ট্যাগ আর্কাইভঃ মেগা সিরিয়াল

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৬

১২।
ছোট ছোট ভাই বোনদের সুখের জন্য, তাদের লেখাপড়া করে মানুষ করার জন্য, তদের সুনাম হবার জন্য, সুখ সমৃদ্ধিতে জীবন যাপনের জন্য, সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য এক জন নিতান্ত যে বয়সে মন দিয়ে পড়া শুনা করার কথা তা না করে বাড়ি ছেড়ে, ঢাকা শহর ছেড়ে, অবশেষে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। শিক্ষা, শান্তি, সুখ সচ্ছলতা কুড়িয়ে আনতে। কিছুটা এনেছিলেন যার উপযুক্ত ব্যবহার হলে আজ তাকে এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হোত না। যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে সব পাওয়া হয়নি তবে তখনকার মত কিছু সামাল দেয়া গেছে। ভাই বোনেরা আজ সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে, কিছু দিন সংসার চলেছে কিন্তু সাথে আর একটি প্রাপ্তি যা বাড়ির সবার অলক্ষ্যে, একান্ত নীরবে সে একাই পেয়েছে বাড়ির আর কেও তা বুঝতে পারেনি। দীর্ঘ দিন বাড়ির বাইরে থাকার ফলে অতি ধীরে ধীরে বাড়ির সাথে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

প্রথম দিকে দুই তিন মাস পর পর তিন চার দিনের জন্য বাড়ি আসার পথে ভাই বোনেরা কে কি পছন্দ করে সে অনুযায়ী ফলমুল, কাপড় চোপর নিয়ে আসতেন, এসে মাকে সংসারের কিছু বাজার করে দিতেন, রান্না ঘরে বা বাড়ির যা যা প্রয়োজন তা কিনে দিয়ে যেতেন বা মনে করে মাথায় করে একটা ফর্দ তৈরি করে নিয়ে যেতেন আবার আসার সময় নিয়ে আসতেন। ভাই বোনেরা নিতান্ত ছোট ছিলো বলে তারা অনেক দিন পর পর বড় ভাইকে দেখত বলে তাদের মনে একটা ধারনা জন্মেছিলো যে এতো আমাদের মেহমান। পরে যখন দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তখন তো বৎসরে একবার আসা হতো।

বাড়ির মানুষ কি আর এতো দিন পরে আসে, এমন ধারনা জন্মান অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিয়ম করে টাকা পাঠাত। যে অভাবের যন্ত্রণা সে দেখেছে, সে অভাবের ছোঁয়া যেন ছোট ভাই বোনদের গায়ে না লাগে। প্রতি মাসে একটা করে বিরাট চিঠি লিখত মায়ের কাছে, বাবার কাছে। তাতে ওই এক কথাই বারবার লিখত ওদের যেন কোন অসুবিধা না হয়, বিশেষ খেয়াল রাখবেন। ছুটিতে আসার সময় পছন্দ মত খেলনা, পোষাক আসাক সবার জন্য যা মনে হতো নিয়ে আসতো।

কখন যে এই সব টাকা আর জিনিষ পত্রের সম্পর্কটা টিকে গেলো আর রক্তের সম্পর্কটা ম্লান হতে হতে এক সময় মুছে গেছে তা হঠাৎ করেই একদিন লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিন্তু তরী তখন কূল ছেড়ে উত্তাল বাতাস আর স্রোতের টানে মাঝ গাঙ্গে চলে গেছে। আর সে তরী পাড়ে ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই। থাক, তবুও আমার মা, আমার বাবা, আমারই ভাই বোন। ওদের জন্যেই সব ছেড়েছি, ওরা সুখী হলেই যথেষ্ট। সময়ের স্রোত আমাকে দূরে টেনে নিয়ে গেছে। যাক, আমি তো দূরে যেতে পারি না। আমার হৃদয়ের গভীর কুঠরি ওদের জন্যই পূর্ণ হয়ে আছে ওরা আমাকে আর কত দূরে ঠেলে দিবে? আবার ভাবে, না তা কি করে হয়? আমি এ বাড়ির বড় ছেলে, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা, সিদ্ধান্ত, মতামত অনেক মূল্যবান। আবার ভাবে কিন্তু বাস্তব যে এর বিপরীত!
তাহলে? নিজেকেই প্রশ্ন করে মনে মনে আহত হলেও মন কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে না। ভাবে, যাক ওরা যা খুশি করুক আমি আমার কাজ করে যাব তাতে যা হয় হবে।

১৩।
মনিরাও এই মুছে যাওয়া সম্পর্কের জের টের পেয়েছে কিন্তু স্বামীর কাছে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পায়নি। এমনিই দুজনে দুজনের মত ভিন্ন ভাবে লক্ষ করে কিন্তু কেও কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। মনিরা নিজেও বিশাল একান্নবর্তী পরিবার থেকে স্কুল শেষ না হতেই বালিকা বধূ সেজে এ বাড়ির বড় বৌ হয়ে এসেছে। দৈনন্দিন কাজে যখন রাশেদ সাহেব বাড়িতে থাকে না তখন বাড়ির এক রূপ আবার যখন সে বাড়িতে থাকে তখন আর এক রূপ।

এই দুই রূপের তারতম্য মনিরার বালিকা মাথায় কিছুতেই ঢুকতে চায় না, কোন অবস্থাতেই সে মেলাতে পারে না। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে সবাইকে কিন্তু সেই আগের দেখা আর বিয়ের পর এই দেখার মধ্যে এই তফাত কেন সে কথা মনিরা তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে পারে না, মেনে নিতে পারেনা, সহ্য করতেও পারে না। বিয়ের পর প্রথম দিকে মনিরার বাবা একবার মনিকে নিতে এলে শাশুড়ি তাকে আড়ালে ডেকে বললো তোমার বাবা যখন আমাকে তোমাকে নিয়ে যাবার কথা বলবে তখন আমি বলবো নিয়ে যান, কিন্তু তুমি বলবে না বাবা আমি আর ক’দিন পরে যাই। এই কথার কোন মানে খুঁজে পায় না। কেন এমন কথার কি এমন প্রয়োজন? সেই তো সরাসরি নিষেধ করে দিতে পারে। এই লুকোচুরি কেন? তার স্বামীর প্রতি উদাসীনতা, অবহেলা, অবজ্ঞা, অমর্যাদা কেন? তার ইচ্ছার কোন মূল্যায়ন নেই, তার মতামতের কোন গুরুত্ব নেই। যে সন্তান নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে সংসারের হাল ধরতে সাঁতার না জেনে সাগর পাড়ি দিয়েছে তার প্রতি এই মনোভাব কেন?

এই এত গুলি চেপে রাখা কেন তার বুকের ভিতর বাসা বাঁধতে থাকে, ক্ষত বিক্ষত হয়ে অসহ্য যন্ত্রণার কামড়ে সে দগ্ধ হতে থাকে। কেমন যেন একটা শূন্যতা, একটা বিষাদ, একটা হাহাকার, কিছু অব্যক্ত বেদনায় দগ্ধ মনিরা নিজেকে স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কি জানি আবার কখনো যদি ভুল করে এর কিছু স্বামীর কাছে বলে ফেলে তা হলে যে সে মনে ব্যথা পাবে, আঘাত পাবে এই মনে করে। এ কি মনি! আমার মা, বাবা, ভাই বোনদের সম্পর্কে এই ধারনা পোষণ কর? তখন সে কি জবাব দিবে? সে নিজেই তো এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না।
কাছের রাশেদ আর দূরের রাশেদের মধ্যে এই পার্থক্যের বোঝা সব গিয়ে পরে মনিরার মাথায়। যে স্বামীর জন্য জীবনের সঞ্চিত সমস্ত শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সমস্ত মমতা উজাড় করে দিয়েছে তার প্রতি এই আচরণ কি করে মেনে নিতে পারে? কিছু না বুঝে ক্রমান্বয়ে তার বুকে চাপা পাথর জমে জমে এখন শ্বাস নিতেও কষ্ট বোধ করে। শ্বাস নেয়ার জন্য শ্বাসনালী সংকুচিত হতে হতে এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও তার প্রিয় স্বামীকে কিছু বুঝতে দিতে চায় না। সমস্ত যন্ত্রণা তার একার উপর দিয়েই যাক। যে তার সংসারের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা নিয়ে বিভোর রয়েছে সে থাকুক তার আপন মনে, যা হবার আমারই হোক। আভাসে ইঙ্গিতেও যাকে বোঝানো যায় না, বুঝতে চায়না সে তার ধারনা নিয়ে সুখে থাক।

একদিন যেদিন প্রথম মনিরার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তখন স্বামীকে বললো-
-আমার এমন লাগছে কেন?
-কি হয়েছে মনি?
-আমি যে শ্বাস নিতে পারছিনা।
-বল কি?
রাশেদ সাহেব তাড়াতাড়ি মাকে ডেকে এনে দেখাল,
-আম্মা দেখেন মনি এমন করছে কেন?
-কি হয়েছে?
ইশারায় দেখাল শ্বাস নিতে পারছি না।
-আম্মা ডাক্তার ডাকবো?
-না থাক এমনিই শুয়ে থাক ঠিক হয়ে যাবে।
-থাকবে কেন? তুমি থাক, আমি আসছি!
বলেই সার্টটা কোন মতে গায়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো ডাক্তারের সন্ধানে। বাড়ির কাছে তাদের চেনা ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ডাক্তারকে পেয়ে সাথে সাথে ধরে নিয়ে আসার মত করে নিয়ে এলো। ডাক্তার রুগী দেখে জানালো অনেক দিন থেকেই এমন চলছে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড মানসিক চাপ থেকে এমন হয়। রাশেদ সাহেব মেনে নিতে চাইলেন না।
-না, ওর কেন মানসিক চাপ থাকবে?
-তুমি পুরুষ মানুষ তুমি কি বুঝবে? মেয়েদের অনেক কারণে মানসিক চাপ হতে পারে।
প্রেসক্রিপশন লিখে দিল আর বলে দিল মানসিক চাপ কমাতে হবে, না হলে এ রোগ কিন্তু জটিল আকার ধারণ করতে পারে। শোন, তোমার স্ত্রীর এই অবস্থা তুমি কিছু জান না এটা কিন্তু মেনে নেয়া যায় না বাবা! ওষুধ গুলি এনে সময় মত খাওয়াবে আর কোন মানসিক চাপের কারণ হয় এমন কিছু করবে না।
এ কথা শুনে রাশেদ সাহেব কিছু বলতে পারলো না মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলেন।
ডাক্তারের সাথে রাশেদ সাহেব বের হলেন ওষুধ আনার জন্য। ওষুধ এনে মনিকে খাইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
-মনি বলতো তোমার কি এমন চাপ, প্রায়ই লক্ষ করি তুমি যেন কোথায় হারিয়ে যাও। আমার পাশে শুয়ে থাক তবুও মনে হয় তুমি আমার নাগালের বাইরে। কি এমন ব্যাপার বলতো মনি!
মনি নিরুত্তর।
-কী, কথা বলছ না যে!
-না কিছু না।
-কিছু না আবার কি? তাহলে এমন হয় কেন? বল, আজ তোমাকে বলতেই হবে, ডাক্তার কি এমনি এমনিই বলেছে? কি হয়েছে তোমার বল।
মনি নিরুত্তর।
-কথা বলছ না কেন?
-কি বলবো, বললাম না কিছু না।
-তাহলে এমন হলো কেন?
-কিছু হয়েছে তা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই, আর তুমি তা চেষ্টাও করনি কখনো।
-হ্যাঁ তোমার একথা আমি মেনে নিচ্ছি, আমিতো তোমাকেই সব ভার দিয়ে দিয়েছি কাজেই আমাকে আলাদা করে কিছু ভাবতে হবে তা কি আমাকে বলেছ কখনো? না কি আমি সে ভাবে ভেবেছি? আমি জানি আমার মনি আছে, ব্যাস আর কি? কি হয়েছে সে কথা তুমি আমাকে বল না কেন?

১৪।
তার বুকটা চিরে তো আর তার স্বপ্ন গুলো দেখাতে পারে না, তাকে কে বিশ্বাস করবে, সবার কাছেই যে সে আজ এক চলমান রাহু, তার ছায়া দেখা বা সকালে উঠে তার মুখ দেখাও যে আজ সবার কাছে অশুভ দিনের পূর্বাভাস। এ না বোঝার মত খোকা সে নয়। জীবনের অনেকটা পথ সে পেড়িয়ে এসেছে, অনেক আলো ছায়া, বাতাসের স্পর্শ, জলের তরঙ্গ সে দেখেছে, অনুভব করেছে প্রকৃতির কঠিন কোমল নিস্তব্ধ মুহূর্ত গুলি, পান করেছে নানা ঘাটের জল। আজ তার একমাত্র আশ্রয় মনিরার বিশাল হৃদয় নামক শান্ত নীড়, যেখানে একমাত্র তারই প্রবেশাধিকার। সেখানে তার জন্য সাজানো রয়েছে এক বিশাল কুঞ্জবন, পাতা রয়েছে বরফ নীল রঙের কোমল গালিচা, যেখানে রয়েছে তার স্বর্গ বিশ্ব যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি যায় সবটাই তার একার। যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন কঠিন যে আর কোন প্রাণীর প্রবেশ সম্ভব নয়।

যে মনিকে সে অকৃত্রিম ভাবে ভালোবাসে, মনিও তাকে ভালবাসে। মনিকে ছাড়া রাশেদ সাহেব কিছুই ভাবতে পারে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সমস্ত পৃথিবীকে চিৎকার করে বলে দেয় আমি মনিকে খুব বেশি ভালোবাসি, মনিই আমার জীবন, মনি শুধুই আমার, ওই আমার বেঁচে থাকা, ওই আমার সব, আমার জীয়ন কাঠি মরণ কাঠি সবই মনি। কখনো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গেলে ওদের জন্য ভিন্ন বিছানা দেয়া যাবে না তা সবাই জেনে গেছে।

বিয়ের পর মনির বড় বোনের ছেলের মুসলমানির অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের যখন নিমন্ত্রণ করতে এলো তখন রাশেদ সাহেব কোন লাজ লজ্জার বালাই না রেখে বলেই ফেললো যে,
-ওখানে যেতে বলছ বেশ যাব কিন্তু এতো মানুষ দাওয়াত দিয়েছ তারা সবাই এলে আমাদের থাকতে দিবে কোথায়? আমি কিন্তু মনিকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
এ কথা শুনে ওর বোন বলেছিলো-
-আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি, তোমরা সে চিন্তা করবে না। তোমরা ওই দক্ষিণ ঘরে থাকবে, হয়েছে?
-হ্যাঁ এবার যেতে আপত্তি নেই।
সেই ছাব্বিশ বছর আগে বিয়ের দিনেই রাশেদ সাহেব তার মনির কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন আজ থেকে আমি বলে আর কিছু নেই যা আছে সবই তোমার, তুমি তোমার মত করে গড়ে নিও।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৫

১০।
ভোরের দিকে জাহাজ চিটাগাং পৌছার পর পতেঙ্গায় তেল কোম্পানির জেটি গুলির কাছে কর্ণফুলী নদীর এক পাশে নোঙ্গর করে রেখে সবাই কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লো। সারা রাতই প্রায় গল্প করে চা খেতে খেতে এসেছে। সকাল
নয়টায় অফিস খোলার পর রফিক অফিসে গিয়ে লোডিং অর্ডার নিয়ে এলে জাহাজ নোঙ্গর তুলে জেটিতে এসে ভিড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইপ কানেকশন করে লোড শুরু করে রফিক আর মহিউদ্দিন চলে এলো। বিকেল নাগাদ লোড শেষ হলে রাতের জোয়ার নিয়ে খুলনা যাবে।
-দেখলেন রাশেদ ভাই, কিছু চন্দন কাঠ পুরিয়ে এই যে এই লোডিং অর্ডার আনলাম ওই দেখেন ময়ূরপঙ্খী আমাদের আগে এসে বসে আছে। সারা বছরই এই ভাবে চলে। কাঠ খর না পোড়ালে লোডিং অর্ডার দিবে না, এক সপ্তাহ বসে থাকলে কোম্পানিই বা বাঁচে কি ভাবে আর আমরাই বা বাঁচি কি ভাবে। কোম্পানিও জানে তাই চন্দনের যোগাড় দিয়ে দেয়, মাথা ঘামায় না। এদিকে বেতনও কমিয়ে দিয়েছে কাজেই এই ভাবে নানান কলা কৌশল ফন্দি ফিকির করে আমরাও টিকে আছি আবার কোম্পানিকেও টিকিয়ে রেখেছি। নতুবা কোম্পানির লাল বাতি জ্বলে যেত অনেক আগে। এই অবস্থায় আমার মনে হয়না, আপনার যে আদর্শ দেখে এসেছি এতোদিন তা বিসর্জন দিয়ে এখানে টিকতে পারবেন।
-ঠিকই বলেছ মহিউদ্দিন। এসব আমি করতে পারবো না। দেখি শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে বিলাতেই যেতে হবে। আমি যেতে চাই না। বিদেশে যারা থাকে তাদের কয়জন মান সম্মত কাজ করতে পারে তা দেখেছ। যে দেশে থাকে তারাই বা কী রকম ঘৃণার চোখে দেখে তাও জান, এই সব নানা কিছু ভেবে আমি বিদেশে যেতে চাই না। অথচ এদেশে আমি প্রথম শ্রেণীর নাগরিক আর ওখানে গেলে কি হব, সাধারণ দিন মজুর তাই না? কারণ পরিচয় দেবার মত কাজ পাওয়া আমার সম্ভব নয়, আমার যে যোগ্যতা তাতে তা পাবো না, এটাও একটা কারণ তার পর যাদের দেশে থাকবো তারা যদি আন্তরিক হতো তাহলেও একটা কথা ছিলো, কিন্তু সে কি আর সম্ভব? ওরা জানে যে এই সব তৃতীয় বিশ্বের আধা কাল মানুষ গুলি আমাদের দেশ থেকে রোজগার করে নিজ দেশে ধনী সাজতে এখানে এসেছে। এই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা আমি কোন দিন সহ্য করতে পারিনি মহিউদ্দিন। আমার নিয়তি যদি তাই লিখে থাকে আমার ভাগ্যে তাহলে তা খণ্ডাবার কোন উপায় নেই। এই বয়সে স্ত্রী সন্তান ছেড়ে থাকা যে কি কঠিন কাজ সে তো আর তোমাদের বলতে হবে না নিজেরাই এখন বুঝতে পার। তবুও যেতেই হবে।
কথার ফাঁকে স্টুয়ার্ড এসে দুপুরের খাবার রেডি হয়েছে কখন খাবে জানতে চাইল।
-চলেন ভাই খেয়ে নিই।
-চলো।
টেবিলে বসার পর মহিউদ্দিন বিরাট একটা ভাজা কৈ মাছ তুলে দিল রাশেদ সাহেবের পাতে, প্লেটের প্রায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত।
-একি মহিউদ্দিন, এতো বড় কৈ কোথায় পেলে?
-আপনার জন্য জোগাড় করেছি, কথা বলবেন না খেয়ে নেন।
বিকেলে লোড হবার পর হিসেব নিকেশ করে জেটি ছেড়ে আবার বাইরে গিয়ে জোয়ারের অপেক্ষা করবে। জেটি ছাড়ার আগে রফিক রাশেদ সাহেবকে নিয়ে লাল খাঁ বাজারের কাছে কোচ স্টেশনে এলো। রফিক স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টার থেকে কোচের টিকেট কিনে রাশেদ সাহেবের হাতে দিল। রাস্তায় খাবার জন্য কিছু কমলা, দু’টা স্যান্ডউইচ আর এক বোতল পানি কিনে দিল।
-রাশেদ ভাই কিছু মনে করবেন না, ভীষণ নির্দয় ভাবেই কথাটা বলছি, মহিউদ্দিন যা বলেছে আমার মনে হয় তাই ভাল হবে, আপনি শুধু শুধু এখানে আর কিছু খোজা খুঁজির চেষ্টা না করে পারলে ওখানেই চলে যান, আপনার তো আর ভিসার সমস্যা হবে না। কি করবেন, আপনার কাছেই শিখেছি, জীবন যেখানে যেমন তেমন করেই চলতে দিও’ কথাটা আপনি বলতেন কিন্তু তখন এর মানে বুঝিনি এখন বুঝি। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে এমন সব জটিল মুহূর্ত এসে পড়ে যে কি করবে, কোথায় যাবে হিতাহিত বিচার করার কোন সুযোগ থাকে না। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই, ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। নয়তো কে ভেবেছে যে সারা জীবন এমন ন্যায় নীতি আর আদর্শ নিয়ে চলে আপনার আজ এই পরিণতি হবে। আমার কষ্ট হচ্ছে যে আপনার এই দুর্যোগের মধ্যে আমি কিছু করতে পারলাম না, আমার ক্ষমতাই বা কতটুক, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আগেও আপনাকে যেমন শ্রদ্ধা করতাম এখনও তেমনি করি। এ কদিন ভেবে আমি এ ছাড়া আর কোন সহজ সমাধান পাইনি।
ওদের কথা বলতে বলতে ড্রাইভার এসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
-যান গাড়িতে বসুন গিয়ে, আসি তাহলে।
রাশেদ সাহেব রফিককে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদে ফেললেন।
-তাহলে আসি, তোমরা সাবধানে থাকবে, ভালো থাকবে।
বলে গাড়িতে উঠে পরলেন। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন রফিক কোচ অফিসের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে, কোচ ছেড়ে দিল।

১১।
রাশেদ সাহেব আর একটা ব্যর্থ মিশন শেষ করে এগিয়ে চললেন রাজধানী ঢাকা শহরের দিকে। যে শহর আজ তার জন্য বিভীষিকার মত। যে শহরের নাম মনে হলে তিনি চমকে উঠেন, যে শহর তার আর তার স্ত্রী সন্তানের জন্য দুমুঠো অন্যের সংস্থান করেনি। যে শহর তাকে ঠাঁই দিতে রাজী নয়, যে শহর তাকে তার স্ত্রী সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যে শহরে তার প্রিয় স্ত্রী সন্তানদের একা অসহায় ভাবে রেখে তাকে চলে যেতে হবে ভিন্ন কোন শহরে যেখানে তার পথ চেয়ে কেও বসে থাকবে না। বারবার ফোন করে কেও তার তদারকি করবে না। অসুস্থ হলে বা অসহনীয় ক্লান্তির পর কেও কপালে একটু মমতা ভেজা হাতের পরশ বুলিয়ে দিবে না।
যতক্ষণ দেখা গেলো দেখলেন রফিক দাঁড়িয়েই আছে তার কোচের দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যার ট্রাফিক জ্যামের জন্য কোচ স্পিডে চালাতে পারছে না বলে অনেকক্ষণ দেখলেন এ ভাবে। এক সময় চোখের সীমানার বাইরে চলে গেলো রফিক।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচের আরামদায়ক সিটে বসে পিছনে হেলান দিলেন। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। গাড়ির ভিতরের আলো নিভিয়ে বিলাস বহুল কোচের সৌখিন যাত্রীদের আয়েশের জন্য মৃদু এক টুকরো নীল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। চোখ বন্ধ হবার সাথে সাথে চোখের পাতার পর্দায় একটা সিনেমা দেখতে পেলেন।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৪

৮।
ওখান থেকে সোজা নারায়ণগঞ্জ চলে এলেন। এখানে যাদের চিনতেন তাদের খুঁজে বের করলেন।
-আরে রাশেদ, কি ব্যাপার? হঠাৎ দেখলাম তোমাকে!
-হ্যাঁ এইতো তোমাদের দেখতে এলাম।
কিছু আবোল তাবোল বলে শেষ পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন-
-আচ্ছা রফিক কোথায় জান?
-হ্যাঁ জানি। কেন কোন কাজ আছে?
-না, তেমন কিছু না, এখানে এলাম যখন একটু দেখা করে যাই।
-ওঃ আচ্ছা, ঠিকানা তো বলতে পারবো না তবে ও চাষাড়ায় থাকে, এমনি বাসা চিনি। ওর ফোন নম্বর আছে ফোন করে জেনে নাও। বলে নম্বরটা দিয়ে দিল।
-তাহলে আজ উঠি কি বল?
-আচ্ছা আবার এসো।
আরও কয়েক জনের সাথে দেখা হলো। যাদের কাছে বলতে পারে এমন দুই এক জনের সাথে আলাপ করলো। সবারই এক কথা। না রাশেদ, তুমি এই এতো দিন সরকারি চাকরি করে এখন আর এই সব চাকরি করতে পারবে না। আগের সে পরিবেশ আর নেই অনেক বদলে গেছে, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়েই রফিকের কাছে ফোন করলেন।
ও প্রান্ত থেকে রফিকের কণ্ঠ ভেসে এলো।
-ও, রাশেদ ভাই? আপনি কোথা থেকে, কেমন আছেন?
-বলছি, তুমি এখন কোথায়? বাসায়! আচ্ছা তাহলে আমি আসছি।
-আমার ঠিকানা জানেন?
-না বল।
ঠিকানা নিয়ে বললো-
-আমি এখন নারায়ণগঞ্জে আছি, তুমি আছ তো বাসায়?
-হ্যাঁ আছি আপনি আসেন।
একটা রিকশা নিয়ে চাষাড়া চলে এলেন। বাসা খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না, রফিক দোতলা বাসা ছেড়ে নিচে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। রফিক রাশেদ সাহেবের জুনিয়র হলেও অনেক দিন আগে একই জাহাজে এক সাথে প্রায় দুই বৎসর কাজ করেছে। রাশেদ সাহেবকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে, মাঝে কয়েকবার খুলনা গিয়েছিলো তখন দেখা করে এসেছে। উপরে যেতে যেতে রফিক বললো-
-মহিউদ্দিনকে ফোন করি ও আসুক।
-ও কোথায়?
-ওই তো ওই বিল্ডিংয়ে থাকে।
-ডাক তাহলে দেখি অনেক দিন যাবত দেখি না।
একটু পরেই মহিউদ্দিন এলো।
-কেমন আছেন রাশেদ ভাই?
-ভালো, তুমি কেমন আছ? তোমাকে তো চিনতেই পারতাম না যদি রফিক আগে না বলতো।
-চিনবেন কি ভাবে আজ কতদিন পরে দেখা, প্রায় বিশ বছর তাই না?
-হ্যাঁ তা হবে।
চা নাস্তার সাথে নানান ধরনের কথা বার্তা। এর মধ্যে রফিকের স্ত্রী এসে সালাম করে গেলো। রফিকের স্ত্রীকে এই প্রথম দেখা। রফিকের ছেলে মেয়েরাও স্কুল থেকে এলো। ওদিকে রফিকের স্ত্রী রান্না বান্নার বিশাল আয়োজন সেরে ডাকল খেয়ে আসার জন্য। রাশেদ সাহেব টেবিলে এসে দেখে অবাক।
-এসব কি করেছ? এতো কিছু, কেন?
-ভাই, আপনি আমাদের বাসায় এই প্রথম এলেন তাই, আপনার কথা ওর কাছে অনেক শুনেছি, শুনতে শুনতে আমারও মনে হোত আমিও যেন আপনাকে খুব চিনি।
-তাই বলে এই অসময়ে এতো ঝামেলা করতে হবে? যাক যা করেছ বেশ করেছ।
খাবার পর আবার এক দফা চা। এই বার রাশেদ সাহেব তার এখানে আসার আসল কথা খুলে বললেন। রফিক এবং মহিউদ্দিন বেশ মনোযোগ দিয়েই তার সব কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো।
-রাশেদ ভাই আপনি এ কি বলছেন! আপনি আবার জাহাজে চাকরি করবেন?
-বাঁচতে তো হবে, না কি?
-আপনাকে কি ভাবে বলবো বুঝতে পারছি না, না রাশেদ ভাই এখন আপনার দ্বারা এ কাজ করা আর সম্ভব নয়। আমি আর রফিক তো এক জাহাজে আছি আপনি একদিন চলেন, আমাদের সাথে। জাহাজে করে চিটাগাং যাই, এতে আপনার একটু বেড়ানোও হবে আর সেই সাথে নিজ চোখে বাস্তব অবস্থাটাও দেখে আসতে পারবেন। আপনি কি পরশু যেতে পারবেন? আমরা পরশু সন্ধ্যায় সেইল করবো।
-এখন বলতে পারছি না, বাসায় গিয়ে তোমার ভাবীর সাথে আলাপ করে দেখি, যদি যেতে পারি কাল বিকেলের মধ্যে ফোন করে জানাবো। তাহলে আজ উঠি?

৯।
বাসায় এসে সারা দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মনিরার সাথে আলাপ করলেন। মনিরা বললো-
-তা হলে ওদের সাথে যেয়ে দেখে আস, কাল রফিক ভাইকে জানিয়ে দাও।
পর দিন কিছু কাপড় চোপড় আর কয়েকদিন থাকতে হলে যা যা প্রয়োজন তা একটা ব্যাগে গুছিয়ে মনিরা রাশেদ সাহেবের হাতে দিয়ে বললো-
-দেখ কি হয়, যতদূর সম্ভব সহ্য করার মত মন মানসিকতা নিয়ে দেখে আস যদি কিছু হয়।
রাশেদ সাহেব মনির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার পাড়ে একটা তেলের ডিপোতে ভেড়ান রফিকদের তেল বাহী কোস্টার জাহাজে এসে উঠলেন।
মহিউদ্দিন জাহাজে ছিলো। রাশেদ সাহেবকে আসতে দেখে নেমে এসে হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে তার এক স্টাফের কাছে দিয়ে বললো-
-ইনি আমার সিনিয়র ভাই, ব্যাগটা আমার পাশের যে রুমটা রেডি করেছ সেখানে রেখে এসো।
রফিক তাদের ডিসচার্জ করা তেলের হিসেব নিকেশ করার জন্য অফিসে গেছে, ও ফিরে এলেই জাহাজ ছেড়ে দিবে। অনেক দিন পর এই পথে চিটাগাং যাবার জন্য এসেছেন, মনের মধ্যে একটা কেমন যেন তোলপাড় করা ভাব এসে উদয় হলো। আবার সেই পথে! যে পথ ছেড়ে দিয়েছি প্রায় আটাশ বছর আগে। মানুষের নিয়তি কখন কোথায় নিয়ে যায় কে জানে! কয়েক মিনিটের মধ্যেই রফিক ফিরে এলো।
মহিউদ্দিন উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-কি খবর?
-আর বলো না, আজ ছয় দিন যাবত পানির নিচে থেকে জাহাজের ট্যাঙ্কে তেলের টেম্পারেচার দুই ডিগ্রী কমেছে বলে তেলের ভলিউম কমবে না? তা ডিপো ম্যানেজার কিছুতেই মানবে না। উনি চিটাগাং থেকে লোড করার পর যে টেম্পারেচার ছিলো সেই টেম্পারেচার ধরেই হিসেব করছে, স্বাভাবিক ভাবেই সাত আট শ লিটার ঘাটতি দেখাচ্ছে। বারবার তাকে বোঝাচ্ছি ডিসচার্জ করার সময় যে টেম্পারেচার পেয়েছেন সেই হিসাব করুন, না তিনি তা মানবেন না। আধা ঘণ্টা ধরে এই ঝামেলা। আজকের টেম্পারেচার দিয়ে হিসেব করে দেখালাম তাতে ওই পরিমাণ গেইন হয় কিন্তু হলে হবে কি, সে কিছুতেই তা মানতে রাজী না। দেখলেন রাশেদ ভাই, শেষ পর্যন্ত তার হিসেবেই মেনে নিয়ে আসলাম। কি করবো মেনে নিলাম, না হলে হয়ত দেখা যাবে সামনের এক মাসেও কোন ট্রিপ দিবে না। আর একটা ট্রিপ যদি মিস করি তাহলে কোম্পানির কত লস হবে বুঝতে পারছেন। এই হচ্ছে এখনকার অবস্থা।
-তাহলে তোমরা এর কোন প্রতিবাদ কর না কেন? সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিকে ডাকতে, তারা এসে দেখত বাস্তবে কি পরিমাণ লস বা গেইন হয়েছে।
-বলছি কি, বুঝতে পারছেন না? কোম্পানির খোদ এমডি এলেও তো ফলাফল একই দাঁড়াবে। আগামী এক মাসেও একটা ট্রিপ দিবে না। কোম্পানি এটা জানে আর জানে বলেই আমাদের কিছু বলে না। এর আগে আপনি যখন ছিলেন তখন সুইপিং ছিলো ৫% আর এখন কত জানেন? মাত্র ২%, তার পরেও এই অবস্থা।
-তাহলে এরা এটা দিয়ে করে কি? কি আর করবে, বিক্রি করে দালান বানায়, ব্যবসা করে।
-কার কাছে বিক্রি করে?
-কি যে বলেন রাশেদ ভাই আপনি এত দিন বিদেশে থেকে আর সরকারি চাকরি করে দেশের এই সব নোংরামির খবর রাখতে পারেননি। যাক এ নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। চলো মহিউদ্দিন জাহাজ ছেড়ে দাও নয়তো আবার সারা পথ উজান ঠেলে যেতে গিয়ে জ্বালানী খরচ বেড়ে যাবে।
এতক্ষণ জাহাজ স্ট্যান্ডবাই করা ছিলো, যে কোন সময় বন্দর ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলো।
-চলেন ব্রিজে যাই।
-চলো।
ব্রিজে এসে জাহাজ ছেড়ে দিল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর কূল বেয়ে নারায়ণগঞ্জ শহর ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় আসতেই মহিউদ্দিন কলিং বেল টিপে তার স্টুয়ার্ডকে ডেকে চা নাস্তা দেবার জন্য বলে দিল।
বর্তমান চাকরির এই সব আরও ঘটনা নিয়ে, রাশেদ সাহেবের পরিণতি নিয়ে আলাপ। রফিক, মহিউদ্দিন এবং রাশেদ সাহেব সবাই সবার কথা মন দিয়ে শুনলেন।
মহিউদ্দিন বললো-
-রাশেদ ভাই, আপনি কি পারবেন এই অনাচার অবিচার মেনে নিতে? ট্রেনিং সেন্টারে আমরা যে আপনাকে কী ভয় পেতাম তা আমাদের ব্যাচের প্রতিটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। শুধু ভয় না ঠিক তার সাথে আপনাকে সব সিনিয়রের চেয়ে বেশি সমীহ করে চলতাম। আপনার নীতি বোধ, ব্যক্তিত্ব সব কিছু আমরা ফলো করার চেষ্টা করতাম। আপনি জানেন না, আপনার অবর্তমানে ইকবাল আর সেলিম আপনার ভয়েস নকল করে আপনার মত হেঁটে অভিনয় করে দেখাত। আর আজ সেই আপনাকে এই সামান্য চাকরি খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে। এটা কি ধরনের পরিহাস ঠিক বুঝতে পারছি না।
রফিক সাথে সাথে বললো-
-আমি কিছুতেই এই অংক মিলাতে পারছি না। আপনি সেদিন যাবার পর থেকেই আমি ভাবছি কিন্তু কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না। আচ্ছা ভাই এ দেশে কিছু খোঁজার চেয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। আপনার সব ভয়েজ তো ব্রিটিশ কোম্পানিতে আর গত বার না আপনি ওখানে গিয়েছিলেন, কাজেই আমার মনে হয় আপনার ভিসা পেতে কোন সমস্যা হবে না।
মহিউদ্দিনও বললো-
-হ্যাঁ ভাই আমারও তাই মনে হচ্ছে এটাই ভাল হবে।
-তোমরা ঠিক বলেছ, তবে নিজ দেশ ছেড়ে কে বিদেশে যেতে চায় বল? তোমরা বা আমি সবাই তো বিদেশে থেকে এসেছি তাই না? কাজেই বিদেশের কি সুখ তা যেমন আমি জানি তেমনি তোমরাও জান। আমাদের এই দেশের মত আর কোথায় এতো সুখ এতো শান্তি আছে বলতে পারবে? হ্যাঁ মানি যে চাকচিক্য বা জৌলুশ আছে চোখ ধাঁধানো রঙের বাহার আছে, প্রাচুর্য আছে কিন্তু শান্তি আছে? দেখি শেষ পর্যন্ত হয়ত তাই যেতে হবে।
ঢাকা শহর বল বা এই আমার নিজ দেশ বল এখানে আমার জায়গা নেই। হিসেব করে দেখ কত দিন আমি এদেশে থাকতে পেরেছি? তোমাদের সাথে তো আজকের সম্পর্ক নয়, গত প্রায় ত্রিশটা বৎসর যাবত আমাকে দেখে আসছ, মাঝখানে একটু দেখা সাক্ষাত না হলেও আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু সবার খোঁজ খবর জানতাম। সত্যিই এ দেশ আমার জন্য নয়। এদেশের মাটিতে আমার মত হতভাগার ঠাঁই নেই। দেশকে আমি যত ভালোবাসি, এ দেশের আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি সবই আমার কত প্রিয়। দেশের মায়ায় বিদেশে থেকে যাবার মত কোন চিন্তা ভাবনা করিনি, চেষ্টা তো দূরের কথা। তোমরা জান না, মিজান জানে, আবুধাবিতে এডনক রিফাইনারিতে ভালো একটা চাকরি পেয়েছিলাম। পুরো ফ্যামিলি নিয়ে ওখানে থাকতে পারতাম। ক্যাপ্টেন বার্কি কত বলেছে চলো আমাদের ইউকেতে চলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাব, গেলে হয় তো এতো দিনে ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে যেতাম, তবুও যাইনি শুধু দেশের মায়ায়। আর দেশ বারবার নানা ছল ছুতা ধরে আমাকে দেশের বাইরে পাঠাবেই। আমার ভাগ্য যদি এমনই হয় তাহলে যেতে হবে। এখানে যখন আমার একটু খানি জায়গা হবে না তাহলে আর কি করবো চলেই যাই।
এ পর্যন্ত বলে রাশেদ সাহেব হেসে ফেললেন।
তার মনে পরে গেলো লিটনের বাবার কথা। রাশেদ সাহেব যখন মংলায় চাকরি করতেন তখন সেখানকার এক গানের শিল্পী তার সাথে অপরূপা তিলোত্তমা ঢাকা শহর দেখার জন্য বেড়াতে এসেছিলো। তাদের এক প্রতিবেশী ছিলেন যিনি রেডিও বাংলাদেশে একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। রাশেদ সাহেবের অতিথি গান গায় জেনে তার গান শোনার জন্য ডেকে পাঠালেন। গান শুনে আলাপের সময় বললেন এতো বড় ঢাকা শহরে আমাদের রাশেদের একটু জায়গা হলো না!
রফিককে কথাটা বলেই রাশেদ সাহেব আরও জোড়ে হাসতে লাগলেন। এই হাসির আড়ালে যে কত কষ্ট লুকিয়ে ছিলো তা এক মাত্র রফিক আর মহিউদ্দিন ছাড়া আর কেও জানতে পারেনি।
হাসি থামার পর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা, কারো মুখে কোন কথা নেই। এমন সময় স্টুয়ার্ড এসে নীরবতা ভেঙ্গে দিল,
-স্যার ডিনার টেবিল কি রেডি করব?
মহিউদ্দিন হাতের ঘড়ি দেখে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-রেডি করতে বলি?
-বল।
একটু পরে নিচে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে রাশেদ সাহেব অবাক।
-একি মহিউদ্দিন, এ কি করেছ? এ তো রাজকীয় ভোজের আয়োজন!
-রাশেদ ভাই যে কি বলেন, ভেবেছেন আপনার কথা ভুলে গেছি? তবুও আমার মন বলছে আপনার মন মত কিছুই হয়নি। আপনার মনে আছে সেই পিকনিকের কথা?
-কোন পিকনিক?
-ওই যে আহসান স্যার যেবার গিয়েছিলেন।
-সে আর মনে থাকবে না? এ কি ভোলা যায়? সেগুলি তো এখন স্মৃতি। তবে কি জান মহিউদ্দিন এখন আর আমার সে দিন নেই।
-কেন ভাবী বুঝি রাঁধতে পারে না?
রফিক বললো-
-না মহিউদ্দিন তোমার অনুমান সঠিক নয়, ভাবীর রান্নার তুলনা নেই।
-তাহলে?
-আমার যে ডায়াবেটিস।
-ও, তাই নাকি?
-তোমার ভাবী আর কি দিয়েছে জানি না তবে ওষুধ গুলি দিতে ভুল করে নাই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ব্যাগ খুলে দেখতে পার।
এমন সময় মহিউদ্দিনের মোবাইল বেজে উঠলো। পকেট থেকে বাম হাতে ফোন বের করে কানে নিয়েই বললো -ভাবী আপনার আয়ু অনেক দিনের, এই মাত্র আপনার কথাই হচ্ছিল, না ভাই বলছিলো যে তোমার ভাবী ওষুধ দিতে ভুল করার কথা নয়। নেন ভাবী ভাইয়ের সাথে কথা বলেন।
-হ্যালো!
ও পাশ থেকে মনিরার কণ্ঠ ভেসে এলো।
-কি করছ?
-এইতো রাজকীয় ভোজের সামনে বসেছি এখনই শুরু করবো, তোমরা কি করছ?
-আমরাও খেতে বসবো, ওষুধ গুলি খেও সময় মত।
-হ্যাঁ সেই কথাই বলছিলাম, খাবো চিন্তা করো না।
রাশেদ সাহেব যাবার পর থেকেই মনিরার মনটা ছটফট করছিলো একটু কথা শোনার জন্য, কোথায় আছে, কি করছে জানার জন্য।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৩

৬।
রাশেদ সাহেব আর মনিরা কল্যাণপুর থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত প্রায় দশটায় ফিরলেন। ওদের দেখে আপা মুরগির মাংস আর খিচুড়ি রান্না করলেন।

রাশেদ সাহেব মনিকে ডেকে আড়ালে নিয়ে বললেন-
-কেন, তুমি নিষেধ করলে না কেন?
নিজের পকেটের স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে কারো বাড়িতে খেতে মন চায় না তা মনি জানে কিন্তু আপার খিচুড়ি রাশেদ সাহেবের খুব প্রিয় বলে আর অমত করেনি।
রাতে শোবার পর বললেন-
-আচ্ছা মনি বলত এভাবে আর কত দিন চলতে পারে? এভাবে তো জীবন চলে না! মেয়েদের লেখা পড়া কি বন্ধ হয়ে যাবে?
-তুমি যে রিজাইন করেছ ওখানে একটু খোঁজ নিয়ে দেখ।
মনি তার স্বামীর আত্মসম্মান বোধ সম্পর্কে ভালো করেই জানে। তবুও বললো-
-জানি তুমি রাজী হবে না তবে আমার মনে হয় তোমার সাবেক বসরা তো তোমাকে আসতে নিষেধ করেছিলো, দেখ না একবার একটু জিজ্ঞেস করে। না হলে বল আমিই ফোন করে বলি।
-না মনি তা হয় না। এই বেকারের দেশে অমন চাকরি কি আর এতো দিন খালি পরে রয়েছে? শুধু শুধু ফোন করে খারাপ কিছু শোনার চেয়ে না করাই ভালো। আমি যতটা শুনে এসেছিলাম তাতে মনে হয় ওখানে হাসান সাহেবকে প্রমোশন দেবার কথা ছিলো
-কোন হাসান সাহেব?
-তুমি চেন না, ওই জাকিরদের সাথে ছিলো।
-তুমি একটু বলেই দেখ না!
-আচ্ছা ঠিক আছে কাল মনে করে দিও।
পরদিন সকালে ফোন করলেন তার সাবেক বসের কাছে।
-আরে রাশেদ সাহেব আমি তো আপনাকে কতবার নিষেধ করেছিলাম তবুও আপনি চলে গেলেন। আমি তো জানি এদেশের ব্যবসার কি অবস্থা তখন তো আপনি আমার কথা শুনলেন না। আমরা তো এই মাত্র মাস দুয়েক আগে হাসানকে প্রমোশন দিয়ে ওখানে নিয়ে নিয়েছি। আর দুইটা মাস আগে খোঁজ নিলে অবশ্যই আপনাকে নিয়ে নিতাম।

-তাহলে তোমার তো জাহাজে চাকরি করার সার্টিফিকেট আছে, সেখানে একটু দেখবে?
-হ্যাঁ এটা করা যায়। দেখি রফিকের কাছে একটু আলাপ করে দেখি এখানে কি অবস্থা। কিন্তু ওর তো কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর জানি না তবে নারায়ণগঞ্জে থাকে এই জানি। আমাকে একবার ওখানে যেয়ে খুঁজে বের করতে হবে।
-তাহলে যাও দেখ পাও কি না।
-পাব, ওখানে গেলে অবশ্যই খুঁজে পাব। হঠাৎ একটা কথা মনে হলো, তোমার শরীফ স্যারের কথা মনে আছে?
-হ্যাঁ।
-উনি এখন ওখানে নেই, ঢাকায়ই আছে এখানে অন্য একটা অফিসের হেড, তার সাথে একবার দেখা করে আসি।
-তাই যাও উনিও তোমাকে খুব পছন্দ করতেন।
-তাহলে এখনই যাই।

