যোগী সোসাইটির মাঠ

ফাঁকফোকর পেলে ঢুকে পরাই আলোর স্বভাব, হাওয়ারও। যেখানে ঢুকতে পারেনা সেখানেই অন্ধকারের রাজত্বে উস্কানি দেয়, দমবন্ধ গুমোট করে তোলে। যোগী সোসাইটির মাঠেও আলো নিজ চরিত্র ভুলে শুদ্ধ হয়ে ওঠেনি, হাওয়াও।

হেমন্তের মিহি কুয়াশায় বিভোর মাঝরাত। ভরা পূর্ণিমা। জোছনায় ভেসে গেছে যোগী সোসাইটির চতুষ্কোণ মাঠ। মাঠের তিন দিকে ঘণ ঝোপঝাড়, বড় বড় ক’টা বট গাছ। ওখানে জোছনার জোড় খাটেনি। ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভয় ভয় আবছায়া, ঝোপঝোপ অন্ধকার। সতর্ক সংকেতের মত জ্বলছে-নিভছে জোনাকি।

যোগী সোসাইটির সদস্যরা গোল হয়ে বসেছে। জোছনায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবার চেহারা। চেহারাগুলোতে গাঢ় ক্ষুধা আর সীমাহীন উত্তেজনার ছাপ। বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে বৃদ্ধ এক নারী। তার হাত বাঁধা, পা বাঁধা, মুখ বাঁধা, শুধু চোখ দু’টো খোলা।

যোগী সোসাইটির জননী আতঙ্কিত চোখে আকাশ দেখছে। মিহি মিহি মেঘ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে। ঝিঝি ডাকছে। হাওয়ায় পাকা ধানের মাতাল ঘ্রাণ। খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কান্নার করুণ সুর। কান্নাটা কি ধীরে ধীরে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ধেয়ে আসছে! চমক ভাঙে, ঘিরে থাকা সন্তানদের দিকে তাকান জননী, ছলো ছলো চোখে ঝাপসা সব মুখ।

শুদ্ধতম এক রাজ্যের স্বপ্ন রক্তে রক্তে সংক্রামিত করেছিলেন জননী। তিনি শিখিয়েছিলেন তার পক্ষ ছাড়া বাকীসব অশুদ্ধ- হোক মানুষ, হোক নদী, হোক ফুল, হোক পাখি, হোক আকাশ, হোক গান, হোক কবিতা, হোক গান, হোক মত, হোক পথ। ‘শুদ্ধে রাজ্যে অশুদ্ধের কোন স্থান নেই’ ব্যাধিতে আক্রান্ত অনুসারীরা শুদ্ধতার নামে একের পর এক খুন করেছে নদী, পাখি, ফুল, ফল, ভ্রুণ, পিতা, মাতা, ভাই, বোন, বন্ধু, আত্নীয় স্বজন।

শুদ্ধতার বিষয়ে যেই সংশয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সেই অশুদ্ধতার অভিযোগে খুন হয়ে গেছে। খুনের পর লাশের সৎকার অনর্থক ভেবেই তারা পান করতে শিখেছে রক্ত এবং মাংস। মাংস খেতে খেতে খেতে খেতে তারা অশুদ্ধ মানুষের মাংস ভক্ষণে আসক্ত হয়ে পরেছে।

প্রোটিন ও মদের কোনো শুদ্ধাশুদ্ধ ভেদ নেই জেনেই যোগীয়ানরা স্বগোত্রীয়দের মাংসও খায়। খেতে না পেলে উন্মাদ হয়ে ওঠে। এটি জেনেই জননী সবাইকে নিরামিষভোজী হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যে বাঘ পেয়েছে রক্তের স্বাদ তার জিভে কি আর শরবত রুচে!

গত দু’মাস ধরে মানুষের মাংস খেতে না পেয়ে যোগীয়ানরা দানবের মত ক্ষুধার্ত উন্মাদের। অবশেষে জননীকেই তুলে নিয়ে এসেছে। বহুদিন অশুদ্ধ মানুষদের মাংস খেয়ে খেয়ে শুদ্ধতার যতটুকু ঘাটতি, আজ তা পূরণ করে নেওয়া যাবে। জননী শুদ্ধতাময়ীর মাংসে আছে অশুদ্ধতা নাশের সব উপাদান।

বৃত্ত থেকে একজন উঠে এসে আমূল একটি ছুরি জননীর চোখে ঢুকিয়ে দেয়। জননী কেঁপে উঠেন, তার মুখ বাঁধা বলে আর্তচিৎকারটা শোনা যায়না। একটানে বের করে আনলে ছুরিটার কোনায় দেখা যায় চোখের খণ্ডিত অংশ লেগে আছে। পরম ভক্তিতে চোখটি খেয়ে যোগী বলে, “মা গো, তোমার চোখ বেঁচে রইলো আমার চোখে, নয়ানে নয়ানে।” মুহুর্তে সবাই হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পরে জননীর মাংস খেতে। অবশ্য খাওয়ার আগে ভক্তি ভরে জননীকে জানায়, “মা গো, তুমি এখন আমাদের সবার রক্তে মিশে গেছো। এতোদিন তুমিই ছিলে আমরা, আজ আমরাই তুমি। শুদ্ধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ছাড়বোই ছাড়বো।”

যোগী সোসাইটির চতুষ্কোণ মাঠে নেমে এসেছে অসীম ক্ষুধা। জননীর কঙ্কাল চুষতে চুষতে পরস্পরের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে শুদ্ধতম যোগীর দল – আহ! ক্ষিধে! অসহ্য ক্ষিধে! ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার মত দানবিক ক্ষিধে।

#অণুগল্প

18 thoughts on “যোগী সোসাইটির মাঠ

  1. ক্ষিধে! অসহ্য ক্ষিধে! ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার মত দানবিক ক্ষিধে মানুষকে অমানব করে তোলে।

  2. দাদা, আপনার প্রতিটি লেখা এবং পোস্ট না পড়লে পুরো শব্দনীড়ই শব্দহীন হয়ে উঠে। চমৎকার বাস্তব উপস্থাপনে আপনি খুবই পারদর্শী। শুভেচ্ছা জানবেন।            

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।