রজবের চায়ের দোকান। সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত জমজমাট। কত কিসিমের লোক আসে। বসে। আড্ডা দেয়। ঝামেলা পাকায়, ঝামেলা সারায়।
মফিজ পুলিশের ইনফর্মার। চায়ে চুমুক দেয় আর ধূর্ত চোখে ধান্ধা তালাশ করে। মোবাইল ফোনে ইয়ারদোস্তের মত থানার সেকেন্ড অফিসারের সাথে কথা বলে।
তিন নম্বর রোডে আফসু ফেন্সি বেচে। সেখানে ফেন্সি গিলে কয়েকটা ছেলে কড়া মিষ্টি চায়ের তালাশে রজবের দোকানে আসে। চা খায়। চকোলেট চুষে। আফসু মাঝে মাঝে মফিজকে থানার মাসোহারা বুঝিয়ে দিতে আসে।
সলিম আর জব্বর জমির দালাল। জমি তালাশ করে, কাষ্টমার তালাশ করে। মুখে মুখে লাখ লাখ টাকা কমিশনের হিসাব কষে। হিসাব শেষে বিবর্ণ মুখে একটা গোল্ডলিফ কিনে দুজনে ভাগ করে খায়।
এগারোটায় দোকান বন্ধ করলে বারান্দায় এক পাগল এসে শোয়। তার নোংরা গা থেকে মাঝে মাঝে গোলাপের তীব্র গন্ধ বের হয়। রজব নিজে এই গন্ধ পেয়েছে। রজব পাগলের কাছে সুদিনের বিধান তালাশ করে। প্রায়ই পাগলের পা ধরে বসে থাকে। বুক ভাসিয়ে কাদে। পাগল হাসে আর ফিসফিসিয়ে বলে, ” মাইনষের বাচ্চারা উপায় জানি গেলি পাগল হয়্যি যায়। উপায় জানতি নাই। উপায় তালাশ করতি হয়। উপায় তালাশ করতি হয়।’
কি যেন কি তালাশ করতে করতে গুমড়ে গুমড়ে ভেসে যায় মধ্যরাতের ফতুর হাওয়া।
সিম্পলি বেস্ট ওয়ান।
একি গল্প নাকি কবিতা
একি কল্পনা না বাস্তবতা
স্বল্প কথায় জীবনের চিত্রকল্প
এক কথায় স্বার্থক অনুগল্প।
অনুগল্প বা ফ্লাশফিকশন
অনুগল্প বা ফ্লাশফিকশন সম্প্রতি সাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা হয়ে উঠেছে। গত পাঁচ বছর ধরে ব্রিটেনের সাহিত্যজগতে ‘ন্যাশনাল ফ্লাশফিকশন ডে’ উদযাপিত হয়ে আসছে। নিউজিল্যান্ডেও অনুরূপভাবে জাতীয় অনুগল্প দিবস পালিত হয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের বিপ্লব, ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তায় বর্তমানে গল্পের এই ক্ষুদে কাঠামো বা ফর্মটি নিয়ে হৈ চৈ হলেও এটি একেবারে নতুন কিছু না- মুখে মুখে বলা গল্প-ঐতিহ্যে (ওরাল ট্রাডিশন) বহু যুগ থেকে চলে আসছে। পশ্চিমে ঈশপের গল্প, ভারতবর্শে জাতক কিংবা লোকমুখে প্রচলিত গোপাল ভাড়ের গল্পও আকারে বেশ ছোট ছিল। গ্রিম ভাইদ্বয় যে ফোক-টেলস সংগ্রহ করেছিলেন তার বেশির ভাগই ছিল অনুগল্পের আকারে। এসব গল্পে সংক্ষিপ্ত আখ্যানে গুটিকতক চরিত্র ও ঘটনার ভেতর দিয়ে গল্পটি শেষ হয়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনুগল্পের প্রধানতম লেখক হলেন বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯)। বর্তমান বিশ্বে অনুগল্প লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেভিস (জ. ১৯৪৭)। ডেভিসের গল্পের দৈর্ঘ্য এক লাইন থেকে শুরু করে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার গল্পকে আদর্শ অনুগল্প বা ফ্লাশফিকশন বলা যায়। ছোটগল্পের পাশাপাশি অনুগল্প লিখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আরেক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার (জ. ১৯৪৫)। তবে বার্টলার এবং ডেভিসের অনেক আগে ছোটগল্পের পাশাপাশি অনুগল্প লিখে বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের প্রথম নোবেলজয়ী লেখক Yasunari Kawabata (১৮৯৯-১৯৭২)। অনুগল্প লিখেছেন কাফকা, হেমিংওয়ে, আর্থার সি ক্লাক, রে ব্রাডবুরি, নগিব মাহফুজ, ডোলান্ড বার্থলেম, আমব্রুস বিয়ার্স, কেট শপা, শেখবের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকরাও।
উল্লেখ্য যে, অনুগল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে অনুগল্প এখন ছোটগল্প থেকে কিছুটা সরে এসে সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ (genre) হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু হয়েছে।
http://www.banglatribune.com/literature/news/118163/বিশ্বসাহিত্যে-অনুগল্প
কবিতার মতো অনুগল্পকে নানামাত্রিক অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। একটি কাব্যিক দ্যোতনা বা ভাবমুদ্রা এখানে থাকে। ভাষা হয় ঘন, রূপকাশ্রিত। ফলে মার্কিন কবি ও কথাসাহিত্যিক গ্রেস পালে (১৯২২-২০০৭) বলছেন, ‘অনুগল্প কবিতার মতোই ধীরে পড়া উচিত।’ অন্যদিকে অনুগল্প গল্পের মতোই সমাজ বাস্তবতার কোনো সুপ্ত চেতনাকে ইঙ্গিত করে। চরিত্র থাকে, কথোপকথন (ডায়লগ) থাকে। একটা চমৎকার সমাপ্তিও থাকে। কেবল বলাটা হয় দ্রুত- বিদ্যুৎ চমকের মতন ঝলক দিয়েই শেষ। এক মুহূর্তে বর্ণিত বাস্তবতার এক ঝলক দেখে নেয়া।
অনুগল্পের সঙ্গে গল্পের মূল পার্থক্যটা হল, গল্প তৈরি হয় কতগুলো মুহূর্ত নিয়ে; এখানে কতগুলো ঘটনা কতগুলো দৃশ্যকে আশ্রয় করে প্রকাশ ঘটে। আর একটি সার্থক অনুগল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যপটের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার করে বলা হবে না, কেবল একটা ইঙ্গিত দিয়েই ছেড়ে দেয়া হবে। উপন্যাস এবং ছোটগল্পের সঙ্গে তুলনা করে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক লুইসা ভেলেনজুয়েলা (জ. ১৯৩৮) বলছেন : ‘I usually compare the novel to a mammal, be it wild as a tiger or tame as a cow; the short story to a bird or a fish; the micro story to an insect (iridescent in the best cases)।’
সব বিবেচনায় একটি স্বার্থক অনুগল্প।
* সুন্দর….
ভালো লাগলো দাদা। আমাদের চারপাশেও এমন অনেক আছে। সারাদিন খেটেখুটে রাতে শুয়ে শুয়ে কোটি টাকার স্বপ্ন দেখে। ভোরবেলা দেখে গায়ে ছিঁড়ে খেতা।
অসাধারণ সাঈদ আহমেদ ভাই।
যুগোপযোগী অনু গল্প হলেও অনেক দিক তুলে এনেছেন
খুবই সংক্ষিপ্ত আর রূপক।
পরিচিত পরিবেশের গল্প।
দারুণ অণুগল্প।