আড়ালে পড়ে থাকা নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লা।
প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জে রয়েছে মোগল আমলের অনেক স্থাপনা। তার মধ্যে একটি হলো হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লা দুর্গটি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নারায়ণগঞ্জ থেকে চিটাগাং রোড যেতে মাঝপথে নবীগঞ্জ গুদারাঘাটের একটু সামনেই, হাজীগঞ্জ ফায়ার ব্রিগেডের পরই হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লাটির অবস্থান। নারায়ণগঞ্জ সিটির হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরেই এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি অযত্নে অবহেলায় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
কোনো একসময় এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও সবার কাছে পরিচিত ছিল। নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোড ভায়া ডেমড়া আসা যাওয়ার মাঝেই এই কেল্লাটি সবার চোখে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে এই কেল্লাটির চারপাশে গড়ে উঠেছিল টিনশেড পাটের গোডাউন। সেসময় নারায়ণগঞ্জ পাট ও বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন সেই নাম-কাম না থাকলেও, কেল্লাটির চারপাশে গোডাউনগুলো এখনো দিব্বি রয়ে গেছে। পাটের নামগন্ধ নেই, অথচ গোডাউনগুলো চলছে ভাড়ায়। টিনশেড গোডাউন গুলোর জন্য মোগল আমালের প্রাচীনতম এই স্থাপনাটি অনেকেরই চোখে পড়ে না। কাজেই ইতিহাস ঐতিহ্যের সৌন্দর্য হারাতে বসেছে মোগল স্থাপত্য এই কেল্লাটি।
জানা যায়, কোনও একসময় ঢাকা শহর কে রক্ষা করতে এই কেল্লাটি নির্মাণ করেছিলেন। সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল। তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ বা কেল্লা। সম্ভবত মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এই দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। জলদুর্গের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত দুর্গটি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুরাতন বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। কেল্লাটি চতুর্ভূজাকৃতির। কেল্লাটিতে চার পাঁচটি প্রবেশদ্বার আছে। প্রবেশদ্বারগুলো দেখে মনে হয়, রাজা, বাদশাহ বা সম্রাটরা নৌযান থেকে নেমেই; খুব অল্পসময়ের মধ্যেই কেল্লায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হতো।
কেল্লাটি সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের ভেতরের সাইটে প্রায় তিন হাত চওড়া সরু রাস্তার মতো আছে। মনে এই রাস্তা দিয়ে সৈন্যদল হাঁটতো আর কেল্লার বাইরে নজর রাখতো। প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি বা বল্লম ছোড়ার উপযোগী ফোকর। আরও আছে চারকোণে গোলাকার বুরুজ। চারকোণের প্রতিটি বুরুজের অভ্যন্তর ভাগে দুর্গ প্রাচীরের শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত সিঁড়ি। এই বুরুজে কর্তব্যরত প্রহরী পাহারা দিতো। আছে কামান বসানোর উপযোগী সুউচ্চ বেদীর অবস্থান, এটি হলো দুর্গটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
ঐতিহ্যবাহী মোগল স্থাপত্য হাজীগঞ্জ কেল্লার সুউচ্চ সিঁড়ির প্রধান ফটক।
কেল্লাটির ভেতরে বিশাল জায়গা। দেখে মনে হয় এ যেন একটা ফুটবল খেলার মাঠ। হয়তো এই মাঠেই সৈন্যদল ট্রেনিং অথবা শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ করতো। মাঠের এক কোণে একটা সুরঙ্গ পথ ছিল। জানা যায় এই সুরঙ্গ পথ নাকি শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত বন্দর কেল্লার সাথে সংযোগ ছিল। বিপদের আশংকা টের পেলে সৈন্যদল এই সসুরঙ্গপথ দিয়ে অন্য কেল্লায় পলায়ন করত। তবে বর্তমানে সুরঙ্গটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ আছে। এই কেল্লাটি দক্ষিণ পাশে একটি খাল রয়েছে। এই খাল দিয়ে সেসময়ের রাজপ্রতিনিধিরা তাদের রাজকীয় নৌযান নিয়ে কেল্লায় আসতো। তাই এই খালটির নামকরণ করা হয়েছে কেল্লা খাল।
নারায়ণগঞ্জ টু ডেমড়া সড়কের মাঝপথেই এই খাল। মানুষ আর যানবাহন চলাচলের জন্য এই খালের উপরে প্রাচীন আমলেই একটা ব্রিজ তৈর করা হয়েছিল। হাজীগঞ্জ কেল্লার নামানুসারে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় কিল্লার পুল। ব্রিজটির পাশেই রয়েছে বিবি মরিয়মের সমাধিস্থান। যা বিবি মরিয়মের মাজার নামে সবার কাছে পরিচিত। জানা যায় সমাধিতে শায়িত বিবি মরিয়মকে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে ঐতিহাসিকরা ধারনা করে থাকেন।
কেল্লার ভেতরের পরিতপ্ত যুদ্ধের ময়দান। স্থানীয় ছেলেপেলেদের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ। রাখাল ছেলের গরুছাগল ছড়ানোর জায়গা।
হাজীগঞ্জ কেল্লাটির উত্তর পাশে এম সার্কাস নামক স্থানে রয়েছে একটি শাহী মসজিদ। মসজিদটি এম সার্কাস শাহী মসজিদ নামে সুপরিচিত। জানা যায়, আগেকার সময়ে কেল্লায় আসা রাজপ্রতিনিধিরা এই শাহী মসজিদেই নামাজ আদায় করতো। তাই এই মসজিদটি স্থানীয় মানুষের কাছে শাহী মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ কেল্লাটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হতে বসেছে। হাজীগঞ্জ গুদারাঘাট বা নবীগঞ্জ গুদারাঘাট হতে কেল্লায় প্রবেশ করার সিঁড়িটিও খসে খসে পড়ছে। প্রাচীরে শেওলা জমে একাকার। কেল্লার ভেতরে দিনের বেলা থাকে ছেলেপেলেদের খেলাধুলা আর গোরু ছাগলের ভিড়। রাতেবেলা কেল্লাটি সহ এর চারপাশ থাকে চোর বদমাশ আর নেশাখোরদের দখলে। সন্ধ্যার পর কেল্লাটির আশেপাশে সৃষ্টি হয় এক ভূতুরে পরিস্থিতি। এমনিতেই কেল্লাটির চারপাশে রয়েছে আগেকার সময়ে গড়া টিনের চালের বিশাল বিশাল পাটের গোডাউন। কালের বিবর্তনে এখন আর আগের মতন পাটের জয়জয়কার সময় নেই বলে, এসব গোডাউন এখন ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্নরকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি এসব টিনের গোডাউনের আড়ালে আবডালেই থেকে যাচ্ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে, হয়তো কোনও একদিন সত্যি সত্যিই নারায়ণগঞ্জের এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি ঝোপ জঙ্গলে ঢেকে যাবে। তাই এখন থেকেই স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ মোগল আমলের স্থাপনা কেল্লাটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া। তা না হলে হয়তো একদিন কেল্লাটি আর কারোর চোখেই পড়বে না। এমনটা যাতে না হয়, সেই আশাই করছি।