শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে একটা গাঁদাফুলের ক্ষেত। সবেমাত্র গাঁদাফুল ফুটতে শুরু করছে।
প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার-ওপার দুই পাড়েই নারায়ণগঞ্জ শহর। নারায়ণগঞ্জ শহরের মাঝখান দিয়েই ইতিহাসের ঐতিহ্য বহন করে চলছে শীতলক্ষ্যা নদী। এই ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করতে গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীকে সইতে হচ্ছে শত লাঞ্ছনা বঞ্চনা। নদীতে বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি। আর নদীর দুই পাড় বেদখল সহ নানারকম অত্যাচার অবিচার চলছে তো চলছেই। আগের মতন শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ আর মিঠাপানি নেই। পানিতে ডাইং আর নীট গার্মেন্টসে কাপড় রং করা বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত। নদীর পানির রং কালো কুচকুচে আর অসহনীয় দুর্গন্ধ। তবু শীতলক্ষ্যা থামছে না, কালের সাক্ষী হয়ে বয়ে চলছে। থাকছে না শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা মানুষ। চলছে তাদের নতুন করে নতুন ফসল ফলানোর চেষ্টা।
প্রতিবছর বর্ষা শেষে নতুন করে জেগে উঠে নদীর পাড়। নতুন করে জেগে ওঠা পাড়ে জমে থাকে পলিমাটি। পলিমাটির রংও থাকে লাল,কালো, হলুদে মিলে একাকার। সেই মাটিতেই শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের মানুষের শুরু হয়ে যায়, ফসলের বীজ ফেলার প্রতিযোগিতা। অনেক আগে থেকেই শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের মানুষেরা ধান সহ নানারকম শীতকালীন সবজির চাষ করে আসছে। কেমিক্যাল মিশ্রিত পলিমাটিতে তেমন ফসল ফলে না। তবুও জাত চাষিদের থাকে ফসল ফলানোর তাড়না।
আরও একটা ক্ষেত! আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যেই পুরো ক্ষেত ফুলে ফুলে ভরে ওঠবে।
সেই তাড়নায় কেউ বর্ষা মৌসুমে ধান। কেউ শীত মৌসুমে লাউ-কুমড়ো, ডাটা, লালশাক, ছিম, মুলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি চাষ করে থাকে। গত দুই- তিনবছর ধরে নতুন করে শুরু হয়েছে নতুন চিন্তাভাবনার নতুন ফসল, গাঁদাফুলের চাষ। যেই নদীর পানি আর মাটিতে সহজে ঘাস জন্মাতে চায় না, সেখানে উন্নতমানের গাঁদাফুল তো স্বপ্নের ব্যাপারস্যাপারই ছিল। স্বপ্নও নাকি একসময় বাস্তবে রূপ নেয়!
“চেষ্টা মানুষকে সাফল্যের শেখরে পৌঁছে দিতে পারে,” কথাটা চিরসত্য।
ছয় ঋতুর দেশে শরৎ, হেমন্তের শেষে, শীতের শুরুতে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে গেলে চোখে পড়ে গাঁদাফুলের বাহার। গাঁদাফুলের মাঝে মাঝে আছে টিউলিপ ফুল, সূর্যমুখী ফুল সহ শীতকালীন সবজিও।
এটিও এক ফুলচাষির সখের ক্ষেত! এই ক্ষেতে এবার তিনি রোপণ করেছেন উন্নত জাতের গাঁদাফুল।
তবে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় বলতে পুরো পূর্ব পাড় নয়! নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ২৫,২৬নং ওয়ার্ড ঘেঁষা নদীর পাড়েই গাঁদাফুলের চাষ বেশি দেখা যায়। এই গাঁদাফুলের চাষ আগে ছিল বন্দর থানাধীন দাসের গাঁও হতে শুরু করে লাঙলবন্ধ ব্রহ্মপুত্র নদীর এপার-ওপারে। তা এখনও অনেক চাষি তাদের ফসলি জমিতে গাঁদাফুলের চাষ করছেই। তবে ফসলি জমি থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গাঁদাফুলের ভালো ফলন হয়ে থাকে।
তাই শীত মৌসুমে নদীর পাড় ঘেঁষা মানুষেরা ফুল চাষের দিকেই বেশি খেয়ালি। নদী পাড়ে যার আয়ত্বে যতটুকু জায়গা আছে, সে ততটুকু জায়গাতেই ফুলের চাড়া রোপণ করছে। বন্দর থানাধীন এলাকা, উত্তর লক্ষণখোলা খেয়াঘাট সংলগ্ন নদীপাড়ে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গাঁদাফুলের চাষ। এর দক্ষিণে সোহাগপুর টেক্সটাইল। উত্তরে সাবেক ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্। বর্তমান সামছুল আলামিন টেক্সটাইল মিলস্। মধ্যখানের পরিত্যক্ত জায়গাতেই, ছোটবড় শ’দুয়েক ফুলের ক্ষেত চোখে পড়ে। নদী পাড়ে ফুল চাষীদের চাষ করা এসব ফুলের সৌন্দর্যে মানুষের মন কেড়ে নেয়। লাল, হলুদে মিশ্রিত গাঁদাফুলের ক্ষেত দেখতে প্রতিদিন বিকালবেলা শত শত ছেলে বুড়ো ছুটে আসে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে। গাঁদা ফুলসহ নানারকম সবজি ক্ষেতের কিনারে বসে বসে যুবক-যুবতীরা আড্ডা দেয়, সময় কাটায়।
ক্ষেতের সীমানা পর্যন্ত বেড়া দেওয়া আছে। দেখে মনে হয়, কৃষকের নিজের জমিতেই গাঁদাফুলের চাষ। আসলে কিন্তু শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের পরিত্যক্ত জায়গা বা নদীর চড়!
এমনিতেই বিকালবেলা স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেই, ফুলের ক্ষেতের সামনে ঘুরেফিরে সময় কাটায়। ক্ষেতে ফোঁটা ফুল আর মানুষের আগমনে পুরো নদীর পাড় যেন এক মিলন মেলায় পরিণত হয়। মানুষের আগমনের সাথে নানারকমের দোকানও বসে সেখানে। ঝালমুড়ি, চটপটি, বুট-বাদাম সহ আরও অনেকরকমের খেলনার দোকানও। আবার একই সময়ে, মানে বিকালবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন জায়গায় ফুল সরবরাহও করা হয়। ফুল নিতে প্রতিদিন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারও আসছে। কেনা-বেচা, টাকা-পয়সার আদান-প্রদান সবই বিকাল বেলাই বেশি হয়ে থাকে।
গত ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন চলাকালীন সময়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় যাওয়া হয়। সকাল ১০টার সময় খেয়ানৌকা থেকে নেমেই গাঁদাফুলের ক্ষেতের দিকে রওনা হলাম। অনেক চাষি তাদের ক্ষেত চাষের কাজে ব্যস্ত। কেউ পানি ছিটাচ্ছে, কেউ চারা রোপণ করছে। জেউ ক্ষেতের পাশে বেড়া মেরামত করছে। মোটকথা ব্যস্ততার মাঝেই ফুল চাষিদের সময় কেটে যাচ্ছে।
ক্ষেতের সামনে গিয়ে ছবি তুলতে তুলতে কয়েকজন ফুলচাষির সাথে আলাপও করা হলো। আলাপ করে জানতে পারলাম, গাঁদাফুলের বিষয়াদি। তবে গতবারের তুলনায় এবার গাঁদাফুলের চাষ আর ক্ষেত কমই দেখা গেল। কেউ বলছে, “সবেমাত্র মৌসুম শুরু, তাই ক্ষেত কম দেখা যাচ্ছে”।
কেউ বলছে, “আগের তুলনায় এবারে খরচ বেশি পরছে বিধায়, ক্ষেত আর চাষের পরিমাণ কম। গতবারের আগেরবার প্রতি এক হাজার ফুল প্রকার ভেদে দাম ছিল ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা। গতবার বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকায়। খরচ কিন্তু কমছে না, বরং বেড়েই চলছে। তাই এবার অনেকেই গাঁদাফুলের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে না। শীতকালীন শাকসবজির উপরই বেশি নজর।” বলছিলেন, সেখানকার কয়েকজন কৃষক।
তবে ধারণা এবং নমুনা দেখে বোঝা যায়, গতবারের তুলনায় এবারও কোনও অংশে কম হবে না। ফুল চাষিদ্বয় যা-ই বলুক, সময়মত আগের চেয়ে এবার বেশিই হবে। শীতকালীন সময়ে এমনিতেই বিয়ে-শাদী আর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বেশি হয়। ফুলের চাহিদাও থাকে বেশি। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের ফুল চাষে নারায়ণগঞ্জবাসীর সেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এই এলাকার কৃষকরাও ফুলের চাহিদা পূরণেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। সাথে বাড়িয়ে দিয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের সৌন্দর্য। মানুষকেও দিচ্ছে আনন্দ। সব মিলিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ছেয়ে যাচ্ছে ফুলে ফুলে। আর ক’দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর পূরতব পাড়া ভরে যাবে ফুলে ফুলে।