ওম

এক শীতের সন্ধ্যা। পুরোপুরি সন্ধ্যা বলা চলে না। রাত আসি আসি করছে। আকাশে চাঁদ থাকলে ও ম্লান প্রভায় চারপাশ হালকা আলোয় উদ্ভাসিত। শীত বেশ ভালো-ই। অবশ্য কানটুপি-জ্যাকেট আর জুতোয় ঢাকা পদযুগল নিয়ে শীতের পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত হয়ে একে সহনীয় মনে হতে পারে। সক্ষম আপট-ডেট মানুষদের বেলায়।

স্ট্রিট লাইট থাকলেও বালবগুলি জ্বলছে না। এমন রাস্তা দিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান ছুটে চলেছে। ওর যাত্রীদের চেয়ে ভ্যানচালকেরই যেনো তাড়াটা বেশী। একজন মা তাঁর শিশু বাবুটাকে নিয়ে বসে আছে। বাবুটার খোলা পা দু’টি চাঁদের ম্লান আলোয়ও বড্ড চোখে পড়ছে। মা’র পরণে সাধারণ শাড়ি। সেটা দিয়ে কোনোমতে মাথা ঢেকে রয়েছেন তিনি।

আরেকজন যাত্রী। মধ্যবয়স পার করে এসেছেন বছর দশেক আগে। সাথে একটি নতুন লেপ নিয়ে ফিরছেন বাড়িতে। কুটুম্ব এসেছে বাড়ি। মেয়ে-মেয়েজামাই। বাজারে বসে থেকে এই লেপটি বানিয়েছেন। তারও মনে মনে তাড়া। মফস্বল শহরে শীত অনেক তাড়াতাড়ি নামে। এতক্ষণে ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার কথা।

ভ্যানচালক একটু অপেক্ষাকৃত ভালো রাস্তায় গিয়ে আরো গতি বাড়িয়ে দেয়। দ্রুত চলার কারণে পাশ কাটানো বাতাস শীতল থেকে শীতলতর হয়ে শরীরে কামড় বসায়। বাবুটা মানুষ হয়ে জন্মাবার দায়ে কেঁপে কেঁপে উঠে। মা অনুভব করেন। নিজের শরীর ছাড়া উষ্ণতা দেবার মতো বাবুটার জন্য আর কিছুই তাঁর কাছে এই মুহুর্তে নেই। হৃদয়ের উষ্ণতার সাথে সাথে কিছু ক্ষুদ্র প্রশ্বাস ও বের হয়ে বাবুটাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়!

লেপওয়ালা যাত্রীকে সামনে নেমে যেতে হবে। তিনি তাদের এই ভ্যানযাত্রার মাঝপথে বাবুটার মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলেন তাঁরা কোথায় নামবেন। সেই হিসেবে এখনো অনেকটা পথ এই ভ্যানে তাদেরকে যেতে হবে। শীত, একটা নগ্ন পায়ের শিশু এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের একজন সাধারণ রমনী- যিনি একজন মা; এই ত্রিভুজ অনুভূতি তাকে কিছুটা বিষণ্ন করে তুলে। ভাবনার দোলাচালে তাকে কিছুক্ষণ দুলিয়ে যায়। এর শুরুটা অবশ্য সেই পথের মাঝে শুরু হয়েছিলো। আর তাঁর নিজের পথের শেষে এসে, আরো একটা চিন্তা চতুর্ভুজ ভাবনাকাশে তাকে পাক খাইয়ে চলে। সেখানে মেয়ে-মেয়েজামাই, শীত এবং একজন বাবা মূখ্য ভূমিকা পালন করে চলেন।

তাঁর নির্দিষ্ট জায়গাটিতে এসে ভ্যান থামাবার অনুরোধ করেন। ভাড়া মিটান। এরপর নিজের নতুন কেনা লেপটির দিকে তাকান। নিজের শোবার ঘরে- তাঁর এবং তাঁর বউয়ের জন্য বরাদ্দ আটপৌড়ে লেপটি ভাসে মনের চোখে। একই সাথে লেপবিহীন একটি শীতের রাত… নিজের বউ আর তিনি…। নিজের ঠিকানায় পৌঁছাতে অর্ধেক পথ বাকী এমন এক মা-ছেলের নন আপটু-ডেট পরিচ্ছদ। এসব কিছু ভেবে ভেবে-ই একজন মানুষ হয়ে উঠেন তিনি সামান্য সময়ের জন্য।

অবাক মা’য়ের চোখের বিহ্বল দৃষ্টির সামনে তিনি পরম মমতায়, লেপটি পরিমাপমতো খুলেন। সেখানে বাবুটিকে আবৃত করেন। শেষে শিশুটিকে মানবহৃদয়ের সত্যিকারের উষ্ণতার ওমে ছুঁয়ে দিয়ে, নিজের বাড়ির পথে ফিরে চলেন।

তখন রাত নেমেছে। রাতের প্রথম লগন। গোল থালার মতন পূর্ণ চাঁদেরকণা গ্রাস করে চলে দৃষ্টির প্রান্তসীমার এপিঠ-ওপিঠ।।

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

4 thoughts on “ওম

  1. অনূগল্পে কখনও কখনও মন ভরে না। মনে হয় আর একটু বিস্তারিত যদি পড়তে পারতাম !! এই অনুভূতিটা বেশী মনে হয় যখন সেটা মি. মামুনের লিখা হয়। :) ধন্যবাদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. কৃতজ্ঞতা ভালোবাসার মোড়কে আপনার জন্য প্রিয় ভাইয়া Smile
      পাঠক বাকীটুকু যাতে ভাবতে পারেন সেজন্যই এই অসম্পুর্ণতা।

      ভালো থাকুন সবসময়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. মানব হৃদয়ের একটু উষ্ণতা যদি পাই
    পৃথিবীর সব শীত কেটে যাবে সুখের ভেতর।
    চমৎকার অণুগল্প মিতা।
    শুভ হোক পথ চলা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।