কৃষ্ণা মালিক এর সকল পোস্ট

দার্শনিক (তিন)

Photo_1626t

সকাল ৮টা।
ছয় ঋতুতে দেখন-অভ্যস্ত ছয় রূপ তার। দিনে যেতে আসতে দু-বার দেখা। আমাকে দেখেই হেসে ওঠে। গাঁও বুড়োর মতো হিরণ্ময় বলিরেখা জাগিয়ে প্রতিদিন এক কথা, “খবর বলো, খবর বলো –!”

দূর! তোমায় কী খবর দেব? তুমি তো আসমানসম নীরব। তবু দিগন্ত ছাড়িয়ে পাখিডানা চোখে দুনিয়া দেখে নাও। সব খবর তোমার কাছে। তুমিই দেবে।
“সময় খারাপ”।

মানে ধরি না কথাটার। সবাই বলে সময় খারাপ। বাবা বলেছে। ঠাকুর্দা বলেছে। সময়ের চির সাবু-বার্লি, সে মাছের ঝোলভাতে কোনোদিন সেরে ওঠেনি। তাই এটাই বৈশ্বিক স্বাভাবিক।

“একদল চলে যায় তীর্থযাত্রীর মতো আলপথ ধরে। একদল আসে। তাদের দেখি, তবু ঠিক চিনি নাকো। তারা যেন বিশেষত্বহীন মানুষপিণ্ড। শুধু ভেতরে কেউ কাঁকনঝুপুস পা, গেরুয়া প্রান্ত দেবদারু, গোপন ছোরার শ্বাসনালী। চোখে শিশির ঝরা লবনাম্বু, কিংবা আপাদমস্তক গড়িয়ে যাওয়া দাউদাউ টায়ার।

কেউ দেখে না সর্বংসহা তৃণ সবুজে ভেঙে পড়ছে। কাপড় জড়ানো ফুটবল পায়ে উড়ে বেড়ায় ফড়িং। আকাশ উথলে হাসিখুশি জলরঙ। সবাই হেঁটে যায় অপরিচিতের মতো”। তার এসব কথা শুনতে শুনতে আমি পার হয়ে যাই। বিদায় জানাই। ও পাশ ফিরে শোয়।

.
“বাইফোকালিজম্ এ প্রথম প্রকাশিত”

সজল চোখের হাম্বারব (দুুই)

Photo_1626

সকাল দরজা খোলার পর থেকে তারাদের রান্নাবাটি শুরু হওয়া পর্যন্ত। সদর দরজায় মাটির রোয়াকে বসে থাকে তো বসেই থাকে। আনা। সারাদিনে ওর সঙ্গে একবার দেখা হবেই। সবার সঙ্গে তার কথা, অবিরত মুখ দিয়ে লালের সঙ্গে ঝরে। ওর কথা না বুঝলেও হৃদয় বুঝি, তাই কিছুক্ষণ বলাটা অভ্যাস।

ঠোঁট ঠেলে বেরিয়ে পড়া উঁচু অপরিচ্ছন্ন দাঁতে অনাবিল হাসি। সদ্য গাইএর বাৎসল্যে চোখ হাম্বা ডাকে। সামনে দিয়ে যে কেউ যাক, তাকেই সে উপহার দেয় ওই হাসি আর কথা।

অন্যথা শুধু দেবুর বেলা। ওই রাস্তা তার নয়। ও রাস্তায় সে গরল ছড়ায়। ওই রাস্তায় দেবু জীয়ন্ত মানুষকে মরণ দিয়ে গাঁথে।
দেবু নিষ্ঠুরতা করে আনার সঙ্গে। – “আনু, ও আনু! তোমার বৌদির সঙ্গে একবার দেখা করে এসো। তোমাকে সে যেতে বলেছে।”

