ফজলউদ্দীন খোন্দকার রুপগঞ্জ জামে মসজিদের পেশ ইমাম। পঞ্চাশ বছর বয়স। জোয়ান বয়েসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে শ্লোগান দিয়ে জেল খেটেছেন। পাকিস্তান স্বাধীন হবার পরে বুক ভরে শ্বাস নিয়েছেন। নিজের দেশ, নিজের পাক জমিন।
ইমামতি নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট আছেন। এই সময়ের রাজনীতি বুঝেন না, এই বয়সে বুঝার ইচ্ছাও নেই। যতটুকু বুঝেন তা নিজের মত করেই বুঝেন। পাঁচ মাস আগে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ। দিনে দিনে জামাতে মুসল্লীর সংখ্যা কমছে। আজ এশার জামাতে হাজির ছিলেন মাত্র ষোলজন। সবার চেহারায় আতংক। লক্ষণ ভালো না।
পাকিস্তান মিলিটারিবাহিনী গতকাল নিতাইগঞ্জ থেকে এই গ্রামে এসেছে। প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প করেছে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। ঘোষ পাড়ার অনেকে মিলিটারির নাম শুনে পালিয়েছে।
হেকমত উল্লাহ মুদী দোকানদার। তিনি মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্বও পালন করে। প্রতিদিন এশার নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের সাথে থাকে। গল্পগুজব শেষে রাত গভীর হলে বাড়ি ফিরে। আজ পোয়াতী বউয়ের ব্যাথা উঠেছে বলে ফরজ নামাজ আদায় করেই চলে গেছে।
ইমাম সাহেব তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে সালাম ফিরাতেই মোয়াজ্জিন হেকমতের গলা শুনলেন, “হুজুর, দরজাটা খুলেন, দেরী কইরেন না, মহাবিপদ..।” ইমাম সাহেব দরজা খুললেন। রক্তাক্ত হেকমতের সাথে মসজিদে মিলিটারি ঢুকলো। ইমাম সাহেবের ঘর সার্চ করে একটা ট্রানজিস্টার পেতেই হেকমত কোঁকাতে কোঁকাতে জানালো, “স্যার, এই ট্রানজিস্টার দিয়াই ইমাম সাহেব আর হাম মিলকে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতা হ্যায়।”
একটা সস্তা ট্রানজিস্টারর আর আট বছরের এতিম নাতীসহ ইমাম সাহেবকে মসজিদের দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মেজর সারাফাত আলী খান ফজর ওয়াক্তের অপেক্ষা করছেন।
ফজরের ওয়াক্তে আজ আজান হয়নি। তবু বিশ-পঁচিশ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে চলে এসেছেন। মিলিটারি দেখে মসজিদে না ঢুকে দূরে জাম গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছেন। মেজর এদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি মসজিদের দরজায় দাড়ানো ইমাম সাহেবকে কোরান ছুঁয়ে শপথ করালেন। সবাই যেন শুনতে পায় এমন স্বরে স্পষ্ট বাংলায় জানতে চাইলেন-
: তুমি স্বাধীন বাংলা বেতার শুনো?
: শুনি।
: তোমার দুই ছেলে মুক্তি?
: জ্বি মুক্তি।
: তুমি মিথ্যা না বলে স্বীকার করলে কেন?
: কোরান ছুঁয়ে মিথ্যে বলবো কেন!
মেজরের কাছে এ কথার উত্তর নেই। তিনি কথা না বাড়িয়ে হেকমতকে ইমাম সাহেবের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন। মাথা নিচু করে ম্রিয়মান গলায় বললেন ‘ফায়ার’। ইমাম সাহেব, তার আট বছরের নাতী আর মোয়াজ্জিন হেকমতের বুক চিরে বেরিয়ে গেল কয়েকটা বুলেট। মসজিদের দরজায় ঢলে পরলো তিনটা দেহ।
যন্ত্রণাকাতর হেকমত রক্তজমাট বাঁধা কাটা ঠোঁট, থেতলানো হাত আর বুকে বুলেট নিয়ে নিত্যদিনের মত সুরেলা গলায় ফজরের আযান দিতে লাগলেন- আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম.. আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম..।
ইমাম সাহেবের জোব্বা খামচে ধরে নাতি বলছে-“নানা, বুকের ভিতর জ্বলি যাচ্ছি, পানি খাবাম। তুই একটু পানি দে..” ইমাম সাহেব নাতির মাথায় নিস্তেজ হতে থাকা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, “আরেকটু সহ্যি কর নানাভাই, ফিরিশতারা তোর জন্যি মিঠা শরবত লয়ি খাড়ায়া আছে যে …”
অসাধারণ।
মন্তব্য করার ভাষা নেই সত্যিই..! অসাধারণ
আপনার লিখা কৌশল আমার কাছে অসাধারণ লাগে দাদা।
পাকিস্তান মিলিটারিবাহিনী গতকাল নিতাইগঞ্জ থেকে এই গ্রামে এসেছে। প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প করেছে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। ঘোষ পাড়ার অনেকে মিলিটারির নাম শুনে পালিয়েছে।
2য় পর্বের পর 1ম খন্ড পড়লাম। সত্যিই! চলে গেলুম সেই ঐতিহাসিক মুহুর্তে।