আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৪১

রাতের করুণ আলোয়
হুইসেল বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে
অ্যাম্বুলেন্স। স্ট্রেচারে শোয়ে আছে পিতা।

ঘরে বিমূঢ় পুত্র, কন্যা।
পাশের কামরায় সহধর্মিণী
আঁচল মুছছে চৌত্রিশ বছরের
দাম্পত্যের স্মৃতি। পজিটিভ সন্দেহে
দূরে দূরে থেকেছে স্ত্রী, কন্যা, পুত্র।

নিজ বাড়িতে অস্পৃশ্য আসামি। পায়নি
মায়ার পরশ। একাকী সময়ে বুকের
ধড়ফড়ানি বেড়ে গেলে
পাশের কামরা থেকে ছুটে আসেনি
কেউ। দরজার খিল খুলে
কেউ বলেনি দুদণ্ড উপশম কথা।

শুশ্রূষার মানসে যদিও তারা ভিড়তে চেয়েছে,
কপালে ছোঁয়াতে চেয়েছে মমতার হাত।
অক্ষম পিতার ভরসার লাঠি
হতে দৌড়ে যেতে চেয়েছে পুত্র।

আদরের কন্যা কষ্টে
চুপসানো জনকের বুকে দিতে চেয়েছে
মায়ার মালিশ। অর্ধাঙ্গিনী পূর্ণ
অঙ্গের বিনিময়ে স্বামী কে
সুস্থ করতে চেয়েছে। পারেনি,
অদৃশ্য ঘাতক প্রবল বিক্রম নিয়ে
বাধা দিয়েছে। পাশাপাশি কামরার
দেয়াল ভেদ করে তারা পৌঁছাতে পারেনি।

করোনার দেয়ালে মাথা ঠুকে মরে
গেছে মায়া। মরে গেছে মমতা।
করোনার দাপটে চুপসে গেছে
দুর্জয় সাহস। তারুণ্যের প্রতিবাদী
মন করোনার ছোবলে ক্ষয়ে গেছে।
পুত্র পিতা থেকে দূরে সরে গেছে,
দূরে সরে গেছে আদরের কন্যা।

সহমরণের প্রতিজ্ঞায় যে নারী ঘর
বেধেছিল, কুঁকড়ে যাওয়া ভয়
প্রতিজ্ঞার চিতায় পুড়েছে।
অসহায় অর্ধাঙ্গিনী গুমরে মরছে
প্রবল কান্নায় চোখে ভর করছে
উছলানো দীঘি। অদৃশ্য ঘাতক
ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে সহজাত সম্পর্ক।

হাসপাতালের কৃত্রিম যন্ত্র ডাক্তার খুলে
নিলে দায়িত্ববান পিতা লাশে পরিণত হয়।
শেষ মুহূর্তের ভয়াবহতা থেকে
মুক্তি। দয়ামায়াহীন অদৃশ্য ঘাতক
কেড়ে ফেলেছে অনেককিছু।
কাড়তে পারেনি শুধু চোখের জল।
পুত্র হাউমাউ কান্নায় বুক কাঁপাচ্ছে
আদরের কন্যা ঘন, ঘন মুর্ছা যাচ্ছে।

অর্ধাঙ্গিনীর চোখে জড়ো হচ্ছে জলের
সমুদ্র, পবিত্র প্রার্থনায় জানাচ্ছে অন্তিম
ভালবাসা। সবকিছু কেড়ে নিয়েছে অদৃশ্য ঘাতক,
কাড়তে পারেনি তবু বিশ্বাস, ভালবাসা।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৩৯

বৃটেনের প্রতিটি বাড়ি আজ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত, প্রতিটি মানুষ আগন্তুকের মত। একে অন্যকে চেনে না, পাশের বাড়ি সংরক্ষিত এলাকায় পরিণত হয়েছে।
করোনা একটি দেশকে ভুতুড়ে দেশে পরিণত করেছে। অসহায় মানুষ একাকী চিলের মত মধ্য দুপুরে বেদনার কান্না করছে।
ভাই ভাইয়ের হাত ধরছে না, পিতার নির্ভরতার আঙুল কবরে শোয়ে পড়েছে। স্তব্ধ মা তাকিয়ে আছে দূর দিগন্তের দিকে, তার চোখে দীঘির কালো জল।
স্ত্রী ভুলে গেছে স্বামীর সোহাগ, দীর্ঘ খরায় স্বামী আত্মহননে উদ্যমী হচ্ছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট উদাসী, গায়ে হেলান দিয়ে জিরানোর কেউ নেই।
চোখের সামনে রাস্তা বদলে যাচ্ছে। চোখের সামনে বাড়ি বদলে যাচ্ছে। মানুষের ভিড়ে হাঁসফাঁস করত যে বাজার সেখানে আজ কবরের নীরবতা।
চোখের সামনে মানুষ মারা যাচ্ছে। চোখের আড়ালে মানুষ মারা যাচ্ছে। তপ্ত দুপুরে মানুষ মারা যাচ্ছে। মধ্যরাতে মানুষ মারা যাচ্ছে।
আজ যে জলজ্যান্ত মানুষ কাল সে লাশের সারিতে। মানুষের লাশে পৃথিবী ভারী হচ্ছে। মানুষ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। করোনা মুছে দিচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের চিহ্ন।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৩৮

ভ্যাকসিন এলে পুনরায় ভিড় হবে
ছয় ফুটের দূরত্ব কমতে থাকবে
প্রেমিকা সংশয় ভুলে প্রেমিকের
ঠোটে দিবে গভীর চুম্বন।
ভ্যাকসিন এলে বাবা
মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, পুনরায়
মায়ের আঁচলে মুখ মুছবে সন্তান।
ভ্যাকসিন এলে দীর্ঘদিনের আড্ডা
পুনরায় ডাক দিবে, চায়ের কাপে
উঠবে কবিতার ঝড়।

ভ্যাকসিন এলে বাইরের পৃথিবী পুনরায়
সহনীয় হবে, দমবন্ধ ঘরের শ্বাস
অক্সিজেনে পরশে বিশুদ্ধ হবে।
ভ্যাকসিন এলে স্কুল ঘরের তেলাপোকা,
মাকড়ের জাল, ধুলো জমা বেঞ্চ
শিক্ষকের বেত পুনরায় জানান দিবে।
ভ্যাকসিন এলে সিনেমার হলে সরব
হবে নায়ক, খল নায়কের অন্ত
হলে পুনরায় হবে সত্যের জয়গান।

ভ্যাকসিন এলে মাস্ক ব্যবসায় আসবে
মন্দা, কেউ গাইবে না আর স্যানিটাইজারের
গুণগান। প্রাক্তন নায়িকার প্রচারের
ভিডিও দেখতে মানুষ আগ্রহ হারাবে।
ভ্যাকসিন এলে পুনরায় পৃথিবী স্বাভাবিক
হবে, রোদের উঠানে হাঁটবে শিশুর শৈশব।
ভ্যাকসিন এলে হাসপাতালে
কাতরাতে থাকা অসুখ মুক্তি পাবে।

ভ্যাকসিন এলে মানুষ বিজয়ী হবে।
বিজয়ের আনন্দে ভুলতে থাকবে
তাদের আত্মত্যাগ, লক্ষ লক্ষ কবরের
আত্মত্যাগ মানুষ ভুলতে থাকবে।
ভ্যাকসিন এলে মানুষ ফিরবে পুরানো অভ্যাসে
অবাদে বৃক্ষ নিধন, যুদ্ধের উন্মত্ত মাঠে
পুনরায় পুড়বে মানুষের লাশ। ভ্যাকসিন
এলে মানুষের হাঁটবে বিপরীত পথে।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৩৬

হাসপাতালের বিছানায় কৃত্রিম যন্ত্র আবৃত যে শরীর
তার নির্মল শৈশবের দিকে তাকালে মায়া লাগে
দুরন্ত কৈশোর উদ্বেলিত করে, তার তারুণ্য
স্পর্ধিত অধিকারে অনুপ্রাণিত করে।
স্খলিত যৌবন কিয়ৎক্ষণের জন্য দিকভ্রান্ত
করলেও মনুষ্য বিভ্রান্তি শেষে ফিরে আসায়
আশাবাদী করে, দিন শেষে ঘরে ফেরার
তাড়না তাকে শুদ্ধ মানুষ হতে প্রণোদনা দেয়।

পরবর্তী অধ্যায়ে তাকে পাই শুদ্ধ মানুষের
দলে। পরিবার আরাধ্য এই ব্যক্তি নিহিত দায়িত্বে
নিষ্ঠাবান থেকে জীবন উদযাপনে এগোয়,
তাকে আমরা অবলোকন করি সাফল্যের মঞ্চে।
সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম শেষে সে যখন
নির্ঝঞ্ঝাট অবসরের দাবিদার, তৃপ্ত হৃদয়
অবসাদ ঝেড়ে যখন প্রশান্তি-মুখি হচ্ছে, সুখী
সূর্যমুখী তছনছ করে হাজির হয় কোভিড-১৯।

মোটামুটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশে তার জীবন কেটেছে
কঠিন অসুখ তাকে তেমন ছুঁতে পারেনি
নিয়মানুগ সময় ধরে হেঁটেছে, সতর্ক পদক্ষেপ
অহেতুক জটিলতা থেকে তাকে মুক্ত রেখেছে।
তবু শেষ রক্ষা হলো না, সব সতর্কতা ডিঙিয়ে
করোনা তাকে আক্রমণ করে। আপাত স্বাস্থ্যবান
এত সহজে কাবু হবে কেউ ভাবেনি। এখন সে
সব ভাবনার ঊর্ধ্বে। কৃত্রিম যন্ত্র তারা খুলে নিয়েছে।

লিখে_রাখি_করোনাকাল_৩৭

আত্মসমর্পণের পরে অস্ত্রাঘাত কাপুরুষতা
শ্রেষ্ঠত্ব যা জাহির করার ছিল করেছ
আমরা পরাজিত, পীড়িত।
এইবার থামাও তোমার ভয়াল হুংকার
এইবার থামাও তোমার নখের তাণ্ডব
শান্ত হও
শান্ত হও।

তোমার পরাক্রম স্বীকার করে নিচ্ছি
স্বীকার করে নিচ্ছি তোমার প্রতাপ।
আমরা নাকে খত দিচ্ছি
আমরা মাথা নত করে নিচ্ছি।
এইবার দয়া করো
এইবার দয়া করো।

অনেক ধ্বংসের সাক্ষী হয়েছ
তোমার প্রতাপ লাশের হিমালয় ছুঁয়েছে
আর কত! আর কত লাশ চাইবে বলো!
করোনা, এইবার করুণা করো
এইবার হৃদয় আদ্র করো, পীড়িতের
চিৎকারে বাতাস ভারী হচ্ছে
কবরের পর কবর, লাশের পর লাশ।

করোনা, আমরা পরাজিত, আর আঘাত
করো না। রহম করো, দয়া করো।
তোমার হৃদয়ে মানবতা জেগে উঠুক
তুমি ক্ষমাশীল মানুষে পরিণত হও।

জগতের_আনন্দযজ্ঞে

জগতের আনন্দযজ্ঞে‘ লিখে থামলাম, আনন্দ খুঁজতে থাকলাম… আমার মেয়ের বন্ধু ফোন করেছে, ওর বাবা করোনা আক্রান্ত, গত কয়েকদিন ধরে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে… ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃত্রিম শ্বাসের অবসান ঘটাবে, কারণ ফিরে আসায় সম্ভাবন শূন্য…

গত তিন সপ্তাহ ধরে ছেলে-মেয়েরা বাবাকে দেখতে পারেনি, করোনা ওয়ার্ডে দেখাসাক্ষাৎ নিষেধ… যেহেতু ডাক্তার কৃত্রিম শ্বাসের যন্ত্র বন্ধ করে ফেলবে তাই শেষবারের মত বাবাকে দেখার অনুমতি দিয়েছে… বাচ্চারা দ্বিধান্বিত দেখা করতে যাবে কি যাবে না, দ্বিধার কারণ তাদের মা গুরুতর অসুস্থ, যেসব কারণে করোনা রোগীর অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করে তার কিছু উপসর্গ তাদের মায়ের আছে, বিশেষ করে শ্বাস কষ্ট এবং ডায়াবেটিক… সব ধরণের নিরাপত্তা সরঞ্জাম পড়েও করোনা মুক্ত থাকা যাচ্ছে না, এ অবস্থায় বাবাকে দেখতে যাওয়া মায়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে…

আমার মেয়ের বন্ধু মেয়ের কাছে পরামর্শের জন্য ফোন করেছে, মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে…
শেষ মুহূর্তে বাবাকে দেখতে যাওয়া ঠিক কিনা, আমি দ্বিধান্বিত… আমি বড়দিনকে আনন্দের উৎস ভাবতে চাচ্ছিলাম, দেখতে চাচ্ছিলাম যীশু পুনরুত্থিত হচ্ছেন… অশুভ পালাচ্ছে, করোনা পালাচ্ছে…

(সাহস সঞ্চয় করে ছেলে-মেয়েরা বাবাকে দেখে এসেছে, মা আল্লাহর ইচ্ছাকে মেতে নিতে রাজি হয়েছেন… তারা মানসিক ভাবে প্রস্তুত, আগামীকাল একটা ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে…)

অণুগল্প: মন_গাছ

মন বৃক্ষের নিচে একদিন ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেল, এই কাণ্ডের রেশ দীর্ঘ দিন আমাদের তাড়া করেছে।

শীলা নামের যে মেয়েটা মৃদুল কে ভালোবাসতো এক ভোরে তাকে দেখা গেল মন গাছে ঝুলে আছে। ধরাধরি করে তার লাশ যখন নামানো হলো, আমরা তাকাতে পারিনি, তার জিব্বা মুখ থেকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে। তাকে বীভৎস দেখাচ্ছে, যে স্নিগ্ধ মুখ আমাদের উৎপীড়িত করত সে মুখের এমন বীভৎস রূপ আমরা সহ্য করতে পারিনি।
অথচ তাকে প্রেমিকা ভাবার কোন কারন নাই, সে বিশ পেরিয়েছে আমরা টিনএজ বয়সও ছুঁতে পারিনি। তবু তাকে প্রেমিকা ভাবতাম, তার আশেপাশে ভিড় করে থাকতাম। শীলা আমাদের প্রশ্রয় দিত, বোনের আদরে গালে চিমটি কাটতো। তার একটুখানি আদরে আমরা দিশেহারা হয়ে যেতাম।

মন গাছের পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা পাড়ায় ঢুকেছে সেই সরু রাস্তায় একদিন মৃদুল কে দেখা গেল বর বেশে বধু নিয়ে আসছে। তার বধু শীলার মতই স্নিগ্ধ, অথচ তাকে আমরা ডাইনি ভাবতাম। সে ডাইনি ছিল না, আমাদের মন পাবার জন্য সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। আমরা তাকে ঘৃণা করতাম বলতাম ‘ডাইনি তুই মর’।

একদিন তাকেও ডাইনির মত মন গাছে ঝুলতে দেখলাম, মৃদুল আরেক ডাইনিকে বিয়ে করে নিয়ে এলো।

পরিচয়

শেষ পর্যন্ত মানুষ চিনতে পেরেছি,
সত্যি বলছি। প্রহেলিকা ভোরে
ছোরা হাতে যে হৃদপিণ্ড ফালাফালা
করছে তাকে গতকালই চিনতে পেরেছি।
জানতাম আমার দিকে ধেয়ে আসছে
ছোরা, জানতাম গুপ্ত ঘাতক নয়
প্রকাশ্য বন্ধু শান দিচ্ছে, ঘৃণার গরল
উগড়ে দিতে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
তার অপেক্ষা ফুরিয়েছে, গর্তে পা আটকালে
টেনে তুলেছিলাম। ছোরার অস্তিত্ব তখনই
টের পেয়েছি। টের পেয়েছি সর্বস্বান্ত
হওয়ায় সময় এলো বলে। উদ্যত ছোরা যখন
পাঁজরে বিঁধছে, আমি হাসছি। মানুষ
চেনার আনন্দে আহত হৃদয় উদ্বেলিত হচ্ছে।

অনাবাসী_জীবন

k-roma

অনাবাসী গাছ থেকে অকালে
ঝরে পড়ে ফুল,
কেউ কুড়ায় না,
তাজা তাজা ফুল
দীর্ঘ অনাদরে
মলিন হয়ে যায়
কেউ মালা গাঁথে না।

প্রতিদিন বুক কাঁদে, প্রতিদিন
চিৎকার। কেউ শুনে না।
এ কোন অভিশাপ
এ কোন দণ্ড, অনাবাসী জীবন
কোন সে পাপের ফল!
সবুজ বৃক্ষের স্মৃতি
সবুজায়নের প্রণোদনা দেয়
সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও
সবুজ বিমুখ। দেশের
মাটির মাপে সার,
দেশের মাটির মাপে ঘাম,
দেশের মাটি মাপে
রক্ত ঢেলেও গজাতে পারি না
নিজস্ব গাছ, ঘাম, রক্তের বিপরীতে
কঠিন শিলা টিপ্পনী কাটে।

মাতৃরূপে সৎ মাও
দেখা দিতে পারে
অনাবাসী সময় বড় নির্মম
একবারও ছোঁয়ায় না মমতার হাত।
দেশ ত্যাগের অভিশাপে পুড়ছি
অঙ্গার হয়ে গেছে সাধের স্বপ্ন!

ধর্মবোধ

পাবের বাইরে জবুথবু বৃদ্ধ
‘স্পেয়ার এ পেনি’ বলে
মনোযোগ কাড়তে চেষ্টা করছে
দাঁড়ালাম, পকেট হাতড়ে
কিছু খুচরো মুদ্রা দিতে
গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিকে প্রণোদনা দিচ্ছি
ভেবে দ্বিধান্বিত হলাম।
দ্বিধা ঝেড়ে ফিরে আসছি
শুনতে পেলাম উচ্ছ্বসিত বৃদ্ধ
বলছে ‘গড ব্লেস ইউ মাই সান’
বৃদ্ধের বিশ্বাসের সাথে
আমার অনেক অমিল
তার গড কি মঙ্গল
করবে, ভাবতে গিয়ে
নিজেকে ছোট মনে হল।
যদিও জানি আল্লাহ, ভগবান, গড
একই অঙ্গে ভিন্নরূপ
তবুও আজন্ম ধর্মবোধ
অন্য বিশ্বাস স্বীকার করতে দেয় না।
বৃদ্ধের আশীর্বাদে দ্বিধা থেকে গেল
মানুষ পরিচয়ে দ্বিধা থেকে গেল।

মধ্যাহ্নের_মোহর

আনন্দময় কৈশোর, দীপ্ত যৌবন
পাড়ি দিয়ে শরীরে লেগেছে মধ্যাহ্নের
মোহর। স্লথ হয়ে গেছে চলার গতি।
দুপুরের দৌড়ে ফুসফুস সংকুচিত
হলে জলের কলে তৃষ্ণা মেটে না
নিজের শরীরের ভারে হাঁপিয়ে উঠি।

চোখের জ্যোতি দূরত্ব অতিক্রমে অক্ষম,
চালশের পর্দার পুরুত্ব অন্ধকার
ডেকে আনছে, মিইয়ে আসছে আলো।
মাথার কাক রঙ ফিকে হয়ে আসছে,
ঘন দুর্বার মাঠ পাতলা। একদা যে
জঙ্গলে চিরুনি চালানো অসম্ভব ছিল
এখন খেলার মাঠ। দুরন্ত কৈশোর
ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে বিগত পাড়ায়।

দীপ্ত যৌবন শুধু কান্নার পারে টিমে
টিমে আলো জ্বালে। হাড্ডি চিবানো
দাঁত তরলের সাথে সখ্য করেছে।
অনিয়মে অহরহ উদরের উৎপাত।
শরীর অবাধ্যতায় পর্যবেশিত হয়েছে
মনের সাথে আর পাল্লা দেয় না।
ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে যৌবনের ভিটামিন।

ভারসাম্য ঠিক রাখতে কৃত্রিম প্রয়োগ
করতে হয়। বলা হয় অর্ধেক পথ বাকি,
বলা হয় সহজে পরাস্ত হতে নেই। আমিও
চাই রোদেলা দুপুর, আমিও চাই পুনরায়
সবুজাভ ক্ষেত। তবু চাইলেই পাওয়া যাবে
সে সময় ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে জীবনের গান।

বনবাসী_মন

সবুজ ডাকছে, অনেকদিন
নীল জল ছুঁয়ে দেখা হয়নি।
গত বসন্তে পাহাড়ের গায়ে
হেলান দিয়ে নিজেকে বলেছিলাম
পরশ্রীকাতরতা বর্জন করব।
আমাদের প্রতিবেশী নাকের ডগায়
আড়াই দিনের বনবাসে গেলে
ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়েছি।

এখনো শুদ্ধ মানুষ হতে পারিনি
অন্যের ভালো বুকে আগুন জ্বালায়।
যতই প্রকৃতি পরিভ্রমণ করি, যতই
বুকভরে নেই নির্মল শ্বাস, রিপু তাড়িত
ঈর্ষা পিছু ছাড়ে না। কালেভদ্রে দুই বাড়ির
মালিক হয়েছি, আরেকখানা বাড়ি না হলে
ইজ্জত পাংচার। ভায়রা ভাইয়ের জাহাজ
আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে, আমাকে
আদার ব্যাপারীর বদনাম ঘোচাতে হবে।

সবুজ ডাকছে ডাকুক, নীল জলে তারা
জলকেলি খেলুক। আমি চাই ইট,
মজবুত শক্ত ইটে তিন মহলা
হলে, কৃত্তিম জলে প্রাণ জুড়াবে।
সবুজ সবুজে থাকুক, নীল জল
সৈকতে আছড়ে পড়ুক। ইটের জঙ্গলে
আপাতত মঙ্গল, যেভাবেই হোক
জাহাজের খবর পেতে হবে।

মৃত্যু

আমাকে নিয়ে যাবে! তোমার দাবীর
কাছে অসহায়, যাব। নিরাশ করব না।
যাত্রা সমাপ্তির আভাস পাচ্ছিলাম
টের পাচ্ছিলাম গাছের সতেজ পাতা
আলগোছে ঝরে পড়ছে।

গতকাল থেকে ওঠার শক্তি হারিয়েছি
দুইদিন আগে শেষ লাগিয়েছিলাম জানালা
অকেজো ফুসফুস বাতাসের অভাবে
হাঁসফাঁস করছে, জানলা খুলে নাক গলাবো
উঠবার শক্তি পাচ্ছি না।

জানালার বাইরে ডাকছে মুক্ত বাতাস
চলৎশক্তিহীন কাঙ্গাল বাতাস কে বৈরী ভাবছি।
যদিও চাইছিলাম না তবু তৈরি হচ্ছিলাম
যেকোনো সময় সমন আসবে বুঝতে পারছিলাম।
জীবনের আকাঙ্ক্ষায় সব তোড়জোড়
দাবিয়ে রাখছিলাম, সমনের পরোয়ানা
আরো কিছুদিন খাম বন্ধ থাকুক
আরো কিছুদিন দূরে থাকুক ভুল বাতাসের গন্ধ।

বাগানের কোনে বুঝি গোলাপ ফুটেছে,
দূরে উড়ছে শিমুলের তুলো।
শৈশবের ঝিল এখনো কি শাপলা ফোটায়,
নরেন ওঝার বীণে গোখরার
ফোঁসফোঁসানি এখনো কি কাঁপন ধরায়।

বড় অবেলায় এলে হে, কতকিছু বাকী ছিল,
কত ক্ষত পুনর্বার ছুঁয়ে দেখার সাধ ছিল।
সাধ ছিল আয়েশের বিড়ি ফুঁকে
দেয়ালে ঘসাব পিঠ। সাধ ছিল পুনরায়
পুকুরের নীলে ঝাপাঝাপি শেষে
গামছায় মুছে নেব জীবনের জল।

মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়
অপেক্ষায়, অপ্রস্তুত আমি প্রস্তুতি সম্পন্ন করি।
যেতে হবে বিকল্প নেই, আদেশের বরখেলাপ
করে কেউ কোন দিন টিকতে পারেনি
আমার সে শক্তি নেই, চললাম।

প্রিয়_দেশ

1263_n

একাত্তরে জন্ম হলে হয়তো
আমার নাম বিজয় হত।
এ নামের ভার কী বহন
করতে পারতাম! বিজয় বিহীন
নাম ছাড়া যে ভার, সেটাই কি
বহন করতে পারছি!
দেশ আমাকে এত দিল
আলো, বাতাস, শ্বাস
বিনিময়ে আমি কী দিলাম!
আমি কী হতে পেরেছি
দেশের যোগ্য সন্তান,
আমি কী দিতে পেরেছি
সঠিক পরিচর্যা!
দেশের ঋণ রক্ত বিক্রি করেও
শোধ করতে পারবনা
আমার চামড়ায় দেশের জুতা
বানালেও দেশের ভালবাসার
পরিশোধ হবে না।
তাঁরা চেষ্টা করেছে, বুকের রক্ত ঢেলে
ধুয়েছে মায়ের পা, তাঁরা নমস্য।
তাঁদের জন্য দেশের মাথা উঁচু হয়
তাঁদের ধারণ করতে পেরে
দেশ গর্বিত, তাঁরা দেশের যোগ্য সন্তান।
আমি, আমরা তাঁদের নখের যোগ্য নই
তবু কাঁদি, প্রাণ কেঁদে ওঠে।
হে প্রিয় দেশ, অযোগ্য সন্তানেরে ক্ষমা করো
অক্ষম সন্তানেরে ক্ষমা করো।

পতাকা

img-2

একটু দূরত্বে দাঁড়ালাম,
উটকো গন্ধ নাকে লাগছে।
আগন্তুকের মলিন পরিধেয়,
শত ছিদ্র। দীর্ঘদিন পানি সংযোগ
ঘটেনি দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
আমরা যখন খাজুরে আলাপে
মত্ত মনোসংযোগে ব্যাঘাত
ঘটাতে ভিক্ষার পাত্র বাড়িয়ে
দিলে বিরক্তির উদ্রেক হয়।

তার আগমনে রসসিক্ত আলাপ
থামাতে বাধ্য হই, ‘চাচা মিয়া দূরে
যান, গায়ে এসে পড়বেন নাকি’!
তিনি দূরত্বে যাচ্ছেন না দেখে
আমরাই সরে গেলাম, কী আপদ!
‘কী ব্যাপার চাচা মিয়া কী চাই
আপনার’! তিনি তাকালেন
‘একটি পতাকা বাবা’! ‘পতাকা
কিসের পতাকা, ইয়ার্কি করেন নাকি’!

তিনি পুনরায় বললেন ‘পতাকা বাবা,
লাল সবুজের পতাকা’। আমরা বিভ্রান্ত
লোকটা পাগল নাকি, বললাম চাচা মিয়া
‘পতাকা টতাকা নেই, অন্যখানে দেখেন’।
তিনি নিরাশ হয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন
বিড়বিড় করে বললেন ‘পতাকা নেই,
কি আছে তাহলে’! বলে ধীরে ধীরে
দূরত্বে মিলিয়ে গেলেন। আমাদের
একজন অগ্রজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন
তিনি এসে লোকটার পরিচয়
খোলাসা করলেন, পাগল
লোকটা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন
দ্বারে দ্বারে পতাকা ভিক্ষা করেন।