নদী ও জীবন…

001

জন্মভূমি নিয়ে আমার কোন উচ্ছ্বাস নেই। নেই বিশেষ কোন টান। যে নাড়ির টান বছরের পর বছর ধরে দীর্ঘ ও শক্ত হয়েছিল তা ঢিলে ও সংকুচিত হয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। চাইলেও তা আগের মত জোরা লাগাতে পারিনা। লাগানোর ইচ্ছা আছে তাও নয়।তবু এখানে ফিরে আসি। কেন আসি তার কোন উত্তর নেই। হতে পারে বুকের ভেতর লুকানো কিছু দীর্ঘশ্বাস বাইরে এনে নিজকে হালকা করার তাগাদা।

সব বিবেচনায় কেন জানি মনে হচ্ছে এটাই হয়ত আমার শেষ আসা। দৈব ও অলৌকিক কিছু না ঘটলে এখানে তেমন কিছু করার নেই আমার। হুট হাট করে ছুটে আসার প্রেক্ষাপট গুলো এখন অতীত।

সে সব সোনালী অতীতের মূলে ছিলেন আমার মা। পৃথিবীর যে কোনায়ই ছিলাম না কেন তিনি ডাকলে আমি আসতাম না এমনটা ছিল অসম্ভব। বছরে দু’বার তিনবারও ছিল আমার আসা যাওয়া। হোক তা অস্ট্রেলিয়া অথবা দূরের দেশ আমেরিকা হতে। কেবল সোভিয়েত দেশের ১২ বছর ছিল ব্যতিক্রম। চাইলেও আসার সুযোগ ছিলনা সময়, সুযোগ ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে।

002

003

004

আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। শীতের জরাজীর্ণ দৈন্যতা, বর্ষার ভরা যৌবন, বসন্তের মৌ মৌ গন্ধ, সবকিছু পাশে নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি।

এ নদী ছিল আমার সবকিছুর সাক্ষী। নিজের কষ্টগুলো ভাগাভাগি করার একমাত্র মাধ্যম। প্রতি মাঘে নদীর তীর ঘেঁষে জমে উঠা বাউলের মেলা ছিল স্বপ্নের মত। এক মাঘ শেষ হলে অন্য মাঘের আশায় দিন গুনতাম তীর্থের কাকের মত। গুণটানা নৌকার পালে হাওয়া লাগার জন্যে প্রার্থনায় বসে যেতাম। যারা কাঁধে করে এ ভার বইতো তাদের কষ্ট চোখ ঝাপসা করে দিত।

সে নদী আজও আছে। বয়ে যাচ্ছে আগের মতই। বদলে গেছে অনেক কিছু। গুণটানা নৌকা এখন দৃশ্যপট হতে মুছে যাওয়া কিছু স্মৃতি। এ স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে গল্প করলে হয়ত বিশ্বাস করবেনা।

নদীর ওপারটা ছিল দ্বীপের মত। চর অঞ্চল হিসাবে জানতাম আমরা। আধুনিক সুবিধার ছিটেফোঁটাও ছিলনা ঐ এলাকায়। বিদ্যুতের আলো দেখতে নদী পাড়ি দিয়ে অনেকে আসতো এ পাড়ে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকত ঢাকা হতে চট্টগ্রাম-গামী ট্রেনগুলোর দিকে।

005

006

007

008

এলাকার মানুষ ধরেই নিয়েছিল এটাই তাদের জীবন। নদী পাড়ি দিয়ে জীবিকার সন্ধানে শহরের অলিগলিতে ঢুঁ মারা, দিন শেষে সদাই করে ঘরে ফেরা… এভাবেই কেটে যেত পুরুষদের জীবন।

সে নদীতে এখন সাঁকো হয়েছে। বিদ্যুতের আলো এখন ঘরে ঘরে। নদীর এপার এখন আর দূরের দেশ নয়, বরং বাড়ির আঙ্গিনা। পরিবর্তনের ছোঁয়া ঘরে ঘরে।

ঘাটে হতে এখনও লঞ্চ ছেড়ে যায়। কোথায় যায় তা কোনদিনও জানা হয়নি। শুনেছি কুমিল্লার হোমনার দিকে যায়। একটা সময় ছিল যখন লঞ্চই ছিল দাদাবাড়ি যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। এখন হয়ত সে পথ বন্ধ। কারণ সড়ক পথের উন্নতি হয়েছে। শুক্রবার সকালে এক বিয়েতে যোগ দিতে দাদাবাড়ি যাচ্ছি। আমার ছোট ভাই নিশ্চয়তা দিল ওখানে পৌঁছতে বিশ মিনিটের বেশি লাগবেনা। আসলে বদলে গেছে মানুষের জীবন।

১০ বছর আগেও ছুটিতে বেড়াতে এলে রাস্তায় পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হয়ে যেত। মেঘনায় যাওয়ার রাস্তা ধরলে একে একে অনেক সালাম দিত। আগ্রহভরে জিজ্ঞাস করত কবে আসলাম, কতদিন থাকবো। পাশের টং হতে বেরিয়ে এসে হাউমাউ করে লংকা কাণ্ড বাধিয়ে বসত কেউ কেউ। জোর করে টংয়ে ঢুকিয়ে এক কাপ চা আর একটা সিঙ্গারা খাওয়ার দাওয়াত দিত। অনেকের কাছে এ ছিল দেনা শোধের মত। মনে করিয়ে দিত আমি নাকি তাকে আমাদের শিল্প কারখানায় শ্রমিক অথবা দারোয়ানের চাকরি দিয়ে কৃতজ্ঞতায় দায়ে আবদ্ধ করেছি। এ চা, এ সিঙ্গারা সে দায় হতে মুক্তি পাওয়ার আকুল চেষ্টা।

আজ আবার সে পথে হেঁটে গেলাম। চারদিকের টং গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। ওদের ব্যবসা এখনো চালু আছে। এক দোকানে দেখলাম গরম গরম পরোটার সাথে ভাজি দিয়ে নাস্তা খাচ্ছে অনেকে। অনেক দোকান হতে কোরান তেলাওয়াত ভেসে আসছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন হিন্দি গানের প্লাবনে ভেসে যেত গোটা এলাকা।

আজ একটু ধীরেই হাঁটলাম। আশায় ছিলাম হয়ত দোকান হতে কেউ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে আমার কুশল। নাস্তা খাওয়ার জন্যে কেউ টানাটানি করলে আজ ইচ্ছা ছিল না করব না। বসে পরবো বিনা বাধায়। অথচ একটা সময় ছিল যখন আমাদের পরিবারের কারও জন্যে ওসব দোকানে কিছু খাওয়া ছিল ‘অসম্মানের’।

না, আজ আর কেউ ডাকেনি। কেউ সালামও দেয়নি।
বদলে গেছে প্রজন্ম। বদলে গেছে মানুষের জীবন। সাথে বদলে গেছে মানুষের বেঁচে থাকা।

সব বিবেচনায় নিজকে মনে হল আগন্তুক। জীবনের সমীকরণ মেলানো প্রবাসী কেউ। এমন প্রবাসী এখন ঘরে ঘরে। এসব নিয়ে কারও কোন কৌতূহল নেই। মানুষ চলছে জীবনের সন্ধানে। মিশে যাচ্ছে জীবন যুদ্ধে। সেখানে আমার মত কাউকে যেচে এসে সালাম দেয়ার যথেষ্ট সময় নেই কারও হাতে।

পরনের লুঙ্গিটা ছিল বিপদজনক সঙ্গী। সব সময় সচেতন থাকতে হয়েছে কখন ইজ্জতের সবকটা চেম্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়।

আমার একটাই লুঙ্গি। এর বয়স কম করে হলেও ২০ বছর। দেশে আসার সময় নিয়ে আসি। ফেরার পথে সাথে করে নিয়ে যাই। কেবল আমার শহরে এলেই আমি শহুরে লেবাস হতে বের হয়ে ফিরে যাই সোনালী অতীতে।
ভাল থেকো প্রিয় শহর। সুখে থেকো শহরের মানুষ। আমার কথা মনে হলে নদীর কাছে যেও। এ নদী ও আমি একই নাড়ির। দুজনকে আলাদা করে দেখতে যেওনা।

009

010

011

013

014

015

017

018

2 thoughts on “নদী ও জীবন…

  1. অসামান্য স্মৃতি গাঁথা। সব মিলিয়ে ভালো থাকবেন সর্বদা এই প্রত্যাশা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।