ট্যাগ আর্কাইভঃ ভৌতিক গল্প

ভয়


আমি তখন ক্লাশ সেভেন এ পড়ি। তখন ছিল বর্ষাকাল। আমাদের গ্রামের পাশেই ছিল হাই স্কুল। সেই স্কুলে এক সাথে লেখাপড়া করতাম আমি ও শিহাব। আমরা এক সাথে সব সময় থাকতাম। শিহাবের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশী দূরে নয়। ওদের বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। আমাদের গ্রামে এসে তারা বাড়ি করেছে। বর্ষাকাল এলেই আমি ও শিহাব এক সাথে ঘুরাঘুরি করতাম। খেলাধূলা করতাম। মাছ ধরতাম। অনেক মজা করতাম। আমাদের গ্রামের পাশেই ছিল এক বিল। বিলের উত্তর পাশে আমাদের গ্রাম ও দক্ষিণ পাশে ঝিকাতলা গ্রাম। সেই বিলে আমি ও শিহাব মাঝে মাঝে রাতের বেলায় মাছ ধরতে বের হতাম। আরো অনেকেই তখন বর্ষাকালে মাছ ধরত। টেটা দিয়ে আমরা মাছ ধরতাম।
একদিন বিকাল বেলা আমি শিহাবদের বাড়িতে গেলাম। তাকে বলে আসলাম আজ রাতে মাছ ধরতে যাব। তুই রেডি থাকিস।
শিহাব বললো, ঠিক আছে দোস্ত।
তখন রাত দশটা বাজে। শিহাব আসল আমাদের বাড়িতে। আমি টেটা, টর্চ লাইট ও ডুলা নিয়ে মাছ ধরার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। দু’জনে মাছ ধরার জন্য বিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বিলের পাশে এসে আমি টস লাইট ও ডুলা হাতে নিলাম আর শিহাব টেটা নিয়ে মাছ ধরছে। অনেকক্ষণ হলো কোন মাছ পাচ্ছি না। প্রতিদিনই মাছ ধরতে এসেই শুরুতে আমরা মাছ পেয়ে যায় কিন্তু আজ দীর্ঘ দুঘন্টা যাবত কোন মাছ পাচ্ছি না। আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন জানি মনে হচ্ছে। আরো অনেকেই এখানে মাছ ধরছে। তারা মাছ পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমরা পাচ্ছি না।
তখন আমি বললাম, শিহাব চল্। আজ মনে হয় কোন মাছ পাব না। এদিকে রাত বারটা বেজে গেছে। আর থাকা যাবে না।
শিহাব বললো, আরেকটু দেখি দোস্ত। কোনদিনতো খালি হাতে বাড়ি ফিরিনি। আজ খালি হাতে যাব।
– ঠিক আছে আরো আধঘন্টা দেখি।
তারপর আমরা আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একেবারে বিলের শেষ প্রান্তে চলে আসলাম। শেষ মূহূর্তে আমরা একটি বোয়াল মাছ পেয়ে গেলাম। প্রায় দেড় কেজি হবে। তারপর আমি শিহাবকে বললাম, চল দোস্ত মাছতো একটা হলোই। এবার চলি।
শিহাবও বললো, ঠিক আছে দোস্ত চল।
এই বলেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমারা গ্রামের ত্রিরাস্তার মাথায় আসলাম। এখান থেকে উত্তর দিকে শিহাবদের বাড়ি যার দূরত্ব ৫ মিনিটের রাস্তা হবে। শিহাবদের বাড়িতে যাওয়ার পথে একটু দূরেই একটি মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের পাশেই একটি বিরাট বড় বটগাছ আছে। এর পাশেই ছিল হিন্দুদের চিতা। হিন্দুধর্মের অনুসারীদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে এখানে পোড়ানো হয়। সন্ধ্যার পর এ রাস্তায় গ্রামের লোকজন চলাফেরা কম করে। আর দক্ষিণ দিকে আমাদের বাড়ি। এখান থেকে আমাদের বাড়িও ৫ মিনিটের রাস্তা হবে। আর পূর্ব দিকে একটি রাস্তা বাজারের দিকে চলে গেছে। আমরা দু’বন্ধু মাছ ধরে ত্রিরাস্তায় এসে হাজির হলাম। তখন রাত ১টা বাজে। এবার দুজন দুই রাস্তা দিয়ে চলে আসব।
এমন সময় শিহাব বললো, সুজন তুই মাছটা নিয়ে যা।
আমি বললাম, না তুই অনেক কষ্ট করেছিস? তুই নিয়ে যা।
– না আমি নেব না। তুই নিয়ে যা। আমি অন্য দিন নেব।
শিহাব আমাকে মাছটি দেয়ার জন্য জোরাজোরি করছে। আমি তখন জোর করেই তাকে মাছটি দিয়ে বললাম, ঠিক আছে তুই নে। আমি সকাল বেলায় তোদের বাড়িতে গিয়ে মাছের তরকারী খেয়ে আসব। এই বলে দু’জন বিদায় নিয়ে দুদিকে রওয়ানা হলাম।
শিহাব কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সে শুনতে পেল পিছন থেকে আমার কণ্ঠে কে যেন ওকে ডাকছে, এই শিহাব দাঁড়া। আমাকে মাছটা দিয়ে যা।
তখন শিহাব পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। কাউকে না দেখে শিহাব ভয় পেয়ে গেল। ভাবল, সুজন তো এখানে নেই। সে চলে গেছে কিন্তু তার কণ্ঠে ডাকছে। শিহাব আবার সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।
আবার পিছন থেকে ডাকছে, এই শোন তুই মাথাটা নিয়ে যা আমাকে মাছটা দিয়ে যা।
শিহাব আবার পিছনে তাকাল দেখল কেউ নেই। তখন ভয়ে তার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। এমতাবস্থায় শিহাব বলল, না তুই পুরো মাছটাই নিয়ে যা। এই বলে সামনের দিকে পা বাড়াল কিন্তু তখনও কাউকে দেখতে পেল না। তখন তার ভয় আরো বেড়ে গেল। এবার সে আর পিছনে তাকাল না। বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌঁড় দিল। আর পিছন থেকে বলছে শিহাব দাঁড়া। শিহাব দাঁ…ড়া…
অনেক দূর পর্যন্ত শিহাব ঐ ডাকটি শুনছে। আস্তে আস্তে সেই শব্দটা মিলিয়ে গেল। আর শিহাব বাড়িতে চলে আসল। ভয়ে তার সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেল। ভাবছে সে, এ কি দেখলাম, কার কথা শুনলাম। এম হল কেন? এখন যদি কাউকে ডেকে বলি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তারচে বরং ঘুমিয়ে পড়ি।
মাছটা ঘরের এক কোনায় রেখে শিহাব তার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারারাত আজে বাজে চিন্তা করল। বিছানার এপাশ ও পাশ করল। কিন্তু ঘুম আসল না।
সকাল বেলা নয়টা বাজে এখনও শিহাব ঘুম থেকে উঠছে না। এ বিষয়টা লক্ষ্য করল শিহাবের মা। স্কুলের সময় হয়ে গেছে এখনও ঘুম থেকে উঠছে না। শিহাবের মা তার রুমে গিয়ে দেখে সে শুয়ে আছে এবং কাৎরাচ্ছে। নাকে মুখে ফেনা উঠে আছে। কোন কথা বলতে পারছে না। এ দৃশ্য দেখে তো মা ভয় পেয়ে গেল। চিৎকার চেচামেচি করতে লাগল। বাড়ির লোকজন ছুটে চলে আসল।
এদিকে আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে শিহাবদের বাড়িতে গেলাম তাকে ডাক দেয়ার জন্য। গিয়ে দেখি তার এই অবস্থা। তখন সে আমাকে দেখে হাউ মাউ করে কিছু বলার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট ভাষায় সে তখন রাতে ঘটনাটা আমাকে খুলে বলল।
আমি তখন তার আব্বাকে বললাম, চাচা শিহাব ভয় পেয়েছে। হুজুর ডেকে পড়াপানি খাওয়ান। আর আজ তার স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি চলে গেলাম। এই বলে আমি তখন তাদের বাড়ি থেকে চলে আসলাম।
আমি আবার বিকাল বেলা শিহাবদের বাড়িতে গেলাম। তখন গিয়ে দেখি শিহাব আগের মতো বোবা হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারছে না।
শিহাবের বাবা আমাকে বললো, তুমি যতক্ষণ ছিলে ততক্ষণ ও স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছে। তুমি যাওয়ার পরই সে আগের মতো অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।
এরপর থেকেই আমি যতবারই শিহাবদের বাড়িতে গেছি সে আমাকে দেখে বড় বড় চোখ করে তাকাত। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন কবিরাজ দেখানো হল। কিন্তু কোন উন্নতি হয় নি।
প্রায় রাতেই চিৎকার দিয়ে সজাগ হয়ে শিহাব বলতে থাকে। ঐ যে কে যেন আমাকে ডাকছে। শিহাবের চিৎকার শুনে তার বাবা মা দৌঁড়ে আসত কিন্তু কাউকে খুঁজে পেত না।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঐ মন্দিরের কাছে দৌঁড়ে যেত শিহাব। তখন বাড়ির সবাই মিলে তাকে ধরে আনত।
এভাবে চলল অনেকদিন।
একদিন আমি গেলাম শিহাবদের বাড়িতে তখন শিহাব আমাকে অস্পষ্ট ভাষায় বললো, দেখ সুজন আমাকে ঐ ভিটা থেকে কে যেন ডাকছে। ওরা আমাকে নিয়ে যাবে। তুই সাবধানে থাকিস!
শিহাবের মুখে এ কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আর ভাবলাম, মাছটা যদি আমি নিতাম তাহলে হয়তো এ ঘটনাটা আমার সাথে হতো। তাই সেদিনের পর থেকে শিহাবদের বাড়িতে বেশি যাইনি এবং রাতের বেলা বাড়ি থেকে বের হয়নি।
শিহাবের বাবা এবার ভাবল, এভাবে ছেলেকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখব। ভাল কবিরাজ ডেকে আনতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। একদিন তিনি এক কবিরাজকে ঢেকে আনলেন।
কবিরাজ তাকে দেখে বললো, আপনার ছেলেকে জিনে ধরেছে। তার উপর দুষ্টু জিন ভর করেছে। তাকে সরাতে হবে।
শিহাবের বাবা বললো, আমরা এগুলো বুঝিনা। যেভাবে পাড়–ন আপনি আমার ছেলেকে বাঁচান।
– আচ্ছা ঠিক আছে চিন্তা করবেন না।
কবিরাজ কিছু মন্ত্র পড়ে শিহাবের উপর ভর করে জিন হাজির করল।
কবিরাজ এবার জিনকে বললো, কে তুমি? এই বাচ্চা ছেলেটার উপর ভর করে আছ?
জিন অদৃশ্য থেকে বলছে, আমি করিমন জিন।
– কি চাও তুমি?
– আমরা জমজ দুই বোন। নসিমন ও করিমন। সবসময় ঐ শ্বশানের কাছে আমরা খেলাধূলা করি। ঐদিন রাতে সে আমাদের উপর লাথি মারে। তাই ওকে আমরা ধরেছি।
– তোমরাতো অদৃশ্য হয়ে থাক। তোমাদেরকেতো কেউ দেখে না। তাই ও না দেখে তোমাদেরকে লাথি মেরেছে। তোমরা চলে যাও।
– না আমরা যাব না। ওকে ছাড়ব না। ওরে ভাল লাগছে। ওরে নিয়েই যাব।
করিবাজ অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কোনক্রমেই জিনদেরকে তার কাছ থেকে সরাতে পারেনি। তাই ব্যর্থ হয়ে কবিরাজ চলে গেল।
দিন যত যায় শিহাবের অবস্থা ততই অবনতি হয়। পরে আবার ঐ কবিরাজকে ডেকে আনল। কবিরাজ আবার জিন হাজির করল।
জিন বললো, তোর রুগীকে মেরে ফেলব।
কবিরাজ বললো, না মারবি না। তোর যা লাগে তাই দিব। কি চাস তুই? তবুও তুই ওকে ছেড়ে যা।
– ঠিক আছে একটা খাসি ও এক মন চাউল দিবি।
– ঠিক আছে তাই দিব। কোথায় দিব?
– ঐ শ্বশানঘাটে।
– ঠিক আছে।
পরের দিন শিহাবের বাবা তার নামে একটা খাসি ও এক মন চাউল দিল। এর পর থেকে সাতদিন শিহাব খুব ভাল ছিল। সবার সাথে খেলাধূলা করছে। কথাবার্তা বলছে। কোন সমস্যাবোধ করেনি।
সাতদিন পর হঠাৎ সন্ধ্যার সময় শিহাবের আব্বা আসল আমাদের বাড়িতে। আমাকে ওনি বললেন, সুজন শিহাবতো আবার আগের মতো হয়ে গেছে। শুধু তোমাকে খুঁজে।
আমি তখন তাদের বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি ঐ করিবাজ শিহাবকে নিয়ে উঠানে বসে আছে। বাড়ির সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে।
আমাকে দেখে তখন শিহাব বললো, সুজন আমিতো যাইতেছি গা তুই ভালমতো থাকিস।
আমি বললাম, কি বলিস এগুলো। তুই ঘুমা। আমি চলি। আবার কাল আসব।
– না যাবি না। আমাকে আর পাবিনা। আমি সত্যিই চলে যাব।
কিন্তু তখন আমি শিহাবের কোন কথাই শুনিনি। আমি বাড়িতে চলে আসলাম। আসার দুইঘন্টা পরই শুনতে পেলাম শিহাব মারা গেছে।
শিহাবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাত ছুটে চলে যাই তাদের বাড়িতে। তার মৃত্যুতে আমি খুবই ব্যথা পাই। তারপর তার জানাযায় অংশগ্রহণ করি। তাকে মাটি দেওয়া হয়। রাতে আর আমার ঘুম আসে না। শুধু তার কথা মনে পড়ে। এমন একটি অদ্ভুদ ঘটনার মধ্যে সে মারা গেল। তাও আবার আমার সাথেই ঘটনাটি ঘটে।
শিহাবের মৃত্যুর এক মাস পর একদিন আমার এক কাকা বলল, চল ঘুরে আসি। ঘুরতে ঘুরতে আমরা শিহাবের কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এর পাশেই ছিল বাঁশ ঝাড়। তখন ছিল রাত প্রায় দশটা। হঠাৎ করে ঐ বাঁশ ঝাড় থেকে একটি আওয়াজ আসল। সুজন কৈ যাস?
আমি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। একটু খেয়াল করে দেখলাম এ যেন শিহাবের কণ্ঠ! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। আবার আমাকে ঐ বাঁশ ঝাড় থেকে বলছে, সুজন কৈ যাস? এ দিকে আয়।
আমি ও কাকা আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম। কিন্তু কাউকে না পাওয়ায় আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর পিছনে না থাকিয়ে তাড়াতাড়ি আমরা সেখান থেকে চলে আসলাম।
শীতের রাতে একদিন বাজার থেকে বাড়ি ফিরছি। বাড়িতে আসার পূর্বে একটি খালি পতিত জমি আছে। সেখানে আসার সাথে সাথে আমি সামনের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম শিহাবের মতো অবিকল এক ব্যক্তি হেঁটে আসছে। পরনে সাদা ধূতি। আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম। এ কি করে সম্ভব! শিহাবতো মারা গেছে। সে এখানে আসল কি করে! আমি আরেকটু সামনে গিয়ে তাকে ষ্পষ্ট দেখে শিহাব বলে ডাক দিলাম। ডাক দেয়ার সাথে সাথে সে ওধাও হয়ে গেল। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভয়ে দ্রুত সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। এবার পিছন দিক থেকে ডাকছে, সুজন কৈ যাস! চলে আয় আমার কাছে।
আমি ঘাড় ফিরে পিছনে তাকালাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। ভয়ে আমার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। প্রচ- শীতের মধ্যে আমি ঘেমে গেলাম। আবার সামনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। আমি দ্রুত হাঁটছি কিন্তু রাস্তা শেষ হচ্ছে না। আবার পিছন থেকে শিহাব আমাকে ডাকছে। এবার আর আমি পেছন ফিরে তাকালাম না। একবার দুবার তিনবার ডাকার পরও আমি পিছনে তাকালাম না। আমি চোখ বন্ধ করে দৌঁড়াচ্ছি। তখন শিহাব আমার সামনে চলে আসল। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি শিহাব সাদা ধূতি পড়ে আমার সামনে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে রইল। এ দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

রচনাকাল: ২১/১০/২০১৪খ্রি:

রহস্যময় পুকুর ও বটগাছ


জুনায়েদদের বাড়ির পাশেই ছিল পুরানো একটি পুকুর। পুকুর পাড়েই ছিল বিশাল একটি বড় বট গাছ। বট গাছটির ডালপালা এতই বিশাল ছিল যে সবগুলো ডালপালাই পুকুরে গিয়ে পড়েছে। বট গাছের ডালপালার কারণে সূর্যের আলো কমই পড়ত পুকুরে। সারাদিনই অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব থাকতো এই পুকুরে । এখন এই জায়গাটা এতই ভূতুরে হয়েছে যে দিনের বেলাও এখান দিয়ে মানুষজন যেতে ভয় পায়। আর সন্ধ্যার পরতো এখান দিয়ে লোকজন একেবারেই যায় না। প্রায় প্রতিদিনই এখানে এসে কোন না কোন লোক ভয়ের শিকার হয়। এই পুকুরে এক সময় মাছ চাষ করতো কিন্তু এখন আর কেউ মাছ চাষ করে না। ইতোমধ্যে এই পুকুরকে নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে। কোন ঘটনারই কোন সমাধান এই এলাকার মানুষ দিতে পারেনি। সবার কাছে এই পুকুর ও বটগাছটি রহস্যময় হয়ে রয়ে গেল।
আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। জুনায়েদের বয়স তখন দশ বছর। তখন বট গাছটা এত বড় ছিল না। তার ডালপালাগুলো আরো ছোট ছিল। কিন্তু বটগাছের শিকরগুলো পুকুরেই গিয়ে পড়েছে। এই পুকুরটা ছিল জুনায়েদদের বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে। অনেকেই দিনের বেলা তখন এই পুকুরে মাছ ধরত। সেই মোতাবেক জুনায়েদ কোন এক বিকাল বেলা তার চাচাতো ভাই মিলনের সাথে এই পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে গেল। দুজনে অনেক্ষণ মাছ ধরল। এক সময় সন্ধ্যা হয়ে গেল।
জুনায়েদ বললো, চল মিলন এবার চলে যাই।
মিলন বললো, তুই যা আমি একটু পরে আসতেছি।
– ঠিক আছে বলেই জুনায়েদ চলে আসল।
বাসায় এসে যথারীতি পড়তে লাগল।
এদিকে এশার আযান হয়ে গেল। এখনও মিলন বাসায় ফিরেনি। মিলনের মা খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। সেতো এতক্ষণ বাহিরে থাকে না। সেই বিকাল বেলা মাছ ধরতে পুকুরে গেল জুনায়েদের সাথে। মিলনের মা জুনায়েদের সাথে দেখা করে বললো, জুনায়েদ তোমার সাথেতো মিলন মাছ ধরতে গেল। সেতো এখনও আসে নাই। সে কোথায় তুমি জান?
জুনায়েদ আশ্চার্য হয়ে বললো, কি বলেন কাকী! জুনায়েদ এখনও ফিরে নাই। আমি আর সেতো এক সাথেই মাছ ধরছি। সেতো বলল, একটু পরে চলে আসবে তাই আমি চলে আসলাম। চলেনতো দেখি তাকে দেখে আসি। বাড়ির সবাই কুপি হাতে নিয়ে ঐ পুকুর পাড়ে চলে আসল মিলনকে খুজার জন্য। জুনায়েদের দেখানো মতে মিলন যে জায়গায় বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিল সেই জায়গায় কুপি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই কুপিটি নিবে যায়। তাই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার কুপি ধরিয়ে ঐ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু এবারও কুপিটি নিভে যাচ্ছে। এভাবে আট থেকে দশ বার চেষ্টা করেও ঐ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। সবাই মিলন মিলন বলে ডাকছে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। পরিশেষে আশে পাশে সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে মিলনকে কোথাও না পেয়ে নিরাশ হয়ে সবাই বাড়িতে ফিরে আসল। মসজিদের মাইক দিয়ে মাইকিং করে দেয়া হল মিলন নামের দশ/এগার বছরের একটি ছেলে হারানো গিয়েছে। কেউ পেয়ে থাকলে তাকে বাড়ীতে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হল।
সারারাত গেল। সকাল হলো। বাড়িতে কান্নার রুল পড়ে গেল। মিলনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দল বেধে সবাই ঐ পুকুর পাড়ে গেল। এবার পুকুরের ঐ বটগাছের গোড়ায় গিয়ে সবাই আতকে উঠল। একি দেখছে তারা! বটগাছের শিকড়ের নিচে মিলনের মাথা পড়ে আছে। বটগাছের শিকড়টা ছিল পানির মধ্যে। সেই মোতাবেক তার মাথাটা পানির মধ্যেই ডুবানো ছিল। আর তার পুরো দেহ কোথায় খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা বেয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তে লাল হয়ে গেল পুকুরের পানি। তারপর গ্রামের কয়েকজন মিলে মিলনের মাথাটা পানি থেকে উঠাল। মাথা উঠিয়ে দেখল চোখগুলো উপড়ানো। নাকে মুখে ভয়ংকর কামড়ের দাগ। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবার মধ্যে ভয় এসে গেল। এবার সবাই ভাবতে লাগল তার দেহ কোথায় থাকতে পারে। যেহেতু এখানেই তার মাথা পাওয়া গেছে। দেহও এখানেই পাওয়া যাবে। পুকুরে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু সবার মাঝে কেমন একটা ভয় কাজ করছে তাই কেউ পুকুরে নামতে রাজি হয়নি। পরে জাল ফেলে খুঁজার সিদ্ধান্ত হলো।
বিভিন্ন পাড় থেকে একের পর এক জাল ফেলতে লাগলো পুকুরে। প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টার পরে এক সময় কিছু হাড্ডি উঠে আসে জালে। কিন্তু মিলনের দেহ কোথাও খুঁেজ পাওয়া গেল না। মিলনের দেহের কোন হদিস না পেয়ে পরিশেষে সবাই বুঝে নিল এটা হয়তো মাছে খেয়ে নিয়েছে। তাই হাড্ডি পাওয়া গিয়েছে। কারণ এই পুকুরে এক সময় মাগুর মাছ চাষ করা হতো। সেই মাছগুলোর মধ্যে হয়তো কিছু পুরানো ভয়ংকর মাছ এখনও আছে সেই মাছগুলো হয়তো খেয়ে ফেলছে। অনেক চেষ্টা করেও মিলনের দেহ খুঁজে না পেয়ে সেই হাড্ডি ও মাথা কাফন করে কবর দেয়া হল।
মিলনের মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। রাত তখন প্রায় ১২টা বাজে। মিলনের মা ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করল।
হঠাৎ মিলনের মায়ের ঘুম ভাঙ্গল। এতো রাতে কে আসবে। তাই মনে ভয় এসে গেল। স্বামীকে ডাকবে কিনা ভাবছে। এমন সময় আবার নক করল। এবার মিলনের মা বললো, কে?
বাহির থেকে আওয়াজ এল মা, আমি মিলন। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আমি ভাত খাব।
এ কথা শুনে মিলনের মা আতকে উঠল। মিলন! তুই কোথা থেকে এলি বাবা?
মিলনের মায়ের কথা শুনে তার স্বামী ঘুম থেকে উঠে গেল। কি হয়েছে? তুমি কার সাথে কথা বলছ?
– মিলনের সাথে।
– মিলনের সাথে! সে আবার কোথা থেকে আসবে। সেতো মরে গেছে।
– সত্যি বলছি আমার ছেলে আমাকে ডাক দিয়েছে দরজা খোলার জন্য। ছেলের খুব ক্ষিধে ভাত খাবে।
– তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি? মরা মানুষ আবার ডাক দিতে পারে নাকি?
– না আমি পাগল হয়নি। আমি স্পষ্ট শুনলাম মিলন আমাকে ডাক দিল। তুমি দরজা খুল। দেখ মিলন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
– তুমি ভুল শুনছ।
– আমি ভুল শুনিনি। আমি দরজা খুলে দেখব।
– তুমি এত রাতে দরজা খুলবে না।
– আমি দরজা খুলবই।
দু’জনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল তর্কাতর্কি। মিলনের মা তার স্বামীকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে মিলন তাকে ডাক দিয়েছে। তাই জোরাজোরির এক পর্যায়ে স্বামীর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মিলনের মা দরজা খুলল। দরজা খুলেই দেখতে পেল কাপনের কাপড় পড়া অবস্থায় শূন্যে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভয়ংকর লোক। চোখগুলো থেকে রক্ত ঝরছে। এ দৃশ্য দেখে মিলনের মা ভয়ে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। তার স্বামী পিছনে পিছনে আসল কিন্তু এসসব কিছুই দেখল না। তারপর বাড়ির আশে পাশের লোকজন চলে আসে। মিলনের মাকে পানি দিল। ঝারফুক করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
সকাল বেলা জ্ঞান ফিরল ঠিকই কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় আর তাকে পাওয়া যায়নি। অর্থ্যাৎ সে পাগল হয়ে গেছে। সে এখন মিলন মিলন বলে চিৎকার করছে। দীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত পাগল অবস্থায় আজও মিলনকে খুঁজে বেড়ায় সেই পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে। কখনো রাতের অন্ধকারে একা একা ছুটে চলে যায় পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে। আজও সেই মিলনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি গ্রামবাসী। তার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে রহস্যময় এই পুকুর পাড়ে।
গত দু’বছর পূর্বেও ঘটে গেল এই পুকুরের পাড়ে বটগাছে এক ঘটনা। কোথা থেকে এক মহিলা এখানে এসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সকাল বেলা লোকজন এসে দেখে ঐ মহিলা জিহ্বা বের করে রশিতে ঝুলে আছে। কেউ ভয়ে এ মহিলার লাশ ছুতে যায়নি। এমনকি কারো সাহস হচ্ছে না তার লাশ নামাতে। গ্রামবাসী এলাকার মেম্বার ও চেয়ারম্যানকে খবর দেয়। তারা এসে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে এ লাশ নিয়ে যায়। সেই থেকে এখানে আরো আতঙ্ক বেড়ে যায়।
এক সময় গ্রামবাসীরা সবাই মিলে এই পুকুর ভরাট ও বটগাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু যেদিন রাতে এ সিদ্ধান্ত নেই সেদিন রাতেই সবাইকে একই স্বপ্ন দেখাল যে, কেউ যদি এই পুকুর ও বটগাছ ধ্বংস করতে চায় তাহলে তার বংশ ধ্বংশ করে হয়ে যাবে। তাই আর কেউ সাহস করে বটগাছ কাটতে যায় না। পুকুর মাটি দিয়ে ভরাট করতে যায় না।
কিছুদিন পূর্বে জুনায়েদ চাকুরী পায় পার্শ্ববর্তী এক শোয়েটার ফেক্টরীতে। প্রথম সপ্তাহ দিনের বেলা ডিউটি পড়ে। প্রতিদিন সকাল ৬ টায় যেত ফিরত দুপুর দুটো। প্রতি সপ্তাহে ডিউটি পরিবর্তন হওয়ায় আজ তার ডিউটি হলো দুপুর দুটো থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত। যথারীতি প্রতিদিনের মতো আজও ডিউটিতে আসল। ছুটি হলো রাত ১০:০০ টায়। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বের হতে সময় লাগল আরো আধা ঘন্টা। অর্থ্যাৎ রাত সাড়ে দশটার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বেশি রাত্র হওয়ায় রাস্তায় কোন রিক্সা নেই। আশে পাশে কোন লোকজনও নেই। তাদের বাড়ি থেকে শোয়েটার ফেক্টরীটা প্রায় দুই কিলোমিটা দূরে। পুরো রাস্তায় হেঁটে আসতে হয়। তাদের গ্রাম থেকে একমাত্র সেই এখানে চাকুরী করে। তাই তার কোন সঙ্গী নেই। একা একা এত রাতে বাড়ি ফিরতে তার কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। কিছুটা ভয় কাজ করছে তার মনে। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জুনায়েদ হাঁটতে হাঁটতে সেই পুকুর পাড়ের বটগাছের কাছাকাছি চলে আসল। তখন বাজে প্রায় রাত সাড়ে এগারটা। শোয়েটার ফেক্টরী থেকে জুনায়েদদের বাড়িতে যাওয়ার এই একমাত্র একটি রাস্তা। এর কোন বিকল্প রাস্তা নেই। এই বটগাছ ও পুকুর কসিং করেই তাদের বাড়িতে আসতে হয়। এছাড়া কোন উপায় নেই। বটগাছের কাছাকাছি আসতেই তার পূর্বের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আর অমনি তার মধ্যে ভয় কাজ করছে। সে যতই সামনে আসছে ততই ভয় পাচ্ছে। বটগাছের কাছাকাছি এসেই দেখতে পেল চারজন লোক বসে একটি লাশ কামড়িয়ে খাচ্ছে। আর একজন চোখ বড় বড় করে বলছে, এই ছেলে এদিকে আসবি না। তোকেও খেয়ে ফেলব।
এ দৃশ্য দেখে জুনায়েদ চিৎকার দিয়ে দৌঁড় দিল। এক দৌঁড়ে বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ে গেল। বাড়ির আশে পাশের লোকজন তার চিৎকার শুনে চলে আসল। সবার কাছে জুনায়েদ ঘটনাটি বর্ণনা করল। সবাই বিশ্বাস করলেও কেউ সাহস করে সত্যতা যাচাই করার জন্য যায়নি।
পরদিন সকাল বেলা প্রতিবেশীরা জুনায়েদের সেই ঘটনা দেখার জন্য দলবেঁধে সেই বটগাছের নিচে গেল কিন্তু এ ধরনের কোন আলামতই দেখতে পেল না। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। কিন্তু এর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি কেউ।

রচনাকাল: ২৩/০১/২০১৫খ্রি:

জিনের আছর


রাত বারটা।
চারদিকে নীরব নিস্তদ্ধতা। কোথাও কেউ নেই। এ মুহূর্তে গ্রামের কেউ এখন জেগে নেই। এমন সময় রুমা একা ঘর থেকে বের হলো প্রস্রাব করার জন্য। স্বামী শিহান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আছে। চারপাশ থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শুনা যাচ্ছে। রুমা যখন বাথরুমে গিয়ে বসল ঠিক তখনই উপর থেকে একটা খচখচ আওয়াজ হলো। রুমা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
– কে, কে ওখানে।
কোন শব্দ নেই। আবার রুমা প্রস্রাব করতে বসল। আবার খচখচ আওয়াজ আসলো। তখন আবার বললো, কে, কে ওখানে।
এবারও কোন শব্দ নেই। রুমা এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। প্রস্রাব শেষে দাঁড়িয়ে গেল। এবার সামনের দিকে পা বাড়াল। সামনের দিকে তাকিয়েই দেখে সাদা ধূতি পড়া এক বয়স্ক লোক। দাঁতগুলো ইয়া বড় বড়। আঙ্গুলের নখগুলো বেশ বড়। লোকটা শুন্যে ভাসছে। পা দুটো মাটি থেকে উপরে। ভয়ংকর চেহারার এই লোকটি রুমার দিকে এগিয়ে আসছে। রুমা যত সামনে যাচ্ছে ভয়ংকর লোকটা ততই সামনে আসছে। লোকটা একসময় রুমার কাছাকাছি এসে একটা অট্টহাসি দিল। তারপর রুমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, তুকে আমি এখন খেয়ে ফেলব।
এই কথা শুনে এবং ভয়ংকর লোকটাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল রুমা। তার চিৎকার শুনে শিহান ঘুম থেকে সজাগ হয়ে গেলো। চোখ মেলে শিহান দেখে রুমা বিছানায় নেই। দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে দেখে বাথরুমের কাছে রুমা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। ইতোমধ্যে বাড়ির অন্যান্য লোকজনও সজাগ হয়ে গেল। কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসল। রুমার শ্বাশুরি বিলকিস বেগম ছুটে আসলেন। শিহান লাইট নিয়ে রুমার কাছে গিয়ে দ্রুত তাকে কুলে নিল। রুমার মুখ থেকে লালা পড়ছে আর গোংগাচ্ছে। কিন্তু কথা বলছে না। তারপর সবাই ধরাধরি করে রুমাকে ঘরে নিয়ে আসল।
পাশের বাড়ি থেকে রুমার চাচা শ্বশুর ছুটে আসলেন। শিহান বললেন, চাচা দেখেন রুমার কি হয়েছে। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল।
চাচা দোয়া কলাম পড়ে রুমাকে ঝারফুঁক দিলেন। শ্বাশুরি মাথায় পানি দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। কিন্তু কোন কথা বলছে না।
চৌয়ালা গ্রামের রমিজ উদ্দিনের মেয়ে রুমা। খুবই শান্ত ছিল। এসএসসি পাশ করার পর পাশের গ্রামের মোতালিব মাস্টারের ছেলের সাথে তার বিয়ে দেন কয়েক মাস আগে। এমন লক্ষ্মী বউ পেয়ে মোতালিব মাস্টার ও বিলকিস বেগম খুব খুশী হয়েছেন। পাড়া প্রতিবেশীরা তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ। মোতালিব মাস্টারের গ্রামটি ছিল ঘন গাছগাছলায় ভরপুর। বাড়ির দু’পাশে দুটো চৌচালা টিনশীট ঘর। পশ্চিম পার্শ্বে বিশাল বড় বাঁশঝাড়। এর পাশেই একটি ঘর। বাঁশ ঝাড়ের ভেতর রমিজ উদ্দিনের মা বাবার কবর। দক্ষিণ পাশে কলার বাগান। এর পাশে আরেকটি ঘর। উত্তর পাশে বাথরুম। এর পাশেই কাঠবাগান। পশ্চিম পাশে তার বড় ভাইয়ের বাড়ি। দক্ষিণ ভিটার ঘরে শিহান তার বউকে নিয়ে থাকে।
পরদিন সন্ধ্যায় শিহান রুমার ঘরে গেল। শিহান রুমার শরীরে স্পর্শ করতেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল। কেমন জানি হয়ে গেলো রুমা। স্বামীকে বলছে, এই ব্যাটা তোর কত বড় সাহস আমার গায়ে হাত দিচ্ছিস। তুকে এক থাপ্পর মেরে বত্রিশ দাঁত ফেলে দিব। যা আমার ঘর থেকে চলে যা। আমি এখন আমার স্বামীর সাথে রাত কাটাব।
একথা শুনে শিহান আশ্চার্য হয়ে বললো, এসব কি বলছ তুমি, কে তোমার স্বামী?
রুমা অট্টহাসি হেসে বললো, তুকে বলব কেন?
– আমি তোমার স্বামী শিহান।
– কে শিহান? তাকে আমি চিনি না। হি হি হি।
তারপর শিহান বুঝতে পারল তার স্ত্রীকে জিনে ধরেছে। এভাবে কয়েকদিন চলল। দিন দিন রুমার অস্বাভাবিক আচরণে পাড়া প্রতিবেশী অতিষ্ট হয়ে গেলো। শ্বশুর শ্বাশুরিকে তুই তোকারি করে কথা বলে। স্বামীকে তার সাথে থাকতে দেয় না। প্রতিবেশীদেরকে গাল মন্দ করে। এমনকি অনেকের গায়ে থাপ্পরও মারে। খাওয়া দাওয়ায় তেমন মনযোগ নেই। গোসল ঠিক মতো করে না। দিন দিন যেন তার শরীরে শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল কে জানে। নতুন বউ এমন আচরণ করে তা কি করে তার শ্বশুর শ্বাশুরি সৈহ্য করবে? তার আবোল তাবুল কথায় বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। নিশ্চয় কোন অশরীরী কিছু ভর করেছে নাহলে এমন করবে কেন? যে বউ কোনদিন বাড়ীর কারো সাথে কোন কটু কথা বলেনি সে কিনা এখন বকাঝকা করে। মারধর করে। তুই তোকারি করে কথা বলে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টাপাল্টা জবাব দেয়। প্রতিবেশীরা কানাকানি করছে নিশ্চয় কোন জিনে ধরেছে। তা না হলে এমন করবে কেন?
রুমার চাচা শ্বশুর বেশ কয়েকদিন ঝারফুঁক করল কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে না। দিন দিন রুমার অত্যাচার বেড়েই চলছে। তার অত্যাচার সৈহ্য করতে না পেরে শিহান তাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।
রুমার বাবা রমিজ উদ্দিন পাশের গ্রামের এক মাওলানাকে ডেকে আনলেন। তিনি জিন-ভূত তাড়াতে পারেন। তার অনেক নাম ডাক। ইতোপূর্বে অনেকেরই জিন-ভূত তাড়িয়ে অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। মাওলানা সাহেব রমিজ উদ্দিনের বাড়িতে এসেই বললেন, আগে রুগীকে দেখান। দেখি কি হয়েছে। মাওলানা সাহেব রুমাকে দেখার জন্য ঘরে গেলেন। রুমা মাওলানা সাহেবকে দেখে বললেন, এই তুই আসছিস কেন? তোকে কে বলছে আসতে?
মাওলানা সাহেব বললেন, আমি তোর যম। তুই তাড়াতাড়ি এই রুগীকে ছেড়ে চলে যা। তা না হলে তুকে আজ মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলব।
রুমা হেসে উঠল, পারবি না।
আচ্ছা দেখা যাক। বলেই মাওলানা সাহেব বাইরে আসলেন। তিনি বুঝতে পারছেন রুমাকে কোন জিনে ধরেছে। এটা বড্ড দুষ্টু জিন। যাকে একবার ধরে তাকে একেবারে শেষ করে ছাড়ে।
মাওলানার আগমনে রুমার আচরণ আরো অস্বাভাবিক হয়ে গেলো। ঘরের ভেতর ছুটাছুটি করতে লাগল। আর জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, ঐ হুজুর বেটাকে বল, এ বাড়ি থেকে চলে যেতে। তা না হলে সবাইকে মেরে ফেলব।
রমিজ উদ্দিন ভয় পেয়ে গেল। মাওলানা আশ্বাস দিলেন ভয়ের কিছু কারণ নেই। যতবড় দুষ্টু জিনই তাকে ভর করুক না কেন সে আজ তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে নতুবা এখানেই তার দাফন হবে। তবে রুগীকে ঘর থেকে বের হতে দিবেন না। তাকে ঘরের মধ্যে দরজা দিয়ে আটকিয়ে রাখুন।
মাওলানার কথামত রুমাকে ঘরের মধ্যে বন্ধি করা হলো।
মাওলানা সাহেব উঠানে একটা গোল দাগ দিলেন। এর মধ্যে কোন দর্শনার্থীকে ঢুকতে দিবেন না। তারপর রুমাকে এই দাগের ভেতর বসানো হলো। দুজন দুপাশ থেকে তাকে ধরে আছে। পাড়ার সমস্ত মানুষ রুমার জিন তাড়ানো দৃশ্য দেখার জন্য হাজির হয়ে গেল। সবাই দাগের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেল।
রুমা চিৎকার চেচামেচি করছে, আমাকে ছেঁড়ে দে। তা না হলে তোদের সবার ক্ষতি হবে।
মাওলানা সাহেব একটি ছুড়া পড়ে রুমার বুকের উপর ফু দিলেন। তারপর রুমার হাত ধরতে যাবেন এমন সময় রুমা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল, খবরদার আমার হাত ধরবি না।
কিন্তু মাওনা সাহেব বড়ই সেয়ানা। এইসব দুষ্টু জিনকে তিনি ভয় পান না। তাই তার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রুমার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল চাপ দিয়ে ধরলেন। বল তুই কে?
– ছেড়ে দে আমাকে।
– না তোকে ছাড়বনা। বল তুই কে?
– বলব না।
– বলতে তোকে হবেই। তা না হলে আজ তোকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলব।
– না না আমাকে মারবি না। আমি বলছি।
– তাড়াতাড়ি বল।
– বলছি। আমি সেন্টু।
– মাওলানা বুঝতে পারছে সে মিথ্যে বলছে, তাই আবার বললো, না তুই মিথ্যে বলছিস। সত্যি করে বল তুই কে?
– সত্যি বলছি।
– না তুই মিথ্যে বলছিস। এই কথা বলেই রুমার আঙ্গুল জোরে চাপ দিয়ে ধরলেন।
– আমাকে মারবি না। বলছি। আমি হরমুজ।
– এবার বল তুই কোথায় থাকিস?
– উত্তর পাশে কাঠ বাগানে।
– এখানে কেন এলি?
– আমি বাগান থেকে এখান দিয়েই প্রতিদিন রাত বারটার সময় খাবারের সন্ধ্যানে দক্ষিণের দিকে যাই। যথারীতি আজও যাচ্ছিলাম। এই রাস্তায় তাদের বাথরুম। এমন সময় দেখি সে বাথরুমে ঢুকছে।
– কিন্তু তোর সমস্যা কি ছিলো? কেন এই নববধুকে তুই ভর করলি?
– তাকে দেখে আমার পছন্দ হয়ে গেল। তাই ওর উপর ভর করলাম।
– তোর সাথে আর কে কে আছে?
– আমার আরো পাঁচ বন্ধু আছে। তারা সবাই এখানেই থাকে।
– তাহলেতো তোদের সবাইকে বোতলে ভরে মারতে হবে।
– এটা করবি না। আমরা এখান থেকে চলে যাব।
– তোরা কথায় কথায় মিথ্যে বলিস। তোদের কথার কাজে কোন মিল নেই। আজ তোকে সহ তোর পাঁচ বন্ধুকে পুড়িয়ে মারব।
এবার সত্যি বলছি আর কোনদিন এই বাড়ির ত্রিসীমানায় পা দিব না। আজকের মতো আমাকে মাফ করে দে।
– বলেই রুমা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।
– কাঁদলে কোন লাভ হবে না। বল কখন যাবি।
– এখনই চলে যাব।
– তোর পাঁচ বন্ধুকে বল চলে যেতে।
– এখনই বলছি। তবে আমার আঙ্গুল ছেড়ে দে। তা না হলে কিভাবে যাব?
– আমার সাথে চালাকি করছ? বলেই মাওলানা সাহেব আরো জোরে আঙ্গুল চেপে ধরলেন।
রুমা চেচামেচি করছে। তোর পায়ে ধরি। আমাকে ছেড়ে দে। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
– ঠিক আছে তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু তুই যে চলে যাবি আমরা কিভাবে বুঝব? কি চিহ্ন রেখে যাবি।
– ঐ যে কড়ই গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে দিয়ে যাব।
– ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম। বলেই রুমার হাত ছেড়ে দিল মাওলানা সাহেব। আর অমনি রুমা ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এদিক দিয়ে ঐ পাশ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে পড়ে গেল। আর শো শো একটা আওয়াজ হলো।
রুমার মাথায় পানি দেয়া হল। এবার রুমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো। শুয়া থেকে উঠে বসল। চারদিকে তাকিয়ে এত লোক দেখে বললো, আমি এখানে কেন? এত লোক কেন এখানে?
কেউ তার উত্তর না দিয়ে তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর মাওলানা সাহেব তাকে পড়া পানি ও বেশ কয়েকটি তাবিজ দিয়ে গেলেন। এগুলো যেন সব সময় তার সাথে রাখেন সেকথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
তারপর থেকে রুমা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে লাগল। এক সময় সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে গেলো। চলে আসলো স্বামীর বাড়িতে।

রচনাকাল: ১০ মার্চ ২০১৫ খ্রি: