ট্যাগ আর্কাইভঃ শরৎচন্দ্র

শেষপ্রশ্নের কমল

(১)

শরৎ সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট হল নারী চরিত্রের বৈচিত্র্যময় সম্ভার। সেই সম্ভারের এক উজ্জ্বল সংযোজন “শেষ প্রশ্ন”-এর কমল। শরৎ সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্রগুলির মধ্যে কমল যেন অদ্বিতীয়। মনে হয় কোন ভিন গ্রহের বাসিন্দা। কিংবা অন্য কোন যুগের। সে যুগের ঠিকানা আমাদের ঠিক জানা নেই। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় পুরুষের আশা আকাঙ্খা বংশরক্ষার প্রয়োজনীয় গণ্ডীতেই যেখানে নারী জীবনের সব স্বাধীনতার সীমায়িত পরিসর, যেখানে তার মধ্যেই সামঞ্জস্য করে নিতে হয় অন্তরাত্মার সাথে বাস্তবের, সাধের সাথে সাধ্যের; সেখানে কমলের মত নারী চরিত্র সত্যিই এক উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। কমল একাধারে শাশ্বত ও আধুনিক।

(২)

কমলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট, কমল ভালোবাসতে পারে। হ্যাঁ নারী বরাবরই পুরুষকে ভালোবেসে চলে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কমল তার ভালোবাসাকে অন্যান্যদের মত “শুধু আমারই ভালোবাসা” বলে কোনো শীলমোহর লাগিয়ে তালা বন্ধ করে রেখে দেয় না। নিন্দুকের কথা কানে না তুলে সে তার ভালোবাসাকে নীল আকাশের মুক্তির ক্ষেত্রে স্থাপন করতে পারে।

এখানেই সে অনন্য। তাই শিবনাথ যখন তাকে এক কথায় প্রবঞ্চিত করে মনোরমাকে জীবনসাথী করে নেয় তখনও সে কত সহজে বলতে পারে- “সত্য যাবে ডুবে। আর যে অনুষ্ঠানকে মানিনে তারই দড়ি দিয়ে ওকে রাখব বেধে? আমি? আমি করব এই কাজ?” কমলের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না।অথচ এ যুগের আধুনিকা নারীরা কত সহজেই বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও স্বামীরই অর্থে প্রতিপালিত হয়েও গর্ব অনুভব করে থাকে। শরৎচন্দ্র “বেলা”র চরিত্রে যাদের ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু কমলের কথায়, “মনই যদি দেউলিয়া হয়, পুরুতের মন্ত্রকে মহাজান খাড়া করে সুদটা আদায় হতে পারে কিন্তু আসল তো ডুবল।” আশ্চর্য্য লাগে অধিকাংশ নারীই এই সত্যটাকে কত সহজেই ভুলে থাকে।

কমলের কথার সূত্র ধরে মনে হয় সত্যিই তো, এ জীবনে সুখ দুঃখের কোনোটাই শেষ সত্য নয়। সত্য শুধু প্রতিক্ষণের আন্তরিক অনুভবের চঞ্চল মুহূর্তগুলির আসা যাওয়া ছন্দটুকু। বুদ্ধি এবং হৃদয় দিয়ে সে মুহূর্তগুলিকে পাওয়াই তো সত্যিকার পাওয়া।তাই কমল জানত সে শিবনাথের কাছে যা পেয়েছিল, যতটুকু পেয়েছিল সেই তার অশেষ ধন। তাই যা পায়নি তা নিয়ে কাঁদাকাটি করতে তার শিক্ষায়, রুচিতে বেঁধে যায়।

কমল এটাও জানত পুরুষের কাছে কমল যতটুকু পায় তা তার নারীত্বের চরম ঐশ্বর্য্যের প্রতিফলনেই পায়। ফাঁকি দিয়ে নয়। রূপ দেখিয়ে মন ভুলিয়ে নয়। আর তাই পুরুষ যখন কমলকে ভালোবাসে, ভালোবাসতে পারে, সেই পারাটাও সম্ভব হয় কমলের স্বাধীন সত্তাজাত নারীত্বের অশেষ মহিমায়। এবং সেইখানেই কমলের নির্ভরতা। নির্ভরতা আবিশ্ব এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থগুলির প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধতার মধ্যেও।তাই তো হরেন্দ্র, শিবনাথ পরিত্যাক্ত নিঃসঙ্গ কমলের অবিচল দৃঢ়তায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবত “এত বড় নিঃসহায়তাও এই রমণীকে লেশ মাত্র দূর্বল করিতে পারে নাই। আজও সে ভিক্ষা চাহে না- ভিক্ষা দেয়।”

কমলের এই নির্ভরতার ক্ষেত্রটিকে অজিত উপন্যাসের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে কিছুটা ধরতে পেরেই বলেছিল, মেয়েরা যে বস্তুটিকে তাদের ইহজীবনের যথাসর্বস্ব বলে জানে, সেইখানে তোমার এমন সহজ ঔদাসীন্য যে, যত নিন্দেই করি, সে-ই যেন আগুনের বেড়ার মত তোমাকে অনুক্ষণ আগলে রাখে। গায়ে লাগবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”

না, সত্যিই কমল পুরুষের ভোগের বস্তু নয়। বস্তুত কোনো প্রকৃত নারীই কখনো পুরুষের ভোগের বস্তু হতে পারে না।নারীত্বের পূর্ণ মহিমায় পুরুষকে বিকশিত করে তোলার মধ্যে দিয়েই নারী প্রকাশ করতে পারে আপন অন্তরাত্মার মাধুরীকে। সেই তার চারিত্রশক্তি। সেই শক্তির পূর্ণ উদ্বোধনেই নারী জীবনের সার্থকতা। আর সেইখানেই তার আসল নির্ভরতা। কমল সেই নির্ভরতারই অব্যর্থ প্রতিচ্ছবি।

(৩)

কমল তার পিতার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিল জীবনে কখনো কোনো কারণেই মিথ্যা চিন্তা, মিথ্যা অভিমান, মিথ্যা বাক্যের আশ্রয় না নেওয়ার। এই বৌদ্ধিক শিক্ষাই কমলকে পদ্ম পাতায় বৃষ্টির জলের মত স্বচ্ছ করে তুলেছিল।তাই তো শিবনাথকে একদিন কমল যেমন ভালোবাসা দিয়েছিল, তেমনি আর একদিন শিবনাথের শঠতার প্রতিদানে তার প্রতি নির্মমতার বদলে কত সহজেই শিবনাথের সকল দোষ সকলের চোখের আড়ালে নিঃশব্দে নিঃশ্বেষ করে মুছে ফেলে দিতে পেরেছিল। সেই মুছে ফেলার মধ্যে না ছিল বিদ্বেষ, না ছিল জ্বালা, না ছিল ক্ষমা করার দম্ভ।

অজিতকে সে তাই কত সহজেই বলতে পেরেছিল গাছের পাতার শুকিয়ে ঝরে যাওয়াটাও যেমন সত্য ঠিক তেমনি সত্য সেই ক্ষত স্থানে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠা। বোঝাতে চেয়েছিল বাইরের শুকনো পাতা মরে গিয়েও গাছের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যে কামড়ে এঁটে থাকে সেইটাই হল মিথ্যে। সেই মিথ্যে জীবনের মোহ কমলের জন্য নয়।আশুবাবুকেও কমল তেমনি সহজে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে, “দুঃখ যে পাইনি তা বলিনে, কিন্তু তাকেই জীবনের শেষ সত্য বলে মেনেও নিইনি। শিবনাথের দেবার যা ছিল তিনি দিয়েছেন, আমার পাবার যা ছিল তা পেয়েছি- আনন্দের সেই ছোট ছোট ক্ষণগুলি মনের মধ্যে আমার মণি- মাণিক্যের মত সঞ্চিত হয়ে আছে। নিষ্ফল চিত্তদাহে পুড়িয়ে তাদের ছাই করেও ফেলিনি, শুকনো ঝরনার নীচে গিয়ে ভিক্ষে দাও বলে শূন্য দুহাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকিনি। তাঁর ভালোবাসার আয়ু যখন ফুরালো তাকে শান্ত মনেই বিদায় দিলাম, আক্ষেপ ও অভিযোগের ধোঁয়ায় আকাশ কালো করে তুলতে আমার প্রবৃত্তিই হয় না”এই সেই স্বচ্ছতা যার কথাই বলছিলাম। ঠিক সেই একই স্বচ্ছতায় কমল; আজকের অন্ধকার কালকের সকালের আলোয় যদি দূর হয়ে যায় তবে সেই “আলোকিত প্রভাতকেই সত্যি” বলে ভালবেসে জড়িয়ে ধরতে পারার আশায় বেঁচে থাকে।

অজিতকে তাই কমল একদিন বলেছিল “একদিনের আনন্দ যেন না আর একদিনের নিরানন্দের কাছে লজ্জাবোধ করে।” এখানেই কমলের শূচিতা। নির্মলতা। কমলের তাই মনে হয়, কোন আনন্দেরই স্থায়িত্ব নেই। আছে শুধু তার ক্ষণস্থায়ী দিনগুলি। সেই তো মানব জীবনের চরম সঞ্চয়। এখানেই কমলের অনন্যতা।

(৪)

কমল সেই দিপ্তীটুকু অর্জন করেছিল, জীবনের অর্থটাকে স্পষ্ট চোখে সোজাসুজি দেখতে পেলে চরিত্রের মধ্যে যে আলোটা জ্বলে ওঠে। কমল তাই জানত মানুষ শুধুমাত্র নরও নয়। নারীও নয়। নর নারী মিলেই তবে সে এক। তাই সে এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিল যে, মানুষের মধ্যে যারা বুঝেছিল নর নারীর ভালোবাসার ইতিহাসটাই হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো সত্য ইতিহাস, তারাই সত্যের খোঁজ পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি। আর যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বেই নারীর চরম সার্থকতা; সমস্ত নারী জাতিকেই তারা ছোট করেছিল। এবং সেই থেকেই বিবাহের স্থায়িত্বের মধ্যে নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে পুরুষতন্ত্র।নারীও যেদিন থেকে বিবাহ বন্ধনকেই জীবনের সর্বস্ব বলে মেনে নিয়েছে সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছে নারী জীবনের চরম ট্র্যাজেডি। দুঃসহ স্থায়িত্বের মোটা দড়ি গলায় বেঁধে মরতে হয়েছে নর নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাজাত নির্মল ভালোবাসাকে।

এই স্বাধীন ব্যাক্তিসত্তাজাত ভালোবাসাকে নির্মল হৃদয়ে নির্মোহ আনন্দে দীক্ষিত করে পূর্ণ জীবনবোধে উত্তীর্ণ করার সাধনাই কমলের ধর্ম।

এই ধর্মের জন্য সে সমাজের চোখরাঙানিকেও যেমন সহজ ভঙ্গিতে উপেক্ষা করতে পারে তেমনি ব্যক্তিগত দুঃখ যন্ত্রনাকেও অবলীলায় হাসিমুখে অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে পারে সামনের দিকে।এই নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে চলার তাগিদেই কোনো আদর্শকেই সে শেষ প্রশ্ন বলে শিরোধার্য করে থেমে যেতে পারে না।
তাই তো কত নিঃসঙ্কোচেই সে বলতে পারে “একদিন যাকে ভালোবেসেচি কোনোদিন কোনো কারণেই আর তার পরিবর্তন হবার জো নেই, মনের এই অচল অনড় জড়ধর্ম সুস্থও নয়, সুন্দরও নয়।”

তাই কমল কোনো কিছুতেই ভেঙ্গে পড়েনা। ভেঙ্গে পড়া আদর্শের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেই নতুন আদর্শের সৃষ্টির আশা তার চিত্তে দৃঢ় প্রত্যয়ে জেগে থাকে। আবার
সেই আদর্শের কাজ শেষ হলে আরও মহত্তর আদর্শের জন্ম হবে। এই প্রত্যয়েই সে বলে, “এমনি করেই সংসারে শুভ শুভতরের পায়ে আত্মবিসর্জন দিয়ে আপন
ঋণ পরিশোধ করে। এই তার মুক্তি পথ।”

শ্রীশুভ্র

শরৎসাহিত্যের দিগন্তে

বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব এক যুগান্তকারী ঘটনা সন্দেহ নেই। বস্তুত তিনিই প্রথম, আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে লেখাপড়া জানা আপামর শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন বললে মোটেও অতিশয়োক্তি করা হয় না। তাঁর হাত ধরেই বাঙালির ঘরে ঘরে আধুনিক সাহিত্যের হাতেখরির সূচনা। তাঁরও পূর্বে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, বঙ্গসাহিত্যের পথিকৃত হলেও তিনি আপামর বাঙালির হৃদয় জয় করতে পারেননি- শরৎচন্দ্রের মতোন এমন সার্বিকভাবে। এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আজ যে সর্বগ্রাসী প্রভাব বাংলা ও বাঙালির জীবনে; তারও সূচনা শরৎসাহিত্যের পরবর্তী অধ্যায়ে। যদিও কবিগুরু শরৎচন্দ্রের পূর্ববর্তী। কথাটা শুনতে প্রথমে খটকা লাগলেও একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ঘটনাটা সত্য।

রামমোহন বিদ্যাসাগরের হাত ধরে বঙ্গসাহিত্যের যে আধুনিক যুগের সূচনা হয়, তা মূলত সংস্কৃত জানা উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর হেম মধু বঙ্কিম নবীনের হাত ধরে তার সীমা বিস্তৃততর হতে থাকলেও, তাতে বাংলার জনমানসের প্রতিভাস ছিল সামান্যই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যর প্রথম পর্বেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল অনেকটাই। কারণ তা যতটা না বিশ্বমানবের ইশারা সম্ভূত, ততটা বঙ্গজীবনের অস্থিমজ্জায় জায়মান নয়। শরৎচন্দ্রই প্রথম, যিনি বাংলার নাড়ির স্পন্দনে টান দিলেন তাঁর সাহিত্যবোধের একেবারে নিভৃততম অন্তর্লোক থেকে। বিশেষত আমাদের খেয়াল রাখা প্রযোজন, বাংলা কথাসাহিত্য প্রধানত ইউরোপীয়ান সাহিত্যের গর্ভসঞ্জাত। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা উচিত, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় শসক প্রভু ইংরেজদের হাত ধরে এদেশে আসা ইংরেজি সাহিত্যের আঁতুরেই বাংলা কথাসাহিত্যের ভুমিষ্ঠ হওয়া। ফলে সেই আমদানী করা সাহিত্য প্রকরণের বাংলার নাড়ির স্পন্দনে স্পন্দিত হতে যে, শরৎসাহিত্য অব্দি অপেক্ষা করতে হয়ে ছিলো তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই।

শরৎচন্দ্রের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তার হাত ধরেই বাংলার ঘরে ঘরে সাহিত্যের অধিষ্ঠান ঘটে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলার জনমানসে বাংলাসাহিত্যের প্রতি যে বিপুল ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়, তারই সূত্রে একদিকে যেমন হেম মধু বঙ্কিম নবীনের সাহিত্যকাল থেকে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকাল অব্দি সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনই শরৎ পরবর্তী সাহিত্যের গর্ভসঞ্চারও ঘটতে থাকে। আর ঠিক এরই প্রেক্ষিতে, বাঙালির সাহিত্য দীক্ষার বিস্তারের হাত ধরেই, বঙ্গজীবনের পরতে পরতে ধীরে ধীরে সর্বময় হয়ে উঠতে থাকল রবীন্দ্র প্রভাব।

শরৎচন্দ্রই প্রথম বাংলা ও বাঙালির নাড়ির স্পন্দনকে ইউরোপ আগত এই আধুনিক কথাসাহিত্যের প্রকরণে স্বার্থক ভাবে ধরতে পেরেছিলেন। এটাই তার বিপুল জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বঙ্গজীবনের চালচিত্রে বাঙালির মানসভূবনকে খুব ভেতর থেকে অনুভব করেছিলেন তিনি। আর সেই অনুভবের স্বর্ণশিখায় তুলে আনলেন বঙ্গনারীর অন্তর ঐশ্বর্য্যকে। রূপময় করে তুললেন তার ব্যাথা বেদনা আশা আকাঙ্খাকে অনুপম কথনশৈলীর নিপুণ ব্যঞ্জনায়। জয় করে নিলেন বাঙালির হৃদয়।

শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিগত জীবনযাপন, বিশেষ করে তাঁর বেড়ে ওঠার ধরণের মধ্যে থেকেই তিনি অর্জন করে ছিলেন তাঁর এই অনুভব শক্তির স্বাতন্ত্র্য দীপ্তি। স্বতন্ত্র্য ছিল তাঁর বাল্য ও কৈশর আর পাঁচটি বঙ্গসন্তান থেকে। আর সেই ছিল তাঁর মূলধন। সেই সূত্রেই খুলে গিয়েছিল তাঁর দেখার দৃষ্টি, অনুভবের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা। তিনিই তাই মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজকে খুব স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করলেন, একেবারে অন্দরমহল থেকে।

আর সেই অন্দরমহলের রূপঙ্কর রূপেই দেখা দিলেন বাংলাসাহিত্যের আঙিনায়। বাংলাসাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব, যেকোনো ভাষার সাহিত্যের পক্ষেই দৃষ্টান্তস্বরূপ। বস্তুত ঊনবিংশ শতকের বঙ্গীয় বর্ণহিন্দুসমাজের সমাজ মানসিকতার প্রতিচ্ছবিটি তাঁর সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হতে থাকল অনুপম ভঙ্গিতে। আর সেই অননুকরনীয় ভঙ্গিতেই বাংলার জনমানসে শরৎপ্রভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল দ্রুতবেগে।

যে কাহিনীটি দিয়ে বঙ্গসাহিত্যে তাঁর জয়যাত্রা, সেই “বড়োদিদি” শরৎসাহিত্যের অন্যতম দিকদর্শনও বটে। যে পথে পরবর্তীতে এগিয়ে গিয়েছিল তাঁর জনপ্রিয়তার জয়রথ। বাংলাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রই প্রথম তুলে আনলেন বাংলার সমাজসংসারে বঙ্গনারীর প্রকৃত ভূমিকাকে। পুরুষতান্ত্রিক এই বঙ্গসমাজে সংসারের অন্তঃপুরে পরাধীন নারী, পুরুষতন্ত্রের অধীনতার মধ্যে থেকেও কিভাবে পুরুষকেই বল ভরসা যুগিয়ে, সেবা যত্ন করে পুষ্ট করে তোলে, সে সত্য শরৎচন্দ্রই প্রথম এমন স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করালেন আমাদের। তাঁর সাহিত্যের অনুপম মুকুরেই বঙ্গনারী প্রথম অনুভব করল- তার শক্তির সুষমাকে। শরৎচন্দ্রের মধ্যে আবিষ্কার করল প্রকৃত দরদী হৃদয়বেত্তার এক অনুপম লেখককে। দেরি হল না শরৎভক্ত হয়ে উঠতে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তাঁর জনপ্রিয়তা।

শরৎসাহিত্যে নারীর মাতৃত্ব বাৎসল্য প্রেম, তার মায়া মমতা এবং পুরুষের প্রতি তার একনিষ্ঠ কর্তব্য প্রেরণা বস্তুত বাংলার জল হাওয়ার মতোই সজীব সজল করুণামিশ্রিত হয়ে দেখা দিল। সেখানেই নারীও প্রত্যক্ষ করল আপন জীবনের সুকুমার অন্তঃস্বরূপ। ঊনবিংশ শতকের বাংলার নারীকে প্রত্যক্ষ করতে হলে তাই ওল্টাতেই হবে শরৎসাহিত্যে পাতার পর পাতা।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকলেন না লেখক। বর্ণহিন্দু সমাজজীবনের নানান অনৈতিকতার প্রেক্ষাপটে হাজারো বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ সংসারজীবনের মধ্যে অবরুদ্ধ নারীমনের নিভৃত আর্তি লেখকের দরদী কলমের নিবিড় সহানুভুতির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে লাগল বর্ণময় উদ্ভাসনে। আমরা পরিচিত হতে থাকলাম, রাজলক্ষ্মী, কমললতা, কিরণময়ী, কমল, অন্নদাদিদি, সুনন্দা, সাবিত্রী, অচলা অভয়াদের সাথে।

“মণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসেবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটা নিত্য-প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোঁটার জন্যে মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি – ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইহাঁর যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে- আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।”

