ট্যাগ আর্কাইভঃ বিবি মরিয়ম সমাধি

ঐতিহ্যবাহী বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারটি রয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে


মোগল আমলে নির্মিত বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজার।

প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস বিশ্বজুড়ে। প্রাচীনকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে সুপরিচিত। নারায়ণগঞ্জে মোগল আমলের স্থাপত্য এখনো অনেক জায়গায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারমধ্যে একটি হলো বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা বিবি মরয়ম মাজার। এই সমাধিসৌধটি স্থানীয় মানুষের কাছে বিবি মরিয়ম মাজার নামেই সুপরিচিত। বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারটি নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল সংলগ্ন অবস্থিত। নারায়ণগঞ্জ টু ডেমরা-চিটাগাং রোড আসা-যাওয়ার মাঝপথেই বিবি মরিয়ম মাজারটির অবস্থান।

বিবি মরিয়ম মাজারের ভেতরের সামনে থেকে তোলা।

কিল্লার পুল হলো আমাদের নারায়ণগঞ্জের একটা ঐতিহ্যবাহী পুল। যা হাজীগঞ্জ কেল্লার নামে নামকরণের ফলে পুলটির নাম হয় কিল্লার পুল। এই হাজীগঞ্জ কেল্লা নিয়ে এর আগেও একদিন শব্দনীড় ব্লগে আলোচনা করেছিলাম। আজকে বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজার নিয়ে কিছু লিখতে চাই। সেই সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজারটির সাথে।

এই বিবি মরিয়ম মাজারের সাথে মিশে আছে আমার আত্মা, মন-প্রাণ সবই। একসময় ভালোলাগা, না লাগার বেশিরভাগ সময়টা কাটাতাম এই পবত্র মাজারটির আশেপাশে। সমায়টা ছিল ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে। যখন কিল্লার পুল ‘ফাইন টেক্সটাইল’ মিলে কাজ করতাম তখন। বিবি মরিয়ম মাজারের সুবিশাল প্রাচীরের পাশেই ছিল ‘ফাইন টেক্সটাল’ মিল। বর্তমানে ফাইন টেক্সটাইল মিল মুন্সিগঞ্জ চান্দের বাজার সংলগ্ন আউটশাহী এলাকায়। সেখানেও কিছুদিন কাজ করেছিলাম। যাক সেসব কথা, আসা যাক বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজার প্রসঙ্গে।

বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারের প্রধান গেইট। এই গেইটের বাইরে ছিল ফাইন টেক্সটাইল মিলস্।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বিবি মরিয়মের সমাধি মুঘল আমলে নির্মিত একটি সমাধিসৌধ। এটি তৎকালীন মুঘল সম্রাট নিয়োজিত সুবেদার শায়েস্তা খাঁন কতৃক নির্মিত বলে ধারণা করে থাকেন ঐতিহাসিকরা । ঐতিহাসিকরা এ-ও ধারণা করেন যে, এই সমাধিসৌধটি ও এর লাগোয়া মসজিদের নির্মাণ কাল ১৬৬৪-৮৮ খৃষ্টাব্দে। সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’কে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে মনে করেন।

বিবি মরিয়ম মাজারের ভেতরে থাকা মসজিদ।

সমাধিসৌধটি সুউচ্চ প্রাচির দিয়ে ঘেরা একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের মাঝখানে ভুমি থেকে অনেক উচুতে নির্মিত। বর্গাকার ইমারতটিতে একটি গম্বুজও রয়েছে। এছাড়াও ভবনের চারদিকে খিলান ছাদ বিশিষ্ট বারান্দা আর অনেকগুলো জানালা রয়েছে সমাধিসৌধটিতে। সমাধিসৌধটির কেন্দ্রস্থলে চতুস্কোন কক্ষে রয়েছে তিন ধাপ বিশিষ্ট সমাধি। সমাধিটি শ্বেত পাথরে নির্মিত ও লতা পাতার নকশা অঙ্কিত। এছাড়া ও কবর ফলক ও সমাধি লাগোয়া বারান্দায় বেশ কয়েকটি সাধারণ কবরও রয়েছে, যা সমাধিসৌধটির সামনে গেলেই সবার চোখে পড়ে ।

মাজারের সামনে সারিবদ্ধভাবে থাকা কয়েকটি কবর।

এছাড়াও রয়েছে সমাধিসৌধটির পশ্চিম পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, যার নির্মাণকাল সমাধিসৌধটির সমসাময়িক অর্থাৎ ১৬৬৪-৮৮ খৃষ্টাব্দে। এটিও শায়েস্তা খাঁন নির্মাণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তার কারণেই হয়তো সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’ এর নামেই একে ‘বিবি মরিয়ম’ এর মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে। সূত্র: উইকিপিডিয়া থেকে।

স্বাধীনতা পরবর্তি সময় থেকে এখানে গড়ে ওঠেছে ‘বিবি মরিয়ম’ সমাধির নামে একটি স্কুল, যার নাম রাখা হয় ‘বিবি মরিয়ম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’। চতুর্দিকের প্রাচীর ঘেঁসে স্থায়ীভাবে গড়ে ওঠেছে বহু দোকানপাট। সন্ধ্যা হলেই সমাধিসৌধটি হয়ে পড়ে একটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো। সমাধিসৌধটি ছাড়া এর আশেপাশে কোনো লাইট বা কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। সমাধিসৌধ সংলগ্ন মসজিদে লাইট থাকলেও পুড়ো সমাধিসৌধটি জায়গা থাকে অন্ধকার। বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধটির চারদিকে স্থায়ীভাবে দোকান-পাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান, জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী পবিত্র মাজারটি রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়েলে।

বর্তমানে এটি নিয়ন্ত্রন দেখভাল করছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা বিভাগ। কিন্তু বহু প্রাচীনতম এই সমাধিসৌধটির কোনো সংস্কার হচ্ছে না বহুবছর ধারে। যার কারণে সমাধিসৌধটির প্রাচীরের পুরানো ইটগুলিও ধসে পড়ছে। সেইসাথে সমাধিসৌধ বা মাজারটিও। ধারণা করা যায়, যখন এই সমাধিসৌধটি তৈরি করে তখন কোনো সিমেন্টের আবিষ্কার হয় নাই, বা তখন কোনো সিমেন্ট-ই ছিলনা। সেইজন্যই পুড়ো সমাধিসৌধটি চুনা আর সুরখি দিয়ে নির্মিত হয়। তাই অনেক পুরানো স্থাপনা হওয়াতে সমাধিসৌধটির প্রাচীর সহ এর মূল স্থাপনাও শেওলায় ঢাকা পড়ে যায়। একযুগ বা দুই যুগ পরে রাষ্ট্রের সুনজরে শুধু সমাধিসৌধটি কিছুটা সংস্কার হলেও, এর পাশে থাকা স্থাপনাগুলো সংস্কারবিহীন পড়ে থাকে যুগযুগ ধরে। আর মোঘল আমলের নির্মিত ঐতিহ্যবাহী বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজারটি পড়ে থাকে আড়ালে আবডালে।

ছবি গত দুইবছর আগে নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা।