ট্যাগ আর্কাইভঃ মামুনের ধারাবাহিক গল্প

তিনি একজন মফঃস্বল সাংবাদিক : পর্ব-১


ফজরের আযান হয়ে গেছে। চারতলা বাসাকে ঘিরে থাকা গাছগুলির ডালে ডালে প্রভাতি পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। নিচতলার ‘কোলাপ্স্যাবল গেট’ টানার শব্দে রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটির তারে বসা তিনটি পাখির একটি ভয়ে উড়ে গেলো। এভাবেই তিনি বের হলেন। বাইরে এখন আলোআঁধারির খেলা। দৃশ্যমান কোমল আলোয় মনটা ভরে উঠলো তাঁর। কালো পিচের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে, ফুরফুরে বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেলো। ভালোলাগাময় এক আবেশে মুগ্ধ দিনের শুরুটা আজ অনেক বছর পরে তিনি অনুভব করছেন। কেমন পবিত্র পবিত্র ভাব! যদিও তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী একটা কাজ করতে বের হয়েছেন। ধান্ধা করতে বের হয়েছেন তিনি।

মহাসড়কের এক তিনরাস্তার মাথায় যাবেন । ওখানে ট্রাফিক ইন্সপেক্টরগণ দায়িত্ব পালন করে। সকাল ছ’টার সময়ে তাদের ডিউটি শুরু হলেও একটু আগেই যেতে চাচ্ছেন। অভিযোগ আছে, প্রতিদিন ওখানে ট্রাফিক পুলিশেরা দিনের শুরুতেই যানবাহন থেকে টাকা তোলে। অন্যভাবে বলতে গেলে চাঁদাবাজির কথা বলা যায়। যদিও চাঁদাবাজি শব্দটা পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে যায় না। আজকাল কার সাথেই বা কোনটা যায়? ডাক্তার সেবামূলক মনোভাবের বাইরে গিয়ে টাকার ক্ষাক্কস হয়ে পড়েছে। ক্লিনিকগুলি মানুষকে শুষে নেয়া এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। যার যার পেশার সাথে কারোই কোনো মিল নেই। সবাই নিজের থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্য এক নিজেকে দেখায় ব্যস্ত।

একটা কালো বিড়াল অন্ধকার থেকে সাই করে ওনার পথ কেটে চলে গেলো। যাবার আগে তাকে চমকে দিয়ে হাঁটার গতিকে শ্লথ করে দিয়ে যায়। সেই সাথে এলোমেলো ভাবনা চিন্তাও মুহুর্তের তরে থেমে গেলো। ভাবেন, ভাবনা চিন্তারাও কি চলমান? না হলে নিজের থেমে যাবার সাথে সাথে সেগুলোও কেন থেমে গেলো? এসময় নিজের মন তাকে এক বেয়ারা প্রশ্ন করে বসে,
– তুমি যা করছো সেটা কি তোমার সাথে যায়?
– কি করছি আমি?

মনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মনকে ফিরতি প্রশ্ন করেই আবার হাঁটা শুরু করেন। সব সময় মনের সব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও দিতে হয় না। তাতে সমস্যা আছে। মফঃস্বল সাংবাদিকদের মনকে কঠিনভাবে বেঁধে রাখতে হয়।

ঠিক ধরেছেন। তিনি একজন মফঃস্বল সাংবাদিক। চলেছেন ট্রাফিকদের চাঁদাবাজির বিষয়টি হাতেনাতে ধরবেন বলে। কেমন এলোমেলো লাগছে তাই না? একটু আগেই বলা হলো তিনি ধান্ধাবাজি করতে চলেছেন। এখন আবার বলা হলো, তিনি ট্রাফিকদের দূর্নীতির বিষয়ে তথ্য নিতে যাচ্ছেন। স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে না?

হ্যাঁ, অবশ্যই পরস্পর বিরোধী। বর্তমানে মফঃস্বল সাংবাদিকতার প্রকৃতিই এমন। বাইরে থেকে যা দেখা যায়, আসলে তা তেমন না। ভিতরে বাহিরে একই থাকলে মফঃস্বল সাংবাদিকতা করা যায় না।

ট্রাফিক দু’জন দুই দিক থেকে ভিন্ন দুটি বাস থেকে নামলেন। বাসের ভাড়া দেয়া লাগে নাই। এ এক অলিখিত নিয়ম। ট্রাফিক এবং পুলিশ- নিজেদের পোষাকে থাকলে কন্ডাক্টররা কখনোই ভাড়া চাইবে না। আর পোষাকের বাইরে সাদা পোষাকে থাকলেও কিভাবে যেন বাসের হেল্পার-কন্ডাক্টররা বুঝে যায়, এই লোকের কাছ থেকে ভাড়া চাইতে হয় না। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততার বহিঃপ্রকাশ? হয়তো পুলিশের ছাপ পড়ে যায় চেহারায়।

তিনি একটু দূরে রাস্তার পাশের একটা সদ্য ঝাপ খোলা চা’র দোকানে বসে আছেন। এখান থেকে তিন রাস্তার মাথাটা খুব ভালো ভাবেই দেখা যায়। তবে সেভাবে লক্ষ্য না করলে, তাকে তেমাথা থেকে কেউ দেখতে পারবে না।

সিরিয়ালে দাঁড়ানো সিএনজি, ইজি-বাইকের সারি ক্রমশঃ লম্বা হচ্ছে। এখানেও চলে নীরব চাঁদাবাজি। তবে সেটা ট্রাফিকদের কাছ থেকে করা চাঁদাবাজির
মতো নয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষে ‘সিরিয়াল্ মেইনটেইনের’ নামে টাকা উত্তোলন করা হয়। এ ব্যাপারে পরেও আলাপ করা যাবে।

একটা বেনসন এন্ড হেজেজ, গ্যাস লাইটার দিয়ে ধরিয়ে, ধোঁয়া দিয়ে ফুসফুসকে ভরিয়ে দিলেন। কেমন কটু বিস্বাদে ভরে উঠলো ফুসফুসটা। খালি পেটে এবং এতো ভোরে কখনও সিগ্রেট টানেন নাই। কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়া বাতাসে ভেসে ভেসে রিঙয়ের মতো হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে কিছুটা আনমনা হলেন। এই অবসরে ভাবনারা ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে আবার তাঁর মস্তিষ্কে গান শুরু করলো।

ট্রাফিক ইন্সপেক্টর রমেশ বাবু মাসিক টাকা দিতে সরাসরি না করলেও দিচ্ছেনও না। অথচ প্রতিদিন এখান থেকে ওনার লোকেরা চারশত করে টাকা নেয়। আর এছাড়া ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, সিএনজি এবং ইজি-বাইক থেকে তো আছেই।

– তোমাকে টাকা দিতে হবে কেনো?

বেয়ারা মনের এমন প্রশ্নে এবার হাসেন তিনি। জ্বলন্ত সিগ্রেটের সামনের অংশের কালো ধোঁয়া লেগে চোখ জ্বালা করে। এরপরও হাসেন। তবে এবার উত্তর দেন,
– আমাকে না দিলে খাবি কি ব্যাটা? পত্রিকা অফিস কি টাকা দেয় আমাকে? আর নিয়োগ দেবার সময়ে উল্টা কতগুলি টাকা নিলো? তখন চুপ করে ছিলি কেন?

মনও কম যায় না। সে ও সরোষে জানায়,
– তোমার কাজ লেখা। অনিয়ম, দূর্নীতি জনগণের সামনে উপস্থাপন করবা বলেই তোমাকে গণমাধ্যম কর্মী বলা হয়। টাকা না পেলে লেখবা, আর পেলে লেখবা না, তাহলে এই চাঁদাবাজ ট্রাফিকদের সাথে তোমার পার্থক্য কি রইলো? অন্য পেশায় যাও।
– আমাদের ভিতরে পার্থক্য আছে কি নাই, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না তোকে। পুলিশ সাংবাদিক সব ভাই ভাই। মাঝে মাঝে এক ভাই আরেক ভাইকে দেখে না বলেই একটু টাইট দিতে হয়। এ তুই বুঝবি না। আর অন্য পেশায় কিছু করতে পারি নাই বলেই তো এই পেশায় আসা। ভুলে গেছিস নাকি সব কিছু?

এবার মন নিশ্চুপ হয়। এক সূর্য ওঠা মুহুর্তকে ঘিরে, মন আর তিনি ভাবতে বসেন। বর্তমান মুহুর্তে অতীত হয়ে যায়।

মফঃস্বল সাংবাদিকদেরকে কখনও কখনও নিজের মনকে সাথে নিয়ে নিশ্চুপ নৈঃশব্দ মাঝে ভাবনাবিলাসে সময় কাটাতে হয়। বর্তমান অতীতে পরিভ্রমন করে আবার বর্তমানে ফিরে আসে। কিন্তু ভুলেও কখনও ভবিষ্যতে যাবার চেষ্টা করে না।

সময়ের সামান্য অতীতকে সাথে নিয়ে অনাহুত ভবিষ্যতকে উপেক্ষা করে শ্রেফ বর্তমান অংশকে ঘিরেই চলে মফঃস্বল সাংবাদিকতা।

(ক্রমশঃ)

দ্য লস্ট আইডেন্টিটি: পর্ব-২

FB_IMG_1485017062699
আমার চাকরিজীবনের কান্নাকাটি শোনানোর দ্বারা আপনাদের সময় নষ্ট করছি ভেবে মন খারাপ করবেন না। শুরুটা এই বিষয় নিয়ে হলেও, আরো অনেক কিছু বলার আছে আমার।

আপনারা হয়তো আমার আগের কথাগুলি ভালোভাবে শুনে বুঝে ফেলেছেন এতোক্ষণে। এখন কেউ কেউ আমাকে বলতে পারেন,
– এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি অনেকের সাথেই হয়। তাই বলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে? আপনার চেয়েও অনেক কষ্ট করে মানুষ চাকরি করছে।

হ্যা! একমত আমি আপনাদের সাথে। তবে আমি অন্য সবাই নই। ‘৭১ এ যুদ্ধের মাঝে এক ভরদুপুরে আমার জন্ম। সেই থেকে আজন্ম জ্বলছি আমি। আমার চিন্তা-চেতনা ও একজন গোলামের মতো নয়।
তবে আরো কিছু কথা বলছি শুনুন। এটুকু বলেই গোলাম জীবনের প্রসঙ্গের ইতি টানবো।

আমি কমপ্লায়েন্স, এইচ আর এবং এডমিন ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। শেষ ও করেছি একই পোষ্টে। তোম, আমার এক ধাপ জুনিয়রকে আমার বস নিজের ইচ্ছেতে সহকারি ব্যবস্থাপক পদে তেনে আনলেন। আমাকে আরো হেয় করার জন্য। অথচ যোগ্যতায় আমি-ই ছিলাম এই পদে যাবার। তা না করে, এক ধাপ ডিঙ্গিয়ে সেই অফিসারকে আমার সিনিয়র করা হলো। তাতেও আমি মন খারাপ করলাম না। আমার ঈশ্বর চেয়েছেন বলেই সে হয়েছে। আমি ঈশ্বরের উপর ভরসা করে মনোযোগ দিয়ে কাজ করে যেতে লাগলাম।

একদিন আমাকে আমার বস ফোন করে বললেন,
– মাহতাব সাহেবকে আপনি ভাই ডাকেন কেনো? আজ থেকে স্যার ডাকবেন।

অফিস্পাড়ার এক অলিখিত নিয়ম ছিলো, জুনিয়রদেরকে সিনিয়রেরা সাহেব সম্বোধন করেন নামের শেষে। আর জুনিয়রেরা স্যার। তবে কেউ কেউ আন্তরিকতার কারণে সিনিয়রদেরকে ভাই ডাকেন। আমাকে সরাসরি আমার জুনিয়র যে সম্প্রতি সিনিয়র হয়েছে আমার, তাকে স্যার দাকতে নির্দেশ দেয়া হলো।
আপনারা বলবেন,
– হ্যা, তাতে ক্ষতিটা কি হয়েছে?
– নাহ! ক্ষতি হইয়েছে কিনা এবার বলছি তবে শুনুন…