বলেছিলেন শরৎচন্দ্র, ‘তাঁর নারীর মূল্য’ প্রবন্ধের একেবারে শুরুতেই। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীজীবনের অবরুদ্ধ কান্না শরৎসাহিত্যের স্রোতধারায় স্রোতস্বিনী হয়ে উঠল অচিরেই। কারণটা এখানেই যে, তিনি জগতসংসারে নারীর প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করেতে পেরেছিলেন, একেবারে তাঁর জীবনবোধের ভিত্তিমূল থেকেই। যেখানে কোনো রকম ফাঁকি ছিল না। ছিল না মেকি সহানুভুতির আতিশয্য। তাঁর দরদী মনের মুকুরে ধরা পড়ল নারীর অন্তর্বেদনার অন্তর্গূঢ় আর্তি! সেই আর্তিই উঠে এল তাঁর কুশলী কলমের জাদুতে। একে একে সৃষ্টি হল শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, পল্লীসমাজ, গৃহদাহ, শেষপ্রশ্নের মতো যুগান্তকারী সব উপন্যাস!

তাঁর গল্প উপন্যাসের পরতে পরতে প্রবাহমান বাঙালী হিন্দুসমাজের সেকালের জীবনযাত্রার যে চালচিত্রকে তিনি প্রস্ফূটিত করে গেছেন তাঁর অনুপম গদ্যশৈলীতে, সে তাঁর নিজস্ব প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভিজ্ঞতা সম্ভূত! এবং তাঁর দরদী মনের সমবেদনা সঞ্জাত! সেইজন্যেই তাঁর কাহিনীগুলি পাঠকের অন্তরে এমনই জীবন্ত হয়ে ওঠে অনুভবের সজল সরসতায় রসসিক্ত হয়ে। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঞ্জীবনী আলোয় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের চরিত্রহীনতাকে। দেখেছিলেন সমাজবাস্তবতার কষ্ঠিপাথরে অমলিন মনুষত্বের অম্লান রূপকে। সেই রূপের ক্যানভাসেই ভাস্বর করে তুলেছিলেন তাঁর অন্নদাদিদির মতো সতীসাদ্ধী নারী থেকে, মুজরো করা পিয়ারী বাঈজীরূপী অনন্ত প্রেমিকা রাজলক্ষ্মীকে।ন্যায়পরায়না তেজস্বী আপোষহীন সুনন্দা থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল নারীসত্তার অবিনশ্বর আত্মা কমলকে। নারীমনের অগম রহস্যের দোলাচলে, সমাজ সংসারের বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়া নারীজীবনের দূর্নিবার অসহায়তার পরাধীনতার কাছে ক্ষতবিক্ষত হওয়া অসামান্য রূপসী তীক্ষ্ণ বুদ্ধীমতী কিরণময়ী থেকে প্রেমের ঘাতপ্রতিঘাতে জর্জরিত অচলাকে। তিনি দেখেছিলেন সমাজের নিচতাকে। সমাজের ক্ষুদ্রতাকে। আর সেই নিচতার যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া অসহায় নারীর আপাত ক্ষুদ্রতার মধ্যেও তাঁর অন্তরাত্মার মহত্বকে। সেই দেখার চোখই তাঁকে তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক করে তুলেছিল। এখানেই শরৎচন্দ্রের অনন্য বৈশিষ্ট।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্রী দেবীপদ ভট্টাচার্যের মতে, “কথন বয়নের কুশলতা, চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য, মনোজগতের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ শরৎচন্দ্রকে কালজয়ী হতে সহায়তা করেছে। কিন্তু আরেকটি দিকও বিস্মৃত হওয়া চলে না। অবিচার ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এত বড়ো দরদী শিল্পী তাঁর পূর্বে বা পরে দেখতে পাই না!”

সামাজিক অবিচার ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্রের দরদী কলম নিষ্পেষিত মানবাত্মার মর্মবেদনাকে সহানুভুতির মরমী আলোয় আলোকিত করলেও, তিনি কোনো প্রতিরোধের দিশা বা বিপ্লবের দিশা দেখান নি। হয়তো সেটা সাহিত্যিকের সত্যিকারের কাজও নয়। কিন্তু তিনি তাঁর নিপিড়ীত অবরুদ্ধ চরিত্রদের মধ্যেও বিপ্লব বা প্রতিরোধের আগুন জ্বলে উঠতে দেন নি। যে পুরুষ শাসিত সমাজে তাঁর সৃষ্ট নিষ্পেষিত নারী চরিত্রদের অন্তর্বেদনাকে তিনি দরদী কলমে ফুটিয়ে তোলেন, সেই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনোরকম প্রতিরোধের প্রত্যয় ফুটে ওঠে না তাঁর সৃষ্টি করা সেই সমস্ত চরিত্রদের মননে ও চেতনায়। এইখানেই শরৎদিগন্তের সীমানা।

সামাজিক অন্যায় অবিচারে নিষ্পেষিত মানবাত্মার সকরুণ বেদনার মরমী চিত্রকর তিনি। কিন্তু বিচারের বাণীকে নিরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ প্রতিরোধের কোনো প্রত্যয় ফুটিয়ে তোলেন না তাঁর সৃষ্টির দিগন্তে। কারণটা যতটা না তাঁর ব্যক্তিগত জীবন দর্শনের সংঘটনে, ততটা তাঁর সাহিত্যিক পরিমিতি বোধের সুদৃঢ় প্রত্যয়ে। তিনি যে কালপ্রবাহের, যে সমাজসংসারের, যে যুগধর্মের জীবনযাত্রার চিত্রকর; সেই প্রেক্ষাপটে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিষ্পেষিত বাঙালি মননে প্রতিরোধ প্রতিবিধানের কোনো বীজমন্ত্র জায়মান ছিল না। সমাজজীবনের ভিত্তিমূলেই যার অস্তিত্ব ছিল না, তাকে লেখকের কল্পনা থেকে ধার করে বা বিদেশী সাহিত্য থেকে আমদানী করে বলপূর্বক সাহিত্যের অন্তঃপুরে ঢুকিয়ে দিলে, তা কখনোই সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠতো না। তা হয়ে উঠত হয়ত কোনো রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো। আহত হতো সাহিত্যের পরিমিতি। এখানেই প্রকৃত সাহিত্যিকের পরিচয়। কারণ সাহিত্যিকের কাজ সাহিত্যের দর্পনে সমাজসংসারের অন্তর্গূঢ় অন্তর্বেদনকে প্রতিফলিত করে তা পাঠকের জায়মান জীবনবোধে নতুন করে প্রস্ফূটিত করে তোলা।

আর এখানেই সার্থক শরৎচন্দ্রের সাহিত্য কীর্তি। প্রায় একটা শতাব্দীর বঙ্গ জীবনের চিত্রকার তিনি, এবং প্রায় একটা শতাব্দী বাঙালি মননে রাজত্ব করে গিয়েছেন স্বমহিমায়। সমাজবদলের দায়িত্ব সাহিত্যিকের নয়, সামাজিক ক্ষতগুলিতে মরমী আলো ফেলে পাঠকের চেতনায় জীবনবোধের সঞ্চারণ ও প্রসারণ ঘটানোই তাঁর কাজ। আর সেই কাজে বিপুল ভাবেই সফল তিনি। সফল বলেই তারপর আমরা পেয়েছি তারাশঙ্কর থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ থেকে বিভুতিভূষণ, বাংলা কথাসাহিত্যের সীমানা বিস্তৃত হতে থেকেছে ক্রমশই। তাঁর সাহিত্য বিচিত্রগামী হলেও সর্বত্রগামী হয়নি বলে, আক্ষেপ ছিল কবিগুরুর। আর শরৎচন্দ্র বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলে গেলেন, “….এই অভিশপ্ত, অশেষ দুঃখের দেশে নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে, রূশ সাহিত্যের মতো যেদিন সে সমাজের নিচের স্তরে আরো নেমে গিয়ে তাদের দুঃখ-বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে সেদিন এই (বাংলা) সাহিত্য-সাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।” এখানেই উপলব্ধি করতে পারি আমরা কত বড়ো দ্রষ্টা ছিলেন এই মহান শিল্পী। বাংলা কথাসাহিত্যের প্রথম ভগীরথ!

শ্রীশুভ্র।