ট্যাগ আর্কাইভঃ শাহ আবদুল করিম

স্মরণে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম : যার ছিল মাটির সোঁদা গন্ধভরা সুরেলা জীবন


বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।

তার ছিল কথা-সুর, তাল- লয়, রঙ-রূপ, রস আর মাটির গন্ধভরা জীবন। বাংলার পথে-প্রান্তরে ছুটে যিনি মানুষকে শুনিয়েছেন শেকড়ের গান। জীবনের বাহারী রূপ তিনি ধারণ করেছেন সুরে। কালনী নদীর পাড়ে বসে কখনো আনমনেই গেয়ে ওঠেছেন ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি…’। মাটি ও মানুষের এই শিল্পী শাহ আবদুল করিম। একজীবনে যিনি ‘সোনার ময়নারে পুষেছেন মাটির পিঞ্জিরায়’।

শহুরে জীবনে মাটির গন্ধ নেয়া বড্ড কঠিন। শহুরে জীবনধারা প্রতিনিয়ত আমাদের অজস্র বিরক্তির মুহূর্ত এনে দেয়। দিনের অজস্র ব্যস্ততার পর রাতবিরাতে খুব নীরবে ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’ অথবা ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’ শুনলে সেইসব বিরক্তি যেন মুহূর্তেই উধাও! এইতো শিল্প -সংগীত যা মানুষকে এনে দেয় কোমল প্রশান্তি। আবার প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ অথবা ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ুরপঙখী নাও’ গানগুলো শুনলে মনের ভেতর এক অদ্ভুত ঢেউ তৈরি হয়। মনে হয় ‘মিশে গেছি’ আকাশ,বাতাস,নদী আর সবুজে।

শাহ আবদুল করিমের গানের কথা যেমন নান্দনিক তেমনি তার সুর মুগ্ধতার নিয়ামক। লিরিকে তিনি ধরতে চেয়েছেন গ্রামীণ জীবন,ভাটির হাহাকার, নাগরিক প্রেম, যাপিত বেদনা এবং আরো নানাবিধ বিষয়। গানে গানে তিনি ‘দয়ালের দয়া’ চেয়েছেন।
দেখিয়েছেন মানুষ ও সময়ের দূরত্ব। তিনি বন্ধুকে পেতে চেয়েছেন তুমুল আকুলতায়। মানুষ ও মনের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, মন ও ভাবনার বৈচিত্র্য, দুনিয়া ও মানুষের মায়াজাল বিষয়গুলো নিজের মতো করে তুলে এনেছেন গানে। মনে মনে কথা সাজিয়ে একান্তে বেঁধেছেন সুর। সে এক অসীম সাধনার সমুদ্র। যেখানে কখনো কখনো ‘কূলহারা’ হতে হয়। তবে গানের এই মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী,আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী’ গানে গানে এমন কথা বলেছেন,তবে মানুষ তাকে ছুঁয়ে গেছে তুমুল আগ্রহে। তিনিও যে ছুঁয়েছেন মানুষের হৃদয়ের অন্দরমহল।

শিল্পীর অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবেন না। তার ভাবনার শতভাগ সৃষ্টির তরে। একজন শাহ আবদুল করিম নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন অবলীলায়। মানুষ আর প্রকৃতিপ্রেম তাকে এমন এক জগতে নিয়ে গেছে যেখানে বৈষয়িক কোনকিছুই শিল্পীকে স্পর্শ করে না। তাইতো তিনি একের পর এক গান বেঁধেছেন মানুষের জন্য। যে গানে আছে জীবনের প্রকৃতরূপ, জীবনকে আরো গভীরভাবে দেখার পথ এবং মানুষ ও জীবনের বোঝাপড়া। একজন মানুষ কিভাবে নিজেকে খুঁজে ফেরেন তার চমৎকার দৃষ্টান্ত একজন শাহ আব্দুল করিম। জীবন তাকে কিছুই দেয়নি কিন্তু তিনি জীবনকে দিয়েছেন অনেক।

একজীবনে তার চাওয়ার কিছুই ছিল না। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তিনি কেবল নিজেকে প্রস্তুত করেছেন মানুষকে কিছু দেবার জন্য। শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীত ও বাউলগানের যে দীক্ষা তিনি ওস্তাদ রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকস এর কাছ থেকে পেয়েছিলেন তা ছিল সুদূরপ্রসারী। যা তার সৃষ্টিকর্মেই প্রতীয়মান। এই বাউলসম্রাটের গান বাংলা সঙ্গীতে যে স্বকীয়তা তৈরি করেছে তা তরুণ শিল্পীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য। এই সমৃদ্ধ ভান্ডার মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

বাংলা সংগীতের অমর এ শিল্পী পিরিতি বাড়িয়েই চলে গেছেন অজানায়। দিনটি ছিল ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯। তার জন্য কেঁদেছিল পৃথিবী। একজন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের জন্য এখনো নাগরিক মন কাঁদে। এইসব দিনরাতে গেয়ে ওঠি ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি’।

মামুন রণবীর
১২/০৯/১৯