ট্যাগ আর্কাইভঃ শ্রীশুভ্র’র গল্প

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন

অরুণ যে আমার বিশেষ নিকট বন্ধু তা নয়! তবে একেবারেই আলগা বন্ধুত্বও নয়! তাই ওর বিবাহে বরযাত্রীর যাওয়ার নিমন্ত্রণ না পেলেও বৌভাতে যাবার অনুরোধ এড়াতে পারিনি! কিন্তু মুশকিল হল কি দেওয়া যায় উপহার হিসেবে? যেটাই ভাবি সেটাই বড়ো খেলো মনে হয়! সাধারণ কেরানীপকেটের চৌহদ্দীতে যা হয় আর কি! যদিও উপহার যা দেব তা দেব ঐ অরুণের বৌকেই! পাক্কা ব্যবসায়ী অরুণ সামান্য তুচ্ছ উপহার নিয়ে মাথা ঘামাবে না জানি তবু ন্যূনতম ভদ্রতা রক্ষার দায় তো থাকেই! যদিও জানি অরুণের সাথে ওর ব্যবসায়ে লাভজনক কোনো বড়ো পার্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে খুশি করা যেত ওকে! কিন্তু আমি ছাপোষা মানুষ, আদার ব্যাপারীও নই! এটা তেমন উপলক্ষও নয়!

তবে সুকন্যা থাকলে আজ আমায় এত ভাবতে হতো না! কোথায় কোনটা মানানসইসেটা বুঝবার একটা দারুণ ক্ষমতা ছিল ওর! রুচিশীল একটা মনের তন্বী মেয়ে! ডানাকাটা পরী নয়, কিন্তু অপরূপ একটা দ্যুতি ছিল টানা দুটি চোখে! দৃষ্টির সেই গভীরতায় ছিল আত্ম প্রত্যয়ের দীপ্তি! আর ছিল কাব্য প্রীতি! নিজে লিখত না! কিন্তু ভালো কবিতার কদর জানতো! ইউনিভার্সিটির তুখর ছাত্রী! ইংরেজী সাহিত্যের বর্ষসেরা! সাহিত্য আমার বিষয় নয়! তবু সুকন্যাই আমাকে সুসাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়! সেই থেকে আমারও কবিতা প্রীতি! সুকন্যা প্রেম! কবিতার মধ্যেই শ্বাস নিত যেন মনে হতো! আস্তে আস্তে আমাকেও ডোবালো ওতেই! ব্রাউনিঙের কবিতা ছিল ওর খুব প্রিয়! খুব আবৃত্তি করতো!

সুকন্যার আবৃত্তি যে খুব উচ্চমানের ছিল তা হয়তো নয়! কিন্তু ওর মুখচোখের দীপ্তি বলার ছন্দ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো আমায়! তার কারণ যতটা কাব্য প্রেম ততটাই ওর প্রতি আমার দূর্বলতা! এই ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালী দিনগুলোও একদিন স্মৃতির সরণীতে ঢুকে গেল! জীবিকার সন্ধানে কে কোথায় ছিটকে গেলাম! সুকন্যাও উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য বাইরে চলে গেল! কিন্তু গেলেও যোগাযোগ যে রাখা যেত না তা হয়তো নয়! হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন সুকন্যা আর আমার মতো সাধারণ মানুষের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করেনি বলেই ধীরে ধীরে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল আরও! ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিক ছন্দে ঘটে গিয়েছিল যে বুঝতেই পারিনি কখন সুকন্যা সরে গেছে দূরে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি এভাবেই মানুষের জীবনে কতো সহজেই যেন স্মৃতি হয়ে যায় একদিন! রোজকার বন্ধুদের, যাদের ছাড়া একদিনও চলে না, কালের গতিতে তারাও কোথায় হারিয়ে যায়! কিন্তু সুকন্যা! সেতো শুধুই বন্ধু ছিল না! তাকে ঘিরে ভবিষ্যৎ জীবনের সপ্নাভ আশার বিস্তার ছিল প্রতিদিনের শাখা প্রশাখায়! তবু সেও তো দূরে সড়িয়ে নিল নিজেকে! তবু এত দিন পরে আজ তাকেই মনে পড়ছে বড়ো বেশি করে! এই আগোছালো জীবন হয়ত আর আগোছালো থাকতনা! সামান্য একটা উপহার নির্বচন করতে কি বেহাল দশা আজ! এই সবই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল ওকে বলেছিলাম ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন উপহার দেব ওর জন্মদিনে! মহালয়ার দিন! দেবীপক্ষের সূচনায়! কিন্তু সে আর দেওয়া হল কই!

সত্যি সুকন্যাকে উপহারটা আর দেওয়ার সুযোগ ঘটেনি! এতদিন পর সেকথা মনে হতেই মনটা বড়ো বিষন্ন হয়ে গেল! মনে পড়ে গেল ব্রাউনিঙের দ্য লাস্ট রাইড টুগেদারের কথা! সুকন্যার আবৃত্তির সাথে আমিও গলা মেলাতাম কখনো সখনো! আসলে ব্রাউনিঙের মধ্যে যে দুরন্ত প্যাশানের সুতীব্র প্রকাশ ছিল, সেটা আমাদের উন্মন করে তুলত প্রথম যৌবনের তরুণ দিনে! হঠাৎ মনে হল, অরুণের বৌভাতে ব্রাউনিঙের সংকলন দিলে কেমন হয়? যদিও অরুণের জীবনে প্রফিট এণ্ড লসের ব্যালেন্স শীট ছাড়া অন্য কোনো কাগজের গুরত্ব নেই বিশেষ! তবে ওর বৌ হয়তো সাহিত্যপ্রেমী হতেও পারে! ওদের নবজীবনের শুভারম্ভ ব্রাউনিঙের রোমান্টিকতায় ভরপুর হয়ে উঠুক না কেন দাম্পত্যের প্রতিদিনের বাসরে!

অরুণদের পয়সা বুঝি মেঝেতে গড়াগড়ি যায়! এমন এলাহী ব্যাপার আগে কোনো বৌভাতে দেখিনি কখনো! গেটের সামনে দেশী বিদেশী কত রঙের ছোট বড়ো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে! আমন্ত্রীতদের পয়সার আভিজত্য পোশাকের গন্ধেই স্পষ্ট বোঝা যায়! এই রকম ধনদৌলতের ঐশ্বের্য্যের মাঝে নিজের কেরাণী গন্ধওয়ালা অস্তিত্বটা নিয়ে, একটা ব্রাউনিঙের কবিতার বই সম্বল করে ঢুকতে বড়ই সঙ্কোচ হচ্ছিল! নিজেকে এত অসহায় মনে হচ্ছিল যে ভাবছিলাম ফিরে যাব কিনা! অন্তত আসার জন্য বড়ই মর্মপীড়া অনুভব করছিলাম!

অরুণ বোধহয় কাউকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিল! আমায় দেখতে পেয়েই সহাস্যে এগিয়ে এলো! সাথে নিয়ে ভেতরে গেল! কিন্তু আমার সাথে কথা বলার অবসর নেই! আমায় বসিয়ে আবার কার সাথে চলে গেল বাইরে! আমি একা জড়সড় বসে হয়ে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছিল্লাম! এই ধনৈশ্বর্য্যের বৈভবের মাঝে নিজেকে খুবই অপাঙতেয় লাগছিল! বেশ অনেক্ষণ পরেই অরুণের আবার আমার ওপর নজর পড়ল! আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! নিজের অস্বস্তিতে বেশ হাঁফিয়ে উঠছিলাম! অরুণ নিজেই আমায় নিয়ে দোতলায় উঠল! নববধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে! আমাকেও উপহারটা দিতে হবে! নববধুকে ঘিরে স্বভাবতই অপরূপা মায়াবিনী সুন্দরীদের ভিড়! উৎসবের আনন্দে উৎসাহিত মুখগুলির কলধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ!

আগেও দেখেছি এইরকম বিবাহ অনুষ্ঠানে সাজসজ্জার ভিড়ে নববধুটি যে কে তা বুঝে উঠতে কয়েক সেকেণ্ড দেরি হয়ে যায়! নববধু হয়তো কারুর সাথে গল্পই করছিলেন! এইরকম বৈভবে উচ্চবিত্ত সমাজের সুসজ্জিত বেশভুষার ঝাঁচকচকে মানুষজনের মধ্যে আমি এতই বেমানান যে, সঙ্কোচ আর লজ্জা আমায় পীড়া দিতে থাকল! কিন্তু আসরে নেমে পড়েছি, আর ভাবা চলে না! মুখে একটা কৃত্রিম কষ্টকলপিত হাসি টেনে এগোলাম! এই অবস্থায় নিজেকে আয়নায় কেমন দেখাতো ভেবে সত্যিই হাসি পেল! সেই নিদারুণ হাসি মুখেই নববধুর নিকটবর্তী হলাম! অরুণ ওর বৌয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে উদ্যত হল! অরুণের ডাকে ওর নব পরিণীতা বধু আমাদের দিকে ফিরতেই মুখে হাসি ঝুলিয়ে উপহারটি দিতে হাত বাড়ালাম!

