দেশ -বৈদেশ

বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া যাবার পথে তিনবার প্লেন বদল হলো আমাদের। প্রথম বাংলাদেশ বিমানে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, এরপর থাই এয়ারে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড দুই ঘন্টার জার্নি, থাইল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘ নয় ঘন্টার জার্নি।
বাংলাদেশ বিমান যদিও মোটামোটি স্মুদ চলেছে কিন্তু থাই এয়ার দুটোই আকাশে উঠে এমন ঝাকাঝাকি শুরু করলো – ভয়াবহ ভয়ে সময় কাটলো । তবু ওদের দুর্দান্ত সুন্দরী এয়ারহোস্টেস দেখে চোখ আটকে থাকে। কিন্তু ওদের ভাষা বিদ্ঘুটে শোনায় মেয়েগুলোর মুখে। নামা এবং ওঠার সময় ওরা ওদের ভাষাতেই সম্ভবত ওয়েলকাম বা বিদায় জানায়। আইয়া বা এই ধরনের একটা শব্দ বলে যে মেয়েগুলোর মুখে যেনো মানাচ্ছে না এই শব্দগুলো । তবু নিজেদের ভাষা বলে কথা ।

থাইল্যান্ড এয়ারপোর্ট

কিন্তু থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টে নেমেই চোখ জুড়িয়ে যায়। জানতাম এই সংক্ষিপ্ত ট্রানজিটে নামা সম্ভব না তাই ভাবলাম জানালা দিয়ে দেখে নেই থাইল্যান্ড। যদিও খুব বেশি দেখা সম্ভব না তবু বোঝা যায় খুব প্ল্যানড শহর। রাস্তাঘাট বিল্ডিং, দীর্ঘ নদীও সরু ফিতার মত মনে হয়। বাংলাদেশ থেকে যখন প্লেন উপরের দিকে উঠে বিশেষ করে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে তখন সমুদ্র আর কর্ণফুলির জল খুব মন কেমন করা অনুভুতি এনে দেয়।
কি হবে – কি হবে না- কি আছে কি নেই কেন এই জীবন এই ধরনের অহেতুক বোধের জন্ম নেয় সম্ভবত আকাশযানে উঠলেই। বড় বেশী অকিঞ্চিৎকর মনে হয় এই জীবন। আহা কেন এই ছুটোছুটি – বড্ড নিরর্থক এই জীবন —


আরববাসী এখানে এত বেশী যে আমার খুব অবাক লাগে। বলা যায় যে এখানে তারা খুব স্বাধীন জীবন যাপন করে। সম্ভবত তাদের দেশে এতোটা স্বাধীন জীবন যাপন তাদের সম্ভব ছিলো না। মেয়েরা খুব যে নাক মুখ ঢেকে রাখে তা নয় তবে ভালো করে মাথা ঢাকা হিজাব পড়া কিন্তু ফ্রিকোয়েন্ট চলাফেরা সম্ভবত স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ধনী দেশ কিন্তু স্বাধীনতা না থাকলে সমস্ত ধন সম্পদ ও যে অর্থহীন যাকে পরাধীনতার স্বাদ নিতে হয় তারাই জানে। স্বাধীনতা এবং পর্যাপ্ত স্বাধীনতা মানুষকে মানুষ হতে শেখায়। পরাধীনতা এবং একই সাথে জীবন যাপনের জন্য অপর্যাপ্ত অর্থ স্বাধীনতা থাকলেও সে স্বাধীনতাও অর্থহীন মনে হয়।


কি যে ওয়েদার ! কিছু বুঝতে পারি না। শুধু ক্লান্তি লাগে। ঘুম আসে সারাদিন। সময় পেলেই ঘুমিয়ে কাটাই। নেভিটাসে সপ্তাহে চারদিন ক্লাস। নেভিটাস ইংরেজী ভাষা শিক্ষা কোর্সের ইন্সটিটিউট। এখানে (অস্ট্রেলিয়া) যারা রেসিডেন্সি নিয়ে আসে সরকার তাদের এই কোর্সটা ফ্রী অফার করে। সিরিয়ান রিফিউজি প্রচুর এখানে। এরপর আছে মিশর, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ইন্ডিয়ান, বার্মার রিফিউজি, চীন এবং আরো বহু দেশের মানুষজনের মিলনমেলা। শিক্ষার্থীদের তিনটা ভাগে ভাগ করা হয়। যারা খুব কম জানে তাদের লেভেল ১, যারা মোটামোটি জানে তাদের লেভেল ২ এবং যারা এক্সপার্ট তাদের লেভেল ৩। আমি পড়লাম লেভেল ২ এ আর দুরন্ত পড়লো লেভেল ৩ এ। সে যেহেতু দেশেই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে তাছাড়া মালয়েশিয়াতেও সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়েছে। তার ইংলিশ অনেক স্পিডি। সে তাই মাঝে মাঝে ক্লাসে যায়।

আমার অবাক লাগে সিরিয়ানদের দেখলে। ওদের জীবন যাপন পোশাক আশাক ফিগার ফেইস সবই পশ্চিমাদের মতই। এমনকি কারো কারো চুলও সোনালী। চোখগুলো শুধু কালো। খুব মিশুক।
মেয়েরা – মেয়েরা ওরা খুব হইচই করে মজা করে কথা বলে। আমরা সিরিয়ানদের সাথে এক বাসে ছিলাম। ওরা আরবী ভাষায় গান গাইছিলো। তবে যেটা হলো ওদের ছেলেরা সম্ভবত কাজ করে বলে সিরিয়ান ছেলেরা এখানে পড়তে আসে না। কয়েকজন সিরিয়ান অল্প বয়েসী মেয়ে বয়স ২৭ – ২৮ এর বেশী না। ওদের তিনটা করে বাচ্চা। আশ্চর্য খুব হাসিখুশী, ফ্যাশনেবল। কি করে মেনেজ করে ! অবাক লাগে। আর একজন মহিলা ওনার হয়তো ৪০ এর উপরে বয়স তার ছয়টা বাচ্চা। নেভিটাসের বেশীরভাগই মেয়ে শিক্ষার্থী। অতএব সবারই বাচ্চা আছে। তাদের বাচ্চাদের জন্য আবার চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থা আছে। ওই ছয় বাচ্চার মা দুজন বাচ্চা নিয়ে আসে সাথে করে। মহিলার সাথে দুটো মেয়ে শিশু। একটা ট্রলিতে দুজন বাচ্চা রাখার ব্যবস্থা। সেদিন ওর বাচ্চা দুটোকে দেখে অবাক হলাম। অদ্ভুত সুন্দর। যেনো বেহেশত থেকে এদের আনা হয়েছে।

কাল আমার ম্যাডাম বললেন – সবাই যেনো দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে আসে সাথে করে প্লেট। প্রত্যেক দেশের মানুষ তার নিজস্ব ঘরানার খাবার নিয়ে আসবে। গতকাল সন্ধ্যায় প্ল্যান করলাম আমি পোলাও আর চিকেন ফ্রাই নিয়ে যাব। সকালে উঠে রান্না করে নেব। সারাক্ষন মনে মনে এটা পরিকল্পনায় আছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি বারটা বাজে। আশ্চর্য এ কি রকম ব্যপার। দুরন্ত দুইটা বাজে এলো নেভিটাস থেকে। সে বললো ‘গেলা না কেন মা। কতজন কত রকম খাবার আনলো’।
কি আর করা – মিসই করলাম –


