আমির ইশতিয়াক এর সকল পোস্ট

আমির ইশতিয়াক সম্পর্কে

আমির ইশতিয়াক ১৯৮০ সালের ৩১ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার ধরাভাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শরীফ হোসেন এবং মা আনোয়ারা বেগম এর বড় সন্তান তিনি। স্ত্রী ইয়াছমিন আমির। এক সন্তান আফরিন সুলতানা আনিকা। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন মায়ের কাছ থেকে। মা-ই তার প্রথম পাঠশালা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন মাদ্রাসা থেকে আর শেষ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তিনি লেখালেখির প্রেরণা পেয়েছেন বই পড়ে। তিনি গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও সাহিত্যের সবগুলো শাখায় তাঁর বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর বেশ কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো- এ জীবন শুধু তোমার জন্য (২০০৩) ও প্রাণের প্রিয়তমা (২০০৬)। তাছাড়া বেশ কিছু সম্মিলিত সংকলনেও তাঁর গল্প, কবিতা ছাপা হয়েছে। তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় গল্প,কবিতা,ছড়া, ভ্রমণ কাহিনী ও কলাম লিখে যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ব্লগ ও ফেসবুক গ্রুপে নিজের লেখা শেয়ার করছেন। তিনি লেখালেখি করে বেশ কয়েটি পুরস্কারও পেয়েছেন। ফেসবুক লিংক- https://www.facebook.com/amirhossain243 ই-মেইল : [email protected] ব্যক্তিগত ব্লগসাইট: http://amirishtiaq.blogspot.com

বিবেক


রাত প্রায় ১২টা বাজে। বেলাল নাদিরাকে নিয়ে তার ব্যাচেলর বাসায় ঢুকেই দরজাটা লাগিয়ে দিল। এ দৃশ্য দেখে তখন নাদিরার হাত পা কাঁপা শুরু করে দিল। একি হচ্ছে! এ আমি কোথায় আসলাম? একজন মেয়ে হয়ে এত রাতে একজন ব্যাচেলর ছেলের বাসায়! তা হতে পারে না। আমাকে মিথ্যে বলে সে এখানে নিয়ে আসছে কেন? কি তার উদ্দেশ্যে?
– বেলাল তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে আসলে?
– এটা আমার বাসা।
– তুমি না বললে তোমার বোনের বাসায় আমাকে নিয়ে যাবে?
– হ্যাঁ বলেছি। ওখানে এখন যাওয়া যাবে না। সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা?
– সেটা এখন বলা যাবে না।
– কাজটা ঠিক কর নাই তুমি। বোনের বাসার কথা বলে তুমি আমাকে ব্যাচেলর বাসায় নিয়ে আসলে কেন?
– কোন কথা বলবে না। আশে পাশের মানুষজন সজাগ আছে। কেউ শুনলে সমস্যা হবে।
– তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসলে কেন? আমাকে আমার বাসায় পৌঁছে দাও।
– চুপ কর। কোন কথা বলবে না। তোমার কোন সমস্যা হবে না। তুমি শুয়ে পড়।
– আমি কিভাবে একজন কুমারী মেয়ে হয়ে তোমার সাথে এ অবস্থায় একা থাকতে পারি বল?
– তুমি নিশ্চিত থাক। তোমার কোন ক্ষতি হবে না।
নাদিরা বেলালের এই কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। একজন যুবক ছেলে আর একজন যুবতী মেয়ে এক সাথে থাকবে আর কিছু হবে না তা কি করে সম্ভব? তারপরও ভয়-শঙ্কা নিয়ে নাদিরা খাটের উপর ঘুমিয়ে পড়ল। আর বেলাল ফ্লোরে ঘুমের ভান ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ নাদিরার ঘুম ভেঙ্গে যেতেই দেখে বেলাল তার পাশে!
– কি ব্যাপার তুমি আমার পাশে আসলে কেন? এটাতো ঠিক হচ্ছে না।
– ঠিক না মানে। এটা কোন বিষয় না। এমনটা হতেই পারে।
– এসব কি বলছ তুমি?
– আস্তে কথা বল। আশে পাশে সবাই ব্যাচেলর। কেউ শুনলে দু’জনেরই ক্ষতি হবে।
– হোক ক্ষতি, তবুও আমি আমার সতীত্ব নষ্ট করতে দেব না।
– প্লিজ নাদিরা আমাকে বুঝার চেষ্টা কর।
– প্লিজ বেলাল তুমি আমাকে টাচ করবে না।
– এমনটা বলে না লক্ষ্মীসোনা। তুমি আমার জান।
– তুমি আমার কাছ থেকে চলে যাও।
– যদি না যাই?
– তাহলে আমি চিৎকার করব।
– এ কাজ তুমি করবে না।
– কেন করব না?
– কারণ তুমি আমার প্রেমিকা।
– তাই বলে বিয়ে না করে এরকম অনৈতিক কাজ করবে?
– সমস্যা কি? আমিতো তোমাকেই বিয়ে করব?
– তুমি যে আমাকে বিয়ে করবে তার কি গ্যারান্টি আছে?
– তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর না?
– বিশ্বাস করি।
– তাহলে?
– কিন্তু বিশ্বাসের মধ্যেও কিছু অবিশ্বাস থেকে যায়। কারণ ছেলেরা হচ্ছে ভ্রমর জাত। তারা একবার মধু পান করতে পারলে সহজে আর ধরা দেয় না।
– এমনটা বলতে পারলে? সব ছেলেরা কি এক রকম হয়?
– তা ঠিক বলেছ। সব ছেলেরা এক রকম হয় না। তুমি ঐরকম হতে কতক্ষণ?
– কি করলে আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করবে?
– আমার মাথায় হাত রেখে কসম কাটতে হবে। তুমি আমাকে কালই বিয়ে করবে? তাহলেই আমি তোমার সাথে এ কাজে যেতে পারব। অন্যথায় নয়।
– ঠিক আছে এই তোমার মাথায় হাত রেখে বলছি, “কালই তোমাকে বিয়ে করব।”
চতুর বেলাল নাদিরাকে বশে আনার জন্য বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মিছে মিছি নাদিরার মাথায় হাত রেখে কসম কেটে নেয়। তারপর তাদের দু’জনের মধ্যে যা হওয়ার তাই হলো।
নাদিরা ছিল বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। তার বাবা নাসির উদ্দিন ছিলেন সরকারি চাকুরীজীবি। চাকুরির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় বদলি হতো। নাসির উদ্দিনের সাথে মা ও মেয়ে থাকত। এভাবে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করায় নাদিরার পড়াশুনা ক্ষতি হচ্ছে। তাই নাদিরা যখন এসএসসি পাশ করে তখন তারা ঢাকায় চলে আসে। নাদিরার মা নাসিমা আক্তার তাকে নিয়ে ফ্ল্যাট বাসায় ভাড়া থাকে। আর নাসির উদ্দিন বর্তমানে সিলেটে কর্মরত আছেন।
নাদিরা বর্তমানে ঢাকার একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। পাশাপাশি একটি কোচিং সেন্টারেও ভর্তি হয়েছে। কোচিং সেন্টারের শিক্ষক বেলালের সাথে তার পরিচয় হয়। তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। নাদিরা সপ্তাহে তিনদিন বেলালের নিকট পড়তে যায়। নাদিরাকে পড়ানোর সুবাদে বেলাল তাদের বাসায় আসা যাওয়া করে। নাদিরার যে কোন সমস্যায় বেলাল এগিয়ে আসে। এক সময় বেলাল নাদিরার প্রেমে পড়ে যায়। সেটা কিছুদিন যেতে না যেতেই নাদিরার মায়ের নজরে পড়ে যায়। তবে বেলালকে অসম্ভব ভালোবাসতো নাদিরার মা। নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসত। তার কথাবার্তা চাল চলন সবই নাদিরার মায়ের পছন্দ ছিল। তাই মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক হওয়াতে কিছু বলতেন না তিনি। বরং তিনি মনে মনে জামাই হিসেবে কল্পনা করতেন। বেলালও নাদিরার পড়াশুনার ব্যাপারে যেখানে যেটা সাহায্য করার লাগে সেটা করে।
সেদিন বেলাল নাদিরাকে নিয়ে তাদের বাসায় যাবে বলে তার মায়ের অনুমতি নিয়ে তাকে নিয়ে যায়। নাদিরার মা তাতে কোন আপত্তি করে নাই। কিন্তু বেলালের মনে ছিল অন্য মতলব। অনেকদিন যাবত সুযোগ খুঁজছে প্রেমের ছলে নাদিরার সাথে দৈহিক সর্ম্পক করবে। তাই সে আজ নাদিরাকে ফাঁদে ফেলে কৌশলে তাদের বাসায় না নিয়ে নিজের ব্যাচেলর বাসায় নিয়ে আসে।
বেলাল সবসময় নাদিরাকে মিথ্যে বলত। সে যে আলাদা বাসায় ব্যাচেলর হিসেবে থাকে সেটা কখনও নাদিরাকে বলেনি। সবসময় তাদের বাড়িতে থাকত এটাই বলত। ঢাকায় তাদের বাড়ি আছে সেটা বলত। কিন্তু আজ নাদিরা আবিষ্কার করলো না, সে বাসায় থাকে না। সে ব্যাচেলর বাসায় থাকে এবং ঢাকায় তাদের কোন বাড়ি নেই। এমনকি তাদের কেউ ঢাকায় থাকেও না।
ভোর পাঁচটা বাজে। কেউ এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। নাদিরা ঘুম থেকে উঠে চিন্তায় পড়ে গেল। এটা আমি কি করলাম। এ অন্যায়। এ পাপ। এ অন্যায়ের ক্ষমা নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বিয়ে করতে হবে। তা না হলে এ অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতেই হবে। নাদিরা মৃদুস্বরে কাঁদতে লাগল। বেলালের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
– কি ব্যাপার তুমি কাঁদছ কেন?
– এটা তুমি কি করলে? একবারও কি তোমার মধ্যে পাপবোধ জাগ্রত হয় নাই। তোমাকে আমি ভালোবাসি বলে বিয়ের আগে আমার সাথে এসব অনৈতিক কাজ করাটা কি ঠিক হয়েছে?
– তুমি টেনশন করবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে।
– আমিতো সেটা মেনে নিতে পারছি না।
– আমিতো আছি। সারাজীবন তোমার পাশেই আছি। তুমি আমার প্রতি বিশ্বাস রাখো।
– ঠিক আছে তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। চল আমরা আজ বিয়ে করে বাড়ি ফিরব।
– আজ নয় কাল করব।
– কেন? তুমি না রাতে আমাকে বললে আজ করবে?
– হ্যাঁ বলেছি। একটু ভাবতে দাও। বিয়ের জন্য প্রস্তুতির ব্যাপার স্যাপার আছে না। হুট করে বিয়ে করা ঠিক না।
– আমি অতসব বুঝি না। তুমি রাতে আমাকে কথা দিয়েছ আজ বিয়ে করবে। আমি আজই বিয়ে করব।
– প্লিজ মাথা গরম কর না। আমাকে একটু সময় দাও।
– তুমি যদি আজ আমাকে বিয়ে না কর তাহলে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে ভোগ করতে হবে।
– আজ বাসায় যাও। কালই সব ঠিক করে তোমাকে জানাব।
– এ অবস্থায় আমি বাসায় যাব না। যেতে হলে তোমাকে বিয়ে করেই যাব।
– তুমি কি জোর করে আমাকে বিয়ে করবে?
– প্রয়োজনে তাই করব।
– পারবে না। তার চেয়ে বরং মাথা ঠান্ডা করে বাসায় যাও। আমি সব কিছু ঠিক করে তোমাকে জানাব।
– না আমি বাসায় যাব না।
– আর শুনো এখন কিন্তু বাইরে বের হবে না।
– কেন?
– এত সকালে তোমাকে বাসা থেকে বের হতে কেউ দেখলে সমস্যা হবে। দশটার পর আমি তোমাকে সুবিধামতো সময়ে বের করে নিব।
নাদিরা অনেক চেষ্টা করেও আজ বিয়ে করার জন্য বেলালকে রাজি করাতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে বিয়ে না করেই তাকে বাসায় ফিরতে হয়েছে।
বিকাল বেলা নাদিরা বেলালকে ফোন দেয়।
– হ্যালো নাদিরা কি মনে করে?
– কাল রাতের ঘটনার পর থেকে একটি বারের জন্যও তোমাকে আর ভুলে থাকতে পারছি না।
– ভুলে না থাকতে পারলে চলে আস আজও।
– এসব কি বল তুমি?
– খারাপ কিছু বললাম নাতো।
– কাল রাতের কথা মনে আছে?
– কোন কথা?
– ঐ যে বিয়ের কথা।
– এখন কি বিয়ের সময় হয়েছে?
– হয়েছে না মানে! রাতেতো এ কথা বলনি?
– রাতে কি বলেছি তা মনে নেই।
– মনে থাকবে কেন?
– এগুলো মনে রেখে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং এভাবেই চলুক। তারপর দেখব কি করা যায়।
– তোমার এসব আবোল তাবোল কথা শুনতে চাই না। তুমি বিয়ে করবে কিনা সেটা বল।
– এখন বিয়ে করলে তোমার আমার পরিবারের কেউ এ বিয়ে মেনে নিবে না।
– পারিবার মেনে না নিলেও কোন সমস্যা নেই। আমরা অন্য জায়গায় বাসা নিব।
– বাসা নিয়ে তোমাকে খাওয়াব কি? কোচিং থেকে যা পাই তা দিয়ে কি সংসার চলবে?
– আমি কাজ করব?
– এখন এসব আবেগে বলছ। পরে পস্তাবে।
– আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না।
সেদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিন নাদিরা বেলালের সাথে ফোনে বিয়ে নিয়ে ঝগড়া হয়। বেলালকে বিয়ের কথা বললেই সে এড়িয়ে যায়। বেলাল তাকে এ বায়না ও বায়না দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আজ প্রায় এক মাস হতে চলল কিন্তু এখনও বেলাল বিয়ের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। ইতোমধ্যে নাদিরা তার শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন টের পেল। কিছুদিন যাবত তার পেটে খুব ব্যথা করছে। তার ভয় হচ্ছে সে হয়তো প্রেগন্যান্ট। কি করবে বুঝতে পারছে না নাদিরা। আজ নাদিরা হঠাৎ বমি করল। নাদিরাকে বমি করতে দেখে তার মা চিন্তায় পড়ে গেল। তাকে দ্রুত ডাক্তারের নিকট নিয়ে গেলেন। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করলেন। পরে নাসিমাকে তাঁর চেম্বারে নিয়ে বললেন- আপনার জন্য একটি সু-খবর আছে?
নাসিমা আক্তার আশ্চর্য হয়ে বললেন, আমার জন্য আবার কি সুখবর!
– আপনি নানী হতে যাচ্ছেন। আপনার মেয়ের জামাই কোথায়? এ মুহূর্তে তার পাশে থাকা খুবই প্রয়োজন।
ডাক্তারের মুখে মেয়ের এ খবর শুনে নাসিমা আক্তারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এ আমি কি শুনছি। না না এখানে এসব কথা প্রকাশ করা যাবে না। এক্ষুণি মেয়েকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তারপর বাসায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করব।
– কি ব্যাপার আপনি খুশি হননি?
নাসিমা আক্তার অনেক কষ্টে মুখে হাসি এনে বললেন, খুশি হয়েছি। এমন সংবাদ শুনে কি কেউ খুশি না হয়ে পারে? আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে ম্যাডাম। বলেই তিনি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরই নাসিমা আক্তার নাদিরাকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন।
নাসিমা আক্তার রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললেন, আচ্ছা নাদিরা এ কাজ তুই কার সাথে করলি?
নাদিরা লজ্জায় মথা নিচু করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কি হলো বল, কার সাথে করছিস?
এবার নাদিরা মুখ খুললো- বেলালের সাথে।
– বেলালের সাথে! ছি: তোর বিবেক কি একবারও বাধা দেয়নি? কিভাবে তুই এ কাজ করলি?
– মা আমি ইচ্ছে করে এ কাজ করিনি। আমার বিবেক বাধা দিয়েছে ঠিকই কিন্তু বেলালের বিবেক বাঁধা দেয়নি।
– এক হাতে তালি বাজে না। নিশ্চয় তোর সম্মতি ছিল?
– বিশ্বাস কর মা। আমার এখানে কিছু করার ছিল না।
– কবে এ কাজ করলি?
– তাদের বাড়িতে যেদিন গেলাম। তখন বেলাল আমাকে তাদের বাড়িতে না নিয়ে তার ব্যাচেলর বাসায় নিয়ে যায়।
– এ কথাতো তখন আমাকে কেন বলিসনি?
– বললে আর কি হতো যা হওয়ারতো হয়েই গেছে। তাছাড়া এমন কিছু হয়ে যাবে তাতো ভাবিনি।
– তোর বয়সটাতো আমি পার করে আসছি। তখন হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করতাম। আর তোর বাবা শুনলে তিনি মারা যাবেন।
– প্লিজ মা বাবাকে এখন বল না।
– কতদিন না বলে থাকতে পারবি?
– বেলাল বলছে আমাকে সে বিয়ে করবে। বিয়ে হয়ে গেলে কোন সমস্যা হবে না।
– প্রায় এক মাস হয়ে গেল এখনওতো বেলাল তোকে বিয়ে করেনি।
– সেটাইতো চিন্তা করছি। সে আমাকে ঐদিন রাতে কথা দিয়েছে পরের দিনই বিয়ে করবে। কিন্তু সে আমাকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে এতদিন পর্যন্ত রেখেছে। তাইতো ভয়ে তোমাকে কিছু বলিনি। ভাবছিলাম বিয়ে হয়ে গেলে ব্যাপারটা কেউ জানবে না। কিন্তু আমার সব হিসাব নিকাশ পাল্টে গেল। প্লিজ মা কাউকে কিছু বলনা। তুমি বেলালকে বল আমাকে বিয়ে করতে। তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
– সে এখন কোথায়?
– জানি না।
– তার সাথে আমি কথা বলব। তাকে ফোন দেতো।
ঘটনাটি মা জেনে যাওয়ায় বেলালের প্রতি প্রচ- ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্মেছে নাদিরার। তাই আজ প্রচ- রাগ নিয়ে নাদিরা বেলালকে ফোন দেয়ার জন্য তার নম্বরটি ডায়াল করল। অপর প্রান্ত থেকে মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে আসল- “আপনি যে নম্বরে কল করেছেন সেটি বন্ধ আছে অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।” বেলালের মোবাইলটি বন্ধ পেয়ে এ মুহূর্তে তার রাগ চরমে উঠেছে। বার বার চেষ্টা করেও সংযোগ পায়নি। এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
– মা তাকেতো ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।
– কি বলিস! তাহলে কিভাবে যোগাযোগ করবি?
– তাইতো ভাবছি।
– আজকে চেষ্টা করে দেখ তাকে ফোনে পাস কিনা। যদি ফোনে না পাস তাহলে কাল আমি তার বাসায় যাব।
– ঠিক আছে।
নাদিরার শারীরিক সর্ম্পকের বিষয়টি তার মায়ের কানে গেলে যতটা কঠোর হওয়ার কথা ছিল ততটা কঠোর হয়নি নাসিমা আক্তার। এই ভেবে নাদিরা এখন কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। আজ সারাদিন চেষ্টা করেও বেলালকে ফোনে পাওয়া যায়নি। সারারাত চিন্তায় নাদিরার ঘুম হয়নি। তাহলে কি বেলাল আমাকে ধোঁকা দিয়েছে? না বেলাল এমন হতে পারে না। বেলাল এতটা পাষাণ হতে পারে না। অবশ্যই বেলাল বিয়ে করবে। হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে তাই সে ফোন বন্ধ রেখেছে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই মা মেয়ে দুজনেই বেলালের ব্যাচেলর বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বাসায় গিয়ে দেখে অন্য একটি ছেলে বসা। ছেলেটিকে বেলালের কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, সে এখান থেকে কিছুদিন আগে চলে গেছে। আর এখানে আসবে না। এমনকি তাদের কাছে বেলালের কোন ঠিকানাও নেই। এক কথা শুনার সাথে সাথে নাদিরা ও তার মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এখন কি উপায় হবে? তাকে কোথায় খুঁজে পাবে? এমন প্রতারণা করবে বেলাল তা দু’জনের কেউ ভাবতে পারেনি। বাসায় এসে বেলালের চিন্তায় নাদিরা কাঁদতে লাগল।
তার কান্না দেখে নাসিমা আক্তার বললেন, কি হবে আর কেঁদে? যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন কিভাবে লোকজন জানার আগে এই আপদ দূর করা যায় সে চিন্তা করতে হবে।
– এসব কি বলতে চাচ্ছ মা?
– বেলাল তোকে কোনদিন বিয়ে করবে না। সে একজন প্রতারক, বেইমান। সে কোনদিন তোর কাছে আসবে না। তার অপেক্ষায় থাকলে আমার মান সম্মান সব যাবে। তার চেয়ে বরং এখন এই অবৈধ সন্তান নষ্ট করতে হবে।
– না মা এ আমি পারব না। একবার ভুল করে যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকে সারাজীবন ভোগ করতে হবে। দ্বিতীয়বার ভুল করে আরেকটা জীবন আমি নষ্ট করতে পারব না।
– কার পরিচয়ে তোর সন্তান বড় হবে?
– আমি বেলালকে খুঁজে বের করবই।
– পারবি না। তারচেয়ে বরং আমার কথা শুন।
– না মা। আমার বিবেক এখন জাগ্রত হয়েছে। আমি আমার সন্তান মারতে পারব না। যতদিন বেলালকে না পাব ততদিন তার অপেক্ষায় বসে থাকব।
– পাড়া প্রতিবেশীকে কি বুঝ দিবি?
– জানি না। তারা যা বলার বলবে।
– তোর বাবাকে কি বুঝ দিবি? তোর বাবা কি এ অন্যায় অপমান মেনে নিবে?
– মা তুমি যাওতো আমি আর এখন কিছু বলতে পারছি না। আমাকে একা থাকতে দাও।
কিছুদিন পরে সিলেট থেকে নাদিরার বাবা হঠাৎ করে বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসেই স্ত্রীকে বললেন, নাদিরার জন্য একটি ভাল পাত্র পেয়েছেন। তাকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চান। এ কথা শুনার পর নাসিমা আক্তার ভাবলেন, এইতো সুযোগ। এই সুযোগে যদি মেয়েকে বিয়ে দেয়া যায় তাহলে কুল রক্ষা হবে। তাই তিনি আর বিয়ের ব্যাপারে কোন আপত্তি করলেন না। পরদিন নাসির উদ্দিন এক পাত্র নিয়ে আসলেন নাদিরাকে দেখানোর জন্য। কিন্তু নাদিরা কিছুতেই ঐ ছেলের সামনে যাবে না। তার মা বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছে। দেখ না মা যা হবার হয়ে গেছে। বাবার কথায় রাজি হয়ে যা। তোর বাবার মনে কষ্ট দিছ না।
নাদিরা বলল, মা আমাকে এসব বলে কোন বুঝ দিবে না। আমি এক পাপ করে এখন প্রায়শ্চিত্ত করছি। আবার কেন বার বার আমাকে পাপ করতে বাধ্য করছো। বিয়ে যদি করতেই হয় আমি বেলালকেই করব। যতদিন সে না আসবে ততদিন আমি তার অপেক্ষায় থাকব।
– আচ্ছা ঠিক আছে সেটা পড়ে দেখা যাবে। এখন যা ছেলেটা বসে আছে। মাইন্ড করবে।
– মাইন্ড করলে আমার কিছু বলার নেই।
– যা না এখন ছেলের সামনে গেলেইতো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।
– ঠিক আছে তোমার কথায় আমি যাচ্ছি কিন্তু মনে রাখবে আমি কিন্তু বেলালকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।
তারপর যথারীতি ঐ ছেলে নাদিরাকে দেখে চলে গেল। কিছুদিন পর ঐ ছেলের সাথে নাদিরার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করল। এই খবর যখন নাদিরা জানতে পেল তখন তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এ হতে পারে না। অন্যের সন্তান পেটে নিয়ে বিয়ে করে নিষ্পাপ ছেলেটাকে ঠকাতে পারব না। তাই সে বাবাকে সত্যি কথাটা বলার সিদ্ধান্ত নিল। পরে যা হবার হবে।
নাসির উদ্দিন সোফায় বসে পানি খাচ্ছেন। ঠিক এই মুহূর্তে নাদিরা তার বাবাকে বলল, বাবা আমার পেটে সন্তান। আমি ঐ ছেলেকে বিয়ে করতে পারব না।
মেয়ের মুখে এ কথা শুনার সাথে সাথে নাসির উদ্দিনের হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে গেল। তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কি বললি তুই? তোর পেটে সন্তান! কার সন্তান?
– বেলালের সন্তান।
– তাকে কবে বিয়ে করলি?
– বিয়ে করিনি বাবা আমি পাপ করেছি। আমার পেটে তার পাপের ফসল।
– একি করলি তুই? তোর কি কোন বিবেক বুদ্ধি নেই?
– বাবা আমি নির্বোধ। আমাকে তোমরা যত পার শাস্তি দাও। তবুও ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আরেকটা পাপ করতে বাধ্য করো না।
– তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর কোন সন্তান নেইনি। সারাজীবন তোকে ভালোবেসেছি। আর তুই কিনা এমন পাপ কাজ করলি!
– বাবা যত পার তুমি আমাকে শাস্তি দাও। কিন্তু ঐ ছেলেকে বিয়ে করে আর কোন পাপ করতে চাই না।
– ছিঃ নাদিরা ছিঃ আমি আর তোর মুখ দেখতে চাই না। দূর হ আমার সামনে থেকে। এ কথা শুনার আগে আমার মরণ হলো না কেন? এ আমি মেনে নিতে পারছি না বলেই বুকে হাত দিয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
হঠাৎ করে একমাত্র মেয়ের এমন জঘন্য অপরাধের কথা শুনে তিনি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বলে মাটিতে পড়ে একটি কথাই বলতে পারলেন, “হে আল্লাহ কেন আমাকে এমন শাস্তি দিলে?” তারপর কোন সাড়া শব্দ নেই। তিনি হার্ট অ্যাটাক করলেন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার জানালেন তিনি আর বেঁচে নেই।
নাদিরা যখন ভুল করেছে তখন অন্য কেউ না জানলেও সে নিজে জানে সে কি ভুল করেছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তাকে শাস্তি না দিলেও প্রতি মুহূর্তে বিবেক তাকে শাস্তি দিচ্ছে। তাইতো একটি ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে নিজের মান সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিল। অন্যের সন্তান তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। একটি পাপকে ঢাকার জন্য অন্য আরেকটি পাপ সে করতে চায় না। তার পাপের শাস্তি সে নিজেই বয়ে বেড়াতে চায়। অন্যকে এই শাস্তি ভোগ করতে দিবে না বলেই সে বিয়েতে অমত করেছিল। আর এর জন্য উল্টো তাকে আরো কঠিন শাস্তি পেতে হলো। এই শাস্তি হিসেবে সে তার বাবাকে হারালো।

রচনাকাল: ১২/০৮/২০১৫খ্রি:

বেকার


এক
– মা, মা তুমি কোথায়? ভাত দাওতো। এই কথা বলতে বলতে আদর খাবার রুমে ঢুকল।
আদরের মা চড়া গলায় বললো, কি হয়েছে? এত চিল্লাছিস কেন? নবাবজাদা সারাদিনতো টইটই করে ঘুরে বেড়াস আর ঘুম থেকে উঠস দিনের বারটায়। ঘুম থেকে উঠেই খাবারের জন্য চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিস। বলি ভাত কোথা থেকে আসে? আর কত বেকার থাকবি? একটু কাজ করে খাসনা।
– মা, প্রতিদিন তোমার একই কথা আর ভাল লাগে না।
– ভাল লাগবে কেন? পরের কামাই খাসতো। তাই বুঝবি না। নিজে কামাই করে খেলে বুঝবি।
– এখন ভাত দিবে কিনা বল?
– না দিব না। রোজ তোর গোলামী আর করতে পারব না।
– ঠিক আছে চলে যাচ্ছি। বলেই খাবার রুম থেকে বের হতে যাবে এমন সময় আদরের বাবা রুমে প্রবেশ করল। দুইজনকেই উদ্দেশ্য করে বললো, কি হয়েছে? এত চেঁচামেচি কেন?
স্ত্রী মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, কি আর হবে তোমার গুনধর ছেলের সেবা আমি আর করতে পারবো না।
– কেন করতে পারবে না। আমার দুটো নয় তিনটা নয় একটা মাত্র ছেলে।
– এক ছেলেইতো তিন ছেলের সাধ মিটিয়ে দিচ্ছে?
– যেমন
– এভাবে আর কতদিন তোমার ছেলে বেকার ঘুরবে?
– যতদিন চাকরি না হয়।
– মাস্টার্স পাস করেছে তিন বছর হয়। এখনও একটি চাকরি যোগাড় করতে পারে না। আর কবে চাকরি হবে।
– হবে, এত ধৈর্যহারা হচ্ছ কেন?
– তুমিইতো আশকারা দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছ? তা না হলে কবেই চাকরি পেয়ে যেত। আমারতো সন্দেহ হয় সে মাস্টার্স পাস করেছে কিনা। তা না হলে সে চাকরি পাচ্ছে না কেন?
এ কথা বলাতে আদরের গায়ে লাগল। কি বললে মা, ছিঃ মা তুমি এমন কথা বলতে পারলে? আমাকে তুমি সন্দেহ করো। আরে তুমিতো মেট্টিক ফেল, তাই ছেলেকে নিয়ে এ ধরনের বাজে চিন্তা তোমার মাথায় আসে।
– কি বললি, আমি মেট্টিক ফেল!
আদরের বাবা বললো, এই থামবে তোমরা। আদরের গায়ে হাত দিয়ে বললো, খেয়ে আস। তোর সাথে কথা আছে।
– না বাবা আমি খাব না। দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যাব। আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকব না।
– কে বলছে তুই আমাদের বোঝা?
তাই নয় কি? প্রতিদিন মা আমাকে যেভাবে অপমান করে। এভাবে অপমান সহ্য করে আর বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কথা বলেই আদর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

দুই
আদরের বাবা আব্দুল লতিফ প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত। মা ফরিদা পারভীন একজন পাকা গৃহিনী। আদর তাদের একমাত্র ছেলে। আব্দুল লতিফ আদরকে খুব ভালোবাসেন। তাই তার নাম রাখছেন আদর। আদরের জন্মের পাঁচ বছর পর তার একটা ছোট বোন হয়েছিল। সে শৈশবেই মারা গেছে। পরে আব্দুল লতিফ অনেক অনুরোধ করলেও ফরিদা পারভীন আর কোন সন্তান নিতে রাজি হননি। তাই একমাত্র ছেলে আদরকে নিয়েই তাদের ছোট্ট সংসার। এতদিন আব্দুল লতিফ সরকারী চাকরি করে যা বেতন পেয়েছেন তা দিয়ে কোন রকমে দিন যাপন করেছেন এবং ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন। এখন পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চলে। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল ফরিদা পারভীনের। বর্তমানে আদরের বয়স ২৭ বছর চলে। স্বপ্ন ছিল মার্স্টাস পাস করে চাকরি করে সংসারের স্বচ্ছলতা আনবে। ভালো পরিবার দেখে তাকে বিয়ে করিয়ে লাল টুকটুকে একটি বউ আনবে কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন মাটি হয়ে যাচ্ছে। এখনও বুড়ো বয়সে ফরিদা পারভীনকে রান্না করে খেতে হয়। তাইতো ছেলেকে আর এখন সহ্য করতে পারছেন না তিনি।
এদিকে বাবা আব্দুল লতিফ নরম মেজাজের মানুষ। ছেলেকে তেমন শাসন করেন না। তাই সে যেভাবে খুশি চলছে। তবে চাকরির জন্যে যে চাপ দিচ্ছেননা তাও নয়। মাঝে মাঝে ছেলেকে বলেন, বাবা এভাবে আর কতদিন। একটা কিছু কর।
কিন্তু ছেলের একটাই উত্তর। বাবা চাকরি পেতে হলে মোটা অংকের ঘুষ লাগবে। পারবে ঘুষ দিতে?
– এত টাকা কোথা থেকে দিব বাবা। আমি গরিব স্কুল মাস্টার। তাছাড়া এখন চাকরিও নেই। পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চলে। আমার পক্ষে কি এত টাকা ঘুষ দেয়া সম্ভব?
– তাহলে চাকুরি হবে না। এভাবেই চলতে হবে।
এই নিয়ে আদরের মা ফরিদা পারভীনের সাথে প্রতিদিনই কথা কাটাকাটি হয়। প্রতিদিন মায়ের অপমান সহ্য করতে করতে এ পর্যন্ত আসছে। তাই আজ আর মায়ের কথা সহ্য করতে পারল না। তাইতো অজানা উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

তিন
মায়ের সাথে রাগ করে আদর চলে আসল বন্ধু মনিরের বাসায়। পরদিন মনির তাকে একটি মেস ঠিক করে দিল। আদর মেসে উঠল। কিছুদিন পর একটি টিউশনী ঠিক করল। এইভাবে চলছে তার বেকার জীবন। পাশাপাশি চাকরির চেষ্টা করছে।
এদিকে তার প্রেমিকা কবিতাও তার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। বেকার বলে তাকে প্রায়ই খোটা দেয়। কবিতার কথায় খুব কষ্ট লাগে আদরের। প্রায়ই তাদের মধ্যে বিয়ে প্রসঙ্গ এলেই কবিতা বলে, বিয়ে করে বউকে খাওয়াবে কি? যে নিজেই অন্যের ঘাড়ে চড়ে খায় সে কিনা বিয়ে করবে! আগে চাকরি নাও, তারপর বিয়ে।
আদর বলে, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে আল্লাহর হাতে। তাতে মানুষের কোন হাত নেই। আমার ভাগ্য তোমার সাথে থাকলে তোমার সাথেই বিয়ে হবেই। অন্যথায় হবে না।
আদরের কথায় কবিতা রাগ করে। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে আদর কবিতাকে একটি থাপ্পর মারে। তারপর কবিতা রাগ করে বললো, তোমার মতো বেকারের সাথে আমার কোন সর্ম্পক নেই। যেদিন চাকরি পাবে সেদিন আমার সাথে আসবে।
– ঠিক আছে যাও। যেদিন চাকরি পাব সেদিন তোমার কাছে আসব।
এদিকে কবিতার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কিন্তু সেদিকে আদরের খেয়াল নেই। সে এখন চাকরির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে কবিতার কথা মনে হলেই ভাবে কবিতাতো ঠিকই বলে বিয়ে করে কি খাওয়াব বউকে? সেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।’ অভাবের কাছেতো ভালোবাসার কোন মূল্য নেই।
আদর ও কবিতা দু’জন দু’জনকে খুবই ভালোবাসে এতে কারো সন্দেহ নেই কিন্তু বেকারত্ব দু’জনকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কবিতা একটা জিনিস কখনো বুঝতে পারে না, আদর যখন কবিতার সামনে আসে তখন সে মুখের ভাবটা এমন করে আসার চেষ্টা করে যেন তাকে দেখলে মনে হয়, সে প্রচ- চিন্তার মধ্যে আছে কিন্তু আসলে তা না। কবিতা তা বুঝে। মাঝে মাঝে কবিতা ভেবে পায় না কি দেখে সে এই আদরের সাথে প্রেম করতে গিয়েছিলো। কবিতার বাবা প্রায়ই বাসায় পাত্র নিয়ে আসছেন যেকোন দিন বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন! অথচ আদর এখন পর্যন্ত একটা চাকরি জোগাড় করতে পারল না।

চার
আদর এখন প্রতিদিন সকাল বেলা পত্রিকা পড়ে। বিশেষ করে চাকরির নিয়োগগুলো বেশি পড়ে। আজ সকালে হঠাৎ তার নজরে পড়ল পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট ছোট অনেক গুলো বিজ্ঞাপন। এক জায়গায় লেখা পাত্র চাই বিজ্ঞাপনটি তার নজরে আসল।
শিক্ষিত, ভদ্র, পাত্র চাই। ছেলে পছন্দ হলে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। বেকার হলে চলবে। সরাসরি যোগাযোগ পাত্রীর বাবা-০১৭১০ .. .. ..।
আদর এ বিজ্ঞাপন দেখে ভাবছে, এইতো সুযোগ এক ঢিলে দুই পাখি মারার। ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। তার মানে চাকরি দিবে। বড় লোক বাবার মেয়েও বিয়ে দিবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
হাতের কাছে থাকা সেলফোনটা নিয়ে বিজ্ঞাপনের নম্বরে ফোন দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু এই মূহুর্তে মোবাইলে পর্যাপ্ত পরিমান ব্যালেন্স না থাকায় কল করা সম্ভব হচ্ছে না। তাইতো আদরের এখন খুব রাগ হচ্ছে। নিজেই নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। তারপর পাশের দোকান থেকে দশটি টাকা রিচার্জ করে নিল। বেচারা দোকানদার দশ টাকা রিচার্জ করার জন্য আদরের কাছ থেকে বারো টাকা নিল।
বাসায় এসে আবার কল না দিয়ে মিসকল দিল। মিসকলের উত্তরে পাত্রীর বাবা ফোন দিল। আদর রিসিভ করে বললো, হ্যালো…। আসসালামু আলাইকুম।
অপর প্রান্ত থেকে পাত্রীর বাবা বশির আহমেদ বললো, ওয়ালাইকুম আসলাম। আপনি কে?
– আঙ্কেল আমি আদর।
– মিসকল দিচ্ছেন কেন?
– না মানে আমি আজ পত্রিকায় ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দেখে মিসকল দিলাম।
– তাতো বুঝলাম কিন্তু মিসকল কেন দিচ্ছেন? কল করতে পারেন না।
– আমার মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।
– ব্যালেন্স না থাকলে মিসকল আসে কিভাবে?
– হ্যাঁ তাইতো। অল্প টাকা আছে। দশ টাকা লোড নিয়েছি।
– ঠিক আছে বলেন কি বলবেন।
– আপনি পাত্রীর কি হন?
– বাবা
– ও আচ্ছা। আঙ্কেল কেমন আছেন?
– ভাল। আপনি কেন ফোন করেছেন?
– আমি পাত্র। আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
– ভাল কথা। কিন্তু যার মোবাইলে ফোন দেওয়ার মতো টাকা থাকে না সে কিভাবে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?
– আপনিতো বেকার ছেলে খুঁজছেন বলে বিজ্ঞাপন দিলেন। বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলছেন। আমি সেই বেকার ছেলে যার মোবাইলে কথার বলার মতো পর্যাপ্ত পরিমান টাকা পর্যন্ত থাকে না। আপনি কি এমন ছেলে চান না?
– ও আচ্ছা। ঠিক আছে। তুমি বাসায় আস। আমার মেয়েকে দেখ। আমরাও তোমাকে দেখি। পছন্দ হলে অবশ্যই বিয়ে দিব এবং চাকরিও দিব।

পাঁচ
আদর বেকার হলেও খুব স্মার্ট ছেলে। সব সময় সাজগোজ করে ভালো পোষাক পরে থাকতে পছন্দ করে। কথাবার্তায়ও কোন অভদ্রতার চাপ নেই। সদা হাসোজ্জল। আজ পাত্রী দেখার উদ্দেশ্যে পাত্রীর বাড়িতে আসল। বাসায় এসে কলিং বেল টিপ দিতেই বশির আহমেদ দরজা খুললো। আদর ওনাকে দেখেই সালাম দিয়ে বললো, আঙ্কেল এটা কি বশির আহমেদ এর বাড়ি?
– জি।
– বশির আহমেদ আছেন?
– আমিই বশির আহমেদ। আপনি কে?
– আমি আদর। গতকাল আপনার সাথে পাত্রী দেখার ব্যাপারে কথা বলছিলাম।
– ও আচ্ছা। আস বাবা। ভেতরে আস।
আদর ভেতরে প্রবেশ করল। ডাইনিং রুমে বসল। পাত্রীর মা রুখসানা আহমেদ আসলেন। বশির আহমেদ আদরকে পরিচয় করিয়ে দিল। ও হচ্ছে আদর। আমার মেয়ে তানিয়াকে দেখতে এসেছে।
রুখসানা আহমেদ বললেন, ও আচ্ছা। তোমার কে কে আছে?
আদর বললো, মা ও বাবা।
– আর কে আছে?
– আর কেউ নেই।
– তার মানে তোমার কোন বোন বা ভাই নেই?
– না।
– তোমার বাবা কি করেন?
– বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল মাস্টার।
বশির আহমেদ বললেন, তোমার পড়াশুনা কতটুকু?
– রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি। চাকরি খুঁজছি। এখনও চাকরি পাইনি। ঘুষ ছাড়া চাকরি নেয়া যাচ্ছে না। তাই চাকরিও পাচ্ছি না।
রুখসানা আহমেদ বললেন, তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমাদের মেয়ে যদি তোমাকে পছন্দ করে তাহলে তোমাকে চাকরি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
বশির অহমেদ বললেন, হ্যাঁ। আমি একজন ব্যবসায়ী। আমার কোন ছেলে নেই। আমার মৃত্যুর পর এই সহায় সম্পতির একমাত্র উত্তরাধিকারি হচ্ছে আমার মেয়ে তানিয়া। তাই মেয়ের জন্য এমন একজন ছেলে খুঁজছি যে নম্র, ভদ্র, বিনীয় ও শিক্ষিত হবে। আমার মনে হয় তুমিই সেই ছেলে। যাকে আমরা এতদিন খুঁজছি। কি বল?
– জি অঙ্কেল। আদর মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানাল।
রুখসানা আহমেদ মেয়েকে ডাকলেন, তানিয়া… এই তানিয়া এই দিকে আয়। দেখতো কে আসছে।
তানিয়া পাশের রুম থেকে বলছে, জি মা আসছি।
তানিয়া ডাইনিং রুমে এসেই আদরকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললো। মা ও কে?
– ঐ যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম তোর জন্য পাত্র চেয়ে। তোকে সে দেখতে আসছে। দেখ ওর সাথে কথা বলে।
– ও আচ্ছা বলেই তানিয়া সোফায় বসল। তানিয়াকে দেখে আদর হা করে তাকিয়ে রইল। এত সুন্দর মেয়ে সে আগে কখনও দেখেনি। দেখতে খুব সুন্দর। এই মেয়েকে হাত ছাড়া করা যাবে না।
রুখসানা আহমেদ বশির আহমেদকে বললেন, চল আমরা যাই। আর তানিয়া ও আদরকে বললো, তোমরা কথা বল আমরা আসছি।
মা-বাবা চলে যাওয়ার পর তানিয়া আদরকে বললো, কি নাম আপনার?
– আদর।
– খুব সুন্দর নামতো। কে রাখছে?
– বাবা।
– বাবা খুব আদর করে তাই না?
– হ্যাঁ। বাবা আমাকে খুব আদর করে। তাইতো আদর করে আমার নাম রাখছেন আদর।
– আমাকে কি পছন্দ হয়েছে?
– আপনার মতো মেয়েকে পছন্দ না হয়ে পাড়ে।
– আমার মাঝে কি আছে যে, প্রথম দেখায় আমাকে পছন্দ করে ফেললেন?
– রূপ, যৌবন, ধনসম্পদ, শিক্ষা দীক্ষা সবই আছে।
– আমার কিন্তু আপনাকে পছন্দ হয়নি।
এই কথা বলাতে আদরের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। তার বাবা মা আমাকে পছন্দ করল। অথচ সে পছন্দ না করলে আমার কাছে বিয়ে দিবে না। না তা হতে পারে না।
– কি ভাবছেন?
– না মানে কিছু না।
– বুঝেছি পছন্দ হয়নি বলে মনে কষ্ট পেয়েছেন। জোক করলাম। আসলে কি আপনাকে আমার অসম্ভব পছন্দ হয়েছে।
এবার আদর খুব খুশি হয়ে বললো, সত্যি বলছেন?
– হ্যাঁ সত্যি। তবে আমাকে আপনি নয় তুমি করে বলবেন।
– ঠিক আছে। তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।
– ঠিক আছে।
তারপর দু’জন আরো কিছুক্ষণ কথা বললো। পরে তানিয়া তার রুমে ফিরে গেল। এক সময় তানিয়ার মা রুখসানা আহমেদ ডাইনিং রুমে নাস্তা নিয়ে আসলেন। আদর নাস্তা খেল।
রুখসানা আহমেদ তানিয়ার রুমে গিয়ে বললেন, কি ছেলে পছন্দ হয়েছে?
– হ্যাঁ মা। তোমরা কথাবার্তা বলতে পার।
– ছেলেটা কিন্তু দারুন। গরিব হলেও তোর সাথে মানাবে ভাল।
– হ্যাঁ।
বশির আহমেদ আদরের কাছে এসে বললেন, তুমি আগামীকাল তোমার মা-বাবাকে নিয়ে আসবে। বিয়ের ব্যাপারে তাদের সাথে কথা বলব।
আদর বললো, আমাকে মাফ করবেন আঙ্কেল। আমি আমার বাবা মাকে নিয়ে আসতে পারব না। কারণ তারা আসবে না। আমি বাড়ি থেকে রাগ করে আসছি। চাকরি না নিয়ে আর কোন দিন তাদের বাড়িতে ফিরব না। আমাকে পছন্দ হলে দিনক্ষণ ঠিক করে বিয়ে দিন। আমি রাজী। তারপর তাদের সাথে দেখা করব।
– ও আচ্ছা। ঠিক আছে।
রুখসানা আহমেদ আবার এখানে ফিরে এসে বললেন, ও বাবা একটা কথা বলতে ভুলে গেলাম। আগে বলে নেয়া ভাল। আমাদের যেহেতু ছেলে নেই তাই বিয়ের পর তোমাকে আমাদের এখানে থাকতে হবে। অর্থাৎ ঘরজামাই থাকতে হবে। কি রাজী?
– পরে জানাচ্ছি বলে চলে আসল আদর।

ছয়
বাসায় এসে অনেক চিন্তা করল আদর। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সে। বাবা মাকে ছেড়ে ঘরজামাই থাকাটা কি শুভ হবে। কিন্তু এ ছাড়াতো এমন পাত্রী পাওয়ার কোন উপায়ও পাচ্ছে না। আগে বিয়ে করি তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।
পরদিন আদর ফোন করে তার সম্মতির কথা জানিয়ে দিল বশির আহমেদকে। বশির আহমেদ দিনক্ষণ ঠিক করে তাদের বিয়ে দিয়ে দিল।
বউ নিয়ে আদর বাড়ি ফিরছে। প্রতিমধ্যে দেখা হল তার প্রেমিকা কবিতার সাথে। কবিতা বললো, কি ব্যাপার তোমার সাথে ও কে?
আদর মুচকি হেসে বললো, আমার স্ত্রী।
– স্ত্রী!
– হ্যাঁ। শুধু স্ত্রী নয়। ও আমার চাকরি। ও আমার সম্পদ।
– এসব কি বলছ তুমি?
– তুমিতো বলেছিলে, যেদিন চাকরি পাব সেদিন তোমার সাথে দেখা করতে। এখন আমি চাকরিও পেয়েছি, বউও পেয়েছি। তুমিতো বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে চাওনি। ও কিন্তু বেকার ছেলেকেই বিয়ে করেছে। আর ওর বদলতেই আমি চাকরিও পেয়েছি। এবার খুশিতো। বলেছিলাম না জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে আল্লাহর হাতে। তাতে মানুষের কোন হাত নেই।
এ কথা শুনার পর কবিতা আর ঠিক থাকতে পারল না। একি করলে তুমি আদর! এ কথা বলেই মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

রচনাকাল: ৩ মার্চ ২০১৫খ্রি:

সিয়াম সাধনা


দিন চলে যায়, রাত আসে এভাবে চলে যায় সপ্তাহ। পার হয়ে যায় মাস। দেখতে দেখতে চলে গেল এগারটি মাস। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেই পবিত্র মাহে রমযান এসে উপস্থিত হল আমার সামনে। সংকেত আসল আর মাত্র একদিন বাকী। মুহূর্তেই মনটা মোচর দিয়ে উঠল।
রমযান উপলক্ষে কলেজ একমাস পনের দিন বন্ধ। ভাবছি এ বছর বাড়িতে গিয়ে রোযার মাসটা কাটাব। তাই কালবিলম্ব না করে আজই কাপড়-ছোপড় গুছিয়ে রওয়ানা হলাম। ঢাকা থেকে বাসে নরসিংদী আসলাম। বাম হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ২:২৫ মিনিট।
হায়! এখন কি হবে, লঞ্চতো ২:৩০ মিনিটে ছেড়ে যাবে।
আর দেড়ি না করে তাই দ্রুত একটি রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম। রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ভাইজান একটু দ্রুত চালান। তা না হলে লঞ্চটা ফেল করতে হবে। তখন আমাকে এক ঘন্টা বসে থাকতে হবে।
রিক্সাওয়ালা তার সাধ্যমত রিক্সা চালাচ্ছে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে দৌঁড়ে টারমিনালে ডুকলাম। না, পারলামনা লঞ্চটাকে ধরতে। আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।
সময়ের যে কত মূল্য এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন আমাকে তীর্থের কাকের মতো এক ঘন্টা বসে থাকতে হবে।
অন্য কিছু আর চিন্তা ভাবনা না করে ব্যাগ থেকে কিশোরকণ্ঠ পত্রিকাটি হাতে নিয়ে টারমিনালের এক কর্ণারে বসে পড়লাম।
কখন যে এক ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেল তা টেরও পেলাম না। লঞ্চ টারমিনালে এসে হর্ণ বাজাচ্ছে। কানে আওয়াজ আসতেই জটপট ওঠে পড়লাম।
সূর্যটা পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে। লঞ্চে এসে সিট নিয়ে বসে পড়লাম। বিকেল পাঁচটায় বাড়ি এসে পৌঁছলাম। সূর্যের আলো ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
বাড়িতে এসেই দেখি মা নামাযের বিছানায় বসে কি যেন ভাবছে। আমি আস্তে করে মায়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা হঠাৎ পিছনে ফিরে আমাকে দেখতে পেয়ে বললো, কিরে বাবা কখন এলি।
আমি বললাম, এইতো কিছুক্ষণ হয়। কেমন আছ মা?
ভাল, তুই কেমন আছিস।
আমিও ভাল মা।
অনেক দিন যাবত তোকে দেখিনা বাবা। বস আমার পাশে।
আমি চুপ করে মার পাশে বসে পড়লাম। তারপর বললাম, মা আমি এ বছর রোযার মাসটা বাড়িতে কাটাব।
মা বললো, বেশ ভাল কথা, আমিও তো চাই তুই অন্তত রোযার মাসটা আমার কাছে থাকবি।
মা মুহূর্তে আবার বললো, যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নে, কখন না কখন খেয়ে আসছিস। তাছাড়া আজ চাঁদ উঠলে কাল থেকে রোজা রাখতে হবে আর দিনে খেতে পারবি না।
তাই বলে এখন এ অসময়ে আমাকে খেতে হবে!
তাতে কি হয়েছে। অনেক দিন তোকে খাওয়াইনি। আজ আমি তোকে নিজের হাতে খাওয়াব। প্রতিটি মা কামনা করে তার সন্তান তার পাশে বসে খাক। যা জলদি যা হাতমুখ ধুয়ে আস।
এসব কথা বলতে বলতে মার চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি জমে গেছে।
মার পিড়াপিড়িতে ভাত না খেয়ে পারলাম না। কারণ মাকে যে, আমি অনেক ভালোবাসি।
বিকেলের সূর্যটা ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে দেহের উত্তাপ হারিয়ে ফেলছে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
আমাদের গ্রামের দক্ষিণ পাশে বিল। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বিলের পাড় আসলাম। নরম কোমল রোদ এসে গায়ের উপর পড়ে দেহের শিরায় উপশিরায় মিশে যাচ্ছে। আর একটু পরেই রক্তিম সূর্যটা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পৃথিবীকে অন্ধকার করে চলে যাবে। তখন হয়তো বা কে‌উ তাকে বাঁধা দিয়ে রাখতে পারবে না।
আমি অপলক দৃষ্টিতে রক্তিম সূর্যটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখের সামনে সূর্যটা বৃন্তচুত্ত্য কমলার মতো টুপ করে পৃথিবীকে নিমিষে অন্ধকার করে চলে গেছে। এদিকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে পবিত্র মাগরিবের আযানের সুর ভেসে আসছে। আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে। চাঁদ এখনো উঠেনি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চাঁদ দেখার জন্য এতক্ষণে বিলের পাড় এসে ভিড় জমাচ্ছে।
আমি দ্রুত মসজিদে এসে মাগরিবের নামায আদায় করলাম। তারপর ফিরে আসলাম আবার বিলের পাড়ে। পশ্চিমাকাশে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম পবিত্র মাহে রমযানের এক ফাঁলি রূপালী চাঁদ কাস্তের মত বাঁকা হয়ে উঠছে। আমি সাথে সাথে চাঁদ দেখার দোয়া পড়ে নিলাম।
ছেলে-মেয়েরা পশ্চিম দিগন্তের দিকে ফিরে একে অপরকে আঙ্গুঁল দিয়ে দেখিয়ে বলছে, ঐ আকাশে চাঁদ উঠেছে, কাল থেকে রোযা রাখতে হবে। এই আনন্দে সবাই মেতে উঠল। মসজিদের হুজুর মাইক দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে আজ থেকে তারাবি পড়তে হবে। সবাইকে সাড়ে সাতটায় মসজিদে আসতে বলা হয়।
গোধূলী বেলার ম্লান আভা ছড়িয়ে পড়ছে সারা আকাশে। অসংখ্য তারা আকাশে মিট মিট করে আলো দিচ্ছে। কিন্তু চাঁদ এতক্ষণে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে।
তারাবি নামায পড়ে বাড়িতে আসতেই মা বলল, বাবা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। ভোররাতে উঠতে হবে। মার কথায় সাথে সাথে শুয়ে পড়লাম।
আমি ঘুমিয়ে আছি। কখন যে আমার মা ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে বসছে তা বলা মুশকিল।
রান্না শেষ করে মা আমাকে এসে ডাক দিল। মার ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গল। কিন্তু পরক্ষণেই চোখের পাতায় আবার ঘুম আসছে। হালকা শীত প্রকৃতির বুকের উপর পড়ছে। শয়তান আমাকে উঠতে দিচ্ছে না।
আবার মা এসে ডাকছে, কি ব্যাপার তুই এখনও উঠছনি। তাড়াতাড়ি আস, চারটা পনের বাজে।
আমি তখন ঘুমকাতর স্বরে বললাম, আসছি মা তুমি যাও। একথা বলে লেপটাকে একটা লাথি মেরে শয্যা থেকে উঠে পড়লাম। ব্রাশ, টুথপেস্ট হাতে নিয়ে কলের পাড় গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে ঘরে ঢুকলাম।
মা, বোন ও আমি খেতে বসলাম। কিন্তু ছোট ভাই রবিউল্লাকে ডাকলেন না মা।
কখন যে ছোট ‍ভাইটি ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আমার পাশে এসে বসল তা টেরও পেলাম না।
মা ওকে দেখতে পেয়ে রাগের ভাব ধরে বললো, তুই কিসের জন্য এসেছিস। যা ঘুমা গিয়ে, সকালে খাবি।
সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, মা আমি রোযা থাকব।
না তোর রোযা থাকতে হবে না।
আমি বললাম, সে যখন খেতে চাচ্ছে ‍তাতে তোমার অসুবিধাটা কোথায়?
মা বললেন, ছোট মানুষ রোযা থাকলে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে। আর এমন না যে, তার বার বছর হয়ে গেছেযে, তাকে রোযা রাখতেই হবে।
তার যখন সখ রোযা থাকতে থাকুক। এতে গুনাহ হবে না। রোযা রাখার অভ্যাস এখন থেকেই করতে হবে। তুমি ওকে খেতে দাও।
মা আর আমার কথার প্রতিউত্তর করলেন না।
ভাইটি চুপটি করে আমার পাশে বসে আছে কিছুই বলছে না।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, কিরে মুখ ধুলিনা। জলদি যা দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে ‍আস।
সে দ্রুত মুখ ধুয়ে এসে আমার পাশে পিড়ি নিয়ে বসে পড়ল।
আমার মনে পড়ে গেল আজ থেকে দশ বছর আগের কথা। তখন রোযা হতো বৈশাখ মাসে। তখন গাছে গাছে আম কাঁঠাল পাকত। আমাদের চারটি আম গাছ ছিল। প্রতিটি গাছেই আম আসত। সে সময় মা আমাকে রোযার দিনে ভোর রাতে ডাক দিতেন না। কারণ আমি তখন ছোট ছিলাম। প্রতিদিন মা-বাবা আম দুধ দিয়ে সেহরী খেত। আমি ঘুম থেকে ওঠে আমের বড়াগুলি দেখতাম। তবে আমাকে মা দিনের বেলা প্রচুর আম দিত। আমি তখন কাঁদতাম কেন আমাকে ভোর রাতে ডাক দিলে না।
মাঝে মাঝে রাতে উঠলে মা আমাকে ধমক দিত। তখন সুপারিশ করার মতো কেউ ছিল না। তাই রোযা থাকতে পারি না। কিন্তু আজ আমি সুপারিশ করতেই মা ছোট ভাইটিকে খেতে দিল।
সেহরী খেয়ে ফযরের নামায পড়লাম। আকাশ একটু ফর্সা হচ্ছে। শীতে শির শির করে কাপঁছি। চোখের পাতায় ঘুম আসছে। তাই আবার শুয়ে পড়লাম। সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠলাম।
দুপুরকে আস্তে করে ঠেলে বিদায় করে দিয়ে বিকেল আশ্রয় নিল প্রকৃতির বুকে। রোদের তাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। আকাশে একটুও মেঘের আভা নেই।
আমার একটু একটু খিদে লাগছে। কিন্তু মনকে এ বলে শান্ত্বনা দিলাম যে, এইতো আর অল্প কিছুক্ষণ বাকী।
এদিকে ছোট ভাইটি এখনও রোযা ভাঙ্গেনি। মা কতবার বললো, রোযা ভেঙ্গে ফেলার জন্য কিন্তু কিছুতেই সে ভাঙ্গেনি। তার পেট খিদে চোঁ চোঁ করছে। সে পেটটি নিচের দিকে দিয়ে খাটে শুয়ে আছে।
এখন পৌনে পাঁচটা বাজে। রেডিওতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত হচ্ছে। রেডিও ছেড়ে দিলাম। সবাই কুরআন তেলাওয়াত শুনছে।
আমি দোকান থেকে মুড়ি, বুট, ডালের বড়া নিয়ে আসলাম।
সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল রং ধারণ করেছে, একটু পরেই ডুবে যাবে। চারদিক হালকা অন্ধকার হয়ে আসছে।
কোরআন তেলাওয়াত শেষ। আমরা সবাই পাটি বিছিয়ে ইফতারি সামনে নিয়ে বসে পড়লাম। ছোট ভাইটি আমার পাশে বসল। আযান দেওয়ার সাথে সাথে রোযা ভেঙ্গে ইফতারি শুরু করলাম। এর মধ্য দিয়ে একটা রোযা পূর্ণ হয়ে গেল।
রচনাকাল- জানুয়ারি ২০০০ খিস্টাব্দ।

স্মৃতিগুলো মনে পড়ে

স্কুল জীবন শেষ করে আজ কলেজে পা রাখলাম। যাদের সাথে দশটি বছর লেখাপড়া করলাম, তাদেরকে ছেড়ে আসতে খুবই কষ্ট হয়েছে। তবুও আসলাম। তারা কতইনা আপন ছিল আমার। কত জায়গায় ঘুরেছি তাদের সাথে। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে কাশেম, নজরুল, আরাফাত ও জয়নাল খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল আমার। ক্লাশে একটু ফাঁক পেলেই আড্ডায় মেতে থাকতাম আমরা।
আমি ছিলাম ক্লাসের ফাস্টবয়। সবাই আমাকে ক্লাশের নেতা নির্বাচন করেছিল। আমি যা বলতাম ওরা তা শুনত। যখন কোন অন্যায় দেখতাম তার প্রতিবাদ করতাম। তারা আমার পিছনে থাকত। কখনো পিছপা হতো না। তাইতো আজ কলেজে এসে আমার মনে পড়ে সেই ফেলে আসা বন্ধুদের নিয়ে সোনালী স্মৃতিময় দিনগুলির কথা। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। যেদিন আমরা ক্লাশের সবাই মিলে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম ঐতিহ্যবাহী সোনার গাঁওয়ে। আমাদের মধ্যে শ্রেণী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন রহিছ স্যার। কাশেম, নজরুল, আরাফাত ও জয়নাল আমরা সব সময় এক সাথে থাকতাম। তাই সেখানে গিয়েও আমাদের পঞ্চজুটি ভাঙ্গেনি। আমার হাতে ছিল ক্যামেরা। গেটে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম একটি পুকুর। এখানে পাঁচ বন্ধু মিলে ছবি তুললাম। তারপর একের পর এক ছবি তুলে সমস্ত ফিল্ম শেষ করলাম। আজও সেই ছবিগুলো দেখলে মনে হয় এখনও বুঝি সেই সোনার গাঁওয়েই আছি।
রহিছ স্যার ছিল আমার প্রিয় স্যার। ওনি আমাকে খুব আদর করতেন। ওনার সাথে সেদিন সোনার গাঁওয়ে যেতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হয়েছিল। সেদিন অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সোনার গাঁও থেকে ফিরে আসতে হল। সোনার গাঁও যেন আমাকে বলছে, ‘আশিক আর একটু থেকে যাও।’ তাইতো সেই স্মৃতিগুলোমনে পড়ে আজও।
আমার সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতি হলো আমি যখন এস.এস.সি পরীক্ষা দেই তখনকার স্মৃতিটা। আমরা পাঁচ বন্ধু পাশাপাশি সিটে পরীক্ষা দিচ্ছি। আমার পিছনে ছিল জয়নাল। নবম পরীক্ষার চলছে। তখন বাজে ১২:৪৫ মিনিট। এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট এসে জয়নালকে লক্ষ্য করে বললো, ‘দাঁড়াও’। এ কথা শুনতে পেয়ে আমার শরীর থর থর করে কাপতে লাগল। না জানি আমাকে চেক করে কিনা। তবে আমি ছিলাম নিশ্চিত। কারণ আমার কাছে তখন কোন নকল ছিল না। তারপরও আমার ভয় বেড়েই চলল। এদিকে জয়নালের সমস্ত শরীর চেক করল। তার পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরা পেল। সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে বহিস্কার করে খাতাটা নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন। তখন জয়নাল জ্ঞানহারা হয়ে বেঞ্চের উপর পড়ে গেল। থেমে গেল আমাদের কলম। হায়রে নির্মমভাগ্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ জয়নালের মত একটা ভাল ছাত্র বহিস্কার হয়ে গেল। অথচ যারা নকলের উপর ভরসা করে পরীক্ষার হলে আসে তারা দিব্যি পরীক্ষা দিচ্ছে। আমরা খাতা জমা দিয়ে জয়নালকে রূম থেকে বের করে মাথায় পানি দিলাম। কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরে এলে ওকে নিয়ে তাদের বাড়িতে আসি। জয়নালের মা ছিল অসুস্থ। ছেলের এ পরিণতির কথা শুনে সাথে সাথে তার মা হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেল।
বন্ধু জয়নালের জীবন থেকে খসে গেল একটি রঙিন জীবন। যা আর কখনো ফিরে আসবে না। কলংকের দাগ লেগে গেল সমস্ত শরীরে। বন্ধুর সেই দৃশ্যটার কথা মনে হলে আজও বুকটা ছ্যাত করে উঠে। এসে যায় চোখে জল।
রচনাকাল-এপ্রিল ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।

শাপলা-শালুক


বর্ষা মানেই বৃষ্টি। আর বৃষ্টি মানেই ঘরে বন্দি হয়ে থাকা। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট-হাট করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। কোথাও বের হওয়া যায় না। রাস্তায় হাটুঁ পানি জমে যায়। কাদায় রাস্তা একাকার হয়ে যায়। ক্লাশে যাওয়া যায় না। অফিসে যাওয়া যায় না। দোকানে যাওয়া যায় না। সারাদিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে হয়। অবশ্য প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য বর্ষাকাল খুব ভাল। সারাদিন ঘরে বসে ফোনালাপ করা যায়। কবি সাহিত্যিকরা ঘরে বসে গল্প, কবিতা লিখেন। আমি তেমন কোন সাহিত্যিকও নয় যে, এই বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে গল্প, কবিতা লিখে সময়টা পার করব। আর ছোটদের জন্য বর্ষাকালটা আরো ভালো। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে খেলা যায়। বর্ষার পানিতে নেমে সাঁতার খেলা, শাপলা-শালুক কুড়ানো, মাছ ধরা, কলার ভেড়ায় চড়া, নৌকা ভ্রমণ আরো কত কি! বর্ষায় বাংলার মাঠঘাট ডুবে যায়। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা সবই পানিতে টইটুম্বর হয়ে যায়। দূর থেকে পানিতে ভাসমান গ্রামকে দেখে মনে হয় কোন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ডিঙি নৌকায়, কলার ভেলায় চড়ে মানুষ এ বাড়ি ও বাড়ি যায়। দৃশ্যটি বেশ উপভোগের।
আজ সকাল থেকেই মেজাজটা খুব চড়া। সেই কাকডাকা ভোর থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো একনাগারে আবার কখনো থেমে থেমে। সে কি বৃষ্টি! বাইরে কিছুই দেখা যায় না। বাইরে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে গেছে। সারাদিন অলসভাবে ঘরে বসে সময় পার করলাম। দোকানেও গেলাম না। কারণ এই বৃষ্টির মধ্যে আমি কষ্ট করে গেলেও কোন ক্রেতা আসবে না। তার চেয়ে বরং ঘরে বসে লুডু খেলায় ভাল। যেই ভাবা সেই কাজ। ছোট বোন মোমেনা, ছোট ভাই রবিউল ও মায়ের সাথে লুডু খেলায় মেঠে উঠলাম। লুডু খেলতে খেলতে কখন যে সন্ধ্যা হলো খেয়াল নেই। এবার লুডু খেলায় বিরতী দিলাম।
পড়ার রুমে গিয়ে বসলাম। জানালা খোলা। এখনও টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। বাইরের দিকে তাকালাম। চারদিক অন্ধকার। পাশেই কদম গাছে কদম ফুল হাসছে। মনকাড়া হাসি। বাগানে রজনীগন্ধা ফুট ফুটেছে কি মিষ্টি গন্ধ! নাকে লাগে ফুলের সুবাস। এসব দেখে ভাবছি উদাস মনে শৈশবের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা। বর্ষায় ফুটে নানা ফুল। কদম, কেয়া, শাপলা, রজনীগন্ধা, পদ্মা, হাসনাহেনা, কলাবতী, হিজল, চালতা, কলমিলতা, দোলনচাঁপা, নীলকমল, সুলতানচাঁপা, কাঁঠাল চাঁপা, কচুরিপানা, এমন নানা নামের বিচিত্র ফুল। আম, কাঁঠালের মধুর গন্ধ বর্ষায়ও যেন নাকে লেগেই থাকে। ডাহুক, শালিক, কাক, কোকিল, হরেক রকম পাখির কিচিরমিচির ডাকে প্রকৃতি মেতে ওঠে এ বর্ষায়। হাজার রূপে বর্ষার রূপের কথা বলে শেষ করা যায় না।
আউশের ক্ষেতে নেমেছে কৃষক। কাটছে ধান। আঁটি মাথায় ছুটছে কৃষক। বাড়ির পাশে বিল। বিলে শাপলা ফুটে হাসছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা শাপলা-শালুক কুড়িয়ে আনছে। মাছ ধরছে। হাঁসগুলো সাঁতার কাটছে বিলের জলে। বকগুলো বিলের পাড়ে কুচুরী পানার উপর বসে আছে। মাছ ধরে খাচ্ছে। ব্যাঙ ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। বর্ষার আগমনবার্তা জানিয়ে ডাহুক আপন মনে ডাকছে অনেকক্ষণ। দোয়েল শীষ দিচ্ছে। বর্ষার মাঠে সবুজ ধানের শিষগুলো দুলছে আর বর্ষার রূপ কীর্তন গাইছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শালুক কুড়াচ্ছে ডুবাইয়ে। শাপলা তুলছে নৌকায় করে। উদাস করা পল্লীবধূ ঘোমটা পরা রাঙামুখ টেনে ছই নৌকায় বাপের বাড়ি নাইয়র যাচ্ছে। পাল তোলা নৌকা কলকল করে এগিয়ে চলছে। চলতে থাকে আপন মনে। ঘুন টেনে মাঝি যাচ্ছে। কতই না আনন্দ লাগে! আর মাঝি গান গায় ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি ও লালনের গান।
মাথার উপর বিশাল আকাশ ভাসছে। আকাশে কোথাও সূর্য্য নেই। বাতাস বইছে। ফুরফুরে বাতাস। সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সারাদিন সূর্য্যরে দেখা নেই। আকাশে জমেছে কালো মেঘ, সাদা মেঘ, ধূসর মেঘ। মেঘের খেলা জমে উঠেছে আকাশে। ক্ষণে ক্ষণে আকাশের রং বদলায়। স্থির থাকে না মেঘ। ছুটতে থাকে একদিক থেকে অন্যদিক। কেঁদে বুক ভাসায় আকাশ। মেঘের জল বৃষ্টি হয়ে নামে জমিনে। টুপটাপ ঝরে পড়ে বৃষ্টি। বাতাসে শোঁ শোঁ আওয়াজ বইতে থাকে। এই খানে আছে বৃষ্টি, তো অন্যখানে নেই। বিভিন্ন সুরে বৃষ্টি নামে। হৃদয় আকুল হয়ে যায়। কখনো গর্জে উঠে আকাশ। ভয়ে চুরমার হয়ে যায় হৃদয়। মাঝে মাঝে এই মেঘ এই রোদ্দুর। যাকে খেঁকশিয়ালের বিয়ে বলে গ্রামের লোকেরা। বৃষ্টি ভেজা কাদা পথ দিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হয় না। মন ভারী হয়ে যায়। কখন পিচলে পা ফসকে পড়ে যাই। সেবার একবার এক তরুণীর সামনে কাদায় পা পিছলে পড়ে সে কি লজ্জা পেলাম তা কি বলা যায়! স্মৃতিময় বর্ষার দিনগুলো কত মধুর ছিল। তখন বর্ষা মানেই ছিল আনন্দ। আর এখন এই বর্ষা আমার কাছে এক বিরক্তিকর মনে হয়। এখন ভাবি বর্ষা ঋতু না থাকলেই ভাল হতো। অলসভাবে ঘরে বসে থাকতে হতো না।
মনে পড়ছে সেই শৈশবের কথা। তখন আমার বয়স ১০/১১ বছর হবে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলে লেখা পড়ায় তেমন মনযোগ ছিল না। সারাক্ষণ টইটই করে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। বনে বাঁদাড়ে ঘুরে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেতাম। নাওয়া খাওয়ার কথা ভুলে যেতাম। বর্ষাকাল আসলে একমূহূর্তও ঘরে বসে থাকতাম না। সেই কাকডাকা ভোরে কিছু খেয়ে বেড়িয়ে যেতাম সন্ধ্যালগ্নে বাড়ি ফিরতাম। সারাদিন শাপলা-শালুক কুড়িয়ে খেতাম। এদেশে বর্ষাকালে নদী-নালা খালবিল জলাশয়ের নিচু জমিতে এমনিতেই জন্মাতো প্রচুর শাপলা শালুক ও ভেট। বাংলাদেশে শাপলার দুটি প্রজাতি পাওয়া যায়। এর একটিকে শাপলা বলা হয় আর অন্যটিকে শালুক। শালুক পাওয়া যায় এই গাছের মাটির নিচের মূল অংশে। শৈশবে অনেক শালুক কুড়িয়ে আনতাম। শালুক হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, দ্রুত ক্ষুদা নিবারন করে এবং শরীরে পর্যাপ্ত শক্তিও জোগায়। এর মধ্যে শাপলা আবার দুই ধরনের। সাদা ও লাল শাপলা। সাদা শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। আর শালুকের রং নীল। শাপলা শুধু ফুলই নয়। সর্বভুক মানুষ শাপলা খায়ও। এমনও দিন গেছে সারাদিন শাপলা, শালুক ও ভেট খেয়ে দিন পার করেছি। শাপলা খাওয়ার একাধিক পদ্ধতি আছে। এই শাপলা থেকেই হয় একটি চমৎকার খাবার। ফুলের মাঝখানের বোটার উপড়ে অর্থাৎ গর্ভাশয়ে গুড়ি গুড়ি বীজ থাকে। সেটা যখন পেকে যায় তখন তাকে ভেট বলতাম। ছোটবেলায় আঙ্গুল দিয়ে খুটে সেই ভেট থেকে কালো দানাদার বীজ বের করে খেতাম। খেতে খারাপ না। খুব মজা লাগত। কিন্তু সেই ভেট হজম হতো না। বাথরুম করলে সেই ভেটের দানাগুলো আস্তা বের হতো। আর সেই বীজ দিয়ে আরেকটি সুস্বাদু খাবার হয়। নাম ভেটের খৈ। খুব হালকা এই ভেটের খৈ। মাঝে মাঝে এই ভেট বাড়িতে নিয়ে আসতাম। একদিন রেখে দিলে পরদিন এই ভেট থেকে দানা ফেটে সুন্দরভাবে বেরিয়ে আসত। তখন খেতে খুব ভাল লাগত। এই ভেট থেকে দানা বের করে রোদে শুকাতাম। মা আমাদেরকে ভেটের খৈ তৈরি করে খাওয়াতেন। আর শাপলা যেখানে হয় সেখানে যত বেশী পানি থাকে তত লম্বা হয় শাপলার ডাটা। তবে সাধারণত শাপলা গাছ ও ডাটা পানির গভীরতায় ৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। নরম কচি আর খসখসে এই ডাটা খালি মুখে কিংবা ঝাল লবণ ও তেতুল মাখিয়ে মুখরোচক সবজী হিসেবে খেতাম। আবার কখনো সবজি হিসেবে মাছ দিয়ে রান্না করে খেতাম। গ্রাম বাংলার অনেকেই চুলকানি এবং রক্ত আমাশয় নিরাময়ের জন্য ঔষধী গুন সম্পন্ন এই শাপলা খুঁজে ফেরেন। পানির উপরে ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে।
আমি শৈশবে দেখতাম গ্রামবাংলার বিলে-ঝিলে ও ডোবানালায় এই ফুলের সমারোহ ছিলো চোখে পড়ার মত। কিন্তু বর্তমানে এই শাপলা তেমন বেশি পাওয়া যায় না। প্রকৃতির বিরুপ প্রভাবে ঐতিহ্যবাহী শাপলা, পানিফল, শালুক আর ভেট আজ তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমানে শাপলা ফুলসহ পানি ফলগুলো যেন হারিয়ে গেছে। এখনও যদি গ্রামে যাই বর্ষায় দুয়েকটা শাপলা হয়তো চোখে পড়ে। জমিতে অতি মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শাপলা ফুল। এক সময় বর্ষা মৌসুমে দেশের নদীনালা খালবিল রাস্তার দুপাশে জলাশয়ে ব্যাপকভাবে শাপলা ফুলের মনোরম দৃশ্য দেখা যেত।
হঠাৎ করে কে যেন দরজায় নক করল। শৈশবের স্মৃতি থেকে ফিরে আসলাম বাস্তবে। দেখি ছোট বোন মোমেনা কুপি হাতে পড়ার ঘরের দিকে আসছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে। চারদিকে অন্ধকার। ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত নয়টা বাজে। কখন যে এত রাত হয়ে গেল টেরই পেলাম না।
– ভাইয়া খাবে না।
– হ্যাঁ খাব। আমি আসছি। তুই যা।
– তাড়াতাড়ি আস ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– আসছি।
বলেই আমি খাবার ঘরে চলে গেলাম। সবার সাথে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি পূর্বাকাশে রক্তিম সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। শুরু হলো সুন্দর একটি সোনালি সকাল।
রচনাকাল: ২৭ জুলাই ২০১৪

শবযাত্রা


– ভাইসব আজ বিকাল তিন ঘটিকায় কড়াই গ্রামের ঈদগাহ মাঠে এক বিরাট ফুটবল ফাইনাল খেলার আয়োজন করা হইয়াছে। উক্ত খেলায় অংশগ্রহণ করবেন কড়াই গ্রাম একাদশ বনাম সিধুলী গ্রাম একাদশ। উক্ত খেলায় আপনারা সকলে আমন্ত্রিত।
এভাবেই মাইকিং করছিল কড়াই গ্রামের বাবুল মিয়া। সবাইকে আজ বিকাল বেলায় তাদের মাঠে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানানো হল।
বিকাল তিনটার পূর্বেই আশে পাশে পাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক খেলা দেখতে কড়াই গ্রামের ঈদগাহ মাঠে উপস্থিত হলো। লোকে লোকারন্য হয়ে গেল খেলার মাঠের চারপাশ। নির্দিষ্ট সময়ে খেলা শুরু হলো।
দু’দলই সমান তালে খেলছে। দু’দলই মরিয়া হয়ে উঠছে পুরস্কার নেয়ার জন্য। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কে জিতে। প্রথমার্ধ খেলা শেষে দু’দলে ফলাফল দাঁড়াল কড়াই গ্রাম একাদশ=০, সিধুলী গ্রাম একাদশ=০।
বিরতীর পর আবার খেলা শুরু হলো। খেলার শেষ মূহূর্তে এসে পেলান্টি শুটে একটি গোল দিল সিধুলী গ্রাম একাদশ। কিন্তু কড়াই গ্রামের নিজের গ্রামে খেলা হচ্ছে তাদের দর্শক সমর্থক বেশি তারা তা মেনে নিতে পারছে না। এই নিয়ে রেফারীর সাথে তর্কে জড়িয়ে পরে কড়াই গ্রামের বেশ কয়েকজন খেলোয়ার।
জীবন মরণ লড়াই করে শেষ মূহূর্তে একটি গোল দিল সিধুলী গ্রামের খেলোয়াররা তারাই বা কেন মেনে নিবে কড়াই গ্রামের অন্যায় আবদার। তাই তারা এর তীব্র প্রতিবাদ করার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু কড়াই গ্রামের নিজের মাঠ বলে শক্তির লড়াই দেখাচ্ছে। এ নিয়ে তুমুল হট্টগোল বেঁধে গেল। এক পর্যায়ে সিধুলী গ্রামের খেলোয়ার আমিনুল কড়াই গ্রামের একজন খেলোয়ারকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তখন কড়াই গ্রামের খেলোয়াররা আর বসে থাকতে পারেনি। তারাও পাল্টা আক্রমন করল। এক পর্যায়ের দর্শকরাও মাঠে প্রবেশ করল। দু‘পক্ষের লোকজনদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বেঁধে গেল। এতে করে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিধুলী গ্রামের লোকজনদের। তারা তখন আঘাত পেয়ে তাদের গ্রামে চলে আসল।
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। পরদিন বল্লম, ছুরা, তীর, টেঁটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সিধুলী গ্রামের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে কড়াইগ্রামের লোকজনদের উপর হামলা চালায় এবং কড়াইগ্রামের সমস্ত বাড়িঘর ভাংচুর করে। লুটপাট করা হয় তাদের মালামাল। জবাবে কড়াইগ্রামের লোকজনও বল্লম, ছুরা, তীর, টেঁটা ইত্যাদি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। দু’গ্রামের বেশ কয়েকজন আহত হয় এবং কড়াই গ্রামের একজন নিহত হয়।
এই ঘটনার খবর পুলিশ জানতে পেরে ঘটনাস্থলে তৎক্ষনাত এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং দুগ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
পরদিন দেশের সকল দৈনিক পত্রিকায় এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াগুলোতো এ সংঘর্ষের খবর প্রচার করা হয়। তখন কড়াই গ্রামের লোকজন বাদী হয়ে সিধুলী গ্রামের ২৭ জন আসামীর নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করা হয়। যাকে নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত হয় সেই আমিনুলের বাপ চাচারা ছিল সাত ভাই। আমিনুল ও তার বাপ চাচা সবাইকে এ মামলায় আসামী করা হয়।
পরদিন পুলিশ আসামী ধরতে এসে গ্রামের কোন পুরুষকে খুঁজে পায়নি। পুরুষ শূন্য গ্রাম হয়ে গেল।
আদালত আগামী ২০ অক্টোবর সোমবার সকল ১০:০০টায় আসামীদেরকে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। নির্দিষ্ট তারিখে সিধুলী গ্রামের ২৭জন আসামী নাটোর আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য একটি লোকাল বাসে আদালতে হাজির হয়। হাজিরা শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঘটে বিরাট দুঘর্টনা।
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহন ও নাটোর থেকে নাটোরের গুরুদাসপুরগামী আসামীদের লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ৩৫ জন এবং আহত হয় অর্ধশত।
আহতদের চিকিৎসার জন্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের বড়াইগ্রাম মোড়ের আগে রেজুর মোড়ে কেয়া পরিবহনের বাসটি একই দিক থেকে আসা একটি ট্রাককে ওভারটেক করার সময় অথৈ পরিবহনের বাসটির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বিকট শব্দে মুখোমুখি সংঘষের পর মহাসড়কের দুই পাশের দুটি গর্তে বাস দুটি সিটকে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ঘটনার সময় রাস্তা ও আশে পাশে আহত ও নিহতরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। এ সময় আহতদের আর্তচিৎকার ও দুর্ঘটনার শব্দে শত শত এলাকাবাসী ছুটে এসে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। খবর পেয়ে নাটোর, লালপুর ও দয়ারামপুর ফায়ার সার্ভিস ও থানা এবং হাইওয়ে পুলিশ এলাকাবাসীর সাথে উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই গাড়ির চালকসহ ৩৫টি লাশ উদ্ধার করে ট্রাকে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আহতদের মধ্যে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের ভর্তি অজ্ঞাত আরো পাঁচজন বিকেলে মারা যান। আহতদের নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতাল, বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বনপাড়ার বেসরকারি আমিনা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
অথৈ পরিবহনের যাত্রীদের মধ্যে সবাই ছিলেন সিধুলী গ্রামের। তারা হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। অথৈ পরিবহনে থাকা সিধুলী গ্রামের আমিনুলের ৬ চাচাসহ ১৪ জন মারা যায়। আমিনুলে বাপ চাচারা সাত ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র আমিনুলের বাবাই আহত অবস্থায় হাসপাতালে আছে। তিনিও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।
নাটোরের বড়াইগ্রামে স্মরনকালের ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় নিহত ৩৫ জনের পরিবারে চলছে এখন শোকের মাতম। বিশেষ করে সিধুলী গ্রামে লাশের মিছিল হচ্ছে। জানাজা আর দাফনের সময় উপস্থিত স্বজন আর জনতার উচ্চস্বরের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে এলাকার সিধুলীর আকাশ বাতাস। নিহতদের জানাজার জন্য বাড়ি থেকে লাশগুলো স্কুল মাঠে নেয়ার সময় পুরো সিধুলী গ্রামে কান্নার রোল পড়ে যায়। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে জানাজায় আগত হাজারো মানুষ তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সিধুলী গ্রাম যেন এখন শোকের গ্রামে পরিনত হয়েছে। দুর্ঘটনার পর থেকেই গ্রামটি মুহ্যমান হয়ে আছে শোকে। উঠানে লাশ নিয়ে রাত কাটিয়েছে তারা। গতকাল দিনের প্রথম ভাগ কেটেছে দাফন-কাফনের কাজে। পাশাপাশি খোঁড়া হয়েছে ১৪ জনের কবর। কবরের দিকে তাকালে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।
সকাল ১০টায় কবরস্থান সংলগ্ন সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জানাজা পড়ানো হয়। স্থানীয় সাংসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী জনপ্রতিনিধিসহ কয়েক হাজার মানুষ জানাজায় অংশ নেন।
খাটিয়ায় করে সারিবদ্ধভাবে লাশগুলো যখন জানাজার জন্য আনা হচ্ছিল, তখন স্বজনদের কান্নায় শোকবিহ্বল হয়ে ওঠে গ্রামের পরিবেশ। শান্ত সবুজ গ্রামের ভেতর দিয়ে লাশের পর লাশ কাঁধে নিয়ে চোখের পানিতে হয়েছে সিধুলী গ্রামের শবযাত্রা।

রচনাকাল: ২৬ অক্টোবর, ২০১৪ খ্রি:

পকেটমার


– এই যে ভাই ভাড়া দেন।
কন্ট্রাক্টর ভাড়া চাইতেই প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে শক খেলাম। আমার মানিব্যাগ গায়েব হয়ে গেছে। পকেটে খুচরা টাকাসহ সব মিলিয়ে ৫০০/৬০০ টাকা ছিল। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ভোটার আইডিকার্ডসহ সবই পকেটমার নিয়ে গেছে, আমি টেরও পেলাম না।
– কী হলো ভাই ভাড়া দেন।
আমি নম্র স্বরে বললাম, ভাই আমার মানিব্যাগ পকেটমার নিয়ে গেছে। তাই ভাড়ার টাকা দিতে পারছি না।
– মশকরা করেন ভাই। জলদি টাকা দেন। নইলে এখানেই নেমে যেতে হবে।
– বিশ্বাস না হলে নামিয়ে দিন।
কন্ট্রাক্টর আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি মনে করলেন আমি সত্যিই মিথ্যা কথা বলছি। তাই ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে আমাকে নামিয়ে দিলেন।
আজ মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বনাম ভারত সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচের খেলা হবে। সেই খেলা দেখার জন্য মিরপুর যাচ্ছিলাম বাসে করে। এমন সময় পকেটমারের খপ্পরে পড়ে সব কিছু হারালাম। এখন কীভাবে বাকি পথ পাড়ি দিয়ে স্টেডিয়ামে যাব সেই চিন্তায় অস্থির।
গাড়ি থেকে নেমে বেশ কয়েকজনের কাছে আমার পকেটমারের ঘটনা খুলে বলে কিছু টাকা ধার চাইলাম। পড়ে বিকাশ অথবা মোবাইলে পাঠিয়ে দিব। কেউ বিশ্বাস করল আবার কেউ বিশ্বাস করল না। এক ভদ্রলোক আমার কথায় বিশ্বাস করে আমাকে ১০০ টাকা দিয়ে বলেন, আপনার ইচ্ছে হলে সেটা ফেরত দিবেন। ইচ্ছে না হলে নাও দিতে পারেন আমার কোন আপত্তি নেই। ঐ ভদ্রলোকের মোবাইল নম্বর আমার মোবাইলে সেভ করে নিলাম। পরে আমি স্টেডিয়ামে আসলাম।
তিনটায় খেলা শুরু হবে। কিছুক্ষণ আগেই আমি স্টেডিয়ামে আসলাম। খুবই উত্তেজনাপূর্ণ এই ম্যাচ। কারণ প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ৭৯ রানে জয়ী হয়েছে। এই ম্যাচ জিততে পারলেই প্রথমবারের মতো ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ। প্রচুর দর্শক। পিঁপড়া হাঁটার জায়গাটুকু নেই। কানায় কানায় পূর্ণ পুরো গ্যালারি। চার, ছক্কা ও ভারতের কোন উইকেট পড়লেই শুরু হয়ে যায় তুমুল হাত তালি ও চিৎকার চেচামেচি, লাফালাফি।
অবশেষে ৬ উইকেটে ভারতকে হারিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। সেই আনন্দে ভাসছে বাংলাদেশ। এই উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ শেষে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে দর্শক ঠেলাঠেলি করে বের হচ্ছে। বাংলাদেশ জিতেছে, বাংলাদেশ জিতেছে শ্লোগানে মুখরিত পুরো স্টেডিয়াম এলাকা।
আমিও খেলা দেখে স্টেডিয়াম থেকে বের হচ্ছি। এত ভিড় ও লোকজনের গাদাগাদিতে আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। এই সুযোগে এক চোর আমার পাশের লোকের পকেটে হাত দিল মোবাইলটি নেয়ার জন্য। এত উত্তেজনার মুহূর্তেও চোরের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি চোরকে হাতে নাতে ধরে ফেললেন এবং চোর চোর বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। এত ভিড়ের মধ্যে চোর পালানোর সুযোগ পেল না। আশে পাশের দুয়েকজন চোরকে ধরে কিল-ঘুষি ও থাপ্পর মারতে লাগল। চোরকে টেনে হেঁচড়ে ভিড় ঠেলে বাহিরে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং যে যেভাবে পারে তাকে মারতে লাগল। কেউ চোরকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না।
চোরকে মারতে দেখে চোরের প্রতি আমার মায়া লেগে গেল। বয়স ২০/২১ হবে। এই বয়সে সে চুরি করছে। তাকে দেখেতো চুরের মতো মনে হয় না। নেহায়েত একটা নিরীহ মানুষ মনে হচ্ছে। কেন চুরি করছে তা জানা দরকার। তাই আর চুপ থাকতে পারলাম না। সবাইকে বললাম, এই যে ভাইয়েরা থামুন। আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। বেশি মারলে সে হয়তো মরে যাবে। উল্টো আপনারা ফেঁসে যাবেন।
আমার কথায় কেউ কেউ চুপ হলেও অনেকে বলাবলি শুরু করে দিয়েছে আমিও মনে হয় চোরের সাথে আছি। তা না হলে চোরের জন্য এত দরদ কেন?
একজন বলেই ফেললেন, এই যে ভাই আপনি ওর হয়ে ওকালতি করছেন কেন? কী হয় আপনার?
– ভাই সে আমার কেউ হয় না। আপনি যেমন মানুষ, সেও একজন মানুষ। মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে না।
– ও মানুষ নয়, চোর।
– চোররাওতো মানুষ। সে কারো ভাই। কারো সন্তান।
– আপনি তাকে কী করতে চান?
– আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।
– বলেন।
অন্য একজন বলল, তাকে পুলিশে দিয়ে দিন।
আমি তৎক্ষণাত বললাম, না ভাই তাকে পুলিশেও দেয়া যাবে না। মারাও যাবে না। তাকে পুলিশে দিলে পুলিশ টাকা খেয়ে ছেড়ে দিবে। কারণ এই চোরদের সাথে পুলিশের হাত থাকে। তাকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করব। কেন সে চুরি করে? তারপর আমরা তার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিব। পরে আমি চোরের হাত থেকে মোবাইলটি কেড়ে নিয়ে যার মোবাইল তাকে দিয়ে চোরকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
বাড়িতে এনে তাকে বললাম। আমি সাহায্য না করলে তোমার কপালে কি ছিল তা বলা মুশকিল। হয় জেলে যেতে না হয় মরে যেতে। আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব তার সঠিক উত্তর দিবে। আমি তোমাকে কিছু করব না।
চোর মাথা নিচু করে বলল, আপনি আমাকে বাঁচাইছেন। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। বলেন কি করতে হবে।
– তোমার নাম কি?
– আমার নাম মতিন
– তোমার বাবা কি করেন?
– ব্যবসা।
– বাড়ি কোথায়?
– ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
– বাসা কোথায়?
– কোন বাসা নেই।
– বাসা নেই তাহলে থাক কোথায়?
– এতদিন জেলে ছিলাম। আজই জেল থেকে বের হলাম। রাতে ঠিক করব কোথায় থাকব।
– জেলে কেন ছিলে?
– শুনবেন সে কাহিনী?
– অবশ্যই শুনব। বল।
– তাহলে শুনেন।
আজ থেকে তিন বছর আগের ঘটনা। আমি তখন এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রেনে করে কমলাপুর আসি। ট্রেন স্টেশনে আসতেই সবাই নামার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু করে দিল । হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমার পিছনে কেউ একজন প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ চুরি করার চেষ্টা করছে। প্যান্ট শার্ট পড়া ভদ্রটাইপের এক লোক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে হাতে নাতে ধরার জন্য নড়াচড়া না করে চুপ করে সামনের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি। চোর আমার মানিব্যাগ টান দিয়ে যেই মাত্র বের করল, ঠিক তখন পকেটমারের পিছন ফিরে তার দিকে তাকালাম। পকেটমার সাথে সাথে আমার মানিব্যাগটি ফেলে আমার কাছ থেকে চোখ ফিরিয়ে পিছন দিকে চলে যাচ্ছে। আমি তখন মানিব্যাগটি হাতে নিয়ে পকেটমারকে ধরার চেষ্টা করলাম। সে তখন এক ঝটকা দিয়ে আমার কাছ থেকে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল এবং সবাইকে ধাক্কিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি নামলাম এবং পিছন থেকে চোর চোর ধর ধর বলে চিৎকার করছিলাম। এত ভিড়ের মধ্যে লোকজন বুঝতে পারছে না কে প্রকৃত চোর আর কার মানিব্যাগ চুরি হলো। আসল চোর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উল্টো আমাকে দেখিয়ে বলতে লাগল, ঐ ছেলেটিকে ধরেন সে আমার মানিব্যাগ চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। দেখেন তার হাতে আমার মানিব্যাগ।
চোরের কথায় তৎক্ষনাৎ লোকজন উল্টো আমাকে ফলো করে ধরার চেষ্টা করল। এখন আমি কিভাবে প্রমাণ দিব যে আমি চোর নয় বরং সেই চোর। চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতক্ষণে ঐ চোর আমাকে ধরার জন্য আমার দিকে এগিয়ে আসল এবং আমাকে ঝাপটে ধরে চোর চোর বলে ঘুষি মারতে লাগল। লোকজন আমাকে চোর ভেবে বৃষ্টির মতো কিল-ঘুষি মারতে লাগল। চারপাশ থেকে লোকজন আমাকে ঘিরে রাখছে। আমি তখন চিৎকার করে বলছি, ভাই আমি চোর নয়। ওনি চোর। ওনি আমাকে ফাসানোর জন্য আমাকে মারছেন।
জনগণের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, তুর কাছে মানিব্যাগ পাওয়া গেল, আর তুই বলছিস তুই চোর না। এই বলে আরো কিছু কিল-ঘুষি মারলো। জনগণের মাইর খেয়ে আমি একসময় মাটিতে পড়ে গেলাম। আমার মানিব্যাগ ও অন্যান্য জিনিপত্র ঐ চোর নিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে আমাকে চোরের অপবাদে থানায় নিয়ে গেল। চোর না হয়েও চোর হয়ে গেলাম।
এই বলেই মতিন চোর থামল।
– তারপর কি হলো?
মতিন চোর একটু জিরিয়ে আবার বলতে লাগল।
আমাকে থানায় আনার পর পুলিশ কোর্টে চালান করে দিল। আমার নামে চোরাচালান মামলা হল। এই মামলায় আমি তিন বছর জেল খাটি। এই তিন বছরে অনেক দাগী আসামীর সাথে আমার পরিচয় হয়। অনেক বড় বড় চোর ডাকাতের সাথে পরিচয় হয়। চুরি না করেও অপরাধী হয়ে জেল খেটেছি। এই জন্য আমার লেখাপড়া শেষ হলো। এতদিনে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতাম। এই ঘটনায় আমি পরিবারের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। পরিবারের কেউ আমাকে জেলে দেখতে আসে নাই। তাই জেল খানায় থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম এই মুখ আর পরিবারের কাউকে দেখাব না। জেল থেকে বের হয়েই আমি চুরি করব। জেলে বসেই আমার অপরাধী সঙ্গীদের কাছ থেকে চুরি বিদ্যা শিখলাম। বিশেষ করে পকেটমার কিভাবে করতে হয় তার কলাকৌশল শিখলাম। জেল থেকে বের হয়েই প্রথমে একটি বাসে উঠলাম। সেটা ছিল সদরঘাট থেকে মীরপুরগামী একটি বাস। সেখানে এক ভদ্রলোকের পকেট থেকে মানিব্যাগ চুরি করি। এটা ছিল আমার প্রথম চুরির ঘটনা।
এই কথা শুনে আমার মনে খটকা লেগে গেল। আজ দুপুরে স্টেডিয়ামে আসার পথে আমার ম্যানিব্যাগ চুরি হয়েছে। এই থাম। এই চুরিটা কবে করেছ?
– আজই।
– মানিব্যাগটি তোমার কাছে আছে?
– হ্যাঁ আছে।
– দেখাওতো।
মতিন চোর অমনি তার প্যান্ট থেকে মানিব্যাগটি বের করে আমাকে দেখাল। আমি এই ব্যাগ দেখে হতবাক হয়ে গেলাম।
– এটাতো আমার মানিব্যাগ। তাহলে তুমিই আমার মানিব্যাগ চুরি করেছ?
– বলেন কি? এটা আপনার মানিব্যাগ?
– হ্যাঁ।
– আমিতো পেছন থেকে চুরি করেছি তাই আপনাকে চিনতে পারিনি। তাহলে প্রথম চুরিটা আপনার কাছ থেকেই করেছি। আর দ্বিতীয় চুরিটায় ধরা পড়লাম।
– হ্যাঁ।
– যাক ভাই তোমাকে পাওয়ায় আমার অনেক উপকার হয়েছে? আমার অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস এই মানিব্যাগে ছিল তা পাওয়া গেল।
– আমারে মাফ করে দেন ভাই।
– মাফ তোমাকে করব। তার আগে তোমার সর্ম্পকে আরো জেনে নেই।
– বলেন কি জানতে চান।
– স্টেডিয়ামে আসলে কেন?
– ভাবলাম এখানে অনেক মানুষের ভিড় থাকবে। পকেট মারতে সুবিধা হবে তাই।
– কিন্তু একবারও কি ভাবলে না ধরা পড়লে আবার জেলে যেতে হবে?
– ভাবছি। এও ভাবছি যে অপরাধ না করে যখন জেলে যেতে হয়েছে তাহলে অপরাধ করেই জেলে গেলে কোন সমস্যা হবে না। পুলিশকে টাকা দিয়ে বের হওয়ার পদ্ধতিও আমি জেল খানা থেকে শিখে এসেছি।
– তাই বলে এভাবে তোমাকে অপরাধ করতে হবে? তুমি একজন ভদ্র ঘরের সন্তান হয়েও কেন এভাবে একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনার জের ধরে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এই জন্য কি অনুতপ্ত হও না?
– হ্যাঁ হই। কিন্তু কি করব স্যার। আমি নিরুপায়। আমি এ মুখ আমার বাবা মাকে দেখাতে পারব না। কোনদিন আমি কোন অপরাধ করিনি। আজ অপরাধ না করেও যখন অপরাধী হয়েছি, তখন এছাড়া আর কিছু করার উপায় ছিল না স্যার। বলেই মতিন কাঁদতে লাগল।
আমাকে বাঁচান। আমি এই পথে যেতে চাইনি। এ সমাজ আমাকে এ পথে যেতে বাধ্য করেছে। এই বলেই ফুফিয়ে কাদঁতে লাগল মতিন।
– কেদোনা শান্ত হও। আমি তোমাকে একটি রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি।
– কি রাস্তা বলেন?
– আজ থেকে শপথ নিবে তুমি আর চুরি করবে না। আর এখন থেকে আমার দোকানে তুমি কাজ করবে।
– ঠিক আছে স্যার আমি শপথ নিলাম আর কোনদিন চুরি করব না। আজ থেকে আপনার দোকানে কাজ করব।
– আর প্রতি বুধবার রাত ১১.২০ মিনিটে এবিসি রেডিওতে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানটি শুনবে। সেই অনুষ্ঠানটি তোমার মতো অপরাধীদের নিয়ে তৈরি হয়। সেখানে গিয়ে একদিন তোমার জীবনের অপ্রিয় সত্য কথাটি লাখো শ্রোতার সামনে বলবে। পারবে?
– পারব স্যার। আপনি আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। আপনি আমার জীবনের মোর গুড়িয়ে দিয়েছেন।
সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে মতিন আর চুরি করে না। আমার দোকানে চাকুরী করে। মাস শেষে যে বেতন পায় তাতেই সে সন্তুষ্ট। কয়েক মাস পর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়ে বাবা মায়ের সাথে দেখা করে আসে। একদিন এবিসি রেডিও থেকে মতিনকে কল করা হল। মতিন অফিসে এসে তার জীবনের সব অপ্রিয় সত্য কথাগুলো রেকর্ড করেন। তারপর সেটা প্রচার করা হয় লাখো শ্রোতার সামনে।

রচনাকাল-৩১/০৭/২০১৫খ্রি:

দাদাকে মনে পড়ে


১৯৯৮ সাল। আজ থেকে ১৯ বছর আগের কথা। তখন আমি ডায়েরি লিখতাম। প্রতিদিনের ঘটনাগুলো প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতাম। এখন আর ডায়েরি লেখা হয় না। দীর্ঘদিন পর ব্যক্তিগত বুকসেলফ খুলতেই আমার প্রথম ডায়েরিটি দেখতে পাই। ডায়েরিটি হাতে নিয়ে একের পর এক স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকি। হঠাৎ চোখ পড়ে ১৮/১০/১৯৯৮ ইং তারিখের লেখাটির প্রতি। দুয়েক লাইন পড়তেই বুঝতে পারলাম এই দিনটি আমাদের পরিবারের একটি শোকের দিন। এই দিনে আমার দাদা পান্ডব আলী মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলয়ংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সংগঠিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা ডুবে যায়। এই বন্যার স্থায়ী ছিল এলাকাভেদে ২০-২৫ দিন। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় যখন বন্যার পানি আমাদের বাড়ির উঠানে চলে আসে, তখন আমার দাদা বার্ধক্য জনিত অসুখে বিছানায় পড়ে যায়। দিন দিন খাওয়া দাওয়া কমে যায় এবং এক সময় বিছানা থেকে উঠার মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
আমাদের গ্রামের কবরস্থান তখন পানির নিচে ডুবে গেছে। আত্মীয় স্বজন সবাই তখন আশংকা করছে এই অবস্থায় যদি দাদার মৃত্যু হয় তাহলে কোথায় দাফন-কাফন করবেন। সবাই দাদার জন্য দোয়া করছেন আল্লাহ যেন আমার দাদাকে সুস্থতা দান করেন এবং আর যদি সুস্থতা দান না করেন তাহলে যেন অন্তত বন্যার পানি বাড়ি থেকে সরে গেলে মৃত্যু হয়। আল্লাহ আমাদের আত্মীয় স্বজনদের দোয়া কবুল করছেন। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পরই দাদার মৃত্যু হয়েছে। এই জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
১৯৯৮ সালে আমি রসুলপুর ওসমান মোল্লা ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় দশম শ্রেণীতে পড়ি। এই মাদ্রাসাটি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলায় অবস্থিত। আমি তখন রসুলপুর গ্রামে সালাহ উদ্দিন (মোক্তার) সাহেবের বাড়িতে লজিং থেকে লেখাপড়া করতাম। দীর্ঘ একমাস যাবত দাদা অসুস্থ্য ছিলেন এই খবর আমি জানতাম না। কারণ তখন মোবাইল ফোনের প্রচলন ছিলো না। ১৯৯৬ সালে এদেশে মোবাইল আসলেও তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মোবাইল ফোন কেনার মতো সমর্থ ছিলো না। তাই তখন চিঠিই ছিলো একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। আর জরুরী খবর লোক মারফত পৌঁছানো হতো।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বন্যার পানি দ্রুত বাড়ায় মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। মাদ্রাসা বন্ধ থাকার পরও বন্যার কারণে আমি তখন বাড়িতে যেতে পারিনি। আমি যে ঘরে থাকতাম সেখানেও পানি চলে আসছিল। তখন মনটা খুবই ছটফট করতো। বাড়ির কোন খবরা খবর পাইতাম না। দাদা-দাদি, আম্মা ও ছোট ভাই বোনদেরকে নিয়ে চিন্তা করতাম। কখন পানি কমবে আর কখন বাড়িতে যাব সেই চিন্তায় অস্থির থাকতাম। বন্যার পানি যখন কমে গেল তখন ১৪ অক্টোবর আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাড়িতে এসে দেখি আমাদের বাড়ি থেকে পানি নেমে অনেক নিচে চলে গেছে। আশে পাশের আবাদী জমি কিছুটা শুকিয়ে গেছে।
আমি ঘরে প্রবেশ করতেই আম্মা ও বড় ফুফু আমাকে দেখে কাঁদতে লাগলো। দাদাকে তখন বিছানায় শায়িত দেখলাম। দাদার দিকে চোখ পড়তেই আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একি দেখছি আমি! আমার দাদার এমন অবস্থা কেন? দাদার শরীর একেবারে কঙ্কাল হয়ে গেছে। মাংস শুকিয়ে চামড়া হাড়ের সাথে মিছে গেছে। শুকনো মাংস থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দাদার কাছে গেলাম। দাদার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দাদা কোন কথা বলতে পারছেন না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁট নাড়াচ্ছেন কিছু কথা বলতে চাচ্ছেন কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। আমি তখন বুঝতে পারছি দাদা আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু কোন কথা শুনছিও না বুঝছিও না। তখন আমার কান্নায় বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। দাদার মুখের কাছে কান নিয়ে কথা শুনার চেষ্টা করলাম কিন্তু তারপরও কিছু শুনতে পেলাম না। তখন ভাবলাম ওনার কথা আমি বুঝতে না পাড়লেও নিশ্চয় ওনি আমার কথা শুনবেন। আমি তখন দাদাকে বললাম, দাদা আমি আপনাকে জানা অজানায় কত কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি আপনার জন্য দোয়া করি আল্লাহ যেন আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে দেন।
দাদা তখন মাথা নাড়ালেন।
কতদিন আগে কোন তারিখে আমি সর্বশেষ বাড়িতে আসছি আর দাদার সাথে কথা বলেছি আমার তখন মনে নেই। দাদার সাথে কথা না বলার আক্ষেপ রয়ে গেল। আম্মার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম দাদা এখন আর শক্ত খাবার খেতে পারেন না। শুধু পানি ও ফলের জোস খেতে পারেন। বিছানা থেকে উঠার ক্ষমতা নেই। তাই বিছানায় প্রশ্রাব-পায়খানা করছেন। দাদার অসুস্থতার পর থেকে আমার আম্মা একাই দাদার সেবা যত্ন করছেন। তবে মাঝে মাঝে আমার ছোট ফুফু দাদাকে দেখে গেছেন। বড় ফুফু মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে এখানে এসে দাদার কাছে ছিলেন। দাদার জন্য তখন নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আল্লাহ যেন দ্রুত আমার দাদাকে আরোগ্য দেন। ইতোমধ্যে দাদার অসুস্থতার খবর শুনে অনেক আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে দেখতে আসেন এবং দাদার জন্য দোয়া করেন।
আমি দুইদিন বাড়িতে ছিলাম। ১৬ অক্টোবর দাদা-দাদি, ফুফু ও আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রসুলপুর চলে আসলাম। বন্যার পর মাদ্রাসা খুললো। তাই পরদিন মাদ্রাসায় যাই। ১৮ অক্টোবর সকাল বেলা ঘুম হতে উঠে পড়তে বসলাম। কেন যেন আজ পড়ায় মন বসছে না। মনটা শুধু ছটফট করছে আর দাদার কথা মনে পড়ছে। ৮টার সময় গোসল করে খাওয়ার পর মাদ্রাসায় গেলাম। মাদ্রাসায় গিয়ে ক্লাস করছি। ৫ম ঘন্টার সময় দপ্তরী এসে আমাকে বললো, আমির তোমার বাড়ি থেকে একজন লোক আসছে তোমার সাথে দেখা করবে। আমি তখন হুজুরের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে দুতলা থেকে নিচে নেমে আসলাম। নিচে আসতেই দেখি আমার কাকা (আব্বার চাচাতো ভাই) মোকার হোসেন ও আমার ছোট ভাই রবিউল্লাহ। তাদেরকে দেখে হঠাৎ চমকে গেলাম। ব্যাপার কি পরশু মাত্র বাড়ি থেকে আসলাম আর আজই তারা এখানে এসে উপস্থিত! আমি তখন কাকাকে বললাম, কি ব্যাপার কাকা? আপনিতো কোনদিন এখানে আসেননি? আজ হঠাৎ এখানে আসলেন?
কাকা বললেন, তোমার দাদা মারা গেছে তাই তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে আসলাম।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ বলে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। কখন মারা গেছে কাকা?
আজ সকাল ছয়টায়। জলদি চল। তুমি বাড়িতে গেলে জানাজা হবে। কারণ তোমার বড় ভাই বাড়িতে নেই।
বড় ভাই কোথায়?
তোমার মামাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে ঢাকা গেছে।
হঠাৎ দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। যেই দাদা আমাকে এতো ভালোবাসতো সেই দাদা আজ নেই। আমি বাড়িতে গেলে দাদা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে টাকা দিত। কোথাও গেলে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। আর ভাবতে পারছি না।
কাকা বললো, কাঁদবে না। সবাইকে একদিন মরতে হবে। তাড়াতাড়ি চল।
আমি চোখ মুছে বললাম, একটু দাঁড়ান আমি ছুটি নিয়ে আসছি বলেই উপরে ক্লাশে ঢুকে হুজুরকে আমার দাদার মৃত্যু সংবাদ দিলাম। হুজুর শুনে আমার দাদার জন্য দোয়া করে বললেন, তুমি বাড়িতে চলে যাও।
তখন বাজে ১২:০০টা। কাকাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত লজিং বাড়িতে আসলাম। পড়ার রুমে বইগুলো রেখে লজিং বাড়ির সবাইকে দাদার মৃত্যুর সংবাদ শুনিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। নরসিংদী আসতে আসতে বেলা ২:০০ টা বেজে গেল। চারটার সময় আমাদের গ্রামের পাশে সোনাবাল্লা লঞ্চ ঘাটে এসে লঞ্চ থামল। লঞ্চ থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে ৪:৩০ মিনিটে বাড়িতে আসলাম। বাড়িতে এসে দেখি পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ আগে দাদার জানাজা ও দাফন-কাফন সম্পন্ন করে লোকজন বাড়িতে চলে আসল। আমাকে দেখে বড় ফুফু, ছোট ফুফু জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আমিও চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না। কেঁদে কেঁকে ফুফুকে, আম্মাকে বললাম, আমার জন্য কি আরেকটু সময় অপেক্ষা করা গেল না?
আম্মা বললো, তোর বড় ভাই ও তোর জন্য মুরুব্বীরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে কিন্তু যথাসময়ে কেউ না আসায় সবার সিদ্ধান্তে ৩:০০ টার সময় দাফন কাফন শেষ করছে। আফসোস করিস না, দাদার জন্য দোয়া কর আর এখন গিয়ে কবরে মাটি দিয়ে আস।
বিকাল ৫:০০টার দিকে আমি গোরস্থানে গিয়ে দাদার কবর দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। দাদার কবরে নিজ হাতে মাটি দিয়ে দাদার জন্য দোয়া করলাম।
আজ দেখতে দেখতে দাদার মৃত্যুর ১৯টি বছর পার হলো। দাদাকে ছাড়া দীর্ঘ ১৯ বছর যাবত আমার আব্বার পরিচালনায় আমাদের সংসার চলছে।
উল্লেখ্য যে, দাদার মৃত্যুর সময় দাদার একমাত্র ছেলে আমার আব্বা শরীফ হোসেন ও আমার মেজো ভাই আবু ইউসুফ ওমান প্রাবাসে ছিলেন বিধায় দাদার পাশে থাকতে পারেন নি। কিন্তু আমরা বাকি ৪ ভাই দেশে থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগের মাধ্যম সহজ না হওয়ায় আমি, আমার বড় ভাই আকবর হোসেন, সবার ছোট ভাই রবিউল্লাহ জানাজায় শরিক হতে পারিনি। শুধুমাত্র ছোট ভাই ওমর ফারুক দাদার জানাজায় উপস্থিত ছিল।
দাদার মৃত্যুর আগে ছবি তোলাটাও ছিল দুর্লভ। তখন স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা যেতো। কিন্তু দাদা ছবি তোলতেন না। আমাদের কারোর কাছে তখন ব্যক্তিগত ক্যামেরা ছিল না বিধায় দাদার ছবি ধারণ করে রাখতে পারিনি। কিন্তু দাদার ছবি আমার হৃদয়ে গেথে আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই ছবি মুছবে না।
১৯টি বছর পার হলো আমরা কোনদিন দাদার মৃত্যু দিবস পালন করিনি। কারণ ইসলামে মৃত্যুদিবস পালন করার কোন বিধান নেই। আল কোরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদীস দ্বারা কারো মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, ইসলামেও শোক পালনের নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। তা হলো কেউ মারা গেলে তিন দিন শোক পালন করবে। তিন দিন পর শোক পালনের কোনো সুযোগ নেই, বরং চতুর্থ দিন থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে, তবে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী চার মাস দশ দিন অথবা গর্ভস্থিত সন্তান (যদি থাকে) প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবে।
রাসুল (স) বলেছেন, কোনো মহিলা যে আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন না করে, তবে স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। (বুখারি, মুসলিম)।
অতএব ইসলামের বিধান হলো কেউই তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন করবে না। শুধু মহিলারা স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন অথবা সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবেন।
নিজের আত্মীয়স্বজনের জন্য অন্যের নিকট দোয়া চাওয়া যেতে পারে। টাকার বিনিময়ে কোন মাওলানা ভাড়া করে দোয়া করানোর বিধানও ইসলামে নেই। তবে নিজে দোয়া করাই অধিক উত্তম। বিশেষ করে পিতামাতার জন্য সন্তান সব সময়ই দোয়া করবে।
রাসুল (স)কে জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল, পিতামাতার মৃত্যুর পর তাদের প্রতি সন্তানের আর কিছু করণীয় আছে কি? রাসুল (স) বললেন, হ্যাঁ, পিতা মাতা মৃত্যুর পর তাদের প্রতি চারটি করণীয় অবশিষ্ট থাকে ১. তাদের জন্য সব সময় দোয়া করা। তাদের মাগফেরাতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। ২. তাদের ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা, ৩. তাদের মাধ্যমে যাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাদের সাথে আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় রাখা, ৪. তাদের বন্ধুদের সম্মান করা। (আবু দাউদ)।
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে আমরা সবাই দাদার জন্য যার যার জায়গা থেকে দোয়া ও তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি।
ইসলামে মৃত্যুর তৃতীয় দিবসে কুলখানি করা এবং চল্লিশতম দিবসে চেহলাম করার কোনো বিধান নেই। এমনিভাবে মৃত্যু দিবস পালন করা, মৃত্যু দিবস উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের বিশেষ আয়োজন করা ইসলামে নেই। ইসলামে মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে যা করণীয় রয়েছে তা হলো, সব সময়ই তাদের জন্য দোয়া করা। এর জন্য কোনো দিনক্ষণ ঠিক করার প্রয়োজন নেই। যেকোনো সময়ই দোয়া করা যায়।
তাইতো তথাকথিত এইসব বেদআত দিবস প্রথা বাদ দিয়ে আমরা দাদার জন্য সব সময় নিজেরা দোয়া করি। যেমন দৈনিক পাঁচবার নামাজের সময়, জুমআর নামাজের সময়, দুই ঈদের নামাজ শেষে দাদার কবর জেয়ারতের সময়, শবে বরাত ও শবে কদরের রাতসহ ইসলামের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে। আমরা এবং আমার ফুফাতো ভাইয়েরা বাড়িতে আসলে প্রায়ই দাদার কবর জিয়ারত করে দোয়া করি।
অন্যান্য দিনের মতো দাদার মৃত্যু দিনটিও প্রতি বছর আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। আমরা অনেকে মনে রেখেছি আবার অনেকে হয়তো মনে রাখি নাই। তাই বলে কেউ দাদাকে ভুলে যাইনি। নির্দিষ্ট দিনে দাদাকে স্মরণ না করে সারা বছরই দাদাকে স্মরণ করি। যারা মৃত্যু দিবস পালন করে তারা সারা বছর মৃত ব্যক্তিকে ভুলে থাকে। মৃত্যু দিবসে তার নামে মিলাদ মাহফিল করিয়ে মৃত ব্যক্তির ক্ষতি সাধন করে থাকে।
মৃত্যুর সময় দাদা এক ছেলে (আমার আব্বা) ও দুই মেয়ের সংসারে ১৬ জন নাতী নাতনি রেখে যান। যারা আজ দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। ১৬ জন নাতী নাতনি থেকে দাদার উত্তারাধীকার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দাদার স্বপ্ন ছিল তাঁর উত্তরাধীকারদের মধ্য থেকে কেউ একজন আলেম হবেন এবং তাঁর জানাজা পড়াবেন। দাদা সবসময় আমাদের পরিবার ও আমার দুই ফুফুর পরিবারের সবাইকে মাদ্রাসায় পড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন এবং ওনার ইচ্ছা অনুযায়ী আমার বড় ফুফুর দুই ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়ানো হয়।
আমাদের পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই সবাইকে দাদা পর্যায়ক্রমে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমরা সবাই কম বেশি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করলেও কেউ প্রকৃত আলেম হতে পারলাম না। যথেষ্ট এলেম থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পরিমাণ আমলের অভাবে আলেম হতে পারিনি। তবে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার কারণে আমরা কেউ ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়নি। আমাদের পরিবারের সবাই আল্লাহকে ভয় করে এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামজ পড়ে। মদ, গাজা, বিড়ি, সিগারেট খায় না। ধর্মীয় রীতি নীতি মেনেই আমাদের জীবন যাপন চলছে।
আমরা পাঁচ ভাই দাদার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও আমার দুই ফুফাত ভাই দাদার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। একজন হচ্ছেন হাফেজ মাওলানা মো: আলমগীর হোসেন। আরেকজন হচ্ছেন মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী। ওরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী একজন, সু-বক্তা, লেখক, দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, মসজিদের খতিব ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। তাছাড়া দাদা আমার বড় বোনকে একজন আলেমের সাথেই বিয়ে দেন।
আমার বড় ভাই আকবর হোসেন তিনি বর্তমানে পরিবারসহ ওমান প্রবাসী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। মেজো ভাই আবু ইউসুফ দীর্ঘ ওমান প্রবাস জীবন শেষ করে বর্তমানে ট্রেইলারের ব্যবসা করেন। আমার ছোট ভাই ওমর ফারুক স্ট্রেশনারীর ব্যবসায়ী ও সবার ছোট ভাই রবিউল্লাহ সেও ওমান প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে কাপড়ের ব্যবসা করছেন। আর আমি চাকরি না পেয়ে বর্তমানে কম্পিউটার ফটোকপির ব্যবসা করছি।
দাদার মৃত্যুর সময় আমরা বড় তিন ভাই জানাজা পড়ানোর মতো সমর্থ ছিলো কিন্তু মৃত্যুর সময় কাছে উপস্থিত ছিলাম না বিধায় তা সম্ভব হয়নি। ফুফাতো ভাইয়েরাও নরসিংদী ও ঢাকাতে থাকায় তাদের কাছে দেরিতে খবর পৌঁছেছে বিধায় যথাসময়ে জানাজায় উপস্থিত হতে পারেন নি। তখন আলেম হিসেবে একমাত্র আমার দুলাভাই উপস্থিত ছিলেন। সবার সম্মতিক্রমে দুলাভাই দাদার জানাজা পড়ান। বর্তমানে আমার দুলাভাইও পরলোকগমন করেন। এই দুলাভাইয়ের জানাজাও তখন আমার ফুফাতো ভাই হাফেজ আলমগীর হোসেন পড়ান। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি আমাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আল্লাহ যেন আমাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের কারো না কারোর মাধ্যমে জানাজার পড়ানোর ব্যবস্থা করবেন।
পরিশেষে সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করব আপনারা সবাই আমার দাদার জন্য বেশি বেশি দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করেন। আমিন।

১৫/০৯/২০১৭খ্রি:

সাকিবের ঈদ


কেন যেন আজ সাকিরে মনটা ভাল লাগছে না। এশার নামায আদায় করে ঘরে এসে বসলো। ইচ্ছে হলো দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারটির প্রতি চোখ বুলাতে। আর মাত্র পনের দিন বাকী ঈদের। অনেকদিন যাবত বাবাকে কোন চিঠি লেখা হয়নি। তাই মনে মনে ভাবছে সে, ঈদ তো প্রায় নিকটবর্তী। এবারের ঈদে বাড়িতে যেতে হবে। কাজেই বাবাকে একখানা চিঠি লেখার প্রয়োজন। কলম ও প্যাড নিয়ে বসে পড়লো সে। চিঠি লিখতে লিথতে রাত ১০টা বেজে গেছে তার কোন খেয়াল নেই। কাজেই আর দেড়ী করা যাচ্ছে না, এখনি শুয়ে পড়তে হবে। কারণ ভোর রাতে উঠে পড়তে হবে। সামনে তার দাখিল পরীক্ষা। সে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে। ঈদের পর পরই তার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। পরদিন সকাল বেলা তাড়াতাড়ি চিঠিটা পোস্ট করে দিল।
দিন যায় রাত আসে এভাবে কেটে গেল ১০দিন।
আজ ডাক পিয়ন এসে আঙিনায় পা রাখতেই তাছলিমা এগিয়ে আসলো। পিয়ন মুচকি হেসে বললো, এই নাও তোমার ভাইয়ার চিঠি। চিঠি পেয়ে তাছলিমা আনন্দে নেচে উঠলো। দ্রুত মা-বাবার কাছে আসলো। মা, ভাইয়ার চিঠি এসেছে।
মা বললেন, কখন এলরে?
এইতো মা এখন পিয়ন চাচা দিয়ে গেল।
মা রহিমা বেগম দেখি বলে চিঠিটা হাতে নিলেন। আনন্দে চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু খসে পড়লো।
বাবা কবির সাহেব বললেন পড়তো দেখি কি লিখেছে?
তাছলিমা মার হাত থেকে খামটি নিয়ে ছিঁড়ে পড়তে লাগলো।
শ্রদ্বেয় আব্বাজান,
পত্রের শুরুতে আপনার প্রতি রইল আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম ও আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ। আশা রাখি মহান প্রভুর অশেষ কৃপায় মা ও বোনকে নিয়ে ভাল আছেন। ভাল থাকাই আমার কামনা। আমিও আপনাদের দোয়ায় বন্ধুদেরকে নিয়ে ভাল আছি।
পরসংবাদ এই যে, আব্বা পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে আমাদের মাদ্রাসা ১০দিন বন্ধ থাকবে। তাই আমি এবারের ঈদ বাড়িতে এসে করব। ঈদের দুদিন পূর্বে বাড়িতে আসব। আমার জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আমার লেখাপড়া ভালই চলছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষার সিলেবাচ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। নামাযান্তে অন্তর থেকে আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে আমি পরীক্ষায় কামিয়াবী হতে পারি। মাকে আমার সালাম দেবেন। বোনকে আমার স্নেহ ও ভালোবাসা দিবেন।
আর বিশেষ কি লিখব। পরিশেষে আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করে আজকের মতো ইতি টানলাম।
ইতি
আপনার স্নেহের ছেলে
সাকিব
চিঠিটা পড়া শেষ হতেই মা-বাবার চোখে মুখে যেন একটা খুশীর ছাপ ফুটে উঠল। আনন্দ ভরা কণ্ঠে কবির সাহেব স্ত্রী রহিমাকে বললেন, ঈদ কি বারে হবে?
শুক্রবারে।
তাহলে আর কদিন বাকী?
এতো পাঁচদিন।
তাহলেতো ঈদ প্রায় নিকটবর্তীই?
হ্যাঁ।
আর মাত্র দু’দিন বাকী ঈদের। আজই সাকিব বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হবে। ইতোমধ্যে মাদ্রাসা ছুটি হয়ে গেছে। ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে এই বিশাল ঢাকা শহর থেকে অধিকাংশ লোকই গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যায়। প্রতিটা চাকুরীজীবিই তার মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে একত্রে ঈদ করতে চায়। ঘরমুখী যাত্রীরা ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য ইতোমধ্যে বাড়িতে চলে যাচ্ছে।
আজ সকাল ১০টায় সাকিব বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। কাজেই আর বিলম্ব না করে সে রিক্সা নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। সে দুইদিন পূর্বেই টিকেট কেটে রেখেছে। কারণ ঈদে যেই ভীড় তাছাড়া আর কোন উপায় নেই। ঈদ উপলক্ষে ভাড়া দ্বিগুণ। মনে হয় তারা দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে। সাকিব বাসস্টেশন এসে দেখতে পেল প্রচন্ড ভীড়। পিঁপড়া হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। নারী-পুরুষ একত্রে লেপটা লেপটি করে গাড়িতে উঠছে। কেউ কেউ বা বাদুরের মতো গাড়ীতে ঝুলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যে সত্যিই ষোল কোটি তা ঈদ না এলে পুরোপুরি বুঝা যায় না।
সাকিবের মনটা ছটফট করতে লাগল কখন বাড়ীতে ফিরবে। সে গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণ পর সাকিব গাড়ীতে কান্নার শব্দ পেল। সাকিব সে দিকে খেয়াল করতেই দেখতে পেল কয়েকজন জিন্স প্যান্ট পরিহিত যুবক। দেখতে কলেজ, ভার্সিটির ছাত্রদের মতো। তাদের হাতে অস্ত্র! তারা একজন ভদ্রলোককে লক্ষ্য করে তারা টিকেট কেটে এ বাসে উঠেছে। যুবকগুলোর উদ্দেশ্য ঐ ভদ্রলোককে হত্যা করে তার টাকা-পয়সা সব লুট করে নিয়ে যাওয়া।
একজন ডাকাত বলে উঠলো, সাবধান কেউ চিৎকার করবে না। তাহলে সবাইকে খতম করে ফেলব।
ডাকাতদের কথা শুনে ভয়ে সাকিবের শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠল। আর মনে মনে সে আল্লাহর নাম স্মরণ করল। লোকটির হাতে ছিল একটি ব্রিফকেস। ডাকাতদের মধ্য হতে একজন পিস্তল নিয়ে লোকটির নিকট গেল। পরে তার কাছে টাকার ব্রিফকেসটা চাইল। ভদ্রলোকটি ব্রিফকেসটি দিতে চাইল না। এমন অবস্থায় অন্য একজন ডাকাত লোকটির পেটের মধ্যে চাকু ঢুকিয়ে দিল। ভদ্রলোকটি তখন একটি চিৎকার দিয়ে সাথে সাথে মারা যায়। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল গাড়ি। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। সমস্ত গাড়ি নিরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যাত্রীদের কারো মুখে কোন শব্দ নেই। মুহূর্তে শোকের ছায়া পড়ে গেল গাড়িতে।
একজন যুবক ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললো, সাবধান কোথাও গাড়ী থামানোর চেষ্টা করবে না। তাহলে বুঝতে পারবি পরিণাম কি হয়। তারপর কয়েকজন ডাকাত মিলে ভদ্রলোকের মৃতদেহটি টেনে হেচরে বের করে চলতি গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। গাড়ি অল্প কিছুদুর যাওয়ার পর যুবকগুলো ড্রাইভারকে গাড়ি থামানোর কথা বলে। ড্রাইভার গাড়ি থামানোর পর ডাকাতগুলো ব্রিফকেস নিয়ে নেমে পড়ল। সাথে সাথে যাত্রীদের কোলাহল বেড়ে গেল। সবাই লোকটির জন্য আপসোস করতে লাগল।
আজ ছেলে বাড়িতে আসবে তাই রহিমা বেগমের মনটা খুশী লাগছে। কখন ছেলে বাড়ি ফিরবে সেই প্রহর গুনছে পাথের পানে তাকিয়ে। কবির হোসেনও ছেলের প্রতিক্ষায় বসে আছেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। আস্তে আস্তে সূর্যের ত্যাজ কমে এলো। বিকেলের আগমন বার্তা জানিয়ে দিল মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিন আযান দিয়ে।
সাকিব বাড়িতে এসে ‘মা’ ডাক দিতেই রহিমা বেগম বললেন, কিরে বাবা কেমন আছিস?
সাকিব মুখ বিবর্ণ করে জবাব দিল বেশী ভাল না।
হ্যাঁ, তাইতো তোর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। কি হয়েছে তোর?
ইতিমধ্যে সাকিবের আগমন বার্তা শুনে তাছলিমা ও কবির হোসেন আসলেন। সাকিব তার বাবাকে লক্ষ্য করে বললো, আব্বা আজ আসার পথে আমার চোখের সামনে এক ভদ্রলোকে খুন করতে দেখলাম।
একথা শুনার সাথে সাথে কবির হোসেনের হৃদয়টা ছ্যাৎ করে উঠল।
রহিমা বেগম চিৎকার দিয়ে বললেন, কি বলিস বাবা! তোর কিছু হয়নিতো?
না মা, আমার কিছু হয়নি। আমাদের চোখের সামনে এ সমস্ত ডাকাতরা বেড়ে উঠছে অথচ আমাদের দেশের সরকার এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
মা বললেন, চল ঘরে আয়। হাত মুথ ধুয়ে খেয়ে নে।
ছেলে সুস্থ্য দেহ নিয়ে বাড়িতে এসে ফিরছে বিধায় রহিমা বেগম আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে নিলেন।
আজ সেই প্রতিক্ষিত ঈদ। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় পালিত হচ্ছে ঈদুল আযহা। চারদিকে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। সাজ সাজ রব। চারপাশে শিশু-কিশোরদের কোলাহল চলছে। বাড়ি বাড়ি ফিরনি সেমাই খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। সবার আনন্দে কবির হোসেন পরিবারও আজ আনন্দিত। আতর গোলাপ দিয়ে নানা রঙ বেরঙের পোশাক পড়ে ছেলে-মেয়েরা ঈদগাহের দিকে যাচ্ছে। পায়ে হেঁটে ঈদগাহের দিকে যাচ্ছে সাকিব। যথাসময়ে ঈদের নামাজ আদায় করলো। ঈদগাহে অনেক বাল্য বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। নামায শেষে তাদের সাখে কোলাকুলি করল। পরে তার বাবা ও বন্ধুদেরকে নিয়ে দাদা-দাদীর কবর জিয়ারত করে বাড়ি ফিরল।
রচনাকাল-২৮ জুলাই ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।

অসহায়


এই রিক্সা যাবে।
কৈ যাবেন আফা?
গুলিস্তান।
ভাড়া কত?
৪০ ট্যাহা।
৩০ টাকায় যাবেন।
না, যাব না।
৩১ টাকায় যাবেন।
না- যাব না।
ঠিক আছে, আরো দুই টাকা বাড়িয়ে দিব। ৩৩ টাকা দিব। যাবেন।
আফা এইডা কি মাছের বাজার পাইছেন? ৪০ ট্যাহার নিচে এক ট্যাহা কম হলেও যাব না। এই বলে রিক্সাওয়ালা চলে গেল।
মনিরা সামনে হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর আবার আরেক রিক্সাওয়ালা সামনে দিয়ে যাচ্ছেÑ ঐ রিক্সা যাবেন।
কৈ যাইবেন আফা?
গুলিস্তান।
যাবনা।
কেন যাবেন না?
তা ক্যান কমু আপনাকে।
রিক্সাওয়ালার জবাবে মনিরা তখন বেকুব হয়ে গেল। কিছুদূর হেঁটে আবার আরেক রিক্সাওয়ালাকে ডাক দিলো, এই রিক্সা যাবেন।
যামু। কৈ যাবেন?
গুলিস্তান।
আহেন।
ভাড়া কত?
৫০ ট্যাহা। ১০ মিনিটের রাস্তা হেটে চলে আসলাম। ১০ মিনিট আগে একজন বলল ৪০ টাকা আর এখনও তুমি বলছ ৫০ টাকা!
ভাড়া ৫০ ট্যাহাই। তয় ৪৫ ট্যাহা যাবেন।
না।
৩৪ টাকায় যাবেন।
কি কইলেন ৩৪ ট্যাহা! রিক্সাওয়ালা মুখ ভেংচিয়ে বললো, হাইট্টা যান ট্যাহা লাগবে না।
মনিরা আর কোন কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগল। আবার সামনে একটি রিক্সাওয়ালাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে ভাড়া চাইল ৪০ টাকা। এবার মনিরার মেজাজটা চড়া হয়ে গেল। কোথায় বাস করছি আমরা। ১৫মিনিটের রাস্তা হেঁটে আসার পরও ভাড়া কমছে না। তাই এবার মনিরা সিদ্ধান্ত নিল হেঁটেই গুলিস্তান যাবে এবং রিক্সা ভাড়ার টাকা দিয়ে কোন কিছু খেয়ে ফেলবে।
অবশেষে মনিরা শাহবাগ থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। মনিরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দীর্ঘ ৩০ মিনিট হেটে গুলিস্তান এসে পৌঁছল। ৩০মিনিট হেঁটে তার এখন ৩৪ টাকা আয় হলো।
মনিরা এখন কিছু খাওয়ার জন্য সামনেই একটি হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এমন সময় পিছন থেকে এক ছিনতাইকারী মনিরার ভ্যানিটি ব্যাগটি ছিনতাই করে দৌঁড় দেয়। ভ্যানিটি ব্যাগটি ধরে যখন ছিনতাইকারী আচমকা টান দেয় তখন মনিরা মাটিতে পড়ে যায়। মাটি থেকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখে তার ভ্যানিটি ব্যাগ নেই এবং ছিনতাইকারী দৌঁড়ে পালাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে মনিরা চিৎকার করে বলছে, ছিনতাইকারী চলে যাচ্ছে। কে আছেন ভাই ওকে ধরেন। কিন্তু আশে পাশের মানুষজন সিনেমার দৃশ্যের মতো উপভোগ করছে কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচির পর মনিরা মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। কারণ ভ্যানিটি ব্যাগে ছিল তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও দুই হাজার টাকা ও মোবাইল। সে এখন ভাবছে এ কোন আজব দেশ। দিনের বেলাও নিরাপদে চলাফেরা করা যায় না। এভাবে সকলের চোখের সামনে আমার টাকাগুলো নিয়ে গেল, কেউ একটু সাহায্যও করল না। এতগুলো লোকের সামনে দিয়ে নিরাপদে ছিনতাইকারী পালিয়ে গেল। এখন আমি কি করব। কিভাবে আমি বাসায় ফিরব। আমার কাছেতো আর কোন টাকা পয়সা নেই। এইসব বিষয় ভাবতে ভাবতে মনিরা কান্নাকাটি করতে লাগল।
এতক্ষণে আশেপাশের অনেক লোক তাকে ঘিরে ফেলল। উৎসুক জনতার কেউ কেউ এখানে হয়তো কোন সুটিং চলছে ভেবে এগিয়ে আসছে। কেউ হয়তো কোন দুর্ঘটনা হয়েছে ভেবে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে যখন আসল ঘটনা জানতে পারে তখন সবাই চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ যাবার বেলায় বলছে এটা ঢাকা শহরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমন চুরি ছিনতাই অহরহ ঘটছে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায়।
এক পথচারী মনিরার সামনে এসে বলছে, এখন কান্নাকাটি করে লাভ নেই বাড়ি ফিরে যান। তানাহলে আরো অন্য কোন বিপদে পড়তে পারেন। এটা ঢাকা শহর। বলতে পারেন বিপদের শহরও!
মনিরা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে, ভাই এখন আমি কি করে বাড়ি যাব। আমার কাছেতো কোন টাকা পয়সাও নেই। সবইতো ঐ ছিনতাইকারী নিয়ে গেছে।
তাতে কি হয়েছে। রাস্তাঘাটে কতলোকজন আছে। সাহায্য চান। কেউ না কেউ দিবে। এই বলে লোকটি চলে গেল।
এভাবে একে একে সব লোকই পর্যায়ক্রমে মনিরার কাছ থেকে চলে গেলো। অনেকেই সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দিয়ে গেছে কিন্তু তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি। বরং উল্টা তারা মনিরাকে ভয় দেখিয়ে গেছে।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মনিরা গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। কিভাবে বাড়ি ফিরবে। কার কাছে টাকা সাহায্য চাইবে। কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। এই শহরের অলিগলি তেমন চেনাজানা নেই। কারণ সে এই শহরে এসেছে বেশী দিন হয়নি। মাত্র এক মাস হয় ঢাকায় এসেছে। তার আত্মীয়র বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে বলে ঢাকায় তার আগমন। ইতোমধ্যে একটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তিও হয়েছে। গুলিস্তান থেকে তার বাসায় হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়। কারণ তার বাসা মিরপুর। মিরপুর যেতে হলে তাকে বাসে যেতে হবে। বাসে বিনা টাকায় যাওয়া সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে অনেক পথ হেঁটে সে এখন ক্লান্ত। অতীতে এতখানি পথ কোন দিন হাঁটেনি। একদিকে সে ক্লান্ত। অন্যদিকে রাত। আবার বাসা অনেক দূরে। আর কিছু ভাবতে পারছে না মনিরা।
মনিরার কাছে এখন কোন মোবাইলও নেই যে বাসার কাউকে ফোন করে বিষয়টি জানাবে। তাছাড়া নতুন বাসায় এসেছে এখানের নাম্বারও মুখস্ত করেনি। তাদের বাড়ির কেউ তার ঐ বাসার কারোর নাম্বারও জানে না যে তাদেরকে জানাবে। এমন বিপদের সম্মুখীন হয়ে মনিরা ভয়ে ভয়ে ধীর পায়ে সামনে এগুচ্ছে। ভাবছে সব লজ্জা ত্যাগ করে কিছু টাকা সাহায্য চাইবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন পথচারীর কাছে তার বিপদের কথা বলে সাহায্য চেয়েছে। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করেনি। সবাই ধুর ধুর করে বলছে, পুরান পাগলের ভাত নেই নতুন পাগলের আমদানী। ক্লান্ত দেহ নিয়ে মনিরা হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ চলে আসল। ইতোমধ্যে রাত ৮ টা বেজে গেছে। আর হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব না। শাহবাগ মোড়ে কোন এক দোকানের সামনে মনিরা বসে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর মনিরা সিদ্ধান্ত নিল আর এভাবে হাঁটা যাবে না। বাসে উঠে বসবে পরে যা হবার হবে। মিরপুরের বাসে উঠে বসল মনিরা। কিছুক্ষণ পর কনটাক্ট্রর এসে ভাড়া চাইল মনিরার কাছে।
মনিরা তার বিপদের কথা কনটাক্ট্ররকে বুঝিয়ে বলল। কিন্তু বদ মেজাজী কনটাক্ট্রর কিছুতেই তার কথা বিশ্বাস করল না। ধান্দাবাজীর আর জায়গা পাওনা। ভাড়া দাও নইলে বাস থেকে নামিয়ে দিব।
প্লিজ ভাই আমি বড়ই বিপদে আছি আমাকে নামিয়ে দিবেন না। আবার যদি কোনদিন দেখা হয় আমি আপনার ভাড়া দিয়ে দিব।
এসব সিনেমার ডায়লগ ছেড়ে ভাড়া দেন। বেশীক্ষণ আপনার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারুম না। অন্যদের ভাড়া কাটতে হবে।
শত অনুরোধ করেও যখন কোন কাজ হলো না তখন কনটাক্ট্রর মনিরাকে টেনে হেঁচরে নামিয়ে দিল ফার্মগেটের ওভারব্রিজের নিকট। এদিকে রাত এখন ৯ টা বাজে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে লাগল। মনিরা ওভার ব্রীজের নীচে বসে পড়ল। তার চোখে ঘুম আসছে।
এদিক দিয়ে মনিরার পাশ দিয়ে এক লোক হেটে যাচ্ছে। বয়স চল্লিশের উপরে হবে। তাকে দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। ব্যাপার কি দেখতে ভদ্র ঘরের মেয়ে কিন্তু এখানে বসে এভাবে জিমাচ্ছে কেন? একটু কাছে গিয়ে দেখে আসি। ঐ লোক মনিরার কাছে আসল। এ মেয়ে কে তুমি?
মনিরা চমকে উঠল। আমি, আ…মি.।
হ্যাঁ কে তুমি?
আমি মনিরা।
এখানে কি করছ?
জানেন ভাই আমি খুব বিপদে আছি।
বিপদ! কিসের বিপদ!!
আমার ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে। টাকা পয়সা, মোবাইল সব নিয়ে গেছে। বাসায় যাওয়ার কোন ভাড়া নেই। তাই এখানে বসে চিন্তা করছি কি করব।
কি বলছ তুমি চুরি হয়ে গেছে! কোন সমস্যা নেই। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব।
আপনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবেন!
হ্যাঁ।
আমিতো আপনাকে চিনি না।
এই দুনিয়ায় কি সবাই সবাইকে চিনে বোন।
বোন! আপনি আমাকে বোন ডাকলেন?
হ্যাঁ তুমি আমার বোন। ভাইয়ের দায়িত্ব বোনের বিপদে সহযোগিতা করা।
সত্যি আমাকে সহযোগিতা করবেন?
অবশ্যই। তোমার বাসা কোথায়?
মিরপুর।
আমার বাসাতো মিরপুর।
কত নম্বর।
১১ নম্বর।
কি কাকতালীয় মিল। আমিও ১১ নম্বর থাকি।
তাই নাকি!
কোন চিন্তা নেই। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব।
মনিরা লোকটির মিঠা কথায় একটু আশার আলো খুঁজে পেল। এবার মনে হয় বাসায় যাওয়া যাবে। দুনিয়ায় এত ভালো মানুষ আছে তা ভাবতে পারে না সে। লোকটি যখন আমাকে বোন বলে ঢেকেছে তাহলে তার সাথে চলে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। মনিরা রাজি হয়ে গেল। ঠিক আছে আমি আপনার সাথে মিরপুর যাব। বাসায় গিয়ে আপনার ভাড়া পরিশোধ করে দিব।
ছি: ছি: এ কথা বলে না বোন। সামান্য কটা টাকা বাসায় গিয়ে পরিশোধ করতে হবে কেন? কোন টাকা লাগবে না। কোন ভাই কি ছোট বোনের কাছ থেকে টাকা নিতে পারে।
মনিরার বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল।
ঠিক আছে চলুন ভাইয়া।
ঠিক আছে চল।
এবার মনিরা উঠে দাঁড়াল। দু’জন মিরপুরের বাসে উঠে বসল। পাশাপাশি সিটে দু’জন বসল। মনিরা জানে না কোথায় সে পা বাড়াল। তার বিশ্বাস লোকটি তাকে বাসায় পৌঁছে দিবে। কিন্তু না কিছুক্ষণ পরই লোকটি আসল চেহারা উম্মোচিত হলো। সে পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে মনিরার নাকে ঘষা দিল। আর অমনি মনিরা অজ্ঞান হয়ে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর লোকটি ড্রাইভারকে গিয়ে বলছে, ভাইজান আমার বোন অজ্ঞান হয়ে গেছে তাকে হাসপাতালে নিতে হবে গাড়িটা এখানে একটু থামান। ড্রাইভার গাড়ি থামানোর সাথে সাথে লোকটি মনিরাকে নিয়ে গাড়ী থেকে নেমে পড়ল।
পড়ে লোকটি মনিরাকে একটি যৌন পল্লীতে নিয়ে গেল। যেখানে গ্রামের সহজ সরল ও অসহায় মেয়েদেরকে নিয়ে আসা হয়। মুখোশধারী লোকটি মূলত ঐ যৌন পল্লীর দালাল। তার কাজ সারাদিন শহরে বা গ্রামে ঘুরাঘুরি করে অসহায় মেয়ে খুঁজে বের করে এখানে নিয়ে আসা। আর তাদেরকে পেলে অসায়ত্বকে পূজি করে সরলতার সুযোগে তাদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসে এবং যৌন পল্লীর মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। যাদেরকে একবার এখানে নিয়ে আসা হয় তারা আর কোনদিন তাদের আসল ঠিকানা খুঁজে পায় না। হয় তাদেরকে এখানে থেকে যৌনকর্মী হিসেবে জীবন যাপন করতে হয় নতুনা মৃত্যুবরণ করতে হয়। এসব অসহায় নারীদের দিয়ে যৌন পল্লীর মালিকরা ব্যবসা করে। এই কাজের বিনিময়ে তারা কিছু পায় না। শুধু খাবার আর কাপড় চোপড় পায়। মালিক প্রত্যেক খদ্দের থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেয়। অনেক অসহায় নারী এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও বেরিয়ে আসতে পারে না। কারণ স্থানীয় লোকজন তাদেরকে বের হতে দেয় না।
মনিরাকে অজ্ঞান অবস্থায় মুখোশধারী দালাল লোকটি যৌন পল্লীতে নিয়ে আসার পর যৌন পল্লীর মালিক খুব খুশী হয়। এই যৌন পল্লীতে আরেকটি অদ্ভুদ কাজ করা হয় তাহলো, যে দালাল যে মেয়েকে এখানে নিয়ে আসবে তাকে প্রথমে সে ভোগ করবে তার ইচ্ছামতো। সেই মতে আজকের রাতটি মুখোশধারী দালালটির জন্য বরাদ্দ হলো। মনিরাকে অজ্ঞান অবস্থায় রেখে সে সারারাত তাকে ভোগ করল। ছিন্নভিন্ন করে দিল মনিরার ফুটন্ত যৌবন। নরপশু সারারাত তার দেহটাকে নিয়ে খেলা করল।
সকাল বেলা মনিরার জ্ঞান ফিরল। চারদিকে তাকিয়ে দেখে এটা তার বাসা নয় অপরিচিত একটি জায়গা। তার চার পাশে অসংখ্য নারী দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
চারদিকে তাকিয়ে মনিরা বললো, কে তোমরা?
চার পাশ থেকে হাসির আওয়াজ এল। হা… হা…।
আমরা তোমার বান্ধবী। আমরা এক সাথে থাকব। একসাথে খেলা করব।
এসব কি বলছেন? আমি এখানে কেন? এটা কোন জায়গা?
যৌন পল্লীর মালিক বলল, এটা তোমার শেষ ঠিকানা। এখান থেকে ফেরার কোন পথ নেই। এখানেই তোমাকে এখন থেকে থাকতে হবে।
না না এ হতে পারে না। আমার ভাইয়া কোথায়?
কে তোমার ভাইয়া?
তার নাম জানি না।
ও যে তোমাকে নিয়ে আসছে তাকে খুঁজছ? তাকে আর দেখতে পাবে না। তার কাজ শেষ। এবার যা করার আমরা করব।
না আমি এখানে থাকব না এখনই চলে যাব। এই বলে মনিরা বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু উঠতে পারছে না। কোমরের ব্যথায় শরীর অস্তির হয়ে গেছে। সারারাত তার উপর পৈশাষিক নির্যাতন হয়েছে তা সে বলতেই পারবে না। কোন রকমে সে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বিছানায় রঙের দাগ!
একি এ অবস্থা কেন আমার! চমকে উঠল মনিরা।
দৌঁড় দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মালিক খপ করে তাকে ধরে বলল, কোথায় যাও। এখানে যে একবার আসে সে আর ফিরে যায় না।
এ কথা বলার সাথে মনিরা আবার অজ্ঞান হয়ে গেল।

রচনাকাল- ১ অক্টোবর-২০১৪খ্রি:

অপেক্ষা


পদ্মা নদীতে এখন যেন কান্নার ঢেউ। চলছে পদ্মাপাড়ে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি। কিছুদিন পূর্বে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ লঞ্চ। এই লঞ্চডুবিতে নিহত হয় দিনমজুর খবির উদ্দিনের তিন মেয়েও স্ত্রী। কন্যা ও স্ত্রীর খুঁজে আজ প্রায় এক মাস যাবত পদ্মার পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন খবির উদ্দিন। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছেন যাঁরা, তাঁরা নেহাতই ভাগ্যবান। অনেকেই লঞ্চে উঠেছিলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। নিজে বেঁচে গেছেন কিন্তু হারিয়েছেন পরিবারের অন্যদেরকে। কিন্তু হতভাগ্য খবির উদ্দিনের পরিবারের কেউ বেঁচে নেয়।
তিন কন্যা ও স্ত্রী নিয়ে ছিল খবির উদ্দিনের পরিবার। তিন কন্যার নাম তিনি আদর করে রেখেছিলেন স্মৃতি, বীথি ও ইতি। ঈদ উপলক্ষে তিন কন্যা তার মাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় চাচার বাড়ীতে বেড়াতে যাচ্ছিল। আর ফিরে আসল না। একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তে তছনছ করে দিল খবির উদ্দিনের পরিবারকে। প্রায় একমাস হলো লঞ্চডুবল এখনও তাদের সন্ধ্যান পাননি খবির উদ্দিন। কি হলো তাদের, কোথায় আছে তা কিছুই জানেন না। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কখন ফিরবে তারা। কখন দেখবে তাদের মুখ। জীবিত বা মৃত অবস্থায় দেখতে চায় তিন কন্যা ও স্ত্রীকে। তিন কন্যা ও স্ত্রীর খুঁজে খবির উদ্দিন প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। নাওয়া খাওয়া নেই। চোখ বেয়ে সারাক্ষণ শুধু পানি পড়ে। পাগলের মতো পদ্মার পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যতদিন উদ্ধার কাজ চলছিল ততদিন তিনি উদ্ধারকর্মীদের কাছাকাছি থেকেছেন। কিন্তু তার তিন কন্যা ও স্ত্রী লাশ ফিরে পায়নি। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও তাদের কোন হদিস মেলেনি। যতবারই নদীতে লাশ ভেসে উঠেছে ততই বারই খবির উদ্দিন দৌঁড়ে ছুটে গেছেন লাশের কাছে আর ততবারই নিরাশ হয়ে ফিরেছেন তিনি।
এখন আর উদ্ধার কাজ নেই। কয়েকশ যাত্রী নিখোঁজ রেখে সরকার উদ্ধার কাজ বন্ধ করে দিল। এ কথা ভাবতেই খবির উদ্দিনের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে। আর হয়তো কোনদিন তাদের লাশ দেখাও সম্ভব হবে না। এতদিন আশায় ছিলেন হয়তো তাদের লাশ ফিরে পাবে কিন্তু এখন আর সেই আশাও করতে পারেনি। তাইতো খবির উদ্দিন সিদ্ধান্ত নিল আর বাড়ি ফিরে যাবেন না। মরতে হয় এখানেই মরবেন। যেই নদীতে তার পরিবারের সলিল সমাধী হলো সেখানেই তিনি মরতে চান। কি হবে বাড়ীতে গিয়ে? কার মুখ দেখে তিনি ঘুমাবেন। কোন কিছু তিনি এখন ভাবতে পারেন না।
হাতে গোনা কয়েকটা লাশের সন্ধ্যান মিলল। আর বাকীরা সবাই লঞ্চের ভেতরে অথবা কোথাও না কোথাও ভেসে বেড়াচ্ছে। আজও লঞ্চের সন্ধান মেলেনি। লঞ্চ এখন কোথায় আছে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। খবির উদ্দিনের পরিবারের লোকজন কোথায় আছে তাও আল্লাহ জানেন। তারা কি লঞ্চের ভেতরে নাকি পানির স্রোতে ভেসে গেছে দূরদূরান্তে যা খবির উদ্দিন জানে না।
এমন বিপদের সময় কে দিবে সান্ত¡না খবির উদ্দিনকে। আপনজন বলতে কেউতো তার বেঁচে নেই। যাদেরকে নিয়ে তিনি বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছিলেন তারাওতো নিষ্ঠুরের মতো না বলে চলে গেল। আল্লাহ ওনাকে তিনটি কন্যা সন্তান দিলেন। কোন ছেলে সন্তান নেই। তাতেও তার কোন ক্ষোভ ছিল না। তাদেরকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন। তিন কন্যাকে তিনি সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য সারা জীবন দিনমজুর খবির উদ্দিন খেটেছেন। সাধারণ কৃষি কাজ করে তিনি তিন কন্যাকে লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। বড় মেয়ে স্মৃতি এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। মেজ মেয়ে বীথি ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে ও ছোট মেয়ে ইতি এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তিন কন্যাকে এম.এ পাশ করাবেন তারপর তিনি সু-পাত্রের কাছে বিয়ে দিবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হলো না। একটি দুর্ঘটনায় ভেঙ্গে গেল তার এতদিনের লালিত স্বপ্ন। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের চারজনই চলে গেলে দূর অজানায়। তাও আবার তাদের কোন লাশ পাওয়া যায়নি। কবর দেয়ার সুযোগ টুকু পর্যন্ত তিনি পাননি।
সকল প্রাণী মরণশীল। তাই মানুষও মরণশীল। মরার পর তাদের একটি শেষ সমাধিস্থল থাকে। সেই সমাধিস্থলে গিয়ে কবর জিয়ারত করে পারিবারের অন্য সদস্যরা তাদেরকে ভুলে থাকার শান্ত¡না পায়। কিন্তু খবির উদ্দিনের এ কেমন দশা হলো যে, পরিবারের সবাইকে এক সাথে হারাতে হলো এবং তাদের কোন সমাধিস্থলও করতে পারেনি। এমনকি তাদেরকে শেষ দেখাটুকুও দেখতে পারেনি। এমন দুর্ঘটনা কি সহ্য করার মতো। কোন মানুষ কি পারবে এমন দুর্ঘটনা নীরবে সহ্য করতে? খবির উদ্দিন সহ্য করতে পারেনি। তাইতো তিনি এখন বোবা হয়ে গেছেন। কোন কথা নেই তার মুখে। শুধু হতাশার চোখে পদ্মার পাড়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এখন তার আর কোন কাজ নেই। যেহেতু তাদের কোন লাশ পাওয়া যায়নি। তাই এটাই তাদের সমাধি। এখানে থাকলে তিনি শান্তি পাবে অন্য কোথাও আর তিনি শান্তি পাবেন না। তাইতো তিনি এখানে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা তাদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
খবির উদ্দিনের একমাত্র বড় ভাই দবির উদ্দিন। যিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি ছোট বেলা থেকেই শহরে থাকতেন। গ্রামে তেমন আসতেন না। মাঝে মাঝে ঈদের সময় গ্রামে আসতেন। তার ছেলে-মেয়েরা ও শহরে থাকে। এবার ঈদে তারা গ্রামে আসেনি। দুর্ঘটনার খবর শুনেও তৎক্ষণাৎ তিনি পদ্মার পাড়ে যাননি ছোট ভাইয়ের বউ ও ভাতিজিদের খোঁজে। শুধু দূর থেকে খোঁজ নিয়েছেন। শুধুমাত্র তার বড় ছেলে আলভী গিয়েছিল তাদের খোঁজে। দীর্ঘ এক মাস পড়ে ভাইয়ে কথা মনে পড়ল দবির উদ্দিনের। তাইতো তিনি ভাইয়ের খোঁজে পদ্মার পাড়ে আসলেন। পদ্মার পাড়ে এসে দেখে ঐ দূরে নদীর পাড়ে বসে আছে খবির উদ্দিন। উসখু-খুসকু চুল। নাওয়া খাওয়া নেই। তাই শরীর কঙ্কাল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন দবির উদ্দিন। পিছন দিক দিয়ে ভাইয়ের কাদে হাত রাখলেন দবির উদ্দিন। ভাইয়ের স্পর্শ পেয়েও খবির উদ্দিনের কোন অনুভূতি নেই। ঘাড় ফিরে তাকিয়ে দেখলেন না কে ধরেছে তার কাদে। তাইতো দবির উদ্দির ইচ্ছে করেই তার সামনে গেলেন। ভাইকে গলায় জড়িয়ে বললেন, ভাই আমার যে চলে যাবার সেতো চলে গেছে। তারা আর ফিরে আসবে না। এখানে বসে থাকলেতো কোন লাভ হবে না। শুধু শুধু কেন এখানে পড়ে আছিস? তাদেরকে এখন পেলেও তাদেরকে চিনতে পারবে না কারণ তাদের লাশ হয়তো এতদিনে পচে গেছে। তাই বলি ভাই বাড়ী চল। আমি তোর দেখাশুনা করব। বাকী জীবন আমার সাথে কাটাবে।
খবির উদ্দিন দবির উদ্দিনের কথার কোন প্রতিউত্তর দিচ্ছে না। কি করে উত্তর দিবে তার মুখের ভাষা যে সেই কবেই হারিয়ে গেছে। তাইতো বড় ভাইয়ের কথায়ও তিনি কোন উত্তর দিতে পারছেন না। বড় ভাইয়ের দিকে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না খবির উদ্দিন।
কি হলো ভাই কথা বলছস না কেন? তুই এভাবে চুপ থাকলেতো চলবে না। চল বাড়ীতে। আল্লাহ যা করেন সবইতো ভালর জন্যই করেন। তার উপরতো আমাদের হাত নেই।
এতকিছু বলার পরও খবির উদ্দিনের মুখে কোন শব্দ বেড় হচ্ছে না। শুধু মাথা নাড়িয়ে জানান দিলেন তিনি এখান থেকে যাবেন না। মরতে হয় এখানেই মরবেন। তবুও বাড়িতে যাবেন না। এমনকি কারো সাথেও যাবেন না। খবির উদ্দিনকে অনেক বুঝিয়ে ও কাকুতিমিনতি করে দবির উদ্দিন এখান ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় চলে আসলেন।
দবির উদ্দিনের বড় ছেলে আলভী সে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেছে। চাকুরীর জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করছে। চাকুরীটা হয়ে গেলেই বিয়ে করবে তার চাচাতো বোন স্মৃতিকে। দীর্ঘদিন থেকেই স্মৃতির সাথে ভালোবাসার সর্ম্পক ছিল। পরিবার ও আত্মীয় স্বজন অনেকেই এ খবর জানত। পরিবারের পক্ষ থেকেও তেমন কোন আপত্তি ছিল না স্মৃতিকে বিয়ে করতে। কারণ স্মৃতির বাবা দিনমজুর হলেও স্মৃতি ছিল অসম্ভব সুন্দরী ও মেধাবী। এসএসসি ও এইচসিতে এপ্লাস পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিল। বড় চাচার বাসায় থেকেই পড়ছিল স্মৃতি। তাইতো আলভী ও আলভীর পরিবারের সাথে তার সর্ম্পক ছিল অন্যরকম। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অঙ্কুরেই সেই ভালোবাসা আজ স্বপ্ন হয়ে রইল।
আলভী যখন লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর পেল তখন যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মূহূর্তে তার জীবনে কালবৈশাখী ঝড় নেমে আসল। তছনছ হয়ে গেল এতদিনের লালিত স্বপ্ন। ছুটে গেল পদ্মার পাড়ে। পাগলের মতো খুঁজতে লাগল স্মৃতিকে। কোথাও জীবিত স্মৃতিকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে গেল আলভী। তার শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেল। এই বুজি তার জীবন থেকে স্বপ্নের মানুষ চলে গেল। সে আর ফিরে আসবে না। তাকে আর ভালবাসার কথা শুনাবে না। তাকে আর সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখাবে না। এই কথা ভাবতে পারছে না আলভী।
উদ্ধার কাজ শুরু হলো। একে একে মৃত লাশ ভেসে আসছে কিন্তু স্মৃতি ও তার পরিবারের কোন লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। তখনই আলভীর মনে জানান দিল স্মৃতির লাশ আর পাওয়া যাবে না। শেষ দেখাটুকু দেখতে পারবে না। স্মৃতি এখন তার মনের মনিকোঠায় স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন।
স্মৃতি যখন বুঝতে পারল লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে, জীবনের প্রদীব নিভে যাচ্ছে। হয়তো আর কারো সাথে দেখা হবে না। তাই মৃত্যুর পূর্বে অনন্ত প্রিয়তম আলভীর সাথে একটু কথা বলে নেই। তখন স্মৃতি আলভীকে ফোন দিল। আলভী ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে কান্নাভেজা কণ্ঠে স্মৃতি বলছে, আলভী আমরা যে লঞ্চে ঢাকায় আসছি সেই লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে।
আলভী আশ্চার্য হয়ে বললো, একি বলছ তুমি!
হ্যাঁ আলভী জীবনের চরম সত্যের মূহুর্তে এখন দাঁড়িয়ে আছি। লঞ্চের ভেতর পানি ঢুকে গেছে।
এ হতে পারে না। আলভী লক্ষ করে শুনছে লঞ্চের ভেতর কান্নার রুল পড়ে গেল। সবাই চিৎকার চেচামেচি করছে। কেউ কালিমা পড়ছে। কেউ আল্লাহকে স্মরণ করছে।
আমি হয়তো বাঁচবো না। আমার সাথে বীথি, স্মৃতি ও মা আছেন তারাও হয়তো বাঁচবে না। তুমি আমার বাবাকে এ খবরটা জানিয়ে দিও। আর যদি পার একবার এসে আমার লাশটা দেখে যেও। যদি আমরা চারজনেই মারা যায় তাহলে গ্রামের বাড়ীতে সবার লাশ এক জায়গায় দাফন করবা। এই আমার অনুরোধ।
আলভী আর কোন উত্তর দিতে পারেনি। ইতোমধ্যে ফোনের লাইন কেটে গেল। হ্যালো হ্যালো বলেও আর কোন সাড়া শব্দ পেল না স্মৃতির। আলভী স্তদ্ধ হয়ে গেল। স্মৃতির কোন সাড়া না পেয়ে আবার আলভী মোবাইল ডায়াল করল। কিন্তু না আর মোবাইলে রিং ঢুকে না। মোবাইল সফটওয়্যার বলছে, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর আলভী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার পায়ের নিচে এখন আর কোন মাটি নেই। হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আলভীর চিৎকার শুনে তার মা আসলো।
বাবা কি হয়েছে?
মা স্মৃতি, বীথি, ইতি ও তার মা লঞ্চডুবির কবলে পড়ছে।
তুই কেমনে জানলি?
এখন আমাকে স্মৃতি ফোন করল।
ফোনটা দেতো আমার কাছে।
এখনতো আর সংযোগ পাচ্ছে না।
একি বলছিস! সবাই মনে হয় এতক্ষণে মরে গেছে।
আলভী আর বিলম্ব না করে তার চাচাকে খবর দেয়। চাচা এ খবর পেয়ে পাগলের মতো ছুটে চলল পদ্মার পাড়ে। আলভীও সাথে রওয়ানা হলো। ঘটনাস্থলে এসে চাচা ভাতিজা দুজনে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগল। কোথাও জীবিত অথবা লাশের সন্ধান পেল না। শত শত মানুষ স্বজনের খুজে এখানে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। কেউ হয়তো লাশ পাচ্ছে আবার কেউ হয়তো লাশ পাচ্ছে না। হতভাগ্যদের স্বজনরা লাশ না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে গেছে। তেমনি আলভী ও তার চাচা তিন থাকার পরও কোন লাশ পায়নি। আলভী নিরাশ হয়ে ফিরে আসল ঢাকায় কিন্তু তার চাচা খবির উদ্দিন ফিরে আসল না। এখন তিনি সেখানেই আছেন। এভাবেই হয়তো বাকী জীবন তিনি তিন কন্যা ও স্ত্রীর খোঁজে পদ্মার পাড়ে ঘুড়ে বেড়াবেন। আর তাদের অপেক্ষায় থাকবেন কখন পাবে তাদের লাশ। আর আলভী হয়তো অপেক্ষা করবেন অনন্তকাল তার প্রিয়তমার জন্য।
রচনাকাল- ০১-০৯-২০১৪খ্রি:

নাকফুল


প্রতিদিনের মতো আজও পাখির কিচিরমিচির ডাকে জোনাকীর ঘুম ভাঙে। ব্রাশ নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে যায়। দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে আয়নার সামনে আসে। মুখে ক্রিম দিতে আয়নায় চোখ রাখে। তারপর বের হয়ে পড়ে উঠান ঝাড়ু দিতে। বিয়ের পর থেকে সকালে উঠেই আয়না দেখাটা প্রতিদিনের অভ্যাস হয়েছে ওর। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আজ আয়নায় মুখ পড়তেই চমকে উঠলো জোনাকী! আঙুলের আগায় আজ আর ক্রিম উঠেনা। নিজের মুখের প্রত্যেকটা ভাঁজ ওর খুব চেনা। এইজন্যই বোধহয় এক পলকেই খালি নাকটা নজড়ে পড়লো। নাক স্পর্শ করে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। সোনার নাকফুলটা নাকে নেই!
এইতো এক মাস পূর্বে বিয়ে হল কবিরের সাথে জোনাকীর। লাল বেনারশী শাড়ী পড়ে এই বাড়িতে যখন জোনাকী আসে তখন তার শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছিল সোনার নাকফুলটি। সেদিন থেকে অন্য একটা জীবন শুরু হলো জোনাকীর। নাকফুলটা পড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ি বলেছিলো, মেয়েদের নাকফুল হারালেই স্বামীর অমঙ্গল হয়। দাদীর মুখেও অনেকবার শুনেছে এতে সংসারের অমঙ্গল হয়। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। অভাবের সংসার, টানাটানি করে কোন রকমে চলে। এই অবস্থায় এত দামী একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছে সে। একথা কেমন করে জানাবে স্বামী, শাশুড়িকে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে ঘরের কোনায়, বিছানায় সারা উঠোনের ময়লা-আবর্জনার মাঝে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে জোনাকী।
এমন সময় কবিরের মায়ের চোখে ধরা পড়ে বিষয়টি। নাকফুল নেই নতুন বউয়ের নাকে। কবিরের মা চড়া গলায় বললো, এই পোড়ামুখী তোর নাকফুল কই?
হঠাৎ শাশুড়ির এমন প্রশ্নে জোনাকী ভয় পেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, আম্মা কই পড়ছে, জানি না। সারা বাড়ি খুজছি কোনখানে পাইনি।
– তুইতো আমার পোলার অমঙ্গল ডাইক্কা আনছিস।
– এইসব কি কন আম্মা!
ততক্ষণে পুরো গ্রামের বৌ-ঝিদের মাঝে খবর রটে যায় নতুন বউয়ের নাকফুল হারিয়ে যাওয়ার কথা। গ্রামের লোকেদের প্রাচীন একটি ধারণা নতুন বউয়ের নাকফুল হারিয়ে যাওয়া অশুভ লক্ষণ। এতে অমঙ্গল হয় স্বামীর। ছেলের আশু অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন কবিরের মা। মায়ের কান্না শুনে ঘুম ভাঙে কবিরের। বাইরে এসে সব কিছু জানতে পেরে নাকফুল খুঁজতে থাকে কবিরও। কোথাও নাকফুল খুঁজে না পেয়ে হতাশায় ভোগছে কবিরও। তার মা জোনাকীকে ইঙ্গিত করে আরো অনেক কথা শুনায়। লজ্জায় অপমানে ঘরের দরজার একপাশে মুর্তির মতো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জোনাকী। কবির তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরে।
আজ কিছুই মনে পড়ছে না জোনাকীর। এমন অনভুলা কেমনে হল তা ভাবতে পারছে না সে। মনে করার চেষ্টা করছে কখন সে শেষ বারের মতো নাকফুলটাকে দেখেছে? মনে পড়ে জোনাকীর। আগের দিন রাতে গোসলের সময় কবিরের দুষ্টমিতে নাকে আঘাত পেয়েছিল জোনাকী। তখন নাকফুলটা নাকে লেগেছিল। তখন হয়তো টিউবওয়ের পাড় পড়েছিল।
কবিরকে জানায় সে কথা। কবির তখন জোনাকীকে নিয়ে টিউবওয়েলে পাড় খোঁজাখুজি করে। কিন্তু এত ছোট্ট একটি সোনার নাকফুল কি ততক্ষণে টিউবওয়েলের পাড় পড়ে রইছে? কাদা পানিতে ভেসে হয়তো মাটির নিচে কোথাও চলে গেছে।
কবির কিছুক্ষন চুপ করে ভেবে বললো, চল্ আর বিছারতে হবে না। আমি তোরে আবার নাকফুল কিন্না দিমু।
কবির তাদের গ্রামের পাশেই একটি কারখানায় চাকরি করে। অল্প টাকা বেতনে চাকুরি করে কোন রকমে সংসার চালায়। সংসার বলতে মা-বাবা, স্ত্রী ও ছোট্ট একটি বোন।
নাকফুল হারানোর সপ্তাহখানেক পর। অন্যান্য দিনের মতো আজও কাজ করতে কারখানায় যায় কবির। প্রতিদিনই সন্ধ্যার আগে কবির বাসায় ফিরে আসে কিন্তু আজ আর ফিরছে না। রাত আটটা বাজে এখনও বাড়ি ফেরেনি কবির। সেই সকালে জোনাকীকে বলে গিয়েছে আজ বেতন পেলে তার জন্যে সোনার নাকফুল আনবে। কিন্তু না, এখনও ফেরেনি।
এদিকে কবিরের মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। নিশ্চয় কবিরের কোন বিপদ হয়েছে। তা না হলে এখনও কেন বাড়ি ফিরেনি। মায়ের মন ছেলের আশু অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে বউকে বললেন, এই অপায়া কইছিলাম না, মাইয়া মাইনসের নাকফুল হারাইলে সোয়ামীর অঙ্গল হয়। আজ যদি আমার পোলার কিছু হয় তোরে ছারুম না।
শাশুড়ির কথায় জোনাকীর কান্না আসে। রাত গভীর হলো। ঘরের এপাশ ওপাশ পায়চারি করে জোনাকী। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোথায় খুঁজবে স্বামীকে। জায়নামাজ হাতে নিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লো জোনাকী। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো, হে আল্লাহ আমার সোয়ামী যেখানেই থাকুক তুমি বালা রাইখ। আমার সোয়ামীকে সহিসালামতে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিও। আমীন। ঘড়িতে দেখে রাত এগারটা বাজে। বিছানায় শুয়ে কবিরের কথাই ভাবতে থাকলো জোনাকী। কখনও যে ঘুমে ঢলে পড়লো তাও টের পেল না সে।
রাত বারোটা বাজে। হঠাৎ দরজায় নক করল।
দরজার আওয়াজ পেয়ে জোনাকীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতো রাতে দরজায় নক করার আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো ও। ভয়ে ভয়ে বললো, কেডা?
আমি কবির। দরজা খোল।
কবির নামটা শুনেই জোনাকীর যেন আত্মা ফিরে আসলো। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খোলে কবিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আপনিতো কোন দিন এত রাইত করে বারিত ফিরেন নি। আজকা এমন হইল ক্যান? আপনার কিচ্ছু হয়নিতো?
– না আমার কিচ্ছু হয়নি। সব কথা বলবো আমারে বসতে দাও। মা-বাবা কই, মা-বাবাকে ডাহ।
জোকাকী তার শাশুড়িকে ডাকছে, আম্মা, ও আম্মা, আব্বা ও আব্বা দেখেন আপনার পুলা আইছে।
এত রাতে জোনাকীর ডাকে কবিরের মায়ের ঘুম ভাঙ্গে। কি কইলা আমার কবির আইছে। কই আমার কবির। বলেই দরজা খুলে দ্রুত কবিরের ঘরে চলে আসলো। কবিরের বাবা ও বোন তারাও ঘুম থেকে উঠে এ ঘরে চলে আসলো। কবিরের মা কবিরকে ঝাপটে ধরে বললো, কিরে বাপজান তোর কিছু হয়নিতো?
– না মা আমার কিছু হয়নি?
– কই ছিলি এত রাইত পর্যন্ত?
– বেতন পাইয়া আমি গঞ্জের বাইনার দোকানে গিয়েছিলাম বউয়ের জন্য সোনার নাকফুল বানাইতে। সেইখান থেকে আসার পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা হইছে। সে জোর করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। আজ ওখানে থাকতে বলছিল। আমি চলে আসছি তাই এত রাত হইয়া গেছে।
– আর আমি কি না কি ভাবছি। তোর বউকে আমি অনেক গাল মন্দ করেছি।
– এসব কি বলছ তুমি মা!
– হ্যাঁ আমি তোর বউকে অপয়া বলেছি।
কবির অশিক্ষিত হলেও কুসংস্কার একদম বিশ্বাস করে না। তার মা সবকিছুতেই কুসংস্কার খুঁজে পান। তাইতো নাকফুলকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে কবির মাকে বললো, মা তোকে বলি আর কোনদিন এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করবি না। এইসব কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করি না।
কবিরের বাজান বললো, হ বাজান ঠিক কইছোস। তোর মা সারাজীবন এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে আমার পরিবারে অশান্তি করছে। তোর মারে বুঝাইয়া ক।
কবিরের মা তখন নরম হয়ে বললো, আমি আর এসব বিশ্বাস করব না। এইসব বিশ্বাস কইরা আমার ফুলের মতো বউটারে গালমন্দ করছি। এই কথা বলেই জোনাকীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ও বউ তুমি আমারে মাপ করে দিও।
এ কথা শুনেই জোনাকী বলে উঠলো, ছি মা এসব কি কইতাছেন? আপনি আমার হরি। আপনি আমার মায়ের মতো। আপনারে আমি মাপ করুম কেমনে। আপনি আর এইসব বিশ্বাস না করলেই আমাগোর আর কোন সমস্যা হবে না।
কবিরের মা বললো, ও কবির কই তোর বউয়ের সোনার নাকফুল দেখি।
কবির সোনার নাকফুল পকেট থেকে বের করে বললো, এই নে মা। তুই তোর পুলার বউরে নাকফুলটা পড়াইয়া দে।
কবিরের মা নাকফুলটা হাতে নিয়ে বললো, অহো মা। তোমারে নাকফুল পড়াইয়া দেই। বলে জোনাকীর নাকে নাকফুলটি পড়িয়ে দিল। সবাই তখন খুশি হলো।

তারিখ: ৩০/০১/২০১৭ইং

ময়নার বিয়ে


– ময়নার মা! ও ময়নার মা।
স্বামী গফুর মিয়ার ডাকে তাড়াহুড়া করে ময়নার মা তার কাছে আসলো।
– কি হইছে? এত ছিল্লাচ্ছেন ক্যান?
– আরে হুন না। একটা সুখবর আছে?
– সুখবর! এই ভরদুপুরে আবার কি সুখবর নিয়ে আসলেন?
– আমাগো ময়নার জন্য একটা ভালা পুলা পাইছি। পুলার ম্যালা পয়সা আছে। বিদেশ থাইক্কা আইছে।
– পুলার বাড়ি কই?
– আমাগো পাশের গ্যারাম মেজেরকান্দি। পুলার বাপ আমার বন্ধু।
– আমাগো ময়নার তো সবে চৌদ্দ বছর হইছে! এহনই মাইয়াডারে বিয়া দিয়া দিবেন?
– আমাগো ময়নাতো ম্যালা বড় হইছে। তারতো বিয়ে দেওন লাগবো। সব সময় ভালা পুলা পাওয়া যায় না। কি কও তুমি?
– আপনে যা ভালা মনে করেন তাই করেন।
– আল্লাহর মাল আমাগো মেয়ে তো পাঁচখান। একটা একটা কইরাতো সব্বাইরে বিয়া দিতে হইবো। তাই দেরি করা যাবে না।
– হ ঠিকই কইছেন। তা পুলাডার খোঁজ পাইলেন কই?
– ঐ যে ঘটক বিল্লাল ভাইকে ছিননা?
– হ ছিনি।
– হেই ঘটকের সাথে আজকা বাজারে দেহা হইছে। সেইতো আমারে কইছে পুলার সম্বন্ধে।
– ঠিক আছে। তয় বিয়ে দেওনের আগে পুলাডারে দেইখা নিয়েন।
– পুলা না দেইখা কি আর বিয়ে দিমু।
গফুর মিয়া বাঙালীনগর গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। নিজের যা জমি আছে তা চাষ করে কোন রকমে সংসার চালায়। একটি ছেলের আশায় তার সংসারে এখন পাঁচটি মেয়ে। প্রতি দু’বছর পর পরই একটি মেয়ে জন্ম হয়েছে। এখন সে ছেলের আশা ছেড়েই দিয়েছে। পাঁচ মেয়ে নিয়েই বাকি জীবন পার করতে চায়। সংসারের অভাব অনটনের কারণে মেয়েদেরকে লেখাপড়াও করাতে পারছেন না। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে বড় মেয়ে ময়নাকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর পর আর পড়ায়নি। অন্য মেয়েরাও কেউ স্কুলে যায় আবার কেউ যায় না। এই নিয়ে তার কোন চিন্তাও নেই। গফুর মিয়া পাঁচ মেয়েকে পর্যায়ক্রমে বিয়ে দিতে পারলেই সংসারের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে করে। মেয়েদের বিয়ে দেয়ার পর কি হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করে না।
গফুর মিয়া ও তার স্ত্রী জরিনা বেগম একেবারেই নিরক্ষর। ভালো মন্দের পার্থক্য তারা তেমন বুঝে না। অল্প বয়সে একটি মেয়ের বিয়ে দিলে ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই। তাদের একটিই কথা, বয়স হয়েছে বিয়ে দিতে হবে। বড় মেয়ে বিয়ে দিতে না পারলে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। ধারাবাহিকভাবে সব মেয়ের বিয়ে দিতে চায় তারা। তাইতো ঘটক বিল্লাল যখন বিয়ের প্রস্তাবের কথা বললো তখন সহজেই রাজি হয়ে গেলো সে।
গফুর মিয়ার সম্মতি নিয়ে আজ ঘটক বিল্লাল আসলো মেজেরকান্দি গ্রামের বাতেন মিয়ার বাড়িতে।
– কালার বাপ! ও কালার বাপ।
– কেডা আইছো এই সাতসহালে?
– আমি ঘটক বিল্লাল ভাই।
– ও চাচা আহেন।
বাতেন মিয়া ঘটক বিল্লাল ভাইকে একটি চেয়ার এনে ঘরে বসতে দিলো। তারপর বললো, কি মনে কইরা গরিবের বাড়িতে?
– ঘটকরা কি মনে কইরা আহে?
– হ বুঝবার পারছি। বিয়া শাদীর আলাপ সালাপ করতে?
– এইতো বুঝবার পারছো। হুনলাম তোমার পুলা কালা মিয়া নাকি বিদেশ থাইক্কা আইছে?
– হ ঠিকই হুনছো।
– তয় কয় দিনের ছুটি নিয়া আইছে?
– তিন মাসের।
– বিয়া শাদী করাইবা নাকি?
– বিয়া তো করামু। তয় ভালা একটা মাইয়া চাইতাছি।
– আমার কাছে একটা ভালা মাইয়া আছে।
– বাড়ি কোন গ্যারামে?
– বাঙালীনগর।
– কার মাইয়া?
– গফুর মিয়ার মাইয়া।
– কি কও। তারেতো আমি চিনি।
– হ সেওতো একই কথা কইছে।
– তার মাইয়া এত বড় অইয়া গেছে তাতো বুঝবার পারি নাই।
– মাইয়া মানুষ বড় হইতে বেশি দিন লাগে না। মাইয়া বিয়ার উপযুক্ত হইছে। দেখতে সুন্দর। গায় গতর নাদুস নুদুস। তোমার পুলাডার সাথে মানাইবো ভালা।
– কালা মিয়া যদি রাজি হয় তাইলে বিয়া করামু।
– রাজি হবে না ক্যান? গফুর মিয়ার কোন ছেলে নাই। সে মইরা গেলে সব জায়গা জমির মালিকতো মাইয়ারাই হইবো।
– বুঝবার পারছি। তয় পুলাডার সাথে একবার কথা কইয়া লই।
– ঠিক আছে ডাহ দেহি তোমার পুলারে। আর তোমার বউরে কও আমারে একখান পান দিতে।
বাতেন মিয়ার বড় ছেলে কালা মিয়া। নামের সাথে হুবহু গায়ের রঙ এর মিল আছে। এমন কালো মানুষ মেজেরকান্দি গ্রামে আর নেই। জন্মের সময় তার চেহারা দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। গফুর মিয়ার ঘরে এমন কালো ছেলে এলো কি করে? তাদের বংশেতো এমন কালো মানুষ নেই! জন্মের সময় তার নাম রহিম মিয়া রাখলেও গায়ের রঙ কালো হওয়ায় সবাই তাকে কালা মিয়া বলেই ডাকতে ডাকতে সে কালা মিয়া নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। বাতেন মিয়ার দুই ছেলে দুই মেয়ে। কালা মিয়া তার বড় ছেলে। অন্য ছেলেটা ঠিক বাবার মতো হয়েছে। মেয়ে দুটো মায়ের মতো।
বাতেন মিয়া গ্রামের একজন কৃষক। সারাজীবন কৃষিকাজ করে যা আয় করেছে তা দিয়েই সংসার চালিয়েছে। নিজেও লেখা পড়া করে নাই। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করার কথা চিন্তাও করে নাই। গত তিন বছর আগে জমিজমা বিক্রি করে বড় ছেলে কালা মিয়াকে সৌদী আরব পাঠায়। সেই থেকে বাতেন মিয়ার ভাগ্য খুলে যায়। ছেলেটা বিদেশ গিয়ে ভালো পয়সার মালিক হয়েছে। এই তিন বছরে বাড়িতে একটা টিনশেড বিল্ডিং করেছে। ছোট ভাই করিম মিয়াকে বিদেশ নিয়েছে। বেশ কিছু জমিও রেখেছে।
এখন বাতেন মিয়ার ছেলে যেহেতু ছুটিতে বাড়িতে আসছে তাকে বিয়ে করাবে। তাই পাত্রী খুঁজছে। আজ ঘটক বিল্লাল বাড়িতে এসে তারই বন্ধু গফুর মিয়ার মেয়ের কথা বলাতে সে রাজি হয়েছে বিয়ে করাতে কিন্তু ছেলের মতামতের জন্য ছেলেকে ডাকছে।
– কালা মিয়া! ও কালা। কই গেছস?
– কি আব্বা? ক্যান ডাকছেন?
– তোর বিল্লাল দাদা আইছে। একটু কথা ক দেহি।
বিল্লাল ঘটককে কালা মিয়া ছোট সময় থেকেই চিনে। তাই তাকে দেখে সালাম দিলো, আসসালামু আলাইকুম দাদা।
– ওয়ালাইকুম আসলাম। কেমন আছ নাতি?
– ভালা আছি। আপনি কেমন আছেন?
– তোমাগো দোয়াই ভালাই আছি। তয় তোমার সাথে একখান কথা আছিন।
– কি কথা কইবেন কন?
– হুনলাম তুমি নাকি বিয়া করবা?
– হ দাদা।
– আমার কাছে একখান সুন্দর মাইয়া আছিন। তোমার মত পাইলে কাজ শুরু কইরা দিবার পারি।
– আমার আবার কি মত। আব্বা যা ভালা মনে করেন তাই করেন। তয় বিয়ের আগে আমি মাইয়াডারে একনজর দেখতে চাই।
– তাতো অবশ্যই। কবে যাইবা?
– কালই চলেন।
– ঠিক আছে আমি মাইয়ার বাপের সাথে কথা কমু। তুমি এখন যাও।
ঘটক বিল্লাল আজ সকালেই ফোন করে গফুর মিয়াকে জানিয়ে দিলো ছেলেকে নিয়ে তার মেয়েকে দেখতে আসার কথা। ছেলের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করতে গফুর মিয়াকে বলে দিলো। গফুর মিয়া তার সাধ্যমতো খাবারের আয়োজন করল।
এদিকে ময়নাকে দেখতে আসবে এ খবর ময়নার মা ময়নাকে দেয়ার পর সে কিছুতেই বিয়েতে রাজি হচ্ছে না।
– আমি এখন বিয়া বসব না।
– ক্যান বিয়া বসবি না?
– আমার এহন বিয়ার বয়স হয়নি।
– কেডা কইছে তোর বিয়ার বয়স হয়নি?
– কেডায় আবার কইবো? আমি কি বুঝি না?
– ভালা একটা পুলা পাওয়া গেছে।
– পুলার কি অভাব পড়বে মা?
– এমন ভালা পুলা পাওয়া যাইবো না।
– এতসব বুঝি না। আমি এহন বিয়া বসব না।
ময়নার এক কথা এখন সে বিয়ে করবে না। তার এখন বিয়ের বয়স হয়নি। এই কথা ময়না বুঝলেও তার পিতা-মাতা কেউ বুঝতে চাইছে না। তাদের এক কথা মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে বিয়ে তাকে দিতে হবেই। এখনই বিয়ের উপযুক্ত সময়।
বিকেল বেলা ঘটক বিল্লাল, কালা মিয়া ও তাদের কয়েকজন মুরুব্বিকে নিয়ে গফুর মিয়ার বাড়িতে আসে। মেয়েকে দেখতে আসবে তাই গফুর মিয়া তার সাধ্যমত তাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলো।
পাশের বাড়ির এক ভাবী ময়নাকে আজ সুন্দর করে সাজালো। তারপর তিনি ময়নাকে ধরে মুরুব্বিদের সামনে নিয়ে আসলো। ময়না সালাম দিয়ে একটি চেয়ারে বসলো। ভাবি ময়নার ঘোমটা খুলে বর পক্ষের সবাইকে দেখালো। ময়না বার বার লজ্জায় ঘোমটা টেনে দেয়। ছেলে পক্ষের মুরুব্বিরা খুটিয়ে খুটিয়ে ময়নার চেহারা দেখে। ঘটক সাহেব ময়নার কথাবার্তা শুনার জন্য কালা মিয়াকে ইশারা দিতেই সে ময়নাকে কিছু প্রশ্ন করল।
– তোমার নাম কি?
ময়না লাজুক ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে আস্তে করে বলল, ময়না।
– তোমরা ক’ভাই বোন?
– পাঁচ বোন, ভাই নেই।
– কোরআন পড়তে জান?
– হে জানি।
পরে সহকারী মহিলাটি ময়নার চুল কতটুকু লম্বা তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী কিনা তা দেখার জন্য তাকে হাঁটানো হয়। তার দাঁতগুলো মুক্তার মতো ঝক ঝক করে কিনা নাকি আঁকাবাঁকা তা দেখার জন্য হা করতে বলা হয়। পায়ের আঙ্গুল ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য পায়ের কাপড় সরিয়ে পা দেখানো হয়। হাতের কবজি পর্যন্ত দেখানো হয়। এমন আরো কত অশুভ আচরণ করা হয় ময়নার সাথে। ততক্ষণে ময়না রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কিন্তু এই রাগ প্রকাশ করতে পারছে না। পারলে এখনই তাদের সামনে থেকে চলে যেত। তার হাতের লেখা দেখার জন্য তার ঠিকানা লিখতে বলা হয়। ময়না সাদা কাগজে ঠিকানা লিখে দিলো। পরিশেষে কালা মিয়া ময়নার হাতে ৫০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বিদায় করে দিল।
ময়নাকে দেখে কালা মিয়ার পছন্দ হলো। ঘটক বিল্লাল এবার খুশি। দু’পক্ষকেই রাজি করাতে পারছে। সে বাতেন মিয়াকে তার ছেলের সম্মতির খবরটি দিলো। দু’পক্ষ আলাপ আলোচনা করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করলো। কালা মিয়া ১০০ বরযাত্রী নিয়ে আগামী শুক্রবার ময়নাকে বিয়ে করতে আসবে। দু’পক্ষের আত্মীয়স্বজন সবাইকে ইতোমধ্যে দাওয়াত করা হয়ে গেছে।
আজ ময়নার বিয়ে। বাড়ির আশেপাশের সবাই আনন্দে ভাসছে। কিন্তু ময়নার মনে কোন আনন্দ নেই। সে একা কাঁদছে। তার কান্না কেউ দেখে না। সে এ বিয়েতে রাজী নয়। তাকে জোরপূর্বক এ বিয়েতে রাজী করানো হয়েছে। সে ভাবছে তার ভবিষ্যত নিয়ে। যে বয়সে সে লেখাপড়া করবে, আনন্দ ফূর্তি করে বেড়াবে সে বয়সে তাকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিয়ে, সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি এগুলো সে কিছুই বুঝে না। যাদের সাথে চৌদ্দটা বছর থেকেছে তারাও বুঝল না ময়নার মনের কষ্ট।
বরযাত্রী আসল। বিয়ে হল। লাল বেনারশী শাড়ী পড়ে ময়না শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা হলো। যাবার বেলা ময়না কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আত্মীয়স্বজন সবাই এই কান্নাকে স্বাভাবিক কান্না মনে করলেও আসলে ময়না স্বাভাবিকভাবে কাঁদেনি। নববধূকে যখন কালা মিয়াদের বাড়িতে আনা হল তখন গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই নতুন বউ দেখতে আসল। সারাদিন মেয়েটা কিছু খায়নি। কান্নাকাটি করে একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ পর পর সবাইকে ঘোমটা উঠিয়ে দেখানো হচ্ছে। এতে করে তার খুবই বিরক্ত লাগছে।
কালা মিয়ার আজ বাসর রাত। তার মনে দারুন আনন্দ। অল্প বয়সী সুন্দরী বউ পেয়েছে সে। নতুন ঘরে বাসরঘর সাজানো হলো। রাত এখন ১ টা বাজে। কিছুক্ষণ আগে কালা মিয়া বাসর ঘরে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কালা মিয়া রুমে ঢুকেই দেখল ময়না ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে এবং মৃদুস্বরে কাঁদছে। সে এগিয়ে গেল নববধূর কাছে।
– কি হল ময়না তুমি কানতাছো ক্যান?
কালা মিয়ার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না ময়না। শুধু কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
কালা মিয়া ময়নার থুতনীতে ধরে বললো, কি হলো কানতাছো ক্যান? বল তোমার কি হইছে? বাসর রাতে কেউ কি কান্দে?
এবার ময়না কালা মিয়ার দিকে একনজর তাকাল। ঐদিন সে মুরুব্বিদের সামনে ভালো করে কালা মিয়ার দিকে তাকায়নি। আজ সে ভালো করে তাকিয়ে তাকে দেখে চমকে উঠল। একি দেখছে সে! মানুষ এত কালো হতে পারে। যেমন কালো তেমন মোটা। আর এমন একটা কালো মানুষের সাথে আমার আব্বা আমাকে বিয়া দিল। এ কথা ভাবতেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
কালা মিয়া এ দৃশ্য দেখে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। এখন কি করব। এ মুহূর্তে কাউকে ডাকা উচিত হবে না। মানুষজন অন্য কিছু ভাবতে থাকবে। যা করার আমাকেই করতে হবে।
– ময়না! ও ময়না উঠো। আমি তোমার সোয়ামী। বাসর রাতে কেউ এমন করে না। এই রাত আর কোন দিন আসবে না।
কিন্তু কিছুতেই ময়নার কোন সাড়া পাচ্ছে না কালা মিয়া। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে। কিছুক্ষণ পর বাহিরে বের হয়ে পানি নিয়ে আসল। ময়নার মাথায় পানি ঢালল। হাত পায়ে তেল মালিশ করল। অনেকক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরে এল।
– কেডা আপনি?
– আমি তোমার সোয়ামী।
– সোয়ামী! আমি আপনেকে চিনি না। আমারে ছুবেন না।
– এসব কি বলছ?
– আপনাকে আমার ভালা লাগেনি।
– ভালা না লাগলেও আমি তোমার সোয়ামী। তুমি আমার বউ। আমাকে তুমি মেনে নাও। বলেই কালা মিয়া ময়নার শরীরে হাত স্পর্শ করে।
– আমি কইছি আমারে ছুবেন না। তাহলে কিন্তুক আমি বাইর হইয়া যামু।
– ছি: ময়না এসব বলে না। গ্যারামের মানুষ তোমারে খারাপ কইবো।
– যা কওয়ার কোউক। তবুও আমি আপনের লগে থাকুম না।
– ক্যান থাকবানা? তাইলে কি তুমি বিয়ার আগে কোনো পুলার লগে পেরেম করছ?
– ছি: এসব কি বলেন। আমার কি পেরেম করার বয়স হয়ছে?
– তাইলে তুমি এই রাতে এমন করতাছো ক্যান?
– কইছি না আপনারে আমার ভালা লাগেনি।
কালা মিয়াকে ময়নার ভালো লাগেনি। তার শরীর স্পর্শ করতে নিষেধ করার পরও এক প্রকার জোর করেই কালা মিয়া ময়নার সাথে শারীরিক মিলন করে। কিশোরী বয়সে তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের স্বামীর অত্যাচার সারা রাত নীরবেই সহ্য করেছে। এ কোন বাসর রাত নয়। বলতে পারেন জোর পূর্বক একজন কিশোরীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামী নামক ব্যক্তিটি ধর্ষণ করছে।
তারপর থেকে প্রতিদিনই ময়নার সাথে কালা মিয়ার শারীরিক ধর্ষণ হতো। দুই মাস পর কালা মিয়া সৌদি আরবে চলে যায়।
ইতোমধ্যে কিশোরী ময়না তার শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন টের পেল। কিছুদিন যাবত তার পেটে খুব ব্যথা করছে। তার ভয় হচ্ছে তার পেটে হয়তো বাচ্চা এসেছে। আমিতো একটা বাচ্চা মেয়ে; আমার পেট থেকে আরেকটা বাচ্চা বের হবে কি করে? কি করবে বুঝতে পারছে না ময়না। আজ ময়না হঠাৎ করে বমি করলো। সে তার শাশুড়িকে এই ঘটনা বললো। শাশুড়ি তখন বললো, তুমি বাচ্চার মা হতে চলেছো।
এই কথা শুনার পর সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। এত অল্প বয়সে কিভাবে সে একটা বাচ্চার বোঝা বহন করবে। যেখানে সন্তান পেটে আসলে প্রতিটি মায়ের মনেই আনন্দ লাগে সেখানে ময়না তার উল্টোটা করছে। শাশুড়ি তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, এত চিন্তা করছ ক্যান। আমরা আছি না? আমরা হগলেতো মা হইছি। সব মাইয়ারাই প্যাটে বাচ্চা লয়।
দিন যায়, মাস যায়। এভাবে নয়টি মাস চলে গেল। ময়নার বাচ্চা প্রসবের সময় এগিয়ে আসল। এতটা সময় একটা বাচ্চা ময়নার পেটে বেড়ে উঠছে। অথচ কালা মিয়ার পরিবার থেকে ময়নার প্রতি কোন যতœ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি কোন ডাক্তারি ঔষধ বা পরীক্ষানিরীক্ষাও করা হয়নি। ভালো কোন খাবার তাকে দেওয়া হয়নি। তাকে দিয়ে ময়নার শাশুড়ি ভারী কাজ করাতো আর বলতো, এই সময় ভারী কাজ করতে হয়। তা না হলে বাচ্চা বড় হয়ে গেলে জন্ম নিতে কষ্ট হবে।
প্রসব বেদনায় অস্থির ময়না। কান্নায় ফেটে পড়লো। আর সহ্য হচ্ছে না তার। ময়নার শাশুড়ি পাশের বাড়ির দাই মাকে নিয়ে আসলো যে মেজেরকান্দি ও আশে পাশে গ্রামের সকলের সন্তান প্রসবের সময় হলে এগিয়ে যায়। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তার হাতে অনেক নারী জীবন দিয়েছে। তারপরও অত্র এলাকার ভরসা এই দাই মা।
দাই ও তার একজন সহযোগি নিয়ে ময়নার ঘরে প্রবেশ করল। সাথে আছে ময়নার শাশুড়ি ও বাড়ির আশে পাশের কিছু মহিলা। ময়নার মা-বাবাকে খবর দেয়া হলো। দাই মা দীর্ঘ দুই ঘন্টা চেষ্টা করেও সন্তান প্রসব করাতে ব্যর্থ হয়ে ময়নার শাশুড়িকে বললো, কালার মা। আমি আর পারছি না। আমার জীবনে অনেক বাচ্চা প্রসব করাইছি। এমন অবস্থা দেহি নাই। আমার মনে হয় বাচ্চা উইল্টা আছে।
– এসব কি কন খালাম্মা!
– হ। তোমরা জলদি কোন কবিরাজ ডাইকা আন। তা না হলে বাচ্চার মাকে বাঁচানো যাবে না। কবিরাজ ডেকে ঝাঁড়ফুক করে দেখ বাচ্চা সোজা হয় কিনা।
দাই মার কথা শুনে কালার মা দ্রুত পাশের গ্রামের নিমাই কবিরাজের বাড়িতে গেলো। নিমাই কবিরাজ আসলো। ততক্ষণে ময়না প্রসব যন্ত্রণায় কাতর। কবিরাজ কি যেন পড়ে ময়নার পেটে ফুঁ দিলো। আর কিছু তেল পড়া দিয়ে দাই মাকে বললো, এই তেল পড়া পেটে মালিশ করতে হবে। তিন ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা সোজা হয়ে যাবে। এ কথা বলে কবিরাজ চলে গেলো।
কিন্তু তিন ঘন্টা গিয়ে চার ঘন্টা পার হলো কিছুতেই বাচ্চা সোজা হচ্ছে না। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই ময়না বেহুশ হয়ে যাচ্ছে।
– মাগো আমি আর পারছি না। আমাকে মেরে ফেল।
ময়নার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পর ময়নার বাবা-মা আসলো। তারাও মেয়ের এই বিপদে কোন সঠিক পরামর্শ দিতে পারছে না। গ্রামের কেউ কেউ বলতে লাগলো, এই মেয়েকে বাঁচাতে হলে গঞ্জের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাতে সবাই সম্মতি দিল। কিন্তু মেজেরকান্দি গ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে। প্রায় চার ঘন্টার রাস্তা। ময়নার বাবা-মা ও শ্বশুর-শাশুড়ি একটি সিএনজি ভাড়া করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। দীর্ঘ চার ঘন্টা জার্নির পর শহরে এসে পৌঁছল। ময়না তখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। দ্রুত তাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দীর্ঘ এক ঘন্টা অস্ত্রোপাচার করে একটি বাচ্চা বের করে ময়নার শাশুড়িকে দিয়ে বললেন, দু:খিত আমরা বাচ্চার মাকে বাঁচাতে পারলাম না। আপনারা অনেক দেরি করে এসেছেন।
এই কথা শুনার সাথে সাথে ময়নার বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়লো। তাদের কান্না দেখে ময়নার শ্বশুর-শাশুড়িও কাঁদতে লাগলেন।
১৪/০৯/২০১৫ খ্রি:

মর্জিনা বিবি


রাত আনুমানিক বারোটা। খালেদার চোখে ঘুম নেই। মনটা ছট ফট করছে। ইচ্ছে হল বাইরে বের হতে। রুম হতে বারান্দায় আসতেই দেখে কাজের মহিলা মর্জিনা বিবি বারান্দায় বসে আছে। তার চোখে পানি। খালেদা মর্জিনা বিবির দিকে এগিয়ে গেল।
– আচ্ছা দিদি আপনি এখনও ঘুমান্নি!
মর্জিনা বিবি চোখের পানি আঁচল দিয়ে মুছে বললো, ঘুম আইতেছে না তাই এহানে বইসা আছি।
– কি হয়েছে আপনার?
– কিছুই হয়নি। এমনিতেই।
– আপনি কাঁদছেন কেন?
– কই কাঁদলাম।
– আপনি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন। আরো অনেক দিন দেখিছি আপনাকে এভাবে কাঁদতে? এর কারণ কি বলবেন?
– কেরে কাঁদি তা কি হুনবেন?
– হ্যাঁ। কেন শুনবো না? আজ আমি আপনার কান্নার রহস্য জানতে চাই।
– সে এক বিরাট কাহিনী।
– সংক্ষেপে বলেন।
– তাইলে হুনেন।
মর্জিনা বিবি তার জীবনের ইতিহাস বলতে লাগল খালেদা তার পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
আজ থাইকা ৩০ বছর আগের কথা। আমি তহন যুবতী। আপনার এহন যেই বয়সটা তহন আমার এই বয়সটা ছিল। তহন আমার লগে আমাগো গ্র্যারামে একটি পুলার সাথে আমার প্রেরেম হয়। হের নাম ছিল হাসু। সব পোলামাইয়ারা জন্মের সময় কাঁন্দে। হে নাকি জন্মের সময় খুব হাসছিল, এললেগি এর মা এর নাম রাখছিল হাসু। আমাগোর প্রেরেম যহন হয়ে যায় তহন বাড়ির হগলতে জাইন্না ফালায়। আমার মা হাসুকে খুব পরছন্দ করতো। তাই আমাগো প্রেরেমে মা কোনো বাঁধা দিত না। একদিন মা হাসুদের বাড়িতে আমার বিয়ার প্ররস্তাব নিয়া যায়। প্ররথম হাসুর মা-বাপ রাজি হইছিল না। পরে রাজি হইয়া গেছে।
এতটুৃকু বলেই মর্জিনা বিবি থামল।
খালেদা আরো জানার জন্য বললো, তারপর।
আবার মর্জিনা বিবি বলতে লাগল, তারপর বিয়া হল। বাসর রাতে আমি যহন ঘুমডা দিয়ে বসে থাহি তখন হাসু আমার কাছে আহে। হে তহন আমার ঘুমডা ফালাইয়া বললো, এইভাবে ঘুমডা দিয়া আছ ক্যান? মনে হয় আর কোন দিন দেহনি। আমারে দেখে কি তোমার শরম করছে?
আমি তহন বললাম, কি যেন কন শরম কিহের।
কতক্ষণ চুপ থাকার পর হাসু বললো, এই আমারে ফালাইয়া যাইবা নাতো?
– তোমারে ছাইড়া কোত্তাও যাইব না।
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথাবর্তা হয়। পরে আমডা দুইজন দুইজনকে ঝাপটাইয়া ধইরা হুইয়া পড়লাম।
এইটুকু বলেই মর্জিনা বিবি বললো, আর কইতে পারুম না। শরম লাগে।
– না দিদি আজ আমি আপনার পুরো কাহিনীটা শুনব।
– আইচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে হুনেন।
কিছু দিন পর আসল ঈদ। ঈদের আগে হাসু আমার জন্যে একটা লিপিস্টিক আনল। আমার হাতে দিয়া কইল, এই হচ্ছে তোমার ঈদের উপহার। আর অহন তোমার ঠোঁটে লিপিস্টিক মেখে আমার গালে একটা চুমা দিবা। তহন আমার গালে দাগ বসবে। ফলে আর কেউ আমার দিকে নজর দিতে পারবেনা।
আমিতো তহন শরমে মরি। কি করুম সোয়ামীর কথা কি অমান্য করা যায়। তাই ওরে তহন আমি চুমা দেই।
তারপর থেকে আমাগো সংসার ভালাই চলছিল। কিছুদিন পর হাসুর কলেরা হয়। এই কলেরাই আমার হাসুরে পর পারে নিয়া যায়। আমি তহন হের লাশের উপর পইড়া কাঁনতে থাহি। এমন সময় আমার হরি আইসা আমার চুলের মুঠি ধরে কয়, আহহারে কি রসের কান্না কানতাছে। এই হতভাগিনী আমার পুলাডারে খাইছে। পোড়া কপালী ভাগ আমার বাড়ি থেকে।
আমি তহন যাইতে চাইলাম না। তহন আমার হওর-হরী জোর কইরা আমারে গলা ধক্কা দিয়া ঘর থেকে বাইর কইরা দেয়। আর তহন আবার বলে, আজকে আমার পুলারে খাইছস পরে আবার আমডার মাথা খাইবি। যা ভাগ এ বাড়ি থেকে।
একথা গুলো বলেই মর্জিনা বিবি কাঁদতে লাগল।
খালেদা বললো, তারা আপনাকে এত অত্যাচার করছে? তারা কি মানুষ ছিল না পশু? আচ্ছা দিদি এর পর কি হয়েছিল শুনি।
মর্জিনা বিবি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো, তারপর থেকে ৩০ বছর মাইনষের বাড়িতে কাম করি। বাপের বাড়িতেও যাইনা। পরে আপনার বাপ আমারে আপনাদের এনে আনে। জানি না আর কয় দিন এহানে থাকতে হবে।
খালেদা এবার বলল, আপনি কী আর বিয়ে করেন নাই?
– না। আমার বাপ-মাই আমারে বিয়া দিবার লাগি অনেক চেরেস্ট্রা করছে কিন্তু তাগো সব চেরেস্ট্রাই বাদ হইছে।
– কেন বিয়ে করেনি?
– আমি জানি মাইয়া মাইনষের বিয়া একবারই হয়। তাই এইডাকে আমি ভাগ্য বলে মাইন্না নিলাম। আর আমি হাসুকে খুব বেশি ভালোবাসতাম তাই আর কারোর সাথে বিয়া বইতে পারি নাই।
এতটুকু বলে মর্জিনা বিবি বললো, চলেন আজকে আর না। আর একদিন বলমু। এহন মেলা রাইত হইছে। এখন শোওন গিয়ে।

রচনাকাল: ০৫/১০/২০১৫খ্রি:

মায়ের স্বপ্ন


খোদেজা বেগমের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন তার সন্তান শাকিল এদেশের একজন নামকরা ডাক্তার হবে। গরিব দু:খী মানুষের সেবা করবে। অভাবের সংসারে কত কষ্ট করে খোদেজা তার সংসার চালাচ্ছেন তা শুধু আল্লাই ভালো জানেন। তার সম্পদ বলতে কিছু নেই। রেললাইনের পাশেই এক বস্তিতে তিনি তার সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজে না খেয়ে শাকিলের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন।
খোদেজা বেগম একজন সহজ, সরল নারী। খুব সাদা-সিধে তার জীবন যাপন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তিনি পাননি। প্রকৃতি থেকেই শিক্ষা নিয়েছেন তিনি। অভাবের সংসারে বড় হয়েছেন বিধায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি বলে কি সন্তানকে শিক্ষিত করবেন না! তা কিছুতেই হতে পারে না। তিনি উপলব্ধি করেন শিক্ষার মর্ম। তাইতো ছেলেকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন। তাকে শিক্ষিত করতে হবে। ছেলে শিক্ষিত হলে নিজের সম্মান বৃদ্ধি পাবে। সমাজে ভালো একটা স্থানে যেতে পারবে। ছেলে চাকুরী করবে সংসারের অভাব দূর হবে। তাইতো খোদেজা বেগম খেয়ে না খেয়ে ছেলের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন। স্বপ্ন একটাই ছেলে শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার হবে।
খোদেজা বেগম কখনো পেট পুরে তিন বেলা খেতে পারেননি। তিনি স্বামীকে বেশি ভালো বাসতেন। তাইতো অল্প বয়সেই স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শাকিলের বয়স তখন দুই বছর। এমন সময় সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যান। নির্বাক হয়ে গেলেন খোদেজা বেগম। হে খোদা একি করলে তুমি? কেন তুমি আমার নিষ্পাপ সন্তানকে এতিম করলে?
অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে ছেলে শাকিলকে নিয়ে বেঁচে আছেন। তাকে নিয়েই তার সমস্ত স্বপ্ন। শাকিল এবার এইচ.এস.সি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। শাকিল কি পাড়বে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে! মাকে খুশি করতে! দীর্ঘ ষোল বছর যাবত খোদেজা বেগম সংসারের ঘানি টানতে টানতে এখন ক্লান্ত। পৌঢ়তা তাকে টানছে মৃত্যুর দিকে। তারপরও ছেলের লেখাপড়ার প্রতি তার অনেক চেষ্টা। এই শাকিলকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন। শাকিলই তার পৃথিবী। শাকিলের জন্য তিনি সব ত্যাগ স্বীকার করছেন। তার বিনিময়ে যেন শাকিল একজন শিক্ষিত মানুষ হয়। ভালো একজন ডাক্তার হয়। এই তার স্বপ্ন।
শাকিল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে। এমন মমতাময়ী মাকে শাকিল কি করে কষ্ট দিবে? শাকিল তার মায়ের স্বপ্ন পূরণে যথেষ্ট চেষ্টা করছে। সেই ছোট বেলা থেকেই শাকিল ছিল পড়াশুনার প্রতি মনোযোগী। অন্য আট/দশটি ছেলেদের মতো শাকিল নয়। সে ছিল খুবই মেধাবী। তাই খোদেজা বেগম এই ছেলেকে নিয়ে গর্ব করেন। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। শাকিল তার মাকে নিয়ে কতটা চিন্তা করে তা কি শাকিলের মা খোদেজা বেগম জানে?
শাকিল অনেক কিছু ভাবে। একদিন সে ডাক্তার হবে। কোন হাসপাতালে তার চাকুরী হবে। তারপর তার মাকে নিয়ে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট বাসা করে থাকবে। মাকে আর অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দিবে না। একদিন তার একটি বাড়ি হবে। মায়ের পছন্দ অনুযায়ী সে বাড়ি বানাবে। মায়ের জন্য সুন্দর করে একটি রুম বানাবে। সেই রুমে মা জায়নামাজে বসে নামাজ পড়বে। আর ছেলের জন্য দোয়া করবে।
আজ শাকিলের স্বপ্নের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা। শাকিলের জন্য দিনটি স্মরণীয় হতে পারে আবার দু:স্বপ্নও হতে পারে। যদি এখানে চান্স না হয় তবে মাকে আর মুখ দেখাতে পারবে না। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে না পাড়লে এ জীবন বৃথা যাবে। কিছুতেই মায়ের স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করা যাবে না। তাইতো শাকিল দিনরাত পরিশ্রম করে লেখাপড়া করছে। অন্য ছেলে-মেয়েরা যেখানে দেশের নামিদামী কোচিং সেন্টারগুলোতে পড়ছে সেখানে শাকিল অর্থের অভাবে পড়তে পারছে না। শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে। কোন রকম প্রাইভেট ছাড়াই শাকিল এস.এস.সি ও এইচ.এস.সিতে গোল্ডেন এ প্লাস পায়।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই শাকিল দেখল তার মা জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে। হে আল্লাহ তুমি আমার ছেলেকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা কর। তুমি আমার ছেলেকে ডাক্তার হওয়ার সুযোগ করে দাও। আমার স্বপ্ন তুমি পূরণ করে দাও। আমার জীবনের সব কষ্টের বিনিময়ে তুমি তারে ডাক্তার বানিয়ে দাও।
শাকিল তার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। খোদেজা বেগম মুনাজাত শেষে ছেলের দিকে তাকালেন। কি বাবা কিছু বলবি।
শাকিল মাথা নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ মা।
– বল।
– মা তুমি আমার জন্য এত চিন্তা কর কেন?
– বাহরে তুই আমার একমাত্র আদরের ধন, কইলজার টুকরা। তোরে নিয়ে চিন্তা করুমনাতো কারে নিয়া চিন্তা করুম?
– আমাকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা করতে হবে না। দেখ মা আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবই ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ যদি সহায় থাকে তোমার স্বপ্ন আমি বৃথা যেতে দিব না। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া কর।
– তাই যেন হয় বাবা।
শাকিল চলে গেলো ভর্তি পরীক্ষা দিতে। যথারীতি পরীক্ষা দিয়ে বের হল। যতক্ষণ সে পরীক্ষার হলে ছিল ততক্ষণ খোদেজা বেগম নফল নামাজ পড়ছেন আর আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন। শাকিল পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসল। শাকিলে মা জিজ্ঞেস করলো, বাবা কিরুম হইছে পরীক্ষা?
– শাকিল মুখে হাসির রেখা টেনে বললো, মা তোমার দোয়াই আল্লাহর রহমতে ভালো হয়েছে।
শাকিল এখন অপেক্ষার প্রহর গুণছে কখন ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। কিছুদিন পরই ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। শাকিল মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেল। এ খবর খোদেজা বেগম শুনতে পেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন।
শাকিল বললো, মা তুমি কাঁদছো কেন? আজতো খুশির দিন।
খোদেজা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো, হ্যাঁ বাবা আজ খুশির দিন। অতি দু:খে যেমন মানুষ কাঁদে আবার অতি খুশিতে মানুষ কাঁদে। আমি আজ খুশিতে কাঁদছি।

২৩/০১/২০১৬খ্রি: