[ এই ধারাবাহিক গল্পটি প্রথম পুরুষে লিখলাম ]
বং উপত্যকার একটি নির্দিষ্ট শহরে, সেই স্কুল জীবনের শেষ ধাপ থেকে দীর্ঘদিন বসবাসের সুযোগ হয়েছিলো আমার। অনেক কিছুর মতো নিজের যতসামান্য শব্দভান্ডার ও সমৃদ্ধ হয়েছে এই শহরটিতে বসবাসের ফলে।
পোন শব্দটি এগুলোর ভিতর একটি। আসলে উচ্চারণ হবে ‘পোন্দ’। পোন্দ শব্দটি এক বিশেষ প্রক্রিয়ায়, খাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে, কষ্টকর অপভ্রংশ স্তরের ভিতর দিয়ে আসা যাওয়ার কারণে পোন শব্দে রুপান্তরিত হয়েছে।
আমার শব্দভান্ডার নিজের মাঝে এরুপ কিছু অতিথি শব্দদের আত্তীকরণে কতটা সাবলীল ছিলো, ওদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করিনি কখনো।
তবে চাকরিজীবনে মানে আক্ষরিক অর্থে গোলাম জীবনে প্রবেশ করে, আমাকে উল্লেখিত শব্দটির রুপক ব্যবহার দেখতে হয়েছে, সইতে হয়েছে।
সর্বশেষ যে লোকটি আমার ইমিডিয়েট উর্ধতন কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি প্রথম থেকেই কেনো জানি আমাকে পছন্দ করলেন না। এমন হয় না? প্রথম দেখাতেই কেউ কেউ বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই কারোর কারোর অপছন্দের পাত্রে পরিণত হয়।
তবে আমি মানুষটা-ই এমন ছিলাম। আমার শ্বশুর আমাকে বলতেন, ‘তুমি সোজা মানুষ। এই যুগে অচল। আরো ভালোভাবে বললে তুমি প্রথম শ্রেণির গর্দভ একজন’। আমি নিরব থাকতাম। মনে মনেও হাসতাম না। কারণ তার কথার ভিতরের ভালোবাসাটুকু আমার অনুভবে আসতো।
আমি প্রথম শ্রেণির গর্দভ হলেও অনুভবক্ষম ছিলাম।
যা বলছিলাম, নিজের কাছের মানুষদের সাথে বনিবনা হলো না। কেনো সে কথায় পরে আসছি। নিজের বউ কে নিয়ে এই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের মৌচাক নগরীর বাসিন্দা হলাম। সেখানে দু’জন মানুষের জীবনধারণের জন্য গোলামির রজ্জু ধারণ করলাম। শুরু হলো পোন মারা খাবার নিরন্তর প্রক্রিয়া।
অফিস পাড়ার রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা আছে আপনাদের অনেকেরই। তাই বিশদ আলোচনার প্রয়োজন দেখি না। আমি সবসময়েই প্রকৃতিগত কারণে দুর্বল শ্রেণির সাথে থাকতাম। আমার সর্বশেষ চাকুরিস্থলেও স্বভাবগত কারণে প্রলেতারিয়েত শ্রেণিভুক্ত হলাম। তাই অনিবার্যভাবেই দুই শ্রেণির মধ্যকার দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ পরিবেশে বাস করতে লাগলাম।
আমার বস বিভিন্নভাবে আমার উপর মানসিক নির্যাতন করে যেতে লাগলেন। আমি একটা সেকশন চালাতাম। আমার নিরলস পরিশ্রম এবং সততা তার চোখে কেনো জানি পড়তো না। সকল কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করলেও তিনি আমাকে কখনো ডাকতেন না। তার নির্দেশ এবং ইন্সট্রাকশনগুলির সব মেইলে কিংবা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে আমার উপর জারি হতো।
আমাকে ডাকা হতো না শ্রেফ অন্যদের কাছে আমার গুরুত্ব কম দেখানর জন্য। আমাকে হেয় অপদস্থ করার এক বিকৃত মানসিকতায় আপ্লুত থাকতেন বস মানুষটি।
একটা উদাহরণ দেই, একবার কি মনে করে এক নতুন বায়ারের কম্পলায়েন্স অডিটের সময়ে আমাকে তার চেম্বারে অন্য সবার সাথে আমাকেও ডাকা হলো। আমি গেলাম। কোনো এক কারণে কি এক কথায় আমার উপর রুষ্ট হলেন। সবার সামনে আমাকে চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসতে বললেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে সেই দিন মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্লোরে বসে থাকতে হয়েছিলো।
অবাক হচ্ছেন?
আমার পুরুষ হবার ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে? আমার ভংগুর মানসিকতার উপর ঘৃণা হচ্ছে?
আমার কিছুই করার ছিলো না। পরিবারের কাছের মানুষদের থেকে অনেক দূরে ছিলাম। আমার বয়স বেড়ে গেছিলো। এই চাকরিটি ও আমি আমার বউয়ের এক আত্মীয়র আমার প্রতি সুনজর এবং ভালোবাসার কারণে পেয়েছিলাম। তাই তখন চাকরি ছেড়ে চলে যাবার কথা মনে এলেও, নতুন করে সবাইকে বিব্রত করতে মন চাইছিলো না। যদিও ঐ ভদ্রলোক মানুষটি ছাড়া আমি আর আমার বউয়ের জন্য বিব্রত হবার মতো আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। আমরা কষ্ট করতাম, আমার এবং বউয়ের কাছের মানুষেরা যথেষ্ট ক্ষমতাধর হয়েও কিছুই করতেন না আমাদের জন্য। একসময় আমি আর আমার বউ এটাই মেনে নিলাম। কিছুই চাওয়ার ছিলো না আমাদের দু’জনের। সব ইচ্ছের মৃতপুরিতে অবস্থান করে আমরা দু’জন নিজেদের দুই সন্তানকে কষ্টকর জীবনে শ্রেফ ভালোবাসায় চুবিয়ে চুবিয়ে মানুষ করতে লাগলাম। সেখানেও অনেক বিড়ম্বনা। যথাসময়ে জানা যাবে। অপেক্ষা করুন।
তাই আমি অন্য স্টাফদের ভিতর এক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ফ্লোরে বসে রইলাম। অনুভূতিহীন। নির্বাক। আমার মনে সামনের মাসের ঘর ভাড়া সহ অন্য খরচগুলি দাঁড়িয়ে নির্লজ্জভাবে আমাকে দেখছিলো। তাই অন্য স্টাফদের লুকানো হাসির ছোঁয়া আমার মনকে স্পর্শ করছিলো না।
আরেকদিন।
এক প্রচন্ড শীতের রাত। বছর শেষের সময়। অনেক শিপমেন্ট ছিলো। নাইট পার হয়ে ভোর পর্যন্ত থাকতে হয়েছিলো। দশ ঘন্টা ডিউটি শেষ করে অফিস সংলগ্ন মেসে ফিরেছিলাম। অধ:স্তনকে সুন্দর ভাবে দায়িত্ব বুঝিয়েই এসেছিলাম। শরীরটা খারাপ লাগছিলো। শুধুমাত্র এই চলে যাবার অপরাধে, ফোন করে ডেকে এনে, রাত তিনটা পর্যন্ত কুয়াশা পড়া উন্মুক্ত আকাশের নিচে, ফ্যাক্টরি কম্পাউন্ডে একটি বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছিলো আমাকে। কাজও করতে হয়নি। শ্রেফ ছোট করানোর জন্যই এমন শাস্তি দিলেন তিনি। আমি রাত তিনটার পরে, সিকিউরিটি অফিসারের কল্যাণে তার শেডের আশ্রয় পেয়েছিলাম। সেদিন ছিলো ইংরেজি বছরের শেষ রাত। প্রায় শারিরিক মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আমি নতুন বছরের প্রথম সুর্যোদয় দেখেছিলাম!
যে মানুষটি আমাকে এই চাকরিটি পেতে সাহায্য করেছিলেন, তাকে কিংবা আমার বউকেও আমি কখনো এইসব কথা বলিনি। আজ তিনিও হয়তো আপনাদের কল্যাণে জেনে যাবেন। আমি তার মন খারাপ করতে চাইনি। আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম ওনার কাছে। ভালোও বাসি তাকে আমি অনেক।
এমনই করতেন আমার উর্ধতন মানুষটি আমার সাথে।
তো, তিনি একদিন যখন সবার সামনে আমাকে বললেন,
– এই চাকরিটা চলে গেলে আপনার, রাস্তায় রাস্তায় পোন মারা খাবেন।
সহ্য হলো না সেদিন আমার আর।
পোন মারা খাবার ইচ্ছে হলো। মন আর আমি, দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম- দেখিনা আরো একবার পোন মারা খেতে কেমন লাগে? কম তো খেলাম না দি মৌচাক নগরে!
