ফজরের আযান হয়ে গেছে। চারতলা বাসাকে ঘিরে থাকা গাছগুলির ডালে ডালে প্রভাতি পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। নিচতলার ‘কোলাপ্স্যাবল গেট’ টানার শব্দে রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটির তারে বসা তিনটি পাখির একটি ভয়ে উড়ে গেলো। এভাবেই তিনি বের হলেন। বাইরে এখন আলোআঁধারির খেলা। দৃশ্যমান কোমল আলোয় মনটা ভরে উঠলো তাঁর। কালো পিচের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে, ফুরফুরে বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেলো। ভালোলাগাময় এক আবেশে মুগ্ধ দিনের শুরুটা আজ অনেক বছর পরে তিনি অনুভব করছেন। কেমন পবিত্র পবিত্র ভাব! যদিও তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী একটা কাজ করতে বের হয়েছেন। ধান্ধা করতে বের হয়েছেন তিনি।
মহাসড়কের এক তিনরাস্তার মাথায় যাবেন । ওখানে ট্রাফিক ইন্সপেক্টরগণ দায়িত্ব পালন করে। সকাল ছ’টার সময়ে তাদের ডিউটি শুরু হলেও একটু আগেই যেতে চাচ্ছেন। অভিযোগ আছে, প্রতিদিন ওখানে ট্রাফিক পুলিশেরা দিনের শুরুতেই যানবাহন থেকে টাকা তোলে। অন্যভাবে বলতে গেলে চাঁদাবাজির কথা বলা যায়। যদিও চাঁদাবাজি শব্দটা পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে যায় না। আজকাল কার সাথেই বা কোনটা যায়? ডাক্তার সেবামূলক মনোভাবের বাইরে গিয়ে টাকার ক্ষাক্কস হয়ে পড়েছে। ক্লিনিকগুলি মানুষকে শুষে নেয়া এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। যার যার পেশার সাথে কারোই কোনো মিল নেই। সবাই নিজের থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্য এক নিজেকে দেখায় ব্যস্ত।
একটা কালো বিড়াল অন্ধকার থেকে সাই করে ওনার পথ কেটে চলে গেলো। যাবার আগে তাকে চমকে দিয়ে হাঁটার গতিকে শ্লথ করে দিয়ে যায়। সেই সাথে এলোমেলো ভাবনা চিন্তাও মুহুর্তের তরে থেমে গেলো। ভাবেন, ভাবনা চিন্তারাও কি চলমান? না হলে নিজের থেমে যাবার সাথে সাথে সেগুলোও কেন থেমে গেলো? এসময় নিজের মন তাকে এক বেয়ারা প্রশ্ন করে বসে,
– তুমি যা করছো সেটা কি তোমার সাথে যায়?
– কি করছি আমি?
মনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মনকে ফিরতি প্রশ্ন করেই আবার হাঁটা শুরু করেন। সব সময় মনের সব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও দিতে হয় না। তাতে সমস্যা আছে। মফঃস্বল সাংবাদিকদের মনকে কঠিনভাবে বেঁধে রাখতে হয়।
ঠিক ধরেছেন। তিনি একজন মফঃস্বল সাংবাদিক। চলেছেন ট্রাফিকদের চাঁদাবাজির বিষয়টি হাতেনাতে ধরবেন বলে। কেমন এলোমেলো লাগছে তাই না? একটু আগেই বলা হলো তিনি ধান্ধাবাজি করতে চলেছেন। এখন আবার বলা হলো, তিনি ট্রাফিকদের দূর্নীতির বিষয়ে তথ্য নিতে যাচ্ছেন। স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে না?
