গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান
দশম পর্ব গাজনের গান-১০
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনা ও গীতরচনা -লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
গাজনের গান: ধর্মঠাকুর, শিব, নীল প্রভৃতি দেবতার গাজনের উৎসবের গানগুলোকে গাজনের গান বলে। গাজনের গান খোল, করতাল, ঢাক, কাঁসর বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অসাধারণ সুর করে গাওয়া হয়। শৈব-সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ হচ্ছে ‘গাজন’। গাজন অর্থে (গাঁ= গ্রাম, জন= জনগণ) গ্রামের জনগণের নিজস্ব উৎসব।
বাংলাদেশে ইহা নানা পৌ্রাণিক ও লৌ্কিক দেবতার নামের সহিত যুক্ত হইয়াছে, যেমন শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন, আদ্যের গাজন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।
ধর্মঠাকুর পশ্চিমবঙ্গ ও রাঢ় অঞ্চলের গ্রামীণ জনসাধারণ কর্তৃক পূজিত একজন দেবতা। তিনি ধর্মরাজ বা কেবলমাত্র ধর্ম নামেও পরিচিত। ধর্মঠাকুর মূলত একটি সিঁদুর-মাখানো নির্দিষ্ট আকারবিহীন প্রস্তরখণ্ডে তাঁর পূজা করা হয়। প্রস্তরখণ্ডটি কোথাও কোথাও গাছের তলায় বা উন্মক্ত ক্ষেত্রে “ধর্মঠাকুরের থান” বা “ধর্মরাজতলা”-এ রাখা হয়, কোথাও আবার মন্দিরে রেখে পূজা করা হয়।
গ্রামের ধর্মরাজ পূজার ইতিহাস কথায়, এই ঠাকুর টি আগে ছিলো একটা কষ্টিক পাথরের মূর্তি। তারপর থেকেই একটা মাটির ঘোড়া কে সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করা হয়। পূজো কয়েকদিন ঠাকুরের ভক্তগণকে তেল ছাড়া হবিষ্যান্ন ও ফলমূল খেতে হবে। এই পূজোর নিয়ম হচ্ছে
______________________
১| প্রথমে ঠাকুর আনা হয়।
_________________________
২| দ্বিতীয় পর্বে ঠাকুর কে মুক্ত স্নান করানো হয়।
________________________
৩| তৃতীয় দিন বাবার পূজা ও রাজ ভারাল ও ভক্ত দের ভিড়।
*************************
৪| প্রতি ঘরে ঘরে বাণেশ্বর পূজা করা হয়। নৈবেদ্য ফলমূল ভক্তজনের আহার্য বস্তু।
*************************
৫| সকল ভক্তগণের সহযোগে ধর্মযজ্ঞ রন্ধন। ধর্মরাজ মন্দিরের একাংশে এই ভোজ্যপদার্থ রন্ধন করা হয়। সকলেই প্রসাদ গ্রহন করে।
*************************
ধর্মঠাকুরের উৎসবকে বলা হয় “ধর্মের গাজন উত্সব।”। ধর্মের গাজন ও শিবের গাজন সমরূপ। তবে ধর্মের গাজনে ঘোড়ার ব্যবহার আবশ্যক, যা শিবের গাজনে নেই। গাজনের সন্ন্যাসীদের “ভক্ত” বা “ভক্তিয়া” বলা হয়। তাঁরা এমন কতকগুলি অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন, যা অন্ত্যেষ্টী সৎকার প্রথার অনুরূপ। মনে করা হয়, গাজন ধর্মঠাকুর ও দেবী মুক্তির বিবাহ উৎসব। কিন্তু এই ধারণায় কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। মাথার খুলি নিয়ে নাচ গাজনের একটি অঙ্গ, যাকে অনার্য সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত মনে করা হয়।
ধর্মঠাকুরের বাহন হল ঘোড়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য হাতিকে ধর্মঠাকুরের বাহন মনে করা হয়। রাঢ় অঞ্চলে পোড়ামাটি ও কাঠের তৈরি ঘোড়া দিয়ে ধর্মঠাকুরের পূজা করা হয়। গ্রামবাসীরা এই সব ঘোড়া ধর্মঠাকুরের কাছে মানত করে। তবে অনার্য দেবতা ধর্মঠাকুরের সঙ্গে ঘোড়ার যোগ একটু আশ্চর্যজনক। কারণ নর্ডিক জাতিগোষ্ঠীই ভারতে ঘোড়া ও লোহার ব্যবহার প্রবর্তন করে। এই কারণে মনে করা হয়, ধর্মঠাকুরের পূজায় ঘোড়ার ব্যবহার সূর্যপূজার পরিচায়ক।
বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে ধর্মঠাকুর গাজনে তিনটি প্রমাণ সাইজের কাঠের ঘোড়ার উপরে মহামানস, স্বরৃপনারায়ণ ও ধর্মরাজ (যথাক্রমেঃ বুদ্ধ, , সংঘ ও ধর্ম)কে চড়িয়ে অসংখ্য ভক্ত-সন্ন্যাসী ও মাথায় জ্বলন্ত ধুনোর খোলা নিয়ে ব্রতচারিণীদলের শোভাযাত্রা বেরোয়। পূর্ব বর্ধমানের কুরমুনের গাজনে সন্ন্যাসীদের মুখে রং মেখে সঙ সেজে ও শ্মশান সন্ন্যাসীদের নরমুণ্ড নিয়ে নৃত্য লক্ষ্যণীয়; কুরমুনের মেলায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি পুতুলের কলানৈপুণ্যের প্রতিযোগিতা আকর্ষণীয়। ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার গাজনে মৃত্তিকানির্মিত বিরাট শিবমূর্তির সামনে বলি দেওয়া এবং বলির রক্তে মূর্তিকে স্নান করানো বিশেষ বৈশিষ্ট্যময়।
গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রনা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। গাজন উপলক্ষ্যে তারা শোভাযাত্রা সহকারে দেবতার মন্দিরে যান। শিবের গাজনে দু’জন সন্ন্যাসী শিব ও দুর্গা সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সং সেজে নৃত্য করতে থাকেন। শিবের নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালীনাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ধর্মঠাকুর গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা কালিকা পাতারি নাচ)। জ্যৈষ্ঠমাসে গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যারা অংশ নেয়, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করে।
একটি প্রচলিত গাজনের ছড়া গান
আমরা দুটি ভাই,
শিবের গাজন গাই।
ঠাকুমা গেছেন গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।
গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান
দশম পর্ব, গাজনের গান-১০
গীতরচনা -লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
সুর – (প্রচলিত)
প্রথম গায়ক: পূবেতে উদয় হল হে…….
গায়কবৃন্দ: ওই-ওই- ওই ওই……ও …ই
প্রথম গায়ক: প্রদীপ্ত দিবাকর।
গায়কবৃন্দ: প্র দীপ্ত দিবাকর।
প্রথম গায়ক: সবাই মিলে ভক্ত সবে
গায়কবৃন্দ: ওই-ওই- ওই ওই……ও …ই
প্রথম গায়ক: বারে বারে প্রণাম কর।
৫১ জন ঢাকী ঢাকে কাঠি দেয়। কাঁসর বেজে ওঠে একসাথে। তত্পশ্চাতে মৃদঙ্গ ও খোল বাদ্যযন্ত্রীরাও আনন্দে নেচে নেচে বাদ্য বাজায়। করতাল বাজিয়ে গায়কবৃন্দ আনন্দে নৃত্য করে। চারিদিকে ধূনোর সুগন্ধে ভরে ওঠে। ধূনুচি নিয়ে ধর্মরাজ ঠাকুর বহনকারীর নাকে ও মুখে ধূনো দেয়। সকলে উল্লাসিত হয়ে জয়ধ্বনি দেয়। এসো বাবা ধর্মরাজ হে।তখন ধর্মরাজ ঠাকুর বহনকারী ভক্ত চলতে শুরু করেন। পরে আবার দাঁড়িয়ে যান। পুনরায় সকলে একসাথে গেয়ে ওঠে…
প্রথম গায়ক: ভক্ত হে ওহে হে…….
গায়কবৃন্দ: ওই-ওই- ওই ওই……ও …ই
প্রথম গায়ক: ভক্ত রাম রাম বল।
গায়কবৃন্দ: ওই-ওই- ওই ওই……ও …ই
প্রথম গায়ক: সূর্য স্নান করে ভক্ত হে
গায়কবৃন্দ: সূর্য স্নান করে ভক্ত হে
প্রথম গায়ক: সবার সাথে চল।
গায়কবৃন্দ: স- বার সাথে চল।
শংখ ও কাঁসর বেজে ওঠে একসাথে। ঢাকের শব্দে গগন বিদীর্ণ হয়। তত্পশ্চাতে মৃদঙ্গ ও খোল বাদ্যযন্ত্রীরাও আনন্দে নেচে নেচে বাদ্য বাজায়। করতাল বাজিয়ে গায়কবৃন্দ আনন্দে নৃত্য করে। চারিদিকে ধূনোর সুগন্ধে ভরে ওঠে। ধূনুচি নিয়ে ধর্মরাজ ঠাকুর বহনকারীর নাকে ও মুখে ধূনো দেয়। সকলে উল্লাসিত হয়ে জয়ধ্বনি দেয়। চল বাবা ধর্মরাজ হে।তখন ধর্মরাজ ঠাকুর বহনকারী ভক্ত চলতে শুরু করেন।
গ্রীষ্মের দাবদাহে কাঠ ফাটা মাটিতে কেহ কেহ স্নান করে সিক্ত বসনে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। ধর্মরাজ ঠাকুর বহনকারী ভক্ত তাকে ডিঙিয়ে পার হয়ে যান। লৌকিক বিশ্বাস এমনি গড়াগড়ি দিলে পারিবারিক মঙ্গল হয়। সকলেই ধর্মরাজ ঠাকুরের অপার স্নেহ ও করুণা লাভ করে। এরপর সকলে একটি বটগাছের নীচে মৃত্তিকা নির্মিত ঘোটকের সামনে আম্রপল্লব সহ ঘটে জল এনে বটগাছের মূলে ঢালতে থাকে। সকলে জয়ধ্বনি দেয় জয় জয় বাবা ধর্মরাজের জয়।
ধর্মঠাকুরের উৎসবকে বলা হয় “ধর্মের গাজন উত্সব।” ধর্মের গাজন ও শিবের গাজন সমরূপ। ___ কোন আইডিয়া ছিলো না। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ মি. ভাণ্ডারী।
আপনার সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। কৃতজ্ঞচিত্তে প্রণিপাত করি।
সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। শারদীয়া অভিনন্দন রইল।
জয়গুরু!
বর্ণনা এমন সুন্দর হয়েছে যে মনে হলো চোখের সামনে ঘটছে সব। খুশি হলাম কবি দা।
ধন্যবাদ সাজিয়া আফরিন কবিবোন।
মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। সাথে থাকুন।
জয়গুরু!
অনেক সমৃদ্ধ আমাদের গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান।
সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম কবিবর।
সাথেই থাকুন। জয়গুরু!
গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকগান কেবলই যেন আমাদের একান্ত উৎসব।
ধন্যবাদ প্রিয় কবিবর। আপনার মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম।
সাথে থাকুন। জয়গুরু!