কৃষ্ণা মালিক এর সকল পোস্ট

স্বতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য সুপিরিয়রের মধ্যে ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স তৈরি করে দেয়

শৃঙ্খলা নামক শৃঙ্খল সুপিরিয়র নামক এককের যাবতীয় ক্ষমতার চাবিকাঠি। আসলে সুপিরিয়র মাত্রেই আধারিত ক্ষমতা। আবার উক্ত একক একটা জেলখানা বা খোঁয়াড়ের পাহারাদার ছাড়া আর কিছু নয়, যা তার কর্মক্ষেত্র। শৃঙ্খলা তথা শৃঙ্খলের বাইরে বের হতে চাওয়া কোনো স্বতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য তাই সহ্য করা কোনো ‘ক্ষমতা’ বা সুপিরিয়রের পক্ষে দস্তুর নয়। হায়ার্কির সকল অধস্থানীয় এবং তার বাইরের সাধারণদের খড়-ভূষি দেওয়া হবে, চকচকে দড়ির গলান দেওয়া হবে, অথচ সেসব অস্বীকার করে খোঁয়াড়ের বাইরে ঘুরে বেড়তে চাইলে কেউই তা মানবেন না।

বিশেষ্য ও বিশেষণ আছড়ে পড়বে খোঁয়াড়ের বাইরে যেতে চাওয়া যে কোনো স্বতন্ত্রের পিঠে! স্বতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য সুপিরিয়রের মধ্যে ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স তৈরি করে দেয়, তখন তাকে গুরুত্ব না দিয়ে সুপিরিয়রের উপায় থাকে না। আর সেখানেই সুপিরিয়রের সব মহিমার ভাঙচুর ঘটে যায়। তখন ঠ্যাঙা নিয়ে তারই পিছনে পড়ে থাকবে সেই সুপিরিয়র। সমন পাঠাবে, পেয়াদা পাঠাবে, জেলখানার ভিতরের জেলখানায় ঢুকিয়ে দিতে চাইবে। আসলে সুপিরিয়রের প্রতি যখন সে আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারছে না, তার ঘাড় বেঁকে যাচ্ছে, এবং কিছু প্রশ্ন সত্যের সরগম ছুঁয়ে ফেলে সুপিরিয়রকে বিদ্ধ করছে তখন সুপিরিয়রের নখ-দাঁত তার ঘাড়ে বসে সেই অসহায় ঘাড়টিকে ভেঙে ফেলতে চাইবে এ তো ক্ষমতার অলিন্দে স্বাভাবিক তরিকা! কারও স্বাতন্ত্র্য ‘ক্ষমতা’র না-পসন্দ। ধমকে কাজ না হলে লাইনছুট তৃণভোজীকে বংশদন্ডের প্রহার করা ছাড়া উপায় কী? নিয়ন্ত্রণের কব্জায় না আনা পর্যন্ত সুপিরিয়রের শান্তি নেই। যেখানে যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করে তার হেঁটোয় কাঁটা, জোড়া হাত পিছন দিকে বেঁধে, আর সেই অদ্বিতীয় ‘ঘাড়’ সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে স্বতন্ত্রকে বসিয়ে দিতে পারলে তবেই তো সুপিরিয়রের সাফল্য! বলির বাজনা বাজবে দ্রুত ঝাঁপতালে, আর সুপিরিয়র খড়্গের রক্ত মুছে প্রচন্ড কাপালিক – রক্তাম্বর, কপালে বড়ো করে সিঁদুরের তিলক, ঘামে চকচকে মুখ …। সিংহাসনে বসে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে নাচাচ্ছেন আর মুখে আত্ম প্রসাদের হাসি।

কিন্তু ‘স্বতন্ত্র’ স্বতন্ত্র বলেই নির্ভয়। সুপিরিয়র যতই পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতে চাইবে, ততই সে শক্তিশালী হবে। সুপিরিয়র প্রতিবার হারবে। হারবে যত তত নিজের ক্ষমতাও জাহির করবে।

আমার রবীন্দ্রনাথ

_11

সদ্য রবীন্দ্র তিথি গেলো। সবাই তাঁকে নিয়ে পোস্ট করছেন। আমারও শখ হলো পোস্টাতে। একটা বছর তিন-চারের পুরোনো, প্রকাশিত লেখা।

আমার রবীন্দ্রনাথ
ভালো বই শিক্ষকের সমান। যে মানুষ বই পড়েন তাঁর অনেক শিক্ষক। আমাদের মাথার উপর অনেক দিকনির্দেশক ছায়ার হাত ছিল। সেইসব হাত আমরা ঠেলে সরিয়েছি। অধীত জ্ঞান আর বিদ্যাকে জীবনে ক’জনই বা প্রয়োগ করতে পারি? শুধু সব অনুভবের অনুভবী সর্বগ্রাসী রবীন্দ্রনাথকে সবটুকু ঠেলে ফেলতে পারি নি।

আজ ঘর-বারের এমন ওলঢাল দেখে তোমাকেই রবিঠাকুর, মনে পড়ে যায় গো ! সামনে – কাছে – দূরে অজস্র যে পথ ও জীবন, – সব দিকেই তোমার বাণীমূর্তি। তোমায় কত সামান্য পড়েছি, কত সামান্য পরিমাণে ভেবেছি। তোমার ভাব আর অনুভবকে ধারণ ও বহন করতে না পারার দীনতা আমার। তবু যেটুকুও ধরা দাও – সে তোমারই প্রসাদ গুণ।

“সহজ পাঠ” দিয়েই জীবনের শুরুতে সুষমাকে চিনেছিলাম। তারপর “শিশু”, “শিশু ভোলানাথ”…! বইএর পাতা থেকে চট করে আঙুলটা সরিয়ে নিয়ে রহস্যময় হাসিটি হেসে, ‘দাঁড়াও, এক্ষুনি আসছি। ততক্ষণ তুমি …” বলেই ধাঁ হয়েছিলে।

তারপর এই অকূল সমুদ্র-তীর। কড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছি, তেষ্টায় ছাতি ফাটছে। পা পুড়ে যাচ্ছে তপ্ত বালিতে। কত কথাই বলে চলেছি তোমার উদ্দেশ্যে, সেসব কথার পাতা হাওয়ার পাগল উড়িয়ে দিল এদিক ওদিক। অথচ দেখ, একটা যদি মেঘছায়া দিন হতো ! … ধরো, খুনসুটির বাতাসে চুল উড়ছে – আঁচল উড়ছে… গাছের ডালে সবুজ কচিকাঁচারা কী উজ্জ্বল! আহা! কেন এমন করে পা ভেজানো নীলাম্বুরাশি আমায় খুশী দিল না বলো তো?

শুধু দেহে নয়, মনেও তো বাঁচতে চাওয়া! আমার মনের কোনে – বাইরে দূরে – আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যত – আমার সকাল সন্ধ্যা – আমার গ্রীষ্ম বর্ষা – সব স-ব-খানে, আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় তোমার পদছাপে চোখ রেখে পথের নির্দেশ পেতে চাইলাম। ভাঙা নৌকায় বৈঠাহীন ঝড়ের রাতে তুমি একটিবার এলে না, ব্যর্থ অভিসার! তবু তোমাকেই বিশ্বাস করতে চেয়েছি যে, সবই শেষ পর্যন্ত পরমের দিকে এগিয়ে যায়।

সারা শ্রাবণ মাথায় নিয়ে একা জিওল রাস্তায় গোধূলি ভেঙে চললাম কোনো এক শৃঙ্গজয়ের দিকে তাকিয়ে। তুমি কুপি জ্বেলে দোরে এলে, আর যদিও তোমার খোয়াই সাজানো ভেজা দুয়ারে বসতে পারলাম এক মুহূর্ত, তবু ভবিতব্য এই যে, বর্ষাভেজা হাঁসশরীর সেই গেরস্থালীর পালকই ঝেড়ে চলেছে।

কার জীবন কে যাপন করছে তা-ই বুঝি না! তোমার কুমুদিনীকে মনে পড়ে যায়। জাগরণে কাতরাতে কাতরাতে জ্বালা জ্বালা চোখ খুলে প্রস্তুত হই। তার মতো করে ভাবি যে স্বামীসঙ্গে সফল করে তুলব আজকের যাপন, তোমার লাবণ্যর মতো পেলব করে তুলব – ইহ গচ্ছ ইহ তিষ্ঠ – সে দিনটি। অথচ সেই দম দিয়ে দেওয়া পুতুল। ক্রমাগত ছুট ছুট রান্নাঘর – নিজের ঘর ( নিজের!) – খাবার না দেখেই মুখ থেকে দু-গ্রাস পেটে চালান। তারপর ঘাম মুছতে মুছতে চক-ডাস্টার। যদি পড়াতে চাইলাম কবিতা, কিংবা কম নম্বর পাওয়া মেদুর চোখের ছাত্রীটির মধ্যে ফটিককে দেখে কাশের ডাঁটা চিবুতে চিবুতে নদীর ধারে হাঁটতে চাইলাম, অমনি সিলেবাস দরজার সামনে কড়া চোখে এসে দাঁড়াল। … দিনশেষে দেখি সব প্রস্তুতি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছেন “মধুসূদন”। তোমার কথা মানলে হয়তো এও ব্যর্থ নয়!

অন্ধকার ঘরে কখনো কখনো তুমি সাগর সেন বা দেবব্রত-র গলায় বেজে চলো। সারারাত। আমি যখন তোমাতেই বাস করি, যখন আবদার করি, সপসপে ভিজে কাঁপতে থাকা আমাকে তুমি শুশ্রূষায় টেনে ভিজে মাথা মুছিয়ে দাও তোয়ালেতে – তখন আমার পিতা তুমি। আমার জ্বরো কপালে জলপট্টি দিয়ে কখনো তো পাশে বসেছ মায়ের মতো! আর ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যখন বেজেছে, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়’, পরানসখা, আমার হাত ধরে পথ চলার অঙ্গীকার চেয়েছি।

তুমি ‘আসছি’ বলে চলে গেলেও আমি বাধ্য ছাত্রীর মতো সেই পাঠ থেকে তোমার অসীমের দিকে যেতে চেয়েছি – তোমাকেই ছোঁব বলে। সেই এক রহস্যময় হাসি আমার প্রাণে সুর তুলল। নির্জন, একান্ত নিজের দুপুর আর রাতগুলোতে উপভোগ করি তোমার নির্মাণের পাকা কতবেল; সেসব সেই ধুলোবেলা থেকেই সব উপকরণে মজে উঠেছে।

মাটির ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে একদিন দেখে ফেলেছি “জনহীন প্রান্তর” পার হয়ে “জ্যোৎস্না সমুদ্রের” চাঁদের নৌকো আমার ঘাটে এসে লাগতে। ‘সহজ পাঠ’ কতটা সহজ হলে মদিরতার মউল ফুল ছড়িয়ে পড়ে বালিকা হৃদয়েও। কাল যে ডাল খালি ছিল আজ কী করে ফুলে ভরে বিস্ময়ের পরম্পরায় সে অবাক ঘোর আজও কাটল না। গাছের ভেতর রয়ে গেল সম্ভাবনার কুঁড়ি। বায়োস্কোপে একটার পর একটা পালটে যাওয়া ছবির মতো কবিতায় পরতের পর পরতে কল্পনার দৃশ্যপট খুলে গেছে। আবার গদ্যে অনুপ্রাসের ঠমকে বোষ্টমী, বিশ্বম্ভরবাবু, শম্ভু, নিস্তারিণী দেবীর কাহিনীর রসের ভাঁড় টুপিয়ে হাতের খুদে তালু শুধু ভরে দেয় নি, মনের কোণে ছন্দের মৌমাছিও চাক বেঁধে ফেলেছিল। তাই স্বীকারোক্তির পায়রা উড়িয়ে দিই – মধুর তোমার শেষ যে না পাই -।

তুমি ডাক শুনেছিলে ‘জীবন দেবতার’। আমি আসি তোমার ডাকে। “স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে …” – তাই কি ডেকেছ, আমার প্রিয়টি?

আধভাঙা চাঁদ ভাসিয়ে দিচ্ছে চরাচর। পিউ কাঁহা বুকের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা রোদনপুঞ্জ ভেঙে দিচ্ছে কাতরতা দিয়ে। বেদনার সুখ এত মধুর! তুমি এত শেখাও তাকে কী করে আঁজলা ভরে চুমকে পান করতে হয়। বেদনাকে সানন্দ নান্দনিক করে তুলে কতখানি বিশ্বজনীন করা যায় তা তুমিই দেখালে। তবু শিখতে পারি নি, বরং নৈর্ঋতে বা ঈশানের দিকে পালিয়েছি কতবার! তার মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে পারি নি। তুমি আমার পালিয়ে যাওয়ার পথে পথে গাছ হলে, হাঁফধরা কর্মক্লান্ত চাষির মতো একটু জিরিয়ে নিতে বসেছি তোমারই ছায়াতলে।

তুমি শিখিয়েছ ‘আমি ‘ও ছোট নই। তুমি বললে ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।’ ‘অসীম ধন’ তোমার হাতে, সে ধনে আমারও যে সত্ত্ব – ইচ্ছাপত্র লিখলে। তাই নিজেকে চিনতে নিজেকেই চিঠি লিখি ; ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে, রেখার পর রেখা টেনে সম্পূর্ণ করে দেখতে চাই। এসবের সঙ্গে তোমাকেও পড়ে চলেছি, চিনে চলেছি। তুচ্ছ এই আমার ‘আমি’কে চেনাজানারও শেষ নাই। একটা ক্ষয়া হলদেটে পাতার আকাশের সীমা ছোঁয়ার ক্ষমতা কোথায়?

তোমার কড়ে আঙুল ধরে আসন বগলে ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর ধপধপে উঠোনের লেবুতলায় গিয়ে বসেছিলাম। তুমি অপেক্ষায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে। একদিন বাসস্টপে বাসে তুলে দিয়ে হাত নাড়লে।… বাড়ি ফিরতে দেরি হলে শাসন করলে। তারপর যেদিন জানলা জুড়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার দিন, বুকের ভেতর চাঁদ আটকালো – সেদিন আবার বুঝলাম তোমার কাঁধের বিস্তার। সহর্ষ রাত কাটিয়েছি নির্ঘুম। ডালপালা মেলে তুমিও সারারাত জেগে থেকে প্লাবন সামলালে। আনন্দে – বেদনায় – হতাশায় – জয়ে – পরাজয়ে তুমি আমার কাছে দু-এক কলিতেই ফিরে ফিরে আসো আমার ধারণ ক্ষমতা খুব সামান্য বলে! আমার খরচের বহর, চার্বাক মেনে ঋণের পর ঋণ জমে যায় তোমার কাছে। শুধতে ভারি ভয়েই গেছে! সেই ঋণেই তো জীবন চলছে।

তবু এই দরিদ্র আমি কতবার বলেছি, ‘তোমায় কিছু দেব বলে চায় যে আমার মন / নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন’। দ্যাখো, মন কেমন টুসটুসে হয়ে গেল! ভালো লাগার কবোষ্ণ হাত পাঁজর ছুঁয়ে গেলে চিরকাল কেন কান্না পেল, ঠাকুর?

মরা ব্যাঙের নাচ

মাঝে মাঝে আমায় বোবায় পায় বলে বাক্যি হরে যায়। মুখে তখন একটা অদৃশ্য ‘কালা হাতে’র মতো সেলোটেপের অস্তিত্ব টের পাই, আর বুকের উপর দিয়ে গোদা পায়ে কেউ নির্ঘাত হেঁটে চলে যায়। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তরে একখানা অক্ষর পর্যন্ত মুখের পেট থেকে খসাতে যন্ত্রণা ও চরম অনিচ্ছা। ফলত অন্তর্জলি যাত্রায় বসা লোককে গঙ্গোদক দেবার সময় যেমন নূন্যতম ঠোঁট ফাঁক করে ঢেলে দেওয়া হয়, আমিও তেমনি আধমরা ঠৌঁট ফাঁক করে উত্তর দেব দেব করতে করতেই টাইম আপ! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই আমি আসলে মুখ ভেটকে গেলাস ভর্তি নিমপাতার রস গেলার মতো একটা এক্সিসট্যান্স। সুতরাং কথা খরচ করতে হলে আমি একেবারেই নাচার।

একই অবস্থা হয় লেখার বেলাতেও। একখানা অক্ষর লিখতেও আঙুল চলে না। খাতায় কলমে লেখা তো কবেই বিগত শতাব্দীর গোলাপফুল আঁকা মরচে ধরা তোরঙের মতো গতায়ু হয়ে চিলেকোঠার ঝুল ধুলোয় কিছুটা কেতড়ে পড়ে আছে। তার উপর ঠাকুমার গায়েহলুদে পাওয়া মাদুরখানা কাঠি ও সুতোর বাঁধন আলগা হয়ে গুটনো আছে মণখানেক ধুলো মেখে। তাকে দেখে মনে হবে একদা অষ্টাদশী বিয়ের কনেটি রূপ-যৌবন ও তৎসহ পেশিটেশি হারিয়ে ঝুল, মানে ঝুলঝুলে চেহারাপ্রাপ্ত। খাতা-কলম জিনিস দুটোর এখন অনেকটা সেই দশা। কেবল মাঝে মাঝে সরকারী ফাইলের অন্তবিহীন গতিহীন লাইনে লাইন লাগানোর জন্য দরখাস্ত-টরখাস্ত লিখতে দরকার লাগে। তো লিখতে ইচ্ছে করে না যেমন তেমন বিষয়, তার থেকেও বড়ো কথা হলো মনে হয় যেন লিখতেই পারব না। – আমি লিখতে জানিই না – কোনো দিন লিখিইনি! এসব ভাবনার পাশাপাশি প্রচন্ড একটা ভয় জেঁকে বসে।

ধরুন, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। বড়দি ক্লাসে ঢুকছেন, এক্ষুণি রেজাল্ট ঘোষণা হবে। আর ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। মানে চোখ মাথায় উঠে গিয়ে মাথা লাট্টুর মতো ঘুরছে আর থেকে থেকে দ্যাখ বাবাজী দেখবি নাকি করে চোখের সামনে অন্ধকারের ভেতর বিদ্যুত ঝিলিক মারছে। কারণ আমি তো জানি, কী হতে চলেছে! ক্লাস ফাইভে অঙ্কে ছিলাম গ্যালিলিওর জ্যাঠাইমা। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে ঘন্টা পড়ার দশ মিনিট আগে হল থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং অনেক হিসেব করে আমার ধারণা দৃঢ় হলো অঙ্কে চব্বিশ পাবো। কিন্তু সবথেকে বড়ো ট্রাজেডিটা হলো, অঙ্কে মেরেকেটে তিরিশ পেলেও আমি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে গেঁটিয়ে বসতে পারতাম। কেন, কীকরে সে অন্য গপ্প। তো বারফাট্টাই থাক। বড়দি তো রেজাল্ট বলছেন, – বলছেন – ভালো ভালো রেজাল্ট বলা হয়ে গেল, নিজের নামটা কানে শুনলাম না। নাকি নিজের নামটাই ভুলে গেছি রে, বাবা! তাহলে কি আমার ধারণাই ঠিক? টেনশনে নন-সেন্স হবার মুখে প্রায় সব শেষে একটা বিষয়ে ফেল মেরে উত্তীর্ণ হবার ঘোষণায় আমার নাম এক্কেবারে পেত্থমে! হুঁ হুঁ বাবা! এরপরের ঘটনা ইতিহাস। অঙ্ক শিখি যে কাকুর কাছে তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে উত্তমমধ্যম খেয়ে মুখের ভূগোল পাল্টে গেল বটে, ক্লাস সিক্সে কিন্তু এ শম্মাই অঙ্কে হায়েস্ট নম্বর পেল এটাও মনে রাখবেন! তবে জীবনে ওই একটিবার। তারপর মাধ্যমিক পর্যন্ত ঘষটে ঘষটে মাজা ব্যথা নিয়ে অঙ্ক টপকেছি।

কিছু মনে করবেন না, এক কথা বলতে বসে অন্য কথায় কিস্যা বহুদূর চলে এলো। একেবারে “শিবেরগীত” শেষ করে বাঁকের মুখ থেকে ফেরৎ আসছি। যা বলছিলাম, লেখার ভয়ে তো হার্টবিট মাথায় ফিল করি আমি। নানা জায়গাতেই ফিল করি, এমনকি যেখানে হার্ট আছে তার ঠিক উল্টো দিকেও ঢিপ ঢিপ করে। মানে বাম দিকের বুকের পাঁজর পার করে পিঠের দিকে হার্টবিট চলে।

দূর ছাই! আবার ফালতু বকছি! বলছিলাম লেখা ও কথা মাঝে মাঝে মনের ভেতর হুুড়কো লাগিয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে। সন্দেহ হয়, অ্যালঝাইমার হলো নাকি! একটা শব্দ, একটা ইনিয়ে বিনিয়ে বাক্য – কিচ্ছু মনে পড়ে না মাইরি! অথচ বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে লিখেছিলেন – ঐক্য বাক্য মাণিক্য। কিন্তু আমার তো সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হার্ট ফুসফুস কিডনি মগজ – সব ছতিচ্ছন্ন। সুতরাং ঐক্য ও বাক্যের হাত ধরাধরি প্রেমের মাণিক্য আসবে কোত্থেকে?

অথচ কথার চাষ চলছে দুনিয়াময়। কত ধরনের কথা। রূঢ়, প্রেমময়, স্নেহময়, তৈল নিষিক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খুব ভালো উপলব্ধি হয় উক্ত ধরনগুলি। আর দরকারী কথা বাদ দিয়ে ফালতু কথায় তীরের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে, না-কে হ্যাঁ, আর হ্যাঁ-কে না, দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারে এমন এলেমদার কি কম পড়েছে? রাজনীতির লোকেরা আছেন তো! পড় পড় পড় পড়বি পাখি ধপ! – চোখ সরু করে মনে মনে বীজমন্ত্র আওড়ালেও, পাবলিক প্লেসে কথা বলার সময় সাধারণত কপালের চামড়ায় ইস্ত্রি মারা থাকে।

আর যারা কথা বেচে খান, সে সেক্টরটাও নেহাৎ কম যায় না। কাউকে একটুও ছোট করার নটখটামি না করেই হাত তুলছি, ছাড়ুন তো – কথা বেচতেও “এলেম” লাগে আগেই বলেছি! সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে। কত সূক্ষ্ম হিসেব কষতে হয় বলুন তো? দল, অর্থ, টিআরপি, কাকে চটাবে, কাকে রাখবে – তেমন তেমন ঘটনা ঘটে গেলে অচানক চানক্যবাজি সহজ নয়। আরও আছে, শুধু ওরাই যে নন সে যে বাপু আর বলে দিতে হবে না, তা আপনারা খুব ভালো করেই জানেন।

দুঃখ হচ্ছে, “কথা বেচে খাওয়া” লোকজনের কথা বাদ দিলে কথার চাষ অধিকাংশ সময় শব্দদূষণ ছাড়া কিছুই করে না। কারণ ঠিক কথাটা ঠিক সময়ে আমরা সম্মিলিতভাবে বলতে পারি না। হয়তো বা বলতে চাইও না। ছা-পোষা মানুষ আমরা, বাঁশ খেতে চাই না, বড়ো ভয় পাই কার লেজে কখন পা পড়ে যাবে ঠিক কী! হতে পারে সে কোনো গনহত্যা বা এককের উপর অবিচার। হতে পারে কোনো কোটি কোটির ঘাপলা কেস। আমরা ফুটানি করি, ট্রোল করি, ফাজলামি করি – এই পর্যন্ত। আবার ধরুন, হয়তো আপনাকে কেউ বেশ দু-কথা বলল, আপনি ঠিকই বুঝলেন, সে লোক যতই দাঁত কেলিয়ে বলুক না কেন, কথাখানা অপমানেরই। অথচ আপনিও দাঁতটাই কেলালেন, কিন্তু উপযুক্ত যে কথা দিয়ে তাকেও আচ্ছা করে কেলানো যেত, সেটা পরে মনে করে নিজের মনেই ফুঁসবেন। তখন গালাগালটা যে অ্যাকচ্যুয়েলিই কেবল নয়, বরং “দুইচ্যুয়ালি”ই নিজেকেই দেওয়া উচিত সেই মুহূর্তে ফিল করে নিজের গালেই চড় কসাবেন।

কথা না বলেও যথেচ্ছ প্রতিবাদ করা যায় বটে! ভেরকরের বই পড়েছিলাম, সাইলেন্স অফ দ্য সি। অনেকদিন আগে পড়া। স্মৃতি ল্যাং দিতে পারে, তবু যদ্দূর মনে হচ্ছে ঘটনাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। ফ্রান্সের এক গ্রামে জার্মানীর সৈনিকদের সঙ্গে কেউ একটি কথাও না বলে নিরুচ্চার ঘৃণা দিয়ে তাদের ইগো দুরমুশ করে দিয়েছিল গ্রামবাসী। তাই কথার সঙ্গে সঙ্গে নৈঃশব্দও হাতিয়ার হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে। আমরাও যদি পারতাম, অসৎ রাজনীতির লোকেদের নিঃশব্দে উপেক্ষা করতে!

সংসার রাজনীতিতে কথার চাষাবাদ, সার-চাপান, ল্যাং মারামারি হামেশাই চলে। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনের কিংবা রামায়ণের যুদ্ধুর ব্রহ্মাস্ত্র, দিব্যাস্ত্র, ব্রহ্মানন্দ অস্ত্র, শিলীমুখ, ঐশিক, অশ্বমুখ ইত্যাদি হরবখতই কথার ধনুকে পরিয়ে বেমক্কা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। তাতে ঘায়েল হয়ে অসার জীবনসহ দিল দরিয়ায় ভেসে যেতে চায় বটে, তবে অচিরাৎ মৃতসঞ্জীবনী আমাদের দিব্যি বাঁচিয়ে তোলে। বেড়ালের নটা জীবন তো সংসার রণাঙ্গনে বাঁচার ফিরিস্তির তুলনায় নস্যি।

তবু এক একসময় দুম করে আঁতে লেগে যায় বইকি! তখন মনে হয় কে আমি, আমি কার। দারা পুত্র, থুড়ি পতি কন্যা কে কার!

সবমিলিয়ে জীবনের সারসত্য আবিষ্কার হয়েছে ধীরে ধীরে। আমাজনের জঙ্গলে খিদে তেষ্টায় কাতর পথহারা আবিষ্কারকের থেকে কম অভিজ্ঞতা লাভ হয়নি সেজন্য। এই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত প্রত্যেকেরই প্রায় নিজস্ব পাদটীকাটি হলোঃ এযাবৎ ভুবনে ভ্রমে ভ্রমণ করেছি।

যে চুলোর পাড়ে গেলে সত্যি সত্যি মানবজনমের সোনা ফলে তেমন কোনো চুলোর পাড় তো জোটে না। তাই সমাজ ও সংসারের চুলোয় দিবারাত্র পুড়ে কয়লা হতে হতে কখনও কখনও বোবায় ভর করে। অথচ শেষ পর্যন্ত কোথাও যাই না আমরা। অশ্বডিম্ব প্রসব করে কাঁটার মুকুট পরে জীয়ন্তে আমরা জলে ডোবা মৃতদেহ। ফুলে ঢোল উপুড় হয়ে ভাসছি চারদিকে নাচতে নাচতে। পুব থেকে হাওয়া বয় নাচতে নাচতে ঘুরে যাই পশ্চিমে। পশ্চিম থেকে হাওয়ার তালে পুবে। এইভাবে চারদিকে ঘুরে ঘুরে মরা ব্যাঙের নাচন নাচছি – যে মরা ব্যাঙের ভেতর একদা বিদ্যুৎ ছিল।

