আমাদের রানু (ছোটগল্প)

অস্থির বিকেলগুলো কাটতেই চায় না রানুর। সারাদিনে বলতে গেলে এটুকুই নিজের একান্ত সময়। বাকি সময়টা পরিবারের অন্য সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখতে ব্যয় করতে হয়। জীবন সংগ্রামে ব্যতিব্যস্ত একজন রানুর দিনের শুরু থেকে বিকেলের আগ পর্যন্ত কেটে যায় প্রচন্ড কর্মব্যস্ততায়। বাবা-মা ছোট ভাই আর এক বোনঝিকে নিয়ে ওর এই সংসার সংসার খেলা।

বড় এক ভাই আছেন। বিয়ে করে ওদের পাশেই আলাদা সংসার করছে। তাঁর এক ছেলে। তিনি নিজের সংসারের ঘানি টেনে কোনোমতে জীবন পার করছেন। চাইলেও সে বাবা-মা’র জন্য কিছু করতে পারছে না। রানুর ছোট ভাই পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক। ইন্টার পাস করে পড়ালেখাটা আর করলো না সে। রানুর চেস্টার কোনো কমতি ছিল এ কথা কেউ বলতে পারবে না। ভাইটি কুসর্গে পড়ে নেশায় আসক্ত। ইলেক্ট্রিকের কাজ শিখেছিল। জানেও ভালো। এলাকার কোথাও প্রয়োজন হলে ওর ডাক পড়ে। যা আয় হয় গাঁজার পিছনেই ব্যয় করে। উল্টা প্রতিদিন রানুকে ওর হাতখরচের টাকা দিতে হয়।

এই ভাইটির নাম আজাদ। মাস ছয়েক হলো ওর মাথায় ভুত চেপেছে বিদেশ যাবার। সে জেগে জেগে দিবা স্বপ্ন দেখে -কাড়ি কাড়ি টাকা কামাই করে দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটা বাড়ি… লেটেস্ট মডেলের একটা গাড়ি আর সুন্দরী এক নারী! এই স্বপ্নটা আজাদকে তাড়িয়ে বেড়ায়।চলাফেরায় একটা কেতাদুরস্ত ভাব বজায় রাখে। যদিও তা এলাকায় ওকে তেমন একটা হালে কল্কে পাইয়ে দিতে যথেষ্ট নয়। একজন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো নেশাখোর ইলেকট্রিশিয়ানের ইমেজ থেকে বের হয়ে আসাটা এতো সহজ হয় না। নেভি সিগ্রেট আর গাঁজার নীলচে ধোঁয়ায় বুঁদ হয়ে তবুও সে জীবনের এই প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হবার স্বপ্ন দেখে…কিন্তু ওকে ওর স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যেতে বাস্তবে কোনো ট্রেন আর আসেনা।

স্বপ্ন রানুও দেখে। কিন্তু সেখানে আজাদের মতো পরাবাস্তব বিলাসী কোনো কিছু থাকেনা। একসময় হয়তো ছিল। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা ওকে চরম বাস্তববাদী এক সংগ্রামী মেয়েতে পরিণত করেছে।বিয়ে হয়নি এখনো এখন আটাশ চলছে। গাঁয়ের রং টাও কালো। এটুকু অপুর্ণতা ছাড়া আর সবই যে কোনো মেয়ের ইর্ষার কারণ হতে পারে। একজন পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো দেহসৌষ্ঠব দিয়েছেন বিধাতা ওকে। আর এটিই ওর জন্য কাল হয়েছে। পথে ঘাটে চলতে ফিরতে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি… অশ্লীল কথাবার্তা আর আঁকারে ইঙ্গিতে নোংরা কামনার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাসায় ফিরে শাওয়ারের নীচে নিজেকে দীর্ঘক্ষণ রেখে দিয়েও দেহ-মনে লেগে থাকা কুৎসিত মুহুর্তগুলো সহজে দূর হতে চায় না। একসময় শাওয়ারের জলের সাথে নয়নের জল মিশে এক হয়ে যায়। তবুও কাটে না মনের গ্লানি!

নিজের দু’রুমের ভাড়া বাসার এক রুমে ব্যাচে ছেলেমেয়েদেরকে পড়ায়। আর সাথে এলাকার বাইরে দু’টো টিউশনি। ব্যস! এই আয় দিয়েই চলে আমাদের রানুর সংসার। ওদের আসি নিবাস ছিল ফরিদপুর। সেখানের বসতবাড়ি সহ যা কিছু সহায়-সম্পত্তি ছিল, সব বিক্রী করে সি ইসলাম্নগরে পাঁচ শতাংশ যায়গা কিনেছিলেন ওর বাবা। সে বেশ আগের কথা । তখন ওরা তিন ভাইবোন অনেক ছোট। কিন্তু ভাগ্যটা এমনই খারাপ যে, দালালদের চক্রান্তে ভুয়া দলিল সর্বস্ব সেই জমিটুকুতে কখনোই আর দখল নেয়া হয়ে উঠেনি। বছর চারেক আগে ওর বাবাও নিরবাক হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। শরীরের এক পাশ ‘প্যারালাইজড’ হয়ে গেছে। মা সারাদিন বাবা’র দেখাশোনাতেইসময় পার করেন। আর হেঁসেলের ঘানি তানেন। এই মহিলাও জীবনে এতটুকুন সুখ পেলো না। তবে সুখের সংজ্ঞা এক একজনের কাছে এক একরকম।

গরীব ঘরে জন্ম হওয়াতে বুঝতে শেখার পর থেকেই চারিদিকে শুধু নেই নেই দেখে দেখে বড় হওয়া রানু জীবনের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছে। ওরা তিনভাই-বোন যখন একেবারে ছোট তখন ওদের বাবা ফরিদপুরের পাট চুকালেন। বাবা আশরাফ হোসেন সময়ের প্রয়োজনে ‘আশরাফ কামলায়’ পরিণত হয়েছেন! এই এল্কার মানুষের জমিতে কামলার কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ক্ষেত কোপানো, বীজরোপণ থেকে শুরু করে জমির কাজ খুব ভালোই বুঝতেন। তিন সন্তানকে মানুষ করার জন্য নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলান কোদাল-নিড়ানি। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে নামের শেষে ‘কামলা’ উপাধি প্রাপ্ত হন। বড় ছেলেকে দিয়ে পড়ালেখাটা মোটেও হলো না। একসময় সে রিক্সা চালাতে শুরু করলো। তখন এই ইসলামনগরে জনবসতি খুবই কম ছিল। খালি জমি অনাবাদি অবহেলায় পড়ে থাকতো। দুই বাপ-বেটা মিলে দিনভর পরিশ্রম করে সংসারের চাকা সচল রেখেছিলো। আর রানু ছোট ভাইটিকে নিয়ে পরালেখায় মন দিয়েছে। সেই বয়সেই রানু বুঝেছিলো এই পৃথিবীতে ওকে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। তাই শত অসুবিধার ভিতরেও দু’ভাইবোন পড়ালেখা ছাড়েনি। আর মেধাবী ছিল দু’ভাইবোন। তাই ধাপে ধাপে শুধু সামনেই এগিয়েছে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়া। একটানা ইন্টার পর্যন্ত গিয়ে রানু থেমে গিয়েছিল… অবশ্য সাময়িকভাবে। ভার্সিটিতে পা দেবার আগেই ওর বাবা প্যারালাইজড হয়ে গেলেন। তারও বছরখানেক আগে বড় ভাই বিয়ে করে কাছেই আলাদা বাসা নিয়েছিলেন। একটা সোয়াটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতেন তখন। সেখানেরই এক মেয়েকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলেন। ওদের দুই রুমের বাসাটিতে আর থাকা গেলোনা। তাই বাধ্য হয়েই পাশের আর এক বাড়ির এক রুম ভাড়া নিয়ে নিজের সংসার পেতেছেন।

বাবার অসুস্থতার সময়েই অনেক কিছু একসাথে ঘটে গেলো। আজাদ তখন কেবল এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। রেজাল্টের অপেক্ষায়। আয়ের কোনো পথ নেই। তাই বাধ্য হয়ে রানু নিজের কাঁধে সংসারের জোয়াল টেনে নেয়। একই সাথে ডিগ্রীতে (পাস কোর্স) ভর্তি হয়। দু’টি বছর কি যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছে তা কেবল রানুই জানে। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে চাকরি খোঁজা শুরু করে। কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকায় তাও জুটে না। আজাদ ইন্টার পাস করে সংসারের এতো অভাব-অনটন দেখে পড়ালেখার ইতি টানে। কাজকর্মহীন হয়ে রঙিন নেশার ভিতরে সাময়িক মুক্তি খুঁজে নেয়। রানু অনেক বোঝালেও সে আর ঐ জীবন থেকে ফিরে আসেনা।

শিহাব রানুর জীবনে আসে ঠিক এই সময়টাতে। গ্রাজুয়েশন করার সময়েই কলেজে দু’জন দুজনকে জানতে শুরু করে। ভালোলাগাটা তখনো শুরু হয়নি। মধ্যবিত্ত ঘরের সুদর্শন শিহাব রানুর একজন ভালো ব্যাচমেটই ছিল কেবল। কলেজের এক শিক্ষা সফরে গিয়েই হঠাৎ করে ওরা কাছে আসে। ভালোলাগাটা তো মুহুর্তের ব্যাপার। তবে ভালোবাসা হতে সময় লাগে। রানুকে শিহাবের কেন জানি ভালো লেগে যায়। কালো এই মেয়েটির ভিতরে ঠিক কোন জিনিসটি যে শিহাবকে টেনেছিল, পরে অনেক ভেবেছে শিহাব, রানুর একহারা দেহ… প্রকৃতির অকৃপন হাতে দান করা সম্পদ নাকি ওর হৃদয়ের উষ্ণতা ওকে পাগল করেছিল- শিহাব আজও এ ব্যাপারে সিওর না। হয়তো রানুর চোখের ভিতরের এক অদৃশ্য আলোয় সে হারিয়েছিল! ওর ওপরের ঠোঁটের ‘পরে কালো তিলটি শিহাবকে হয়তো বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাতে চেয়েছে। রানু ওর সমগ্র সত্ত্বাকে জয় করে নিয়েছিলো।

কলেজ প্রাঙ্গনে এই জুটি সকলের কাছেই প্রিয় ছিল। দু’জনেই মেধাবি এবং ভালো মনের মানুষ। তাই ওদের অবাধ বিচরণ কারো কাছেই দৃষ্টিকটু লাগেনি। তবে শিহাবের পরিবার থেকেই চরম বাঁধাটা আসে। একমাত্র ছেলের পছন্দকে তাঁরা অপছন্দ না করলেও রানুর পরিবার এ ক্ষেত্রে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। দুই পরিবারের মাঝে যে সামাজিক মর্যাদার স্তরভেদ ছিল- সেটিকে চাইলেও শিহাবের পরিবারের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হল না।

এক বর্ষনমুখর বিকেলে শিহাব থেকে রানু বিচ্ছিন্ন হল।
সেদিন একটি নির্জন যাত্রী ছাউনিতে ওরা দু’জন।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি…
দমকা বাতাসে নুয়ে পড়া গাছগুলোর যন্ত্রনাক্লিষ্ট বোবা অনুভূতি দেখতে দেখতে দু’টি ভিন্ন হৃদয়ের পাশাপাশি অবস্থান! কাছে থেকেও যেন যোজন দূরত্ব!
বাহিরে ঝড়…
রানু আর শিহাবের হৃদয়েও সেই ঝড়ের থেকেও বড় এক তুফান বয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ চমকের ক্ষণিকের আলোয় বিসন্ন বসনে তির তির করে কেঁপে উঠা রানুকে শিহাবের চোখে শরীরহীন এক মায়াবিনী মনে হচ্ছিলো… যে কিনা অনন্তলোকের সব রহস্যকে সাথে নিয়ে মৌন হয়ে শিহাবের কাছ থেকে একটি কথা শুনতে আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

শিহাবের কথায় সেদিন রানু শুধু তাকিয়েছিল। শিহাব বলেছিল, ‘ আমার ভালবাসার কি কোনোই মূল্য নেই!’ রানু জবাব দেয়, ‘ থাকবে না কেন? আছে… তবে ভালোই যখন বাসলে- শর্ত দিচ্ছ কেন?’ শিহাব অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘ আরো একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবে?’ এ কথায় বিষন্ন হাসিতে রানুকে পৃথিবীর একমাত্র রুপসী মেয়ের মতো লাগে শিহাবের কাছে। ওর বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠে। রানুর ওকে বলা শেষ কথাটি ওর ভালবাসার তাসের ঘরকে মুহুর্তেই গুড়িয়ে দেয়। আর রানু নিজের দুটো হাতকে আড়াআড়ি বুকের উপর চেপে ধরে বলে, ‘ আমার অসহায় পরিবার আমার দিকে চেয়ে আছে। এ অবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে ভালবাসার হাত ধরে সামনে আগানো আমার পক্ষে সম্ভব না। স্যরি… যদি কোনোদিন শর্তহীন ভালোবাসতে পারো, আমায় ডেকো। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য!’

প্রচণ্ড বৃষ্টিতে নির্জন এক যাত্রী ছাউনির নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে দু’জন নারী-পুরুষ ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এক পথে পা বাঁড়ায়। তবে দুজনের পথ দু’দিকে…

আজাদই প্রথম লিয়াকতকে সাথে নিয়ে বাসায় এসেছিল। দুই ছেলের বাবা এই মধ্যবয়স্ক লোকটিও বেশ সুদর্শন। আদম ব্যবসা করে বেশ তাকা-পয়সা করেছে। এখন ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা পর্যায়ের একটা ভাইতাল পোষ্ট দখল করে আছে। কয়েকটি বাড়ি আছে। এলাকায় বেশ প্রভাব নিয়ে চলাফেরা করে সে। রানু আগেও তাঁকে বেশ ক’বার হোন্ডায় চলাফেরা করতে দেখেছে। তবে কখনো আলাপ হয়নি। এর সব কিছুই ভালো। তবে চোখদুতো খুবই খারাপ লাগলো রানুর কাছে। সেদিন রানুর বাসায় পরিচয়ের শুরুতেই লোকটি তাঁর দৃষ্টি দিয়ে রানুকে যেন নগ্ন করে ফেলতে চাইছিলো।ওর দেহের প্রতিটি বাঁকে তাঁর চোখের অদৃশ্য জিহ্বার স্পর্শ অনুভব করে করে রানু শিউরে উঠছিল। তবুও ভদ্রতার খাতিরে লোকটির সাথে বেশ সময় নিয়ে কথা বলে… চা করে দেয়। চায়ের কাপ নেবার সময়ে ইচ্ছে করে সে রানুর হাতের স্পর্শ পেতে দীর্ঘসময় লাগিয়েছিল। প্রথম দেখায় রানু বুঝেছিল এই লোক তাঁর জন্য সর্বনাশের জাল বিছিয়ে ওকে গ্রাস করার জন্যই এসেছে।

তখন ইরাকে বাংলাদেশীদের জন্য শ্রমবাজার বেশ লোভনীয় ছিল। একটি হ্যান্ডসাম স্যালারির জব রয়েছে এই লোকের কাছে। আজাদ জীবনে ওর আশার পথে শেষ ভরসা দেখতে পায় এই লিয়াকতের ভিতর। বোনকে বলেও সে কথা। কিন্তু সেখানে যাবার জন্য যে পরিমান টাকার প্রয়োজন, এই মুহুর্তে রানু তা কীভাবে জোগাড় করবে? ভেবে ভেবে রানু যখন দিশেহারা, সেই সময়ে একদিন লিয়াকত আসে। অযাচিতভাবে সাহায্যের হাত বাড়ায়। আজাদকে ইরাক পাঠানোর সব ব্যবস্থা-ই সে করে দেবে জানালো। সেখানে যেয়ে মাসে মাসে তাঁর টাকা শোধ দিলেই হবে।

প্রথমটায় বিষ্ময়ে হতবাক রানু ভাবে লোকতা হয়তো চরম একটা রসিকতা করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সে যখন তাঁর য়ারো একটা শর্তের কথা জানালো- রানু প্রথমটায় অবাক হলো… পরে দুঃখে হৃদয়টা চুর চুর হয়ে গেলো… এরপর অধরের কোনে ম্লান হাসিটুকু ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। দু’জন পুরুষ সম্পুর্ণ ভিন্ন রকম দু’টি শর্ত রানুকে কাছে পেতে চাইলো! একজন দিয়েছিল দেহহীন ভালোবাসা পাবার জন্য। আর দ্বিতীয়জন শর্ত দিলো ভালোবাসাহীন দেহ লাভে উন্মুখ হয়ে।

প্রথমটায় রানুর লোকটিকে আচরে খামছে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু পরক্ষনেই ওর চোখের ভিতরের সকল আলো নিভে গেলো। প্রতিবাদী রানু মুহুর্তেই বিবশ রানুতে পরিণত হতে বাধ্য হলো। ওর বিবশ সেই চোখে ভাসছিলো চিকিৎসার অভাবে শুয়ে থাকা প্যারালাইজড এক বাবা… অসহায় এক মা… নেশাসক্ত এক ছোট ভাই যে জীবনকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে দিরিয়ে এনে জীবনের গান গাইতে চাইছে… পরিবারের জন্য বেঁচে থেকে হৃদয়ের গহীনে আজন্ম লালিত এক স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছে- এদের সকলের আকূতি এক নিমিষে রানুর চোখে ভেসে উঠলো। সে এসব কিছু ভেবে বারবার জীবনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই পর্যন্ত টিকে থাকার যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিল- তাঁকে নিজের পায়ে মাড়িয়ে লিয়াকতকে নিয়ে অদের দুই রুমের ভারা বাসাটির ওর নিজের ভূবনটিতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে।

সেই-ই রানুর পতনের শুরু। তবে একটি অন্ধকার টানেলে নিমজ্জিত হবার আগ মুহুর্তে সে নিজের এক সময়ের ভালবাসার মানুষটিকে তুলে নিয়ে আসে। লিয়াকতের ভিতরে একজন শিহাব প্রবেশ করে… আর সেই শিহাবের কাছে আমাদের রানু ভালবাসার রঙিন চাদরে ফুল তুলতে উন্মুখ হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয়… বার বার… হাজার বার!
…… …… ……

অস্থির সেই বিকেল শেষ হবার পথে। রানুর বাসার সামনে একটি মটবাইক থেমে যাবার আগে দু’বার হুরণ দেয়। এই শব্দ রানুকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। লিয়াকত এসেছে। একটু পরেই নামবে সন্ধ্যা। রোজই সে এই সময়ে আসে। এই বাইকের হর্ণের শব্দ রানুর ভিতরে শিহাবকে অটোমেটিক নিয়ে আসে। হাসিমুখে রানু দরোজা খুলে দেয়। মা’র নির্বাক দৃষ্টির সামনে লিয়াকতে রুপান্তরিত শিহাব আর রানু পাশের রুমটিতে অদৃশ্য হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ে থাকা ছাড়া মায়ের আর করার কিছুই থাকেনা। সময় যে অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। সংসারে এখন সমৃদ্ধি এসেছে। তবে সুখ এসেছে কি?

তবে সব থেকে বড় ক্ষতিটা হয়েছে… তাঁরা তাঁদের রানুকে হারিয়েছে। সবার জন্য বাঁচতে গিয়ে একজন রানুর আর নিজের জন্য বাঁচা হলো না! রানুরা চীরকালই আমাদের। ওরা কখনোই নিজের হতে পারে না।।

#আমাদের_রানু_ছোটগল্প
—————————————
ফটো কার্টেসীঃ ভালবাসার কবিতা

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

2 thoughts on “আমাদের রানু (ছোটগল্প)

  1. অসাধারণ আপনার লিখন মি. মামুন। ভালো লাগে। :)

  2. আমি আপনার লেখার এক মুগ্ধ ভক্ত বনে গেছি মামুন ভাই। ধন্যবাদ এখানে খুবই নগন্য।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।