ট্যাগ আর্কাইভঃ শিশুতোষ গল্প

মায়ের ভালোবাসা

অনিক খুব চঞ্চল স্বভাবের বালক। সারাদিন এ বাড়ী ও বাড়ী ঘুরে বেড়ানো যার কাজ। লেখা পড়ার দিকে তেমন কোন মনযোগ নেই। বাবা-মা স্কুলের কথা বললেই বন্ধুদের নিয়ে চলে যায় খেলার মাঠে। খেলার ছলে কখনো কাউকে চিমটি কাটে। কখনো বা ব্যাট দিয়ে কারো মাথা ফাঁটিয়ে দেয়। আবার কখনো রাগে কারো জামা ছিঁড়ে দেয়। ফল খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে কখনো কখনো অন্যের গাছে ঢিল মারে। একদিন পাশের বাড়ীর কুল গাছে ঢিল মেরে তাদের গরুর পানি খাওয়ার গামলা ভেঙ্গে দেয়। এই নিয়ে চলে দু’পরিবারের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। সেই থেকে অনিক আর সেই বাড়ীতে যায় না। দিনে অনন্ত ৪/৫টি নালিশ আসে তার বাবা-মার কাছে। বাবার বকুনি ও মায়ের শাসনে দিন কাটছে তার। তাই এখন আর সে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়ে না কিন্তু অন্য একটি নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। আর তাহলো পাখি শিকার করা। কারণ সে এতদিনে বুঝতে পেরেছে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়া অন্যায় কিন্তু পাখি শিকার করা অন্যায় না। পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখির ছানা ধরা এখন তার নেশা হয়ে গেছে। বনে জঙ্গলে, আশে পাশের ঝোপ ঝাড়, ক্ষেত-খামারে ঘুরে বেড়ানো এখন তার নিত্যদিনের কাজ। এ কাজে কেউ তাকে বাঁধা দেয় না। কেউ আর এখন পাখির বাসা ভাঙ্গার জন্য তার বাবা-মার কাছে নালিশ করে না। তাই মনের আনন্দে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পাখির ছানা ধরার নেশায় দিন রাত ঘুরে বেড়াচ্ছে অনিক।

অনিকের দুষ্টুমির সংঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছে তার প্রতিবেশী রবিন। সেই শিশুকাল থেকেই দু’জনে এক সাথে খেলা-ধূলা, মারা-মারি করে আসছে। একদিন দুজনে এক ঝোপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তারা টুনটুনি পাখির ছানার ছিঁ ছিঁ আওয়াজ শুনতে পায়।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে কোন কথা বলবি না। টুনটুনির ছানা ধরার সময় কথা বলা নিষেধ। তোর কথার আওয়াজ পেলে ফুরৎ করে টুনটুনির ছানা চলে যাবে। অনিক তার বন্ধু রবিনকে একথা বলেই টুনটুনির বাসার দিকে চুপি চুপি হাঁটতে লাগল। অনিক আগে রবিন পিছনে। অনিক সামনে থেকে দু’হাতে চেপে ধরে বাসাটি গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলে। আর অমনি বাসার ভেতর থেকে টুনটুনির চারটি ছানা ছিঁ ছিঁ করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু সেদিকে অনিকের কোন খেয়াল নেই। তার আনন্দ লাগলো এই ভেবে যে, সে আজ বিরাট কিছু জয় করে ফেলছে। অনেক দিনের শখ ছিল সে টুনটুনির ছানা ধরবে এবং সেটি খাঁচায় বন্দি করে লালন পালন করবে।

টুনটুনির ছানাগুলোর ছিঁ ছিঁ আওয়াজ পেয়ে মা টুনটুনিটা বাসার কাছে এসে টুনটুন করে আওয়াজ করছে। সন্তান হারানোর শোকে মা টুনটুনিটা কাঁদছে কিন্তু অবুঝ অনিক তার সেই কান্না বুঝে না। মনের আনন্দে অনিক আর রবিন ছানাগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে এল। মা টুনটুনিটা বাচ্চার শোকে কাঁদতে কাঁদতে অনিকের পিছে পিছে তার বাড়ীর সামনে আসছে। একবার মা টুনটুনিটা উড়াল মেরে অনিকের কাছে আসে আবার দূরে চলে যাচ্ছে। আর টুনটুন করে কাঁদছে। টুনটুনি বলছে, ‘অনিক আমার বাচ্চাগুলোকে মেরো না। তাদেরতো কোন দোষ নেই। আমিতো তোমাদের কোন ক্ষতি করি নাই। তাহলে কেন তুমি আমার অবুঝ শিশু বাচ্চাগুলোকে ধরে নিলে?’ কিন্তু সেই বোবা পাখির মনের ভাষা অবুঝ অনিক বুঝে না।

অনিক তার বাবার কাছে বায়না ধরল একটা খাচা এনে দেয়ার জন্য। কারণ সে টুনটুনির ছানাগুলো খাঁচায় বন্দি করে পালবে। অনিকের বাবা চিন্তা করে দেখলো পাখির ছানা লালন পালন করলে হয়তো ছেলের দুষ্টুমিটা একটু কমবে। তাই ছেলের বায়না রাখতে গিয়ে অনিকের বাবা বাজার থেকে খাঁচা কিনে আনলেন। অনিক বাচ্চাগুলো খাঁচায় বন্দি করে রাখল।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শত চেষ্টা করেও যখন মা টুনটুনিটা তার বাচ্চাগুলোকে রক্ষা করতে পারেনি তখন মনের দুঃখে এ বাড়ি ছেড়ে তার নিজ বাসায় ফিরে গেল।

মা টুনটুনি তার বাচ্চাগুলোকে কোন ধরনের খাবার খাওয়ায় তা অনিকের জানা নেই। টুনটুনির ছানাগুলো নতুন পরিবেশে এসে তাদের কাছে অসহ্য লাগছে। একদিকে মা হারানোর বেদনা অন্যদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছানাগুলো ছিঁ ছিঁ করে কাঁদছে। এ দেখে রাতের বেলা অনিক টুনটুনির বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর জন্য কিছু চাউল নিল। তাকে দেখে বাচ্চাগুলো হা করল। অমনি অনিক তাদের মুখে চাউল তুলে দেয়। কিন্তু সে চাউল তাদের মুখে ঠিকমত পড়ে না। তাই অনিক বাধ্য হয়ে একটা একটা বাচ্চা ধরে মুখ হা করে টিপে টিপে ইচ্ছে মতো চাউল খাওয়ালো। একটা বাচ্চাকে এমনভাবে খাওয়ালো যে, পেটে আর জায়গা নেই। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

রাত অনেক হলো। অনিক ঘুমিয়ে পড়েছে। সে স্বপ্ন দেখছে তাকে দুজন সন্ত্রাসী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার মা-বাবা তার পিছে পিছে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও। অনিক নিজেও মা মা বলে কাঁদছে। কিন্তু কিছুতেই তারা অনিকের বাবা-মায়ের কথা শুনছে না। এক সময় তারা অনিকের চোখ বেধে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। অনেক রাত হলে তারা তাকে খাবার দেয়। অনিকের পেটে ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তাদের খাবার খাচ্ছে না। তখন তারা অনিককে গলা টিপে ধরে খাওয়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে অনিক হাউ-মাউ করে কেদে ঘুম থেকে উঠল। কান্নার আওয়াজ পেয়ে অনিকের বাবা-মাও ঘুম থেকে উঠল। অনিকের বাবা বলল, কি হয়েছো তোর কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছিস?

অনিক তখন চিৎকার করছে আর বলছে আমার টুনটুনির ছানা কোথায়? এই বলেই দৌঁড়ে পাখির খাঁচার দিকে ছুটে গেল। খাঁচাটি খুলে দেখলো একটি ছানা মারা গেছে এবং ঐ ছানাটির সারা শরীরে পিঁপড়া কামরাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে সে আরো জোরে হাউ-মাউ করে কাঁদছে।

পরদিন সকাল বেলা তার মামা আমির আসল বেড়াতে। অনিকের মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে। অনিক তার পাখির ছানার ঘটনাটি ও স্বপ্নের কথা তার মামার কাছে খুলে বলে। মামা সব ঘটনা শুনে বলল, দেখ অনিক মা-বাবা যে তার সন্তানকে কত ভালোবাসে তা তুমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছো। আজ সত্যি সত্যি যদি তোমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায় তাহলে তোমার মা নিশ্চয় কষ্ট পাবে?

অনিক মাথা নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ।
তুমিও তোমার মায়ের জন্য কষ্ট পাবে?
হ্যাঁ।
তেমনি টুনটুনির ছানাগুলো ধরে আনাতে টুনটুনির মা-বাবাও নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে তাই না?
হ্যাঁ মামা।
আর বচ্চাগুলোতো তাদের মায়ের জন্য কষ্ট পেয়েছে।
হ্যাঁ মামা।
অন্য পরিবেশে তাদের খাবার দেয়াতেও খেতে কষ্ট হয়েছে। তুমি জোর করে তাদের খাওয়ানোর ফলে পেট ফেপে একটি বাচ্চা মারা গেল। এই কাজটা কি তুমি ভাল করেছে?
অনিক নিশ্চুপ হয়ে গেল।
কি হলো বলো কাজটা কি ভালো হয়েছে? অন্যকে কষ্ট দিলে নিজেও কষ্ট সহ্য করতে হয়। তোমার যেমন প্রাণ আছে ঐ টুনটুনিরওতো প্রাণ আছে।
অনিক অনুতপ্ত হয়ে বললো, মামা আমার ভুল হয়েছে। আমি কাজটি ঠিক করিনি। আর কোনদিন পাখির ছানা ধরব না।
তাহলে এখন তাদেরকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসো।
ঠিক আছে মামা।

অনিক মৃত ছানাটি ফেলে দেয় আর মামার কথামতো মামাকে সাথে নিয়ে অনিক অন্য তিনটি ছানা নিয়ে টুনটুনির বাসায় রেখে আসে। অনিক ছানাগুলো বাসায় দিতেই মা টুনটুনি বাসায় আসল। এসেই বাচ্চাগুলোকে পেয়ে আনন্দে টুনটুন করে উঠল। আর এ দৃশ্য দেখে অনিক ও তার মামার চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু ঝড়ে পড়ল।

রচনাকাল-১৭ আগস্ট ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ।
[শব্দতরী পঞ্চম বর্ষ, ২০১৪, প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত]

বন্ধু


মোহতেশাম ছোট্ট শিশু। বয়স আট কি নয়। সে তার বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় থাকে। এবার সে তার দাদার বাড়িতে এসে ঈদ করবে। সামনে কোরবানির ঈদ। তাই এ উপলক্ষে সে ঈদের দু’দিন পূর্বেই গ্রামের বাড়িতে চলে আসল। মেঘনার তীর ঘেষে তার দাদার গ্রামের বাড়ি।
মোহতেশামের গ্রাম দেখতে খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ হলে যে চলে আসে দাদার কাছে। তখন আর যেতে ইচ্ছে করে না তার। শহরের মত যানজট নেই এখানে। মুক্ত আবহাওয়ায় ছুটাছুটি করতে পারে। নেই কোন বাঁধা। নদীতে সাঁতার কেটে গোসল করতে পারে। আরও কত্ত কি! তাইতো তার গ্রাম এত ভাল লাগে।
শনিবার দিন শ্রীঘর বাজার থেকে তার দাদা একটা কুরবানির গরু কিনে আনল। দাদা যখন বাজারে যায়, তখন মোহতেশাম তার সাথে গিয়েছিল। সে গরুটি পছন্দ করেছে। কুচকুচে কালো ষাড়। নাদুস-নুদুস শরীর। গরু যখন বাড়িতে আনল তখন তার দাদাকে দিয়ে একটা ছবি তুলে রাখল।
ঈদের দিন সকাল বেলা চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। ছেলে-মেয়েদের কোলাহল। কেউতো এ মূহুর্তে বিছানায় নেই। সবাই মেঠে উঠল ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য। সবার মনে আজ শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মোহতেশাম তার দাদাকে সাথে নিয়ে মেঘনা থেকে গোসল সেরে আসল। মা সেমাই পাক করছে। বাবা-মা, দাদা সবাই এক সাথে মিলে সেমাই খেল।
মা পরিপাটি করে মোহতেশামকে কাপড় পড়িয়ে দিলেন। সুন্দর করে চিরুনী দিয়ে মাথা আচরিয়ে দিলেন। তারপর মোহতেশাম দাদার কাছে এসে বললো, দাদা!
দাদা বললেন, কি দাদা ভাই।
– চল আর দেরি কেন? ঈদগাহে যাই।
– হ্যাঁ চল দাদা ভাই।
– তাড়াতাড়ি চল দাদা নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।
দাদা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ তাইতো!
মোহতেশাম নামাজের বিছানা হাতে নিল। দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হলো। নানা রঙের পোশাক পড়ে কচি কচি ছেলে-মেয়েরা ঈদগাহে যাচ্ছে। মোহতেশাম পড়েছে পাঞ্জাবী ও পায়জামা। দাদা-নাতী যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখন একটি গরিব ছেলে এসে মোহ্তেশাম বললো, আমারে একটা ট্যাহা দ্যাও।
ছেলেটির পড়নে একটা অর্ধময়লা শার্ট ও একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। মুখটা শুকনা। তাকে দেখে মোহতেশামের মায়া লেগে গেল। সে ছোট থেকেই গরিব দু:খিকে ভালোবাসে। গরিবের দু:খ দেখলে তার চোখ দিয়ে জল এসে যায়।
মোহতেশাম ছেলেটিকে লক্ষ্য করে বললো, আচ্ছা তোমার নাম কি?
ছেলেটি বললো, আমার নাম রফিক।
– তোমার মা-বাবা নেই?
– ছেলেটির চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, আমার আব্বা নৌকা ডুইব্বা মইরা গেছে।
– আর তোমার মা?
– মা আমারে ছাইড়া আরেক বেডার লগে বিয়া বইয়া গেছে।
– এখন তোমার বাড়িতে আর কে আছে?
– আমার বুবু আছে। তার সাথে আমি থাহি। বুবু হারাদিন ভিক্ষা কইরা যা আনে তাই দিয়া আমডা চলি।
ছেলেটি মোহতেশামের কথার জবাব দিতে দিতে চোখে জল এসে গেল। মোহতেশামের দাদা এসব দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখছেন।
মোহতেশাম ছেলেটির গায়ে ময়লা জামাটার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কি আর কোন ভাল জামা নেই?
– না। ভালা জামা কত্তে আনমু। ঠিকমত তো খাইতেই পারি না।
মোহতেশামের এ দৃশ্য দেখে দাদা ভাবছে, এতোটুকু ছেলের গরিবের প্রতি কত দরদ!
মোহতেশাম তার বাবার কাছে এসে বললো, বাবা আমারতো অনেক জামা। একটা জামা ঐ গরিব ছেলেটাকে দিয়ে দেই?
ছেলের মুখে এ কথা শুনে বাবাতো রীতিমতো অবাক! তারপর বললো, তুমি যদি দিতে চাও, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
মোহতেশাম ছেলেটিকে তার একটা শার্ট ও দশটা টাকা দেয়। ছেলেটি টাকা ও জামা পেয়ে খুশীতে বাহ্ বাহ্ করতে থাকে। সে তার দু’হাত দিয়ে দু:খ ভরা অশ্রু মুছলো। তারপর বললো, আল্লাহ তোমারে অনেক বড়লোক করুক। বলেই ছেলেটি যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আর অমনি মোহতেশাম বললো, আর শোন! তুমি দুপুরে আমাদের বাসায় খাবে।
– ঠিক আছে। বলেই ছেলেটি চলে গেল।
পরে দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহে রওয়ানা হল।
সারি বেঁধে মানুষ ঈদগাহে যাচ্ছে। রাস্তায় যেন আজ লোক জনের ঢল নেমেছে। ধীরে ধীরে ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হলো। দাদা-নাতী দু’জনে পাশাপাশি নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে যখন ইমাম সাহেব খুৎবাহ পড়ছেন মোহতেশাম তা মনযোগ দিয়ে শুনছে। মুনাজাতের পর শুরু হলো কুলাকুলি পর্ব। সমবয়সী ছেলেরা পরপস্পরের সাথে কুলাকুলি করছে। মোহতেশামের ইচ্ছে দাদার সাথে কুলাকুলি করতে কিন্তু ছোট বলে তার দাদার বুক নাগাল পাচ্ছে না। তাই সে লাফ দিয়ে তার দাদার কোলে উঠে কুলাকুলি করলো। দাদাতো নাতীর বুদ্ধি দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
ঈদগাহ থেকে এসেই ইমাম সাহেব গরু জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। মোহতেশামের সমবয়সী ছেলে-মেয়েরা গরু জবেহ দেখার জন্য ইমাম সাহেবের পিছে পিছে ছুটল। মোহতেশামও ইমাম সাহেবের পিছনে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল্লাহু আকবার বলে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। গরুকে যখন মাটিতে শুয়ানো হল তখন সবাই গরুর কাছাকাছি চলে গেল। যখন আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালানো হল; তখন লাফিয়ে দৌঁড়ে চলে আসল মোহতেশাম।
মোহতেশামদের গরুটি জবেহ করার জন্য যখন ইমাম সাহেব তাদের বাড়িতে আসলেন তখন তার গরুটির প্রতি মায়া লেগে গেল। নিরীহ প্রাণীটি আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারে না মোহতেশাম। গরু জবেহ হয়ে গেল। গোস্ত কাটার কাজে লেগে গেল মোহতেশাম। গোস্ত কাটা শেষে মোহতেশাম বেড়িয়ে পড়লো ঐ এতিম ছেলেটির সন্ধানে। ছেলেটিকে খুঁজে বের করলো। এতিম ছেলেটিকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসল। তাদের গোস্ত রান্না হলে তাকে পেট ভরে খাওয়ালো। তারপর তাকে বললো, আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।
এরপর থেকে যখনই মোহতেশাম গ্রামের বাড়িতে আসত তখনই ছুটে যেত ঐ এতিম ছেলেটির কাছে। হাত বাড়িয়ে দিত বন্ধুত্বের।

টুনি ও প্রজাপতি


টুনি তার নাম। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। সে কেবল অ আ ক খ পড়ে। তার একটা বর্ণমালার বই আছে। বইটি খুবই সুন্দর। ছড়ায় ছড়ায় বর্ণমালা দিয়ে বইটি সাজানো। রঙিন সব ছবি। প্রজাপতির ছবি। পাখির ছবি। ফলের ছবি। ফুলের ছবি। প্রতিদিন জানালার পাশে বসে টুনি বর্ণমালার বই পড়ে।
জানালার পাশেই টুনির বাবা একটি ফুলের বাগান করেছে। সেই বাগানে বিভিন্ন জাতের ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। নানা জাতের ফুল ফুটেছে। টুনি প্রতিদিন সেই বাগানের যত্ন করে। বাগানে পানি দেয়।
একদিন টুনি দেখলো, ফুলবাগানে একটি প্রজাপতি আসল। হায়! কি অপরূপ! এমন সুন্দর প্রজাপতি টুনি আগে দেখেনি। কিন্তু এখন দেখামাত্রই সে চিনে ফেলল। কারণ সে তার বর্ণমালা বইয়ে এমন একটি প্রজাপতির ছবি দেখেছে এবং পড়েছে প-তে প্রজাপতি। লাল, নীল, হলুদ, কালো, মেরুনের চমৎকার ছোপ ছোপ সাজের প্রজাপতিটা উড়ছে। ফুল গাছের এ পাতা থেকে ও পাতায় বসছে। উড়ে উড়ে অপরূপ বর্ণচ্ছটাই বিকিরিত করছে দৃষ্টির তরঙ্গে।
হঠাৎ করে প্রজাপতিটা উড়াল দিল। টুনি তাকিয়ে থাকে প্রজাপতি চলে যাওয়া পথের দিকে। ওই তো রঙ্গিন প্রজাপতিটা উড়ে চলে যায় টুনির মাথার উপর দিয়ে অনন্ত পথের পানে। আর তখন টুনি এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

তারিখ: ১৪/০২/২০১৬খ্রি:

নালিশ


মনিষার বয়স এখন তিন বছর। সে এখন কথা বলতে পারে। খেলতে পারে। রাগ করতে পারে। বায়না ধরতে পারে। বিশেষ করে খাবার খাওয়ানোর সময় অনেক বায়না ধরে। কোন কিছুতেই ভুলিয়ে তাকে খাওয়ানো যায় না। তাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য রীতিমত তার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। তাকে খাবার খাওয়ানো যে কত কঠিন তা মনিষার মা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। কত রূপকথার গল্প ও মিথ্যার ভা-ার সাজিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাকে খাওয়াতে হয় তা বলা মুশকিল। কখনো এক লোকমা মুখে দিলে এ রুম ছেড়ে অন্য রুমে চলে যায়। এ নিয়ে তার মাকে সারাক্ষণ তার পিছনে দৌঁড়াতে হয়।
সেদিন অফিস থেকে এসেই দেখি মনিষার মা ফরিদা তাকে সারা ঘর দৌঁড়িয়ে খাবার খাওয়াচ্ছে। আমাকে দেখেই মনিষা দৌঁড়ে এসে আমাকে ঝাপটে ধরে বললো, আব্বু আমি আম্মুর হাতে ভাত খাব না। আম্মু আমাকে বকা দেয়! আমাকে মারে!
– কি বললে! তোমার আম্মু তোমাকে মারে?
– হ্যাঁ আব্বু।
এতটুকুন মেয়ে বাবার কাছে মায়ের নামে নালিশ করায় ফরিদা বললো, কি আমার নামে বাবার কাছে নালিশ! বলি কে খাওয়াবে তুকে? আমি আর পারব না। তোর আব্বুকে বল অফিস থেকে এসে তুকে যেন খায়য়ে দিয়ে যায়।
আমি তখন বললাম, ঠিক আছে আমিই আমার মেয়েকে খাওয়াবো। তোমাকে খাওয়াতে হবে না।
– তুমি বুঝবে কি কত কষ্ট করে এই মেয়েকে ভাত খাওয়াতে হয়। দেখ একদিন খাওয়ায়ে কেমন মজা লাগে।
– আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে নিই তারপর খাওয়াচ্ছি।
মনিষাকে নিয়ে ড্রাইনিং টেবিলে বসলাম। তারপর ফরিদাকে বললাম ভাত দেয়ার জন্য। ফরিদা ভাত বেড়ে দেয়ায় আমি মনিষাকে খাওয়ানোর জন্য প্লেট হাতে নিলাম। ভাত মেখে এক লোকমা হাতে নিয়ে বললাম, হা কর আম্মু।
– আব্বু আমি এখন খাব না। পরে খাব। তুমি খাও।
– আমিতো খাবই তুমিও খাবে আমার সাথে।
– খাও আম্মু ডিম দিয়ে খাও।
– আমি ডিম দিয়ে খাব না, মাছ দিয়ে খাব।
– ঠিক আছে মাছ দিয়ে খাও।
– মাছ দিয়ে খাব না, মুরগি দিয়ে খাব।
মনিষার এসব বায়না দেখে আমি তাকে ভয় দেখানোর জন্য বললাম, আম্মুু! ভাত না খেলে কিন্তু কাক আসবে! কাকে ভাত নিয়ে যাবে!! কিন্তু না কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তাই এবার নতুন পন্থা অবলম্বন করলাম।
– শোনো আম্মু! ভাত না খেলে শিয়াল আসবে! শিয়াল তোমাকে নিয়ে যাবে।
শিয়ালের কথা শুনে মনিষা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আব্বু শিয়াল কী?
– আগে ভাত খাও। তারপর বলব।
– না এক্ষুনি বল।
– বলছি তার আগে ভাত খাও।
শিয়াল সর্ম্পকে জানার জন্য এবার মনিষা হা করল। আর অমনি আমি তার মুখে পুড়ে দিলাম এক লোকমা ভাত।
কোনরকম এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই বললো, আব্বু বল না শিয়াল কী?
– শিয়াল মানে এটা দেখতে কুকুরের মতো। দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে।
– লুকিয়ে থাকে কেন?
– মানুষের ভয়ে।
– মানুষকে ভয় পায় কেন?
– মানুষ শিয়াল দেখলে মেরে ফেলে তাই।
– মানুষ শিয়াল মারে কেন?
– শিয়াল মানুষকে খেয়ে ফেলে তাই।
– শিয়াল মানুষকে খেয়ে ফেলে! বলেই আমাকে ঝাপটে ধরে আবার বললো, আব্বু আমি শিয়াল দেখব।
– হ্যাঁ আম্মু তোমাকে দেখাবো। আগে খাবার শেষ করে নাও।
– না! আগে শিয়াল দেখাও।
– দেখো! বেশি কথা বলো না! ভাত না খেলে সত্যি সত্যি শিয়াল এসে কামড় দিবে!
– তুমি মিথ্যে বলছো আব্বু! শিয়ালতো দিনের বেলা আসে না। বলেই দিল এক দৌঁড়। এক দৌঁড়ে দাদুর কাছে চলে গেল।
– দাদু! দাদু! আব্বু আমাকে ভয় দেখাচ্ছে।
নাতনীর কথা শুনে আম্মা আমাকে তলব করল।
– কিরে ফয়সাল তুই আমার নাতনীকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন?
– কি করব আম্মা? ভয় দেখিয়েতো ভাত খাওয়াতে পারছি না।
– ছোট বাচ্চাকে ভয় দেখাছনে।
– ওতো ভয়ও পায় না। বলে কি সে শিয়াল দেখবে।
মনিষা আবার আমার কাছে এসে বললো, আব্বু আমি শিয়াল দেখে তারপর ভাত খাব।
– ঠিক আছে বলছিতো আমি তোমাকে শিয়াল দেখাব। রাত হলে তারপর দেখাব। এখন তুমি ভাত খাও লক্ষ্মীটি।
– না! না!! না!!! খাব না। বলেই দিল দৌঁড়। আর আমনি আমার সাথে ধাক্কা লেগে হাতের প্লেটটি পড়ে ভেঙ্গে গেল।

রচনাকাল: ১০/০৯/২০১৫খ্রি:

প্রতিজ্ঞা


সেই ছোট বেলা থেকেই আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। লেখাপড়ার দিকে তেমন কোন মনযোগ ছিল না। মা-বাবা স্কুলে যাওয়ার কথা বললেই বন্ধুদের সাথে খেলার মাঠে চলে যেতাম। সারাদিন ডাংগুলি, গোল্লাছুট, ফুটবল, হা-ডু-ডু, কানামাছি, বৌছি খেলে দিন পার করতাম। তপ্ত রৌদের সময় মেঘনা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে বন্ধুদের সাথে সাতার কেটে ছুয়াছুয়ি খেলতাম। দুপুরের খাবারের কথা মনে করতাম না। তবে পড়ন্ত বিকেলে পেঠে যখন বেশি ক্ষুধা অনুভব করতাম তখন বাড়িতে ফিরতাম। খাবার দাবার ও পড়াশুনা নিয়ে মা অনেক বকাঝকা করতেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমি সারাক্ষণ নিয়ম মতো আমার কর্তব্য পালন করেই যাচ্ছি।
পাখি শিকার করা ছিল আমার আরেকটি নেশা। খেলাধূলার ফাঁকে ফাঁকে যখন অবসর পেতাম তখন পাখি শিকারে বের হয়ে যেতাম। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘরের কোনে চড়–ই পাখির বাসা খুঁজে বের করতাম। বাসা ভেঙ্গে চড়ুই পাখির ছানা নিয়ে আসতাম। আশে পাশের ঝোপÑঝাড়ের পাশে টুনটুনির বাসা খুঁজতাম। কোথায় টুনটুনির আভাস পেলে বাসা ভেঙ্গে টুনটুনির ছানা নিয়ে আসতাম। আরেকটি নেশা ছিল ছাগল পালন করা। পড়াশুনার প্রতি টান না থাকায় বাবা একটি ছাগল এনে দিলেন। সেই ছাগল নিয়ে প্রতিদিন মেঘনার পাড়ে চলে যেতাম। সারাদিন ছাগল ছেড়ে দিয়ে খেলাধূলা ও পানিতে লাফালাফি করে দিন পার করতাম। এভাবেই চলত আমার শৈশবের দিনগুলি।
দিন যায়, রাত আসে। দিনে দিনে বড় হচ্ছি আমি। বয়স আমার ৮ পার হয়ে গেল। আমি পড়াশুনার ধারধারেও নাই। আমার সমবয়ী অনেকেই স্কুলে যায়। আবার অনেকেই আমার মতো সারাদিন দুষ্টুমি করে দিন পার করে। আমার বন্ধু আজহারুল। একই দিনে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। সে এখন ক্লাশ টুতে পড়ে আর আমি কিছুই পড়িনা। এই নিয়ে আমার মায়ের খুব চিন্তা। তাকে দেখিয়ে মা আমাকে তিরষ্কার করে। প্রতিদিন মা আমাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বকাঝকা করেন।
মায়ের বকুনি খেয়ে মাঝে মাঝে স্কুলে গেলেও অন্য ছেলেদের অত্যচারে বেঞ্চে বসতে না পেরে চলে আসতাম। আমাকে দেখতে একটু বড় লাগায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হাসি ঠাট্টা করত। তখন আমি লজ্জা পেতাম। বাড়িতে এসে কেঁদে কেঁদে মাকে বলতাম, মা আমি আর স্কুলে যাব না।
আমার বড় ভাই আকবর হোসেন পড়াশুনায় খুবই ভাল। ক্লাশের ফার্স্ট বয়। ওনি প্রতি দিন প্রাইমারী স্কুলে যায়। রাতের বেলা প্রচুর পড়াশুনা করেন। আমাকে স্কুলে নেয়ার চেষ্টা করেও নিতে পারেন নাই। স্কুলে যাওয়ার জন্য ভাই আমাকে মাঝে মাঝে মারতেন। তারপরও আমি স্কুলে যেতাম না।
ইতোমধ্যে বড় ভাই পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ফেললেন। আমার দাদার স্বপ্ন ছিল আমার বড় ভাইকে মাদ্রাসায় পড়াবেন। আলেম বানাবেন। তাই পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর বড় ভাইকে আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। বড় ভাই ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। মাদ্রাসার পাশেই এক বাড়িতে বড় ভাইয়ের লজিং ঠিক হলো। ঐ বাড়ির তিনজন ছেলে আব্দুল আলী, মুঞ্জুর আলী ও জমির আলীকে বড় ভাই পড়াতেন। আব্দুল আলী ক্লাশ ফোরে, মুঞ্জুর আলী ক্লাশ থ্রিতে এবং জমির আলী ক্লাশ টুতে পড়ত। তাদেরকে পড়াতে গিয়ে বড় ভাই আমার কথা ভাবলেন। আমাকে ঐ মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিবেন এবং তার ছাত্রদের সাথে আমাকে পড়াবেন। বড় ভাই বাবাকে চিঠি লিখলেন আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করার কথা জানিয়ে। বাবা-মা ও দাদা সবাই রাজি হলেন। সবাই আমাকে বুঝালেন। আমার মতামত নিলেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
তিন মাস পর বড় ভাই বাড়িতে আসলেন। বড় ভাই আমার সম্মতি পেয়ে খুশি হলেন।
দুই দিন বাড়িতে থাকার পর বড় ভাই আমাকে নিয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। জীবনের প্রথম গ্রাম ছেড়ে নরসিংদী শহরে পা রাখলাম। শহরের চাকচিক্য দেখে খুব ভাল লাগল। বড় ভাই আমাকে নিয়ে বাসে উঠলেন। বাস যখন শেখেরচর আসল তখন আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমরা বাস থেকে নামার সাথে সাথে একটা আওয়াজ হলো। পিছন ফিরে দেখলাম আমাদের কাছ থেকে ২০০ গজ দূরে দুটো বাস মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। সাথে সাথে বেশ কয়েকজন মৃত্যু বরণ করল। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল রাজপথ। জীবনের প্রথম শহরে এসেই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলাম। যা হোক পরে আমরা প্রথমে বড় ভাইয়ের লজিং বাড়িতে আসলাম।
পরদিন মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য আমি পাঞ্জাবী, পায়জামা, টুপি পড়ে প্রস্তুত হলাম। বড় ভাই আমাকে নিয়ে মাদ্রাসায় আসলেন। আমি যেহেতু গ্রাম থেকে আসছি। তেমন ভাল পড়াশুনাও করিনি। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ এখনও সবগুলো পড়তে পারিনি। তাই আমি রিডিং পড়তে পারিনা। সবগুলো অক্ষর এখনও ঠিকমত লিখতে পারিনি। এমন অবস্থায় আমাকে বড় ভাই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার জন্য প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া কঠিন মনে হল। কিন্তু বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। বড় ভাই বললেন, কোন চিন্তা করিস না আমি পড়াব। সব পাড়বি।
মাদ্রাসা ১০ টা থেকে শুরু হয়। পরদিন আমি বড় ভাইয়ের সাথে মাদ্রাসায় আসলাম। বড় ভাই আমাকে প্রথম শ্রেণিতে বসিয়ে ওনি ওনার ক্লাশে চলে যান। আমি তখন সবার পিছনে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে অন্য ছাত্ররা বলাবলি করছে ও নতুন আইছে। যথারীতি আমি বই খুলে পড়তে শুরু করলাম। শ্রেণি শিক্ষক মোতালিব স্যার ক্লাশে আসলেন। সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। আমিও সালাম দিলাম। স্যার খুবই রাগি। সবাই এই স্যারকে ভয় পায়। স্যার আমাকে নতুন দেখে বলল, এই ছেলে এদিকে আস।
আমি এগিয়ে গেলাম স্যারের দিকে। স্যার বলল, তোমার নাম কি?
আমি বললাম, আমির।
– আমির অর্থ কি জান?
– না স্যার।
– আমির মানে নেতা। তুমি যদি ভালো করে লেখাপড়া কর। ক্লাশে যদি রোল নং ১ হয় তাহলে এ ক্লাশের নেতা হতে পারবে। কি ভালো করে লেখাপড়া করবে?
– জি স্যার।
– বাড়ি কোথায়?
– ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
– এতদূর থেকে কার সাথে আসলে?
– আকবর ভাইয়ের সাথে।
– ও আচ্ছা।
– ঠিক আছে যাও। প্রতিদিন নিয়মিত মাদ্রাসায় আসবে।
– আচ্ছা স্যার। বলেই আমি আবার সবার পিছনে গিয়ে বসলাম।
আমার নামের অর্থ নেতা। ক্লাশের নেতা হওয়ার জন্য মোতালিব স্যারের কথায় সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আমি ভালো করে লেখাপড়া করব এবং ক্লাশের নেতা হবো। তাই প্রতিদিন নিয়মিত মাদ্রাসায় আসতে লাগলাম। ক্লাশের ফার্স্ট বয় রায়হান আমাকে ভাল চোখে দেখত না। সে আমাকে অবজ্ঞা করে কথা বলত। আমি তাকে বলতাম দেখিস আমার রোল নং ১ হবে। আমার বড় ভাই আমাকে পড়ায়।
বড় ভাই আব্দুল আলী, মঞ্জুর আলী ও জমির আলীর সাথে আমাকেও পড়াতে শুরু করলেন। আমিও মনযোগ দিয়ে পড়ছি। প্রতিদিন আমি পড়া মুখস্থ করে মাদ্রাসায় যাই। ইতিমধ্যে আমি কয়েকজন হুজুর ও স্যারের নজরে পড়ে গেলাম। তখন থেকে সবাই আমাকে আদর করছে। বিশেষ করে যারা জেনেছে আমি আকবর এর ভোট ভাই তারাতো আমাকে আরো বেশি করে আদর করছে। তাঁরা আমার প্রশংসা করছে যে আমি এত ছোট হয়েও মা-বাবাকে ছেড়ে বড় ভাইয়ের সাথে লেখাপড়া করছি।
একদিন আমাদের শ্রেণি শিক্ষক মোতালিব স্যার বললেন, আমির তুমি আর পিছনে বসবে না। এখন থেকে সামনে বসবে। কিন্তু স্যারের কথা ফার্স্ট বয় রায়হান মানতে নারাজ। তার কথা সে ক্লাশের ফার্স্ট বয়। সে ছাড়া অন্য কেউ প্রথম বেঞ্চে বসতে পারবে না। এই নিয়ে আমার সাথে রায়হানের মারামারি হয়। স্যার এই খবর জানতে পেরে রায়হানকে বেত দিয়েছে। সেই থেকে রায়হান আমাকে শত্রুর মতো মনে করত। কোন কিছু জিজ্ঞাস করলে বলতনা। নিজেকে বেশি জ্ঞানী মনে করত।
একবার আলোচনা উঠলো ক্লাশের ফার্স্ট বয় রায়হানকে নিয়ে। সবাই বলাবলি করছে, ও খুব মেধাবী। ওকে ঠেকাতে কেউ পারবে না। আমরা যা পারি না ও না পড়লেও সব পেড়ে যায়।
সুমন বললো, আমারতো মনে হয় না ওকে কেউ পিছনে ফেলতে পারবে।
আরেকজন পিছন থেকে বলে উঠল, আমির ক্লাশের নতুন ছাত্র। সেও কিন্তু কম না। খুব মেধাবী। এই পর্যন্ত যতদিন ক্লাশে এসেছে ততদিন সে পড়া পেড়েছে। কোনদিন স্যারের পিটুনি খায়নি। ছাত্র হিসেবে খারাপ নয়। তা ছাড়া তার স্বভাব-চরিত্রও যথেষ্ট ভাল। সে প্রতিজ্ঞাও করেছে সে ক্লাশ টুতে ফার্স্ট বয় হবেই।
আরেকজন বললো, আসলে সবাই পাড়বে যদি সঠিক মনোবল, সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও পর্যাপ্ত পরিশ্রম করে। আমি কিন্তু আমিরের প্রতিভাকে অস্বীকার করছি না।
ততক্ষণে আমি বলে উঠলাম, বন্ধুরা তোমরা চিন্তা করবে না। যে রায়হান আমাকে দেখতে পারে না তাকে আমি বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষার পরই প্রমাণ করে দিব আমিও পারি।
রায়হান বলে উঠলো, পারবি না আমাকে ঠেকাতে। চ্যালেঞ্জ তোর সাথে।
আমি বললাম, ঠিক আছে তোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।
দৃঢ় প্রতীজ্ঞা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি এখন আগের চেয়ে পড়ায় বেশি মনোযোগি হলাম। দিন যায় রাত আসে এভাবে চলতে চলতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলে আসল। মে মাসের প্রথম সাপ্তাহে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হল। ক্লাশের সবাই দীর্ঘ চার মাস লেখাপড়া করেছে আর আমি মাত্র এক মাস লেখাপড়া করেছি। এমতাবস্থায় পরীক্ষা আরম্ভ হলো। পরীক্ষা দিলাম। কিছুদিন পর রেজাল্ট দিল। সবগুলো খাতার নম্বর যোগ করে দেখলাম। আমি রায়হানের চেয়ে ১০ নম্বরে পিছিড়ে রয়েছি।
শিক্ষক, ছাত্র/ছাত্রীরা সবাই আমার রেজাল্ট দেখে অবাক হয়ে গেল। এত অল্পদিনে কিভাবে আমি এত ভাল রেজাল্ট করতে পারলাম। সকল স্যার ও হুজুররা আমার জন্য দোয়া করল। তারপর থেকে আমি আরো দ্বিগুন উৎসাহ পেলাম। এদিকে আমার বড় ভাইয়ের ছাত্র আব্দুল আলী, জমির আলী ও মঞ্জুর আলীও মনযোগ দিয়ে পড়ছে। আমাদের চারজনের প্রতি বড়ভাইয়ের একটাই নির্দেশ অবশ্যই মনযোগ দিয়ে পড়তে হবে এবং ক্লাশের ফার্স্ট বয় হতেই হবে। এর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।
দেখতে দেখতে বার্ষিক পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষা দিলাম। সব পরীক্ষা ভাল হয় আমার। যথারীতি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে ক্লাসমেটসহ শিক্ষকবৃন্দ তো বটেই আমি নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেলাম। রেজাল্ট ভাল হবে শুধু এতটুকুই জানতাম এবং আমি ক্লাশের ফার্স্ট বয় হব সবাই জানত কিন্তু এতটা ভালো রেজাল্ট হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি সারা মাদ্রাসায় গড়ে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও আরবি বিষয়ে মোট ৪০০ মার্কের পরীক্ষা হয়েছিল। সবগুলো বিষয়ে ১০০ থেকে ১০০ পেয়েছি। কিন্তু একশ থেকে একশ পাওয়ার বিধান ঐ মাদ্রাসায় না থাকায় প্রতি বিষয়ে ১ করে কম দিয়ে ৩৯৬ নম্বর প্রদান করে আমাকে। যা গড়ে ৯৯% হয়। গড়ে ৯৯% নম্বর একমাত্র আমিই পেয়েছি। আর আমাদের ক্লাশের রায়হান পেয়েছে মাত্র ৮০% নম্বর!
এদিকে আমার রেলাল্ট ভাল হওয়ার পাশাপাশি আরো জানলাম বড় ভাইসহ তার তিন ছাত্র আব্দুল আলী, জমির আলী ও মঞ্জুর আলীসহ সবাই যার যার ক্লাশে ফার্স্ট বয় হয়েছে। এই ঘটনায় মাদ্রাসার সুপার অবাক হয়ে যান যে, তা কি করে সম্ভব! সকল ছাত্রছাত্রী শিক্ষকবৃন্দ আমাদের প্রশংসা করতে লাগলেন।
তারপর থেকে আমি একনাগারে ক্লাশ টেন পর্যন্ত প্রতি ক্লাশে ফার্স্ট বয় ছিলাম। কেউ শত চেষ্টা করেও আমাকে আর পিছনে ফেলতে পারেনি। আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও মনোবল আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে। আর অহংকারী রায়হান ক্লাশ ফাইভ পাস করার পর পড়াশুনা থেকে চিটকে পড়ল।

রচনাকাল- ২০/০৯/২০১৪খ্রি:

ভিক্ষুক


সবুজ গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। বাংলাদেশের অন্যতম নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা একটি বৃহৎ নদী। এই গ্রামেই বসবাস করে সুসানের দাদা। এখানেই তার বাবার জন্ম। সুসান তার বাবার সাথে ঢাকায় বসবাস করে। সে মাঝে মাঝে বাবা-মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসে।
গত দুইদিন হয় গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে সুসান গ্রামে এসেছে। এখন সুসানের বয়স ১১ বছর। এ বছর পঞ্চম শ্রেণী পড়ছে। ছাত্র হিসেবে সুসান খুবই ভাল। ক্লাশ রোল নং-১। প্রতি ক্লাশেই তার রোল ১ ছিল। কেউ তার সাথে প্রতিযোগিতা করে ঠিকে থাকতে পারেনি। প্রতিবারই সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম স্থান দখল করে নেয়। সুসান গ্রামে এসে দেখে তার সমবয়সী অনেক ছেলে-মেয়ে এখনও স্কুলেও যায়নি। সুসানকে নিয়ে তার দাদা-দাদীর খুব গর্ববোধ করেন। পাড়ার সকলের সাথে নাতীর সুনাম বয়ে বেড়ায়।
একদিন সকাল বেলা সুসান লক্ষ করল এক ভিক্ষুক তাদের বাড়ির গেইটে এসে ধাক্কাচ্ছে আর বলছে, আল্লাহরওয়াস্তে ভিক্ষা দিবেন। পরনে ময়লা ছেঁড়া পোশাক। পায়ে জুতা নেই। মুখভর্তি সাদাপাকা দাড়ি। ইয়া বড় গ্রোফ। মাথায় ঝটপাকানো এলোমেলো চুল। সাদা পাকা চুলের মিশ্রন। মনে হয় যেন চুল, দাড়ি গ্রোফের সাথে ব্লেডের কোন সর্ম্পক নেই। তার কাধে একটি ব্যাগ। সারাদিন ভিক্ষা করে যা পায় তা এই ব্যাগে রাখে।
ভিক্ষুকের ডাক শুনে সুসান গেইট খুলে ভিক্ষুকের সামনে আসল। সাথে সাথে তার দাদাও আসল। দাদা ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে বললেন, কি চায়?
ভিক্ষুকটি মলিন মুখে বললো, আল্লাহরওয়াস্তে ভিক্ষা চাই।
না না ভিক্ষা দেয়া যাবে না। মাফ করেন।
ক্যান ভিক্ষা দেয়া যাবে না? মাফ করব ক্যান? আমি যতবারই আসি ততবারই বলেন মাফ করেন। আপনি ভিক্ষা না দিলে খামু কি?
কেন কাজ করে খেতে পার না। হাত, পা, মুখ সবইতো ভালো দেখছি।
জানেতো কুলাই না সাব।
তুমি যে কাজ করতে পার সে কাজ কর।
সুসান এতক্ষণ দাদা ও ভিক্ষুকের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছে। এবার সুসান ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে বললো, হ্যাঁ দাদা ঠিক বলেছে, ভিক্ষা করেন কেন? কাজ করে খান। নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা। ভিক্ষা করা ভালো না। অন্যের করুণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
ভিক্ষুক বললো, কাজ কোথায় পাব? কে দিবে কাজ?
আমাদের বাড়িতে থাকবে? দাদা দিবে কাজ।
দাদা ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে বললেন, হ্যাঁ তুমি কি কাজ করতে চাও বল। আমি তোমাকে কাজ দেব। তবুও ভিক্ষা করো না।
ভিক্ষুক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, আপনি যা কাজ দিবেন তাই করব।
ঠিক আছে তোমার কাছ হচ্ছে আমাদের বাড়ী দেখাশুনা করা, বাজার সদায় করা।
কত টাকা দিবেন সাব।
তিন বেলা খাবার ফ্রি। মাসে ৫,০০০/- টাকা দিব। কি চলবে?
হ্যাঁ চলবে।
তোমার বাড়ীতে কে কে আছে?
এ কথা বলার সাথে সাথে ভিক্ষুকের চোখ বেয়ে জল বেয়ে পড়তে লাগল।
কি হলো কাঁদছ কেন? কি হয়েছে তোমার?
ভিক্ষুক চোখের জল মুছে বললো, সাব আমার কেউ নেই। গত বছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় ডুইবা আমার ছেলে-মেয়ে ও বউ সবাই মইরা গেছে। সে সময় আমিও ঐ লঞ্চে ছিলাম। কিন্তু আমি পারিনি তাদেরকে বাঁচাতে। সেই থেকে আমি কাজ কর্ম বাদ দিয়ে পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছি।
ভিক্ষুকের দুঃখের কথা শুনে সুসানের দাদারও চোখে জল এসে গেল। তিনি চোখ মুছে বলনে, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করেন। তুমি এখন থেকে আমার বাড়ীতে থাকবে। তোমার সব দায়-দায়িত্ব আমার।
ভিক্ষুক বললো, তয় সাব আপনি আমাকে কাম দিয়া বড়ই উপকার করছেন। এখন থেকে আর আমি ভিক্ষা করুম না।
দাদা পকেট থেকে ৫০০ টাকার একটি নোট বের করে বললেন, এই নাও। এই টাকা দিয়ে চুল, দাড়ি, গ্রোফ কেটে পরিষ্কার করবে এবং একটি ভাল শার্ট কিনবে। এখন যাও, কাল আসিও।
ভিক্ষুক টাকাটা নিয়ে চলে গেলেন।
সুসানের মনে পড়ে গেল কয়েক মাস আগের এক ভিক্ষুকের কথা। একদিন সকাল বেলা সুসান পড়ার টেবিলে পড়ছিল। তখন এক ভিক্ষুক তাদের ঢাকার বাসায় এসে কলিং বেল চাপল।
সুসানের মা রাত একটার আগে ঘুমাতে যায় না। প্রায় প্রতি রাতেই টিভি দেখে গভীর রাতে ঘুমাতে যায়। তাই সকাল বেলা তার উঠতে দেড়ী হয়। নয়টার আগে ঘুম ভাঙ্গে না। আজ হঠাৎ এত সকালে ভিক্ষুকের কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে তার মন বিগরে গেল। ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খুলল। সাজ সকালে ভিক্ষুককে দেখে তার রাগ চরমে উঠলো। কি চাই?
ভিক্ষুকটি ভয় পেয়ে গেল। ভেজা কণ্ঠে বললো, মাগো সারা রাত কিছু খায় নাই। তই এত সহালে আইছি। কিছু ভাত দেবে।
তুর ছাই ভিক্ষুক আসার সময় পাইলিনা। আমার কাচা ঘুমটা ভেঙ্গে এখন বলছিস ভাত খায় না। যা যা পরে আসিস। এই বলে দরজাটা লাগিয়ে দিল। সুসান তখন পড়ার টেবিলে বসে সব লক্ষ করল। তখন সুসান বললো, মা তুমি এত সকালে ভিক্ষুকটাকে বকাঝকা করলে কেন? ভিক্ষা দিলে কি হতো?
চুপ তুই কোন কথা বলবি না। বলেই আবার ঘুমাতে চলে গেল।
অথচ আজ তার দাদা এই ভিক্ষুকের সাথে কত ভদ্র ভাষায় কথা বললেন। আবার তাকে কাজ করার ব্যবস্থাও করে দিলেন।
পরেদিন ভিক্ষুক লোকটি চুল, দাড়ি, গ্রোফ কেটে সুন্দর একটি শার্ট গায় দিয়ে আসলো। ভিক্ষুককে দেখে প্রথমে দাদা চিনতে পারে নি। পরে পরিচয় দেওয়ার পর চিনতে পারলো। ভিক্ষুকটি দাদার পায়ে ধরে সালাম করে বললো, সাব এখন থেকে আমি আপনার বাড়িতে কাজ করুম।
দাদা বললেন, ঠিক আছে। দেখেছো একদিনে তোমার কি পরিবর্তন হয়েছে।
হ্যাঁ সাব সব আপনার দোয়ায়।
সেই থেকে ভিক্ষুকটি সুসানের দাদার বাড়িতে নিয়মিত কাজ করতে লাগলো। আর কোন দিন ভিক্ষা করেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বাড়িতেই কাটিয়েছে।
আজ সুসান অনেক বড় হয়েছে। তার দাদা-দাদী কেউ আজ বেঁচে নেই। নেই সেই ভিক্ষুকটি। যার সাথে সুসানের ছিল বন্ধুত্ব। যতবারই বাড়িতে যেত সেই ভিক্ষুকটির কাছ থেকে গল্প শুনতো। জীবনের গল্প। জীন-পরীর গল্প।
রচনাকাল-১৬ মে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ।

সিয়ামের নীল ঘুড়ি


গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদার বাড়িতে বেড়াতে আসল সিয়াম। সে বিকেল বেলা মাঠের ধারে খেলা করতে গেল। তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল নাটাই হাতে বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে। মাঠে তখন সোনালী রোদ জলমল করছে। গাঢ় নীল আকাশে সাদা-সাদা ছেঁড়া মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এমনই সুন্দর বিকালে আকাশ ভর্তি লাল, কালো, নীল, সবুজ ঘুড়িসহ আরো কত রকমের ঘুড়ি যে উড়ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কোনো ঘুড়ির লম্বা লেজ, দেখতে অনেকটা সাপের মতো। আকাশে সাপের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। আরো অনেক রকম ঘুড়ি আছে। কোনোটা বিমানের মতো, কোনোটা পাখির মতো, কোনোটা আবার ছিল বাক্সের মতো, কোনটা প্রজাপতির মতো।
সিয়াম লক্ষ্য করলো একটি ছেলে একটি ঘুড়ির মাথায় বাঁশের কঞ্চি বাকা করে তার মধ্যে এক ধরনে প্লাস্টিকের পাতলা পাত লাগিয়ে আকাশে উড়াচ্ছে। সেই ঘুড়ি যখন আকাশে উড়ছে বাতাসে বারি খেয়ে তখন চং চং করে শব্দ করছে। অনেক দূর থেকে সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে।
কেউ কেউ একে অপরের ঘুড়ির সাথে সুতা দিয়ে কাটাকাটি করছে। যাদের ঘুড়ি সবচেয়ে উপরে, মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়তে থাকে; তারা খুশিতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, আমার ঘুড়ি মেঘের দেশে চলে গেছে। আমার ঘুড়ি প্রথম হয়ে গেছে কী মজা… কী মজা… আমার ঘুড়ি সবচেয়ে সেরা ঘুড়ি!
সিয়াম দেখতে পেল এক লাল ঘুড়ির মধ্যে নীল ঘুড়ির ভীষণ লড়াই চলছে। এ দেখে সিয়ামেরও ঘুড়ি উড়ানোর শখ জাগছে। আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি দেখে, আপন মনে ঘুড়ির সাথে কথা বলে সিয়াম। দাদার কাছে তার একটাই আবদার। একটা নীল ঘুড়ি, যেটা সে সবচেয়ে উঁচুতে ওড়াবে! মেঘের অনেক কাছে তার নীল ঘুড়িকে সে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। নীলকাশ আর নীল ঘুড়ি একাকার হয়ে যাবে।
দাদা ভাই, আমাকে একটা নীল ঘুড়ি ও নাটাই এনে দাও না! গ্রামের ছেলেরা ওড়ায় আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখি।
– তুমিতো শহরের ছেলে গ্রামের ছেলেদের সাথে তুমি পারবে না।
– আমি পারব দাদা ভাই।
– ঠিক আছে আমি কালই বাজার থেকে তোমার জন্য একটি ঘুড়ি নিয়ে আসব।
দাদা ভাইয়ের ঘুড়ি কিনে দেয়ার শুনে সিয়াম খুব খুশি হলো। এবার সে যে ক’দিন এখানে আছে সেকদিন আনন্দে ঘুড়ি উড়াবে।
পরদিন সিয়ামের দাদা ভাই বাজারে থেকে সুন্দর একটা নীল রঙের ঘুড়ি ও নাটাই কিনে এনেছে। আর এক রিল নাইলনের সুতো। কেমন জ্বলজ্বল করছে সুতোটা। ঝিলমিল করছে রোদে। দাদা ভাই ওগুলো এনে সিয়ামকে বললো, কইরে আমার দাদা ভাই! এই দেখো, তোমার জন্য কী এনেছি।
সিয়ামতো নীল ঘুড়ি দেখে খুশিতে আত্মহারা। সে বললো, দাদা ভাই এত সুন্দর ঘুড়ি!
– হ্যাঁ দাদা ভাই, তুমি আমার আদরের নাতী। সবচেয়ে সেরাটাই তো তোমাকে দেব, তাই না!
– দাদা ভাই তুমি খুব ভালো। বলেই সিয়াম দাদা ভাইকে একটি চুমো দিল।
বিকেল বেলা সিয়াম দাদা ভাইকে নিয়ে মাঠে গেল ঘুড়ি উড়াতে। দাদা ভাই সিয়ামের ঘুড়িটি আকাশে উড়িয়ে দিল। এরপর সিয়ামের হাতে নাটাই ধরিয়ে দিল। সিয়াম সুতা ছাড়ে আবার নাটাই ধরে টান দেয়। আবার সুতা ছাড়ে আবার নাটাই ধরে টান দেয়। একবার এদিকে টান দেয়। আবার ওদিকে টান দেয়। এইভাবে ঘুড়ি আস্তে আস্তে উপরে উড়ছে। একেবারে মেঘের দেশে মিশে যাচ্ছে। একবার মেঘের দেশে হারিয়ে যাচ্ছে আবার ভেসে বেড়াচ্ছে। তখন সিয়াম লাফিয়ে বলে উঠল, আমার ঘুড়ি প্রথম হয়েছে। আমার ঘুড়ি সেরা ঘুড়ি।
সিয়ামের ঘুড়ি উড়ানো দেখে আশে পাশের অন্য সকল ছেলেরা তখন তাকিয়ে দেখছে।

তারিখ: ২৭/১২/২০১৫

আনিকার কবুতর


সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আনিকা। তার পুরো নাম আফরিন সুলতানা আনিকা। আব্বু-আম্মু আদর করে ডাকে আনিকা। এই বয়সেই পোষা প্রাণীর প্রতি তার অনেক দরদ। এইতো কিছু দিন আগে আনিকার আব্বু তার নামে আকিকা দেয়ার জন্য একটি খাসী কিনে আনলেন। খাসী দেখে আনিকা খুব খুশি হয়। এই খাসী সে পালবে। কিছুতেই এই খাসী জবেহ করতে দিবে না। রাতে ঘুমানোর আগে আনিকা তার আব্বুকে বলছে, আব্বু আমার খাসী তুমি জবেহ করবে না। আমি তাকে জবেহ দিব না। যদি তুমি জবেহ কর তাহলে কিন্তু আমি খুব কান্না করব।
মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আনিকার আব্বু ইশতিয়াক আহমেদ বললো, ঠিক আছে আম্মু। এখন ঘুমাও।
আনিকা ঘুম থেকে উঠার আগেই খাসীটি আল্লাহর রাস্তায় জবেহ করে দেয়া হল। সকাল বেলা আনিকা ঘুম থেকে উঠে খাসীর মাংস কাটতে দেখে সেকি কান্না! কাঁদো কাঁদো স্বরে আব্বুকে বললো, আব্বু তুমি আমার কথা রাখনি। তোমার সাথে আড়ি।
তারপর থেকে আনিকা সারাদিন তার আব্বুর সাথে কথা বলেনি।
কিছুদিন পরই আসল কোরবানির ঈদ। আনিকা তার আব্বু-আম্মুর সাথে ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে গেল। তার দাদা ভাই বড় একটি গরু আনলেন কোরবানি দেয়ার জন্য। আনিকা গরু দেখেতো খুব খুশি। সে তখন দাদা ভাইকে বলছে, দাদা ভাই, এই দাদা ভাই!
আনিকার দাদা শরীফ আহমেদ বললেন, কি দিদি ভাই কিছু বলবে?
আনিকা মাথা ঝাকিয়ে বললো, হ্যাঁ।
– বল কি বলবে?
– দাদা ভাই এই গরুটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এটা পালবো।
– এটা পালার জন্য আনিনি দিদি ভাই। এটা ঈদের দিন কোরবানি দিব।
– কোরবানি কি দাদা ভাই?
– আল্লাহ রাস্তায় জবেহ করব।
– কি বললে! আমি এটা জবেহ করতে দিব না। আমি এটা পালবো। বলেই কান্না করতে লাগল।
নাতনীকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য শরীফ আহমেদ বললেন, কাঁদে না লক্ষ্মী দিদি ভাই। ঠিক আছে তুমিই পালবে। এটা জবেহ করব না।
কিন্তু দাদা ভাইও সেই কথা রাখেনি। ঈদের দিন অন্য ছেলে-মেয়েদের মতো আনিকাও যখন আনন্দ করছে ঠিক সেই মুহূর্তে দাদা ভাই তার প্রিয় গরুটি কোরবানি দিয়ে দিলেন। এই দৃশ্য দেখে তখন আনিকা প্রচ- কেঁদেছে। আনিকা তার দাদুকে বলছে, দুাদু আমার দাদা ভাই আমার কথা রাখেনি। আমার প্রিয় গরু জবেহ করে দিয়েছে। আমি আর তোমাদের বাড়িতে আসব না।
আনিকার প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কেউ বুঝে না। আব্বু যেমন বুঝে না। দাদা-দাদুও বুঝে না। তাই তাদের প্রতি আনিকার রাগ।
আনিকা যেই ঘরে থাকে সেই ঘরের কোণে চড়ুই পাখি বাসা বানাইছে। সেই বাসায় ইতিমধ্যে দুটো ছানা হয়েছে। প্রতিদিন চড়ুই পাখির কিচির মিচির শব্দে আনিকার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠেই আনিকা আব্বুকে বলে, এই আব্বু!
আনিকার আব্বু ঘুমের ঘুরে বলে, কি আম্মু। বল কি বলতে চাও।
– আব্বু আমাকে একটি চড়ুই ছানা এনে দাও। আমি পালব।
– চড়ুই ছানা আনলে ছানার মা কান্না করবে।
– কান্না করবে না। আমি ভাত খাওয়াব। চাউল খাওয়াব। গম খাওয়াব।
আনিকার মা ইয়াছমিন তার আব্বুকে বললো, এই শোন না। সে যখন পাখি পালার এত শখ একটি কবুতর এনে দাও না।
– কবুতরতো সে পালতে পারবে না।
– আমি পালব। তুমি একটা খাঁচা ও কবুতর এনে দাও।
– ঠিক আছে তাই করব।
আনিকা এবার খুশি হলো। আব্বুকে গলায় জড়িয়ে ধরে চুমো দিয়ে বললো, তুমি আমার লক্ষ্মী আব্বু।
পরদিন ইশতিয়াক আহমেদ আনিকার জন্য একটি কবুতর ও খাঁচা এনে দিল। কবুতর দেখে আনিকা কত যে খুশি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
সেই থেকে আনিকা কবুতরকে লালন পালন করতে লাগল। আনিকা কবুতরকে খুব আদর করে, ভালোবাসে। তাকে গম, চাউল খাওয়ায়। পানি খাওয়ায়। কখনো কখনো তাকে ধরে চুমো খায় আর বলে, লক্ষ্মীসোনা কাঁদে না। তখন কবুতর বাক-বাকুম করে ডাক দেয়। আনিকা তখন হেসে তার আম্মুকে বলে, দেখ আম্মু আমার কবুতর আমার সাথে কথা বলে।
কবুতর নিয়ে আনিকার ব্যস্ত দিন কাটে। সারাক্ষণই কবুতরের যত্ন করে। একটু চোখের আড়াল করতে চায় না তাকে।
এভাবে যখন আনিকার দিনগুলো ভালোই চলছিল তখন হঠাৎ করে শখের কবুতরের অসুখ হলো। কিযে হলো কবুতরের কেউ বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে খাওয়া বন্ধ করে দিল। কিছুতেই কোন খাবার কবুতরকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। আনিকার আব্বু-আম্মু অনেক চেষ্টা করল। জোর করে হা করিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সেগুলোও সে ফেলে দেয়। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ইশতিয়াক আহমেদ। আনিকার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মুখ মলিন। তার চেহারায় কান্নার ছাপ ভেসে উঠল। আনিকা তার আব্বুকে বলছে, ও আব্বু, আব্বু তুমি আমার কবুতরকে ডাক্তার দেখাও।
আনিকার কথায় ইশতিয়াক আহমেদ পশু ডাক্তারের নিকট গেলেন। ওখান থেকে ঔষধ এনে খাওয়ালেন কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে। এভাবে একদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কবুতর খুবই দুর্বল হয়ে গেল। কবুতর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। হঠাৎ করেই খাঁচার ভেতর শুয়ে পড়ল। এই দৃশ্য দেখে আনিকা তার আম্মুকে ডাকছে, আম্মু… ও আম্মু… দেখ আমার কবুতর যেন কি করছে।
আনিকার মা দ্রুত কবুতরের খাঁচার কাছে এসে খাঁচা খুলে কবুতরটি হাতে নিলেন। কবুতরটি হাতে নিতেই মরে গেল। এ দৃশ্য দেখে আনিকা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল। তার কান্নায় বাড়ির আশে পাশের লোকজন জমে গেল। একটা বোবা পাখির জন্য ছোট্ট একটি মেয়ে যে এত কাঁদতে পারে তা ভাবতেই অবাক লাগছে প্রতিবেশীদের কাছে।
আনিকার আম্মু মরা কবুতরকে ফেলে দিতে চাইছিল কিন্তু আনিকা দেয়নি। সে এটা তার আব্বুকে দেখাবে।
কিছুক্ষণ পর ইশতিয়াক আহমেদ বাসায় আসলেন। আব্বু আসায় আসতেই আনিকা বলছে, আব্বু, এই আব্বু আমার কবুতর মরে গেছে। বলেই কাঁদতে লাগল।
আব্বু আনিকাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, আম্মু তুমি কেঁদ না। তোমাকে আমি আরেকটি কবুতর এনে দিব।
– না আব্বু। আমাকে এই কবুতর এনে দাও।
– ঠিক আছে। কালই তোমাকে কবুতর এনে দিব।
এই বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে কবুতরটিকে ফেলে দিতে গেলেন কিন্তু আনিকা বলছে, আব্বু তুমি এটা ফেলে দিবে না। এটা কবর দিয়ে দাও। আমার নানা ভাইকে যেভাবে কবর দিয়েছে সেভাবে করব দিয়ে দাও। আমি প্রতিদিন আমার কবুতরের করব দেখব।
আদরের মেয়ে আনিকার কথামতো ইশতিয়াক আহমেদ সত্যিই কবুতরটিকে তার বাড়ির সামনে যেখানে বসে আনিকা পুতুলের বিয়ে দেয় সেখানে কবর দিয়ে দিলেন।
২৩/১২/২০১৫খ্রি:

আয়না

রমনা পার্ক রাজধানী ঢাকার ঠিক মধ্যভাগে নগরের অক্সিজেন সরবরাহকারী হিসেবে নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। নানা প্রজাতির গাছ, কৃত্রিম হ্রদ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে পার্কটি নগরবাসীর এক প্রিয় ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। এখানে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ নানা শ্রেণী মানুষের আগমন ঘটে।
মুনিয়া ও শ্রাবণ নামের এক প্রেমিক-যুগল রমনা পার্কের ভিতর প্রবেশ করল। তারা হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের কোন একটি জায়গায় এসে বেঞ্চের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরই নয়/দশ বছরের একটি মেয়ে কতগুলো বকুল ফুলের মালা নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসল। মেয়েটির পরনে একটি ময়লা জামা ও একটি স্যালোয়ার। মেয়েটি অসহায় দৃষ্টিতে ডান হাতে একটি মালা নিয়ে শ্রাবণের সামনে ধরে বললো, সাব মালা নিবেন! মালা! বকুল ফুলের মালা। নেন না একটা মালা। দ্যাহেন কি সুন্দর ঘ্র্যান! আফারে খুব মানাইবো।
মুনিয়া মেয়েটির মিনতি মাখা কথা শুনে হেসে উঠল।
মেয়েটি আবার বললো, হাসবেন না আফা। হাছা কথা কইছি আফনারে মানাইবো। আর আফনারা যদি আমাগর কাছ থিকা মালা না নেন তাইলে আমরা খামু কি?
মেয়েটির এ সমস্ত মিনতি মাখা কথা শুনে শ্রাবণ ভাবতে লাগলো, এত ছোট মেয়ে অথচ কত সুন্দর করে কথা বলে। মেয়েটির প্রতি তার মায়া হল। শ্রাবণ তাকে বললো, তোমার এখানে কয়টি মালা?
মেয়েটি গুণে বললো, সাব দশটা।
– একটি মালার দাম কত?
– পাঁচ ট্যাহা।
– সবগুলো মালা আমার কাছে দাও।
মেয়েটি সবগুলো মালা শ্রাবণের হাতে দিল। শ্রাবণ সবগুলো মালা মুনিয়ার গলায় ও খোঁপায় পড়িয়ে দিল। বাহ! পার্কের প্রকৃতি পরিবেশে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মুনিয়াকে। এবার শ্রাবণ মানিব্যাগ থেকে একশত টাকার একটি নোট বের করে মেয়েটির হাতে দিল।
মেয়েটি আঙ্গুলের কর গুণে দেখল একটি মালার দাম পাঁচ টাকা হলে দশটি মালার দাম পঞ্চাশ টাকা হয়। মেয়েটি শ্রাবণের হাতে টাকাটা দিয়ে বললো, সাব মালার দামতো পঞ্চাশ ট্যাহা। আপনি একশ ট্যাহা দিছেন ক্যান?
– বাকিটা তোমাকে বকশিশ দিলাম।
– না সাব। আমি বকশিশ নেই না। বাপজান কইছে, চুরি করা পাপ। তাই চুরি করি না। ভিক্কাও করা ভালা না। তাই বকুল ফুলের মালা বেইচ্ছা ভাত খাই। মালার দাম যা হইছে তাই দ্যান। আমি বেশি ট্যাহা নিমু না।
মুনিয়া এবার জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তোমার পরিবারে কে কে আছে?
একথা বলতেই মেয়েটির দু’চোখে পানি এসে গেল। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, বাপজান আছে। কোন কাজকাম করতে পারে না। হাত পা ভাইঙ্গা লুলা হইয়া গ্যাছে। আমি মালা বেইচ্ছা যা পাই তা দিয়ে চলি। আজ থাইক্কা দুই বছর আগে আমার মা মইরা গ্যাছে।
– তোমার মা কীভাবে মারা গেছে?
– একসিডিন কইরা মইরা গ্যাছে। জানেন আমি তহন আরো ছুটো। একদিন মা-বাপজান আমারে নিয়া রিক্সা কইরা বাসায় যাইতেছে। তহন একটা বাস আইসা আমাগো রিক্সার উপর তুইল্যা দ্যায়। আমার মা তহন মইরা যায়। আর বাপজানের পা ভাইঙ্গা যায়। তহন আমি আল্লার রহমে বাঁইচ্ছা যাই।
মেয়েটির দুঃখের কথা শুনে মুনিয়ার খুব মায়া হল। তাই সে তাকে আবার অনুরোধ করে বলল, বাকি টাকাটা নিয়ে যাও। এই টাকা দিয়ে তোমার বাবার জন্যে ভালো খাবার কিনে নিবে।
– না আফা না, ট্যাহা লাগব না। আমি ভিক্কা নেই না।
মেয়েটির কথা শুনে মুনিয়া ও শ্রাবণ আশ্চর্য হয়ে গেল। শ্রাবণ বললো, এটা ভিক্ষা নয় তোমাকে উপহার দিলাম।
শ্রাবণ বারবার টাকাটা দেওয়ার পরও সে তা নিচ্ছে না। এক সময় সে জোর করে তাকে টাকাটা দিয়ে দিল। মেয়েটি সালাম দিয়ে চলে যাচ্ছিল এমন সময় মুনিয়া ডাক দিল, শোন!
মেয়েটি কাছে আসতেই বললো, তোমার নাম কি?
– আয়না।
– সুন্দর নামতো! কে রেখেছে তোমার নাম?
– আমার বাপজান। জানেন সাব, আমার বাপজান আমার নাম আয়না ক্যান রাখছে?
– কেন?
– আমি নাকি দেখতে আমার মায়ের মতো। তাই আমার বাপজান আমার নাম রাখছে আয়না। মায় বাপজানরে মরার আগে কইয়া গেছে, “আমি যদি মরে যাই তাহলে তুমি আর কোন বিয়া করবা না। আমাগো মাইয়াডারে দেইখ্যা থাকবা। আমাগো মাইয়ার মুখের দিকে চাইলে আমারে দ্যাখতে পাইবা।”

রচনাকাল: ৩১/০৮/২০১৫খ্রি:

পুতুলের বিয়ে


সুমি তার আব্বুকে বলছে, আব্বু আমি আমার পুতুলের বিয়ে দিব।
সুমির বাবা বললো, তাই নাকি! কার পুতুলের সাথে?
– রিমার পুতুলের সাথে।
– এখন আমাকে কি করতে হবে?
– রিমার বান্ধবী সবাই বরযাত্রী নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। তাদেরকে আয়োজন করে খাওয়াতে হবে।
– ঠিক আছে। তুমি আমার আদরের মেয়ে তোমার কথা কি ফেলতে পারি।
বাবার সম্মতি পেয়ে সুমি তার মেয়ে পুতুল বান্ধবী রিমার ছেলে পুতুলের সাথে বিয়ে ঠিক করল। গতকাল রিমা তার বান্ধবী মিমকে নিয়ে সুমির বাসায় এসে বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত করেছে। বিয়ের আয়োজন হবে সুমির বাসায়।
আজ গায়ে হলুদ। তাইতো দু’বাড়িতেই চলছে হলুদের আয়োজন। কাঁচা হলুদ বেটে একে অন্যের মুখে মেখে হাসি খেলায় মেতে উঠল সুমি ও রিমার বান্ধবীরা।
পরদিন সকাল বেলায় সুমি তাদের বাড়ির সামনে কালাগাছ দিয়ে গেইট বানাইল। রিমা তার পুতুলকে পাঞ্জাবী পায়জামা পরিয়ে বর সাজিয়ে বরযাত্রী নিয়ে সুমির বাড়িতে হাজির। ইতোমধ্যে কনেও সেজেগুজে প্রস্তুত। সুমি তার পুতুলকে লাল শাড়ী পরিয়ে কনে সাজাল। রঙিন কাগজে সাজানো হয়েছে বিয়ের আসর। বন্ধু বান্ধবসহ মেহমান সকলের মনের মধ্যে কাজ করছে এক উৎসবের আমেজ। সুমির বান্ধবীরা ফিতা দিয়ে গেইট আটকাল। রিমা বেলুন ফাটিয়ে ফিতা কেটে সবাইকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
সবাই আজ নানা রঙের পোশাক পড়ে আসছে। সুন্দর করে সেজেছে। সবাইকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। মনে হয় যেন এটি সত্যিকারের বিয়ে।
রিমার বান্ধবীদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছে সুমির বাবা। আদরের মেয়ে বলে কথা তার আবদার রাখতে গিয়ে এতসব আয়োজন। আর রান্নার কাজ করছে সুমির মা।
খাবারের পর যথারীতি কাজী এনে বিয়ে পড়ানো হলো। এবার কনে বিদায়ে পালা। বিদায়ের করুণ সুর বেজে উঠল সুমির বাড়িতে। সুমি এবার কান্না শুরু করে দিলে। তার এত সাধের পুতুল কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চায় না। তারপরও বিয়ে বলে কথা। সুমি রিমার হাত ধরে বললো, কথা দাও। আমার পুতুলকে প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবে।
সুমি বললো, ঠিক আছে।
রিমা কনেকে নিয়ে তাদের বাড়িতে আসল। কনে পেয়ে রিমার বান্ধবীরা সবাই আনন্দিত।

তারিখ: ২৫/১২/২০১৫খ্রি: