ভালোলাগা তিনটি অসাধারণ অনুগল্প

নিমগাছ
বনফুল

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ। কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে। এমনি কাঁচাই….. কিংবা ভেজে বেগুন- সহযোগে। যকৃতের পক্ষে ভারী উপকার। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক…। দাঁত ভালো থাকে। কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হন। বলেন- নিমের হাওয়া ভাল, থাক, কেটো না। কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না। আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে। শান দিয়ে বাধিয়েও দেয় কেউ- সে আর এক আবর্জনা। হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বলে উঠলো, বাঃ কি সুন্দর পাতাগুলো…..কি রূপ। থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার….এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ! খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল। কবিরাজ নয়, কবি। নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে। ওদের বাড়ীর গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মী বউটার ঠিক এই দশা।

বার্লিন
ম্যারি বয়লি ও’রেইলি

(অনুবাদঃ মোজাফ্ফর হোসেন)

একটি ট্রেন হামাগুড়ি দিয়ে বার্লিন ছেড়ে আসছিল। ট্রেনের প্রতিটা বগি নারী ও শিশুতে গিজগিজ করছিল। সুস্থ-সবল দেহের পুরুষ মানুষ সেখানে ছিলো না বললেই চলে। একজন বয়স্ক মহিলা ও চুলে পাক ধরা সোলজার পাশাপাশি বসে ছিলেন। মহিলাটিকে বেশ রুগ্ন ও অসুস্থ দেখাচ্ছিল। তিনি গুনে চলেছেন- ‘এক, দুই, তিন’, ট্রেনের মতোই আপন ধ্যানে স্বল্প বিরতি দিয়ে। ট্রেনের একটানা ঝিক্ঝাক্ শব্দের ভেতরেও যাত্রীরা তার গণনা দিব্যি শুনতে পাচ্ছিল। দুটি মেয়ে বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করছিল। বলাই বাহুল্য, তারা মহিলার গণনা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিল। মেয়ে দুটোকে উদ্দেশ্য করে একজন মুরব্বী গোছের লোক বিরক্তিসূচক গলা খ্যাঁকানি দিয়ে উঠলে কক্ষটিতে এক ধরনের হালকা নীরবতা এসে ভর করলো।
‘এক, দুই, তিন’- মহিলাটি শব্দ করে গুণলেন, যেন পৃথিবীতে সেই একমাত্র বাসিন্দা। মেয়ে দুটি আবারও খুকখুক করে হেসে উঠলো। বোঝা গেল তারা হাসিটা চেপে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়েছে। পাশে বসা বয়স্ক সোলজার সামনের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে ভারী গলায় বললেন- ‘শোনো মেয়েরা, আশা করি আমার কথাগুলো শোনার পর তোমরা আর হাসবে না। এই অসহায় মহিলাটি আমার স্ত্রী। কিছুক্ষণ আগেই আমরা যুদ্ধে আমাদের তিন সন্তানকে হারিয়েছি। যুদ্ধের সম্মুখভাগে অগ্রসরের আগে আমি তাদের মাকে একটা বিকারগ্রস্ত চিকিৎসাকেন্দ্রে রাখতে যাচ্ছি।’
কক্ষটিতে ভয়ঙ্কর নীরবতা এসে ভর করলো।

কথা
স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আমি বনগাঁ লাইনের গোবরডাঙা শ্যামসুন্দর বিদ্যামন্দিরের মাস্টার। চারটে ছ’য়ের ডাউন বনগাঁ লোকালে উঠে বাড়ি ফিরি। একটা নির্দিষ্ট কামরা আছে আমাদের। মছলন্দপুর থেকে দুজন মাস্টারমশাই ওঠেন। ওই দুজনের জন্য জায়গা রাখি।
যে কামরায় উঠি, সেই কামরার জানালার ধারে মুখোমুখি সিটে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা বসেন। ভদ্রলোক বই পড়েন, ভদ্রমহিলাও বই পড়েন। ভদ্রলোকটি কী বই পড়েন আড়চোখে দেখেছি। রামকৃষ্ণ কথামৃত, ভারতের সাধক, চৈতন্যচরিতামৃত এইসব। ভদ্রলোকটির বয়েস ষাটের মতো, ভদ্রমহিলারও প্রায় ওরকম। ভদ্রলোকের মাথায় টাক, ভদ্রমহিলার মুখে শ্বেতির চিহ্ন। ওরা দুজনে একই কামরায়, একই ট্রেনে বহুদিন। ভদ্রমহিলাও পড়েন। নব কল্লোল, বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা। কোনোদিনই কথা বলতে দেখিনি ওদের। ভদ্রমহিলা হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে যান। স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকবার একটু আগে ভদ্রমহিলা সিট ছেড়ে উঠে রোজই বলেন- এসে গেলাম, আসি। আবার কাল কথা হবে কেমন?
ভদ্রলোক বই থেকে চোখ তুলে বলেন- হ্যাঁ, আবার কাল কথা হবে।

8 thoughts on “ভালোলাগা তিনটি অসাধারণ অনুগল্প

  1. নিম গাছের গুণাগুণ বলে শেষ হবে না, চমৎকার বর্ণনা। রেলে বই পড়ার সুন্দর চিত্র পড়লাম।
    ভালো লাগলো। স্যার ভালো লাগা জানালাম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. ধন্যবাদ আপনাকে।

      আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

  2. আমারও দৃষ্টিতে এই তিন অসাধারণ অনুগল্প সাহিত্য জগতের অনন্য দৃষ্টান্ত।

  3. বাংলা ভাষায় সম্ভবত প্রথম অণুগল্প বনফুল লেখেন। তাঁর সেরা অণুগল্পগুলোর মধ্যে অবশ্যই নিম একটা। অণুগল্পের স্টান্ডার্ড এখনো বনফুলই। দ্বিতীয় গল্পটির অনুবাদ আমার কাছে অত ভাল লাগে নি। অনুবাদের কারনে গল্পটি মার খেয়েছে বলব। তবে তিনটির মাঝে নিমই সেরা।

    আমাদের দেশে অনেকে অণুগল্প লেখেন। ইদানিং অণুগল্পের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। তবে অনেকে মনে রাখতে পারেন না, সাইজে অণু হলেই অণুগল্প হয় না।

    1. অনুগল্পে অল্পকথনের ভেতর দিয়ে অনুভবের বিষয়টি উঠিয়ে আনা হয়। প্রখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭)-এর মতো অনেক কবি ক্ষুদে গদ্য-কবিতা (prose poetry) লিখেছেন যেগুলোকে অনুগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। অন্যদিকে হালের জনপ্রিয় মার্কিন কবি ও গল্পকার স্টুয়ার্ট ডাইবেক (জ. ১৯৪২)-এর অনেক অনুগল্প গদ্য-কবিতা হিসেবে কবিতার কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কবিতা এবং ছোটগল্প দু’য়ের বৈশিষ্ট্যই অনুগল্পে বিদ্যমাণ।

  4. দীলখুশ মিঞার পক্ষ থেকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif
    হাই হ্যালো।
    আপনার কল্যান হোক।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।