সোজা রিজাইন লেটার লিখে তার সামনে জমা দিয়ে ওনার মুখের উপর হাসলাম 😀
অবাক হচ্ছেন?
হ্যা!
এমনই আমি।
( ক্রমশ: )
লিখাটি পড়ে সত্যই দুঃখ পেলাম মি. মামুন। গল্প না হয়ে যদি সত্যেরও ধারকাছে থাকে এই প্রথম পুরুষ; তাহলে এই পর্বের শেষ আরও কঠিন হলে ভালো লাগতো।
অপেক্ষা নিয়ে রইলাম ক্রমশের দিকে। দেখা যাক।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
এই গল্পটির তিনটি পর্ব লিখে আর লিখিনি। ফেবুতে কিছু মানুষ প্রথম উরুষে লেখার কারণে, আমার নিজের গল্প মনে করে কিছু অর্থহীন মন্তব্য করেছিল। তাতে গল্পটি শেষ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম।
প্রিয় ব্লগ নতুনভাবে চালু হওয়াতে এই গল্পটি এখানে ধারাবাহিকভাবে লেখবার এক তাড়ণা অনুভব করায় আবার শুরু করেছি। শেষে গিয়ে হিয়তো গল্পটি আমার এক অনন্য গল্পে রুপ নেবে। আমার চাকুরী জীবন বড্ড বর্ণাঢ্য। আমি অনেকের সাথে মিশেছি, লেখকের দৃষ্টিভংগী নিয়ে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, আনন্দ দু:খ-বেদনাকে অনুভব করেছি। সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে এই ধারাবাহিক গল্পটিকে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি।
ধন্যবাদ আপনাকে সাথে থাকার জন্য।
ভালো থাকুন।
এবার ধৈর্য্যের সাথে লিখাটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। অপেক্ষা করবো।
অশেষ কৃতজ্ঞতার মোড়কে ভালোবাসা রেখে গেলাম

পড়লাম…. ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ভাই আপনার ভালোলাগার অনুভূতি জানিয়ে যাবার জন্য।
অনেক ভালো থাকুন।
চমৎকার লিখেছেন মিতা। পরবর্তী দৃশ্যের(পোন মারা) অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু আমার

হ্যা, আপনাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখবো না। ভালো থাকুন মিতা।
আমাদের এই সোনার দেশের সোনার মালিকেরা যারা অন্যকে দিয়ে নিজের ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তদের কথা সুনদর ভাবেই বলেছেন। এরা এমনই হয় এমনটা হওয়ার জন্যই এদের জন্ম হয়েছে। এদের চেয়ে আপনার যোগ্যতা কার্যক্ষমতা অনেক বেশি হলেই এরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এদের সাথে এদের এক ধরনের চ্যালা থাকে তারা আর কিছু করুক বা না করুক আপনার যোগ্যতাগুলি গোপন করে কাল্পনিক দোষত্রুটি তার কাছে অবিরাম বিনাপারিশ্রমিকেই বিলাতে থাকেন এতেই তাদের সুখ।
একজন MD হতে হলে তার বাবার কিছু টাকা থাকলেই হয় কিন্তু একজন GM হতে গেলে আপনার এক বস্তা ডিগ্রির সাথে বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন হয় যা আপনাকে অনেক কষ্ট করেই অর্জন করতে হয়।
এই সোনার দেশের বিজ্ঞ সোনার মত মালিকেরা সবজায়গায় একই, এদের সবার চরিত্রই এক।
অসাধারণ বলেছেন প্রিয় খালিদ ভাই। সম্পুর্ণ সহমত আপনার সাথে।
কর্পোরেট জীবনের অনেক অপ্রিয় সত্য আমার অনুভবে এসেছে। সেগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করবো এই গল্পে ইনশা আল্লাহ।
সাথে থাকার শুভেচ্ছা গ্রহন করুন।

ভালো থাকুন সবসময়।
প্রথম পর্ব পড়লাম। সাথেই আছি পাঠক হয়ে। শুভকামনা।
ধন্যবাদ প্রিয় ভাই।
সাথে থাকার শুভেচ্ছা গ্রহন করো।