জিয়া রায়হান এর সকল পোস্ট

পিকনিকের হাসি-কাঁন্না

fd

১৯৮২ সাল। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। কলেজের পিকনিক হয়, হবে করে করেও প্রথম বছর পেরিয়ে গেলো। আমাদের ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবী সবার মনের মধ্যেই ইচ্ছের সাত রং পাখার প্রজাপতিটা মরতে শুরু করলো। সবায় চায় পিকনিক কিন্তু কোন শিক্ষক এগিয়ে এসে দায়িত্ব নেয় না। শেষে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে আমাদের কেমেস্ট্রি স্যারকে রাজি করালাম। স্যার রাজি হয়ে প্রমাণ করলেন রসায়নের টিচার বলেই হয়ত তার যথেষ্ট রস আছে এখনো। আমরা স্যারের নামে ধন্য ধন্য রব তুললাম। পিকনিকের স্থান নির্বাচিত হলো যশোরের পিকনিক কর্ণার। যারা পিকনিকে যাবে বলে কনফার্ম করেছে তাদের বুকের মধ্যে প্রতিদিনই একটা চিকন আনন্দ নূপুর পায়ে নেচে বেড়াচ্ছে। আমরা যাবো ট্রেনে করে। আমরা সবাই খুব খুশী বিশেষ করে ছেলেরা। লম্বা ট্রেন ভ্রমনে ক্লাসের মেয়েদের সাথে খুনসুটির এক মহা সুযোগ পাওয়া যাবে। স্যার সবাইকে নিয়ে মিটিং করলেন। বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন দুই-তিন জনের একটি একটি গ্রুপ করে। আমি আর মুসা মিলে এক গ্রুপ এবং আমাদের দায়িত্ব পরলো পিকনিকের খাসী কেনার এবং দুইটা খাসীর দেখভাল করে পিকনিক স্পট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এক কথায় আমরা হলাম খাসির কেয়ার টেকার।

নির্ধারিত দিনে আমরা সবাই জয়পুরহাট রেল স্টেশনে। কলেজের সামনেই রেলস্টেশন। যথা সময়ে পার্বতীপুর-খুলনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি এসে দাঁড়ালো প্লাটফর্মে। সবাই সবার মতো করে উঠে পড়লো ট্রেনে। সবার শেষে আমি আর মুসা পরম আদরের সাথে সর্ব শক্তি দিয়ে কোলে করে খাসী দুটিকে উঠলাম ট্রেনে কিন্তু এর মধ্যে যা হবার তাই হলো। কোলে করে ট্রেনে উঠবার সময় অতি আদরে আদোরিত হয়ে ব্যাটা খাসী আমার গায়ে দিলো হিসি করে। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সারা গায়ে ছাগলের পেচ্ছাবের গন্ধ। বন্ধুরা কেউ পাশে বসতে নেয় না। পাশে বসা তো দূরের কথা, বান্ধবীরা তো আমাকে দেখলেই মুখে ওড়না চেপে ধরে। আমার সকল আশায় গুড়েবালি। যে বান্ধবীর পাশে বসবো বলে এতদিন মনে মনে ভেবেছি, ছবি এঁকে রেখেছি সেই কিনা গিয়ে বসলো স্যারের পাশে। হায়রে কপাল। হায়রে ছাগল, এতো আদর করে কোলে করে ট্রেনে উঠালাম আর সেই তুই কিনা দিলি আমার গায়ে পেচ্ছাব করে। কপাল আমার।

যাক, যথা সময়ে যশোর পৌঁছালাম। মাইকের দায়িত্বে যারা ছিলো তারা মাইক লাগিয়ে তাদের পছন্দ মতো গান বাজতে লাগলো। কখনো কখনো মনের না বলা কথাগুলো গানের ছলে নিজের পছন্দের মানুষটিকে বলার চেষ্টায় কেউ কেউ নিজেকে ব্যস্ত রাখলো। রান্নার আয়োজন শুরু করেছে একদল। কসাই এনে খাসি জবাই শেষ করেছি। কসাই উপর দায়িত্ব দিয়ে আমি আর মুসা কাউকে না জানিয়ে চুপ করে চলে এলাম রিক্সা নিয়ে সোজা সিনেমা হলে। এ-এক কঠিন নেশা তখন। নতুন সিনেমা কোন ভাবেই মিস করা যাবেনা। তা যা কিছুর বিনিময়ে হোক। আর তা যদি হয় সোহেল রানা আর সুচরিতার সিনেমা। আমরা মনে মনে হিসেব করে নিয়েছি রান্না-বান্না শেষ হতে কমপক্ষে ঘন্টা দুয়েক লাগবে। ইনশাল্লাহ আমরা তার আগেই ফিরে এসে এক সংগে খাবো কিন্তু সুচরিতার নাচ আর সোহেল রানার ফাইটিং আমাদের হিসেবে কখন যে গড়মিল করে দিয়েছে তা টের পাইনি।

যখন টের পেলাম তখন সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। ভয়ে ভয়ে ফিরলাম পিকনিকে। এসে দেখি খাওয়া-দাওয়া শেষ। সবাই সব কিছু গুছিয়ে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। আমাদের দুজনের প্রতি কারো কোন উৎসাহ নেই, কারো কোন কিছু জানবার আগ্রহ টুকুও চোখে পরলো না। এমনকি যে খুব কাছের বন্ধু সেও নির্বিকার। স্যারও কিছুই বলছে না। মনে সাহস আনবার চেষ্টা করছি কিন্তু ঠিক সে সময় এক বন্ধুর ইশারা জানিয়ে দিলো ঝড়ের পূর্বাভাস। এবার স্যার আমাদের দু’জনকে কাছে ডাকলেন। ভাবলাম হয়ত কিছু বকা দিয়ে আমাদের জন্য উঠিয়ে রাখা খাবার খেতে দেবেন। যত অপরাধ-ই করিনা কেনো ছাগল দুটিকে তো আমরাই এত সেবা যত্ন দিয়ে নিয়ে এসেছি। এখনো আমার গায়ে পেচ্ছাবের বিকট গন্ধ যার জন্য আজ সারাদিনে বান্ধবীর সান্নিধ্য পেলাম না। না পাই, আপাতত খাবারটা পেলেই চলবে। পেটে রাজ্যের ক্ষুধা। কিন্তু না, স্যার সব প্রত্যাশার গলা টিপে ধরে মাংশ রান্নার বড় দুটি হাড়ি দেখিয়ে বললেন- তোমারা দুজন ঐ দুটি হাড়ি খুব ভালো করে পরিষ্কার করে ডেকোরেটরকে দিয়ে সোজা স্টেশনে এসো। স্যারের এই নির্মম আদেশ পেয়ে এবার আমি সত্যি সত্যিই টের পেলাম আমার শরীরে ছাগলের পেচ্ছাবের বিকট দুর্গন্ধ। আমি বমি করে দিলাম সেই গন্ধে আর ক্ষমা করে দিলাম সেই সব বান্ধবীদের যারা আমাকে দেখলেই মুখে ওড়না চেপে ধরছিলো।

খাসির মাংশ রান্না করা হাড়ি পরিষ্কার করে কাঁদতে কাঁদতে স্টেশনে এলাম অনাহারে, রাগে, দুঃখে, অভিমানে। ট্রেন এক ঘন্টা লেট। মনে মনে স্যারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছি আর প্ল্যান করছি দুজন মিলে, কি করে স্যারকে একটা ছ্যাঁকা দেয়া যায়। আবার ভয়ও পাচ্ছি। ওলট-পালট কিছু করলে স্যার যদি প্র্যাকটিক্যালে ফেল করিয়ে দেয়, তাহলে তো সব শেষ। ঠিক তখনি স্যারের ডাক। কাছে গেলাম ভয়ে ভয়ে। আড়ালে নিয়ে গেলেন। আরো ভয় পেলাম। স্যার এবার পকেটে হাত দিলেন। তারপর আমাদের দুজনকে তিনশো প্লাস তিনশো ছয়শো টাকা দিয়ে বললেন-সমানে বড় হোটেল আছে, গিয়ে যা ইচ্ছে হয় খেয়ে আয় তাড়াতাড়ি। স্যার হাসতে হাসতে আরো বললেন-হোটেলে যাবি কিন্তু, সিনেমা হলে নয়। ১৫০ টাকা পিকনিকের চাঁদা দিয়ে পেলাম ৩০০ টাকা। মূহুর্তেই আমাদের সব রাগ-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে মুছে গেলো আর আমার শরীরে ছাগলের বিকট পেচ্ছাবের গন্ধ যেন সন্ধ্যার ধুপের গন্ধ হয়ে বান্ধবীদের নাকে চেপে রাখা ওড়না সড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। মনের আনন্দে হাঁটতে লাগলাম হোটেলের দিকে।

পিকনিক-২০২২ এসে আজ ৪০ বছর পর স্মৃতিরা আমায় কাঁদিয়ে গেলো, ভাসিয়ে নিলো অন্যরকম সুখে। জানিনা, স্যার আজ কোথায়, কেমন আছে। বন্ধুরা আজ কোথায় কেমন আছে। মুখে ওড়না দেয়া বান্ধবীরা আমার কোথায় আছে কেমন আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনাদের মাঝে আমি আমার স্যারকে খুঁজি, বন্ধুকে খুঁজি, খুঁজি মুখে ওড়না চেপে রাখা বান্ধবীদের। এবার আমার পিকনিকে যাওয়া হয়নি। পৃথিবীর কোন এক নির্জন ছায়াতলে বসে তোমাদের খুঁজে পেতে চাই হাঁসতে চাই, কাঁদতে চাই, ভাসতে চাই স্মৃতির ভেলায়। পিকনিকে যেতে চাই।

শেষ পংক্তি

KA1

শেষ পংক্তি উচ্চারণের আগে একবার মাছ হতে চাই।
নদীর গভীরে নদী আমি তার গভীরে যেতে চাই
বর্ষায় ভিজে শাখা প্রশাখা ছড়ায় যে কদম বৃক্ষ
আমি তার কাছে উৎসের ঠিকানায় নতজানু হতে চাই।
আমি দেবী হত্যা হুলিয়ায় ফেরারী কয়েদী আজ
তোমার কাছে আশ্রয় চাই।
শব্দরা সব সূর্যস্নানে মায়ামি কিম্বা রিমিনি বীচে।
কবিতার ঠোঁট এখন স্পিন বলের উইকেট
মিডিয়াম পেসের বদলে চাই দারুন এক অফ ব্রেক স্পেল।
মাছ হতে চাই,
শেষ পংক্তি উচ্চারণের আগে মাছ হয়ে শিখে নিতে চাই
নদীর গভীরে জলজ ভাষায়
মাছেরা কিভাবে কবিতা লিখে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে।।

প্রাণী প্রেমিক এই আমি ও আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা

Hos

ছোটবেলা, মানে আমার কলেজ জীবন পর্যন্ত কেটেছিলো উত্তরের এক অবহেলিত জেলা শহরে। কিছুটা গ্রামীন আবহে। সে কারণে আজকের এই মানুষটি আমি গর্বিত এবং ভীষণ অহংকারীও বটে কারণ আমি মাটির গন্ধ চিনি। নদী নালা খাল বিল, ফসলের মাঠ, ধান ফুলের গন্ধ, তাজা মাছের স্বাদ, জোনাকির আলো, এ সব আমার মুখস্থ। নদী থেকে স্নান সেরে ভেজা মহিষের পিঠে করে বাড়ি ফেরা ছিলো স্বর্গ সুখ।

সে সময় বাড়িতে এক দেশী কুকুর ছিলো। আমি তার নাম দিয়েছিলাম “বাঘা”। তাকে তিন বেলা খাবার দেয়া হতো নিজেদের স্বার্থেই, কারণ সে ছিলো বাড়ির খুব ভালো পাহারাদার। বাঘার উপস্থিতিতে বাড়িতে চোর ডাকাতের উপস্থিতি ছিলো প্রায় অসম্ভব। একদিন সকালে বাঘার মৃত দেহ পাওয়া গেলো। চোরের বা ডাকাত দলের কেউ তাকে বিষ পানে হত্যা করেছিলো কারণ সে সময় চোর এবং ডাকাতের বেশ উপদ্রব ছিলো এলাকায়।
পরের জীবন বিভাগীয় শহরে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। আমার স্বর্গীয় জীবন। আমার ভালো মন্দ, রাজনীতি অ রাজনীতি, প্রেম অপ্রেম, সব কিছুর সূতিকাগার এই মতিহার চত্বর। এখানেও আমার এক নেড়ী কুত্তা ছিলো সর্বক্ষণের সাথী। সে সময় অনেকেই আমাকেই পাগল বলে এড়িয়ে চলতো, আবার কেউ কেউ এই পাগলামীর কারণেই উন্মাদের মতো ভালবাসতো।

এর পরের জীবন ইউরোপ। এ এক অন্য জগৎ। প্রতি সেকেন্ডে অবাক হই আর শিখি। পুরো ইউরোপ তখন আমার চারণ ভূমি। আজ এখানে তো কাল ওখানে। ছবি তুলি কবিতা লিখি। মাঝে মাঝে প্রেমে পড়ি। আসলে don’t fall in Love, I only make Love আমি প্রেমে পড়ি না, আমি শুধু প্রেম করি। দীর্ঘ সময় আমি তখন যাযাবর। এক সময় উপলব্ধি হয় এ জীবন আমার নয়, অন্য কারো কারণ ততদিনে আমি বুঝে গেছি, জেনে গেছি স্বরসতী আর লক্ষী হচ্ছে দুই সতীন। এরা এক সাথে বসবাস করবে না। আমাকে বেছে নিতে হয় একজনকে। আমি লক্ষী কে পূজা দিয়ে ঘরে ফিরি। সেটি ১৯৯৮। তখন আমি ইতালির এক ফ্যাশন ডিজাইনারের সাথে কাজ করি। সে ডিজাইন করে পাঠাতো আর আমি তা ডেভোলপ্ট করতাম।

আমার এখনো মনে আছে সে সময় সাইফুদ্দীন হাসান চন্দনকে দুইদিনের মডেল শ্যুটের জন্য সন্মানী দিয়েছিলাম দুই লক্ষ টাকা। তখন চন্দন ভাই এর সহযোগী হিসেবে ছিলেন বশীর আহমেদ সুজন। আমরা শ্যুট করেছিলাম, একদিন শফিপুর আনসার ক্যাম্পে আর একদিন লালবাগ কেল্লায়। তখন আমি একা থাকতাম রামপুরা মহানগর আবাসিক এলাকার একটা ফ্ল্যাটে। আমার ফ্ল্যাটে তখন নিজস্ব একটা মিনি বার ছিলো সংগত কারণেই। কারণ তখন আমার অধিকাংশ মেহমান ছিলো বিদেশি। তবে দেশের অনেকেই আসতো তখন আমার বাসায় ফ্রি মদ খেতে। তাদের মধ্যে ছিলো বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ছিলো সব নামকরা শিল্পী, সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিমান বালা, রাজনীতিবীদ।

সে সময় আমার সখ জাগলো বানর পোষার। বানর ছিলো তখন আমার সর্বক্ষণের সাথী। নাম দিয়েছিলাম তার রাধা। সারা ঢাকা শহর সে আমার সাথেই থাকতো। কখনো গাড়িতে, কখনো আমার কাঁধে। একদিন বাসায় ফিরে দেখি রাধা আমার বারান্দার গ্রিলে ঝুলে মরে আছে। জানি না সে আমার অন্য প্রেমের অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলো নাকি পড়ে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে মরেছিলো।

এরপর আসি ইস্কাটন গার্ডেনের বাসাতে ভাড়াটিয়া হিসেবে। আমার বাসার মালিক তখন অভিনয় শিল্পী রোকেয়া প্রাচী, নিহত সার্জেন্ট আহাদের স্ত্রী। তখন আমি কাটাবন পশু পাখি মার্কেটে একজন তার ছেড়া ক্রেতা হিসেবে ব্যপক পরিচিতি। তখন কাঁটাবন মার্কেটের এমন কোন পাখি নাই যা আমার ছিলো না। তখন আমার গ্রামের বাড়িতে মায়ের সখ পূরনে গড়ে তুলি মিনি চিড়িয়াখানা। আর সে সময় ঢাকার পাখি স্মাগলার গোষ্ঠীর সাথে আমার পরিচয় হয়। জানতে পারি কাঁটাবন মার্কেটের আড়ালে চলে আন্তর্জাতিক পাখি চোরাকারবারী চক্রের কার্যক্রম।

দামী পাখিদের তখন দারুণ চাহিদা বলিউড তারকাদের এবং ঢাকা তখন সেই স্মাগলারদের ট্রানজিট রুট মাত্র। ম্যাকাও, গ্রে প্যারোট, কাকাতুয়া থেকে শুরু করে সব নামি দামী পাখি ঢাকা হয়ে চলে যেতো দিল্লি, বোম্বে এবং পাখি গুলো আসতো মূলত পাকিস্তান থেকে। আমি তখন পাখি কিনতাম সেন্ট্রাল রোডের এক স্মাগলারের কাছ থেকে স্বল্প দামে। তখন আমার হরিণ পালন এবং জবাই করে খাবার লাইসেন্স ছিলো।

যাই হউক রোকেয়া প্রাচীর বাসায় থাকার সময় সখ হলো কুকুর পোষার। সাদা ধবধবে লোমশ ছোট্ট একটা কিউট কুকুর কিনলাম। নাম রাখলাম তার “গুণ্ডা”। বিড়াল ছিলো অনেক গুলো। কিন্তু পড়ে রিয়ালাইজ করলাম, এ সবের পেছনে আমার যতোটা না ভালোবাসা তার চেয়ে অনেক বেশী বিলাসিতা, ট্রেন্ড বাজি, লোক দেখানো ফুটানি। রাস্তার ভিক্ষা করা, ফুল বিক্রেতা কোন মানব শিশু আমার কাছে তখন পশু প্রেমের চেয়ে অনেক বেশী আপন মনে হলো।

আজকাল অনেক পশু প্রেমিক দেখি। কুকুরের মুখে চুমু দিতে দেখি, বিড়ালের মা বাপ হতে দেখি। আর কি কি দেখবো তার সব কিছুই আমার জানা দেখা। জানিনা বাংলাদেশে এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আজ থেকে আরো ৩০ বছর আগে রোমে এক ইতালিয়ান বান্ধবী তার মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াত দিয়েছিলো। গিফট সহ গিয়ে দেখি তার বিড়ালের জন্মদিন। নিজে সন্তান নেয় না চাকুরী করে বলে, তাই বিড়ালকে সন্তান বানিয়েছে। অবাক পৃথিবী,অবাক সব মানুষের রীতিনীতি, রুচি।

দেশে আমার অনেক প্রিয় মানুষ কুকুর বিড়ালকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দেন এবং তাতে গর্ব বোধ করেন। সেই সব প্রিয় জনের কাছে অনুরোধ, আপনার কুকুর বা বিড়াল সন্তানের জন্মদিনে আমাকে দাওয়াত দেবেন না প্লিজ।

এখানে সাধারণত বয়স্করা কুকুর বেড়াল পালন করেন তাদের নিঃসঙ্গতা থেকে। আবার কিছু কিছু নারী কুকুরের সাথে সেক্স করার জন্যে তা পালন করে থাকে। এ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। ২০ বছর আগে রোমে আমার পাশের ফ্ল্যাটের এক নারীকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ এবং তদন্তে জানা যায় রাতে কুকুরের সাথে সেক্স করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও এখন যে কেউ সোস্যাল মিডিয়াতে সার্চ দিয়ে কুকুরের সাথে মেয়েদের হরদম সেক্স দেখে নিতে পারেন।

তাই ভয় হয় বাংলাদেশের পশু প্রেম কোন দিকে এগুচ্ছে। আমরা তো সব কিছুই শিখি হয় বোম্বে থেকে নয় ইউরোপ থেকে। আল্লাহ,তুমি আমাদের সঠিক পথে রেখো প্লিজ।

আমার ফ্রেন্ড লিষ্টে অনেক পশু প্রেমিক আছেন। প্লিজ আমার এ লিখায় কেউ আহত হবেন না। ভুল বুঝবেন না আমাকে। আমি শুধু আমার জানা এবং দেখার কথা, আমার নিজের কথা শেয়ার করেছি মাত্র। সবার জীবন মঙ্গলময় হউক। সুন্দর হউক।

জলের কাব্য

abs

নারী চায় জল
জল চায় নারী, উষ্ণ কিম্বা শীতল
সমুদ্র ঝর্ণা নদী, সান বাঁধা পুকুর।

যদিও জলের বুকে কাঁপে ছাঁয়া
কাঁপে চাঁদ সূর্য্য হৃদয়
তবু নারী জল চায়, ছুঁয়ে দেখে
আঙ্গুলে তোলে ঢেউ, বিষণ্ন হয়, হাসে কাঁদে।

জল ভাঙ্গে-
জলের স্রোতে নারী হয় মা,
চোখে নামে জল, নারী কাঁদে
চোখে নামে জল, নারী হাসে

জল চায় নারী
নারীও চায় জল
জল-ই জানে নারীর উজান ভাটি
ভিতর বাহির হৃদয় ও মন।

কষ্ট

will

চন্দন কাঠের নিচে শুয়ে আছি
আমার উত্তরে অগ্নি দক্ষিণে মহুয়া
আজ বুঝতে পারি
মৃত মানুষেরা কেনো এতো মাদকতা ভালোবাসে ।
গভীর রাতে হঠাৎ টের পাই কোন এক গৃহকোণে আনন্দ উৎসব
বাসর রাতে বাঁজে নিক্কন ভাঁঙ্গে কাকঁন।
পরিচিত রমনীর কন্ঠস্বর মনে হয় অন্য কারো টিয়া পাখি
আমারি হৃদপিন্ডে বসে শিস দেয় সে সারাক্ষণ।
একটু আগে আমার মুখাগ্নি করে গেছে যে তরুনী তাকে চিনিনা,
তবু আমি তার আনন্দিত ও কম্পিত ঠোঁট ছুঁয়ে বলেছি-
শ্বশ্মানের আগে আজ বিকেলে চন্দ্রিমার কৃষ্ণচূড়ায় যে রঙ দেখেছিলাম-সেই মুগ্ধতার কসম
আমার পুড়ে যাওয়া গলে যাওয়া চোখের মনির কসম
আজ আমি ভাল নেই, একদম ভালো নেই
তবে তুমি ভালো থেকো হে আমার প্রিয়জন
হৃদয় চিতার আগুনে পুড়ে আমি না হয় হলাম আজ ভস্ম।

চিঠি দিও, জোসনার খামে ভরে অমাবস্যার ঠিকানায়

45237892

সেদিনের রাত ছিলো মেঘমেদুর; বাতাসে ছিলো হংসমিথুন ছায়া,
জলকেলী শেষে উড়েছিলো সে, আকাশে। স্বপ্নরাজ্যের খোঁজে।
বাতাসে ছিলো মৃদু সোঁদা গন্ধ, বৃষ্টি ছিলোনা কোথাও,
দেখেছিলাম রুপবতী চাঁদ আর দুষ্টমেঘের প্রণয়
বড় লোভ জেগেছিলো চোর হতে, জোসনা ভেজা সেই রাতে।

তুমি দেখেছিলে কি তা?
পূর্ণিমার চাঁদ যখন জোসনার খামে ভরে চিঠি নিয়ে এলো অমাবস্যার কাছে গতরাতে,
তখন তোমার চুল কি খোলা ছিলো প্রিয়?
তোমার স্বপ্নবোনা আঁচল দমকা হাওয়ার টানে হয়েছিলো কি এলোমেলো?
আটপৌরে লজ্জায় হয়েছিলে কি নত?
নাকি বেঁধেছিলে খোঁপা শক্ত করে পুরনো সেই রুপোর কাঁটায়,
নাকি শব্দবেণী বুনেছিলে তোমার খোলা চুলে জোসনা জলে ভিজেভিজে সেদিনের সেই রাতে, বড় জানতে ইচ্ছে করে।

চিঠি দিও।
চিঠি দিও প্রিয় হা করা ফসলের মাঠ থেকে রৌদ্রের খামে ভরে মেঘমাল্লার ঠিকানায়
চিঠি দিও যমুনার ঘাট থেকে জোসনার খামে ভরে অমাবশ্যার ঠিকানায়।
চিঠি পেলে আমি তোমার ললাট ছোঁবো বৃষ্টি-নূপুর ছন্দে
চিঠি পেলে আমি তোমার চোখের পাতায় চুমু দেবো আধো আলো-আঁধারে
চিঠি পেলে আমি হবো দুষ্টমেঘ তুমি রুপবতী চাঁদ
আমাদের প্রণয় পরাগে ফলবতী হোক পৃথিবীর সব গাছ।
চিঠি দিও।

নারী-৩

2422253

নত চোখে নববধূ তুমি, জড়ানো মসলিনে
নদী তুমি, তুমি আনন্দদায়িনী, নবান্ন, নীল শাড়িতে কদমতুল্য,
তুমি নকশীকাঁথা, কলাবউ তুমি, তুমি তুলনাহীনা।
নত শিরে পূজি তোমাকে, দেবতার পুস্পার্ঘ্য তোমায় অবিরত
নীলোৎপলে সাজো তুমি, তুমি জলকন্যা; তুমি জল
আমার আকাশ নক্ষত্র নত নিঃসীম কৃষ্ণ রাত।

তুচ্ছ সবি, তুচ্ছ দরবারি ঘোষক, তুচ্ছ সানাই মূর্চ্ছনা;
তুচ্ছ মালয়দ্বীপের শুকপাখি, নীলপাহাড় কিবা নগ্ন নটী,
তুচ্ছ সবি, শুধু তুমি, তুমি তুলনাহীনা।

লাঞ্ছনার লতায় জড়ানো দেহ, আমি আনন্দহীন,
নাই নারী, নাই ঘুম, একা মম রাত্রি
নির্জন ঝর্ণায় ছুড়েছি নূপুর, বিষণ্ন এক একটি দুপুর।
উত্তরীয় নেই, প্রসাধন নেই, নেই ঘুম কিবা রমণ
আমি তৃষ্ণার্ত আশাহীন
গহীন গোপন নির্বাসনে হয়েছি নিয়তির নিবেদক।

নারী তু্মি, তুমি কলাবউ, তটীনী তুমি, তুমি নন্দিনী
তুমি দেবী, তুমি তুলনাহীনা, নত শিরে পূজি নিরন্তর
তোমায় দিলাম আমার পুষ্পার্ঘ্য, পৃথিবীর সব সাদা ফুল।

রাজকন্যার গল্প

Beautiful

রাজ পথটা সোজা এসে মিলেছে পান্থশালা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ায় হেম আর হিয়া। তখনো শহর জাগেনি। ভোরের সূর্যালোকের স্নিগ্ধ আভা দুজনের ধরে থাকা হাতে চুমু দিয়ে আমন্ত্রন জানায় সকালের শহরে। ওরা হাটতে হাটতে ঢুকে পড়ে প্রথম গলিতে। গলিটির তিনটি বাড়ির পরের বাড়িটি রাজার বাড়ি। রাজার বাড়ির সামনে সবুজ ঘেরা স্বচ্ছ জলের সরোবর। হেমের খুব রাগ হয়। এখানে স্বচ্ছ জলের বদলে সে দেখতে চায় লাল শাপলা আর শ্বেত পদ্মের বাসর। হিয়া শক্ত করে ধরে রাখে হেমের হাত। হেম তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আবার তাকায় জলের দিকে। একটা মাছরাঙ্গা ভুল করে পুটি ভেবে ঠোকর দিয়েছে মস্ত এক কাতলার চোখে। কাতলার লেজের জলে ভিজে মাছরাঙাটা দৌড়ে পালায় ছাতিম গাছের মগ ডালে। দৃশ্যটা দেখে হিয়া খুব হাসতে থাকে।

হিয়ার প্রাণ খোলা নিষ্পাপ হাসি দেখে হেম আনমনা হয়, ভাবে কেন সে নিজে এমন করে হাসতে পারে না। অথচ হেম চায় এমনি করে হাসতে। হেম খুব জোরে হিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয় বকুল গাছের ছায়ার নিচে। হিয়া অবাক হয় না তাতে। কারন হিয়া হেমের এই স্বভাবের সাথে অনেক আগে থেকেই খুব বেশি পরিচিত। রাজার বাড়ি আর লেকের মাঝে চওড়া যে পায়ে হাটা পথ তার পুরোটাই বকুল গাছের ছায়া দিয়ে মোড়ানো। মনে মনে হেম ভাবে তবে কি বকুল রাজার খুব পছন্দের ফুল।

হেমের খুব জানতে ইচ্ছে করে রাজা কি কখনো খালি পায়ে শিশির মাড়িয়ে বকুল কুড়িয়েছে তার প্রিয়ার জন্য? কে দেবে উত্তর ? রাজা তো আর নেই। হেম হিয়াকে এই রাজার গল্প, এই রাজ্যের গল্প বলতে বলতে হাটতে থাকে সামনে, বকুলের বুকে পা রেখে। হিয়া কে চেনায় ফুল, ফল, গাছ, পাখি। হঠাৎ একটা কাঠগোলাপের গাছ চোখে পড়ে। সাদা ক্যানভাসে হলুদের জলরঙ ছোয়া। হাল্কা একটা মিষ্টি গন্ধ। হিয়া কে নিয়ে সে এসে দাড়ায় কাঠগোলাপ গাছটির নিচে। গন্ধটা আরো তীব্র হয়। হেম ফিরে যায় পেছনে ৩০ বছর আগে। হিয়া কিছুই বোঝে না। সে ফুল পেয়ে খুশী। হিয়া বোঝে না জীবনের কিছুই, সে শুধু আদরের কাঙ্গাল। আবার তারা হাটতে শুরু করে। হেম মোবাইলে সময় দেখে নেয়। দেরী হয়ে গেছে আজ। কাঠের সেতু পেড়িয়ে হিয়াকে নিয়ে যখন সে এসে পৌঁছায় স্কুলের গেটে তখন এসেম্বলি শুরু হয়ে গেছে। হিয়া “বাই বাবা” বলে দৌঁড়ে স্কুলে ঢুকে যায়। হেম কান পেতে দেয়, সোনা-মানিকেরা গাইছে-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। হেম তার জীবনে অনেক বার অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে এই গান শুনেছে কিন্তু আজ অব্দি কোন শিল্পী স্কুলের এসেম্বলিতে গাওয়া এই গানের সুর, আবেগ আর প্রত্যয়কে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।

হেম টের পায় তার চোখের দুফোঁটা জল হাতে ধরা কাঠগোলাপের পাপড়িতে। হেম চোখ মোছে। সামনে তাকিয়ে দেখে নেয় কোন পথে ফিরবে। চোখে পড়ে স্কুলের সামনে অনেক বড় একটা কাঠগোলাপের গাছ আর ঠিক তার নিচে দাঁড়িয়ে একজন। তার হাতে ধরা সাদা ক্যানভাসে হলুদের জলরঙে আকা একটা কাঠ গোলাপ। যেমন করে ৩০ বছর আগে একটা কাঠগোলাপ হাতে স্কুল শেষে হেমের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো রূপকথা। হেমের খুব জানতে ইচ্ছে করে মেয়েটির হাতের কাঠগোলাপের পাপড়িটিও তার চোখের জলে ভেজা কিনা।

নে

6653_o

নে। নে, তবে সবটুকু জল তোকেই দিলাম
ফিঙ্গে ফড়িং মরুক সব তেষ্টা পেয়ে
পাখার ভাজে পরাগ মেখে আর না আসুক প্রজাপতি
সরষে ফুলে মধুর লোভে,
নিবি যখন সবটুকু নে
শিউলীবৃন্তে একফোঁটা জল সেটিও নে
ঘাসের ডগায় শিশির কণা, সেটুকুও নে
দারুণ আমার সবুজ ক্ষেতের গামর ধান মরুক খরায়
নাইবা ভরলো সোনালী আভায় এবার আমার উঠোন খানি
পুড়ে মরুক জোনাকিরা সব হেজাক বাতি তোর আভায়।
নাইবা ছুঁলাম তোর ঠোঁটের বাঁ পাশের ওই কালো দাগ
এই জোছনায়, কি আসে যায়? যাস যদি তুই অন্য গাঁয়ে
বাজিয়ে নূপুর ছুটন্ত পায়, আর কি বাকি ?
সবটুকু তো তোকেই দিলাম, বর্ষার কদম সেটিও চাস ?
নে, সেটিও নে।
এবার তবে কথা দে-
আর বলবি না করতে আমায় কবিতার চাষ, বেলা অবেলায়।

দেবদাস

দেবদাস কে আমার কোন কাল্পনিক বা উপন্যাসের চরিত্র মনে হয় না, হয়নি কখনো। সব সময় মনে হয় সে আমার পাশের বাড়ির কিম্বা পাড়া মহল্লার খুব পরিচিত কেউ। কখনো নিকট আত্মীয়, স্বজন বন্ধু বলেও মনে হয়। শরৎ বাবুর এক অসাধারন সৃষ্টি। অথচ লেখক নিজেই একে তুচ্ছ ভেবে ফেলে রেখেছিলেন দীর্ঘ ১৭ বছর কিন্তু বেলা শেষে সেই সৃষ্টি তাকে দিয়ে গেছে অমরত্ব। তাই বন্ধুরা আপনার কোন সৃষ্টিই ফেলবেন না। রেখে দিন। হউক তা কোন লিখা, পেইন্টিংস কিম্বা ফটোগ্রাফি। কে জানে সময়ের টানে তা হয়ত আলোও ছড়াতে পারে।

“দেবদাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি প্রণয়ধর্মী বাংলা উপন্যাস। দেবদাস শরৎচন্দ্রের প্রথমদিককার উপন্যাস। রচনার সমাপ্তিকাল সেপ্টেম্বর ১৯০০ কিন্তু প্রকাশনার বছর ১৯১৭। উপন্যাসটি নিয়ে শরৎচন্দ্রের দ্বিধা ছিল বলে দীর্ঘ ১৭ বছর প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলেন। উপন্যাসটি তিনি রচনা করেছিলেন মাতাল হয়ে এবং বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে ১৯১৩-তে লেখা এক চিঠিতে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘ওই বইটা (দেবদাস) একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান প্রধান ভাষায় উপন্যাসটি অনূদিত হয়েছে। পারুর জন্য দেবদাসের বিরহ উপজীব্য করে রচিত এই উপন্যাস অবলম্বনে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দেবদাস বিরহকাতর চিরায়ত প্রেমিকের ধ্রুপদী নিদর্শন হিসেবে গণ্য।

দেবদাস মোড়ক। দেবদাস উপন্যাস – বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ। লেখকঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ভাষা : বাংলা। ধরন : উপন্যাস। প্রকাশক : জিসিএস। প্রকাশনার তারিখ : ৩০ জুন, ১৯১৭।

কাহিনীর সংক্ষিপ্তসার
উপন্যাসে দেবদাস (সম্পুর্ন নাম দেবদাস মুখার্জি) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৎকালীন ব্রাহ্মন জমিদার বংশের সন্তান, পার্বতী(পারো) এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাংলার তালসোনাপুর গ্রামে এই দুই পরিবারের পাশাপাশি বাস। ছোটবেলা থেকেই দেবদাস ও পার্বতীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যা পরবর্তীতে প্রেমের রূপ নেয়। দেবদাস বয়সে পার্বতীর চেয়ে কিছু বড়ো। দেবদাস ও পার্বতী একে অপরকে ‘পারো’ ও ‘দেবদা’ বলে ডাকে। বিদ্যালয়ে পড়াশোনা থেকে পুকুরে মাছ ধরা পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজ‌ই তারা এক সঙ্গে করত। পার্বতী কিছু ভুল করলে দেবদাস তাকে মারতো, তবুও এদের সম্পর্ক বন্ধুর মতই ছিল৷ঘটনা পরম্পরায় দেবদাসকে কলকাতা শহরে পাঠানো হয় পড়াশোনা করার জন্য। কয়েক বছর পর ছুটির সময় সে তার গ্রামে ফিরে আসে। কৈশোরে উত্তীর্ণ দুজন হঠাৎই অনুভব করে, তাদের বাল্যকালের বন্ধুত্ত্ব আর‌ও গভীর কিছুতে উত্তীর্ণ হয়েছে। দেবদাস দেখে যে তার ছোটবেলার পারো বদলে গেছে। পার্বতী তাদের কৈশোরের প্রেম বিবাহবন্ধনে পরিস্ফুটনের কথা ভাবে। প্রচলিত সামাজিক রীতি অনুযায়ী, পার্বতীর বাবা-মাকে দেবদাসের বাবা-মায়ের কাছে তাদের বিবাহের প্রস্তাব আনতে হবে।পার্বতীর মা দেবদাসের মা হরিমতির কাছে বিয়ের প্রস্তাব আনলে তিনি আনন্দিত হলেও পাশের বাড়ির সাথে এই সম্পর্ক রাখতে তিনি বিশেষ উৎসাহী হননা। তাছাড়া পার্বতীর পরিবারে দীর্ঘকাল থেকে বরের পরিবার থেকে ‘পণ’ গ্রহনের প্রথা চলে আসছে। দেবদাসের মা তাই পার্বতীর পরিবারকে “বেচা-কেনা ছোটঘর” মনে করে এই সম্পর্কে অসম্মত হন। দেবদাসের বাবা, নারায়ণ মুখার্জিও এই যুক্তি সমর্থন করেন। এতে পার্বতীর পিতা নীলকন্ঠ চক্রবর্তী অপমানিত বোধ করেন ও পার্বতীর জন্য আরও ধনী গৃহে বিয়ে ঠিক করেন। পার্বতী একথা জানলে দেবদাস অন্তত তাকে গ্রহন করবে এই আশায় রাতের অন্ধকারে তার সাথে দেখা করে। দেবদাস মনস্থির করে তার বাবাকে বললে, তিনি অরাজি হন। বিভ্রান্ত অবস্থায়, দেবদাস বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে যায়। সে চিঠি লিখে পার্বতীকে জানায় যে সে এই সম্পর্ক আর রাখতে চায় না। পার্বতী বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। এরপর দেবদাস বললেও আর সে ফিরে যেতে চায় না ও কাপুরুষতার জন্য তাকে ধিক্কার জানায়। তবুও, সে দেবদাসকে বলে যে তার মৃত্যুর আগে যেন সে দেবদাসকে অন্তত একবার দেখতে পায়। দেবদাস এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। দেবদাস কলকাতায় ফিরে যায় ও পার্বতীর হাতিপোতা গ্রামে ভুবন চৌধুরী নামে এক জমিদারের সাথে বিয়ে হয়। ভুবন চৌধুরীর পূর্বের স্ত্রী মারা গেছেন ও তার তিনজন সন্তান রয়েছে, যারা পার্বতীর প্রায় সমবয়সী বা তার চেয়ে বড়ো।কলকাতায় গিয়ে দেবদাসের চুনীলালের সাথে বন্ধুত্ব হয় ও তার মাধ্যমে সে চন্দ্রমুখী নামে এক বাঈজীর সাথে পরিচিত হয়। সে দেবদাসের প্রেমে পড়ে, যদিও দেবদাস তাকে ঘৃণা করতে থাকে। হতাশাগ্রস্ত দেবদাস অত্যধিক মদ্যপান শুরু করলে তার শরীর ক্রমশ ভে‌‌ঙে পড়ে। চন্দ্রমুখী তার দেখভাল করতে থাকে। দেবদাস তার মনে প্রতিনিয়ত পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর তুলনা করতে থাকে ও চন্দ্রমুখীকে সে পারোর কথা বলে। দুঃখ ভুলতে দেবদাস ক্রমশ মদ্যপানের মাত্রা বাড়াতে থাকে ও তাতে তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। চন্দ্রমুখী বুঝতে পারে যে দেবদাসের ভিতরের আসল মানুষটির আজ পতন ঘটেছে। লক্ষ্যশূন্য দেবদাস শেষপর্যন্ত চন্দ্রমুখীর প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়। শীঘ্র আসন্ন মৃত্যুর কথা অনুভব করতে পেরে দেবদাস, পারোকে দেওয়া তার পূর্বের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে হাতিপোতা গ্রামে পার্বতীর কাছে র‌ওনা হয়। পার্বতীর বাড়ির সামনে পৌঁছে, এক অন্ধকার শীতের রাতে দেবদাসের মৃত্যু হয়। দেবদাসের মৃত্যুর খবর শুনে পার্বতী সেখানে ছুটে যায়, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই, বাড়ির লোকজন তাকে বাড়ির চৌকাঠ অতিক্রম করতে দেয়না।

শরৎচন্দ্র তার অন্যান্য অনেক উপন্যাসগুলির মতো এটিতেও তৎকালীন বঙ্গসমাজের নিষ্ঠুরতার চিত্র কঠোরভাবে তুলে ধরেছেন, যে সমাজব্যবস্থা এক সত্যিকারের প্রেমের শুভ পরিণতির এক বৃহৎ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।