সুতোর টান

ছোট খাটো একটা চাকুরী জুটার বছর দুয়েক যেতে না যেতেই, পারিবারিক ভাবে কাননের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।

কানন আব্বার বন্ধুর মেয়ে, দু’জনেই ঠিকদার একই পেশার মানুষ; কাননের মা মানে আমার শ্বাশুড়ী আম্মা প্রাইমারী স্কুলের সহঃ শিক্ষিকা, আর আমার মা ভালো গৃহিনী বড় ছেলে আর মেজ মেয়ের সন্তানদের নিয়ে ৮/১০ বছর কাটাতে না কাটাতেই ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এখন ছোট ছেলের বউ দেখে শান্তিতে মরতে চান!
মাকে ভালবাসি বলেই অনিচ্ছা সত্বেও বিয়েতে রাজী হয়ে গেলাম।

কানন শ্যামলা হলেও ওর চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর, চিকন আঙ্গুলে আংটি গুঁজে দেওয়ার সময় কয়েক সেকেন্ডের জন্য একপলক দেখেছি মাত্র। ওর সাথে পুর্বে কখনোই আমার দেখা হয়নি তবে ওর বাবাকে আমি ভাল মতেই চিনতাম কাজের খাতিরে মাঝে মাঝে বাবার খোঁজে আমাদের বাসায় আসতেন।

কাননেই পরিবারের বড় মেয়ে অর্নাস ২য় বর্ষের ছাত্রী, আর ক্লাস টুতে পড়ুয়া ওর একটা ছোট ভাই আছে। হ্যাপী ফ্যামেলী। আংটি বদল পর্ব শেষ হতেই কাজী বাবাজীর বাড়িয়ে দেওয়া দেড় লাখ টাকা দেনমোহর উল্লেখিত বিবাহ রেজিষ্ট্রী নামায় আমার মত কাননও খসখস করে নিজের নাম লিখে দিলো, তার মুখের ঘোমটায় শুধু তার বাঁশির মত নাকটা ছাড়া কিছু চোখে পড়লো না।

পছন্দ-অপছন্দ গুলোকে বিসর্জন দিয়ে সারা জীবনের জন্য একে অপরের সাথে থাকার চুক্তিতে ওয়াদাবদ্ধ হলাম অথচ, আমরা কেউ কারো সম্পর্কে তেমন কিছু জানলাম না; জানলাম না বিয়ের অনুভুতি কেমন হয় বা জুটি বাঁধার আনন্দ কেমন! বাবা-বড় ভাইয়া, বোন জামাই, ২ চাচা ও ২ চাচাত বোন ছাড়া আমার একজন বন্ধুও উপস্থিত নেই- উপস্থিত নেই আমার গর্ভধারিণী মা আর একমাত্র বোন। মা হসপিটালে মাকে দেখাশোনা করছে মেজ আপু তাই তারা আসতে পারেনি।

মনে খচখচ করলেও প্রবোধ দিলাম আপাতত কাবিন করে রাখা হলো পাত্রী উঠানো হবে ৪ মাস বাদে কাননের পরীক্ষার পর, তাই বন্ধু-বান্ধবকে পরেও ম্যানেজ করা যাবে। তাতে যদি কেউ বিগড়ে যায় যাবে, আমার কোন আপত্তি থাকবেনা কারণ পরিবারের পছন্দে বিয়ে করতে হচ্ছে তাদের পছন্দের জন্য আমি সবকিছু বিসর্জন দিতে পারি।

৩দিনের ছুটি নিয়ে কাবিন নামায় স্বাক্ষর দিতে এসেছিলাম, শেষের দিন মাকে দেখতে গেলাম হসপিটালে। ক্যান্সারের থাবায় মায়ের শরীর বেডে লেপ্টে আছে কিন্তু মুখে চমৎকার হাসি- আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো ‘ঢাকায় গিয়ে যেন কাননের সাথে যোগাযোগ রাখি, তাতে মহব্বত নাকি বাড়বে আরো বললো কাননকে বিয়ে করাতে মা ভীষন খুশি’। সত্য কথা হলো, আমি কাননের ফেস খুব একটা মনে করতে পারছিনা লজ্জায় ওর দিকে একবার তাকিয়েছিলাম বটে চোখ দুটো ছাড়া তেমন খেয়াল নেই শুধু তার নাকটা বার বার আমার চোখে ভাসছে।

মা তো আর জানেনা যার দিকে তাকাতে পারলাম না, যাকে একটা কথাও বলতে পারলাম না; তার বা তার পরিবারের কারো কোন ফোন নম্বার আমার সংগ্রহে নেই।
যোগাযোগ তো মিশন ইম্পসিবল। শুধু হাঁ হু করে সত্যটা গোপন রেখে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাড়ি জমালাম ঢাকার পথে কর্মস্থলে……

ঢাকায় এসেছি ২ মাস ১৮ দিন,
আর ১মাস ১২ দিন পর কাননকে ঘরে তোলার কথা।
অথচ কানন বা কাননের পরিবার থেকে আমার খোঁজ খবর বা সৌজন্যমূলক কোন ফোন এলো না আমার ফোনে! এর মধ্যে বাবা আর আপু প্রতিদিন গড়ে ৫/৭ বার মায়ের শরীরের আপডেট জানিয়েছে যার ৯৫% হতাশা জনক আহাজারি। আকার ইঙ্গিতে আপুর কাছে কাননের কথা জানতে চেয়েছি হয় আপু আমার কথার অর্থ বুঝেনি নয়তো কৌশলে কানন প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে, আব্বার কাছে কাননদের বাসার নাম্বার চাইতে গিয়েও লজ্জা ভয়ে আর চাওয়া হয়নি- শেষে কি জানি কে ভেবে বসে তাই প্লান বাতিল।

ভরসা ছিলো মা, মা তখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিস্থলে কথা বলার পজিশনে মা আর নেই। বাকী রইলো বড় ভাইয়ের বউ ভদ্র মহিলার সাথে ১ যুগের আড়ি দেবর ভাবীর সম্পর্ক নেউল সাপে পরিণত হয়েছে তাই কোন আলোর পথ পেলাম না- ধীরে ধীরে কাননের সাথে বিয়ের ঘটনা রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগলো আমার কাছে।

কেউ কাননের সম্পর্কে কিছু বলতে চায় না কেন?
বন্ধুদের কাছে শেয়ার করা যায়না-
আমার দুর্বলতাকে অনেকে হাস্যরস চটি বানাতে পারে তাই নিজের কাছেই চেপে গেলাম। ধুর ছাই! ভাল্লাগে না!! কেন যে সেদিন মুখ ফুটে কাননের কাছে নাম্বার নিলাম না, সেদিন একটু সাহস করলে আজ এত এত চাপে ধরতো না নিশ্চিত।

নুর হোসেন সম্পর্কে

সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন অসম্ভব আত্মহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক; বাউন্ডুলে টাইপের একজন মানব সন্তানসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন অসম্ভব আত্মহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক; বাউন্ডুলে টাইপের একজন মানব সন্তান।

4 thoughts on “সুতোর টান

  1. গল্পটি পড়লাম নুর হোসেন ভাই। ভালোবাসা নেবেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. পাঠক হিসেবে আপনার পোস্টে অনেক অনেক শুভেচ্ছা রেখে গেলাম। ধন্যবাদ।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।