মরা ব্যাঙকে নাচিয়েছিলেন বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি জীবদেহে বিদ্যুতের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে। কোনো গ্যালভানি কোনো একদিন কি আমাদের আগাপাশতলা এমনই বিদ্যুৎ ফুঁড়তে পারেন না, যাতে আমরা নড়ে উঠতে পারি চরমভাবে বিদ্যুৎবাহিত হয়ে? কে জানে, কখনও হবে কিনা! তা যদি হয় কোনোদিন, তবে হয়তো কথার উৎসমুখ খুলে গিয়ে আমাদের অসহ্য এই নোনাধরা জীবনে আর কখনও তাকে বোবায় পাবে না।

(প্রকাশিত)

যাতনার নকশিকাঁথা

আমার পূর্ণ আকাশে তুমি অর্ধচন্দ্র। একদিকে তার মায়াময় বিভায় আমার আনন্দসুষমা, আর বাকি আধখানায় অন্ধকার। সেই আধখানা আকাশ যেন দূরের নক্ষত্র দিয়ে কালো পশমিনায় বোনা একটা যাতনার নকশিকাঁথা।

ওগো প্রেম, তুমি তো এমনই! তোমার ভেতর একজন ঈশ্বরীতলার ফুলধূপচন্দনগন্ধের সম্ভ্রম আর শুচিবাইগ্রস্ত। তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আর একজন বড্ড নিজের, বড্ড আপন। ধুলো পায়ে এসে ধপ করে দুয়ারের মাটিতে বসে পড়ে, একটা আসন বা পিঁড়িরও প্রত্যাশী নয় সে।

মানুষ যে দুটোকেই চায়! কিন্তু সে সোনার হরিণ। ইঙ্গিতে ডাক দিয়ে পালিয়ে বেড়ায় চিরকালই!

তুমি জেনে রাখো

এভাবেই কান্নাকে বিলিয়ে দিচ্ছি জলের দরে। যার কান্না নেই, সে তো শালগ্রাম শিলা। নিজের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়েখুঁড়ে নেবার পর তোমার উঠোনে রেখে গেলাম একটা ওপড়ানো নিষ্পত্র গাছ। তাই এখন আমার কোনো কষ্ট নেই। তোমার দেউড়িতে ঢুকতে না-পারা আমার কথারা গর্ভপাতের মতো নষ্ট হয়। আমার কথারা না জন্মাতেই পর্ণমোচী। তারা তোমার নীরবতার শীতঋতুতে অনর্গল ঝরে পড়ছে নড়বড়ে একটা গোটা সাঁকো জুড়ে। তোমার ফুৎকারে তারা উড়ে যায় এলোমেলো। অথচ তারা তোমার উঠোনের কোনায় একটু মাটি পেলে বট-অশ্বত্থ হতে পারত, গড়ে তুলতে পারত ভাষাদেহের ছায়ার মিনার। অথচ আমার জিভ কেটে ফেললে তুমি। আমার চারপাশে যখন ধূধূ দিগন্ত নেমে এলো, টের পেলাম আমি কোথাও নেই, কোনোদিন ছিলাম না। সেই না-থাকার ভেতর টের পাই, তোমার নাভিকুন্ড গনগনে লাল আঙরার এক বলয় পেরিয়ে এক কৃষ্ণগহ্বরের মুখ। তার ভেতর যে আঁধারের উনুন, সেইখানেই বুঝি আমার জন্ম ও মৃত্যু? আসলে অনাদি আমি কিংবা অনন্ত গর্ভাধানের অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা এই আমি একটি নুড়িমাত্র।

কিন্তু তুমি খুশি থেকো, কোটি সূর্য গিলে নিলেও কৃষ্ণগহ্বর নিজেকেই চেনে না। তুমি নিশ্চিত থেকো, অনাদি আমির কোনো রূপান্তর নেই। তাই তোমার উঠোনে দূরও আসবে না, নিকটও আসবে না কোনোদিন। নিশ্চিত করে তুমি জেনে রাখো।

এখন কবিতা লিখি না – ১৬

তীরে যে নৌকো বাঁধা ছিল
আলগা হয়েছে নোঙর
উপড়ে গিয়ে ভেসে যাবে এবার মাঝনদীতে – হয়েছে সময়।
মাঝি থাকে না কখনও শেষ পারানীর। দাঁড় ও হালবিহীন নৌকো চলে যাবে মোহনার দিকে।
তুমি তীরে দাঁড়িয়ে শেষবার দেখে নিও,
সে নৌকো তোমার কখনও হয়তো প্রিয় ছিল!

মার্চের অসুখ

মনে আছে, সে-বছর তোর ভীষণ অসুখ?
দিবারাত্র কষ্ট, খিদে নেই ঘুম নষ্ট –
এক অসহ্য সুখে তোর পুড়ে যেত বুক।

শোনিত মধ্যে ফুলে ভরা আস্ত একটা মার্চ গাছ
মাথা দোলাত হঠাৎ হঠাৎই হাওয়ায়
হাওয়ারও বিরাম ছিল না দু’বাড়ি আসা-যাওয়ায়

তোর মাথার ভেতর, নিঃশ্বাসে তখন একটাই নাম
বললাম, ভালো নয়, অহেতুক এ মর্ষকাম –

রক্তে পোঁতা অমনি দুলে উঠল চিরকালীন গাছ
আমার চোখে শেকড় চারিয়ে গেল
বললি, মার্চ! ও মার্চ! মার্চ – ভালোবাসলাম
তুই দিয়েছিলি এই নামের ইনাম

তথাপি কখন তোর সেরে গেল সব অসুখের সুখ
ইদানীং আর মাটিতে পড়ে না পা –
আজ লালফুলী মার্চ, কাল শুধু ঝরাপাতা

কে আছে – আছো কেউ?

রাতের সমুদ্রের সামনে ঠাকুমা আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ছেলেবেলায়। অন্ধকারে ছুটে আসা ঢেউগুলো দেখে মনে হয়েছিল জমাট কালো দলমার চলমান পাহাড় ধেয়ে আসছে। তার যেন শেষ নেই। তারা করাল শুঁড়ে জড়িয়ে আমায় দূরে ছুঁড়ে ফেলে চূর্ণ করে দেবে একেবারে। ভয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছি সমুদ্র সৈকত থেকে। স্বপ্নেও সে দৃশ্য দেখে ঘুম ভেঙে গেলে ঠাকুমা আলো জ্বেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভয় তাড়াত আমার।

আজও যেন মনে হচ্ছে, সারা পৃথিবী জুড়ে নিরেট অন্ধকারের অতিকায় ঢেউ ছুটে আসছে ক্রমাগত, আর আছড়ে পড়ছে অনিঃশেষ। হাঁসফাঁস করে বাতাসে ভেসে উঠতে না উঠতে আবার -! দিগ্বিদিক বিরাট সেই কালো পাহাড় আমাকে চাপা দিচ্ছে, গুঁড়িয়ে যাচ্ছি কখনও। অন্ধকারের ভেতর অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছি – এখান থেকে কোথায় পালাব?

কোথাও এতটুকু আলো নেই। জ্বেলে দেবার কেউ নেই। অন্ধকার ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে এলে বাইরে শূন্য রোয়াক। সেখানে ঝরে পড়ছে বালি, পলেস্তারা। … এরপর… কোথায়?

পালাতে পালাতে বারবার এসে পড়ি অন্ধকার সমুদ্রেরই সামনে। তবে কি এর থেকে পরিত্রাণ নেই, পালাবার পথ নেই? ভবিতব্যের হাতে তবে এভাবেই মার খেতে হবে? নাকি কেউ আসবে বরাভয় নিয়ে আর আলো জ্বেলে দেবে? কে আছে – আছো কেউ?

এখন কবিতা লিখি না – ১২

আমিও বন্দর ছেড়ে পাল উড়িয়ে দিই
ডাঙায় পড়ে রইল ভরাট গাভীচরাট আলো
গঞ্জের স্যাঁতস্যাঁতে মায়াবী ঘরবাড়ি

দূরে ভেসে যায় আমার অপার শস্যডিঙি
মানুষের মাথার পিছনে যে মুখগুলি কখনও দেখিনি
তারা পাশে পাশে জলে ভেসে যায়

দূর থেকে কুয়াশার ভেতর দেখি পাকুরতলার জাগ্রত দেবি থান –
সে নাকি অনাদি সংসারের মনস্কামনা পূরণ করে,
সেখানে জ্বলে উঠল সন্ধ্যার প্রদীপ
আহা পাকুরগাছ!
তোমায় রেখে গেলাম
আহা পাকুরগাছ!
তুমি আলোটুকু রেখো

গদ্য না পদ্য না – ইয়ার্কির লেখা

দুটো বিরাট ষাঁড় পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি নৈর্ঋতে। ছবিয়ালা যেন এই ভঙ্গিতে রেখে গালে তুলি ঠেকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে। একটু ওপাশে উঁকি দিলেই পাতার ঝালর পরা একটা লোক ল্যাদনা হাতে গোবেচারা মুখ। কপালে হাত রেখে দূর ঠাওর করে। ওই যে হোতা সত্যি একটা ছাগল-চড়ানী বৌ দুপুর হয়ে বসে আলের মাথায়, গালে হাত। মাথায় তার আধখানা ঘোমটায় আধলা চাঁদ উঠেছে দিনের বেলা। হাতের পাঁচন মাটিতে অবহেলায়। তার চারপাশে হাত কয়েকের ভেতর কয়েকটা পোষা ছাগল, দুটো ভেড়া ছানা। তাদের গায়ে পুরু লোম, ঘিয়ে রঙের, কোঁকড়ানো। সামনে রোগা নয়ানজুলি। তাতে একটা বাঁশের ডগালি কয়েকটা ডগা বার করে রেখেছে, আসলে পা বাড়িয়ে। কাউকে ল্যাং দেবার বাহানায়। পানকৌড়ি সেসব গেরাহ্যিমাত্র না করে, বৌটাকেও, সেই ল্যাং সমান ডগায় বসে ডানা মেলে দিয়েছে। একদিকের খুঁট জড়িয়ে অন্যদিকের আঁচল শুকোচ্ছে যেন। সারা মাঠে এখানে ওখানে টিয়াপাতা রঙা বোরো ক্ষেত। বাকিটা ধূ ধূ, ফসলহীন।

ব্যাস! এটুকুই। এটুকুই যেন কী একটা গুমরে মরছে।

ভ্রমর কোয়ো গিয়া

‌যখন নিষেকের আকাঙ্ক্ষায় ধানফুল মেলে দেবে তার গোপন ওষ্ঠপুট। এক আশ্চর্য পৃথিবী খুলে গিয়ে সেই দৃশ্য ডানায় আড়াল করে অন্ধ করে দেবে মানুষের বাচালতা। তখনই ফুলখেলার গন্ধ মাখা বাতাসের প্রবাহ ধরে তুমি আসবে বলেছিলে এই ধুলোর গ্রামদেশে। যেখানে প্রতিটি পথের বাঁকে সরল ঘাসফুলে গোপন বয়ান ফুটে আছে। জলজ শব্দে কেউ পড়ে ফেলবে মঙ্গলকাব্যের কয়েকটি লাইন। সরল পুকুরে ঘাই মেরে উঠে তোমার সম্বর্ধনা উৎসবে স্বাগত ভাষণ দিয়ে যাবে বোয়াল চূড়ামণি। আলপথে হাঁটতে হাঁটতে তোমার পা টলমল করে উঠলে গর্ত থেকে ইঁদুর বেরিয়ে এসে ইয়ার্কি হেসে বলবে, এসেছ ঠাকুর? আমি খুব উৎসাহে তোমাকে দেখাব ঐহিকের দরবারে আমার ধুলোমাখা শৈশব আর যৌবনের হারিয়ে থাকা জড়োয়াগুলি। এসব আলগোছে দেখার ফাঁকে তোমার চোখ খুঁজে নেবে নিবিষ্ট গল্পদের। আমরাই শুধু জানব, তিন হাত আগে পরে হেঁটে যাওয়া জোড়া দেহ দিগন্তের দেহলিতে দীর্ঘ আলিঙ্গনে দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল।

হাবিজাবি লেখা- ১১

‌প্রকাশিত
‌১৬. ৬.২০২২

হাবিজাবি লেখা – ১০

তবু শুকতারা পার হলে আমিও ঘাসে ঘাসে নিহারিত পা,
বেহদ্দ ক্লান্তির পোশাক খুলে নদীতে ডুবি, যেন তেষ্টাপূরণ জল –
আদিগন্তময় নিজেকেই ছড়িয়ে বলি, আঃ! জীবন –

এভাবেই প্রথাগত ভালোবাসা লেখার পর যদি ঘৃণার খোলা করতল রাখি –
তবে আর কীসের জয় পরাজয়?

অথচ আমাদের জীবনে প্রেম আছে, আছে পরকীয়া ও স্বকীয়ার দীর্ণ কিংবা দীপ্ত ঘোষণা ;

আমাদের রাতজাগা তারা আছে, আমাদের আছে ইলিশের ল্যাজা মুড়ো চাখা অষ্টপ্রহরের সংকীর্তন…

বাতাসে বাতাসে বয়ে যাওয়া বিকট উদ্গার

কিশোরের ক্ষয়ে যাওয়া আঙুলে দেগে দেওয়া অক্ষয় নীলকালি আছে

রেডলাইট এরিয়ায় একদা কিশোরীর মরা স্বপ্নের হাঁ-করা মুখে ভনভনে মাছি আছে

সেই ঝাঁকের একটা মাছি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা বরাবর সহস্রাক্ষ

ঘুরিয়ে চলেছে —

ঘুরিয়েই চলেছে

আমাদের হৃদয়ের মহামারীতে মরা সব বাসি কবিতার ভেতর

এখন কবিতা লিখি না – ৮

নিজেকে আবিষ্কার করি এক মহাশ্মশানে

তুমুল বজ্রপাত আমায় গেঁথে ফেলেছে মাটির সঙ্গে
পোড়া গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি

দেখছি করোটির স্তুপ…
কবন্ধে রক্তের ফোয়ারা…
কোটি কোটি মুদ্রার পত্তনিদার জ্বালিয়েছে চিতা…

সদম্ভ পদচারণা করে
যত দুঃশাসনের চেলা –
তত পুতনা –
আর বারোভাতারি স্বৈরাচারীর তর্জনী করে খেলা

গোধূলি -এক

313

আজও পৃথিবীতে গোধূলি এসে নামে,
পল্লবের ফাঁকে শিস দিয়ে পাখিরা দেশে গ্রামে
দুলিয়ে যায় বাতাসের শরীর,
সুখের মতো কচি ঘাসে শিশির ঝরে পড়ে শবরীর
মতো, তাতে ফুটে থাকে সূর্যের অফুরন্ত দেয়ালা।
কার্তিকেয় বাতাস এখন প্রথম প্রেমের মতো মেদুর, আর
সবুজ প্রান্তরের উপর গড়িয়ে গেছে অলৌকিক
এক বিভার পেয়ালা –
হিমেল গন্ধ মেখে সকালে রোদ্দুরের সঠিক পরিমাপে ধানে গর্ভসঞ্চারের আবেশে যে বিভা জন্মায় ঋতুকালে।

এবার মাঠে মাঠে অনাগত অন্নের প্রস্তুতি

গোধূলি -দুই
সমস্ত সুসংবেদ ভেঙে ঠগ প্রতারক বা হত্যাকারীরা রক্তের গন্ধ শুঁকে জেঁকে বসে কুকুরকুন্ডলীতে –
বাতাসের প্রবাহে পেতে রাখে কান।
সেসব বোঝে বুঝি একাকী ঘোড়াও; সে ম্রিয়মাণ,
ম্লান চোখে চেয়ে থাকে তীর্যকপতন গোধূলি রোদের বর্শার দিকে, গোধূলির সুরে মাথা নেড়ে
অন্ধকারে গোপন ডানায় যায় ভ্রমণে ;
যতদূর যেতে পারে মানুষ – ক্ষিয়মান,
দেখে নেয় দিনের আলোয় ঢেকে রাখা সব সত্যি

আমাদের একাকী সূর্যের সারথি

হাবিজাবি লেখা – ৬

জলময়ূরের মতো ব্যথালু ডেকে ওঠে মেঘবৃষ্টির বিকেলটি।
তোমার মনে পড়ে কি…

ঝাঁপি টেনে নিজেকে গুটিয়ে নিই
গৃহহীন,
ভিজে ভিজে অসুখকে সুখ দিই,

জল গিলে শরীর পচিয়ে ফেলি যত
ফুটপাত যাত্রীর সর্পিল লাইন, শরীর টেনে টেনে ছাউনির নীচে এ কোণে ও কোণে
ঘুম সরাই, খিদেমেটার সামান্য খড়কুটো সরাই—-
তখন শুনি ঘনঘোরে তোমাদের কাতর রিনিঝিনি, গ্রামোফোনিক বাদল দিবস।

তোমাদের জানালার কাচে
হাওয়ার হরবোলা স্মৃতি গিলে ফিরে চলা
পরিযান শেষে,
আবার একবার ডেকে ওঠে কালবোশেখীর বিকেল
জলময়ূরের ছদ্মবেশে