আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

আয়না

বিধ্বস্ত আয়নায় প্রতিচ্ছবি
দেখে নিজেকে চিনতে পারছি না
আয়নার ওপারে যে মুখ
আমি নই, তবে মায়া জাগ্রত হচ্ছে।

এমন পরাজিত মুখাবয়ব জীবনে
অবলোকন করিনি। চোখে হতাশার
দীঘি। জীবনের ঘাটে পরাভূত,
জীবনের ভারে মুষড়ে পড়েছে।

বইবার ক্ষমতা তার ফুরিয়েছে,
শুধু শোয়ে থাকা বাকী।
আয়না বিধ্বস্ত নয়, বিধ্বস্ত
আমি, দীর্ঘ ঘুমের আগে …

জীবনের অসারতা যাচাই করতে
ক্ষণিকের আয়না বিলাস।

মায়া_নিম্নশ্রেণী

কুকুরের সাথে আমার আলগা খাতির নাই, পছন্দ করি না আবার অপছন্দ করি না। তবে কুকুর দেখলে পাড়তপক্ষে এড়িয়ে যাই, নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীদের বিশ্বাস করতে নাই, কখন দৌড়ে এসে কামড়ে দেয়। পাড়ার চায়ের দোকানে তেমন যাওয়া হয় না। দোকান ঘিরে অকর্মা, অলসদের আড্ডা। চব্বিশ ঘন্টাই চলতে থাকে, অহেতুক সময় নষ্ট করার সময় আমার নাই। আরেকটা কারণ একটা কুকুর দোকানের আশেপাশে বসে থাকে।

অনেকদিন আগে কি এক কারণে চায়ের দোকানে গেছি, মফিজ চা দিয়েছে। বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছি হঠাৎ কুকুর হাজির, এসেই আমার পা শুঁকা শুরু। আমি ভয়ে শেষ। পা দুটো বেঞ্চে উঠিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছি। আমি ভয় পাচ্ছি দেখে মফিজ দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে গেলে আমি বললাম তাড়াতে হবে না এক টুকরো বিস্কিট দিয়ে দেখ।

মফিজ বিস্কিট আমার হাতে দিলে আমি একটু দূরে ছুড়ে দিলাম। পা শুঁকা ছেড়ে কুকুর বিস্কিটে মনোযোগ দিলে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর থেকে এই কুকুর আমাকে দেখলেই দৌড়ে আসে, পাড়ার মোড় থেকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়। যদিও আমার পিছন পিছন হাঁটে তবু আমি ভয়ে থাকি, স্বস্তি পাই না। যদি কোন কারণে চায়ের দোকানে যাওয়া হয়, গিজগিজ লোকের মাঝে আমাকে ঠিক চিনে নেয়। হয়তো একটু দূরে শোয়ে আছে আমাকে দেখা মাত্রই দৌড়ে আসে। তার এই আগলা প্রেম আমার পছন্দ হয় না, অস্বস্তি বোধ করি তবু এড়াতে পারিনা। পাড়ায় সবাই এখন এই কুকুর কে আমার কুকুর হিসাবে চিনে, আবুলের কুকুর। ফাজিল দুয়েকজন আড়ালে আমার নাম ধরে কুকুর কে ডাকে, আবুল নাম শুনে কুকুর তাকায় ঠিকই কিন্তু সাড়া দেয় না।
সেদিন কি কারণে চায়ের দোকানে গেছি। তুমুল আড্ডা চলছে, চা চলছে, চলছে বিস্কিট। পুবের বাসার মোখলেস চায়ে টোস্ট ভিজাতে গিয়ে বেখেয়ালে মাটি ফেলে দেয়, মাটি থেকে উঠাতে গিয়ে দূরে কুকুর কে দেখে টোস্ট ছুড়ে মারে। বলে ‘নেরে আবুল এটা তোর ভাগের বিস্কিট।’

