গত বছর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জ সফরে। সদস্য আমরা এক পরিবারের চারজন। উদ্দেশ্য ছিল নারায়ণগঞ্জের কিছু প্রাচীন ও দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা। সেই উদ্দেশ্যে আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে। বাড্ডা থেকে আসমানই পরিবহনের বাসে ১ ঘণ্টায় চলে আসি মদনপুর চৌরাস্তায়। রাস্তা পার হয়ে সকালের নাস্তা করে নিয়ে একটা সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ করি ৩০০ টাকায় গোটা আটেক স্থানে যাবো বলে।
প্রথম লক্ষ্য ছিল “বন্দর মসজিদ” (মিলের মসজিদ) বলে একটি পুরনো ৩ গম্বুজ মসজিদ দেখার। কিন্তু সেটি খুঁজে বের করতে না পেরে চলে যাই কাছাকাছি থাকা “১নং ঢাকেশ্বরী দেব মন্দিরে”। মন্দিরটি দেখে আমরা চলে আসি নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জে অবস্থিত “T Hossain House” দেখতে। শত বছররে পুরনো কিন্তু এখনো ঝকঝকে চমৎকার বাড়িটি দেখে আমরা চলে আসি “কদম রসুল দরগা” তে। দরগার সুউচ্চ তোরণ এবং আশপাশটা দেখে আমরা চলে যাই “বন্দর শাহী মসজিদ” দেখতে। প্রাচীন এক গম্বুজ মসজিদ দেখা আমরা যাই “নির্মাণাধীন মাজার” দেখতে। নির্মাণাধীন মাজার” দেখে চলে “সিরাজ শাহির আস্তানা” তে। “সিরাজ শাহির আস্তানা” দেখা শেষে আমাদের এবারের গন্তব্য “সোনাকান্দা দূর্গ” ।
“সোনাকান্দা দূর্গ” মোঘল আমলে তৈরি করা একটি জলদূর্গ। তৎকালীন সমৃদ্ধ শহর ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকাকে নদী পথে মগ ও পর্তুগিজদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ও জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষ্যা করার জন্য ১৬৫০ সালের দিকে তৎকালীন বাংলার সুবাদার মীর জুমলা এ সোনাকান্দা দূর্গ নির্মাণ করেন। ঐ একই সময়ের কাছাকাছি সময়ে এমন তিনটি জলদূর্গ নির্মাণ করা হয়। যার দুটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে। একটি শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পাড়ে “হাজীগঞ্জ দূর্গ” । অন্যটি শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে এই “সোনাকান্দা দূর্গ” । তৃতীয়টি মুন্সিগঞ্জের “ইদ্রাকপুর দূর্গ”।
চতুর্ভুজাকৃতির সোনাকান্দা দূর্গটি চারপাশে মজবুত উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দূর্গের ভিতরে নিরাপদে থেকে দেয়ালের মধ্য দিয়ে গোলা নিক্ষেপের জন্য বহুসংখ্যক প্রশস্ত-অপ্রশস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। সেগুলি দিয়ে বন্দুক এবং হালকা কামান ব্যবহার কর যেতো। দূর্গের চার কোনায় অষ্টভুজা-কৃতির চারটি বুরুজ রয়েছে।
দূর্গের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে এর পশ্চিম অংশে উঁচু বিশাল গোলাকার কামান প্ল্যাটফর্ম। অনেকগুলি বড়বড় সিঁড়ি টপকে উঠতে হয় প্ল্যাটফর্মে। দূর্গের পশ্চিম দিক দিয়েই বয়ে যেতো শীতলক্ষ্যা নদী। তাই এই পশ্চিমমুখী কামান প্ল্যাটফর্মের উঁচু মঞ্চে শক্তিশালী কামান স্থাপন করা ছিল নদীপথে আগত জলদস্যুদের ঠেকাতে।
দূর্গের উত্তর পাশের প্রাচীরে উত্তরমুখী একটি মজবুত প্রবেশ তোরণ রয়েছে। এটিই দূর্গের একমাত্র প্রবেশ তোরণ। প্রবেশদ্বারটি একটি আয়তাকার তোরণ কাঠামোর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে।
এই দুর্গ নির্মাণের তারিখ সম্বলিত কোন শিলালিপি পাওয়া যায় নি তবে ঐতিহাসিকদের মতে এটি ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল।
জিপিএস কোঅর্ডিনেশন : 23°36’25.0″N 90°30’43.5″E
পথের হদিস : ঢাকা থেকে বাসে মদনপুর, মদনপুর থেকে শেয়ার সিএনজি বা ইজি বাইকে নবীগঞ্জ হয়ে সোনাকান্দা দূর্গ।
তাছাড়া বাস বা ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে নৌকায় নদী পার হয়ে রিকসা নিয়ে চলে আসা যায় সোনাকান্দা দূর্গ।
তথ্য সূত্র : উইকি
কালের আবর্তে প্রাকৃতিক কম্পন সহ নানা কারণে যুগে যুগে এই প্রাচীন নিদর্শন গুলোর আশেপাশে জমি ভরাট হয়ে গিয়ে এর যেমনটা স্বাভাবিক উচ্চতা ছিলো; সেটা হারিয়েছে। শুধু এখানে নয়; দেশে দর্শণীয় দু'একটি জায়গা ঘুরে আমি সেটা অনুধাবন করেছি। এই সব ইমারত এর নির্মাণ কৌশলীরা এতোটাই দক্ষ ছিলেন যে, আধুনিককালের বহু প্রতিভাধর প্রকৌশলীও হার মানবেন পুরোনোদের ধ্যানজ্ঞান এর কাছে নিশ্চিত।
____ ধন্যবাদ প্রিয় দস্যু ভাই।
উচ্চতা হারানোর বিষয়টা সবগুলি দূর্গের ক্ষেত্রেই দেখেছি।
আরেকটা বিষয় ম্যাপ দেখলেই বুঝা যায় যে নদীর প্রবাহ অনেকটাই সরে গেছে বা নদী সংকৃর্ণ হয়ে পরেছে। তিনটি জলদূর্গের বর্তমান অবস্থান দেখলেই সেটা প্রতিয়মান হয়।
যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপত্যকলাগুলো কালের স্বাক্ষ্য বহন করে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আপনার গমনের মধ্য দিয়ে অনেক ভ্রমণ পিপাসু বন্ধুরা সন্ধান পেয়ে গেল। যার মধ্যে আমিও একজন গর্বিত অংশিদার। আশা করি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীর স্বাক্ষী হওয়া ঘটনাগুলো আমাদেরকে অবহিত করে আমাদেরও ভ্রমণ স্বাদ নিভৃত করবেন।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ সাইদুর রহমান ভাই। ঘুরে বেরানোটা আমার প্রিয়কাজ গুলির একটা। সময় সুযোগ আর অর্থের মিলন ঘটাতে পারলেই বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে যাগে।
জয় হোক আপনার স্বপ্নের…….
খুব ভালো ছবি সংবলিত ভ্রমণ কাহিনী। প্রায় সাড়ে ৩ শত বছর আগে বানানো এই দূর্গ এখনো টিকে আছে। মাঝে কতো বার যে ভূমিকম্প হয়েছে তার হিসেব নেই। ধন্যবাদ সূপ্রিয় লেখক কে। শুভেচ্ছা রইলো।
স্বাগত আপনাকে ইলহাম ভাই। ভূমিকম্পে সাধারণত এই ধরনের স্থাপনাগুলির কিছু হয়না। বরং ভূমিদস্যুদের কবলেই বেশী আক্রান্ত হয়।
ভারতেও সহস্র পুরাকীর্তি রয়েছে। কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে অনেক। তারপরও বহুকালের স্মৃতি গুলো এভাবেই কালের স্বাক্ষী হয়ে রইবে। ইতিহাস হয়তো ম্লান হবে কিন্তু হারাবে না।
এমন অনেক যায়গাই আছে ঐতিহাসিক নিদর্শনের নিরব স্বাক্ষী, তাদের দেখার আলাদা একটা আনন্দ আমি পাই।