ট্যাগ আর্কাইভঃ মেগা সিরিয়াল

নক্ষত্রের গোধূলি-২১

৩৩।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করলো
-এবার বল দেখি কি ব্যাপার, হঠাৎ করে চলে এলে, নাকি কোন কাজ আছে? কামরুলের কাছে শুনেছি তুমি তো ভাল চাকরি করতে তারপর আবার বিরাট ব্যবসা করছিলে।
-সে ব্যবসা আর নেই সব শেষ, সেই জন্যই তো আসা। একটা কাজকর্ম কিছু যোগাড় করে দাও। সম্ভব হলে দুজনকেই নয়তো অগত্যা আমার যা হোক একটা কিছু।
সব খুলে বললো । শুনে ফিরোজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো-
-এই ব্যাপার! আমি তো ভাবতেও পারছি না তোমার এমন হলো কি করে। যোগাযোগ বা দেখা না হলে কি হবে আমি তোমার সব খবরই জানি। তুমি মালেকের বোনকে বিয়ে করেছ এ ও জানি তবে তোমার এই শেষ দিকের কিছু জানার সুযোগ পাইনি।
একটু ভাবল।
-ঠিক আছে এই অবস্থায় এসেছ যখন কিছু একটা করতে হবেই। তবে শুধু তোমার জন্য, ভাবীর জন্য কোন অবস্থাতেই না। সে কিছু দিন বেড়িয়ে দেশে চলে যাক ওখানে তোমার মেয়েরা রয়েছে। যদিও তারা বড় হয়েছে তবুও তাদের মা কাছে থাকা দরকার। তুমি থাক।
এমন সময় শেফালি ভাবীর কাছে ড্রাইভিং শিখছে এমন এক ছাত্রী ফোন করে জানতে চাইল সে কখন যাবে। বাংলাদেশ থেকে মেহমান এসেছে বলে আজ যাবে না জানিয়ে দিল। ফিরোজও সেদিন কাজে গেলো না।
ফিরোজের মা এসে বললো যাও ওকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আস।
তারাও এর মধ্যে মনিরার কাছে ওদের আসার উদ্দেশ্য সব শুনেছে।
-এসেছ কদিন বেড়িয়ে লন্ডন দেখে নাও, ভাবীকেও দেখিয়ে দাও তারপর দেখি কি করা যায়।
শুনে ওরা উভয়েই যেন হাতে স্বর্গ পেলো। মনিরা বললো-
-দেখেন ভাই যে করেই হোক ওর যেমন তেমন একটা কিছু না হলে যে আর কোন উপায় নেই।
-চিন্তা করবেন না কিছু একটা হয়ে যাবে, এখন চলেন একটু ঘুরে আসি। আপনার ভাবী আবার ফার্স্ট ক্লাস ড্রাইভার।
-হ্যাঁ সেতো কালই দেখলাম। তবে আজ না ভাই। শরীর এখনও টলমল করছে। কাল না হয় যাওয়া যাবে, আজ ঘরেই থাকি।

মনি তো বেড়াতে আসেনি। ওর মনে চলছে সেই ঝড় যে ঝড় তাদের এখানে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। তার পাগল আজ ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া, দেউলিয়া। কি করে ঋণ শোধ হবে, মেয়েদের মানুষ করবে, তার রাশেদ কি ভাবে একা এখানে থাকবে এই সব চিন্তায় সে জর্জরিত। তার এখন বেড়াবার মত মন নেই। এ কথা কি আর বলা যায়? এ যে তার একান্ত নিজের যন্ত্রণা। সুখ কারো সাথে ভাগ করে নেয়া যায় কিন্তু দুঃখ? সে তো একান্ত আপনার। সে ভাগ কাউকে দেয়া যায় না! আনন্দ করতে হয় সবাইকে নিয়ে, কাঁদতে হয় নীরবে, একা একা।

নক্ষত্রের গোধূলি-২০

৩১।
রাশেদ আর ফিরোজ একই স্কুলে পড়েছে। স্কুল ছাড়ার পর এই প্রথম দেখা। লন্ডন আসার দিন ঠিক হবার পর কামরুলের কাছ থেকে ফিরোজের ফোন নম্বর, মেইল ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করেছিলো। প্রায় ত্রিশ বছর পর দেখা। খেতে বসে আরও আলাপ হলো। শেফালি ভাবী একটা ড্রাইভিং স্কুল চালায়। মনিরা যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মনিরা জানে ওর সব বন্ধুরাই এমন। একেক জনের সাথে বিশ, পঁচিশ বা ত্রিশ বৎসর পরে দেখা হলেও কারো ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে এতো দিন পর দেখা হয়েছে, এমনকি এর মধ্যে এদের কারো সাথে কোন যোগাযোগও নেই তবুও কেও কাউকে কোন অবহেলা করে না ভুলে যায় না। সবাই একই রকম, আন্তরিকতায় কেও কম না। আনন্দে, কৃতজ্ঞতায়, পাগল স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় মনিরার চোখ ভিজে উঠলো।
-সত্যিই ভাবী আমি যে এখানে এসে এমনটা পাব তা কল্পনাও করতে পারিনি। মনে হচ্ছে আপনি আমার কত দিনের চেনা, কত আপন, বলেই শেফালিকে জড়িয়ে ধরল।
-না ভাবী আপনার ভাই শুধু বলেছে ওর অনেক দিনের পুরনো এক বন্ধু বৌ নিয়ে আসছে। আমাকে আর কিছু বলেনি।
-মনিরা বলে উঠলো তাহলে দুইজনে একই রকম?
-শেফালি বললো তা না হলে বন্ধুত্ব হবে কি করে?
মনিরার চোখ এর পরে আর পানি সামলাতে পারেনি ফোটা ফোটা করে গড়িয়ে পরছে।
তাই দেখে ফিরোজের মা বললো
-ওকি মা তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো জানতাম না যে তুমি আমাদের আপন জন। ফিরোজ আমাকেও কিছু বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করাতে শুধু বলেছিলো তোমাদের পাশের গ্রামেই।
-তা বলত মা গ্রামের কি অবস্থা, কে কেমন আছে, কোথায় কি হচ্ছে, কৌড়ির ব্রিজটা কি হয়েছে, ঢাকা থেকে ঝিটকা যেতে এখন রাস্তার কি অবস্থা? এরকম আরও নানা কৌতূহল। তোমার ছেলে মেয়ে কজন, বাড়িতে কে কে আছে, তোমার বাবা চাচার কি অবস্থা?
-আমার বাবা তো অনেক আগেই চলে গেছেন ফুফু, চাচাও এইতো কয়েক বৎসর হলো। কাসেম চাচাকে কিছু দিন আগে দেখেছিলাম, আমাদের বাড়ি এসেছিলো। আমিও ফুফু আম্মা আপনার মতই প্রায়, দেশে থেকেও গ্রামে খুব একটা যেতে পারি না
-আচ্ছা চলো শুয়ে পর আজ আর না কাল গল্প করব, এতদিন পর গ্রামের মেয়ে পেলাম আমার যে কি ভালো লাগছে মা। আজ তোমরা ক্লান্ত, যাও বিশ্রাম নাও।
-ভাবী চলেন। এখানে কিন্তু আপনাদের ঢাকার মত বড় বড় ঘর নেই। ছোট ঘর, শীতের দেশে ঘর গরম রাখতে গেলে বড় ঘরে অনেক খরচ হয় তাই সবাই ছোট ছোট ঘর বানায়।
-কি যে বলেন ভাবী, ছোট আর বড়। আমি যে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় থাকবো আমি তো আসতেই চাইছিলাম না। শুধু ওর পাগলামির জন্য আসা।
-এসে ভালো করেছেন, এর পরে আপনি যে কোন সময় আসতে পারবেন।

৩২।
মনিরা আর রাশেদ সাহেব আপাতত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে তাদের ঘরে চলে এলো। ছোট্ট একটা ঘর, সিঙ্গেল একটা খাট। এর মধ্যেই তাদের দুজনকে থাকতে হবে। রাশেদ সাহেব বাঙ্গালির স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি লম্বা বলে দেশের বাজারে যে মাপের খাট তৈরি হয় তাতে শুতে পারে না। নিজে কাঠ কিনে এনে বাড়িতে মিস্ত্রী ডেকে তার নিজের মাপ মত খাট বানিয়ে নিয়েছেন। আজ এই ছোট্ট খাটে দুজনকে শুতে হবে। মনির দিকে চেয়ে হেসে বললেন কি করবে, এর মধ্যেই শুয়ে পর। লম্বা জার্নি করেছ তুমি ক্লান্ত। খাটের দিকে চেয়ে লাভ নেই। এখানে যা পেয়েছ তাতেই শোকর কর। না হলে এতক্ষণে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কাছা কাছি বা হোয়াইট চ্যাপেলের কাছে কম দামের ‘বেড এন্ড ব্রেক ফাস্ট’ খুঁজতে হতো। অনেক পেয়েছি এখানে।
দেখেছ, ফিরোজের বোন, বোন জামাই আমাদের জন্য এই ঘর ছেড়ে অন্য বাসায় গিয়ে থাকছে। এদেশে যার যার নিজের যতটুক দরকার ততটাই ঘর কিনে। এতো বড় ঘর দিয়ে কি করবে? এটাই এই লন্ডনের জীবন। দেশের মানুষ যেমন ভাবে যারা লন্ডন থাকে তারা না জানি কত সুখে আছে আসলে তা নয়। হ্যাঁ রোজগার ভাল কিন্তু জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় এখানে। ক’দিন থাক দেখবে, এখানকার জীবন কেমন।
এই যে এই জানালা দেখছ দেখ এতে মোটা দুইটা কাঁচ লাগানো রয়েছে, এর নাম হচ্ছে ডাবল গ্লেজিং যাতে শীতের তাণ্ডব দ্বিতীয় কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকতে না পারে। শীত বল আর গরম বল কখনোই জানালা খুলে রাখতে পারবে না। আমাদের দেশের মত বারান্দায় বসা কাকে বলে এরা জানেই না। কাল দিনে দেখবে বাড়ি ঘর একেকটা একেক দিকে মুখ করা। দক্ষিণ মুখী হতে হবে নয়তো একান্ত পূর্ব মুখী না হলে বাতাস এসে দেহ মন জুড়িয়ে দিবে এদের এমন ভাবনা নেই। আরও দেখবে, এখানে কেও কারো নয়। কেও কাউকে এক কাপ চাও খেতে বলে না নিতান্ত কোন উদ্দেশ্য না থাকলে। তবুও যা করেছে আমি ভাবতেও পারিনি। সেই কবে স্কুল ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি, জানা না থাকলে ওকে দেখে হয় তো চিনতেও পারতাম না। ও যা করেছে সে ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারব কিনা জানি না। ওর বৌ যদি এমন না হতো তাহলে হয়ত ফিরোজের পক্ষে এতটা সম্ভব হতো না।

সবই আল্লাহর ইচ্ছা নয়তো এমন জামাই আদর? অসম্ভব। আমি তো ভাবতেই পারিনি, শুনেছি এদেশের মেয়ে তাই ভেবেই নিয়েছিলাম সাদা কেও হবে, এতো দিন তাই মনে করেছি। নিজের আপন ভাই তো রয়েছে তাকে তো জানাতেও পারিনি। যাক কাল থেকেই সব দেখতে পাবে। এখন শুয়ে পর, আমরা তো আর হানিমুন করতে আসিনি বা সখ করে বেড়াতে আসিনি। আমাদের ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছে এখানে।
ভোরে সেহরি খাবার জন্য উঠেছিলো, কোন রকম সেহরি খেয়েই আবার ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক দেরীতে। ভাবী বা ফিরোজ কেও ইচ্ছা করেই ডাকেনি।
মনিরার সাড়া পেয়ে ভাবী উপরে এসে জিজ্ঞেস করলেন -কি ভাবী ঘুম হয়েছে?
-হ্যাঁ ভাবী দুই দিন পথে থেকে ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম শোবার সাথে সাথেই ঘুম কোথা দিয়ে এত বেলা হয়েছে বুঝতেই পারিনি।

নিচে নেমে সবাই গল্প করছে। চলো দেখি তোমাদের জায়গাটা কেমন দেখায়। ঘরের বাইরে বের হলো, প্রচণ্ড শীত, গরম কাপড় গায়ে তবুও কাঁপুনি লাগছে। ওর বাড়িটা বেশ সুন্দর। সামনে একটু ফুলের বাগান, এখন শীত বলে কোন ফুল নেই শুধু গাছ গুলি দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই বাচ্চাদের খেলাধুলার একটু জায়গা। আবার তার পরেই রাস্তা। কাল যে গাড়িতে করে এসেছে সেটা রাস্তার পাশেই ওর বাড়ির সামনে রেখেছে। ফিরোজ বললো ওটা শেফালির।
-তোমার কোনটা?
-ওই তো ওর পিছনের টা।
শীত সহ্য করতে না পেরে মনি ভিতরে চলে এলো। বাড়ির পিছনে শাক সবজি করার মত খানিকটা মাটি, চারদিকে কাঠের বেড়া দেয়া। এক কোনায় একটা আপেল গাছ। নীচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘরে আবার ছোট একটা খাবার টেবিল পাতা আছে, ছোট একটা টয়লেট আর একটা ঘর যেখানে ওর মা থাকে। উপরে দোতলায় দুইটা ঘর, বাথরুম টয়লেট, তিনতলায় চিলে কোঠার মত একটা ঘর। বেশ ছিম ছাম করে সাজানো। সারা বাড়িতে মোটা কার্পেট বিছানো। এমনকি বাথরুমেও। বাথরুমের এক পাশে পর্দা ঘেরা বাথ টাব। এখানে আমাদের দেশের মত ঘরে ঘরে জনে জনে একটা করে বাথরুম নেই। অতিরিক্ত কোন ঘর নেই। এখানে একটা বাড়ি আছে এই যথেষ্ট। বিলাসিতা করার মত বা অনর্থক খরচের বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। শীত কালে বাড়ি গরম রাখার জন্য যথেষ্ট গ্যাস বিজলী খরচ হয়ে যায়। এর নাম লন্ডন শহর। সারা দিন কাজ আর কাজ, বাড়িতে কতক্ষণই থাকার সুযোগ পায়। রাতে কোন রকমে শরীরটাকে একটু বিছানায় ফেলে দেয়া।
বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং চলছে তবুও বসার ঘরে আলাদা একটা হিটার চলছে। নভেম্বরের প্রথম, এর মধ্যে লন্ডন শহরে আর কেও জায়গা পাক আর না পাক শীত মহোদয় তার আসন পেতে নিয়েছে। ফিরোজের মা মনিকে ডেকে পাশের রান্না ঘরে গেলো।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৯

৩১।
রাশেদ আর ফিরোজ একই স্কুলে পড়েছে। স্কুল ছাড়ার পর এই প্রথম দেখা। লন্ডন আসার দিন ঠিক হবার পর কামরুলের কাছ থেকে ফিরোজের ফোন নম্বর, মেইল ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করেছিলো। প্রায় ত্রিশ বছর পর দেখা। খেতে বসে আরও আলাপ হলো। শেফালি ভাবী একটা ড্রাইভিং স্কুল চালায়। মনিরা যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মনিরা জানে ওর সব বন্ধুরাই এমন। একেক জনের সাথে বিশ, পঁচিশ বা ত্রিশ বৎসর পরে দেখা হলেও কারো ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে এতো দিন পর দেখা হয়েছে, এমনকি এর মধ্যে এদের কারো সাথে কোন যোগাযোগও নেই তবুও কেও কাউকে কোন অবহেলা করে না ভুলে যায় না। সবাই একই রকম, আন্তরিকতায় কেও কম না। আনন্দে, কৃতজ্ঞতায়, পাগল স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় মনিরার চোখ ভিজে উঠলো।
-সত্যিই ভাবী আমি যে এখানে এসে এমনটা পাব তা কল্পনাও করতে পারিনি। মনে হচ্ছে আপনি আমার কত দিনের চেনা, কত আপন, বলেই শেফালিকে জড়িয়ে ধরল।
-না ভাবী আপনার ভাই শুধু বলেছে ওর অনেক দিনের পুরনো এক বন্ধু বৌ নিয়ে আসছে। আমাকে আর কিছু বলেনি।
-মনিরা বলে উঠলো তাহলে দুইজনে একই রকম?
-শেফালি বললো তা না হলে বন্ধুত্ব হবে কি করে?
মনিরার চোখ এর পরে আর পানি সামলাতে পারেনি ফোটা ফোটা করে গড়িয়ে পরছে।
তাই দেখে ফিরোজের মা বললো
-ওকি মা তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো জানতাম না যে তুমি আমাদের আপন জন। ফিরোজ আমাকেও কিছু বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করাতে শুধু বলেছিলো তোমাদের পাশের গ্রামেই।
-তা বলত মা গ্রামের কি অবস্থা, কে কেমন আছে, কোথায় কি হচ্ছে, কৌড়ির ব্রিজটা কি হয়েছে, ঢাকা থেকে ঝিটকা যেতে এখন রাস্তার কি অবস্থা? এরকম আরও নানা কৌতূহল। তোমার ছেলে মেয়ে কজন, বাড়িতে কে কে আছে, তোমার বাবা চাচার কি অবস্থা?
-আমার বাবা তো অনেক আগেই চলে গেছেন ফুফু, চাচাও এইতো কয়েক বৎসর হলো। কাসেম চাচাকে কিছু দিন আগে দেখেছিলাম, আমাদের বাড়ি এসেছিলো। আমিও ফুফু আম্মা আপনার মতই প্রায়, দেশে থেকেও গ্রামে খুব একটা যেতে পারি না
-আচ্ছা চলো শুয়ে পর আজ আর না কাল গল্প করব, এতদিন পর গ্রামের মেয়ে পেলাম আমার যে কি ভালো লাগছে মা। আজ তোমরা ক্লান্ত, যাও বিশ্রাম নাও।
-ভাবী চলেন। এখানে কিন্তু আপনাদের ঢাকার মত বড় বড় ঘর নেই। ছোট ঘর, শীতের দেশে ঘর গরম রাখতে গেলে বড় ঘরে অনেক খরচ হয় তাই সবাই ছোট ছোট ঘর বানায়।
-কি যে বলেন ভাবী, ছোট আর বড়। আমি যে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় থাকবো আমি তো আসতেই চাইছিলাম না। শুধু ওর পাগলামির জন্য আসা।
-এসে ভালো করেছেন, এর পরে আপনি যে কোন সময় আসতে পারবেন।

৩২।
মনিরা আর রাশেদ সাহেব আপাতত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে তাদের ঘরে চলে এলো। ছোট্ট একটা ঘর, সিঙ্গেল একটা খাট। এর মধ্যেই তাদের দুজনকে থাকতে হবে। রাশেদ সাহেব বাঙ্গালির স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি লম্বা বলে দেশের বাজারে যে মাপের খাট তৈরি হয় তাতে শুতে পারে না। নিজে কাঠ কিনে এনে বাড়িতে মিস্ত্রী ডেকে তার নিজের মাপ মত খাট বানিয়ে নিয়েছেন। আজ এই ছোট্ট খাটে দুজনকে শুতে হবে। মনির দিকে চেয়ে হেসে বললেন কি করবে, এর মধ্যেই শুয়ে পর। লম্বা জার্নি করেছ তুমি ক্লান্ত। খাটের দিকে চেয়ে লাভ নেই। এখানে যা পেয়েছ তাতেই শোকর কর। না হলে এতক্ষণে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কাছা কাছি বা হোয়াইট চ্যাপেলের কাছে কম দামের ‘বেড এন্ড ব্রেক ফাস্ট’ খুঁজতে হতো। অনেক পেয়েছি এখানে।
দেখেছ, ফিরোজের বোন, বোন জামাই আমাদের জন্য এই ঘর ছেড়ে অন্য বাসায় গিয়ে থাকছে। এদেশে যার যার নিজের যতটুক দরকার ততটাই ঘর কিনে। এতো বড় ঘর দিয়ে কি করবে? এটাই এই লন্ডনের জীবন। দেশের মানুষ যেমন ভাবে যারা লন্ডন থাকে তারা না জানি কত সুখে আছে আসলে তা নয়। হ্যাঁ রোজগার ভাল কিন্তু জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় এখানে। ক’দিন থাক দেখবে, এখানকার জীবন কেমন।
এই যে এই জানালা দেখছ দেখ এতে মোটা দুইটা কাঁচ লাগানো রয়েছে, এর নাম হচ্ছে ডাবল গ্লেজিং যাতে শীতের তাণ্ডব দ্বিতীয় কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকতে না পারে। শীত বল আর গরম বল কখনোই জানালা খুলে রাখতে পারবে না। আমাদের দেশের মত বারান্দায় বসা কাকে বলে এরা জানেই না। কাল দিনে দেখবে বাড়ি ঘর একেকটা একেক দিকে মুখ করা। দক্ষিণ মুখী হতে হবে নয়তো একান্ত পূর্ব মুখী না হলে বাতাস এসে দেহ মন জুড়িয়ে দিবে এদের এমন ভাবনা নেই। আরও দেখবে, এখানে কেও কারো নয়। কেও কাউকে এক কাপ চাও খেতে বলে না নিতান্ত কোন উদ্দেশ্য না থাকলে। তবুও যা করেছে আমি ভাবতেও পারিনি। সেই কবে স্কুল ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি, জানা না থাকলে ওকে দেখে হয় তো চিনতেও পারতাম না। ও যা করেছে সে ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারব কিনা জানি না। ওর বৌ যদি এমন না হতো তাহলে হয়ত ফিরোজের পক্ষে এতটা সম্ভব হতো না।

সবই আল্লাহর ইচ্ছা নয়তো এমন জামাই আদর? অসম্ভব। আমি তো ভাবতেই পারিনি, শুনেছি এদেশের মেয়ে তাই ভেবেই নিয়েছিলাম সাদা কেও হবে, এতো দিন তাই মনে করেছি। নিজের আপন ভাই তো রয়েছে তাকে তো জানাতেও পারিনি। যাক কাল থেকেই সব দেখতে পাবে। এখন শুয়ে পর, আমরা তো আর হানিমুন করতে আসিনি বা সখ করে বেড়াতে আসিনি। আমাদের ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছে এখানে।
ভোরে সেহরি খাবার জন্য উঠেছিলো, কোন রকম সেহরি খেয়েই আবার ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক দেরীতে। ভাবী বা ফিরোজ কেও ইচ্ছা করেই ডাকেনি।
মনিরার সাড়া পেয়ে ভাবী উপরে এসে জিজ্ঞেস করলেন -কি ভাবী ঘুম হয়েছে?
-হ্যাঁ ভাবী দুই দিন পথে থেকে ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম শোবার সাথে সাথেই ঘুম কোথা দিয়ে এত বেলা হয়েছে বুঝতেই পারিনি।

নিচে নেমে সবাই গল্প করছে। চলো দেখি তোমাদের জায়গাটা কেমন দেখায়। ঘরের বাইরে বের হলো, প্রচণ্ড শীত, গরম কাপড় গায়ে তবুও কাঁপুনি লাগছে। ওর বাড়িটা বেশ সুন্দর। সামনে একটু ফুলের বাগান, এখন শীত বলে কোন ফুল নেই শুধু গাছ গুলি দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই বাচ্চাদের খেলাধুলার একটু জায়গা। আবার তার পরেই রাস্তা। কাল যে গাড়িতে করে এসেছে সেটা রাস্তার পাশেই ওর বাড়ির সামনে রেখেছে। ফিরোজ বললো ওটা শেফালির।
-তোমার কোনটা?
-ওই তো ওর পিছনের টা।
শীত সহ্য করতে না পেরে মনি ভিতরে চলে এলো। বাড়ির পিছনে শাক সবজি করার মত খানিকটা মাটি, চারদিকে কাঠের বেড়া দেয়া। এক কোনায় একটা আপেল গাছ। নীচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘরে আবার ছোট একটা খাবার টেবিল পাতা আছে, ছোট একটা টয়লেট আর একটা ঘর যেখানে ওর মা থাকে। উপরে দোতলায় দুইটা ঘর, বাথরুম টয়লেট, তিনতলায় চিলে কোঠার মত একটা ঘর। বেশ ছিম ছাম করে সাজানো। সারা বাড়িতে মোটা কার্পেট বিছানো। এমনকি বাথরুমেও। বাথরুমের এক পাশে পর্দা ঘেরা বাথ টাব। এখানে আমাদের দেশের মত ঘরে ঘরে জনে জনে একটা করে বাথরুম নেই। অতিরিক্ত কোন ঘর নেই। এখানে একটা বাড়ি আছে এই যথেষ্ট। বিলাসিতা করার মত বা অনর্থক খরচের বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। শীত কালে বাড়ি গরম রাখার জন্য যথেষ্ট গ্যাস বিজলী খরচ হয়ে যায়। এর নাম লন্ডন শহর। সারা দিন কাজ আর কাজ, বাড়িতে কতক্ষণই থাকার সুযোগ পায়। রাতে কোন রকমে শরীরটাকে একটু বিছানায় ফেলে দেয়া।
বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং চলছে তবুও বসার ঘরে আলাদা একটা হিটার চলছে। নভেম্বরের প্রথম, এর মধ্যে লন্ডন শহরে আর কেও জায়গা পাক আর না পাক শীত মহোদয় তার আসন পেতে নিয়েছে। ফিরোজের মা মনিকে ডেকে পাশের রান্না ঘরে গেলো।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৮

৩০।
আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফিরোজ এসে ওকে খুঁজে পেয়ে বললো তাড়াতাড়ি চলো যেখানে গাড়ি রেখে এসেছি ওখানে বেশিক্ষণ রাখা যায় না। তাড়াতাড়ি করে একটা ট্রলি এনে ফিরোজ সহ মালপত্র উঠিয়ে বাইরে এসে দেখে ফিরোজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ওর স্ত্রী বসে আছে। ওদের দেখে নেমে এলো। এর আগে ফিরোজের স্ত্রীর সাথে দেখা হয়নি। দ্রুত পরিচয় পর্ব সেরে মাল গুলি গাড়ির পিছনে রেখে গাড়িতে উঠে বসার সাথে সাথেই ফিরোজের স্ত্রী শেফালি, চিটাগাং এর মেয়ে লিভারপুলে জন্ম এবং বেড়ে উঠা, গাড়ি স্টার্ট দিল। টার্মিনাল থেকে বের হয়ে এই সামান্য একটু হেঁটে গাড়িতে আসতেই মনিরা শীতে কেঁপে উঠলো।
-ভাবী হিটার বাড়িয়ে দেন।
-হ্যাঁ ভাই দিচ্ছি। একটু রসিকতা করে বললো কি ভাবী আগুনের কাছে বসেও শীত লাগছে?
রাশেদ নিজের কোট খুলে মনির গায়ে জড়িয়ে দিল। একটু পরেই গাড়ি গরম হলে মনি একটু স্বস্তি পেল। ফিরোজ আর রাশেদ সাহেবের হাসি তামাশা আর ওদের দুজনের আন্তরিকতা দেখে মনি অবাক হলো। এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু এরা! হিথরো এলাকা ছাড়িয়ে এসে গাড়ি মটর ওয়ে ধরে ওদের বাড়ির দিকে চলছে। ভাবী গাড়িও চালাচ্ছে আবার ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলছে। মনিরা ওদের এই সব কাণ্ড দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে, মুখে হাসির আলো দেখা যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা খানিক ড্রাইভ করে রাত আটটার দিকে ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।
ফিরোজের নিজের বাড়ি। বাড়িতে মা, বোন, বোন জামাই আর ওদের দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে ফিরোজের সংসার। মালপত্র নামিয়ে ভাবী দোতলায় ওদের জন্য বরাদ্দ করা ঘরে রেখে এসে বসার ঘরে বসল।
ফিরোজের মা বললো তোমাদের বড় মেয়ে ফোন করেছিলো। তোমরা পৌঁছেছ কি না জানতে চেয়েছিলো, ওদের একটা ফোন করে জানিয়ে দাও, চিন্তায় আছে।
ফিরোজ উঠে গিয়ে লাইন ধরে দিল।
মনি কথা বললো, হ্যাঁ মা আমরা এই মাত্র পৌঁছলাম। তোমার চাচা চাচী দুজনেই গিয়েছিলো, তোমরা কেমন আছ? আচ্ছা সাবধানে থেক, রাখি তাহলে।
বাড়ির সবার সাথে আলাপ পরিচয় হবার পর শেফালি ভাবী বললো-
-ভাবী কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন, আমার মনে হয় গোসল করলেই ভাল হবে। আপনার রুমের পাশেই বাথরুম। লম্বা জার্নি করে এসেছেন আজ আর বেশি কথা না, খেয়ে দেয়ে রেস্ট করেন কাল কথা হবে
শেফালির আন্তরিকতা দেখে মনিরা একটু অবাক হলো। লন্ডনের মত শহরে যেখানে সব কিছু মাপা এমনকি মুখের হাসিটাও। মনিরা এ কয়দিন জেনে এসেছে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে সেখানে প্রথম দেখাতেই এমন আপন করে নেয়াতে মনিরার কাছে অবাক লাগারই কথা।
ভাবীর কথা শুনে ওরা দুই জনেই উঠে গেলো। মনিরা বললো সে গোসল করবে।
-করে ফেল ভাল লাগবে, আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলেই হবে।
সুটকেস খুলে মনিরা কাপড় বের করে গোসল করে এলো। রাশেদ সাহেব হাতমুখ ধুয়ে এসে বললো-
-ফিরোজের জন্য কাসুন্দি, ঝিটকার পিঁয়াজ আর ওগুলি এনেছি ওগুলি বের কর।
মনিরা ভাবল তাহলে ও আগে থেকে জানতো এখানে আসবে। আমাকে তো শুধু বলেছিলো ফিরোজকে মেইল পাঠাবে, তা ওর এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথচ এতদিন কিছু জানতে পারিনি, আমাকে তো কোনদিন কিছু বলে নি। শুধু বলেছে ফিরোজের বাড়ি উঠবে সে ফিরোজের সাথে যে ওর এত ঘনিষ্টতা তা কিছুই বলেনি। যাক ওদের বন্ধুত্বের ভাব দেখে মনটা বেশ প্রফুল্ল হলো। ভাবতে ভাবতে সব কিছু বের করে একটা ব্যাগে ভরে নিচে নেমে এলো।
শব্দ পেয়ে ভাবী ডেকে বললো-
-ভাবী এদিকে কিচেনে আসুন খাবার রেডি।
মনি এগিয়ে কিচেনে গিয়ে ভাবীর সামনে ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে বললো-
-এই যে ভাবী আপনার ভাই তার বন্ধুর জন্য এনেছে।
-ওতে কি পিঁয়াজ আছে?
-হ্যাঁ।
-আমি জানি পিঁয়াজ থাকতে হবে।
-কেও এলেই তার আর কিছু না, শুধু এই পিঁয়াজ আনতে বলবেই। যাক, ভাবী গোসল করেছেন মনে হচ্ছে!
-হ্যাঁ ভাবী, গোসল করে ফেললাম।
-ভাল করেছেন। কি, এখন শীত লাগছে?
-না বেশ তো ভালই লাগছে।
-নেন এবার খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরুন।
-শুনলাম আপনি এদেশে জন্মেছেন, এদেশে বড় হয়েছেন অথচ এত সুন্দর বাংলা বলেন আমার কাছে অবাক লাগছে।
-ওমা, কি বলেন! এদেশে জন্মেছি বলে কি আমরা বাঙ্গালি না?
-আপনাকে পেয়ে খুব ভাল লাগছে।
ভাবী অনেক কিছু রান্না করেছে। বিরিয়ানি, রোস্ট, কাবাব, চিকেন গ্রীল। খেতে বসে ফিরোজের মা মনিকে বললো-
-রাশেদের বাড়ি তো শুনলাম আমাদের পাশেই তা তোমার বাবার বাড়ি কোথায়?
-ওখানেই। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, -আপনাদের বাড়ির পাশেই! আপনার বাড়ি কোথায়?
ফিরোজের মা তার বাবার বাড়ির ঠিকানা বলতেই মনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল,
-ও! আপনি কাসেম চাচার বোন? এই ব্যাপার! অথচ দেখেন আমাকে এতো দিন কিচ্ছু বলেনি, তাহলে তো আপনি আমাদের ফুফু হন। আমাদের গ্রাম গালা আর আমার বাবার নাম আঃ সোবহান, আপনি আমার বাবাকে চিনতে পেরেছেন?
-তুমি তাহলে সোবহানের মেয়ে!
-হ্যাঁ। আর আমি ভাবছিলাম কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় থাকবো কি করবো কত কি ভেবে আমি অস্থির ছিলাম এ কয় দিন।
ফিরোজ এলো একটু পরে, এসে পিঁয়াজ দেখেই বললো, -কি রাশেদ, পিঁয়াজ এনেছ তাহলে?

নক্ষত্রের গোধূলি-১৭

২৯।
রাশেদ সাহেব ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আর ডাকতে পারলো না। কাত হয়ে থাকা মনির মাথাটা টেনে নিজের বুকে এনে নিলেন, মনি একটু কাত হয়ে রাশেদ সাহেবের বুকে ঘুমাচ্ছে। মনির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন সে কত সুখী। মনির মত স্ত্রী পেয়েছে। যে তার সমস্ত সত্তা দখল করে রয়েছে, ওকে ছাড়া একটা দিন তো দূরের কথা একটা বেলাও চলে না। তার মনের কথা গুলি কেমন করে যেন সব ঠিক ঠিক বুঝে ফেলে। অবাক লাগে। ভালবাসা কি এমনই গভীর? কত গভীরে গেলে এমন হতে পারে? কই আমি তো পারি না! ভাবতে ভাবতে সেও এক সময় ঘুমিয়ে পরে। হঠাৎ মাইকে এয়ার হোস্টেস এর কণ্ঠে চমকে উঠলেন, প্লেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হিথরো এয়ারপোর্টে নামবে, সেখানকার তাপ মাত্রা দুই ডিগ্রী এবং আবহাওয়া সম্পর্কে জানিয়ে যাত্রীদের সেই অনুযায়ী পোষাক পরে নেবার কথা জানিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নেবার অনুরোধ জানালো। মনিরার ঘুম তখনও ভাঙ্গে নি। রাশেদ সাহেব আস্তে করে ডাকলেন, মনি ওঠ, লন্ডন এসে গেছে! মনির সিট বেল্ট বেঁধে নিজেরটাও বেঁধে নিলেন।
আবার ডাকলেন, মনি ওঠ!
মনি চোখ মেলে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো
-কি হয়েছে?
-লন্ডন এসে পরেছি প্লেন নামছে।
মনি জানালা দিয়ে দেখল। ছবির মত সাজান সুন্দর বাড়ি ঘর, টেমস নদী, আই অফ লন্ডন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনের চাকা মাটি ছুঁয়ে গেলো। একটু পরেই প্লেন হিথরো এয়ারপোর্টের তিন নম্বর টার্মিনালের সামনে থেমে গেলো। রাশেদ সাহেব ব্যাগ থেকে মনির গরম কাপড় বের করে মনিকে পরিয়ে দিলেন, পায়ে মুজা বদলে গরম মুজা পরিয়ে দিলেন, এছাড়া হ্যান্ড গ্লোভস আর গলার মাফলার মনির হাত ব্যাগে ভরে দিলেন।
গ্যাং ওয়ে টেনে প্লেনের দরজার সামনে আনতে দরজা খুলে দিল। যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে গেলো। টার্মিনালের দোতলার উপর বেশ অনেকটা পথ হেঁটে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বেশ দীর্ঘ কিউর পিছনে। তাদের পালা এলে কাল ইমিগ্রেশন অফিসার তাদের পাসপোর্ট দেখে সিল দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। রাশেদ সাহেব এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে মনিরার হাত ধরে লাগেজ কনভেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালো। ওদের মালামাল কোন বেল্টে আসছে তা মনিটরে দেখে নিয়ে সেখানে যেয়ে দাঁড়ালেন। ওদের মাল আসতেই বেল্ট থেকে নামিয়ে কাস্টমের সবুজ গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরে যেখানে যাত্রীদেরকে রিসিভ করার জন্য সবাই এসে অপেক্ষা করে সেখানে এসে ফিরোজকে খুঁজে না পেয়ে মনিরাকে বললো তুমি এখানে এগুলি নিয়ে বসে থাক আমি ফিরোজকে খুঁজে বের করি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফিরোজকে না পেয়ে আবার মনির কাছে ফিরে এলেন।
মনি জিজ্ঞেস করলো, পেলে না?
-দেখছি না।
-তাহলে কি আসে নি?
-না আসলেও আসবে।
-তুমি কি ঠিক ভাবে জানিয়েছিলে?
-কি যে বল, তারিখ, ফ্লাইট নম্বর, সময় সব জানিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে ওরা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে আটকে রয়েছে।
-এখানেও ট্রাফিক জ্যাম আছে নাকি?
-থাকবে না মানে, এখন পুরো পিক টাইম! দাঁড়াও আর একটু দেখি, তারপর ফোন করি।
বলেই তিনি মনির পাশে বসলেন।
-আমার কিন্তু ভয় করছে আসবে কি না, যদি না আসে তাহলে কি করবে এখন?
-কী যে বল তুমি আসবে না কেন, অবশ্যই আসবে। একটু অপেক্ষা কর।
প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেলো এর মধ্যে ওকে না দেখে এবার রাশেদ সাহেবও একটু চিন্তিত হলেন। উঠে গিয়ে দোকান থেকে সাথে থাকা পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে এনে ফিরোজের বাসায় ফোন করলেন।
ফিরোজের মেয়ে জানাল আব্বু আম্মু দুজনেই আপনাদের রিসিভ করতে চলে গেছে, আম্মু একটু বাইরে কাজে গিয়েছিলো ফিরতে দেরি হওয়াতে দেরি হয়েছে।
-আচ্ছা ঠিক আছে তা হলে আমি ওকে মোবাইলে ফোন করছি।
লাইন কেটে দিয়ে আবার মোবাইলে ফোন করে সরাসরি ফিরোজের সাথে কথা হলো।
-হ্যাঁ রাশেদ আমরা আসছি, তোমরা কি তিন নম্বর টার্মিনালে আছ?
-হ্যাঁ।
-তাহলে ওখানেই থাক আমাদের আরও আধা ঘণ্টা লাগবে।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৬

২৮।
একটু পরেই দেখলো তারা যে গেট দিয়ে লন্ডন যাবার প্লেনে উঠবে সেখানে এক বিশাল ৭৪৭ বোইং এসে দাঁড়ালো। দেখ, দেখ মনি আমরা এই প্লেনে লন্ডন যাব। ঘণ্টা খানিক পর লন্ডনের যাত্রীদের প্লেনে ওঠার জন্য C গেটে যাবার ঘোষণা শুনে তারা এগিয়ে গেলো। ওদের বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট দেখে যথারীতি অন্যান্য এয়ারপোর্টের মত এখানেও বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও রক্ষা যে ওদের বেশ মোটা এবং পুরাতন পাসপোর্ট এবং রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টে ইতিপূর্বে ব্রিটেন ভ্রমণের ভিসা দেখে তেমন কোন ঝামেলা করেনি। এক সময় সব ঝামেলা শেষ করে প্লেনে উঠে সিট খুঁজে বসে পরলেন। এবারেও মনি জানালার পাশে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই প্লেন ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, সামনের জিপিএস এর স্ক্রিনে দেখছে। জানালা দিয়ে নিচে নীল সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা আরও বেশি সুন্দর ছবির মত দেখাচ্ছে, মাঝে মাঝে টুকরো মেঘ গুলির উপর দিয়ে যাচ্ছিল। সাগর পাড়ি দেয়ার পর যে শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছে রাশেদ সাহেব বলে যাচ্ছেন কবে এই শহরে এসেছিলেন, দেখ দেখ মনি আমি এই এই শহরে এসেছিলাম দেখ উপর থেকে দেখ কেমন দেখাচ্ছে! ওইসব শহরের নানা গল্প বলছিলেন। তার কোনটা মনিরার কানে যাচ্ছে কোনটা যাচ্ছে না। সে শুধু অবাক হয়ে রাশেদ সাহেবের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন তাকে এই প্রথম দেখছে।

কুয়ালালামপুর থেকে লন্ডন দীর্ঘ চৌদ্দ ঘণ্টার পথ। কম না। মাঝে দুই বার খাবার দিয়েছে, দুই বার হালকা নাশতা আর চা কফি বা পানীয় তো আছেই। যে যখন যা চাইছে। রাশেদ সাহেব মনিরা কে জোর করে বার বার পানীয় দিচ্ছে যাতে ডি-হাইড্রেশন হয়ে এয়ার সিকনেস না ধরে। মাঝে মাঝে উঠে এলি ওয়েতে হাঁটা হাটি করতে বলছে নিজেও করছে। রাশেদ সাহেবকে যেন আজ মনিরার কাছে নতুন লাগছে। এর আগেও তো কত বার প্লেন জার্নি করেছে তখন তো এতো এমন করেনি, এ যেন অন্য কোন নতুন রাশেদ সাহেব।

মনিরার ভাবনা শুধু একটাই, যে জন্য আসা তার কতটা কি হবে, কোন কাজকর্ম পাবে কি না, কি করবে, মনি যখন চলে যাবে তখন এই আত্মভোলা মানুষটা কি ভাবে থাকবে, কি করবে এই সব সাত পাঁচ ভেবে নানা আশঙ্কায় মনিরার মন বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে। না কি আবার দেশে ফিরে যেতে হবে। এমন যদি হয় তাহলে কি উপায় হবে, নানা কিছু। আবার এটাও ভাবছে দেশ ছেড়ে যখন বের হয়ে এসেছে নিশ্চয়ই একটা গতি হবে। এতো বড় এই ইংরেজদের রাজ্যে কি ওর জন্য একটা কাজও জোগাড় হবে না? নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আশা নিরাশার অনিশ্চয়তা আর গতরাতের অনিদ্রায় ক্লান্ত হয়ে মনিরা ঘুমিয়ে পড়েছে।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৫

২৭।
আজও মানুষটা সংসারী হতে পারল না। আজ ছাব্বিশটা বছর ধরে দেখে আসছে সংসার সম্পর্কে কি উদাসীন। নিজের কথা আর কোন দিন ভাবতে পারবে না। এমনি কি আর বলে, তুমি না হলে আমি কবে বাতাসে উড়ে যেতাম। যদি মনি নিজে যদি শক্ত করে হাল না ধরত তাহলে কি যে হোত কে জানে! মানুষটার মনে সারাক্ষণ শুধু দেশ, সমাজ, প্রতিবেশী, বাবা মা ভাই বোন। কোন সময় একবার ভুলেও নিজের কথা ভাবতে দেখেনি। বাজারে গেলে দুটার বেশি তিনটা জিনিসের কথা বলে দিলে আর মনে রাখতে পারে না, লিখে দিতে হয়। টাকা, ব্যাগ আর লিস্ট লিখে বাজারে পাঠালে কখনো দেখা যায় যে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে। কি হলো, বাজারে যাওনি? না, ওই ভ্যান ওয়ালাটা বললো ওর মেয়ের অসুখ তাই ওকে ওষুধ কেনার জন্য টাকা দিয়ে দিলাম। আমাদের তো আছে, চলবে না? এই মানুষকে আর কি বলবে। ছাব্বিশ বছর ধরে এই দেখে আসছে।
রাগা রাগিও করা যাবে না, ওই ড্রইং রুমে টিভির সামনে বসে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদর সোহাগ করে না আনা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিচ্ছু খাবে না। এই পাগলকে বুকে নিয়েই মনি চলছে। মনটা শিশুর মত সরল আর সাগরের মত বিশাল। থাকুক, আমার পাগল আমার বুকেই থাক এতেই আমার পরম শান্তি। কত বলেছে ভবিষ্যতের জন্য কিছু ভাব, সে কথা কোন দিন কানে নেয়নি। অফিসের বেতন তোলার সময় চেক লিখে তার পিওন সুনীলের হাতে দিয়ে দিত। সুনীল আবার সেই টাকা এনে মনির কাছে দিয়ে যেত। কোন দিন জিজ্ঞেসও করেনি সুনীল কত টাকা দিয়েছে। সেই জিজ্ঞেস করে নিত আজ কত টাকার চেক লিখেছিলে মনে আছে? না। চেকের মুড়ি দেখে মনিকেই তা সামাল দিতে হতো। যদিও জানে সুনীল খুবই বিশ্বাসী তবুও। ওর নিজের কখনো টাকার দরকার হলে মনির কাছে চেয়ে নিত। মনি আমাকে পঞ্চাশ টা টাকা দিতে পারবে? তার নিজের রোজগারের টাকা সে চাইছে বলে মনি কোন দিন জিজ্ঞেস করেনি টাকা দিয়ে কি করবে? মনি নিজেই এর মধ্যে থেকে সংসার চালিয়ে যা কিছু সঞ্চয় করতে পেরেছে তাই তার সম্বল।
-খুব ক্ষুধা লেগেছে মনি।
মনি ব্যাগ খুলে ঢাকা থেকে বড় মেয়ের দেয়া সেদ্ধ আটার রুটি আর শামী কাবাব বের করে দিয়ে খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতলটা ভরে এনে দিল।
-নাও খাও।
-তুমি খাবে না, তোমারও তো ক্ষুধা লেগেছে।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৪

২৫।
চেক ইন, ইমিগ্রেশনের ঝামেলা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জ। কিছুক্ষণ বসেই রাশেদ সাহেব পাশে বসা মনির হাত ধরে আবার গেয়ে উঠলেন ‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে—–———। মনিরা শুকনো কাঠের মত একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বাসায় ফোন করে খবর নিয়ে এলো গাড়ি পৌঁছেছে কি না। ওদের পৌঁছার খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো। মাইকে নারী কণ্ঠের ঘোষণা ভেসে এলো। উঠে প্লেনে উঠার গ্যাং ওয়ের গেটের কাছে এসে কিউতে দাঁড়ালেন। বোর্ডিং কার্ড চেক হবার পর শেষ বারের মত সিকিউরিটি চেক সেরে আস্তে আস্তে গ্যাং ওয়ে দিয়ে প্লেনের ভিতর এসে সিট নম্বর খুঁজে বসে পড়লো।
মনিরা জানালার পাশে তার পাশে রাশেদ সাহেব। রাশেদ সাহেব মনির হাত ধরে গুনগুনিয়ে আবার সেই গান গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সব যাত্রী ওঠা হলে মাইকে বিমান বালার কণ্ঠ ভেসে এলো, যাত্রী দের সিট বেল্ট বাঁধার অনুরোধ এবং ঢাকা বিমান বন্দর ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে জানিয়ে দিল। একটু পরেই প্লেন টারমাক ছেড়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে ছুটে চলে এক সময় ঢাকা বিমান বন্দরের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেলো। নিচে রাশেদ সাহেবের অপূর্ণ সব স্বপ্নের সাথে রাতের ঢাকা শহরের ঝকমকে নানা রঙের বাতি পরে রইলো।
রাশেদ সাহেবের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এই ঢাকা শহর আমাকে একটু জায়গা দিতে রাজী হলো না। আমার নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন শহরে। মনি রাশেদ সাহেবের এই পরিবর্তন দেখে তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো, -মন খারাপ করবে না, এইতো ক’দিন দেখতে দেখতে চলে যাবে তার পরে তো আবার আসবে। ততক্ষণে প্লেন অনেক উপরে উঠে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে তখন কিছু কিছু ছিটে ফোটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে নিজ দেশের শেষ বিন্দুটা দেখে নিতে চাইলেন কিন্তু আর সে সময় পেলেন না। প্লেন ততক্ষণে বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে।

২৬।
রাশেদ সাহেব অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ মুহূর্তে নিজ দেশের শেষ কণাটা দেখতে না পেরে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেলো। মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মনিরা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তার নিজ মনের বিষণ্ণতা, যাতনা কষ্ট সব চেপে রেখে হেসে ফেলল। কি হয়েছে তাই, এমন মন খারাপ করছ কেন?
মানুষটা এইতো এতোক্ষণ কি আনন্দে ছিলো। হঠাৎ করেই কেমন নিভে গেলো। মনি সব বুঝতে পারল। বুঝেও না বোঝার ভান করে তার কাঁধে স্বামীর মাথা টেনে নিয়ে বললো দেখ একটু ঘুমাতে পার কি না। রাশেদ সাহেব কিছু না বলে সুবোধ বালকের মত স্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। কখন যেন একটু তন্দ্রার মত এসেছিলো বুঝতে পারেনি। মনির কথার শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে মনির দিকে তাকিয়ে দেখে মনি কার সাথে কথা বলছে। এ পাশে চেয়ে দেখে মালয়েশিয়ান এয়ারহোস্টেস খাবার মেনু নিয়ে এসেছে, তারা কি খাবে মনি তাই বলে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির হাত চেপে ধরে আবার গেয়ে উঠলো সেই গানটা। মনি আবার একটু হাসল। এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট চেপে রেখেছে তা শুধু মনিই জানে। স্বামীকে বুঝতে দেয়নি। কত দিন পরে সে তার স্বামীকে একটু হাসি খুশি দেখছে, তার ভাল লাগা দেখছে। তাকে আর বিব্রত করা কেন? থাক না তার কষ্ট চাপাই থাক। ওকে আর জানাবার কি এমন দরকার? তার ভাল লাগায় বিঘ্ন ঘটাবার কোন ইচ্ছা হলো না, যে ভাবে চলছে চলুক। নিয়তি যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকেই চলুক।

খাবার পরে চা খেয়ে রাশেদ সাহেব আবার মনির কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজলেন। কতক্ষণ এভাবে ছিলো তা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ মাইকে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে নামার ঘোষণা শুনেই চমকে উঠলেন।
-একি মনি, তুমি আমাকে একটু ডাকবে না? তুমি একটু চোখ বন্ধ করতে পারতে। এভাবে সারা রাত জেগে রইলে কেন?
-কেন আবার, দেখলাম তোমার নাক ডাকছে, কত দিন পর তুমি একটু ঘুমিয়েছ তাই আর ডাকিনি। বেয়াই এক বার এসেছিলো খোঁজ নিতে। ওনার সিট সামনের দিকে, তোমাকে ঘুমে দেখে কিছু বলেনি চলে গেছে। আমারও চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো।
-নাও রেডি হয়ে নাও।
জানালা দিয়ে দেখলেন মালয়েশিয়ার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিচে পাম বাগানের সারি দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি লাল মাটির বুকে পাম গাছ গুলি দেখতে বেশ লাগছিলো।
-দেখ মনি একে বারে ঠিক আমাদের সাভারের মত তাই না?
মনি জানালা দিয়ে দেখে বললো-
-হ্যাঁ তাইতো!
একটু পরেই প্লেন নেমে মাটি স্পর্শ করে মটরিং করে ধীরে ধীরে টারমাকের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গেলো। দরজা খুলে দেয়ার পর যাত্রীরা সিট বেল্ট খুলে একে একে যার যার সিট ছেড়ে নেমে গেলো। রাশেদ সাহেবরাও নেমে এসে ট্রান্সফার ডেস্ক খুঁজে তাদের টিকেট দেখিয়ে বসার যায়গা এবং পরবর্তী ফ্লাইটের ডিপার্চার গেট জেনে নিয়ে বসে পরল। কায়সার বেয়াই এলো একটু পরেই।
-আসেন বেয়াই।
-আমি এখানে দুই দিন থাকবো, আপনারা চলে যান লন্ডনে গিয়ে দেখা হবে।
-লন্ডনে আপনি কোথায় থাকবেন ফোন নম্বরটা দিয়ে যান।
ফোন নম্বর নিয়ে সে যেখানে থাকবে সে বাসার ঠিকানা দিয়ে চলে গেল।

এখানে দশ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।
-চলো না মনি বাইরে যেয়ে কুয়ালালামপুরে একটু বেড়িয়ে আসি। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি এখানে সব চিনি। এয়ারপোর্টে এই দশ ঘণ্টা কি করবো?
মনি খরচের কথা ভেবে বললো-
-না আমার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে চলো ভেতরেই হাঁটা হাটি করি। চারিদিকে তো কাঁচের দেয়াল সবকিছুই দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার কি দেখবে? তারপরে আবার তো চৌদ্দ ঘণ্টার জার্নি রয়েছে, শুধু শুধু ক্লান্তি বাড়ানোর কি দরকার? চলো একটু হেঁটে দেখি।

বলেই মনিরা উঠে গিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাদের হাতের ব্যাগ গুলি ট্রলিতে নিয়ে এগিয়ে বললো এসো, ঘুরে দেখি। রাশেদ সাহেব মনির পিছনে উঠে গেলেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যত দোকান পাট যা আছে সব ঘুরে ঘুরে দেখে এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন তাদের লন্ডনের প্লেন যেখান থেকে ফ্লাই করবে সেই C গেটের কাছে। মনিরা খরচের কথাটা রাশেদ সাহেবকে বুঝতেই দেয়নি যে সে খরচের কথা ভেবে বাইরে যেতে চায়নি। এখানে বাইরে গেলেই অন্তত সত্তর ডলার বা পঞ্চাশ পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে। সে জানে তার পাগল খেয়ালের বসে যা মনে আসছ তাই বলছে। সেও যদি আবেগের বশে তাই রাজী হয়ে যায় তাহলে কি আর চলে? মামার কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনে এনেছে। তাকে যে আবার এই টাকা ফেরত দিতে হবে। লন্ডনে গিয়ে কি হবে না হবে তার কি কিছু ঠিক আছে?

নক্ষত্রের গোধূলি-১৩

২৫।
চেক ইন, ইমিগ্রেশনের ঝামেলা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জ। কিছুক্ষণ বসেই রাশেদ সাহেব পাশে বসা মনির হাত ধরে আবার গেয়ে উঠলেন ‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে—–———। মনিরা শুকনো কাঠের মত একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বাসায় ফোন করে খবর নিয়ে এলো গাড়ি পৌঁছেছে কি না। ওদের পৌঁছার খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো। মাইকে নারী কণ্ঠের ঘোষণা ভেসে এলো। উঠে প্লেনে উঠার গ্যাং ওয়ের গেটের কাছে এসে কিউতে দাঁড়ালেন। বোর্ডিং কার্ড চেক হবার পর শেষ বারের মত সিকিউরিটি চেক সেরে আস্তে আস্তে গ্যাং ওয়ে দিয়ে প্লেনের ভিতর এসে সিট নম্বর খুঁজে বসে পড়লো।
মনিরা জানালার পাশে তার পাশে রাশেদ সাহেব। রাশেদ সাহেব মনির হাত ধরে গুনগুনিয়ে আবার সেই গান গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সব যাত্রী ওঠা হলে মাইকে বিমান বালার কণ্ঠ ভেসে এলো, যাত্রী দের সিট বেল্ট বাঁধার অনুরোধ এবং ঢাকা বিমান বন্দর ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে জানিয়ে দিল। একটু পরেই প্লেন টারমাক ছেড়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে ছুটে চলে এক সময় ঢাকা বিমান বন্দরের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেলো। নিচে রাশেদ সাহেবের অপূর্ণ সব স্বপ্নের সাথে রাতের ঢাকা শহরের ঝকমকে নানা রঙের বাতি পরে রইলো।
রাশেদ সাহেবের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এই ঢাকা শহর আমাকে একটু জায়গা দিতে রাজী হলো না। আমার নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন শহরে। মনি রাশেদ সাহেবের এই পরিবর্তন দেখে তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো, -মন খারাপ করবে না, এইতো ক’দিন দেখতে দেখতে চলে যাবে তার পরে তো আবার আসবে। ততক্ষণে প্লেন অনেক উপরে উঠে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে তখন কিছু কিছু ছিটে ফোটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে নিজ দেশের শেষ বিন্দুটা দেখে নিতে চাইলেন কিন্তু আর সে সময় পেলেন না। প্লেন ততক্ষণে বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে।

২৬।
রাশেদ সাহেব অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ মুহূর্তে নিজ দেশের শেষ কণাটা দেখতে না পেরে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেলো। মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মনিরা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তার নিজ মনের বিষণ্ণতা, যাতনা কষ্ট সব চেপে রেখে হেসে ফেলল। কি হয়েছে তাই, এমন মন খারাপ করছ কেন?
মানুষটা এইতো এতোক্ষণ কি আনন্দে ছিলো। হঠাৎ করেই কেমন নিভে গেলো। মনি সব বুঝতে পারল। বুঝেও না বোঝার ভান করে তার কাঁধে স্বামীর মাথা টেনে নিয়ে বললো দেখ একটু ঘুমাতে পার কি না। রাশেদ সাহেব কিছু না বলে সুবোধ বালকের মত স্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। কখন যেন একটু তন্দ্রার মত এসেছিলো বুঝতে পারেনি। মনির কথার শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে মনির দিকে তাকিয়ে দেখে মনি কার সাথে কথা বলছে। এ পাশে চেয়ে দেখে মালয়েশিয়ান এয়ারহোস্টেস খাবার মেনু নিয়ে এসেছে, তারা কি খাবে মনি তাই বলে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির হাত চেপে ধরে আবার গেয়ে উঠলো সেই গানটা। মনি আবার একটু হাসল। এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট চেপে রেখেছে তা শুধু মনিই জানে। স্বামীকে বুঝতে দেয়নি। কত দিন পরে সে তার স্বামীকে একটু হাসি খুশি দেখছে, তার ভাল লাগা দেখছে। তাকে আর বিব্রত করা কেন? থাক না তার কষ্ট চাপাই থাক। ওকে আর জানাবার কি এমন দরকার? তার ভাল লাগায় বিঘ্ন ঘটাবার কোন ইচ্ছা হলো না, যে ভাবে চলছে চলুক। নিয়তি যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকেই চলুক।

খাবার পরে চা খেয়ে রাশেদ সাহেব আবার মনির কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজলেন। কতক্ষণ এভাবে ছিলো তা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ মাইকে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে নামার ঘোষণা শুনেই চমকে উঠলেন।
-একি মনি, তুমি আমাকে একটু ডাকবে না? তুমি একটু চোখ বন্ধ করতে পারতে। এভাবে সারা রাত জেগে রইলে কেন?
-কেন আবার, দেখলাম তোমার নাক ডাকছে, কত দিন পর তুমি একটু ঘুমিয়েছ তাই আর ডাকিনি। বেয়াই এক বার এসেছিলো খোঁজ নিতে। ওনার সিট সামনের দিকে, তোমাকে ঘুমে দেখে কিছু বলেনি চলে গেছে। আমারও চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো।
-নাও রেডি হয়ে নাও।
জানালা দিয়ে দেখলেন মালয়েশিয়ার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিচে পাম বাগানের সারি দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি লাল মাটির বুকে পাম গাছ গুলি দেখতে বেশ লাগছিলো।
-দেখ মনি একে বারে ঠিক আমাদের সাভারের মত তাই না?
মনি জানালা দিয়ে দেখে বললো-
-হ্যাঁ তাইতো!
একটু পরেই প্লেন নেমে মাটি স্পর্শ করে মটরিং করে ধীরে ধীরে টারমাকের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গেলো। দরজা খুলে দেয়ার পর যাত্রীরা সিট বেল্ট খুলে একে একে যার যার সিট ছেড়ে নেমে গেলো। রাশেদ সাহেবরাও নেমে এসে ট্রান্সফার ডেস্ক খুঁজে তাদের টিকেট দেখিয়ে বসার যায়গা এবং পরবর্তী ফ্লাইটের ডিপার্চার গেট জেনে নিয়ে বসে পরল। কায়সার বেয়াই এলো একটু পরেই।
-আসেন বেয়াই।
-আমি এখানে দুই দিন থাকবো, আপনারা চলে যান লন্ডনে গিয়ে দেখা হবে।
-লন্ডনে আপনি কোথায় থাকবেন ফোন নম্বরটা দিয়ে যান।
ফোন নম্বর নিয়ে সে যেখানে থাকবে সে বাসার ঠিকানা দিয়ে চলে গেল।

এখানে দশ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।
-চলো না মনি বাইরে যেয়ে কুয়ালালামপুরে একটু বেড়িয়ে আসি। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি এখানে সব চিনি। এয়ারপোর্টে এই দশ ঘণ্টা কি করবো?
মনি খরচের কথা ভেবে বললো-
-না আমার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে চলো ভেতরেই হাঁটা হাটি করি। চারিদিকে তো কাঁচের দেয়াল সবকিছুই দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার কি দেখবে? তারপরে আবার তো চৌদ্দ ঘণ্টার জার্নি রয়েছে, শুধু শুধু ক্লান্তি বাড়ানোর কি দরকার? চলো একটু হেঁটে দেখি।

বলেই মনিরা উঠে গিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাদের হাতের ব্যাগ গুলি ট্রলিতে নিয়ে এগিয়ে বললো এসো, ঘুরে দেখি। রাশেদ সাহেব মনির পিছনে উঠে গেলেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যত দোকান পাট যা আছে সব ঘুরে ঘুরে দেখে এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন তাদের লন্ডনের প্লেন যেখান থেকে ফ্লাই করবে সেই C গেটের কাছে। মনিরা খরচের কথাটা রাশেদ সাহেবকে বুঝতেই দেয়নি যে সে খরচের কথা ভেবে বাইরে যেতে চায়নি। এখানে বাইরে গেলেই অন্তত সত্তর ডলার বা পঞ্চাশ পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে। সে জানে তার পাগল খেয়ালের বসে যা মনে আসছ তাই বলছে। সেও যদি আবেগের বশে তাই রাজী হয়ে যায় তাহলে কি আর চলে? মামার কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনে এনেছে। তাকে যে আবার এই টাকা ফেরত দিতে হবে। লন্ডনে গিয়ে কি হবে না হবে তার কি কিছু ঠিক আছে?

নক্ষত্রের গোধূলি-১২

২৩।
সামনে আর মাত্র দুই দিন বাকী আছে। বিকেলে মামিকে নিয়ে মামা এলেন। মামা মামি দুজনেই বোঝালেন।
-মনে কর ও যাবার পর কোন অসুখে পরলে তখন কি হবে, অন্তত তুমি যদি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পার তাহলে কেমন হবে আর যদি কেও কাউকে দেখতে না পার তাহলে কেমন হবে? মন স্থির কর, ওখানে তোমাকে কাছে পেলে ওর শক্তি সাহস বেড়ে যাবে কয়েক গুন। ওর শরীর চেহারা কেমন হয়েছে দেখছ না? এরকম অবস্থায় তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দরকার। তুমিই পার ওকে আগের সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। কাজেই মন খারাপ না করে কে কি ভাবল তা চিন্তা না করে ওর সাথে যাওয়াই মঙ্গল। লোক লজ্জা নিন্দা যা আসে তা আমি দেখবো। এসব নিয়ে তুমি ভেবো না।

এই মামাই রাশেদ সাহেবের সুখ দুঃখের খবরাখবর রাখেন, বিপদ আপদে সাহায্য সহযোগিতা করেন, পরামর্শ দেন। তার কথা মনি ফেলতে পারলো না। মনে মনে প্রস্তুত হলো, মুখে কিছুটা হলেও শ্রাবণ আকাশের বৃষ্টির পর মেঘের ফাঁকে যেমন একটু খানি রোদের ঝিলিক দেখা যায় তেমনি একটু হাসি ফুটে বের হলো, বিশেষ করে মামার অনুরোধ বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলো। তবুও পদ্ম পাতার পানি যেমন টলমল করে তার মনের তেমন দোদুল্যমান ভাবটা কিছুটা হলেও রয়ে গেলো।

মামাতো ঠিকই বলেছেন। ওখানে যাবার পর যদি ওর কিছু হয়েই যায় তখন কি উপায় হবে? তার চেয়ে ওর সাথে এক বার যেয়ে আমার যাতায়াতের পথটা খুলে দেয়াই ভাল। রাতের খাবার খেয়ে মেহমানরা সবাই চলে গেলে মনি রাশেদকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসল আলাপ করার জন্য। রাশেদ মনির এই পরিবর্তন দেখে মহা খুশি। মনের আনন্দে মনির হাত ধরে গেয়ে উঠলো-
‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে, ভিসা করছি টিকেট করছি উইরা যাইমু পেলেনে’।
শুনে মনিরা হেসে উঠলো।
সে হাসিতে যে একটু অবাক মাখানো চমক ছিলো তা এক মাত্র রাশেদ সাহেবই টের পেলেন। আজ কতদিন পর যেন মনির হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট বেলার হাসিটা দেখতে পেলেন। দুজন দুজনকে ছুঁয়ে হাস্না হেনার টবের পাশে বেঞ্চে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। উভয়েই উভয়ের উষ্ণ স্পর্শে কত দিন পর যেন সেই ঝর্ণা ধারায় স্নান করছিলেন। সে রাত আর রাত রইলো না হয়ে গেলো মধু যামিনী।
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলো সেদিকে কোন খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ করেই একটু একটু বৃষ্টি নামছে দেখে মনি উঠে রাশেদের হাত ধরে নিয়ে নিচে নেমে শুয়ে পড়লো। মধু মাখা এই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুজনের কেওই টের পায় নি। ভোর হতে পাশের মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। চলো মনি গোসল করে আসি, ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। চলো। গোসল করে এসে নামাজ পরে মনি চলে গেলো রান্না ঘরে।
নাশতা খাবার পর রাতের এই ক্ষণিকের মধু মাখা বসন্তের আমেজ বেশিক্ষণ রইলো না। পৃথিবীর সব অনর্থের মূল এই অর্থ। অভাবের গ্লানি আর দুশ্চিন্তার ছায়া যার চারিদিকে তার কীইবা করার আছে। মধু বসন্ত সারা জীবনের জন্য আসেনি, এসেছিলো ক্ষণিকের জন্য। চোখের পলকেই যেন আবার কোথায় হারিয়ে গেলো, মিলিয়ে গেলো দূর দূরান্তের স্বপ্নে দেখা গভীর প্রশান্তির অতলে। সেখানে জায়গা করে নিল ঘন কুয়াশা ঢাকা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কি হবে কি হবে না তাই ভেবে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে নারকেল গাছের মাথায় যে সিনেমা দেখেছিলো সেই কথা মনে এসে ভিড় করলো আবার।

২৪।
লন্ডন যাবার প্রস্তুতি শেষ। নেহায়েত যা একান্ত দরকার তাই কেনা কাটা করা বা পাসপোর্টে পাউন্ড এন্ডোর্স করা সবই করে ফেলেছে যাবার আগে যাতে কোথাও বের হতে না হয়। আজ মেয়েরা কেও স্কুল কলেজে যায়নি। মেয়েরা সবাই উঠে নাশতা সেরে বাবা মাকে নিয়ে বসল। এ গল্প সে গল্প, আশা আকাঙ্ক্ষা কত কি এলো মেলো কথা হলো। আড্ডা জমে উঠে এতো দিনের গুমোট বাঁধা ভাবটা কেটে গিয়ে যেন বাড়িটা আবার প্রাণ চঞ্চলে ভরে উঠলো। বাড়িটা হাসি খুশিতে ভরে গেলো। মেয়েরা সবাই বায়না ধরল মা আজ খিচুড়ি রান্না কর, বাবা পছন্দ করে সবাই মিলে এক সাথে খাব। বড় মেয়ে বললো না মা তুমি থাক আজ আমি রান্না করি।
দুপুরে ডিম ভাজি দিয়ে খিচুড়ি খেতে বসে মেঝ মেয়ে বললো মাংস হলে ভাল হতো। ছোট মেয়ে বলে উঠলো যা হয়েছে তাই যথেষ্ট হয়েছে। শুনে মেঝ মেয়ে আবার বললো হ্যাঁ তাই, ভাগ্যে থাকলে আবার হবে ইনশাল্লাহ। মেয়েদের এই সব বিচক্ষণতা দেখে রাশেদ সাহেব মনির মুখের দিকে তাকালেন। মেয়ে গুলি হয়েছে একেবারে মায়ের মত। কোন বায়না নেই, কোন চাহিদা নেই, কোন চাওয়া নেই, কোন দাবী নেই। যা পাচ্ছে তাতেই খুশী। না পেলেও কোন আফসোস নেই। খাবার পর মেয়েদের নিয়ে আবার বসলেন। ওরা যাবার পর মেয়েরা কি ভাবে চলবে সে ব্যবস্থা মোটামুটি করে রেখেছিলেন।
বড় মেয়ের হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলে দিল এর পরেও যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে মামা অর্থাৎ তোমাদের দাদাকে ফোন করে জানাবে। আমি মামাকে বলেছি, উনি দেখবেন। ছোট মেয়ে জানতে চাইল
-আব্বু তোমরা এয়ারপোর্টে যাবে কি ভাবে?
-আমি তো ভেবে রেখেছি আমি আর তোমার মা একটা স্কুটার নিয়ে চলে যাব। তুমি কি কিছু বলতে চাও?
মনিরা বললো, -তা কি করে হয়?
-তাহলে কি করতে চাও?
মনি একটু দ্বিধার সাথে বললো-
-ওদের বাবা মা দুজনেই চলে যাচ্ছে ওরা যদি একটু এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে বিদায় দিয়ে আসতে পারে তাহলে মনে হয় ওদের ভাল লাগবে।
-কিন্তু সে রকম গাড়ি ভাড়া করার মত টাকা কোথায়? আগে বললে হয়ত কিছু খরচ কমিয়ে ব্যবস্থা করতে পারতাম।
-আচ্ছা সে আমি ব্যবস্থা করছি তুমি ভেবো না।
-দেখ যদি পার কর। আমারও তো মনে হয় যাবার আগে সবার মুখে একটু হাসি দেখে যেতে পারলে ভালো লাগতো। দেখ যদি পার কর সবার হাসি মুখ দেখে যাই। আবার কবে ফিরে আসি না আসি তা কি বলা যায়?

রাশেদ সাহেব কোন বাঁধা দিলেন না। মনিরা তার হাতের শেষ সম্বল ভেঙ্গে সেঝ দেবরকে দিয়ে এয়ারপোর্টে যাবার জন্য একটা মাইক্রো ভাড়া করার ব্যাবস্থা করল। যাবার সন্ধ্যায় সব কিছু রেডি। গাড়ি এসে অপেক্ষা করছে। মনির মা, বড় বোন, ছোট বোন এসেছে। তারাও এয়ারপোর্টে যাবে। রাশেদ সাহেবের সেঝ ভাই ছোট ভাই আর মেয়েরা সবাই যাবে। মালামাল গাড়িতে তোলা হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাবাকে সালাম করে বিদায় নিতে এলেন।
-আব্বা এর আগেও আমি অনেক বার এরকম যাত্রা করেছি কিন্তু সে সব যাত্রা আর আজকের এই যাত্রার মধ্যে অনেক পার্থক্য। জানি না এটাই আমার শেষ যাত্রা কিনা। ভুল ভ্রান্তি অনেক করেছি, অনেক বেয়াদবিও হয়ে গেছে মাফ করার যোগ্য মনে হলে মাফ করে দিবেন। আমি তো বাড়ি ছাড়া, দেশ ছাড়া হলাম আমার মেয়েরা রইলো।
মনে মনে ভাবলেন বাবা আপনাকে আবার দেখতে পাব কিনা জানি না। এই বলেই ভেজা চোখে বেড় হয়ে গাড়িতে উঠলেন। এয়ারপোর্টে পৌঁছে সবার কাছ থেকে একে একে বিদায় নিলেন। শাশুড়ি, বড় আপা, ছোট শ্যালিকা। শ্যালিকার গাল টেনে একটু রসিকতা করলেন, ছোট ভাই, সেঝ ভাই, সবার শেষে মেয়েদের কাছে। মনি মেয়েদের বোঝাচ্ছে কাঁদে না মা আমি তো কয়েক দিন পরেই আসছি। মেয়েদের একে একে সবাইকে বুকে নিয়ে মন শক্ত করার কথা বলে মনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
এয়ারলাইন্সের চেক ইন কাউন্টারে এসেই কায়সার বেয়াইর সাথে দেখা।
-আরে বেয়াই আপনি এখানে?
-লন্ডন যাচ্ছি। আপনারা?
-আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি।
-যাক ভালোই হলো
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-১১

২২।
বাড়ির কাউকে কিছু না বলে বুধবার সকাল সাড়ে সাতটায় রাশেদ সাহেব মনিরাকে নিয়ে বারিধারা ব্রিটিশ হাই কমিশনে গিয়ে অপেক্ষা করছিলো। অফিস খুলতেই গেটের সাথে ভিসা এক্সপ্রেসে রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টের সাথে মনির পাসপোর্ট, আবেদন ফি সহ ফর্ম জমা দেয়ার পর রাশেদ সাহেবের পাসপোর্ট একটু উল্টেপাল্টে দেখে হাতে একটা টোকেন দিয়ে বলে দিল আগামী কাল সারে এগারোটায় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। রাশেদ সাহেবের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কোন রকম ইন্টার্ভিউ ছাড়াই মনির ভিসা! বিশ্বাস করবে কি করবে না এমন দুরুদুরু ভাব নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।
পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় আবার এসে ভিসা এক্সপ্রেসে ওদের টোকেন দেখানর পর খুঁজে ওদের পাসপোর্ট দিয়ে দিল। বাইরে এসে খুলে দেখে মনিরার এবং রাশেদ সাহেবের ভিসা দিয়ে দিয়েছে। আনন্দে রাশেদ সাহেব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কেঁদে ফেললেন। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই ভাবে কোন ইন্টার্ভিউ ছাড়া, উৎকণ্ঠা নিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে থাকা ছাড়া মনির ভিসা এত সহজে পাবে, এতো স্বপ্নাতীত। মনিও কেঁদে ফেললো। মনিরা কাঁদতে কাঁদতে বললো-
-তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্যই আমি যাচ্ছি। আমি জানি অনেক আলোচনা সমালোচনা হবে, অনেক ঝড় উঠবে, অনেক গঞ্জনা যন্ত্রণা পোহাতে হবে তবুও শুধু তোমার জন্য আমি সব মেনে নিতে প্রস্তুত।

মনে মনে খোদাকে ডেকে বললেন ‘হে খোদা তোমার দরবারে শোকর জানাবার ভাষা আমার মনে আসছে না, তুমি তো সবই জান, তোমার মনিকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, নিশ্চয়ই তুমি এটা জান বলেই আমার প্রতি এই রহমত করেছ।
একটু শান্ত হয়ে মামাকে ফোন করে জানিয়ে বাড়িতে মেয়েদের জানালেন।
-মামা বললেন তাহলে তোরা দেরি করবি না।
একটা ঠিকানা দিয়ে বলে দিলেন এই ঠিকানায় যেয়ে আমার কথা বলে টিকেট ফাইনাল করে এক বারে বাসায় যাবি, আমি ওদেরকে বলে দিচ্ছি।
মামার কথা মত ওরা একটা স্কুটার নিয়ে মতিঝিলের একটা ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে এসে টিকেট কনফার্ম করে পাসপোর্ট দিয়ে চলে এলো। আগামী বুধ বারে রাত এগারোটায় ফ্লাইট। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে লন্ডন। পরশু এসে পাসপোর্ট টিকেট নিয়ে যেতে বলে দিল। বাড়িতে ফেরার পথে স্কুটারে বসে মনির মুখের দিকে চেয়ে দেখে মনির ঠোট নীল হয়ে গেছে, চেহারা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।
-কি ব্যাপার মনি তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, কি হয়েছে?
-সাধে কি আর তোমাকে আমি নাদু গোপাল বলি?
-কেন কি হয়েছে?
আমাকে তো নিচ্ছ কিন্তু যেয়ে থাকবো কোথায়? তুমি একা পুরুষ মানুষ যেখানে সেখানে থাকতে পারতে।
-আরে বোকা এ হচ্ছে লন্ডন এখানে কি ভেবেছ মানুষ ফুটপাথে বা রেল স্টেশনে থাকতে পারে? ওটা শীতের দেশ না? ওখানে কেও ফুটপাথে থাকে না। আমার ভাই তার ওখানে যেতে নিষেধ করেছে বলে কি ভেবেছ আমার কোন জায়গা নেই? তুমি জান না, সারা পৃথিবীতে আমার সব বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে? আর আমার বন্ধুদের তো জানই তারা কেমন।
-ওখানে কে আছে?
-আছে, আছে। ভেবো না
-বল না কে আছে।
ওখানে ফিরোজ আছে, শাহিনের বোন আছে। ফিরোজকে আজই মেইল পাঠাবো।
-কোন ফিরোজ?
-তুমি চিনবে না।
-আমার ভয় করছে!
-আরে পাগল নাকি? কি যে বল, আমি আছি না? সারা জীবন দেশের বাইরে কাটান স্বামীর স্ত্রী তুমি, আর তুমি আমার উপর এটুকু আস্থা রাখতে পারছ না?
কথা বলতে বলতে বাড়িতে এসে পৌঁছে গেলো। বাড়িতে এসে সবাইকে জানিয়ে দিল, মনিও যাচ্ছে আমার সাথে। বৌ যাচ্ছে, ভাবী যাচ্ছে শুনে সবাই অবাক!
-এতো টাকা পেলেন কোথায়?
-টাকা কি আর পাওয়া যায়, ম্যানেজ করেছি।
এই শুরু হলো সন্দেহের আর এক স্তর যা রাশেদ সাহেবের সরল মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকল না।
ঘনিষ্ঠ দুই এক জন আত্মীয় স্বজনকে জানিয়ে দিল। মনের ভিতর একটা করুণ বেহাগের সুর বাজিয়ে আস্তে আস্তে বাঁধা ছাঁদার কাজ করছে। মনিরার মন থেকে অজানা আতংক কোন ভাবেই দূর হচ্ছে না। সব সময় তার মনে হচ্ছে কি জানি কখন কোথা থেকে কি হতে কি হয়ে যায়। রাশেদ সাহেব তাকে অভয় দিয়ে বুঝিয়ে যাচ্ছেন আর যা যা নিয়ে যেতে হবে তা সংগ্রহ করছেন। দু এক জন আত্মীয় এসে দেখা করে তাদের মত করে কিছু পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। এক দিন বিকেলে মনিরার বড় বোন আর দুলাভাই এলেন। তারাও মনিরাকে বোঝালেন।
-এ তো ভালোর জন্যই হয়েছে। তুমি ওকে হতাশ করে দিও না। ও যা বলে সেই ভাবে চলো। মনে সাহস সঞ্চয় কর। যে যাই বলে বলুক এখন তোমার সেদিকে মন দিলে চলবে না। তুমি শুধু রাশেদের কথা ভাব। বাসায় মেয়েদের জন্য চিন্তা করো না। ওদের চাচী থাকছে তাছাড়া ফুফু, নানী, খালা যে যখন পারে এসে থাকবে। মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার। তুমি তো আবার চলেই আসবে।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-১০

২১।
সন্ধ্যায় নেয়া ছোট ভাইয়ের দেখান সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে আর কি করবে? কিন্তু তার পরেও একটা কাটার খোঁচা তার মনে বিঁধেই রইলো। মনি। মনিকে ছাড়া সে থাকবে কি ভাবে? আর মনিই বা থাকবে কি ভাবে? হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো। আচ্ছা মনিকে যদি সে এবার সাথে নিয়ে যায় তাহলে তো মনি অন্তত বছরে একবার করে যেতে পারলেও এতটা অসহ্য মনে হবে না। ওর সাথে যদি মনির ভিসার জন্য এপ্লাই করে তা হলে কোন সমস্যা নেই, ভিসা পেয়ে যাবে।
হ্যাঁ, তাইতো এই কথাই ঠিক। কিন্তু, এতো টাকা পাবে কোথায়? তার নিজের ভাড়ার টাকার কোন হদিশ নেই, মনির জন্য কোথায় পাবে? তাছাড়া বাড়ির সবাই ভাববে, ভাত জোটে না আবার বুড়ো বয়সে হানিমুন করতে বিলাত যাচ্ছে! কিন্তু কিন্তু করতে করতেই রাশেদ সাহেব ভেবে নিয়েছে, এই ই করতে হবে। মনি যদি বৎসরে এক বারও যেতে পারে তা হলেও অন্তত এই দীর্ঘ চার বৎসরের বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা পোয়াতে হবে না। আর একটা কথা হচ্ছে এখন মনে হচ্ছে চার বৎসর, আসলে যে এর চেয়ে বেশি হবে না তাই বা কে জানে।
-মনি, ঘুমিয়েছ?
-না, তুমি যেভাবে ধরে রেখেছ তাতে ঘুম আসে?
-এই সংলাপ আবার কবে আমদানি করলে, আমি কি এই নতুন ধরে রাখলাম, ধরে তো রয়েছি আজ ছাব্বিশ বছর ধরে।
-কিছু বলবে?
-হ্যাঁ, বলছিলাম কি, একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেললো, তুমিও চলো না আমার সাথে
মনিরা কিছু না বুঝে বললো-
-সাধে কি আর আমি পাগল বলি?
-না সাধে বলবে কেন আমি তো পাগল, আর এজন্য তো তুমিই দায়ী, তুমিই আমাকে পাগল বানিয়েছ।
-আচ্ছা ঠিক আছে এজন্য যে শাস্তি দিতে চাও কাল দিও এখন ঘুমাও।
বলেই শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে স্বামীর গায়ে মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল।
সকালে উঠে আবার মনিকে কাছে ডেকে নিয়ে বললো-
-তুমি তো পাগল বলেই খালাস, আমার কথাটা একটু মন দিয়ে শোন।
-বল।
রাশেদ সাহেব রাতের ভাবনা গুলি আবার বুঝিয়ে খুলে বললো । আরও বললো যে নয়া মামার অনেকের সাথে জানা শোনা আছে তাদের কারো ট্রাভেল এজেন্সি আছে, তাকে বলে দেখি যদি বাকিতে বা অন্য কোন ভাবে দুইটা টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারে।
শুনে মনিরা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-টিকেট দুইটা কেন?
-বারে, রাতে কি বললাম আর এতক্ষণে বা কি বললাম?
-না, না, তা হবার নয়। তুমি এভাবে ভেবো না, এসব এই মুহূর্ত সম্ভব নয়, সবাই বলবে কি?
-সবার কথা বাদ দাও, আমি তো তোমাকে নিয়ে হানিমুন করতে বা রং ঢং করতে যাচ্ছি না, শুধু তোমার ভিসার একটা ব্যবস্থা হয় এই জন্য। তুমি যেয়ে অন্তত এক সপ্তাহ থেকে এলেও হবে। এবার আমার সাথে গেলে যত সহজে ভিসা হবে পরে এমন সহজে আর হবে না। দেখ এক নাগারে এতো দিন আমি আমার মনিকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবো না।
-থাকতে কি আমিও পারবো?
-তাহলে আর এমন করে বলছ কেন?
মনিরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হলো না।
-দেখ মনি, আমি যদি এতো দিন তোমাকে ছাড়া থাকি তাহলে আর আমাকে সুস্থ ফেরত পাবে না, নিশ্চয়ই আমি পাগল হয়ে যাব। তুমি কি বাকী জীবন এক জন পাগলকে নিয়ে চলতে পারবে?
শেষ পর্যন্ত মনিরাকে হার মানতেই হলো।
নাশতা খেয়ে রাশেদ সাহেব বের হয়ে সোজা মামার অফিসে গিয়ে সব খুলে বললেন।
শুনে মামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন-
-ঠিক বুদ্ধি করেছিস। তুই তোদের ভিসার জন্য প্রসেস কর আমি টিকেটের ব্যবস্থা করে দিব, আজ রাতেই তোকে ফোনে জানাব, টিকেট নিয়ে তুই ভাবিস না। এখনই বাসায় গিয়ে ওয়েব সাইট থেকে ভিসা ফর্ম নিয়ে ফিল আপ করে কালই দিয়ে আসবি। এপ্লাই করার টাকা আছে?
-না।
-তাহলে সে কথা বলছিস না কেন? একটু অপেক্ষা কর, টাকা নিয়ে যা।
একমাত্র মামাই তার যন্ত্রণা বুঝতে পারলেন। মামা হলেও প্রায় সম বয়সী, এক সাথে বিড়ি সিগারেট খায়। মামাই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দেয়, নে। এজন্যেই মামা বুঝতে পেরেছেন। মামার অফিস থেকেই ফোন করে মনিকে জানালেন। সবাই যখন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন একমাত্র এই মামাই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
-কিছু খাবি?
-না, এইতো নাশতা করে এসেছি।
-তা হলে একটু চা খা এই ফাঁকে আমি কবিরকে ব্যাংকে পাঠাই?
-তা করা যায়।
কলিং বেল টিপে কবিরকে চা দিতে বলে ব্রিফ কেস থেকে চেক বই বের করে লিখে রাখলেন। কবির চা নিয়ে এলে তার হাতে চেকটা দিয়ে দিলেন। চা খেতে খেতেই কবির টাকা নিয়ে এলো।
টাকা নিয়ে খুশি মনে মামার অফিস থেকে বের হয়ে সোজা বাড়িতে এসে ছোট ভাইয়ের কম্পিউটার অন করে ব্রিটিশ হাই কমিশনের ওয়েব সাইটে খুঁজে খুঁজে ভিসার ফর্ম বের করে প্রিন্ট করে তা পূরণ করে মনিরাকে ডেকে সই স্বাক্ষর দিতে বললো ।
মনি ইতস্তত করছে দেখে রাশেদ সাহেব বললো-
-নাও সই কর, ভয় কিসের তোমার সতীন আনতে যাচ্ছি না তোমাকে নিয়েই রংগ লীলা করতে যাচ্ছি ভয় পেয়ো না।
-আমি সে ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি আমাকে আল্লাহর রহমতে সতীনের মুখ দেখতে হবে না, সে ব্যাপারে আমার কোন ভয় নেই। আমি ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে।
-আহা সই করতো, ভয়ের কোন কারণ নেই, যা হবার হোক। কাল সকালে চলো এগুলি জমা দিয়ে আসি।
-না কাল না।
-তাহলে?
-বুধবারে চলো।
-মানে আজ সোম বার, তুমি পরশুর কথা বলছ?
-হ্যাঁ, তোমার সব শুভ কাজ বুধ বারেই হয়, এ যাবত তাই দেখে আসছি।
-আচ্ছা বুঝেছি, তাহলে তাই হবে পরশুই চলো।
রাতে মামা ফোন করে রাশেদকে চাইলেন, রাশেদ ফোন ধরতেই ও পাশ থেকে মামা বললেন
-হাই কমিশনে গিয়েছিলি?
-না।
-কেন?
-মনি রেডি ছিলোনা তাই কাল যাব।
-আচ্ছা ঠিক আছে। টিকেটের ব্যাপারে কথা বলেছি। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে পাওয়া যাবে কিন্তু শর্ত হচ্ছে এক মাসের মধ্যেই টাকা দিতে হবে। কি করবি, পারবি?
-হ্যাঁ তা পারা যাবে।
-তাহলে তোরা কালই যা দেখ কি হয়, আমাকে জানাবি।
[হেমন্তের এই শিশির ভেজা পথে রাশেদ সাহেবের চলার সাথে সাথে এই উপাখ্যান চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৯

১৯।
সিনেমা আর কতক্ষণ চলতো জানিনা, কোচ ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ডে এসে থেমে গেলো। কোচের সুপারভাইজার শেখানো তোতা পাখির মত মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে ভ্রমণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজধানী ঢাকা

শহরে এসে তাদের যাত্রা পথের সমাপ্তি ঘোষণা করলো। যাত্রীরা সবাই একে একে নেমে গেলো রাশেদ সাহেবও তার ব্যাগটা খুঁজে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে কোচ থেকে নেমে গাবতলি গামী একটা লোকাল বাসে কল্যাণপুর নেমে ভোর হবার বেশ অনেক আগে রিকশা না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার বাবার তৈরি বাড়িতে যেখানে তাকে তার স্ত্রী সহ সন্তানদের আশ্রয় দিয়েছে, যেখানে তার মনি সহ তিন মেয়ে রয়েছে সেই বাড়ির সামনে এসে দেখলো এখনও কেও ওঠেনি।
কলিং বেলের সুইচ টিপে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই কলাপসিবল গেটের ফাঁকে মনির সদ্য ঘুম ভাঙ্গা হাসিতে উজ্জ্বল মুখটা দেখতে পেলেন। চাবি নিয়ে এসে গেটটি খুলে দিলে রাশেদ সাহেব ভিতরে ঢুকতেই মনিরা রাশেদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরল, যেন কত যুগ ধরে সঞ্চিত কত বিরহের অবসান হয়ে মহা মিলন হলো।
-কি করছ? চলো ভিতরে যেয়ে নিই, মানুষে দেখবে তো!
-দেখুক।
-এই তো মাত্র দুই রাত আর এক দিন গেছে এর মধ্যেই এতো!
-হু, আমার মনে হচ্ছে কতকাল তোমাকে দেখি না, কেমন আছ তুমি?
-কাল সন্ধ্যায় না কথা হলো, ভালো না হলে রাত জেগে এলাম কি করে? তুমি, তোমার মেয়েরা কেমন আছ?
-সবাই ভালো, চলো তুমি কাপড় বদলে নাও আমি গোসলের পানি গরম দিয়ে আসছি, তারপরে তুমি গোসল কর আর আমি নাশতা বানাই।