এই ডিপার্টমেন্টের সহকারি কর্মকর্তা পদের কিছু জুনিয়র নেয়া হলো। আমার জয়েনের সময়েও ওরা ছিলো। তারা নিয়মানুযায়ী আমাকে ভাই বা স্যার না ডেকে, আমাকে সাহেব সম্বোধন করতে লাগলো। আমার সেকশনের আমার অধঃস্তনেরা এই ব্যবহারে কষ্ট পেতে লাগলো। আমাকে একজন বললো ও যে, ওরা কতো জুনিয়র, কেনো আপনাকে সাহেব ডাকবে?

আসলে আমার বস মানুষটির প্রচ্ছন্ন ইশারায় ওরা এই কাজটি করছিলো। একদিন একজনকে লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করাতে সে সত্যটা বলেছিলো।

কি হলো? এখন মুখ লুকোচ্ছেন কেনো? একটু আগেই তো লাভ-ক্ষতির হিসাব করছিলেন বড়ো, এখন উত্তর দিবেন কি আমাকে?

এসব-ই আমি দীর্ঘ পাঁচটি বছর নিরবে একা একা সয়েছিলাম।
আমি একা একা নিজের ভিতরে ক্ষয়ে যেতে লাগলাম। আমার বউ-বাচ্চাদেরকে ছেড়ে সপ্তাহের ছ’টি দিন নিজের ভিতরে প্রতি মুহুর্তে মরছিলাম। আমার দীর্ঘশ্বাসগুলি ও মানুষ দেখে বের হবার পথ খুঁজে ফিরতো।

আমার বউ আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকতো। আমি যখন আসতাম, তখন ওর ছোট্ট দুই রুমের বাসাটিতে যেনো ঈদের আমেজ বিরাজ করতো। আমার সন্তানেরা আমার সব জীর্ণতা-মলিনতা কষ্টকর ক্লেদাক্ততা ঘুচিয়ে দিতো ওদের ভালোবাসার দ্বারা- ওদের অগোচরে!

আমি আমার ছোট বাবুটাকে বুকের ভিতরে জড়িয়ে রেখে বিগত সপ্তাহের জীর্ণতা ভুলতে চাইতাম। আমি প্রতি সপ্তাহে একদিন বেঁচে থাকতাম- বাকি ছ’দিনের আসন্ন মৃত্যুর কথা মাথায় রেখে।

এভাবেই আমার দিনগুলি কাটছিলো।
এক বিষণ্ণ বেলাশেষের অণুক্ষণ বিরাজ করতো আমার ২৪টি ঘন্টা।

( ক্রমশ: )

ছবিঃ Nobi Hossain

দ্য লস্ট আইডেন্টিটি: ধারাবাহিক গল্প- পর্ব: এক

FB_IMG_1484843315823

[ এই ধারাবাহিক গল্পটি প্রথম পুরুষে লিখলাম ]
বং উপত্যকার একটি নির্দিষ্ট শহরে, সেই স্কুল জীবনের শেষ ধাপ থেকে দীর্ঘদিন বসবাসের সুযোগ হয়েছিলো আমার। অনেক কিছুর মতো নিজের যতসামান্য শব্দভান্ডার ও সমৃদ্ধ হয়েছে এই শহরটিতে বসবাসের ফলে।

পোন শব্দটি এগুলোর ভিতর একটি। আসলে উচ্চারণ হবে ‘পোন্দ’। পোন্দ শব্দটি এক বিশেষ প্রক্রিয়ায়, খাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে, কষ্টকর অপভ্রংশ স্তরের ভিতর দিয়ে আসা যাওয়ার কারণে পোন শব্দে রুপান্তরিত হয়েছে।

