দিন দিন মানুষ নামের প্রাণীটি যেন অন্য রূপ ধারণ করছে। অন্য রূপ মানে অন্য চরিত্র, অন্য স্বভাব, অন্য বৈশিষ্ট্য। মানুষ কাকে বলে, কী করলে মানুষ হওয়া যায়, শুধু মানুষের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় কিনা- প্রশ্নগুলো এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরও রয়েছে, তবে বিবিধ। মানুষ শব্দটি এসেছে মনুষ্য থেকে, ডিকশনারিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এমন- “যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে সে-ই মানুষ। মনুষ্যত্ব হলো মানুষের চিরাচরিত বা শাশ্বত স্বভাব বা গুণ।” যেমন দয়া-মায়া, ভালোবাসা, পরোপকারিতা, সহানুভূতি, সম্প্রীতি, ঐক্য ইত্যাদি। যুগে যুগে মানবজাতি তাদের বাস্তব জীবনে এই গুণগুলোর যথাসাধ্য প্রয়োগ ঘটিয়েছে। মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে সবাই নয়। ভালো-মন্দ, কৃতজ্ঞ-কৃতঘ্ন, পরোপকারী-স্বার্থবাদী দুই ধরনের মানুষেরই পদচারণা ঘটেছে এই নিখিল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে। তারা সকলেই মানবতা-মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদেরকে মানুষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয় নি। যাদের কর্মকাণ্ডে মনুষ্যত্বের চিরন্তন-সনাতন প্রতিফলন ঘটে নি তারা মনুষ্যত্বহীন, তথা ধর্মহীন। আর ধর্মহীন মানবসন্তানকে কখনই মানুষ বলা যায় না, মানুষ নামের মর্যাদা তার শোভা পায় না। যারা কাজে-কর্মে মনুষ্যত্বের পরিচয় প্রদান করতে পারে কেবল তারাই মানুষ নামে পরিচিত হবার যোগ্য। তাদের সম্মান অতি উচ্চ। স্বয়ং স্রষ্টার গুণ প্রকাশিত হয় তাদের মধ্য দিয়ে। জগতে তারা নন্দিত হন ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ বলে। তাদের উপস্থিতি পৃথিবীকে আলোকোজ্জ্বল করে। ধর্মানুরাগীদের সঠিক মার্গ প্রদর্শন করে ও অধার্মিকদের দণ্ড প্রদান করে তারা পৃথিবীকে শান্ত রাখেন। অর্থাৎ মানুষ ও অমানুষ বলতে যথাক্রমে ধার্মিক ও অধার্মিককে বোঝায়। যে ব্যক্তি মনুষ্যত্ব বা মানবতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সেই প্রকৃত ধার্মিক, অন্যদিকে যে ব্যক্তির মাঝে মানবতা নেই সে অধার্মিক। একইভাবে যে ব্যক্তি ধর্মের পথে চলে সে-ই মানুষ, আর যে অধর্মের পথে চলে সে অমানুষ।
এই ধর্ম ও অধর্মের দ্বন্দ্বই মানবজাতির প্রকৃত অতীত। বর্তমানও তাই। ভবিষ্যতেও এরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এরই অংশ হিসেবে কালচক্রে এমন সময় এসেছে যখন সমাজ পুরোপুরিই ধর্মাবৃত হয়ে গেছে। অধর্ম পুরোপুরি নাশ হয়েছে। সমাজ শান্তি-সমৃদ্ধি-সৌহার্দ্য, মানবতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। স্বর্গের মতো অবারিত সুখ-শান্তির দ্বার খুলে গেছে, যে ইতিহাসগুলো আজকাল রূপকথার মতো শোনায়। আবার এমনও হয়েছে যে, সমাজে অধর্মের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারণে ধর্মকে থাকতে হয়েছে কোণঠাসা হয়ে।
এখানে একটি কথা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অধর্মের মাত্রা বৃদ্ধি পায় কীভাবে? সাধারণভাবে মনে হতে পারে- ধার্মিক লোক কমে যাওয়া, সকলে ধর্মকর্ম পরিত্যাগ করে অধর্মের পথে ধাবিত হওয়া। কিন্তু আসলে তা নয়। ইতিহাস এটাই বলছে যে, ধার্মিক সকল সমাজে, সকল জাতিতেই ছিল, কিন্তু তথাপি অন্যায়-অবিচার, অশান্তি, অধর্ম বেড়ে যাবার কারণ হলো ঐ ধার্মিকরা ধর্ম মনে করে যা করেছে তা আসলে প্রকৃত ধর্ম নয়। তারা প্রকৃত ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে বিকৃত ধর্ম পালনে নিয়োজিত হয়েছে। কিন্তু বিকৃত ধর্ম যখন শান্তি আনয়নে ব্যর্থ হয়েছে তখনই ঘটেছে যত অশুভ, অকল্যাণকর কর্মকাণ্ড, ভোগ করতে হয়েছে অনিবার্য পরিণতি।
ইহুদিদের নবী রাজা দাউদ বা কিং ডেভিড (আ:) এর সময় যে শান্তির রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল তা ছিল সত্যধর্মের অনুসরণের ফল। হিন্দুশাস্ত্রে রামরাজত্বের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাও ছিল ঐ সত্যধর্মের অনুসরণের ফল। আবার মুসলিমদের স্বর্ণযুগখ্যাত ইসলামের প্রাথমিক যুগে অর্ধপৃথিবীব্যাপী যে অকল্পনীয় শান্তি-সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাও ছিল সত্যধর্মের বিধান অনুযায়ী চলার ফল, মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করার পুরস্কার। কিন্তু ইউরোপের মধ্যযুগের যে বর্বরতা মানবজাতির ইতিহাসে আজও কলংক হয়ে আছে সেটা ধর্মের ফল ছিল না, শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী মুসলিম সমাজে যে বিভেদ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অন্ধত্ব, পশ্চাদপদতা ইত্যাদি গ্রাস করে আছে সেটাও ধর্মের ফল নয়। এগুলো বিকৃত ধর্মের পরিণতি। যখন ধার্মিকরা অধর্মকেই ধর্মকর্ম সাব্যস্ত করে ধর্মীয় মর্যাদায় সেগুলো পালন করে চলে তখনই জন্ম হয় এমন অশান্তির।
বস্তুত কোনো সমাজে ধর্ম আছে কিনা তা যাচাই করার প্রথম ও প্রধান উপায় হলো সে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত আছে কিনা তা দেখা। ধর্মের ফল শান্তি, অধর্মের ফল অশান্তি। এ কারণে শেষ নবীর আনীত সত্যদীনের নাম ‘ইসলাম’, যার শাব্দিক অর্থই হলো শান্তি। অর্থাৎ সেটাকে প্রতিষ্ঠা করলে তার অনিবার্য ফলাফল হবে অনাবিল শান্তি। যুগে যুগে যতো নবী-রসুল-অবতার এসেছেন, যত দীন, শাস্ত্র বা জীবনব্যবস্থা এসেছে তার সবগুলোই ছিল ইসলাম। কারণ- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল জীবনব্যবস্থারই ফলাফল হচ্ছে শান্তি। তাই আল কোর’আনে আল্লাহ বলছেন- আমার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) হলো ইসলাম (শান্তি)। (সুরা আল এমরান, ১৯) এর মর্মার্থ এই যে, তিনি যুগে যুগে যে দীনগুলো পাঠিয়েছেন এবং যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে- সেই জীবনব্যবস্থাগুলোই কেবল তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য। এর বাইরে যে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে শান্তির পরিবর্তে মানবসমাজে কেবল অশান্তিই বৃদ্ধি পায় সেগুলো অগ্রহণযোগ্য, সেগুলো ইসলাম নয়।
আজ সমস্ত পৃথিব্যাপী অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। চারদিকে অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ-রক্তপাত, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, শোষণ, বঞ্চনা আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষিত আদম সন্তানের ক্রন্দন আর হাহাকারে পৃথিবী পরিণত হয়েছে এক অভিশপ্ত আতঙ্কের পুরীতে। কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতি নয়, সকল ধর্মের অনুসারীই এই আতঙ্কপুরীতে মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে আছে। অর্থাৎ প্রচলিত কোনো ধর্মই মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। এর কারণ এই সব জাতিগুলোই তাদের নবী-রসুল-অবতারগণের আনীত সত্যধর্ম থেকে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গেছে। তারা কার্যত কেউই প্রকৃত ধর্মের অনুসারী নয়। তারা ধর্মের খোলসে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে অধর্মের বীজ বপন করে চলেছে। অর্থাৎ মানুষ অধর্মকেই ধর্ম মনে করে পালন করছে আর ভাবছে- ‘আমরা বুঝি খুব ধর্মকর্ম করছি, স্রষ্টা আমাদের প্রতি অতি প্রসন্ন রয়েছেন, স্বর্গ হতে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছে।’ কিন্তু বাস্তবে তারা অধর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে স্রষ্টার ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়েছে।
এই পার্থিব নরক থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় একটিই- প্রকৃত ধর্মকে বরণ করে নেওয়া। ধর্মের নামে অধর্মের ডালপালা বিস্তার বন্ধ করা। মানবসমাজে একটি ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে, ‘পৃথিবীতে এতগুলো ধর্মের মধ্যে মাত্র একটি ধর্ম সত্য হতে পারে (!) অন্য সকল ধর্ম মিথ্যা এবং ঐ সত্য ধর্মই কেবল মানুষকে মুক্তি দিতে সক্ষম।’ এ ধারণা প্রচলিত থাকায় সকল ধর্মের অনুসারীরাই দাবি করে যে, কেবল তাদের ধর্মই সত্যধর্ম। এটা ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম মেনে চলে স্বর্গে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল ধর্মই সত্যধর্ম। এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর যে কোনোটি মানুষ মেনে চলতে পারে। তবে মানতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় জীবনে একমাত্র স্রষ্টাকেই সার্বভৌম বিধানদাতা হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করলে যে কোনো ধর্মের মানুষই শান্তি পাবে। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূরিভূত হবে। কেবল তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে খ্রিস্টানদের কাক্সিক্ষত কিংডম অব হ্যাভেন, হিন্দুদের কাক্সিক্ষত রামরাজত্বের শান্তি তথা সত্যযুগের পুনরাবৃত্তি এবং মুসলিমদের কাক্সিক্ষত স্বর্ণযুগের শান্তি। শান্তি-অশান্তি, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্বে তখন জয় হবে সত্যের, জয় হবে ধর্মের, জয় হবে শান্তির।
যে ব্যক্তি মনুষ্যত্ব বা মানবতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সেই প্রকৃত ধার্মিক, অন্যদিকে যে ব্যক্তির মাঝে মানবতা নেই সে অধার্মিক। একইভাবে যে ব্যক্তি ধর্মের পথে চলে সে-ই মানুষ, আর যে অধর্মের পথে চলে সে অমানুষ।
শান্তি-অশান্তি, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্বে জয় হবে সত্যের, জয় হবে ধর্মের, জয় হবেই শান্তির।
ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় …
স্বাগতম মি. সালজার রহমান সাবু।
আবার আসিব ফিরে এই পোষ্টে—
পড়লাম লেখাটি।
পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ।