মমি এর সকল পোস্ট

একজন মফিজ এর সমসাময়িক সাক্ষাৎকার-পর্ব ০২

সম্মানীত দর্শক, বিরতীর পর আবারো ফিরে এলাম আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান “একজন মফিজ এর সমসাময়িক সাক্ষাৎকার” এ। আমরা কথা বলছিলাম সম্মানীত অতিথি মফিজ সাহেবের সাথে।

-আপনার বয়স কত?
-আরে ছাগলে কয় কি! তোর বয়স আর আমার বয়সতো প্রায় সমান।
-এইই কাট কাট….!!! কি হলো এটা? ক্যামেরা লাইট সব কিছু অন আর তুই কি না … কেমন সব জঘন্য ভাষায় কথা বলে যাচ্ছিস!
-অ এই কথা! সরি দোস্ত ভুলে গেছিলাম। .. নে এবার শুরু কর।
আবারো মেকাপম্যানকে তার মেকাপটা দেখে নিলেন। লাইট ক্যামেরা সবগুলো সার্ভিস আবারো কনফার্ম হল। এরপর এক দুই তিন স্টার্ট।

-প্রিয় দর্শক আপনাদের আর্শীবাদ দোয়ায় আমরা আবারো বিরতির পর ফিরে এলাম “একজন মফিজ এর সমসাময়িক সাক্ষাৎকার” অনুষ্ঠান নিয়ে। আজও যথারীতি প্রশ্ন চলবে এ ছাড়াও আমার প্রশ্নোত্তর ফাকে ফাকে আজ থাকছে দর্শকদের জন্য সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ। দর্শকদের প্রশ্ন করতে ডায়াল করুন-00000000420।

তাহলে শুরু করছি- আজকের পর্ব।
-কেমন আছেন আপনি?
-ভাল আছি।
-আমাদের আজকের এ পর্বটি তা গত পর্বের শেষের অংশ থেকে শুরু করব নাকি নতুন কিছু প্রশ্ন দিয়ে করব ?

-না না, যা গেছে তা যেতে দেয়াই ভাল অনর্থক মায়া কান্না করে লাভ কি! ঘুমানো লোকদের জাগানো যায় কিন্তু ঘুমের ভান ধরে ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে জাগানো যায় না। এই যে আমরা এক সময় ওয়াজ মাহফিল হলে কত দূর দূরান্তেই না চলে যেতাম। ও’মুক হুজুর আসবে, ভাল ওয়াজ নসিহত হবে, মন ভাল হবে, আত্মা শুদ্ধিতার সুযোগ পাবে ইত্যাদি মনে এক ধরনের পবিত্রতার চিন্তা আসত।

সে সময় এতো ঘন ঘন ওয়াজ মাহফিল হতো না, এখন যেমন হয় বিশেষ করে শীতলকাল এলেই দেশে ওয়াজ মাহফিলের হিড়িক পড়ে যায়। দেশের প্রায় প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় মসজিদে মসজিদে এখন বলা যায় ওয়াজ মাহফিল নামক ধান্দার উৎসব চলে। আপনি হয়তো বলতে পারেন- এসবতো পূণ্যের কাজ তাহলে এ কাজটিকে আমি ধান্দার উৎসব বলছি কেন?
প্রথমতঃ আমি বলবো আশির দশক কিংবা তার আগ হতে নব্বই দশকে ওয়াজ মাহফিল হতো পুরো এক গ্রাম, বেশ কয়েকটি মসজিদ মিলিত হয়ে, বিশাল একটি মাঠে যেখানে ওয়াজ শুনতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান কিশোর যুবক বৃদ্ধরা কনকনে শীতের হিমায়িত ঠান্ডায় গায়ে চাদর কিংবা মোটা কাপড় পড়ে, পায়ে হেটে জিকিরের সহিত দলে দলে গিয়ে পাটখরির/চট বা ছালার চাদরে ছাউনি বেষ্টিত বিশাল ওয়াজের ময়দানটি নিমিষেই লোকে লোকারণ্য হত। আরো অসংখ্য ভক্তপ্রাণ মুসলিম শীতের হিম সহ্য করে তাঁবুর বাহিরে দাঁড়িয়েই ওয়াজ শুনতেন। আর আশে পাশের বাড়ীগুলোতে নারী মুসলিমদের ভিড়তো বলাই বাহুল্য।

কি বলেন আপনার অভিজ্ঞতায় এ সব ঠিক কি না?
-হ্যা, আমারো এমন অসংখ্য স্মৃতি আছে। আমিও মাথায় টুপি আর পায়জামা পাঞ্জাবী পড়ে বাবার হাতটি ধরে চলে যেতাম কয়েক মাইল দূরে ওয়াজ শুনতে। সত্যিই সে সব স্মৃতিগুলো বড় মধুর ছিলো।
আবারো মফিজ বললেন।
-আর এখনকার সময়ের ওয়াজ মাহফিলের অবস্থা দেখলে আমরা কি দেখতে পাই! পাড়ায়-মহল্লায় ওয়াজের ব্যাবস্থা। পাবলিক শুনতে (ভিন্ন ধর্মের) না চাইলেও একেবারে কানের কাছে মাইক এনে দিবে। যদিও ওয়াজের প্যান্ডেল কয়েক মাইল দূরে তবুও তারা এতোটা দূরে মাইক লাগিয়ে শব্দ দূষণের কারনটা কি আমি ঠিক বুঝি না! এ ছাড়াও যদি ঐসব ওয়াজ মাহফিলের মুল প্যান্ডেলের ভেতরে অবস্থানরত ওয়াজ শুনার মুসল্লির সংখ্যা যদি আপনি দেখেন তবে দেখতে পাবেন প্রায় খালি ময়দান। তাহলে এতো দূর মাইক লাগিয়ে ওয়াজ করার ফজিলত কি? তারা কি মানে না যে,একটি দেশে অন্যান্য ধর্মের লোকদের নিশ্চিন্তে বসবাস করার নিশ্চয়তার কথা হাদিসেও আছে? এ ছাড়াও ছেলে মেয়েদের পড়া লেখা সহ এ সব শব্দ দূষণ হতে মুমূর্ষ রোগীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। তাদের কি এই কমনসসেনসটুকুও কি নেই যে, এ রকম শব্দ দূষনে পক্ষান্তরে তারা মানুষের বিরক্তের কারন হচ্ছেন। সে জন্যই হয়তো হাদিসে ইসলামের প্রথম ও শেষ নবী বলে গিয়েছেন-মসজিদ যত পাকা হবে মুসল্লী তত কমবে বা কাচা রবে অর্থাৎ কোন কিছুতেই অতিরঞ্জিত কিছু করতে নেই, তাতে হিতের বিপরীত হয়।

মফিজ সাহেবের জল তৃষ্ণা পেল। তিনি সামনে রাখা টি টেবিল হতে এক গ্লাস জল গলার্ধকরন করছেন।

এই ফাকে এবার উপস্থাপক বললেন…
-যতটুকু জানি আজ কালকার অনেক ওয়াজ মাহফিলে বক্তা হুজুররা নাকি হেলিকপ্টার করে ওয়াজ করতে আসেন…।
গ্লাসের জলটুকু মফিজ পুরোটা গলায় ঢালার পূর্বেই উপস্থাপকের এমন কথা শুনে মফিজ হাসতে গিয়ে জল অনেকটা তার নাকে মুখে উঠে গেল। অলরেডি পোষাকে পড়া জল মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন।
-শুধু কি তাই! ভাল বক্তা এতই কম যে তাদের একটি ওয়াজ মাহফিলের জন্য দাওয়াত দিতে হলে অগ্রীম অসহনীয় টাকাতো দেওয়াই লাগে আবার সিরিয়ালেও থাকতে হয়। অথচ পবিত্র কোরান ও হাদিসে স্পষ্ট লেখা আছে-ধর্ম নিয়ে ব্যাবসা করা হারাম। মুলতঃ এই কারনে হয়তো মানুষের মনে আ্ল্লাহর হেদায়েত ঢুকে না আর মানুষও ধর্মের পথে তেমন একটা চলতে চায় না–নয়তো স্বাধীনের পর হতে এ যাবৎকাল যত ওয়াজ নসিহত হয়েছে তাতে বাংলার প্রতিটি ঘরে প্রতিটি লোকের মাথায় টুপি থাকত। আরেকটি বিষয় হল আপনার সূত্র ধরেই বলছি- এই যে ওয়াজ মাহফিলের ব্যায় তা পূরণ করবে কি ভাবে ? পূরণ করতে তারা ভাল দুএক জন কালেকসন বক্তা আনেন যারা মাহফিলের একটি সময়ে টাকা কালেকসন করেই মাহফিল শেষ করেন তাহলে বান্দাদের মনে হেদায়েত আসবে কোথা হতে? যেখানে টাকার গন্ধ কয় সেখানে শয়তানেরও বসবাস রয়।

আগের দিনের ওয়াজ মাহফিল আর এখনকার দিনের ওয়াজ মাহফিল এর মধ্যে রাত দিন পার্থক্য। ইসলাম প্রচারে এই যদি হয় চিত্র! তাহলে ইসলাম প্রচারের চেয়ে অপপ্রচারটাই বেশী হবে। পক্ষান্তরে আমাদের প্রিয় ধর্মটিই ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে। মনে রাখতে হবে ধর্ম প্রচারে,কোন জোর চলবে না, অন্য ধর্মকে কটুক্তি করা যাবে না, মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে হবে,যেন অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলেই কেবল আপনার ধর্মের পরিধি বাড়বে-আর এসব আমার কথা নয় সব হাদিস কোরানের কথা। কিন্তু আমাদের দেশে দেখি এসব চিত্রের উল্টো রূপ।
আবারো উপস্থাপকের প্রশ্ন
-কিন্তু আমাদের দেশে যেখানে ৯০% মুসলিম সেখানে মুসলিম কোন দলই দেশের জাতীয় ক্ষমতা আসতে পারে না কেন?
-ঐতো এতক্ষণ কি বললাম! আরো কিছু কারন আছে যেমন ধরুন-ক্ষমতা ভাগা ভাগির বিষয়টি। এদেশে বৃহৎ ধর্ম একটি আর লক্ষ্য করে দেখুন দেশে ইসলাম ধর্মীয় দল কয়টি ? কিন্তু কেন ? এই সব ইসলামী দল গুলো কি একত্রিত হয়ে একটি ইসলামী দল গঠন করতে পারেন না ? পারেন কিন্তু তা তারা কখনোই করবেন না! তাহলে দলের মাথা যে কমে যাবে। ক্ষমতা যষ প্রতিপত্তিতে ভাটা পড়বে.. এখানে লোভ কাজ করে যার অবস্থান ইসলামের বিপরীতমুখী। আরেকটি বিষয়ে স্পষ্ট বলব ধর্ম নিয়ে যত চাপাচাপি করবেন ততই মানুষের অমঙ্গল বয়ে আসবে।
এই তো সেই দিন শান্তিপ্রিয় দেশ নিউজিল্যান্ডের মসজিদে প্রকাশ্যে ঘটে গেল ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষী হত্যাযজ্ঞ। এর পর শ্রীলংকায় ঘটে গেল গীর্জা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলা যার মৃত্যু সংখ্যা প্রায় ৩৫৯ পরে তা সংশোধিত হয়ে ২৫৩ জন। এখন লক্ষ্য করে দেখুন দুটো হামলাতে ধর্মের ছোঁয়া পাওয়া যায় তবে কোন ধর্মেই কিন্তু এমন হত্যাযজ্ঞের অনুমতি নেই।

ধর্মীয় বিদ্বেষী এ দুটো হামলাতে বাংলাদেশের বেশ কয়জন লোক নিহত হয়েছেন। সব চেয়ে হৃদয় বিদারক হল মাননীয় সাংসদ শেখ সেলিমের নাতি কিশোর জায়ান এর মৃত্যু। কলি ফুটতে না ফুটতেই ঝড়ে গেল।

এই যে এতো সহিংসতা এতো হত্যা এ সব তারা কোন ধর্মীয় আদর্শে করেন! তারা মানুষকে মেরে আর কোন ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়! অথচ ধর্মের সকল কিতাবেই স্পষ্ট লেখা আছে “জীব হত্যা মহা পাপ”।

পৃথিবী হতে সকল ধর্মীয় বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনি সময়…. বুঝাতে হবে পৃথিবীর বিপদগামী মানুষকে, একটাই পৃথিবী তার ধ্বংস হতে দূরে থাকার কারনগুলোর একটি হল ধর্মান্ধতা-তাই “যার যার ধর্ম ও সকল প্রাণীদের রক্ষার্থে-ধর্ম হউক যথা তথা-মানুষ হওয়াই বড় কথা”।

এর মধ্যে সরাসরি দর্শকদের প্রশ্ন করার টেলিফোন সেটে ফোন আসে। উপস্থাপক ফোনটি রিসিভ করতে ব্যস্ত হলেন।
-একজন দর্শক আমাদেরকে ফোন করেছেন কথা বলবেন। আমরা তার ফোনটি রিসিভ করছি-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন? কোথা হতে বলছেন? আপনার পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন রাখুন। তবে টিভির ভলিউমটি কমিয়ে নিবেন।
-জি আসসালামু আলাইকুম আমি ওমুক তমুক জায়গা থেকে বলছি.. আমি মফিজ সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছি।
উপস্থাপক অনুমতি দিলেন।
-জ্বী কথা বলুন।
-আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন ভাইয়া?
-জি আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি, আপনিও ভাল থাকুন। বলুন কি জানতে চান?
-আচ্ছা আপনিতো একজন মুলতঃ চিত্রশিল্পী এছাড়াও আপনি এ যাবৎকাল বহু বই লিখেছে যেখানে গল্প কবিতা প্রচ্ছদ সবিই আপনি করেছেন। এ সব প্রকাশিত বইগুলোর মাঝে সমসাময়িক প্রকাশিত একটি বইয়ে দেশের আইন কানুন আর বিচারিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ক্ষোভ কি কেবল এ সরকারের বেলায় নাকি দেশ স্বাধীনের এ যাবৎকাল আগত সকল সরকারের উপরই বর্তায়? আর এই যে দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বিচারহীনতা সে সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?

-ধন্যবাদ আপনাকে, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছেন। আমি চেষ্টা করব আমার অভিজ্ঞতার আলোকে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে আলোচনা করতে। তবে….রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ষষ্ঠ বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে… শুধু এই টুকুই এখন মনে রেখে ভাবুন। আর…??

এর মধ্যে আমন্ত্রিত অতিথি মফিজ এর মাইক এর শব্দ বন্ধ,ক্যামেরাও ক্যামেরাম্যান ঘুরিয়ে নিয়েছেন উপস্থাপক আবুল এর দিকে।
-জ্বী দর্শক, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সাথে থাকার জন্য। আমরা আপনার প্রশ্নের উত্তরে আসবো তবে আরো একটি বিরতির পর। সেই পর্যন্ত সাথেই থাকুন।

ক্যামেরা লাইট সব বন্ধ করে আবুল তার লোকদের এখানেই কিছুক্ষণ অবস্থান করার কথা বলে বের হবেন বাহিরে মনস্থির করে মফিজের কাছে গেলেন।
-দোস্ত! মাথাটা ঝিম ঝিম করছে, বাহির থেকে একটা বিড়ি খাইয়া আসি।
-এই শুন গু’ খাবি খা-আমার কোন সমস্যা নাই তয় সিগারেটে প্যাকেটে যে ছবি দেয়া থাকে “ধূমপান বিষ পান” সেই ছবিটা ভাল করে দেখে নিজের মনকে প্রশ্ন করিস ঐসব গু’খাওয়া কি ঠিক নাকি বে-ঠিক!
-ঠিক আছে তা দেখা যাবেনে, তুইও চলনা?
-ঠিক আছে… চল।

আবারো আসছি…..

একজন মফিজ এর সমসাময়িক সাক্ষাৎকার-০১ পর্ব

হায় মফিজ, কেমন আছিস? কি লিখছিস? গল্প না কবিতা?
-নারে দোস্ত! গল্পেরাতো সেই কবেই মিশে গেছে সাম্যহীনতার যাঁতার তলে আর কবিতা সেতো আকাশচারী কেবলি নীঁলাকাশে বাহারী রং খুঁজে বেড়ায়।
-কিছু একটাতো এখন করিস, তাই না!
-হ’তুলিটা হাতে নিয়ে ব্লাক জমিনে ব্লাক রঙে কেবলি আঁকছি! বার বার আঁচড়গুলো বড় অচেনা মনে হয়।
-তোর সব কথায় খালি হতাশা! এতো হতাশায় থাকিস কেন তুই?
-কি করব আমার জন্মটাই যে হয়েছিলো ১৯৭১ এ এক দূর্বিষহময় হতাশার মাঝে, যুদ্ধের ময়দানে।
-তবুওতো মাঝে মাঝে এ সব মানুষের জীবনেও রসকষ বলে সামান্য কিছু হলেও থাকে। তোর তো কোন কালেই দেখলাম না।
-জীবনের মানি বুঝিস! অবশ্য তোর না বুঝার কথা। কারন তোর জন্মতো সোনার চামচ মুখে নিয়া। তুই যদি আমার জায়গায় থাকতি তবে বুঝতে পারতি। যাকগে এ সব কথা, এখন বল, আমার এখানে এতো বছর পর কেন এলি?
-এসেছিলাম আমাদের টিভি চ্যানেলের জন্য একটি সাক্ষাৎকার ধারণ করতে।
-আমার সাক্ষাৎকার!
-হ, তুইতো বা তোরাতো এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ পপুলার বলা যায় সেলিব্রেটি। সাম্প্রতিক সময়ে যে সব টপ নিউজগুলো ভাইরাল হচ্ছে তাতো তোর তোদের মতন ব্লগার, ইউটিউবার, ফেবুকার- টুইটারের বদলতেই হচ্ছে।
-তা যা কইছস আবাইল্লা (আবুল কাসেম আবুল)। সব ফালতু কথা! যা হচ্ছে তা সব পাপের ভারে হচ্ছে, বুঝলি। এই যে…..
-দাঁড়া দাঁড়া, ক্যামেরাটা একটু অন করে নিই, আর হ্যা-ক্যামেরা চালু হলে কিন্তু তুই আর আমাকে কিংবা আমি তোকে-তুই তোকারি শব্দ করে উচ্চারণ করতে পারব না, ঠিক আছে?।
-আইচ্ছা!
-এই যে পুরুষ শাষিত ঘূণে ধরা সমাজে নারীদের প্রতি একের পর এক ধর্ষণ, অত্যাচার-এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি? সর্বশেষ রাফি হত্যাকাণ্ডের আলোকে যদি কিছু বলতেন।
-দিলেন’ তো কলিজায় আঘাত কইরা। এখন এ সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে, হয় আমি কূপ খাবো নতুবা জেল খাটবো।
-মানে! একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
-রাফি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কিন্তু এক দিনে ঘটেনি অথবা শুধু যে তার সাথেই হয়েছে তা কিন্তু নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ কখনো চলতে পারেনি এখনো পারছে না। পাকিস্থানের কিছু জারজকে দোসরদের এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেয় এ দেশের কিছু রাজনৈতিক কুলাঙ্গার নেতা। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে একশ ভাগ পাকিপ্রেমিরা। তাদের প্লান পরিকল্পিত। লাল সালুর মতন কিছু কুলাঙ্গার নিজ স্বার্থলোভী গজিয়ে উঠার চেষ্টা করলেও অবশেষে সফল হতে পারেনি তাই তাদের আরেকটি প্লান হল দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা তৈরী করে সহজ সরল অভিভাবক লোকগুলোকে আল্লাহর উপর ভয় দেখিয়ে তাদের সন্তানদের বিনা বেতন ও ফ্রি খাওন দাওনের কথা বলে মাদ্রাসায় ভর্তি করায় অথচ খোঁজ নিয়ে দেখেন মাদ্রাসায় ভর্তিকৃত ছাত্র ছাত্রীর অভিভাবকদের নিকট হতে মাসিক এক প্রকার ভাল টাকাই তারা আদায় করে নিচ্ছে কিন্তু মাদ্রাসা বা এতিম খানা নামক লক্ষ কোটি অনুদানের টাকা যায় কোথায়..?? অবশ্য দেশের সব মাদ্রাসা যে একই রকম চিত্র তা আমি বলব না, দেশে কিছু মাদ্রাসাতো আছে যেখান হতে প্রকৃত ঈমানদার হয়ে বের হয়ে আসছেন, সমাজে ভাল ভাল কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছেন আবার কিছু হচ্ছেন আত্মঘাতী ইসলামের নামে জিহাদকারী জঙ্গি সন্ত্রাসী। যে ধর্মে স্পষ্ট লেখা আছে মানুষ হত্যা পাপ তাই তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে করে যাচ্ছে।

এ সম্পর্কে আমার এক দিনের এক ঘটনা বলি যদি অনুমতি দেন? আবুল সাহেব মাথা নেড়ে অনুমতি দিলেন। মফিজ বললেন- এক দিন বেশ কয়েক জন হুজুর টাইপের লোক তাদের মাদ্রাসার দানের টাকা তুলতে আমার অফিসে এলেন। তখন আপাতত বস না থাকায় আমি তাদের সাথে কিছু এ সম্পর্কিত বিষয়ে কিছু আলোচনা শুরু করলাম। এক জনকে বললাম-আচ্ছা হুজুর যতটুকু জানি এ মাদ্রাসাটা আপনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন? তিনি খুব গর্বের সহিত বললেন- হ্যাঁ আপনাদের দয়ায়, ওমুক ওমুক জেলায়ও আরো তিনটা মাদ্রাসা আমিই প্রতিষ্ঠিত করেছি।

-ভাল কথা! খুব ভাল কথা- তা হুজুর বলবেন কি আপনার জেলাটা কোথায়? তিনি বললেন ওমুক জেলায়। আমি বললাম- আপনি আপনার জেলা রেখে এ জেলা সহ আপনি যা বললেন অন্যান্য জেলায়ও এমন মাদ্রাসা তৈরী করেছেন। আমার কথা হল আপনার নিজ এলাকায় মাদ্রাসা করার সাথে জড়িত না থেকে এখানে এসে তা করার চিন্তাটা কেন করলেন? তিনি বললেন দেখুন মুসলমান হিসাবে এটা আমার দায়িত্ব। আমি বললাম- তাহলে এখানে আরো যারা স্থানীয়রা আছেন তারা কি তাহলে অমুসলিম? তিনি অনেকটা রেগে গিয়ে বললেন, আরে আপনি তো দেখছি মসজিদ মাদ্রার বিপক্ষে কথা বলছেন! এ সব হওয়ার সুবাদে মৃত্যু কালে আপনার জানাযা তো পড়াবে পারবে, তাই না?! আমি বললাম- শুধু মাত্র আমার জানাযা পড়ার জন্য আপনাদের এ সব অন্যায় আমাকে মেনে নিতে হবে? তিনি বললেন- এ সব আল্লাহওয়াস্তে কাজকে আপনি এ ভাবে মনে করছেন কেন? আমি বললাম-মনে করতাম না যদি না আপনাদের এ অর্থ কালেকশন পুরোটা না হউক অন্তত সেভেনটি/এইটটি পারসেন্ট ঐ সব আল্লাহ ভক্ত এতিমদের মাঝে ব্যাবহার করা হত। ঐ সব এতিমদের নামে টাকা সংগ্রহ করতে আপনাদের মতন লেবাসধারী মোল্লারা জর্দা দিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে নেশার ঘোরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এটা কি ঠিক? লোকটি ইতস্তত হয়ে তার মুখে লেগে থাকা পানের পিক রুমালে মুছলেন এবং মনে হল লোকটি খুব লজ্জায় পড়ে গিয়ে বললেন- কি যে কননা ভাই আপনি! আমার এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে ঠিক যেন কিছুক্ষণ আমতা আমতা নামতা পড়তে লাগলেন। বুঝে নিলাম এ সব হল তাদের লাল সালুর আধুনিক রূপ। এরই মধ্যে আমার বস এসে যাওয়াতে আমি চুপ হয়ে গেলাম। বস আমাকে তাদের বিশ হাজার টাকার একটি চেক দিয়ে দিতে অর্ডার করলেন।

আবুলের চ্যানেলে এ সব বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে রাগে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। যদিও আবুল বার বার প্রসঙ্গ এড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিল তবুও যেন আমি আমার আবেগকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না-কথা যখন উঠেছে তখন কথা শেষ না করতে পারলে মন আমার শান্ত হয় না আর আমার কথা বলার মাঝে শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কারো কথা বলার সুযোগ আমি দেই না। এটা বলতে পারেন আমর বদ অভ্যাসের একটা।

আমি অনবরত বলে যাচ্ছি।
তা যাই হোক এ ভাবেই কিছু সহজ সরল লোকদের ছেলে মেয়েরা বন্দি হচ্ছেন বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কয়দিন আগেও যেখান থেকে পাশ করলে অফিসার পদতো পরের কথা সামান্য পিয়নের চাকুরীও পেত না আর দেশ ও দশের স্বার্থে মহাজ্ঞানী বা আবিষ্কারক হওয়াতো কল্পনাতীত তাহলে সেখানে কি শিখাচ্ছেন? সেখানে যা শিখাচ্ছেন তা হল-কেবলি আল্লাহর ভয়, বেহেস্তের লোভ নরকের আগুন, নবী ও রাসূলগণের বাণী-যা সৎ পথে চলার মানব জীবনের জন্য বেশ জরুরী এবং কোরানে হাফেজ। মুলতঃ এ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনের কি লাভ হয় তা কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়। সাধারণতঃ পূর্বে একজন মাদ্রাসার ছাত্র তার পড়া লেখার বিষয় ভিত্তিক অনুযায়ী বড় জোর কোন মসজিদে ইমামতি, কোন মাদ্রাসায় মাষ্টারী আর এখানে-সেখানে কেউ হেলিকপ্টারে, কেউ বা হেটে হেটে গিয়ে ওয়াজ নসিহত করতেন।

সাধারনতঃ আর কি কি শিক্ষা এ সব অনেক প্রতিষ্ঠানে হয় না বললেই চলে, -তা হল-যে মাটিতে তার জন্ম ও বসবাস সেই মাটি জন্মের ইতিহাস বলেন না তাদেরকে দেশপ্রেম শেখান না, লক্ষ জনতার রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা ভাল করে তারা চিনেন না, জাতীয় সঙ্গীত গায় না এর মহত্বও কি তাও জানেন না, নিজ সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখকে ভ্রান্ত ধারণায় ইসলাম বিরোধী করে তুলেন, জীবনের প্রয়োজনে কারিগরি শিক্ষার ধার ধারে না, মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্র বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আরহণ করা তাদের জন্য যেন মহা পাপ। তবে হ্যা তাদের এ শিক্ষায় তাদের অভিভাবকরা পাবেন পরকালে বেহেস্ত পাবার আশ্বাস আর মৃত্যুকালে তথা কথিত তার জানাজা পড়ার নিশ্চয়তা।

আমার হঠাৎ কেন যেন মনে হল আমি কথার লাইন ছেড়ে অন্য লাইনে চলে যাচ্ছি। যা বলছি বা বললে এ দেশে অনেকে আমাকে পাগল ভাববে! ভাববে আমি ইসলাম বিরোধী। আসলে কি তাই? যদি কেউ বা কোন গোষ্ঠি আমাদের শান্তি প্রিয় পবিত্র ইসলাম ধর্মটিকে কলংকিত করতে চায় তাকে নিয়ে ব্যাবসা করে ধান্দাবাজী আর কূপাকূপিতে ভাই ভাইকে হত্যা করতে চায় তাহলে সে সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কি ইসলাম বিরোধী? প্রতিটি ধর্মেই কিছু লোকতো আছেই যারা ধর্মীও গুরুদের কোন ধরনের সমালোচনা শুনতে নারাজ। তেমনি একটি সমসাময়িক উদাহরণ ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোতে। হত্যাকাণ্ডের মুল হোতা অধ্যক্ষ বলতেও লজ্জা লাগে, তিনিই সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাহ। তার নিকট প্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্র-ছাত্রী সন্তান তুল্য হবার কথা অথচ তিনি কি করলেন তা আজ আমাদের নিকট স্পষ্ট। সেই অমানুষটার পক্ষেও মানুষ নামের স্বার্থ লোভী অ-মানুষগুলো রাস্তায় নামে। এই অমানুষটার মুক্তির পক্ষে এবং রাফিকে পুড়িয়ে মারার পিছনে সহজ সরল নারীরাও শামিল হন। এবার ভাবুক সিরাজের মত মোল্লা লেবাসধারী তথাকথিত আল্লাহ ভক্ত লোকগুলো সমাজের সহজ সরল মানুষগুলোর মগজ কতটা সুক্ষ্ণ ভাবে ধোলাই করেছে। এরা দেশের শত্রু ইসলামের কলঙ্ক দশের আতংক। আমি পাপী হুইন্না মুসলমান,আমার অপরাধ হয়তো ক্ষমার যোগ্য কিন্তু তারাতো আল্লাহ ভক্ত হাদিস কোরানের বিধি নিষেধগুলো তাদের মুখস্ত তারা এমন জগণ্য অপরাধ করে কি করে? তাও আবার পুড়িয়ে মারে।

তবে যাই হোক মেয়েটি এ ঘূণে ধরা পুরুষ শাষিত সমাজের নারীদের একটি বার্তা দিয়ে গেল তা হল-বঙ্গ নারী নিজেকে আর ভেবো না অবলা, গর্জে উঠো যার যার অবস্থান থেকে, তাতে যদি মৃত্যুও হয়, তুমি বেচে থাকবে অত্যাচারিত নিপীড়িত নারীদের জাগরিত হৃদয়ে।

ক্যামেরার লাইট হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। মফিজ অবাক হয়ে বললেন-কিরে দোস্ত আর ইন্টারভিউ নিবিনা? সাক্ষাৎকার ধারণকারী দোস্ত বলল- নারে দোস্ত ইন্টারভিউ বন্ধ করিনি, একটু বিরতিতে যাবো- তুই যে ভাবে থলের বিড়ার বের করে বলেই যাচ্ছিস! তাতে আমার মনে হল একটু বিরতি দিয়ে আসা ভাল।
– ঠিক আছে দোস্ত…. ঐ কইরে ময়নার বাপ-আমারে এক গ্লাস জল দে।

চলবে…

খোকার লাল পাঞ্জাবী

এ পাড়ায় বিশাল বিশাল বিল্ডিং এর নীচ দিয়ে পাশে প্রবাহিত একটি খালের অপজিটে গড়ে উঠেছে কিছু ছিন্নমুল লোক বসতির একটি বস্তি। সেখানে বেড়ে উঠা কিছু টুকাই ছেলে মেয়েরা রোজই উদোম পিঠে পিছনে প্লাষ্টিকের ব্যাগ নিয়ে কেউ টুকায় কাগজ, কেউ ড্রিংস এর কৌটা, কেউ বা অন্যান্য বস্তুয়াদি। তাদের একজন নান্টু। বেশ পরিপাটি থাকে সব সময়। এ সব কাজ তার ভাল লাগে না। তাই সে দিনের বেশীর ভাগ সময় বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সগুলোতে কাষ্টমারদের ক্রয়কৃত মালামালের ব্যাগ কেরিং করত। তবে কাজে যাবার পূর্বে প্রতি দিন তার সম বয়সীদের সাথে কিছু ক্ষণ আড্ডা দিয়ে যেত। সেদিনও তাই করল সে তবে এক সময় তাদের আচরনে ক্ষুব্ধ হয়। এক দল ক্ষুদে কিশোরদের কয়েক জন রাস্তার এক পাশে ময়লা আবর্জনার স্তুপে ওদের রুজি রোজগার খুঁজে বেড়াচ্ছে আর কয়েক জন ময়লা আর্বজনার স্তুপের এক পাশে বসে পলিথিনের মুখে নাক মুখ লাগিয়ে আইকা বা গামের নেশায় ব্যাস্ত। সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল নান্টু হঠাৎ একজন ডাক দিল তাকে। সে ধীর গতিতে তাদের কাছা কাছি যেতেই তাকে হাত ধরে টান দিয়ে তাদের নেশার আসরে বসিয়ে পলিথিন একটা ধরিয়ে দিয়ে নেশা করার চাপ প্রয়োগ করতে থাকল। কিন্তু নান্টু কিছুতেই এ পথে যায়নি আর যাবেও না তাই সে হঠাৎ পলিথিনটা হাতে নিয়ে দিল দৌড়। সেদিনের পর হতে সে আর ওপথে যায় না। অন্য পথে তার কাজে সে চলে যায়।

