গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান সপ্তম পর্ব- টুসুগান-৭

গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান
সপ্তম পর্ব- টুসুগান-৭

গীতরচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

গ্রাম বাংলার নানা অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং জীবনচর্যাকে ঘিরে সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে বাংলার লোকগান। সারা বাংলায় অঞ্চলভেদে হরেক রকমের লোকগানের উদ্ভব ও প্রচলন রয়েছে। সুদীর্ঘকাল ধরে এই লোকসংগীত ও লোকনৃত্যগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারিত ও প্রসারিত। গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্তরের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেক লোকসংগীতের একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। রয়েছে আলাদা উচ্চারণরীতি, গীতরীতি। অঞ্চলভেদেই এই স্বাতন্ত্র্য সূচিত হয়। বাংলার কয়েকটি লোকগানের ধারার কথা এখানে উল্লেখযোগ্য- ভাওয়াইয়া, চটকা, ভাটিয়ালি, টুসু, ভাদু, চড়ক পরবে শিবের আরাধনা-গান গম্ভীরা, গাজন, নীলগান। এছাড়াও রয়েছে ধামাইল গান ও গচ, ধান কাটার গান, ধান ভাঙার গান, ধর্মমঙ্গলের গান, সারি, জারি গান, ভাসান গান, বনবিবির গান ইত্যাদি। এছাড়া আছে বাউল গান। এই সব গান বঙ্গ-সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল অংশ।

রাঢ়বঙ্গ লোকসংস্কৃতি হিসাবে পুরুলিয়ার পাতা নাচ, ছৌ নাচ, বুলবুলি নাচ, সারপা নাচ, ঝুমুর গানের পাশাপাশি বীরভূমের বাউল গান, বর্ধমানের ভাদু ও টুসুগান, পশ্চিম মেদিনীপুরের লোধা নাচ, বাঁকুড়ার রন-পা, পূর্ব মেদিনীপুরের পুতুল নাচ প্রভৃতি গ্রাম বাংলার মূখ্য লোকসংস্কৃতি উত্সব।

টুসু উৎসব এক প্রকার বাংলা লোকসংস্কৃতির লোকগান। এটি প্রচলিত বিশ্বাস ও শস্যকাটার আনন্দোৎসবের এক সমন্বিত রূপ। টুসু উৎসব শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে, আর শেষ হয় পৌষ-সংক্রান্তি বা মকর-সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে। টুসু একজন লৌকিক দেবী এবং তাঁকে কুমারী বালিকা হিসেবে কল্পনা করা হয়। কুমারী মেয়েরা টুসুপূজার প্রধান ব্রতী ও উদ্যোগী। মাটির মূর্তি বা রঙিন কাগজের চৌদল দেবীর প্রতীকরূপে স্থাপন করা হয়। পূজার উদ্যোগী বালিকা ও তরুণীরা প্রচলিত আচারবিধি অনুযায়ী পূজার যাবতীয় কর্ম সম্পন্ন করে। টুসু অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য এক উৎসব।

টুসু অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেয়েরা টুসু সঙ্গীত পরিবেশন করে, যা এ উৎসবের বিশেষ অঙ্গ ও মূল আকর্ষণ। টুসু গান আকারে ছোট হয় এবং গ্রাম্য নিরক্ষর নারীরা সেগুলি তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে রচনা করে। গানগুলি পল্লিবাসীর লোকায়ত সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার এক অনন্য প্রকাশ। উৎসবান্তে প্রতিমা বিসর্জন খুবই বৈচিত্র্যময় ও বেদনাদায়ক হয়। এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মেলাও বসে।

টুসু শব্দটির উদ্ভব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। ধানের তুষ থেকে ‘টুসু’ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত পৌষালি উৎসব ‘তুষতুষালি ব্রতকথা’র মধ্যে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়।

গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান
সপ্তম পর্ব- টুসুগান-৭

গীতরচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পৌষ পরবে টুসু পূজিব——
আমরা টুসুর ভোগ সাজাব-
পৌষ পরবে টুসু পূজিব।

বাড়িতে আছে চালের পিঠা
আতপ চাল আর গুড়,
হরেক রকম গুড়ের চাকতি
সন্দেশ আর খেজুর।

মুড়কি, খই আর বাতাসা
টুসুকে আমরা খাওয়াব।
… … … … … … … …
পৌষ পরবে টুসু পূজিব——
আমরা টুসুর ভোগ সাজাব-
পৌষ পরবে টুসু পূজিব।

পৌষ পরবে টুসুর পূজা
গোটা পৌষ মাস ধরে,
সাঁঝের বেলা সবাই মিলে
টুসুগান গায় সুর করে।

সংক্রান্তির দিন এলে টুসুকে
অজয়নদীর জলে ভাসাব।
… … … … … … … …
পৌষ পরবে টুসু পূজিব——
আমরা টুসুর ভোগ সাজাব-
পৌষ পরবে টুসু পূজিব।

বাংলায় অনেক ধরনের গান রয়েছে। এখানে সে রকম কয়েকটি গানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হল –
ভাদুগান:ভাদ্রমাসে রাঢ় অঞ্চলে কুমারী জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়ে মেয়েরা যে গান গেয়ে থাকেন সেগুলো ভাদুগান।
[প্রথম পর্বে প্রকাশিত]
কবিগান: দু’জন কবি বা দুই কবি দলের মধ্যে গানের লড়াই কবিগান হিসেবে পরিচিত।
[দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত]
বাউল গান: একতারা, খঞ্জনি, ডুগি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গাওয়া এক বিশেষ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনার গান বাউল গান।
হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েই বাউল গান প্রচলিত। [তৃতীয় পর্বে প্রকাশিত]
কীর্তন গান: কীর্তন মানে কীর্তির গান। শ্রীকৃষ্ণের বিবিধ নাম, লীলা ও কীর্তি সংবলিত গানই কীর্তন। [চতুর্থ পর্বে প্রকাশিত]
যাত্রাগান: মঞ্চ তৈরি করে বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য ও অভিনয় সহকারে একপ্রকার বিনোদনমূলক গান পরিবেশিত হয় তা যাত্রাগান নামে পরিচিত। [পঞ্চম পর্বে প্রকাশিত]
ঘাটুগান: ঘাট থেকে ঘাটু। বর্ষাকালে নৌকার উপর বালিকা বা বালিকাবেশী বালকদের নৃত্যকে কেন্দ্র করে এই ঘাটুগান গাওয়া হয়। [ষষ্ঠ পর্বে প্রকাশিত]
টুসু গান: হেমন্তে নতুন ধান তোলার সময় মেয়েদের ‘তুষতুষালী’ ব্রতের গানগুলো টুসুগান নামে পরিচিত। [বর্তমান প্রকাশ]

পরবর্তী পর্বে প্রকাশিত হবে।

ভাটিয়ালি গান: ভাটি অঞ্চলে নদীকেন্দ্রিক গানগুলো ভাটিয়ালি গান নামে পরিচিত। ভাটিয়ালি গানের নাম নয়, সুরের নাম। ঐ সুরের গানগুলো ভাটিয়ালি গান। [অষ্টমপর্বে প্রকাশিত হবে]

ঝুমুর গান: সাঁওতাল আদিবাসিদের গানগুলো ঝুমুর গান নামে পরিচিত। [নবমপর্বে প্রকাশিত হবে]

গাজনের গান: ধর্মঠাকুর, শিব, নীল প্রভৃতি দেবতার গাজনের উৎসবের গানগুলোকে গাজনের গান বলে।
[দশমপর্বে প্রকাশিত হবে]

গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান দ্বিতীয় অধ্যায় –এ প্রকাশ দেওয়ার আশা রাখি:
আলকাপ: মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত লোকগীতি আলকাপ নামে পরিচিত। গম্ভীরা: দেবতা শিবের নিকটে দুঃখী মানুষ যে গানের মাধ্যমে তাদের দুঃখ নিবেদন করে তাই গম্ভীরা গান। গাজির গান: মুসলিম ধর্ম প্রচারকেরা গাজি নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁদের নিয়ে রচিত গানগুলো গাজির গান। চটকা গান: ভাওয়াইয়া গানের অধঃপতিত রূপের নাম চটকা। ছাদ পেটানোর গান: পাকা বাড়ির ছাদে চুনসুরকির আস্তরণ দিয়ে মুগুর দিয়ে পিটিয়ে শক্ত করে তোলা হয়। এই কাজের সময় কর্মীরা যে গান গেয়ে থাকেন তা ছাদ পেটানোর গান। জাগগান: সারা রাত জেগে পীর-দরবেশের মাহাত্ম্য সংবলিত যে গান গাওয়া হয় তা জাগগান বা জাগরণ গান। জারিগান: মুহরম উপলক্ষ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের গীত গানগুলো জারিগান। তরজা: প্রহেলিকাজাতীয় প্রশ্নোত্তরমূলক ছড়া গান। দেহতত্ত্বের গান: প্রধানত বাউল, মুর্শিদা, মাইজভাণ্ডারী ও মারফতি গানে দেহসংকেতপূর্ণ কিছু গান আছে। এগুলো দেহতত্ত্বের গান বলে পরিচিত। দেহতত্ত্ব গানের রাজা ছিলেন লালন শাহ্। ধামালী: শ্রীকৃষ্ণ বা কখনও শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে নাচযুক্ত একধরনের কাহিনীমূলক গানকে ধামালী বলে। এই গানগুলো মেয়েরা গেয়ে থাকেন। পদাবলী: হিন্দু বৈষ্ণব ও শাক্ত মতের ধর্মীয় ভক্তিমূলক গানগুলো যথাক্রমে বৈষ্ণবপদাবলী ও শাক্তপদাবলী (শ্যামাসংগীত) নামে পরিচিত। বোলান:পৌরাণিক বিষয় নিয়ে সন্ন্যাসীদের গীত গানগুলো বোলান গান। ভাওয়াইয়া: উত্তরবঙ্গের উজান বা শুষ্ক অঞ্চলের লোকগীতি ভাওয়াইয়া নামে পরিচিত। মারফতি: মধ্যযুগের বাংলা সুফী সাধকরা এক প্রকার আধ্যাত্মিক গান রচনা করেন যেগুলো মারফতি নামে পরিচিত। মালসী: দেবী বিষয়ক এক রকম গানকে মালসী বলা হয়। কখনও দুর্গা পূজার আগমনী বা শাক্ত সংগীতকেও মালসী বলা হয়। মুর্শিদা: মুর্শিদ মানে গুরু। গুরু প্রশংসা, ভক্তি, স্রষ্টার কাছে আত্মনিবেদন ইত্যাদি আধ্যাত্মিক বিষয় সংবলিত গানই মুর্শিদা গান। লেটোগান: মঞ্চ তৈরি করে বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য ও অভিনয় সহকারে একপ্রকার বিনোদনমূলক গান পরিবেশিত হয় যা লেটোগান নামে পরিচিত। সারিগান: সারিগান এক ধরনের কর্মসংগীত। কর্মরত অবস্থায় সমবেত কণ্ঠে এই গান গাওয়া হয়।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

14 thoughts on “গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান সপ্তম পর্ব- টুসুগান-৭

  1. টুসু উৎসব। সত্য বলতে কি, বঙ্গ সংস্কৃতিতে এতো এতো উৎসব থাকতে পারে আমার জানা ছিলো না। আপনার পোস্ট পড়ছি আর ধীরে ধীরে জানার সুযোগ পাচ্ছি।
    শুভেচ্ছা মি. ভাণ্ডারী। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. আপনার সুন্দর হৃদয়ছোঁয়া মন্তব্যে বিমুগ্ধ হলাম।
      সর্বদাই সাথেসাথে থাকবেন- এটা প্রত্যাশা করি।
      জয়গুরু!

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। আন্তরিক অভিনন্দন রইল
      শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
      সাথে থাকুন পাশে রাখুন, জয়গুরু!

  2. শিল্প সংস্কৃতি ক্যাটাগরিতে এই ধারার লেখা গুলো শব্দনীড়েরর সম্পদ হয়ে থাকবে। ভালোবাসা কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. আপনার সুন্দর হৃদয়ছোঁয়া মন্তব্যে বিমুগ্ধ হলাম।আপনার লেখা একাঙ্ক নাটকটি পড়লাম।
      ভালো লেগেছে। মন্তব্য দেওয়া বন্ধ আছে।নাট্যকারের অনুমতি পেলে নাটকটি
      পূজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ করার আশা রাখি।
      জয়গুরু!

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। আন্তরিক অভিনন্দন রইল
      শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
      জয়গুরু!

  3. গ্রাম বাংলার নানা অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং জীবনচর্যাকে ঘিরে সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে বাংলার লোকগান। সারা বাংলায় অঞ্চলভেদে হরেক রকমের লোকগানের উদ্ভব ও প্রচলনের অংশবিশেষ পড়লাম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. আপনার সুন্দর হৃদয়ছোঁয়া মন্তব্যে বিমুগ্ধ হলাম।
      জয়গুরু!

  4. আগের এবং বর্তমান পর্ব পড়েছি। সামনের পর্ব গুলোও পড়বো আশা করি। :)

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। আন্তরিক অভিনন্দন রইল
      শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
      জয়গুরু!

    1. ধন্যবাদ। আন্তরিক অভিনন্দন রইল
      শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
      জয়গুরু!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।