ব্যাংকসটাউন (নেভিটাস ) টু তামারামা বিচ–

তামারামা সমুদ্র সৈকত

তামারামা সমুদ্র সৈকত

নেভিটাস থেকে বলা হলো যে আমাদের তামারামা সমুদ্র সৈকত দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে। সমুদ্র সৈকতে নেয়া হবে ভাল কথা। কিন্তু সমুদ্রে কি কি বিপদজনক ঘটনা ঘটতে পারে সে সম্পর্কে প্রতিটা ক্লাসেই কিছু না কিছু ব্রিফিং দেয়া শুরু হলো। সমুদ্রে শার্ক থাকতে পারে, কুমির থাকতে পারে, কয়েক ধরনের জেলি ফিস আছে। কিছু নিরীহ কিছু বা ভয়াবহ। সমুদ্রে কোথাও বা কারেন্ট আছে। সে জায়গা গুলোতে যাওয়া যাবে না। সাঁতার কাটতে একা যাওয়া যাবে না। বিপদে কিভাবে হাত নাড়াতে হবে সমুদ্র গিয়ে আরো কত কি। যাই হোক গত ৪ তারিখ আমরা সবাই নেভিটাসের অঙ্গনে হাজির হলাম। হাওদা নামে ইরানী মেয়েটা সে এসেছে তার দুই বাচ্চা নিয়ে। একটার বয়স সম্ভবত ছয় মাস আর একটার দুই বা তার কিছু বেশী। সে হয়রান এই বাচ্চাদের নিয়ে ।

চারটা বাস ঠিক করা হলো। সে বাসে করে আমরা সবাই নেভিটাসের শিক্ষার্থীরা যাবো। হাওদা একা পেরে উঠছিল না তার বাচ্চাদের নিয়ে। বাংলাদেশের এক মেয়ে এগিয়ে এলো। সে পিচ্চিটাকে সামলালো আর বড়টাকে হাওদা। এরপর আবার ট্রলিটা নিয়ে বাসে ওঠা। ওর কষ্ট দেখে মনে হলো আহা পৃথিবীর সব মায়েরই সমান কষ্ট।

নেভিটাসে আমাদের লেভেল ২ এর ম্যাডাম এক মরিশাসের মহিলা। ছয়ফিটের মত লম্বা একটু শ্যামলা ছোট চুলের খুব হাসিখুশী একটানা সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর ঠিক দুইটা পর্যন্ত ক্লাস নেন কোনোরকম ক্লান্তি ছাড়াই। মরিশাসে তিনটা ভাষায় মানুষ কথা বলে। ওদের মাতৃভাষার সম্ভবত কোনো বর্ণ নেই। ফ্রেঞ্চ ভাষায় তাই লেখাপড়া চলে। ইংরেজীটাও ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজের মত শিখতে হয়। বাসে উনি আমার পাশে বসেছিলেন। নিজেদের ভাষায় কি অসম্ভব তাড়াতাড়ি কথা বলে যাচ্ছিলেন। কথার শেষে বার বার মেসি মেসি বলছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম মেসি মানে কি। তখন উনি বললেন যে মেসি হলো ধন্যবাদ। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ধন্যবাদকে মেসি বলে।

যাই হোক শহর পেরিয়ে যখন সমুদ্র সৈকতে পৌছালাম তখন আমাদের সবাইকে কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে একটা বড় হলরুমে নেয়া হলো। আয়োজকরা সবাই পড়েছে হলুদ গেঞ্জি, লাল শর্টস। হলুদ গেঞ্জির কলার লাল। উজ্জ্বল রঙ। তামারামা বিচে স্কারশানের আয়োজক নেভিটাসে লেভেল ২ এর শিক্ষক মিসেল। মিসেল সারাক্ষল হই চই করা ফুর্তিবাজ মহিলা। মিসেল ও হলুদ গেঞ্জি লাল শর্টস পড়লো। আমি ভাবলাম সকালে হয়তো নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে। কিসের কি – আবার সেই প্যাঁচাল। সমুদ্রে কি কি বিপদ ঘটতে পারে সে সম্পর্কে তিন থেকে চারজন ব্রিফিং করলো। আবার বড় বড় স্টিকার দিয়ে বিপদজনক চিহ্নগুলো দেখানো হলো। সমুদ্র দেখতে গেলাম এরপর। মনে পড়ে গেলো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। কত যে বিশাল আমাদের এই সমুদ্র সৈকত। সেই তুলনায় তামারামা সমুদ্র সৈকতকে নদীর তীরই মনে হয়। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রের যে উত্তাল ঢেউ এর ওঠা নামা সে এক অবর্ণনীয় ইতিহাস মনে হলো। তবে এই সমুদ্রের ঢেউ যে কম ভয়ংকর তা বলা যাবে না। এরই মাঝে কিছু তরুণ ইয়টে সমানে ঢেউ এর সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে দেখতে ভালই লাগে আবার ওদের সাহসের প্রশংসা না করে পারি না ।

দুপুর ঠিক একটা বাজে আমাদের লাঞ্চ দেয়া হলো। মেনু – একটা বান , একটা সসেজ (বিফ অথবা পোর্ক যার যেটা পছন্দ ), সালাদ বাদাম সহ, জুস আর পানি। খাওয়া দাওয়া শেষ এবার ফেরার পালা। পাকিস্তানী আর একটা মেয়ে তার মেয়েকে নিয়ে হয়রান হচ্ছিল। আমার কর্তা তাকে বললো তোমার ট্রলি আমাকে দাও। তুমি ফ্রী যাও। মেয়েটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মেয়েরা আসলেও মায়ের জাত। তার পোষাক আশাক যতই আধুনিক হোক ভেতরে সে মমতাময়ী মা। সিরিয়ান ছোট ছোট মেয়েরাও ছেড়া ফাটা জিন্স সোনালী চুল, আইল্যশে ভর্তি চোখ নিয়ে ট্রলি ঠেলে ঠেলে নিলেও মনে হয় পৃথিবীর সব মা- এর হৃদয়ই তো সমান মমতায় আদ্র ।

14 thoughts on “দেশ -বৈদেশ

  1. দেশ-বৈদেশ এর দ্বিতীয় পর্ব বেশ মন দিয়ে পড়লাম। নিজ প্রবাস জীবন ছিলো জন্য আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। আমার ভালো লাগে ভ্রমনের কথা গুলোন ভীষণ জানতে। চলুক। :)

  2. আনন্দ নিয়ে পড়লাম। বিফ/পোর্ক সসেজের অংশটুকু পড়ে কিছু  স্মৃতি মনে পড়ে গেল। ভুলে সর্বভুক হয়ে ওঠার স্মৃতি।

    দারুণ লিখেছেন !

     

  3. হ্যা, থাইল্যান্ড থেকে সিঙ্গাপুরের অর্ধেক পথে এয়ার পকেট থাকে বলে প্লেনেhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif বেশ বাম্পিং হয়। তবে আপনার ডাইরি পড়ছি, কিছু ক্লোজ ছবি থাকলে দেখতে ভালই লাগে।

    1. সেই বাফারিং এর যাত্রীদের কেমন লাগে  জানিনা । তারা সবাই নিশ্চিন্তে পেপার পড়ে , ম্যাগাজিন পড়ে , গান শোনে , সামনে ভিডিও সেট করা ছে । মুভি  দেখে । আমি পরে মনে মনে ভাবছিলাম হয়তো আমারি সমস্যা , কেউ তো কোনো রিএক্ট করছে না । 

  4. খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়লাম দিদি ভাই। প্লিজ কন্টিনিউ করুন। ধন্যবাদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. ইনশাল্লাহ দিদি । চেষ্টা করবো । আমিও এভাবে আজাইরা বক বক করতে ভালোবাসি । 

  5. আমি নিজেও ভ্রমন পিপাসু মানুষ। কোন দেশের সম্যক অভিজ্ঞতা থাকে এমন লিখা আমার কাছে বেশী অথেনটিক মনে হয়। আপনার সাথে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়িয়ে এলাম। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।