শ্রী শুভ্র এর সকল পোস্ট

শ্রী শুভ্র সম্পর্কে

ফ্রীলান্স লেখক ওয়েব পত্রিকা সম্পাদক ও প্রকাশক।

বর্ষার চিঠি

আমি কি গান গাব যে ভেবে না পাই-

উতল-ধারা বাদল ঝরে। সকল বেলা একা ঘরে। সত্যিই গত কয়েকদিন ধরে এমন অঝোর বৃষ্টি। সারাদিন। কখনো ঝিরিঝিরি তো কখনো মুষলধারে। মাঝেমধ্যে এক একটি দমকা হাওয়া যেন মনের মধ্যে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যায়। ভেতরটা মুচড়িয়ে ওঠে। হু হু করে। দক্ষিণের জানলাটা খোলা। ঠান্ডা বাতাসে একটা আরামে চোখ বুঁজে আসে। পূবের জানলা দিয়ে সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে সেই রেলস্টেশন অব্দি। খুব বেশি দূরেও নয়। সারাদিন ট্রেনের শব্দেই ঘড়ির কাজ হয়ে যায় প্রায়। আজকাল ট্রেন বেশ সময় ধরেই চলছে দেখছি। এখান থেকে রেলস্টেশনটা দেখা যায় না ঠিক। কিন্তু দক্ষিণের জানলা দিয়ে ঐ দূরে ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়াটা দেখা যায় চেষ্টা করলে। ট্রেনের চলে যাওয়ার সাথে প্রিয়জনের চলে যাওয়ার একটি মিল আছে যেন। মনে হয় একই রিদিমে অনেকটা দূরত্ব সাথে নিয়ে চলে গেল যেন। ঠিক যেমন চলে গিয়েছিল পিয়ালী। সে অনেক দিন আগের কথা। এখন এই আধা শহরেই পাকাপাকি একটি বন্দোবস্ত করে নিয়েছি প্রায়। প্রায় এই জন্যেই যে জীবনে চিরস্থায়ী কিছুই নয়। আজ আছি। কাল কি হবে জোর দিয়ে কে বলতে পারে। পরশুর কথা তো দেব নঃ জনান্তি! এই বৃষ্টি ভেজা অলস দিন। কি বলবো আমিই জানি না। কি কথা আমার যা অন্য কাউকে বলা যায়। কিন্তু কাউকে না কাউকে যে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে হয়। বিশেষ করে এমন দিনে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আজকাল আর কথাই খুঁজে পাই না। অথচ অনর্গল কথা বলার একদিন ছিল। সেসব যেন ধুসর স্মৃতি আজ। এই বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে মনটাও কেমন উতলা হয়ে ওঠে। পুরানো স্মৃতির সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যেতে চায় অনেক অতীতে। তবু প্রশ্ন জাগে জীবন কি সত্যিই অতীত হয় কখনো? কেই বা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে?

এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়-

সত্যিই তাই এ আমার জীবনেরই ইতিহাস যেন। কতযুগ আগের কথা। এরকমই এক উথাল পাতাল বৃষ্টিভেজা বিকাল। ইউনিভার্সিটির ক্লাসে আমরা দুজন। ভাষা শিক্ষার ক্লাস ছিল। বৃষ্টির মধ্যে কেউই আসতে পারেনি। শুধু আমরা দুজন বাদে। সে ছিল মোবাইল ফোন আবিষ্কারের আগের যুগ। খুব কম মানুষের বাড়িতেই তখনো ল্যাণ্ডফোন। আমাদের ভাষাশিক্ষার ক্লাসের অধ্যাপকও হয়তো আটকিয়ে গিয়েছিলেন সারাদিনের বৃষ্টিতে। কিন্তু সেই বৃষ্টিও আমাকে আটকাতে পারেনি। পারেনি কারণ সেই ক্লাসেই প্রথম দেখা মিতালীর সাথে। তাই একটি দিনও ক্লাস মিস করার উপায় ছিল না। আসতেই হতো। কিন্তু মিতালীও কি তাই এসেছিল? নিশ্চয়ই তাই। না হলে আর কেউ না এলেও শুধু আমরা দুজনেই বা কেন অমন অঝোর বৃষ্টির বিকালে গিয়ে উপস্থিত হবো। ইউনিভার্সিটির বিশাল বিশাল জানলার কাঁচের ওপারে তখন বৃষ্টি আর সবুজ গাছপালার যুগল নৃত্য। ভেতরে আমাদের চঞ্চল চোখের দুইকুলে। মিতালীর মতো সুন্দরী আমি সত্যিই আর দেখিনি। সব কিছু বাদ দিলেও অমন দুটি চোখ। যে কোন মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। আমার তো রোজই ঘুরতো। ভাষা শিক্ষার ক্লাসের অধ্যাপকের কথা উড়ে যেতো মাথার উপর দিয়ে। শুধু অবাক হয়ে দেখতাম মিতালী কি অবলীলায় নতুন একটি ভাষাকে দ্রুত তালে রপ্ত করে নিচ্ছে! সেই থেকে মিতালীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার শুরু। সেদিনের সেই বৃষ্টির বিকেলেই তাই ঠিক করে ফেলি, আর স্বপ্ন নয়। এবার স্বপ্নকে নামিয়ে আনতে হবে বাস্তবতায়। এমন মধুর লগ্ন সহজে আসবে না আর।

কিছু বলবো বলে এসেছিলেম, রইনু চেয়ে না বলে

হয়তো এটাই জীবন। এইভাবেই জীবনের নাগরদোলায় আমাদের ওঠা নামা। দূর থেকে দেখলে হাসিই পায়। কিন্তু যারা ওঠে নামে তাদের যে সবসময় অবিমিশ্র ভালোই লাগে তা নাও হতে পারে। সেদিন মিতালীর মনেও রং ধরিয়েছিল ঝরঝর বরিষণ। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই সহপাঠির কাছেই তার ভালোবাসার গল্পগুলি মেলে ধরেছিল। আমার মধ্যে ভরসা করার মতোই একজন মানুষকে খুঁজে পেয়ে অনর্গল উপুর করে দিয়েছিল তার মনের আদিগন্ত। তৃপ্তি পেয়েছিল। ঠিক যে ট্রেনটা ধরার জন্যে আপনি ব্যাকুল হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন, সেটি আপনাকে না নিয়েই স্টেশন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলে যেমন অসহায় দশা হয়, আমারও সেদিন সেই দশা। বাইরে আদিগন্ত উথাল পাতাল বৃষ্টি। ইউনিভার্সিটির জানালার কাঁচ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে জলপ্রপাতের মতো। ভিজে যাচ্ছি আমিও। আমার স্বপ্নগুলোও তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে ধ্বসে যাচ্ছিল গলে গলে। সেও তো রক্তজল করা কষ্ট না কি। একমনে কত কথাই বলে যাচ্ছিল মেয়েটি। কত তার স্বপ্ন। কতরকম পরিকল্পনা। হয়তো সেই প্রথম আমি আঁচ করতে পারছিলাম নারীর মন। কতরকম বিচিত্র তার নকশা। কতরকম বিচিত্র তার বুনন। কিন্তু ভরা বর্ষার নদীর মতোই যেন অবাধ তার গতি। একবার জল পেয়ে গেলে আর যেন দুকুল মানে না। সবিকিছুই ভাসিয়ে নিয়ে অভিমুখ তার সাগরসঙ্গমে। ভাষাশিক্ষার ক্লাসে সেই আমার শেষদিন। মনে মনে অধ্য়াপককে শুভকামনা জানিয়েই রওনা দিয়ে ছিলাম বাড়ি ফেরার পথে। সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে।

যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়

সে শ্রাবণ বড়ো নিঃসঙ্গ। চারদিকে কান পাতলে শুধুই বৃষ্টির গোঙানি তখন। মেঘের তোরে যেন ধুলিস্মাৎ সব স্বর্ণালী স্বপনের রামধনু আশা। জলকাদা মাখামাখি শহরের গোলকধাঁধায় ভাষাহীন ব্যাথার নিরব প্রতিধ্বনি। রোজকার খবরের কাগজের মতোই নিরানন্দ পৃথিবী রোজকার ভেজারাতে উঁকি দিয়ে যায় জানলায়। নিবিষ্ট অন্ধকার জমে উঠতে থাকে দিনলিপির সব সাদা সাদা পাতা জুড়ে দুই মালাটের জীবনে। পথ চলতি রাস্তায় বেহঁশ গাড়ীর চাকায় জলকাদা ছিটকিয়ে ভিজে যাওয়ার মতো অসহনীয় সে অবস্থা। তবু স্মৃতিময় ঝরে পড়া স্বপ্নের আবেশ নিয়ে অলস সময়ের হাতছানি। চারিদিকে কেউ নাই। কিছু নাই। তবু মিতালীর সেই দুটি চোখ রয়ে গিয়েছে তখনো। যে চোখ তার সহপাঠীকে ভরসা করে ছিল। সেই স্মৃতিটুকু খড়কুটোর মতো ধরে নিজের দিকে চেয়ে নতুন ভাষা খোঁজা কেবল। মানুষের মন বেশিরভাগ সময়েই অবুঝ শিশুর মতো খেলা করে জীবনের চারকোণে। নিজের কাছেই তার যত বায়না। আর চাওয়ারও শেষ নাই, আশার ভাঁজে ভাঁজে।

মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো

গিয়েছিলাম বেড়াতে। পাহাড় ছিল। টলটল জলের নদী পাশ দিয়ে। মনে হয় হেঁটেই পার হয়ে যাওয়া যাবে। সঙ্গীসাথী কেউ নাই। একাই। বেশ কিছু ছুটি জমে গিয়েছিল সরকারী দপ্তরের। একটু ছুটি চাইছিলাম। নিরবে নিভৃতে নিজের সাথে বসার জন্যে।
সেও এমনই শ্রাবণ মাস। রোদ বৃষ্টির লুকোচুড়ি খেলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির একটা মৌতাত আছে। যতটুকু গায়ে মেখে নেওয়া যায়। একাই বসেছিলাম নদীর ধারে পাহাড়ী ঢালে। সামনে সবুজে সবুজ। আর মেঘে ঢাকা বৃষ্টির আকাশ। না কোন কবিতার কথা মনে ছিল না। বেসুর গলা নিজের বশেই ছিল। ভাবাবেগের স্রোতও ভাটির টান, সেও অনেক দিন। শুধুই নিরিবিলি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মুখোমুখি নিজের সাথে একা। দেখা হল ঠিক সেই সময়। নদীর জলে পা ডুবিয়ে নদীতে নামার জন্যে ব্যালেন্স ঠিক রাখার চেষ্টায়। আমি ছিলাম সামান্য বাঁদিকে। কখন যে কেউ সামনে এসে গিয়েছে খেয়াল করতে পারিনি। যখন পারলাম ততক্ষণে সে টাল সামলাতে না পেরে নদীর জলে হাবুডুবু। তারপর অনেকটা চিত্রনাট্যেরই মতোন। হবু শ্বশুর শাশুড়ীর অনেক আশীর্বাদ আর তাঁদের ডাকাবুকো মেয়ের স্পর্শ নিয়ে ফেরা একটা আস্ত গোটা রাত। বাঁধ ভাঙা বন্যার জলের তোড়ের মতো উচ্ছাসে উদ্দাম।

হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে

সত্যই তাই প্রায় নাচতে নাচতেই পিয়ালীর সাথে কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর। বেঁচে থাকা যে এমন মনোহর হতে পারে, সেটা জেনেছিলাম ওর কাছেই। যেমন ডাকাবুকো তেমনি উচ্ছল। সবেতেই ওর বিস্ময়। আর সবেতেই ওর আনন্দ। ঠিক যেন প্রকৃতির মতোই। মনে হয় না কোথাও কোন দুঃখ আছে। ছিল। থাকবে কোনদিন। গোটা জীবনের অর্থটাই যেন বদলে দিয়ে গেল। কি বিপুল উৎসাহ। কোন কাজেই পিছপা নয়। হাজার পরিশ্রমেও কোন ক্লান্তি নাই। বিরক্তি নাই। আর সারা মুখে সেই দুকুল ছাপানো হাসি। না পিয়ালী, আমি আজ এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় তোমার ঢাক পিটাতে বসিনি মোটেও। তুমি যা তুমি তাই। যারা তোমাকে চিনতো তারাই তা জানে। কাউকে ডেকে ডেকে শোনানোর কোন প্রয়োজন নাই আমাদের কারুরই। জীবনের আনন্দ যে চলার ছন্দের মধ্যেই এ কথা প্রথম শেখা তো তোমার কাছেই। সেই ছন্দটাকেই চলিষ্ণু রাখাটাই প্রতিভা। বলেছিলে তুমি। সেদিন যখন তোমার সাথে প্রথম আলাপ। তোমার মায়ের অজস্র বকুনির উত্তরেই। সেই হয়তো আমার জীবনের প্রথম সহজপাঠ।

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে

কবি বলেছিলেন; ‘জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। কিন্তু আজ এতদিন পেরিয়ে এসেও আমি তো জানি। জানি কেন এমন পাগল করা বৃষ্টিও আমাকে আর ভেজাতে পারে না আগের মতো। আসলে ভিজতে চাওয়ার মতো মনটাই যে হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষের মতো। যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যাবে না কোনদিন। মিসিং ডায়েরী করার সময়ও বুঝতে পারিনি, যা হারিয়ে যায় সে আর ফিরে পাওয়া যায় না হয়তো কোনদিন। গিয়েছিলাম আবার পাহাড়ে। সে হিমালয়ের সবুজ অরণ্যের অনেক গহন ভেতরে। গিয়েছিলাম শুধু দুজনেই। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রাতে খেয়াল চাপলো তার বৃষ্টিতে ভেজার। আমিও যে নিষেধ করেছিলাম তেমনটাও তো নয়। কিন্তু পিয়ালী, বারণ করলেই কি তুমি শুনতে? আমিও তো তখন তোমারই মতো। তোমার আনন্দেই বিভোর। কি যে জাদু করেছিলে! গোটা জীবনটাই যেন একটা উদযাপন হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি ইচ্ছেই এক একটি উৎসব। বাঁধন ছেঁড়ার সাধন শুধু। শুধু জানতাম তুমি আছো আমি আছি।

আমার প্রিয়ার ছায়া
আকাশে, আজ ভাসে, হায় হায়!
বৃষ্টিসজল বিষন্ন নিশ্বাসে, হায়!
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্য়াদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার আসে। হায়!
বারি-ঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশ-হারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেযে মনের কথা হারায়।
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে, হায়।

শ্রীশুভ্র

সেলফি দিয়ে যায় চেনা!

সেল্ফ সাফিশিয়েন্ট হয়ে ওঠার কতরকমের পথই না রয়েছে! কিন্তু সেই পথকে অনেক সময়েই সেলফিশ পথ মনে হলেও সমাজ সংসারে সেলফ-মেড মানুষদের চিরকালই কদর রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সেল্ফ সেলিব্রিটি হয়ে ওঠার নতুন এক ফিকির চালু হয়েছে। আজকের আলোচনা তাই সেলফি নিয়েই। সংবাদপত্র চালু হওয়া আর ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে এই সেদিন অব্দিও বিখ্যাত মানুষজনদের ছবিই শুধু বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যেত। যে ছবিগুলি তোলার জন্যে পেশাদার ফটোগ্রাফারদের ডাক পড়তো। কিন্তু বিজ্ঞান প্রযুক্তি তো আর কোথাও থেমে থাকে না। তাই চালু হয়ে গেল সেলফি! কি দারুণ ব্যাপার! নিজের মোবাইল। নিজেরই লেন্স! নিজেই তোলো। আর আপলোড কর। তারপর! ওয়ালে পোস্ট আর আমাকে দেখুন!

এই ‘আমাকে দেখুন’ বিষয়টি সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি হিট কনসেপ্ট! এবেলায় দেখুন, ওবেলায় দেখুন। বাড়িতে দেখুন, গাড়িতে দেখুন। এ শাড়িতে দেখুন ও শাড়িতে দেখুন। এর সাথে দেখুন ওর সাথে দেখুন। হাসতে দেখুন, হাসাতে দেখুন। নাচতে দেখুন, নাচাতে দেখুন। বাজতে দেখুন, বাজাতে দেখুন, রাঁধতে দেখুন, খাওয়াতে দেখুন। মঞ্চে দেখুন, লঞ্চে দেখুন। ট্রেনে দেখুন, প্লেনে দেখুন। অফিসে দেখুন, মলে দেখুন। না মলত্যাগে দেখুন অব্দি অতদূর গড়ায় নি এখনো। তবে ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু দেখতে হবে। দেখাতে হবে। যা দেখাবো দেখবে তবে। যত বেশি দেখাতে থাকবেন, তত বেশি সেলিব্রেটি!

এই যে সারাদিন ধরে অক্লান্ত সাধনায় নিজেকে দেখানোর প্রয়াস, সমাজ সংসারে এ কিন্তু সত্যই এক নবতম সংযোজন। কখন কবে কে কোথায় আপনার ফটো তুলবে, সেই ফটো আবার খবরের কাগজে ছাপা হবে কি হবে না, না এত কিছু যদির জন্যে বসে থাকার দিন শেষ। হাতে মোবাইল তোল ছবি দাও পোস্ট। গোনো লাইক। সেল্ফ হেল্পের কি অসাধারণ নমুনা, ভাবা যায়? কারুর পায়ে তেল দেওয়ার দরকার নাই। আপন হাত জগন্নাথ! শুধু ক্লিক করে যেতে হবে সারাদিন। বলা যায় না, আপনার ভাগ্যও কখন কোথায় কিভাবে ক্লিক করে যায়? কে বলতে পারে!

হ্যাঁ এই ক্লিক করতে করতে আপনার পরকালের টিকিটও কনফার্ম হয়ে যেতেও পারে। অনেকেরই গিয়েছে। সেল্ফ ওয়ে টু রীচ দ্য হেভেন! সেলফি তুলতে তুলতে সেল্ফলেস পরকালে পৌঁছিয়ে যাওয়ার রাস্তাটিও সুগম হয়ে উঠছে অনেকেরই। অনেকেরই উঠবে। তবু ক্লিক করা থামলে চলবে কেন? আপনি থামালে অন্যেরা যে সব লাইক আর কমেন্ট বগলদাবা করে নিয়ে যাবে? তখন? আপনি পড়ে রইলেন সেই মান্ধাত্বার বাবার আমলে। স্মার্টফোন আর স্মার্টকার্ডের যুগে অতটা আনস্মার্ট হওয়া কি পোষাবে আপনার? সেটাই আসল কথা। তাই শুধু দেখিয়েই যেতে হবে নিজেকে। না দেখালে কি আর আপনাকে দেখবে কেউ?

তাই আমাকেই নিজেকে দেখিয়ে যেতে হবে নিরন্তর। কিন্তু এই ভাবে নিজেকে দেখাতে দেখাতে আমরা যে কখন আমার পাশের মানুষটিকে দেখতে ভুলে যাচ্ছি, সেকথা ভেবে সময় নষ্ট করা চলবে কি? নিন্দুকেরা যতই বলুক সেলফি তুলতে তুলতে সেলফিশ!

শেষপ্রশ্নের কমল

(১)

শরৎ সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট হল নারী চরিত্রের বৈচিত্র্যময় সম্ভার। সেই সম্ভারের এক উজ্জ্বল সংযোজন “শেষ প্রশ্ন”-এর কমল। শরৎ সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্রগুলির মধ্যে কমল যেন অদ্বিতীয়। মনে হয় কোন ভিন গ্রহের বাসিন্দা। কিংবা অন্য কোন যুগের। সে যুগের ঠিকানা আমাদের ঠিক জানা নেই। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় পুরুষের আশা আকাঙ্খা বংশরক্ষার প্রয়োজনীয় গণ্ডীতেই যেখানে নারী জীবনের সব স্বাধীনতার সীমায়িত পরিসর, যেখানে তার মধ্যেই সামঞ্জস্য করে নিতে হয় অন্তরাত্মার সাথে বাস্তবের, সাধের সাথে সাধ্যের; সেখানে কমলের মত নারী চরিত্র সত্যিই এক উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। কমল একাধারে শাশ্বত ও আধুনিক।

(২)

কমলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট, কমল ভালোবাসতে পারে। হ্যাঁ নারী বরাবরই পুরুষকে ভালোবেসে চলে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কমল তার ভালোবাসাকে অন্যান্যদের মত “শুধু আমারই ভালোবাসা” বলে কোনো শীলমোহর লাগিয়ে তালা বন্ধ করে রেখে দেয় না। নিন্দুকের কথা কানে না তুলে সে তার ভালোবাসাকে নীল আকাশের মুক্তির ক্ষেত্রে স্থাপন করতে পারে।

এখানেই সে অনন্য। তাই শিবনাথ যখন তাকে এক কথায় প্রবঞ্চিত করে মনোরমাকে জীবনসাথী করে নেয় তখনও সে কত সহজে বলতে পারে- “সত্য যাবে ডুবে। আর যে অনুষ্ঠানকে মানিনে তারই দড়ি দিয়ে ওকে রাখব বেধে? আমি? আমি করব এই কাজ?” কমলের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না।অথচ এ যুগের আধুনিকা নারীরা কত সহজেই বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও স্বামীরই অর্থে প্রতিপালিত হয়েও গর্ব অনুভব করে থাকে। শরৎচন্দ্র “বেলা”র চরিত্রে যাদের ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু কমলের কথায়, “মনই যদি দেউলিয়া হয়, পুরুতের মন্ত্রকে মহাজান খাড়া করে সুদটা আদায় হতে পারে কিন্তু আসল তো ডুবল।” আশ্চর্য্য লাগে অধিকাংশ নারীই এই সত্যটাকে কত সহজেই ভুলে থাকে।

কমলের কথার সূত্র ধরে মনে হয় সত্যিই তো, এ জীবনে সুখ দুঃখের কোনোটাই শেষ সত্য নয়। সত্য শুধু প্রতিক্ষণের আন্তরিক অনুভবের চঞ্চল মুহূর্তগুলির আসা যাওয়া ছন্দটুকু। বুদ্ধি এবং হৃদয় দিয়ে সে মুহূর্তগুলিকে পাওয়াই তো সত্যিকার পাওয়া।তাই কমল জানত সে শিবনাথের কাছে যা পেয়েছিল, যতটুকু পেয়েছিল সেই তার অশেষ ধন। তাই যা পায়নি তা নিয়ে কাঁদাকাটি করতে তার শিক্ষায়, রুচিতে বেঁধে যায়।

কমল এটাও জানত পুরুষের কাছে কমল যতটুকু পায় তা তার নারীত্বের চরম ঐশ্বর্য্যের প্রতিফলনেই পায়। ফাঁকি দিয়ে নয়। রূপ দেখিয়ে মন ভুলিয়ে নয়। আর তাই পুরুষ যখন কমলকে ভালোবাসে, ভালোবাসতে পারে, সেই পারাটাও সম্ভব হয় কমলের স্বাধীন সত্তাজাত নারীত্বের অশেষ মহিমায়। এবং সেইখানেই কমলের নির্ভরতা। নির্ভরতা আবিশ্ব এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থগুলির প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধতার মধ্যেও।তাই তো হরেন্দ্র, শিবনাথ পরিত্যাক্ত নিঃসঙ্গ কমলের অবিচল দৃঢ়তায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবত “এত বড় নিঃসহায়তাও এই রমণীকে লেশ মাত্র দূর্বল করিতে পারে নাই। আজও সে ভিক্ষা চাহে না- ভিক্ষা দেয়।”

কমলের এই নির্ভরতার ক্ষেত্রটিকে অজিত উপন্যাসের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে কিছুটা ধরতে পেরেই বলেছিল, মেয়েরা যে বস্তুটিকে তাদের ইহজীবনের যথাসর্বস্ব বলে জানে, সেইখানে তোমার এমন সহজ ঔদাসীন্য যে, যত নিন্দেই করি, সে-ই যেন আগুনের বেড়ার মত তোমাকে অনুক্ষণ আগলে রাখে। গায়ে লাগবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”

না, সত্যিই কমল পুরুষের ভোগের বস্তু নয়। বস্তুত কোনো প্রকৃত নারীই কখনো পুরুষের ভোগের বস্তু হতে পারে না।নারীত্বের পূর্ণ মহিমায় পুরুষকে বিকশিত করে তোলার মধ্যে দিয়েই নারী প্রকাশ করতে পারে আপন অন্তরাত্মার মাধুরীকে। সেই তার চারিত্রশক্তি। সেই শক্তির পূর্ণ উদ্বোধনেই নারী জীবনের সার্থকতা। আর সেইখানেই তার আসল নির্ভরতা। কমল সেই নির্ভরতারই অব্যর্থ প্রতিচ্ছবি।

(৩)

কমল তার পিতার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিল জীবনে কখনো কোনো কারণেই মিথ্যা চিন্তা, মিথ্যা অভিমান, মিথ্যা বাক্যের আশ্রয় না নেওয়ার। এই বৌদ্ধিক শিক্ষাই কমলকে পদ্ম পাতায় বৃষ্টির জলের মত স্বচ্ছ করে তুলেছিল।তাই তো শিবনাথকে একদিন কমল যেমন ভালোবাসা দিয়েছিল, তেমনি আর একদিন শিবনাথের শঠতার প্রতিদানে তার প্রতি নির্মমতার বদলে কত সহজেই শিবনাথের সকল দোষ সকলের চোখের আড়ালে নিঃশব্দে নিঃশ্বেষ করে মুছে ফেলে দিতে পেরেছিল। সেই মুছে ফেলার মধ্যে না ছিল বিদ্বেষ, না ছিল জ্বালা, না ছিল ক্ষমা করার দম্ভ।

অজিতকে সে তাই কত সহজেই বলতে পেরেছিল গাছের পাতার শুকিয়ে ঝরে যাওয়াটাও যেমন সত্য ঠিক তেমনি সত্য সেই ক্ষত স্থানে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠা। বোঝাতে চেয়েছিল বাইরের শুকনো পাতা মরে গিয়েও গাছের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যে কামড়ে এঁটে থাকে সেইটাই হল মিথ্যে। সেই মিথ্যে জীবনের মোহ কমলের জন্য নয়।আশুবাবুকেও কমল তেমনি সহজে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে, “দুঃখ যে পাইনি তা বলিনে, কিন্তু তাকেই জীবনের শেষ সত্য বলে মেনেও নিইনি। শিবনাথের দেবার যা ছিল তিনি দিয়েছেন, আমার পাবার যা ছিল তা পেয়েছি- আনন্দের সেই ছোট ছোট ক্ষণগুলি মনের মধ্যে আমার মণি- মাণিক্যের মত সঞ্চিত হয়ে আছে। নিষ্ফল চিত্তদাহে পুড়িয়ে তাদের ছাই করেও ফেলিনি, শুকনো ঝরনার নীচে গিয়ে ভিক্ষে দাও বলে শূন্য দুহাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকিনি। তাঁর ভালোবাসার আয়ু যখন ফুরালো তাকে শান্ত মনেই বিদায় দিলাম, আক্ষেপ ও অভিযোগের ধোঁয়ায় আকাশ কালো করে তুলতে আমার প্রবৃত্তিই হয় না”এই সেই স্বচ্ছতা যার কথাই বলছিলাম। ঠিক সেই একই স্বচ্ছতায় কমল; আজকের অন্ধকার কালকের সকালের আলোয় যদি দূর হয়ে যায় তবে সেই “আলোকিত প্রভাতকেই সত্যি” বলে ভালবেসে জড়িয়ে ধরতে পারার আশায় বেঁচে থাকে।

অজিতকে তাই কমল একদিন বলেছিল “একদিনের আনন্দ যেন না আর একদিনের নিরানন্দের কাছে লজ্জাবোধ করে।” এখানেই কমলের শূচিতা। নির্মলতা। কমলের তাই মনে হয়, কোন আনন্দেরই স্থায়িত্ব নেই। আছে শুধু তার ক্ষণস্থায়ী দিনগুলি। সেই তো মানব জীবনের চরম সঞ্চয়। এখানেই কমলের অনন্যতা।

(৪)

কমল সেই দিপ্তীটুকু অর্জন করেছিল, জীবনের অর্থটাকে স্পষ্ট চোখে সোজাসুজি দেখতে পেলে চরিত্রের মধ্যে যে আলোটা জ্বলে ওঠে। কমল তাই জানত মানুষ শুধুমাত্র নরও নয়। নারীও নয়। নর নারী মিলেই তবে সে এক। তাই সে এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিল যে, মানুষের মধ্যে যারা বুঝেছিল নর নারীর ভালোবাসার ইতিহাসটাই হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো সত্য ইতিহাস, তারাই সত্যের খোঁজ পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি। আর যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বেই নারীর চরম সার্থকতা; সমস্ত নারী জাতিকেই তারা ছোট করেছিল। এবং সেই থেকেই বিবাহের স্থায়িত্বের মধ্যে নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে পুরুষতন্ত্র।নারীও যেদিন থেকে বিবাহ বন্ধনকেই জীবনের সর্বস্ব বলে মেনে নিয়েছে সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছে নারী জীবনের চরম ট্র্যাজেডি। দুঃসহ স্থায়িত্বের মোটা দড়ি গলায় বেঁধে মরতে হয়েছে নর নারীর স্বাধীন ব্যাক্তি সত্তাজাত নির্মল ভালোবাসাকে।

এই স্বাধীন ব্যাক্তিসত্তাজাত ভালোবাসাকে নির্মল হৃদয়ে নির্মোহ আনন্দে দীক্ষিত করে পূর্ণ জীবনবোধে উত্তীর্ণ করার সাধনাই কমলের ধর্ম।

এই ধর্মের জন্য সে সমাজের চোখরাঙানিকেও যেমন সহজ ভঙ্গিতে উপেক্ষা করতে পারে তেমনি ব্যক্তিগত দুঃখ যন্ত্রনাকেও অবলীলায় হাসিমুখে অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে পারে সামনের দিকে।এই নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে চলার তাগিদেই কোনো আদর্শকেই সে শেষ প্রশ্ন বলে শিরোধার্য করে থেমে যেতে পারে না।
তাই তো কত নিঃসঙ্কোচেই সে বলতে পারে “একদিন যাকে ভালোবেসেচি কোনোদিন কোনো কারণেই আর তার পরিবর্তন হবার জো নেই, মনের এই অচল অনড় জড়ধর্ম সুস্থও নয়, সুন্দরও নয়।”

তাই কমল কোনো কিছুতেই ভেঙ্গে পড়েনা। ভেঙ্গে পড়া আদর্শের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেই নতুন আদর্শের সৃষ্টির আশা তার চিত্তে দৃঢ় প্রত্যয়ে জেগে থাকে। আবার
সেই আদর্শের কাজ শেষ হলে আরও মহত্তর আদর্শের জন্ম হবে। এই প্রত্যয়েই সে বলে, “এমনি করেই সংসারে শুভ শুভতরের পায়ে আত্মবিসর্জন দিয়ে আপন
ঋণ পরিশোধ করে। এই তার মুক্তি পথ।”

শ্রীশুভ্র

বই বিমুখ বাঙালি

রাস্তা ঝাঁট দিয়ে অর্থ উপার্জন বরং অনেক সহজ। কিন্তু লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন আদৌ সহজ নয়। পেশা হিসাবে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে ও সংসারধর্ম পালন করে বহু মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু পেশা হিসাবে লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করে সংসারধর্ম পালন করতে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়। তাও জীবনের অনেক বছরের সংগ্রামের পর, জনপ্রিয়তার নিরিখে একমাত্র কোন কোন লেখক সাহিত্যিকের পক্ষেই পেশা হিসাবে লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরা সম্ভব হয়। তাদের সংখ্যা গুটি কয়েক। কিন্তু বাকি যাঁরা আজীবন লেখালেখির সাধনায় ব্যস্ত পেশা হিসাবে তাঁদেরকে অন্য কোন না কোন কাজকেই বেছে নিতে হয়। আর নয়তো স্বামী বা স্ত্রীর আয়ের উপর নির্ভর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় লেখালেখির একান্ত সাধনাকে। না রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার পেশার প্রতি কোনরকম কটাক্ষ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় আদৌ। বা পেশা হিসাবে ঝাড়ুদারীর সাথে লেখালেখির কোন তুলনা টানাও নয়। বলার কথা শুধু এইটুকুই যে একজন ঝাড়ুদারের পক্ষেও সংসার চালানো সম্ভব হয়। কিন্তু একজন লেখককের পক্ষে সেই একই কাজ দুঃসাধ্য। কিন্তু কেন? প্রশ্নটি সেখানেই।

বিনা পয়সায় কেউই রাস্তা ঝাঁট দেয় না রোজ। সখের স্টান্টবাজি দেওয়া রাজনীতিবিদদের পরিস্কার রাস্তায় একসাথে একধিক নতুন ঝাঁটাসহ টিভি ক্যামেরার ফুটেজ খাওয়ার নির্ধারিত দিন ছাড়া। কিন্তু বিনে পয়সায় লেখা প্রকাশের জন্যে কোন লেখকেরই উদ্যোমের কোন অভাব দেখা যায় না কখনো। একজন ঝাড়ুদার বিনা পয়সায় যে কাজ করেন না, একজন লেখক কেন সেই কাজ পয়সা ছাড়াও অম্লানবদনে করতে এগিয়ে যান? প্রশ্ন এখানেও। তবে কি রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজটিকে অর্থমূল্য বিচার করার যে আত্মসম্মান একজন ঝাড়ুদারের থাকে, একজন লেখকের তাঁর লেখাটিকে অর্থমূল্য বিচার করার মতো সেই ন্যূনতম আত্মসম্মানটুকুও কি থাকে না? থাকলে তিনি বিনে পয়সায় তাঁর লেখাকে প্রকাশকের হাতে তুলেই বা দেন কি করে? এর সহজ একটি উত্তর এই মনে হয়, পাব্লিকের রাস্তা ঝাঁট দিয়ে কারুর মনে ব্যক্তিগত আনন্দ হয় না। তাই বিনা পয়াসায় সেই কাজ করতেও কেউ এগিয়ে আসে না। ভোটের ঠেকায় স্টানটবাজির দলীয় উদ্যোগ ছাড়া। কিন্তু পাব্লিকের কাছে বিনা পয়সায় হলেও নিজের লেখাটি পৌঁছিয়ে দিতে পারলেই একজন লেখকের ব্যক্তিগত আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না বল্লেই হয়। না এইটুকুই সব নয়। আরও একটি বড়ো কারণ রয়েছে। একজন ঝাড়ুদার জানেন, প্রয়োজনে পাব্লিকই নিজেদের গরজে অর্থের বিনিময়ে তাকে দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করিয়ে নেবে। নয়তো একদিন রাস্তা দিয়ে চলাচলই দুস্কর হয়ে উঠবে। ঠিক তেমনই একজন লেখকও জানেন তাঁর লেখা পড়ার গরজে পাব্লিক কোনদিনও তাঁর কাছে ছুটে আসবে না, অর্থ মূল্যে লেখা কেনা তো দুরস্থান।

এই যে পড়ার প্রতি অনাগ্রহ, না পড়লেও জীবনের কোথাও কোন অসুবিধা ঘটার কোন কারণই ঘটে না, ঘটবে না কখনোই; এই বোধ ও বিশ্বাস থেকেই লেখকের কাছ থেকে অর্থমূল্যে লেখা কিনে পড়ার মতো পাঠক থাকে না। এই সত্যটুকু সবচেয়ে ভালো জানেন একজন প্রকাশক। তাই স্কুল কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের বিষয়ে তিনি যত আগ্রহী হবেন, একজন লেখকের গল্প কবিতা প্রবন্ধ প্রকাশের বিষয়ে তাঁর যে কোন ব্যবসায়িক আগ্রহ থাকবে না সেতো বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী লাভের জন্যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বই কেনার আগ্রহ থাকুক বা নাই থাকুক, প্রয়োজনটুকু এতটাই সর্বাত্মক যে না কিনে উপায় নাই। তা সে যতই অগ্নিমূল্য হোক না কেন। খেয়ে পড়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে যে কোন একটি ভালো ডিগ্রী এতই মহার্ঘ্য। কিন্তু একটি ভালো গল্প বা উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ বা গবেষণা গ্রন্থ রোজকার বেঁচে থাকার জন্যে আদৌ জরুরী নয়। কিন্তু একটি পরিস্কার রাস্তা অনেক বেশি জরুরী। তাই সমাজের কাছে একজন লেখকের থেকেও একজন ঝাড়ুদারের প্রয়োজনীয়তা এত বেশি।

আবারও বলি, ঝাড়ুদারের সাথে লেখকের কোন লড়াই বা প্রতিতুলনা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমাদের সমাজে একজন লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি সেইটুকু অনুসন্ধান করাই বর্তমান লেখার মূল উদ্দেশ্য। অনেকেই হইহই করে উঠবেন হয়তো। তা কেন? তাহলে এত পত্র পত্রিকা এত বইপত্র, এত বইমেলা এসব কিসের জন্যে? খুবই সত্য। কিন্তু এসবই বই প্রকাশের সাথে যুক্ত প্রকাশক সম্প্রদায়ের জন্যে। এইগুলি না থাকলে তাদের ব্যবসায় গণেশ উল্টানো অবধারিত। অনেকেই প্রতিবাদ করবেন এই বলে যে তাঁরা যথেষ্টই বইপত্র কেনাকাটি করেন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও। তাহলে সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন ওঠেই বা কি করে? ওঠে, কারণ এই যে এত লেখা, এত লেখক, তার মধ্যে কয়জন শুধু তাঁর লেখাকেই পেশা হিসাবে আঁকড়ে ধরে বহাল তবিয়তে আছেন? আমরা সবাই জানি, সেই মাত্র কয়েকজনের সংখ্যাটাই কি মারাত্মক ভাবে কম। আমরা এটাও জানি, অধিকাংশ লেখকই অন্য কোন না কোন পেশার সাথে যুক্ত থেকেই কেবল মাত্র নেশা আর ভালোবাসা হিসাবেই লেখালেখি চালিয়ে আসছেন। অধিকাংশ বিখ্যাত লেখকই অন্য কোন পেশায় গ্রাসাচ্ছাদনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করে তবেই লেখালেখির নেশাকে টেনে নিয়ে চলেন। সেই লেখা থেকে সামান্য কিছু আয় যদিও কখনো সখনো হয়ও, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সুরাহা ঘটানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। এইখানেই আমাদের সমাজে একজন লেখকের মূল অপ্রাসঙ্গিকতা। অন্য যে কোন পেশাজীবী মানুষের যে সামাজিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যেমন ডাক্তার, উকিল, প্রযুক্তিবিদ, মিস্ত্রী, শিক্ষক, আমলা থেকে শুরু করে দোকানি এমন কি আমাদের লেখার শুরুতে যে ঝাড়ুদারের উপমা টানা হয়েছে, তাদের; একজন লেখকের কি সেই একই সামাজিক প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান এই সমাজে? সামাজিক এই প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতেই কোন কাজের প্রাসঙ্গিকতার নির্ধারণ হয়ে থাকে।

তাই লেখালেখি ও লেখকের কোনরকম প্রাসঙ্গিকতাই গড়ে ওঠে নি আমাদের সমাজে। অবশ্যই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পেশার পাঠপুস্তকের লেখকরা আমাদের এই আলোচনার মধ্যে পড়েন না। মনের খোরাক জোগানো, চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত করা, জীবনবোধের বিস্তার ঘটানোর জন্যে যে সব লেখালেখি ও তার লেখকরা দুঃখের বিষয় হলেও আজও সামাজিক ভাবেই ব্রাত্য। তাদের সাধনা ও পরিশ্রম, সমৃদ্ধি ও অর্জনের কোন রকম অর্থমূল্যই তৈরী হয়ে ওঠেনি আমাদের সমাজে। এই যে কোনরকম অর্থমূল্য তৈরী না হওয়া এটাই প্রমাণ করে একটি সমাজে লেখক শ্রেণীর অপ্রাসঙ্গিকতার। শুরুর সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করলে বলতে হয়, ঝাড়ুদার প্রাসঙ্গিক কিন্তু লেখক অপ্রাসঙ্গিক।

কিন্তু কেন এই অবস্থা? সেটি মোটামুটি ঠিকমতো বুঝতে গেলে একবার ফিরে তাকাতে হবে আমাদের ইতিহাসের দিকেই। আধুনিক বাংলার ইতিহাস, সাগর পারের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাতে গড়ে দেওয়া ইতিহাস। হাজার হাজার বছর ব্যাপি গড়ে ওঠা একটি জনপদের ধারাবাহিক অগ্রগতির সামাজিক ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাস পলাশীর প্রান্তরেই কবরস্থ। তারপর ব্রিটিশের স্কুলে পড়াশুনো করে মেকলের এ বি সি ডি মুখস্থ করে ব্রিটিশের তৈরী ডিগ্রী বগলদাবা করে আমাদের সুসভ্য হয়ে ওঠা। এটাই আধুনিক বাংলা ও বাঙালির সার্বিক ইতিহাস। যদিও সেই ইতিহাস পর্যালোচনার পরিসর নেই বর্তমান আলোচনায়, তবুও এই ইতিহাসটুকুর সামগ্রিক গুরুত্ব অনুধাবন না করতে পারলে আজকের বাঙালি সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিটুকু ছোঁয়া যাবে না আদৌ। ব্রিটিশের স্কুলে এ বি সি ডি মুখস্থ করে এক একজন অকস্ফোর্ড কেম্ব্রিজ ডিকশনারীর বিশেষজ্ঞ হয়ে ম্যকবেথ প্যরাডাইস লস্ট আবৃতি করে আমরা শিখেছি কি করে মনমতো একটি সরকারী কি বেসরকারী চাকুরী বাগিয়ে নিতে হয়। এবং শিখেছি সেই বাগিয়ে নেওয়ার পথে প্রতিযোগিতার রাস্তা সাফ করতে কখন কাদের পায়ে সঠিক পরিমাণে তৈলমর্দন জরুরী। কবি কত তীব্র আক্ষেপেই না বলেছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ কর নি’। এই যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতা, একটি সমাজের এই যদি আধুনিকতার সার্বিক চেহাড়া হয়, তবে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সেই সমাজের উঁকি দেওয়ার আগ্রহ কতটুকু থাকবে সে কথা বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী আর মাসিক উপার্জনই যে সমাজের সবকিছু বিচারের মানদণ্ড সেই সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। একজন লেখক ঠিক ততখানিই বড়ো লেখক, যত বড়ো তাঁর ডিগ্রী ও যত বেশি তাঁর মাসিক উপার্জন। তারপর তো তিনি একজন লেখক! তারও পরে তাঁর জনপ্রিয়তা। লেখা ও লেখকের সামাজিক কোন প্রাসঙ্গিকতা না থাকলেও। এই হচ্ছে বাংলার সামগ্রিক চিত্র।

ব্রিটিশের স্কুলে সুসভ্য হয়ে ওঠা বাংলা আরও একটি শিক্ষা অর্জন করে নিতে পেরেছে সহজেই। দেশের অধিকাংশ জনগন যত বেশি পরিমানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তত বেশি আরামেই দিন কাটবে এ বি সি ডি মুখস্থবিদ ডিগ্রীধারীদের। তাই বৃটিশ চলে যাওয়ার পর সাড়ে সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আজও অধিকাংশ বাঙালিকেই আমরা অশিক্ষিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সমাজে অশিক্ষিত জনসংখ্যার পরিমাণ যত বেশি হবে লেখকের লেখার পাঠকও তত কম হবে। এতো জানাই কথা। ফলে আমাদের সমাজে একজন লেখকের সামাজিক অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি ব্যাপক সেটি অনুধাবন করতে গেলে এইসব বিষয়গুলির দিকেও সার্বিক নজর দিতে হবে। হবেই। কিন্তু ইউরোপের স্বাধীন দেশগুলির মতোই আমরাও যদি কালের ধারাবহিকতায় একটি স্বাধীন জাতির স্বাধীন সমাজের মতোই মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে দিনে দিনে সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাতে বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগ ও পরিসর পেতাম, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির সাথে স্বাধীনভাবে মোলাকাতের মধ্যে দিয়ে পুষ্ট হয়ে উঠতে পারতাম, তাহলে আমাদের আপন স্বাধীকারে অর্জিত সমৃদ্ধির পথেই আমরাও একদিন অধুনিক যুগে পা রাখতে পারতাম। আধুনিক যুগের চৌহদ্দিতে সেই প্রবেশ ঘটত আমাদের নিজেদের পায়ের দৃপ্ত পদক্ষেপেই। ব্রিটশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে নয়। এই যে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে বাঙালির একাংশের আধুনিক হয়ে ওঠার অভিশপ্ত ইতিহাস, এই ইতিহাসেই নিহিত আমাদের সার্বিক ব্যর্থতার আজকের চিত্রগুলি। পরিতাপের কথা আমাদের ইতিহাসের এই দিকটি ও তার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত মানুষদেরই কোনরকম বাস্তব ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠে নি আজকেও। তার মাশুলই গুনছি আমরা প্রতিদিনের সমাজ ও জীবন বাস্তবতায়।

কিন্তু বাঙালির পাঠাভ্যাস ও তার জীবনে বইয়ের প্রকৃত অবস্থা, বাঙালি জনমানসে একজন লেখকের অস্তিত্ব ও সম্মান, এইসব বিষয়গুলি প্রকাশক মাত্রেই ভালো জানেন। তাই লেখককে একটি সৌজন্য সংখ্যা ধরিয়ে দিয়েই তিনি কোনরকমে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন একটি সাময়িকী। কিন্তু বই প্রকাশের প্রয়োজন হলেই প্রকাশকের মাথায় হাত। কে কিনবে লেখকের বই? কয়টি সংখ্যা বিক্রী হবে? বই প্রকাশকের লগ্নীই বা কি করে মুনাফার মুখ দেখবে? তিনি তো আর দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসে পড়েননি? তখনই প্রকাশক লেখকের কাছেই তাঁর বই প্রকাশ করে দেওয়ার নানান রকম স্কীমের ফাঁদ পাতেন। লেখক একবার শুধু ধরা দিলেই হলে। প্রকাশকের লক্ষ্মীলাভ নিশ্চিত। ফেল কড়ি মাখো তেল। তোমারই পয়সা। তোমারই বই। আমি শুধু লাভের বখড়া রেখে বই ছাপিয়েই ক্ষান্ত। তরপর তোমার বই বিক্রীই হোক আর নাই হোক। মাথাব্যাথা আমার নয় তোমার।

কিন্তু লেখকেরই বা এত মাথা ব্যাথা কেন? কি হবে লিখে? কিই বা হবে সেইসব লেখা জমিয়ে বই প্রকাশ করে? নিজের বা নিজের স্ত্রী কিংবা স্বামীর কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় করে? প্রথমত লেখক কেন লেখেন? লেখেন নিজের কথাগুলি বলার জন্যে। সে তো ঘরের দেওয়ালের দিকে মুখ করেও বলা যায়। বলাই যদি হয় উদ্দেশ্য। কিন্তু না। শুধু বলাই তো আর উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য অন্য একজনকে শোনানো। বেশ তো, বাড়িতে যিনি শুনতে চান, তাঁকে শুনিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তার জন্যে আবার কষ্ট করে সময় ব্যায় করে লেখাই বা কেন। কারণ তো শুধুই লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যেই নয়। কারণ সেই লেখাটিকে সংরক্ষণ করে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তিজাত আনন্দের মধ্যেই। সেই আনন্দই হলো সংযেগের আনন্দ। একজন লেখক তখনই লেখক, যখন তিনি পাঠকের সাথে সেই সংযোগ সূত্রটি গোড়ে তুলতে পারেন ঠিকমত। প্রত্যেক লেখকের অস্থিমজ্জায় এই সংযোগেরই সাধনা। লেখক চান তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের। এই যে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের একন্ত অভীপ্সা ও নিরন্তর তাগিদ, সেই তাগিদেই একজন লেখক বাজারের সব রকম নিয়মকেই শিরোধার্য্য করে নিতে বাধ্য হন। তাই বাধ্য হন বিনা পারিশ্রমিকেও লিখতে। বাধ্য হন নিজের কষ্টার্জিত অর্থে হলেও সামর্থ্য থাকলে বই ছাপাতে। বাধ্য হন অন্য কোন পেশায় নিযুক্ত হতে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ারই জন্যে। আমাদের সমাজ ও বইয়ের বাজারের কাছে লেখক তাই দাসত্বের শৃঙ্খলেই বেঁধে ফেলেন নিজেকে। না ফেললে যে তাঁর মুক্তি নাই। কেননা তাঁর মুক্তি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই বহজনের সাথে সংযোগসূত্র গোড়ে তুলতে পারার মধ্যেই।

কিন্তু সার্বিক অশিক্ষিত মানুষের সমাজে মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতার পরিসরে এমনকি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষিত মানুষের জীবনেও লেখকের কোন লেখার সাথে এই সংযোগ সূত্র গড়ে তোলার কোন রকম প্রাসঙ্গিগতাই নাই আমাদের দেশ ও সমাজের জীবনে। তাই সাধারণ ভাবেই কি অশিক্ষিত কি শিক্ষিত সব ধরণের মানুষের কাছেই একজন লেখক ও তাঁর লেখা মূলত অপ্রাসঙ্গিক ও ব্রাত্য হয়েই পড়ে থাকে। পড়ে থাকে অনাদরে অবহেলায়। এইকারণেই আমাদের দেশে মানুষের বইপত্র পড়ার অভ্যস প্রায় নাই বললেই চলে। বইপত্রের পাঠক থাকলেই বইয়ের বাজার থাকতো। আর বইয়ের বাজার যত শক্তিশালী হবে ততই লেখকদের সমাদর ও প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাবে। কেবল মাত্র তখনই একজন লেখক লেখাকেই পেশা করে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ন্যূনতম চাহিদা পুরণ করতে পারবেন অন্তত। যখন লেখকও হয়ে উঠবেন সমাজেরই প্রাসঙ্গিক একটি অংশ।

অনেকেই হয়তো বলবেন আসলে ইনটারনেট প্রযুক্তির বিপ্লবের কারণেই মানুষের বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে। অনেকেই দোষ দেবেন বোকাবাক্সেরও। কিন্তু আমাদের আলোচনা এই দুইটি বিষয়কে বাদ রাখলেও সর্বাংশেই সত্য। অর্থাৎ নেটে আসার আগে থেকেই বাঙালির পাঠভ্যাস এরকমই লজ্জাজনক ভাবেই কম ছিল। বোকাবাক্স আসারও আগে যে বইয়ের বাজার খুব বিরাট ছিল, না বিষয়টি আদৌ সেরকম নয়। আর ছিল না বলেই কলকাতা বইমেলের জন্ম হয়েছিল। মেলার হুজুগেও যদি কিছু পরিমানে অবিক্রীত বইয়ের সৎকার করা যায়। বাংলায় বইমেলার দাপট দেখে একথা মনে করার কোন কারণই নাই যে বাঙালি বই পাগল জাতি। বরং ঠিক এর উল্টো। বাঙালি বইয়ের থেকে দূরে থাকতেই বেশি অভ্যস্থ বলে বইকেই বাঙালির ঘরের সামনে হাজির হতে বইমেলায়র মাঠে এসে উপস্থিত হতে হয়েছে। অধিকাংশ উন্নত দেশে ও জাতিতে মানুষ সারা বছর ধরেই যে পরিমাণে বই কেনে ও পড়ে, তাতে কিন্তু সেইসব দেশে বইয়ের প্রকাশককে সারা বছর ধরে বাৎসরিক বইমেলার জন্যে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না। তাই সেই সব দেশে বইমেলার হুজুগও বেশি দেখা যায় না। সেখানে মানুষ হুজুগে পড়ে বই কেনে না। কেনে বই পড়ার জন্যেই। পড়ে জীবনের সাথে বইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই। পড়ে তার জীবনকে জানার ও অনুধাবনের একান্ত তাগিদেরই তীব্র সংবেদন থেকেই। সেখানে বই ও লেখালেখির বিরাট বাজার বিদ্যমান। এবং হ্যাঁ ইনটারনেট বিপ্লবের পরেও। কারণ ইনটারনেট একটি মাধ্যম। ছাপাখানার মতোই। সেই মাধ্যম বইয়ের বজার সঙ্কুচিত করার বদলে বরং প্রাসরিত করেই চলেছে। আরও বেশি করে কদর বেড়েছে তাই লেখকদেরও। তাই উন্নততর দেশে ও জাতিতে লেখকের প্রাসঙ্গিকতা সমাজের অস্থিমজ্জাতেই প্রোথিত। হ্যাঁ আমাদের দেশের সেই ঝাড়ুদারদের মতোই প্রাসঙ্গিক। কিংবা হয়তো বা তার থেকেও বেশি।

শ্রীশুভ্র

অভিশপ্ত ছাত্ররাজনীতি

শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির প্রবেশ, দলীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে পঠন পাঠনের ঘোর অবনতিই সূচীত করে!

জীবনের সমগ্র পরিসরে শিক্ষার্জনের সময়সীমা খুবই সীমিত! সেই সীমিত কালসীমায় যে বিদ্যার্জন এবং মেধার বিকাশ সাধন হয়, তার উপরেই সাধারণত বাকি জীবনের সুখ শান্তি কর্ম ও পরিতৃপ্তি নির্ভর করে! নির্ভর করে একটি জাতি, একটি দেশের উন্নতিও! রাজনীতির অঙ্গনে, সে নিজের ব্যক্তিগত আখের গোছানোর দূর্নীতিই হোক কিংবা সুনাগরিকের দেশপ্রেমে অভিষ্ট দেশসেবা ও দেশের উন্নয়ণ প্রক্রিয়ায় সদর্থক ভূমিকা রাখাই হোক; কর্মমুখর হয়ে ওঠার জন্যে সারা জীবন পাওয়া যাবে! কিন্তু শিক্ষার্জনের জন্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনই জীবনে পাওয়া যায়!

জীবনের সেই স্বল্প কয়টি দিন, যা কার্যকরি শিক্ষার্জনের জন্যেই নির্দিষ্ট তা কখনই রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্র হতে পারে না! শিক্ষার্জনের এই পর্বটি ছাত্রছাত্রীর মৌলিক মেধা বিকাশের প্রস্তুতি পর্ব! তারা এই কালসীমায় শিক্ষা আহরণ করবে, আত্তীকরণ করবে! সেই অধীত বিদ্যায় তাদের মেধা পুষ্ট হতে থাকবে! বিকশিত হয়ে ওঠার পথে দ্রুত গতিশীল থাকবে! এবং পর্বে পর্বে তাদের মৌলিক চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটবে! পারদর্শী হয়ে উঠবে কোনো না কোনো কার্যকরী বিদ্যায়! যে পারদর্শিতায় তারা তাদের কর্মজীবনে ক্রিয়াশীল থাকবে জীবনের মূলপর্বে! তাই সমগ্র জীবনের প্রেক্ষিতে শিক্ষাজীবনের এই মূল্যবাণ পর্বটি জীবন গড়ার জন্যেই নির্দিষ্ট থাকা উচিত!

কিন্তু! দুই বাংলায় শিক্ষাক্ষেত্র আজ ছাত্ররাজনীতির অভিশাপের করাল গ্রাসে! কেন এমন হলো? সেটা বুঝতে গেলে একটু ফিরতে হবে ইতিহাসে! বৃটিশ এসে শাসনকার্য পরিচালনা এবং শোষণকার্য চালু রাখার জন্য বশংবদ রাজভক্ত কর্মচারী তৈরীর কারখানা স্বরূপ পত্তন করল আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা! যে শিক্ষাব্যবস্থা সমাজদেহের অন্তর থেকে গড়ে উঠল না! বিদেশী শোষক চাপিয়ে দিলো বাইরে থেকে! ফলে দেশের নাড়ির স্পন্দন থেকে বিচ্যুত, জাতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে সম্পর্কহীন, স্বদেশের প্রাণের সাথে শিকড়হীন এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি চালু হল, যা মেরুদণ্ডহীন অনুকরণ প্রিয় নকলনবীশ মুখস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ডিগ্রী সর্বস্ব চাকুরী প্রার্থী তৈরী করে!

ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো চাকুরী সন্ধান! মৌলিক মেধা বিকশের জন্যে সমগ্র জীবনের উদ্বোধন নয়! সুচতুর বৃটিশ বুঝেছিল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রথমেই যদি জাতির মেরুদণ্ডটি ভেঙ্গে দেওয়া যায়, তবে সেই জাতিকে শতাব্দীব্যাপি বশংবদ করে রেখে শোষণ প্রক্রিয়াকে সুনিশ্চিত করা যায়! আর স্বাধীনতার নামে ভারতবর্ষে বৃটিশের তাঁবেদারদের হাতে শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমতা হস্তান্ততরের পর, স্বদেশী শোষককুল সেই একই শোষণ ব্যবস্থা জারি রাখার উদ্দেশ্য বৃটিশ প্রবর্তীত শিক্ষাব্যবস্থাকেই বজায় রাখল! আগে যেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কারখানায় বৃটিশভক্ত রাজকর্মচারী তৈরী হতো; এখন সেখানেই রাজনৈতিক দলীয় কর্মী তৈরীর ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেল!

স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল রাখার উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ নেতাকর্মীর নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের প্রবাহ বজায় রাখার জন্যে শিক্ষাক্ষেত্রকেও রাজনীতির পরিমণ্ডলে নিয়ে আসা হল ছাত্ররাজনীতির নাম করে! ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল! আর ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকল রাজনৈতিক দলগুলির হাতে! ছাত্ররা ব্যবহৃত হতে থাকল দলীয় রাজনীতির স্বার্থে! শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য গৌন থেকে গৌনতর হতে থাকল! কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি রাজনৈতিক দলেগুলির আখড়ায় পরিণত হল! শিক্ষাক্ষেত্রও হয়ে উঠল রাজনৈতিক দলগুলির অঞ্চল দখলের লড়াইয়ের ময়দান! নষ্ট হয়ে গেল স্কুলকলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের পরিবেশ! ছাত্র শিক্ষক সুসম্পর্ক!

শিক্ষাক্ষেত্রে এরফলে নেমে এসেছে এক চরম নৈরাজ্য! এবং সেটা কাঁটাতারের উভয় পাড়েই সত্য হয়ে উঠেছে! পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে সরকারী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পরস্পরের রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ের একটা বড়ো ময়দান হয়ে উঠেছে শিক্ষাক্ষেত্রগুলি! শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররাজনীতিতে তারই স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে! আর পড়েছে বলেই বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে মুক্ত চিন্তাশক্তি ও মৌলিক মেধা বিকাশের পথটি! ছাত্ররা হাফপ্যাণ্ট পড়া থেকেই দেশের বা রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির দলদাসে পরিণত হয়ে পড়ছে! তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি ছাত্রছাত্রীদেরেই স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে! যেহেতু সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিরই স্বার্থ এক তাই এই অভিশাপ চলবে!

পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের চৌঁত্রিশ বছরের শাসন আমলে ছাত্ররাজনীতিকে ক্যাডার তৈরীর প্রক্রিয়া হিসেবে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়ছিল! এবং সাংগঠনিক দৃঢ়তায় ছাত্ররাজনীতিকে কার্যত বিরোধীশূন্য করে, বামফ্রন্টের একছত্র আধিপত্য রাজ্যে এক বিরোধীশূন্য গণতান্ত্রিক পরিসরের সংস্কৃতির পত্তন করেছিল! ছাত্র থেকে শিক্ষক, পঠনপাঠন থেকে কর্মসংস্কৃতি সর্বত্র বামরাজনীতির ছাত্রসংগঠনটি নিঃশ্ছিদ্র আধিপত্ত বিস্তার করেছিল! তাতে শিক্ষাবিস্তার হোক না হোক, রাজনৈতিক আধিপত্ত বিস্তারের কাজটি হয়ে ছিল নিখুঁত! পরিবর্ত্তনের কাণ্ডারীরা এইখান থেকেই ক্ষমতা দখলের সূত্রটি গ্রহণ করে!

পরিবর্ত্তনের কাণ্ডারীরা ক্ষমতায় এসেই রাতারাতি বাম আমলের চৌঁত্রিশ বছর ধরে গড়ে তোলা আধিপত্ত, দুদিনের মধ্যেই কায়েম করতে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সরাসরি পেশিশক্তির আস্ফালনের উপর নির্ভর করতে শুরু করল! যার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা দিতে থাকল বিভিন্ন কলেজে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে! অধ্যাপক অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই যে শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এর জন্যে বর্তমান সরকারি দলের প্রত্যক্ষ মদত নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না! এবং এই প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এক কলেজ থেকে আর এক কলেজে! এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে!

এবং রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে ব্যবহৃত পেশিশক্তিই সরাসরি ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারী দলের তাঁবেতে নিয়ে আসতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে স্বাভাবিক পঠনপাঠনের পরিবেশ! সমস্ত রাজ্য জুড়ে এই যে পেশিশক্তির দাপটের আস্ফালন আছড়ে পড়ছে শিক্ষাঙ্গনের চত্বরে, অবশ্যই এর পেছনে সরকারী দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে! তারা ভাবছেন, বাম আমলের সাড়ে তিনদশকের রাজত্বের অন্যতম স্তম্ভ এই ছাত্ররাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে তাদেরও দীর্ঘমেয়াদী সময়সীমায় শাসন ক্ষমতা দখলে রাখা সহজ সাধ্য হবে! তাই গণতন্ত্রের পরিসরে স্বৈরতন্ত্রের অভিলাষ চরিতার্থের এই প্রয়াস চলছে!

এই যে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির অভিশপ্ত নাগপাশ গ্রাস করে ফেলেছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে, এখানেই কপাল পুড়েছে বাংলা ও বাঙালির! পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ জুড়ে চিত্রটা মূলত একই রকম! এর পরিণতি ভবিষ্যতে যে ভয়াবহ সে কথা সহজেই অনুমেয়! যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড স্বরূপ সেই শিক্ষাব্যবস্থার আগাগোড়া ঘূণে ধরে গেলে সে জাতির উন্নতি কোনোদিনও সম্ভব নয়! নয় বলেই উন্নত বিশ্বের জাতিগুলির শিক্ষাব্যবস্থা এই ঘূণ থেকে মুক্ত! সেসব দেশে শিক্ষাক্ষেত্র রাজনৈতিক কলুষতা মুক্ত! শিক্ষাক্ষেত্র সেখানে জাতির ভবিষ্যত সুনাগরিক গড়ে তোলার অঙ্গন! মৌলিক মেধা বিকাশের সুবিস্তৃত মুক্ত পরিসর! জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পীঠস্থান!

সুচতুর বৃটিশের প্রবর্তীত শিক্ষাব্যবস্থা, ও তাদের তৈরী করে দেওয়া ভোট সর্বস্ব ক্ষমতালোভী গণতন্ত্রের যুগলবন্দীর ফল ফলেছে আজ কাঁটাতারের উভয় পাড়ের বাংলায়! সেই ফলেরই অভিশপ্ত ফসল এই ছাত্ররাজনীতি! সারা বাংলা জুড়ে আজ তাণ্ডব চালাচ্ছে! কিন্তু এই অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে গেলে সমাজ বিপ্লব ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই! যে রোগ সমাজদেহের ভিতরে শিকড় ছড়িয়েছে; সমাজদেহের গভীর থেকে তার মূলোৎপাটন করতে গেলে সমাজ সংস্কার করতে হবে আগাগোড়া! আর সেই সমাজসংস্কার সম্ভব একমাত্র সমাজ বিপ্লবের পথ ধরেই! এই অভিশপ্ত ছাত্ররাজনীতির কবল থেকে শিক্ষাঙ্গনকে মুক্ত করতে না পারলে বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যত যে অন্ধকার সে কথা বিতর্কের উর্দ্ধেই!

শ্রীশুভ্র

আমরা সবাই কবি আমাদের এই নেটের রাজত্বে …

না কেউ কেউ কবি নয়! সকলেই কবি! বিশেষত যদি বাঙালি হন, আর লগইন করেন ফেসবুকে! তবে স্ট্যাটাসে কীপ্যাড ওপেন করলেই কাব্যসরস্বতী আপনার অধীনস্ত! অক্ষর জুড়ে অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, দলবৃত্ত তছনছ হতে পারে! ধর্ষিত হতে পারে ছন্দ অনুপ্রাস কাব্যমাত্রা! কিন্তু কবিতাদেবীর শরীরের বিভঙ্গে শব্দযোজনা করলেই আপনি কবি! সম্পাদকের কাঁচি নেই! প্রকাশের জন্য অপেক্ষা নেই! বন্ধুবৃত্ত যত জোরালো তত লাইক! কমেন্টের হুল্লোর আছড়ে পড়বে আপনার পোস্টের মার্চপাস্টে, ট্যাগের মিসাইলে অধিকৃত করতে পারবেন যত বেশি বন্ধু দেওয়াল! শেয়ার বাটনে সৌরভ ছড়াবে আপনার কবিখ্যাতির নতুন দিগন্তে! শুধু একটা লগইনেই বঙ্গলক্ষ্মীর কাব্যভাঁড়ারের চাবি আপনার হাতে!

সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু যুগ পূর্বেই বলে গিয়েছিলেন, বঙ্গসন্তান যৌবনে কাব্যচর্চা করবে না, এ হয় না! বঙ্গজীবনে বাঙালির কাব্যচর্চার ধারার বিবর্তন হয়েছে নানান ভাবে, যুগ পরিবর্তনের নানা পর্বে! কিন্তু পরাধীন জাতির- বৃটিশের স্কুলে প্রবেশ করে কাব্যচর্চায় ঘটে গিয়েছিল এক বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী আর কবিকৃতী যেন সমান্তরাল পদধ্বনী করে এগিয়ে চলছিল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আধুনিক পর্বে! হয়ত সেই কারণেই কবি জীবনানন্দ দাশকে উচ্চারণ করতে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক সাবধানবাণী; “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি” কবি যশ প্রার্থী বাঙালি অবশ্য তাতে কান দেবার পাত্র নয়! দেয়ও নি তাই কোনোদিন!

