে। বর্তমানে টেলিভিশন প্রায় ৪০” ইঞ্চি। তাও আবার অ্যান্ড্রয়েড। সাথে থাকে ইন্টারনেট সংযোগ সিস্টেম। তা-ও আবার প্রায় ঘরে, হাটবাজারে, মহল্লার চায়ের দোকান-সহ বড়সড় সব দোকানেই দেখা যায়।
আর আমাদের সময়ে এই ১৪” ইঞ্চি, ১৭” ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনই ছিলো মস্তবড় টেলিভিশন। টেলিভিশন দেখার জন্য শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিতে হতো। তারপর সেসময়ের রুস্তম পাইন্না রুস্তমদের কতো যে মাইর, গুতা, খেতে হতো, তা আর লিখে শেষ করতে পারছি না। তবুও সেসময়কার কাঠের বাক্সের ভেতরে শাটানো কাঁচের পর্দার সামনাসামনি বসে থাকতে যে কতো ভালো লাগতো, তা একটু-আধটু লিখে স্মৃতি করে রাখছি মাত্র।
বলে রাখা ভালো যে, তখনকার সময়ে ইন্টারনেট আর ওয়াই-ফাই তো দূরের কথা, ডিশ অ্যানটেনা বা ডিশ লাইনও ছিলো না। ১৪” ইঞ্চি বা ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশনের সামনে বসে আমরা যা দেখতাম, তা কেবল আমাদের স্বাধীন বাংলার বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত খবর, নাটক, সিনেমা, সিনেমার গান ও দেশীয় নৃত্যানুষ্ঠানগুলোই দেখতাম।
তখন সপ্তাহের ৭ দিনই রাত ৮ টা বাংলা সংবাদের পর কোনো-না-কোনো ইংরেজি সিরিজ শুরু হতো। সেসব বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখনো মনে আছে।যেই সিরিজগুলো দেখানো হতো সেগুলো থেকে কয়েকটা সিরিজের নাম এখানে উল্লেখ করছি। “হাওয়াই ফাইভও”, “টারজান”, “দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ল্ড ওয়েস্ট”, “সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান”, “বায়োনিক ওমেন”, “নাইট রাইডার”, “স্পেস নাইন্টিন নাইন্টি নাইন”।
বাংলা নাটকের সিরিজগুলো হলো, ‘সংশপ্তক’ এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’। আরও কিছু বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখন আর মনে নেই। তবে কিছুকিছু দৃশ্য এখনো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এইসব দর্শকপ্রিয় নাটকগুলোর নাম আর কথা মনে পড়লেই এখনো টেলিভিশনের রঙিন পর্দায় ফিরে তাকাই। কিন্তু না, সেরকম মনমাতানো নাটক আর ইংরেজি সিরিজ গুলো দেখা মেলেনা।
আগেকার মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ছায়াছবি, নাটক, ইংরেজি সিরিজ টেলিভিশনের সামনে বসে মনের আনন্দে কেউ উপভোগও করে না। সিনেমা হলে তো যায়-ই-না। এখন টেলিভিশনে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে দেখা যায় ডিজে গান, ডিসকো ড্যান্স, গ্রুপ ড্যান্স, অর্ধনগ্ন পোষাকে হৈ-হুল্লোড়। সেগুলোই যোয়ান-বুড়ো সবাই দেখে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বিটিভি’ তো কেউ দেখেই না, ‘বিটিভি’তে সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানও কেউ দেখে না।