রাজ পথটা সোজা এসে মিলেছে পান্থশালা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ায় হেম আর হিয়া। তখনো শহর জাগেনি। ভোরের সূর্যালোকের স্নিগ্ধ আভা দুজনের ধরে থাকা হাতে চুমু দিয়ে আমন্ত্রন জানায় সকালের শহরে। ওরা হাটতে হাটতে ঢুকে পড়ে প্রথম গলিতে। গলিটির তিনটি বাড়ির পরের বাড়িটি রাজার বাড়ি। রাজার বাড়ির সামনে সবুজ ঘেরা স্বচ্ছ জলের সরোবর। হেমের খুব রাগ হয়। এখানে স্বচ্ছ জলের বদলে সে দেখতে চায় লাল শাপলা আর শ্বেত পদ্মের বাসর। হিয়া শক্ত করে ধরে রাখে হেমের হাত। হেম তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আবার তাকায় জলের দিকে। একটা মাছরাঙ্গা ভুল করে পুটি ভেবে ঠোকর দিয়েছে মস্ত এক কাতলার চোখে। কাতলার লেজের জলে ভিজে মাছরাঙাটা দৌড়ে পালায় ছাতিম গাছের মগ ডালে। দৃশ্যটা দেখে হিয়া খুব হাসতে থাকে।
হিয়ার প্রাণ খোলা নিষ্পাপ হাসি দেখে হেম আনমনা হয়, ভাবে কেন সে নিজে এমন করে হাসতে পারে না। অথচ হেম চায় এমনি করে হাসতে। হেম খুব জোরে হিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয় বকুল গাছের ছায়ার নিচে। হিয়া অবাক হয় না তাতে। কারন হিয়া হেমের এই স্বভাবের সাথে অনেক আগে থেকেই খুব বেশি পরিচিত। রাজার বাড়ি আর লেকের মাঝে চওড়া যে পায়ে হাটা পথ তার পুরোটাই বকুল গাছের ছায়া দিয়ে মোড়ানো। মনে মনে হেম ভাবে তবে কি বকুল রাজার খুব পছন্দের ফুল।
হেমের খুব জানতে ইচ্ছে করে রাজা কি কখনো খালি পায়ে শিশির মাড়িয়ে বকুল কুড়িয়েছে তার প্রিয়ার জন্য? কে দেবে উত্তর ? রাজা তো আর নেই। হেম হিয়াকে এই রাজার গল্প, এই রাজ্যের গল্প বলতে বলতে হাটতে থাকে সামনে, বকুলের বুকে পা রেখে। হিয়া কে চেনায় ফুল, ফল, গাছ, পাখি। হঠাৎ একটা কাঠগোলাপের গাছ চোখে পড়ে। সাদা ক্যানভাসে হলুদের জলরঙ ছোয়া। হাল্কা একটা মিষ্টি গন্ধ। হিয়া কে নিয়ে সে এসে দাড়ায় কাঠগোলাপ গাছটির নিচে। গন্ধটা আরো তীব্র হয়। হেম ফিরে যায় পেছনে ৩০ বছর আগে। হিয়া কিছুই বোঝে না। সে ফুল পেয়ে খুশী। হিয়া বোঝে না জীবনের কিছুই, সে শুধু আদরের কাঙ্গাল। আবার তারা হাটতে শুরু করে। হেম মোবাইলে সময় দেখে নেয়। দেরী হয়ে গেছে আজ। কাঠের সেতু পেড়িয়ে হিয়াকে নিয়ে যখন সে এসে পৌঁছায় স্কুলের গেটে তখন এসেম্বলি শুরু হয়ে গেছে। হিয়া “বাই বাবা” বলে দৌঁড়ে স্কুলে ঢুকে যায়। হেম কান পেতে দেয়, সোনা-মানিকেরা গাইছে-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। হেম তার জীবনে অনেক বার অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে এই গান শুনেছে কিন্তু আজ অব্দি কোন শিল্পী স্কুলের এসেম্বলিতে গাওয়া এই গানের সুর, আবেগ আর প্রত্যয়কে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।
হেম টের পায় তার চোখের দুফোঁটা জল হাতে ধরা কাঠগোলাপের পাপড়িতে। হেম চোখ মোছে। সামনে তাকিয়ে দেখে নেয় কোন পথে ফিরবে। চোখে পড়ে স্কুলের সামনে অনেক বড় একটা কাঠগোলাপের গাছ আর ঠিক তার নিচে দাঁড়িয়ে একজন। তার হাতে ধরা সাদা ক্যানভাসে হলুদের জলরঙে আকা একটা কাঠ গোলাপ। যেমন করে ৩০ বছর আগে একটা কাঠগোলাপ হাতে স্কুল শেষে হেমের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো রূপকথা। হেমের খুব জানতে ইচ্ছে করে মেয়েটির হাতের কাঠগোলাপের পাপড়িটিও তার চোখের জলে ভেজা কিনা।
সিদ্ধ হাতের লিখা যে কোন মানসিকতার পাঠকদের পাঠক-প্রিয় হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। কবি জিয়া রায়হান এর আজকের গল্প আয়োজন নিঃসন্দেহে অসাধারন।
সুন্দর একটা লেখা পড়লাম।