(১)
শরৎ সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট হল নারী চরিত্রের বৈচিত্র্যময় সম্ভার। সেই সম্ভারের এক উজ্জ্বল সংযোজন “শেষ প্রশ্ন”-এর কমল। শরৎ সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্রগুলির মধ্যে কমল যেন অদ্বিতীয়। মনে হয় কোন ভিন গ্রহের বাসিন্দা। কিংবা অন্য কোন যুগের। সে যুগের ঠিকানা আমাদের ঠিক জানা নেই। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় পুরুষের আশা আকাঙ্খা বংশরক্ষার প্রয়োজনীয় গণ্ডীতেই যেখানে নারী জীবনের সব স্বাধীনতার সীমায়িত পরিসর, যেখানে তার মধ্যেই সামঞ্জস্য করে নিতে হয় অন্তরাত্মার সাথে বাস্তবের, সাধের সাথে সাধ্যের; সেখানে কমলের মত নারী চরিত্র সত্যিই এক উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। কমল একাধারে শাশ্বত ও আধুনিক।
(২)
কমলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট, কমল ভালোবাসতে পারে। হ্যাঁ নারী বরাবরই পুরুষকে ভালোবেসে চলে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কমল তার ভালোবাসাকে অন্যান্যদের মত “শুধু আমারই ভালোবাসা” বলে কোনো শীলমোহর লাগিয়ে তালা বন্ধ করে রেখে দেয় না। নিন্দুকের কথা কানে না তুলে সে তার ভালোবাসাকে নীল আকাশের মুক্তির ক্ষেত্রে স্থাপন করতে পারে।
এখানেই সে অনন্য। তাই শিবনাথ যখন তাকে এক কথায় প্রবঞ্চিত করে মনোরমাকে জীবনসাথী করে নেয় তখনও সে কত সহজে বলতে পারে- “সত্য যাবে ডুবে। আর যে অনুষ্ঠানকে মানিনে তারই দড়ি দিয়ে ওকে রাখব বেধে? আমি? আমি করব এই কাজ?” কমলের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না।অথচ এ যুগের আধুনিকা নারীরা কত সহজেই বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও স্বামীরই অর্থে প্রতিপালিত হয়েও গর্ব অনুভব করে থাকে। শরৎচন্দ্র “বেলা”র চরিত্রে যাদের ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু কমলের কথায়, “মনই যদি দেউলিয়া হয়, পুরুতের মন্ত্রকে মহাজান খাড়া করে সুদটা আদায় হতে পারে কিন্তু আসল তো ডুবল।” আশ্চর্য্য লাগে অধিকাংশ নারীই এই সত্যটাকে কত সহজেই ভুলে থাকে।
কমলের কথার সূত্র ধরে মনে হয় সত্যিই তো, এ জীবনে সুখ দুঃখের কোনোটাই শেষ সত্য নয়। সত্য শুধু প্রতিক্ষণের আন্তরিক অনুভবের চঞ্চল মুহূর্তগুলির আসা যাওয়া ছন্দটুকু। বুদ্ধি এবং হৃদয় দিয়ে সে মুহূর্তগুলিকে পাওয়াই তো সত্যিকার পাওয়া।তাই কমল জানত সে শিবনাথের কাছে যা পেয়েছিল, যতটুকু পেয়েছিল সেই তার অশেষ ধন। তাই যা পায়নি তা নিয়ে কাঁদাকাটি করতে তার শিক্ষায়, রুচিতে বেঁধে যায়।
কমল এটাও জানত পুরুষের কাছে কমল যতটুকু পায় তা তার নারীত্বের চরম ঐশ্বর্য্যের প্রতিফলনেই পায়। ফাঁকি দিয়ে নয়। রূপ দেখিয়ে মন ভুলিয়ে নয়। আর তাই পুরুষ যখন কমলকে ভালোবাসে, ভালোবাসতে পারে, সেই পারাটাও সম্ভব হয় কমলের স্বাধীন সত্তাজাত নারীত্বের অশেষ মহিমায়। এবং সেইখানেই কমলের নির্ভরতা। নির্ভরতা আবিশ্ব এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থগুলির প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধতার মধ্যেও।তাই তো হরেন্দ্র, শিবনাথ পরিত্যাক্ত নিঃসঙ্গ কমলের অবিচল দৃঢ়তায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবত “এত বড় নিঃসহায়তাও এই রমণীকে লেশ মাত্র দূর্বল করিতে পারে নাই। আজও সে ভিক্ষা চাহে না- ভিক্ষা দেয়।”
কমলের এই নির্ভরতার ক্ষেত্রটিকে অজিত উপন্যাসের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে কিছুটা ধরতে পেরেই বলেছিল, মেয়েরা যে বস্তুটিকে তাদের ইহজীবনের যথাসর্বস্ব বলে জানে, সেইখানে তোমার এমন সহজ ঔদাসীন্য যে, যত নিন্দেই করি, সে-ই যেন আগুনের বেড়ার মত তোমাকে অনুক্ষণ আগলে রাখে। গায়ে লাগবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”
না, সত্যিই কমল পুরুষের ভোগের বস্তু নয়। বস্তুত কোনো প্রকৃত নারীই কখনো পুরুষের ভোগের বস্তু হতে পারে না।নারীত্বের পূর্ণ মহিমায় পুরুষকে বিকশিত করে তোলার মধ্যে দিয়েই নারী প্রকাশ করতে পারে আপন অন্তরাত্মার মাধুরীকে। সেই তার চারিত্রশক্তি। সেই শক্তির পূর্ণ উদ্বোধনেই নারী জীবনের সার্থকতা। আর সেইখানেই তার আসল নির্ভরতা। কমল সেই নির্ভরতারই অব্যর্থ প্রতিচ্ছবি।
(৩)
কমল তার পিতার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিল জীবনে কখনো কোনো কারণেই মিথ্যা চিন্তা, মিথ্যা অভিমান, মিথ্যা বাক্যের আশ্রয় না নেওয়ার। এই বৌদ্ধিক শিক্ষাই কমলকে পদ্ম পাতায় বৃষ্টির জলের মত স্বচ্ছ করে তুলেছিল।তাই তো শিবনাথকে একদিন কমল যেমন ভালোবাসা দিয়েছিল, তেমনি আর একদিন শিবনাথের শঠতার প্রতিদানে তার প্রতি নির্মমতার বদলে কত সহজেই শিবনাথের সকল দোষ সকলের চোখের আড়ালে নিঃশব্দে নিঃশ্বেষ করে মুছে ফেলে দিতে পেরেছিল। সেই মুছে ফেলার মধ্যে না ছিল বিদ্বেষ, না ছিল জ্বালা, না ছিল ক্ষমা করার দম্ভ।
অজিতকে সে তাই কত সহজেই বলতে পেরেছিল গাছের পাতার শুকিয়ে ঝরে যাওয়াটাও যেমন সত্য ঠিক তেমনি সত্য সেই ক্ষত স্থানে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠা। বোঝাতে চেয়েছিল বাইরের শুকনো পাতা মরে গিয়েও গাছের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যে কামড়ে এঁটে থাকে সেইটাই হল মিথ্যে। সেই মিথ্যে জীবনের মোহ কমলের জন্য নয়।আশুবাবুকেও কমল তেমনি সহজে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে, “দুঃখ যে পাইনি তা বলিনে, কিন্তু তাকেই জীবনের শেষ সত্য বলে মেনেও নিইনি। শিবনাথের দেবার যা ছিল তিনি দিয়েছেন, আমার পাবার যা ছিল তা পেয়েছি- আনন্দের সেই ছোট ছোট ক্ষণগুলি মনের মধ্যে আমার মণি- মাণিক্যের মত সঞ্চিত হয়ে আছে। নিষ্ফল চিত্তদাহে পুড়িয়ে তাদের ছাই করেও ফেলিনি, শুকনো ঝরনার নীচে গিয়ে ভিক্ষে দাও বলে শূন্য দুহাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকিনি। তাঁর ভালোবাসার আয়ু যখন ফুরালো তাকে শান্ত মনেই বিদায় দিলাম, আক্ষেপ ও অভিযোগের ধোঁয়ায় আকাশ কালো করে তুলতে আমার প্রবৃত্তিই হয় না”এই সেই স্বচ্ছতা যার কথাই বলছিলাম। ঠিক সেই একই স্বচ্ছতায় কমল; আজকের অন্ধকার কালকের সকালের আলোয় যদি দূর হয়ে যায় তবে সেই “আলোকিত প্রভাতকেই সত্যি” বলে ভালবেসে জড়িয়ে ধরতে পারার আশায় বেঁচে থাকে।
অজিতকে তাই কমল একদিন বলেছিল “একদিনের আনন্দ যেন না আর একদিনের নিরানন্দের কাছে লজ্জাবোধ করে।” এখানেই কমলের শূচিতা। নির্মলতা। কমলের তাই মনে হয়, কোন আনন্দেরই স্থায়িত্ব নেই। আছে শুধু তার ক্ষণস্থায়ী দিনগুলি। সেই তো মানব জীবনের চরম সঞ্চয়। এখানেই কমলের অনন্যতা।
(৪)
কমল সেই দিপ্তীটুকু অর্জন করেছিল, জীবনের অর্থটাকে স্পষ্ট চোখে সোজাসুজি দেখতে পেলে চরিত্রের মধ্যে যে আলোটা জ্বলে ওঠে। কমল তাই জানত মানুষ শুধুমাত্র নরও নয়। নারীও নয়। নর নারী মিলেই তবে সে এক। তাই সে এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিল যে, মানুষের মধ্যে যারা বুঝেছিল নর নারীর ভালোবাসার ইতিহাসটাই হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো সত্য ইতিহাস, তারাই সত্যের খোঁজ পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি। আর যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বেই নারীর চরম সার্থকতা; সমস্ত নারী জাতিকেই তারা ছোট করেছিল। এবং সেই থেকেই বিবাহের স্থায়িত্বের মধ্যে নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে পুরুষতন্ত্র।নারীও যেদিন থেকে বিবাহ বন্ধনকেই জীবনের সর্বস্ব বলে মেনে নিয়েছে সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছে নারী জীবনের চরম ট্র্যাজেডি। দুঃসহ স্থায়িত্বের মোটা দড়ি গলায় বেঁধে মরতে হয়েছে নর নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাজাত নির্মল ভালোবাসাকে।
এই স্বাধীন ব্যাক্তিসত্তাজাত ভালোবাসাকে নির্মল হৃদয়ে নির্মোহ আনন্দে দীক্ষিত করে পূর্ণ জীবনবোধে উত্তীর্ণ করার সাধনাই কমলের ধর্ম।
এই ধর্মের জন্য সে সমাজের চোখরাঙানিকেও যেমন সহজ ভঙ্গিতে উপেক্ষা করতে পারে তেমনি ব্যক্তিগত দুঃখ যন্ত্রনাকেও অবলীলায় হাসিমুখে অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে পারে সামনের দিকে।এই নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে চলার তাগিদেই কোনো আদর্শকেই সে শেষ প্রশ্ন বলে শিরোধার্য করে থেমে যেতে পারে না।
তাই তো কত নিঃসঙ্কোচেই সে বলতে পারে “একদিন যাকে ভালোবেসেচি কোনোদিন কোনো কারণেই আর তার পরিবর্তন হবার জো নেই, মনের এই অচল অনড় জড়ধর্ম সুস্থও নয়, সুন্দরও নয়।”
তাই কমল কোনো কিছুতেই ভেঙ্গে পড়েনা। ভেঙ্গে পড়া আদর্শের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেই নতুন আদর্শের সৃষ্টির আশা তার চিত্তে দৃঢ় প্রত্যয়ে জেগে থাকে। আবার
সেই আদর্শের কাজ শেষ হলে আরও মহত্তর আদর্শের জন্ম হবে। এই প্রত্যয়েই সে বলে, “এমনি করেই সংসারে শুভ শুভতরের পায়ে আত্মবিসর্জন দিয়ে আপন
ঋণ পরিশোধ করে। এই তার মুক্তি পথ।”
শ্রীশুভ্র