আমার শব্দভান্ডার নিজের মাঝে এরুপ কিছু অতিথি শব্দদের আত্তীকরণে কতটা সাবলীল ছিলো, ওদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করিনি কখনো।
তবে চাকরিজীবনে মানে আক্ষরিক অর্থে গোলাম জীবনে প্রবেশ করে, আমাকে উল্লেখিত শব্দটির রুপক ব্যবহার দেখতে হয়েছে, সইতে হয়েছে।

সর্বশেষ যে লোকটি আমার ইমিডিয়েট উর্ধতন কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি প্রথম থেকেই কেনো জানি আমাকে পছন্দ করলেন না। এমন হয় না? প্রথম দেখাতেই কেউ কেউ বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই কারোর কারোর অপছন্দের পাত্রে পরিণত হয়।

তবে আমি মানুষটা-ই এমন ছিলাম। আমার শ্বশুর আমাকে বলতেন, ‘তুমি সোজা মানুষ। এই যুগে অচল। আরো ভালোভাবে বললে তুমি প্রথম শ্রেণির গর্দভ একজন’। আমি নিরব থাকতাম। মনে মনেও হাসতাম না। কারণ তার কথার ভিতরের ভালোবাসাটুকু আমার অনুভবে আসতো।

আমি প্রথম শ্রেণির গর্দভ হলেও অনুভবক্ষম ছিলাম।

যা বলছিলাম, নিজের কাছের মানুষদের সাথে বনিবনা হলো না। কেনো সে কথায় পরে আসছি। নিজের বউ কে নিয়ে এই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের মৌচাক নগরীর বাসিন্দা হলাম। সেখানে দু’জন মানুষের জীবনধারণের জন্য গোলামির রজ্জু ধারণ করলাম। শুরু হলো পোন মারা খাবার নিরন্তর প্রক্রিয়া।

অফিস পাড়ার রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা আছে আপনাদের অনেকেরই। তাই বিশদ আলোচনার প্রয়োজন দেখি না। আমি সবসময়েই প্রকৃতিগত কারণে দুর্বল শ্রেণির সাথে থাকতাম। আমার সর্বশেষ চাকুরিস্থলেও স্বভাবগত কারণে প্রলেতারিয়েত শ্রেণিভুক্ত হলাম। তাই অনিবার্যভাবেই দুই শ্রেণির মধ্যকার দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ পরিবেশে বাস করতে লাগলাম।

আমার বস বিভিন্নভাবে আমার উপর মানসিক নির্যাতন করে যেতে লাগলেন। আমি একটা সেকশন চালাতাম। আমার নিরলস পরিশ্রম এবং সততা তার চোখে কেনো জানি পড়তো না। সকল কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করলেও তিনি আমাকে কখনো ডাকতেন না। তার নির্দেশ এবং ইন্সট্রাকশনগুলির সব মেইলে কিংবা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে আমার উপর জারি হতো।
আমাকে ডাকা হতো না শ্রেফ অন্যদের কাছে আমার গুরুত্ব কম দেখানর জন্য। আমাকে হেয় অপদস্থ করার এক বিকৃত মানসিকতায় আপ্লুত থাকতেন বস মানুষটি।

একটা উদাহরণ দেই, একবার কি মনে করে এক নতুন বায়ারের কম্পলায়েন্স অডিটের সময়ে আমাকে তার চেম্বারে অন্য সবার সাথে আমাকেও ডাকা হলো। আমি গেলাম। কোনো এক কারণে কি এক কথায় আমার উপর রুষ্ট হলেন। সবার সামনে আমাকে চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসতে বললেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে সেই দিন মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্লোরে বসে থাকতে হয়েছিলো।

অবাক হচ্ছেন?
আমার পুরুষ হবার ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে? আমার ভংগুর মানসিকতার উপর ঘৃণা হচ্ছে?

আমার কিছুই করার ছিলো না। পরিবারের কাছের মানুষদের থেকে অনেক দূরে ছিলাম। আমার বয়স বেড়ে গেছিলো। এই চাকরিটি ও আমি আমার বউয়ের এক আত্মীয়র আমার প্রতি সুনজর এবং ভালোবাসার কারণে পেয়েছিলাম। তাই তখন চাকরি ছেড়ে চলে যাবার কথা মনে এলেও, নতুন করে সবাইকে বিব্রত করতে মন চাইছিলো না। যদিও ঐ ভদ্রলোক মানুষটি ছাড়া আমি আর আমার বউয়ের জন্য বিব্রত হবার মতো আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। আমরা কষ্ট করতাম, আমার এবং বউয়ের কাছের মানুষেরা যথেষ্ট ক্ষমতাধর হয়েও কিছুই করতেন না আমাদের জন্য। একসময় আমি আর আমার বউ এটাই মেনে নিলাম। কিছুই চাওয়ার ছিলো না আমাদের দু’জনের। সব ইচ্ছের মৃতপুরিতে অবস্থান করে আমরা দু’জন নিজেদের দুই সন্তানকে কষ্টকর জীবনে শ্রেফ ভালোবাসায় চুবিয়ে চুবিয়ে মানুষ করতে লাগলাম। সেখানেও অনেক বিড়ম্বনা। যথাসময়ে জানা যাবে। অপেক্ষা করুন।

তাই আমি অন্য স্টাফদের ভিতর এক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ফ্লোরে বসে রইলাম। অনুভূতিহীন। নির্বাক। আমার মনে সামনের মাসের ঘর ভাড়া সহ অন্য খরচগুলি দাঁড়িয়ে নির্লজ্জভাবে আমাকে দেখছিলো। তাই অন্য স্টাফদের লুকানো হাসির ছোঁয়া আমার মনকে স্পর্শ করছিলো না।

আরেকদিন।
এক প্রচন্ড শীতের রাত। বছর শেষের সময়। অনেক শিপমেন্ট ছিলো। নাইট পার হয়ে ভোর পর্যন্ত থাকতে হয়েছিলো। দশ ঘন্টা ডিউটি শেষ করে অফিস সংলগ্ন মেসে ফিরেছিলাম। অধ:স্তনকে সুন্দর ভাবে দায়িত্ব বুঝিয়েই এসেছিলাম। শরীরটা খারাপ লাগছিলো। শুধুমাত্র এই চলে যাবার অপরাধে, ফোন করে ডেকে এনে, রাত তিনটা পর্যন্ত কুয়াশা পড়া উন্মুক্ত আকাশের নিচে, ফ্যাক্টরি কম্পাউন্ডে একটি বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছিলো আমাকে। কাজও করতে হয়নি। শ্রেফ ছোট করানোর জন্যই এমন শাস্তি দিলেন তিনি। আমি রাত তিনটার পরে, সিকিউরিটি অফিসারের কল্যাণে তার শেডের আশ্রয় পেয়েছিলাম। সেদিন ছিলো ইংরেজি বছরের শেষ রাত। প্রায় শারিরিক মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আমি নতুন বছরের প্রথম সুর্যোদয় দেখেছিলাম!

যে মানুষটি আমাকে এই চাকরিটি পেতে সাহায্য করেছিলেন, তাকে কিংবা আমার বউকেও আমি কখনো এইসব কথা বলিনি। আজ তিনিও হয়তো আপনাদের কল্যাণে জেনে যাবেন। আমি তার মন খারাপ করতে চাইনি। আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম ওনার কাছে। ভালোও বাসি তাকে আমি অনেক।

এমনই করতেন আমার উর্ধতন মানুষটি আমার সাথে।

তো, তিনি একদিন যখন সবার সামনে আমাকে বললেন,
– এই চাকরিটা চলে গেলে আপনার, রাস্তায় রাস্তায় পোন মারা খাবেন।

সহ্য হলো না সেদিন আমার আর।
পোন মারা খাবার ইচ্ছে হলো। মন আর আমি, দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম- দেখিনা আরো একবার পোন মারা খেতে কেমন লাগে? কম তো খেলাম না দি মৌচাক নগরে!

সোজা রিজাইন লেটার লিখে তার সামনে জমা দিয়ে ওনার মুখের উপর হাসলাম 😀
অবাক হচ্ছেন?
হ্যা!
এমনই আমি।

( ক্রমশ: )