আনুর নরম চোখে কঠিন আগুন জ্বলে ওঠে। কুঁজো পিঠ তুলে বাঁকা বাঁকা হাতে ঢিল কুড়িয়ে আক্ষেপ আর অপমান ছুঁড়ে মারে। অবিশ্রান্ত চিৎকারে আর কান্নায় ছটফট করে।
দেবতার পিঁড়ি নড়ে যায়, দেবু না! সে তখন হাসির ব্যাপারি।

দেবু যেদিন বিয়ে করে ঠাকুরতলায় জোড়ে প্রণাম করতে এলো, সেদিন আনার অন্ধ নৌকো ঝড়ের রাতে। কেঁদে, হিজিবিজি বকে ইশারায় বলেছিলো ও দেবুর বিয়ে মানতে পারছে না। দেবুর বৌ ও-ই হবে! অবাক না হবার মতো লোকের অভাব ছিলো। দুঃখবোধ ব্যাকরণ খুলেছিলো কেউ কেউ। কেউ শুধু সাদা চোখে আকাশ দেখেছে। কিন্তু কেউ তার দুঃখ সারিয়ে নৌকো তীরে আনেনি।

.
“বাইফোকালিজম্ এ প্রথম প্রকাশিত”

গৃহিণী (এক)

Photo

শুধু রান্নাবাটি। আর ছুটন্ত ঘোড়া ,কিংবা ফুল- প্রজাপতি ঘরের এখানে ওখানে যেখানে যেমন মানায় ঘড়ির সঙ্গে টিক্ টিক্ করতে করতে। কঠিনপাচ্যের ইংরাজী ফেল। তার বদলে আসান বোনা, রিফু করা, কাঁথা সেলাই। কুরুশ কাঁটায় পুজোর থালার খুঞ্চিপোষও। … কাঁটায় কাঁটায় ঘনিয়ে আসে ঝড়ঝঞ্ঝা – চারপাশে জেগে থাকা বাঁকা নখ। উগলে আসা কালচে রঙা ডলি সুতোর কঠিন পাক – বাদলা দিনের আগুন – আর একলা হলে জ্যোৎস্নায় পোড়া তরকারির গন্ধ।-বুনতে বুনতে নিজেকে ছাড়িয়ে যায় নিজে।

থতমত সর্বদা। যেন শুকনো পাতা হাওয়ার টানে গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় যে যাবে বোঝে না! মন – একটা ঝুপসিকোণা দোনামোনা মেঘ।ঝরবে, না কি ঢোঁক গিলে নেবে? কেউ যখন বকে দেয়, টেনে হাওয়ায় একটাও কথা ছুঁড়ে দিতে পারে না। তখনই কথা বলতে গেলে চোখ থেকে ঝরে পড়ে।

কেউ এগিয়ে দেয় নি যত্নের থালা। বরং সবার গ্রীষ্মদিন নিভিয়ে দিয়েছে তেলহলুদ লাগা আঁচলে। এই আর কি! দুঃখসুখের পাঁচমিশেলি গেরস্তবাড়ির বড় বৌ। তবু গৃহিণীরা কিছু বেশি খোঁজে। শুধু চেনে না ‘বেশি’টা কী?

অথচ তারও তো কিশোরীবেলা – ? রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছুটন্ত ধুলো, আর ফ্রকের কুঁচি খেলেছে হাওয়ার সঙ্গে? এখন পানের তবক মোড়া দুপুরে খোলা চুলে পিঠ ঝাঁপানো রোদ। তবু নিজস্ব আছে কিছু গোপন বাক্সবন্দী।

একদিন মরচে রঙা সুর ভাসানো তোরঙ্গ খুলে পুরোনোর গন্ধ নিলো। বাক্স ভর্তি জল। জলের শয়ানে এক বুড়োর ছবি আর একটা পাথরের হার। ছবি তার বাবার। বুড়ো কোথায় নাকি খাঁচার দাঁড় কেটে চোখ ছানতে গিয়ে এনে দিয়েছিলো তাকে। পাথর থেকে গোলাপি রঙ ঠিকরোচ্ছে। তার আভা যত তার গালে লাগে ততই চোখ থেকে গঙ্গোত্রী গলতে থাকে।

