শিশুবেলায় বাবার আঙ্গুল ধরে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে হলেই মনে পড়ে আমার বৃদ্ধ দাদার কথা। দাদা বৃদ্ধ অবস্থায় আমার বাবার সাথে খুব বেশী ঘুরে বেড়াতে চাইতেন। দাদা প্রায়ই কথা বলতে শুরু করলে আর থামতেন না। বাবা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কখনও কখনও একবারে মধ্য রাত পর্যন্ত দাদা কথা বলেই যেতেন। স্মৃতিচারণ, সাংসারিক, জীবনে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনা সব কিছুই থাকতো এই আলাপচারিতার মধ্যেই। আমার কাছে খুব আশ্চর্য মনে হত যে বাবা সারা রাত ধরে দাদার একই কথা শুনে যায় তবুও কখনও বিরক্তি বোধ করে না এর কারণ কি আসলে !
উত্তর পাওয়ার জন্য অনেকগুলো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। দাদা এবং দাদু মৃত্যুর পর বুঝতে পেরেছি শূণ্যতা আর অনুভূতির কতটা গাঢ়ত্ব। বৃদ্ধকালে দাদা এবং দাদু দুজনেই একেবারে শিশুর মত হয়ে গিয়েছিলেন। যাই করতেন সব কিছু বাবাকে জিজ্ঞেস করে করতেন। বাবা অনেক সময়ই দেখতাম দাদার বিছানা থেকে ময়লা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন এবং আমার মাও সাহায্য করছেন। এত কিছুর পরও দাদা দাদু প্রায়ই একাকী আলাপ করতে এবং বলতেন সেই তারুণ্য ভরা জীবনের গল্পগুলো। এক সময় একজনের মৃত্যুর পর যখন অন্যজন খুব বেশী একা হয়ে যান তখন দেখলাম শিশু আচরণের একেবারে চুড়ান্ত পর্যায়।
ঠিক এই সময়টাতে প্রতিটি মানুষই একদিন আসে। কিন্তু প্রতিটি মানুষই কি আমার দাদা দাদুর মত সঙ্গ পায় ? অনেক প্রতিষ্ঠিত পরিবার গুলোর এখন একক পরিবার হিসেবে থাকতে পছন্দ করছে। বাবা মাকে তারা ঝামেলার মনে করে। একটি পরিবারে যেখানে সন্তান আছে কিন্তু বাবা মা নেই এ বিষয়টি যে অভাবের, তাড়নার তা যেন ভাববার মানুষই পৃথিবীতে এখন আর নেই। আরেক ধরণের পরিবার আছে যারা বাবা মা এর সাথে একসাথে থাকলেও বাবা মায়ের খবর রাখতে যেন খুব অমনোযোগিতা ! তেমনি একটি বাস্তব দেখা গল্প বলি।
আমাদের বাড়ির কাছেই একজন মানুষ যিনি খুব বেশী প্রতিষ্ঠিত সমাজে। রাজনীতির সাথেও খুব বেশী সংশ্লিষ্টতা আছে তার। সে হিসেবে প্রতি ঈদে যাকাতের কাপড় নেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমান মানুষের সমাগম ঘটে তার বাড়িতে। শাড়ি লুঙ্গি দিয়ে সবার মন জয় করে নেন খুব তাড়াতাড়িই। মানুষ দোয়া করে যায় আর তার মুখে দেখি অনাবিল হাসি !
তার মা বৃদ্ধ অবস্থায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। এক সময় একটি ছোট্ট ঘরে তার মাকে আমরা বেঁধে রাখতেও দেখেছি ! কি সেই মর্মান্তিক দৃশ্য ! চিৎকার করে কান্না আর অভিশাপের চরম হাহাকার দেখে হৃদয়ে দাগ কেটে যেতো বার বার ! প্রতিবেশীরা কিছু বললে তাদের উপরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন তিনি।
আচ্ছা যখন এই লোকটি খুব ছোট ছিলেন তখন মা কিভাবে বড় করে তুলেছেন ? আমার ছোট্ট বাচ্চাটির জন্য রাতে ঘুমোতে পারি না, তার আবদার রাখার জন্য মধ্য রাত্রিতে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে চাঁদ দেখাতে হয়, যখন হাঁটা শুরু করলো একাধারে দু-ঘন্টা ধরে তার হাতে ধরে ধরে হাঁটাতে হত, একটু মন খারাপ হলেই আমার কোলেই অর্ধেক রাত কাটিয়ে দেয় আরও কত কি ! এরকম তো প্রতিটি শিশুই বাবা মা কে ঘিরেই বেড়ে ওঠে। তারপর শিশুরা বড় হয় আর বাবা মায়েরা হয়ে ওঠেন শিশু !
যখন বাবা মায়েরা শিশু হয়ে ওঠেন তখনই যেন ঘোর বিপত্তি। এই বিপত্তি গুলোই প্রবীণদের জীবনকে ঠেলে দেয় অসহায়ত্বের দিকে। বৃদ্ধাশ্রমে না গিয়েও বয়স্ক মানুষেরা অনেকেই আছেন ঘরে বন্ধী হয়ে। দেখার কেউ নেই, কথা শোনার কেউ নেই, নেই মান অভিমানের কোন পরিসমাপ্তির মানুষও !
আপনি যখন পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত তখনই হয়ত আপনার বাবা মা আপনার শিশু জীবনে ফিরতে শুরু করবে। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। আমাদের শিশু জীবনে আমরা যেমন বাবা মাকে ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখি তেমনি আমাদের বাবা মায়েরাও আমাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সময় যেন আমরা পাশে থাকি এটাই বড় কর্তব্য। ধর্মগত দিক আর বাস্তবিক দিক যেভাবেই যাই না কেন পিতামাতার স্থান সবার উপরে। সুতরাং এখনি আমাদের মানবিকতার উন্নয়ন ঘটানোর সময়।
পারিবারিকভাবেই শিক্ষা দিয়ে সন্তানকে বড় করুণ যে সন্তানই বাবা মায়ের শেষ আশ্রয়স্থল। আগে থেকেই শিশুদের বোঝাতে হবে একটা সময় বাবা মাকেই আবার সন্তানের দায়িত্বে থাকতে হয় বা হবে। সঠিক শ্রদ্ধার জায়গায় যদি বাবা মাকে স্থান দেওয়া যায় তবে বৃদ্ধ অবস্থায় বাবা মা কে সন্তানেরা নিজেদের শিশুদের মতই আদরে লালন পালন করতে থাকবে।
আমার বাবা দাদার সাথে যে আচরণ করতেন তা আমার প্রায়ই মনে হয় আর আমি শুদ্ধ হই। একারণেই যৌথ পরিবার প্রথাও প্রয়োজন যাতে করে একজনকে দেখে অন্যজন অনুপ্রাণিত হয়। বয়স্ক মানুষ একটি বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ হিসেবে বসবাস করবে এটাই আমাদের চাওয়া।
ধর্মগত দিক আর বাস্তবিক দিক যেভাবেই যাই না কেন পিতামাতার স্থান সবার উপরে। বয়স্ক মানুষ একটি বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ হিসেবে বসবাস করবে এটাই আমাদের চাওয়া। কথা গুলো মেনে নিচ্ছি। খুবই মূল্যবান আহ্বান।
কৃতজ্ঞতা রইলো প্রিয় । ভালো থাকবেন অনেক ।
আমাদের বাবা মা'য়ের শেষ আশ্রয়স্থল যেন কখনই কোন বৃদ্ধাশ্রম না হয়।
অবশ্যই তাই । এই কামনা আমাদেরও । ধন্যবাদ আপনাকে শ্রদ্ধেয়
চিন্তাগুলো হোক স্বার্থহীন,,, সবাই ভাল থাকুক। মূল্যবান লেখা।
কৃতজ্ঞতা রইলো আপু আপনার প্রতি । ভালো থাকবেন অনেক ।
বাবা মা আমাদের না হোক অলংকার; হোক অহংকার।
ভালো থাকুক আমাদের বাবা মায়েরা । ধন্যবাদ আপু