আলমগীর কবির এর সকল পোস্ট

করোনা আমাদের যা শেখাতে পারে

ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়া অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা থেকেই বলছি আমরা আবারও শিখবোনা। ইতিহাসের শিক্ষার পূণরাবৃত্তির অংশ হিসেবেই আমরা দেখলাম পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যখন জীবন ও মৃত্যু’র সন্ধিক্ষণে সেই সময়েও শত শত ত্রাণ দাতাগণ ত্রাণের বস্তাগত বস্তু চুরিতে মহা-ব্যস্ত! না তাদের সামাজিক দায়িত্ব, না তাদের মানবিক মূল্যবোধ, না তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ না তাদের দেশত্ববোধ এহেন কর্মকাণ্ড থেকে তাদের বিবেককে বাঁধা দেবে এমন কোন উপলক্ষ্য ত্রাতা হয়ে তাদের সামনে উপস্থিত হয়নি।

আমরা সবাই জানি এই অতিমারি করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য করুণাময়ের করুণা ছাড়া আমাদের সামনে আপাতত কোন উপায় নেই, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা বিজ্ঞানীদের কৃপায় প্রতিরোধক বা প্রতিষেধক হাতে পাচ্ছি। এই সময়ে করোনা আমাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ভালোমত শিখিয়েছে-

• বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নীতিনির্ধারকগণ যারা সাধারণ সময়ে দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগলে চিকিৎসা বাবদ পৃথিবীর সেরা সেরা হাসপাতালে চিকিৎসার সেবা গ্রহনের সুযোগ পান, শুধু সুযোগ পান বল্লে ভুল হবে বরং চিকিৎসা বাবদ যে অর্থ পেয়ে থাকেন তা অবশ্যই প্রকৃত খরচের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। তারমানে তিনি যদি সুস্থ্য হয়ে গৃহে ফিরতে পারেন তার দূরারোগ্যটাই তার জন্য একটি লাভজনক পণ্যে পরিণত হয়। ***করোনা শিখিয়েছে না সেটা সব সময় সম্ভব নয়। সুতরাং তোমার দেশের চিকিৎসা সেবাকে সার্বজনীন করো, উন্নত করো।

• ***করোনা শিখিয়েছে যেখান থেকে খুশি, যা খুশি, যে ভাবে খুশি, যে কোন প্রাণী হত্যা করে খাবে আর সামান্য কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করবে, সেটা হবে না। তোমরা এখন তোমাদের, হাত মুখ, জিহ্বাকে সংযত করো আর পদযুগলকে সচল করো।

• *** তোমরা অর্থ লালসায় বিশ্ব বাণিজ্য দখল দরিদ্র তৈরীর এক অশুভ প্রতিযোগিতায় নামবে, সেখানে ধরনীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার কথা একদম ভুলে যাবে তা হবে না, প্রকৃতি বুঝিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি কিভাবে তার ভারসাম্য রক্ষা করবে।

• নিজেদেরকে যে সকল দেশ অসীম ক্ষমতার অধিকারী বলে জাহির করতে চান তাদের বোধহয় বোঝবার সময় এসেছে, ১,৮২২ বিলিয়ন ডলার দৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলা করার জন্য যে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার বাজার মূল্য শুণ্য যদি ***করোনার মত অদৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলার কোন প্রস্তুতি না থাকে। যদিও বস্তুত শত্রু মোকাবিলার নামে হয় নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয় অথবা অজাতশত্রু মানুষগুলোকে অপ্রয়োজনীয় অজুহাতে বিভাজিত করে শত্রু বানানো হয়।

•করোনা পরিস্থিতি যে বিষয়টি সবচেয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছে তা হলো, আমরা সাধারণ মানুষ অসাধারণ মর্যাদায় কিছু ভাঁড়কে দেশের দায়িত্বভার তাদের হাতে তুলে দিয়েছি এবং এই ভাঁড়দের সেই দায়িত্ব দিয়ে আমরা বিরাট গৌরব বোধ করি।

•করোনা আমাদের শিখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে হিংসা বিদ্বেষ শেখানোর মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভবিষ্যতের ভাঁড় তৈরী করার কোন মানেই হয়না বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় রিসার্চে তাদেরকে মনোনিবেশ করান অথবা ল্যাবে বসান তাতে ভবিষ্যতে আপনিও আপনার অতিপ্রিয়জনরা নিরাপদে থাকবে, ভালো থাকবে।

সর্বশেষে বলতে চাই, আমাদের এখন সময় এসেছে, আমাদের প্রতিদিনের আয়ের একটি অংশ খেলা-ধুলা, বিনোদনে খরচের পাশাপাশি ল্যাবে বিনিয়োগ করার মানশিকতা গড়ে তুলতে হবে।
রাজনীতিবীদ নামক ভাঁড়দের দালাল, আত্মীয়, চাটুকারী ইত্যাদি লজ্জাজনক পরিচয় দেওয়ার চেয়ে একজন অপরিচিত মানবতাবাদী মানুষের শুভাকাঙ্খী পরিচয়ে গৌরবান্বিত বোধ করুন অথবা একজন সৎ কৃষক, সৎ দিনমজুরের পরিচয় দিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করুন।

সামাজিক দূরত্ব ও সৌদির কোকো কোলার বিলবোর্ড

সৌদি আরবে, কোকা কোলা কোম্পানির পানিয় বিক্রয় কমে যাওয়া বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই বিপনণ বিভাগ, প্রমোশন বিভাগ ও অন্যান্যরা মিলে কি ভাবে বিক্রয় বৃদ্ধি করা যায় সে ব্যাপারে মিটিং-এ বসলেন। মিটিং এ বসে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রমোশন বিভাগ এমন একটি বিজ্ঞাপন তৈরী করবে; যে বিজ্ঞাপনের কারণে সৌদি আরবে কোকো কোলা বিক্রয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

যথারীতি, সৌদি আরবের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বিল বোর্ড বসিয়ে দেওয়া হলো, এবং যেখানে দেখানো হলো,
প্রথম ছবিতে : একজন মানুষ খুবই ক্লান্ত বোধ করছেন, ক্লান্তির কারণে নড়াচড়া করতে পারছে না।
দ্বিতীয় ছবিতে : তার হাতে একটি কোকো কোলার বোতল দেওয়া হলো।
তৃতীয় ছবিতে : কোকো কোলা পান করে লোকটি চাঙ্গা হয়ে গেলো।

বিল বোর্ড বসিয়ে দেওয়ার পর তারা খুবই আশাবাদী হলেন, এই বিল বোর্ডের কারণে তাদের বিক্রয় সংক্রান্ত সমস্যা কেটে যাবে। বাস্তবে দেখা গেলো উল্টো চিত্র, যা বিক্রয় হচ্ছিলো তাও বন্ধ হয়ে গেলো। স্বাভাবিক ভাবে তারা আবারও কারণ অনুসন্ধান করার জন্য মিটিং ডাকলেন। মিটিং-এ উঠে আসলো যে, সৌদী আরবের মানুষ ডান দিক থেকে পড়ে। অর্থাৎ তাদের বিজ্ঞাপনের অর্থ দাঁড়ালো একজন চাঙ্গা মানুষ কোকা কোলা পানের ফলে ক্লান্ত হয়ে গেলো।

কোরণার সংক্রামক রোধ করার জন্য স্বাভাবিক প্রচারেই সামাজি দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হলো। বলা হলো নামায মসজিদে না পড়ে বাড়িতে পড়া যেতে পারে। এইসব প্রচারের মধ্যেই হুজুররা ষড়যন্ত্র খুজে পেলেন। তারা ওয়াজ করতে শুরু করলেন ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্যই এইসব প্রচার করা হচ্ছে। ইসলামে ছুঁয়েছে (সংক্রামক) রোগ বলতে কিছু নেই।

অতঃপর ব্যাপক ভাবে চিন, ইটালি, স্পেনের (তখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকোপ ছড়ায়নি) উদাহরণ দেওয়া হলো। এইবার হুজুররা গজব বলে চালিয়ে দিতে লাগলেন এবং বল্লেন, বাংলাদেশে করোনা আসবে না। নামায পড়লে কোরনা হবে না।

অতঃপর করোনা দেশে আসলো; লোকজনও করোনার ভয়াবহতা বুঝতে শুরু করলো। সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সরকার, অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষনা করলো। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদে নামায না পড়ে বাড়িতে পড়তে বল্লো।

এইবার মানুষ সত্যিই ভয়ে পেতে লাগলো; ভয় ও দীর্ঘ ছুটি পেয়ে মানুষ ঢাকা ছাড়লো। ছুটির কারণে বাস, ট্রেন, বিমান লঞ্চ-ফেরির ভীড় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উদ্যোগকে কৌতুকে পরিণত করে ফেল্লো। মিডিয়া ও ইন্টারনেটের কারণে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলো মানে মানুষ সত্যিই ভয় পেতে শুরু করলো।

ঢাকা ফেরত ও লোকাল মানুষ ভয় কাটানোর জন্য বেশি বেশি মসজিদে যাওয়া শুরু করলো। মসজিদের এই ভীড় সামাজিক দূরত্বের উদ্যোগ আবারও কৌতুকে পরিণত করলো।

মানুষ নিজের বাড়ীটাকে পবিত্র করার সুযোগটাকে হাতছাড়া করলো।

দুই দু’গুণে তিন

(এক)
‘একটি বিশেষ কারণে আপনাকে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে আজ থেকে বিশ বছর পূর্বে অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে ক্লোনিং করে পূণর্জন্ম দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৬ সাল যখন আপনার বয়স ছিল মাত্র ষোল; তখন সেই বয়সে আপনি একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেন।; তবে ঠিক কি কারণে আপনাকে ক্লোনিং করা হয়েছে সে বিষয়টি আমারও ভালমত জানা নেই। আমাকে বলা হয়েছে আপনাকে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে জানানো হবে। অত:পর ক্লোনিং করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আপনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়। অন্যদিকে যে মেয়ের কারণে আপনি আত্মহত্যা করেন তার বয়স এখন ষাট। ষাট বছরের সেই নারী একই সাথে ষোল ও ষাট দুইজনই যিনি একজন পুনুরুত্থিত সৌন্দর্য্য অন্যজন বিদ্যমান সৌন্দর্য্য নিয়ে যুগপৎ ভাবে পৃথীবিতে বিরাজ করছে।’ বিদ্যমান সৌন্দর্য্যরে মেয়েটি হারানো সৌন্দর্য্যরে নারীর কোষ থেকে স্বযত্নে ২০২৫ সালে একজন কন্যা শিশুকে ক্লোনিং করে জন্ম দেওয়া হয়, যার নাম দেওয়া হয়, না নামটিও আপনাকে না জানানোর জন্য বলা হয়েছে। আপনার মত সেই শিশুটিরও জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে এবং তা ক্লাউড স্টোরেজে রাখা হয়েছে। যদিও বর্তমান শাসক শ্রেণী সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামী কয়েক বছররের মধ্যে সকল নবজাতকের অটোমেটেড সিস্টেমের মাধ্যমে জিনোম সিকুয়েন্সিং করে ক্লাউডে তা সংরক্ষণ করা হবে। এটা বলাই বাহুল্য যে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে অতি গোপনে ক্লোনিং করে আপনাদেরকে জন্ম প্রদান করা হয়েছে।

‘সেটা আপনাদের কাছ থেকে নিশ্চয় প্রত্যাশিত ব্যাপার নয়, বিশেষত: দেশ ও পৃথীবির কাছে যাদের দাবি ও দায়বদ্ধতা রয়েছে’ অর্ণব তার পাশের ছেলেটি ভাবলেশহীন ভাবে বল্ল।

‘কথা সত্য, কিন্তু মি. অর্ণব আপনি কতটা সৃষ্টিশীল তার প্রমাণ পাওয়া যায় আপনার ভাঙ্গা-গড়ার ক্ষমতা কতটুকু তার মাধ্য দিয়ে, শুধু সৃষ্টির মাধ্যমে নয়, আর তাছাড়া পৃথীবিতে দ্বিতীয়বার আসতে পেরে আপনার খারাপ লাগার কথা নয়।’

‘পৃথীবিতে এসে বিদায় নেওয়ার পর আমার কাছে আমার কোন অস্তিত্ব ছিলনা, যেমনটি আগামিতে যারা আসবে এই মূহুর্তে তাদের কাছে তাদের কোন অস্তিত্ব নেই, তবে যে কোন কারণেই হোক না কেন কারও না কারও কাছে আমার অস্তিÍত্ব ছিল, বিশেষ করে পূর্বে আমি যাদের সংস্পর্শে ছিলাম’।

(দুই)
জেনেটিক্স ডিকোডিং এই বিলাসবহুল সেন্টারটিতে অর্ণবকে আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে অর্ণব তা বুঝতে পারছে না। অর্ণবের সুপার স্মার্টফোন থেকে আসা নোটিফিকেশন তাকে বারবার জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘You have exceeded your patience limit, you should walk outside or keep listeing your favorite song, প্রায় দশ ঘন্টা যাবৎ অর্ণব রুমটি মধ্যে একা একা হাঁটছেন এবং গান শুনছেন। মোবাইল ফোনের চার্জ কমে গেলেই তার মোবাইলেও ওভার দ্যা ইয়ার চার্জিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ফোনে চার্জ দিয়ে নিচ্ছেন।

অর্ণবের সামনে কিছু খাবারে প্যাকেট রাখা হয়েছে। প্রত্যেক প্যাকেটেই মূলত: শুকনো খাবার রয়েছে যেখানে খাবারে ক্যালরি ও পুষ্টিগুণ তথ্যসমৃদ্ধ কিউআর কোড দেওয়া আছে। অর্ণব খাবারের একটি প্যাকেট তুল্ল, প্যাকেটের গায়ের উপরে লেখা রয়েছে ‘জৈব প্রোটিন’। খাবারের কিউআর কোডটি স্ক্যান করা মাত্রই অর্ণবের মোবাইলে নোটিফিকেশান চলে আসলো, You have to three kilomiters walk after havings this meal. সঙ্গত কারণে অর্ণব অন্য একটি খাবারের প্যাকেট তুলে নিল, যথারীতি কিউআর কোড স্ক্যান করা মাত্রই বাংলায় নোটিফিকেশন আসল ‘এটি আপনার জন্য এমন একটি খাবার যা এই মুহূর্তে খাবার পর আপনাকে আগামী ছয় ঘন্টা না খেলেও আপনি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ্য থাকবেন’।

বিশেষত কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি কম্পিউটার আবিস্কারের পর থেকে ব্যবহাকারীর gesture, Posture, emotion, mood, passion ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে মোবাইল তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে স্বয়ংক্রীয় ভাবে ভাষা, আলো ইত্যাদি পরিবর্তন করে নিতে পারেন এমনকি কোন নাম্বারের কলটিও এই মূহুর্তে ব্যবহারকারী ধরতে চাইবেন না তা বিশ্লেষণ করে unreachable মুডে নিয়ে যায় অত:পর ব্যবহারকারীর মুডের পরিবর্তন হলে তাকে নোটিফিকেশান দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়।

‘মি. অর্ণব আমরা এখন মানুষের সমস্ত অনুভূতি, ভালোবাসা তার আবেগ সবকিছু যান্ত্রিক ভাবে বুঝে থাকি আর যন্ত্রকে কিভাবে আরও যৌক্তিক করে তোলা যায় সেটা হৃদয় দিয়ে ভাবি, এই রুমে আপনার কাছে রক্ষিত ডিভাইসটির সংরক্ষিত ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নিয়ে সরি ভুল বল্লাম, বলতে পারেন অসুবিধা নিয়ে দশ ঘন্টা আপনাকে আটকে রাখা হয়েছে। আপনাকে দশ ঘন্টা আটকে রাখা হয়েছে এইটা বোঝার জন্য যে, আপনার পূণর্জন্ম ও পুর্ববর্তী জন্মের মধ্যে এর emotional behavioral এর মধ্যে কোন পার্থক্য তৈরী হয়েছে কিনা

সেটা বোঝার জন্য’ ।

‘কিন্তু আমার পূর্ব জন্মের যদি সেটা হয়ে থেকে থাকে, তাহলে তার কোন ডেটা আমার জানামতে সংরক্ষণ করা নেই তাহলে এই দুইটা সময়ের emotional behavioral -এর পার্থক্য কিভাবে বুঝবেন?’

‘ঠিক ধরেছেন, সেটা মেসিন দ্বারা কোন ভাবেই বোঝা সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদের কাছে এমন একটি জিনিষ আছে যা আপনার emotional behavioral -এর পার্থক্য বোঝার জন্য কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির চেয়েও কার্যকর, এই জন্মে আপনার কাছে তার খুব একটা মূল্য আছে বলে আমার কাছে মনে হয়না। মি. অর্ণব কোন কথা বলছেন না যে, আপনার কি জানতে ইচ্ছে করেনা সেই জিনিষটা কি?’

‘না আমার জনার ইচ্ছেটা যথেষ্ঠ সংযত, আমার যা জানার প্রয়োজন নেই তা আমার জানার ইচ্ছে করেনা।’
‘আপনারকি আপনার বিষয় কাউকে জানাতে ইচ্ছে করে?’
‘যদি আমার কাছে মনে হয় আমার বিষয়টি কাউকাকে জানালে কোন ফল পাওয়া যাবেনা তা জানায়না’
‘কিন্তু আপনি যদি না জানান, তাহলে তো আপনি জানতে পারবেন না যে, আপনি জানালে ফল পাবেন কি পাবেন না’
‘সেটা হয়তো ঠিক কিন্তু আমার ফল পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে আমি জানায়না’
‘তারমানে আমাদেরকে কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির চেয়েও কার্যকর যে জিনিষটা ছিল তার আর প্রয়োজন নেই ’।
———চলবে

পর্যবেক্ষণ যখন শ্রেয়

যখন কোন ঘটনা সংঘটিত হওয়া এবং না হওয়ার সমান সম্ভাবনা হয়; তখন হতে পারে বা নাও হতে পারে ধরে নিয়ে বিচার করাটায় শ্রেয় যদি সি বিষয়টি আপনি নিজে প্রত্যক্ষ করে না থাকেন। তার মানে যেহেতু আমি ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করিনি সেহেতু, হয়েছে অথবা হয়নি ধরে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করায় শ্রেয়। প্রায়শই দেখা যায় অসামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত খবর কেউ হয়তো শেয়ার দিয়েছে, আর যদি সেটা আমার বিশ্বাস করতে স্বাচ্ছন্দ লাগে তাহলে আমাার বিশ্বাসের পক্ষে আমি এমনটিই প্রচারমূলক ভূমিকা রাখি যে, মনে হয় ঘটনাটা আমার সামনেই ঘটেছে। কিন্তু এহেন স্বাচ্ছন্দমূলক বিপরীত ভূমিকা রাখার সমান সম্ভাবনার ঘটনাট পক্ষ নিয়ে বা বিপক্ষতার পক্ষ নিয়ে আমরা হয়তো অনেক মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছি অথবা সত্যকে মিথ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছি। অতএব, নিরপেক্ষভাবে ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করার চেয়ে শ্রেয় আর কোন ভালো বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয়। আমাদের বিশ্বাস কারও যাতে অনিষ্ঠ না করে সে বিষয়ে আমরা নিশ্চয় সাজগ দৃষ্টি রাখবো।

পরাজয়

(এক)
অপা অর্ণবের উপর প্রচণ্ড রেগে আছেন, অপা কোথায় যেন একবার দেখেছিলেন দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালালে রাগ কমে, মুশকিল হচ্ছে গুলশান এ্যাভিনিউয়ের মধ্যে কোথায় দেশলাই কিনতে পাওয়া যায় অপা তা জানেননা। সামান্য একটা দেশলাই কোথায় কিনতে পাওয়া যায় অপা তা জানেননা ভেবে অপার আরও মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। অনলাইনে খুঁজতে গিয়ে দেশলাইয়ের নানান ধরনের বানান দেখে অপার আরও মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সব ধরনের বানান প্রয়োগ করে গুলশানের সবগুলো সুপারশপের ওয়েবসাইটে গিয়ে সার্চ বক্সে দেশলাই লিখে সার্চ দিলেন কিন্তু সবক্ষেত্রে একটাই ফলাফল আসল Sorry! We could not find any products to match your search.

বাসা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন দোকানে দেশলাই খুঁজতে লাগলেন কিন্তু ছোট বড় কোন দোকানেই দেশলাই খুঁজে পেলেন না। একবার এক দোকানীতো বলেই বসলেন, ম্যাডাম আপনি লাইটার নিতে পারেন লাইটারে ভাল সিগারেট ধরানো যায় অথবা আপনি চাইলে আপনার গ্যাসের অটো চুলা ব্যাবহার করেও আপনি সিগারেট ধরাতে পারবেন, দোকানির কথা শুনে অপার আরও মেজাজ খারাপ হলো। অত্যন্ত রাগে তুতলাতে তুতলাতে দোকানী কি বল্লেন অপা নিজেও তা বুঝতে পারলেন না। দেশলাই কেনার চিন্তা বাদ দিয়ে রাগ কমানোর নতুন পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাসার দিকে ফিরতে শুরু করলেন।

বাসায় ঢুকতে গিয়ে সদর দরজার পাশে গাছের নিচে এক বৃদ্ধ চা সিগারেট বিক্রি করছে। অপা লক্ষ্য করলেন তার কাছে বেশকিছু দেশলাই আছে। অপা বৃদ্ধ লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনার কাছে কতটি দেশলাই আছে?’
‘বারটি’
‘সবগুলো দেশলাই আমাকে দেন’
পার্স থেকে একশ টাকার একটি নোট দোকানিকে দিয়ে হাটতে লাগলেন।
‘ম্যাডাম বায়ান্ন টাকা ফেরত পাবেন, নিয়ে যান’

অপা ইতিপূর্বে অনেকবার লক্ষ্য করে দেখেছেন রিক্সার ভাড়া বা খুচরা ক্রয়ের বিল মেটাতে গেলে সব সময় তারা পাওনা টাকার চেয়ে একটু বেশি টাকা প্রত্যাশা করে কিন্তু নিজে থেকে যখন সময় বাঁচানোর জন্য বেশি ভাড়া বা বিল পরিশোধ করতে চান তখন তারা পুরো টাকা ফেরত দিতে চায়। এই ভাবনাটাও অপার খারাপ মেজাজ আরও খারাপ করে দিচ্ছে।

অপা দুই তিন বার বাসার কলিং বেল বাজালেন কিন্তু কাজের মেয়েটি দরজা খুলতে আসল না। মেজাজ খারাপের সময় সবাই সম্ভবত: দেরী করেই বাসার দরজা খোলে।
‘তোমার দরজা খুলতে এত দেরি হলো কেন?’
‘দেরীতো করি নাই আপা, রান্না ঘর থেকে দরজা পর্যন্ত আসার সময়তো দেবেন’
‘মুখে মুখে এত তর্ক কর কেন? আর তুমি কাজের মেয়ে তোমাকে এত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে কেন?’
‘এসব কি বলেন আপা? আমি কাজের মেয়ে বলে শুদ্ধ করেও কথা বলতে পারব না’
‘সরি, যাও তুমি সব সময় শুদ্ধ করে কথা বলো’

দেশলাইয়ের কাঠি বের করে একে একে আগুন জ্বালাতে গিয়ে একটা কাঠি জ্বলে তো আর একটি জ্বলেনা, আবার জ্বালাতে গিয়ে কয়েকবার হাত ও পুড়ে গেছে। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে রাগ কমানোর এই কৌশল পুরোটাই জলে গেছে, বরং রাগ আর বেড়ে গেছে। অপা অত্যন্ত বিরক্তে দেশলাইয়ের কাঠিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দিয়ে আরাম করে সোফায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন।

…কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে,
হৃদয় মম থরোথরো কাঁপে তোমার গানে!!
আজিকে এই প্রভাতবেলা মেঘের সাথে রোদের খেলা,
জলে নয়ন ভরোভরো চাহি তোমার পানে!!
আলোর অধীর ঝিলিমিলি নদীর ঢেউয়ে ওঠে,
বনের হাসি খিলিখিলি পাতায় পাতায় ছোটে।
আকাশে ওই দেখি কী যে- তোমার চোখের চাহনি যে।
সুনীল সুধা ঝরোঝরো ঝরে আমার প্রাণে।।

ঘুমের ঘোরেইে ৫:১ চ্যানেলের হোম থিয়েটারে গানটি শুনতে লাগলেন। অপার প্রচন্ড ভাল লাগতে শুরু করল। অপা বুঝতে পারছেন না যে এখন তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মধুর কোন স্বপ্ন দেখছেন নাকি সত্যি তার হোম থিয়েটারে গানটি বাজছে। একটু আগে যে তার প্রচন্ড রাগ হয়েছিল তাও তিনি ভুলে গেছেন। অপা ঘুমের ঘোরেই উপলব্ধি করলেন কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। অপার প্রচন্ড ভাল লাগছে। স্ব-স্নেহে হাত বুলানোর এই সুখ অপা অনেকদিন ধরে পেয়ে আসছেন। এটাকে শুধু সুখ বললে কম বলা হবে বরং এটাকে স্বর্গী আশ্রয় বলা উচিৎ।

‘তুমি? তুমি কখন এলে? তুমি আমার মাথায় হাত দেবেনা’ অপা বিরক্তির স্বরে অর্ণবের উদ্দেশে বললেন।
‘ওকে, ঠিক আছে মাথায় হাত দিচ্ছিনা’ বলে অর্ণব অপাকে ডান হাতের বাহুর মধ্যে জড়িয়ে অপার বাম পাশে বসে পড়লেন।
‘না তুমি জড়িয়েও ধরবেনা’
‘আচ্ছা ঠিক আছে জড়িয়েও ধরছি না’
বলে অর্ণব অপার চুলের গোছা এক হাত ধরে চেপে ধরে নিজের ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট নিয়ে অপাকে চুমো খেতে লাগলেন। অপা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও তা পারলেন না। সেটা শক্তি প্রয়োগের অপেক্ষাকৃত প্রতিযোগিতার কারণে নয়। সেটা এই ভালবাসাকে উপেক্ষা করার অসামর্থ্যরে কারণে।
‘আমাকে আদর করতে তোমার লজ্জা করে না?’ কান্না হাসির সংমিশ্রণের অভিমানি অভিযোগে প্রশ্ন করে অর্নবকে।
‘তুমি এতগুলো মানুষের সামনে কেন আমাকে অপায়া বললে? তুমি জানোনা একথাটি শুনলে আমি খুব কষ্ট পাই’
‘সরি, দশ বছর আগের সেই কথাটা আমি ভুলে যেতে চাই, তুমি কেন ভুলতে পারনা?’
‘আমি কেন পৃথিবীর কোন নারীই সেই ঘটনা ভুলতে পারবে না’

(দুই)
‘১৫ নভেম্বর ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম আপনাদের মধ্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সফল শারীরিক সম্পর্ক সংঘঠিত হয় এবং সেখান থেকে অপা একটি বাচ্চাও ধারণ করেন। অত:পর পরের ঘটনা আমার সার্ভারে সংরক্ষিত না থাকলেও আপনার জিনেটিক এ্যাভিডেন্স সার্চ করে ঢাকার সবচেয়ে নামকরা হাসপাতালে দূর্ঘটনার চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে এবং সেই দূর্ঘটনায় অপা তার গর্ভে ধারন করা তিন মাসের গর্ভের সন্তান হারান সাথে মা হবার সক্ষমতাও এবং আপনি হারান বাবা হবার ক্ষমতা।’ এরপর পাঁচ বছর পরে আপনারা আমার কাছে চেক-আপ করতে আসেন। ’

চিকিৎসক রোবটের উপরোক্ত কথাগুলো শুনে অপা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছেন এবং অর্ণবও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বাংলাদেশের সর্বাধুনিক চিকিৎসার এই হাসপাতালটিতে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই ডিপ লার্ণিং রোবট দ্বারা চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। নমুনা সংগ্রহের সাথে সাথেই সমস্ত স্বাস্থ্য প্রতিবেদন দেওয়া হয় এবং সকল তথ্যই স্থায়ী ভাবে ক্লাউড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে।

‘আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমস্যা হলো মানুষ কোন্ কথায় কাঁদতে পারে এটা আমরা এখনও পর্যন্ত শিখতে পারিনি, বলতে পারেন আমাদেরকে শেখানো হয়নি, তবে বর্তমানে এটা আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে।’
‘ওকে, আপনি বলে যান মি. রোবট’
‘গুচ্ছ গুচ্ছ এ্যালগারিদমের মাধ্যমে জটিল জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারি কিন্তু একজন অতি সাধারণ শিশু যা বুঝতে পারেন আমরা তা বুঝতে পারিনা, মি. অর্ণব আপনি ভাবছেন, আমরা যে খুবই সামান্য বুঝি সেটা আমি কিভাবে বুঝলাম? এটা মানবীয় গুণ তাইতো?, এটা কোন ব্যাপার না, আমি সার্চ ইঞ্জিন থেকেই এই তথ্য পেলাম। আমার মেধার দু’টি মাত্র উৎস এক নাম্বার প্রিলোডেড প্রোগ্রাম, দুই সার্চ ইঞ্জিন, তবে বর্তমানে আমরাও কিন্তু করতে করতে শিখি, তবে সেটাও অন্য একটি সফওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেখানো হয়।’

কথা শেষ করেই ডিপ লার্ণিং রোবটটি অপার শরীরের দিকে তাকালেন, এ বছরের বিশ্ব সুন্দরী যিনি হয়েছেন তার ছবি সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এবং অপার শরীরের একটি ছবি নিয়ে ডিপলার্ণিং রোবটটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখলেন তার সাথে উচ্চতা ছাড়া ৯১.৩৭ % মিল রয়েছে। রোবটের চাহনীতে অপা কিছুটা ব্রিবত হয়ে স্তন জোড়া ওড়না দিয়ে ঢেকে দিলেন। রোবটি প্রিলোডেড প্রোগ্রামিং থেকে এর কোন কারণ খুঁজে পেলনা। সার্চ ইঞ্জিন থেকে ভিডিও ক্লিপ বিশ্লেষণ করে রোবটটি খেয়াল করে দেখলো কোন পুরুষ তাদের বুকের দিকে তাকালে সাধারণত: বাংলাদেশের নারীরা বুকে ওড়না দিয়ে ভালো করে ঢাকার চেষ্টা করেন। সাথে সাথে রোবটটি তার অবয়ব পরিবর্তন করে নারী রুপ ধারণ করে ফেললো। সাধারণ বাংলাদেশের ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুশাসনের কারণে নারী পুরুষদের ব্যাপারে পারস্পারিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি মাথায় রেখেই রোবটটি এই ভাবে তৈরী করা হয়েছে।

‘মি. অর্ণব কোন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আপনি কখনও বাবা হতে পারবেন না, এমনকি মিসেস অপাও কখনও মা হতে পারবেন না’
রোবট চিকিৎসকের এই কথা শুনে অপা আরও উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগলেন।
‘মিসেস অপা বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিংহোমের সিসিটিভি ফুটেজের ইমেজ ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখলাম একজন নারী যখন মা হন তখন তিনি সবচেয়ে বেশি সুখি অনুভব করেন, আপনার জীবনেও সেই সর্বোচ্চ সুখি সময় স্বাভাবিক ভাবে আর কখনও আসবেনা ’
অর্ণব একটু বেশি বিরক্ত হয়ে বল্লেন
‘রোবট যে সত্যিই খুব মূর্খ হয়, সেটা আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি’
‘মি. অর্ণব আপনার আবেগ বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারছি আপনি এমন কিছু বল্লেন, যা মানুষ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলেন; মি. অর্ণব আমি এইযে আপনার সাথে বেশি বেশি কথা বলছি এটা আমার প্রোগ্রামার দ্বারাই করা হয়েছে, যাতে আমরা বেশি বেশি শিখতে পারি।’
‘আপনি আপনার চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করুন, মি. রোবট’
‘মি. অর্ণব আপনার বাবা হবার একটি পথ অবশ্যই খোলা আছে’
অপা রোবটের এই কথাটি শুনে নির্ভার বোধ করতে লাগলেন, হঠাৎ করে মনে হলো তার বুক থেকে পাহাড়সম এক পাথর সরিয়ে নেওয়া হলো।
‘কিন্তু সেই চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু ভ্যালিডেশনা প্রয়োগ করা আছে, নামের শুরুতে মো:, মোছা: ইত্যাদি বসানো থাকলে বা আব্রাহামী ও কিছু ধর্মের অনুসারী হলেই সে চিকিৎসা আমার দ্বারা দেওয়া সম্ভব হয়না। ’
‘কি সেই ব্যবস্থা?’
‘সেই ব্যবস্থার নাম হলো in vitro fertilization যার মধ্যে Embryo transfer পদ্ধতিটি আপনাদের জন্য একমাত্র অগ্রহণযোগ্য কার্যকরী পদ্ধতি,
‘পদ্ধতিটি অগ্রহণযোগ্য পদ্ধতি কেন?’
‘মি. অর্ণব সঠিক পদ্ধতিতে Algarithom সেট করে কোডিং ও ট্রেনিং অভিন্ন হলে ভূখণ্ড, ধর্ম, বর্ণ, সমাজ নির্বিশেষে আমরা রোবটরা একই ফলাফল প্রদর্শন করে থাকব কিন্তু মানুষ এমন এক প্রাণী যারা ধর্ম ভুখণ্ড ইত্যাদি কারণে তাদের আচরণ, জীবন চর্চা, এ্যাপ্রোচ এমনকি মানবিক গুণাবলীরও সীমাহীন তারতম্য হয়ে থাকে যা একটি পশুর ক্ষেত্রেও তা হয়না, আপনারা যারা মানুষ তারা গালমন্দ করে অন্য মানুষকে কোন কোন প্রাণীর নামে যে গালি দেন এমনকি সেই প্রাণীও মানুষের মত বর্ণবাদ, ধর্মবাদ হয়না।’
অর্ণব বুঝতে পারছেন না এই যন্ত্রের যন্ত্রণায় আরও যন্ত্রণা বোধ করবেন নাকি, হাসবেন। অর্ণবের এই ভাবনার দৈর্ঘ্য মি. রোবটিক ডাক্তার আর বাড়তে দিলেন না, আবারও বকবকানি শুরু করলেন।

‘মানুষ এমন এক অদ্ভুত প্রাণী যারা ভূখণ্ডের কাল্পনিক সীমা নিয়ে একদল মানুষ আর একদল মানুষকে হত্যা করে, অন্যের সীমানার সীমাবদ্ধ তৈরী করার মধ্য দিয়েই নিজের সীমানা সঙ্কুচিত করে, শুধু সীমানাই সঙ্কুচিত করেনা জ্ঞান আহরণের সীমা পরিসীমাও সঙ্কুচিত করে, মানুষ এতটায় নির্বুদ্ধিতার চর্চা করে যে, একটা কুকুর বা একটা শুকরকেও একদেশ থেকে আর দেশে যেতে ভিসা বা পাসপোর্ট লাগেনা কিন্তু মানুষের লাগে, অর্থাৎ মানুষ চরম আত্ম-পরিচয় সঙ্কটে ভোগা এক প্রাণী’

অর্ণব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বল্লেন-
‘মি. রোবট আপনি চুপ করবেন? আপনার বকবকানি আর ভালো লাগছে না’
রোবট চুপ করে গেলেন এবং বল্লেন
‘আপনি আমাদের চিকিৎসা নিয়ে কথা বলুন, মি. রোবট’
‘আপনাকে একজন ডোনার নারী খুঁজতে হবে; যান্ত্রিক বা যৌন প্রক্রিয়ায় তার ডিম্বানুর সাথে আপনার স্পার্ম মিলিত করতে হবে এবং সেখান থেকে ভ্রুণ তৈরী হবে এবং সেই সেই ভ্রুণ আপনার স্ত্রী অপার গর্ভের স্থানান্তর করা হবে এবং সেখান থেকে গড়ে উঠবে আপনার ও অপার ভবিষ্য স্বপ্ন, কিন্তু আপনার স্পার্ম যদি ভ্রুণ তৈরীর জন্য অনুপোযোগী হয়ে থাকে তাহলে অন্য পুরুষের স্পার্ম নেওয়া হবে অত:পর….., এই প্রক্রিয়াটি কোন ভাবেই আপনার ধর্মীয় সংস্কৃতি সমর্থন করে না বা একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সংস্কৃতির বলয়ে গড়ে উঠা আপনার চল্লিশ বছরের আরোপিত অভিজ্ঞতার ফলে তা আপনি মানতে পারবেন বলে মনে হয়না।

রোবটের এহেন কথা শুনে অর্ণবের কপালে দুঃশ্চিন্তার ছাপ পড়তে শুরু করলো। অপার দু;চোখ বেয়ে পানি ঝরতে শুরু করলো।
‘মি. অর্ণব আমি অপার এই কান্নার ইমেজ নিয়ে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে অনুরূপ ইমেজের ডেটা বিশ্লেষণ করে কান্নার কারণ বুঝতে গিয়ে তাতে বিপরীত ধর্মী ফল পেলাম, তাতে অপা কেন কাঁদছে তার আবেগিক কারণের দ্বন্দহীন কোন কারণ খুঁজে পেলাম না’
অর্ণব পূর্বের মতই বিরক্ত হয়ে বল্লেন
‘তুমিতো এমনিতেই জিরো ও ওয়ানের বেশি কিছু বোঝনা, তোমার দ্বারা এটি বোঝা সম্ভব নয়, অথচ আজ থেকে হাজার হাজার বছর পূর্বেও কোন মানুষ যদি অপার এই কান্না দেখতো তাহলে অপার কান্নার কারণ বুঝতে পারতো’
‘মি.অর্ণব আপনি কি আমাকে অপার কান্নার কারণ বিশ্লেষণ করে আমাকে সমৃদ্ধ করবেন?’
‘সেটাকি আমাদের কোন কাজে আসবে?’
‘আপনার ক্ষেত্রে এটা হয়তো কোন কাজে আসবেনা তবে আগামীতে নারীদের ইমোশোনাল ডিটেক্ট করতে কাজে আসবে’
‘তার মানে তুমি কি নারীদেরকে বুঝতে চাইছো?’
‘ঠিক তাই, মি. অর্ণব’
‘এইবার তাহলে তুমি মরছো, তোমার ক্লাউড স্টোরেজের অসীমত্ত্ব শেষ হবে, কিন্তু নারীদের মন বোঝা সম্ভব হবেনা’
‘মি. অর্ণব আপনি কি লজিকের বাইরে কিছু বল্লেন?’
‘আগেই তো বলেছি, তুমি শুন্য আর এক এর অংক ছাড়া কিছু বোঝনা’
এইরকম একটি পরিস্থিতিতে অর্ণবের এই ধরনের কৌতুক করা দেখে অপা হাসবে না রাগ করবে তা বুঝতে পারছে না। অর্ণব আবার সিরিয়াস হয়ে গেলেন এবং বলতে শুরু করলেন
‘আজ থেকে প্রায় দশ বছর পূর্বের কথা, তখন আমরা একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, পড়তাম বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পড়া প্রায় শেষ’
‘চুপ কর তুমি, আমি এই ঘটনার কোন গল্প আর শুনতে চাইনা, চুপ কর তুমি, চুপ কর’ বলে অপা কাঁদতে লাগলো।’
‘ওকে ঠিক আছে, আমি আর বলছিনা, তুমি শান্ত হও, প্লিজ’

(তিন)
২০০৮ সাল। অপা ও অর্ণব তখন এক সাথে পড়া লেখা করতেন। দু’জন দু’জনের প্রতি আফিমের মত টান ছিল। এটাকে সাধারণ ভাবে প্রেম বল্লে কম বলা হবে। অপার দিক থেকে আপত্তি থাকলেও অর্ণবের দিক এইরূপ প্রেমে নিবিড় কোন সম্পর্ক অপরাধ বলে গন্য হতে পারে অর্ণব তা কখনও আমলে নেননি। কোন এক সময়ের অসতর্কতামূলক নিবিড় সেই সম্পর্কের কারণেই অপা সগর্ভা হন। অত:পর অপার কান্না-কাটি; আর অপার কান্নাকাটি থামাতেই সাথে সাথে অর্ণব ও অপা বিয়ে করেন। স্বাভাবিক ভাবে দুইজনই কেউই তাদের পরিবারকে জানাতে পারেননি। যদিও তাদের দুই পরিবারের সদস্যদের পুরো ঘটনা জানতে দুইদিনও সময় লাগেনি।

সঙ্গত কারণেই অপার পরিবারের লোকজন এই বিয়ে মানতে সময় নেননি। যদিও বিয়ের স্বাভাবিক ক্যালকুলেশন অনুযায়ী অতি প্রেমীয় ঘটনা না ঘটলে অপার পরিবার থেকে এই বিয়ে মেনে না নেওয়ার আর্থিক সঙ্গতি বিষয়ক যথেষ্ঠ যৌক্তিক ঘটনা ছিল। অপরদিকে বিয়ের পূর্বেই মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনের অপরাধে অর্ণবের পরিবারের কেউ কেউ এবং অর্ণবের পরিবারের চার পাশের মানুষ এই বিয়ে মানেননি। এমনকি এই বিয়ে মেনে না নেওয়ার জন্য অর্ণব অপার কোন দেষ দেখেননি বরং তার পরিবার ও সমাজকে তার ভুলটাকে সকলের দৃষ্টিগোচরীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন।

অর্ণব সব সময় বলতেন, অপা যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে সেই অপরাধের সমস্ত ঘটন পটিয়সী হিসেবে আমিই প্রধান এমনকি আমিই একমাত্র ভূমিকা পালন করেছি। তাহলে শাস্তি কেন অপা পাবে? এই সমস্ত অপরাধের (!) ক্ষেত্রে পুরুষদের পুরুষ হওয়ার গুণে তার সমস্ত অপরাধ প্রায় ক্ষমা করে দেওয়া হয়, শুধু ক্ষমা করেই দেওয়া হয়না বরং পুরুষের সমস্ত অপরাধ নারীর অপারাধের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়। সমাজের এই অদ্ভুত আচরণ অর্ণব মানতে পারেননি। তাই অর্ণবের পরিবার সামাজিক প্রথা মেনে অপাকে বউ হিসেবে ঘরে না তুললেও, অর্ণব অপাকে স্ত্রী’র সামাজিক মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে নিয়মিত অপার বাড়ীতে যাতায়াত করতেন।

স্ত্রী’র এহেন মর্যাদা প্রদানের সময়ে ধর্মীয় মর্যাদায় পালিত হওয়ার জন্য ঈদ প্রায় সমাগত। বাংলা সংস্কৃতির স্বাভাবিক ধারায় ঈদ উপলক্ষে অপার বাবা অপার মাধ্যমে অর্ণবের হাতে বেশকিছু টাকা দেন। শিশুদের প্রতি দু’জনের অপরিসীম ভালাবাসা ও নিজেদের অনাগত শিশুর সম্ভাব্য আগমনের আনন্দে ও তার মঙ্গল কামনার্থে অপার বায়নাতেই চারপাশের সকল শিশুদের ঈদের দিন খাওয়াবে বলে তারা দু’জন সিদ্ধান্ত নেন।

মধ্যম স্বরে গান বেজে চলেছে। শিশুরা গান শুনছে ও নাচানাচি করছে, অপা পরম আনন্দে রাস্তার পাশে চেয়ারে বসে দৃশ্যগুলো অবলোকন করছে। অপা এতটাই আনন্দ পাচ্ছেন যে, অপার কাছে একবার মনে হলো এই আনন্দ পাবার পর তার যদি মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে মানুষ হিসেবে যে স্বল্প কয়েকদিন পরমায়ু তিনি পেয়েছেন সেটাই যথেষ্ঠ। অর্ণব রাস্তার পাশের খেলার মাঠটিতে বাচ্চাদের সাথে আনন্দ করছেন আর কিছুক্ষণ পরপর মাঝে মাঝে রান্নার খবর নিচ্ছেন এবং অপাকে দেখে আসছেন।

অপা যেখানটিতে বসে ছিলেন অর্ণবও অপাকে দেখতে এসে অপার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি ট্র্যাক বিপরীত দিক এসে ধীর গতিতেই তাদেরকে ক্রস করছিল হঠাৎ করে একটি শিশুকে দৌঁড়ে অর্ণবের দিকে ছুটে আসছিল, অপা দ্রুত গিয়ে বাচ্চাটি আটকাতে গিয়ে পা ফসকে ট্র্যাকের পাশে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা লাগে সাথে সাথে অর্ণব অপাকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনিও ট্র্যাকের সাথে ধাক্কা মারেন। অত:পর অর্ণব ও অপাকে বাবা ও মা হবার সক্ষমতা হারাতে হয় এবং ঘটনার অব্যবহিত পরেই অপাকে অপায়া খ্যাতি নিয়েই গ্রাম ছাড়তে হয়।

(চার)
‘সার্চ ইঞ্জিন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মি. অর্ণব আপানার কাছে আমি আবারও জানতে চাইছি, Embryo transfer করে যে সন্তান অপার গর্ভে বড় হবে সেটা আপনি মানতে পারবেন কিনা?’
‘আমার মানতে সমস্যা কেন হবে? সমস্যা যেটুকু হবে তার চেয়ে পিতৃত্ত্বের আনন্দ অনেক বেশি’
‘অপা মানে আপনার স্ত্রী কি মানতে পারবেন? ’
‘হুমম, কথা সত্য অন্যের স্পার্ম ও ডিম্বানু সমন্বয়ে কৃত্রিম উপায়ে গঠিত ভ্রুণ অপার গর্ভে স্থানান্তরে অপার যথেষ্ঠ আপত্তি ছিল কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে আমরা দু’জনে একমত হয়েছি যে, এই বিষয়ে আমাদের দু’জনের কারও কোন আপত্তি নেই’
‘মি. অর্ণব সামাজিক জীব হিসেবে আপনার নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর খুব সামান্য অধিকারই আপনার রয়েছে’
‘মি. রোবট আমি সমাজকে খুব একটা তোয়াক্কা করিনা’
‘ঠিক আছে, তাহলে আজকেই Embryo transfer করে অপার গর্ভের স্থাপন করা হবে’

এই হাসপাতালটি আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কোন রুমে কোন প্রকার এসি স্থাপন করা হয়নি। হাসপাতালের বিল্ডিং-এর ছাদের উপরে এবং চারপাশে সবুজ তৃণ গাছ লাগানো হয়েছে যা হাসপাতালের রুমগুলোর সর্বোত্তম তাপমাত্র বজায় রাখতে সহায়তা করছে। বিশেষ গবেষণার মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ঔষুধগুলো প্রাকৃতিক উপায়ে সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধুমাত্র অতিপ্রয়োজনীয় ক্ষুদ্রাকারের কক্ষগুলোতে কিছু বিশেষ জাতীয় ঔষধ সংরক্ষণের জন্য বা বিমেষ কিছু কক্ষে এসি বসানো আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে অপাকে যে কক্ষে Embryo transfer করে অপার Uterus এ বসানো হবে সেটি মূলত: এসি কামরা।

মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই Embryo transfer করে অপার Uterus এ বসানো হয়েছে। আর মাত্র মাস খানেক বাদেই অপা মাতৃত্ব স্বাদের যন্ত্রণা উপভোগ করতে শুরু করবেন।

(পাঁচ)
রাত সাড়ে বারোটা বাজে। অপার ফোনে রিংটোন বেজে উঠে, আমার মুক্তি আলোয় আলোয় গানটি বেজে উঠলো। সাধারণত অপার ফোনে এত রাতে কেউ ফোন করেনা। অপা মনে মনে ভাবতে লাগলো এত রাতে আবার কে ফোন দিল। সাধারণত বন্ধুর ছদ্মবেশে পুরোনো প্রেমিকরা নস্টালজিক হবার জন্য কখনও কখনও রাতে ফোন দিয়ে থাকে। যদিও সেসব নিয়ে অর্ণবের কোন মাথাব্যাথা নেই। কারণ অর্ণব মনে করে প্রেমকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করলে তা নদীর স্রোতকে বাঁধ দিয়ে রাখার মত হবে, সেই বাঁধ ভেঙ্গে সম্মুখপানে যাবেই বরং প্রেমকে মনের জানালার মুক্ত বাতাসে উড়তে দেওয়া উচিৎ যাতে সে বিশুদ্ধ বাতাসের আশে আবার সেই মনের জানালাতেই ফিরে আসবে।

‘বাবা এত রাতে তুমি? ভালো আছোতো বাবা?’
‘অপা তোমার কি মনে হয়? আমি ভালো থাকলে এত রাতে তোমাকে ফোন দেই?’
‘বাবা আমি তো ভাবছি তুমি খুশিতেই আমাকে ফোন দিয়েছো’
‘আমার তো খুশি হবারই কথা, দেখো অপা, যে কথা শুনে আমার খুশি হবার কথা সেই কথা শুনে আমি খুব রাগ করেছি’
‘বাবা তুমি আমার নাম ধরে ডাকছো?’
‘হ্যাঁ আমি তোমার উপর খুবই বিরক্ত’
‘কিন্তু বাবা, এছাড়া আমার কি করার ছিল? আমাদের হাতে অন্য উপায় থাকলে আমরা সেটাই করতাম’
‘আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃতি এটাকে তো কোন ভাবে উপেক্ষা করা যায়না’
‘আমরা কারও কোন ক্ষতি না করে, সমাজের কোন ক্ষতি না করে শুধুমাত্র Parents হতে চেয়েছি’
‘তোমার সামাজের কোন ক্ষতি করনি কথা সত্য কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছো’
‘না বাবা আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্ত নেইনি’
‘তোমরা ধর্ম সমর্থন করেনা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছো’
‘সমর্থন করেনা আর বিরুদ্ধ আচরণ এক কথা নয়’
‘তুমি কি তোমার বাবার সাথে তর্ক করছো?’
‘তোমার শেখানো মতে যৌক্তিক মতামতের বহি:প্রকাশ তর্ক বা বেয়াদবি নয়, যদি তুমি এটাকে তর্ক বা বেয়াদবি বল, তাহলে আমি ক্ষমা চাইছি, বাবা তুমি যখন আমার নাম ধরে ডাকো আমি তখনই বুঝি তুমি আমার উপর কতটা রাগ করেছো, নাম ধরে ডাকাটাই আমার জন্য বিরাট শাসন’ অপা কাঁদতে শুর করলো।

‘তোমরা কেন বোঝনা, আমাদেরকে এমন এক সংস্কৃতির মধ্যে বাস করতে হয়, যে সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে আমরা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ি; কথা সত্য যে, এই সংস্কৃতি আমাদের শুধুমাত্র কিছু সংস্কারই দেয়, সাথে দেয় বেঁচে থাকার কিছু অস্তিত্ব, দেয় কিছু অভিন্ন আত্ম-পরিচয়’
‘বাবা তোমাদের কাছে যদি, আমাদের থেকে তোমাদের সমাজ সংস্কৃতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে আমরা এমন সংস্কৃতিতে গিয়ে থাকতে চাই, যেখানে আমাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হবে। ’
‘মা, সংস্কৃতি একটা ফলদায়ী বৃক্ষের মত, আমরা প্রতিটি ব্যক্তি বৃক্ষের পাতার মত, যদি কোন পাতা তার বৃক্ষের পোকামাকড় বহন করে তাহলে সেই বৃক্ষের স্বার্থে হয় তাকে পোকা মুক্ত করতে হয়, অথবা সেই পুরো পাতাটাকেই ফেলে দিতে হয়, যাতে সেই পাতা থেকে পুরো বৃক্ষে পোকা না ছড়িয়ে পড়ে’
‘বাবা তুমি এত বড় কথা বলতে পারলে?’
‘আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, আজ মসজিদেও খুতবার আগে তোমাদের এইসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যার যা খুশি তাই বলছে, তোমার মা সারাদিন কান্নাকাটি করেছে, তাকেও যে যা খুশি শুনিয়ে গেছে। তোমরা আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইলে তোমাদের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে অথবা তোমার বাবার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন হয়ে অন্য কোথাও বাস করতে হবে, যেখান থেকে তোমার বাবার কাছে তোমাদের ফিরে আসা সহজ কোন কাজ হবে না’

(ছয়)
‘মি. অর্ণব Embryo transfer এর বাহাত্তর ঘন্টার পূর্বে এইরকম সিদ্ধান্ত অপার শরীরের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানুষের মানুষিক যন্ত্রণা উপলব্ধি করার কোন ক্ষমতা আমাদের প্রোগ্রামারগণ আমাদেরকে দিতে পারেননি। তাই আমি জানিনা যে অপা কতটা কষ্ট পাবে। আমার বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে অনেক কিন্তু হৃদয় দেওয়া হয়নি। কারণ মানুষ কারও হৃদয় দিতে পারেনা। মানুষ শুধু যৌক্তিক কিছু বৃত্তীয় বুদ্ধি দিতে পারে, হৃদয় প্রেম এগুলো শুধু প্রকৃতিই দিতে পারে। যেটাকে আস্তিকগণ ঈশ্বর বলে থাকেন আর আপনারা বলে থাকেন প্রকৃতি। তাই সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি ব্যবস্থার মধ্যে আছে কিছু শৃঙ্খলা, আছে কিছু নিয়ম-কানুন, যা শুধু শৃঙ্খলার নামে শেকল পরায়, পুরো বিষয়টাই হৃদয়হীন, এতটায় হৃদয়হীন যে, অনার কিলিং-এর নামে নারকীয় হত্যাকাণ্ডও ঘটানো হয়ে থাকে। পুরো ব্যবস্থাটাই প্রেমহীন একটি দেওয়াল। যে দেওয়াল ভেদ করে বিজ্ঞানের মহান আবিস্কার, মানবীয় মহান উদারতা কারও কারও মাথায় প্রবেশ করে কিন্তু কারও হৃদয়ে প্রবেশ করেনা। আমি সার্চ ইঞ্জিন থেকে প্রাপ্ত ঘটনা বিশ্লেষণ করে বলতে পারি, আজকের এই ঘটনার পর থেকে অপা আত্মহননের মত সিদ্ধান্তও নিতে পারে।

অর্ণব এই প্রথম রোবটিক এই ডাক্তারে কথার প্রেক্ষিতে কোন কথা বল্লেন না, অর্ণবের সমস্ত আর্ত-চিৎকার অশ্রু হয়ে তৃণ পল্লবে ঘেরা এই হাসাপাতালের মেঝেতে ঝরতে লাগলো।
——————-সমাপ্ত——————-

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের বৈপরিত্য সাদৃশ্যগুলো এই রকম

মিয়ানমার : ০১

ঢাকাতে রাস্তা ও গাড়ী দু’টোতেই জ্যাম হয়, মিয়ানমারে গাড়িতে জ্যাম হয় রাস্তায় না। ঢাকাতে অটোমেটেড ট্রাফিকের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো কোথাও কোথাও কখনও কখনও ব্যবহার করা হয়। ইয়াঙ্গুনে অটোমেটেড ট্রাফিক ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হয় কখনও কখনও নাকি ম্যানুয়াল ট্রাফিক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। ঢাকাতে দামী খাবার আছে তেমনি দামও বেশি নেওয়া হয়, ইয়াঙ্গুনে দামী খাবার আছে তবে দাম বেশি নেওয়া হয়না।

ঢাকাতেও দূর্নীতি আছে, আছে ইয়াঙ্গুনেও, ঢাকাতে দোকানি কোন ভাবে দাম বেশী নিতে পারলে সেগুলো হজম করার সমস্ত আয়োজন করে, ইয়াঙ্গুনে, দোকানিকে ভুল করে ক্রেতার স্বীকৃতিতে টাকা নিলেও ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্থ বিক্রেতাকে নিজ দায়িত্বে টাকা ফেরত দেয় (যদি সম্ভব হয়)।

ধর্মীয় গোঁড়ামি ইয়াঙ্গুনে আছে তবে আপনি ধর্ম বিশ্বাস না করলে ধর্ম বিশ্বাসী আপনার পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, ঢাকাতে আপনি ধর্ম বিশ্বাস না করলে অন্য পাশ থেকে এসে ধর্ম বিশ্বাসীরা আপনার পাশ কেটে দিয়ে যাবে।

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের ধনীরা বিপরীত ধর্মী হলেও দরিদ্ররা কিন্তু একই শ্রেণীর। ইয়াঙ্গুনে সকল নারীই এমনকি Big boobs থাকলেও বক্ষ ঢাকার জন্য অতিরিক্ত কাপড় ব্যবহার না করেই দিন রাত একা একা ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, এমনকি ধর্ষণ যৎসামান্য হলেও নারীর পোষাককে দায়ী করে পুরুষদেরকে পাপমুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় না। ঢাকাতে শিশু ধর্ষণ হলেও নারীদের পোষাককে দায়ী করা হয় এমনকি প্রেমিকের চরিত্র নষ্ট হলেও প্রেমিকার বক্ষ বেষ্টনীর সাইজকে দায়ী করা হয়।

ইয়াঙ্গুনের সাধারণ মানুষের ভাষ্যমতে- রোহিঙ্গাদের সরকার ও সাধারণ মানুষ বের করে দিতে না চাইলেও সেনাবাহিনী বের করে দিয়েছে, ঢাকার মানুষ না চাইলেও সরকার রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে।

অপেক্ষা

(এক)
অপা শহরের ছাদে জন্মগ্রহণ করা টিপিক্যাল বাঙ্গালী এক মেয়ে। অনিন্দ্য সুন্দরী বললে ঈশ্বর বোধহয় তোষামোদ করার দায়ে আমাকে বাড়তি কোন পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন না। তবে পক্ষপাতের দায়ে ঈশ্বরকে এই কারণে দায়ী করা যেতে পারে যে অপার চোখ দুটো ঈশ্বর নিজ দায়িত্বে কোন শিল্পী দিয়ে আঁকিয়ে তা তৈরী করেছেন। অর্ণবের কাছে মনে হয়েছে ঈশ্বরের এই পক্ষাপাতিত্ব নিরপেক্ষ ভাবেই সমর্থনযোগ্য! ঈশ্বরের এই হারানো নিরপেক্ষতার কারণেই অর্ণবের সর্বনাশের সূচনা অধ্যায় শুরু।

অপা ও অর্ণবের পরিচয়টাও ঐ ঈশ্বরের ভূমিকার কারণেই। কোন এক অপরাহ্নে অফিস শেষে অর্ণব ধানমন্ডি লেকের ধারে বৃষ্টিতে ভেজার বিলাসিতা নিয়েই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে হাঁটা-হাঁটি করছিল! অর্ণব কাছ থেকে ১০ মিটার দূরেই তাকিয়ে দেখে একটি একটি মেয়ে নারিকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিতে ভিজছে। চিরায়ত পুরুষপ্রাণীয় আগ্রহের ফলেই অর্ণব পথের গতিপথ ও গতি পরিবর্তন করে মেয়েটির দিকে হেঁটে গেলো।

‘অর্ণব : এক্সকিউজ মি’
‘অপা : ইয়েস প্লিজ ‘ অপা কোন প্রকার শব্দ না করে বিরক্তি নিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালেন।
‘অর্ণব : আপনাকে আজ আমাদের অফিসে দেখলাম, না?’
‘অপা: কোন অফিস আপনার?’
‘ঐ যে ১৫ নং রাস্তার পূর্ব দক্ষিণ কোণে’
‘জ্বি দেখেছেন’ অপা স্বলজ্জ ভাবে উত্তর দিল!
‘কিছুক্ষণ আগে আপনাকের আমাদের অফিসে আবির্ভূত হতে দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল আপনি বোধ হয় আমাদের অফিসে আধুনিক দাসত্ব চর্চায় আমাদের সহসঙ্গী হতে যাচ্ছেন’
‘মানে?’
‘মানে টানে কিছু নেই, বৃষ্টিতে কেন ভিজছেন? বলুন, ‘
‘বলতে পারেন এটা একটা বিলাসিতা’
‘ওয়াও, আচ্ছা বলুনতো ঈশ্বরের সাথে কি আপনার কি কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে?’
‘মানে?’
‘আপনি বার মানে মানে কেন বলছেন আমি তার মানে বুঝছি না’
‘আধুনিক দাসত্ব, ঈশ্বরের সাথে আত্মীয়তা, এই সব বাক্য শুনলে, যে কেউ মানে মানে বলবে, সেটা কি স্বাভাবিক নয় ‘
‘এই স্বাভাবিক শব্দটা না সব সময়ই আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়’
“মানে?’
‘আবার মানে, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ’
‘কোথায় যাবেন বলুন’
‘মোহাম্মদপুর যাব’
‘আমিও তো ঐদিকে যাব, আপনি যাবেন আমার সাথে?’
‘আমি সদ্য গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা ছেলে, যে এই ঢাকা শহরের কোলাহল, ধুলোবালি, নির্মমতা, চাপাবাজ ইত্যাদির সাথে তাল মিলিয়ে চলার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, এর মধ্যে আবার আপনার মত সর্বজন স্বীকৃত একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে হাঁটা শিখতে হবে সেটা আমার জন্য অধিক্রমণ হয়ে যাবে না?’
‘কেন? আপনি কি কখন কোন মেয়ের সাথে রাস্তায় হাঁটেননি?’
‘অবশ্যই হেঁটেছি, তবে তারা হয়তো বা মেয়ের মা অথবা যে সব মেয়েরা সদ্য মেয়ের মা হয়েছেন সেই সব মায়েদের মেয়ে. .হ্যাঁ.হ্যাঁ’
‘নিজের কথা নিজে শুনেই মজা পেয়েছেন মনে হচ্ছে?’ প্রশ্নটি করে অপাও হাসতে লাগল।
‘তা পেয়েছি বৈকি, চলুন যাই, মোহাম্মদপুর যাবেন বলছিলেন’
‘না, আমি একা যেতে চাই, আপনার সাথে যাব না’
‘কেন যাবেন না, এই প্রশ্নটা কি উদ্ধ্যত হয়ে যায়?’
‘যাবনা এই কারণে যে, আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছেন’
‘আপনার কি মনে হয়? আপনার বয়ফ্রেন্ড এখন এইদিকে আসবে? তবে এই কথাটা কিন্তু খুব সত্যি আমি আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্যই এইভাবে কথা বলে আসছি’
‘মানে? ইমপ্রেস করার স্বীকার উক্তিটাওকি ইমপ্রেস করার জন্য?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারতো মনে হয়, আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য শেষের স্বীকারোক্তীমূলক বাক্যটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী’

বৃষ্টি থেমে গেছে, অপা দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো। অর্ণব বেশ দুরুত্ব বজায় রেখে অপার পিঁছে পিঁছে হাঁটতে শুরু করলো। অর্ণব প্রত্যাশা করছিল অপা পেঁছন ফিরে তাকিয়ে তাকে একসাথে হাঁটার প্রস্তাব দিক। কিন্তু অর্ণবের যতদূর মনে পড়ে এইরকম অতি প্রত্যাশিত বিষয় কখনও ভাবনার সাথে মেলেনা এবং এটা যে মিলবে সে ব্যাপারে অর্ণব নিশ্চিত। অর্ণব সাধারণত সিগারেট টানে না কিন্তু অর্ণবের কেন জানি মনে হচ্ছে সে একটা সিগারেট ধরাবে এবং সিগারেট টানতে টানতে দ্রুত হেঁটে মেয়েটিকে অতিক্রম করবে।

‘এই একটা সিগারেট দাওতো’ অর্ণব সিগারেটটি হাতে নেওয়ার আগেই কেউ একজন তাকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য পেছন থেকে বলে উঠলেন
‘এক্সকিউজ মি’
‘আরে আপনি?’ অর্ণব বড্ড বেশিই আশ্চর্য হয়ে গেলো।
‘আপনি সিগারে টানেন নাকি?’
‘না না ‘
‘তাহলে কিনছেন যে’
‘সিগারেট টানি না, আজকে আপনাকে দেখানোর জন্যই সিগারেট টানতে চাইছিলাম’
‘মানে?’
‘আবার মানে?, হ্যাঁ হ্যাঁ’
‘চলুন দুইজন একসাথে হাঁটতে হাঁটতে যাই’
অপার এই প্রস্তাবে অর্ণব খুশি হয়ে সিগারেট টা ফেলে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল
‘আচ্ছা আপনি কি কাজ করেন?’
‘আমার একমাত্র কাজ হচ্ছে আমি কোন কাজ করি না, হ্যাঁ, হ্যাঁ’
‘মানে’ এই মানে শব্দটি বলে নিজেই হেসে উঠলো।
‘তবে এইবার আপনার মানের জবাব দেব, প্লেটোর একটা কথা আছে, সেটা হলো ‘একজন জ্ঞানী মানুষকে শ্রম থেকে অব্যাহতি দিতে হয়, তাকে অন্যের উপার্জিত খাবার খেয়ে থাকতে হবে, আর জানেন তো সেই কারণে দেখবেন দরিদ্র দেশে জ্ঞানী মানুষের অভাব দেখা দেয়’
‘তার মানে আমাদের দেশ ধনি হয়ে যাচ্ছে?’
‘সরকার তো তাই বলে’
‘হু বুঝছি’
এইবার দুইজন একসাথে হাসতে শুরু করলো ।

(দুই)
‘বিবাহ বিষয়টি সমাজ মানুষের প্রয়োজনে একটি সময় এটিকে একটি সামাজিক প্রথা হিসেবে প্রচলন করে; কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের ফলে এটি প্রয়োজন আছে কিনা সে বিষয়ে আমাকে আরও ভাবতে হবে বা পড়াশোনা করতে হবে; অতঃপর মন্তব্য করতে হবে। তবে এই বিষয়ে বাট্রান্ড রাসেলের বইতে যতটুকু পড়েছি তাতে মনে হয়েছে, একটা সময় অবাধ যৌনতার কারণে যৌনবাহিত রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছিল এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধিহার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল যা নিয়ে সমাজপতিগণ চিন্তিত ছিলেন। সুতরাং তাদের কাছে মনে হয়েছিল যৌনতা বিষয়ক মহামারি রোগ এবং জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্যই বিবাহ নামক প্রথা চালু করা দরকার। যেহেতু এখন আর এই সমস্যা দু’টি নেই সুতরাং ‘
‘সুতরাং থামাবেন আপনার এই লম্বা বক্তব্য, আপনার এই লম্বা বক্তব্যের মতলব আমি খুব ভালমত বুঝেছি।’
‘এটাকে মতলব বলছো কেন? বল, কুমতলব!’
‘আচ্ছা আপনার এই কুমতলবী কথা বলতে লজ্জা লাগেনা’
‘না লাগে না, কারণ আমি আমার সমস্ত লজ্জা আমার পোষাক দিয়ে ঢেকে রাখি।’
‘ওগুলো পোষাক দিয়ে ঢেকে রাখার কি দরকার? পোষাক গুলো খুলে রাখলেই তো পারেন।’
‘দেখো, আমার তাতে কোন সমস্যা হবে না, যা সমস্যা তোমার হবে।’
‘উফফ, আপনি এত বেশি আজায়রা কথা বলতে পারেন’
‘ঠিক আছে, আমি চুপ থাকছি, আর কথা বলবো না’
‘এত রাতে ফোনে কেউ এই সব কথা বলে?’
‘আমার তো মনে হয় এই রাতে ফোনে কথা বলার জন্য এর চেয়ে ভালো টপিকস আর হতে পারে না’
‘আপনি থামবেন? এত বাজে কথা শোনার অভ্যাস বা সময় কোনটাই আমার নেই’
‘ওকে, আজ তাহলে রাখি’
‘রাখি মানে? আমি রাত জেগে কথা বলছি, আর আপনি রাখবেন’
‘তুমিই তো বল্লে কথা শোনার সময় নেই’
‘আমার শোনার সময় থাকুক বা না থাকুক আপনার তো বলার সময় আছে, বলে যান, আমি চুপ করে থাকি’
‘একটা কবিতা শুনবে? কবিতা’
‘না কবিতা শুনতে আমার ভালো লাগেনা, পারলে গান গেয়ে শোনান’
‘না গান আমি শুধু পৃথিবীতে একজনকেই শোনাতে পারি, আর কাউকে শোনাতে পারিনা’
‘কাকে শোনাতে পারেন?’
‘ সেটা আপাতত বলতে চাইছি না, পরে বলব’
‘ওকে বলার দরকার নাই’
‘আচ্ছা আমার কথা বাদ দাও, তোমার কথা শুনি, তোমার ঐ ভেড়া বয়ফ্রেন্ডের কথা বল?’
‘আপনার সাহস তো কম নয়, আপনি আমার সাথে আমার বয় ফ্রেন্ডকে ভেড়া বলছেন’
‘এটা সাহস নয়, সত্যি, আর তাছাড়া আমি নিশ্চিত যে, তুমি তোমার বয় ফ্রেন্ডকে এখন আর খুব একটা পছন্দ করনা, কারণ, তোমার বয়ফ্রেন্ড সব সময় তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এই নিয়ন্ত্রণ তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের ভালবাসার বহি:প্রকাশ হিসেবে দেখো কিন্তু তুমি আনমনে এটাকে অপছন্দও কর, প্রকৃতপক্ষে এটাকে তুমি অপছন্দই কর কিন্তু তার এই নিয়ন্ত্রণের ন্যায্যতে দিতেই তুমি মনে মনে ধরে নিয়েছো বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড ভালোবাসার বহি:প্রকাশ ঘটাতেই তারা পারস্পারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তুমি নিশ্চয় জানো, দূর্বল ব্যক্তিরা যেমন হিংস্র হয় তেমনি ভাবে দূর্বল ও নিজের প্রতি আস্থাহীন হয়ে থাকে; তেমনি ভাবে দূর্বল মননের প্রেমিক প্রেমিকারা অন্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেই নিয়ন্ত্রণ আবার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণহীন’
‘আপনি নিজেকে খুব জাহির করতে চান, না? আপনি মনে করেন আপনি খুব জ্ঞানি, তাই না?’
‘তোমার এই প্রশংসগুলো কিন্তু সত্যি ‘
‘কে বল্ল আমি আপনাকে প্রশংসা করলাম?’
‘তুমি’
‘উফফ’
‘শোন একজন অপরাধী পুরুষ হিসেবে আমি কিছু দোষ স্বীকার করছি, আমি তোমার অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি’
‘সেটা কেমন?’
‘ সেটা পরে বলব, আজ তাহলে রাখি’
‘ওকে ঠিক আছে রাখি’

(তিন)
বিবাহ নামক তিন অক্ষরের এই শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো শব্দ, যেখানে আবার প্রতিটি শব্দের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রিকতা। বিবাহ শব্দের সাথে দায়িত্ব, প্রতিশ্রুতি, বিশ্বস্ততা এইসব ব্যুতপত্তিগত শব্দের ভার বহনে সিদ্ধহস্ত পুরুষগণ আজ ভারাক্রান্ত। দায়িত্বের অবহেলা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা এবং বিশ্বাস ভঙ্গের মত ঘটনা এখন সর্বজ্ঞাত এক গোপন ঘটনা। অবশ্যই এক্ষেত্রে ধর্মীয় সংস্কৃতির বলয়ে গড়ে উঠা অনুভূতিহীন নারীদের সহানুভূতির কারণেই পুরুষ সমাজ একক ভাবে তাদের গ্রাসী অভিজান অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

অর্ণব বিবাহত্তোর এইসব আরোপিত চর্চাগত বিষয়গুলো এইকালে কতটা প্রযোজ্য সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছে কিন্তু প্রবাহমান সমাজ ব্যবস্থায় আক্রান্তু নারীগণ যথাযোগ্য সম্মান বা মর্যাদা বা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাসহ বাঁচার প্রশ্নে আটকে গেছে। আবেগিক বিষয়গুলি অবশ্যই সামাজিকীকরণ বলেই তিনি মনে করেন।

বিবাহত্তোর বগুগামিতা নিয়ে অর্ণব দ্বিধাবিভক্ত। বৈচিত্রময় প্রকৃতিগত জৈবিক চাহিদা তার কাছে গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়। তবে সামাজিকীকরণের দীর্ঘ প্রবাহমান ধারা যা সামান্য বিতর্কসহ হাজার বছর ধরে টিকে আছে তা যদি অগ্রহণযোগ্যই হবে তাহলে তা এতদিন টিকে থাকবে কেন। যদিও সমাজে অনেক ধোয়াসাময় সত্য বা দিনের আলোর মত অসত্য হাজার বছর ধরে টিকে আছে।

এহেন নিষ্ফলা চিন্তাগুলোই অর্ণবের নি:সঙ্গ সময়ের নিত্য সঙ্গী।

এমন সময় অর্ণবের ফোনে রিং বেজে উঠলো
‘তুমি কোথায়?’ কল রিসিভ করে অর্ণব অপাকে জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি শাম্পানের পাশে দাঁড়িয়ে আছি’
‘সামনের দিকে তাকিয়ে দেখো তুমি আমাকে দেখতে পাবে’
‘হ্যাঁ আমি দেখতে পেয়েছি, আপনি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন’
ফোনটি পার্সে রেখে অপা অর্ণবের কাছে পৌঁছে গেলো। অপার অর্ণবের হাত ধরে হাটতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু সম্ভবত: তাদের সম্পর্ক বিষয়ে তথাকথিত সামাজিক আড়চোখা দৃষ্টির ভয়েই অপা তা করছে না।
‘আমার হাত ধরে হাঁটতে তোমার খুব ইচ্ছে করছে তাই না?’
‘কেন, আপনার এইরকম কথা মনে হলো কেন?’
‘আমি যখন গ্রামে থাকতাম এই রকম আবহাওয়ায় বুক সমান পাটগুলো বাতাসে দোল খেতো, দেখে মনে হতো সুন্দরী অপ্সরারা বাতাসের বিপরীতের তাদের চুলগুলো মেলে ধরেছে, আর আমি সেই পাটগাছগুলোকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরতাম; পাটগাছগুলো বুকে জড়িয়ে ধরার পর আমি প্রচন্ড আনন্দ পেতাম। কিন্তু আমার সেই মনে হওয়ায় অপ্সরাদের আমি কখনও দেখবো বা দেখতে পাবো সেই সাহস কখনও পেতাম না। এখন মনে হয়…. ‘
‘এখন কি মনে হয়?’
‘এখন মনে হয়, তুমিই সেই অপ্সরা’
‘আপনার কাছে নিশ্চয় একটা পাটগাছকেই একটা অপ্সরা মনে হতো?’
‘হুম, তা বলতে পারো’
‘তা না হলে তো আপনার চরিত্রের সাথে মিলবে না’
‘আমার বুকে একশো’টা তুমি আসলে, সেই এক’শো তুমিকেই আমি আঁকড়ে ধরবো, তাতে যদি তুমি আমাকে চরিত্রহীন বলে থাকো তাহলে সেই চরিত্রহীন শব্দটি আমার জন্য বিশেষায়িত আশির্বাদ শব্দ বলেই ধরে নেব’
‘উফ, আবার ফ্লাটারি?’
‘হুম, আর এই ফ্লাটারির কারণেই তুমি আমার হাত ধরে হাঁটতে চাইবে’
‘আচ্ছা আপনার কি মনে হয় আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড?’
‘আচ্ছা সেটা না হয় লোক চক্ষুর আড়ালের গিয়েই বলবো, তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড, কিন্তু এই লৌকিক সমাজে তুমি, আমাদের সম্পর্কের কি নাম দিবে?’
‘আপনি দেখছেন? আকাশে কি সুন্দর মেঘ করেছে?’
‘তানাহলে এতক্ষণ তোমার সাথে পাট ক্ষেতের গল্প কেন করবো? চল তোমার প্রশ্রয়ে কোথাও আশ্রয় নেই, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি নামতে পারে’
‘আমি বৃষ্টিতে ভিজবো’
‘বৃষ্টিতে ভিজবে মানে?’
‘তোমার আমার যে সম্পর্ক তাতে কি বৃষ্টিতে ভেজা যায়?’
‘আপনার কাছে কেন মনে হলো আমি আপনার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো’
‘ঠিক আছে, তুমি ভিজতে থাকো, আমি ঐ শপিং মলটাতে গেলাম’
‘কোথাও যাবেন না, আপনি আমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজবেন, যতক্ষণ বৃষ্টি হয় ততক্ষণ ভিজবেন’
‘তুমি দেখছো প্রচন্ড বজ্রপাত হচ্ছে?’
‘বজ্রপাত হচ্ছে তাতে কি হয়েছে? মরলে এক সাথে মরবো’
‘সে না হয় মরা গেলো, কিন্তু তাতে সমস্যা হলো, মৃত্যু বরণ করে প্রেমের প্রমাণ দিলে না হয় প্রেমের ঐতিহাসিক গল্প তৈরী হবে; কিন্তু মৃত্যবরণ গ্রহণের মাধ্যমে যদি প্রমাণ হয় যে আমি অপরাধ করেছি’
‘আপনার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে যদি বজ্রপাতে দুইজন একসাথে মৃত্যুবরণ করি তাহলে প্রমাণ হবে, প্রেমিকযুগল শুধু প্রেমের অপরাধে নয় অপরাধের প্রেমেও মৃত্যু বরণ করতে পারে’
‘দারুন বলেছো তো’
‘বাদ দেন তো, বৃষ্টির এ সময়টা আমি অন্য কিছু ভাবতে চাইনা ‘
অপা অর্ণবের হাত ধরে দৌঁড়াতে লাগলো, প্রচন্ড রকমের বৃষ্টি হচ্ছে। সাতাশ নং এর এই রাস্তাটি বৃষ্টির পানিতে পুরোপুরি ডুবে গেছে। বৃষ্টির সাথে তীব্র ঝড় ও বজ্রপাত শুরু হয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করেছে কিন্তু অজানা এক কারণে অপা মোটেও কাঁপছেনা এমনকি তার এতটুকু শীত লাগছে বলে মনে হয় না। হঠাৎ করে অর্ণবের মনে হলো তার ব্যাগে ল্যাপট রয়েছে কিন্তু সে ভাবনাকে পাত্তা না দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। বৃষ্টির পানিতে অপা ও অর্ণবের শরীরে তাদের পোষাকগুলো সেটে গেছে। অর্ণব হঠাৎ করে লক্ষ্য করলো কয়েকজন যুবক দূর থেকে তাদেরকে লক্ষ্য করছে।
‘একটু দাঁড়াও’ অর্ণব অপাকে বল্ল
‘কেন?’
‘তোমার কাপড়গুলো একটু সামলে নাও’
‘অপা তার পোষাকগুলো ঠিক করতে লাগলো’
হঠাৎ করে বৃষ্টি থেকে গেলো। অর্ণব ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলো
‘আপনি খুব ভয় পাচ্ছেন না?’
‘হুম পাচ্ছি’
‘কিসের ভয়?’
‘দায়িত্বের ভয়, যে প্রতিশ্রুতি কখনও দেইনি, সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ভয়’
‘আপনি ভয় পেতে থাকেন, আমি শুধু এইটুকুই বলবো, যে সময়টুকু আপনি আমাকে দিলেন, তা আমার জীবনের একমাত্র সেরা সময় কিনা জানিনা তবে অন্যতমা সেরা সময়তো বটেই’
‘আমি তোমাকে বলতে পারি, এটা আমার জীবনের সেরা সময়’
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায়…
ডেডিকেটেড রিংটোনটি অর্ণবের ফোনে বেজে উঠলো।
‘কে ফোন করলো?’
‘আমি যার কাছে বন্দি’

(চার)
কিছু বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গৃহীত অবস্থান অর্ণবের কাছে ভুল অবস্থান বলে মনে হয় বরং সেই সকল বিষয়ে দ্বিধান্বীত অবস্থানই সঠিক অবস্থান বলে মনে হয়। যেমন বিয়ে নামক যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান তিলে তিলে সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে তা যে ভুল তাও তার কাছে মনে হয়না; আবার সেটা যে সঠিক তাও তার কাছে মনে হয়না। বিশেষত: উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে স্ত্রীকে ভাল না বেসে স্বামী সারা জীবন ঘর করছে সেটা কতজনের ক্ষেত্রে কতটুকু সত্য জানা না থাকলেও এটা জানা যে, হাজার হাজার স্ত্রী তার স্বামীকে ভাল না বেসেও যুগের পর যুগ ঘরসংসার করে যাচ্ছে। সেটা এই কারণে যে, এই উপমহাদেশের স্ত্রী পদমর্যাদায় বা পদঅমর্যাদায় যে সকল নারী অধিষ্ঠিত রয়েছে তাদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড একদম নেই বল্লেই চলে। তার মানে যদি এই উপমহাদেশের নারীরা অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ বা শক্তিশালী হতো তাহলে কি সংসার নামক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী কোন রূপ পরিগ্রহ করতো না? সেটা যদি না হতো তাহলে কি কোন সমস্যা হতো? নিজের সাথে নিজেই এই তর্ক করতে করতে অর্ণব সংসদ ভবন রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে ফুটপথ দিয়ে হাটতে হাটতে আসাদ গেট অব্দি পৌঁছালো। ডান পকেটে রাখা ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো।
‘অপা তুমি কোথায়?’
‘আপনি আপনার ডান দিকে তাকান’
‘তুমি এখানে কতক্ষণ পৌঁছালে?’
‘এইতো এই মাত্র’
‘আজকে কোথায় যাবে?’
‘চলুন নতুন কোন পথ আবিস্কার করি’
‘আমরাতো নতুন পথেই আছি’
‘মানে?’
‘আবার মানে?’
‘অপা তুমি কি গান ছেড়ে দিলে?’
‘আমার বয়ফ্রেন্ড চায়না, তাই ছেড়ে দিয়েছি’
‘সেটা কি তার প্রতি ভালবাসা থেকে, নাকি তাকে করুনা করে?’
‘আমি ঠিক ওকে এখন আর বুঝিনা। আপনি জানেন ঐ মানুষটাকে ভুলে থাকার জন্য আমাকে আমার পরিবার কানাডায় পাঠিয়ে দেয়, সেখানে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমার বড় বোন ভাল পাত্রও ঠিক করে রাখে কিন্তু আমি কাউকেই বিয়ে করতে পারিনি। আমিও ভেবে ছিলাম ছয়মাস ওকে ছেড়ে থাকলে ভুলে যেতে পারব, তারপর একজনকে বিয়ে করে ঘর সংসার করবো; কিন্তু ওকে কিছুতেই ভুলতে পারলাম না। কানাডা থেকে আবার দেশে ফিরে আসলাম, আবার ওর সাথে যোগাযোগ করলাম’
‘তারপর?’
‘এখন ওর সাথে সরাসরি দেখা হয় খুব কম। কথা যা হয় মোবাইল ফোনে, কিন্তু কথা বলতে যা হয়, সব সময় ঝগড়ায় হয়। ও কেন জানি আগের মত আমাকে আর বোঝেনা। এখন মনে হয় সে সময় কাউকে বিয়ে করে নিলেই ভালো হতো ‘
‘ওনি কেন তোমাকে বোঝেন না?’
‘সেটা তো ঐ বলতে পারবে’
‘ওনি তোমাকে বোঝেন না, আমার কিন্তু তা মনে হয়না’
‘আমার তো মনে হয় তুমিই এখন তোমাকে ঠিকমত বোঝনা’
‘বুঝলাম না’
‘ওকে বুঝিয়ে বলছি, তোমার মনে আছে? আমি তোমার সাথে প্রথম বার যেদিন লেকের মধ্যে হাঁটতে বেরুতে যায় সেদিন তুমি আমার সাথে ওর গল্প করতে করতে কেঁদে ফেলেছিলে?’
‘হুম, সেদিন আপনি ওর বিষয়ে খুব উল্টাপাল্টা কথা বলছিলেন, আপনার মুখে ওর বিষয়ে সেই কথাগুলো শুনে এক ধরনর আশ্চর্য রকম বিরক্ত হচ্ছিলাম, আসলে ওটাকে বিরক্ত বলা বোধ হয় ঠিক হবেনা।’
‘হুম, ওটা আসলে বিরক্ত ছিলনা বরং নিজের ও তোমার বয় ফ্রেন্ডের বিষয়ে তোমার ত্রিশ বছরের জীবনের ঐরকম সব সত্যি কথা শুনে তুমি একদিকে যেমন আশ্চর্য হচ্ছিলে অন্যদিকে আমার কথা শোনার প্রেক্ষিতে তোমার জীবনের নতুন উপলব্ধি তোমাকে কষ্টও দিচ্ছিল’
‘হুম আপনি ঐ দিনও এই কথাগুলো বলছিলেন’
‘বিশেষত আমাদের দেশের নারীরা প্রেম ও বিয়ের ক্ষেত্রে একধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে, বিয়ের পরে বা কিছু ক্ষেত্রে প্রেমের পরে তার জামাই বা বয়ফ্রেন্ডের অধিনস্ত হয়ে চলবে অন্যভাবে বলতে গেলে তারা দাসত্ব চর্চার মাধ্যমে সময় অতিবাহনই সুখি সময় পার করার সবচেয়ে ভালো কৌশল বলে মনে করে। এবং এটা তুমি একটা সময় ভালো ভাবে রপ্তও করেছিলে তারপর কপালক্রমে নগরীর অরবিটে তোমার আমার দেখা হলো, সেখানে আমি এক নতুন পৃথিবী তোমার কাছে পেলাম, তুমি এক নতুন পৃথিবী আমার কাছে পেলে, সেখানে কার লাভ হলো বা কার ক্ষতি হলো সেটা জানিনা, তবে দু’জনায় দুই ধরনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলাম, তবে সেই সমৃদ্ধি সুখকর কিনা জানিনা, তবে তার মুল্য ভালমত দিতে হচ্ছে, মনে হয় আরও কিছুদিন তা দিতে হবে।’
‘আপনি কি বলতে পারেন আমাদের পরের গল্প কি হবে?’
‘তুমি যদি তোমার আমার এই সম্পর্কের গল্প জিজ্ঞেস কর, তাহলে এই গল্প যদি কোন পরণতি পায় তাহলে সেটা হবে ভয়াবহ, আর যদি পরিণতি না পায় তাহলে হবে অপরিণত’
‘আচ্ছা আপনি কি কোন কথা সহজ করে বলতে পারেন না? সব সময় ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলেন’
‘উত্তরটা সহজ হলেই তো উত্তর দেব, উত্তরটা কঠিন বলেই ঘুরিয়ে পেচিয়ে সঠিক উত্তরটা উপেক্ষা করি বা এড়িয়ে চলার কৌশল অবলম্বন করি, বলতে পারো এক্ষেত্রে আমি পলেটিসিয়ান’

(পাঁচ)
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, নানান বিষয়ে স্ববিরোধী অবস্থানই অর্ণব সঠিক অবস্থান বলে মনে করে। উদহারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একজন মানুষ যদি তার একাধিক সন্তানকে ভালবাসতে পারে এবং এক্ষেত্রে সেই লোকটি কখনও তার একজন সন্তানকে ভালোবাসার জন্য দ্বিতীয় সন্তানকে বালবাসেনা বা কম ভালবাসে তা হয়না। তাহলে একজন নারী বা পুরুষ একাধিক নারী বা পুরুষ ভালবাসলে অপর পুরুষ বা নারী কেন তা মানতে পারেন না। এটাকি ঐ মানুষটার পরম্পরায় পাওয়া হাজার বছরের সামাজিকীকরণ মন নাকি প্রকৃতি প্রদত্ত প্রাকৃতিক কোন ফেনোমেনা।

‘হ্যালো অপা তুমি কোথায়?’
‘মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ের দক্ষিণের রাস্তায়’
‘দেখো আমি তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি’
অর্ণব এব অপা প্রায় প্রতিদিনই অফিস ছাড়ার পূর্বে এসএমএস করে কোথায় তারা সাক্ষাৎ করবে তা জানিয়ে দিত।
‘কি ভাবছেন?’
‘একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছো অপা, একসাথে একজন মানুষকে ঘৃণা করা অপরাধ বা অন্যায় এবং একসাথে একাধিক মানুষকে ঘৃণা করা আরও অপরাধ বা অন্যায়, কিন্তু একসাথে একনজ মানুষকে ভালবাসা ন্যয় কিন্তু একসাথে একাধিক মানুষকে ভালবাসা অন্যায়’
‘আপনার মাথায় শুধু উল্টোপাল্টা চিন্তা’
‘সময় কিন্তু এই সব উল্টোপাল্টা চিন্তা করতে বাধ্য করছে’
‘সেটা কিভাবে?’
‘দেখো এই মুহূর্তে তুমি কিন্তু একধরনের অপরাধবোধে ভুগছো’
‘কেন আপনি ভুগছেন না? আপনি তো আমার চেয়ে বেশি অপরাধ করছেন?’
‘না আমার কাছে এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি যে আমি অপরাধ করছি’
‘কেন?’
‘একজন নারীর প্রেমে পড়ার জন্য তার বাহ্যিক সৌন্দর্যকে আমি যদি গৌণ বিষয় হিসেবে ধরে নেই তাহলে তোমার প্রেমে পড়ার অনেকগুলো মৌলিক বিষয় আছে বলে আমি মনে করি।’
‘যেমন?’
‘যেমন তোমার মধ্যে মানুষকে ভালবাসার, মানুষকে শ্রদ্ধা করার অসামান্য গুন আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি কিন্তু দারুন গান গাইতে পার সাথে নাচতেও পার, তোমার বাচন ভঙ্গি অসাধারণ এবং তোমার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য্য তোমার ছেলেমানুষী, এইরকম একজন মানুষকে ভালবাসব তাতে আমার অপরাধ কেন হবে? তুমি কি কখনও দেখেছো একটা গোলাপকে পছন্দ করার পর অন্য গোলাপকে পছন্দ করার কারনে অপরাধবোধে ভুগছো ?’
‘কিসের সাথে আপনি কি মেলাচ্ছেন?’
‘মেলাচ্ছিনা, তথাকথিত সমাজের চোখের আমার অবৈধ প্রেমের বৈধতা দেওয়া চেষ্টা করছি মাত্র, হ্যাঁ আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে খুব ভালবাসি, তুমি অনুমতি দিলে আমি গলা চিৎকার করে বলতে পারি আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ভালবাসা কেন আমার অপরাধ হবে? আমি তো কাউকে কথা দেইনি যে, আমি অন্য কারওর প্রেমে পড়তে পারব না’
‘পুরুষ মানুষ হিসেবে আপনি সহজেই কোথাও লুকাতে পারেন, কিন্তু আপনি ভেবে দেখেছেন, এসব কথা শুনে আমার কি হবে? আমি কি করব? আপনি হয়তো সহজেই সব কিছুই ম্যানেজ করে চলতে পারবেন, আমি, আমি কি পারব? আপনি চলে যান, আমি বাসায় যাব’
‘আমি তোমাকে তোমার বাসার কাছা-কাছি পৌঁছে দেই?’
‘আমি জানিনা আপনি কি করবেন? আমি বাসায় চলে যাব’
‘একটু হাঁটি চল’
‘একদম না, আমি এখনই বাসায় যাব, আপনার মাথাটাতো গেছেই, আর কিছুক্ষণ থাকলে আমার মাথাটাও যাবে’ কথা শেষ করে অপা তার বাসার দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। অর্ণবও অপার পেঁছনে পেঁছনে ছুটতে লাগল।

অপা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্ণবকে জিজ্ঞেস করল-
‘আমি একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব, সরাসরি উত্তর দেবেন, কোন প্রকার পেচিয়ে উত্তর দেবেন না’
‘যদি সরাসরি উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার না থাকে?’
‘তবুও আপনাকে সরাসরি উত্তর দিতে হবে’
‘আচ্ছা তোমার প্রশ্ন কর’
‘আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’
অর্ণব চুপ করে থাকল, অর্ণবের কাছে এটি এমন এক প্রশ্ন, যার উত্তর হিসেবে এই মূহুর্তে হ্যাঁ বা না কোনটি ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্ণবের নেই।

(ছয়)
একান্নতম বারের মত অর্ণব অপার ফোন নাম্বারে ডায়াল করল, ফোন বাজতে লাগল..
বায়ান্নতম….তিপান্নতম…চুয়ান্নতম… করতে করতে যখন ডায়াল সংখ্যা নব্বইতমবার হলো তখন অর্ণব চিন্তা করল আর মাত্র দশবার অপার নাম্বারে ডায়াল করবে। এইবার শততম বার ডায়াল কল করল। তবুও অপা অর্ণবের ফোন রিসিভ করল না। অর্ণব পূর্ববর্তী প্রেমের ক্ষেত্রেও নানান ঘটনাকে কেন্দ্রকরে কোন এক মেয়ে সর্বোচ্চ দশবার ডায়ালর করেছিল, সেক্ষেত্রে প্রথম দুইবার স্বাভাবিক ডায়াল ছিল বাকি আটবার ছিল ইগো থেকে কিন্তু আজ তিনি এক থেকে একশততম বার প্রত্যেকবারই ডায়াল করেছে ভালবাসার ইনটেনসিটি থেকে। অপা যতবার অর্ণবের ফোন কল রিসিভ করা থেকে বিরত থেকেছে ততগুণন অর্ণবকে মনের যন্ত্রণায় পুড়তে হয়েছে। অর্ণব প্রচণ্ড মন-যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত ও সম্পূর্নরূপে বিদ্ধস্ত। পারিবারিক পরজীবি হিসেবে এখন তার একমাত্র দায়িত্ব হলো সমস্ত যন্ত্রণাকে জলে দিয়ে অফিস শেষ করে সংসগারফেরতগামী একজন সমাজ স্বীকৃত দায়িত্বশীল পুরুষ। এই অভিনয়টা বিগত ছয় মাস যাবৎ অর্ণব ঠিকমত করে চলেছে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে বলে অর্ণব তা মনে করেনা।

বাসাভাড়া বাবদ খরচ সাশ্রয়ের জন্যই অর্ণব লিফ্ট বিহিন এক সাত তলা বিল্ডিংএর পঞ্চম তলায় ভাড়া নিয়ে থাকেন। বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ণব কলিংবেল চাপতে লাগলো।
‘ কে?’ দরজার ওপাশ থেকে অর্ণবের ছেলে জিজ্ঞেস করল।
‘বাবা আমি’
‘অফিস থেকে ফিরতে তোমার এত দেরী হল কেন বাবা?’
‘ভাল আছো বাবা?’ অর্ণব পাঁচ বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘তনিমা এইদিকে আস, ব্যাগটা ধর, দেখো বাবা কোল থেকে নামতে চাইছে না’
‘ওকে তুমি আমার কাছে দাও, সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছো, যাও ওয়াশ রূমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, জুস বানানো আছে খেয়ে বস, তারপর বাবাকে আদর কর’
‘আমি তোমাকে আমার ব্যাগটা ধরতে বলছি ব্যাগ ধর, ওকে ধরতে হবেনা’
‘কি ব্যাপার এত সহজে বিরক্ত হচ্ছো কেন?’
‘ও সরি’
‘তোমাকে রীতিমত বিদ্ধস্ত লাগছে, আজকে নিশ্চয় অফিসে অনেক পরিশ্রম করেছো?’
‘অফিসে বেশি পরিশ্রম করলে আমাকে কখনও পরিশ্রান্ত লাগে সেইরকমতো কখনও হয়না।’
এই বলে ব্যাগ ও ফোনটি তনিমার হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লেন। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ো আসা মাত্রই অর্ণব তনিমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তনিমা কাঁদছে। হঠাৎ করে অর্ণবের মনে হলো তিনি আজ কি তাহলে ডায়াল লিস্ট থেকে অপার ডায়াল হিস্টিরি ডিলিট করেননি। অর্ণব প্রচন্ড বিব্রতবোধ করতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না যে, এই অবস্থায় তনিমাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে কিনা যে, সে কেন কাঁদছে।
‘তনিমা তুমি কাঁদছো কেন?’ বুকে সাহস নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘মা অসুস্থ্য’ অর্ণব জোরে বড় করে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে বল্লেন
‘তাহলে কাল যাও, দেখে আস’
‘না আমি একা যাবনা, পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নেই, বাসায় একা রেখে যাওয়া যাবেনা’
‘এইটা তুমি একদম ঠিক বলেছো, পুরুষ মানুষকে একদম একা ফেলে যাওয়া উচিৎ নয়, আবার তার উপর যদি হয় তোমার জামাইয়ের মত স্মার্ট জামাই’ বলেই অর্ণব হাসতে লাগলেন
‘কি তনিমা তুমি আমার কথা শুনে হাসলেনা যে’
‘তোমার কথাটা যেহেতু সত্য তাই জোকস মনে করে হাসতে পারছিনা’
‘এইবার তুমি কিন্তু সত্যিই জোকস করলে তনিমা’ কথা শেষ করেই অর্ণব হাসতে লাগলেন।

‘কি ব্যাপার তনিমা তুমি ঘুমাচ্ছ না যে? ‘
‘তুমি কালকে আমাকে আর বাবুকে সকালের ট্রেনে তুলে দেবে, আমরা চলে যাব’
‘চলে যাব মানে? মাকে দেখতে যাবে?’
‘না, একদম চলে যাব, আর কখনও ফিরে আসব না তোমার কাছে’ বলে তনিমা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো
‘মানে?’
‘মানে তোমার মত বুদ্ধিমান মানুষের বুঝতে তো সমস্যা হবার কথা নয়’
‘বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে নয়, অঘটনঘটনপটিয়সী হিসেবে বিষয়টি বুঝতে সমস্যা হচ্ছেনা তবে খুব কষ্ট হচ্ছে, কিভাবে বুঝলে?’
‘আজ দশ বছর যাবৎ যে বুকের মধ্যে নিজের মুখটাকে লুকিয়ে নিজেকে সমর্পণ করে সম্পুর্ণ নিরাপদে, সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আসছি সেই বুক যবে থেকে আমার নিরাপত্তা দিতে অসহায় বোধ করেছো তখন থেকেই বুঝতে পেরেছি’
‘মানে কত দিন থেকে বুঝতে পারছো?’
‘আজ পাঁচ মাস যাবৎ কোন রাতই আমি ঠিক মত ঘুমায়নি, সেটা তুমি জেগে থেকে বা ঘুমিয়ে থেকে কোন অবস্থাতেই বুঝতে পারনি’
‘কিন্তু তোমার কি কখনও মনে হয়েছে? আমি বিন্দুমাত্র কম ভালবেসেছি?’
‘সেটা হয়তো বহি:প্রকাশে আমার কাছে কখনও মনে হয়নি, কিন্তু ঘটনাটি বোঝার পর থেকে তোমার প্রতিটি স্পর্শই আমার কাছে এক প্রাতররেক স্পর্শ মনে হয়েছে’
‘কিন্তু আমিতো তোমার সাথে কখনই প্রতারণা করিনি’
‘এত কিছুর পরও তুমি বলবে তুমি প্রতারণা করনি?’
‘হ্যাঁ হয়তো এটাকে তুমি প্রতারণাই বলবে, এই প্রতারণা শব্দটা আমি যদি এখন অস্বীকার করি তাহলে সেটা হবে আরও বিপত্তিকর, কিন্তু জান তনিমা এটা কোন ভাবেই প্রতারণা নয়। আমি এক নিমিষের জন্যও তোমার সাথে প্রতারণা করতে চাইনি, আমি কখনও তোমার প্রতি দায়িত্বে অবহেলাও করিনি বা তোমার ভালবাসাকে উপেক্ষা করব তাও মনে হয়নি’
‘তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো, তুমি আমার স্বামী হয়েও আর একজন ভালবেসেছো, এটা অবশ্যই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, আমি যদি তোমার মত করে আরএকজন পুরুষকে ভালবাসি তাহলে তুমি হয় আমাকে বাড়ী থেকে বের করে দেবে না হয় তুমি বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবে’
‘তুমি যদি বিশ্বাসঘাতকা বল তাহলে সেটা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় অবশ্যই ঠিক, দ্বিতীয় কথা যেটা বল্লে তুমি যদি আর একজন পুরুষকে ভালবাস আমি হয়তোবা বাড়ী ছেড়ে চলে যাব সেটাও হয়তো ঠিক যদিও সেটা Experienced না করা পর্যন্ত বলা মুশকিল, আর যদি সেটা আমি করেও থাকি তাহলে সেটা আমার আমি নই, তোমাদের আমি, তোমরা মানে তোমাদের এই সমাজ আমাকে যে ভাবে গড়ে-পিটে যে ছাচে মানুষ করেছে আমি সেই ছাচের একজন মানুষ’
‘তোমার বকবক শোনার কোন ইচ্ছে আমার নেই, ব্যাস আমার শেষ কথা কালকে তুমি আমাকে ট্রেনে তুলে দেবে ‘

(সাত)
‘অপা, আমি প্রেমে পড়ার সময় নিছক তোমার সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে এক আদিম খেলার দূর্বিসন্ধিমুলক আকাঙ্খা থেকেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম বা প্রেমে পড়তে চেয়েছিলাম সেটা অস্বীকার করব না। যে কারণে তোমারা পুরুষ মানুষদেরকে চরিত্রহীন তকমা বুকে সেটে দাও আমি ঠিক সেই কারণেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু তোমার আমার পরিচয়ের সময় যত বেশি অতিবাহন হয়েছে তত বেশি তোমার সারল্য আমার আমার কাছে আবিষ্কৃত হয়েছে তত জটিল ভাবে আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। অপা, কিছু বলছনা যে?’
‘আপনি বলে যান আপনার কথা শুনতে ভাল লাগছে’
‘তোমার সবকিছু এত সাধারণ যে, সকল সাধারনে সময়ন্বয়ে সত্যিই তুমি এক অসাধারণ তুমি হয়েছো, আমার ব্যাপারে তোমার সাধারণ চিন্তাগুলোর মাধ্যমে আমি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা পেয়েছি। এক কাপ কফি চুমক দিয়ে ভাগ করে পান করা, বা একটাই আইসক্রিম কিনে একসাথে চুষে চুষে খাওয়া, বৃষ্টিতে হাটা এটা সত্যিই অসাধারণ; এগুলোর জন্য অনেকগুলো স্বর্গ উপেক্ষা করা যায়। আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে অসাধারণ এই পাওয়া সাধারণত: খুব বেশি মানুষ পায়না, যারা পায় তারা হাজার স্বর্গ উপেক্ষা করতে পারে, অপা কিছু বলছ না যে’
‘ঐরকমতো সব প্রেমিকদেরই মনে হয়, আপনি বলে যান, কথাগুলো শুনতে আমার খুব ভাল লাগছে’
‘অপা কয়েকদিন পরই তোমার বিয়ে, মহাকালে যা ঘটে থাকে তার প্রতিটি মূহুর্তই হয়তো কোন কোন সময়ের তৈরী করা ছক পূরণ করার জন্যই করা হয়ে থাকে এগুলো হয়তো সব কিছুই অবধারিত, তুমি যখন আমার সাথে কোন কারণে কথা বন্ধ করে দিতে তখন আমার কাছে প্রতিটি সময় তীব্র যন্ত্রনার, বিভিষীকাময় মনে হতো, আমি কোন কিছুর বিনিময়েই চাইব না যে, আমার জীবনে ঐ সময়গুলো আবার ফিরে আসুক, অথচ দেখো ঘটা করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি যে আমরা পরস্পর কেউ কারও সাথে কথা বলব না। যদি সেটা বলব না বলার চেয়ে বলতে পারবনা শব্দটিই বেশি মানানসই, এগুলোতো প্রকৃতির পূর্বাঙ্কিত কোন ছক পূরণ বই কিছু নয়। অপা কাঁদছো?’
‘জানি না’
‘অপা, কতটা একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছো, আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমি আমাকে ভালবাস, আমারও একজন জীবনসঙ্গী আছে আমি তাকেও ভালবাসা, তুমিও আরএকজন ভালবাস, ভালবাসার এই সমীকরণ নাকি অশ্লিল, সমাজ বিরুদ্ধ, এটা নাকি অনৈতিক, তাহলে কি ভালবাসাই ভালবাসার প্রতিবন্ধক? ভালবাসাইকি ভালবাসতে দেয় না?’
‘আমি এতসব বুঝিনা, শুধু এইটুকু বলব, আমার একটা ঈশ্বর ছিল যে ঈশ্বরকে আমি নি:সঙ্গ করে দিলাম, আমি নি:সঙ্গ হলাম, হ্যাঁ জানি সেটা হয়ত কিছুদিন পর কেটে যাবে, তবে এই নি:সঙ্গটা সারা জীবন আমার সঙ্গ হিসেবেই থাকবে’।

(আট)
অপার আগামীকাল বিয়ে, আজকে গায়ে হলুদ, তড়িঘড়ি করে বিয়ের সমস্ত আয়োজন। তড়িঘড়ির কারনেই বিবাহ সংক্রান্ত বেশকিছু প্রথা ঠিকঠাক ভাবে না মেনেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হচ্ছে। অর্ণব তার সমস্ত কাজ স্বাভাবিক গতিতে করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। হঠাৎ করে অর্নবের ফোনে ইনকামিং রিং হচ্ছে, অর্নব ফোনটা হাতে নিয়েই বিস্মিত হলেন, বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে অপা এই সময় ফোন দিতে পারে।
‘হ্যাঁলো, অপা তুমি কেমন আছ?’
‘আপনি একটু বেঙ্গল বইয়ের পাশে আসতে পারবেন?’
‘তিন মিনিটের মধ্যেই চলে আসছি’ অফিস থেকে দৌঁড়ে অর্ণব অপার কাছে দুই মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলেন
‘কি ব্যাপার তুমি এই সময় বাইরে?’
‘গাঁয়ে হলুদ দেওয়ার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে কিন্তু আপনাকে দেখতে খুব ইচেছ করল, তাই ছোট্ট একটা কাজের অজুহাতে আপনার কাছে ছুটে আসলাম, আর একটা কথা বলার জন্যও আসলাম’
‘কি কথা বল’
‘আজ সন্ধ্যায় আমি আপনি একসাথে তিন ঘন্টা হাত ধরে হাঁটব, এই তিন ঘন্টায় যত দূরেই যায়না কেন আপনার সাথে রিক্সায় করে আবার ফিরে আসব’
‘কালকে তোমার বিয়ে’
‘তাতে কি?’
‘তাহলে তোমার যদি অসুবিধা হয়?’
‘আমি তো চাইছিয় অসুবিধা হোক’
‘হুম, আমার জন্য তোমার বিয়ে ভেঙে যাক আর আমি বিপদে পড়ি না? অবশ্যই, তোমার নিয়ে বিপদে পড়তে আমার বেশ ভালই লাগবে’
এখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে অর্ণব অপার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করছে মাত্র। কারণ ঢাকার রাস্তা ফুটপথগুলোতে দুইজন পাশাপাশি হাঁটা প্রায় অসম্ভব যদি সেই রাস্তাটা ক্যান্টনমেন্ট বা প্রধান মন্ত্রীর অফিস বা বাস ভবনের পাশের ফুটপথ না হয়ে থাকে। অর্ণব ও অপা হাঁটতে হাঁটতে ক্যান্টোনমেন্টের মধ্যকার ফুটপথে গিয়ে পৌঁছালো।
‘আশে পাশে প্রায় কেউ নেই, আমার হাত ধরে হাঁটতে তোমার ভয় করছে না? অথবা সেটা যদি ভয়ের নাও হয়ে থাকে, তুমি অন্য কিছু প্রত্যাশা করছ না?’ অর্ণব অপাকে জিজ্ঞেস করল।
‘আজকে রাতের আর ঘন্টা দুইয়েক সময় আপনার হাতে আছে এই সময়টা আপনি আপনার মত করে কাজে লাগাতে পারেন, তবে আমি খুব ভাল করেই জানি আপনি এমন কিছু করবেন না বা করতে পারবেন না যা করলে আমি কষ্ট পাব; নারী-পুরুষের যৌথ সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক আপনার কাছে পবিত্র কাজ কিন্তু স্ত্রী’র অস্মতিতে বা সম্মতি না নিয়ে স্ত্রীর সাথেই যৌন সম্পর্ককে যে মানুষ পাপ মনে করে তাকে নিয়ে আমার কোন ভয় নেই, তবে আমার নিয়ে আমার ভয় আছে কি না সেটাই ভাবছি’
‘অপা তোমার প্রেমে পড়ে জীবনের কয়েকটা বিষয়ে আমার বিস্ময়কর উপলব্ধি হয়েছে, সুতরাং তোমার কোন ভয় নেই’
‘কি কি উপলব্ধি হয়েছে আপনার?’
‘উলব্ধি নাম্বার (এক) নারী-পুরষের ভালবাসা সৃষ্টির নৈপথ্যে হয়তো যৌনতায় মুল কারণ, তবে সত্যিকার অর্থেই কেউ যদি কারও প্রেমে পড়ে সেই যৌণতায় তখন তার কাছে গৌণ হয়ে যায়, উপলব্ধি নাম্বার (দুই) দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস তার পেঁছনে যদি কোন প্রকার যুক্তি নাও থাকে তবুও সেই বিশ্বাসটাই এক সময় সত্যি হয়ে যায়। উপলব্ধি নাম্বার (তিন) ভালবাসা এমন একটি অনুভূতি যা যে কোন সাধারন মানুষকেও ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে দিতে পারে, উপলব্ধি নাম্বার (চার) ঘৃণার প্রতিরোধে যখন ঘৃণা আনা হয় তখন সেটা হয় সংঘাত আর ভালবাসার প্রতিরোধে যখন ভালবাসা আনা হয় তখন সেটা হয় সাংসারিক দায়িত্ব, শেষটা বলব ভালবাসায় সব। বাদ দাও এসব আলোচনা করতে আর ভাল লাগছে না’ বলে অর্নব ও অপা দুইজনই চুপি চুপি কাঁদতে লাগল। অর্ণব একটি রিক্সা ডাকল, অর্ণব ও অপা এই মুহূর্তে দুইজনই পাশাপশি রিক্সায় বসে অপার বাড়ীর দিকে ফিরতে শুরু করছে, কেউ কারও সাথে কথা বলছেনা, এই ভাবে একটা সময় তাদের পথ শেষ হয়ে গেলো, অপা রিক্সা থেকে অর্ণবকে কি যেন বলতে গেলো কিন্তু কোন কথাই বলতে পারল না, অপা রিক্সা থেকে নেমে দ্রুত তার বাড়ীতে ঢুকে পড়ল, অর্ণব তার বাসায় ফিরে আসল।

পনের দিন পর:
অপা অফিসে এসে জানতে পারল অর্ণব চাকুরী ছেড়ে অন্যত্র চাকুরী নিয়ে চলে গেছে; অপার খুব ইচ্ছে করলো অর্ণবকে ফোন দেবে কিন্তু অপার পুরোনো বিশ্বাস অনুসারে অর্ণবের ফোনের আশায় নিজে ফোন না করে অর্ণবের ফোনের আশায় অপেক্ষা করতে লাগলো….

বাঁধ ভাঙ্গা আলো

অখ্যাত হবার সুবিধা নিয়ে কিছু লেখা-লেখি করা যেতেই পারে। সমস্যা হলো অ-স্পর্শকাতর মানুষজনদের স্পর্শকাতরতা নিয়ে। অন্যভাবে বলতে গেলে কিছু অনুভূতিহীন লোকের অতি-অনুভূতি নিয়ে। সাধারণত: সমাজে কিছু মানুষকে দেখা যায় যারা যাদের অসুবিধাগুলোকে সুবিধামত সময়ে সুবিধাজনক ভাবে ব্যবহার করে দীর্ঘ মেয়াদী সুবিধা ভোগ করে থাকে। অনুরুপভাবে অখ্যাত হওয়া সুবিধা নিয়ে বিখ্যাত হবার সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অসুবিধা হলো ভয়ের।

অখ্যাত হবার সুবিধা নিয়ে হয়তো কখনও কখনও বিখ্যাত হওয়া যেতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষে অ-স্পর্শকাতর মানুষের অতিস্পর্শকাতরতার সুবিধা নিয়ে পরিচিতি পাওয়া যেতে পারে, আবার কিছু অসুবিধাকে সুযোগমত ব্যবহার করে দীর্ঘ মেয়াদী সুবিধা পাওয়া, সবই হতে পারে। শুধুমাত্র ভয় কখনও সাহসের কারন হয়না। বরং এক্ষেত্রে উপরের বৈশিষ্ট্যগুলোর বিপরীত ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ ভীতু লোক ভীতু লোক দেখেও ভীতু হয়ে থাকে।

আমি মানুষ হিসাবে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যের বৈশিষ্ট্য বহনকারী ব্যক্তি। আমি সবসময়ই মাত্রারিক্ত ভীতু লোক দেখেও অতিমাত্রায় ভীতু হয়ে থাকি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে সাহসী লোক দেখে তাহলে কি করি? উত্তরটা খুব সহজ, সাহসী লোক দেখে ভীতু হবার কোন সুযোগ থাকেনা। এই ভীরুতা থেকে কখন কখনও সাহসী হবার চেষ্টা করি বটে কিন্তু সেই চেষ্টাও ভীতির কারণ হয়ে থাকে।
উপরোক্ত তিনটি অনুচ্ছেদকে অর্থহীন মনে করছেন? না, ব্যাপারটা আমার প্রেক্ষাপটে অর্থহীন নয়। উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলোর মাধ্যমেইতো এতক্ষণ ধরে নিজেকে সাহস দিলাম দেখি তাতে কোন সাহস হয় কি না? প্রথম অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যে ফিরে যাই। অখ্যাত হবার সুবিধা নিয়ে কিছু লেখা যেতেই পারে।

সাধারণ লক্ষ্য করে দেখি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তি বক্তব্য দিয়ে থাকেন। যারা বক্তব্য দিয়ে থাকেন তাদের নামের শুরুতে প্রথিতযশা, বিখ্যাত বক্তা ইত্যাদি অমূলক শব্দগুলো না বসালেও বোঝা যায় তারা বিখ্যাত বা প্রতিথযশা হয়ে থাকতে পারেন। কারন সেটা বোঝা যায় তাদের বক্তৃতায় বলা বাক্য শুনে নয়; বক্তৃতায় না বলা বাক্য জেনে বা অনুধাবন করে। যেহেতু তারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারগুলো অলংকৃত করে থাকেন সেহেতু তাদের এমন কিছু বলতে নেই যা বল্লে তাদের সমাজ কলঙ্কিত হবে। বিখ্যাত হওয়া যেহেতু বিরাট জ্ঞানের ব্যাপার সেহেতু জ্ঞানী হিসাবে সমাজের প্রতি বিরাট একটা দায়বদ্ধতা থাকতেই হয়। তা না হলে জ্ঞানী কিসের? সেই দায়বদ্ধতা থেকেই বক্তৃতায় অনেক কিছু না বলতে হয় বা বলা থেকে বিরত থাকতে হয়।এই জন্যই তো বলা হয়ে থাকে জ্ঞানী লোকে কথা কম বলে। আমার বলার ক্ষেত্রে বিখ্যাত হবার বিড়ম্বনা নেই কিন্তু ভীরুতার চরম সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

মাঝে মাঝে আপনি যদি আমার মত স্থুল বুদ্ধির মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে এই পরামর্শ অনেক শুনে থাকবেন যে, সব কথা সবখানে বলতে নেই। আমাকে এই পরামর্শ খুব বেশি শুনতে হয়না। শুনতে হয় তখন যখন জ্ঞানীমানুষগণ আমার প্রতি স্নেহপরবশ হযে সামান্য ভুল করে থাকেন অর্থাৎ স্নেহপূর্ণ ভুলবশত: কোন জ্ঞানী ব্যক্তি যদি আমাকে সামান্য কিছু বলার সুযোগ দিয়ে থাকেন তখনই আমাকে উপরোক্ত পরামর্শ শুনতে হয়।
জ্ঞানীলোকজন জ্ঞানের কারণে বলা থেকে বিরত থাকছেন আর আমার মত স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন লোকজন ভীতির কারণে বলা থেকে বিরত থাকছে। অনেক কিছু বলা হচ্ছে কিন্তু বলা হচ্ছেনা কিছুই। বলা হচ্ছেনা বলেই মানুষের শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বধির লোকগুলো যখন অন-অভ্যস্ততার কারণে উচ্চ আওয়াজী কথা শুণে থাকে তখন সেগুলো সহ্য করা হয় না। যারা বলে তাদের কেউ সহ্য করা হয়না। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ না বলে বলে শ্রবণকারীদের বধীরতা বাড়িয়ে চলিয়েছেন, ভীত ব্যক্তিরা না বলে বলে তাদের বলার সাহস একদিকে যেমন নষ্ট করেছে অন্যদিকে তেমনি শ্রবণকারীদের বধীরতাও বাড়িয়ে চলেছেন।

একটা সময় আমার বিশ্বাস ছিলো এই সমাজে যারা আলোকিত মানুষ বলে পরিচিত তাদের দায়িত্ব হলো অন্ধকারগামী মানুষদেরকে আলোর পথ দেখানো, এখন দেখি তারা তাদের আলোগুলো নিভিয়ে অন্ধকারগামী মানুষের অন্ধকারে যাওয়া নেতৃত্ত্ব দিয়ে থাকেন। যে ব্যক্তি কখনও আলো দেখেনি তাকে হঠাৎ করে আলোয় নিয়ে আসলে আলোক রশ্মি তার রেটিনা গ্রহণ করতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। একটু ধৈর্য্য ধরিয়ে তাকে আলোয় রাখলে দেখবেন তিনি চমৎকারভাবে আলোয় হাটছেন। কিন্তু সমাজ আজ জ্ঞানী ও ভীতু লোকের ভারে নূজ্য, জ্ঞানীরা সব সত্য কথা সবখানে বলতে নেই বলে বলেনা, ভীতুরা জানলেও ভয়ে বলেনা। জ্ঞানী ও ভীতু লোকের এই অর্থবহ ভূমিকায় সমাজে বধীর ও অন্ধকারগামী মানুষের সংখ্যা দিন দিনি ভয়াবহ গতিতে বেড়ে চলেছে।

সমাজে অনেককে দেখা গেছে যারা আলোর পথযাত্রী, অন্ধকারগামীরা তাদেরকে টিকতে দেয়নি। আলোকিত মানুষগুলোর নীরবতার নির্মমতা তাদেরকে টিকতে দেয়নি, তাদের বাঁচতে দেয়নি। ভীতুদের সম্পর্কে কিছু বলার নেই।

এখন সময় এসেছে না বলা কথা গুলো বলে বধীর মানুষের বধীরতা ঘোঁচানো, এখন সময় এসেছে আলোর বাঁধ ভাঙ্গার। যে আলোয় অন্ধকারগামী মানুষ চলতে শিখবে। আমি ভীতু, আমার গলার স্বরও নরম। আমি বলতে সাহস করবনা বললেও কেউ শুনতে পাবেনা। যাদের সাহস আছে, যাদের গলা উঁচু আছে তাদেরকে সমবেত স্বরে বলতে হবে। আলোর বাঁধ ভেঙ্গে দাও! অন্ধকারকে হটাও!

বেশ পুরাতন লেখা–

ব্লগ নিয়ে ব্লগিং

ভূমিকা :
সংখ্যা তত্ত্বের আলোকে শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক ব্লগিং বিশ্বে ও বাংলাদেশে কতটা জনপ্রিয় সেটা আমার জানা নেই। জানা খুব একটা জরুরীও নয়। তবে ব্লগিং নিয়ে আমি যা কিছু এই লেখাটাতে লিখছি তা বেশ কিছুদিন ধরেই লেখার প্রয়োজন বোধ করছি। কারণ একজন ব্লগার হিসেবে ব্লগিং-এর নানান বিষয় আমার কাছে কু-দৃষ্টিগোচরীভূত হয়েছে। যার কিছু অংশ নিম্নে অতি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছি।

ব্লগে পাঠকের চেয়ে লেখক সংখ্যা বেশি :
আমাদের দেশের অনেকেই একটা কথা বলে থাকেন, সেটা হলো ‘এদেশে পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যা বেশি’। অবশ্যই কথাটা আমার কাছে কম বেশি সত্য মনে হয়। আমি এমন দু’একজন মানুষকে জানি যারা কখনই কোন বই পড়েন না যদিও তারা নিয়মিত ভাবে সংবাদপত্র পাঠ করেন। অবশ্যই সংবাদপত্রও সেই কারণে পাঠ করেন যে কারণে আমাদের দেশে টিভিতে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের মধ্যে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে সংবাদই বেশি জনপ্রিয়। উনারা আবার হয়তোবা যৌক্তিক কারণে নিয়মিত ভাবে আঞ্চলিক, জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রেও লেখেন। এক্ষেত্রে দুঃখটা হলো তারা কোন প্রকার বই না পড়েও শুধুমাত্র সংবাদপত্র পড়ে পত্রিকা বা সংবাদপত্রগুলোতে শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক লেখা লেখেন। আবার এইরকম দু’একজন পেয়েছি যারা পড়ার ব্যস্ততার কারণে লেখার সময় পান না। আর ব্লগিং নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি এখানেই। ব্লগ পড়তে গিয়ে যেটা যথেষ্ট পরিমাণ লক্ষ্য করি সেটা হলো, অনেক লেখক আছেন যারা তেমন পড়া লেখা করেন না কিন্তু লেখা-লেখি করেন। আমার ঐ পরিচিতনজনদের মতই। হ্যাঁ অবশ্যই কিছু ভাল লেখক বা লেখা পাওয়া যায় যেগুলো পড়তে ভাল লাগে। মুশকিল হলো প্রচুর লেখকদের ভীড়ে ভাল লেখক বা ভাল লেখা খুঁজে পাওয়া। সুতরাং এ থেকেই বোঝা যায় ব্লগে পাঠকের চেয়ে লেখক বেশি।

ব্লগে লেখার ভাল ও মন্দ দিক :
ব্লগে লেখার সবচেয়ে ভাল দিক হলো লেখা বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানা যায়। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আবার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক বা প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। যেটা কিছুটা ফেসবুকী কৌশল। আর সেটা হলো ব্লগে যারা পড়েন তারা মুলত ব্লগার, উনারা অন্যের ব্লগ পড়ুক বা না পড়ুক অন্যের ব্লগে নিয়মিত ভাবে মন্তব্যও করেন। তারা অন্যের লেখায় মন্তব্য করেন এই কারণে যে, তিনি যদি কারোর লেখায় মন্তব্য করেণ তাতে তিনিও তার লেখায় মন্তব্য পাবেন বা হিট পাবেন। অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে। ব্লগার হিসাবে এর অনেক প্রমাণ আমি অনেক বার পেয়েছি। এইতো কয়েক দিন আমি একটা গল্প ব্লগে প্রকাশ করলাম লেখাটি বড় করার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বড় হয়ে গেলো। লেখার সাইজ ইউনিকোড ১১ ফন্ট, প্রায় ৮ পৃষ্ঠা, অথচ আমার লেখায় আমি প্রথম যে মন্তব্যটি পায় তা হলো-আপনার গল্পটি পড়ে খুব ভাল লাগল, উক্ত মন্তব্যটি লেখা প্রকাশের ১/২ মিনিটের মধ্যেই পেয়ে যায়। ওনি ৮ পৃষ্ঠা লেখা ১/২ মিনিটের মধ্যে পড়ে কেন মন্তব্য করলেন সেটা বুঝতে সমস্যার হবার কথা নয়। আরেকবার আমি সংশ্লিষ্ট ব্লগ সাইটের নিয়মের মধ্য থেকে কবিগুরুর শেষের কবিতা স্বীকারোক্তি দিয়েই নিয়মিত ভাবে শেয়ার করছিলাম। সেই শেয়ারে কয়েকজন ব্লগার মন্তব্য লিখে বসলেন এই রকম- আপনি কঠিন কিছু লেখা লিখে ফেললেন, খুব চমৎকার একটা লেখা লিখেছেন, আপনি এত সুন্দর ভাবে লেখেন যা আমি কখনই পারিনা, আপনার লেখা বরাবরই ভাল।

এরকম মন্তব্য পাওয়ার একমাত্র কারণ হলো উনারা লেখক, অবশ্যই পাঠক নন। যেহেতু তাদের লেখায় হিট ও মন্তব্য পাওয়া দরকার সেহেতু তারা অন্যের লেখা না পড়েই ভাল মন্তব্য করেছেন। সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবিদদের থেকে ব্লগারদের বোধহয় এই পার্থক্যটুকু আছে। সাধারণ মানুষজন ও রাজনীতিবীদ কোন কিছু না দেখে, না জেনে, না শুনে সহজেই বলতে পারেন ওটা একদম ঠিক হয়নি বা ভাল হয়নি, আর ব্লগারগণ না পড়েই বলতে পারেন লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে। যেটা পূর্বেই বলেছিলাম ব্লগিং-এর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো লেখার সাথে সাথেই মন্তব্য পাওয়া। কিন্তু মন্তব্যগুলো যদি এত বেশি ভাল হয়ে যায় তাহলে তো মুশকিল। এত ভাল মন্তব্য নিশ্চয় ভাল লেখক তৈরীতে বড় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে।

ব্লগের পাঠ বিষয়ে কিছু সমস্যা :
ব্লগের যারা পাঠক তাদেরকে মুলত কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে পড়তে হয়। একটু বড় লেখা এখানে পড়া খুবই মুশকিলের ব্যাপার হয়ে যায়। স্ক্রীনের আলো খুবই বিরক্ত তৈরী করে বা পড়ার ব্যাপারে মনসংযোগ ব্যাপক ভাবে ব্যহত করে। এর কোন সমাধান আছে কিনা আমার জানা নেই। আবার বড় লেখাগুলি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করার সমস্যা হলো যেহেতু অনলাইনে প্রকাশের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে স্ট্রিমিং হয়ে থাকে সেহেতু ধারাবাহিক লেখাগুলোর সবগুলো পর্বের স্ট্রিমিং আপনার সামনে পড়বে না সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে বড় ধারাবাহিক লেখাগুলো কিভাবে পড়া সম্ভব সেটাও আমার জানা নেই। যেহেতু ব্লগের যারা পাঠক তারা মুলত লেখক পাঠক নন সেহেতু এখানের পাঠের চেয়ে লেখাটায় অধিংকাংশের কাছে মুখ্য সেহেতু এটাও একটা বড় সমস্যা। এর সমাধান কি সেটাও আমার জানা নেই।

উপসংহার :
সবশেষে এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই যে শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক ব্লগগুলিতে যারা বিচরণ করেন তারা অপেক্ষাকৃত মনন চর্চায় অন্যান্য ব্লগ-গুলিতে বিচরণকারীদের চেয়ে একটু এগিয়ে থাকবেন। সুতরাং মনন চর্চার জন্য সহায়ক লেখক ও পাঠকগণ এখানে তাদের মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করবেন এবং ভালবাসা উজার করে দিয়ে তাদের লেখাগুলো লিখবেন অতঃপর ব্লগে প্রকাশ করবেন এবং ভাল করে পড়ে অন্যের লেখায় সুন্দর সমালোচনামূলক মন্তব্য লিখবেন ব্লগার হিসেবে সেটাই আপনাদের কাছে আমার প্রত্যাশা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে লেখক বা ব্লগারের লেখায় যে মন্তব্যটি করা হয় সেটা সংশ্লিষ্ট ব্লগার বা লেখকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব সময় তো নয়ই, কোন সময়ই ভাল হয়েছে, সুন্দর হয়েছে জাতীয় মন্তব্য এড়িয়ে লেখার ত্রুটি বিচ্যুতিসহ সুন্দর দিক তুলে ধরে সত্যিকার অর্থেই সমালোচনামূলক মন্তব্য লেখা উচিৎ। তাহলে এইসব নবীন লেখকগণ তাদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো এড়িয়ে ভাল ভাল লেখা উপহার দিতে পারবেন বলে আশা করছি।

লেখাটা বেশ পুরোনো…

আঁধার

এখানে নক্ষত্রেরা আলো দেয় পাখির পালকের মত করে,
অপূর্ব লাল সন্ধ্যায় তারা নীড়ে ফিরে যায় প্রেমিকার বুকে।
পাখির নীড়ের মত করে নক্ষত্রের প্রেমিকেরা অপেক্ষা করে-
প্রহর গুণতে গুণতে তারাও একসময় সুনিদ্রা যায় আঁধারের বুকে।

এখানে নক্ষত্রেরা নীড়ে ফিরে শকুনের ঠোঁটের মত করে,
দীপ্ত বীথির দ্যুতিতে নীলাভ আকাশের নীচে ঘুমবে বলে।
নিশ্চল সমুদ্রের মত জোয়ারের অপেক্ষায় থাকে শকুনের খাদ্যগুলো
ভুল তিথিতে অপেক্ষিত খাবারেরা সমুদ্রের বুকে শুকিয়ে মরে।

এখানে প্রেমিকেরা নক্ষত্রের আলোয় স্নান করে পবিত্র হবে বলে,
তাদের ভেজা শাড়ীতে জড়িয়ে থাকে কলঙ্কিত শরীরের শীরা
আর পবিত্র যোনিতে মধ্যরাতে জড় হয় একদল শুকরের শুক্রাণু
দিনের পর দিন সেখান থেকে জন্ম নেয় সহস্র দানবীয় ব্লাক হোল।

এখানে রাতের আলোয় দিনের আঁধার লুকিয়ে থাকে সহস্র বছর ধরে
শরীরের পচা দুর্গন্ধ এক প্রহরের রোদে শোকাবে বলে-
লুকায়িত রোদের শরীররে সেই পচা গন্ধে ছুটে আসে হাজারো নীল কাক
রাতের পর রাত সে শুধু ছুটেই চলে অন্তহীন পথে।

এখানে নিষ্পাপ চাঁদের বুকে লুকিয়ে থাকা ব্যথাকে কলঙ্ক বলে;
রাশি রাশি ব্যথা তখন বুক চিতিয়ে ধরে নক্ষত্রের আলোর পানে,
লক্ষ বছরের ব্যথা উপশম করবে বলে।
সুদীর্ঘ সময়ে চিতিয়ে রাখা বুকে ব্যথা আরও বাড়ে তবু নক্ষত্ররা আলো দেয়না ।

চারটি কবিতা

(১)
এই নগরীর সূত্র অতি সহজ,
হয় এখানে অন্ধ হও
অথবা তোমাকে অন্ধ করে দেওয়া হবে।

এখানে সকলেই আত্মম্ভরিতা অন্ধ,
তাই এখানে তোমার দেখার মত কেউ নেই;
তুমিও কাউকে দেখবেনা, কারণ তুমিও আত্মম্ভরিতা ।

(২)
তোমার হাতে জীবিকার সাদা ছড়ি তুলে দেওয়া হয়েছে,
যা নিয়ে তুমি নগরীরর নিষ্ঠুর রাস্তাগুলো পাড়ি দেবে।

রাস্তাগুলো আবার হারিয়ে যায় জীবনের উদ্ধত্য স্বপ্নে,
স্বপ্নগুলোও হারিয়ে যায় নির্জন জন অরণ্যে।

রাস্তার জোছনারা চাঁদের আলোয় হারিয়ে যায়,
প্রেম বেচে জীবন স্বপ্নের সুতো কেনার মরণ নেশায়।

(৩)
নগরীর সূত্র দিয়ে তোমাকে মূক হয়ে থাকতে বলা হয়েছে,
হয় তুমি বোধির হয় অথবা তুমি ফিরে যাও।

দেড় কোটি অভিমানি চোখ অন্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে,
তোমার ফিরে যাওয়ার আগমনী নিস্তব্ধ ধ্বনীতে।

(৪)
এই নগর বেঁচে আছে শুধু মৃত্যু শৈলি নিয়ে,
হাজারো শৈলি আছে এখানে মৃত্যু কলায়।

এখানে মৃত্যু হয় মিছিলে মিছিলে,
এখানে মৃত্যু হয় লাইনে লাইনে।

নগরীর প্রতিটি জীবনের জেব্রা ক্রসিং,
একেকটি মৃত্যু ফাঁদ।

রাজার ভেলা

এক যে ছিল দেশ। সেই দেশ ছিল প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর। সেই প্রাকৃতিক প্রাচুর্য সম বন্টনের জন্য দরকার ছিল অনেক গাড়ী। অনেক গাড়ী যেহেতু দরকার। সেই গাড়ী চালানোর জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক চালক। গাড়ীতো আর যে সে চালাতে পারবে না। তার জন্য দরকার প্রশিক্ষণ। গাড়ী চালকদের জন্য যত মানুষের প্রশিক্ষণ দরকার, তাদের প্রশিক্ষণের জন্য দরকার প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হলেই তো আর চলবে না। তার জন্য দরকার মাস্টার প্রশিক্ষক। মাস্টার প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য যে প্রশিক্ষক হবে সেটা আবার এই দেশে পাওয়া যাবেনা। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে হবে সাত সমুদ্র তের নদীর ঐ পারে। তার জন্য দরকার অনেক টাকা পয়সা। টাকা কোন রকম জুটলেও প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য চাই সেই রকম গুণি লোক। যে সে লোককে তো আর প্রশিক্ষণের জন্য সেই দূরদেশে পাঠানো যায় না। যারা দূরদেশে যাবে তাদের আবার ইংরেজী জানা চাই। এই সব নানা বিষয় নিয়ে দেশের রাজা ছিলেন চিন্তিত।

সৃষ্টি হলো আর এক সমস্যার। যাকে তাকে তো আর ইংরেজী শেখানো যায় না। ইংরেজী শেখাতে হলে চাই
শিক্ষিত লোক। ইংরেজী শেখার মত শিক্ষিত লোক হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু ইংরেজী শেখাবো কে? কোথায় পাওয়া যাবে সেই রকম ব্যক্তি যিনি ইংরেজী শেখাতে পারবেন। সে হয়তো সারা দেশ খুঁজলে কিছু লোক পাওয়া যাবে। তাদেরকে দিয়ে ইংরেজী শেখানো যাবে। কিন্তু যেন তেনো ইংরেজী শিখলে তো আর হবে না। ভাল করে ইংরেজী শিখতে হবে, সেই দূরদেশের উচ্চারণ শিখতে হবে, বুঝতে হবে তাদের উচ্চারণ। তানা হলে ইংরেজী জানা ভদ্রলোকেরা যতটুকু শেখাবে যারা শিখতে যাবে তারা হয়তো ১০ ভাগের এক ভাগ শিখবে। শেখাতে গিয়ে যাদেরকে প্রশিক্ষণ দেবে তাদের হয়তো ১০ ভাগের আট ভাগ শেখাবে। এই ৮ ভাগ থেকে যে প্রশিক্ষকরা শিখবে তারা হয়তো চালকদের ৬ ভাগ শেখাবে। চালকরা মনে রাখতে পারবে ৫ ভাগ। ৫ ভাগ মেধা দিয়ে যতটুকু গাড়ী চালানো শেখাবে তাতে হয়তো এইটুকু শিখবে যে এ গাড়ী গরুতে টানে না, যন্ত্রে টানে।
যন্ত্রনা তো কম নয়। এই গাড়ী গরুতে টানেনা যন্ত্রে টানে তাতে তো তেমন কোন লাভ হবে না। গাড়ী যন্ত্রে চলে এই টুকু শিখতে লাগবে ৬+৩= নয় মাস। ততদিনে দেশেরর সব্য পণ্য পঁচে শেষ হয়ে যাবে। তাহলে কি করা যায়।

উপরোক্ত ভাবনা সমূহ ভাবতে ভাবতে দেশের রাজা সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু বেশিক্ষণ খুম হলো না। রাজা সাহেব তো মহা চিন্তায়। এখন কি করবে? গাড়ী যদি না চলে দেশের এক অঞ্চলের মানুষ ধান পাবে সব্জি বা পোষাক পাবেনা। আর এক অঞ্চলের মানুষ সজ্বি পাবে ধান বা পোষাক পাবে না। এক অঞ্চলের মানুষ পোষাক পাবে ধান বা সব্জি পাবে না। শুধু ধান খেয়ে বা শুধু সব্জি খেয়ে বা শুধু পোষাক পরে তো দিন যাবেনা। আগে অন্য দেশের মানুষ এসে বিনিময় করে যেতো এখন তো তারা আর আসেনা। রাজা সাহেব এভাবে বেশ কিছু দিন চিন্তা করলেন। রাত্রে ভাল ঘুমাতে পারেন না। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখের কোণায় কালি পড়ে গেলো। ও দিকে রাণী সাহেবাও রাজা সাহেবের উদ্বিগ্নতা নিয়ে বেশ চিন্তিত। রাজা সাহেবের এই কষ্ট রাণী ও মেনে নিতে পারছেনা। দেশের জনগণও মেনে নিতে পারছেনা।

রাজা সাহেবের এই কষ্ট দেখে রাণী সাহেবা হাওয়া বদলের জন্য নদীর ধারে বাগান বাড়ীতে বেড়াতে নিয়ে গেলো। রাজা সাহেব তো রাণী সাহেবকেও এখন সহ্য করতে পারেনা। দেশের মানুষের কথা ভেবে রাজা সাহেব পেরেষান। দেশের মানুষও তাদের প্রতি রাজা সাহেবের ভালবাসা দেখে তো অবাক। তারা সবাই মসজিদে মসজিদে, মন্দিরে মন্দিরে, গির্জায় গির্জায় প্রত্যেকে নিজস্ব ধর্মালয়ে প্রার্থনা করতে লাগলো। সেই প্রার্থনাতে বোধ হয় আল্লাহ/ভগবান/ঈশ্বর রাজা সাহেবের প্রতি কৃপা করলেন। অবশেষে রাজা সাহেব এক বালকের কাছ থেকে সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলেন।

রাজা সাহেব মহা আনন্দে নাচা-নাচি করছে। তাই দেখে দেশের রাণী ও দেশের সকল মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত। রাজা সাহেব বলছেন।
রাজা : রাণী আমি পেয়েছি, পেয়েছি।
রাণী : কি পেয়েছেন?
রাজা :সমাধান পেয়েছি।
রাণী : কিসের সমাধান?
রাজা : এত দিন যে সমাধান আমি খুঁজেছি।।
রাণী : কিভাবে সমাধান পেলেন?
রাজা : বলব, বলব, শুধু তোমাকে একা নয় দেশের সকল মানুষের সামনে বলব। সকলকে একসাথে নিয়ে বলব।
রাজা সাহেবের চাওয়া বলে কথা। সকলেই রাজা সাহেব কি ভাবে সমাধান পেলেন তা জানার জন্য দেশের সব শ্রেণীর মানুষ, সব পেশার মানুষ, সব বয়সের মানুষ আজ সমাগত। আজ রাজা সাহেব তার সেই সমাধান কি ভাবে পাওয়া তার গল্প শোনাবেন। রাজা সাহেব সবার সামনে সমাধান খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে শুরু করলেন –
রাজা : রাণী তুমি জান আমি পরশু একা একা নদীর ধারে বসে ছিলাম। বসে থাকতে থাকতে দেখি বাজার থেকে কিছু মানুষ বাড়ী ফিরছে নদী পার হয়ে। দু’টো বালক ছেলে তাদেরকে কলা গাছের ভেলায় করে নদী পার করে দিচ্ছে। দু’জন বালক দু’টি ভেলায় পৃথক করে দু’জন করে মানুষ নদী পার করছে। একজন বালক একটি ভেলায় একজন মানুষকে বসিয়ে ভেলা ধরে সাতার কেটে নদীর অপর প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। নিতে নিতে কখনও কখনও ভেলা উল্টে যাচ্ছে, আবার ভেলা যদি উল্টে নাও যায় তবে সেই ভেলায় চড়ে ভেলার যাত্রীর পোশাক পরিচ্ছদ ভিজে যাচ্ছে।
রাণী : উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এতে সমাধান কোথায় পেলে? এটা তো সমস্যা।

রাজা :একটু ধৈর্য্য ধর রানী। সকল সমস্যার মধ্যেই তো সমাধান নিহিত থাকে। তাহলে শোন, এই ভাবে যখন ভেলায় একজন যেতে গিয়ে ভিজে যাচ্ছে, তখন ছেলে দু’টি করল কি! দুইটি কলা গাছের ভেলা একসাথে বেঁধে দিলে এবং তখন দুই জন করে যাত্রী পার হচ্ছে কিন্তু আগের মত ভিজে যাচ্ছে না বা ভেলা উল্টেও যাচ্ছে না। এই সাফল্যে উৎসাহ পেয়ে ছেলে দু’টি আরও কয়েকটি কলা গাছ কেটে এক সাথে বেঁধে নিয়ে বড় আকারের ভেলা তৈরী করল এবং তখন অনেকেই এক সাথে নিরাপদে নদী পার হতে পারছে, কাপড় ও ভিজছে না বা ভেলাও উল্টাচ্ছে না। মানুষের সাথে মালপত্রও নিরাপদে পার করে নিয়ে যাচ্ছে। ঐ ভেলার মত সকলে মিলে আমরা যদি একসাথে চলতে পারি তাহলে আমাদেরও কোন সমস্যা হবে না। আমাদের জীবন চলার ভেলাটাও উল্টে যাবে না।

আইডিয়া

এক
গুলশানের এই বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টটিতে একবার খাবারের ব্যয় মেটানোর পর সাধারণত ঐ ব্যক্তিকে এখানে দ্বিতীয়বার আসার ব্যাপারে যথেষ্ঠ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যদিনা এইরকম হয়ে থাকে যে পরের বার তার খাবারের ব্যয় ভার অফিস বা তার সাথে আগত ব্যক্তিই তা বহন করছে।
আরিন সাহেব খাবারের মেনুকার্ড-এ খাবারের ছবি দেখেই তা অর্ডার করে দিলেন । ক্যালরি বা মূল্য বিবেচনাবোধে আনলেন না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাংঙ্গালীদের আত্মমর্যাদা প্রদর্শনের একটি উপায় হলো এই ধরনের রেস্টুরেন্টে গিয়ে কোনমতে খাবারের দাম মেটানোর সামর্থ্যটুকু থাকলেই তিনি কোন ভাবেই বুঝতে দেবেন না যে, আজকের এই খাবারের দাম মেটানোর পর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো চলার জন্য তাকে অপেক্ষাকৃত কোন ধনী বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে চলতে হবে। অবশ্যই আরিন সাহেবের তা করতে হবেনা। আরিন সাহেবের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও ব্যবসায়ীক ধারনা ও তার নেতৃত্বদানের অসচরাচর গুণবালী তিনি নিজেকে উচ্চ বেতনের একজম কর্মী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই আরিন সাহেব যেখানটিতে খাবার অর্ডার করতে হয় সেখান থেকে মেনুকার্ডটি হাতে নিয়ে খাবার অর্ডার করলেন।

বার কোর্ড স্ক্যানের মাধ্যমে আরিন সাহেব খাবারগুলো গ্রহণ করলেন। পে-ফাস্ট রেস্টুরেন্ট হওয়ায় পকেটের থেকে ডেবিট কার্ডটি বের করে খাবারের বিল মেটালেন। ওয়ালেটটি জিন্সের পকেটে রাখা মাত্রই মোবাইলে ক্ষুদেবার্তা আবির্ভাবের ভাইব্রেশন হলো। আরিন সাহেব সাধারণত: তার স্মার্ট ফোনটিতে যেকোন ধরনের নোটিফিকেশন এ্যালার্ট আসা মাত্রই তিনি তা পড়ে নেন কিন্তু দুই হাতে খাবারের পাত্র থাকার কারণে তিনি এখন তা করতে পারলেন না।

আরিন সাহেব সব সময় দ্রুত আহারকার্য সম্পন্ন করলেও সাধারণত উনি যখন তথাকথিত বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে খেতে বসেন তখন একটু বেশি সময় নিয়েই খেয়ে থাকেন। তবে এখন স্মার্টফোনের ক্ষুদ্রে বার্তা পড়ার তাগিদেই তিনি একটু দ্রুত খাচ্ছেন। খাওয়া শেষ করার ধৈর্য্যটুকু তিনি ধরতে পারলেন না। আরিন সাহেব লক্ষ্য করে দেখেছেন যখন তিনি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে গান বা কবিতা শুনতে শুরু করেন তখনই ফোনে কল বা ক্ষুদে বার্তা এসে তা বিঘ্ন ঘটায়। এখনও তিনি শেষ করলেন না দ্রুত খাওয়া শেষ করে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে পকেট থেকে সুপার স্মার্টফোনটি বের করে তিনি ক্ষুদে বার্তা পড়তে শুরু করলেন।

‘এ মাসের খাদ্য তালিকা থেকে প্রাপ্ত ক্যালরি হিসাব করলে বিশ দিনে আপনি প্রায় বিশ হাজার উদ্বৃত্ত ক্যালরি গ্রহণ করেছেন, এই উদ্বৃত্ত ক্যালরি আপনার ওজন তিন কিলোগ্রামের মত বৃদ্ধি করতে পারে, আপনাকে আরও একটু বয়সস্ক মনে হতে পারে। আপনি প্রতিদিন গড়ে চারশত পঞ্চাশ টাকার মত খাবারে পেছনে অতিরিক্ত ব্যয় করেছেন। যা এদেশের এদেশের একটি সাধারণ পরিবারের পুরোদিনের খাবারের ব্যয়ের সমান।’

ক্ষুদে বার্তাটি পড়া শেষ করা মাত্রই আরিন সাহেবের ফোনে আবার ইনকামিং কলের ভাইব্রেশন শুরু হলো :
‘জ্বি স্যার বলুন, আমি একটু রেস্টুরেন্টে আছি’
‘আপনার আসতে কত সময় লাগবে? আরিন সাহেবের বস উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বল্লেন, তবে আপনাকে সর্বোচ্চ বিশ মিনিটের মধ্যেই অফিসে এসে পৌঁছাতে হবে’

‘স্যার আমি যতটা সম্ভব দ্রুত আসার চেষ্টা করছি’ কথা শেষ করা মাত্রই আরিন সাহেবের মোবাইলে আবার ক্ষুদে বার্তা আসল।
‘রাস্তায় এই মুহূর্তে তীব্র যানজট শুরু হয়েছে, আর ঘন্টা দুইয়েক পরেই মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বিমান বন্দর থেকে তার কার্যালয়ে যাবেন, তাই কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; সঙ্গত কারণেই তীব্র জ্যাম শুরু হয়েছে। আপনি যদি গাড়ীতে যান আপনার রাস্তা ঘুরে অফিসে যেতে সময় লাগবে এক ঘন্টা তের মিনিট, আর হাঁটতে থাকলে আপনার সময় লাগবে সতের মিনিট’।
আরিন সাহেব দুপুরের এই তীব্র রোদে হাঁটতে শুরু করেছেন। মোবাইলে আবার ভাইব্রেশন
‘ইয়েস’
অটোমেটেড এইআই কল থেকে আরিন সাহেবকে শোনানো হলো
‘আপনি যে গতিতে হাঁটছেন তাতে আপনার অফিসে যেতে সময় লাগবে আঠার মিনিট’; রোদের তাপ ও আদ্রতা বিবেচনায় আপনাকে ত্রিশ মিনিটের মাধ্যে আঁধা লিটার পানি পান করতে হবে’।

অফিসের কোন একটা সমস্যা হওয়ার কারণে আরিন সাহেবের অফিসে পান করার যোগ্য কোন পানি নাই। সাধারণ আরিণ সাহেবের সুপার ইনটেলিজেন্ট স্মার্ট ফোনটি নিউজপোর্টাল থেকে তথ্য নিয়ে বা বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে পূর্ব থেকেই লোডশেডিং বা পানি বা গ্যাস সমস্যার কথা জানিয়ে দিয়ে থাকে কিন্তু আজকের পানির সমস্যাটি এতটাই অনির্দেশ্য ছিল যে, আরিন সাহেবের সুপার ইনটেলিজেন্ট ফোন তা জানাতে পারেনি।

‘ভাই এক লিটার পানি দেন তো’ আরিন সাহেব দোকানীর হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে ওয়ালেট থেকে বিল পরিশোধের জন্য এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে দিলেন।
‘স্যার এত টাকা ভাংতি হবে না’
ভাংতি টাকা না থাকার কারণে আরিন সাহেব পানি না নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। কয়েক মিনিট হাঁটার পর আরিন সাহেব প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত অনুভব করতে শুরু করলেন। গলা শুকিয়ে গেছে। পানির অভাবে মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। সূর্য সামান্য পশ্চিম দিকে হেলে গেছে। এই মূহুর্তে অনুভূত তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি। আরিণ সাহেব আবার পাশে দোকানে গেলেন।
‘ভাই এক বোতল পানি দেনতো’
পানির বিল পরিশোধ করার জন্য আরিন সাহেব পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে দিলেন।
‘স্যার ভাংতি টাকা দেন’
আরিন সাহেব বোতলের মুখ খুলে পানি পান করতে লাগলেন। পানি পান করার পর খুব আরাম বোধ করলেন। শারিরীক আরামে তিনি দোকানের সামনে রাখা চেয়ারটিতে বসে পড়লেন।
‘দেন টাকা ফেরত দেন’ আরিন সাহেব দোকানী কে বল্লেন।
‘স্যার আমার কাছে ভাংতি হবে না, আপনি ভাংতি দেন’
সুপার স্মার্ট ফোনটিতে আবার এসএমএস আসলো।
আপনাকে আর মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে অফিসে পৌঁছাতে হবে কিন্তু জিপিএস তথ্য বলছে আপনি এখনই হাঁটতে শুরু করলে আপনাকে অফিসে যেতে এখনও ১১ মিনিট সময় ব্যয় করতে হবে।
‘ভাংতি হবে না, পানি নিচ্ছেন ৩০ টাকার, নোট দিচ্ছেন ১ হাজার টাকার, আপনার পানি নিতে হবেনা, আপনি আপনার টাকা নেন’
‘কিন্তু আমিতো পানি খেয়ে নিয়েছি, তো?
‘যান টাকা ভাংতি করে নিয়ে এনে দেন’
‘আমি কোত্থেকে টাকা ভাংতি করব?
‘সেটা আমি কি করে বলব?
‘আচ্ছা আপনি এই নোটটি রেখে দেন, বাকি টাকা আমি আপনার কাছ থেকে পরে নিয়ে যাব’
‘আমি আপনার টাকা রাখতে পারবনা’
আবারও এআই থেকে কল, ফোনটি কানে ধরা মাত্রই আরিন সাহেব শুনতে পেলেন-‘জামিল সাহেবের ভয়েস ইমোশোনাল এ্যানালাইসিস অনুযায়ী, আপনি যদি আজ দশ মিনিটের বেশি দেরী করে অফিসে পৌঁছান তাহলে আজকে আপনাকে কাঠোর শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে’।
দোকানীর কাছ থেকে টাকা ফেরত না নিয়েই আরিন সাহেব হাটতে শুরু করলেন।
‘স্যার টাকা ফেরত নিয়ে যান’
আরিন সাহেব বুঝতে পারছেন না তিনি অফিসের দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করবেন নাকি টাকাগুলো ফেরত নিয়ে যাবেন। এতগুলো টাকা ফেলেও যেতে ইচ্ছে করছে না। দ্রুত দোকানীর কাছে আরিন সাহেব আবার আসলেন।
‘ভাই দেন আমার টাকাগুলো ফেরত দেন’ দোকানী আরিন সাহেবকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই একটি মেয়ে বলছে-আপনি দ্রুত আমার টাকাগুলো ফেরত দেন, আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে।
আরিন সাহেব লক্ষ্য করলে কিশোরী বয়সের একটি মেয়ে ১০-১২ ইঞ্চির খাকি কাগজের একটি প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আরিন সাহেব দোকানীকে জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটিকে কত টাকা ফেরত দিতে হবে?’ আরিন সাহেব লক্ষ্য করলেন মেয়েটি বেশ বিব্রত বোধ করছে।
‘আচ্ছা নেন টাকাগুলো নেন, মেয়েটাকে টাকাগুলো আগে ফেরত দেন, আমার টাকাগুলো পরে ফেরত দিলেই হবে’
ধন্যবাদ আঙ্কেল-বলেই মেয়েটি দ্রুত চলে গেলো।
আরিন সাহেব মনে মনে বলেলন- আমি তোমাকে টাকাগুলো ফেরত দিলাম আর তুমি আমাকে আঙ্কেল বলে প্রতিদান দিলে?
আরিন সাহেবের সুপার স্মার্ট ফোনের আবার নোটিফিকেশান-আপনার অফিসে পৌঁছাতে বিশ মিনিট দেরী হবে।
‘স্যার দাঁড়ান, আমি আপনাকে টাকাগুলো ভাংতি করে ফেরত দিচ্ছি’ বলেই আরিন সাহেবকে কোন কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই দোকানী টাকা ভাংতি করার জন্য দোকান ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলো।
আরিন সাহেব বুঝতে পারছেন না যে, ৯৭০ টাকার জন্য আজ তাকে কত টাকার মুল্য চোকাতে হবে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পরে দোকানী ফিরে এসে আরিন সাহেবকে হাজার টাকার নোট ফেরত দিয়ে বল্ল
‘সরি স্যার আপনি নোটটা নিয়ে চলে যান, আমার টাকা আপনি পরে দেবেন, আমরা লোক দেখলেই বুঝতে পারি কে কেমন মানুষ, আপনি আমার টাকাটা পরে দিয়ে দেবেন’।
আরিন সাহেব দোকানীর উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। দোকানীকে বাজে ভাষায় একটি গালি দিতেও ইচ্ছা করলো কিন্তু তারপ্রতি আস্থা রাখার কৃতজ্ঞতা বোধের কারণেই কিছু বল্লেন না।
আরিন সাহেবের সুপার স্মার্ট ফোনে আবার এইআই থেকে অটোমেটেড কল ‘জামিল সাহেবে গত ৫ বছরের ভয়েস ডেটার ইমোশনাল এ্যানালাইসি বলছে, আজকে আপনার শঙ্কার চেয়েও বড় ধরনের শাস্তির হতে হবে’।

দুই
জামিল সাহেব চেয়ারে বসে স্মার্ট ফোনটি ট্যাপ করায় ব্যস্ত আছেন। আরিন সাহেবকে তিনি মোটেই বকা-ঝকা করছেন না। আরিন সাহেবের ভয় সেখানেই। জামিল সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করলে তাকে মিথ্যা কোন উত্তর দেওয়া যাবেনা; কারণ জামিল সাহেব প্রত্যেক এ্যাম্পøয়ির হাতের কব্জিতে Wirless Emotional Detector Sensor (WEDS) বসিয়ে দিয়েছেন। মিথ্যা কথা বলার মজা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে বহু কর্মী শহরের অন্যতম উচ্চতম বেতনভোগী এই চাকুরী ছেড়ে স্বল্প বেতনে অন্য প্রতিষ্ঠানের চাকুরী নিয়ে চলে গেছেন। এইতো কয়েকদিন আগের কথা’ একটি ছেলে চাকুরীতে সবে মাত্র যোগদান করার পর তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরে-ফিরে অফিসে পৌঁছাতে দেরী হয়, জামিল সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি অফিসে আসতে কেন দেরী করলেন? ছেলেটি মিথ্যা না বলতে পেরে রিতীমত মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল, পরবর্তীতে মিথ্যা বলার ঝুঁকির চেয়েও মাত্রারিক্ত ঝুঁকি নেওয়ায় জামিল সাহেব তাকে চাকুরী থেকে অব্যাবহিত দেন।
আরিন সাহেব কেমন আছেন? অতি নমনীয় ভাবে জামিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
জিজ্ঞাসার ধরন আরিন সাহেবের ভয় বাড়িয়ে দিল। জামিল সাহেব যদি কখনও তার কোন এ্যাম্পøয়িকে তার ভুলের জন্য বকা-ঝকা করেন তাহলে বুঝতে হবে তার এই ভুলের কারণে তাকে আর কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।
‘জ্বি স্যার ভাল আছি’
‘আপনার কি মনে হয় আপনার ভাল থাকা উচিৎ?’
‘জ্বি স্যার?’
‘আপনার কি মনে হয় আপনার ভাল থাকা উচিৎ?
আরিন সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারছেন না, তাই চুপ করে বসে রইলেন।
‘আপনি কি জানেন আপনার জন্য প্রতিষ্ঠানের কতবড় ক্লায়েন্ট হাতছাড়া হয়ে গেছে? আপনার মূল্যবোধের সমস্যা নেই, তবে আপনার মূল্য নিয়ে বোধ হয় আপনার বোধের সমস্যা আছে’
আরিন সাহেব চুপ করে রইলেন।
‘আমি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আপনি ভুল করেও আমার সামনে আসবেন না’
‘স্যার তাহলে কি এখন চলে যাব?’
‘আপনার কি মনে হয়? আপনি আমার সামনে বসে থাকবেন আর আমি আপনাকে যামাই আদর করব?
‘সে সুযোগ আছে স্যার, আপনি চাইলেই তা করতে পারেন।’
আরিন সাহেবের কৌতুকরসবোধ অত্যান্ত সাহসি মানের, সাহসী রসবোধের কারণেই আরিন সাহেব প্রায়সর্বজগ্রহণযোগ্য একজন মানুষ। অবশ্যই উল্টো চিত্রও আছে, যেখানে সেখানে কৌতুক করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে।
জামিল সাহেব অতিবিরক্তিতে হেসে ফেল্লেন।
‘আচ্ছা আমি যে আপনার উপর এখন মহা বিরক্ত সেটাও কি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি?’
‘না স্যার, তবে আমি আপনার বিরক্তি কমাতে সমর্থ হয়েছি’
‘আপনার কি মনে করছেন যে, আপনার এই অতি নি¤œমানের রসিকতার কারণে আপনার প্রতি আমার বিরক্ত কমে গেছে?
‘জ্বি স্যার, শুধু রসিকতা নয়, স্যার নানান কারণে আপনি আমাকে পছন্দ করেন’
‘আপনাকে একথা কে বা কারা বল্ল যে, আমি আপনাকে পছন্দ করি?’
‘আমাকে একথা বলার জন্য আমিই যথেষ্ঠ, অন্যকোন পক্ষ বা সম্প্রদায়ের দরকার নেই, আর আপনি তো জানেন স্যার আমি খুব অসাম্প্রদায়িক, আর আপনি এটাও জানেন স্যার, Problem is the mother of invention’
‘না, তা তো জানি না, আমি তো জানি Necessity is the mother of invention’
‘এটা স্যার পুরোনো দিনের ফুরানো কথা আর আমারটা হলো নতুন দিনের নতুন কথা, নতুন ইনোভেশন, আজকে দেরীতে আসার কারণেই আমি আপনাকে ভাল কিছু আইডিয়া দিতে পারব, তবে আইডিয়াটা একদমই নতুন নয়, আপনিও সেটা জানেন, আর পৃথীবিতে নতুন বলতে কিছু নেই, তবে স্যার আইডিয়াটা পুরোনো হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নতুন করে তাগিদ অনুভব করলাম’
জামিল সাহেব রীতিমত ভুলেই গেছেন তিনি আরিন সাহেবের উপর রাগ করেছেন।

তিন
‘আমাদের দেশে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নানান অস্থিরতা আছে! এখানকার অনেক সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো আয় বৈষম্য! আর আয় বৈষম্যের কারণেই এক দল শোসক ও অন্যদল শোষিত শ্রেণীতে পরিণত হচ্ছে। আয় বৈষম্যের কারণেই মূলত: মানুষের মধ্যে এক ধরনের ধনকেন্দ্রিক শ্রেণী বৈষম্য তৈরী হচ্ছে। এই বৈষম্যে এগিয়ে থাকা শ্রেণী এতটাই এগিয়ে রয়েছে যে, তাদের একবছরের আয়ের সমান আয়, পিঁছিয়ে থাকা শ্রেণী এক হাজার বছরেও করতে পারবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এগিয়ে থাকা শ্রেণী আলোর গতিতে অন্ধকার পথে সম্পদ বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন আর পিছিয়ে থাকা শ্রেণী কচ্ছপ গতিতে আলোর পথে সম্পদ অর্জন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলো আর পিছিয়ে থাকতে চাইছে না, তারাও চাইছে যেভাবেই হোক তারাও টাকা কামাবে, তারাও আলোর গতিতে এগুবে। মানুষের মধ্যেই এই বিশ্বাস তৈরী হয়েছে যে, একমাত্র অধিক টাকার মালিক হতে পারলেই কেবল সুখি হওয়া যায়। কথাটা এক অর্থেও সত্যিও। কারণ আপনারা জানেন যে, এখানে যদি আপনি ভাল চিকিৎসা নিতে চান, যদি সন্তানকে ভাল শিক্ষা দিতে চান তাহলে আপনাকে প্রচুর পরিমাণে টাকার মালিক হতে হবে।’ আরিন সাহেব কথাগুলো বলতে বলতেই পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ওপেন করতে শুর করলেন।

‘কিন্তু এগুলোর সাথে আপনার আইডিয়ার সম্পর্ক কি?’ জামিল সাহেব জানতে চাইলেন।

‘স্যার সম্পর্ক এই যে, উপরোক্ত যে সকল সমস্যা বল্লাম আপনাদের সবারই তা ভালমত জানা আছে এবং এগুলোর কারণও আপনাদের কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট। যারা আলোর গতিতে সম্পদ অর্জন করে যাচ্ছে তারা কিন্তু তা অন্ধকার পথেই করছে এবং এই সম্পদগুলোও থেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। এতে করে এই সম্পদ থেকে প্রতি বছর দেশ যেমন হাজার হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্য দিকে সম্পদগুলো পরিচালন মূলধন হিসেবে কাজে না লাগানোর ফলে সাধারণ জনগণও আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং যেগুলোর ট্র্যাক করাও সম্ভব হয়না বা হচ্ছে না। আর এই অসম্ভবের কারণেই দেশে ঘুষ-দূর্ণিতি পরিস্থিতি একধরনের অলিখিত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি নগদ লেনদেন বন্ধ করে ট্র্যাকিংযোগ্য কোন লেনদেন প্রক্রিয়া চালু করতে পারেন তাহলে এইসব অন্ধকার পথগুলো রাতা-রাতি ব্লাকহোলে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব।

‘নগদ অর্থ লেনদেন বন্ধ করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?’

‘স্যার সব সমস্যার সমাধান হবে কি না এখনই বলা সম্ভব নয়, তবে স্যার আপনি এইটুকু ধরে নিতে পারেন যে, অবৈধভাকে হোক বা বৈধ ভাবে হোক যে সকল নগদ অর্থ লেনদেন করা হয় তার আন্ত:গমন বা বহি:গমন কোন গমনই রেকর্ড থাকে না, ফলে দূর্ণীতিবাজগণ দূর্ণীতি করে পার পেয়ে যান, অন্যদিকে এই সর্ব দুর্ণীতিবাজদের পার পাওয়া দেখে মধ্যবর্তী অবস্থানকারী মানুষগুলো দূর্ণীতি করতে উৎসাহী হয়ে উঠে’

‘তারমানে বুঝতে পারছি, আপনি এমন আইডিয়ার কথা বলছেন যেখানে অর্থ লেনদেনসমূহ ট্র্যাক করা যাবে কিন্তু আমরা সবাই জানি আপনি যদি এখনই অনলাইনে অর্থ লেনদেন করেন তাহলে সেটা তো ট্র্যাক করা যাবে।’

‘স্যার ঠিকই বলেছেন, স্যার আপনি জানেন যে, স্যার জানেন যে যারা দূর্ণীতি করে থাকে তারা অনলাইন লেনদেন করে না, স্যার আমি এমন এক ধারনার কথা বলছি যেখানে বাংলাদেশের সমস্ত লেনদেন, এমনকি ১০ টাকার বাদাম ও বিক্রি হবে ক্যাশলেস লেনদেনের মাধ্যমে’

‘সেটা কি বাস্তবে আদৌ সম্ভব? যেখানে এদেশের বিরাট একটা অংশ মানুষ পড়তেই পারেনা এমনকি তারা জানে না যে কিভাবে লিখতে হয়, তারা জানেনা যে, কিভাবে মোবাইল চালাতে হয়, সেখানে এই চিন্তা কি খুবই অমুলক না?’

‘স্যার ধরুন, আপনার শরীরে একটি কম্পিউটার বসিয়ে দেওয়া হলো, যে কম্পিউটার ব্রেইন ওয়েভ রিড করতে পারবে, যার মাধ্যমে চীপের সুপার আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্ট আপনার চাওয়া না চাওয়া বুঝতে পারবে। কোন প্রকার শব্দ বা কোন প্রকার বাটন না চেপেই ব্রেণ ওয়েভের মাধ্যমে আপনি আপনার কাঙ্খিত পরিমাণ অর্থ লেনদেন করতে পারবেন। আপনার সমস্ত লেনদেন ক্লাউডে জমা থাকলো, আজীবনই আপনার ১০ টাকার বাদাম ক্রয় থেকেই সমস্ত দশ কোটি টাকার বাড়ী ক্রয়ের সমস্ত তথ্যই ক্লাউডে থাকবে।’

‘তার মানে সবার মাথার উপর একটি করে কম্পিউটার বসিয়ে দেওয়া হবে, এবং লোকটি টানতে থাকবে, তাইতো?’

দর্শকসারির একজনের এই মন্তব্য শুনে সকলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন।

আরিন সাহেব একটুও বিচলিত না হয়ে বল্লেন ‘ঠিক সেরকমটাই, তবে এই কম্পিউটারটি সবার মাথায় চড়ে থাকবে না তবে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো থাকবে, যা আকারে খুবই ছোট হবে এবং মানুষ আজীবন ধরে এটি খুব সহজেই বহন করতে পারবে’

‘কিন্তু ষোল কোটি চিপ বসাতে কত খরচ হবে?’ দর্শক সারী থেকে আর একজন প্রশ্ন করলেন।
‘খরচ কত হবে সেটা ঠিক এই মূহুর্তে বলতে পারবনা, তবে এই টুকু বলতে পারি, এদেশে একটি সেতু তৈরী করা হচ্ছে যার ব্যয় প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকা, বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে সেতু চালুর দশ বছর পরে এই সেতুর প্রয়োজন থাকবে কিনা সেটা সময় বলে দেবে। আমি যদি বলি এ দেশে বছরে প্রায় দূর্ণীতি হয় ৫০ হাজার কোটি; আপনি নিশ্চয় এ বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করবে না, দ্বিমত পোষণ করলেও এই কারণে করবেন যে এই টাকা ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। স্যার জানেন, প্রতিনিয়ত টাকা ছাপাতে বছরে কোটি টাকা খরচ করা হয়ে থাকে। আমি শুধু এইটুক বলতে পারি যে, এই প্রকল্পের খরচ এসবের চেয়ে বেশ কম।’

চার (শেষ)
প্রায় দুই মাস পূর্বে আরিন সাহেবের আইডিয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল আরিন সাহেবের কোম্পানি ইন্টেল ইন্টারন্যাশানাল থেকে চিপ সেট আমদানী করবে এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠান দিয়ে সফ্টওয়্যার ডেভেলপ করবে এবং বাংলাদেশে সফল ভাবে বাস্তবায়ন করার পর পৃথীবির বিভিন্ন দেশে এটি ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে। ইন্টারন্যাশনাল পেটেন্ট নেওয়ার পর এটি বিশ্বের যে দেশেই বাস্তবায়ন হোক না কেন সেখান থেকে সেই বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান আরিন সাহেবের প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব শেয়ার করতে বাধ্য থাকবে। সুতরাং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর থেকে আইডিয়াটা বাস্তবায়নের জন্য যে খরচ হবে সেটা খুব সহজে মন্ত্রণালয়কে ফেরত দেওয়া যাবে। যদিও ইনোভেটিভ আইডিয়া হিসেবে এটি বাস্তবায়ন করার জন্য মন্ত্রণালয় প্রকল্পের খরচ অনুদান হিসেবে দিতে পারে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর, আরিন সাহেবের কোম্পানি ও ইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল এর মধ্যে গড়ট স্বাক্ষরের প্রস্তুতি হিসেবে মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এর আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রালয়ের মাননীয় মন্ত্রী, সচিব, ইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল এর সিনিয়র একজন কর্মকর্তা এবং আরিন সাহবে ও জামিল সাহেবের উপস্থিতে প্রেজেন্টশন উপস্থাপন করা হয়েছে। আরিন সাহেবের প্রেজেন্টেশনকে সকলকেই খুব প্রশংসা করলেন এবং তার সমস্ত আইডিয়া বাস্তয়নের জন্য মাননীয় মন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিলেন এবং সব ধরনের সহযোগতিার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং সকলকে জানিয়ে দেওয়া হলো এটি বাস্তবায়নের জন্য খুব শিঘ্রই সকলকে আনুষ্ঠানিক ভাবে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। জামিল সাহেব আরিন সাহেবের উপর প্রচন্ড খুশি হলেন এবং তাকে প্রাপ্য সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন কিন্তু আরিন সাহেব সব সমই খুশি প্রকাশে সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন বলা যেতে পারে রক্ষণশীল নীতি অনুসরণ করে থাকেন এখনও তাই করলেন।

প্রায় দুই মাস পরে প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে জামিল সাহেব বরাবর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের খাম দেখেই জামিল সাহেব প্রচন্ড উত্তেজনা অনুভব করলেন। তিনি উচুস্বরে আরিন সাহেবকে ডাকলেন। খামটি খুলতে শুরু করলেন। চিঠিটি নিয়ে জামিল সাহেব পড়তে শুরু করলেন। হঠাৎ করে জামিল সাহেবের মুখ দেখে মনে হলো এইমাত্র তার নিতম্বে কেউ আলপিন ঢুকিয়ে দিয়েছে। হাসি উধাও হয়ে গেছে। আঞ্চলিক ভাষায় একটি গালি দিয়ে তিনি চিঠিটা আরিন সাহেবকে পড়তে দিলেন।

‘মি. জামিল সাহেব আমরা আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রোপোজালটা ভালভাবে স্টাডি করেছি। তাতে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, দেশের আর্থিক দূর্নীতি দমনের নামে আপনাদের যে আইডিয়া তা বাস্তবায়ন হলে আমাদের দেশের সমস্ত আর্থিক লেনদেনের তথ্য অন্যের হাতে চলে যেতে পারে এবং দেশের আর্থিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে সুতরাং এহেন কোন প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় যে কোন প্রকার সহযোগিতা করার অপারগতা প্রকাশ করছে। শুধু অপরাগতা প্রকাশ করছে তাই নয় এহেন কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন যদি কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক করার চেষ্টা করা হয় তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানকে দেশবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং তাদের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে সেই প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

পরের দিন—
আরিন সাহেব গতকাল সন্ধ্যায় আমার কাছে ফোন আসে, সেই ফোনের প্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত। আমি খুবই দু:খিত, এটা বল্লে খুবই কম বলা হবে যে এই প্রতিষ্ঠানকে আপনি অনেক কিছু দিয়েছেন বরং বলব আমাদের এই প্রতিষ্ঠান যে এত বড় হয়েছে তারজন্য আপনার অবদানই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। তাই আপনাকে খুব কষ্টের সাথেই বলতে হচ্ছে যে, আপনি আগামীকাল থেকে আর অফিসে আসবেন না। অবশ্যই আপনাকে এখান থেকে যাওয়ার সময় ছয় মাসের বেতন ও আপনার সমস্ত পাওয়না মিটিয়ে দেওয়া হবে। আশাকরি গ্রামে গিয়ে সেই টাকা দিয়ে আপনি ভালমত চলতে পারবেন।

গ্রামে গিয়ে আমি ভাল থাকব সেটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই কিন্তু স্যার আপনি আমাকে গ্রামে চলে যাওয়ার কথা কেন বলছেন? আমি কেন বলছি সেটা বুঝতে আপনার মত বুদ্ধিমান লোকের সেটা বুঝতে একদম সমস্যা হবার কথা নয়। আরিন সাহেবের বুঝতে কোন সমস্যা হলো না যে, আজ তার কোন সেন্স অফ হিউমার কোন কাজে আসবে না।

-সমাপ্ত–

তুমি চাইলেই

তুমি চাইলেই সাত সমুদ্র ওপার হতে তোমায় একটা সমুদ্র এনে দিতাম;
কি দরকার ছিল শরীরে এক ফোটা লোনা জল লুকিয়ে রাখার।

তুমি চাইলেই আকাশ হতে সমস্ত নীলিমা তোমায় এনে দিতাম;
কি দরকার ছিল চোখের কোনায় এক ফোঁটা নীলিমা লুকিয়ে রাখার!

তুমি চাইলে চেরাপূঞ্জির সমস্ত মেঘ তোমার গাঁয়ে জড়িয়ে দিতাম!
কি দরকার ছিল এক ফোঁটা বৃষ্টি খোপায় লুকিয়ে রাখার!

তুমি চাইলেই জোছনাকে শিশির বানিয়ে কুসুম কমলে তোমাকে ভিজিয়ে দিতাম;
কি দরকার ছিল এক ফোটা জোছনাকে আচলে বেঁধে রাখার!

তুমি চাইলেই সমস্ত আধাঁরকে ঠেলে দিতাম ব্লাক হোলের গোহিন অরণ্যে;
কি দরকার ছিল এক রতি আঁধার ঠেলে আমাকে দেওয়ার!

তুমি চাইলেই গঙ্গা, পদ্মা কর্ণফুলি সবগুলোকে এনে ধরিয়ে দিতাম তোমার হাতে;
কি দরকার ছিল পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার!

তুমি চাইলেই পৃথিবীর সমস্ত ফুল তোমার খোপায় গুজে দিতাম!
কি দরকার ছিল গোলাপের কাঁটায় হাত দেওয়ার!

তুমি চাইলেই পাহাড় চূড়ায় তুলে দিয়ে রূপালী বরফ দেখাতাম;
কি দরকার ছিল পাথলে উষ্ঠা খেয়ে নখ কাটার!

জীবন্ত নগরী

জীবন্ত শহর আজ নগর হয়ে বেঁচে আছে ধরণীর বুকে,
সমস্ত কোলাহল শেষে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছে মশাড়ীর ভেতরে!

সমস্ত প্রকৃতি আজ রাস্তায় নেমেছে, মিছিলে মিছিলে;
মুখরিত করে রেখেছে শহরের রাজপথ,
কারা যেন তাদের নি:শ্বাস ছিনিয়েছে বলে।

শহরের গলিপথে প্রকৃতির অর্ধাহারী শিশুরা আজ না খেয়ে ঘুমিয়ে আছে;
আযানের সুর অথবা মন্দিরের ঘন্টা তাদের ঘুম ভাঙাবে বলে!

নগরীর জোছনার মত যোনিতে আজ কোন প্রেম নেই!
ঢেউয়ের মত ঠোঁটের উরুতে আজ ভালবাসাও নেই!

সমস্ত প্রকৃতি কোনমতে বেঁচে আছে প্রেমহীন এক প্রেমিকের বুকে!
আর নগরী উদ্ধ্যত এক অন্ধ বিশ্বাসে বিকশিত সহস্র নক্ষত্রের নীচে।

সমস্ত শহর আজ এক পতিতা নগরী,
এখানে খরিদ করা প্রেমের ডিম্বাশয়ে জমা হয় নিষিক্ত নগরীর শুক্রাণু;
অত:পর জন্ম হয় মাতৃ পরিচয়হীন হাজারো জারজ ভবিষ্য পিতা।

ধরনীর সমস্ত প্রকৃতি এখন নংপুংসক পিতামহ,
তার সমস্ত জননকোষ নিষ্ফল হয়ে গেছে!
কোন মৈথুনে এখন তার শরীর থেকে ঘাম ঝরেনা।
তাই জন্ম হয়না কোন পবিত্র শিশু!

সমস্ত প্রকৃতি বেঁচে আছে শেষকৃত্যের প্রহরগুণে,
আর নগীর তার শরীরের ঘাম ঝরানোই ব্যস্ত;
হাজারো স্বাস্থবান অসুস্থ্য শিশু জন্ম দেবে বলে।

————-সমাপ্ত———-