২০।
চিটাগাং থেকে ফিরে আসার পর কি করবেন ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। এমন সময় একদিন ছোট ভাই বললো-
-দাদা, আপনি যদি লন্ডন যেতে চান তাহলে চলে যান। আজ মেঝ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে, আপনি ওখানে যেতে চাইলে যেতে বলেছেন। তবে কথা হচ্ছে উনি যে শহরে থাকে সেখানে থাকতে পারবেন না এবং যাবার ভাড়া আপনাকে ব্যবস্থা করতে হবে। আর আমি বলছি যদি যান তাহলে অন্তত চার বছর থাকবেন এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। এখন ভেবে দেখেন কি করবেন, চার বছর কিন্তু একেবারে কম না। যাওয়া হলে এখানে এখন যেমন রেখে যাবেন এসে তেমন পাবেন না। হয়ত এসে দেখবেন আপনার অবর্তমানেই মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়েছে, ছোট মেয়ে স্কুল কলেজ সেরে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে বা আরও কত পরিবর্তন হতে পারে যা এখন ভাবা যাচ্ছে না। এর আগে যেমন গিয়েছিলাম এবার কিন্তু তেমন নয়। যদিও একবার ভিসা পেলে পরের বার ভিসার জন্য সমস্যা হয় না। ভেবে দেখেন কি করবেন।
মনি পাশেই বসে ছিলো। রাশেদ সাহেব মনির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
মনি বললো-
-তাই কর, অনেকেই এমন কত প্রয়োজনে কত কি করছে কত জায়গায় যাচ্ছে, চেষ্টা তো কম করা হলো না।
-যেতে বলছ কিন্তু যাবার ভাড়ার টাকা পাব কোথায়?
-সে দেখা যাবে, তুমি মত দিলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে তাহলে ভাড়ার টাকা জোগাড় করে নিই পরে ভিসার জন্য এপ্লাই করি, এটাই তাহলে ফাইনাল।

রাতে শুয়ে মনিরাকে জড়িয়ে ধরে ভাবছে একা একা এভাবে চারটা বৎসর মনিকে না দেখে থাকবো কি করে আর মনিই বা থাকবে কি করে, সিদ্ধান্ত তো নিয়ে ফেললাম!
সিদ্ধান্ত নেয়া আর তা বাস্তবায়ন করা এক নয়। তাদের বিয়ে হয়েছে আজ ছাব্বিশ বছর, বিয়ের পর থেকে বিগত ছাব্বিশ বত্সরের নানা স্মৃতি ভেসে এলো মাথায়। ঘরে তিন মেয়ে, মেয়েদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত। তাদের পোষাক আসাক, চিকিৎসা, বই পত্র কত কি! মেয়েদের হাতে কোন রকম দশটা টাকা দিয়ে বলা যায় না যে বাসে করে ঝুলে গিয়ে ক্লাস করে এসো, ঢাকা শহরে বাসে চেপে মেয়েদের স্কুল কলেজে যাতায়াত ভাবাই যায় না।
দেশের জন্য, দশের জন্য বড় কিছু করার স্বপ্ন তার ধুলায় মিলিয়ে কোথায় চলে গেছে এখন বাঁচবে কি করে এই চিন্তায় অস্থির। শেষ পর্যন্ত ভাবল অনেকেই তো নানা রকম অপরাধ করে জেলে বা হাজতে বাস করছে, তাদেরও তো দিন চলে যাচ্ছে, না হয় সে ভেবে নিবে সেও এমন কোন অপরাধ করেছে যার শাস্তি হিসেবে তাকে অজ্ঞাত বাসে বা নির্বাসনে যেতে হবে, সে তো এমনই অপরাধ করেছে।

ওই তো, তার সহকর্মী নির্বাহী প্রকৌশলী শফিক সাহেবের কি হলো? আহা বেচারা নির্দোষী সহজ সরল মানুষটা! অফিস থেকে ট্রেনিং এর জন্য বাইরে পাঠাল আর ফিরে আসতে না আসতেই তেল চুরির অপরাধে চাকরিটাই চলে গেলো। তারও তার মেয়েদের বয়সী তিন মেয়ে। মেয়েগুলোর দিকে তাকান যায় না। বিভাগীয় চূড়ান্ত নির্দেশের প্রেক্ষিতে তা মকুফের আবেদন নাকচ হবার পর শফিক সাহেব আদালতে মামলা করলো, আপীল করলো কোন লাভ হলো না।
তার স্টোর কিপার পঁয়ত্রিশ লিটার তেলের ইন্ডেন্ট বানিয়ে শফিক সাহেবের স্বাক্ষর নিয়ে সেটাকে তিন শত পঁয়ত্রিশ করে তেল উঠিয়ে বিক্রি করে দিত। যে জাহাজ ডকে রয়েছে তার নামে ভুয়া ইন্ডেন্টে শফিক সাহেবের স্বাক্ষর জাল করে দশ হাজার লিটার ডিজেল উঠিয়ে বিক্রি করে দিত এই ভাবে নানা ফন্দি ফিকির করে টাকা কামিয়ে এক দিনেই তিনটা হিনো বাস কিনে রাস্তায় চালু করে দিয়েছে তার আয় দিয়েই সে চলছে, তারও চাকরি গেছে, কিন্তু সে তো বাসের আয় দিয়ে চলে যাবে।
শফিক সাহেবের যে সে উপায় নেই! সে তো চুরি করেনি বা চুরির ভাগও পায় নি। ওহ! কি কষ্টে যে তার দিন যাচ্ছে সে না দেখলে বোঝার উপায় নেই! মেয়েদের মামা বাড়ি থেকে কিছু দেয়, চাচারা কিছু দেয় এই দিয়েই মেয়েদের লেখাপড়া চলছে। কোন ভাবে দিন যাচ্ছে।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৮

১৭।
সেদিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো বলে আর কিছু করার ছিলো না তবে রাশেদ সাহেব বাবাকে বলে রাখলেন সে যেন কালই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। মনিকে বলে রাখলেন কাল যেন সময় মত তাদের পাঠিয়ে দেয়। পর দিন
ডাক্তার দেখেই বলে দিল যে ‘ব্রেস্ট ক্যান্সার’, বি লেভেলে চলে গেছে আপনি এতো দিন আসেননি কেন? এ তো এখনই অপারেশন করতে হবে। আপনারা টাকা পয়সা আর সবার অনুমতি নিয়ে কালই চলে আসুন। বাড়িতে ফিরে সবার সাথে আলাপ হলো।
রাশেদ আর তার ছোট ভাইয়ের বক্তব্য,
-না, অপারেশন করতে হলে কিছুতেই এখানে না, কোলকাতা গিয়ে করাতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো সাথে কে যাবে? বাবা সিদ্ধান্ত দিলেন সেঝ বৌ আর রাশেদ যাবে। মা বেঁকে বসলেন।
-না, যেতে হলে বড় বৌকে ছাড়া আমি যাবো না।
এ বাড়ির সবারই পাসপোর্ট আছে কাজেই দেরী করতে হয়নি। মার কথা মত পর দিনই ভিসার জন্য সবার পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হলো। তার পরের দিন ছোট ভাই গিয়ে পাসপোর্ট ভিসা সহ তিনটা টিকেট নিয়ে এলো। ওই দিনই রাতের কোচ। তার পর দিন কোলকাতার বেহালায় ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে। ওরা সারা দিন এটা সেটা নানান টেস্ট ফেস্ট করে জানাল আগামী দশ দিন পূজার বন্ধ আপনারা এর পরে আসুন। রাশেদ সাহেবের পিলে চমকে গেলো, বলে কি? এটা তো আর নিজের দেশ না, এখানে কী করতে পারবে সে?
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পাশেই একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে গেলো। মা আর মনিকে রেখে রাশেদ বের হয়ে গেলো বেহালা বাজারে। বাজার থেকে মায়ের পছন্দের বাজার এনে দেখে এর মধ্যেই মনিরা ফ্ল্যাটের পাশের দোকান থেকে হাড়ি পাতিল কিনেছে আর গ্যাস সিলিন্ডার সহ একটা সিঙ্গেল বার্নার চুলা ভাড়া করে এনে মৃত্যু পথ যাত্রী শাশুড়ির জন্য রান্নার যোগাড় করে নিয়েছে।

রাশেদ বাজার নামিয়ে দিয়ে আবার বের হলো ফোন বুথ খোঁজার জন্য। বিলাতে মেঝ ভাইকে জানাতে হবে। তাকে বিস্তারিত জানিয়ে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কোথায় আছে খুঁজতে বের হলো। আশে পাশের দোকান, লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে সন্ধান পাচ্ছে না এমন সময় একজনের সাথে আলাপ হলো যার পূর্ব পুরুষ বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ শুনে নিজেই এগিয়ে এসেছেন, পেশায় ডাক্তার। সব শুনে সে সল্ট লেকের এক ডাক্তারের ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে বলে দিলেন উনি আমার শিক্ষক।
আপনি এখনি ফোন করে দেখুন উনি কি বলে। রাশেদ সাহেব দেরি না করে একটু আগে যে বুথ থেকে ফোন করেছিলেন আবার সেখানে গিয়ে ফোন করলেন। ডাক্তার সাহেব নিজেই ধরেছেন, শুনে বললেন হ্যাঁ ঠিক আছে আপনি সন্ধ্যা সাতটায় আসুন। ফোন রেখে মার ক্ষুধা লেগেছে ভেবে তার প্রিয় দৈ চিড়া নিয়ে এসে দেখে মনিরার রান্না প্রায় শেষের দিকে। মা দৈ খেতে চাইল না, বললো এই তো রান্না প্রায় হয়ে গেছে। একটু পরেই মনি খেতে দিল। রূপচান্দা মাছ ভাজা, ডাল আর ভাত। ভাত মুখে দিয়ে মা বৌকে কাছে টেনে নিলেন। নিজের দেশ ছেড়ে এসে তার নিজের হাতে ছাব্বিশ বছর ধরে গড়া বৌয়ের হাতের রান্না তার কাছে অমৃতের মত লাগছে তাই কান্না থামাতে পারেননি,
-তুমি তো আসতে চাইছিলে না, তুমি না এলে আমাকে কে এই রান্না করে দিত?
-না মা, আমি তো নিষেধ করিনি, আব্বাই তো রেখার নাম বলেছে।
খাবার শেষ করতেই বিকেল হয়ে গেলো। অচেনা জায়গা, এখান থেকে সল্ট লেক যেতে কতক্ষণ লাগে জানা নেই বলে একটু আগেই বের হলো। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সল্ট লেক ডাক্তার ঘোষের চেম্বার। ডাক্তার ঢাকার প্রেসক্রিপশন দেখলেন, রুগী দেখে রোগীকে পাশের ঘরে নিয়ে বসিয়ে আসতে বললেন। মনি মাকে নিয়ে পাশের ঘরে বসিয়ে এলো। ডাক্তার জানতে চাইলেন,
-ইনি আপনার কি হয়?
-মা।
-তাহলে এতো দেরী করেছেন কেন, এখন বি স্টেজে চলে গেছে, এই লেভেলে চলে গেলে মাস ছয়েকের বেশি রাখা যায় না। আপনারা চাইলে আমি অপারেশন করতে পারি এতে আমার লাভ হলেও আপনাদের কোন লাভ হবে না
শুনে রাশেদ মনি দুই জনেরই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে মনি জিজ্ঞেস করলো তাহলে এখন কি করা যায়? আপনি বলে দিন কোথায় গেলে ভাল হবে সে যেখানেই হোক তা নিয়ে ভাববেন না, যত টাকা লাগে লাগবে।
-দেখুন কার কাছে পাঠাবো বলুন, যদি অন্য কারো কাছে কোন ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সেটা আমার কাছেও থাকতো।
রাশেদ সাহেব কিছু বলতে পারছে না, শুধু একবার মনির দিকে আবার ডাক্তারের দিকে চেয়ে দেখছে।
মনি আবার বললো, -তা হলে?
-তা হলে এখন ওই কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি এই সব দিয়ে যত দিন থাকে। আর দেরী করবেন না। আপনারা একটু বসুন আমি কেমো থেরাপি দিয়ে নিই।
কেমো দেয়ার পর বললেন একটু বসুন দেখি কি অবস্থা হয়। আধা ঘণ্টা পর বললেন এখন নিয়ে যান। তবে আপনারা কালই চলে যাবেন না। অন্তত তিন দিন এখানে থাকুন, কেমোর কোন সাইড এফেক্ট দেখা দেয় কিনা সেটা দেখতে হবে। তিন দিন পর এখানে আসার দরকার নেই যেখানে আছেন ওখান থেকে আমাকে ফোনে জানাবেন, যদি ঠিক থাকে তাহলে চলে যেতে পারবেন। এর পরে আর রোগীকে কষ্ট দিয়ে এখানে আসতে হবে না আপনাদের ঢাকাতেই আমার চেনা ডাক্তার আছে আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি তাকে আমার এই প্রেসক্রিপশন দেখাবেন, আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি উনি সেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
রাশেদ সাহেব ঠিকানা দেখল, -এতো আমাদের বাড়ির কাছেই।
দেশে ফিরে এসে কোলকাতার ডাক্তারের দেয়া ঠিকানা খুঁজে ডাক্তারের সাথে দেখা করে প্রেসক্রিপশন আর তার চিঠি দেখালেন। ডাক্তার হিসেব করে তারিখ দিয়ে বলে দিলেন সেদিন নিয়ে আসার জন্য, এখানেই কেমোথেরাপি দেয়া যাবে। সব ভাই বোন, বৌ, জামাই, মেয়েদের ডেকে একত্র করে সবাইকে কঠিন মর্মান্তিক সংবাদটা জানিয়ে বলে দিলেন তোমরা মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকো। যে যে ভাবে পার তার সেবা করার চেষ্টা কর আর সে যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু বুঝতে না পারে এরকম অভিনয় করে যেও। বিলাতে ফোন করে ভাইকেও জানিয়ে দিল।
কয়েকদিন পর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এসে সেও শেষ দেখা দেখে গেলো। কেমোথেরাপি শেষ হলে চলল রেডিও থেরাপি। এক সময় এটাও শেষ হবার পর কি যেন কি একটা দামী ওষুধ দেয়া হলো। আত্মীয় স্বজনেরা নানা রকম খাবার এনে খাইয়ে দিয়ে শেষ দেখা করে গেলো। বডি স্ক্যানের ছবিতে দেখেছে শরীরের প্রায় সব হাড় ঝাঁজরা হয়ে গেছে। মা তার ব্যথা আর যন্ত্রণা যতটা সম্ভব চেপে রাখতে চাইতেন কিন্তু রাশেদ সাহেব তার মুখ দেখেই বুঝতে পারতেন কি যন্ত্রণা মা সহ্য করছেন। সারাক্ষণ বাড়িতে মায়ের কাছেই থাকতেন আর ভাবতেন হায়রে অর্থ! তুমি আমাকে ধরা দিলে না, আমি কি এতই ঘৃণ্য? তোমার জন্যই আমার মায়ের এই যন্ত্রণা আমাকে নিরুপায় হয়ে দেখতে হচ্ছে। বাড়িতে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই আছে।

স্থানীয় ডাক্তারের দেয়া সব ধরনের চিকিৎসা শেষ হবার পর কোলকাতার সেই ডাক্তারের কাছে ফোন করে জানতে চাইলেন এখন কি করতে হবে। উনি সব শুনে বলে দিলেন সবই তো হয়ে গেছে এখন দেবার মত আর কিছু নেই।
এর দিন দুয়েক পরেই মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। এই অবস্থায়ও নামাজ ছাড়েননি। সেদিন মাগরিবের নামাজের পর থেকেই শ্বাস কষ্ট দেখা দিল, বড় মেয়ে প্রেশার মেপে দেখল অসম্ভব রকম লো প্রেশার দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে মনির শ্বাস কষ্টের ওষুধ নেয়ার মেশিন নেবুলাইজার দিয়ে ওষুধ দিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিয়রে বসা মনির কাছে পানি চাইলেন। কে যেন এক গ্লাস পানি মনির হাতে এগিয়ে দিলে মনি এক হাতে মাথাটা একটু উঁচু করে ধরে পানি খাইয়ে দিল। পানি খেয়ে মনিকে জোরে চেপে ধরে তার কোলে মাথা রেখে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। প্রাণ বায়ু উড়ে গেলো, নির্বাক রাশেদ সাহেব পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখলেন।