৭।
অফিস খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না, কারওয়ান বাজারে একটা বিল্ডিং এর চার তলায় উঠে অফিসে ঢুকেই দেখলেন তার পুরনো সহকর্মী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মকসুদ সাহেব এক টেবিলে বসে ড্রইং দেখছে। পায়ের শব্দ পেয়ে তাকিয়েই-
-আরে রাশেদ সাহেব আপনি এখানে? কি ব্যাপার? বসেন।
বসে রাশেদ সাহেবও অবাক।
-তাহলে আপনি রিজাইন করে এখানে এসেছেন?
-হ্যাঁ।
-ও আচ্ছা, শরীফ স্যার এখানে না?
-হ্যাঁ এখানেই, দেখা করবেন? তাহলে যান স্যার রুমেই আছে। আসেন পরে চা খাই।
-হ্যাঁ তাই।
স্যারের রুমে ঢুকতে যাবার আগে কে যেন পিছন থেকে ‘স্যার বলে ডেকে সালাম দিল, পিছনে ঘুরে দেখে তাদের অফিসের এক পিওন।
-বারেক মিয়া তুমি এখানে?
-হ্যাঁ স্যার আমি একা না ওই তো বাসার সাহেব সহ আরও কয়েক জন চলে এসেছিলাম।
স্যারের পিএ বাসার সাহেবের রুমে উঁকি দিলেন। বাসার সাহেব উঠে সালাম দিয়ে বললো
-স্যার আপনি?
-এইতো আপনাদের দেখতে এলাম, আমি জানতাম কেও কেও এখানে এসেছেন তবে কে কে এসেছেন তা জানতাম না। যাক কেমন আছেন সবাই?
-হ্যাঁ স্যার ভালই আছি। স্যারের সাথে দেখা করবেন?
-হ্যাঁ আসলাম যখন একটু দেখেই যাই।
-যান স্যার আছেন।
পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই স্যার হাসি মুখে উঠা দাঁড়ালেন,
-আরে রাশেদ! এসো এসো বস। তারপর বল কি খবর, কি করছ, কেমন আছ সব বল।
রাশেদ সাহেব কোথা থেকে শুরু করবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। এদিকে চুপ করে কতক্ষণই থাকা যায়? যা বলতে এসেছেন তা যে তাকে বলতে হবে। ভাবছেন।
এমন সময় স্যার নিজেই প্রশ্ন করলেন-
-তুমি ব্যবসা করবে বলে রিজাইন দিয়ে এসেছিলে না?
-হ্যাঁ স্যার।
-তা কি অবস্থা?
-না স্যার সুবিধা করতে পারলাম না, বলে এবার আস্তে আস্তে সব কিছু গুছিয়ে বলে সর্ব শেষে তার আসল কথাটা বললেন। এখন কি করি, আপনার এখানে কোন ব্যবস্থা করে দেন স্যার, আর কিছু করার দেখছি না।
-হু বুঝলাম, কিন্তু তুমি এমন সময় এসেছ তোমাকে আমি এখন কোথায় প্রোভাইড করি, আমি নিজেই আর মাত্র দেড় মাস আছি এর পরেই এলপিআর এ চলে যাচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না।
এর পর আর কিছুক্ষণ থেকে টুকিটাকি কিছু কথা বার্তা বলে বেরিয়ে এলেন।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-২

পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধুলি – ১ (১২৫)

বিগত দশ বছর ধরে বিলাতে থাকা মেঝ ভাইয়ের টাকা দিয়ে এই জমি কিনেছিলেন। সেখানেও এক কথা হয়েছিলো। বাবা চেয়েছিলেন তার নামে দলিল করতে কিন্তু রাশেদ সাহেব তা বাঁধা দিয়েছিলেন। না আব্বা এটা করবেন না। সে
জানে বিদেশে থেকে টাকা উপার্জন করা কত কঠিন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, সমস্ত সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে, দিন রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে উপার্জন করতে হয়। কত রাত কেটে যায় ঘুমহীন, কত কি খেতে ইচ্ছে হয়, কত কি অনিচ্ছা সত্যেও পেট ভরার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য খেতে হয়, কত জনের অশ্রাব্য কথা হজম করতে হয়। সেই রোজগারের টাকা কেন তার নামে করবেন না? ওর নামে করুন, এখানে আপনার নামে দলিল করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। এই জমি কেনার পর থেকেই পড়েছিলো, এখান থেকে কোন আয় ছিলো না বা আয় করার কোন পথও ছিলো না। ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে ওকে দিয়ে বাবাকে রাজী করিয়ে বাবা এবং ভাইএর দেয়া কিছু আর কিছু টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এটা গড়ে তুলেছিলেন। সে ছিলো শুধু পরিচালক, কোন মালিকানা তার নেই। ভেবেছিলেন একবার ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে তখন এটা পারিবারিক ব্যবসা হবে কাজেই তার নিজের আর কি দরকার?

সব ব্যবসায়ীরা মিলে প্রধান মন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাল, ভারতীয় আমদানির বিরুদ্ধে মিছিলও করলো। সারা দেশ জুরে চিৎকার করলো মাননীয় প্রধান মন্ত্রী এর বিহিত করুন, দেশের শিল্প বাঁচান, দেশের উৎপাদন ব্যবহার করুন। খবরের কাগজে লেখালেখি হলো কিন্তু প্রধান মন্ত্রীর কানে সে চিৎকার পৌঁছল না। সে তার গদি বাঁচাবার ধ্যানে পূর্ণ উদ্যমে মশগুল রইলো। ফলে যা হবার তাই হলো।

রাশেদ সাহেব নিশ্চিত এগিয়ে চললেন ধ্বংসের দিকে। প্রাণান্তকর চেষ্টা করলেন। কর্মচারীরাও বসে থাকেনি তারাও কোথা থেকে ধার কর্জ করে টাকা এনে রাশেদ সাহেবের হাতে তুলে দিয়ে বললো ভাই দেখেন চেষ্টা করেন। ডুবন্ত প্রায় মানুষ যেমন তার কোলের শিশুর উপর দাঁড়িয়ে নাক উঁচু করে শ্বাস নেয়ার জন্য বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে ঠিক তেমনি মনিরা তার গহনা গুলি এনে দিল। নাও দেখ কদিন চলে। গহনা বলতে আর কি মনিরা যা নিয়ে এসেছিলো তাই, সে নিজে কিছু দিতে পারেনি। কিছু অদরকারি জিনিষ পত্র বিক্রি করে কিছু দিন চালালেন এতেও হলো না। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বেড় হলেন ধার করার জন্য। কিন্তু তাকে কে ধার দিবে? সবার একই কথা তোমার হাতি পোষার খরচ আমরা কি ভাবে জোটাবো? তোমার দরকার অনেক তা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কতজনের কাছে কাকুতি মিনতি করে বোঝালেন, এরকম থাকবে না অবশ্যই পরিবর্তন হবে। মনে কর তোমরা চালান খাটাচ্ছ। দিনের পরিবর্তন হলেই আমি তোমাদের লাভ সহ ফেরত দিব। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। সবাই তাকে দেখলেই ভাবতো এইতো টাকা চাইতে এসেছে। আগেই বলে নিত টাকা চাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ থাকলে বল। বিভিন্ন দোকানে বাকীর খাতা বেশ ঊর্ধ্ব গতিতেই বাড়তে থাকল, দোকানদাররাও আর মাল দিতে চায় না। তাদেরও একই কথা আগের কিছু শোধ করে মাল নিন এভাবে আমি আর কত বাকী দিতে পারি বলুন আমার ক্ষমতাই বা কতটুকু। আমি তো আমার ব্যবসার চালান এক জায়গায় ফেলে রেখে আমার ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারি না। রাশেদ সাহেব দেনার দায়ে জর্জরিত, কি করবেন তিনি? রাতে ঘুম নেই। এই দুর্দিনে তার একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী মনিরা। দুজনে হাজার পরামর্শ করেও কোন কূল কিনারা পায় নি।

রাশেদ সাহেব মনিরাকে না জানিয়ে ভাবছেন, অনেকেই তো নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি বা চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করার জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। দেখি না তেমন কিছু পেলে একটা কিডনি বা একটা কর্নিয়া বিক্রি করে। এক কিডনি বা এক চোখ দিয়ে চলা যাবে। প্রতিদিন খবরের কাগজে এমন বিজ্ঞাপন খুঁজেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজেন। যাও বা দুই একটা পাওয়া যায় তা তার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে না। অবশেষে যখন হতাশ হতে বসেছেন তখন একদিন যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন। জার্মানি থেকে এক ভদ্র লোক কিডনি চেয়ে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন যাতে তার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে যায় কিন্তু যোগাযোগের জন্য স্থানীয় বা ঢাকার ফোন নম্বর না দিয়ে জার্মানির ফোন নম্বর দিয়েছেন। সমস্যায় পড়লেন। বাড়ির ফোন থেকে ওভার সিজ কল করা যায়না। বাইরের ফোনের দোকান থেকে ফোন করতে হবে এবং এ জন্য তিন চারশো টাকার দরকার। কোথায় পাই এই টাকা? ভেবে না পেয়ে মনিরাকেই বললেন, -কিছু টাকার যোগাড় করা যাবে?
-কি করবে টাকা দিয়ে?
-দেখ না একটু কাজ আছে।
-কি কাজ শুনি!
-আছে, তুমি দেখ।
-বলই না কি কাজ, কী আমাকে বলা যাবে না?
-না।
-তাহলে টাকাও যোগাড় করা যাবে না।
ব্যাস ঐ পর্যন্তই, আর এগুতে পারেননি, ওখানেই সমাপ্তি। সেদিন দুপুরে খাবার পর এই সবই ভাবছিলো।

৫।
মনিরা ডাকল,
-একটু শুয়ে বিশ্রাম নাও, ওখানে বসে কি করছ?
-একটু চা দিতে পার?
-আচ্ছা দিচ্ছি।
কিন্তু ঘরে চা পাতা বা দুধ নেই সে কথা মনিরা জানে, তবুও বললো দিচ্ছি। একটু পরে পরদিন মেয়েদের স্কুলে যাবার ভাড়া থেকে টাকা নিয়ে বাসার কাজের মেয়ে মমতাজকে পাশের দোকানে পাঠাল। রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন মমতাজ কোথায় গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মমতাজ চা পাতা আর গুড়া দুধের একটা ছোট প্যাকেট নিয়ে যখন এলো তা দেখে রাশেদ সাহেব মনিরাকে বললেন-
-তাহলে আর কি দরকার ছিলো? ঘরে যখন ছিলো না তখন নাই দিতে!
-তুমি একটু চা চেয়েছ তা কি করে না দিই বল!
-টাকা কোথায় পেলে?
-সে থাক তোমার অত কিছু জানার দরকার নেই, একটু বস আমি চা নিয়ে আসছি।
মমতাজকে দিয়ে চা বানিয়ে সে চা মনিরা তার স্বামীকে দিতে পারে না। নিজেই চা বানিয়ে এনে স্বামীর হাতে কাপটা দিয়ে আস্তে করে বললেন নাও। চায়ে এক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রেখে পাশে দাঁড়ানো মনিরাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে বললেন-
-তুমি এতো ভাল কেন মনি? এই অপদার্থ স্বামীকে তুমি এখনও এতো ভালবাস? যার কোন রোজগার নেই স্ত্রী সন্তানকে খাওয়াবার যোগ্যতা নেই তার জন্য এতো মায়া কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
মনিরার চোখ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে এলো, স্বামী দেখে ফেলে তাই তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বললো-
-কে বলেছে তুমি অপদার্থ, তুমি অপদার্থ বা অযোগ্য হবে কেন? তোমাকে কি আজ নতুন দেখছি? বুদ্ধি হবার পর থেকেই তো তোমাকে দেখে আসছি, তুমি কোন দিন অযোগ্য বা অলস ছিলেও না এখনও নেই। মানুষের জীবনেই এমন দুর্যোগ আসে আবার তা কেটেও যায়। তুমি এতো ভেঙ্গে পরো না একটু ধৈর্য ধর দেখবে সময় এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার নতুন সূর্য উঠবে। মন খারাপ করো না, চা টা খেয়ে শেভ হও তারপর চলো কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি। সেই সকাল থেকেই এই যে এক ভাবে কেমন মন মরা হয়ে বসে আছ।

এমন সময় ও পাশের ঘর থেকে সেঝ বৌ রেখা ডাকল ভাবী একটু এদিকে আসবেন! সঙ্গে সঙ্গে রাশেদ সাহেবকে ছাড়িয়ে ওদিকে চলে গেলো। রাশেদ সাহেবের সামনে চায়ের কাপ হাতে ধরা কিন্তু আর চুমুক দিচ্ছেন না ভুলে গেছেন।

রান্না ঘরের জানালা দিয়ে ওই নারকেল গাছের মাথায় দুটা কাক বসে ছিলো। মনে হচ্ছিল যেন কাক দুটিকে দেখছে। বৃষ্টিতে ভেজা কাক। এক মনে ওই দিকেই তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। সব ছবি গুলি মনে হচ্ছে একে একে নারকেল গাছের মাথায় কোন স্ক্রিনে ভেসে ভেসে আসছে আর যাচ্ছে। ওই ভেজা কাক দুটি যেন প্রজেক্টর চালাচ্ছে। কতক্ষণ এ ছবি দেখছিলেন তা খেয়াল নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর মনিরা এসে এই দৃশ্য দেখেই বললো-
-কি ব্যাপার চা খাও নি? এ কি! চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কি ভাবছ এমন করে?

রেখা কি যেন সেলাই করছিলো তাই দেখিয়ে দেবার জন্য বড় জাকে ডেকেছিলো। মনিরার ডাকে রাশেদ সাহেবের সিনেমা দেখা থেমে গেলো। হঠাৎ চমকে উঠলেন। মনিরা জানে রাশেদ সাহেব ঠাণ্ডা চা খেতে পারে না। কাপটা নিয়ে রান্না ঘরে এলো। এই ঠাণ্ডা চা আবার গরম করে স্বামীর জন্য নিয়ে যেতে পারবে না। তা কি করে হয়? সেই যে তার সব, সে ছাড়া আর কি আছে মনিরার? অগাধ ভালোবাসা। বলতে গেলে বাল্য বিবাহই তাদের, আজকাল এতো কম বয়সে সাধারণত বিয়ে হয় না। মনিরা মাত্র স্কুল ফাইনাল দেয়ার পরই এ বাড়িতে বড় বৌ হয়ে এসেছে। সেই ছোট বেলা থেকেই যাকে দেখে আসছে সে মানুষটাকে আজ পঁচিশটা বছর ধরে বুকে করে রেখেছে তাকে এই ঠাণ্ডা চা আবার গরম করে দেয়া যায়? আবার নতুন করে আর এক কাপ বানিয়ে এনে স্বামীর হাতে দিলেন আর পুরনো কাপের চা গরম করে নিজের জন্য নিয়ে এসে স্বামীর পাশে বসে কথা বলতে বলতে দুজনেই একসাথে চা খেলেন। এর মধ্যেই মনিরা প্ল্যান করে ফেলেছে,
-চলো কল্যাণপুর বড় আপার বাসায় যাই। তুমি ওঠ শেভ হয়ে নাও।
-আচ্ছা উঠছি, চলো যাই একটু ঘুরেই আসি, কাছে আর কোথায় বা যাব? এই, চলো না হেঁটে যাই!
-হেঁটে যাওয়া যেত কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে যে, থাক রিকশায়ই চলো
রাশেদ সাহেব স্ত্রীর তাগিদে উঠে শেভ করে, ওজু করে নামাজ পরে কাপড় বদলে দেখে মনিরা রেডি হয়ে রেখাকে বলছে,
-তোর দাদাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি, খেয়াল রাখবি আর বড় মেয়ে এলে খেতে দিস
[চলবে]