ছবি হাতে নিয়ে সাত চড়ে রা না কাড়া ঠোঁট কুরুশ কাঁটায় কথা বুনতে থাকে একা একা।

.
“বাইফোকালিজম্ এ প্রথম প্রকাশিত”

বিভাজন রেখা

কী-ই বা যায় আসে যখন কেউ ঝকঝকে কলারের নীচে বেখাপ্পা ময়লাটে গেঞ্জি পরে
আগডোম বাগডোম ঢোলের সঙ্গে সঙ্গতে নেমে পড়ে?

আসলে বিভাজন শব্দটা একটা সর্বৈব সত্য, কলার আর ময়লা গেঞ্জির মতোই।
বাংলা কবিতা যেমন ইংরেজির মাস্টারমশাইদের হাতে শায়েস্তা হলো, থুড়ি ফুল ফোটাল!
তারপর বিষয়টা খুব কলার তোলা গরিমায় মোলায়েম ফ্যালাসি পর্যায়ে চলে গেছে।
সুতরাং লাঙ্গল তুলে ধরা ছাড়া বাংলার গেঁয়ো গণ্ডমুর্খের দল করবেটাই বা কী!

কলকাতার সত্যপীরের দরগায় লম্ফ জ্বলছে
মুশকিল আশানের। সেই আলো দেখে যে কোনো গন্ধপ্রিয় মাছি তো ছুটবেই।

বউকথা

জানলা খুলে ফেলেছি। সামনে লাফিয়ে উঠল তুষারের দেশ।
আর তুষার ঢাকা গাছে একটি হলদে বৌ অনেক বৈভব নিয়ে এসে বসল বেশ!
বৃষ্টি হলেই তো সে আসে বলে জানি।
তবে কি আশা আছে বউঠাকুরাণী?

পাত পেড়ে আবার বসব ঢলে পড়া দুপুরে পংক্তিভোজনে!
কান্নার ঝরনাগুলো আবার লাফিয়ে উঠবে আর সাত রঙ নেবে চিনে।
শুধু দিগন্তের কাছাকাছি উড়তে থাকা পাপিয়াটি একবার প্রকটিত হও,
শুধু একবার বলো, বউ, কথা কও!

প্রাণ আছে

index

প্রাণ আজও আছে বলে
খিদের অবিনাশী পাত্রে শব্দ ওঠে – ভাত দে – ভাত দে – ভাত
কালো ছায়ার ফেনা মাথার উপর দাঁড়িয়ে
তিনপা মাপার নিপাট অভিনয়ে
দাবি করছে সমস্ত রাজপাট।
আমি বিশ্বাস করিনি সে সর্বগ্রাসী রূপ,
দেখি বন্ধুদের চোখে জাগিয়ে তুলেছে সেই ছায়া।
এরপর আর কোন্ কররেখায় মাপি আলো?

এই ঘনঘোর রাতে এসেছি হেঁতালের বনে,
ভেবেছি ভালো হবে
লোহার বাসরঘরের সব ছিদ্র বেঁধে ফেলবে
অশ্রু লুকিয়ে তৃতীয় নয়নে
সব পাপ, সব ভোগবন্দনার মানুষী লোভ
ভেঙে দেয় বেঁধে বেঁধে থাকার সব শেকল।
লুকোনো অশ্রু এবার আগুন জ্বালো

জৈষ্ঠ্যের দায়হীন আঁধারে পুরোনো নদীজলে
ডুবিয়ে দিই অহঙ্কারী উপবীত, তবু আছে আমারও দায়
আর কেউ যেও না – আর কেউ যাবে না অসময়ে
ভাতের হুতাশে বা মারীর গ্রাসে
দেখে যেতে চাই –
সব রঙিন অক্ষর আকাশ সাজায়।