মায়ের ভালোবাসা

অনিক খুব চঞ্চল স্বভাবের বালক। সারাদিন এ বাড়ী ও বাড়ী ঘুরে বেড়ানো যার কাজ। লেখা পড়ার দিকে তেমন কোন মনযোগ নেই। বাবা-মা স্কুলের কথা বললেই বন্ধুদের নিয়ে চলে যায় খেলার মাঠে। খেলার ছলে কখনো কাউকে চিমটি কাটে। কখনো বা ব্যাট দিয়ে কারো মাথা ফাঁটিয়ে দেয়। আবার কখনো রাগে কারো জামা ছিঁড়ে দেয়। ফল খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে কখনো কখনো অন্যের গাছে ঢিল মারে। একদিন পাশের বাড়ীর কুল গাছে ঢিল মেরে তাদের গরুর পানি খাওয়ার গামলা ভেঙ্গে দেয়। এই নিয়ে চলে দু’পরিবারের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। সেই থেকে অনিক আর সেই বাড়ীতে যায় না। দিনে অনন্ত ৪/৫টি নালিশ আসে তার বাবা-মার কাছে। বাবার বকুনি ও মায়ের শাসনে দিন কাটছে তার। তাই এখন আর সে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়ে না কিন্তু অন্য একটি নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। আর তাহলো পাখি শিকার করা। কারণ সে এতদিনে বুঝতে পেরেছে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়া অন্যায় কিন্তু পাখি শিকার করা অন্যায় না। পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখির ছানা ধরা এখন তার নেশা হয়ে গেছে। বনে জঙ্গলে, আশে পাশের ঝোপ ঝাড়, ক্ষেত-খামারে ঘুরে বেড়ানো এখন তার নিত্যদিনের কাজ। এ কাজে কেউ তাকে বাঁধা দেয় না। কেউ আর এখন পাখির বাসা ভাঙ্গার জন্য তার বাবা-মার কাছে নালিশ করে না। তাই মনের আনন্দে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পাখির ছানা ধরার নেশায় দিন রাত ঘুরে বেড়াচ্ছে অনিক।

অনিকের দুষ্টুমির সংঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছে তার প্রতিবেশী রবিন। সেই শিশুকাল থেকেই দু’জনে এক সাথে খেলা-ধূলা, মারা-মারি করে আসছে। একদিন দুজনে এক ঝোপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তারা টুনটুনি পাখির ছানার ছিঁ ছিঁ আওয়াজ শুনতে পায়।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে কোন কথা বলবি না। টুনটুনির ছানা ধরার সময় কথা বলা নিষেধ। তোর কথার আওয়াজ পেলে ফুরৎ করে টুনটুনির ছানা চলে যাবে। অনিক তার বন্ধু রবিনকে একথা বলেই টুনটুনির বাসার দিকে চুপি চুপি হাঁটতে লাগল। অনিক আগে রবিন পিছনে। অনিক সামনে থেকে দু’হাতে চেপে ধরে বাসাটি গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলে। আর অমনি বাসার ভেতর থেকে টুনটুনির চারটি ছানা ছিঁ ছিঁ করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু সেদিকে অনিকের কোন খেয়াল নেই। তার আনন্দ লাগলো এই ভেবে যে, সে আজ বিরাট কিছু জয় করে ফেলছে। অনেক দিনের শখ ছিল সে টুনটুনির ছানা ধরবে এবং সেটি খাঁচায় বন্দি করে লালন পালন করবে।

টুনটুনির ছানাগুলোর ছিঁ ছিঁ আওয়াজ পেয়ে মা টুনটুনিটা বাসার কাছে এসে টুনটুন করে আওয়াজ করছে। সন্তান হারানোর শোকে মা টুনটুনিটা কাঁদছে কিন্তু অবুঝ অনিক তার সেই কান্না বুঝে না। মনের আনন্দে অনিক আর রবিন ছানাগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে এল। মা টুনটুনিটা বাচ্চার শোকে কাঁদতে কাঁদতে অনিকের পিছে পিছে তার বাড়ীর সামনে আসছে। একবার মা টুনটুনিটা উড়াল মেরে অনিকের কাছে আসে আবার দূরে চলে যাচ্ছে। আর টুনটুন করে কাঁদছে। টুনটুনি বলছে, ‘অনিক আমার বাচ্চাগুলোকে মেরো না। তাদেরতো কোন দোষ নেই। আমিতো তোমাদের কোন ক্ষতি করি নাই। তাহলে কেন তুমি আমার অবুঝ শিশু বাচ্চাগুলোকে ধরে নিলে?’ কিন্তু সেই বোবা পাখির মনের ভাষা অবুঝ অনিক বুঝে না।

অনিক তার বাবার কাছে বায়না ধরল একটা খাচা এনে দেয়ার জন্য। কারণ সে টুনটুনির ছানাগুলো খাঁচায় বন্দি করে পালবে। অনিকের বাবা চিন্তা করে দেখলো পাখির ছানা লালন পালন করলে হয়তো ছেলের দুষ্টুমিটা একটু কমবে। তাই ছেলের বায়না রাখতে গিয়ে অনিকের বাবা বাজার থেকে খাঁচা কিনে আনলেন। অনিক বাচ্চাগুলো খাঁচায় বন্দি করে রাখল।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শত চেষ্টা করেও যখন মা টুনটুনিটা তার বাচ্চাগুলোকে রক্ষা করতে পারেনি তখন মনের দুঃখে এ বাড়ি ছেড়ে তার নিজ বাসায় ফিরে গেল।

মা টুনটুনি তার বাচ্চাগুলোকে কোন ধরনের খাবার খাওয়ায় তা অনিকের জানা নেই। টুনটুনির ছানাগুলো নতুন পরিবেশে এসে তাদের কাছে অসহ্য লাগছে। একদিকে মা হারানোর বেদনা অন্যদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছানাগুলো ছিঁ ছিঁ করে কাঁদছে। এ দেখে রাতের বেলা অনিক টুনটুনির বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর জন্য কিছু চাউল নিল। তাকে দেখে বাচ্চাগুলো হা করল। অমনি অনিক তাদের মুখে চাউল তুলে দেয়। কিন্তু সে চাউল তাদের মুখে ঠিকমত পড়ে না। তাই অনিক বাধ্য হয়ে একটা একটা বাচ্চা ধরে মুখ হা করে টিপে টিপে ইচ্ছে মতো চাউল খাওয়ালো। একটা বাচ্চাকে এমনভাবে খাওয়ালো যে, পেটে আর জায়গা নেই। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

রাত অনেক হলো। অনিক ঘুমিয়ে পড়েছে। সে স্বপ্ন দেখছে তাকে দুজন সন্ত্রাসী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার মা-বাবা তার পিছে পিছে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও। অনিক নিজেও মা মা বলে কাঁদছে। কিন্তু কিছুতেই তারা অনিকের বাবা-মায়ের কথা শুনছে না। এক সময় তারা অনিকের চোখ বেধে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। অনেক রাত হলে তারা তাকে খাবার দেয়। অনিকের পেটে ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তাদের খাবার খাচ্ছে না। তখন তারা অনিককে গলা টিপে ধরে খাওয়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে অনিক হাউ-মাউ করে কেদে ঘুম থেকে উঠল। কান্নার আওয়াজ পেয়ে অনিকের বাবা-মাও ঘুম থেকে উঠল। অনিকের বাবা বলল, কি হয়েছো তোর কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছিস?

অনিক তখন চিৎকার করছে আর বলছে আমার টুনটুনির ছানা কোথায়? এই বলেই দৌঁড়ে পাখির খাঁচার দিকে ছুটে গেল। খাঁচাটি খুলে দেখলো একটি ছানা মারা গেছে এবং ঐ ছানাটির সারা শরীরে পিঁপড়া কামরাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে সে আরো জোরে হাউ-মাউ করে কাঁদছে।

পরদিন সকাল বেলা তার মামা আমির আসল বেড়াতে। অনিকের মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে। অনিক তার পাখির ছানার ঘটনাটি ও স্বপ্নের কথা তার মামার কাছে খুলে বলে। মামা সব ঘটনা শুনে বলল, দেখ অনিক মা-বাবা যে তার সন্তানকে কত ভালোবাসে তা তুমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছো। আজ সত্যি সত্যি যদি তোমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায় তাহলে তোমার মা নিশ্চয় কষ্ট পাবে?

অনিক মাথা নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ।
তুমিও তোমার মায়ের জন্য কষ্ট পাবে?
হ্যাঁ।
তেমনি টুনটুনির ছানাগুলো ধরে আনাতে টুনটুনির মা-বাবাও নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে তাই না?
হ্যাঁ মামা।
আর বচ্চাগুলোতো তাদের মায়ের জন্য কষ্ট পেয়েছে।
হ্যাঁ মামা।
অন্য পরিবেশে তাদের খাবার দেয়াতেও খেতে কষ্ট হয়েছে। তুমি জোর করে তাদের খাওয়ানোর ফলে পেট ফেপে একটি বাচ্চা মারা গেল। এই কাজটা কি তুমি ভাল করেছে?
অনিক নিশ্চুপ হয়ে গেল।
কি হলো বলো কাজটা কি ভালো হয়েছে? অন্যকে কষ্ট দিলে নিজেও কষ্ট সহ্য করতে হয়। তোমার যেমন প্রাণ আছে ঐ টুনটুনিরওতো প্রাণ আছে।
অনিক অনুতপ্ত হয়ে বললো, মামা আমার ভুল হয়েছে। আমি কাজটি ঠিক করিনি। আর কোনদিন পাখির ছানা ধরব না।
তাহলে এখন তাদেরকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসো।
ঠিক আছে মামা।

অনিক মৃত ছানাটি ফেলে দেয় আর মামার কথামতো মামাকে সাথে নিয়ে অনিক অন্য তিনটি ছানা নিয়ে টুনটুনির বাসায় রেখে আসে। অনিক ছানাগুলো বাসায় দিতেই মা টুনটুনি বাসায় আসল। এসেই বাচ্চাগুলোকে পেয়ে আনন্দে টুনটুন করে উঠল। আর এ দৃশ্য দেখে অনিক ও তার মামার চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু ঝড়ে পড়ল।

রচনাকাল-১৭ আগস্ট ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ।
[শব্দতরী পঞ্চম বর্ষ, ২০১৪, প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত]

আমির ইশতিয়াক সম্পর্কে

আমির ইশতিয়াক ১৯৮০ সালের ৩১ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার ধরাভাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শরীফ হোসেন এবং মা আনোয়ারা বেগম এর বড় সন্তান তিনি। স্ত্রী ইয়াছমিন আমির। এক সন্তান আফরিন সুলতানা আনিকা। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন মায়ের কাছ থেকে। মা-ই তার প্রথম পাঠশালা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন মাদ্রাসা থেকে আর শেষ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তিনি লেখালেখির প্রেরণা পেয়েছেন বই পড়ে। তিনি গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও সাহিত্যের সবগুলো শাখায় তাঁর বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর বেশ কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো- এ জীবন শুধু তোমার জন্য (২০০৩) ও প্রাণের প্রিয়তমা (২০০৬)। তাছাড়া বেশ কিছু সম্মিলিত সংকলনেও তাঁর গল্প, কবিতা ছাপা হয়েছে। তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় গল্প,কবিতা,ছড়া, ভ্রমণ কাহিনী ও কলাম লিখে যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ব্লগ ও ফেসবুক গ্রুপে নিজের লেখা শেয়ার করছেন। তিনি লেখালেখি করে বেশ কয়েটি পুরস্কারও পেয়েছেন। ফেসবুক লিংক- https://www.facebook.com/amirhossain243 ই-মেইল : [email protected] ব্যক্তিগত ব্লগসাইট: http://amirishtiaq.blogspot.com

2 thoughts on “মায়ের ভালোবাসা

  1. শব্দতরী’তে প্রকাশিত হয়েছিলো। তাইতো বেশ নস্টালজিক হলাম লিখাটি পড়ে।
    অভিনন্দন মি. আমির ইশতিয়াক। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।