ভগ্নাংশ

গতকাল মধ্যরাতে মান্না দে’র গানের মত জোছনা ছিলো, প্রেম আর বিরহে বেসামাল ও উদভ্রান্ত। মফস্বল নীরব, ঝিঁঝিঁর ডাক, গাছের পাতায় হাওয়ার খসখস ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। না, না শব্দ ছিলো। সংঘবদ্ধ নীরবতাকে অধিকতর নীরবতা দানের জন্যই ডেকে উঠছিলো রাত জাগা কোনো পাখি। ছাদে যাবো, ঘরের দরজা খুলতেই পোষা পায়রাগুলোর বাকবাকুম শুরু, খাঁচার সামনে দাঁড়াতে তাদের সুর ধীর হয়ে আসে। একটা গিরিবাজ জানতে চায়,
– ভালো আছো তো?
– হ্যা। তোমরা?
– ভালো আছি, খাঁচার জীবন খুব একটা খারাপ নয়, সকাল বিকাল পাখা মেলে উড়বার সুযোগ পাই, খাদ্য খানা নিয়ে ঝামেলা নেই। সমস্যা শুধু তোমার।
বিস্মিত হয়ে জানতে চাই,
– সমস্যা শুধু আমারই হবে কেনো?
– তোমারই হবে। এই যে আমাদের খেয়াল রাখা, ছাদে পাখিদের জন্য দুই বেলা শস্য দানা দেওয়া, খরগোশের জন্য ঘাসের যোগার করা, পথের বিড়াল আর কুকুরের জন্য খাবার দেওয়া- এসব তো বহু ঝামেলার কাজ, সবাই তাই বলে।
-ওহ! আমি ভাবলাম কি না কি ঝামেলা!
গররা পায়রাটার কণ্ঠে বেশ ঝাঁঝ,
– কোথাকার কোন লোক, তাকে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছো, এদিকে নিজের পায়ের ব্যাথাটাকে পুষছো, রাতদিন খুড়িয়ে হাঁটছো, এটা ঝামেলা নয়!
এই পৃথিবীতে উত্তরের তুলনায় প্রশ্ন ও বিস্ময়ের সংখ্যা বেশী। তাই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়না, সকল বিস্ময়ের অবসান ঘটাতে নেই। পায়রাদের বাকবাকুমে খরগোশ দম্পতির ঘুম ভেঙেছে, ছাদের দিকে পা বাড়াতেই খরগোশদের একজন কান নেড়ে জানালো, তাদের সংসারে নতুন অতিথি আসছে।

২.
ছাদ জুড়ে জোছনা আর আবছায়ার যুগলবন্দী শয়ান। ছাদের প্রতিবেশী কদম আর পেয়ারা গাছের পাতায় পাতায় জোছনার নরম ঝলকানি। যেখানে জোছনা পৌছতে পারেনি সেখানে আধো আধো অন্ধকার। শ্রাবণ মাস শেষ হয়েছে বেশ ক’দিন আগে, গাছে এখনও বেশুমার কদম ফুল। ছাদে দাঁড়িয়ে একটা ফুলে হাত বুলাতেই ফিসফিসিয়ে ওঠে কদম,
– এতো রাতে ধ্যান ভাঙালে কেনো?
চমকে উঠি, নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চাই,
– ধ্যানে ছিলে বুঝি!! কিসের ধ্যান?
– সে তুমি বুঝবে না, স্থবিরতার ধ্যান।
– ও.. হো। তবে থাক..
– থাকবে কেনো! ধ্যান যখন ভাঙালেই এসো একটু গল্প করি..
হাওয়া বয়ে যায়, হিম হিম। দুপুরে প্রচণ্ড গরম ছিলো, ভাদ্র মাসের তালপাকা তাপ। হাওয়ার শিরশিরানি গায়ে মেখে প্রশ্ন করি-
– কদম, তোমার সহস্র সহস্র বছর আগের স্মৃতি মনে আছে?
– আমাদের কোনো ক্যালেন্ডার নেই, বছরের হিসেব যে জানিনা..
– স্মৃতিও কি জমা রাখো না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদম,
– চাইলেই কি স্মৃতি ভুলা যায়! আমাদের স্মৃতি জমা করে রাখি বীজে, আমাদের জন্ম হয় বিগত সকল জন্মের প্রতিটি মুহুর্তের স্মৃতি নিয়ে।
– তাই!
– তাই না তো কি! সেই কবেকার কথা, আমার ছায়াতেই দুরন্ত এক প্রেমিক বাঁশী বাজাতো। বাঁশীর সুরে সুরে আকুল আহ্বান, বিধিনিষেধের দেওয়াল টপকে আসতো তার প্রেমিকা বৃষভানু নন্দিনী। তারপর একদিন..
– তারপর একদিন কি?
– এক গাঢ় জোছনা রাত, ঘোষ বাড়ির কর্তা এলো কুঞ্জবনে, গোপনে। নিজ চোখেই দেখলো সব। তার প্রিয়তমা স্ত্রী বৃষভানু নন্দিনী পরম প্রেমে ধারণ করে আছে সচ্চিদানন্দকে। দু’জনের মুগ্ধ প্রেম আর কানাকানি কথায় ক্রোধে ফেটে পরেনি আয়ান ঘোষ। সে বুঝেছিল প্রেমে যে ডুবে গেছে তার ডুবে যাওয়াতেই আনন্দ, ডুবে থাকাতেই বেঁচে থাকা।
বিস্মিত হই, বাড়ির পাশের এক কদম গাছ নিজের ভেতর এতো স্মৃতি জমা করে রেখেছে। তার কাছে জানতে চাই,
– সচ্চিদানন্দ আর বৃষভানু নন্দিনী কে?
– তুমি চিনো না বলছো!
– সত্যিই চিনি না, এটা জানি যে সচ্চিদানন্দ সেই কৃষ্ণ, যে বৃষভানু নন্দিনী সেই রাধা।
– শুধু এটুকুই জানো?
– আর যা জানি তা বিস্ময়, পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে কৃষ্ণের বাম পাশ থেকেই রাধার জন্ম।
– হ্যা। তো?
– মথুরা থেকে লক্ষ যোজন দূরে তারও আগে জন্ম নিয়েছিলো সেমেটিক ধর্ম, ওই ধর্মে বাবা আদমের বুকের বাম পাশের পাঁজরের হাড় থেকেই বিবি হাওয়ার জন্ম। কি অদ্ভুত মিল, তাই না। আরও আছে…
কথা শেষ করতে না দিয়েই কদম ফিসফিসিয়ে ওঠে,
– চুপ! একদম চুপ। ওসব নিয়ে কথা বলবে না। কৃষ্ণের গায়ের রঙ কেনো কালো, ক্ষৌরকর্ম ধর্মবিরুদ্ধ, কিন্তু কেনো তিনি ক্ষৌরকর্ম করতেন, কৃষ্ণ আর্যদের দেবতা ছিলেন না এই মাটির ব্রাত্যজনদের দেবতা – এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তো মরেছ। দুই পক্ষই তোমাকে মারবে, কেউ ছাড় দিবে না।
কদমের সতর্ক বাণীতে মনে মনে হেসে উঠি, কিছুটা বিমর্ষও হই। যে জীবন হওয়ার কথা ছিলো ক্ষুধার মত সরল, খাদ্যের মত আনন্দময়, বিশ্রাম ও প্রেমের মত মুখর, তার পরতে পরতে ছড়িয়ে দিয়েছি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। একটা মাত্র জীবন, প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়ে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে এই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই জেনেও প্রশ্নের চক্রে ঘুরছি সবাই।

৩.
কদম আর কোনো কথা বললো না। নীরবতায় কেটে গেলো কয়েক মিনিট, সম্ভবত সে ফের ধ্যানে মগ্ন হয়েছে। ছাদের কার্নিশে প্রাচীন তপস্বীর মত বসে আছে এক বিড়াল, কোমল দৃষ্টি। চোখে চোখ রাখতেই বলে,
– মানুষ মাত্রই ভগ্নাংশ, ভাগশেষে শূন্য।
– মানে?
– মানুষ একটা ভাগশীল প্রাণী, নিজেকে ভাগ করে দেয়। একটা মানুষের ষোল আনা ভাগ হয়ে যায় বহু বহু ভগ্নাংশে।
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করি-
– যেমন?
– খুব সহজ, ধরো একজন মানুষ সমস্তটা মিলে ষোলো আনা। এর এক আনা দিলো পাখিদের, এক আনা খরগোশদের, এক আনা করে কুকুর আর বিড়ালকে। এরপর চার আনা দিলো পাকস্থলির অন্ন যোগানোর দায়ে, এক আনা দিলো বন্ধুদের, এক আনা দিলে সোসাইটিকে, এক আনা দিলে আত্নীয়দের। যে কয় আনা বাকী রইলো তা সমান ভাগে ভাগ করে দিলো সংসার আর প্রিয়তম মানুষদের মাঝে।
– তো?
– সব ভাগ করে দেবার পর সে বুঝতে পারলো আরও ক’টা আনা থাকলে ভালো হতো। নিজেকে ভাগ করে দেওয়া অংশগুলোয় টান পড়ছে, এর থেকে কমিয়ে দিতে হচ্ছে ওকে, ওর ভাগেরটা দিতে হচ্ছে একে।
দম নেয় বিড়াল, সামনের পা দিয়ে মুখ ঘষে, তারপর গাঢ় বিষন্ন কণ্ঠে বলে,
– এসব ভাগাভাগি করতে করতে ধরো কোনো এক দিন, অথবা এমন চাঁদগ্রস্ত কোনো রাতে অকস্মাৎ বুঝতে পারে, নিজেকে ভাগ করে দিতে দিতে নিজের জন্য কিছুই রাখেনি সে।।ভাগশেষে নিজের জন্য অবশিষ্ট আছে শুধু শূন্য।
বিড়ালের অঙ্ক নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করেনা। আকাশের দিকে তাকাই, জানি আকাশ বলে কিছু নেই, শুধু অথৈ শূন্যতা।

৪.
কদম কি ধ্যানে মগ্ন হবার আগে মাথার ভেতর বপন করে গেছে বীজ! অঙ্কুরোদগম ঘটছে, খলবলাচ্ছে স্মৃতি। শত সহস্র বছর আগের কথা। সেদিন সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি। সূর্য ডোবার আগে বৃষ্টি থামলো। আধো আলো আধো ছায়াতে দাঁড়িয়ে থাকা এক হরিণকে বর্শায় গেথে নিলাম। ক্ষুধার অন্নে প্রস্ফুটিত হবে হরিণের সকল সৌন্দর্য্য।
আগুন জ্বালছে, হরিণের মাংস ঝলসানো হচ্ছে। গোল হয়ে বসে আছি আমরা ক’জন। আমার কাঁধে ভর দিয়ে আছে যে নারী, তার ঘামের ঘ্রাণ ঝলসানো মাংসের চাইতেও তীব্র সুন্দর। তাকে রেখে উঠে দাঁড়াই, পাশের ঝোপ থেকে ক’টা জোনাকি পোকা এনে গুঁজে দেই কানের ভাঁজে। সে হেসে ওঠে, তার হাসি মেঘের দিনের ঝর্ণা, উচ্ছল দুর্বার। তার হাসির সরল তীক্ষ্মতা বারবার বিদ্ধ করে যায়।
মাঝরাত। সবাই ঘুম। সে আর আমি জেগে আছি। শুয়ে আছি ঘাসে, সে আমার বামপাশে। খুব কাছ থেকে ভেসে আসছে বাঘের ডাক, ভ্রুক্ষেপ নেই। মাথার ওপর বিশাল চাঁদ। দু’জনেই তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। পরস্পরের মাঝে কোনো কথা নেই, ওই আদিম আমাদের কোনো ভাষা জানা নেই, কবিতা জানা নেই, গান জানা নেই। বেঁচে থাকার জন্য ভাষা তখনও অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি, পৃথিবীর সকল প্রেম নীরবতায় বোঝাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
রাত বাড়ে, চাঁদ নেমে আসে মাথার ওপর। তার চুলে তখনও জ্বলছে কয়েকটা জোনাক পোকা। জোনাক পোকাদেরও কোনো ভাষা নেই, আলোর কারুকাজ ছাড়া। সে আলতো করে আমার বুকে হাত ধরে, তার জট বাঁধা আঠালো চুলে বিলি কেটে দেই। সে জানে বা জানেনা, সেই পাবে আমার সর্বস্ব, আমার বর্শা ও শিকারের সব ভাগ। দাঁতাল বাঘের আক্রোশ থেকে বাঁচার জন্য আমার বুনো কালো শরীরই তার নিরাপত্তার দেয়াল।
সে ঘুমোয়, আমি জেগে থাকি, পাহারা দেই, যতক্ষণ না আসে নতুন সকাল।

৫.
ধ্যান ভেঙে ফের কথা বলে কদম,
– ঘরে যাও, একটু ঘুমোও। ভোর হতে দেরী নেই।
– এখন আর ঘুমাবো না। একটু পরেই ফজরের আযান দিবে, ভীষণ ভালো লাগে, খায়রুন মিনান নাউম… খায়রুন মিনান নাউম…
কদম খুব মোলায়েম স্বরে প্রশ্ন করে,
– মনসুখিয়ায় যাচ্ছো কবে?
– জানিনা, ডাকলেই যাবো।
– আমায় নিবে?
– শত সহস্র বিগত জীবনের স্মৃতি নিয়ে যে মনসুখিয়ায় যেতে নেই। মনসুখিয়ায় যেতে হয় নিজেকে নিয়ে, নিজের ষোলো আনা নিয়ে…
হাওয়া বয়ে যায়, হাওয়ায় হাওয়ায় তীব্র স্বরে হেসে ওঠে কদম,
– তোমার ষোলো আনাই তো হারিয়ে ফেলেছো, নিজের কাছে এক কানা আনাও নেই, মনসুখিয়া তোমায় নেবে!
কদমের বিস্ময় ভাঙাতে ইচ্ছে করে না। মনসুখিয়া হতে ভেসে আসছে অভ্রবকুলের ঘ্রাণ, সে ডাকছে আমায়, ডাকে সাড়া দিতে আমারই শুধু দেরী হয়ে যায়, দেরী হয়ে যায়।

#মনসুখিয়া/দ্বিতীয়_খণ্ড।

3 thoughts on “ভগ্নাংশ

  1. আপনার লিখনের প্রতি সব সময়ই আমার সম্মান দৃষ্টি থাকে। অসাধারণ অণুগল্প। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।