মাইকে ঘোষণাটি শুরু হতেই মুহুর্তেরও কম সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এসে মিলিয়ে গেলো, সবার মনযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কানে।
ফজল দাঁড়িয়ে আছে রফিকের সব্জীর দোকানে। ছেলেবেলার বন্ধু, তবে বহু আগেই দু’জনার দু’টি পথ গেছে বেঁকে। ফজল এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বেতনের থেকে ভাব বেশী। রফিকের স্বাধীন ব্যবসা, ভাব থেকে আয় বেশী, চিন্তাও বেশী।
আজকাল জ্যান্ত রুই বিক্রি হয় মাছ বাজারে। মাছগুলো হাঁপানি রোগীর মত শ্বাস টানে। মাঝে মাঝে লেজ ঝাপটায়। এক একবার শরীরের সকল শক্তি একত্রিত করে জলে ছুটে যাবার জন্য লাফিয়ে ওঠে। জলে যাওয়া হয়না, মাছওয়ালার এলুমিনিয়ামের থালাতেই ফের আছড়ে পরে। মাছদের জানা নেই মৃত্যু অমোঘ, মৃত্যু অনিবার্য সত্য, মৃত্যুই চিরমুক্তি হোক তা জলে বা ডাঙায়। ফজল এমনই এক জ্যান্ত রুই কিনেছে। ফজলের ভোজ, রুইয়ের চিরমুক্তি।
আলু, বেগুন আর টমেটো কেনার জন্যই রফিকের দোকানে আসা। রুই দিয়ে আলু, বেগুন, টমেটোর তরকারি যেনো অমৃত। তবে ফজল বিভ্রান্ত। আশ্বিনের শুরুতেই বাজারে উঠেছে শীতের সবজি- সতেজ সিম, ছোটো ফুলকপি, মাঝারি বাঁধাকপি, টসটসে টমেটো। রুই মাছ দিয়ে আলু- ফুলকপি না আলু-সিম- টমেটো দিয়ে রান্না হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
ফজলের বিভ্রান্তি দূর হবার আগেই ঘোষণাটি শুরু হলো। পুরো বাজারে মুহুর্তেরও কম সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এসে মিলিয়ে গেলো, সবার মনযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কানে। মহল্লার মসজিদের মাইক হতে ভেসে আসছে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ- “একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ। আমাদের মহল্লার মরহুম রমজান হাজির মেঝো ছেলে ফজলুল হক ফজল আজ সকালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজেউন। মরহুমের নামাজে জানাজা আজ বাদ আসর বায়তুল আকবর জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। একটি শোক সংবাদ.. একটি শোক সংবাদ.. আমাদের মহল্লার….।
রফিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফজলের দিকে। শুধু রফিক নয়, মহল্লার বাজার বলেই বহু পরিচিত চোখ ফজলের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফজলের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, একছুটে পালিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু পা নড়ছে না। রফিক দোকান ছেড়ে বাইরে এসে ফজলকে রিকশায় তুলে দিয়ে বলে, “জলদি বাড়িতে যা, দেখ ঘটনাটা কি। জলদি যা।”
রিকশায় মাথা নিচু করে বসে আছে ফজল। অস্বস্তি হচ্ছে- কেউ না থাকে জীবন্ত অবস্থায় দেখে ফেলে। মহল্লার সীমানা হতে বেরিয়ে এসে সংকোচে মাথা তুলে তাকায়- না, এখানে পরিচিত কেউ নেই। রিকশা বদলে নতুন রিকশায় উঠে বলে- ‘চলো, সামনে যেতে থাকো।’
কোথায় যাবে জানেনা, বাড়িতে ফেরা যাবেনা। সত্যিই যদি সে মরে গিয়ে থাকে তবে তার লাশের পাশে বসে কান্না করছেন মা। রুমু নিশ্চয় জ্ঞান হারাচ্ছে বারবার। আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করেছে। ছোটো ভাই বিষাদভরা মুখে দাফনের দায়দায়িত্ব আর আত্মীয়দের আপ্যায়ন তদারকি করছে। ইতোমধ্যে সে কতটা ভালো ছিলো বা ছিলোনা- ওই আলোচনা আর স্মৃতিরোমন্থন চলছে। নাজিয়া কি খবর পেয়েছে-! কি যে প্রেম ছিলো। বেকারের সাথে বিয়ে দেবে না বলে ডেটল খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। এখন সুখে টইটুম্বুর। ওর চোখেও হয়তো জল- ব্যর্থ প্রেমিকের জন্য নয়, প্রেমের জন্য। অথবা সবাই প্রতিক্রিয়াহীন। এখন জীবন্ত অবস্থায় হাজির হলে সবাইকে কি বিতিকিচ্ছিরি একটা অবস্থা ফেলা হবে- ভাবতেই তার লজ্জা লাগছে।
রিকশা ছুটছে। কোথায় যাবে জানেনা ফজল। বাজারের থলিতে ঘাই মারছে রুই।
মাছদের জানা নেই মৃত্যু অমোঘ, মৃত্যু অনিবার্য সত্য, মৃত্যুই চিরমুক্তি হোক তা জলে বা ডাঙায়। মৃত্যু সংবাদের অবাক হয়ে গেলাম হরবোলা ভাই। এমন ফিকশন আশা করিনি।
অসাধারণ এই অণুগল্পে রহস্যের চাদর যেন বিছানো রয়েছে।
ভীষণ অন্য রকম একটি গল্প পড়লাম।
অসাধারণ অনুগল্প।
শুভ জন্মদিন মি. আবু সাঈদ আহমেদ।
অসাধারণ এক রহস্যময় গল্প পড়লাম। ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা রইল শ্রদ্ধেয় কবি আবু সাঈদ দাদার জন্য।
কি কল্পনাশক্তি আপনার, অবাক
আজকাল জ্যান্ত রুই বিক্রি হয় মাছ বাজারে। মাছগুলো হাঁপানি রোগীর মত শ্বাস টানে। মাঝে মাঝে লেজ ঝাপটায়। এক একবার শরীরের সকল শক্তি একত্রিত করে জলে ছুটে যাবার জন্য লাফিয়ে ওঠে। জলে যাওয়া হয়না, মাছওয়ালার এলুমিনিয়ামের থালাতেই ফের আছড়ে পরে। মাছদের জানা নেই মৃত্যু অমোঘ, মৃত্যু অনিবার্য সত্য, মৃত্যুই চিরমুক্তি হোক তা জলে বা ডাঙায়।
অসাধারণ লিখেছেন। লেখা পাঠ করলাম। অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল।
জয়গুরু!