ছাপাখানার চৌহদ্দীর সেই যুগে জীবনানন্দ কল্পনাও করে যেতে পারেন নি- আজকের লগইন অনলাইনের এই যুগের কাব্যসুনামীর প্রলয়ের বর্তমান চিত্রটি! ইনটারনেট পত্তনের আগে, পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষার সেই যুগেই কবি অস্থির হয়েছিলেন অকবির সংখ্যাধিক্যে! আর আজ তিনি জীবিত থাকলে হয়ত দমবন্ধ হয়েই মমি হয়ে যেতেন আমাদের দাপাদাপিতে! কিন্তু আমরা বাঙালিরা কাঁটাতারের কী এপাড়ে, কী ওপাড়ে সেকথা ভেবে দমার পাত্র নই! আমাদের অফুড়ন্ত দম! সেই দমেই দমদমাদম কবিতার বৃষ্টি হয়ে চলেছে অনলাইনে! কিন্তু কি লিখছি আমরা? কেন কবিতা! কবিতাই তো? কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়, সেই সীমারেখাটা কি ধুয়ে যায় নি ইনটারনেটের পক্ষ বিস্তারে? কবিতা আর অকবিতার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্যের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন কবি; ইনটারনেটে কাব্যচর্চার যুগে সে পার্থক্যের বিষয়ে আমরা কজনই বা আর খেয়াল রাখি? জীবনবোধের পরতে পরতে, অভিজ্ঞতা আর সজ্ঞান কালচেতনার যুগলবন্দীতে- সমাজ সভ্যতা ও ইতিহাস জ্ঞানের বিস্তারে; প্রাত্যহিক জীবনের পরিধিতে- শাশ্বত জীবনবোধের সুস্পষ্ট মায়াবী উদ্ভাসনের যে প্রবল সংঘটনের অন্যতম অভিমুখই হলো কবিতা; সে কথা আজকের এই লগইন সভ্যতায় কজনই বা আর অনুভব করি আমরা? কতগুলি মনের ভাবনা বা বক্তব্যের পরিস্ফূটনে আপাত অসংলগ্ন কিছু শব্দ বিন্যাসের মাধ্যমে একটি ধারাবাহিক ছবির উদঘাটনকেই কবিতা বলে ভুল করে বসি অধিকাংশ সময়েই! জীবনযাপনের চর্চার মধ্যে নান্দনিক প্রত্যয় এবং ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্বন্ধে দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা ও দেশ আর জাতীয়তার শিকড়ের সাথে নিবিড় সংযোগ না থাকলে, যে কবিতা লেখা সম্ভব নয়, ভুলে যাই আমরা সেই মূল সত্যটাকেই! অনেক সময়! তাই বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ করে অনলাইনে- মূলত শব্দ বিন্যাসের কারিকুরিকেই কাব্যচর্চা বলে ভেবে বসি! কারণ জীবনযাপনের পরিসরে আমরা সাধারণত ভাসমান কচুরীপানার মতোই জীবনের উপরিতলে ভেসে বেড়াই! ফলে কোনো গভীর জীবনবোধের সামনাসামনি হতে আগ্রহী হই না আমরা!সেখানেই আমাদের কাব্যচর্চার পরিসর জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে! আর জীবন বিচ্ছিন্ন লেখা কখনোই হয়ে ওঠে না কবিতা!

জীবনবোধের অগভীর তল থেকে এই যে আমাদের প্রাত্যহিকতা, এই কারণেই সমস্ত কিছুর সাথেই আমদের সংলগ্নতা বড়োই আলগা হয়ে পড়ছে ক্রমশ! ক্রমশই আমরা নিজেদের জীবন প্রক্রিয়ার চারপাশে কখনো তৃপ্তি কখনো বা অতৃপ্তির আত্মগত একটি সংকীর্ণ বলয় তৈরী করে ফেলছি! যার মধ্যে থেকে সমগ্র জীবনবোধের গভীরে পৌঁছাতে পারছি না আমরা কিছুতেই! হারিয়ে ফেলছি বৃহৎ মানবজীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিজীবনের মূল প্রেক্ষিতটাকেই! আর ঠিক সেই কারণেই বিস্তৃতভাবে বাংলা কাব্যচর্চা আজ আর ঠিক সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠতে পারছে না! হয়ে উঠতে পারছে না আমাদের জীবনযাপনেরই মূল অনুষঙ্গ! এর সাথেই যোগ হয়েছে নেটদুনিয়ায় “আমরা সবাই কবি, আমাদের এই লগ-ইনের দৌলতে!”-মানসিকতা! তাই তো আজ নেট দুনিয়ায় বাংলা কাব্যসাহিত্যে ঘটে গেছে কবিদের বিপুল বিস্ফোরণ! লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, যে পরিমাণে কবিতার সুনামি আছড়ে পড়ছে প্রতিদিন নেটের দেওয়ালে, তার সিকি ভাগও কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে না সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলিতে! একটু ভাবলেই কিন্তু কারণটা স্পষ্টতর হয়ে উঠবে আমাদের মানস পটে! গল্প প্রবন্ধ নাটক উপন্যাস লিখতে যে পরিমাণ সাহিত্যবোধ, পরিশ্রম, আর ধৈর্য্যের প্রয়োজন; আমাদের ধারণায়- কবিতা লিখতে গেলে সেই পরিমাণ সাধনার প্রয়োজন নেই! আমরা দেখেছি কবিতার আকারে কিছু বিশৃঙ্খল শব্দের সাময়িক বিন্যাসেই কবি বলে বাহবা পাওয়া যায় বেশ সহজেই! যে লেখা যত বেশি অবোদ্ধ, প্রিয় বন্ধুদের প্রীতিতে তাই তত বড়ো কবিতা!

আর এই ছবিটি দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জুকেরবার্গের ফেসবুকের দৌলতে! কী এক আশ্চর্য্য আলাদীনের প্রদীপ কবি যশ প্রার্থী বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছে কলেজ ড্রপআউট প্রতিভাধর এই ছেলেটি! হয়ত সে নিজেও সে বিষয়ে আদৌও অবহিত নয়! কবিতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে ব্যক্তিগত ওয়াল থেকে নোটের ভল্টে! না তাতেও রক্ষা নেই! ফেসবুক গ্রুপ আর পেজের সৃষ্টিতে বাঙালি যেন কাব্যসরস্বতীর বরপূত্র আজ! লক্ষ্য করার মত বিষয়, প্রায় প্রতি জনেরই এক বা একাধিক গ্রুপ রয়েছে আমাদের! যার বেশির ভাগটাই কবিতা কেন্দ্রিক! আর যার বন্ধুবৃত্ত যত প্রসারিত, এবং জনপ্রিয়তা যত বেশি, তার কবিতায় তত বেশি লাইক আর বাহবা দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা! ফেসবুকের এই বন্ধুত্বের অলীক জগতে বাঙালি বিনা কাব্যচর্চায় কবি হয়ে ওঠার এক চমৎকার সুষোগ হাতে পেয়ে গেল! বন্ধুদের বাহবা পেলেই তার কবি খ্যাতির প্রসারে সে তৃপ্ত! ট্যাঁকে বাজে খরচের রেস্ত থাকলে তো কথাই নেই! “আপন হাত জগন্নাথ!” নিজের বা স্বামীর পয়সায় প্রকাশক ধরে বই ছাপিয়ে বইমেলায় একবার পৌঁছে গেলেই হল! বিক্রী হোক বা না হোক আত্মীয় বন্ধুদেরকে নিজের নাম স্বাক্ষর করে বই উপহার পাঠাতে পারলেই “আমি কবি!” বিভিন্ন কাব্যপাঠের আসর থেকে কবিতা প্রতিযোগিতার অনলাইন বিচারকের আসনটি পাকা! আর এদিকে ফ্রীতে বই উপহার পেতে তথাকথিত কবির বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপানো স্ট্যাটাসে কমেন্টের লম্বা মিছিল! বাঙালির কাব্যপ্রীতির নমুনা ঐ অব্দিই! ফেসের পার্সোনাল ওয়াল থেকে গ্রুপের ওয়ালগুলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে অধিকাংশ কবিতারই কোনো পাঠক নেই! ব্যক্তিগত ওয়ালে নিজের লেখা যারা বন্ধুদের ট্যাগ করেন নিয়মিত , সেখানেও অধিকাংশ সময়েই মাত্র তিরিশ শতাংশ মত বন্ধুরাই তাতে সাড়া দেন! এবং চুপি চুপি বলে রাখা ভালো তার মধ্যেও অধিকাংশই কবিতাটি না পড়েই লাইক ও কমেন্ট করে বন্ধুকৃত্য সারেন! সেটা তাদের কমেন্টের বহর দেখলেই অনুধাবন করা যায়! অসাধারন, অনবদ্য, অপূর্ব, চমৎকার, খুব ভালো লাগল, দরুণ লিখেছ- এর থেকে আর বেশি কিছু লিখে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার মত ভাষা খুঁজে পান না অধিকাংশ প্রিয় বন্ধুরাই! তাই কবিও জনে জনে ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্টের কমেন্ট সংখ্যা বাড়িয়ে যান! এবং বন্ধুর লেখা কবিতা পড়ে ভালো না লাগলেও কিংবা নিজের কাব্যবোধের অভাবজনিত কারণে মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে না পারলেও আমরা লেখা ও লেখককে অভিনন্দনে ভাসিয়ে দিতেই ভালোবাসি! কিন্তু অপরিচিত লেখক- যিনি আমার বন্ধুবৃত্তে নেই; তাঁর লেখা ভালো না মন্দ তা পড়ে দেখতেও যাই না, যদি না গ্রুপ এডমিন হই! অন্যের লেখা পড়ার থেকে নিজের লেখা সবাইকে পড়ানোর জন্যেই আমাদের তৎপরতা অনেক বেশি! তাই ফেসের পাতায়, সত্যি কথা বলতে কি, কবিতার পাঠকের থেকে লেখকের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি! আর ঠিক এই কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো কবিতা নিয়েই যথার্থ সাহিত্য সমালোচনার কোনো পরিসরই গড়ে ওঠে না অনলাইনের এই আত্মপ্রচারের জগতে!

ফলে আত্মপ্রচারের এই নেট দুনিয়ায়, যেখানে সম্পাদকের নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাঁচি নেই, প্রকাশের সীমাবদ্ধতাও নেই, যেখানে আমিই আমার সম্পাদক ও প্রকাশক; সেখানে যা লিখব তাই কবিতা, যদি আমার বন্ধুবৃত্ত বেশ শক্তিশালী হয়! আর তখনই ভাষা ও ভাবের উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়! যে কোনো ভাষার কাব্যচর্চার প্রেক্ষিতে যা সত্যিই অশনিসংকেত! তবুও এর বাইরেও এই কাব্য তিমিরের বলয়েও কবি ও কবিতার জন্ম হবেই! বাংলার মাটির শিকড় থেকেই পুষ্ট হয়ে উঠবে আগামীদিনের কবি প্রতিভা! অকবিদের মিছিলের পদধ্বনি ছাপিয়েও শোনা যাবে কবিকন্ঠে জীবনের বাণী, শাশ্বত মানবকন্ঠের বাঁশিতে! সেদিনের অভিমুখেই এগোতে হবে আমাদের তলায় তলায়!

শ্রীশুভ্র

ঈশ্বর বিশ্বাস

********প্রাককথন*******

যে কোনো বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই আমাদের মধ্যে জন্ম দেয় ঐ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের! অর্থাৎ বিষয়টি সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব থাকলেই হয় আমরা সেটির সম্বন্ধে মনগড়া প্রচলিত ধারণাকে বিশ্বাস করি! অথবা সেই ধারণাটিকে অবিশ্বাস করি!
আর এইভাবেই সীমিত বুদ্ধিতে বিষয়টিকে বুঝে নেবার প্রয়াসে নিজেদের সান্ত্বনা জোগাই!

যতদিন প্রমাণ হয়নি পৃথিবী সূর্য্যের চারিধারে ঘুরছে ততদিন শুধুমাত্র সত্য জ্ঞানের অভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে আমরা বিশ্বাস করতাম সূর্য্যই পৃথিবীর চারধারে ঘুরছে! বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে এই হল শাশ্বত বাস্তব চিত্র! অর্থাৎ প্রকৃষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে যখন কোনো সত্যকে জানি, অনুধাবন করতে পারি; তখন কিন্তু আর, কোনো বিশ্বাসের কিংবা অবিশ্বাসের ওপর আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় না! তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই, থাকলে তিনি সাকার না নিরাকার এই বিষয়ে আমাদের ধারণাও সেই মনগড়া বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপরেই নির্ভরশীল! অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও রূপ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের গণ্ডীতেই অন্ধের মত ঘুরপাক খায়! কারণ বিজ্ঞান বা দর্শন আজও অভ্রান্ত ভাবে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেনি! যদিও বিশ্বের সব দর্শন চিন্তার আদি উৎসই হল বিশ্বসত্যের রহস্যকে কেন্দ্র করে! এবং বিজ্ঞানও সেই রহস্য উন্মোচনে সদা সক্রিয়!

*********(এক)*********

জীবজগতে স্বপ্রাণ বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে একমাত্র মানব মনই বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা দিয়ে প্রশ্ন করতে জানে! অন্যান্য কোনো প্রাণীই প্রশ্ন করতে জানে না! তারা প্রাপ্ত জীবনকে বিনা প্রশ্নেই গ্রহণ করে! কারণ তাদের চেতনায় কোনো বিস্ময় বোধ নেই! কিন্তু মানুষ তাঁর চেতনা উন্মেষের ঊষা লগ্ন থেকেই জগতের দিকে চোখ মেলে ছোটো বড়ো বিভিন্ন বিষয়ে বিস্মিত হতে থাকল! যত তার বিস্ময় তত তার প্রশ্ন তত তার নতুন নতুন জিজ্ঞাস্য! কিন্তু যত প্রশ্ন ততই তো হাতের কাছে চট জলদি উত্তর নেই! এক একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে লেগে গেছে কত প্রজন্ম! কত অণ্বেষন! কত পরীক্ষা নিরীক্ষা! কত ভুলের পাহাড় পেড়িয়ে এক একটি উত্তর!জীবনযাপন ও জীবন রক্ষার প্রয়োজনে মানুষ দেখল এই বিশাল জগতে প্রবল প্রকৃতির অসীম শক্তির কাছে সে কত অসহায়! কতই দূর্বল তার সমস্ত প্রয়াস! প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে তার উপলব্ধি হল কোনো বিরাট শক্তি রয়েছে এর পেছনে! সেই অদৃশ্য অপ্রত্যক্ষ কিন্তু প্রবল শক্তির তুলনায় তার ক্ষুদ্রতা অসহায়তা তাকে বাধ্য করল উত্তরহীন এই প্রশ্নের কাছে বিনীত হতে! সেই অজানা শক্তির কাছে সে সমস্ত জাগতিক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবার প্রার্থনা নিয়ে উপস্থিত হলো! এই ভাবে প্রকৃতির বিশালতায় প্রবল শক্তির মহিমায় তার মধ্যে ধীরে ধীরে এই শক্তির প্রতি জেগে উঠল বিস্ময়! এবং শ্রদ্ধা! শুরু হল এই শক্তির পূজা! জন্ম হল ঈশ্বরের! মানুষের বিশ্বাসে!

**********(দুই)*********

সভ্যতার সেই আদি যুগে ঈশ্বর ভাবনা ছিল মূলত প্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার একান্ত প্রয়াস যাতে প্রতিদিনের জীবনযাপন ও জীবন রক্ষা সহজ সাধ্য হয়! সাধারণ মানুষ চিরকালই শান্তিতে থাকতে পছন্দ করে! এবং অজানা আশঙ্কার ভয় তাকে সব সময়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়! কারণ তার অধিকাংশ প্রশ্নেরই উত্তর ছিল না হাতের কাছে! তাই বিভিন্ন সাম্ভব্য অসাম্ভব্য বিপদ আপদ থেকে উদ্ধারের আর্জি নিয়ে সে প্রাকৃতিক বিভিন্ন শক্তির কাছে উপস্থিত হলো! এই ভাবেই সৃষ্টি হতে থাকল এক এক প্রাকৃতিক দেবদেবীর! গড়ে উঠল পূজার নানাবিধ উপাচার! যা জাতি ধর্ম বিশেষে স্বভাবতই বিভিন্ন! কিন্তু উদ্দেশ্য ও মূল ভাবনায় সাযুয্য সম্পন্ন!চিন্তা ভাবনার ব্যাপ্তীর সাথে স্বভাবতই মানুষের মনে হতে থাকল এই সব প্রবল প্রাকৃতিক শক্তির অন্তরে নিশ্চয়ই কোনো অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাক্তিসত্ত্বা আছে! যার সচেতন ইচ্ছার সৃষ্টি এই জগত সংসার! এবং যার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল সমস্ত মানব জীবন! ফলত মানুষের মনে হতে থাকল এই ব্যাক্তিসত্ত্বাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে বিভিন্ন ইচ্ছাপূরণ সম্ভব! শুরু হল ঈশ্বরবন্দনা ঈশ্বর পূজো! বিভিন্ন জনগোষ্ঠিতে বিভক্ত মানব সভ্যতায় এই ভাবে গড়ে উঠল ঈশ্বরতত্ব! চিন্তাশীল মানব তার বুদ্ধিবৃত্তিতে খুঁজতে থাকল এই জগত সৃষ্টির রহস্য! শুরু হল দর্শন চর্চা! এবং তার পর বিজ্ঞানের হাত ধরেও আজও চলেছে বিশ্বতত্ব রহস্য উন্মোচনের সাধনা!

*********(তিন)*********

একদিকে কাল্পনিক ঈশ্বরকে খুশী রেখে জাগতিক জীবনে সুখে থাকা আর অন্য দিকে বিশ্বরহস্য উদ্ধারে চিন্তা শক্তি নিয়োগ করা, এই দুই পথেই চলতে থাকল মানুষ! কিন্তু তবু মানব জীবনে প্রার্থিত সুখ শান্তি আসল না! সমাজ জীবন হতে থাকল কলুষিত! তখন, যারা এর কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেন তারা অনুধাবন করলেন মানুষের স্বভাব প্রবৃত্তিতে এমন অনেক কু-প্রবৃত্তি আছে যেগুলি সংযমের শৃঙ্খলে না বাঁধলে সমাজ জীবন সুস্থ হতে পারে না! সেই প্রবৃত্তিগুলিকে শাসনে রেখে পারস্পরিক উন্নতির ও শান্তির জন্য তাঁরা চালু করলেন কিছু অনুশাসন! কালক্রমে এই সব অনুশাসনে জনগণকে শৃঙ্খলিত করার জন্য যোগ করা হলো ঈশ্বর ভাবনাসাধারণ মানুষকে বোঝানো হল অনুশাসনগুলি না মানলে ঈশ্বর রুষ্ট হবেন! মানলে তিনি হবেন সন্তুষ্ট! জীবনে যদি প্রার্থিত সুখ নাও আসে পরলোকে স্বর্গবাস সুনিশ্চিত! কিংবা পরজন্মে থাকা যাবে রাজার হালে! জীবন যাপনের জন্য সৃষ্টি হল বিভিন্ন নিয়ম নীতি! বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এই বিষয়গুলি নিয়ে গড়ে উঠল নানা লোকাচার! অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত ধীশক্তি সম্পন্ন এক এক জন মানব বিশ্বসত্য সম্বন্ধে তাঁদের মতবাদ প্রচার করলেন! কেউ কেউ এগিয়ে এলেন সমাজ সংস্কারে! গড়ে উঠল তাঁদেরকে কেন্দ্র করে এক একটি শিষ্য সম্প্রদায়! কালক্রমে এই সব সম্রদায়ের বিস্তারে গড়ে উঠল এক একটি ধর্ম গোষ্ঠী! ঈশ্বর ভাবনা বদ্ধ হল গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত মতবাদে!

**********(চার)********

ফলে কালক্রমে আমাদের ঈশ্বর ভাবনা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে গেল! শৃঙ্খলিত হল ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন ভাবনা– সাম্প্রদায়িক সমষ্টি বদ্ধতার বেড়াজালে! এবং সৃষ্টি হল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের ঈশ্বর ভাবনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব! এবং প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের ধ্যান থেকে দূরে সরে এসে, বিশ্বতত্বের রহস্য অনুসন্ধান ছেড়ে আমরা সাম্প্রদায়িক ধর্মের কূটকাচালিতে নিমগ্ন হলাম! ঈশ্বরের সম্বন্ধে আমাদের ব্যস্ততা পড়ে থাকল শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত সুখ কামনার চৌহদ্দিতেই! আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থখরচ করে পূজো দিই আর ঈশ্বরের কাছে প্রাথনা করি নিজের সুখ সাচ্ছন্দের!সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল প্রত্যেক সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে তাদের ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ! এবং মহৎ! এবং অন্য সম্প্রদায়ের ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছেই মহাপাপ! ভাবতে অবাক লাগে, কাল্পনিক এক ঈশ্বর নিয়ে এই মানব বিশ্বে মানুষের পরস্পরের মধ্যে কত হানাহানি রক্তপাত! কত রাজনীতি! কত সাম্রাজ্যর উত্থান পতন! কত প্রাণ বলি হল অকালে! অথচ আজও মানুষের কল্পিত ঈশ্বর মানুষের কাছেই রয়ে গেল অধরা! আজও প্রমানিত নয় তার অস্তিত্ব! আজও জানা গেল না তিনি সাকার না নিরাকার? এবং এই না জানার কারণেই বিভিন্ন কল্পিত মতবাদের খাঁচায় তাকে আবদ্ধ রাখতে হয়! পাছে তাকে নিয়ে কল্পনার ফানুসটি ফুটো হয়ে যায়! তাইতো কল্পিত বিশ্বাসেই তার অস্তিত্ব!

শ্রীশুভ্র।

টোটকার সাতসতেরো

নিজের বউ বাদে সব মেয়েদেরই পরমা সুন্দরী বলে মনে হয়। না কোনো মহাপুরুষের বিশ্ব বিখ্যাত কোনো বাণী নয়। সাত বাই সতেরোর লিচুবাগান বাইলেনের আমার মুখরা সহধর্মিণীর মুখনিসৃত মুখরবাণী। বাণের মতো সোজা গিয়ে বেঁধে একেবারে মনের দূর্বলতম জায়গায়। সত্যি কথা বলতে কি, চোখদুটো ট্যারা না হলেও সুন্দরীদের টেরিয়ে দেখার বেগুনচেরা দৃষ্টিটুকু এখনো ততটা দুর্বল হয়ে পড়েনি। আর পড়েনি বলেই তবু রক্ষে। না হলে বড্ড বেশী বৌ নেওটা হয়ে পড়ার ষোলোআনা চান্স ছিল। তাতে বৌয়ের পায়াই ভারী হতো, আমার পায়ে শেকল পড়তো। তখন খাঁচার পাখির মতো বিলাপ করতে হতো, শকতি নাহি (ফুলে ফুলে) উড়িবার। না তাই বলে অস্থানে কুস্থানে, উড়ে বেড়ানোর মতো বুকের পাটাও সাত বাই সতেরোর বাইলেনে দেখানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাই বলে শুধুই স্ত্রীধনে চোখে সর্ষেফুল দেখতে কে চায় আর!

রমলার সাথে প্রথম আলাপ ওদের বাড়িতে বিয়ের পাত্রী দেখতে গিয়েই। মাসতুতো দাদার জন্যে মেয়ে দেখতে গিয়ে আমার সেই টেড়িয়ে দেখাই কাল হলো। এখন বুঝি দাদার কপালই ভালো ছিল। নয়তো কার বৌ কার ঘরে। খবরটা প্রথম বড়মাসির কাছ থেকেই জানা যায়, কনেপক্ষ পাত্রের মাসতুতো ভাইয়ের সাথেই ঘটকালীতে বেশী আগ্রহী। বলাই বাহুল্য বড়মাসি তাতে বিরাট কিছু আহ্লাদিত হননি সেসময়। নিজের বোনের উপর অভিমানও করতে পারেননি, আবার বোনের কাল্পনিক সৌভাগ্যের কথা মনে করে মনে মনে যে ঈর্ষান্বিত হননি, সেকথাও বলা যায় না জোর করে। যাই হোক সাত বাই সতেরোর বাইলেনের সানাইয়ের ভেঁপুর এই হলো পূর্ব কথা।

তখন বয়স ছিল স্বপ্নীল। বিয়ে করা বৌয়ের সাথে ঘর করার অভিজ্ঞতাও শূন্য। দাম্পত্যসুখের ভ্যালিডিটি যে থাকে ঘরণীর তূণে, সে তথ্যও অজানা। ফলে মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে বলেই মনে হয়েছিল, যদিদং হৃদয়ং মম আউরাতে গিয়ে। পুরুষের পক্ষে পরিণয়ের সূত্র যে কলুর বলদের সমগোত্রীয়, সেকথা স্ত্রীর গোত্ত্রান্তরের সময় কজনেরই বা খেয়াল থাকে! তাই সাত বাই সতেরোর বাইলেনে সেদিন নিজেকে যে শাহজাহান গোত্রীয় মনে হচ্ছিল, তাতে কোনো ভুল নেই।

কিন্তু ভুল ভাঙ্গল অচিরেই। রমলার পায়ের মলের মধুর ধ্বনী যে পরাধীনতার হৃৎকম্প ধরিয়ে দেবে কে জানত! উঠতে রমলা বসতে রমলা। প্রথম প্রথম গর্বের ছাতি বেলুনমুখী হলেও, তা চুপসে যেতে বেশী দেরী হয়নি। ভাগ্গিস শুতেও রমলা ছিল, নয়তো ভারসাম্যের অভাবে স্বভাব খারাপ হলেই পুরুষেরই দোষ! তা এভাবেই শ্রীমতি ভয়ঙ্করীকে নিয়ে মোটামুটি একটা সহাবস্থনের রুটিন চলছিল! কিন্তু ঐ, স্বভাব যায় না মলে, সেই সুন্দরীরমণী দেখলেই দৃষ্টি টেড়িয়ে যায়। আর ওখানেই রমলার যত খবরদারি। কি করে বোঝাই তাকে, ও যে সুন্দর তাই চেয়ে দেখি রুমু, সেকি মোর অপরাধ! তোমাকেও তো একদিন দেখেছিলাম সোনা! সেদিন ছিল না মনে?

না বিষয়টা মেয়েদের কাছে ঠিক মনে রাখা না রাখার বিষয় নয়। ছাদনাতলায় একবার বাগে পেলেই, ঐ যে সাতপাকে বেঁধে ফেলল, আর নিস্তার নেই। তখন আর খেয়াল থাকবে না, প্রথম দেখার দিন থেকে প্রেমে পটানোর যাবতীয় মেশিনারীগুলি একদিন ঠিক কি কি ছিল, স্বামী নামক অধুনা গৃহপালিত নির্জীব জীবটির! বিজ্ঞাপনের চমকে ভুলে জাঁকজমক করে বিয়ে করাটাও যে পুরুষের পক্ষে মেয়েদের রূপের ছটায় চোখ ওল্টানোই, সে কথাই বা কে আর মনে রাখছে? একবার সাতপাকের পাকে পাকে আটকে ফেলতে পারলেই! অর্থাৎ কিনা সেই চান্স ইন আ লাইফটাইম অপুরচুনিটির পর বাড়ির বাইরে বেরুলেই একেবারে ব্রহ্মচর্য্য! মাতৃবৎ পরদারেষু। উফ এক বঙ্কিমী মোক্ষম দাওয়াইতেই বঙ্গীয় প্রেমিককূলের অন্তেষ্টী সারা!

ভুলটা হয়েছিল আমারই, নতুন কেনা মোবাইল হ্যান্ডসেটে শখ করে মৌয়ের ছবিটাকেই দুদিনের জন্যে স্ক্রীনসেভার করাই কাল হল আমার। অতএব দুই আর দুইয়ে চার করতে বঙ্গললনাদের দুমিনিটও লাগার কথা নয়। লাগেওনি। কিন্তু জোর লেগেছিল আমার। জোরসে ঝটকা ধীরেসে লাগা নয়, ঝটকা অ্যায়সা লাগল যে সহাবস্থানের রুটিনের যাবতীয় ফাঁকফোঁকরে নজরদারির ফেবিকল সেঁটে গেল একেবারে, লাইফসেন্টেন্সের মতো। এরপরেরর সব সেন্টেন্সেরই টেন্স একটাই! নঃ ভূত নঃ ভবিষ্যৎ।

তোমার মোবাইলে মৌটুসীর ছবি কেন, সে কথা আমি বুঝি না ভেবেছো? কচি খুকি পাওনি আমাকে। না কচি খুকি আর পাব কি করে? একে তো নাবালিকা বিয়ে করা আইনত অসম্ভব, আহা মনে মনে এখন খুব আফসোসস হয় ঠাকুর্দার বাবার কালে কেন জন্মাইনি? বালিকাবধুর যুগেই সত্যিকারের মধুর বসন্ত আসত মধুর মিলন ঘটাতে। কবি না দেখেই কি আর অমনি লিখেছিলেন! যাই হোক আমাদের মত বিংশশতকীদের তো সে গুড়ে বালি, তাই কচি খুকি আর পাবো কোথায় সোনা? তারপর তোমার জন্মসাল? সেতো দেব নঃ জনান্তি! এযুগে তো ছাদনাতলায় ধারিদেরই দাপাদাপি। না এসব অপ্রিয় সত্য আর কে কানে তুলতে যাচ্ছে! দাম্পত্যের বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে মনে মনে কথা বলায় পারদর্শী হয়ে ওঠার যে কি অ্যাডভান্টেজ সে কথা পীড়িত পতিকুলের প্রতিনিধি মাত্রেই জানেন, তাই নতুন করে আর বলার কিছু নেই।

কিন্তু আমার সেই স্বভাব যায় না মলে। তাই ১৪২০-র চতুর্থ মাসের বিংশতি দিবসে মৌকে মানে মৌটুসীকে প্র্রথম দেখার সেই ম্যাজিক্যাল মোমেন্টসে সেই যে দুই চোখ টেড়িয়ে গেল, সে গেল তো গেলই। আর সোজা হল না। সোজা হবে কি করে, তুমি তো নাম্বার ওয়ান ৪২০! রমলার মুখ নিসৃত বাণী তেড়ে আসে। আর তার তোড়? সে আটাত্তরের বন্যা দেখার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারাই বুঝবেন। একেবারে বাঘে গরুতে এক ঘাটের জল খাইয়ে ছাড়বে, আমি তো কোন ছাড়! না তাই বলে আমারো দুচোখ ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। মৌয়ের সাথে দেখা হবে, আর তার রূপে দৃষ্টি নোঙর ফেলবে না তাই আবার হয় না কি? আর হতে যাবেই বা কেন? আমি তো আর কুরুক্ষেত্রের পিতামহ ভীষ্ম নই রে বাবা। আর ভীষ্মের শরশয্যায় একবার দুই এক পিস মৌটুসীর মতো মেয়েকে এনে দিলে কি হতো কুরুক্ষেত্রের গতি, ব্যাসদেবের কলম সে কথা লিখে যাবার মতো কালি খুঁজে পায়নি নিশ্চয়, সে যুগে। সে না পাক, কিন্তু আমার সদ্য পাক ধরতে থাকা চুলেও যে মধুর বসন্ত আবার উঁকি দেবে না সে কথা হলফ করে বলতে পারি না, মৌটুসীকে দেখার পর।

মৌ, মৌটুসী-রমলারই জ্যাঠতুতো দিদি সুরধ্বনী-র খুড়তুতো ননদ অঙ্গীরা-র মাসতুতো ভাসুর রমাপদ-র পিসতুতো শালী মাধবীলতার একমাত্র কন্যা! রমলার মতে যথেষ্টই নিকট আত্মীয়তার সম্পর্ক! এটাই নাকি ওদের পারিবারিক ঐতিহ্য, আমাদের মতো বাবা মা আর এক আধটা ভাইবোনের ছোট পরিসরের পারিবারিক সংস্কৃতি না কি ওদের নয়! তো রমালার সেই পরম নিকট আত্মীয় মাধবীলতাদিই নাকি কিভাবে রমলার হদিশ বার করেছিলেন, সে কথা তিনিই বলতে পারবেন। মোদ্দা কথা বিয়ের এক যুগ পর এই প্রথম মৌটুসীরা কলকাতায় আসছে মৌকর্তার নতুন চাকুরীর সূত্রে। আজন্ম প্রবাসী এই দম্পতির জন্যে তাই একটা বাসযোগ্য মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগার করে দেবার ভার পড়েছিল সাত বাই সতেরোর রমলাপতির ওপরেই। বলাই বাহুল্য আপন স্ত্রীরত্নের এমন নিকট আত্মীয়তার পারিবারিক ঐতিহ্যের মুন্ডুপাত করতে করতেই আচম্বিতে- মেঘ না চাইতেই জল! ১৪২০র চতুর্থ মাসের বিংশতিতম দিবসে মৌদর্শন!

আমি কবি নই। সাহিত্যিকও নই তাই প্রথম দেখার সেই অনুপম লগ্নের বর্ণনা দেওয়া সাত বাই সতেরোর কানাগলি থেকে সম্ভবই নয়। তাই সে পথও মারাবো না। শুধু বলব রমলার সেই সাত বাই সতেরোর বাইলেনের বিখ্যাত বাণী, নিজের বৌ বাদে সব মেয়েদেরই পরমা সুন্দরী বলে মনে হয়; হয়তো সব বৌ-রাই তাদের স্বামী সম্বন্ধে বলে থাকে। হয়তো ইহাই নারীধর্ম! তা সে রমলা যাই বলুক, নতুন কেনা মোবাইলে মৌয়ের ছবি টাঙানো রমালাপতির চরিত্রের দোষ না নান্দনিক সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ সে বিচারের ভার অন্তর্যামীর হাতেই থাক, আপাতত গৃহযুদ্ধ মোকাবিলা করাই প্রধান সমস্যা- সাত বাই সতেরোর লিচুবাগান বাইলেনে!

রমলার কড়া শাসনে পঁচাত্তরের ইন্দিরা গান্ধীর মুখটা মনে পরে যেতেই পারে, সে যুগের সরকারী কর্মচারীদের স্মৃতিরোমন্থনে! অগত্যা গৃহ শান্তিস্বস্তয়নার্থে মোবাইল পরিষেবা বন্ধ! বন্ধ অন্তর্জালের মায়াবী জগতের অশরীরী চলাফেরা। পুরাকালের রাজাদের সভাকবির মতো তাই আমায় রমলাবন্দনা পরিষেবা চালু করতে হলো আবার নতুন করে। পীড়িত পতিকুলের প্রতিনিধিরা আমার এই টোটকাটি প্রয়োগ করে দেখতে পারেন, ফল হাতে হাতে না পেলেও ঠিক মতো ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারলে বিফল হবেন না আদৌ, এ কথা হলপ করেই বলতে পারি। দাদ হাজা চুলকানির মতোই হয়তো একেবারে নিরাময় সম্ভব নয়, কিন্তু যখন তখন গৃহশান্তিস্বস্তয়নের ব্যাপারে এই টোটকা আপনাকে কখনোই ঠকাবে না! এটা প্রমানিত সত্য। চোখ বুঁজে ভরসা করতে পারেন। আর সুসময় এলে চোখ খুলে দেখতে পাবেন, বন্ধ ফাঁকফোঁকর গুলি আবার সদন্ত্যহাসিতে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে হয়তো!

শ্রীশুভ্র

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…….

“আলো আমার, আলো ওগো, আলোয় ভূবন-ভরা, আলোয় নয়ন- ধোয়া আমার, আলোয় হৃদয়- হরা। নাচে আলো, নাচে ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে—বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে” এত আলো! চারিদিকে! যে আলোর স্রোতে পাল তুলেছে বিশ্বভূবন! যে আলোর সাজে সাজতে ভালোবাসে মানুষের অন্তর্দীপ্ত বিবেক, সভ্যতার সেই ঊষা লগ্ন থেকেই! সেই আলোতেই কি আমরা আমাদের চেতনার সব ঘরদূয়ারগুলো ধুয়ে নিতে চাইনা? মন মননের মাস্তুলে সেই আলোর পাল তুলে ভালোবাসার উজানে কে না চায় পাড়ি দিতে? কিন্তু বাস্তবে কি সত্যিই তাই ঘটে? আমাদের চারপাশের এই চেনা অচেনার জগতসংসারের আটপৌরে জীবনের দৈনন্দিন চৌহদ্দিতে? অন্তত গড়পড়তা হিসেবের চেনা জানা পরিসংখ্যান কি সেই কথাই প্রমাণ করে? নাকি মানুষের ইতিহাস একটু অন্য চিত্রই তুলে ধরে? অনেকেই বলেন আলো অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, শুভ অশুভের দ্বৈরথ আর তার মধ্যেই পথ করে এগিয়ে চলা, চরৈবেতি চরৈবেতি- এটাই জগতসংসারের মূল স্বরূপ। খুবই সত্যি কথা! কিন্তু এগিয়েই চলা তো? নাকি এগনোর তালে তালে তলে তলে আবার সেই শুরুর বলয়েই ফিরে আসা? কোনাো একটি স্থানাঙ্ক কে কেন্দ্র করে যে ঘূর্ণন, তার প্রতিটি মুহূর্ত্তই কিন্তু পূর্ববর্তী ক্ষণ ও স্থানাঙ্ক থেকে ক্রমাগত এগিয়ে চলাই। কিন্তু সমগ্র পথের হিসেব নিলে স্পষ্ট হয়, সে এগনো আসলে কিন্তু আবার সেই শুরুর মুহূর্ত্তেই ফিরে আসা। সভ্যতার চরৈবেতি ঠিক সেই রকম এগনো নয়ত?

যে আলোর কথা বলছেন বিশ্বকবি, সেই আলো যদি সত্যিই আমাদের আপামরের হৃদয়বীণায় বাজত তবে কবির কথাতেই প্রশ্ন করা যায়, আজও ‘বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে’ কাঁদে কেন? কাঁদে যে সে’তো রোজ সকালের প্রভাতী আলোয় প্রভাতী সংবাদে চোখ রাখলেই কান পেতে শোনা যায়। তাহলে কোথাও কি কোনো গন্ডগোল রয়ে যাচ্ছে? তাইতো মনে হয়। একটু ভাবলে বুঝতে পারি, গন্ডগোলটা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে! আমাদের লোভ লালসা ঈর্ষা দ্বেষ ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির উদগ্র তড়ণা আর রক্তের কোষে কোষে হিংসার অনির্বাণ প্রবৃত্তি- আমাদেরই চারদিকে অন্ধকারের যে বলযটি তৈরী করে রাখে; সেই বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না চৈতন্যের আলো! মানব সভ্যতার এইটিই নিদারুণ অভিশাপ! এবং মানুষের ইতিহাস মূলত এই অন্ধকার বলয় থেকেই উত্তরণের প্রাণান্তকর প্রয়াসের ইতিহাস। এই অভিশাপ মুক্তির দূর্বার স্বপ্নের ইতিহাস। কিন্তু তবু কি সফল হয় সেই প্রয়াস? সার্থক হয় হয় আলোর স্বপ্ন? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন জনপদ, বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন যূগে সেই সাফল্যকেই পাখির চোখ করে এগনোর প্রয়াস করে চলেছে। কিন্তু চললেও আজও কত অন্ধকার ক্রমাগত ঘিরে ধরে আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে। আর তখনই প্রশ্ন জাগে তাহলে কি আমরা আসলেই এগনোর পথ ধরে চলতে চলতে আসলে সেই একই অন্ধকারকে প্রদক্ষিণ করে চলছিনা?

চলছিই তো। চলছে বলেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেও হাজার হাজার যুদ্ধ সংঘঠিত করেও আজও ধর্ম সংস্থাপন অধরাই রয়ে গেল। হাল আমলের দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ- যা নাকি অশুভ শক্তির পরাজয়ে শুভ শক্তির জয় বলে ইতিহাস বন্দিত, সেও ধর্ম সংস্থাপনে ব্যার্থ পুরোপুরি। মানুষের যূদ্ধ আজ অব্দি ক্ষমতার হাতবদলের যুদ্ধ, ধর্ম স্থাপনের যুদ্ধ নয়! মারণাস্ত্রের ব্যবহারে ধর্ম স্থাপন অসম্ভব। বস্তুত মারণাস্ত্রই অধর্মের প্রমাণ। তাই দিয়ে কি করে সম্ভব ধর্ম প্রতিষ্ঠা? তাই কুরুক্ষেত্রও ব্যর্থ- অন্ধকারের বলয়ে চৈতন্যের আলো প্রজ্জ্বলনে। ব্যর্থ কারণ আমাদের চরৈবতি মূলত একটি ঘূর্ণন প্রক্রিয়া মাত্র। তা আমাদের কোনো ভিন্নতর স্তরে বা নতূনতর ভূবনে পৌঁছিয়ে দিতে পারে না। কেননা আমরা আজও লোভ লালসা ঈর্ষা দ্বেষ জনিত ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির উদগ্র সেই তারণা আর আমাদের রক্তের অন্তর্গত হিংসার অনির্বাণ প্রবৃত্তির কবল থেকে আমাদের নিজেদেরকেই মুক্ত করতে পারিনি। পারিনি বলেই আমাদের চারপাশের এত নিত্যনতুন অন্ধকারের নীরেট বলয় আমাদের চৈতন্যের শুভ আলোকে বিকশিত হতে দেয় না!

আর তখনই মাথা তুলে দাঁড়ায় অন্ধকারের বিষাক্ত ফণা! তার বিষাক্ত ছোবলে যত্রতত্র নিরবে নিভৃতে কাঁদতে থাকে বিচারের বাণী তার নির্বাক অভিমান নিয়ে। বৈষম্য শোষণ অত্যাচার নিপীরণ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে দূর্বলের জীবন। আর বিভেদের মন্ত্র আউড়িয়ে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে মিথ্যার জাল বিছিয়ে অপপ্রচারের দুন্দুভি বাজিয়ে অন্ধকারের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে যাবতীয় অশুভ শক্তি, অশুভ আঁতাতের হাত ধরে। এটাই তো এই পৃথিবীর শাশ্বত ইতিহাস! মানুষের অতীত। মানুষের বর্তমান। আর ভবিষ্যতের মলিন দিশা। অন্ধকারের এই যে ভয়াবহ আরতি, তা আমাদের ঘরসংসার সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস সর্বত্রই প্রতিদিনের সত্যি! যে সত্যি’র ভয়াবহ চিত্র শিহরিত করে তুলবে যে কোনো শুভবোধ জাগ্রত মানুষের বিবেককে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর অবস্থান, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্র্যের অবস্থান, একমেরু বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বের অবস্থান; সেই সব সত্যিরই এক একটি ভয়াবহ চিত্র! যা আমাদের কেবলই ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর করে তোলে। আর ঠিক সেই প্রেক্ষিতেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমরা, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীতেই গুছিয়ে নিতে চাই নিজেদের আশু ভবিষ্যৎ! অন্ধকারের মূল বীজটি ঠিক এইখানেই বপন করতে থাকি আমরা, হয়ত নিজের অজান্তেই! আর তাই আমাদের যে এগিয়ে চলার কথা ক্রমাগত সামনের দিকে- স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর আলের অভিমুখে; সেই চলা কার্যত কেবলই ঘুরতে থাকে ঐ অন্ধকারের বীজটুকুকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে। তাই আলো অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, শুভ অশুভের দ্বৈরথের মধ্যে দিয়ে যে চরৈবেতি- এগিয়ে চলা; বস্তুত তা আমাদের কোনো আলোর জগতে পৌঁছিয়ে দিতে পারে না আদৌ।

তাইতো বিশ্বকবি মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দেওয়ার জন্যে প্রার্থনা করে বলেন, ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলোর ঢাকা ধুইয়ে দাও’। এই ধুলোর ঢাকাই সেই অন্ধকার যা আমাদের এগিয়ে চলাকে কেবলই অন্ধকারেরই চারপাশে আবর্তিত করতে থাকে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় একটিই। যার সূত্র দিয়ে গিয়েছিলেন সর্বপ্রথম স্বয়ং বুদ্ধদেব; মৃত্যর পূর্বে প্রিয় শিষ্যদের বলে গিয়ে ছিলেন- “আত্মদীপভব” আর তাইতো বিশ্বকবি গাইলেন, ‘যে যন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে, আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপাল এই অরুণ আলোর সোনার কাঠি ছুইয়ে দাও’। কবির কথায়, আমাদের পরাণ-বীণায় যে অমৃতগান ঘুমিয়ে আছে, যার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান; তাকেই আলোকের এই ঝর্ণাধারার আনন্দে জাগিয়ে তুলতে হবে। হয়তো তবেই আর গোলক ধাঁধার আবর্তে নয়, আমাদের এগিয়ে চলা সত্যই সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়া হবে।

কিন্তু কি ভাবে সম্ভব এইভাবে জাগিয়ে তোলা? কি ভাবে সম্ভব বুদ্ধদেব কথিত ‘আত্মদীপভব’ হয়ে ওঠা! পথ কিন্তু একটিই! আর সেটি হল মানুষ গড়ে তোলার প্রকৃত যে শিক্ষা, সেই শিক্ষা বিস্তারকে করে তুলতে হবে সর্বব্যাপী। যে কাজে আজও হাত দেওয়াই হয়নি! সেই কাজটির সার্থকতার সাথে সাথেই মানুষের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত আলোর অভিসারে সমাজ সংসারে বদলাতে থাকবে নারীর অবস্থান। ছিন্ন হতে থাকবে দারিদ্র্যের অভিশাপ। আর তখনই একমাত্র সম্ভব প্রকৃত আলোর অভিমুখে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সর্বজনীন অগ্রসরণ! যে অভিমুখ হিংসা দ্বেষ লোভ লালসা ঈর্ষা ও ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির বিপরীত অবস্থানে মুক্তি দেবে আমাদেরকে, সমস্ত অন্ধকার থেকে। আর তখন ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধ বলে মিথ্যা প্রচারের দুন্দুভি বাজানো সম্ভব হবে না। ধর্ম সংস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হবে না কোনো কুরুক্ষেত্রের। আর সেইদিনই বেজে উঠবে ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’। আমরা সবাই মিলে নিঃসংশয়ে বলতে পারব, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে…..’

শ্রীশুভ্র

যৌনতার পরিসর

নরনারীর যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলাপ আলোচনার চর্চার পরিসরটিই আমাদের সমাজে আজও গড়ে ওঠেনি। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরেই এই বিষয়টিকে আমরা সঙ্গপনে বহুজনের আড়ালে নিভৃত নিরালায় গুপ্ত রাখতেই অধিকতর স্বচ্ছন্দ। আর সেই নিভৃত গঙ্ডীর বাইরে বেড়িয়ে এড়লেই গেল গেল রবে আমরা কোলাহল করি সমাজ রসাতলে গেল বলে। কিন্তু কেন এই লুকোচুরি মানসিকতা? কেন এইভাবে অনিবার্য একটি প্রবৃত্তিকে সব কিছু থেকে আড়াল করতে হবে? শুধু তো অনিবার্যই নয়, বিশ্ব জগতের মূল চালিকা শক্তিইতো যৌন উদ্দীপনা। যেটা না থাকলেই সৃষ্টি হয়ে যেতো মরূভুমি। সেটা জেনেও জীবনের মূল বিষয়টিকেই সব কিছুর তলায় চাপা দিয়ে আড়াল করার এই মন মানসিকতাই কি সভ্যতার মূল আভিশাপ?

আধুনিক সভ্যতাকে বুঝতে হবে, যৌন প্রবৃত্তিকে যত বেশি করে দিনের আলো থেকে দূরে লুকিয়ে রাখা যায় তত বেশি করে একটি সুন্দর প্রবৃত্তি অসুন্দরের অভিমুখে বদলে যেতে থাকে। এখন আমাদের দেখতে হবে সেই অমঙ্গল থেকে আমরা নরনারীর যৌনতাকে রক্ষা করবো কি করে। আসলে নারী পুরুষের যৌনতাকে আমরা যখনই শুধু মাত্র সন্তান উৎপাদনের পদ্ধতি হিসাবে দেখি, তখনই বিষয়টি নিতান্তই জৈবিক একটি প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়ে যায় শুধু। যে প্রক্রিয়া সকল জীবজগতের মূল বৈশিষ্ট। কিন্তু সেই মূল বৈশিষ্ট মানুষের ক্ষেত্রে এসে নতুন একটি পরিসর পেয়ে যায়। যে পরিসর জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতির ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না কোন ভাবেই। যৌনতা যখন কেবলই সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া, তখন যৌন সংসর্গের আগে পরে পরস্পর বিপরীত লিঙ্গের দুটি সত্ত্বা যে যেখানে যেমন ছিল, সেখানেই রয়ে যায়। তাদের মধ্যে সত্ত্বাগত কোন মিলনই সম্ভব হয় না। দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই একই সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। যেখানে রতিক্রিয়ার আগে পরেও যে যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে যায় সে। ঘটে না কোন সত্ত্বাগত মিলন। নিতান্তই জৈবিক একটি প্রক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে নিয়মিত যৌন সংসর্গ।

আর এই ঘটনা সম্ভব হয় তখনই যখন যৌনতা কেবল শারীরীক একটি বাহ্যিক প্রক্রিয়ার নামান্তর। যার মূল উদ্দেশ্যই সন্তান উৎপাদন। জীবজগতে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে সবচেয়ে পরে। আগের সকল পর্ব থেকে সকল দিক থেকেই এই বিবর্তন অভিনব সন্দেহ নাই। সেই বিবর্তনের প্রায় প্রতিটি ধারাতেই জীব জগতের অন্যান্য সকল প্রজাতির থেকেই মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে গিয়েছে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য। আর সেইটা হলো মানুষের অনুভব শক্তি। যা থেকে জন্ম নেয় উপলব্ধির দিগন্ত। যে দিগন্ত জন্ম দেয় বিশ্লেষণী শক্তির। আর এইখানেই প্রকৃতিতে মানুষই অভিনব। অনেকেই বলতে পারেন, অবশ্যই। আর ঠিক সেই কারণেই তো জীবজগতের সকল প্রজাতির ক্ষেত্রে যৌনতা দিনের আলোর মতো খোলামোলা হলেও মানুষের বেলায় তাকে নিভৃত নিরালায় একান্ত অনুভবে পেতে হয়। আর ঠিক সেই কারণেই যৌনতার চর্চাটি জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মতো প্রকাশ্যে সংঘঠিত হওয়ার নয়। এইখানেই মানুষের বৈশিষ্ট। যা তাকে জীবজগতের সকল প্রজাতি থেকে উন্নত করে তুলেছে।

না বিষয়টি আবার ঠিক এইরকম একরৈখিকও নয়। নারী পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত রতিক্রিয়ার নিভৃত নিরালা নির্জন বাসরের প্রয়োজন নিয়ে বিতর্ক নেই। বিতর্ক আমাদের চিন্তা চেতনায় মন মননে জীবনের উদযাপনে যৌনতা নিয়ে যে রাখঢাক আড়াল অবডাল চাপা স্বরে আকারে ইঙ্গিতে ইশারার আয়োজন, সেইটির উপযোগিতা নিয়েই। যে বিষয়টি এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে, সেটিকে এড়িয়ে চলার মানেই মরুভুমির চর্চা করা; সেই বিষয়টি নিয়েই এমন একটা ভাব করা যেন ওটিই সভ্যতার অন্তরায়। ওটিকে আড়ালে লুকিয়ে রাখলেই সমাজ সংসারের একমাত্র মঙ্গল।

বস্তুত নরনারীর যৌনতা নিয়ে চর্চার পরিসরটি যত বদ্ধ থাকবে ততই পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নটি দূর্বল হয়ে ওঠে। সেটাই স্বাভাবিক। যৌনতা চর্চার অভাবেই যৌন মিলনের মাধুর্য্য থেকে বঞ্চিত হয় অধিকাংশ মানুষ। একটি সম্পূর্ণ সত্ত্বাগত মিলন প্রক্রিয়া পর্যবসিত হয় শারীরীক মিলনে। এই যে শরীর সর্বস্বতা, এইখানেই মানুষ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট হারিয় ফেলে নিতান্তই জৈবিক হয়ে ওঠে। আর সেইটা হয় যৌনতার সঠিক চর্চার পরিসরটিকে অবরুদ্ধ রাখার জন্যেই।

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন

অরুণ যে আমার বিশেষ নিকট বন্ধু তা নয়! তবে একেবারেই আলগা বন্ধুত্বও নয়! তাই ওর বিবাহে বরযাত্রীর যাওয়ার নিমন্ত্রণ না পেলেও বৌভাতে যাবার অনুরোধ এড়াতে পারিনি! কিন্তু মুশকিল হল কি দেওয়া যায় উপহার হিসেবে? যেটাই ভাবি সেটাই বড়ো খেলো মনে হয়! সাধারণ কেরানীপকেটের চৌহদ্দীতে যা হয় আর কি! যদিও উপহার যা দেব তা দেব ঐ অরুণের বৌকেই! পাক্কা ব্যবসায়ী অরুণ সামান্য তুচ্ছ উপহার নিয়ে মাথা ঘামাবে না জানি তবু ন্যূনতম ভদ্রতা রক্ষার দায় তো থাকেই! যদিও জানি অরুণের সাথে ওর ব্যবসায়ে লাভজনক কোনো বড়ো পার্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে খুশি করা যেত ওকে! কিন্তু আমি ছাপোষা মানুষ, আদার ব্যাপারীও নই! এটা তেমন উপলক্ষও নয়!

তবে সুকন্যা থাকলে আজ আমায় এত ভাবতে হতো না! কোথায় কোনটা মানানসইসেটা বুঝবার একটা দারুণ ক্ষমতা ছিল ওর! রুচিশীল একটা মনের তন্বী মেয়ে! ডানাকাটা পরী নয়, কিন্তু অপরূপ একটা দ্যুতি ছিল টানা দুটি চোখে! দৃষ্টির সেই গভীরতায় ছিল আত্ম প্রত্যয়ের দীপ্তি! আর ছিল কাব্য প্রীতি! নিজে লিখত না! কিন্তু ভালো কবিতার কদর জানতো! ইউনিভার্সিটির তুখর ছাত্রী! ইংরেজী সাহিত্যের বর্ষসেরা! সাহিত্য আমার বিষয় নয়! তবু সুকন্যাই আমাকে সুসাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়! সেই থেকে আমারও কবিতা প্রীতি! সুকন্যা প্রেম! কবিতার মধ্যেই শ্বাস নিত যেন মনে হতো! আস্তে আস্তে আমাকেও ডোবালো ওতেই! ব্রাউনিঙের কবিতা ছিল ওর খুব প্রিয়! খুব আবৃত্তি করতো!

সুকন্যার আবৃত্তি যে খুব উচ্চমানের ছিল তা হয়তো নয়! কিন্তু ওর মুখচোখের দীপ্তি বলার ছন্দ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো আমায়! তার কারণ যতটা কাব্য প্রেম ততটাই ওর প্রতি আমার দূর্বলতা! এই ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালী দিনগুলোও একদিন স্মৃতির সরণীতে ঢুকে গেল! জীবিকার সন্ধানে কে কোথায় ছিটকে গেলাম! সুকন্যাও উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য বাইরে চলে গেল! কিন্তু গেলেও যোগাযোগ যে রাখা যেত না তা হয়তো নয়! হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন সুকন্যা আর আমার মতো সাধারণ মানুষের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করেনি বলেই ধীরে ধীরে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল আরও! ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিক ছন্দে ঘটে গিয়েছিল যে বুঝতেই পারিনি কখন সুকন্যা সরে গেছে দূরে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি এভাবেই মানুষের জীবনে কতো সহজেই যেন স্মৃতি হয়ে যায় একদিন! রোজকার বন্ধুদের, যাদের ছাড়া একদিনও চলে না, কালের গতিতে তারাও কোথায় হারিয়ে যায়! কিন্তু সুকন্যা! সেতো শুধুই বন্ধু ছিল না! তাকে ঘিরে ভবিষ্যৎ জীবনের সপ্নাভ আশার বিস্তার ছিল প্রতিদিনের শাখা প্রশাখায়! তবু সেও তো দূরে সড়িয়ে নিল নিজেকে! তবু এত দিন পরে আজ তাকেই মনে পড়ছে বড়ো বেশি করে! এই আগোছালো জীবন হয়ত আর আগোছালো থাকতনা! সামান্য একটা উপহার নির্বচন করতে কি বেহাল দশা আজ! এই সবই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল ওকে বলেছিলাম ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন উপহার দেব ওর জন্মদিনে! মহালয়ার দিন! দেবীপক্ষের সূচনায়! কিন্তু সে আর দেওয়া হল কই!

সত্যি সুকন্যাকে উপহারটা আর দেওয়ার সুযোগ ঘটেনি! এতদিন পর সেকথা মনে হতেই মনটা বড়ো বিষন্ন হয়ে গেল! মনে পড়ে গেল ব্রাউনিঙের দ্য লাস্ট রাইড টুগেদারের কথা! সুকন্যার আবৃত্তির সাথে আমিও গলা মেলাতাম কখনো সখনো! আসলে ব্রাউনিঙের মধ্যে যে দুরন্ত প্যাশানের সুতীব্র প্রকাশ ছিল, সেটা আমাদের উন্মন করে তুলত প্রথম যৌবনের তরুণ দিনে! হঠাৎ মনে হল, অরুণের বৌভাতে ব্রাউনিঙের সংকলন দিলে কেমন হয়? যদিও অরুণের জীবনে প্রফিট এণ্ড লসের ব্যালেন্স শীট ছাড়া অন্য কোনো কাগজের গুরত্ব নেই বিশেষ! তবে ওর বৌ হয়তো সাহিত্যপ্রেমী হতেও পারে! ওদের নবজীবনের শুভারম্ভ ব্রাউনিঙের রোমান্টিকতায় ভরপুর হয়ে উঠুক না কেন দাম্পত্যের প্রতিদিনের বাসরে!

অরুণদের পয়সা বুঝি মেঝেতে গড়াগড়ি যায়! এমন এলাহী ব্যাপার আগে কোনো বৌভাতে দেখিনি কখনো! গেটের সামনে দেশী বিদেশী কত রঙের ছোট বড়ো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে! আমন্ত্রীতদের পয়সার আভিজত্য পোশাকের গন্ধেই স্পষ্ট বোঝা যায়! এই রকম ধনদৌলতের ঐশ্বের্য্যের মাঝে নিজের কেরাণী গন্ধওয়ালা অস্তিত্বটা নিয়ে, একটা ব্রাউনিঙের কবিতার বই সম্বল করে ঢুকতে বড়ই সঙ্কোচ হচ্ছিল! নিজেকে এত অসহায় মনে হচ্ছিল যে ভাবছিলাম ফিরে যাব কিনা! অন্তত আসার জন্য বড়ই মর্মপীড়া অনুভব করছিলাম!

অরুণ বোধহয় কাউকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিল! আমায় দেখতে পেয়েই সহাস্যে এগিয়ে এলো! সাথে নিয়ে ভেতরে গেল! কিন্তু আমার সাথে কথা বলার অবসর নেই! আমায় বসিয়ে আবার কার সাথে চলে গেল বাইরে! আমি একা জড়সড় বসে হয়ে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছিল্লাম! এই ধনৈশ্বর্য্যের বৈভবের মাঝে নিজেকে খুবই অপাঙতেয় লাগছিল! বেশ অনেক্ষণ পরেই অরুণের আবার আমার ওপর নজর পড়ল! আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! নিজের অস্বস্তিতে বেশ হাঁফিয়ে উঠছিলাম! অরুণ নিজেই আমায় নিয়ে দোতলায় উঠল! নববধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে! আমাকেও উপহারটা দিতে হবে! নববধুকে ঘিরে স্বভাবতই অপরূপা মায়াবিনী সুন্দরীদের ভিড়! উৎসবের আনন্দে উৎসাহিত মুখগুলির কলধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ!

আগেও দেখেছি এইরকম বিবাহ অনুষ্ঠানে সাজসজ্জার ভিড়ে নববধুটি যে কে তা বুঝে উঠতে কয়েক সেকেণ্ড দেরি হয়ে যায়! নববধু হয়তো কারুর সাথে গল্পই করছিলেন! এইরকম বৈভবে উচ্চবিত্ত সমাজের সুসজ্জিত বেশভুষার ঝাঁচকচকে মানুষজনের মধ্যে আমি এতই বেমানান যে, সঙ্কোচ আর লজ্জা আমায় পীড়া দিতে থাকল! কিন্তু আসরে নেমে পড়েছি, আর ভাবা চলে না! মুখে একটা কৃত্রিম কষ্টকলপিত হাসি টেনে এগোলাম! এই অবস্থায় নিজেকে আয়নায় কেমন দেখাতো ভেবে সত্যিই হাসি পেল! সেই নিদারুণ হাসি মুখেই নববধুর নিকটবর্তী হলাম! অরুণ ওর বৌয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে উদ্যত হল! অরুণের ডাকে ওর নব পরিণীতা বধু আমাদের দিকে ফিরতেই মুখে হাসি ঝুলিয়ে উপহারটি দিতে হাত বাড়ালাম!

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যে উপহার একদিন সুকন্যার জন্মদিনে ওর হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল, আজ অরুনের বৌভাতে সেইউপহার তার বৌয়ের হাতে তুলে দিতে এসেছি! অরুণের গর্বিত হাসির লহড়াতেই দৃষ্টিবিনিময় হল নববধুর সাথে! আর তখনই বেনারসী আর স্বর্ণালঙ্কারের সজ্জায় সুকন্যাকে দেখে চমকে ওঠার পালা আমারই! কিন্তু সুকন্যা ওর, আমায় চেনার চমকটাকে কি অদ্ভুত সহজভাবেই না মনভোলানো হাসিতে ঢেকে দিলো! আরও আশ্চর্য ওর ঐ অভিজাত হাসির উপরেই ভর করে আমিও কত সহজেই সামলে নিলাম নিজেকে! তুলে দিলাম ওরই হাতে আমার ক্ষুদ্র উপহার ওর প্রিয় ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যেখান থেকে একদিন আবৃত্তি করতাম আমরা দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার!

শ্রীশুভ্র

দেওয়াল

সব রোদ সাঁতরিয়ে
আরও নতুন রোদের পটভূমি তৈরী হবে বলে
প্রস্তুত রেখেছি ধর্মগ্রন্থ সব
যারা বলেছিল সব কথা বলা হয়ে গেছে
যারা জেনে গেছে শেষ সত্যের স্বাদ
যারা ভেবে গিয়ে ছিল
আর কিছু নাই দেখে নেওয়ার
তাদের মতো নয় আমার দেওয়াল

সব রোদের ভিতরে
আরও নতুন রোদের আলো ফুটে উঠবে বলে
আজ আর কোন বাণী নয়
সব অক্ষরের পিরামিড ভেঙ্গে
সব শব্দের শিকল কেটে
সব প্রচারের মুখে তুড়ি মেরে
প্রথম দিনের মানুষের মতো
আজ পরিষ্কার আমার দেওয়াল

সব রোদের শেষে
আরও নতুন রোদের কাছে ঋণী হব বলে
নতজানু আমার হৃদয়
এখানে কোন কিছুই্ব স্বতঃসিদ্ধ নয়
এখানে প্রশ্নবিদ্ধ সকল সময়
এখানে যুক্তি তর্ক বোধ খেলা করুক
সকাল বিকাল মহা সাগরের ঢেউয়ের মতো
সজীব থাকুক আমার দেওয়াল

——শ্রীশুভ্র

হারজিৎ

এই শহরে বদলি হয়ে আসার পর আলাপ হলো অফিসের বড়বাবুর সাথে! ওনার সাথে আলাপটা ধীরে ধীরে বেশ জমে উঠল! ওনার অন্তঃকরণটা বেশ নির্মল! অফিসের কুটিল রাজনীতির বাইরেই থেকে গিয়েছেন বুঝলাম! আশ্চর্যও লাগল খুব! ক্ষমতা আছে বলতে হয়! দেখলাম চারিদিকের স্বার্থপরতার বেড়াজালের মধ্যে ভদ্রলোকের সাথে দু-দণ্ড কথা বলে একটা নির্মল তৃপ্তি পাওয়া যায়! নতুন জায়গায় বিদেশ বিভুঁইয়ে এরকম মানুষের সঙ্গ ভরসা জোগায়! বন্ধুত্ব জমে উঠতেই সেই খাতিরে অনেকদিন ধরেই ওনার বাড়িতে একদিন বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছিলেন! শহরের অন্য প্রান্তে বেশ নাকি একটা ছোটো বাড়ি বানিয়েছেন! দেশের বাড়িও বেশি দূরে নয়! জমি জমাও কিছু আছে!

যাব যাব করেও শেষ পর্য্যন্ত আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি! নিজেরই তাগিদের অভাব! আসলে বড়োই কুঁড়ে মানুষ আমি! অফিস আর বাসার বাইরে আর কোথাও বিশেষ যাওয়া হয়ে ওঠে না! তারপর একলা মানুষের পক্ষে সময়ের অভাবটাও একটা অন্যতম অজুহাত! যদিও বুঝতে পারি আমার প্রতি ওনারও একটা আন্তরিক টান জন্মেছে! এটাই হয়ত হয়! মনের নিভৃতে আমরা প্রত্যেকেই নির্মল বন্ধুত্বের আকাঙ্খা বয়ে বেড়াই! তাই যার সাথে মনের খানিকটা মেলে, তাকে কাছে টানতে চাই আন্তরিক ভাবেই! যাই হোক গত কদিন ধরেই ভদ্রলোক প্রায় একরকম জোর করেই ওনার বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য আমায় বলে রেখেছিলেন! অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেড়ানো গেল! ওনার স্কুটারেই প্রায় আধঘণ্টা লাগল ওনার বাড়ি পৌঁছাতে!

শহরের একেবারে উল্টো দিকে রেল লাইন পেড়িয়ে ওনাদের অঞ্চল! পাড়াটি বেশ অভিজাত বলেই মনে হল! সাজানো গোছানো ডিজাইনার বাড়িগুলি দেখলেই বাসিন্দাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা পরিস্কার বোঝা যায়! পীচ রাস্তা ছেড়ে বেশ চওড়া কংক্রিটের বাঁধানো গলি ধরে এগোলেই ডান দিকে খান তিনেক বাড়ি পড়েই ওনার আবাস! উচুঁ পাঁচিল ঘেরা চওড়া গেট! গেটের দুধারে ব্যুগোনভিলার ঝাড়! প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে যায়! বেশ বাংলো ধাঁচের, গোলাপী রঙের বাড়ি! ছোট্ট কিন্তু নয়নাভিরাম! বাড়ির সামনে বাঁধানো চত্বরের দুই ধারে নানান ধরনের হরেক রঙের মরশুমি ফুল! খুবই মনোরম পরিবেশ! শ্যামলিমায় ঘেরা একটুখানি বাসা! পিছনের দিকে ছোটো একটা সবজী বাগানও আছে!

বল্লাম –বাঃ খুবই সুন্দর । খুব ভালো লাগছে এসে! আপনার রুচিরও প্রশংসা করতে হয়! সুন্দর একটা শান্তিকুঞ্জ তৈরী করেছেন!

-বলছেন তাহলে? মুখে একটা অনাবিল হাসি ফুটিয়ে বল্লেন রমেনবাবু, এসব পরিকল্পনা আমার মাথায় আসত নাকি? সব প্ল্যান যা দেখছেন সব আমার স্ত্রীর! আরে মশাই আমি চিরকালই আগোছালো মানুষ! বিয়ের পর ওর হাতে পড়ে এখন তো অনেক ভদ্রস্থ হয়েছি! আমি শুধু উপার্জন করেই খালাস তার পর সব ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মত পরম নিশ্চিন্ত আছি মশাই! বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন নতুন অফিসের বড়বাবু রমেন্দ্রনাথ মিত্র!

রমেনবাবুর প্রাণখোলা হাসিতে আমার অনেকদিনের পুরানো চাপা দীর্ঘশ্বাসটা হঠাৎই বেrরোতে গিয়েও যেন আবার চাপা পড়ে গেল!

সত্যিই তো এমন পরিপূর্ণ জীবন মানুষকে এত প্রাণবন্ত করে তুলবেই! রমেনবাবুর প্রাণখোলা নির্মল অন্তঃকরণের পেছনে তবে নারীর প্রেরণা ও সাহচর্যের সচেতন যত্ন বর্তমান! আমরা বারান্দায় উঠতেই ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এসে রমেনবাবুর কন্যা বোধহয় রোজকার অভ্যাস মতোই এক লাফে বাবার কোলে উঠে পড়ল! সদ্য ফোটা একটা ফুল যেন! ফুটফুটে পরীর মতন রূপ! কতই বা আর বয়স হবে! বড়জোড় চার কি পাঁচ! চোখে মুখে রমেনবাবুর মতোই প্রফুল্লতা! এই সাজানো সুন্দর বাড়ি, রমেনবাবুর মতো অমায়িক মানুষ, এই কচি কিশলয় শিশু তার একরাশ আনন্দ নিয়ে; যেন বিভিন্ন যন্ত্রীর হাতে একটাই আনন্দের মঙ্গলধ্বনি মুর্ত্ত হয়ে উঠেছে!

মেয়েকে আদর করে কোল থেকে নামিয়ে মাকে ডাকতে বলতেই রমেনবাবুর শিশুকন্যা মিষ্টি কচি কণ্ঠে – মা দেখো বাপি এসেছে বলেই ভেতরে একছুট! রমেনবাবুও আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন! যে ঘরটায় ঢুকলাম স্বভাবতঃই সেটি বসার ঘর! খুব বড় নয়! ঘরটা ছোটোই, কিন্তু এমন সুন্দর করে সাজানো যে একবার ঢুকলে আর চট করে বেরোতে ইচ্ছে করবে না! অফিস থেকে এতটা পথ এসে এইরকম একটা ঘরে আসলে ক্লান্তি উপশম হতেই হবে!
-আপনার বাড়িটা কিন্তু বড়ই ভালো লেগে গেল! ঘরে বাইরে সর্বত্রই সুন্দর একটা শান্তি বিরাজ করছে!
আমার প্রশংসার উত্তরে উনি আবার সেই তৃপ্তির হাসিটা হাসলেন; -যা দেখছেন সব কৃতিত্ব কিন্তু ওরই! বুঝলাম ভদ্রলোক স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসেন!

-সত্যি আপনার সৌভাগ্যে কিন্তু ঈর্ষা হওয়া উচিত! মজা করে হাসতে হাসতে বল্লাম বটে, কিন্তু মনের অতলে যে দীর্ঘশ্বাসটা চাপা পড়ল তার পরিসরে যে সামান্যও ঈর্ষার বাষ্প ছিল না, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না!
-আরে মশাই সেটাই তো আমার গর্ব!
বলেই আবার প্রাণখোলা হাসিতে মেতে উঠলেন! হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হাত মুখ ধোবেন নাকি? জলটলের কিন্তু কোনো অভাব নাই!
অসম্মতি জানিয়ে বল্লাম বাড়ি ফিরে একবারে চান করে নেব ওটাই আমার বরাবরের অভ্যাস!
-আরে সেটাতো এখানেই সেরে নিতে পারেন!
ওনাকে কোনোক্রমে নিরস্ত করি! কিন্তু ভদ্রলোকের এই নিপাট আন্তরিকতায় ওঁর এই আলোকিত মনের পরিসরে সত্যিই একটা আত্মিক টান অনুভব করতে থাকলাম!

-ওঃ ওই তো ও এসে গেছে, এসো আলাপ করিয়ে দিই!
ভদ্রলোকের এই নির্মল শুদ্ধ অন্তঃকরণের সানন্দ প্রভায় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম বোধহয়! সম্বিত ফিরল ওঁর কণ্ঠস্বরে! আর তখনই ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ফেরাতেই প্রচণ্ড চমকে উঠলাম!
-যুথী তুমি?
আমার অজান্তেই যেন মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল যুথিকার নামটা!
এবার অবাক হওয়ার পালা রমেনবাবুর!
ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে একবার আমার দিকে আর একবার যুথিকার দিকে চাইতে থাকেন!
ওদিকে যুথীও স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে!
এতটাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে যে, যাকে এক কথায় বলা যায় হতবাক হয়ে যাওয়া!
আমারও অবস্থা তথৈবচ!
যুথী? এতদিন বাদে! এভাবে আমাদের দেখা হয়ে যাবে আবার, সে কথা কি অন্তর্যামীও জানতেন? মনে হয় না!

প্রায় একমিনিটের স্তম্ভিত নীরবতা ভাঙল রমেনবাবুরই প্রশ্নে! ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে তিনি বিস্মিত হয়েই আমায় জিজ্ঞাসা করেন,
-কি ব্যাপার বলুনতো আপনি ওকে চেনেন নাকি?
চিনি যে সে তো আমার মুখে যুথীর নাম শুনেই বোঝার কথা! বিস্মিত রমেনবাবুকে ঘাড় নেড়েই আশ্বস্ত করি!
নিজের স্ত্রীর কাছেও ভদ্রলোক জানতে চান একই কথা!
যুথিকা কিছু বলল না!
ওর সেই বিখ্যাত ঠোঁট চাপা হাসিতে বাঁ গালে সামান্য টোল পড়ল!
এটাই ওর স্বভাব! অধিক আনন্দ উত্তেজনায় ও কোনোদিনো বেশি কথা বলে না! ঐ হাসিই ওর ট্রেডমার্ক! বুঝলাম এতদিন বাদে এভাবে আচমকা আমায় দেখে ও ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত! কিন্তু যারা ওকে জানে না তার টেরও পাবে না! রমেনবাবু নিশ্চয় বুঝেছেন!

এবার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা রমেনবাবুর! তাঁর বিস্ময় বাড়ল বই কমলো না!
তিনি একবার আমার দিকে আর একবার যুথিকার দিকে তাকান! যুথীই তখন রমেনবাবুকে বলল,
-আগে বলবে তো?
– আগে বলবো? কি আগে বলব?
-কি আবার, তুমি যে ওকে আনবে সে কথা বলোনি তো? সামান্য হেসে উত্তর দেয় যুথিকা!
-হ্যাঁ সে তো তোমায় বলেই গিয়েছিলাম! রমেনবাবুর সোজো উত্তর!
-অফিসের এক নতুন কলিগ বেড়াতে আসবেন, এর বেশি কিছু বলেছিলে নাকি?
অনেকটাই সপ্রতিভ হয়ে ওঠে যুথী! এও ওর মস্তবড়ো গুণ! যে কোনো পরিস্থিতিকে সহজে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে!
বুঝলাম রমেনবাবু এখনও অথৈজলে! ওনাকে ধরে পাশে বসাই! যুথিকাও সমনের সোফায় এসে বসে!মুখে সেই বাঁ গালে আলতো টোল পড়া হাসি!

রমেনবাবুর একরাশ বিস্ময় মাখা বড়ো বড়ো চোখদুটির দিকে তাকিয়ে, আমি যে কে সেটা বলতে গিয়েও সামলিয়ে নিলাম! যুথীর দিকে তাকালাম! রমেনবাবুকে এতদিন অন্ধকারে রেখেছে কিনা সেটা না জেনে…
আমার সাথে চোখাচোখি হতেই, আমার মনের কথা পড়ে নিতে দেরি হয় না যুথিকার! হেসে রমেনবাবুকে দেখিয়ে বলল, -ও সব জানে!
-কি? কি জানি?
রমেনবাবুর অবস্থার অবশ্য তাতে তারতম্য হয় না কোনো!
বললাম, আপনার সাথে বিবাহটা যুথিকার যে দ্বিতীয় বিবাহ সেটা জানেন তো?
-হ্যাঁ জানব না কেন? কিন্তু তাতে কি হয়েছে? রমেনবাবু পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাকেই!
বুঝলাম, রমেনবাবু যুথীর ঠিক উল্টো এই ব্যাপারে!
ওঁর চিন্তাশক্তি জট পাকিয়ে গিয়েছে! সহজ কথাটাও ধরতে পারছেন না সহজে!

সাতটি বছর আগে আমার কষা অংকটার ধুলো পড়া স্মৃতি ঝেড়ে নিজেকে সহজ
রেখেই বলি, না কিছু হয়নি, তবে ঘটনাটা হল আমিই সেই….
মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন আপনিই? ওর প্রথম….?
ওনাকে আশ্বস্ত করতে মুখের কষ্টকল্পিত হাসিটাকে আরও একটু চওড়া করি!
হঠাৎই উনি আমাদের চমকে দিয়ে হো হো করে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে ওঠেন! দু হাতে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে আনন্দের আতিশয্য কোনোক্রমে চেপে বলে ওঠেন, আরে সেকথা তো আগে বলতে হয়? তার মানে আমি আপনার ব্রাদার ইন ল? আমরা এত কাছের আত্মীয়! অথচ এত কাছে থেকেও দূরে রয়ে গিয়েছি! কি আশ্চর্য!

ওঁর আলিঙ্গন থেকে মুক্তি পেয়ে দেখি শিশুর মত আপন আনন্দে উনি বিভোর! সারা মুখে অনিন্দ্য সুন্দর এক স্বর্গীয় আভা ফুঠে উঠেছে! আশ্চার্য্য লাগল এই যুগেও, সমাজ সংসারে মানুষ নিজেকে এমন নির্মল রাখতে পারে কি করে? এই ভাবে যুথীর সাথে এরকম আচমকা দেখা হয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে আনন্দের না বেদনার, কতটা স্বস্তির আর কতটা অস্বস্তির সেসব অনুভবেরও সময় পাওয়া গেল না রমেনবাবুর এই আনন্দ লহরীতে! বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভদ্রলোকের প্রভায় সত্যিই কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম! নিজেকে কেমন যেন অকিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল! যুথীকে বল্লাম, তুমি ভাগ্যবতী ওঁর মতো মানুষ খুঁজে পেয়েছ!

-না না অমন কথা বলবেন না, প্রতিবাদ করে উঠলেন রমেনবাবু; আমারই সাতজন্মের পূন্য যে ওকে পেয়েছি!

সাত বছর আগের আমার কষা অংকটা যে কত বড় ভুল ছিল, সেটা নিজের অজান্তেই আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিলেন উনি! যে গ্লানিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ার কথা, আমায় পেয়ে ওনার আনন্দের জোয়ারে তা জানান দেওয়ার সুযোগটুকুও পেল না!

যুথীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম দৃষ্টি ওর আমার দিকেই নিবদ্ধ! মুখে যেন যুদ্ধ জয়ের দৃপ্ত দীপ্তি ওর ঠোঁট চাপা হাসিতে আলোকিত! বুঝলাম সাত বছর আগের বাজিটায় জেতার জয়টা ও বেশ উপভোগ করছে!

শ্রীশুভ্র

শরৎসাহিত্যের দিগন্তে

বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব এক যুগান্তকারী ঘটনা সন্দেহ নেই। বস্তুত তিনিই প্রথম, আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে লেখাপড়া জানা আপামর শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন বললে মোটেও অতিশয়োক্তি করা হয় না। তাঁর হাত ধরেই বাঙালির ঘরে ঘরে আধুনিক সাহিত্যের হাতেখরির সূচনা। তাঁরও পূর্বে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, বঙ্গসাহিত্যের পথিকৃত হলেও তিনি আপামর বাঙালির হৃদয় জয় করতে পারেননি- শরৎচন্দ্রের মতোন এমন সার্বিকভাবে। এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আজ যে সর্বগ্রাসী প্রভাব বাংলা ও বাঙালির জীবনে; তারও সূচনা শরৎসাহিত্যের পরবর্তী অধ্যায়ে। যদিও কবিগুরু শরৎচন্দ্রের পূর্ববর্তী। কথাটা শুনতে প্রথমে খটকা লাগলেও একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ঘটনাটা সত্য।

রামমোহন বিদ্যাসাগরের হাত ধরে বঙ্গসাহিত্যের যে আধুনিক যুগের সূচনা হয়, তা মূলত সংস্কৃত জানা উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর হেম মধু বঙ্কিম নবীনের হাত ধরে তার সীমা বিস্তৃততর হতে থাকলেও, তাতে বাংলার জনমানসের প্রতিভাস ছিল সামান্যই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যর প্রথম পর্বেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল অনেকটাই। কারণ তা যতটা না বিশ্বমানবের ইশারা সম্ভূত, ততটা বঙ্গজীবনের অস্থিমজ্জায় জায়মান নয়। শরৎচন্দ্রই প্রথম, যিনি বাংলার নাড়ির স্পন্দনে টান দিলেন তাঁর সাহিত্যবোধের একেবারে নিভৃততম অন্তর্লোক থেকে। বিশেষত আমাদের খেয়াল রাখা প্রযোজন, বাংলা কথাসাহিত্য প্রধানত ইউরোপীয়ান সাহিত্যের গর্ভসঞ্জাত। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা উচিত, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় শসক প্রভু ইংরেজদের হাত ধরে এদেশে আসা ইংরেজি সাহিত্যের আঁতুরেই বাংলা কথাসাহিত্যের ভুমিষ্ঠ হওয়া। ফলে সেই আমদানী করা সাহিত্য প্রকরণের বাংলার নাড়ির স্পন্দনে স্পন্দিত হতে যে, শরৎসাহিত্য অব্দি অপেক্ষা করতে হয়ে ছিলো তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই।

শরৎচন্দ্রের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তার হাত ধরেই বাংলার ঘরে ঘরে সাহিত্যের অধিষ্ঠান ঘটে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলার জনমানসে বাংলাসাহিত্যের প্রতি যে বিপুল ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়, তারই সূত্রে একদিকে যেমন হেম মধু বঙ্কিম নবীনের সাহিত্যকাল থেকে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকাল অব্দি সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনই শরৎ পরবর্তী সাহিত্যের গর্ভসঞ্চারও ঘটতে থাকে। আর ঠিক এরই প্রেক্ষিতে, বাঙালির সাহিত্য দীক্ষার বিস্তারের হাত ধরেই, বঙ্গজীবনের পরতে পরতে ধীরে ধীরে সর্বময় হয়ে উঠতে থাকল রবীন্দ্র প্রভাব।

শরৎচন্দ্রই প্রথম বাংলা ও বাঙালির নাড়ির স্পন্দনকে ইউরোপ আগত এই আধুনিক কথাসাহিত্যের প্রকরণে স্বার্থক ভাবে ধরতে পেরেছিলেন। এটাই তার বিপুল জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বঙ্গজীবনের চালচিত্রে বাঙালির মানসভূবনকে খুব ভেতর থেকে অনুভব করেছিলেন তিনি। আর সেই অনুভবের স্বর্ণশিখায় তুলে আনলেন বঙ্গনারীর অন্তর ঐশ্বর্য্যকে। রূপময় করে তুললেন তার ব্যাথা বেদনা আশা আকাঙ্খাকে অনুপম কথনশৈলীর নিপুণ ব্যঞ্জনায়। জয় করে নিলেন বাঙালির হৃদয়।

শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিগত জীবনযাপন, বিশেষ করে তাঁর বেড়ে ওঠার ধরণের মধ্যে থেকেই তিনি অর্জন করে ছিলেন তাঁর এই অনুভব শক্তির স্বাতন্ত্র্য দীপ্তি। স্বতন্ত্র্য ছিল তাঁর বাল্য ও কৈশর আর পাঁচটি বঙ্গসন্তান থেকে। আর সেই ছিল তাঁর মূলধন। সেই সূত্রেই খুলে গিয়েছিল তাঁর দেখার দৃষ্টি, অনুভবের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা। তিনিই তাই মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজকে খুব স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করলেন, একেবারে অন্দরমহল থেকে।

আর সেই অন্দরমহলের রূপঙ্কর রূপেই দেখা দিলেন বাংলাসাহিত্যের আঙিনায়। বাংলাসাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব, যেকোনো ভাষার সাহিত্যের পক্ষেই দৃষ্টান্তস্বরূপ। বস্তুত ঊনবিংশ শতকের বঙ্গীয় বর্ণহিন্দুসমাজের সমাজ মানসিকতার প্রতিচ্ছবিটি তাঁর সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হতে থাকল অনুপম ভঙ্গিতে। আর সেই অননুকরনীয় ভঙ্গিতেই বাংলার জনমানসে শরৎপ্রভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল দ্রুতবেগে।

যে কাহিনীটি দিয়ে বঙ্গসাহিত্যে তাঁর জয়যাত্রা, সেই “বড়োদিদি” শরৎসাহিত্যের অন্যতম দিকদর্শনও বটে। যে পথে পরবর্তীতে এগিয়ে গিয়েছিল তাঁর জনপ্রিয়তার জয়রথ। বাংলাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রই প্রথম তুলে আনলেন বাংলার সমাজসংসারে বঙ্গনারীর প্রকৃত ভূমিকাকে। পুরুষতান্ত্রিক এই বঙ্গসমাজে সংসারের অন্তঃপুরে পরাধীন নারী, পুরুষতন্ত্রের অধীনতার মধ্যে থেকেও কিভাবে পুরুষকেই বল ভরসা যুগিয়ে, সেবা যত্ন করে পুষ্ট করে তোলে, সে সত্য শরৎচন্দ্রই প্রথম এমন স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করালেন আমাদের। তাঁর সাহিত্যের অনুপম মুকুরেই বঙ্গনারী প্রথম অনুভব করল- তার শক্তির সুষমাকে। শরৎচন্দ্রের মধ্যে আবিষ্কার করল প্রকৃত দরদী হৃদয়বেত্তার এক অনুপম লেখককে। দেরি হল না শরৎভক্ত হয়ে উঠতে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তাঁর জনপ্রিয়তা।

শরৎসাহিত্যে নারীর মাতৃত্ব বাৎসল্য প্রেম, তার মায়া মমতা এবং পুরুষের প্রতি তার একনিষ্ঠ কর্তব্য প্রেরণা বস্তুত বাংলার জল হাওয়ার মতোই সজীব সজল করুণামিশ্রিত হয়ে দেখা দিল। সেখানেই নারীও প্রত্যক্ষ করল আপন জীবনের সুকুমার অন্তঃস্বরূপ। ঊনবিংশ শতকের বাংলার নারীকে প্রত্যক্ষ করতে হলে তাই ওল্টাতেই হবে শরৎসাহিত্যে পাতার পর পাতা।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকলেন না লেখক। বর্ণহিন্দু সমাজজীবনের নানান অনৈতিকতার প্রেক্ষাপটে হাজারো বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ সংসারজীবনের মধ্যে অবরুদ্ধ নারীমনের নিভৃত আর্তি লেখকের দরদী কলমের নিবিড় সহানুভুতির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে লাগল বর্ণময় উদ্ভাসনে। আমরা পরিচিত হতে থাকলাম, রাজলক্ষ্মী, কমললতা, কিরণময়ী, কমল, অন্নদাদিদি, সুনন্দা, সাবিত্রী, অচলা অভয়াদের সাথে।

“মণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসেবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটা নিত্য-প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোঁটার জন্যে মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি – ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইহাঁর যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে- আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।”

বলেছিলেন শরৎচন্দ্র, ‘তাঁর নারীর মূল্য’ প্রবন্ধের একেবারে শুরুতেই। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীজীবনের অবরুদ্ধ কান্না শরৎসাহিত্যের স্রোতধারায় স্রোতস্বিনী হয়ে উঠল অচিরেই। কারণটা এখানেই যে, তিনি জগতসংসারে নারীর প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করেতে পেরেছিলেন, একেবারে তাঁর জীবনবোধের ভিত্তিমূল থেকেই। যেখানে কোনো রকম ফাঁকি ছিল না। ছিল না মেকি সহানুভুতির আতিশয্য। তাঁর দরদী মনের মুকুরে ধরা পড়ল নারীর অন্তর্বেদনার অন্তর্গূঢ় আর্তি! সেই আর্তিই উঠে এল তাঁর কুশলী কলমের জাদুতে। একে একে সৃষ্টি হল শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, পল্লীসমাজ, গৃহদাহ, শেষপ্রশ্নের মতো যুগান্তকারী সব উপন্যাস!

তাঁর গল্প উপন্যাসের পরতে পরতে প্রবাহমান বাঙালী হিন্দুসমাজের সেকালের জীবনযাত্রার যে চালচিত্রকে তিনি প্রস্ফূটিত করে গেছেন তাঁর অনুপম গদ্যশৈলীতে, সে তাঁর নিজস্ব প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভিজ্ঞতা সম্ভূত! এবং তাঁর দরদী মনের সমবেদনা সঞ্জাত! সেইজন্যেই তাঁর কাহিনীগুলি পাঠকের অন্তরে এমনই জীবন্ত হয়ে ওঠে অনুভবের সজল সরসতায় রসসিক্ত হয়ে। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঞ্জীবনী আলোয় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের চরিত্রহীনতাকে। দেখেছিলেন সমাজবাস্তবতার কষ্ঠিপাথরে অমলিন মনুষত্বের অম্লান রূপকে। সেই রূপের ক্যানভাসেই ভাস্বর করে তুলেছিলেন তাঁর অন্নদাদিদির মতো সতীসাদ্ধী নারী থেকে, মুজরো করা পিয়ারী বাঈজীরূপী অনন্ত প্রেমিকা রাজলক্ষ্মীকে।ন্যায়পরায়না তেজস্বী আপোষহীন সুনন্দা থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল নারীসত্তার অবিনশ্বর আত্মা কমলকে। নারীমনের অগম রহস্যের দোলাচলে, সমাজ সংসারের বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়া নারীজীবনের দূর্নিবার অসহায়তার পরাধীনতার কাছে ক্ষতবিক্ষত হওয়া অসামান্য রূপসী তীক্ষ্ণ বুদ্ধীমতী কিরণময়ী থেকে প্রেমের ঘাতপ্রতিঘাতে জর্জরিত অচলাকে। তিনি দেখেছিলেন সমাজের নিচতাকে। সমাজের ক্ষুদ্রতাকে। আর সেই নিচতার যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া অসহায় নারীর আপাত ক্ষুদ্রতার মধ্যেও তাঁর অন্তরাত্মার মহত্বকে। সেই দেখার চোখই তাঁকে তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক করে তুলেছিল। এখানেই শরৎচন্দ্রের অনন্য বৈশিষ্ট।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্রী দেবীপদ ভট্টাচার্যের মতে, “কথন বয়নের কুশলতা, চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য, মনোজগতের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ শরৎচন্দ্রকে কালজয়ী হতে সহায়তা করেছে। কিন্তু আরেকটি দিকও বিস্মৃত হওয়া চলে না। অবিচার ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এত বড়ো দরদী শিল্পী তাঁর পূর্বে বা পরে দেখতে পাই না!”

সামাজিক অবিচার ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্রের দরদী কলম নিষ্পেষিত মানবাত্মার মর্মবেদনাকে সহানুভুতির মরমী আলোয় আলোকিত করলেও, তিনি কোনো প্রতিরোধের দিশা বা বিপ্লবের দিশা দেখান নি। হয়তো সেটা সাহিত্যিকের সত্যিকারের কাজও নয়। কিন্তু তিনি তাঁর নিপিড়ীত অবরুদ্ধ চরিত্রদের মধ্যেও বিপ্লব বা প্রতিরোধের আগুন জ্বলে উঠতে দেন নি। যে পুরুষ শাসিত সমাজে তাঁর সৃষ্ট নিষ্পেষিত নারী চরিত্রদের অন্তর্বেদনাকে তিনি দরদী কলমে ফুটিয়ে তোলেন, সেই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনোরকম প্রতিরোধের প্রত্যয় ফুটে ওঠে না তাঁর সৃষ্টি করা সেই সমস্ত চরিত্রদের মননে ও চেতনায়। এইখানেই শরৎদিগন্তের সীমানা।

সামাজিক অন্যায় অবিচারে নিষ্পেষিত মানবাত্মার সকরুণ বেদনার মরমী চিত্রকর তিনি। কিন্তু বিচারের বাণীকে নিরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ প্রতিরোধের কোনো প্রত্যয় ফুটিয়ে তোলেন না তাঁর সৃষ্টির দিগন্তে। কারণটা যতটা না তাঁর ব্যক্তিগত জীবন দর্শনের সংঘটনে, ততটা তাঁর সাহিত্যিক পরিমিতি বোধের সুদৃঢ় প্রত্যয়ে। তিনি যে কালপ্রবাহের, যে সমাজসংসারের, যে যুগধর্মের জীবনযাত্রার চিত্রকর; সেই প্রেক্ষাপটে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিষ্পেষিত বাঙালি মননে প্রতিরোধ প্রতিবিধানের কোনো বীজমন্ত্র জায়মান ছিল না। সমাজজীবনের ভিত্তিমূলেই যার অস্তিত্ব ছিল না, তাকে লেখকের কল্পনা থেকে ধার করে বা বিদেশী সাহিত্য থেকে আমদানী করে বলপূর্বক সাহিত্যের অন্তঃপুরে ঢুকিয়ে দিলে, তা কখনোই সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠতো না। তা হয়ে উঠত হয়ত কোনো রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো। আহত হতো সাহিত্যের পরিমিতি। এখানেই প্রকৃত সাহিত্যিকের পরিচয়। কারণ সাহিত্যিকের কাজ সাহিত্যের দর্পনে সমাজসংসারের অন্তর্গূঢ় অন্তর্বেদনকে প্রতিফলিত করে তা পাঠকের জায়মান জীবনবোধে নতুন করে প্রস্ফূটিত করে তোলা।

আর এখানেই সার্থক শরৎচন্দ্রের সাহিত্য কীর্তি। প্রায় একটা শতাব্দীর বঙ্গ জীবনের চিত্রকার তিনি, এবং প্রায় একটা শতাব্দী বাঙালি মননে রাজত্ব করে গিয়েছেন স্বমহিমায়। সমাজবদলের দায়িত্ব সাহিত্যিকের নয়, সামাজিক ক্ষতগুলিতে মরমী আলো ফেলে পাঠকের চেতনায় জীবনবোধের সঞ্চারণ ও প্রসারণ ঘটানোই তাঁর কাজ। আর সেই কাজে বিপুল ভাবেই সফল তিনি। সফল বলেই তারপর আমরা পেয়েছি তারাশঙ্কর থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ থেকে বিভুতিভূষণ, বাংলা কথাসাহিত্যের সীমানা বিস্তৃত হতে থেকেছে ক্রমশই। তাঁর সাহিত্য বিচিত্রগামী হলেও সর্বত্রগামী হয়নি বলে, আক্ষেপ ছিল কবিগুরুর। আর শরৎচন্দ্র বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলে গেলেন, “….এই অভিশপ্ত, অশেষ দুঃখের দেশে নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে, রূশ সাহিত্যের মতো যেদিন সে সমাজের নিচের স্তরে আরো নেমে গিয়ে তাদের দুঃখ-বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে সেদিন এই (বাংলা) সাহিত্য-সাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।” এখানেই উপলব্ধি করতে পারি আমরা কত বড়ো দ্রষ্টা ছিলেন এই মহান শিল্পী। বাংলা কথাসাহিত্যের প্রথম ভগীরথ!

শ্রীশুভ্র।

নারীবাদ পূনর্নিমাণ

নারী মাত্রেই নারীবাদী নন। নারীবাদী মাত্রেই নারী নন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজবাস্তবতায় নারীবাদ নারীর অন্তিম অর্জন না প্রাথমিক শর্ত সেই নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু এটা খুব সত্যি, নারীবাদ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর অন্যতম প্রতিরোধ। কিন্তু বর্তমান ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বিশ্বে নারীবাদ কি আদৌ নারীর রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পেরেছে? এই প্রশ্নগুলির সাথে আমরা কতটুকু পরিচিত। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সাথে এই প্রশ্নগুলিই বা কতটুকু সংশ্লিষ্ট? আমি বলছি আমাদের সাধারণ জনসাধারণের কথা। আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনচর্চার সামাজিক পরিসরে নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতাই বা কতখানি? এবং নারী নিজে কি ভাবে দেখে থাকে এই বিষয়গুলি? না বিষয়টি এতটাই ব্যাপক ও বৈচিত্রময় যে, এক কথায় এর কোন উত্তর হয় না। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের পরিসরে, আমাদের সামজিক রীতিনীতির পরতে পরতে উত্তর রয়ে গিয়েছে প্রতিটি প্রশ্নেরই। পিতৃতন্ত্রের স্বরূপ ও ইতিহাস নির্ণয়ের দিকে না গিয়েও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, কালের নিয়মেই পিতৃতন্ত্রের প্রকরণ ও অনুষঙ্গেও বদল ঘটেছে বিস্তর। আধুনিক প্রযুক্তির বিপ্লব ও ধনতন্ত্রের একচ্ছত্র বিশ্বায়নেই ঘটেছে এই পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তন কতটা পিতৃতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিগত আর কতটা বাইরের সরূপগত সেটি বিতর্কের বিষয় অবশ্যই। তবে একথা বলা যায়, আবিশ্ব বিভিন্ন দেশেই নারী সুরক্ষার বিষয়ে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন দিনে দিনে নারীবাদীদের হাত শক্ত করে পিতৃতন্ত্রের আস্ফালনে কেবলই লাগাম পড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে আর হচ্ছে না সেটি পরের বিষয়। কিন্তু এই যে নারী সুরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন আইন তৈরী হওয়া, এটি কিন্তু আবিশ্ব নারীবাদের প্রসারের সরাসরি অভিঘাত। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজ বাস্তবতায় এই অভিঘাতের ধরণ ও পরিমানও ভিন্ন। এক দেশের সাথে আরেক দেশের এই বিষয়ে যে পার্থক্য থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নারীবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলির বাইরেও একটি পরিসর রয়ে যায়। যেখানে অর্থনৈতিক স্বাধিকারও একটি নারীর স্বঅভিভাবকত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে না। এই না পারার কারণগুলিই পর্যালচনা করা সবচেয়ে বেশি জরুরী। সাধারণ ভাবে আর্থিক স্বনির্ভরতাই যেখানে নারীমুক্তির চাবিকাঠি, সেখানে বাস্তব পরিস্থিতি যে দেশে দেশে সমাজে সমাজে ভিন্ন এবং এক একটি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণতই বিপ্রতীপ অবস্থানে অবস্থানরত সেকথা কম বেশি আমরা জানি সকলেই। কিন্তু কেন হয় এরকমটি? অনুসন্ধান করে দেখা দরকার সেটাও।

উন্নত বিশ্বের সমাজ ও অনুন্নত বিশ্বের সমাজ বাস্তবতার ভিন্নতার কারণে দুই সমাজের নারীবাদের প্রকৃতি ও নারীর প্রকৃত অবস্থান ভিন্নরূপ হতে বাধ্য। আবার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও জাতপাতের বিভেদ এবং অর্থনৈতিক শ্রেনীবিন্যাস এই পার্থক্যগুলির পিছনেও কাজ করতে থাকে। সামাজিক পরিকাঠামোয় একটি মেয়ে কিভাবে বেড়ে উঠবে, কিভাবে তার চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটতে থাকবে, এবং বংশগত ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার কিভাবে তার সংস্কার ও বিশ্বাসকে রূপ দিতে থাকবে; এই সবগুলি বিষয়ই হিসাবের মধ্যে ধরতে হবে। আর এই বিষয়গুলি দেশ সমাজ ও সম্প্রদায়গত ভাবে এতই বৈচিত্রপূর্ণ যে নারীবাদের প্রকৃতি ও নারীর প্রকৃত অবস্থানও এত বিভিন্ন রকমের। কিন্তু মুশকিল ঘটে তখনই, যখন আমারা এই জটিল বিষয়টিকে একরৈখিক মাত্রায় সরল করে নিয়ে দেখতে ও দেখাতে যাই। তাই শুধুমাত্র আর্থিক স্বনির্ভরতাই নারীর স্বঅভিভাবকত্ব নিশ্চিত করতে পারে না। পাশ্চাত্য সমাজে নারীর অবস্থান ও প্রাচ্যের নারীর অবস্থানজনিত কারণে এই দুই সমাজের নারীবাদের প্রকরণও ভিন্ন। কিন্তু যাঁরা সেটি বিস্মৃত হয়ে আন্তর্জাতিক নারীবাদের প্রবক্তা হয়ে উঠতে চান, তাঁরা ভুল করেন প্রথমেই। ইউরোপ আমেরিকার মেয়েদের সাথে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মেয়েদের সংস্কার ও বিশ্বাস, চাহিদা ও প্রত্যাশার ভিন্নতা খুবই সুস্পষ্ট। সেই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করা যাবে কি করে। তাই বস্তুত আন্তর্জাতিক নারীবাদ বলে কিছু হয় না। এক একটি দেশে, রাষ্ট্রে, সমাজে ও সম্প্রদায়ে এবং জাতিগত গোষ্ঠীতে নারীর অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। তার জীবনবোধ ও মূল্যবোধও বিভিন্ন। তার সমস্যা ও সম্ভাবনার দিগন্তও বিশিষ্ট রকমভাবেই ভিন্ন। তাই তাদের চেতনায় নারীবাদ কখনোই একরৈখিক হতে পারে না। আমাদের সেই সত্যটি অস্বীকার করলে চলবে না কিছুতেই। এবং এর সাথে যুক্ত করতে হবে যুগলক্ষ্মণকেও। অর্ধ শতাব্দী পূর্বের নারী আর আজকের নারীর ভুবন, সে- যে দেশগত ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারই বহন করুক না কেন; এক নয় কখনোই। তাই নারীবাদও পাল্টাতে থাকে, থাকবে দশক থেকে দশকে।

পিতৃতন্ত্রের মধ্যেই সবচেয়ে মুখ্য যে বিষয়টি সুপ্ত ভাবে লুকিয়ে থাকে, সেটি হল নারীগর্ভের উপর পুরুষের সত্ত্বাধিকার। কম বেশি, দেশ কাল সমাজ নিরপেক্ষ ভাবে সবখানেই এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য। এবং মানব সভ্যতার আরও বিশেষ করে বললে বলা যায় এইটিই আধুনিক মানব সভ্যতার মূলস্বরূপ। বয়সসন্ধির পরপরই ছেলে মেয়ে উভয়ই এই বিষয়টি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে যায়। সচেতন হয়ে যায় এমন ভাবেই যে বিষয়টি তাদের বিশ্বাস ও সংস্কারের ভিতের মধ্যেই দৃঢ় হয়ে গেঁথে যায়। তাই এই নিয়ে প্রশ্ন করার সচেতনতা জন্মায়ই না সাধারণত। জল হাওয়া মাটি আকাশের মতোই স্বতঃসিদ্ধ সত্য হয়ে যায় তাদের কিশলয় ধারণায়। আর সেই বিশ্বাসই তাদের আজীবন সংস্কারে পরিণত হয়ে ওঠে যৌবন পর্বেই। নারীবাদ এই বিশ্বাস ও সংস্কারকেই প্রশ্ন করে। যে বা যারা সেই প্রশ্নের সরিক হয়ে উঠতে থাকে, সমাজ সংসার তাদেরকেই নারীবাদী বলে দেগে দিতে চায়। দেগে দেয়ও। বিশেষত আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পারিবারিক সংস্কৃতি ও সমাজিক রীতিনীতিগুলি এমনভাবেই ছেলেমেয়েদের উপর খবরদারি করতে থাকে যে, তাদের স্বাধীন চিন্তার ও অনুভববের পরিসরটিই ক্রমে সংকুচিত ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। তাই তারা প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। একটি মেয়ে বা ছেলে এই রকম অবরুদ্ধ পরিসরে বেড়ে উঠতে থাকে বলেই পিতৃতন্ত্রের ভিতটা এতটাই মজবুত থাকে। আর সেই মজবুত ভিতটাই মেয়েদরকে গুরুত্বপূর্ণ জীবনপ্রশ্নগুলি থেকে দূরবর্তী করে রাখে। তাকে নির্বাক নিরব করে গড়ে তোলে। মেয়েরা শিখে যায়, না- প্রশ্ন করতে নাই। চিন্তা করতে নাই। অন্যরকম ভাবে ভাবতে নাই। অন্যরকম হতে নাই। এই নিরব আত্মসমর্পণ, পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যের কাছে, এটিই তৃতীয় বিশ্বের মেয়েদের আসল ইতিহাস। এবং বর্তমানও। হ্যাঁ প্রযুক্তি বিপ্লবের এই একুশ শতকেও। এই যে অন্যরকম হতে নেই, এই যে সংস্কার এইটিই একটি মেয়েকে নিরব করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ। আর তারপরেও যদি কাজ না হয়, তাহলেই সেই মেয়েটিকে দেগে দেওয়া যাবে নষ্ট তসলিমা বলে। এইটিই পিতৃতন্ত্রের রাজনৈতিক ছক। কজন মেয়ের মধ্যে সেই মানসিক শক্তি ও চারিত্রিক দৃঢ়তা আছে, যে এই ছকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে? বেড়িয়ে আসতে চাইবে চেনা এই ছকের ঘোরতর বাস্তবতার থেকে? মেয়েরা সাধারণতঃ এবং খুবই স্বাভাবিক ভাবেই তাই অন্যরকম হতে চায় না। বরং কেবল একটি দরদী পুরুষের স্বপ্ন দেখতে চায়, যে আদরে সোহাগে সুরক্ষিত করে রাখবে তার প্রেয়সীর জীবন। সেটাই তো ভালোবাসার মাপকাঠি। আমাদের সমাজ সংসার সেই মাপকাঠিটিই প্রতিটি মেয়ের চেতনায় গেঁথে দেয় সফল ভাবে। কেননা তবেই সেই মেয়েটির গর্ভের উপর পিতৃতন্ত্রের সত্ত্বটুকু আরোপ করা যাবে সহজে ও নিশ্চিন্তে।
আর তাই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের এই দেশগুলিতে আর্থিক স্বনির্ভর নারীও অন্যরকম করে ভাবতে পারে না। অন্যরকম হয়ে উঠতে পারে না। যেখানে সে তার গর্ভের উপর পিতৃতন্ত্রের সত্ত্বাধিকার আরোপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে নিজের মতো করে। বই পড়া নারীবাদী তত্ব মুখস্থ করে নয়, বা নয় সেমিনারে শোনা নারীবাদের আলোচনাকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে। সেইখানে নিজেকে দেখার মতো সাহস ও অধ্যাবসায় নিরানব্বই শতাংশ নারীরই থাকে না। উচ্চশিক্ষা কিংবা অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা যতই থাকুক না কেন। আর সেইখানেই কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিকত, কি আর্থিক স্বয়ম্ভর, কি স্বামীর অর্থে প্রতিপালিত; সব নারীর চেতনাতেই চলতে থাকে পিতৃতন্ত্রের আরোপিত কার্ফিউ। বরং যে মেয়ে যতবেশি শিক্ষিত ও আর্থিক সয়ম্ভর সে তত বেশি তার থেকে শিক্ষিত ও অর্থবান মনের মানুষ কল্পনা করতে থাকে। যার আদরে সোহাগে সুরক্ষার নিশ্চয়তার নিশ্চিত পরিসরে তুলে দিতে পারবে আপন নারীগর্ভের স্বত্তাধিকার সম্পূর্ণ করে। হ্যাঁ নিরানব্বই শতাংশ নারীই এইখানেই নারী জন্মের মূল সার্থকতা খুঁজে পেয়ে কৃতার্থ হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে যাদের জীবনে এই প্রত্যাশা এইরকম মসৃণ ভাবে পরিপূর্ণ হয় না, তারাই বিলাপ করতে থাকে নারী হয়ে জন্মানোর জন্যে। দোষারোপ করতে থাকে আপন ভাগ্যের উপর। তবুও অন্যরকম হয়ে উঠতে পারে না। ভাবতে পারে না অন্যভাবে। অনুধাবন করতে পারে না, গণ্ডগোলটা ঠিক কোথায় ঘটে গিয়েছে। কিভাবে ঘটেছে, বা কেনই বা ঘটলো। এই সমাজ বাস্তবতায় আমাদের দেশীয় পরিস্থিতিতে নারীবাদের চর্চা নেহাৎই ইউরোপ আমেরিকা থেকে আমদানী করা শৌখিন অবসর বিনোদন মাত্র। কিংবা কখনো সখনো সেটাই খ্যাতির চৌকাঠে পা রাখার কৌশল বা পেশাগত দক্ষতা পরিচর্যার একটি মাধ্যম মাত্র।

না নারীর এই অক্ষমতার কারণ নারী নয়। একেবারে শৈশব থেকেই মেয়েদেরকে গড়ে তোলার সাংসারিক ও সামাজিক প্রকরণই এই ঘটনার জন্যে দায়ী। আমাদের সমাজে আমরা মেয়েদেরকে সর্ববিষয়ে খাটো করে গড়ে তুলি। কে কত কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জন করলো, কিংবা নির্দিষ্ট পেশাগত দক্ষতায় কত পারদর্শী হয়ে উঠলো সেটাই শেষ কথা নয়। যে আত্মপ্রত্যয় ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের নির্যাসে স্বাধীন ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে আমাদের সমাজে আমাদের সংসারে মেয়েদেরকে সচেতন ভাবেই তার থেকে অনেক দূরবর্তী করে রেখে দেওয়া হয়। স্বাধীন ব্যক্তিত্ব বলতে ইচ্ছে মতো পেশা নির্বাচন কি স্বামীর অর্থে খেয়াল খুশির মতো শপিং করতে পারাই বোঝায় না। স্বাধীন ব্যক্তিত্ব তাই, যা একটি মানুষকে তার দেহ মন সত্ত্বার কোনটিকিই কোনদিন কোন ভাবে কোথাও কারুর কাছে বন্ধক দিতে প্ররোচিত করে না। এই যে স্বাধীন ব্যক্তিত্ব, দুঃখের বিষয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অনুন্নত সমাজব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ করা যায় কদাচিৎই। আর করলেই সমাজ তাকে একঘরে করতেই উঠে পড়ে লাগে। তাই এই দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে নারীর দশা দশচক্রে ভগবান ভুতের মতো আজো।

পিতৃতন্ত্রের এই ঘেরাটোপে নারীকে খর্ব করে রেখে নারীর গর্ভের উপর পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম রাখার আবহমান সংস্কৃতির সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ারই হলো সাম্প্রদায়িক ধর্ম। কম বেশি সকল ধর্মই এই অপকর্মে যথেষ্ঠ পরিমাণে কার্যকরি। এবং পারদর্শী। আজকের প্রযুক্তির এই অভুতপূর্ব সাফল্য ও অগ্রগতির যুগেও সাম্প্রদায়িক ধর্ম নারীর উপর পিতৃতন্ত্রের কর্তৃত্ব কায়েম রাখার বিষয়ে প্রবলভাবেই শক্তিশালী। তাই ধর্ম ও পিতৃতন্ত্র এই বিষয়ে একে অপরের পরিপূরক। আর লিঙ্গরাজনীতির শুরুই এই দুইয়ের অশুভ আঁতাত থেকে। তাই ব্যক্তিগত ভাবে যে কোন নারীর পক্ষেই এই অসম লড়াইয়ে জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব। আর সেই জন্যে তো নারীবাদকে সেই অসম্ভব কাজটিতে মেয়েদেরকে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগানোর কাজে স্বচেষ্ট হতে হয়েছে। আরও বেশি করে হতে হবে। আরও বেশি করে হতে হবে কারণ বিষয়টি, আগেই দেখানো হয়েছে আদৌ এক রৈখিক কোন সমস্যা নয়। তাই পথ ও পদ্ধতি সকল সমাজেই সকল সম্প্রদায়েই একরকমও হতে পারে না। সেই কারণেই নারীবাদকেও হয়ে উঠতে হবে আরও বেশি বাস্তববাদী। এখানে আবেগ সর্বস্ব শ্রেয়বাদের ভুমিকা যত কম হয় ততই ভালো। বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলায় বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা কেন্দ্রিক বিবেচনার প্রয়োজন। প্রয়োজন নারীশিক্ষা বিস্তারের মধ্যে দিয়েই কাজ শুরু করা। নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার নিশ্চয়তা বৃদ্ধির সাথে তার আত্মপ্রত্যয়ের উদ্বোধনে কাজ করে যেতে হবে নারীবাদকে। এক এক অঞ্চলে এক এক ভাবে। আত্মপ্রত্যয়ের উদ্বোধনের পথেই অর্জিত হবে আত্মশক্তির। লিঙ্গরাজনীতির ঘেরাটোপ কেটে নারীমুক্তির জন্যে যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। একমাত্র তখনই পিতৃতন্ত্রের আস্ফালন ও আধিপত্যের কাছে নিঃশর্ত ও নিরব আত্মসমর্পন না করেও নারী তার নিজস্ব ভুবনে লড়াই করে বেঁচে থাকার সাহসটুকু খুঁজে পাবে। সেইদিনই একজন নারীর কাছে মুক্তির দিন। গর্বিত হওয়ার দিন। পথ দেখানোর দিন বাকিদেরকে।

—-শ্রীশুভ্র