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যে উপহার একদিন সুকন্যার জন্মদিনে ওর হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল, আজ অরুনের বৌভাতে সেইউপহার তার বৌয়ের হাতে তুলে দিতে এসেছি! অরুণের গর্বিত হাসির লহড়াতেই দৃষ্টিবিনিময় হল নববধুর সাথে! আর তখনই বেনারসী আর স্বর্ণালঙ্কারের সজ্জায় সুকন্যাকে দেখে চমকে ওঠার পালা আমারই! কিন্তু সুকন্যা ওর, আমায় চেনার চমকটাকে কি অদ্ভুত সহজভাবেই না মনভোলানো হাসিতে ঢেকে দিলো! আরও আশ্চর্য ওর ঐ অভিজাত হাসির উপরেই ভর করে আমিও কত সহজেই সামলে নিলাম নিজেকে! তুলে দিলাম ওরই হাতে আমার ক্ষুদ্র উপহার ওর প্রিয় ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যেখান থেকে একদিন আবৃত্তি করতাম আমরা দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার!

শ্রীশুভ্র

হারজিৎ

এই শহরে বদলি হয়ে আসার পর আলাপ হলো অফিসের বড়বাবুর সাথে! ওনার সাথে আলাপটা ধীরে ধীরে বেশ জমে উঠল! ওনার অন্তঃকরণটা বেশ নির্মল! অফিসের কুটিল রাজনীতির বাইরেই থেকে গিয়েছেন বুঝলাম! আশ্চর্যও লাগল খুব! ক্ষমতা আছে বলতে হয়! দেখলাম চারিদিকের স্বার্থপরতার বেড়াজালের মধ্যে ভদ্রলোকের সাথে দু-দণ্ড কথা বলে একটা নির্মল তৃপ্তি পাওয়া যায়! নতুন জায়গায় বিদেশ বিভুঁইয়ে এরকম মানুষের সঙ্গ ভরসা জোগায়! বন্ধুত্ব জমে উঠতেই সেই খাতিরে অনেকদিন ধরেই ওনার বাড়িতে একদিন বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছিলেন! শহরের অন্য প্রান্তে বেশ নাকি একটা ছোটো বাড়ি বানিয়েছেন! দেশের বাড়িও বেশি দূরে নয়! জমি জমাও কিছু আছে!

যাব যাব করেও শেষ পর্য্যন্ত আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি! নিজেরই তাগিদের অভাব! আসলে বড়োই কুঁড়ে মানুষ আমি! অফিস আর বাসার বাইরে আর কোথাও বিশেষ যাওয়া হয়ে ওঠে না! তারপর একলা মানুষের পক্ষে সময়ের অভাবটাও একটা অন্যতম অজুহাত! যদিও বুঝতে পারি আমার প্রতি ওনারও একটা আন্তরিক টান জন্মেছে! এটাই হয়ত হয়! মনের নিভৃতে আমরা প্রত্যেকেই নির্মল বন্ধুত্বের আকাঙ্খা বয়ে বেড়াই! তাই যার সাথে মনের খানিকটা মেলে, তাকে কাছে টানতে চাই আন্তরিক ভাবেই! যাই হোক গত কদিন ধরেই ভদ্রলোক প্রায় একরকম জোর করেই ওনার বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য আমায় বলে রেখেছিলেন! অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেড়ানো গেল! ওনার স্কুটারেই প্রায় আধঘণ্টা লাগল ওনার বাড়ি পৌঁছাতে!

শহরের একেবারে উল্টো দিকে রেল লাইন পেড়িয়ে ওনাদের অঞ্চল! পাড়াটি বেশ অভিজাত বলেই মনে হল! সাজানো গোছানো ডিজাইনার বাড়িগুলি দেখলেই বাসিন্দাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা পরিস্কার বোঝা যায়! পীচ রাস্তা ছেড়ে বেশ চওড়া কংক্রিটের বাঁধানো গলি ধরে এগোলেই ডান দিকে খান তিনেক বাড়ি পড়েই ওনার আবাস! উচুঁ পাঁচিল ঘেরা চওড়া গেট! গেটের দুধারে ব্যুগোনভিলার ঝাড়! প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে যায়! বেশ বাংলো ধাঁচের, গোলাপী রঙের বাড়ি! ছোট্ট কিন্তু নয়নাভিরাম! বাড়ির সামনে বাঁধানো চত্বরের দুই ধারে নানান ধরনের হরেক রঙের মরশুমি ফুল! খুবই মনোরম পরিবেশ! শ্যামলিমায় ঘেরা একটুখানি বাসা! পিছনের দিকে ছোটো একটা সবজী বাগানও আছে!

বল্লাম –বাঃ খুবই সুন্দর । খুব ভালো লাগছে এসে! আপনার রুচিরও প্রশংসা করতে হয়! সুন্দর একটা শান্তিকুঞ্জ তৈরী করেছেন!

-বলছেন তাহলে? মুখে একটা অনাবিল হাসি ফুটিয়ে বল্লেন রমেনবাবু, এসব পরিকল্পনা আমার মাথায় আসত নাকি? সব প্ল্যান যা দেখছেন সব আমার স্ত্রীর! আরে মশাই আমি চিরকালই আগোছালো মানুষ! বিয়ের পর ওর হাতে পড়ে এখন তো অনেক ভদ্রস্থ হয়েছি! আমি শুধু উপার্জন করেই খালাস তার পর সব ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মত পরম নিশ্চিন্ত আছি মশাই! বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন নতুন অফিসের বড়বাবু রমেন্দ্রনাথ মিত্র!

রমেনবাবুর প্রাণখোলা হাসিতে আমার অনেকদিনের পুরানো চাপা দীর্ঘশ্বাসটা হঠাৎই বেrরোতে গিয়েও যেন আবার চাপা পড়ে গেল!

সত্যিই তো এমন পরিপূর্ণ জীবন মানুষকে এত প্রাণবন্ত করে তুলবেই! রমেনবাবুর প্রাণখোলা নির্মল অন্তঃকরণের পেছনে তবে নারীর প্রেরণা ও সাহচর্যের সচেতন যত্ন বর্তমান! আমরা বারান্দায় উঠতেই ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এসে রমেনবাবুর কন্যা বোধহয় রোজকার অভ্যাস মতোই এক লাফে বাবার কোলে উঠে পড়ল! সদ্য ফোটা একটা ফুল যেন! ফুটফুটে পরীর মতন রূপ! কতই বা আর বয়স হবে! বড়জোড় চার কি পাঁচ! চোখে মুখে রমেনবাবুর মতোই প্রফুল্লতা! এই সাজানো সুন্দর বাড়ি, রমেনবাবুর মতো অমায়িক মানুষ, এই কচি কিশলয় শিশু তার একরাশ আনন্দ নিয়ে; যেন বিভিন্ন যন্ত্রীর হাতে একটাই আনন্দের মঙ্গলধ্বনি মুর্ত্ত হয়ে উঠেছে!

মেয়েকে আদর করে কোল থেকে নামিয়ে মাকে ডাকতে বলতেই রমেনবাবুর শিশুকন্যা মিষ্টি কচি কণ্ঠে – মা দেখো বাপি এসেছে বলেই ভেতরে একছুট! রমেনবাবুও আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন! যে ঘরটায় ঢুকলাম স্বভাবতঃই সেটি বসার ঘর! খুব বড় নয়! ঘরটা ছোটোই, কিন্তু এমন সুন্দর করে সাজানো যে একবার ঢুকলে আর চট করে বেরোতে ইচ্ছে করবে না! অফিস থেকে এতটা পথ এসে এইরকম একটা ঘরে আসলে ক্লান্তি উপশম হতেই হবে!
-আপনার বাড়িটা কিন্তু বড়ই ভালো লেগে গেল! ঘরে বাইরে সর্বত্রই সুন্দর একটা শান্তি বিরাজ করছে!
আমার প্রশংসার উত্তরে উনি আবার সেই তৃপ্তির হাসিটা হাসলেন; -যা দেখছেন সব কৃতিত্ব কিন্তু ওরই! বুঝলাম ভদ্রলোক স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসেন!

-সত্যি আপনার সৌভাগ্যে কিন্তু ঈর্ষা হওয়া উচিত! মজা করে হাসতে হাসতে বল্লাম বটে, কিন্তু মনের অতলে যে দীর্ঘশ্বাসটা চাপা পড়ল তার পরিসরে যে সামান্যও ঈর্ষার বাষ্প ছিল না, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না!
-আরে মশাই সেটাই তো আমার গর্ব!
বলেই আবার প্রাণখোলা হাসিতে মেতে উঠলেন! হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হাত মুখ ধোবেন নাকি? জলটলের কিন্তু কোনো অভাব নাই!
অসম্মতি জানিয়ে বল্লাম বাড়ি ফিরে একবারে চান করে নেব ওটাই আমার বরাবরের অভ্যাস!
-আরে সেটাতো এখানেই সেরে নিতে পারেন!
ওনাকে কোনোক্রমে নিরস্ত করি! কিন্তু ভদ্রলোকের এই নিপাট আন্তরিকতায় ওঁর এই আলোকিত মনের পরিসরে সত্যিই একটা আত্মিক টান অনুভব করতে থাকলাম!

-ওঃ ওই তো ও এসে গেছে, এসো আলাপ করিয়ে দিই!
ভদ্রলোকের এই নির্মল শুদ্ধ অন্তঃকরণের সানন্দ প্রভায় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম বোধহয়! সম্বিত ফিরল ওঁর কণ্ঠস্বরে! আর তখনই ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ফেরাতেই প্রচণ্ড চমকে উঠলাম!
-যুথী তুমি?
আমার অজান্তেই যেন মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল যুথিকার নামটা!
এবার অবাক হওয়ার পালা রমেনবাবুর!
ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে একবার আমার দিকে আর একবার যুথিকার দিকে চাইতে থাকেন!
ওদিকে যুথীও স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে!
এতটাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে যে, যাকে এক কথায় বলা যায় হতবাক হয়ে যাওয়া!
আমারও অবস্থা তথৈবচ!
যুথী? এতদিন বাদে! এভাবে আমাদের দেখা হয়ে যাবে আবার, সে কথা কি অন্তর্যামীও জানতেন? মনে হয় না!

প্রায় একমিনিটের স্তম্ভিত নীরবতা ভাঙল রমেনবাবুরই প্রশ্নে! ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে তিনি বিস্মিত হয়েই আমায় জিজ্ঞাসা করেন,
-কি ব্যাপার বলুনতো আপনি ওকে চেনেন নাকি?
চিনি যে সে তো আমার মুখে যুথীর নাম শুনেই বোঝার কথা! বিস্মিত রমেনবাবুকে ঘাড় নেড়েই আশ্বস্ত করি!
নিজের স্ত্রীর কাছেও ভদ্রলোক জানতে চান একই কথা!
যুথিকা কিছু বলল না!
ওর সেই বিখ্যাত ঠোঁট চাপা হাসিতে বাঁ গালে সামান্য টোল পড়ল!
এটাই ওর স্বভাব! অধিক আনন্দ উত্তেজনায় ও কোনোদিনো বেশি কথা বলে না! ঐ হাসিই ওর ট্রেডমার্ক! বুঝলাম এতদিন বাদে এভাবে আচমকা আমায় দেখে ও ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত! কিন্তু যারা ওকে জানে না তার টেরও পাবে না! রমেনবাবু নিশ্চয় বুঝেছেন!

এবার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা রমেনবাবুর! তাঁর বিস্ময় বাড়ল বই কমলো না!
তিনি একবার আমার দিকে আর একবার যুথিকার দিকে তাকান! যুথীই তখন রমেনবাবুকে বলল,
-আগে বলবে তো?
– আগে বলবো? কি আগে বলব?
-কি আবার, তুমি যে ওকে আনবে সে কথা বলোনি তো? সামান্য হেসে উত্তর দেয় যুথিকা!
-হ্যাঁ সে তো তোমায় বলেই গিয়েছিলাম! রমেনবাবুর সোজো উত্তর!
-অফিসের এক নতুন কলিগ বেড়াতে আসবেন, এর বেশি কিছু বলেছিলে নাকি?
অনেকটাই সপ্রতিভ হয়ে ওঠে যুথী! এও ওর মস্তবড়ো গুণ! যে কোনো পরিস্থিতিকে সহজে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে!
বুঝলাম রমেনবাবু এখনও অথৈজলে! ওনাকে ধরে পাশে বসাই! যুথিকাও সমনের সোফায় এসে বসে!মুখে সেই বাঁ গালে আলতো টোল পড়া হাসি!

রমেনবাবুর একরাশ বিস্ময় মাখা বড়ো বড়ো চোখদুটির দিকে তাকিয়ে, আমি যে কে সেটা বলতে গিয়েও সামলিয়ে নিলাম! যুথীর দিকে তাকালাম! রমেনবাবুকে এতদিন অন্ধকারে রেখেছে কিনা সেটা না জেনে…
আমার সাথে চোখাচোখি হতেই, আমার মনের কথা পড়ে নিতে দেরি হয় না যুথিকার! হেসে রমেনবাবুকে দেখিয়ে বলল, -ও সব জানে!
-কি? কি জানি?
রমেনবাবুর অবস্থার অবশ্য তাতে তারতম্য হয় না কোনো!
বললাম, আপনার সাথে বিবাহটা যুথিকার যে দ্বিতীয় বিবাহ সেটা জানেন তো?
-হ্যাঁ জানব না কেন? কিন্তু তাতে কি হয়েছে? রমেনবাবু পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাকেই!
বুঝলাম, রমেনবাবু যুথীর ঠিক উল্টো এই ব্যাপারে!
ওঁর চিন্তাশক্তি জট পাকিয়ে গিয়েছে! সহজ কথাটাও ধরতে পারছেন না সহজে!

সাতটি বছর আগে আমার কষা অংকটার ধুলো পড়া স্মৃতি ঝেড়ে নিজেকে সহজ
রেখেই বলি, না কিছু হয়নি, তবে ঘটনাটা হল আমিই সেই….
মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন আপনিই? ওর প্রথম….?
ওনাকে আশ্বস্ত করতে মুখের কষ্টকল্পিত হাসিটাকে আরও একটু চওড়া করি!
হঠাৎই উনি আমাদের চমকে দিয়ে হো হো করে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে ওঠেন! দু হাতে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে আনন্দের আতিশয্য কোনোক্রমে চেপে বলে ওঠেন, আরে সেকথা তো আগে বলতে হয়? তার মানে আমি আপনার ব্রাদার ইন ল? আমরা এত কাছের আত্মীয়! অথচ এত কাছে থেকেও দূরে রয়ে গিয়েছি! কি আশ্চর্য!

ওঁর আলিঙ্গন থেকে মুক্তি পেয়ে দেখি শিশুর মত আপন আনন্দে উনি বিভোর! সারা মুখে অনিন্দ্য সুন্দর এক স্বর্গীয় আভা ফুঠে উঠেছে! আশ্চার্য্য লাগল এই যুগেও, সমাজ সংসারে মানুষ নিজেকে এমন নির্মল রাখতে পারে কি করে? এই ভাবে যুথীর সাথে এরকম আচমকা দেখা হয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে আনন্দের না বেদনার, কতটা স্বস্তির আর কতটা অস্বস্তির সেসব অনুভবেরও সময় পাওয়া গেল না রমেনবাবুর এই আনন্দ লহরীতে! বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভদ্রলোকের প্রভায় সত্যিই কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম! নিজেকে কেমন যেন অকিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল! যুথীকে বল্লাম, তুমি ভাগ্যবতী ওঁর মতো মানুষ খুঁজে পেয়েছ!

-না না অমন কথা বলবেন না, প্রতিবাদ করে উঠলেন রমেনবাবু; আমারই সাতজন্মের পূন্য যে ওকে পেয়েছি!

সাত বছর আগের আমার কষা অংকটা যে কত বড় ভুল ছিল, সেটা নিজের অজান্তেই আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিলেন উনি! যে গ্লানিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ার কথা, আমায় পেয়ে ওনার আনন্দের জোয়ারে তা জানান দেওয়ার সুযোগটুকুও পেল না!

যুথীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম দৃষ্টি ওর আমার দিকেই নিবদ্ধ! মুখে যেন যুদ্ধ জয়ের দৃপ্ত দীপ্তি ওর ঠোঁট চাপা হাসিতে আলোকিত! বুঝলাম সাত বছর আগের বাজিটায় জেতার জয়টা ও বেশ উপভোগ করছে!

শ্রীশুভ্র