মৌসুমী মণ্ডল দেবনাথ এর সকল পোস্ট

সুইট সিক্সটিন

সুইট সিক্সটিন

কিছু কিছু সত্যি গল্প বহু বছরের জন্যে মনে গেঁথে বসে থাকে। যেমন ক্ষিধে কোনো দিনও শেষ হয়না। আকাশ কোনও দিন মেঘশূন্য হয়না। পাখিরা খড়কুটো ঠোঁটে গাছে বাসা বাঁধবেই।

একটা গ্রাম গ্রাম শহরের পাশে স্বচ্ছতোয়া ছোট নদীটি। এই নদীর নীল জলের তলায় বাস রূপোর ঝিনুকদের। শিশু ঝিনুকরা মুখ হাঁ করে থাকে। মা ঝিনুক এক ফোঁঁটা সোনালী খাবার মুখে পুরে দেয়। নিঃশব্দে কথা বলে। এই সুযোগে দু ‘তিন কণা বালি সেঁধিয়ে যায় মা ঝিনুুুুকের শরীরে। যন্ত্রণার অশ্রু সিক্ত হলো।

একটা সুডৌল মুক্তো রেস্তোরাঁয় বসে থাকা দু ‘টো মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ের গলায় দুলছে। যে দু ‘টো মেয়ে চৌকো টেবিল ঘিরে আরাম করে বসেছে, ওরা হাইস্কুল ফেরত মেয়ে। ক্রিস্টিন আর মারিয়া। সুইট সিক্সটিন। টুংটাং শব্দ হচ্ছে হাতের তালুতে রাখা মোবাইলে। হয়তো কারোর সাথে চ্যাটে আছে। এরা দু ‘বছর পরে সাবালিকা হলে মা, বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকবে।

বাইরের আকাশটাতে ছলোছলো মেঘ জমে আছে। এপ্রিল মাস। চোখের পাতা ভিজিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হলো। বসন্ত এখানে থমকে আছে ড্যাফোডিল ফুলের রঙে, ঘাসবনে। একটা ধূসর নির্জন শহরে যেন ভ্যান গঘ্ ছড়িয়ে দিয়েছে কিছুু হলুদ আলো। বিকেলের আলতো রোদেরাও ফুুঁ দিয়ে ছড়িয়ে দিলো কিছু আধো লালচে মেঘ টিউলিপ ক্ষেতে।

দু “টো মেয়ে গল্পে মাতোয়ারা।

কেউ ভেড়ার মাংস কব্জি ডুবিয়ে খাবে।
বিয়ারের গ্লাসে ভাসমান লেবুর টুকরোয় গোলাপী জিহ্বা স্পর্শ করবে। তেতো স্বাদ নেবে। গল্প করবে লেটেস্ট পোশাকের ব্র্যান্ড নিয়ে। শেষ দেখা মুভির ক্লাইমেক্স ও মৃদু সৌখিন তর্কাতর্কি। ঝিরিঝিরি আলোর ঝালরে সেন্টেট অরিগামি। পরিজের সুগন্ধ ব্লেন্ডেড ফ্লোরের হাল্কা গানের সাথে।

রেস্তোরাঁর বাইরে একটা বড় ডাস্টবিন রাখা আছে। তার গা ঘেঁষে কিছু নরম সিম্ফনির লাল হয়ে থাকা। বসন্ত এখানেও। রেস্তোরাঁর লাগোয়া রাস্তাটার সাইডে ম্যাপেল গাছেদের ছায়ায় যে ছোট্ট সাদা বাড়িটা, সেই বাড়ির একটা ঘরে বসে হেমন্তের কবি। প্রিয় কবি মার্গারেট অ্যাটউড্ “টু হেডেড” কবিতা লিখছেন। লিখছেন ক্ষিধের কথা। বড় বড় ধনী দেশগুলোতে রোজ বাড়তি খাবারগুলো বাইরের ডাস্টবিনে জমা হয়। রাতের শেষ বাস বা টিউব চলে যাওয়ার পরে ওখানে একটা কাড়াকাড়ি চলে কিছু সর্বহারা মানুষের। কে আগে নিতে পারবে মোৎজারেলা চিজের অপেক্ষাকৃত তাজা বার্গারটি।

ক্ষিধে এখানে বিশ্রী ভাবে থাবা বসায়। ডাস্টবিনকে ভরসা করে জীবন কেটে যায় অনেক মানুষের। সেইসব বড় দেশের অনেক মানুষের রবিবার গীর্জায় সেকেন্ড হ্যান্ড জামা, সোয়েটারও মিলে যায়। প্রার্থনা শেষে ওরা জায়েন্ট ম্যাপেলের ঝরে যাওয়া ফ্যাকাশে কমলা, লাল পাতাগুলো মাড়িয়ে ধীরে ধীরে তাদের আস্তানায় চলে যায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো সেইসব ছোট শহরের তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলোর জন্যে। এরা কখনও উঁচু উঁচু বাড়ীর মাথায় পরী দেখেনি। শিমূল, পলাশের ধু ধু প্রান্তরের প্রখর রোদে এইসব মানুষের ক্লান্ত পা টেনে টেনে হেঁটে যায়। এদের ঘরে দিনের পর দিন হাঁড়ি শুকোয়। বছর ষোলোর মেয়েটা, ছেলেটা সকাল থেকে গভীর রাত অবধি খেটে খেটে অকালবৃৃৃদ্ধ হয়ে যায়। (সুইট সিক্সটিন এখানেও)! ওরা গান গায়না। কোনও দিন রবিন হুডের নামও শোনেনি। এদের খোঁঁজ কেউ দেবে?

ঝরো পূর্ণতায়

ঝরো পূর্ণতায়

না হয় চুপটি করো। থাকবো রাতের পাশটিতেই
কতোটা মেঘ জমলে পরে, কান্না ঝরে বৈশাখেই

এখন যেমন গাইছে পাখি, ব্যালকনিতে সূর্যোদয়
বৃষ্টি তোমায় ছন্দ দেবো, ঝরবে ঝরো পূর্ণতায়

যেমন ক’রে পাহাড় ফুরোয়, ধূসর বাসর নীলঘন
কালচে মৃত্যু ছড়িয়ে বনে, সবুুুজে প্রাণ নিমগ্ন

বরফদেশের সুরগুলো সব, মুখর হলো উষ্ণতায়
আলতো করে মন মেশাবো, ম্যাপেল বনের উচ্চতায়

চলছে নদী ধমনীতে, সামনে জোয়ার সাবধানে
হৃদয় খুলে দিলাম দ্যাখো, মধ্যবেলার যৌবনে

এই অবেলায় ফুরোলো দিন, আকাশ হলো মেঘাতুর
অন্তরাতে বাঁধছি জীবন, ডানায় মিলায় রোদ্দুর

প্রাণহীন

প্রাণহীন

একদল হরিণ রোজ সীমান্ত পেরিয়ে
ঘাসের খোঁজে আসে
-জীবন
শীতের রোদ মেখে আগুন হয়ে যায় গুপ্ত চাঁঁদ
শস্য ক্ষেতের তীর ছুঁয়ে মৌন মিছিল হাঁটে
-বিদ্রোহ
পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে চা বাগান
আমলকী বনের নিরুত্তাপ ঝরনার ছায়ারা
—সবুজ
একদল শরণার্থী কোলে শিশু কাঁটাতার পেরোয়
ভীরু পায়ে পায়ে ক্ষিধে আঁকা শূন্য শরীরে
—আকাশ
যাওয়ার কথা ছিলো নদীর ঢেউয়ের কাছে
যেখানে ঢেউয়ের মাথায় নাচে মেরুন প্রজাপতি
-বেদনা
কে যেন শীতের শেষ রোদে লুকিয়েছে রেশম চাদর
বইয়ের ভাঁজে রয়েছে গত বসন্তের পলাশের বন
—নিঃসঙ্গ
পৃথিবীর ডানায় বাসা বেঁধেছে লাবণ্য অমিত

সমুদ্রেরা বারবার পাল্টেছে বৃৃষ্টির নীল পোশাক
—নিরুদ্দেশ ‘

একদিন

একদিন

আর কতো বড়ো আয়না হলে নিজেকে দেখতে পাবে তুমি?
ক্যামেরায় তোলা মানুষের ছবিগুলো সাদা কালো, সাদা কালো।
শুধু কৃষ্ণচূড়ারা লাল হয়ে আছে।
কিছু বোকা মানুষ যারা খরগোশকে কোনওদিন ভালোবাসেনি, তারা কৃষ্ণচূড়ার লালকে আলাদা করতে চাইছে।
মে ‘মাসের একটা সারাদিন ধরে রাজপথে
ঝরছে লাল টুপটাপ টুপটাপ।
খরগোশটা চে ‘গুয়েভারার হলুদ ডায়েরিটা
খুঁজে পেলো একটা অক্টোবরগামী মেহগনি গাছের কোটরে। সেখানে পাখিরা ডাক্তার। তারা মানুষদের হৃদয় থেকে পেসমেকার খুলে কিছু গান ভরে দেয়। সারাটা জীবন ধরে চে ‘ শুধু স্ফুলিঙ্গ খুঁজে গেলো। অথচ চারপাাশটা ছিলো ভীষণ অন্ধকার। ভেজা ভেজা। একদিন জুন মাসে সেই পাহাড় চরা মেয়েরা আসবে। পৃথিবীর যাবতীয় বিষণ্ণতার মূহুর্তকে সমুদ্রে বিসর্জন দিয়ে ওরা সেই সোনালী পুরুষকে খুঁজে পাবে। একদিন প্রত্যুত্তরে ভালোবাসার নীল চিঠিই আসবে।

নিভে যাওয়া কথা

নিভে যাওয়া কথা

এই যে বসেছ পাশে ল্যাপটপে ছবি হয়ে
জানালার পাড়ে ধূপছায়া শাড়িতে দুলছে
চৈত্রের আনমনা বিষণ্ণ দুপুর,
একটা ডাহুক ডাকছে কখন থেকে
যেন একটানা অসহ্য বিবশ মাইগ্রেন,
বিছানায় এলো হয়ে পড়ে আছে কার রৌদ্রশরীর,
একটা, দু ‘টো আলতা পরা বেহাগ কথা
ছিটিয়ে দিচ্ছো খইয়ের মতো যন্ত্র স্ক্রিনে
যেমন করে মৃত্যু নামে হলুদবনে,
কথা ছিলো একসাথে সাঁতরে পার হবো
চূর্ণী নদীর জোয়ার মাছের পাখায়
কথা ছিলো নির্ঝর বৃষ্টিতে ভিজবে
মধুবিন্নী ধানের ক্ষেত,
আমের পল্লব,
এখন শুধু নিস্তব্ধ এক মলিন প্রহর এপার ওপার
স্নায়ুর অসুখে ডুবে আছে বাথটাব স্নান
সাবানে ঠোঁট রেখে মুছে নেয়া দিন
মাঝখানে পড়ে শুধু
নিখোঁজ ভুলভুলাইয়া

রোমন্থন

রোমন্থন

সাগর যতোই নীলাম্বরী, জাহাজ কিন্তু কম্পাসের
সন্ধ্যে জ্বলে হ্যালোজিনে, তারিফ থাকে জোছনার

ঝাউবনেরা উড়ছে হাওয়ায়, সমুদ্র স্নান দম্পতির
একটি ঝিনুক ঠেকলো তীরে, ঝড়ের পাশেই অভিসার

ঝরা পাতার শব্দ জমে, ডায়েরিতে আজ অমনিবাস
ঝাপসা বয়স একলা ঘরে, জানলার আজ মনখারাপ

আমি ও তুমি

আমি ও তুমি

বরং তুমি এসো বৃৃষ্টি বিকেল, গান সাজিয়ে মল্লারে
অঙ্গে আমার ঢাকাই শাড়ি, তুুমিও মেঘের বন্দরে
এক পশলা কথার পরেও, জমলো কিছু অভিমান
লেবুফুলও হঠাৎ উদাস, বেহাগ সেতার তরল তান
আগুনরঙা গোধুলিতে, পলাশ ফুুুল আর জৌনপুরী
ভুট্টা কিছু উনুন সেঁকে, বিভাস রাগের ফুলঝুড়ি

ভিজছে পাখি উতল হাওয়ায়, ভিজলো পিলু কোন সুখে
তুমি তখন ব্যক্তিগত, আমিও বিজন কোন দুখে
থামলো বাতাস উদাস আকাশ, রইলো কথা নিঃশ্বাসে
বাজলো বীনা বাজলো সানাই, বিসমিল্লা আর বিশ্বাসে
আবার গাইলো পাখি মধুমন্তী, আনন্দ গান হিন্দোলে
ইচ্ছে টোরির গানের আসর, সন্তুরে আর ফুলদলে

শহর তুমি কার

শহর তুমি কার

সমুদ্রের জলে কান্নার কোনও যতি নেই
ইচ্ছে নীলের গভীরে মৃত্যুহীন জেলিফিশের বাস
সমুদ্র তার নিগূঢ় বিষাদ প্রহরের
দুঃখ গুছিয়ে রাখতে জানেনা
আবদার রাখে কলম্বাসের দূরবীনে
দূর পাহাড়ের পাদদেশে চুম্বন গচ্ছিত রাখে,
শুধু নিষ্পাপ শিশুরা যখন তার
জলের শরীর ছোঁয়, তার মা হতে ইচ্ছে হয়
স্নান শেষে সেইসব এলাচ গন্ধমাখা শিশুদের
চন্দনবনের ঠিকানা বলে দেয়,
একদিন নাবিকেরা ঘরে ফেরে
আয়নায় দেখে লুকিয়ে রাখা
মোহ্র ফুলের জোছনা
জাফরি কাটা ঘরে আলোর ফুলকারি
অভিমানে দক্ষিণে তাকায়
এ শহর ডাকেনি তাকে
ঘরে ফেরার উৎসবে
তবু ভেজা বকুলে এখনোও
লেগে আছে তার সাক্ষর

অরণ্য পরিবার

অরণ্য পরিবার

এমনই তোমার মেঘে ঢাকা রীতি। যেন কোনও দিন দেখোনি বজ্রপাত
দুপুরের ছাদে উড়ছে পোস্টকার্ড চিঠি। যেন নীল প্রজাপতি ও জলপ্রপাত

একদিন বাতিল কৃষ্ণচূড়ার ফুল। যেন প্রমাণ লোপাট হলো বেঁচে থাকার
ডোরাকাটা রাস্তায় ছেঁড়াপাতা পড়ে। যেন মৃত্যু নিষাদ মেঘ ব্রাত্য কবিতার

তারপর জাগে ছিন্ন ক্যাপাচিনো কফি। যেন দু ‘চামচ বৃষ্টিচিনির প্রিয় অধিকার
আজ বিছানায় থাক জোছনার কথা। যেন ঘুমের বালিশে আঁকা অরণ্য পরিবার