ঈদের আছে আর মাত্র এক দিন বাকী, পরশু ঈদুল ফিতর। ঢাকার অভিজাত শপিংমলগুলোতে ক্রেতা বিক্রেতাদের বেশ ভীড়। নান্টু তার ছেড়া ময়লা শার্ট প্যান্ট পড়ে কাষ্টমারের খোঁজে দাড়িয়ে আছে একটি শপিংমলের সিড়িতে। সে লক্ষ্য করল এক সাহেব তার দু’বাচ্চা ছেলে মেয়ের প্রচুর মার্কেট করে বের হচ্ছিল শপিংমল থেকে। সাহেবও মনে মনে খুঁজছিল কেউ এক জনকে যেন তার অতিরিক্ত মালামাল গুলো কেরিং করাতে পারেন, ঠিক সে সময় নান্টু তার সামনে গিয়ে হাজির। নান্টুকে দেখে তার বয়সের কথা ভেবে কেরিং করাতে সাহেব তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করলেন না কিন্তু নান্টুর জোর আবদার।

-স্যার, আমি পারব, আপনি কোন চিন্তা কইরেন না, আমি পারব।
-তুমি পারবে কি পারবে না আমি তা আমি ভাবছি না। তোমার যে বয়স তাতে আমিতো শিশুশ্রম আইনে আটকা পড়ে যাব।
-স্যার কিছু মনে করবেন না, আপনাদের আইন কি আমাদের পেটের খিদে মেটাতে পারবে? আমার ঘরে ছোট এক বোন আছে, আছে মা বাবা। আমার কামাইয়ের উপর অনেকটা সংসার চলে।
-কেন? তোমার মা বাবা কাজ করেন না?
-বাবা কামলা দেয়, মা পরের বাড়ী ঝিয়ের কাজ করেন।
-তোমার কথা শুনেতো মনে হয় তুমি লেখা পড়া করেছ!
-হ, আমাগো গ্রামে দুই তিন ক্লাশ পাস করছিলাম। এরপর পদ্মায় যহন আমাগো ঘর বাড়ী ভাইঙ্গা লইয়া গেল তহন আমরা এই ঢাহা শহরে চইলা আহি।
-ওহ্…ভেরি স্যাড।
-স্যার আমাগো দুঃখের কথা হুনলে রাইতও পোহাইব না…দেন না স্যার আপনার ব্যাগগুলো।
-ও হ্যা নেও…এই কয়টা ব্যাগ তুমি লও।
ব্যাগগুলো কোনটা মাথায়, কোনটা দু’হাতে, কোনটা আবার বোগলের তলে নিয়ে শপিং মল হতে সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগল এবং চলন্ত অবস্থায় কথপোকথন চলছে।
-স্যার, আপনি কি গাড়ী আনছেন?
-হ্যা,
-তাইলে ড্রাইভারকে দিয়েওতো কেরিং করাতে পারতেন।
-না না, ওনি আমাদের শুধু ড্রাইভার না ওনি আমাকে আমার চৌদ্দ পূরুষদের রক্ষণাবেক্ষন। ওনাকে নীচে গাড়ীতে রেখেই আমরা শপিংয়ে এসেছি। আসতে চেয়েছিলো, তার কষ্ট হবে ভেবে ওনাকে নিয়ে আসিনি।
-ও’ তাই। আপনি খুব ভালা মানুষ।
সাথে চলা সাহেবের ওর সম বয়সী ফুটফুটে দুই সন্তানদের দেখে বললেন।
-ওরা কে হয় আপনার ?
-এ হল আমার মেয়ে টুম্পা আর ছেলে আরবান।

টুম্পা আর আরবান দু’জনেই নান্টুকে হাই হ্যালো জানাল। সেও সাদরে হাসি মুখে হাই হ্যালোর উত্তর দিল। এর মধ্যে সাহেব তার প্রাইভেট কারের নিকট এসে গেল। ড্রাইভার প্র্রাইভেট কারের দরজা খুলে দিলেন, নান্টু ব্যাগগুলোকে কারের পিছনে রেখে সাহেবের কাছে এল। টুম্পা আরবান আর ড্রাইভার গাড়ীতে গিয়ে বসল। সাহেব এবার আরেক চিন্তায় পড়লেন। ব্যাগগুলোকে তার রুম পর্যন্ত কে নিয়ে যাবে। বাড়ীর চাকর বাকরদের তো ঈদের ছুটিতে তিন দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। মনে মনে ভাবলেন ছেলেটিকে সাথে করে নিয়ে গেলে কেমন হয়।
-আচ্ছা, তোমার নাম যেন কি?
-নান্টু।
-ও হ্যা, তা তুমি কি আমাদের সাথে আমার বাসা পর্যন্ত যেতে পারবে?
-কেন যামুনা স্যার। এডাইতো আমার কাম।
-ঠিক আছে তাহলে টেক্সিতে উঠো।
এর মধ্যে তার মেয়ে গাড়ী থেকে নেমে তার বাবাকে ইঁশারা করল, যেন তার এক কান মেয়ের মুখের বরাবর রাখেন। তার মেয়েটি সাধারণতঃ কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাইলে এ ভাবে তার বাবার কানে কানে বলে। সেও বুঝতে পারেন লাজুক মেয়ে তার বাবাকে কিছু বলতে চায়। বাবা কান পেতে দিল। মেয়ে ফিস ফিস করে কি যেন বলল। অতপর নান্টুকে বলল।
-চলো আবার একটু শপিং মলে যাব।
-চলেন।
সাহেব এবং নান্টু আবারো শপিংমলে গেলেন। নান্টুর পছন্দ মত একটি কমপ্লিট সুট ক্রয় করেন যা নান্টু কিনা শপিংমলের ড্রেসিং রুম হতেই পরিধান করে ফিরে এল গাড়ীর সামনে। পড়নের আগের জামাটা সেই শপিং ব্যাগে ভরে সাথে নিল। নান্টুর চোখ জলে ছলছল। সে সাহেবের পা ছুয়েঁ সালাম করল।
-স্যার, আমার এ জীবনে বহু মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, হয়…কিন্তু কেউ বলে, “যা টুকাই জাহান্নামে যা, কেউ বলে ফকিন্নিরপুত যা বাগ” কিন্তু আপনার মত এমন ভাল মানুষ এই প্রথম পেলাম। আল্লাহ আপনেরে আরো বড় করুক।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে…চলো এবার।

নান্টু সাহেব সেজেঁ টেক্সি করে সাহেবদের বাসায় গিয়ে নেমে দেখল সাহেবের বাসাটা তার বস্তির অনেকটা কাছা কাছি। সাহেবকে আঙ্গুল উচিয়ে বলল- স্যার ঐতো আমাদের বস্তি। সাহেব প্রত্যুত্তরে বলল।
-এ ভাবে নিজেকে ছোট ভাবতে নেই, বলো ঐতো আমাদের বাসা। আর হ্যা, ঈদের দিন আমরা তোমাদের ওখানে যাব মানে বাসায় যাব। নান্টু সাহেবদের সব মালপত্র রুমে রেখে বাহিরে এসে পড়নের তার স্যুট বদলিয়ে পুরাতনটা পড়ল। নতুন জামাটা শপিং ব্যাগে ভরে বাসার দিকে রওয়ানা হল। পথে কিছু কাজ সেরে বাসায় ফিরল রাতে।

নান্টু রাতে বাসায় ফিরে দেখল ঘরে তার মা বাবা কেউ নেই। ছোট বোনটিও মনমরা হয়ে চকির এক কোণে বসে ছিলো, ভাইকে দেখে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে ভাইয়ের হাতের ব্যাগটিকে লক্ষ্য করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বলল।
—ভাইয়া এইডা কি? আমার জামা আনছো? জানো ভাইয়া, আমার বান্ধবীরা না কত সুন্দর সুন্দর জামা কিনছে। আমার লাইগা কি তাই আনছো?

নান্টু বোনকে এখন কি বলবে বুঝতে পারছে না। স্বার্থপরের মত ছোট বোনটির জন্য জামা না এনে নিজের জন্য নিয়ে এল। এখন ছোট বোনটিকে কি জবাব দিবে। খুব চিন্তায় পড়ে গেল নান্টু। অবশেষে বোনটিকে মমতায় কোলে তুলে নিয়ে বলল হ্যা, এটা তোর জন্যই আনছি তয় এহন না সকালে মা বাবার সামনে তোকে পড়াব। শান্তনা দিয়ে আদুঁরে বোনটিকে ভাত খাওয়াইয়া ঘুম পাড়িয়ে দিল।

রাতে নান্টুর মা বাবা দুজনেরই যার যার কাজ থেকে বাসায় ফিরেন। দুজনেই ক্লান্ত। মা তার বাসা বাড়ী হতে রাতের সেহরীর জন্য টিফিন বাটিতে কিছু খাবার নিয়ে এলেন। বাবা বস্তি ঘরের ভাড়াটা দেবার জন্য ঘরে ঢুকে চকিতে বসে টাকাগুলো গণতে লাগলেন। টাকাগুলো গুণে দেখলো আরো একশ টাকা কম। নান্টুর মাকে ডাক দিল। এরই মধ্যে নান্টু জামার সেই ব্যাগটি হাতে নিয়ে আবারো বাহিরে বেরিয়ে পড়ল। নান্টুকে এ ভাবে হঠাৎ ঘর হতে বের হতে দেখে পিছু ডাক দিয়েও তাকে থামাতে পারেনি তার বাবা।

নান্টুর মা রাহেলা স্বামীর কাছে এসে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল।
-কি হয়েছে বলেন?
-কালকের পরদিন ঈদ! বাচ্চাদের লাইগাতো কিছুই আনা হলো না। আমার কাছে যা আছে তাতো ঘর ভাড়াটা দিতেও আরো একশ টাকা লাগে,,, ওদের জামা-কাপড়, দুধ, সেমাই-চিনি আনবো কি দিয়ে? বুঝতে পারছি না কি করব।
রাহেলা বললেন।
-গরীবের আবার ঈদ !
-তবুওতো,,,আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, পোলাপাইন তো আর বুঝবে না অভাব কি। আর মা বাবা হয়েই আমাগো পরান কি সয় বলো! রাহেলা চকিতে তার মুখোমুখি বসে কাপড়ের আচঁলে গিটবাধা গিট খুলে কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন।
-এই নেন, এগুলো একখানে করে দেহেন, হয় কি না।
উৎসব এলেই এ সব খেটে খাওয়া মানুষ জন বেশ বিপাকে পড়ে যান। উৎসব এলে কিছুনা কিছু বাড়তি খরচ তো অনিচ্ছায়ও করতে হয় অথচ ওদের জীবন ধারণের জন্য দৈনন্দিন কোন মতে পেটের ক্ষুধা নিবারণের আহারে টান লেগেই থাকে যা কি না নুন আনতে পান্তা ফুরালো অবস্থা।

রাহেলার স্বামী লাল মিয়া টাকাগুলো ভাজ করে গুণে দেখলেন। নাহ্ এখনো টান আরো পাচ ছয় টাকার। ততক্ষনে মা বাবার কথা বার্তার আওয়াজে মেয়েটি জেগে চোখ কচলাতে কচলাতে তাদের সামনে এসে বলল।
-বাবা…ওবাবা আমার লাল জামা আনছো?
ছোট চার পাচ বছরের মেয়েটি অনেকটা অভিমানের সুরে মা বাবাকে পড়নে তার ছেড়া জামার ছেড়া অংশটিতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলতে লাগল।
– এই দেখ ! জামা ছিড়া, আর একটাও নাই…ওরা (খেলার সাথীরা) কত সুন্দর সুন্দর জামা কিনছে, আমারে কিন্না দিবা না।

কি বলবেন এ জগতে কোন মতে পাশ কেটে যাওয়া পৃথিবীর এ অভাবী মানুষগুলো ! কি জবাব দিবেন তারা লোকে বলে বেহেস্তের ফুল এই ছোট শিশু কিশোরদের প্রশ্নের! যেখানে পৃথিবী সাম্যহীনতায় ডুবে আছে সেখানে এ সব অভাবী মা বাবার সন্তানদের প্রতি সব শখ আহলাদ কি ভাবে মেটাবে ! কি ভাবেই বা মন তৃপ্ত হবে স্বার্থক মা বাবার আদলে।রাহেলা এবং লাল মিয়ার অন্তর জ্বলে উঠে, মনে এ জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যায়। শত বাধা দিয়েও লাল মিয়া তার চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিচ্ছেন ঠিক সেই সময় নান্টুর দুহাতে দুটো শপিং ব্যাগ নিয়ে নান্টু হাজির।
-এইতো আমি নিয়া আইছি…।
ভাইকে দেখে বোন পিতার বুক ছেড়ে দৌড়ে ভাই এর কাছে গিয়ে বলল।
-কি আনছো!
-তোমার লাল জামা। এই নাও…।

জামাটি শপিং ব্যাগ হতে বের করতে না করতেই বোন জামাটি ভাইয়ের হাত হতে অনেকটা ছিনিয়ে নিল। জামাটার এ পিঠ ওপিঠ নেড়ে চেড়ে দেখল সে। সে এখন মহা খুশি। নান্টু খুশি মুখে মা বাবার মাঝে গিয়ে বসে বোনের খুশিতে সেও মিটমিটিয়ে হাসছে। নান্টু আরেকটি ব্যাগ হতে বাবার জন্য একটি পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য একটি নতুন কাপড় বের করে দিল। মা বাবা দু’জনেই ছেলের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। বাবা বলল।
-কিরে তুই এতো টাকা পাইলি কই? ঘর হতে বাহিরে যাওয়ার সময় তোর হাতের শপিং ব্যাগে কি ছিল?
-কিছুই না।
-তয় এত কিছু কিনলি টাকা পাইলি কই থেকে?
পিতার অনেক পিরাপিরিতে নান্টুর মুখ খুলল।
-শপিং কমপ্লেক্সে এক সাহেব আমারে অনেক দামী একটা কমপ্লিট স্যুট কিনে দিয়েছিল। বাসায় আইয়া দেহি বোন আমার জামার জন্য কাঁদছে। পরশু ঈদ, ওরতো জামা কিনতেই হবে তাই আমার স্যুটটা একজনের কাছে বিক্রি করে বোনটার জন্য ঐ লাল জামা আর তোমাদের লাইগা এই সব কিনলাম।
-আর?
-আর কি?
-তোর জন্য! তোর জন্য কিছুই কিনলি না!
-আমার জন্য লাগবে না…ছোট বোনটির মুখের হাসিই আমার ঈদের খুশি। তাছাড়া তোমরাই তো কইছো, ছেলেরা যহন বড় হয় তহন বাপ মা ছেলেদের সন্তান হয়ে যায়।

মা রাহেলা এবং বাবা লাল মিয়া মাত্র চৌদ্দ পনের বছরের ছেলে নান্টুর এমন আত্মত্যাগের দান কি ভাবে শোধ করবেন। মোমবাতির ন্যায় নিজেকে জ্বালিয়ে অন্যকে আলো দেয়া মোমের সম্ভব হলেও মানবের ক্ষেত্রে বিরল। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ পিতা হয়ে নিজের অক্ষমতায় কাদঁলেন। মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্নাময় কম্পনরত দু’ঠোটের ভাজেঁ ভাজেঁ ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থণা “হে দয়াময় তুমি আমার ছেলেকে দেখে রেখো”।

পরদিন ফজরের আযানের পর ছেলে মেয়েকে ঘুমের ঘরে রেখে রাহেলাকে লাল মিয়া বলল।
-একটা কাজ পেয়েছি ওখানে কিছু টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা দিয়ে বাজার থেকে নান্টুর জন্য সুন্দর সাদা একটা পাঞ্জাবী আর টুপি কিনে আনবো তারপর বাপ-বেটা মিলে ঈদের নামাজ পড়তে যাব। তোমারতো ছুটি দিছে সাহেবরা, তাই না? তুমি নান্টুরে আজ কাজে যেতে দিওনা, ওদের দেখে রেখো, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসব। ঘুমন্ত ছেলে মেয়ের কপালে চুমো দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন লাল মিয়া। রাহেলা পতির ছায়া যতদূর দেখা যায় চেয়ে রইলেন।

সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো তবুও লাল মিয়ার আসার নাম নেই। ছেলে মেয়ের শত জিজ্ঞাসায় সন্ধ্যায় মায়ের কোন সঠিক জবাব পেল না। এ দিকে সারা বস্তিতে ছোট বড় মানুষদের ঈদের খুশির আমেজ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আকাশে ঈদের চাদ উঠা নিয়ে আনন্দের মিছিলে মশগুল। রেডিও টিভিতে বাজছে…”রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” সেই কালজয়ী গানের সূর। কোন আনন্দই যেন নান্টুর মনকে খুশির জোয়ারে ভাসাতে পারছে না। সে কেবলি “বাবা কেন এখনো আসছে না”-এই চিন্তায় মায়ের কাছে মনমরা হয়ে বসে আছে-বাবার প্রতীক্ষায়।

বস্তির গলিতে এক দিকে বাচ্চাদের ঈদ আনন্দ মিছিল যায় অন্য দিকে একটি লাশের লাশের ভ্যান গাড়ী আসছে। আশ পাশের মানুষজন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে ফিসফাস শব্দে বলে- “কার লাশ যায়গো”। ভ্যান গাড়ীটি নান্টুদের ঘরে কাছে আসা মাত্রই নান্টু মা এর হাত ছেড়ে দৌড়ে ভ্যান গাড়ীটির সামনে গেল। গাড়ীর সাথে ছিলো নান্টুদের প্রতিবেশী তার বাবার সাথে দিন মজুরের কামলা এক যুবক। ভয়ার্ত হৃদয়ে সে তাকে বার বার জিজ্ঞাসা করছে।
-আংকেল ও’আংকেল, আমার বাবা কৈ? আমার বাবারে তুমি দেখো নাই.. সেই যে ভোরে কাজে গেছে আর তো এলো না। যুবক নান্টুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রাহেলা খুব ধীর গতিতে ভ্যান গাড়ীর কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন তার স্বামী আর নেই, সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন তার আপন ঠিকানায়।

যুবকটির হাতে ছিলো একটি সাদা পাঞ্জাবী আর টুপি। পাঞ্জাবীটার প্রায় পুরো অংশটাই রক্তে লাল হয়ে আছে। পাঞ্জাবীটা নান্টুর হাতে দিয়ে বলল- “এই নাও তোমার পাঞ্জাবী, তোমার বাবা তোমার জন্য কিনছিলেন। নান্টু পাঞ্জাবীটা হাতে নিল। রক্তে লাল হয়ে গেল তার দু’হাত- এ যেন ঈদে মেহেদী রাঙ্গা তার হাত দুটো। ততক্ষণে ভ্যানে ওগলামুড়িতে লাল মিয়ার নিথর লাশটি উম্মুক্ত করা হয়। বাবা হারা এতিম নান্টুর চিৎকারে আকাশ ভারি হয়ে উঠল। রাহেলা স্বামী হারা এক চিৎকারে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে ভ্যানে তার নিথর স্বামীর দেহে মাথা ঠেকিয়ে রইল। ছোট মেয়েটিও কাঁদছে অঝর নয়নে।

সব শেষে জানা যায়, লাল মিয়া কাজ শেষে টাকা হাতে পেয়ে ফুটপাত থেকে খোকার জন্য একটি সাদা পাঞ্জাবী আর টুপি কিনে বাড়ী ফিরছিল। বাসে উঠা মুহুর্তে হঠাৎ অন্য এক প্রান্ত হতে চলন্ত ট্রাক এসে তাকে পিষে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। পরে পুলিশের তত্বাবধানে তাদের যাবতীয় কাজ সেরে লাল মিয়ার সাথে থাকা যুবকটির মাধ্যমে লাশ বাড়ীতে পৌছায়।

অনুভূতিগুলোর বিশ্রাম- “জন্ম থেকে জ্বলছি”

জন্ম থেকে জ্বলছি! হ্যা তাইতো আগুনের সৃষ্টি হল সব কিছু সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা। বহু কাল আগে তখন অবশ্য খুব ছোট একবার আমার এলাকায় এক বাড়ীতে আগুন লাগে। কিছুটা স্মরণে আছে আমরা ভয়ে আমাদের বাসা হতে যতটুকু সম্ভব জিনিসপত্র গুছিয়ে অন্যত্র সরে গিয়েছিলাম। তখন মনে এক আতঙ্ক কাজ করেছিলো। বিশাল বাড়ীটি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে জ্বলে। তখন যোগাযোগের খোলা মাঠ থাকলেও দ্রুত আগুন নেভাতে সক্ষমতা ছিলো না ফায়ার সার্ভিসগুলোর। এর পর শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে পারটেক্স গ্রুপের একটি ফ্যাক্টরী পুড়েছিলো এপাড় হতে দেখেছি আগুনের লেলিহান শিখা। আরেক বার বর্তমান এ ইপিজেড পূর্বে এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুট মিলস এ দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আদমজীর ভিতরে রোডের দুই সাইটের বড় বড় গাছগুলোতে আগুন জ্বলে উঠে। দূর হতে দেখেছি আগুনের তীব্রতা।কি ভয়ংকর ভাবে শব্দ করে জ্বলছিলো গাছগুলো।

আজকাল বাসা বাড়ীতে আগুন লাগার ঘটনা তেমন একটা শুনতে পাই না। তবে দেশের বস্তিগুলোতে কয়েক দিন পর পর শুনতে পাই আগুন লাগার বীভৎস কাহিনী। বস্তিগুলোতে আগুন লাগার বেশীর ভাগ কারনগুলো সু-স্পষ্ট কিন্তু কিছুই বলার নেই। এ দেশে কারনে অকারনে বিনা নোটিশে বস্তি পুড়িয়ে দেয়া এখন সবার কাছে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। দেশে বর্তমানে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে গার্মেন্টস ও বিভিন্ন শিল্প কল কারখানাগুলোতে। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে দেশের প্রধান অর্থকারী সেক্টর গার্মেন্টগুলোতে আগুন লাগা যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।

ইউরোপের জঙ্গলগুলোতে আগুন লেগে বন উজার হয়ে যায় তার অবশ্য তাদের পরিবেশ বা আবহাওয়া নষ্টের কারন থাকতে পারে কিন্তু আমাদের নাতিশীতষ্ণ ষড় ঋতু দেশে যখন বনে আগুন লাগে তখন এখানে পরিবেশ নয় নিজ স্বার্থ হাসিলের কারন থাকে। প্রায় সময় নিউজ আসে সুন্দর বলে আগুন লেগেছে। আসলে কি তাই? নাকি কেউ আগুন লাগিয়ে দেয় বা দিয়েছে।

দেশে উল্লেখযোগ্য বা আলোচিত আগুন লাগার কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
@১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সারেকা গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ২৭ জন।
@১৯৯৫ সালে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসের কারখানায় নিহত হন ১০ গার্মেন্টকর্মী।
@১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সানটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যান।
@১৯৯৭ সালে ঢাকার মিরপুরের তামান্না গার্মেন্ট এ রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলস কারখানায় নিহত হন ৪৯ জন।
@২০০০ সালে ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেড গার্মেন্টস নিহত হন ৫৩ জন।সেই বছর বনানীর চেয়ারম্যান বাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেড গার্মেন্ট এ ১২ নিহত হন।
@২০০১ সালে ৮ আগষ্টে মিরপুরে মিকো ফ্যাক্টরীতে শুধু আগুন লাগার গুজবে কান দিয়ে পায়ে পিষ্ট হয়ে নিহত হন ২৪ জন তার সপ্তাহখানেক আগে মিরপুরের কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিল।
@২০০৪ সাল এ ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৮ শ্রমিক নিহত হন।একই বছর ৩ মে মিসকো সুপার মার্কেট কমপ্লেক্সের এ নিহত হন ৯জন।
@ ২০০৫ সাল এ নারায়ণগঞ্জের সান নিটিং নামের একটি গার্মেন্টসে নিহত হন ২০ জন।
@ ২০০৬ সালে চট্রগ্রামে কে টি এস অ্যাপারেলস নিহত হন এ ৬৫ জন,একই বছরে ৯ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন ৬ জন।এছাড়াও মার্চ মাসে সায়েম ফ্যাশন লিমিটেডে আগুনে ৩ জন শ্রমিক নিহত হন।
@ ২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন লেগে নিহত হন ১১১ জন।একই বছরে গাজীপুর সদরে গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে ২১ জন নিহত।একই বছরে গাজীপুর আশুলিয়ায় হা মীম এ নিহত হয় ৩০ জন।
@ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ৭৮ হাজার ৯৫টি, নিহত হয়েছেন ১১২৫ জন, আহত হয়েছিলেন ৫ হাজার ৩৩৫ জন।
@২০১৪ সালে ১৭ হাজার ৮৩০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত হন ৭০ আর আহত হয়েছিলেন ২১০ জন।
@২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৮৮টি অগ্নিকান্ডে নিহত ৬৮ জন, ২১৬ জন
@২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৮৫৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে এতে নিহত হন ৫২ জন, আহত হন ২৪৭
@২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নিকান্ড ঘটে, এতে নিহত হন ৪৫ জন, আহত হন ২৬৯ জন,
@ ২০১৮ সালেই দেশে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ১৯ হাজার ৬৪২টি।তাতে নিহত হয় ১৩ জন,আহত হয়েছেন ৬৬৪ জন।
আলোচিত আগুন লাগার ঘটনাগুলোর মধ্যে নীমতলীর ট্র্যাজেডি ও বর্তমান আলোচিত পুরান ঢাকার চকবাজার ট্র্যাজেডি।

২০১০ সালের ৩ জুনে পুরনো ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের কারখানায় আগুন ধরে নিহত হয় প্রায় ১২৪ জন। চলছিল বিয়ের আয়োজন। কনেরা চলে গেলেন পার্লারে। বরযাত্রীরা চলে এলেন সন্ধ্যার আগেই। হঠাৎ আগুন লেগে গেল। কেমিক্যালের কারনে আগুনের তীব্রতা এত বিকট ছিলো যে মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। সেই বিয়ে বাড়ীর প্রায় ৪১জন মেহমান অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন।

বসত বাড়ীর আনাচে কানাচে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ কেমিক্যালের স্টক বিক্রয় এর কারনে আগুনের ভয়াবহতা বাড়ে। ঘটনাটার আট নয় বছর পরও সেখানের ক্ষত বা সেই সময়কার ভয়াবহতার চিহ্ন এখনো লেগে আছে অথচ সেখানকার বাসিন্দা ব্যাবসায়ীরা সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ সব কেমিক্যালস এর ব্যাবসা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার হাজার চেষ্টা করলেও জনগণের সহযোগিতা ছাড়া এ সব জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের ব্যাবসা বানিজ্য অন্যত্র সরানো কষ্টকর। এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু গাফলতিও ছিল।

নীমতলির এ ভয়াবহ ট্র্যাজেডির কয়েক বছরের মাথায় যেন সিনেমা স্টাইলে ঘটে গেল পুরান ঢাকা চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। চকবাজার এমন একটি এলাকা যেখানে দেশের এমন কোন ব্যাবসা নেই যে, না আছে। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন প্লাষ্টিকের খেলনা, বিদ্যুত ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির তৈরীর কাঁচামাল, আতশঁবাজি, ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দাহ্য পদার্থের ক্রয় বিক্রয়ের মুল কেন্দ্র। একই সাথে বসবাস করছেন অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে সেখানকার বাড়ীওয়ালারা এসব কেমিক্যাল রাখার জন্য বেশ উচ্চ মুল্যে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন। অথচ ভাবলেন না এই লোভ তাদের জন্য একদিন না একদিন কাল হয়ে আসবে। সেই কাল রাতটি ছিলো ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ বুধবার দিবাগত রাতে তিন’শ বছর আগের মোঘল আমলের স্মৃতি বিজরিত পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকার একটি চারতলা ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে যা পরবর্তীতে আশ পাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে খুবই দ্রুত।তবে আগুনের এ সূত্রপাত নিয়ে এখনো লোকজনের মাঝে সন্দেহের গুঞ্জন আছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর মতে যতটুকু জানা যায়, পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারী সহ সরকারী তিন দিনের ছুটি। স্বাভাবিক ভাবে ব্যাবসায়ীক, পথ চারীর বিভিন্ন পিকআপ ভ্যানগাড়ী সহ প্রায় শতাধিক গাড়ীর ভিড় ছিলো, ছিলো আগত, কর্ম শেষে ফেরত যাওয়া অসংখ্য মানুষজনের ভিড়। একটি সিলিন্ডারের গাড়ী বুধবার রাত প্রায় ১০টা ১০ মিনিটে নন্দ কুমার দত্ত সড়কের শেষ মাথায় মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে এসে থামার সাথে সাথে হঠাৎ বিকট শব্দে একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে উপরে উঠে নীচে পড়ে আশপাশে ক্যামিক্যালের দোকানেগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়লে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের তীব্রতায় এতোই ছিলো যে নীচে যে সমস্থ গাড়ী ছিলো রিক্সা পিকাপ ভ্যান এবং সাধারণ জনগণ তৎক্ষণাত জ্বলে পুড়েঁ ছাইঁ হয়ে যায়। যতটুকু জানা যায় এ ঘটনায় প্রায় ৭০/৮০ জন নিহত হয়েছেন এবং অসংখ্য লোক আহত সহ ব্যাবসায়ীক ভাবে প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয়।

সেদিন টিভিতে আমি ২১ ফেব্রুয়ারীর শোকাহত দিবসটির লাইভ দেখতে টিভি অন করতেই প্রথম আগুন লাগার লাইভ নিউজটি চোখে পড়ে। অবাক হয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছি সেখানকার মানুষজনে ভয়াবহ পরিস্থিতি, দমকল বাহিনীর কষ্টকর উদ্ধার কাজ। সেই রাতে আর ২১ ফেব্রুয়ারীর শোকাহত রাতে অনুষ্ঠানগুলোর লাইভ দেখা আর হল না। হয়তো আমার মত আরো অনেকে সেই ভয়াবহ রাতটির কথা ভুলবে না যা কিনা একটি জাতীয় শোকাবহ রাতে আরেকটি শোকাহত রাতের জন্ম হল। অথচ দুঃখের বিষয় হল তবুও বাঙ্গালী মানুষ হল না। সরকার যখন সচেষ্ট চকবাজারে ক্যামিক্যাল স্থানান্তরে তখন সেখানকারই কিছু অবৈধ ব্যাসায়ী বাধা দেন মিছিল করে। যেন ভাবটা এমন যে তাদের কাছে অর্থই সব। অর্থের জন্য এ সব অকাল মৃত্যু যেন তাদের কাছে নগণ্য।

দেশটা জন্ম থেকেই জলছে, জ্বালানো পুড়ানোর মধ্যে দিয়েই একটি লাল সবুজ পতাকার জন্ম। কখনো বঙ্গবন্ধুকে স-পরিবারে হত্যায় জ্বলেছিলো স্বদেশ, কখনো কু্-স্বৈরশাসনে জ্বলেছে দেশ জনতা, কখনো বা সুবিবাদী রাজাকার আলবদরের হাতে ছিলো স্বদেশ জ্বালানোর মশাল। স্বাধীনের এতোগুলো বছর পরও যখন দেশের উন্নয়ণের শির উদিয়মান তখনো আমরা সরকারের জনকল্যায়ণকর বিভিন্ন উন্নয়নে করি অ-সহযোগীতা যা প্রক্ষান্তরে আমাদের ভাবায়-আমরা যেন কেবলি জ্বলতেই অভ্যাস্ত-ভালবাসি।

তথ্য ও ছবি
অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যম।

অনুশোচনা

রাত গভীর হলেই মন আনচান করে
সকালের দেখা পাবো কি আর!
হয়তো!
মসজিদের মাইকে শুনতে পাবো
একটি শোক সংবাদ!
হতেও পারে সে-কোন এক আত্মীয় আমার,
রাত গভীর হলেই মন আনচান করে
সকালের দেখা পাবো কি আর।

দিনের আলোতে শত কাজের ভিড়ে
ভাবি না কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ আর,
শয়নে রাতের গভীরতায় মনে পড়ে সব!
রিপুর তাড়নায়,
হয়তো গড়েছি পাপের পাহাড়,
রাত গভীর হলেই মন আনচান করে
সকালের দেখা পাবো কি আর।

পরপারে যাবে যাচ্ছে জাতকুল আমার
দিতেই হবে পাড়ি চির সত্য মৃত্যুর দরজাটির,
ভাই গেল বন্ধু গেল এর পর সিরিয়াল কার!
রাত গভীর হলেই মন আনচান করে
সকালের দেখা পাবো কি আর।

মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু খৃস্টান যাই বলো
সবাই একই সুরে বলবে যাহা,
ধর্মে যত থাকুক ভেদাভেদ মৃত্যই হল সত্য তাহা
মৃত্যুই যেন হয় মানবের আরাধনা,
রাত গভীর হলেই মন আনচান করে
সকালের দেখা পাবো কি আর।

দুইয়ের দুনিয়া

ধরণীর বুকে নও একা তুমি
দুইয়ে আল্লাহ-রাসুল(সঃ),
মানব-মানবী হয়ে
দুনিয়ায় এলাম।

সৃষ্টি-ধ্বংসে দুইয়ের বসবাস
বর-কনে মিলে হয় জগৎ- সংসার,
এখানেও দুইয়ের বস বাস
বিয়ে-বিচ্ছেদে!
জীবনের হয় সর্বনাশ।

মা হলে পিতা আসে
দাদা-দাদী, নানা-নানী
সবিতে জোড় সংখ্যা রয়,
শিক্ষক শিক্ষার্থী দুইয়েতে
মানবের দ্বিতীয় জনম কয়।

জন্ম-মৃত্যু জীবনের মাঝে
বেহস্ত -জাহান্নাম,
দুইয়েতে জীবন চলে যায়
ইহকাল-পরকাল দুইয়ের মাঝে
দেহ-মন ভাল-মন্দ,
দুই দুইয়েতে মানব সাজা বয়।

দুনিয়া-আখেরাত এ দুইয়ের খেলায়
হাসি-কান্নার যেন মানব-মানবীর উপহাস!
নশ্বর দুনিয়ায় মানবতার দেবতা কই?
হাসি যেন কান্নার মাঝে মরনের ব্যাধি।

ছবিটি কার তুলা ঠিক তার নামটি মনে নেই। তবে ছবিটি তুলার সময়কার ঘটনাটির বর্ণনা মনে আছে। যুদ্ধাস্ত সিরিয়া একটি কিশোরী। পৃথিবী শাসনে বর্বরোচিত যে অমানবিক অত্যাচার করা হয় তার ফল ভোগ করতে হয় দেশের সাধারণ মানুষদের। বিশেষ করে অনাহারে অর্ধহারে অত্যাচারিত রুগ্ন নারী শিশু কিশোরদের মুখের দিকে তাকালে বা তাদের অসহায়ের মুখাবয়ব চোখে পড়লে মনে হয় এ পৃথিবীতে আমার মতন মানব দরদী’র বেচে থাকার কোন মানে হয় না কারন আমি অধম পাওয়ার লেস একজন মানুষ কি বা উপকার করতে পারি তাদের জন্য অথচ যারা পাওয়ারফুল যারা পৃথিবীকে শাসন করে তারাই তো ভাবেন ঐ সব মায়াভরা শিশু কিশোরদের রক্ষিত সুন্দর জীবন যাপনের। ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশ রক্ষার্থে যুদ্ধের দামামাকে আমি ঘৃণাভরে দেখি। যুদ্ধ কেবলি ধ্বংসই ডেকে আনে, শান্তি নয়।

ছবিটি ফটো সাংবাদিক যখন তুলতে যাবেন ঠিক সে সময় এ কিশোরীর চোখে ছিলো, জলের প্রবাহিত ঝর্ণাধারা, মুখে ছিল আতংকের প্রতিচ্ছবি, মনে ছিলো ভয়, পেটে ছিলো জন্মের ক্ষুধা। আশাহীন পরিবারহীন (যুদ্ধে মৃত) জীবন ছিলো কোন মতন বেচে থেকে দায় সারাবার। সাংবাদিক বহুবার তাকে দিয়ে চেষ্টা করালেন মুখে একটু হাসি আনতে কিন্তু না, পুরো মুখাবয়ব জুড়ে কিশোরীর মুখাবয়বে হাসি আনতে পারেননি যতটুকু এসেছিলো তাতেই সাংবাদিক শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন।

“যেমন কর্ম তেমন ফল-নেতা নির্বাচনে থাকুন সচেতন”

হ্যালো!
হ্যালো!!
হ্যালো!!!
রিক্সাওয়ালাকে নিজের দিকে তাকাতে বাধ্য করতে কয়েক বার হ্যালো হ্যালো বলার পরও তিনি শুনছেন না। রিক্সাওয়ালা সোজা রিক্সা থামালেন এক অফিসের দরজায়। রিক্সায় আরোহী ভদ্রলোক অবাক! তার গন্তব্যের বিপরীতে চলে আসায় অনেকটা রাগ হয়েই বললেন।
-আরে বেটা তোরে একটা চড় দিতে মন চায় বুঝলি, তুই যাবি আমার অফিসে আর তুই এলি এদিকে।
-স্যার, রাগ কইরেন না…সময় শেষ তাই আজই কিনতে হবে।
-মানে!
-মানে স্যার নমিনেশন পেপার। আমি ইলেকসনে খারাইমু।
ভদ্রলোক এবার হার্টফেল করার অবস্থা। বলে কি বেটা!।ভদ্রলোকের মুখভঙ্গি দেখে রিক্সাওয়ালাও একহাত নিলেন।
-কেন স্যার! আমরা কি মানুষ না এ দেশের জনগণ না?
-তা কেনো! আমি ভাবছি ইলেকশন করতে হলে তো সামান্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে তাছাড়া নমিনেশন পেপার কিনতে আর জমা দিতে কম করে হলেও পঁচিশ ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে।
-কোন সমস্যা নাই স্যার, আমি মেট্রিক পাস আর টাকা! আমার আরো দুটো ব্যাটারী রিক্সা আছে ওগুলা বিক্রি কইরা দিমু।
-এর পর তুমি চলবে কি করে?
-কি যে কন স্যার, আমি পাস করলে কি আর এগুলা চালামু!
-আগে তো পাস করবি তারপর না হয় ভাববি।
-কেন? এ দেশে এতো এতো চোর মাস্তান পাস করতে পারলে আমি পারমু না কেন? হুনছি আমাগো খেলোয়ার মাশরাফি, হিরো আলমও নাকি নির্বাচন করব আমি হেগো থেকে কম কিসে? পরিশ্রম করে খাই হুম। তাছাড়া আর কত কাল এমন গরিবী হালে থাকমু কন? পাস যদি নাই করতে পারি তবে ইলেকসন খারানোর কারনে এলাকায় মানষে আমারে এমপি সাব কইয়া ডাকবো তাতেই আমি কোটিপতি হইয়া যামু। বুঝলেন স্যার, আস্তে আস্তে কই-এদেশে রাতরাতি কোটিপতি হইতে রাজনিতীই হইল এহন উত্তম জায়গা। দেহেন না এহন রাজনিতী কে না করে বলেন! দেশের সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দুই এহন রাজনিতীর কাতারে।

ভদ্রলোক ভাবলেন এর সাথে তর্কে পারা যাবে না। এ দিকে অফিসের সময়ও যায় যায়।
-ঠিক আছে ঠিক আছে, এই নাও তোমার ভাড়া।
রিক্সাওয়ালা ভদ্রলোকের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন।
-ছি ছি স্যার লজ্জা দিয়েন না, ভাড়া লাগবে না শুধু দোয়া চাই।
এ কথা বলে রিক্সাওয়ালা রিক্সার চাকায় লক করে নমিনেশন পেপার কিনতে দিলেন দৌড়। ভদ্রলোকটি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। আর ভাবেন হায়রে রাজনিতী তুই এখন কোন পর্যায়ে চলে গেলি। না আছে বংশপরায়নপর রাজনীতির অভিজ্ঞতা না আছে শিক্ষা আর জনপ্রিয়তার আলো। ইচ্ছে হলেই, যে কেউ নেতা হতে চায়, হয়েও যায়।

অফিশিয়াল ব্যাগটি হাতে নিয়ে মাথা নীচু করে কিছুটা হেটেই যাচ্ছিলেন তার অফিসের দিকে। হঠাৎ সামনে এসে দাড়ালেন তার এক সহকর্মী।
-আরে স্যার যে, হেটে হেটে কি অফিসে যাচ্ছেন?
-আরে না ভাই রিক্সায় আসছিলাম হঠাৎ রিক্সাওয়ালার সাধ জাগল নেতা হবার। সে অনেক কথা। চলুন ঐ চা দোকানটায় একটু চা পান করে রেষ্ট নিয়ে নেই।

ব্যাস্ত শহরে আজ কাল মানুষের ঢল। আসছে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ জাতীয় নির্বাচন। তাই নমিনেশন পেপার কিনতে মানুষের জোয়ার। নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে তেমন কঠিন কোন নিয়ম নীতি না থাকায় দিন দিন বাড়ছে নেতা বা প্রার্থীর সংখ্যা। কখনো দেখা যায় একই ঘরে স্বামী-স্ত্রী, দেবর-ভাবীর নমিনেশন নেয়া এবং নির্বাচনী লড়াই। আজব মানুষ আমরা কোন একটা সেক্টর বা উৎসতে প্রফিটেবল দেখলে যেন আমরাই হ্যামিলনের বাশিঁর সূরে মেতে উঠি।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই সেই দোকানে দল বল নিয়ে হাজির হলেন এক নির্বাচনী প্রার্থী। মার্কার কাগজটি জনে জনে বিলি করছেন তার কর্মীরা আর সে নিজে যখন, যেখানে যাকেই পাচ্ছেন বুকে বুক লাগিয়ে দোয়া ও দাওয়া চাচ্ছেন। ঠিক সেই সময় সেখানে হঠাৎ উদয় হলেন এক উড়নচন্ডী পাগলের। পাগলের শরিরের অবস্থার কথা বর্ননা নাই বা দিলাম তার শরির হতে নির্গত দুগন্ধ যেন আমাদের রাস্তাঘাটে ফেলে দেয়া পচা ডাষ্টের চেয়েও অসহনীয়। সেই পাগল আচমকা প্রার্থীকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন… যাবে যাবেগো এবার যাবেগো ইত্যাদি পাগলের যা প্রলাপ।

বেচারা প্রার্থী! নিজেকে খিচ মেরে সংযত রেখে পাগলের আলিঙ্গনকে স্বাগত জানালেন। তৎক্ষনাত তার কর্মীরা এসে পাগলটিকে ধীরে ধীরে নেতার কাছ হতে সরালেন। নেতার শরীরে জামা পুরোটাই ময়লা আর পাগলের মুখের লোল পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। চায়ের দোকানে আর সবাইকে সালাম দিয়ে তড়িৎ তিনি চলে গেলেন তার দলবল নিয়ে। দোকানদারও কিছুটা স্বস্তি পেলেন। সেই দোকানেই বসা দুজন লোকাল বাসিন্দা বলাবলি করছেন।

১ম জন-শালায় একটা ভন্ড!গত বারও এ ভাবে ভোট ভিক্ষা চাইয়া এলাকায় কোন কাম করে নাই খালি নিজের পকেট ভরেছে।
২য় জন-তাতো হবেই! দেখতে হবে না ওর বংশ পরিচয়! ওর জাত খান্দান! ও’তো নন মেট্রিক,ট্রাকের হেলপারি করত। দিন আনতো দিন খেতো। মায় করত বেশ্যাগিরি বাবা করত কুলিগিরি… ও আর কত ভালা হইব! ট্রাকষ্টেসনের সদস্য হইয়া কিছু টাকা কামাইছিলো! সেই টাকার গরমের নির্বাচনে দাড়াইয়া টাকা উড়াইয়া পাস করছিলো। এই বার কি করবে?
পাশেই বসে চা পান করছিলেন ভদ্রলোক ও তার সহকর্মী। লোকাল বাসিন্দাদের এমন তর্কে যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে তার মন। এক সময় তর্কের সাথে তাল মিলালেন। মাঝে মধ্যে তার সহকর্মীও দু একটা কথা বলে ফেললেন।
-হ্যালো! ভাইজানরা কি এখানকার লোকাল পাবলিক?
-হ’ভাই।
-আচ্ছা, এই যে তর্ক করছেন দুজনে, এখানে কি আমি কিছু কথা বলতে পারি? যদি অনুমতি দেন।
লোক দুটো খুব উৎফুল্ল ভাব নিয়ে অনুমতি দিলেন।
-জি জি বলেন।
-আপনাদের কথায় বুঝতে পারলাম তিনি মানে ঐ যে কিছুক্ষণ আগে একজন নির্বাচন প্রার্থী এসেছিলেন ভোট চাইতে। তিনি সাবেক সাংসদ ছিলেন তাইতো?
১ম জন- জি, এমপি ছিলেন।
-আচ্ছা ঠিক আছে, তো তিনি এমপিতে পাস করলেন কি ভাবে? আপনারা মানে জনগণ কি তাকে ভোট দিয়ে পাস করান নাই? নাকি সে ভোট ছিনতাই করে সন্ত্রাসী কায়দায় এমপি হয়েছেন?
২য় জন- না, না, সে ভোট পেয়েই পাস করেছিলো।
-তাহলে তার এমপি হওয়াতে তার দোষটি কোথায়? আপনি আমরাইতো তাদেরকে ভোট দেই তাই না? যদি আমরা আমাদের দেখবালের প্রতিনিধি নির্বাচনে সঠিক যোগ্য ও সৎ প্রার্থীকে বেছে নিতে না পারি তবে তার এমপি হওয়ার পরবর্তী অপকর্মের দায় কার? নিশ্চয় আমাদের?
১ম জন মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললেন।
-এবার আসি আপনার শেষের কথায়। আমাদের দেশে প্রতি পাচ বছর অন্তর অন্তর আমরা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেই। ভোট দেয়া একটি পবিত্র দায়ীত্ব এবং মৌলিক অধিকার। এখন আপনি আমি যদি সেই পবিত্র ভোটটিকে অপবিত্র করি টাকা খেয়ে তবে দোষ কার? আমি আমার কর্মফল ভোগ করব এটাই চিরন্তন সত্য, তাই নয় কি? সেতো আপনাকে আমাকে টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলল এ অবস্থায় তার কাছ থেকে কি আর কোন সুবিদা আশা করতে পারি? সেতো ভোটে পাস করে তার লগ্নি তুলবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?

তর্ক করা দুজনেই একদম বোবা হয়ে গেলেন। এবার ভদ্রলোকটির সহকর্মী বললেন।
-আর ঐ যে বললেন বংশ পরিচয়!। ভাল এবং যোগ্য নেতা হতে হলে ভাল কোন বংশ পরিচয় লাগে না। জগতে এ রকম বহু উদাহরণ আছে যারা মুচির ঘরে জন্মেও সমাজ সেবায় জীবন দিয়েছেন, হয়েছেন জগৎ বিখ্যাত। তাইতো গুণিজনেরা বলে গেছেন ”জন্ম হোক যথা তথায় কর্ম হোক ভাল”।
আর একটা কথা মনে রাখবেন, যে দেশের রাজনৈতীক নেতারা কেবল মাত্র তাদের স্বার্থ সম্বলিত নির্বাচনী প্রক্রিয়া কি ভাবে হবে তা ঠিক করতেই পার করে দিয়েছেন দীর্ঘ ৪০/৪৫টি বছর সে দেশের জনগণ হয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে আমাদের ভবিষৎ ভাল করার নেতা নির্বাচনে। শুধু অন্যের দোষ নয় নিজেকেও মাঝে মধ্যে আয়নায় দেখতে হবে নিজের চেহারাটা কেমন। তাই আসছে নির্বাচনে সঠিক নেতা নির্বাচনেই দেশ ও দশের উন্নয়ণ ঘটবে নতুবা আমরা যেই আছি সেই থেকেও পিছিয়ে পড়ব বহুগুণ দূরে।

তর্ক কারীদের মুখ বন্ধ-মাথা নত। শুধু মুখে বলে যাচ্ছেন, জি জি….স্যার।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

ছবি:অনলাইন সংগ্রীহিত।

ফেইসবুক জ্বর

হ্যালো, শুনছো?
-হুম…
-শুনছো তো?
-আরে বাবা বলো না…।
-আমি তোমার কে?
এতো ক্ষণ আজম সাহেবের স্ত্রী মোবাইলে ফেবুকে মগ্ন থাকায় খুব ব্যাস্ত ছিলেন স্বামীর কথায় তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এবার স্বামীর এমন অপ্রস্তুত প্রশ্নে অবাক হন, আপাতত ফেবুক হতে চোখ ফিরিয়ে স্বামীর প্রশ্নের উত্তরটা একটু রাগ নিয়েই দিলেন।
-মানে! হঠাৎ এতো বছর পর এ কথা কেনো?
-না মানে আমিতো আর সেই ভেবে কথাটা বলিনি, তুমি আমার কথা শুনছো কি না তাই তোমার ঐ উচ্চাআধুনিক স্যোসাইল সাইট থেকে মনযোগটা সরাতে চেয়েছিলাম মাত্র।
-ও তাই…
আবারো ম্যাডাম ফেবুকে টিপাটিপি শুরু করলেন। তা দেখে সাদা সিদে স্বামী বেচারার মনে বিরক্ত এসে যায়।কি সব সারা দিন রাত জেগে ইউজ করে তার মাথায় যেন তা আসতেই চায় না। সে এক প্রকার বাধ্য হয়েই সোফায় স্ত্রীর মুখো মুখি বসলেন। তার এমন বসার ভঙ্গিটা আড় চোখে দেখলেন তার স্ত্রী তবুও সে মোবাইলের ফেবুর স্কিন থেকে চোখ সরালেন না। মনে হচ্ছে বিশ্ব জয়ের দিকে ধাপিত হচ্ছেন তাইতো সে চ্যাটিংয়ে অভ্র কি বোর্ডে আঙ্গুল চালাচ্ছেন খুব দ্রুত। ভাগ্যিস বাংলায় অভ্র কি বোর্ডটা আবিষ্কার হয়েছিলো নতুবা ইংরেজী চ্যাটিং টাইপিনে খবর আছিলো। এই কৃতিত্ব অর্জন কারী হলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মেহেদী হাসান।
-কি কিছু বলবে?
-তুমি কি খুব ব্যাস্ত?
-দেখতে পাচ্ছো না!
-হ্যা তাতো দেখছিই মনে হচ্ছে সকালে দাত ব্রাসও করোনি
-কি বললে?
-না মানে… কিছু বলতে চাইছিলাম।
-বলো,
-না মানে তোমরা যে অবস্থায় সময় অপচয় করছো তাতে যদি টাকা আসতো তবে কোন কথাই ছিল না,তাই বলছিলাম কাজের বুয়ারে ছাটাই করলে কেমন হয়!
-তাহলে বাড়ীর এতো কাজ কে করবে? তুমি?
-দূর! আমার কি আর এতো সময় আছে? …আমি বলছিলাম কি তুমিই যদি ঘরের কাজে একটু মনযোগ দিতে,,, না মানে তোমারতো অফুরন্ত সময়। সারা দিন কেবল ফেবুক আর জলসা টিভিতে সিরিয়াল দেখে দেখে অযথা সময় কাটাও।
-কি বললে? তুমি জানো এতে কত জ্ঞান অর্জন হয়! …তুমি জানবে কি করে তুমিতো আবার অসামাজিক গেয়ো।
-হ্যা, ঠিকই বলছো তবে টাকা রোজগার যদি করতে তবে বুঝতে…।
-তুমি কিন্তু আমার রাগ তুলে দিচ্ছো…।
-না না কি যে কও জীবনের বিশটি বছর গত হলো এক সাথে আর জীবনের এ অবেলায় সঙ্গী করলে ফেবুককে! এই দুঃখটাই একটু বললাম আর কি।
কর্তৃর যেনো সে দিকে কান নেই আবারো অনবরত সে চ্যাটিং করেই যাচ্ছেন আর মিটমিট করে হাসছেন। মনে হচ্ছে খুব মজার একটা চ্যাটিং চলছে। স্বামী বেচারা একটু উকি মেরে চ্যাটিং দেখার ভান করলেন তাতে কর্তৃর এক দিকে রাগ আসলেও চ্যাটিং আপাতত শেষ হওয়াতে মোবাইলের ফেবুক বন্ধ করে চ্যাটিংয়ের কাহিনী শুনালেন।
-কি কার সাথে দীর্ঘ ক্ষণ চ্যাটিং না ফেটিং করলে? মনে হচ্ছে আজকাল খুব মজে আজো।
-আরে না,,,, আহা! বেচারা।ঐ যে আমার বান্ধুবী রাহেলা…তার চ্যাচিং বক্সে তারই মেয়ের প্রেম ঘটিত ম্যাসেজ এসে পড়ে।
-বলো কি? আর তাতে তুমি খুশি হচ্ছো কেনো? এ ভাবে পরিবারের হাতে ধরা পড়া এটাতো রীতিমত বিষ্ময় কর। আমাদের আগের দিনই ভাল ছিলো যখন একটি চিঠির জন্য অপেক্ষায় থাকতাম দিনকে দিন। অতি গোপনে ডাক পিয়নের সাথে যোগা যোগ রাখতাম। আর এখন কি কলি কাল এলোরে বাবা!।
-আরে রাখতো তোমার সেইকাল। কি মজা তাই না? ভালোই হলো এখন আর ছেলে মেয়েরা কোন কিছু লুকাতে পারবে না আমরা গার্ডিয়ানরা সহজেই ধরতে পারব। জুকারবার্গকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
-তুমি গেছো! ফেবুক জ্বরে তোমাকে পেয়ে বসেছে। এটাকে তুমি ভাল বলছো, তবে তো প্রাইভেসি বলে আর কিছুই থাকছে না।
-আগে শুনবেতো কি হয়েছিলো?
-বলো!
-রাহেলার মেয়ে তার প্রেমিককে চ্যাটিংয়ে এত্তো এত্তো কিস মানে চুমো দিছে সব রাহেলা জেনে গেছে, আগেতো সরা সরি যা হবার হতো আর এখন হচ্ছে ভার্চুয়ালে অদেখা স্পর্শহীন। খুব ভালো তাই না? জীবনের নিরাপত্তায় আর কোন টেনসন থাকলো না।
-হ ঠিকই কইছো, তুমি থাকো তোমার ফেবুক জ্বরে আমি চল্লাম আমার অফিসে।
স্বামী বেচারা স্ত্রীর ফেবুক নেশায় নিজেই যেন কাইত হয়ে না যায় সেই ভয়ে অফিস শুরুর অনেক আগেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। মৌচাক মোড়ে এসে জেব্রা ক্রসিং পার হবেন, অপেক্ষায় সিগনাল পরার। সে এ দিক ঐ দিক তাকিয়ে দেখেন তার সাথে সব বয়সের আরো লোক জন তারই মতো অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছেন, কম বেশী সবার হাতেই এড্রুয়েড মোবাইল প্রায় সবাই যেনো মহা ব্যাস্ত। একটু কাৎ হয়ে অন্য একজনের মোবাইলের বিষয় দেখার চেষ্টা করলেন। হুম! এখানেও ফেবুক। এর মধ্যে সিগনাল ছেড়ে দিলে যে যার মত রাস্তা পার হচ্ছেন শুধু এদের মধ্যে এক জন যুবককে সে দেখলেন, যুবকটি খুব ধীর গতিতে রাস্তা পার হচ্ছেন, হাটার সাথে চোখ তার মোবাইলে, আঙ্গুল তার মোবাইল স্কিনে সাতরাচ্চে। হঠাৎ একটি প্রাইভেট কার তাকে একটু হালকা বায়ু স্পর্শ দিয়ে চলে গেলেন স্পিডে, সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটি তার হাত হতে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায় তৎক্ষনাৎ তার চোখের সামনে আরেকটি গাড়ীর চাকায় তা ভেঙ্গে চুড়মাচুড় হয়ে গেল। যুবক অবাক হয়ে গাড়ীর দিকে চেয়ে সেখানেই দাড়িয়ে রইলেন। এরই মধ্যে আজম সাহেব তাকে পাজা কোলের মতো আলগিয়ে দ্রুত রাস্তা পারা পার করালেন। যুবক রীতি মত আজম সাহেবের উপর ক্ষ্যাপে গেলে।
-কি ব্যাপার আপনি আমাকে এ ভাবে তুলে আনলেন কেনো?
-আর একটু হলে তুমিও গাড়ীর তলে চাপা পড়তে…বুঝলে।
যুবক পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তাকে ধন্যবাদ দিলেন।
-আসলে ঐ আমার সাধের মোবাইটা গাড়ী চাপা দিলো তাই আমার মাথা কি যেনো কি হয়ে গেল,,,,আপনাকে ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ না দিয়ে একটু চিন্তা করো,,, এভাবে চলন্তবস্থায় কখনো মোবাইল টিপবে না বুঝলে।
যুবকটিকে আচ্ছা মত উপদেশ দিয়ে সে অফিসের সামনে গিয়ে এক চা স্টলে চায়ের অর্ডার দিলো। চা স্টলেও বেশ কয়েকজন যুবক চা পান করছেন আর মোবাইল টিপছেন। নাহ্ এখানেও দেখছি সেই ফেবুক জ্বর। অবাক হলে যখন রাস্তার এক ভিখারী ফোনে তার পার্টনারকে বলছেন।
-পার্টনার তুমি আজ কোন কোন জায়গায় যাইবা?
-কেন, তুমি আমার ফেবুক স্টেটাসটা দেখো নাই?
-ওমা আমার কি আর ফেবুক আছেনি। আমিতো ওয়া চালাইবার পারি না।
-ঠিক আছে,,,ঠিক আছে আজ রাহি তুমি তাড়া তাড়ি ফেবুক অ্যাকাউন্ট খোল।ওকে,,,!!
ফকির বেচারা কি বিপদেই না পড়ল। এখন কাকে দিয়ে এই ফেবুক অ্যাকাউন্ট খুলবে। ওটা না বানালে তো সাথীদের খোজঁও পাবে না সে, কে কোথায় আছেন। ফকিরের চোখ পড়ল চা স্টলে দাড়িয়ে চা পান অবস্থায় আজম সাহেবের উপর। সে নিজে এক হাত পঙ্গু অন্য হাতে এন্ডুয়েট মোবাইলটা আজম সাহেবের মুখের সামনে নিয়ে একটি ফেবুক খোলে দেবার অনুরোধ করেন।
-স্যার আমার একটা ফেবুক অ্যাকাউন্ট খুইল্লা দিবেন।
কি জ্বালা আজম সাহেব এমনিতেই ফেবুক ইউজ কারীদের উপর ক্ষ্যাপা তার উপর সে বলছে তাকে একটা এ্যাকাউন্ট খুলে দিতে হবে। তাও আবার ফেবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে একজন ফকিরের। দুঃখে জীবন তার যায় যায়!! এটা কি হচ্ছে যেখানে যাচ্ছি সেখানেই ফেবুক। ফকির বেটারে এক দমক দিলেন।
-যা বেটা খাইয়া লইয়া আর কাম নাইহে…
-কেন স্যার আমিতো আর ভিক্ষা চাই নাই….।
আজম সাহেবের মেজাজটা আরো খারাপ হলো। রাগে চা কাপের চা গুলোকে দূরে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে সে দ্রুত কেটে পড়লেন। অফিসের বাহিরে আজম সাহেব যাই হন না কেনো অফিসে তার একটি গুড উইল আছে। তা হলো সবার আগে অফিসে ঢুকবেন এবং সবার পরে অফিস থেকে বের হবেন। অফিসের অন্য সব কর্মচারীদের কাজের আদান প্রদানে আছে বেশ স্বচ্ছতা। অফিসে ঢুকে সে সাধারণতঃ যে কাজটা করেন তা হলো সোজা তার কক্ষে প্রবেশ করেন। আজ সে একটু ব্যাতিক্রম করেন। অফিসে ঢুকে চলে যান তার সহকারীর টেবিলে এর মধ্যে যে যার মতো তাকে হঠাৎ দেখে সালাম দিয়ে শ্রদ্ধাবোধ জানালেন। সরকারীর টেবিলে যেতেই সরকারী কর্মকর্তা তাকে সন্মান দেখিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন।

-বসুন বসুন,,,তা কজটা কতটুকু হলো?
-জি স্যার কমপ্লিট।অন লাইনে আশা কাল থেকেই অর্ডার পাবো।
-এটা কি ভাবে করলেন?
সহকারী তার চেয়ারে বসলেন অতপর অন লাইন চালু করেন। কম্পিউটারের মনিটর টি তার দিকে একটু বাকা করে তাদের তৈরীকৃত সাইটটি দেখালেন।
-স্যার এইতো আমাদের সাইট। ফেবুকেও এড করে দিয়েছি।
আজম সাহেব সাইটটি দেখে যতটুকু না খুশি হয়েছিলেন ফেবুকে এডের কথা শুনে ততটুকুই মুখ তার গম্ভীর হয়ে গেল। সে তার সহকারীকে ভাল মন্দ কিছু না বলেই চলে যাচ্ছেন তার কক্ষে। যাবার পথে আড় চোখে তার সহকারীর টেবিলেই রাখা এন্ড্রুয়েট ফোনের দিকে। ফেবুক ওপেন! তার পর এক এক করে আড় চোখে প্রায় অন্য সবার মোবাইল খেয়াল করলেন তারাও সম্ভবত ফেবুক জ্বরেই ভুগছেন। নিজ কক্ষে এসে চেয়ারটিতে আরাম করে হেলান দিয়ে ভাবছেন,,,একি অবস্থা দেশের সর্বত্রই কেবল ফেবুকের জয়ো গান রীতি মত চিকুনগুনিয়াকেও যেনো হার মানিয়ে দিচ্ছে।

আজম সাহেব খুবই কষ্ট পাচ্ছেন। মানুষ কেমন যান্ত্রিক হয়ে গেল। ঘরে বসেই সব কিছুই অনায়াসেই পাচ্ছেন, পকেটেই থাকে দুনিয়ার সব তথ্য ভান্ডার তাই তার একটু লোভ হলো অন লাইন জগৎটাকে একটু চেখে দেখবার। পাশেই ছিলো তার একটি কম্পিউটার। ইউজ না করার কারনে ধূলো বালি পড়ে ছিলো। তা নিজেই একটু একটু ফু দিয়ে পরিষ্কার করে তা চালু করলেন। যেহেতু শিক্ষিত তাই ওটা চালাতে তার কোন সমস্যা হলো না।

পাচ বছর পর
এ পাচঁটি বছরে সে বদলেনি একটুও বদলে গেছে তার চির শত্রু ফেবুক জ্বরের প্রতি আসক্তির হাওয়া, বলা যায় স্বামী স্ত্রী সমান তালে প্রায় প্রতিযোগিতার বন্ধু বান্ধুবী সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। এর মধ্যে তার গ্রুপিংয়ে আছে দেশের সুনাম ধন্য মাটি ও মানুষের কথা বলে তার অনলাইন জন্ম ভুমি ব্লগ সোনেলা ব্লগ, সোনেলা দিগন্তে জল সিড়িঁর ধারে” আরো আছে শব্দের ভান্ডার ব্লগ শব্দনীড়, মানবতার হাত ছানি দিয়ে মুক্ত বিহঙ্গে স্বাধীন ভাবে উড়ে চলা এক রঙ্গা এক ঘুড়ি,জল ছবি প্রকাশন,কুড়েঁঘর প্রকাশনী,আগামীর জন্য আমরা,, রঙধনু সাহিত্য গ্রুপ,দুর্জয় বাংলা,,নক্ষত্র ব্লগ,সামু,আমরা ব্লগার,দাড়িকমা প্রকাশনী। আছে কিছু প্রিয় মানুষের মুখ-হেলাল৴জিসান ভাইয়া,ভুমিহীন,নীল দাদা,পাশা ভাই,নাসির আহম্মেদ কাবুল,শফিকুল ইসলাম কহিনুর,শিপু ভাই,সবুজ ভাই,ইঞ্জা ভাই,সৈয়দ আলীউল আমিন,নীল কণ্ঠ জয়,জায়েদ হোসেন লাকী,ম্যাক্স তামিম,রুদ্রা আমিন,অনিমেস রহমান,শামিম রহমান আবির,শওকাত মিথুন,মজিবর ভাই,নিতাই দাদা,দীপ মাহমুদ,সঞ্চয় কুমার,হামিদ আহসান,আহম্মেদ রব্বানী,সোহেল আহম্মেদ,,শহিদুল হক,চারু হক,আনিস,ব্লগার সজীব,তরিকুল ইসলাম,,সাইদ মিল্টন,বায়রিক শুভ্রা আবুল কালাম আজাদ,আহমেদ ইশতিয়াক,পার্থসারথি বসু –সে যদিও ভারতীয় কলকাতার বাংলাদেশের প্রতি রয়েছে তার অনন্য ভালবাসা।
এই পাচ বছরে আরো অনেক বন্ধুই এড হয়েছিলো তার মধ্যে যা তৎক্ষণাত মনে এসেছে তাই বলা হলো,তবে তারা প্রত্যকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।এমন সব বন্ধুদের সাথী করে প্রত্যাহ ফেবুকিং ব্যাস্ততায় কাটছে তার সময়,মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন।এর মধ্যে ছদ্ম নাম ও নকল ছবিওয়ালা আইডি সে বয়কট করে চলেন।তার বোধগম্য হয় না যদি সত্যি কথাই লিখি তবে কেনো এতো ভয়।ফেবুক তার ভাল লাগে কারন এখানে উঠে অন্যায়ের প্রতিবাদের ঝড় এবং নিত্য নতুন খবর পাওয়া যায় যা অনেক সময় অন লাইন সংবাদ পত্রের আগেই জানা যায়।খারাপ লাগে যখন একটি প্রতিষ্ঠিত অন লাইন পত্রিকায় মিথ্যে খবর প্রকাশ করেন।অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলেন আজম সাহেব।

আজম সাহেবের বিশাল বাড়ী তবে দুতলা বিশিষ্ট।ড্রইং রুমের ভিতরে সিড়ি দিয়ে দুতলায় যেতে হয়।ছেলে এক জন সবে মাত্র ক্লাশ নাইনে আর দুই মেয়ে যাদের এক জন মৌ কলেজ ফাষ্ট ইয়ারে আর এক জন সুমী ল কলেজে অনার্স পড়ছেন।তার এই দুই মেয়েও মা বাবার মতো ফেবুকার।মৌ ফেবুকে পরিচয় হয়ে এক ছেলের সাথে অদেখা প্রেম করে চলছেন দীর্ঘ দিন।মা কিছুটা টের পেলেও বাবা এর কিছুই জানেন না।
বাসায় ঢুকেই আজম সাহেব তার স্ত্রী ও ছোট মেয়ে মৌকে বাসায় ড্রইং রুমে পেয়ে বেশ অবাক হলেন,যাদের সময় নেই বাসায় সময় দেবার তারাই এ অবেলায় বাসায়।তবে মা মেয়ে এমন চুপ চাপ যে দুজন দুদিকে মুখ করে বসে আছেন যা আজম সাহেবকে ভাবায়।
-কি খবর তোমরা এ সময় বাসায়।
কেউ কোন কথা বলছেন না।আজম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার চোখে অস্পষ্ট জল।সে মেয়ের দিকে এগুলেন।
-কি মা মণি মন খারাপ।
আজম সাহেব মেয়ের পাশে বসতেই মেয়ে মুখ কালো করে উঠে চলে গেলেন দুতলায়।অবাক হলেও আজম সাহেব উঠে দাড়িয়ে কোট টাই খুলতে খুলতে তার ওয়াইফকে জিজ্ঞাসা করলেন।
-কি ব্যাপার বলোত!কিছু হয়েছে নাকি….মৌ এভাবে উঠে চলে গেল যে?
-কি আর হবে,,,মান সন্মান বুঝি সবিই গেলো।
আজম সাহেব তার ওয়াইফের পাশে চিন্তিত মনে বসলেন।
-মানে?খোলে বলো।
-আমি কিছু জানি না তুমি তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো?
-এটা কোন কথা হলো!মেয়ে তোমাকে যতটা সহজে যতটা ক্লিয়ার বলবে আমাকে কি সেই ভাবে বলবে?
-ঐ ফেবুকে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছে।দীর্ঘ দিন ধরেই.. গত পরশু ঐ ছেলেটার সাথে দেখা করতে গিয়ে ব্লাক মেইলের ধান্দায় পড়েছে।
-মানে!
-মানে আবার কি ছেলেটা এখন পাচ লাখ টাকা চাচ্ছে নতুবা…।
-নতুবা কি?
-নতুবা ছেলেটা বলছে তোমার মেয়ের কি যেনো কি ওর কাছে আছে তা মিডিয়ায় প্রকাশ করে দিবে।
আজম সাহেব বেচারা এতো কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে এতো দুর মানে সমাজের একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তিদের স্থানে এসেছেন আর তারই মেয়ে….না আজম সাহেব আর কিছু ভাবতে পারছেন না।ওয়াইফকে শাসাচ্ছেন।
-এই তোমার জন্য মেয়েটা আজ বিপদে দিকে গেছে।কত করে তোমাকে বললাম সংসারের দিকে খেয়াল দাও।ছেলে মেয়েরা কখন কি করছে তা লক্ষ্য রাখো।কৈ কে শুনে কার কথা।এবার হলোতো!তা এবার ফেবুকে স্ট্যাটাস দাও!নাকি এটাও ফেবুককে জানিয়ে দিয়েছো?
ক্ষোভ জিদে মন ভিষিয়ে উঠে।আজম তৎক্ষনাত তার রুমে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে চিন্তায় মগ্ন যে ভাবে হউক এ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে কিন্তু কি ভাবে?ঘরের কম্পিউটারটি ওপেন করে ফেবুকে কি যেন খোজতে থাকেন।এক সময় পেয়ে গেলেন।তার বাল্যকালের এক বন্ধুর খোজ পেলেন পেশা ঘাটতে গিয়ে দেখলেন অন্য থানার বড় দারোগা।দুহাত উচু করে ইউরেকা বলে আজম সাহেব চিৎকার করে উঠেন।তার রুমে ঢুকে তা দেখে একটু ভয়ার্ত মনে তার ওয়াইফ জিজ্ঞাসা করলেন।
-কি হলো তুমি হঠাৎ এমন করলে যে….।
-বসো….আজম সাহেব সেই পুলিশ অফিসারের সাথে চ্যাটিংয়ে গেলেন।ভাগ্য ভাল বন্ধুকে অনলাইনেই পেলেন।চ্যাটিংয়ে পরিচয় হয় উভয় খুশিতে আটখানা বহু দিন পর ক্লোজ বন্ধুর খোজ পেলেন।তার পর আজম সাহেব তার সমস্যার কথা বুঝিয়ে বলাতে বন্ধুর উত্তর আসে।
-টাকা আছে?
-অবশ্যই কত লাগবে?
-আরে সালা আমার জন্য নয় যেই ছেলেটা ব্লাক মেইল করেছে তাকে দিবো।
-কি বলিস তুই,টাকা দিয়ে দিলেতো আর তোর লাগবে না।
-তাই!যদি ছেলেটা টাকা নিয়েও ঐ ভিডিওটি না দেয় তখন কি করবি?
-তাইতো! আমার মাথা ঠিক নাইরে তুই যা ভাল মনে করিস কর।
-ঠিক আছে তবে আমিতো তোর থানার না প্রথমে তোর থানার যিনি আছেন তার সাথে কথা বলে আমি সব ব্যাবস্থা করছি।তুই কেবল ঐ ছেলেটা কবে কখন কোথায় টাকগুলো নিতে আসবে তা জানাবি বাকী কাজ আমি করব ওকে।আর একটি কথা ছেলেটি যেনো জানতে না পারে আমাদের এ প্লানের কথা।প্লানটা কি জানো?আমি তোর মেয়ের বাপ হয়ে টাকা দিতে যাবো,ঠিক আছে তবে এক্ষুণি আমাকে কনফার্ম করো ছেলেটি তোমাকে চিনে কি না
তার ওয়াইফকে ডাক দিতে বলল মৌকে।মৌ তৎক্ষণাত এলে জিজ্ঞাস করে জানতে পারলেন যে না’ ছেলেটি আজম সাহেবকে চিনেন না।কারন মেয়ের সাথে দীর্ঘদিন কেবল ফেবুকেই যোগাযোগ হয়েছিলো।অঘটন যা হয়েছে তা প্রথম সাক্ষাতেই হয়েছে।
-তাহলে ঐ কথাই রইল।
-ওকে…ধন্যবাদ দোস্ত…তুই বাচাইলি আমারে।
আজম সাহেব চ্যাটিং বন্ধ করে এক বার মেয়ের দিকে তাকালেন।মেয়ে মাথা নীচু করে আছেন।
-আয় এখানে বস্।
মেয়েকে ডাক দিয়ে তার পাশের চেয়ারটিতে বসতে বললেন, সে কাদো কাদো নয়নে বাবার সামনে বসলো। বাবা দাড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মেয়েকে শান্তনা দিয়ে নিজের চোখের দু’ফোটা জলও ফেললেন।এ সমাজে যাদের ঘরে মেয়ে আছে তাদের চোখে ঘুম নেই,নেই শান্তি চিত্তে;মনে হয় এ সমাজে মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই আজন্মের পাপ।
-ভাবিস না মা,সব ঠিক হয়ে যাবে।
তিন দিন পর
আজম সাহেব ছেলেটির নিকট থেকে এরই মধ্যে ঠায় ঠিকানা কালেক্ট করলেন তার মেয়ের মোবাইলে মেয়ের মাধ্যমে কথা বলে।ছেলেটির সাথে কথা হলো সাক্ষাৎ হবে কেবল টাকা’ আজম সাহেব এবং তার মেয়ে মৌ,এছাড়া অন্য কেউ যেন না জানে সে ব্যাপারে বেশ সতর্ক করে দিলেন ছেলেটি।বলা বাহুল্য এর মধ্যে আজম সাহেবের ব্যাবহৃত পুরো পরিবারে মোবাইলের লিংক সংযোগ ছিলো থানার টেলিকমিনিকেশনের সাথে।তাদের সব কথাই পুলিশ লিংক সংযোগে জানতে পারেন এবং প্লানিং মতো আজম সাহেবের বন্ধু পুলিশ অফিসার,সে মৌয়ের পিতা সেজা টাকার ব্যাগটি নিয়ে নিদিষ্ট স্থানে পৌছেন।পুলিশ অফিসার তার পরনের কোর্টের এক অংশে স্যাটেলাইট সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে যা দিয়ে থানার কন্ট্রোল রুমেও টিভিতে সহজেই ঘনটনার পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন এবং সেই সাথে যে কোন অপরাধী ধরতে কমান্ড প্রয়োগ করতে পারবেন অপারেসনস কর্মকর্তারা।পুলিশের বিশেষ অভিযানে বন্ধু পুলিশের তত্বাবধানে ছেলেটি এক সময় ধরা পড়লো।

মেয়েকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়ে আজম সাহেব বন্ধুর সাথে হাসতে হাসতে চলে গেলেন কোন এক আড্ডাস্থলের দিকে।চলার পথে পুলিশ বন্ধু আজম সাহেবকে আবারো বিচলিত করলেন।
-দোস্ত এবার না হয় তোমার মেয়ে বেচে গেলো কিন্তু তুমি বাচবে কি করে?
বিষ্ময়ে হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লেন আজম সাহেব।
-তার মানে?
-তুমি তোমার ফেবুকে রাষ্ট্র বিরোধী লেখা পোষ্ট করায় ৫৭ ধারায় তোমাকে গ্রেফতার করবেন তোমার থানার দারোগা।
-হা হা হা বন্ধু বোধ হয় জানো না আমি এখন তুখোর ফেবুকার।সব খবরই আমার জানা আছে বন্ধু।তোমরা ফেসে গেছো..হা হা হা এখন ৫৭ ধারায় কাউকে গ্রেফতার করতে হলে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের পূর্ব অনুমতি নিতে হবে হা হা হা বুঝলে।
-ঠিকই বলেছো বন্ধু,আমরা ফেসে গেছি ফেসে যাই;কখনো আইনের মারপ্যাচে কখনো বা রাজনৈতিক নেতাদের হুকুমে।
কথার সমুদ্রে ডুবে যায় বেলা নতুন আশায় নতুন ভাবে চলায় একটি নতুন ভোঁরের অপেক্ষায়।

কৃতজ্ঞ পাঠকদের নিকট

অসহায় জনতা

দেশ আটকে গেছে
যানবাহনের চাকার পিষে,
মানুষ না গরু ছাগল
মনবিকতায় টের পাবি কবে।

দেশ আটকে গেছে
যানবাহনের চাকার পিষে,
ভন্ড যত মাতাল তত অর্থ ধান্দায় রাজনিতী
আদালতের রায়কেও তারা দেখাচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গলী।

দেশ আটকে গেছে
যানবাহনের চাকার পিষে,
অন্ধ আমি নেতা খেতা,বোবা আমি ওমুক কর্তা
পুলিশী তান্ডবে রক্তে লাল কেবলি কিশোর যুদ্ধা।

দেশ আটকে গেছে
যানবাহনের চাকার পিষে;
রাষ্ট্র হাসে অট্ট্রো হাসিতে।

এইতো আমার সোনার বাংলা
আমি কাঙ্গাল মরি তোমায়,
ভাল বাসিতে বাসিতে।

বৈশাখী ঝড়

-হে লো….
-হ্যা, বলছি বলো কি হয়েছে?
-কালতো পয়েলা বৈশাখ ছেলে মেয়েরা বায়না ধরে এ বছর বৈশাখে ওদের ইলিশ মাছ লাগবেই।
-তা আমি কি করব?
-তুমি কি করবে মানে! অফিস ফেরার পথে বাজার থেকে দুটো বড় সাইজের ইলিশঁ নিয়ে আসবে। রাত পোহালে সকালেই তো বৈশাখের প্রথম দিন। আমি ওদের বৈশাখী জামা কাপড়ের ব্যাবস্থা করেছি তুমি ইলিশ মাছটা আনতে পারবা না?
শুনেছি ইলিশের দাম আকাশ ছোয়াঁ… এতো টাকাতো আমার কাছে হবে না।
আমি জানি না তা কি ভাবে আনবে মেনেজ করবে….ফোন রাখলাম।

বলেই শরীফ সাহেবের স্ত্রী ফোনটা কট করে কেটে দিলেন। বেচারা শরীফ সাহেবকে আর কোন কথা বলার সুযোগই দিলেন না। শরীফ তার অফিসের চেয়ারে বসেই মোবাইলটা হাতের দুআঙ্গুলে ঘুরাতে ঘুরাতে চিন্তা করছেন কি করবেন হঠাৎ প্যান্টের পকেটে হাত দিলেন। হাতের দু আঙ্গুলে পকেট থেকে বের হলো মাত্র পাচ’শ টাকার একটি নোট। টাকাই বা থাকবে কৈ থেকে। সৎ কামাইয়ে কত বা জমানো যায়। তাছাড়া এইতো কয়দিন আগে মায়ের অসুস্থতায় ব্যাংকে জমানো সব টাকাই চিকিৎসা খরচে শেষ। তাই সে এ মুহুর্তে খুব চিন্তিত। ইলিশ মাছ কিনতে কম করে হলেও দুটো মাছের দাম লাগবে দেড় দু’হাজার টাকা। এতো টাকা এই মুহুর্তে সে কোথায় পাবেন! তাছাড়া মেয়ের জন্য ফুলের মালাও কিনতে হবে। খুব দুঃচিন্তায় মন ভারি করে বসে আছেন। ঠিক সে সময় এক কাষ্টমার মানে এক কন্টেকদার এলেন তার ফাইলের খোঁজে।

-আসসালামুআলাইকুম স্যার, কেমন আছেন?
-জি আলহামদুলিল্লাহ ভাল, বসেন।
-তা স্যার, আমার ফাইলটার কি কাজ হয়েছে?
-কি নাম যেন?
-জি সোহান ট্রেডার্স।

ডেলিভারী রেজিষ্টারীটা দেখলেন অতপর বললেন।
-জি আপনার ফাইলতো দুদিন আগেই সামাদ সাহেবের টেবিলে দিয়ে দিয়েছি, আপনি নেননি?
-ও তাই! একটু ফোন দিলেই পারতেন ফোন নাম্বার তো দিয়েই গিয়েছিলাম।
-কেনো?
-না মানে,,,,যাকগে ফাইল যখন ওখানে দিয়ে দিয়েছেন তখন সামাদ সাহেবের টেবিলেই যাই, কি বলেন স্যার।
-হ্যা হ্যা অবশ্যই,

কন্টেকদার সামাদ সাহেবের টেবিলের দিকে যাচ্ছেন আর ভাবছেন এতো ভাল লোক অনেক বছর পর দেখলাম। সে যদি ফাইলটি ছাড়তে দশ হাজার টাকাও চাইত, তাই দিতাম যা এর আগের অফিসারকে দিয়েছিলাম। এখন দেখা যাক সামাদ সাব কি বলেন। সামাদ সাহেবের টেবিলটি তার তিনটি টেবিলের পর। শরীফ সাহেবের চোখ সে দিকে। সামাদ সাহেব আগত ফাইল গ্রহনের লোকটির সাথে চোখের ইশারায় আর টেবিলের তলায় লেনদেনের কাজটি সারলেন।

শরীফ সাহেব অফিসের কাজ মনের ক্ষোভে রেখে দিয়ে অফিস হতে বের হয়ে সোজা চলে এলেন শাহবাগে কিছু ফুলের মালা কিনতে। একটি মাত্র মেয়ে তার অফিসে আসার সময় বলে দিয়েছেন অফিস ফেরার পথে যেন তার জন্য যে কোন ফুলের মালা নিয়ে আসেন। তাই আগে মেয়ের কথা রাখতে শাহাবাগে। ফুলের দোকানে গিয়ে দুটো ফুলের মালা তিনশ টাকা দিয়ে কিনে চলে এলেন সোজা মাছ বাজারে ইলিশ দেখতে। কেননা পকেটে যে দুশত টাকা ব্যালেন্স আছে তা দিয়ে নিশ্চিৎ সে ইলিশের পোনাও কিনতে পারবেন না। কিন্তু শাহবাগে এতো ভীড় যে যাতায়াতের কোন বাহন দেখছেন না। শাহবাগে ভীড়টি ছিলো সরকারী চাকুরী ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের। এমন সব আন্দোলনে এক সময় ভার্সিটিতে শরীফ সাহেবের ভুমিকা ছিলো সম্মুখ কাতারে। এখন আর তার এ সবে মন যায় না তাছাড়া আগের ছাত্র আন্দোলন আর এখনকার ছাত্র আন্দোলনে অনেক তফাৎ। এখন এর ভিতরে সহজেই এ দেশের নোংরা রাজনীতির নোংরামি চলে আসে তাই সে একটু হেটে বাসে চড়ে চলে এলেন মাছ বাজারে।

আজকে মাছ বাজারে অনেক ভীর। বৈশাখ বলে কথা,বছরের একটা দিন ভোরে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ না হলে যে বাঙ্গালিয়ানা আর থাকে না। এমন সব আক্কেলহীন চিন্তা ধারার মানুষগুলোর ভীড়ই মাছ বাজারে বেশী। তাছাড়া কে কত বেশী দামের ইলিশ কিনছেন এমন উম্মাদ ধারনার লোক তো আছেই। এই সুযোগটাই কাজে লাগান মাইছ্ছারা। হুর হুর করে মাছের দাম বাড়িয়ে দেন। শরীফ সাহেব ফুলের ব্যাগটি হাতে নিয়ে মাছ বাজারে ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এক দোকানে ইলিশগুলো দেখে একটু দাঁড়ালেন। যেমন সাইজ তেমনি তার রূপালী রং যেনো পদ্মার ইলিশ। দোকানের সামনে অনেক ভীড়ের মাঝে কিছু ক্ষণ দাঁড়াতে মাছ বিক্রেতা জিজ্ঞাসা করছেন।

-স্যার কি ইলিশ কিনবেন?
-হ্যা, দেখি পছন্দ হয় কি না।
বলেই একটি তর তাজা মোটা সোটা বড় সাইজের ইলিশের পেটে আঙ্গুলে আলতু চাপ দিতেই ইলিশ মাছটি লাফিয়ে বলতে থাকে।
-ও স্যার কেনো খামাখা আমারে গোতান আমি জানি আপনের পকেটে হেই টাকা নেই যা দিয়ে আমারে কিনতে পারবেন,,,।
শরীফ সাহেব এবার ইলিশের কানশাটা ফাক করতেই ইলিশ চেচিয়ে উঠল।
-করেন কি স্যার করেন কি, আস্তে আস্তে আমিতো অপছন্দনীয় হয়ে যাবো…তাছাড়া আপনিতো কিনতে আহেন নাই দেখতে আইছেন।
এবার মাছ বিক্রেতা মাছটারে হাতের কব্জায় উলোট পালোট করে বলে উঠলেন ।
-কি টিপেন স্যার! এই রকম তর তাজা আর পাইবেন কৈ? কি দিমুনি….
-কত?
-এক দাম বার শ টাকা।
-কন কি এতো দাম কেন?
-একটু পরে এই দামে এইডাও পাইবেন না।কি চলবে?
-না না দেখি ঘুরে আসি।
বিক্রেতা রাগে মাছটারে এমন ভাবে তার খাচিতে রাখলেন যে মাছটি একটু ব্যাথার সূরেই শরীফ সাহেবকে বললেন।
-যান স্যার যান,,, ঐহানে আমার বাচ্চারা আছে, ঐহানে যান! অযথাই আমারে টিপে টিপে কাহিল করলেন আর মাইর খাওয়ালেন।

শরীফ সাহেব চিন্তা করে পকেটে হাত দিয়ে বের করলেন দুশত টাকা। আর ভাবলেন কি আর করা দেখি এই দুশত টাকায় ওখানে ইলিশের পোনা পাওয়া যায় কি না। শরীফ সাহেব অপেক্ষা কৃত ভীর কম একটি দোকানে গেলেন। সেখানে দেখলেন অল্প কিছু ইলিশের বাচ্চা মাছ সাজানো তাদের মাছের খাচিতে তাও আবার বিক্রেতা মানুষের ভীড়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখছেন হয়তো কোন পুলিশ টুলিশ আসে কি না। কারন ঝাটকা মাছ ধরা, বিক্রয় এবং ক্রয় আইনত অপরাধ। বিক্রেতার সাজানো ঝাটকা মাছগুলো এক বার তার খাচিতে সাজায় আবার লুকায় খাচির ভিতর। ঠিক সে সময় শরীফ সাহেব সেখানে গিয়ে দাম জিজ্ঞাসা করতেই বিক্রেতা একটি প্লাষ্টিকের ব্যাগে (অনেকটা শরীফ সাহেবের অনিচ্ছায়) দু তিনটি ঝাটকা মাছ ঢুকিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন এই নিন।
-না ভাই এতো ছোট ইলিশ!
-আরে ভাই দেনতো দু’শ দেন…..।
এরই মধ্যে হঠাৎ ঝাটকা মাছের মতন ঝটিকা অভিযানে পুলিশ আসে। বিক্রেতা সব কিছু রেখেই দৌড়ে পালালেন পিছনের পথ দিয়ে। ঝাটকা মাছের ব্যাগটি সহ শরীফ সাহেবকে পুলিশ গ্রেফতার করলেন। শরীফ সাহেব অবাক!
-কি ব্যাপারে আমাকে ধরছেন কেনো?
-কেনো আপনি জানেন না অপরাধ করা আর প্রশ্রয় দেয়ার মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
-তাই বলে!
-কিছুই করার নেই, যা বলার থানায় গিয়ে বলবেন।
পুলিশের অভিযানে মুহুর্তের মধ্যে ইলিশ বিক্রেতারা মার্কেট শুণ্য হয়ে গেল। লোকজনও কমতে থাকে। পুলিশের দল অনেকগুলো ইলিশ মাছের খাচি তাদের পুলিশ ভ্যানে তুললেন সেই সাথে শরীফ সাহেব ও দুজন মাছ ব্যাবসায়ীকেও।

শরীফ সাহেবকে থানার এক কোনায় টেবিলে বসিয়ে রাখলেন আর ঐ দুজনকে লকাপে ঢুকালেন। সন্ধ্যার আভাস কাটিয়ে রাতের গভীরতা বাড়তে থাকে। থানার বড় কর্তা বাহিরে তাই তাকে টেবিলেই বসিয়ে রাখলেন। এক পুলিশ এসে তাকে কানে কানে বললেন।
-ভাইজান আপনি ঐযে ছোট স্যার আসছেন তাকে কয়েক হাজার টাকা গোপনে হাতে গুজে দিয়েন কাম হইয়া যাইবো।

সে আশ্চর্য হলেন নিজে ঘুষ খান না অপরকে ঘুষ দিবেন তা কি করে হয়। পকেটে হাত দিয়ে ভাবলেন টাকাওতো নেই।অফিসার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন।
-কি ব্যাপার কত দিন যাবৎ এ ব্যাবসা করেন?
-কি যে বলেন না আমি এ ব্যাবসা করবো কেনো?
-তাহলে ওরা যে বলল আপনার ইলিশ মাছের আড়ত আছে?
-মিথ্যে বলেছে!
-তা আপনি কি করেন?
-চাকুরী করি
-সরকারী?
-হুম!
-তাহলে তো আপনি অনেক মালদার পার্টি।
-না ভাই আমি গরীব মানুষ বেতন যা পাই তাই দিয়েই চলি।
-হা হা হা ঘুষখোররা কি বলে আমি ঘুষ খাই! যত সব….দু একটা কিল ঘুষি দিলেই সত্য বেরিয়ে আসবে।

শরীফ সাহেবের চোখের জল টল টল করছে। কি বলে লোকটা ঘুষ না খেয়েও খুষখোর আমিই! অপরাধ না করেও অপরাধী আমি! এ সময়ে পুলিশের বড় কর্তা অফিসে ঢুকেন। অফিসের অন্য পুলিশরা তাকে স্যালুট করতে থাকেন। সে শরীফ সাহেবকে এখানে এ ভাবে জলে ভেজা নয়নে দেখে অবাক। চতুর সে থমকে দাড়িয়ে শরীফ সাহেবের কাধে হাত রেখে তার রুমে নিয়ে গেলেন।
-আরে শরীফ সাহেব যে কোন ফোন না করেই চলে এলেন ….চলুন আমার রুমে চলুন। ভিতরে ঢুকে বড় কর্তা তার চেয়ারে বসলেন এবং শরীফ সাহেবকে তার সামনে থাকা চেয়ারে বসতে বললেন। সে বসলেন না দাঁড়িয়েই রইলেন ততক্ষণে শরীফ সাহেবের মনে অপমানিত ক্ষোভের জল চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। বড় কর্তা কিছুই বুঝতে পারছেন না, সে উঠে গিয়ে তার সামনে গেলেন এবং হাত ধরে চেয়ারে বসালেন।
-বসুন, কি হয়েছে বলুনতো? এখানে কেন?
সে নিজে কিছু বলছেন না দেখে বড় কর্তা অফিসের সে ছোট সাহেবকে ডাকলেন। ছোট সাহেব বড় কর্তার রুমে ঢুকে শরীফ সাহেবের পা ধরে কান্না কাটি শুরু করে দিলেন।
-স্যার,আমারে মাফ কইরা দেন। আমি ভুল করেছি বুঝতে পারি নাই।
তার এমন অনুনয় বিনয় দেখে বড় কর্তা ধমক দিলেন।
-এই এদিকে আসো।
সে বড় কর্তার কাছে গিয়ে মাথা নীচু করে অপরাধী মুখে দাঁড়ালেন।
-বলতো কি হয়েছে?
সে সমস্ত ঘটনার সত্য বিবরণ দিলেন। ঘটনা শুনে বড় কর্তা তখনকার ডিউটি অফিসারকে ডাকলেন। সে রুমে ঢুকে স্যারকে স্যালুট দিলেন।
-শরীফ সাহেবকে থানায় এনেছো কেন? তাকে চিনো? সে কে? এই যে এই নোংরা সমাজটা দেখছো এই নোংরা সমাজের অনেক নোংরামীর ভীরে সে সচিবালয়ের একজন সৎ নিষ্টাবান কর্মঠ অফিসার। সরকার তাকে তার কাজে সততা আর নিষ্ঠাবানের জন্য বেশ কয়েক বার পুরষ্কৃত করেছেন। তার মতো সৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ অফিসার যদি বাংলার ঘরে ঘরে থাকতো তবে এ দেশ এতো দিনে মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গ বন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হয়ে যেত।
এবার শরীফ সাহেবকে লক্ষ্য করে ক্ষমা চাইলেন বড় কর্তা।
-স্যার আপনি ওদের ক্ষমা করে দেন। ওরা আপনাকে চিনতে পারেনি।

শরীফ সাহেব বসা থেকে উঠে দাড়ালেন এবং তাদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু বলার চেষ্টা করলেন।
-দেখুন,আমি কে কি আমার পরিচয় সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো, আমি একজন কেবলি মানুষ যেমন আপনি আপনারা সবাই। আমাদের জীবনে জীবনকে চালাতে গিয়ে অনেক কাল বৈশাখী ঝড়ের মুখো মুখি হতে হয় তখন কেউ খুটির জোরে টিকে থাকেন কেউ বা হারিয়ে যায় অন্ধকার জগতে। সবার জীবনেই ভাল মন্দ দুটো দিকই থাকে কেউ মন্দটা গ্রহন করে হাজারো কোটি টাকার মালিক বণে যায় কিন্তু জীবনের প্রকৃত স্বাধ কি জিনিস তারা হারিয়ে ফেলে আবার কেউ বা ভালোর দিকটা গ্রহন করে ছিদ্রোযুক্ত চালের কূড়ের ঘরেই সুখ খোজে পায়। কিন্তু এ দুটো দিকের শেষ ফলা ফল শুণ্য কারন যার জন্ম আছে তার ধ্বংস আছে তাই মৃত্যুই এক মাত্র চির সত্য এটা ভেবেই সবাইকে কাজ করতে হবে যেনো শত কাল বৈশাখী ঝড়েও তাল গাছটির মতন আমি আমার সততায় স্থির দাড়িয়ে থাকতে পারি। কারন আমার সৎ কর্মই আমাকে বাচিয়ে রাখবে পৃথিবীর মানুষ মনে রাখবে আমায় আজীবন।

আর একটি কথা আপনাদের যে চাকুরী তা খুব ভাগ্যবানরাই পায় কারন সেবক সবাই হতে পারে না। তাই যখন যে কাজটি করবেন ভেবে চিন্তে যাচাই বাছাইয়ের পর করবেন। আমিতো জানি ঝাটকা মাছ ধরা নিষেধ তাছাড়া বিক্রেতা এক প্রকার জোর করেই ব্যাগটি হাতে ধরিয়ে দিল ঠিক সে সময়ই আপনেরা এলেন। যাক যা হবার তা হয়েছে আমি কিছু মনে করছি না তবে আমাকে আমার ফুলের ব্যাগ আর মানি ব্যাগটি ফেরত দিলেই চলবে।
এরই মধ্যে তড়িগড়ি করে এক কনেস্ট্যাবল তার জিনিস পত্রগুলো তাকে বুঝিয়ে দিলেন। বড় কর্তা আবারো তাকে সরি বললেন।

-সরি ভাই যা কিছু হয়েছে সব কিছুর জন্য দুঃখিত আর যদি কিছু মনে না করেন আগামীকাল তো পহেলা বৈশাখ তাই আপনার জন্য ওরা যে ইলিশগুলোর আটক করেছে সেখান থেকে কয়েকটি ইলিশ মাছ যদি দিয়ে দেই, আপনি নেবেন?
-না, আপনিতো জানেন আমি কেমন।
-আচ্ছা ঠিক আছে তবে শেষ এবং একটা অনুরোধ রাখবেন? আমাদের ভুলের কিছুটা মাসুল দিয়ে নিজেকে একটু হালকা করতে চাই।
-কি?
-রাত অনেক এখন আপনাকে আমার গাড়ি দিয়ে আপনার বাসায় আমি নিজে পৌছে দিতে চাই। অন্তত এই অনুরোধ টুকু রাখেন।
-ঠিক আছে।

সমাপ্ত।