মোখলেসের পিছনে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সরাসরি অপমান সহ্য না হওয়ার তুমুল ঝগড়া বাধে। ঝগড়া যখন হাতাহাতির পর্যায়ে হঠাৎ কুকুর আমাদের দিকে দৌড়ে আসে কেউ কিছু বুঝার আগেই মোখলেসের পায়ে কামড়। তারপর দৌড়ে পালায়।

মোখলেস ঝগড়ায় ক্ষান্ত দিয়ে বাবাগো, মাগো বলে লাফাতে থাকে। কুকুরের কামড়ে তার মরণ অবস্থা হয়। আটাশ দিন হাসপাতাল থাকতে হয়, যখন ফিরে তার চেহারা দেখে মায়া জাগে।
মোখলেস কে কামড়ানোর রাতেই আবুলের কুকুর বন্দি হয়। লাওয়ারিশ কুকুরকে বাড়তে দিলে কামড়াতেই থাকবে এই ভেবে বিনাশই সঠিক সিদ্ধান্ত। কুকুর কে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়, তার মৃত্যুর খবরে কারো কোন ভাবান্তর হয় না, কেউ কোন মায়া অনুভব করে না। আমিও কোন মায়া অনুভব করি না।

জীবন

প্রতিটি ভাঙনের পরে সূর্য দেখি
প্রতিটি প্রলয়ের পরে প্রদীপ
বারবার আঘাত সয়ে চলেছি
আমাকে ভেঙ্গে ফেলবে, এত সহজ!
ঝড়ে হয়তো মুষড়ে যাব
পুনরায় দাঁড়াতে পারবো না, ভুল!
পরাজয় প্রতি পদে ডেকে যায়
জয়ের কাঙ্ক্ষা তবু ছাড়ি না।
তোমার পায়ের জুতোর ধার পরখ
করেছি, লাথি খেয়ে ছিটকে পড়েছি
দূরে। উঠে দাঁড়ালে পুনরায়
লাথি। মনের বারুদ তবু জ্বলে।
বারবার পরাজিত হই, বারবার
অপমানিত। জীবনের পিছু তবু ছাড়ব না।

যাবজ্জীবন

আড়াই দিনের বৈরাগ্য শেষে
যখন ফিরে এলাম
গ্রাম ভেঙ্গে পড়ল আমার উঠোনে।
অবজ্ঞা, টিটকারি, বিদ্রূপ
মনে হল পুনরায় ফুড়ুৎ করে উড়ি।
উঠানের ওপর পারে উদ্বিগ্ন মুখ
সব সহ্য করতে প্ররোচনা দিল।

আরও আড়াই দিন পরে
উদ্বিগ্ন মুখে হাসি ফুটল,
বৈরাগ্য উধাও। সংসার ধর্মের প্রতি
অনীহা ছিল, এই আমি ঘোর সংসারী।
উঠানের ওপর পারের যে মেয়েটি
একদিন গলা চেপে ধরেছিল
প্রতিদিন তার গলায় ফাঁস লাগাই,
আমার যাবজ্জীবন ফাঁসি হয়েছে।

আমার_গরিমা

একদিন ঘুমিয়ে পড়বো, মুঠো মুঠো
মাটি ঢেকে দিবে আমার লজ্জা।

আমি কী লজ্জিত ছিলাম? পায়ের
জুতা কী অকারণে আঘাত করেছে?

আমার গরিমায় বিব্রত বাতাস কী
নালিশ জানিয়েছিল?

নিজেকে উঁচু ভাবতাম, নিম্ন জাতদের
সবসময় এড়িয়ে গেছি। আমার
পায়ের কাছে বসে থাকা কুকুরের
অবয়বে মানুষ দেখছি। অথবা মানুষের
অবয়বে কুকুর রুটির আশায়
পায়ের কাছে এসে বসে থেকেছে।

আমি চিরকাল কুকুরদের তাচ্ছিল্য
করে গেছি, তাচ্ছিল্য করেছি মানুষকে।

গতকাল কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম
কয়েকটি কুকুর সদ্য খোঁড়া কবর
থেকে লাশ টেনে বের করে কামড়ে
খাচ্ছিল। ভাল করে চেয়ে দেখলাম
লাশটি আমার। কুকুরের মুখের দিকে
তাকিয়ে নিজেকেই দেখছিলাম।

কবরের মাটি আমাকে নিরাপদ রাখতে
পারে নি, আমার নগ্ন লজ্জা
উন্মুক্ত করছে কুকুর। কুকুরের পায়ের
নীচে পিষ্ট আমার গরিমা।

কবিতা_যাপন

গাছের একটি পাতা হালকা বাতাসে
তিরতির করে কাঁপছে
পাতার কম্পনে আমি কবিতা দেখি।

বহু পথ অতিক্রম করে পাহাড়ি ঝর্ণা
ছুটছে সমুদ্রের টানে
ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে আমি কবিতা দেখি।

নুয়ে পড়া লেবুর গাছে ধ্যানী মাছরাঙা
টুপ করে ডুবে যায় জলে
মাছরাঙার ঠোঁটের মাছে আমি কবিতা দেখি।

ক্লান্ত দুপুরে মায়ের কোলে ঘুমন্ত শিশু
মায়ের ঘুম ঘুম চোখ
মায়ের অলস ঘুমে আমি কবিতা দেখি।

জানালায় পর্দায় লাজুক কিশোরী, ওপাশে
নম্র কিশোর
বয়ো-সন্ধি ভালবাসায় আমি কবিতা দেখি।

মসজিদের চাপকলে তৃষার্ত পথিক
আঁজলা আঁজলা জল
তার পরিতৃপ্ত মুখে আমি কবিতা দেখি।

ইটের ঝাকা বয়ে পরিশ্রান্ত শ্রমিকের
দুদণ্ড অবসর
শ্রমিকের গুড়-রুটিতে আমি কবিতা দেখি।

হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া তরুণীর
বিব্রত ঠোঁটের হাসি
চোখের অনাবিল আনন্দে আমি কবিতা দেখি।

পাতাকুড়ুনির ফোকলা দাঁতে রোদের ঝিলিক
তুলতুলে গাল
আগুন পোহানো ভোরে আমি কবিতা দেখি।

মাটির সমীহে হাঁটা নুজ্জ্ব বয়োবৃদ্ধ দাদা
তার হাতের লাটি
দাদার পায়ের ছাপে আমি কবিতা দেখি।

পিতার কনিষ্ঠ আঙুল ছেড়ে ছুটে যাওয়া শিশু
মায়ার উদ্বিগ্ন চোখ
বুকের তোলপাড়ে আমি কবিতা দেখি।

দমকা বাতাসে সরে যাওয়া সহপাঠিনীর ওড়না
সহপাঠীর নত মুখ
পারস্পরিক বিশ্বাসে আমি কবিতা দেখি।

ভিখারির থালায় চকচকে নোটের ঝিলিক
ভুবন বিজয়ী হাসি
তার আশ্বস্ত মুখে আমি কবিতা দেখি।

শীতে ফেটে যাওয়া চামড়ায় আগুনের তাপ
খড়কুটোয় মেলে দেয়া হাত
শীতার্থ মানুষের ওমে আমি কবিতা দেখি।

উঠোনের বাঁশঝাড় বেয়ে ওঠা পানের বরজ
বাহারি মশলার পানদান
দাদীর লাল ঠোঁটে আমি কবিতা দেখি।

পুকুরের মাছের ঘাই ধ্যাননেত্র শিকারি
বড়শিতে পুঁটিমাছ
ধনেপাতা তরকারিতে আমি কবিতা দেখি।

মসজিদের লাগোয়া মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি
টুপি, পৈতার প্রার্থনা
ধর্মের সম্প্রীতিতে আমি কবিতা দেখি।

বেদনায় কাতরাতে থাকা মানুষের পাশে
সহমর্মি মানুষের হাত
মানুষের মানবিক কর্মে আমি কবিতা দেখি।

আমার কবিতা যাপন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ
মানুষের চোখ, মুখ, শ্বাস
মাঠের অবারিত সবুজ
আমার প্রতিদিনের কবিতা, প্রতিক্ষণের কবিতা।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪৬

দীর্ঘদিন ঘরে আলো ঢুকে না
দীর্ঘদিন কপাটের ওপারে কী
আছে দেখা হয় না।
শুনেছিলাম করোনার তাণ্ডবে
মানুষ মরে যাচ্ছে, বিশ্বাস হয় নি
ওমন হয় নাকি!

বুকের বোতাম খুলে সদর্পে ঘুরে
বেরিয়েছি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, থোড়াই
কেয়ার করেছি করোনা।
করোনা গিমিক মিথ্যা প্রমাণ করতে
কোন কসুর রাখিনি। নিজে আক্রান্ত
হই নি, করোনা মিথ্যা।

করোনার অস্তিত্ব ভুলতে বসেছিলাম।
অন্যের করোনাক্রান্ত খবরে অবহেলার
হাসি হেসেছিলাম।
সবকিছু নিজের মত চলছিল, অস্বীকার
তত্ত্বে নিজেকে নিরাপদ ভেবে আত্মতৃপ্তির
পরিধি বর্ধিত করেছিলাম।

নিজে নিরাপদ ছিলাম ঠিকই, শ্বাসের কষ্টে
বুক চুপসে গেলে সামান্য অক্সিজেনের
জন্য হাঁসফাঁস করতে হয় নি।
আমার অস্বীকারে করোনা থেমে থাকে নি
তার দর্প ঠিকই দেখিয়ে দিয়েছে, হারিয়েছি
প্রিয় পিতাকে, মমতাময়ী মাতাকে।

তাদের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে আমি দায়ী
করোনা আমিই বহন করে নিয়ে গেছি, করোনা
তাচ্ছিল্য আমাকে ক্ষমা করে নি।
দীর্ঘদিন কপাট খুলিনি, আলোর খবর জানি না
দীর্ঘদিন। করোনা সত্য, অনেক মূল্য দিয়ে
উপলব্ধি করতে পেরেছি।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪৮

এখন বেশি বেশি করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা
এখন হাতে হাত ধরে টেনে তোলার কথা
এখন তাদের কান্নায় হাউমাউ করে কান্নার কথা
তাদের বেদনায় বেদনার্ত হওয়ার কথা।
এখন মানুষের পাশে যাওয়া বারণ
এখন মানুষ থেকে ছয় ফুট দূরত্বে থাকতে হয়
এখন শুধুই গোমর কান্না
এখন বেদনায় নীল হয়ে বসে থাকা।
এখন সময় মানুষের নয়
এখন মানুষ সময়ের নয়।
অদৃশ্য ঘাতক মানুষ মেরে ফেলছে
মানুষের চোখের সামনে মানুষ মরে যাচ্ছে
মানুষ আজ অসহায়
মানুষ আজ অসহায়।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪৭

জামাকাপড়ে জং লেগে যাচ্ছে
হাওয়াই ফিনফিনে সার্টে কতদিন
লাগেনি হাওয়া, অলস সময়ের ঘেরে
মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

নিরানন্দ ভবে আনন্দ আশ্রম ফিরবে
কী কোনদিন! মহামুক্ত আকাশে পাখির
স্বাধীনতায় মানুষ কী আর ঈর্ষিত হবে।
নাকি থেকে যাবে গহ্বরের অতল অন্ধকার!

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪৫

আমাদের প্রতিটি গল্প
সমান্তরাল ছাঁচে রূপ নিচ্ছে,
প্রতিটি পদক্ষেপ ঘুরে ঘুরে ফিরছে
এক অভিমুখে। প্রতিটি বাক্য শেষ পর্যন্ত
করোনায় মিলিত হচ্ছে, প্রতিটি শ্বাস
ধাবিত হচ্ছে কৃত্রিম যন্ত্রে।
আমাদের প্রতিদিন লাশ গুনতিতে
ব্যয় হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ছুটে যাচ্ছে
কোন প্রিয় হাত। রাতের অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে
আমাদের প্রতিটি ভোর।
তিরোহিত হয়েছে জগতের সমস্ত আলো।
আমাদের উচ্ছল সময়ে শুধুই নীরবতা।
আমাদের জনপদ গা ছমছম করা কবর।
আমাদের কবরে দীর্ঘ লাশের সারি
আমরাও অপেক্ষমাণ
দীর্ঘ ঘুমের আয়োজনে।

করোনা_এবং_বিলেতের_বাঙালি

বিলেতের বাঙালিরা ভয়ে আছে, প্রতি মুহূর্তের আতঙ্কে তাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন ব্যাহত হচ্ছে। বিলেতের বাঙালি আজ বিপর্যস্ত। দেখে মনে হচ্ছে করোনা বেছে বেছে শুধু বাঙালিকেই আক্রমণ করছে। বিলেতের বাঙালি সমাজে করোনামৃত প্রায় ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি বাঙালির ঘরে এক বা একাধিক করোনা আক্রান্ত, প্রতিটি বাঙালির এক বা একাধিক আত্মীয় করোনার সাথে যুদ্ধ করছে।

বিলেতের বাঙালির জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ সময় পূর্বে আসেনি, এত অসহায় কোনদিন বোধ করেনি। বাঙালি আড্ডাবাজ এবং অতিথি পরায়ণ। দুদিন বন্ধুর মুখ না দেখলে বাঙালি পাগল হয়ে যায়, পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সাপ্তাহে একদিন আহার না করলে বাঙালির সাপ্তাহ পরিপূর্ণ হয়না।

আজ প্রায় প্রতিটি বাঙালির ঘরে কবরের নীরবতা। মানুষের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেছে। ভাইয়ের ঘরে ভাই, পুত্রের ঘরে পিতার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবেশী প্রতিবেশীর দরজায় টোকা দিতে ভুলে গেছে। রাস্তায় দেখা হওয়া শুভেচ্ছা সম্ভাষণ জানানো অতীতের অংশ হয়ে গেছে।

বিলেতের বাঙালি বর্ধিত ঘরের মতো ছিল, যৌথ পরিবারের আমেজে বসবাস করত। একে অন্যের বিপদে দৌড়ে ছুটে যেতে বাঙালির বিকল্প ছিল না। বাঙালি এতদিন হাত ধরাধরি করে চলেছে, একে অন্যের প্রতি ভরসার হাত বাড়িয়েছে। বাঙালি কখনো বাঙালিকে ভুলে যায়নি।

কিন্তু আজ প্রতিটি বাঙালির চোখেমুখে হতাশা। বন্ধুর বিপদে বন্ধু দৌড়ে যেতে পারছে না, অসুস্থ বন্ধুর মাথায় ছোঁয়াতে পারছেনা ভরসার হাত। হাসপাতালের কৃত্রিম যন্ত্রে যে বৃদ্ধ পিতা শেষ শ্বাস ফেলে অসাড় হয়ে আছে, তার কাছে পৌঁছাতে পারছে না অক্ষম পুত্র। করোনা যুদ্ধে পরাস্ত বৃদ্ধ মাতা শেষ মুহূর্তে এক চামচ জল চেয়েছিল, তার জলের আশা অপূর্ন থেকে গেছে।

একাকী মৃত্যু যে কত বেদনার বাঙালি উপলব্ধি করতে পারছে। পিতামাতার মৃত্যুর পাশে সন্তান থাকতে পারছে না। অসহায় পিতার ঘাড়ে পুনরায় চাপছে সন্তানের লাশ কিন্তু সঠিক সৎকার করতে পারছে না পিতা। শেষ মুহূর্তে প্রিয়জন কে ছুঁয়ে দেখার আকুতি জীবিত কে মৃত্যুর স্বাদ দিচ্ছে।

করোনা মহামারী বাঙালিকে ব্যাপকভাবে জানান দিচ্ছে। মৃত্যুর এমন সুনামি এর আগে অবলোকন করে নি। করোনা যেন বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর।

বাঙালি অন্ধকার রাত পাড়ি দিচ্ছে, ভোর হয়তো হবে। ভোরের আকাশে সূর্য হয়তো দেখা দিবে কিন্তু সে ভোর কতটুকু প্রত্যাশার হবে জানি না। তবু ভোরের আশায় থাকবো, পুনরায় শুরু করার স্পৃহা নিয়ে উঠে দাঁড়াবো।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪৪

শ্বাসের কষ্ট, জ্বরের প্রকোপ
বেড়ে যাওয়ায় তাকে যখন
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল
শেষ মুহূর্তে হাত ধরেছিলাম
কম্পিত ঠোটে আঙুল ছুঁইয়েছিলাম
চোখের কোনে অশ্রু উদয় হলে
নিরব টিস্যু দিয়ে মুছেছিলাম।
রাতের নিস্তব্ধতায় সাইরেন বাজিয়ে
অ্যাম্বুলেন্স ছুটে গিয়েছিল
দরজার কপাট ধরে অপলক
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।

মানুষের অসহায়ত্বে মানুষ এসে দাঁড়ায়
এতদিন তাই জেনে এসেছি
এই মহামারী ভিন্ন শিক্ষা দিচ্ছে
ছ’ফুটের দূরত্বে দাঁড়াতেও
ভয় পাচ্ছে মানুষ, হঠাৎ বেখেয়ালে
দূরত্ব কমে গেলে ভূত গ্রস্থের মত
পালিয়ে যাচ্ছে মানুষ।
অ্যাম্বুলেন্স চলে গেলে একাকীত্ব
আঘাত করতে থাকলো
বাইরে সুনসান নীরবতা, ঘরে করোনাক্রান্ত
নিজের শ্বাসের শব্দে উদ্বিগ্ন।
হয়তো এ যাত্রা বেঁচে যাব
পরাস্ত হতে হতে জীবনকে আঁকড়ে ধরে
দ্বিতীয় জন্মের পথে হয়তো হাঁটতে পারব।

তাকে ফিরিয়ে দিতে ফিরবে না অ্যাম্বুলেন্স,
যুদ্ধে সে পরাস্ত, কৃত্তিম যন্ত্রের আয়ু ফুরিয়েছে
কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে অন্য কোন আয়ুর
বর্ধিতাংশ হিসাবে কাজ করবে।
নিরব টিস্যু চোখের জল আটকাতে পারছে না
ভাবছি পৃথিবীতে মানুষ কি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে
যদিও থাকে চোখের জলের বন্যায়
তারাওতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪৩

ক্রমেই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছি
দুদণ্ড আগেও সরব ছিলাম
প্রাণের আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে
আঘাত করতো প্রাণে
এখন সেখানে শুধুই স্তব্ধতা।
উচ্ছল, উজ্জ্বল, নন্দিত
জীবন হঠাৎ থমকে যাচ্ছে,
ব্যতিব্যস্ত পথের মাঝে
নেমে আসছে আঁধার। রোদের
দুপুর ছেয়ে যাচ্ছে কালো মেঘে।
একটু আগেও বেঁচে ছিলাম
হৃৎপিণ্ডে সুন্দরের আকুতি ছিল।
ফুলের বাগানে ফুটবে সুরের ফুল
সুগন্ধ আর নাকে পৌঁছাবে না
কোন সুর তুলবে না তান।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪২

ঘিরে ফেলছে, এতদিন ভালো ছিলাম
ঘাতক দূরে রাখতে পেরেছিলাম
মনে হচ্ছে আর সম্ভব না, পালানোর সব পথে
দাঁড়িয়ে আছে অদৃশ্য ঘাতক।
পাশের ঘরের মুরুব্বী, চাচা সম্পর্কীয়
সব সতর্কতার পরেও আক্রান্ত।
সম্মুখের ঘরের উৎফুল্ল ভাবী
প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর, অদৃশ্য ঘাতক তাকেও
মায়া দেখায় নি।
নিরাপদ থাকার প্রচেষ্টা সংকুচিত হচ্ছে
অদৃশ্য ঘাতকের সাঁড়াশি আক্রমণে
ওষ্ঠাগত মানুষের প্রাণ।
এতদিন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলাম
আর কি সম্ভব হবে! অষ্টবাহুর অক্টোপাস
সমস্ত শক্তি নিয়ে চেপে ধরছে।
অদৃশ্য শত্রু অতীব শক্তিশালী
শেষ পর্যন্ত তার পাঞ্জা থেকে হয়তো
বাঁচতে পারব না, তবু বিনা যুদ্ধে
জয়ী হতে দেব না, মানুষের মর্যাদা
সমুন্নত রাখতে শেষ শ্বাস পর্যন্ত হার মানবো না।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪০

অন্ধকার সময় সম্পর্কে আন্দাজ ছিল, ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ, মহামারী অনেক পড়েছি। পড়ে ধারণা হয়েছিল অন্ধকার সময় এমন হয়, কিন্তু সত্যিকার অন্ধকারের মুখোমুখি হয়ে ইতিহাসের অন্ধকার সময়কে রূপকথা মনে হচ্ছে।

বিশ্বাস করুন এর চেয়ে অন্ধকার পৃথিবীতে আগে আসেনি। মৃতের বিছানার পাশে কেউ নাই। মৃতের শেষকৃত্যে কেউ নাই। চিতা একা একা জ্বলে যাচ্ছে, কেউ নাই শেষ মুহূর্তে এক মুঠো ধূপ ছুড়ে দেবে।

ভোরের সূর্য প্রতিদিন পুবাকাশে উঁকি দিচ্ছে ঠিকই আকাশের অন্ধকার কিন্তু তিরোহিত হচ্ছে না, মানুষ ভুলে গেছে সূর্যের সখ্যতা। ঘরের দরজা খুলতে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে মানুষ, ঘরের জানালায় পড়েছে চিরস্থায়ী খিল।

অপেক্ষায় মানুষের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স, কবর খুঁড়তে খুঁড়তে ক্লান্ত গোরখাদক। কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গেছে চোখের জল, স্বজনের বেদনায় বুকের পাথরের ওজন ক্রমেই ভারি হচ্ছে। অদৃশ্য শত্রু করোনা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে পরিচিত জনপদ। মানুষের দূরত্ব ছ’ফুট ছাড়িয়ে ছ’শ ফুটের অধিক হয়ে গেছে। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। জন্মদাতা পিতা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, সন্তান মৃত্যু পথযাত্রী পিতার মুখে এক ফোটা জল ঢেলে দিতে ভয় পাচ্ছে। মমতাময়ী মায়ের হাত কাঁপছে, জ্বরে কাবু সন্তানের কপালে জলপট্টি দিতে গিয়ে ভয়ে শিউরে উঠছে।

মানুষ প্রাণপণে সাঁতরাচ্ছে, অন্ধকার জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে মানুষ তলিয়ে যাচ্ছে। মানুষ সুরঙ্গ খুঁড়ছে, আলোর প্রত্যাশী মানুষ সুরঙ্গের অন্ধকারে লাশ হচ্ছে। তাদের প্রাণের আকুতি কেউ শুনতে পারছে না, শুনলেও আলো হাতে কেউ এগিয়ে আসছে না।

ইতিহাসে অন্ধকার থাকে, ইতিহাসের অন্ধকার পড়ে মানুষ ব্যথিত হয় কিন্তু বাস্তবের অন্ধকারে ব্যথা, বেদনা থাকে না, থাকে হাজার, লক্ষ লাশের সারি। মানুষের লাশে চাপা পড়ে আছি, কে সরাবে লাশ! কে উদ্ধার করবে!