হ্যাঁ, অবশ্যই পরস্পর বিরোধী। বর্তমানে মফঃস্বল সাংবাদিকতার প্রকৃতিই এমন। বাইরে থেকে যা দেখা যায়, আসলে তা তেমন না। ভিতরে বাহিরে একই থাকলে মফঃস্বল সাংবাদিকতা করা যায় না।
…
ট্রাফিক দু’জন দুই দিক থেকে ভিন্ন দুটি বাস থেকে নামলেন। বাসের ভাড়া দেয়া লাগে নাই। এ এক অলিখিত নিয়ম। ট্রাফিক এবং পুলিশ- নিজেদের পোষাকে থাকলে কন্ডাক্টররা কখনোই ভাড়া চাইবে না। আর পোষাকের বাইরে সাদা পোষাকে থাকলেও কিভাবে যেন বাসের হেল্পার-কন্ডাক্টররা বুঝে যায়, এই লোকের কাছ থেকে ভাড়া চাইতে হয় না। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততার বহিঃপ্রকাশ? হয়তো পুলিশের ছাপ পড়ে যায় চেহারায়।
তিনি একটু দূরে রাস্তার পাশের একটা সদ্য ঝাপ খোলা চা’র দোকানে বসে আছেন। এখান থেকে তিন রাস্তার মাথাটা খুব ভালো ভাবেই দেখা যায়। তবে সেভাবে লক্ষ্য না করলে, তাকে তেমাথা থেকে কেউ দেখতে পারবে না।
সিরিয়ালে দাঁড়ানো সিএনজি, ইজি-বাইকের সারি ক্রমশঃ লম্বা হচ্ছে। এখানেও চলে নীরব চাঁদাবাজি। তবে সেটা ট্রাফিকদের কাছ থেকে করা চাঁদাবাজির
মতো নয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষে ‘সিরিয়াল্ মেইনটেইনের’ নামে টাকা উত্তোলন করা হয়। এ ব্যাপারে পরেও আলাপ করা যাবে।
একটা বেনসন এন্ড হেজেজ, গ্যাস লাইটার দিয়ে ধরিয়ে, ধোঁয়া দিয়ে ফুসফুসকে ভরিয়ে দিলেন। কেমন কটু বিস্বাদে ভরে উঠলো ফুসফুসটা। খালি পেটে এবং এতো ভোরে কখনও সিগ্রেট টানেন নাই। কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়া বাতাসে ভেসে ভেসে রিঙয়ের মতো হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে কিছুটা আনমনা হলেন। এই অবসরে ভাবনারা ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে আবার তাঁর মস্তিষ্কে গান শুরু করলো।
ট্রাফিক ইন্সপেক্টর রমেশ বাবু মাসিক টাকা দিতে সরাসরি না করলেও দিচ্ছেনও না। অথচ প্রতিদিন এখান থেকে ওনার লোকেরা চারশত করে টাকা নেয়। আর এছাড়া ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, সিএনজি এবং ইজি-বাইক থেকে তো আছেই।
– তোমাকে টাকা দিতে হবে কেনো?
বেয়ারা মনের এমন প্রশ্নে এবার হাসেন তিনি। জ্বলন্ত সিগ্রেটের সামনের অংশের কালো ধোঁয়া লেগে চোখ জ্বালা করে। এরপরও হাসেন। তবে এবার উত্তর দেন,
– আমাকে না দিলে খাবি কি ব্যাটা? পত্রিকা অফিস কি টাকা দেয় আমাকে? আর নিয়োগ দেবার সময়ে উল্টা কতগুলি টাকা নিলো? তখন চুপ করে ছিলি কেন?
মনও কম যায় না। সে ও সরোষে জানায়,
– তোমার কাজ লেখা। অনিয়ম, দূর্নীতি জনগণের সামনে উপস্থাপন করবা বলেই তোমাকে গণমাধ্যম কর্মী বলা হয়। টাকা না পেলে লেখবা, আর পেলে লেখবা না, তাহলে এই চাঁদাবাজ ট্রাফিকদের সাথে তোমার পার্থক্য কি রইলো? অন্য পেশায় যাও।
– আমাদের ভিতরে পার্থক্য আছে কি নাই, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না তোকে। পুলিশ সাংবাদিক সব ভাই ভাই। মাঝে মাঝে এক ভাই আরেক ভাইকে দেখে না বলেই একটু টাইট দিতে হয়। এ তুই বুঝবি না। আর অন্য পেশায় কিছু করতে পারি নাই বলেই তো এই পেশায় আসা। ভুলে গেছিস নাকি সব কিছু?
এবার মন নিশ্চুপ হয়। এক সূর্য ওঠা মুহুর্তকে ঘিরে, মন আর তিনি ভাবতে বসেন। বর্তমান মুহুর্তে অতীত হয়ে যায়।
মফঃস্বল সাংবাদিকদেরকে কখনও কখনও নিজের মনকে সাথে নিয়ে নিশ্চুপ নৈঃশব্দ মাঝে ভাবনাবিলাসে সময় কাটাতে হয়। বর্তমান অতীতে পরিভ্রমন করে আবার বর্তমানে ফিরে আসে। কিন্তু ভুলেও কখনও ভবিষ্যতে যাবার চেষ্টা করে না।
সময়ের সামান্য অতীতকে সাথে নিয়ে অনাহুত ভবিষ্যতকে উপেক্ষা করে শ্রেফ বর্তমান অংশকে ঘিরেই চলে মফঃস্বল সাংবাদিকতা।
(ক্রমশঃ)