১৮।
মনি রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাতের পাখা নামিয়ে নিশ্চল পাথরের মত মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরে ফুল স্পিডে ফ্যান চলছিলো এ ফ্যানের বাতাস মায়ের যন্ত্রণা মুছে দিয়ে বা উড়িয়ে না নিয়ে প্রাণ বায়ুটাই উড়িয়ে নিয়ে গেলো। বাবা, মনি সবাই হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছিলো। রাশেদ সাহেব বাবাকে বললেন ‘আব্বা হয়েছে আর বাতাস করতে হবে না’ বলেই হাত থেকে পাখাটি নিয়ে পাশে রেখে মায়ের মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন -কি করছিস?
মনি অনেক কষ্ট করে শুধু এটুকুই বলতে পারলো তার আর বাতাসের প্রয়োজন নেই আব্বা।
ঘর ভর্তি আত্মীয় স্বজনদের কেও কেও ডুকরে কেঁদে ফেললেন।
রাশেদ সাহেব বাবাকে বললেন আমি একটা অন্যায় করেছি আব্বা আমাকে ক্ষমা করবেন, সব কিছু আমি জানতাম, সবাইকে বলেছি কিন্তু আপনাকে বলতে পারিনি। বাবা বললেন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেঝ ভাই অফিসে, ছোট ভাই বাইরে গেছে। তাদের সবাইকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। বোনকে ফোনে জানালেন ওরা সবাই যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে চলে আসে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটরকে মৃত্যু সংবাদ দেয়ার কথা বলে জরুরী ভাবে কল বুক করলেন, প্রায় সাথে সাথেই লাইন পাওয়া গেলে বিলাতে মেঝ ভাইকে বললেন তোরা এখন কোথায় কি করছিস?
শুনে বললো -আম্মা তো আর নেই।
-কখন?
-এইতো চার মিনিট আগে।
-ও, আচ্ছা তাহলে আপনারা সব ব্যবস্থা করে ফেলেন, আমি এখনই টিকেট বুকিং দিচ্ছি, পেলে সাথে সাথেই আসছি, তবে আমার জন্য দেরী করবেন না।
আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিলেন। ছোট ভাইদের বন্ধুরা সবাই এলো, তারাই সব ব্যবস্থা করে ফেললো। সবাইকে ভাগাভাগি করে কোরান খতম করার কথা বলে দিলেন। পরদিন মিরপুর বুদ্ধি জীবী গোরস্তানে রেখে আসার আগ পর্যন্ত রাশেদ সাহেব অবিচল ছিলেন। যা যা করতে হবে তা যাকে দিয়ে যা করা যায় সবই ঠিক ভাবে করেছেন। যাকে যাকে সংবাদ দেবার তা তিনি নিজেই দিয়েছেন। গোরস্তান থেকে ফিরে এসে সবার অলক্ষ্যে গ্যারেজের এক কোণায় গিয়ে একা বসে পড়লেন। হঠাৎ করেই কান্না, সে কি কান্না! কোন পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদতে পারে এ এক বিস্ময়!
হঠাৎ ছোট মেয়ে দেখতে পেয়ে মাকে ডেকে নিয়ে এলো। মনি এসে মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে কোন ভাবে ওখান থেকে ঘরে নিয়ে এলো। মায়ের মৃত্যুর পরেই শুরু হলো রাশেদ সাহেবের অনন্ত পতন, একেবারে পৃথিবীর অতলে তলিয়ে যাবার যাত্রা আরম্ভ হলো তার।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৭

১৫।
দাউদকান্দি ব্রিজের কাছে এসে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ফিল্মের ফিতা ছিঁড়ে গিয়ে রাশেদ সাহেবের সিনেমা দেখা থেমে গেলো। রাশেদ সাহেব চমকে উঠলেন। সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলেন-

-কি ব্যাপার ভাই কি হয়েছে?
-না কিছু হয়নি সামনে বিরাট কিউ তাই থেমেছে।
মিনিট পনের পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করলেই সিনেমার ফিতা আবার জোড়া লেগে যায়।
একটা পরিবার, একটা সংসার, একটা বংশের উন্নতি ঘটানো কারো একার পক্ষে বা এক পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরা চার ভাইয়ের মধ্যে রাশেদ সাহেব বাদে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। রাশেদ সাহেব পড়াশুনার সুযোগ পেলেন কোথায়? তবুও তার সাথে কথা বলে, তার আচার আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা, মানুষের সাথে মেলামেশা দেখে বোঝার উপায় নেই। চমৎকার এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি। তাদের বাড়ির একটা সুনাম আছে, পড়ালেখা বাড়ি। নিজেদের বাড়ির একটা নামও ঠিক করে রেখেছেন কিন্তু বাড়িটা উপরে উঠার আগে এই নাম বেমানান তাই আর পয়সা খরচ করে নাম লেখা হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন তার ব্যবসার উন্নতি হলে আস্তে আস্তে দোতলা, তিন তলা, চারতলা, পাঁচ তলা করে আকাশের একটু কাছে গিয়ে চার ভাই আর এক বোন মিলে এক বাড়িতেই সুখে দুঃখে মিলে মিশে থাকবে, যাতে করে সবাই সবাইকে কাছে পায় এরকম একটা ইচ্ছে ছিলো। সে ইচ্ছে ইচ্ছে পর্যন্তই রয়ে গেলো, এ আর কোন দিন বাস্তব হবে বলে মনে হয় না। আরও কত আশা ছিলো। মনিরা এবং তার নিজের বাগান করার বেশ ঝোঁক।

চাকরির উপলক্ষে যেখানে থেকেছে সেখানেই একটা অস্থায়ী বাগান করে নিয়েছে। তা এই ঢাকা শহরে এতো জায়গা কোথায় পাবে যেখানে দালানকোঠার মাথা উঠে আকাশ ঢেকে ফেলেছে সেখানে বাগানের জায়গা কোথায় তাই ছাদের উপরে টব সাজিয়ে বাগান করবে। দুজনে মিলে এক সাথে পানি দিবে, গাছের যত্ন করবে, টব পরিষ্কার করে নতুন মাটি সার মিশিয়ে আবার নতুন গাছ লাগাবে।

মনিরা এর মধ্যেই ছাদের উপরে একটা ছোট বাগান করেছে যেখানে প্রতিদিন তার নিজের সন্তানদের মত করে ফুল গাছের যত্ন করে। যতক্ষণ বাগানে কাজ করা যায় ততক্ষণ মনে সুন্দর একটা প্রফুল্ল ভাব থাকে। একটা স্বর্গীয় সুবাতাস এসে মনে জমা কালিমাগুলি ঝড়ের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়। গাছ গুলি যেন কথা বলে আর ফুল গুলি তো হাসতেই থাকে। আজে বাজে দুশ্চিন্তাগুলি মনে ঢোকার দরজা খুঁজে পায় না। তার আরও স্বপ্ন ছিলো বাড়িটাকে লতায় পাতায় ঘেরা কুঞ্জবন বানাবে। যেখানে থাকবে নানা রঙের বাহার আর মৌ মৌ করা ফুলের গন্ধ। সেবার লন্ডন থেকে দেখে এসেছে কারুকাজ করা অক্ষরে বাড়ির নম্বর লেখা রয়েছে প্রায় বাড়িতে, তেমন করে নক্সা আঁকা বোর্ডের উপর কারুকাজ করা নম্বর প্লেট লাগাবে বাড়ির গেটে।

বিকেলে বা বৃষ্টির সময় সবাই মিলে বারান্দায় বসে চা পিঁয়াজু খেতে খেতে বৃষ্টি দেখবে, নয়তো জোসনা দেখবে, গল্প করবে। এর মধ্যেই সাভার হর্টাস নার্সারি থেকে ওয়াল কার্পেটের চাড়া এনে বাড়ির সীমানা দেয়ালে লাগিয়েছে, একটা বকুল গাছ লাগিয়েছে বাড়ির পিছনে দক্ষিণ পশ্চিম কোনায়, সামনের উত্তর পূর্ব কোনায় লাগিয়েছে একটা স্বর্ণ চাঁপা গাছ। বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হলে সিঁড়ির এক পাশে একটা মাধবী লতা আর অন্য পাশে হলুদ আলমন্ডা গাছ লাগিয়ে একেবারে ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো।
সামনের দিকে পূর্ব দক্ষিণ কোনায় যে বারান্দায় সবাই মিলে বসবে বলে ভেবে রেখেছে সেই বারান্দার নিচে গ্যারেজের পাশে একটা চামেলি গাছ থাকবে এটাও ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে নিতে চেয়েছিলো যাতে সবাই বসলে সারা বছরেই চামেলি বা মাধবী লতার পাগল করা গন্ধে মনে কোন কলুষতা আসতে না পারে। নানা ফুলের গন্ধে পুরো বাড়িটা হয়ে উঠবে একটা স্বপ্নপুরী বা মায়াকুঞ্জ কিংবা কুঞ্জবন।

নাম যেটা ঠিক করে রেখেছে তা হচ্ছে ‘পান্থনীড়’ বাড়িটা তো কয়েক পুরুষ ধরে টিকে থাকবে কিন্তু এ বাড়িতে যারা বাস করবে তারা আর বাড়ির মত ইট বা লোহার তৈরি নয় যে বাড়ির সমান বয়স পাবে। বাড়ির বাসিন্দারা পুরুষানুক্রমে যখন এক এক করে আসবে তখন আনন্দের মেলা বসবে আবার যখন প্রকৃতির ডাকে চলে যাবে তখন তেমনি তার উলটো কান্না কাটির ঝড় বয়ে যাবে। এই যে আসা যাওয়া এই নিয়েই তো সংসার। এই পৃথিবীতে সবাই সংসারের পথিক। ক্ষণকালের জন্য আসবে আবার চলেও যাবে।
যারা এই বাড়িতে থাকবে তারা না জানি কে কি পেশা নিয়ে থাকবে। হয়ত কেও শিক্ষক হবে, কেও ডাক্তার হবে, কেওবা উঁকিল ব্যারিস্টার বা কেও হয়ত নিতান্ত সাধারণ জীবন যাপনই করবে। এরাই হয়ত পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে আবার কোন বিশেষ দিনে প্রিয় জনের সাথে মিলিত হবার আগ্রহে আধির প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করবে। ও আসছে কে কি পছন্দ করে আহা বিদেশে থাকে কি খায় না খায় তার কি কোন ঠিক আছে? কি কি বাজার করতে হবে, কে কে এয়ারপোর্টে যাবে এই আয়োজনে ব্যস্ত থাকবে। যারা আসবে তারাও কার জন্য কি নিয়ে যাবে তাই নিয়ে মাস ধরে কেনা কাটার ধুম চলবে। সবাই এসে একত্র হবে।
বিশাল হৈ চৈ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠবে ক্ষণিকের জন্য, আবার সবাই সুখের একটা স্মৃতি নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন ভার করে যার যার কর্মস্থলে ফিরে যাবে। যারা থাকবে তাদের কাছে কিছু দিন বাড়িটা ফাঁকা মনে হবে। এক সময় আবার তা সয়ে যাবে। সবাই তো পথিক, এটা তো পথিকের ঘর, ক্ষণিকের জন্য আসা আর যাওয়া তাই এর নাম ‘পান্থনীড়’। রাশেদ সাহেবের এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এখনও যে তা বাস্তবায়নের কোন আভাস সে খুঁজে পায়নি, আজ চট্টগ্রাম থেকেও তেমন কোন আশার বাণী শুনে আসতে পারেনি।

১৬।
রাশেদ সাহেবের মা হঠাৎ করেই মারা গেলেন। হঠাৎ করেই বলা যায়। বুকে এক ঘা হয়েছিলো যা তিনি নিজে অনুভব করছিলেন কিন্তু কাউকে কিছু বলছিলেন না। যখন ব্যথা সহ্য করতে পারছিলেন না তখন এক দিন বড় বৌকে বললেন। মনিরা দেখে এসে তার স্বামীকে জানালেন। রাশেদ সাহেব শুনেই মায়ের কাছে এসে দেখতে চাইলেন। মা নিরুপায় হয়ে দেখালেন। দেখেই রাশেদ সাহেব বুঝলেন ‘ক্যান্সার’, তার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। মাকে বললেন-
-একি! আপনি কেন একথা এতদিন জানাননি?
মা নির্বাক। কোন কথা বলছেন না।
-কেন চেপে রেখেছেন বলেন।
-কি বলবো, তোর এই অবস্থা দেখছি ভাবলাম দেখি এমনিই হয় তো সেরে যাবে তাই বলিনি।
-আমার অবস্থা দেখে আপনি বলেননি বেশ কিন্তু আপনার তো আরও ছেলে আছে তাদের অবস্থা তো আমার মত নয়।
-ওদের কাছে কি আমি কখনো কিছু বলি?
-তাই বলে এই সর্বনাশ করবেন? জানেন এর ফল কত ভয়ঙ্কর?
মা নিরুত্তর। পরিবেশ নিস্তব্ধ।
রাশেদ সাহেব জানেন মা এক তাকে ছাড়া আর কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না, তাই বলে এর কি কিছুই মা বুঝতে পারেনি? তাকে বললে কি সে কিছুই করতে পারতো না? মায়ের জন্য কি তার কিছুই করার ছিলো না? সে নিজে না পারলেও অন্তত তার ভাইদেরকে তো জানাতে পারত এবং সে জানে ভাইয়েরা চুপ করে বসে থাকতে পারতো না, অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে ত্রুটি করত না।

সব নিয়তি, আজ যদি আমার এ অবস্থা না হোত তা হলে মা কিছুতেই এটা চেপে রাখতে পারতেন না। হায়রে অর্থ! হে মহান অর্থ! ওহে মহান, তুমি এতই উচ্চ শিখরে উঠে বসে আছ? হে সর্ব সমস্যার সমাধান, তোমার কাছে কি আমি এতই তুচ্ছ? তুমি আমাকে ধরা দিলে না, তোমার অভাবে যে আমার মা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে আর আমাদেরকে তাই বসে বসে দেখতে হবে। সময় মত তার চিকিৎসা করাতে পারলাম না। একি তুমি দেখতে পাচ্ছ না? তবুও তোমার এতো অহংকার কেন? হায়রে পলাতক অর্থ, তুমি আমার মায়ের এই সময়েও পালিয়ে রইলে? আমি তোমার সাথে কোন অন্যায় করিনি, কোন অমর্যাদা করিনি, আমি তোমায় দিয়ে জুয়া খেলিনি, আমিতো কোন নেশা করার জন্য তোমায় ব্যবহার করিনি, তোমার কোন অপব্যবহার করিনি। তাহলে কেন আমার থেকে দূরে রইলে? কেন আমার সাথে এই বঞ্চনা?
[চলবে]