আমির ইশতিয়াক এর সকল পোস্ট

আমির ইশতিয়াক সম্পর্কে

আমির ইশতিয়াক ১৯৮০ সালের ৩১ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার ধরাভাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শরীফ হোসেন এবং মা আনোয়ারা বেগম এর বড় সন্তান তিনি। স্ত্রী ইয়াছমিন আমির। এক সন্তান আফরিন সুলতানা আনিকা। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন মায়ের কাছ থেকে। মা-ই তার প্রথম পাঠশালা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন মাদ্রাসা থেকে আর শেষ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তিনি লেখালেখির প্রেরণা পেয়েছেন বই পড়ে। তিনি গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও সাহিত্যের সবগুলো শাখায় তাঁর বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর বেশ কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো- এ জীবন শুধু তোমার জন্য (২০০৩) ও প্রাণের প্রিয়তমা (২০০৬)। তাছাড়া বেশ কিছু সম্মিলিত সংকলনেও তাঁর গল্প, কবিতা ছাপা হয়েছে। তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় গল্প,কবিতা,ছড়া, ভ্রমণ কাহিনী ও কলাম লিখে যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ব্লগ ও ফেসবুক গ্রুপে নিজের লেখা শেয়ার করছেন। তিনি লেখালেখি করে বেশ কয়েটি পুরস্কারও পেয়েছেন। ফেসবুক লিংক- https://www.facebook.com/amirhossain243 ই-মেইল : [email protected] ব্যক্তিগত ব্লগসাইট: http://amirishtiaq.blogspot.com

কাশফুল


আকাশে শরতের সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে শরতের সাদা মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আকাশের দিকে তাকাতে পারছি না। উপরে আকাশ নিচে নদী মাঝখানে আমি ও রফিক। তিতাস নদীর দুপাশে কাশফুল। খুব ভালই লাগছে। আমি আর রফিক কাশফুল দেখার উদ্দেশ্যে নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছি সেই বিকাল বেলা।
ধরাভাঙ্গা গ্রামের পাশেই তিতাস নদী। নদীর পাড়ে সারি সারি কাশফুল ফুটে আছে। এটি বাংলাদেশের আর পাঁচটি গ্রামের মতো নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শেষ সীমানায় এই গ্রামটি অবস্থিত। উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া লাগে নি। এ গ্রামের মানুষগুলো খুবই সাধা-সিধে, সহজ-সরল। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসে। বিপদ আপদে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর বিপক্ষে ঝাপিয়ে পড়ে। এক বাড়িতে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান হলে সবাই মিলেমিশে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করে। এই গ্রাম থেকে সলিমগঞ্জ বাজারে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি ভাঙাচোরা। এই রাস্তায় প্রতিদিন শত শত মানুষ কষ্ট করে দেড় কিলোমিটার দূরে সলিম গঞ্জ বাজারে গিয়ে বাজার সদাই করে। এই গ্রামের দক্ষিণ পাশে মস্ত বড় এক বিল। বিলের এক পাশে রফিকদের গ্রাম ধরাভাঙ্গা আর অন্যপাশে আছে মুক্তারামপুর গ্রাম। দুই গ্রামের মাঝখানে এই বিলের অবস্থান। সেই বিলে বর্ষাকালে এক সময় মাছ চাষ করা হতো। আর শীতকালে যখন সেই বিল শুকিয়ে যেত তখন সেখানে বোরো ও এনাম ধান লাগাতো কৃষকরা।
কোরবানীর ঈদ করার জন্য গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসছে রফিক। বাড়িতে এসে দেখে সেই বিলের চেহারা অন্যরকম হয়ে গেছে। এমন চেহারা রফিক আর কোন দিন দেখেনি। হঠাৎ করে বিলের দিকে নজর দিতেই রফিক দেখল সমস্ত বিল কচুরী পানায় ভরে গেছে। মনে হয় যেন কচুরী পানার চাষ করা হচ্ছে। সবগুলো কচুরী পানায় ফুল ফুটেছে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। বিলের আশে পাশে ও তিতাস নদীর দুধারে কাশফুল ফুটেছে। এ দৃশ্য দেখার জন্য রফিক আমাকে ঈদ উপলক্ষে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করল। আমিও কাশফুল, কচুরী পানা, নদী, গ্রাম এগুলো কখনো দেখিনি। তাই এসব দেখার জন্য রফিকের আমন্ত্রণে আর দেরি না করে ঈদের পরদিন চলে আসলাম তাদের গ্রামে।
রফিক বিকাল বেলায় আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেড় হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য প্রথমে কচুরীপানা দেখব এবং পরে নৌকায় করে কাশফুল ও প্রকৃতি উপভোগ করব। আমিতো এমন সুন্দর পরিবেশ দেখে অবাক। কচুরী পানার ফুল দেখে লোভ সামলাতে না পেরে সাথে থাকা ক্যামেরায় বন্ধি করি সেই চমৎকার ছবিগুলো। বিলের শেষ প্রান্তে আছে ব্রিজ। সেই ব্রিজে দাঁড়িয়ে পুরো বিলের ছবিটি উঠালাম।
কচুরীপানা দেখার পর নৌকায় তিতাস নদীতে গিয়ে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। এই প্রথম আমি নৌকাতে উঠলাম। কারণ শৈশব কেটেছে আমার শহরে। গ্রামে আমার কেউ নেই বলে কোনদিন গ্রামে আসা হয়নি। আর নদী, কাশফুল এগুলোতো চোখেই দেখিনি। নৌকা ছুটছে নদীর পাড় ঘেষে। রফিক নিজে মাঝি সেজে নৌকা চালাচ্ছে। নৌকা ছুটছে স্রোতের টানে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। শরতের আকাশ খুব সুন্দর। শরতের সাদা সাদা মেঘ এবার স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে। বেশ ভালই লাগছে।
ধরাভাঙ্গা গ্রামের উত্তর পাশেই রয়েছে বিশাল একটি চর। আমরা লক্ষ্য করলাম সেই চরে অসংখ্য কাশফুল ফুটেছে। সেই দৃশ্য উপভোগ করার জন্য ও ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে আমি রফিককে বললাম তাড়াতাড়ি নৌকা ঐ চরে নেয়ার জন্য। নৌকা ওপারে এসে থামল। আমরা চরে নেমে পড়লাম। একটু সামনে গিয়ে দেখি কাশফুলে ছেয়ে গেলে পুরো চর।
কাশফুল দেখে আমি আকাশ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দিত হলাম। এ রকম আনন্দ জীবনে খুব কমই এসেছে। চারদিকে কাশফুল। যেন কাশফুলের বাগান। যেদিকে তাকাই শুধু কাশফুল আর কাশফুল। উপরে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আর নিচে এই কাশফুলের বাগান। শরতের যেন অপূর্ব সৃষ্টি। এ দৃশ্য প্রচন্ড ভালো লাগছে আমার। রফিককে ধন্যবাদ দিতে হয় এ রকম পরিবেশে নিয়ে আসার জন্য। কাশফুলের মাঝ দিয়ে হেঁটে চললাম আমরা। ফুলের এলাকা যেন শেষ হচ্ছে না। আশে পাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বসে প্রেমালোচনায় মগ্ন। ওদের যেন ডিস্টাব না হয় সেই ভেবে আমরা অন্যদিক দিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম।
কাশফুলের সাথে নদীর একটি সর্ম্পক আছে। তাইতো বেশিরভাগ কাশফুল নদীর তীরেই ফুটে। সাদা সাদা মেঘের মতো বাতাসে দুল খাচ্ছে কাশফুল। এ দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এমন চমৎকার নয়নাভিরাম দৃশ্য আর কোনদিন দেখিনি। যেখানে তাকাই শুধু সাদা মেঘের মতো যেন ভেসে বেড়াচ্ছে কাশফুল।
কথিত আছে, নদীর তীরে যে সারি সারি কাশফুল দেখা যায় তা একদা এক অপসরার কেশের মতো ঘনকালো দীঘল ছিল। অপসরার হলো শরৎ ঋতু পরিচালিকা সুরকেশী। শরৎ কাল এলে এই অপসরা স্বর্গ থেকে তার দীঘল ঘনকালো কেশগুলো ছড়িয়ে দিতো কাশফুলের রূপে। কেশগুলো ছড়িয়ে নদীর শারদীয় বাতাস ও রোদে শুকাতো। শারদীয় বাতাসে কাশফুলে একটা নরম সুরের মূর্ছনা উঠতো। রাতেরবেলা সেই সুরের মোহে নদীকূলকর্তী যুবক ও যুবতীরা ছুটে আসতো, প্রণয়ে মত্ত হতো। সেই কথা অনেক আগেই আমি বইয়ে পড়েছি। আজ তা সরাসরি দেখে মুগ্ধ হলাম।
আমি লক্ষ্য করলাম চারিদিকে ঘন কালো দীঘল কাশফুল বাতাসে ঢেউ খেলছে। ঋতু পরিবর্তনের চক্রে সুরকেশী এবার যেন দ্রুত পদক্ষেপেই ধরায় এসেছে। তিতাস নদীর দুই তীর যেন এক অপার বিস্ময়ের রূপ ধারণ করেছে। নদী তীরের বৃক্ষরাজীগুলো ভিন্ন সৌন্দর্যে শোভিত হয়েছে। আমি আরো লক্ষ্য করে দেখলাম নানান পাখি এ গাছ ও গাছে গান গেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ফুলে ফুলে প্রজাপতিরা ডানা মেলে ওড়ছে।
অনেকক্ষণ ধরাভাঙ্গার চরে বেড়ালাম। যতই ঘুরছি ততই ভাল লাগল। এখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। রক্তিম সূর্যটা টুপ করে আমাদের সামনে ডুবে গেল। সন্ধ্যা হতে না হতেই কাশফুলগুলো যেন বীনের বাজনা শুরু করে দিল। হালকা বাতাসে দুল খাচ্ছে কাশফুল। এবার বিদায়ের পালা। আর এখানে থাকা যাবে না। তাই দুই বন্ধু চলে আসলাম।
রফিকদের গ্রামের পূর্ব পাশে এমপি টিলা খ্যাত একটি স্থান আছে। সেখানে ইদানিং একটি ইটখোলা তৈরি করা হয়। এর পাশেই মেঘনা নদী। সেই ইটখোলা ও এমপি টিলা দেখার জন্য আমরা সেখানে যাই। এই এমপি টিলাটি তৈরির পেছনে একটি ছোট ইতিহাস আছে। এ গ্রামের সাবেক প্রয়াত এমপি ছিল আঃ লতিফ। তিনি নদী ভাঙ্গন রোধ করার জন্য মাটি দিয়ে নদীর পাড় অনেক উঁচু করে দেন এবং এর চারপাশে সিমেন্টের পাটা দেন। এর ফলে নদী ভাঙ্গন রোধ হয়। এই পাড়ে এখন বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়। এটা এখন দূর থেকে দেখলে পার্কের মতো মনে হয়। তাই এলাকার মানুষ এই জায়গাটার নাম এমপি টিলা রাখে এবং এই নামেই সবাই ডাকে। প্রতিদিন বিকেল বেলা গ্রামের বিভিন্ন পেশার লোকজন ও অন্যগ্রামের লোকজনও এখানে বেড়াতে আসেন। বিশেষ করে বছরে দুটো ঈদে এখানে বেশি লোক সমাগম হয়। তাছাড়া ইদানিং ইটখোলা তৈরি হওয়ায় দর্শনার্থীদের ভীড় বেড়ে গেছে।
পরদিন বিকাল বেলা সেই এমপি টিলা ও ইটখোলা পরিদর্শনে গেলাম। দেখলাম শত শত নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর বুড়া-বুড়ি সবাই এমপি টিলা ও ইটখোলা পরিদর্শনে আসছে। আমরা একে একে ইটখোলার বিভিন্ন দৃশ্য ও এমপি টিলার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়। তারপর সন্ধ্যা লগ্নে বাড়ি ফিরে আসি।
প্রথম বার গ্রামে এসে রফিকের সাথে আনন্দময় কিছু মূহুর্ত কাটিয়ে ফুরফুরে মন নিয়ে আজ আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

রচনাকাল: ১৫/০৮/২০১৪ খ্রি:

ফেরা


এক
১৯৯৫ সাল।
শীতের সকাল। চারদিকে কুয়াশা। কুয়াশার জন্য দূরের লোকজন তেমন দেখা যায় না। এখনও সূর্য উঠেনি। জসিম উদ্দিন রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছেন। ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন ভোরে উঠে তিনি হাঁটেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার কাছে মনে হল কোথাও একজন কাঁদছে। কয়েক কদম যাওয়ার পর দেখলো আট-নয় বছরের একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জসিম উদ্দিন যতই সামনে যাচ্ছে ততই মেয়েটি সামনে আসছে। মেয়েটি ইতোমধ্যে জসিম উদ্দিনের কাছাকাছি চলে আসলো। জসিম উদ্দিন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি তাকে ঝাপটে ধরে বললো, আংকেল আমার আব্বু আমাকে রেখে চলে গেছে। আব্বুকে খুঁজে দেন। বলেই সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মেয়েটি হঠাৎ জসিম উদ্দিনকে ঝাপটে ধরায় তিনি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে। কিন্তু এই সকাল বেলায় এখানেই বা এলো কি করে? তার বাবাকেই বা তিনি কিভাবে খুঁজে দেবেন। জসিম উদ্দিন মেয়েটিকে দুই হাতে সারিয়ে বললো, এই মেয়ে এসব কি বলছ?
জসিম উদ্দিনের প্রশ্নে সে আরো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
– এই মেয়ে কাঁদছ কেন? বল কি হয়েছে?
মেয়েটি শীতে থর থর করে কাঁপছে আর কাঁদছে। মনে হয় জসিম উদ্দিনকে পেয়ে তার কিছুটা সাহস হয়েছে। তাই আবার বললো, আমার আব্বুকে খুজে দেন আংকেল।
– কি হয়েছে তোমার আব্বুর?
– আমার আব্বু আমাকে রেখে চলে গেছে?
– এতটুকুন মেয়েকে রেখে কোন বাবা চলে যেতে পারে? ঘটনা কি সত্যি করে বল। তুমি তোমার বাবার সাথে রাগ করেছো?
– না আমি রাগ করিনি।
– তোমার নাম কি?
– সাদিয়া।
– কোথায় তোমার বাড়ি?
– ঢাকা আমাদের বাড়ি।
-এখানে আসলে কি করে?
– চট্টগ্রাম থেকে আব্বুর সাথে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে সামনের স্টেশনে ট্রেন থামে। আব্বু তখন ট্রেনে বসে ঘুমাচ্ছিল। তখন আমি ট্রেন থেকে নামি। নামার কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন আমাকে রেখে চলে গেল। আমি আর ট্রেনে উঠতে পারিনি।
– কেন নামছিলে?
– দেখার জন্য।
– বাবাকে কেন সজাগ করলে না?
– আমি কি জানি ট্রেন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
– এখন কি করবে কিভাবে তোমার বাবাকে খুঁজে বের করব? ঢাকার কোন জায়গায় তোমাদের বাসা?
– বনানী।
– বাসা নম্বর কত জান?
– না।
– তাহলে তোমার বাবাকে কোনদিনই আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না।
– তুমি এক কাজ কর। আমার কোন সন্তান নেই। তুমি আমার বাসায় থাকতে পার। আমাকে তুমি বাবা ডাকবে। আমি মেয়ের মতো তোমাকে লালন পালন করব।
– না আপনাকে আমি বাবা ডাকব না। আপনি আমার বাবাকে বের করে দিন।
– ঠিক আছে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার বাবাকে খুঁজে বের করার জন্য। যদি না পাই তাহলে আমার বাসায় থাকবে।
– ঠিক আছে।
সাদিয়া জসিম উদ্দিনের বাসায় থাকতে রাজি হওয়ায় তাকে নিয়ে তিনি বাসায় আসলেন।
জসিম উদ্দিন সাদিয়াকে নিয়ে ঢাকার বনানীর অলিগলি সব জায়গায় ঘুরলো। সাদিয়া তাদের বাসা জসিম উদ্দিনকে চিনাতে পারেনি। তাই তার আপ্রাণ চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার আব্বুকে খুঁজে বের করতে পরেননি। সেই থেকে জসিম উদ্দিনের বাসায় সাদিয়া তার মেয়ে হয়ে থাকতে শুরু করলো।
জুলফিকার আলীর একমাত্র মেয়ে সাদিয়া ছিল নয়নের মনি। তাকে হারিয়ে তিনি এখন পাগল। হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে মেয়েকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। মেয়ের খোঁজে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের রেল লাইনের প্রতিটি স্টেশনে তিনি খুঁজেছেন। কোথাও মেয়েকে পাননি। মেয়ের শোকে তিনি পাগল হয়ে গেলেন। রাস্তায় যখন যাকে দেখেন তখনই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমার মেয়েকে খুঁজে দাও। তিনি আর বাসায় ফিরে যাননি। সেই থেকে তার ঠিকানা হলো রেলস্টেশন।

দুই
২০১৫ সাল।
জসিম উদ্দিন এখন সত্তর বছরের বৃদ্ধ। আর সাদিয়ার বয়স প্রায় ত্রিশ বছর। জসিম উদ্দিন সাদিয়াকে নিজের মেয়ে মনে করে তার জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে তাকে পড়াশুনা করিয়েছেন। সাদিয়া এখন দেশের একজন নামকরা ডাক্তার। সাদিয়ার জন্য পাত্র খুঁজছেন জসিম উদ্দিন। শেষ বয়সে তাকে বিয়ে দিয়ে নাতির মুখ দেখে মরতে চান তিনি।
সাদিয়া আজ বড় ডাক্তার। দেশের অসহায় মানুষের চিকিৎসা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজেই তার পোস্টিং। প্রতিদিন শত শত অসহায় রোগীর চিকিৎসা করেন। বৃদ্ধ কোন রোগী দেখলেই তার বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।
আজ হঠাৎ করে ৬০/৬১ বৎসরে একটি পাগল তার চেম্বারে এসে হাজির। উসকু খুসকু চেহারা। দাড়ি গোফে সারা মুখ একাকার। মাথায় চুলের ঝটলা। পাগল লোকটি ডা: সাদিয়াকে বললো, এই ডাক্তার আমার মেয়েকে খুঁজে দাও।
পাগলের কথা শুনে ডা: সাদিয়া চমকে উঠলো, আপনি এসব কি বলছেন? আমি আপনার মেয়েকে কোথায় পাব?
– পাবে! রেল স্টেশনে পাবে! ট্রেনের ভেতর পাবে!
– কি বলছেন আপনি? আপনার মেয়ের নাম কি?
– সাদিয়া।
– সাদিয়া!
পাগলের মুখে এ কথা শুনতেই সাদিয়া চমকে উঠলো। কি বলছে ওনি। রেল স্টেশন! সাদিয়া! ট্রেন! তার স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠলো। মনে পড়লো ছোটবেলায় রেল স্টেশন থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু ওনি কে? কে আপনি?
আমি জুলফিকার পাগল।
হ্যাঁ মনে পড়ছে সাদিয়ার। তার বাবার নাম জুলফিকার। তাহলে ওনিই আমার পিতা!
চেহারার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল তার বাম গালে বড় একটি তিল আছে। তার স্পষ্ট মনে পড়ছে তার আব্বুর গালেও তিল ছিল। এ আর কেউ নয়। তিনি আমার আব্বু। আমার খুঁজে দীর্ঘ বিশ বছর পাগল অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আর ভাবতে পারছে না। আব্বু বলেই চিৎকার দিয়ে জুলফিকার পাগলকে জড়িয়ে ধরলো।
জুলফিকার পাগল বললো, না তুমি আমার মেয়ে না। আমার মেয়ে ডাক্তার না।
– না আব্বু আমিই তোমার সেই হারানো মেয়ে। দেখ আজ আমি কত বড় হয়েছি। দেশের নামকরা ডাক্তার হয়েছি। আমি আর সেই ছোট্ট খুকিটি নেই।
– সত্যি বলছিস? তুই আমার বুকের ধন। তুই আমার কলিজার টুকরা সাদিয়া। আয় আমার বুকে আয় মা। তোকে পেয়ে আজ আমি জীবন ফিরে পেয়েছি।
– আব্বু তোমার এই অবস্থা কেন?
– শুধু তোর জন্য। তুকে না পেয়ে দীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত রেল স্টেশনে থেকেছি। শুধু তুর দেখা পাব বলে। এই বলেই পকেট থেকে সেই ছোট্ট সাদিয়ার একটি সাদাকালো ছবি বের করে বললো, এই দেখ সেই ছোট্ট বেলায় তুকে হারিয়েছি। আজও তোর ছবি বুকে নিয়ে ঘুরছি।
এই ছবি দেখে ডাঃ সাদিয়া অজোর ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
– এই কাঁদবি না। আজ আর কাদার দিন নয়। চল বাড়ি চলি।
– না বাবা। যার অন্ন খেয়ে বড় হয়েছি। যার আশ্রয়ে আমি আজ ডাঃ হয়েছি তাকে না বলে কিভাবে বাড়ি যাই? যার মায়া মমতায় তোমার কথা আমাকে ভুলিয়ে রাখছে তাকে তুমি দেখে যাবে না?
সাদিয়া তার বাবাকে সেলুন থেকে গোফ দাড়ি কাটালো। নতুন পাঞ্জাবী পড়িয়ে তার বাসায় নিয়ে আসলো। এসেই তার পালিত বাবা জসিম উদ্দিনের রুমে ঢুকলেন।
জসিম উদ্দিন জুলফিকার কে দেখে বললো, সাদিয়া মা উনি কে?
– বাবা এ হচ্ছে আমার জন্মদাতা আব্বু। এই আব্বুর খোঁজে দীর্ঘ ২০ বছর যাবত আমি তোমার বাসায় আশ্রিত হয়ে আছি।
– এসব কি বলছিস মা! তুই আশ্রিত হবি কেন? তুইতো আমার মেয়ে। বুকের ধন। আমি তুকে জন্ম দেইনি ঠিক কিন্তু তুকে আমি আমার নিজের সন্তানের মতো করেই লালন পালন করেছি। তুকে পেয়ে আমি পিতার স্বাদ পেয়েছি। তুকে না পেলে হয়তো এতদিন বেঁচে থাকতাম না।
– এই জন্য বাবা আমি তোমার কাছে চির ঋণী। কিন্তু আজ বাবা আমাকে বিদায় দিতে হবে। আমি আমার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে চাই।
এ কথা শুনার পর জসিম উদ্দিন বললো, একি বলছিস মা। এ আমি পারব না। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।
– কিন্তু বাবা কিছু করার নেই। আমাকে আমার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে হবে।
– না তুই যেতে পারবি না। যেতে হলে আমার বুকের উপর দিয়ে যেতে হবে। এই বলেই জসিম উদ্দিন ডা: সাদিয়ার সামনে শুয়ে পড়লেন।
ডা: সাদিয়া এ দৃশ্য দেখে নির্বাক হয়ে গেলো।

রচনাকাল: ১৫/১১/২০১৫ইং

বোকা


সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গলো একটি মেয়ের মোবাইল ফোনের আওয়াজে। বেশ কয়েকবার মোবাইলে রিং বাজল। বিরক্ত হয়ে মোবাইল রিসিভ করলাম।
– হ্যালো…
– হ্যালো…
– হ্যালো কে বলছিলেন?
– আই আপনার বউ।
– কি বললে, আপনি আমার বউ! আমার বউতো আমার সাথেই ঘুমাচ্ছে।
– আপনার বউ আপনার সাথেই ঘুমাচ্ছে! এসব কিতা বলছেন আপনি?
– সত্যিইতো বলছি।
– আপনি না ঐদিন আ্যারে বিয়া কইরা গেছেন।
– এসব কি আবোল তাবুল বলছেন আপনি?
– আইতো কিছুই বুঝিনি। আপনার বউ কয়টা?
– কেন? আমার বউ একটা।
– ঐদিন আপনি আ্যার মাথায় হাত রেখে বললেন আপনার কোন বউ নেই। আইজকা বলছেন আপনি বউয়ের সাথে ঘুমাচ্ছেন! সত্যি কইরা বলেনতো আপনার বউ কয়টা?
– আচ্ছা আপনি কোথায় ফোন করেছেন বলেনতো?
– আমিতো আ্যার জামাইরে ফোন দিয়েছি।
– তাতো বুঝলাম। আপনার জামাইর নাম কি?
– মাইয়া মাইনসের জামাইর নাম মুখে নিলে পাপ হয়। তাই কওবার পারুম না।
– আমার মনে হয় আপনি রং নাম্বারে ফোন করেছেন।
– জিনা আমি ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছি।
– তাহলে বলুনতো এটা কোন জায়গা?
– আপনি বলুন কোন জায়গা?
– আমি কেন বলব? আপনি কাকে, কোন জায়গায় ফোন দিয়েছেন তাতো আপনিই ভালো বলতে পারেন।
– আমিতো আ্যার জামাইরে ফোন দিয়েছি এইডা প্রথমই বললাম।
– যতসব ফালতু প্যাচাল। আমি আপনাকে চিনি না। ফোন রাখুন আমি এখন ঘুমাচ্ছি।
এই বলেই আমি ফোন লাইনটি কেটে দিলাম। কিছুক্ষণ পর সে আবার ফোন দিল।
– এই আপনি আ্যার ফোন কেটে দিলেন কেন?
– আপনি আবার ফোন করেছেন কেন? আমি না বললাম আপনাকে চিনি না।
– কিন্তু আইতো আপনাকে চিনি।
– চিনলে পরিচয় দিচ্ছেন না কেন?
– বললাম না আই আপনার বউ।
– আচ্ছা আপনার মতলবটা কি বলুনতো? কেন আমাকে বিরক্ত করছেন?
– কোন মতলব নেই।
– আচ্ছা আপনি আমার ফোন নাম্বার পেলেন কোথায়?
– আপনিতো আ্যারে নাম্বার দিয়ে বলছেন ফোন করার জন্য।
– কবে কখন?
– হায় আল্লাহ আপনার দেহি কিচ্ছু মনে থাহেনা। হেদিন একলগে পার্কে ঘুরলাম। তারপর বিয়ে করলাম। বাসর হলো। পরে চলে আসলেন। আর বললেন মাঝে মাঝে ফোন দিও। কয়দিন পর আননে আ্যার সাথে দেখা করবেন। আহন দেহি কিচ্ছুই মনে নাই।
– আপনার নাম কি?
– বুজছি। আপনি নতুন বউ পাইয়া আ্যার নামও ভুইলা গেছেন!
– নতুন বউ! আমিতো ছয় বছর আগেই বিয়ে করছি। বউতো কবেই পুরানো হয়ে গেছে।
– হইছে আর মিছা কতা কইতে হবো নে। আননে যে আমারে ভুইলা গেছেন আজকা ফোন না দিলে বুজবার পারতাম না।
– আপনি আর ফোন দিয়ে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমার কোন দ্বিতীয় বউ নেই।
– ঠিক আছে এখন রাখছি। তয় পরে আবার ফোন দিব নে।
এই বলে মেয়েটি ফোন নিজেই রেখে দিলো।
স্ত্রী রাবেয়া আমাদের ফোনালাপ সবই শুনছে। মেয়েটি ফোন রেখে দেওয়ার পরই রাবেয়া বললো, এত সকাল বেলা তোমাকে কে ফোন দিল?
– কি জানি কে? চিনি না। মনে হয় রং নাম্বার।
– রং নাম্বারে এতক্ষণ কথা হয়! তার কথা শুনেতো বুঝতে পারলাম ও তোমার বিয়ে করা বউ।
– ওতো তাই বলল।
– কি বললে! তুমি আরেকটা বিয়ে করছ?
– কি যা তা বল। আমি বিয়ে করতে যাব কেন?
– তা না হলে ঐ মেয়ে তোমাকে এত সকালে ফোন করে বলবে কেন?
– কি জানি। আমিতো ঐ মেয়েকে চিনি না। আর সে বললেই কি আমি তার স্বামী হয়ে যাব?
– সামথিং রং। তুমি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ আর আমি জানি না।
– তুমি কি আমাকে সন্দেহ কর?
– এত দিন সন্দেহ করিনি। কিন্তু এখন করছি।
– কেন সন্দেহ কর?
– বিয়ে না করলে কোন মেয়ে ফোন করে বলতে পারে না ‘আমি তোমার বউ।’
– ভালো মেয়েরা একথা বলে না। কিন্তু ফালতু মেয়েরা ঠিকই শয়তানি করে বলে। এই নিয়ে কেন শুধু শুধু সন্দেহ করছো?
– কোন স্ত্রীই একথা শুনার পর ঠিক থাকতে পারে না।
– তুমি কেন অযথা মাথা ঘামাচ্ছো। এটাতো একটা ফানও হতে পারে। হতে পারে কোন পরিচিত বান্ধবী আমার সাথে দুষ্টুমির ছলে এ কথা বলছে। আবার অপিরিচিত দুষ্টু প্রকৃতির মেয়েরাও ছেলেদেরকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে প্রেমের ফাঁদে ফালানোর জন্য বলতে পারে। দেখ বাজে চিন্তা করে সংসারে অশান্তি ডেকে আনবে না। আমি তোমারই আছি তোমারই থাকব।
– ঠিক আছে ঐ মেয়ে যদি ফের আবার তোমাকে ফোন দেয় তাহলে কিন্তু খবর আছে।
– ঐ মেয়ে যদি আবার আমাকে ফোন দেয় তাহলে আমি কি করতে পারি। আমিতো তাকে বাঁধা দিয়ে রাখতে পারব না। পারব মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিতে।
– প্রয়োজনে তাই করবে।
এই বলেই আজকের মতো রাবেয়ার সাথে মিমাংসা হয়ে গেল। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যেত যদি না ঐ মেয়েটি রাত বারটার পর ফোন না দিত।
একটি মাত্র মেয়ে হঠাৎ করে আমার সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করছে। এবার রাগের সহিত ফোনটি রিসিভ করে বললাম, এই আপনাকে ফোন করতে নিষেধ করছি। তারপরও কেন আবার ফোন করলেন?
– আপনার নিষেধতো আর আই মানিনি। আর মানবই বা ক্যান? বউ তার জামাইর কাছে ফোন করবে এতে নিষেধাজ্ঞার কি আছে?
– আপনি কিন্তু সীমালঙ্গন করছেন। রাত বারটার পর ফোন দিয়ে আমাকে ডিস্টাব করছেন। ভদ্র পরিবারের কোন মেয়ে এত রাতে ফোন করে কোন বিবাহিত পুরুষকে ডিস্টাব করতে পারে না। অভদ্র কোথাকার। ফোন রাখুন।
– এই আপনি কিন্তু আ্যার পরিবারকে নিয়ে গালাগালি করছেন। তা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আপনিতো ভদ্র ছেলে তাহলে আ্যার সাথে অভদ্র ব্যবহার করছেন কেন?
– শুধু আপনার কারণে এখন অভদ্র হচ্ছি। আপনি আমার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করছেন।
– আই আপনার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করছি!
– হ্যাঁ শুধু আপনার কারনে সকালে আমার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হয়েছে।
– আমি জানি আপনার কোন বউ নেই। আর আমিই আপনার একমাত্র বউ।
– আমার কিন্তু ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর ফের যদি আপনি আমাকে ডিস্টাব করেন তাহলে আপনাকে আমি পুলিশে দিব।
– পারবেন না।
আমার ফোনে চেচামেচিতে রাবেয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
– এই কি হয়েছে তোমার। আবার কার সাথে কথা বলছো?
– আর বল না। ঐ ফালতু মেয়েটা আবার ফোন করে যা তা বলছে।
– ফোনটা দাওতো আমার কাছে দেখি কার মেয়ের এত বুকের পাঠা আমার স্বামীর সাথে পিরিতের আলাপ করে।
আমি ফোনটা লাউড স্পিকার দিয়ে রাবেয়ার হাতে দিলাম।
– হ্যালো… কে আপনি?
– আপু আমি তোমার ছোট বোন ঋতু।
– ঋতু তুই!
– হ্যাঁ আপু।
– তুই আমার স্বামীর সাথে এসব বলছিস কেন?
– আরে আপু। দুলাভাইয়ের সাথে একটু দুষ্টুমি করলাম। কণ্ঠ ও ভাষা পরিবর্তন করে কথা বলায় বেচারা আমাকে চিনতেই পারল না। দেখলাম আমার আদরের বোন জামাই আমার বোনকে কতটুকু ভালোবাসে। না আপু দুলাভাইকে পটানো সম্ভব নয়। আমি কয়েকবার ফোন দিলাম দুলাভাইতো একবারও আমাকে ফোন দিল না।
এই কথা শুনে দুবোন খিল খিল করে হাসতে লাগল।
আর আমি তাদের কথা শুনে বোকা বনে গেলাম।

১৪/০৮/২০১৬ইং

ফাঁদ


আজ অফিস থেকে বের হতে শাহিনের অনেক দেরি হয়ে গেছে। সারাদিন তার উপর ধকল গেছে। তাছাড়া বাসার বাজার সদাই করতেও অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেল। রাত আনুমানিক দশটা বাজে। মতিঝিল শাপলা চত্বরের পাশে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে শাহিন। কিছুক্ষণ পর একটি খালি রিক্সা আসল।
– এই যাবেন ভাই?
– কোথায় যাবেন?
– শাহবাগ।
– যাব। উঠেন।
শাহিন রিক্সায় উঠতেই অচেনা এক বোরকা পড়া মেয়ে এসে বলল, ভাই আমি বড় বিপদে আছি। ছিনতাইকারী আমার সব কিছু নিয়ে গেছে। আমার কাছে কোন ভাড়া নেই। আমিও শাহবাগ যাব। আপনার সঙ্গে আমাকে নিলে খুব উপকার হতো।
শাহিন বলল, শাহবাগ কোথায় আপনার বাসা?
– শিশু পার্কের পাশেই।
– আমি ভাড়া দিয়ে দিই আপনি চলে যান।
– না আমি একা যেতে পারব না।
– তাহলে আমি কি করব?
– আমাকে আপনার সাথে নিবেন।
– আমি কেন আপনাকে নিব? তাছাড়া আমিতো আপনাকে চিনি না। জানি না।
– ভাই বিপদে পড়েছি। আমি মেয়ে মানুষ একা যেতে পারব না। ভয় করছে। এই উপকারটুকু করেন।
– না আমি নিতে পারব না। আপনি আসতে পারেন।
মেয়েটি এবার শাহিনের হাত ধরে বলল, প্লিজ ভাই। আপনারতো বাড়ীতে মা বোন আছে। তারা বিপদে পড়লে কি এভাবে রেখে যেতেন?
শাহিন পড়ল মহাবিপদে। কি করবে এখন? শাহিন মেয়েটির কথায় চিন্তায় পড়ে গেল। তাইতো একটি অসহায় মেয়ে বিপদে পড়ে আমার সাথে যেতে চাচ্ছে। আমি নিয়ে গেলে অসুবিধা কোথায়? এত রাতে একজন অসহায় মেয়ের আকুতি শুনে শাহিনের মায়া লেগে গেল। প্রথমে শাহিন মেয়েটিকে না করলেও পরে তাকে বলল, ওঠেন।
দুজন একসাথে রিক্সায় উঠল। দুজনেই রিক্সায় উঠে খোশগল্পে মেতে উঠল। রিক্সা যখন শিশু পার্কের কাছাকাছি আসল তখনই মুখোশধারী মেয়েটি শাহিনের গলায় ছুরি ধরে বলল, যা কিছু আছে দিয়ে দিন।
শাহিন হঠাৎ মহিলার পরিবর্তন লক্ষ করে ভয় পেয়ে গেল। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে বলল, কি ব্যাপার আপনি এমন করছেন কেন? আপনি কে?
– পরিচয় জানার দরকার নেই।
– জলদি দিয়ে দিন।
– যদি না দিই।
– তাহলে আমি চিৎকার করে বলব, আপনি আমার ইজ্জত নিয়েছেন। আর তখন বুঝবেন পাবলিকের মাইর কারে কয়। পাবলিক সবসময় মেয়েদের পক্ষে থাকে।
শাহিন ভাবতে লাগল। তাতো ঠিকই। এখন কি করা যায়। সেতো আমাকে বিরাট ফাঁদে ফেলে দিল। কিভাবে নিজেকে সেভ করে তার কাছ থেকে বাঁচা যায় সেই চিন্তা করতে লাগল।
– কি হলো দেরি করা যাবে না। চিৎকার করলেও কোন কাজ হবে না। উল্টো গণপিটুনি আপনিই খাবেন। এত রাতে অপরিচিত মহিলার সঙ্গে রিক্সায় উঠেন আবার পাবলিক ডাকবেন। তা হবে না।
শাহিন নিরুপায় হয়ে তার সব কিছু ছিনতাইকারী মেয়েটির হাতে দিয়ে দিল। মেয়েটি সবকিছু নিয়ে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করল।
শাহিন তখন রিক্সা থেকে নেমে আশে পাশের সবাইকে বলতে লাগল, এই যে ভাই, ঐ মেয়েকে ধরেন। ও ছিনতাইকারী। ও আমার সব কিছু নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার কথায় আশে পাশের লোকজন দৌঁড়াতে লাগল ঐ বোরকা পড়া মেয়ের পিছনে। মেয়েটিও সর্বশক্তি দিয়ে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পুরুষের কাছে মেয়েটি দৌঁড়াতে না পেরে ধরা পড়ল।
অনেকেই তাকে মারার জন্য হাত তুলল। একজন লোক বলতে লাগল, ভাই মেয়ে মানুষ। গায়ে হাত দিবেন না। উল্টো আপনারা ফেসে যাবেন। আগে কি হয়েছে সেটা জানার চেষ্টা করুন।
আরেকজন বলল, হ ভাই ঠিকই কইছেন।
অন্যজন শাহিনকে দেখিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, ওনাকে আপনি কি করেছেন?
মেয়েটি ভয়ে থতমত খেয়ে বলতে লাগল, আমি ওনাকে কিছু করেনি।
শাহিন বলল, ভাই ওনি আমার মোবাইল, টাকা সবকিছু নিয়ে গেছে।
আরেকজন বলল, সত্যি কথা বলুন। তা না হলে পুলিশের কাছে দিয়ে দিব।
তখন মেয়েটি নমনীয় হয়ে বলল, প্লিজ আমাকে পুলিশে দিবেন না। আমি সব সত্যি কথা বলে দিব। আমি ওনাকে মিথ্যা কথা বলে আমার সাথে রিক্সায় করে নিয়ে আসছি। তারপর ওনার সব কিছু ছিনতাই করছি। তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি বলেই সবকিছু শাহীনকে দিয়ে দিল।
শাহিন তার সবকিছু বুঝে পেয়ে ফিরে গেল। আর ছিনতাইকারী মেয়েটিও জানে বেঁচে গেল।
রচনাকাল: ০৯/০৮/২০১৫ খ্রি:

ধান্দাবাজ


সকাল ছয়টা বাজে। আলাল সাহেব সবেমাত্র ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় আসলেন। সোফায় বসে চা খাচ্ছেন এমন সময় ওনার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। ফোনটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে একজন বললেন, আমি গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ার থেকে মুরাদ হাসান বলছি।
এত সকাল বেলা আলাল সাহেবের মোবাইলে কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন করায় তিনি বিস্মিত হলেন। তা কি মনে করে এত সকাল বেলায় ফোন করছেন?
– স্যার আপনি এই সিমটি দীর্ঘদিন যাবত ব্যবহার করছেন তাই না?
– হ্যাঁ।
– আপনার জন্য একটি সুখবর আছে।
– সুখবর! কি সুখবর?
– যারা দীর্ঘদিন যাবত গ্রামীণফোন কোম্পানির মোবাইল সিম ব্যবহার করছে তাদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে কোম্পানি বিশজনকে পুরস্কারের ব্যবস্থা করছেন। আপনি সেই সুভাগ্যবানদের মধ্যে একজন যিনি পাঁচ লক্ষ টাকা লটারিতে জিতেছেন। অভিনন্দন আপনাকে!
আলাল সাহেব একজন বিচক্ষণ ও শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি আগে থেকেই জানেন দেশে এখন ডিজিটাল ধান্দাবাজ বের হয়েছে। তারা মোবাইলে ফোন করে কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে পুরস্কারের প্রলোভন দেখায়। কথার মারপ্যাঁচে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বিকাশের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। তাই তিনি ধান্দাবাজ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কৌশলগুলো জানার জন্য কথিত কর্মকর্তা মুরাদ হাসানের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনছেন।
– তাই নাকি!
– হ্যাঁ স্যার।
– তা কবে, কখন, কিভাবে এই টাকা পাব?
– এই টাকা পেতে হলে আপনাকে আমাদের কোম্পানির কিছু নিয়ম মানতে হবে।
– বলুন কি নিয়ম। যা বলবেন তাই শুনব। টাকার বড়ই অভাবে আছি। টাকার জন্য মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছি না। আল্লাহ মনে হয় এতোদিনে আমার দিকে মুখ তুলে তাকাইছেন। সকাল বেলা সুসংবাদটা দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আলাল সাহেবের মুখে কথিত কর্মকর্তা মুরাদ হাসান এমন কথা শুনে মনে মনে বললেন, যাক এবার একজন মক্কেল পেয়েছি মনে হয় তার কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নেয়া যাবে। তারপর তিনি কোম্পানির নিয়মগুলো বলতে লাগলেন।
– এই কথা এই মুহূর্তে কাউকে বলবেন না। এমনকি আপনার স্ত্রীর কাছেও না।
– ঠিক আছে বলব না।
– এই টাকা আপনাকে অনলাইনের মাধ্যমে ব্যাংকে দেয়া হবে। এই জন্য কোম্পানির কিছু খরচ হবে। আমি আপনাকে একটি বিকাশ নাম্বার দিব। সেই খরচের টাকাটা আপনি এক ঘন্টার মধ্যে পাঠাতে হবে। টাকা পাঠিয়েই আমাকে এই নাম্বারে কল করে নিশ্চিত করবেন এবং আপনার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিবেন। কিছুক্ষণ পর আপনার ব্যালেন্স চেক করলেই দেখতে পারবেন আপনার একাউন্টে টাকা জমা হয়ে গেছে। বুঝতে পারছেন স্যার?
– হ্যাঁ বুঝতে পারছি। কিন্তু কত টাকা দিতে হবে?
– মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।
– আমার যে একটা সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা?
– ঐ যে বললেন, পাঁচ হাজার টাকা আপনার নাম্বারে বিকাশ করতে হবে সেটাতো দিতে পারব না।
– কেন পারবেন না। পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন না? দেখুন আপনি পুরস্কার না নিলে অন্যজনকে দিয়ে দেওয়া হবে। আপনি পুরস্কার নিবেন কিনা সেটা বলুন। পুরস্কার না নিলে আপনার সাথে আর কোন কথা বলব না। সুযোগ বার বার আসে না। এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না স্যার।
– আমিতো পুরস্কার নেয়ার জন্য রাজি আছি।
– তাহলে আপনাকে এই টাকাটা খরচ করতেই হবে।
– পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য পাঁচ হাজার টাকা খরচ করাটা কোন ব্যাপার না কিন্তু এ মুহূর্তে আমার কাছে এত টাকা নেই। আপনিতো আমার সর্ম্পকে জানেন না। আমি একজন সাধারণ কেরানী। অল্প বেতনে চাকরি করে কোন রকমে সংসার চালাই।
– আপনার সর্ম্পকে জানার আমার কোন প্রয়োজন নেই। কোম্পানি আপনাকে ফোন দিতে বলছে আমি ফোন দিয়েছি। আপনি টাকা না নিলে আমি লাইন কেটে দিব।
– না ভাই লাইন কাটবেন না। আমার একটা পরামর্শ শুনুন।
– জি বলুন।
– আমি এ মুহূর্তে বিকাশে আপনাকে টাকা দিতে পারছি না। আবার পুরস্কারের লোভও সামলাতে পারছি না। আমার টাকাটার বিশেষ প্রয়োজন। টাকাটা পেলে আমার বড়ই উপকার হবে।
– কিন্তু খরচ না দিলেতো কোম্পানি আপনাকে টাকা দিবে না।
– আপনি এক কাজ করুন।
– কি কাজ?
– আপনার পকেট থেকে কোম্পানিকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা আপনি তুলে নেন। তারপর সেই টাকাটা আপনি আমার বাসায় এসে দিয়ে যান। আমি আপনাকে আমার বাসার ঠিকানা দিচ্ছি। এই জন্য আপনাকে আমি পাঁচ লক্ষ টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বকশিশ দিব। তাছাড়া বাসায় আসলে আপনি আমার বউয়ের হাতের রান্না করা খাবারও খেয়ে যেতে পারবেন।
আলাল সাহেবের এমন প্রস্তাবে কথিত কর্মকর্তা মুরাদ হাসান বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনিতো আমার চেয়েও বড় ধান্দাবাজ! এতক্ষণ যা কথা বললাম তাই লস। বলেই ফোন লাইনটি কেটে দিলেন।

তারিখ: ০৭/০২/২০১৭ইং

অভিমান


এই সবুজ!
আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঋতু দাঁড়িয়ে আছে। একটু অবাক হলাম! এ মুহূর্তে ঋতুর এখানে আসার কথা না। কিন্তু কেন আসলো? আমিতো একা থাকতে চেয়েছিলাম। আমিতো তার কাছ থেকে দূরে চলে আসছি। আমি বললাম, কি?
ঋতু বললো, তুমি আমাকে একা রেখে এখানে চলে আসলে কেন?
– কি করবো?
– তুমি জান না আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি?
– না।
– তুমি জান না আমি তোমাকে ছাড়া একটি মুহূর্তও থাকতে পারি না?
– কিভাবে জানব? তুমিতো আমাকে ভালোবাস না।
– কে বললো, আমি তোমাকে ভালোবাসি না? ওটাতো আমার মনের কথা ছিলো না।
– আমি কি করে বুঝবো কোনটা তোমার মনের কথা?
– এই জন্যই তুমি অভিমান করে দূরে চলে আসলে?
– হ্যাঁ। এ ছাড়াতো আমার কোন উপায় ছিল না।
– ঋতু আমার হাত ধরে বললো, সবুজ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মনে হলো কতদিন পর ঋতু আমার হাত ধরলো। মুহূর্তে মনটা উষ্ণতায় ভরে উঠলো। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
– তুমি এখানে কিভাবে এলে?
– তোমার ভালোবাসা আমাকে এখানে টেনে নিয়ে আসছে।
– তাই!
– তুমি জান না মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। বলেই ঋতু কাঁদতে লাগল।
ঋতুর চোখের কোনে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই আমি হাত দিয়ে চোখ মুছে বললাম, কে বললো আমি তোমাকে রেখে এসেছি। তুমিতো আমার বুকের ভেতর আছ।
ঋতু তখন ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। তুমি আমাকে ছেড়ে আর যাবে নাতো?
– না। কোন দিন যাব না।
– ঋতুর মুখে তখন এক ঝলক হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

তারিখ: ১২/০১/২০১৭ইং

পুরস্কার


সুবর্ণা ও সজিব ওরা দু’ভাইবোন। সুবর্ণা বড় নবম শ্রেণিতে পড়ে। সজিব ছোট ষষ্ট শ্রেণিতে পড়ে। কয়েকদিন যাবত দু’জনেই পড়ালেখা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। কারণ সামনে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে হবে ওদেরকে। প্রতিযোগিতায় দু’জনেরই নাম দেয়া হয়েছে। সুবর্ণা প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা দিবে আর সজিব কবিতা আবৃতি করবে। সজিব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতাটি আবৃতি করবে। তাই সজিব বাড়িতে প্রতিদিন ‘লিচু চোর’ কবিতাটি চর্চা করছে। সুবর্ণার জানা নেই ওর ভাগ্যে কোন বিষয় পড়ে। তাই ও অনেক গুলো বিষয় নিয়ে নিয়মিত চর্চা করছে।

১২ জুন প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হবে। তাই ওরা দু’জনেই সেদিনটির জন্য অধির অপেক্ষা করছে কবে সেই শুভ দিনটি ওদের মাঝে আসবে। যতই দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল, ততই তাদের মন উসখুস করতে লাগল। দেখতে দেখতে সেই দিনটি প্রায় নিকটবর্তী হয়ে গেল। আর মাত্র দু’দিন বাকি।

সুবর্ণা তার বাবাকে বলছে, বাবা তুমি কিন্তু আমাদের সাথে অনুষ্ঠানে যাবে।
তার বাবা বললেন, অবশ্যই যাব।
সজিব তার মাকে বলছে, মা তুমিও কিন্তু আমাদের সাথে যাবে।
তার মা বললেন, যাব আমরা দু’জনেই তোদের সাথে যাব। যা এখন গিয়ে কবিতাটি বার বার পড়। পুরস্কার কিন্তু অবশ্যই আনতে হবে।
– মা তুমি দোয়া করিও অবশ্যই পুরস্কার আনব।

সকাল বেলা পাখির কিচিরমিচির ডাকে সুবর্ণা ও সজিবের ঘুম ভাঙ্গল। জলমলে রোদ এসে আঙ্গিনায় পড়ল। দু’ভাইবোন গোসল করে কাপড় পড়ে রেডি হল। দশটা বাজার পূর্বেই তাদেরকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হবে।

মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে স্বুর্ণা ও সজিব যথাসময়ে অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হল। সেখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে উপস্থিত হচ্ছে। এ মুহূর্তে অনুষ্ঠানস্থল মানুষে জমজমাট হয়ে গেল।

উক্ত অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতার অনেকগুলো বিভাগ করা হয়েছে। ষষ্ট শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ক’ বিভাগ। নবম-দশম শ্রেণি ‘খ’ বিভাগ। কলেজ ও মাদ্রাসার আলিম ও ফাজিল শ্রেণির জন্য ‘গ’ বিভাগ। সেই অনুসারে সজিব ‘ক’ বিভাগে এবং সুবর্ণা ‘খ’ বিভাগে পড়েছে।

দশটা বাজার সাথে সাথে অনুষ্ঠানটি কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ‘ক’ বিভাগের কুরআন তেলাওয়াত। তারপর ‘খ’ বিভাগের কুরআন তেলাওয়াত। এভাবে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা চলছে। সুবর্ণা ও সজিব অপেক্ষা করছে কখন তাদের পালা আসবে। দু’জনেরই মন ছটফট করছে।
অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃতি, রচনা লিখা, উপস্থিত বক্তৃতা, সুন্দর হাতের লেখা, হামদ-নাত, কোরআন তেলাওয়াত কৌতুক, নৃত্য- ইত্যাদি পর্ব করা হয়েছে।
এবার ‘ক’ বিভাগের কবিতা আবৃতির পালা। প্রথমে ভাষ্যকার আশিক নামের একজন ছেলেকে ডাকছেন। সে মঞ্চে গিয়ে একটি কবিতা আবৃতি করল। এভাবে কয়েকজনের নাম ডাকা হল।

সজিব ভাবতে লাগলো, আমিতো এ বিভাগেই আছি। আমি কি পারব সুন্দর করে আবৃতি করতে। পারব কি পুরস্কার ছিনিয়ে আনতে। এমন সময় ভাষ্যকার সজিবের নাম ঘোষণা করল। সজিব চমকে উঠল। তারপর দ্রুত সজিব মঞ্চে চলে গেল। সালাম দিয়ে ওর পছন্দের ‘লিচু চোর’ আবৃতি করতে লাগল।

বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সেকি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।

পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোতা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
……………………

এভাবে সজিব কবিতাটি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সুন্দর করে আবৃতি করল।
কবিতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত লোকজন করতালি দিল। তারপর আরও কয়েকজন কবিতা আবৃতি করল।
এবার ‘খ’ বিভাগের উপস্থিত বক্তৃতার পালা। প্রথমে সুবর্ণার নাম ঘোষণা করা হল। সুবর্ণা মঞ্চে চলে আসল।

পাঁচজন বিচারক বসেছেন। বিচারকগণ কয়েকটি কাগজে উপস্থিত বক্তৃতার বিষয়গুলো লিখলেন। সুবর্ণাকে বলা হলো একটি কাগজের টুকরা হাতে নেয়ার জন্যে। সুবর্ণা একটি কাগজ হাতে নিল। কাগজ খুলে দেখে তার বিষয় হলো ‘বাংলাদেশের নারী নির্যাতন’। সময় দেওয়া হল ৫ মিনিট। অতএব ৫ মিনিটের মধ্যে বিষয়ের সাথে মিল রেখে তার বক্তব্য শেষ করতে হবে।

সুবর্ণা তার বক্তৃতা শুরু করলো- উপস্থিত আজকের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, উপস্থিত বিজ্ঞ বিচারকমন্ডলী, উপস্থিত শ্রোতা ভাই ও বোনেরা আসসালামু আলাইকুম। ভাগ্যের লিখন যায় না খ-ন। তাই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে ঘুরতে আমার বিষয় নির্বাচন হলো ‘বাংলাদেশের নারী নির্যাতন’। আমি একজন নারী। নারী হয়ে নারী নির্যাতনের করুন চিত্রগুলো এখন আপনার সামনে তুলে ধরছি।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা আজ আমরা প্রবেশ করেছি একবিংশ শতাব্দিতে। নতুন শতাব্দীতে কেমন আছে বাংলাদেশের নারীরা? এই প্রশ্নের উত্তর সুখকর নয়। কারণ এককথায় বলতে পারি বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা ভাল নেই। বর্তমান সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। বাড়ছে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ ও নারী পাচারের মতো ঘটনা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের চেয়ে ঢের বেশি নারী নির্যাতন হচ্ছে পথে, ঘাটে, গৃহে, কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নারীর করুণ চিত্র। বর্তমানে দেশের সরকার প্রধান ও বিরোধী দলের নেতা দুজনই নারী। কিন্তু এই নারীরা কি পেরেছে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা চিরতরে বন্ধ করতে? পেরেছে কি ধর্ষণের সেঞ্চুরীর হাত থেকে নারীদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি এসিড নিক্ষেপের হাত থেকে আঁখির মতো অসহায় মেয়েদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী থেকে শিক্ষাঙ্গনকে কলঙ্কমুক্ত করতে?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা একটু লক্ষ্য করুন বর্তমানে নারীরা পুরুষ কর্তৃক যত প্রকার নির্যাতিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে যৌতুকের শিকার। বর্তমানে এ যৌতুক একটি প্রথা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যা নারী সমাজের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুকের ফলে কত নারীর সোনার সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। কত নারী যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারও কোন পরিসংখ্যান নেই। যুগ যুগ ধরে এ যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। আজ যৌতুক নামক এ কু-প্রথাটি ক্রমান্বয়ে সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের নারীরা উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে কিন্তু যৌতুকসহ বিভিন্ন অশুভ সামাজিক প্রথা সামাজিকভাবে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত হবার পথে এখন প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা এবার আসুন এসিড নিক্ষেপের কথা বলি। সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করেই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। কারণে অকারণে নারীর প্রতি এই মরণ এসিড নিক্ষেপ হচ্ছে। এসিড নিক্ষেপের ফলে ঝলছে যায় আক্রান্ত নারীর শরীর। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মানুষ এতোটা পাষাণ হয় কিভাবে? এর উত্তর আমার জানা নেই।

তাছাড়া কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে অনেক নারী বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। বাজারের পণ্যের মতো নারীকে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় নেই?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা বাংলাদেশের নারী নির্যাতনে আরো অনেক কারণ আছে সময় স্বল্পতার কারণে আর বলতে পারলাম না। পরিশেষে নারী সমাজের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে আমাদের অধিকারের জন্য আরো সচেতন হতে হবে। বুঝে নিতে হবে আমাদের হিসাব নিকাশ। পুরুষ শাসিত এই সমাজে আমাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হতে হবে। মুখ বুঝে সহ্য না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তাহলে নারী জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হবে। ধন্যবাদ সকলকে।

বক্তৃতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত লোকজন করতালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানালো। তারপর ভাষ্যকার পর্যায় ক্রমে আরো কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর নাম ঘোষণা করল। কারো ভাগ্যে পড়েছে ‘মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য’, কারো বা ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ ইত্যাদি। তারপর পর্যাক্রমে অন্যান্য পর্বগুলো শেষ হলো।
প্রধান বিচারকের নিকট ফলাফল এসে উপস্থিত হল। প্রধান অতিথি বক্তৃতা করলেন। তিনি সকল ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অনেক মজার মজার ঘটনা শেয়ার করলেন। তাদেরকে ভবিষ্যতে ভালভাবে গড়ে উঠার জন্য উৎসাহ দিলেন।

তারপর প্রধান বিচারক সাহেব ভাষন দেন। তিনি একজন নামকরা লোক। লোকেরা সবাই তাকে ভালোবাসেন।
মধ্যহ্নভোজের পর পুরস্কার বিতরণ শুরু হল। সুবর্ণা ও সজিব অপলক দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রতি পর্বে তিনজনকে পুরস্কার দেয়া হবে। বিচারক সাহেব প্রথমে কোরআন তেলাওয়াতের পুরস্কার ঘোষণা করলেন। তাদেরকে একটি করে সার্টিফিকেট ও বই উপহার দেওয়া হল। এভাবে পর্যাক্রমে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

এবার ‘ক’ বিভাগের কবিতা আবৃতির পুষ্কার ঘোষণার পালা। সজিবের মনটা উতাল পাতাল হয়ে যাচ্ছে কি জানি তার রেজাল্ট হয়। মনটা ছটফট করতে লাগল।
বিচারক সাহেব তৃতীয় পুরস্কার ঘোষণা করলেন কিন্তু সজিব নয় অন্য একজনের নাম। সজিবের হার্টবিট আরো বেড়ে গেল। তারপর দ্বিতীয় পুরস্কার এখানেও তার নাম নেই। এবার বিচারক সাহেব বললেন, প্রথম পুরস্কার পেয়েছে সজিব আহমেদ।

সজিব তার নাম মাইকে শুনতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সুবর্ণাকে জড়িয়ে ধরল। মা আনন্দের সাথে বলছেন, কি হল সজিব তাড়াতাড়ি যা। পুরস্কার নিয়ে আস।

সজিব মঞ্চে চলে আসল। প্রধান অতিথি খুব খুশি হয়ে পুরস্কার ও সার্টিফিকেটটি তার হাতে তুলে দিলেন।

এবার ‘গ’ বিভাগেরর উপস্থিত বক্তৃতার পুরস্কার ঘোষণা করা হচ্ছে। বিচারক সাহেব পর পর তৃতীয় ও দ্বিতীয় পুরস্কার ঘোষণা করলেন। সুবর্ণার নাম না আসায় চিন্তিত হয়ে গেল।
বাবা বললেন, চিন্তা করিসনা মা তুই ফাস্ট হবি।

ইতিমধ্যে বিচারক সাহেব বলতে লাগলেন, খুব আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আজকের প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা বিভাগে এবং সকল বিভাগে যিনি সবোর্চ্চ নাম্বার পেয়েছেন তিনি হচ্ছেন…বলে বিচারক একটু থামলেন।
সুবর্ণার হার্টবিট আরো বেড়ে গেল। কি জানি কি হয়।
– … তিনি হচ্ছেন সুবর্ণা আহমেদ। যিনি সকল প্রতিযোগিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন। আপনারা করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান।
সুবর্ণার নাম ভাষ্যকারের মুখে শুনতে পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে লাফিয়ে উঠলো সে। সজিব ও তার পিতা-মাতাও আনন্দে আত্মহারা।
সজিব বললো, কি আপু মঞ্চে যাও।
সুবর্ণা মঞ্চে গিয়ে তার পুরস্কার গ্রহণ করলো। মুহু মুহু করতালিতে মুখরিত মঞ্চ। চারপাশ থেকে ফুল ছিটানো হচ্ছে। এবার ভাষ্যকার সুবর্ণাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলেন।

সুবর্ণা তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, সত্যি আমি ভাবতে পারিনি যে এত বড় পুরস্কার পাব। এ পুরস্কার আমার একার নয়। আপনাদের সকলের। আমি পুরস্কার পেয়ে ভীষণ খুশি। আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে ভবিষ্যতে আরো ভাল করতে পারি। ধন্যবাদ সকলকে।
তারপর অন্যান্য সকল পুরস্কার বিতরণ করল। সবার শেষে মুনাজাতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসল। রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে লাগল। সজিব সুবর্ণা ওদের মা-বাবা সবাই আনন্দের সহিত বাড়ি ফিরল।

রচনাকাল- জানুয়ারি ১৯৯৯ খ্রি:।

প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ


গত দীর্ঘ ৯ মাস ২ দিন আমার স্ত্রীর গর্ভের ভেতর বেড়ে উঠছিল একটি প্রাণের অস্তিত্ব। যা আমাকে বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। আমি একটা নতুন জগতের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম। দিন দিন আমি আমার স্ত্রীর পরিবর্তন কাছ থেকে লক্ষ্য করেছিলাম। যা আমাকে একটি নতুন জগতের সাথে পরিচয় করে দিচ্ছিল। প্রতিদিন রাতে শুয়ে অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় দিন গুনতাম। আর ভাবতাম কেমন হবে আমার সন্তান। ছেলে না মেয়ে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ ছিল না। আল্লাহ যা দেন তাতে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম এবং অপেক্ষায় ছিলাম একটি সুস্থ্য সবল সন্তানের আশায়। শত কষ্টের মাঝেও আমার স্ত্রীর চোখে-মুখে আনন্দের উচ্ছ্বল ঢেউ দেখতাম। তার চেহারা দেখে আমার চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ খেলে যেত।
আমার অনাগত সন্তানের বয়স যখন আট মাস তখন আমি আল্ট্রানোগ্রাম করিয়ে জানতে পারলাম আমার সন্তানটি মেয়ে হবে। অনেকে মেয়ে সন্তানকে অবহেলা করে। আমি মেয়ে সন্তানের সু-সংবাদটি পেয়ে এত খুশি হয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া করছি আমার সন্তানকে যেন সুস্থ্য দেহে ভূমিষ্ঠ করে।
অবশেষে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখ রাত ১০:০০টার পর থেকে আমার মেয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আনন্দ বার্তা দিচ্ছিল। আমার স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হলো। এক দিকে প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ আমার বুকের ভেতর তোলপাড় করছিল, অন্য দিকে আমার স্ত্রীর অসহনীয় যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল তা দেখে আমার হৃদয়টা কষ্টের দাবানলে জ্বলছিল। আনন্দ লাগছিল এই ভেবে যে, আল্লাহর অশেষ কৃপায় যে কোন মুহুর্তে আমি আমার মেয়ের মুখ দেখতে পাব। মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী বলছিল ‘আমি মনে হয় মরে যাব। আমাকে মাফ করে দিও।’ আমি তাকে বার বার একই সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে, এ ধরনের অলক্ষণে কথা বল না। তোমার কিচ্ছু হবে না। একটু ধৈর্য ধর।
পরিশেষে ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২ খ্রীষ্টাব্দ, ২১ শাওয়াল ১৪৩৩ হিজরী, ২৫ ভাদ্র, ১৪১৯ বাংলা, রোজ রবিবার, সময় সকাল ৭:৩০ মিনিটে ভুমিষ্ঠ হলো আমার প্রথম কন্যা সন্তান। আমি তখন তার মুখ দর্শন করে তাকে কুলে নিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, সত্যি সত্যি আমি বাবা হয়েছি। আমি তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। এর কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে এসেই সে মেয়েকে কুলে নেয় এবং তার পিঠে হাত বুলিয়ে আনন্দের বার্তার জানান দেয়।

মা


আমার নানার চার মেয়ে ও দু’ছেলের মধ্যে আমার মা ছিলেন সবার বড়। নানা আমার মাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের বাড়ি থেকে নানার বাড়ি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের নাম চরবাড্ডা মির্জাচর। সবুজ গাছপালা বেষ্টিত গ্রামটি খুবই চৎমকার। মাঝে মাঝে আমার মাকে দেখার জন্য নানা আমাদের বাড়িতে আসতেন। আসার সময় নানা মায়ের জন্য কাঁঠাল, আম, কলা, আনারস, বেদানা, আঙুর আরো কত কি যে নিয়ে আসতেন তার কোন হিসেব নেই। নানা যখন চলে যেতেন, তখন মা প্রায়ই কাঁদতেন আর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতেন। তখন প্রিয় বাবা চলে যাওয়ায় নিজের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করতেন।
নানাকে দেখার সুভাগ্য আমার হয়নি। আমি দুনিয়াতে আসার পূর্বেই আমার নানা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। নানার মৃত্যুতে আমার মা একদম পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুর শোক আজও আমার মা ভুলতে পারেননি। এখনও নানার কথা মনে হলে কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলায়। নানার কথা চিন্তা করে আমিও মাঝে মাঝে কাঁদি। আমি দুনিয়াতে এসে নানার স্নেহ, ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হলাম। মনভরে নানাকে ডাকতে পারলাম না। তবে নানীর কাছ থেকেই নানার সমস্ত আদর ভালোবাসা পেয়েছি।
আমার বাবা একজন সাধারণ শ্রমিক। আমার জন্মের পরই আমাদের সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। তখন মা মাঝে মাঝে নীরবে বসে কী যেন চিন্তা করতেন। আর দুচোখের জল ফেলতেন।
আমরা তিন ভাই, এক বোন। এর মধ্যে আমি বড় সন্তান। বাড়ির সমস্ত কাজ আমার মায়ের একা করত হতো। কারণ মায়ের কোন জা ছিল না। বাবা সারাদিন কাজ করার পর রাতে বাড়িতে ফিরতেন। তখন আমার মা বাবার পাশে বসে তাল পাতার পাখায় বাতাস করে ভাত খাওয়াতেন। আর তখন সংসারের সুখ দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতেন। কিভাবে আমাদেরকে বড় করবেন তা নিয়ে ভাবতেন। রাতে খাওয়ার পর মা আমাকে সুন্দর সুন্দর গল্প বলে ঘুম পড়াতেন। আমি অসুস্থ্য হলে মায়ের চিন্তার শেষ থাকত না। আমার রোগ মুক্তির জন্য সারাক্ষণ খোদার কাছে প্রার্থনা করতেন। সারা রাত আমার পাশে বসে আমার সেবা যত্ন করতেন। আমার প্রতি একটুও বিরক্ত দেখাতেন না।
আমি যখন একদম ছোট, তখন এক কান্ড ঘটেছিল। আমার মা বাহিরে চুলোয় রুটি খোলা দিচ্ছেন। তখন বাবা ও আমরা চার ভাই-বোন পিঁড়ি নিয়ে চুলোর পাশে বসলাম। মা একে একে সবাইকে ভাগ করে তিনটি করে রুটি দিলেন। আমি তখন রুটি নিয়ে একটু দূরে বসেছিলাম। আমি একটি রুটি খেয়ে অন্য একটি রুটি খেতে যাব এমন সময় একটি কুকুর এসে আমার বাকী রুটিটা নিয়ে দিল দৌঁড়। আমি তখন রুটি আনার জন্যে দৌঁড়ে গিয়ে কুকুরের গলায় জড়িয়ে ধরলাম। ভাগ্যিস কুকুর তখন আমাকে কামড় দেয়নি। কুকুর তৎক্ষনাত রুটি ফেলে চলে গেল। আর তখন আমি কুকুরের কাছ থেকে রুটিটি উদ্ধার করে মায়ের ভয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমি ভাবছি মা বুঝি আমাকে মারবে। কিন্ত না আমার মা লক্ষী আমাকে মারেনি বরং আদর করে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে বললেন, ‘তুই আমার লক্ষী ছেলে কাঁদিস না। এটা তোর দোষ না। আর এ রুটি খাসনে। মুরগীকে দিয়ে দে। আমি এক্ষুনি আবার রুটি বানিয়ে দিচ্ছি।’
মা আমাকে তখন আবার রুটি বানিয়ে দিলেন।
সারাদিন কাজ করার পর সন্ধ্যা হলে মা আমাকে পড়াতেন। আমি মায়ের সাথে বসে অ, আ, ক, খ পড়তাম আর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমি যখন ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম তখন থেকেই মায়ের কাজে একটু একটু সাহায্য করতাম।
ঈদ এলে আমাদের এলাকায় পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। বিশেষ করে ঈদ-উল ফিরত এর সময় চাঁদ উঠার একদিন পূর্বে প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা বানানো হতো। বাড়ির আশের সবার মতো আমার মাও পিঠা বানাতেন। মা গায়িল, সায়িট দিয়ে গুড়ি কুড়তেন। তারপর পানি সিদ্ধ করে মাধা তৈরি করতেন। পরে পিঠা বানাতেন। আমি তখন আমার মাকে পিঠা বানানোর কাজে সাহায্য করতাম। আমি লতি বানিয়ে দিতাম। মা তখন নিপুণ হাতে সুন্দর করে পিঁড়ির উপর হাত ঘুরিয়ে সেয়ুই বানাতেন। মায়ের সব কাজই আমার খুব ভাল লাগে। মা ঈদের দিন সকালে গুড় দিয়ে সেয়ুই পাক করতেন। ভাই-বোন সবাই মিলে সেয়ুই খেতাম। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে টাকা দিতেন। মা আদর করে আমাকে জামা কাপড় পড়িয়ে দিতেন। সুন্দর করে আমার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতেন।
আমি পরিবারের বড় ছেলে তাই বাবা-মার অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। লেখাপড়া করে একদিন অনেক নামি-দামী ব্যক্তি হব। সেই স্বপ্নে বিভোর আমার পিতা-মাতা। মাঝে মাঝে দেখতাম আমার মা পাক ঘরে বসে কাঁদতেন আর কি যেন এক শূন্যতা ‍অনুভব করতেন। আমি তখন মাকে বলতাম, ‘মা তুমি কাঁদছ কেন?’
মা আমাকে দেখে সাথে সাথে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে মুখে হাসির রেখা টেনে বলতেন, ‘কই কাঁদিনাতো।’
আমার জন্মের পর থেকেই আমার মায়ের দুঃখ বেড়েছ। প্রায়ই মা আমাকে দুঃখের কাহিনী শুনাতেন। মাঝে মাঝে মা আমাকে নিয়ে নানার পুরানো ইতিহাস বলতেন। এত কষ্টের পরও আমার লক্ষী মা আমার বাবা ও ভাই-বোনদের প্রতি একটুও বিরক্তবোধ করতেন না। শত কাজের মাঝেও পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিকমত আদায় করতেন।
মমতাময়ী মা তাঁর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বড় করছেন। তাইতো আমার মাকে দেখলে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ভুলে যাই। জগতের শ্রেষ্ঠ মায়েদের মধ্যে আমার মা একজন। আমার মায়ের মত এমন মা কয়জন আছে এ পৃথিবীতে? মাগো, তুমিই আমার প্রাণ লক্ষী মা তুমি।
রচনাকাল-জুন-১৯৯৯খ্রিস্টাব্দ।
[জলছবি বাতায়ন নববর্ষ সংকলন ১৪২১ বাংলা এ প্রকাশিত]

লাল গরু


ঈদুল আজহার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। বড় ভাই কামাল উদ্দিনের মৃত্যুর পর জামাল উদ্দিন কোন ঈদে কোরবানি দিতে পারেনি। আজ থেকে পনের বছর পূর্বে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন কামাল উদ্দিন। জামাল উদ্দিন ভাবছে এবার নিজের পোষা লাল গরুটা বিক্রি করে কোরবানিতে শরিক হবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর জামাল উদ্দিন ও স্ত্রী জরিনা বেগম তাদের শোবার ঘরে আসলো। জামাল উদ্দিন বালিশটা টেনে হেলান দিয়ে বসলেন। জরিনা বেগম একটি পান মুখে দিয়ে বললেন, কি ব্যাপার আইজকা এতো তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়বেন নাকি?
– না। তোমার সাথে কিছু কথা আছে। তার আগে আমারে এক খিলি পান দাও।
জরিনা বেগম সুপারি, জর্দা, খয়ার ও চুন দিয়ে পান বানিয়ে স্বামীর নিকট এসে বললো, নেন আপনার পান।
জামাল উদ্দিন পানটি হাতে নিয়ে মুখে দিল। জরিনা বেগম এবার বললো, বলেন কি বলবেন?
জামাল উদ্দিন পান মুখে দিয়ে চিবাচ্ছে আর বলছে, ভাইয়া মারা যওয়ার পর এ পর্যন্ত কোনদিন কোরবানি দিতে পারি নাই। প্রতিবছরই তো মাংসের জন্য শিহান মাইনষের বাড়িতে গিয়া বইসা থাকে। তাই ভাবতেছি এইবার আমি কোরবানিতে শরিক হইব। এহন তুমি কি কও?
– কোরবানিতে শরিক হইবেন ট্যাহা কোথায় পাইলেন?
– ট্যাহা কোথাও পাইনি। লাল গরুটা বেইচ্ছা কোরবানিতে শরিক হইবো। আল্লাহর রহমে আমাগো গরুতো এখন চাইরট্টা। সামনের বছরটা গেলেইতো বাছুরটা বড় হইয়া যাইবো।
– আমারও তো ইচ্ছে করে কোরবানি দিতে। কিন্তু আপনার সমর্থের কথা চিন্তা কইরা কিছুই বলতে পারি নাই। শিহান প্রতি বছরই কোরবানির ঈদ এলে কাঁইন্দা বেড়ায়। এহন আমার কোন আপত্তি নাই। আপনি গরু বেইছতে পারেন।
স্ত্রীর সম্মতি পেয়ে জামাল উদ্দিন খুশি হয়ে বললো, তাইলে আজ আর কোথাও যাইবো না। এহন ঘুমাইয়া পড়ি। বাতিটা নিভাইয়া আহ।
জরিনা বেগম বাতি নিভিয়ে স্বামীকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। জরিনা বেগম মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও জামাল উদ্দিনের কেন জানি আজ ঘুম আসছে না। হঠাৎ করে তার ভাইয়ের কথা মনে হল।
কামাল উদ্দিন তখন নরসিংদীর ইউ.এম.সি জুট মিলে চাকরি করতেন। তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এতই ভদ্র ছিলো যে জুট মিলের সকল কর্মচারীরা তাকে শ্রদ্ধা করত। কিন্তু কতিপয় দুষ্ট লোক তার এই ভাল আচরণ মেনে নিতে পারেনি। তারা অনেক চেষ্টা করেছে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে। কিন্তু যখন তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল তাকে মেরে ফেলবে। চাকরিতে যোগদান করার পর থেকেই কামাল উদ্দিন তাঁর স্ত্রী জরিনা বেগমকে নিয়ে জুট মিলের নিকটই বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
জামাল উদ্দিন তার ভাইকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে নরসিংদী আসতো। তেমনি একদিন সে বাড়ি থেকে ভাইয়ের জন্য শাক সবজি ও কিছু প্রিয় খাবার নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ান হলো। প্রতিমধ্যে খবর পেলো তার ভাই কামাল উদ্দিন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এই খবর শোনার সাথে সাথে তার হাত থেকে সব কিছু পড়ে গেলো।
কামাল উদ্দিনের লাশ বাড়িতে আনা হল। তার লাশ দেখার জন্য গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে। এমনকি অন্য গ্রাম থেকেও মানুষ আসছে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই আসল। লাশ নিয়ে যখন গোরস্থানে যাচ্ছে তখন তার বাবা রহম উদ্দিনের চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা বইতে লাগল। এ কেমন দৃশ্য! পিতার কাঁধে ছেলের লাশ! এ দৃশ্য কোন বাবা কামনা করতে পারে না। এ শোক কিভাবে সইবে রহম উদ্দিন? সবাই লাশ দেখার পর দাফন করা হয়।
এদিকে জামাল উদ্দিন সবে মাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র। তার ভাইয়ের হঠাৎ মৃত্যুতে সে খুবই মর্মাহত। কারণ সংসারের সমস্ত বোঝা তার মাথায় নিতে হচ্ছে। বাবা-মা বৃদ্ধ। তার আর কোন ভাইও নেই যে, তার দায়িত্ব নিবে। তাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জামাল উদ্দিন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দু’টো গরু কিনে কৃষি কাজে লেগে যায়।
রহম উদ্দিনের বড় আশা ছিল কামাল উদ্দিন লেখাপড়া করে, চাকরি করে সংসারের স্বচ্ছলতা আনবে। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যায়।
কামাল উদ্দিনের মৃত্যুর তিন মাস পর জরিনা বেগমের একটি পুত্র সন্তান জন্ম হলো। রহম উদ্দিন পুত্র সন্তান জন্ম হওয়াতে খুবই খুশি হয়েছে। কারণ তার ছেলের বংশধর তার মাধ্যমে বেঁচে থাকবে। জরিনা বেগম তার সন্তানের নাম রাখলেন রাকিব।
সময় থেমে থাকেনি। দিনের পর রাত আসে। তারপরে সপ্তাহ পার হয়। এভাবে চলে যাচ্ছে মাসের পর মাস। দিনে দিনে বড় হতে লাগল রাকিব। রাকিবের দু’বছর পূর্ণ হল। এদিকে জরিনা বেগম প্রাণের প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পিতৃতুল্য শ্বশুরের অনুরোধে এ বাড়িতে রয়ে গেলেন।
রহম উদ্দিন চিন্তায় অস্থির। এভাবে আর কতদিন বউমা থাকবে? তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যে নারী কোন দিন শ্বশুরের মনে আঘাত দেয়নি, শশুরের একবিন্দু কষ্ট হতে দেয়নি। সেই নারীকে কীভাবে রহম উদ্দিন বিদায় দিবেন। এমন আদর্শ পরহেযগার সতী নারীকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যায় না। তাকে যেভাবে হোক এ বাড়িতে রাখতে হবে। কামাল উদ্দিনের একমাত্র উত্তরাধিকারী শিশু সন্তান রাকিবকেই বা কি করে দিয়ে দিবে। আর যদি নাতিকে রাখতে চান তাহলে কে করবে তার দেখা শুনা? এসব ভাবছেন রহম উদ্দিন। এবার এও ভাবছেন জামাল উদ্দিন বর্তমানে বিয়ের উপযুক্ত। তাকে তো অন্য জায়গায় বিয়ে করাতে হবে। সে বউতো রাকিবকে অন্য নজরে দেখবে। তার চেয়ে বরং জামাল উদ্দিনকে দিয়ে বউমাকে রেখে দিলে কেমন হয়? হ্যাঁ ভালই হয়। এক ঢিলে দুই পাখি।
রহম উদ্দিন একদিন জামাল উদ্দিনকে ডেকে বললো, বাজান, আমার বয়স তো ফুরাইয়া যাইতেছে। জানি না কোন দিন মইরা যাই। তোকে আমার জীবনের শেষ একটি আবদার রাখতে হবে।
জামাল উদ্দিন নম্র স্বরে বললো, আব্বা আপনার সব আবদার আমি হুইন্না আইছি। আজও হুনবো। বলেন আপনার কি আবদার।
– আমি চাই তুই তোর ভাবিকে বিয়া কর। ও যদি চইলা যায় তাইলে তোর ভাতিজার কি হবে? সে কারে মা ডাকবে? সে জন্ম হয়ে তার বাপকে দেহেনি। এহন যদি মাকেও হারায় তাহলে তার মত অভাগা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কামাল উদ্দিনের অবর্তমানে তুই ওর বাপ। আমার আয়ু তো শেষ হয়ে আসছে। আমি হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবো না।
পিতৃভক্ত জামাল উদ্দিন কোন দিন কোন কাজে তার বাবার মনে আঘাত দেয়নি। আজ পর্যন্ত কোন কথা অমান্য করেনি। কি করে পারবে আজ বাবার শেষ আবদার ফেলে দিতে। শত কষ্ট হলেও পারবে না তার বাবার আবদারকে অপমান করতে।
রহম উদ্দিন আবার বলল, আমি জানি বাজান, বউমার চেয়ে তোর বয়স কম হবে। তারপরও সবদিক চিন্তা করে আমি তোকে বিয়া করতে কইছি। তোর ভাল হইবে।
জামাল উদ্দিন তার বাবার কথাগুলো শ্রবণ করে চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললো, দেখেন আব্বা এত কিছু কইতে হইবে না। আপনি যা ভালা মনে করেন তাই করেন। আমার কোন আপত্তি নাই।
রহম উদ্দিন একইভাবে জরিনা বেগমের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করেন। জরিনা বেগম শুধু ছেলে ও শশুরের দিকে চেয়ে এ বিয়েতে সম্মতি দেয়।
বিয়ে হয়ে গেল জামাল উদ্দিনর সাথে জরিনা বেগমের। জামাল উদ্দিন তার বাবার কথা রাখতে গিয়ে, ভাতিজাকে মা ডাকার অধিকার দিতে গিয়ে, সদ্য ফুটে উঠা যৌবন খানা বিলিয়ে দিলেন তার চেয়ে বয়সে বড় একটা মহিলার মাঝে। যাকে সে এতদিন ভাবি হিসেবে জানত। আজ সে তার স্ত্রী।
ভাই মারা যাবার পর জামাল উদ্দিনের সংসারে অভাব শুরু হয়। বাবা রহম উদ্দিন বয়সের ভারে দিন দিন বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। এখন তেমন বেশি চলাফেরা করতে পারেনা। এখন শুধু মসজিদ ছাড়া আর কোথাও যেতে পারেন না। তার মা কিছুদিন আগে মারা যায়।
দেখতে দেখতে দু’বছর পার হয়ে গেল। জামাল উদ্দিনের সংসারে একটা কন্যা সন্তান হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই সন্তান দুনিয়াতে বেশিদিন থাকতে পারেনি। হঠাৎ একদিন নিউমোনিয়া হয়ে মারা যায়। দিন মজুর জামাল উদ্দিন তার সন্তানের সু-চিকিৎসা করতে পারেনি। সন্তান হারিয়ে বুকে ব্যথা নিয়ে রাকিবকে সন্তানের মত করে লালন পালন করতে লাগলেন। নিজে একা পরিশ্রম করেন তবু রাকিবকে কাজে নেননি। ওর বয়স যখন ছয় বছর হলো তখন তাকে নরসিংদীর একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলো।
জামাল উদ্দিনের মেয়ের জন্মের তিন বছর পর শিহানের জন্ম হয়। যে দিন শিহান জন্ম হল সেদিন তার ঘরে এক মুঠো ভাতও ছিলনা। শিহান জন্মের পর থেকে তার সংসারে অভাব বেশি করে দেখা দেয়। যা কিছু জমি জমা ছিল তাও বিক্রি করে শেষ করে ফেলল। এই অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে শিহান বড় হতে লাগল। এখন তার নিজের জমি বলতে কিছুই নেই। বর্তমানে চারটি গরু দিয়ে মানুষের জমিতে বর্গা চাষ করে কোন মতে দিন চলছে। এই অভাবের সংসারে শিহানকে লেখাপড়া করানোর সামর্থ হারিয়ে ফেললো সে।
রাকিব একদিন মাদ্রাসা থেকে একা বাড়িতে আসার পথে হারিয়ে যায়। পিতৃহারা সন্তান রাকিবকে হারিয়ে জরিনা বেগম এখন দিশেহারা। প্রাণ প্রিয় প্রয়াত স্বামীর মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই ছেলে আবার নিরুদ্দেশ। তার কান্না সহ্য করতে না পেরে জামাল উদ্দিন কয়েকবার নরসিংদী এসে খুঁজে যায়। শহরের কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় সে।
মুয়াজ্জিনের আজানের সুরে স্বামী-স্ত্রীর দু’জনের ঘুম ভাঙ্গল। জামাল উদ্দিন যথারীতি মসজিদে নামাজ পড়তে গেলো। তার বাবা রহম উদ্দিনও নামাজ পড়তে গেলেন। তিনি এখন দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। মসজিদটা বাড়ির কাছে বলে সেখানে কোন মতে যেতে পারেন। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই তিনি দুর্বল হয়ে গেলেন। ওনার বয়স এখন ৯০ বছর চলছে। মনে হয় না যে আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন। নামাজ পড়ে এসে রহম উদ্দিন খাটে শুয়ে আছেন। জামাল উদ্দিন তাঁর পাশে গিয়ে বসলেন। রহম উদ্দিন জামাল উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু কইবি বাজান?
জামাল উদ্দিন মাথা ঝাকিয়ে বললো, হ্যাঁ আব্বা কিছু কথা কমু।
– কি কইবি?
– আব্বা আমি নিয়ত করেছি এইবার ঈদে লাল গরুটা বিক্রি করে কোরবানিতে শরিক হইব। আপনি কি কন?
– আমার কিছু কওয়ার নাই। আমার সময় ফুরিয়ে গেছে। এহন তুই যা ভালা মনে করছ তাই কর।
– আপনার কোন আপত্তি নাই তো?
– না।
জামাল উদ্দিন আর কোন কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে চলে গেল।
সকাল বেলা শিহান, জরিনা বেগম ও জামাল উদ্দিন এক সাথে খেতে বসলেন। কোন প্রসঙ্গ ছাড়াই শিহান বললো, আব্বা লাল গরু বেইচ্ছা আমার জন্য কি আনবেন?
জামাল উদ্দিন বললো, তুই ক তোর জন্য কি আনবো?
– আমার জন্য একটা লাল গেঞ্জি ও লাল হাফপ্যান্ট আনবেন। আর একটা লাল কাগজের টুপি।
– আর কিছু লাগবে না?
– না।
– তোর আম্মার জন্য কি আনবো?
– আম্মার জন্য লাল শাড়ী।
– দাদার জন্য?
– লাল পাঞ্জাবী আর লাল পায়জামা।
– তুই শুধু সব কিছুই লাল কিনতে কছ ক্যান?
– আব্বা আপনি জানেন না। আমি লাল গরুকে কত্ত ভালোবাসি। আপনি আমার লাল গরুকে বেইচ্ছা দিবেন। তহন আমি থাকুম কিভাবে? সব গুলান যদি লাল হয় তাইলে আমি লাল দেইখা থাকতে পারুম।
– ঠিক আছে বাজান।
শিহান জামাল উদ্দিনের একমাত্র ছেলে। তার এখন ৮ বছর বয়স। এখনও স্কুলে যায় না। পড়ার কথা বললেই সে গরু নিয়ে মাঠে চলে যায়। তাই সে শিহানকে একটা ছাগল কিনে দেয়। তাদের গ্রামের উত্তর পাশে এক বিরাট চর। তার কাজ এই চরে গরু ও ছাগলকে ঘাস খাওয়ানো। আর মাঝে মাঝে বাবার সাথে খেত নিড়াইতে যায়। বাবা কাজ করতে গেলে চরে বাবার জন্য ভাত নিয়ে যায়। শিহান লাল গরুটাকে খুব বেশি ভালোবাসে। এবার সেই লাল গরুটা বিক্রি করে দিবে তাইতো তার মনে কষ্ট। তারপরও যেহেতু এইবারই প্রথম কোরবানি দিবে। সেই কথা চিন্তা করে সে মহাখুশি।
আজ শুক্রবার। পাশের বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি এসে জামাল উদ্দিনকে বললো, কিরে জামাল, তোর লাল গরুটা নাকি বেইচ্ছা লাইবি?
জামাল উদ্দিন বললো, হ চাচা। ভাবছি এইটা বিক্রি কইরা শরিক হইব।
মুরুব্বিদের মধ্যে একজন বললো, তা ভালা কথা আমডা ছয়জন আছি। আরেক জন লোক চাইতাছি। তুই আমাগো লগে থাকতে পারস। আর তুই রাজি থাকলে তোর লাল গরুটা দাম দর করে কোরবানি দিয়ে দেই। হুদাহুদি বাজারে কষ্ট কইরা নিয়া কোন লাভ নাই।
– আপনারা মুরুব্বি মানুষ। আপনারা যা ভালা মনে করেন তাই করেন।
অন্য একজন মুরুব্বি বললো, তো কত দিতে হবে দাম?
আমি কি কমু চাচা। কতর মাল আছে তা আন্দাজ কইরা দিয়া দেন।
অন্য একজন বললো, আটাশ হাজার ট্যাকা দিমু। তোর কোন আপত্তি আছে?
– চাচা ত্রিশ হাজার দিলে হয় না?
– না আটাশ হাজার ট্যাকা মিল আছে। ৭ জনে চার হাজার ট্যাকা করে পরবে। তুই আর কোন আপত্তি করিস না। আল্লাহ রাস্তার নিজের পালা গরু কোরবানি দিবি আল্লাহ অনেক ছোয়াব দিবে।
– ঠিক আছে চাচা। তাইলে কথা তাই রইল।
– আর হোন তোর চার হাজার ট্যাকা বাদে বাকি চব্বিশ হাজার টাকা কাল্কা দিমু।
– ঠিক আছে।
জরিনা বেগম মুড়ি, চানাচুর নিয়ে এসে বললো, আপনারা হগলতে মুড়ি, চানাচুর খান।
একজন মুরুব্বি বললো, আরে তুমি আবার এইসব আনতে গেলে ক্যান?
জামাল উদ্দিন বললো, গরিবের বাড়িতে আসছেন আর কি দিমু। সামান্য কিছু দিলাম।
মুড়ি, চানাচুর খাওয়ার পর একজন বললো, এহন যাইরে জামাল। কাল্কা সহালেই তোর ট্যাহাটা দিয়া দিমু।
– তাই কইরেন চাচা। কাল্কা শনিবার তো বাজার সদাই করতে হবে।
– ঠিক আছে। এই বলেই মুরুব্বিরা সবাই চলে গেল।
জামাল উদ্দিন স্বপ্ন দেখছে এবারের ঈদটা একটু আনন্দে কাটাবে। শিহান স্বপ্ন দেখছে লাল জামা পড়ে ঈদ করবে। জরিনা বেগমের মনেও আজ আনন্দ।
ফজরের আজান দিতেই জরিনা বেগমের ঘুম ভাঙ্গল। নামাজ পড়ে তিনি গোয়াল ঘরে গেলেন গোবর ফালানোর জন্যে। গোয়াল ঘরে ঢুকতেই দেখে লাল গরুটি নেই।
– হায় আল্লাহ! একি করলা তুমি? বলেই জরিনা বেগম চিৎকার দিয়ে উঠলো।
জামাল উদ্দিন স্ত্রীর চিৎকার শুনে দ্রুত আসলো। লাল গরুটিকে না দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। কিছুই বলতে পারছে না। জারিনা বেগম কাঁদছেন।
– হে আল্লাহ কি অপরাধ করেছিল আমার সোয়ামী? কি অপরাধ করেছিল আমার শিহান? যার জন্যে তুমি আমাগো প্রতি এমন অবিচার করছো?
শিহান তখনও ঘুমাচ্ছিল। মায়ের চিৎকার শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে আসল।
– আম্মা তুমি কাঁন্দ ক্যান?
– বাজানরে তোর লাল গরুটা চোরে নিয়া গেছে।
– কি কও আম্মা!
শিহান ঘোয়াল ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি লাল গরুটি নেই। তারপর জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।
– তাইলে আম্মা আমার আর লাল জামা কিনা হইব না?
জরিনা ও বাবুলের কান্নায় বাড়ির আশে পাশের লোকজন এসে ভিড় জমালো। সবাই গরুটার জন্যে আফসোস করতে লাগল।
শিহান রহম উদ্দিনের কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো, দাদা আমি আর নতুন জামা পড়ে ঈদে যেতে পারুম না।
রহম উদ্দিন নাতির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নাতির কান্না দেখে বৃদ্ধ দাদার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল খসে পড়ল।
জামাল উদ্দিনের কত স্বপ্ন ছিল গরু বিক্রির টাকা দিয়ে নতুন জামা আনবে। কোরবানিতে শরিক হবে। আনন্দে ঈদ করবে কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে আজ চুরমার হয়ে গেল। যারা গরুর দাম ঠিক করছিল তারাও আসলো। জামাল উদ্দিনকে শুধু সান্ত¡না ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলো না তারা।
আজ সারাদিন জামাল উদ্দিন মনমরা হয়ে বসে আছে। কারো সাথে কোন কথা বলেনি। কত লোকজন বাজারে গিয়ে ঈদের কেনাকাটা করল। কোরবানির গরু কিনল। কিন্তু জামাল উদ্দিন কিছুই কিনতে পারলো না। পাশের বাড়ির বিশিষ্ট শিল্পপতি এম.এ মতিন সাহেব ১ লক্ষ টাকা দিয়ে মোটা তাজা দেখে একটি গরু কিনে আনলেন। গ্রামের যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর সবাই ঐ গরু দেখতে গেল। শিহানও তাদের দেখাদেখি গরু দেখতে গেল।
আজ ঈদ। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা বইছে। সবাই আজ ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা। কিন্তু জামাল উদ্দিনের পরিবারে নেই কোন আনন্দ। নেই কোন ঈদ। এদিকে রহম উদ্দিনের অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। জরিনা বেগম ও শিহান তাঁর পাশে বসে চোখের পানি ফেলছে। যে শ্বশুর কোনদিন জরিনাকে কোন কটু কথা বলেনি। সারাক্ষণ তাকে শধু বউমা বলেই ডেকেছে, সে শ্বশুর আজ মৃত্যু পথের যাত্রী। তা জরিনা বেগম ভাবতেই চোখের জল এসে যায়।
সকাল ৭ টায় রহম উদ্দিন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য পরদেশে চলে গেলেন। যিনি আর এই পৃথিবীতে আসবেন না। এমন একটা ঈদের দিনে, খুশির দিনে তার মৃতুত্যে বাড়িতে কান্নার রুল পড়ে গেল। শিহান দাদা…দাদা… বলে চিৎকার করছে। এ চিৎকার প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পিতার মৃত্যুতে জামাল উদ্দিন একেবারে বোবা হয়ে গেছে। কথায় আছেÑ ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।’ বাড়ির আশে পাশে শোকের ছায়া পড়ে গেল। ইমাম সাহেব এসে বললো, ঈদের নামাজের পর ঈদগাহের মাঠে জানাজার নামাজ সম্পূর্ণ করবে। তাই তাড়াতাড়ি গোসল করানোর জন্য বলে গেল। ঈদের দিন মৃত্যুবরণ করায় দূরের আতœীয় স্বজনরা কেউ আসতে পারে নি। নয়টায় ঈদের জামাত হবে। মাত্র দুই ঘন্টা ব্যবধানে তাকে দাফন করানোর জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হল। ঈদের নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হল। হাজার হাজার গ্রামবাসী জানাজায় অংশ গ্রহণ করল। শিহান কালো একটা হাফপ্যান্ট ও শার্ট পড়ে ঈদগাহে আসে। নামাজ শেষে রহম উদ্দিনকে কবর দিয়ে জামাল উদ্দিন শিহানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
সবাইতো আজ ঈদের আনন্দে ব্যস্ত। দু’একজন হয়তো তাদের শোকে শোকাহত। হতভাগা জামাল উদ্দিনের জীবনে এমন করুণ পরিণতি আসবে তা সে ভাবতেও পারেনা। জীবনের প্রতিটি পদে পদে তাকে আল্লাহ কষ্ট দিয়েছে। সে যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন তার বাবা চাকুরি হারান। আর তখন থেকেই তাদের সংসারে অভাব দেখা দেয়। যখন লেখাপড়া করে ভাল একটি চাকুরী করার স্বপ্ন দেখছিল, তখন সে তার ভাই জামাল উদ্দিনকে হারায়। তারপর আসে তার জীবনে করুণ পরিণতি। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ভাবীকে বিয়ে করে সংসারি হতে হয়েছে তাকে। অভাবের তাড়নায় নিজের ছেলেকেও লেখাপড়া করাতে পারে নি। আজ এমন খুশির দিনেও খোদা তার সুখ সইল না। গরু চুরি হল। বাবা মারা গেল। একি খোদার ইনসাফ! কেন এত বড় শাস্তি দিলো তাকে? কেউ কি দিতে পারবে তার উত্তর? আসলে বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকে আসে। আজ যেন জামাল উদ্দিনের সেই অবস্থাই হল।
জরিনা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাঁধভাঙ্গা নদীর জলের মত অশ্রু তার চোখ বেয়ে পড়ছে। বার বার আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়।
ইতোমধ্যে গ্রামবাসীরা সবাই যার যার পশু কোরবানি করে নিল। অন্যান্য ঈদের মত শিহান এবার আর অন্যদের গরু জবেহ করা দেখতে যায় না। কারণ আজ যে সে দাদার মৃত্যু শোকে শোকাহত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। সবার ঘরে ঘরে মাংস রান্না হচ্ছে। মাংসের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জরিনা বেগম রান্না ঘরে বাঁশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জামাল উদ্দিন বিছানায় শুয়ে আছে।
শিহান এসে বললো, আম্মা আমডা কি গোস্ত খাইতে পারুম না?
জরিনা বেগম নিরুত্তর।
শিহান আবার বাবার কাছে গিয়ে বললো, আব্বা আপনি মতিন সাবের বাড়ি থেকে গোস্ত নিয়া আসেন।
জামাল উদ্দিন বললো, বাজানরে একথা বলে আমারে আর কাঁদাসনে। আমাগো ভাগ্যে আজ গোস্ত জুটবে না। আজ কি করে গোস্ত খামু? আজ যে তোর দাদাকে হারালাম।

২১/০৯/২০১৫খ্রি:

সেমুলী

আমি তখন ছোট। বয়স ছয় কি সাত হবে। মাঝে মাঝে স্কুলে যেতাম এবং দিনে একটা করে বই ছিঁড়তাম। আমি ছিলাম নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার জন্মের পর থেকেই বাবার সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। অথচ আমার জন্মের পূর্বে আমাদের সংসারে ছিল গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ও বালতি ভরা দুধ। দাদা যখন সংসার ছেড়ে দিলেন, তখন থেকেই আমাদের সংসারে অবনতি ঘটতে থাকে। এখন বাবা একদম নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আসের মত জমিজমা নেই। সব বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন বাবা পরের জমিতে কাজ করে। এই রোজগার দিয়ে কোন মতে সংসার চালায়। আমরা পর পর চারটি ভাই ও একটি বোন জন্ম নিলাম। আমি হলাম বড় সন্তান। আমি পশু-পাখিকে খুব ভালোবাসতাম। মাঝে মাঝে টুনটুনি, বাবুই, বক ও চড়ুই পাখির বাসা ভেঙ্গে ছানা চুরি করে নিয়ে আসতাম। এসব পাখি ছানা বাড়িতে এনে খুব যত্ন করে লালন পালন করতাম। আমার এই পাখি প্রেম স্বভাব দেখে মা আমাকে একটি ছাগল কিনে দেন। ছাগলটি ছিল কুচ কুচে কালো। ছাগলটি পেয়ে আমি খুব খুশি হলাম। মনে মনে মাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। সেই থেকে আনন্দের সহিত ছাগলটি লালন পালন করতে লাগলাম। সারা দিন টো-টো করে এই ছাগলটির পিছনে লেসে থাকতাম। কয়েক মাসের মধ্যেই ছাগলটি বেশ বড় হয়ে গেল।
এক মাস, দুই মাস, তিন মাস এভাবে কেটে গেল ছয়টি মাস। ছাগলটি কিছুদিনের মধ্যে সুন্দর ফুটফুটে একটি বাচ্চা জন্ম দিল। যেদিন বাচ্চাটি জন্ম নিল সেদিন ছিল সোমবার। তাই আমি বুদ্ধি করে সোমবারের সাথে মিল রেখে ছাগল ছানাটির নাম রাখলাম ‘সেমুলী’। আমার এই বুদ্ধি দেখে মা-বাবা খুব খুশি হলেন।
সেমুলী যখন জন্ম নিল তখন হাঁটতে পারছিলনা। আমি তাকে ধরে হাঁটালাম। সেমুলী আমার দিকে লক লক করে তাকিয়েছিল। আমি তাকে আলতো করে ধরে দুধ খাওয়ালাম। সেমুলী যখন হাঁটা শিখল তখন থেকেই সে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে। কখনো বা পাক ঘরে চলে যায়। মায়েরর আঁচল গিয়ে কামড়ে ধরে। আবার কখনো বা ঘরের পিড়ায় উঠে উঠে লাফায়। একবার আমার কাছে আগে আবার তার মায়ের কাছে যায়। মনে হয় যেন আমি তার বাবা। আমি ডাকি, ‘সেমুলী কাছে এসো।’ অমনি সে লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে বসে। আমি ওকে আদর করি। ও তখন শান্ত হয়ে যায়। তখন আমি ওর শরীরে সুর সুরি দিই। সেমুলী সারাক্ষণ আমার পাশে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য আমাকে না দেখলে ভ্যা ভ্যা করে চিৎকার করে। তখন আমি ছুটে এসে ওর মসৃণ গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করি। আমার ভালোবাসার আদর পেয়ে সে আনন্দে চোখ বুঝে থাকে কিছুক্ষণ।
সেমুলী রাতে আমার পাশে থাকে। সারাক্ষণ আমায় জ্বালাতন করতো। আমি মাঝে মাঝে রাসে ওকে কানমলা দেই। কানমলা খেয়ে সে আরো বেশি করে আমার গা ঘেষে বসে। তবে সে একদিক দিয়ে ভাল ছিল। কখনো সে রাতে বিছানায় প্রস্রাব করে না। আমি তাকে রুটি, ভাত, ঘাস সবই খাওয়াতাম। আদরে আদরে সেমুলী এতদিনে খুব বাদর হয়ে সেছে। বাড়ির আশে পাশের যা কিছু পায় তা খেয়ে সাবাড় করে। এজন্য মাঝে মাঝে পাক ঘরে গিয়ে তরিতরকারি খেয়ে ফেলে। কখনো লবণের কোটা ফেলে দেয়। ওর এসব কা-কারখানা দেখে মা কখনো রেগে ওকে এক থাপ্পর মারে। তখন সেমুলী থাপ্পর খেয়ে দৌঁড়ে আমার কাছে এসে মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করে। তখন আমি খুব ব্যথা পাই। আমি তাকে মায়ের নিকট যেতে নিষেধ করি। কিন্তু কে শুনে কার কথা!
আমি মাকে বলি, ‘তুমি আর সেমুলীকে মের না।’
মা রেগে গিয়ে বলেন, কি করব বল, এত দুষ্টু কি ছাগল ছানা হয়!
দিন যায় সপ্তাহ আসে। এভাবে কেটে যায় মাসের পর মাস। সেমুলী আস্তে আস্তে তাজা হতে লাগল। তার সমস্ত শরীর কালো কুচকুচে লোমে ছেয়ে গেল। নাদুস-নুদুস শরীর। আমার ভালোবাসা ও আদর পেয়ে সে যেন অল্প কয়েকদিনেই মোটা হয়ে গেল। এখন সেমুলী আমার এতই ভক্ত হয়ে গেল যে, আমি যা বলি সে তাই করে। আমার মনে হয় সে আমার ডাক শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে আমার কুলে এসে যখন বসে তখন আমি ওকে চুমো দেই। তার শরীরের চুল চিরুনী করে আঁচড়ে দিই।
আমি যখন সেমুলী’র মাকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাই তখন সে পেছনে পেছনে লাফিয়ে যায়। দু’একটি ঘাসে কামড় দিয়ে আবার দ্রুত আমার কাছে চলে আসে। এভাবে চলছে প্রতিদিন। আমিও সেমুলীকে খুব বেশী ভালোবাসি। ওকে ছাড়া যেন আমার এখন আর কোন কিছু ভালো লাগে না। কোথাও বেড়াতে গেলে এক দিনের বেশি থাকতে পারি না। এভাবে কেটে গেল একটি বছর। এখন সেমুলী অনেক বড় হয়ে গেছে।
একদিন আমার বাবা মায়ের সাথে আলাপ করছে। বাবা বললো, আমাদের সেমুলী তো এখন অনেক বড় ও মোটা তাজা হয়ে সেছে। ওকে এখন বিক্রি করে দিই। তাছাড়া আমার হাতে এখন কোন টাকা পয়সা নেই যে সংসার চালাব।
মাতো রীতিমত অবাক। একি বলছেন আপনি! রাজুতো ওকে বিক্রি করতে দেবে না। সেতো কেঁদে সারা বাড়ি মাতিয়ে তুলবে।
কাঁদলে কি হবে? আজ হোক কাল হোক একদিন তো ওকে বিক্রি করতেই হবে।
মায়ের মুখে সেমুলীর বিক্রির কথা শুনে আমিতো হতবাক। মনে হয় যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি মাকে বললাম, মা তুমি বাবাকে বলো সেমুলীকে যেন বিক্রি না করে।
মাও সেমুলীকে খুব ভালোবাসে। মায়ের মুখে কষ্টের ছাপ লক্ষ করলাম। মা বললেন, তোর বাবাতো আমার কথা শুনবে না। যা মুখে একবার বের করবে তা আর ফেরানো যাবে না।
– আমি এত কষ্ট করে সেমুলীকে লালন পালন করছি। তাছাড়া তার প্রতি আমার অন্য এক ধরনের ভালোবাসাও জন্মালো। সেই আদরের সেমুলীকেকে বাবা বিক্রি করে দিবে তা আমার ভাবতে অবাক লাগে। এ হতে পারে না। আমি কিছুতেই সেমুলীকে বিক্রি করতে দিব না।
আজ শনিবার। বাবা সেমুলীকে বিক্রি করার জন্য হাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। বাবা যেন আজ পাষান হয়ে গেলেন। আমি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলাচ্ছি। বাবা সেদিকে কোন দৃষ্টিই দিচ্ছেন না। আমি একবার মায়ের নিকট যাই আবার সেমুলীর নিকট যাই। সেমুলী’র দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তার চোখের কোণায় পানি জমে আছে। আমাকে দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকাল। মনে হয়যেন সে বলছে, রাজু তোমাকে ছাড়া আমি পরের বাড়িতে কেমন করে থাকব। তোমার বাবা এত পাষান কেন?’ কিন্তু কে শুনে এই বোবা সেমুলীর ভাষা।
বাবা যখন সামনের দিকে সেমুলীকে নিয়ে যাচ্ছেন তখন সেমুলী ঘাড় ফিরিয়ে ভ্যা-ভ্যা করে ডাকছে। তার এই ডাক আমি সহ্য করতে না পেরে বাবার পিছনে ছুটলাম। বাবা আমাকে বাজারে যেতে বারণ করা সত্ত্বেও বাবার পিছে পিছে সারাটা পথ কেঁদে কেঁদে বাজারে পৌঁছলাম। এরি মধ্যে বাবার একটুও মন পরিবর্তন হলো না। তবে একটি কথা বলে বার বার সান্ত¡না দিল, রাজু আর কাদিস না। তোকে অন্য একটি বাচ্চা কিনে দিব।
কিন্তু আমি কি তা আর মানি। আমি যে নাছোড় বান্দা। চোখের পানি মুছে বললাম, আমি অন্য ছাগল চাইনা। আমি শুধু সেমুলীকে চাই। ওকে আমি বেঁচতে দিব না।
এদিকে সেমুলী কিছু দূর গিয়ে আর যাচ্ছে না। বার বার বাড়ির দিকে ফিরে আসতে চাচ্ছে। এক পর্যায়ে বাবা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে করতে বাজারে নিয়ে আসল। বাজারে শত শত ছাগল বিক্রেতারা তাদের ছাগল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাও একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে সেমুলীকে নিয়ে দাঁড়ালেন।
অনেক্ষণ বসে থাকার পর এক ক্রেতা আসল। সে সেমুলীকে ১০০০ টাকা দিয়ে কিনে ফেলল। তখন আমার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেল। এ বুঝি সেমুলীকে জীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। ক্রেতা আমার কান্না দেখে আশ্চার্য হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেসা করলেন, ছেলেটি কে হয় আপনার?’
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ও আমার ছেলে।
– কাঁদছে কেন?
বাবা আমার কান্নার কারণ ক্রেতা লোকটিকে বিস্তারিত ঘটনা বললেন। ক্রেতা এ ঘটনা শুনে খুব মর্মাহত হলেন। তার মনটা নরম হয়ে গেল। তিনি বাবাকে বললেন, আমি ছাগলটি অবশ্য ভাগি দিতাম। এখন যেহেতু আপনার ছেলে ছাগলটির জন্য কাঁদছে সেহেতু আমার মনে হয় আপনিই ছাগলটি ভাগি নিয়ে গেলে ভাল হবে।
একথা শুনে আমি ও বাবা খুব খুশি হলাম। আমি তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। সেমুলী মনে হয় একথা শুনছে তাই সে আনন্দে লেজ দোলাচ্ছে। আমি তার শরীরে হাত বুলালাম। লোকটিকে বাবা আমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলেন। পরে আমি সেমুলীর রশি ধরে খুশিতে বাবার আসে বাড়িতে চলে আসলাম।
মা সেমুলীকে দেখে আশ্চার্য হয়ে গেলেন। পরে মাকে আমি বিস্তারিত বললাম। মা একথা শুনে খুব খুশি হলেন।
সেদিনের পর থেকে আমি আবার আগের মতো সেমুলীকে লালন পালন করতে লাগলাম। এভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন সেমুলী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে আগের মতো আর ঘাস খায় না। আর দুষ্টুমি করে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চোখ দিয়ে জল পড়ে। পশু ডাক্তার দিয়ে সেমুলীকে চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে না। দিন দিন সেমুলী শুকিয়ে যাচ্ছে। যিনি সেমুলীকে কিনলেন ওনাকে খবর দেয়া হল। তিনি আসলেন। সেমুলীকে দেখে আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, রাজু এর জন্য মন খারাপ কর না। আল্লাহর নিকট দোয়া কর যাতে তিনি তোমার সেমুলীকে ভাল করে দেন।
লোকটি চলে গেলেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই সেমুলীর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন সেমুলীকে আদর করে বলি, তুমি একদিন ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু সেমুলী যেন আমাকে বলছে, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না।
বেশি ভালোবাসার জিনিস বেশি দিন থাকে না। সেমুলীকে আমি বেশি ভালবেসেছিলাম তাই খোদা সেমুলীকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন। সেমুলীর মৃত্যুর পর আমি তার উপর পরে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না দেখে আশে পাশের সবাই আমাকে বুঝালো, কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হয়নি।

রচনাকাল-১৫ মার্চ ২০০০ খ্রিঃ।

দুষ্টু মিন্টু


আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। তখন আমাদের ক্লাসে ছিল এক দুষ্টু ছেলে। তার নাম মনির হোসেন মিন্টু। সে সব সময় স্যারদের ক্লাসে পড়া জিজ্ঞাসা করলে উল্টাপাল্টা জবাব দিত। অবশ্য তার জবাবে যুক্তি থাকে। একদিন ক্লাসে বিজ্ঞান স্যার আমাদেরকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সর্ম্পকে বোঝাচ্ছিলেন। তিনি অনেকবার বুঝানোর পর স্যার একে একে সবাইকে বললেন, আম পাকলে আকাশের দিকে না উঠে মাটিতে পড়ে কেন?
আমরা সবাই যে যার মতো বুদ্ধি খাটিয়ে উত্তর দিলাম। যখন স্যার মিন্টুকে প্রশ্ন করলেন মিন্টু তখন জবাব দিল, স্যার আকাশেতো খাওয়ার কেউ নেই, তাই আম আকাশের দিকে না উঠে মাটিতে পড়ে যায়।
তার উত্তর শুনে আমরা সবাই তখন খিল খিল করে হাসতে লাগলাম।
স্যার আর কোন কথা না বলে ক্লাস থেকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর বাংলা স্যার ক্লাসে আসলেন। তিনি আমাদের সবাইকে কাল কত প্রকার ও কি কি বলতে বললেন। আমরা সবাই কালের প্রকারভেদ গুলি বলি। কিন্তু মিন্টুকে বলতেই মিন্টু চট করে উত্তর দিল স্যার ওদের উত্তর হয়নি।
স্যার বললেন, কেন হয়নি?
– কারণ স্যার কাল হচ্ছে ১২ প্রকার। আর তারা উত্তর দিচ্ছে মাত্র ৩ প্রকার। তারা ৯ প্রকার কম বলেছে।
স্যার মিন্টুর কথায় আশ্চার্য হয়ে বললেন, বলতো দেখি তোমার প্রকারভেদগুলো।
– ঠিক আছে স্যার বলছি।
১. অতীত কাল
২. বর্তমান কাল
৩. ভবিষ্যৎ কাল
৪. গতকাল
৫. সকাল
৬. বিকাল
৭. আগামীকাল
৮. ইহকাল
৯. পরকাল
১০. একাল
১১. সেকাল
১২. যৌবনকাল
মিন্টুর এ প্রকারভেদগুলো শুনে স্যারসহ আমরা সবাই খিলখিল করে হাসলাম।
পড়া শেষে আমাদের সাবাইকে উদ্দেশ্য করে স্যার বললেন, তোমরা সবাই মনযোগ দিয়ে শোন, কখনো পরের উপকার করতে ভুলবে না। যে উপকার করে না সে মানুষ না।
মিন্টু তখন জবাব দিল, স্যার আপনার ক্ষেত্রেও কি সেটা প্রযোজ্য?
স্যার বললেন, অবশ্যই। তবে একথা বললে কেন তুমি?
– স্যার, সেদিন পরীক্ষার হলে কি বিপদে পড়েছিলাম। কিন্তু উত্তর বলে দিয়ে আপনি একটুও উপকার করেননি।
– চুপ বেয়াদব, কিসের সাথে কি মিলাচ্ছ।
মিন্টু তখন লজ্জা পেল। চুপ করে মাথা নিচু করে রইল।
পরিশেষে স্যার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখ তোমরা জীবনে কু-অভ্যাস, কু-কথা, কু-নেশা কু-পরামর্শ হতে বিরত থাকবে। কারণ এগুলো মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
আমরা সবাই বললাম, ঠিক আছে স্যার। কিন্তু দুষ্টু মিন্টু বলে উঠল, স্যার আমার পক্ষে এক কু-ত্যাগ করা সম্ভব নয়।
স্যার রাগান্বিত স্বরে বললেন, তুমি সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি কর, কেন কু-ত্যাগ করা সম্ভব নয়?
– স্যার আমার বাড়ি কুমিল্লা। কু-ত্যাগ করলে বাড়ির ঠিকানাটাই যে ভুলে যাব!
এ কথা শুনে আরেকজন ছাত্র বলে উঠল, স্যার আমার বাড়ি কুষ্টিয়া!
স্যার দুই ছাত্রের কথা শুনে বোকা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর স্যার বললেন, ঠিক আছে তোমরা সবাই কু-অভ্যাস নিয়েই থাক আমি চললাম। বলেই স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলেন।
স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়ার পর নরসিংদীর ছেলে ছোটন বললো, কিরে মিন্টু তুই স্যারদের সাথে এভাবে উল্টাপাল্টা কথা বলছ কেন?
মিন্টু বললো, কেন কি হয়েছে তোর?
– আমার কিছু হয়নি। আমার জানতে ইচ্ছে করছে তোর বাড়ি কোথায়?
– কেন? শুনলি না আমার বাড়ি কুমিল্লা।
– কিন্তু তোর গ্রাম কোথায়?
– শুনবি নাকি আমার গ্রামের নাম?
– হ্যাঁ শুনব।
– আয় দেখিয়ে দিই।
– এখান থেকেই দেখাবি?
– হ এখান থেকেই দেখাব।
– আচ্ছা দেখাতো দেখি তোদের গ্রাম।
এ কথা বলার সাথে সাথে মিন্টু ছোটনকে সজোরে ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে ছোটন মাটিতে পড়ে গেল। তখন তার একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল।
ছোটন তখন কাঁদতে কাঁদতে হেডস্যারের কাছে গিয়ে মিন্টুর নামে নালিশ করল।
হেডস্যার ছোটনের অভিযোগ শোনার পর মিন্টুকে স্যারের রুমে ঢেকে আনলেন।
মিন্টু আসামীর মতো হেডস্যারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হেডস্যার জিজ্ঞেস করলেন, মিন্টু তুমি ওকে ধাক্কা দিয়েছ কেন?
মিন্টু বললো, স্যার ও আমাদের গ্রাম দেখতে চেয়েছিল, তাই।
– তাই বলে কি ধাক্কা মারতে হবে?
স্যার আমাদের গ্রামের নাম ধাক্কামারা। সে আমাদের গ্রাম দেখতে চেয়েছে তাই ধাক্কা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি!
মিন্টুর এই খামখেয়ালিপনা কথা শুনে হেডস্যার খুবই রাগান্বিত হলেন। অন্য একজন ছাত্রকে বললেন একটা বেত আনতে। একজন ছাত্র একটি বেত এনে দেয়। হেডস্যার বেত হাতে নিয়ে মিন্টুকে সামনে আসতে বললেন। মিন্টু সামনে আসতেই কয়েকটি বেত মারল আর বললেন, আর কখনো দুষ্টামী করবে?
মিন্টু কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, না স্যার। এখন থেকে আমি ভাল হয়ে যাব। আর কখনো এমন দুষ্টুমী করবো না। আমাকে মাফ করে দেন স্যার।
হেডস্যার তখন মিন্টুকে মাফ করে দিলেন এবং ছোটনের সাথে মিলিয়ে দিলেন।
সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে মিন্টু আর দুষ্টুমী করে না। এখন থেকে খুব ভাল মানুষ হয়ে গেছে। নিয়মিত ক্লাসে আসে। প্রতিদিনের পড়া মুখস্থ করে আসে। ইতিমধ্যে সকল ছাত্রদের মধ্যে সে একজন প্রিয় ছাত্র হয়ে গেল এবং ছোটন তার প্রিয় বন্ধু হয়ে গেল।

রচনাকাল-১ জুলাই ২০১৩ খ্রি:

মায়ের ভালোবাসা

অনিক খুব চঞ্চল স্বভাবের বালক। সারাদিন এ বাড়ী ও বাড়ী ঘুরে বেড়ানো যার কাজ। লেখা পড়ার দিকে তেমন কোন মনযোগ নেই। বাবা-মা স্কুলের কথা বললেই বন্ধুদের নিয়ে চলে যায় খেলার মাঠে। খেলার ছলে কখনো কাউকে চিমটি কাটে। কখনো বা ব্যাট দিয়ে কারো মাথা ফাঁটিয়ে দেয়। আবার কখনো রাগে কারো জামা ছিঁড়ে দেয়। ফল খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে কখনো কখনো অন্যের গাছে ঢিল মারে। একদিন পাশের বাড়ীর কুল গাছে ঢিল মেরে তাদের গরুর পানি খাওয়ার গামলা ভেঙ্গে দেয়। এই নিয়ে চলে দু’পরিবারের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। সেই থেকে অনিক আর সেই বাড়ীতে যায় না। দিনে অনন্ত ৪/৫টি নালিশ আসে তার বাবা-মার কাছে। বাবার বকুনি ও মায়ের শাসনে দিন কাটছে তার। তাই এখন আর সে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়ে না কিন্তু অন্য একটি নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। আর তাহলো পাখি শিকার করা। কারণ সে এতদিনে বুঝতে পেরেছে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়া অন্যায় কিন্তু পাখি শিকার করা অন্যায় না। পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখির ছানা ধরা এখন তার নেশা হয়ে গেছে। বনে জঙ্গলে, আশে পাশের ঝোপ ঝাড়, ক্ষেত-খামারে ঘুরে বেড়ানো এখন তার নিত্যদিনের কাজ। এ কাজে কেউ তাকে বাঁধা দেয় না। কেউ আর এখন পাখির বাসা ভাঙ্গার জন্য তার বাবা-মার কাছে নালিশ করে না। তাই মনের আনন্দে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পাখির ছানা ধরার নেশায় দিন রাত ঘুরে বেড়াচ্ছে অনিক।

অনিকের দুষ্টুমির সংঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছে তার প্রতিবেশী রবিন। সেই শিশুকাল থেকেই দু’জনে এক সাথে খেলা-ধূলা, মারা-মারি করে আসছে। একদিন দুজনে এক ঝোপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তারা টুনটুনি পাখির ছানার ছিঁ ছিঁ আওয়াজ শুনতে পায়।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে কোন কথা বলবি না। টুনটুনির ছানা ধরার সময় কথা বলা নিষেধ। তোর কথার আওয়াজ পেলে ফুরৎ করে টুনটুনির ছানা চলে যাবে। অনিক তার বন্ধু রবিনকে একথা বলেই টুনটুনির বাসার দিকে চুপি চুপি হাঁটতে লাগল। অনিক আগে রবিন পিছনে। অনিক সামনে থেকে দু’হাতে চেপে ধরে বাসাটি গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলে। আর অমনি বাসার ভেতর থেকে টুনটুনির চারটি ছানা ছিঁ ছিঁ করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু সেদিকে অনিকের কোন খেয়াল নেই। তার আনন্দ লাগলো এই ভেবে যে, সে আজ বিরাট কিছু জয় করে ফেলছে। অনেক দিনের শখ ছিল সে টুনটুনির ছানা ধরবে এবং সেটি খাঁচায় বন্দি করে লালন পালন করবে।

টুনটুনির ছানাগুলোর ছিঁ ছিঁ আওয়াজ পেয়ে মা টুনটুনিটা বাসার কাছে এসে টুনটুন করে আওয়াজ করছে। সন্তান হারানোর শোকে মা টুনটুনিটা কাঁদছে কিন্তু অবুঝ অনিক তার সেই কান্না বুঝে না। মনের আনন্দে অনিক আর রবিন ছানাগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে এল। মা টুনটুনিটা বাচ্চার শোকে কাঁদতে কাঁদতে অনিকের পিছে পিছে তার বাড়ীর সামনে আসছে। একবার মা টুনটুনিটা উড়াল মেরে অনিকের কাছে আসে আবার দূরে চলে যাচ্ছে। আর টুনটুন করে কাঁদছে। টুনটুনি বলছে, ‘অনিক আমার বাচ্চাগুলোকে মেরো না। তাদেরতো কোন দোষ নেই। আমিতো তোমাদের কোন ক্ষতি করি নাই। তাহলে কেন তুমি আমার অবুঝ শিশু বাচ্চাগুলোকে ধরে নিলে?’ কিন্তু সেই বোবা পাখির মনের ভাষা অবুঝ অনিক বুঝে না।

অনিক তার বাবার কাছে বায়না ধরল একটা খাচা এনে দেয়ার জন্য। কারণ সে টুনটুনির ছানাগুলো খাঁচায় বন্দি করে পালবে। অনিকের বাবা চিন্তা করে দেখলো পাখির ছানা লালন পালন করলে হয়তো ছেলের দুষ্টুমিটা একটু কমবে। তাই ছেলের বায়না রাখতে গিয়ে অনিকের বাবা বাজার থেকে খাঁচা কিনে আনলেন। অনিক বাচ্চাগুলো খাঁচায় বন্দি করে রাখল।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শত চেষ্টা করেও যখন মা টুনটুনিটা তার বাচ্চাগুলোকে রক্ষা করতে পারেনি তখন মনের দুঃখে এ বাড়ি ছেড়ে তার নিজ বাসায় ফিরে গেল।

মা টুনটুনি তার বাচ্চাগুলোকে কোন ধরনের খাবার খাওয়ায় তা অনিকের জানা নেই। টুনটুনির ছানাগুলো নতুন পরিবেশে এসে তাদের কাছে অসহ্য লাগছে। একদিকে মা হারানোর বেদনা অন্যদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছানাগুলো ছিঁ ছিঁ করে কাঁদছে। এ দেখে রাতের বেলা অনিক টুনটুনির বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর জন্য কিছু চাউল নিল। তাকে দেখে বাচ্চাগুলো হা করল। অমনি অনিক তাদের মুখে চাউল তুলে দেয়। কিন্তু সে চাউল তাদের মুখে ঠিকমত পড়ে না। তাই অনিক বাধ্য হয়ে একটা একটা বাচ্চা ধরে মুখ হা করে টিপে টিপে ইচ্ছে মতো চাউল খাওয়ালো। একটা বাচ্চাকে এমনভাবে খাওয়ালো যে, পেটে আর জায়গা নেই। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

রাত অনেক হলো। অনিক ঘুমিয়ে পড়েছে। সে স্বপ্ন দেখছে তাকে দুজন সন্ত্রাসী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার মা-বাবা তার পিছে পিছে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও। অনিক নিজেও মা মা বলে কাঁদছে। কিন্তু কিছুতেই তারা অনিকের বাবা-মায়ের কথা শুনছে না। এক সময় তারা অনিকের চোখ বেধে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। অনেক রাত হলে তারা তাকে খাবার দেয়। অনিকের পেটে ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তাদের খাবার খাচ্ছে না। তখন তারা অনিককে গলা টিপে ধরে খাওয়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে অনিক হাউ-মাউ করে কেদে ঘুম থেকে উঠল। কান্নার আওয়াজ পেয়ে অনিকের বাবা-মাও ঘুম থেকে উঠল। অনিকের বাবা বলল, কি হয়েছো তোর কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছিস?

অনিক তখন চিৎকার করছে আর বলছে আমার টুনটুনির ছানা কোথায়? এই বলেই দৌঁড়ে পাখির খাঁচার দিকে ছুটে গেল। খাঁচাটি খুলে দেখলো একটি ছানা মারা গেছে এবং ঐ ছানাটির সারা শরীরে পিঁপড়া কামরাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে সে আরো জোরে হাউ-মাউ করে কাঁদছে।

পরদিন সকাল বেলা তার মামা আমির আসল বেড়াতে। অনিকের মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে। অনিক তার পাখির ছানার ঘটনাটি ও স্বপ্নের কথা তার মামার কাছে খুলে বলে। মামা সব ঘটনা শুনে বলল, দেখ অনিক মা-বাবা যে তার সন্তানকে কত ভালোবাসে তা তুমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছো। আজ সত্যি সত্যি যদি তোমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায় তাহলে তোমার মা নিশ্চয় কষ্ট পাবে?

অনিক মাথা নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ।
তুমিও তোমার মায়ের জন্য কষ্ট পাবে?
হ্যাঁ।
তেমনি টুনটুনির ছানাগুলো ধরে আনাতে টুনটুনির মা-বাবাও নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে তাই না?
হ্যাঁ মামা।
আর বচ্চাগুলোতো তাদের মায়ের জন্য কষ্ট পেয়েছে।
হ্যাঁ মামা।
অন্য পরিবেশে তাদের খাবার দেয়াতেও খেতে কষ্ট হয়েছে। তুমি জোর করে তাদের খাওয়ানোর ফলে পেট ফেপে একটি বাচ্চা মারা গেল। এই কাজটা কি তুমি ভাল করেছে?
অনিক নিশ্চুপ হয়ে গেল।
কি হলো বলো কাজটা কি ভালো হয়েছে? অন্যকে কষ্ট দিলে নিজেও কষ্ট সহ্য করতে হয়। তোমার যেমন প্রাণ আছে ঐ টুনটুনিরওতো প্রাণ আছে।
অনিক অনুতপ্ত হয়ে বললো, মামা আমার ভুল হয়েছে। আমি কাজটি ঠিক করিনি। আর কোনদিন পাখির ছানা ধরব না।
তাহলে এখন তাদেরকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসো।
ঠিক আছে মামা।

অনিক মৃত ছানাটি ফেলে দেয় আর মামার কথামতো মামাকে সাথে নিয়ে অনিক অন্য তিনটি ছানা নিয়ে টুনটুনির বাসায় রেখে আসে। অনিক ছানাগুলো বাসায় দিতেই মা টুনটুনি বাসায় আসল। এসেই বাচ্চাগুলোকে পেয়ে আনন্দে টুনটুন করে উঠল। আর এ দৃশ্য দেখে অনিক ও তার মামার চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু ঝড়ে পড়ল।

রচনাকাল-১৭ আগস্ট ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ।
[শব্দতরী পঞ্চম বর্ষ, ২০১৪, প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত]

বন্ধু


মোহতেশাম ছোট্ট শিশু। বয়স আট কি নয়। সে তার বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় থাকে। এবার সে তার দাদার বাড়িতে এসে ঈদ করবে। সামনে কোরবানির ঈদ। তাই এ উপলক্ষে সে ঈদের দু’দিন পূর্বেই গ্রামের বাড়িতে চলে আসল। মেঘনার তীর ঘেষে তার দাদার গ্রামের বাড়ি।
মোহতেশামের গ্রাম দেখতে খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ হলে যে চলে আসে দাদার কাছে। তখন আর যেতে ইচ্ছে করে না তার। শহরের মত যানজট নেই এখানে। মুক্ত আবহাওয়ায় ছুটাছুটি করতে পারে। নেই কোন বাঁধা। নদীতে সাঁতার কেটে গোসল করতে পারে। আরও কত্ত কি! তাইতো তার গ্রাম এত ভাল লাগে।
শনিবার দিন শ্রীঘর বাজার থেকে তার দাদা একটা কুরবানির গরু কিনে আনল। দাদা যখন বাজারে যায়, তখন মোহতেশাম তার সাথে গিয়েছিল। সে গরুটি পছন্দ করেছে। কুচকুচে কালো ষাড়। নাদুস-নুদুস শরীর। গরু যখন বাড়িতে আনল তখন তার দাদাকে দিয়ে একটা ছবি তুলে রাখল।
ঈদের দিন সকাল বেলা চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। ছেলে-মেয়েদের কোলাহল। কেউতো এ মূহুর্তে বিছানায় নেই। সবাই মেঠে উঠল ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য। সবার মনে আজ শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মোহতেশাম তার দাদাকে সাথে নিয়ে মেঘনা থেকে গোসল সেরে আসল। মা সেমাই পাক করছে। বাবা-মা, দাদা সবাই এক সাথে মিলে সেমাই খেল।
মা পরিপাটি করে মোহতেশামকে কাপড় পড়িয়ে দিলেন। সুন্দর করে চিরুনী দিয়ে মাথা আচরিয়ে দিলেন। তারপর মোহতেশাম দাদার কাছে এসে বললো, দাদা!
দাদা বললেন, কি দাদা ভাই।
– চল আর দেরি কেন? ঈদগাহে যাই।
– হ্যাঁ চল দাদা ভাই।
– তাড়াতাড়ি চল দাদা নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।
দাদা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ তাইতো!
মোহতেশাম নামাজের বিছানা হাতে নিল। দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হলো। নানা রঙের পোশাক পড়ে কচি কচি ছেলে-মেয়েরা ঈদগাহে যাচ্ছে। মোহতেশাম পড়েছে পাঞ্জাবী ও পায়জামা। দাদা-নাতী যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখন একটি গরিব ছেলে এসে মোহ্তেশাম বললো, আমারে একটা ট্যাহা দ্যাও।
ছেলেটির পড়নে একটা অর্ধময়লা শার্ট ও একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। মুখটা শুকনা। তাকে দেখে মোহতেশামের মায়া লেগে গেল। সে ছোট থেকেই গরিব দু:খিকে ভালোবাসে। গরিবের দু:খ দেখলে তার চোখ দিয়ে জল এসে যায়।
মোহতেশাম ছেলেটিকে লক্ষ্য করে বললো, আচ্ছা তোমার নাম কি?
ছেলেটি বললো, আমার নাম রফিক।
– তোমার মা-বাবা নেই?
– ছেলেটির চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, আমার আব্বা নৌকা ডুইব্বা মইরা গেছে।
– আর তোমার মা?
– মা আমারে ছাইড়া আরেক বেডার লগে বিয়া বইয়া গেছে।
– এখন তোমার বাড়িতে আর কে আছে?
– আমার বুবু আছে। তার সাথে আমি থাহি। বুবু হারাদিন ভিক্ষা কইরা যা আনে তাই দিয়া আমডা চলি।
ছেলেটি মোহতেশামের কথার জবাব দিতে দিতে চোখে জল এসে গেল। মোহতেশামের দাদা এসব দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখছেন।
মোহতেশাম ছেলেটির গায়ে ময়লা জামাটার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কি আর কোন ভাল জামা নেই?
– না। ভালা জামা কত্তে আনমু। ঠিকমত তো খাইতেই পারি না।
মোহতেশামের এ দৃশ্য দেখে দাদা ভাবছে, এতোটুকু ছেলের গরিবের প্রতি কত দরদ!
মোহতেশাম তার বাবার কাছে এসে বললো, বাবা আমারতো অনেক জামা। একটা জামা ঐ গরিব ছেলেটাকে দিয়ে দেই?
ছেলের মুখে এ কথা শুনে বাবাতো রীতিমতো অবাক! তারপর বললো, তুমি যদি দিতে চাও, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
মোহতেশাম ছেলেটিকে তার একটা শার্ট ও দশটা টাকা দেয়। ছেলেটি টাকা ও জামা পেয়ে খুশীতে বাহ্ বাহ্ করতে থাকে। সে তার দু’হাত দিয়ে দু:খ ভরা অশ্রু মুছলো। তারপর বললো, আল্লাহ তোমারে অনেক বড়লোক করুক। বলেই ছেলেটি যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আর অমনি মোহতেশাম বললো, আর শোন! তুমি দুপুরে আমাদের বাসায় খাবে।
– ঠিক আছে। বলেই ছেলেটি চলে গেল।
পরে দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহে রওয়ানা হল।
সারি বেঁধে মানুষ ঈদগাহে যাচ্ছে। রাস্তায় যেন আজ লোক জনের ঢল নেমেছে। ধীরে ধীরে ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হলো। দাদা-নাতী দু’জনে পাশাপাশি নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে যখন ইমাম সাহেব খুৎবাহ পড়ছেন মোহতেশাম তা মনযোগ দিয়ে শুনছে। মুনাজাতের পর শুরু হলো কুলাকুলি পর্ব। সমবয়সী ছেলেরা পরপস্পরের সাথে কুলাকুলি করছে। মোহতেশামের ইচ্ছে দাদার সাথে কুলাকুলি করতে কিন্তু ছোট বলে তার দাদার বুক নাগাল পাচ্ছে না। তাই সে লাফ দিয়ে তার দাদার কোলে উঠে কুলাকুলি করলো। দাদাতো নাতীর বুদ্ধি দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
ঈদগাহ থেকে এসেই ইমাম সাহেব গরু জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। মোহতেশামের সমবয়সী ছেলে-মেয়েরা গরু জবেহ দেখার জন্য ইমাম সাহেবের পিছে পিছে ছুটল। মোহতেশামও ইমাম সাহেবের পিছনে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল্লাহু আকবার বলে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। গরুকে যখন মাটিতে শুয়ানো হল তখন সবাই গরুর কাছাকাছি চলে গেল। যখন আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালানো হল; তখন লাফিয়ে দৌঁড়ে চলে আসল মোহতেশাম।
মোহতেশামদের গরুটি জবেহ করার জন্য যখন ইমাম সাহেব তাদের বাড়িতে আসলেন তখন তার গরুটির প্রতি মায়া লেগে গেল। নিরীহ প্রাণীটি আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারে না মোহতেশাম। গরু জবেহ হয়ে গেল। গোস্ত কাটার কাজে লেগে গেল মোহতেশাম। গোস্ত কাটা শেষে মোহতেশাম বেড়িয়ে পড়লো ঐ এতিম ছেলেটির সন্ধানে। ছেলেটিকে খুঁজে বের করলো। এতিম ছেলেটিকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসল। তাদের গোস্ত রান্না হলে তাকে পেট ভরে খাওয়ালো। তারপর তাকে বললো, আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।
এরপর থেকে যখনই মোহতেশাম গ্রামের বাড়িতে আসত তখনই ছুটে যেত ঐ এতিম ছেলেটির কাছে। হাত বাড়িয়ে দিত বন্ধুত্বের।

টুনি ও প্রজাপতি


টুনি তার নাম। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। সে কেবল অ আ ক খ পড়ে। তার একটা বর্ণমালার বই আছে। বইটি খুবই সুন্দর। ছড়ায় ছড়ায় বর্ণমালা দিয়ে বইটি সাজানো। রঙিন সব ছবি। প্রজাপতির ছবি। পাখির ছবি। ফলের ছবি। ফুলের ছবি। প্রতিদিন জানালার পাশে বসে টুনি বর্ণমালার বই পড়ে।
জানালার পাশেই টুনির বাবা একটি ফুলের বাগান করেছে। সেই বাগানে বিভিন্ন জাতের ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। নানা জাতের ফুল ফুটেছে। টুনি প্রতিদিন সেই বাগানের যত্ন করে। বাগানে পানি দেয়।
একদিন টুনি দেখলো, ফুলবাগানে একটি প্রজাপতি আসল। হায়! কি অপরূপ! এমন সুন্দর প্রজাপতি টুনি আগে দেখেনি। কিন্তু এখন দেখামাত্রই সে চিনে ফেলল। কারণ সে তার বর্ণমালা বইয়ে এমন একটি প্রজাপতির ছবি দেখেছে এবং পড়েছে প-তে প্রজাপতি। লাল, নীল, হলুদ, কালো, মেরুনের চমৎকার ছোপ ছোপ সাজের প্রজাপতিটা উড়ছে। ফুল গাছের এ পাতা থেকে ও পাতায় বসছে। উড়ে উড়ে অপরূপ বর্ণচ্ছটাই বিকিরিত করছে দৃষ্টির তরঙ্গে।
হঠাৎ করে প্রজাপতিটা উড়াল দিল। টুনি তাকিয়ে থাকে প্রজাপতি চলে যাওয়া পথের দিকে। ওই তো রঙ্গিন প্রজাপতিটা উড়ে চলে যায় টুনির মাথার উপর দিয়ে অনন্ত পথের পানে। আর তখন টুনি এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

তারিখ: ১৪/০২/২০১৬খ্রি: